পেলে

পেলে

পেলের সঙ্গে কবে প্রথম দেখা হয়েছিল ঋষির, একদম মনে পড়ছে না। সেই দুপুর থেকে মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু বারবার পথ হারিয়ে ফেলছে ওর স্মৃতি। কলকাতার ছেলেমেয়েরা বন্ধুত্বের প্রথমদিনটা রিমাইন্ডার নোটবুকে অ্যাড করে রাখে। কারণে-অকারণে পয়লা দিনটা তারা সেলিব্রেট করে। পিৎজা পার্লার বা কোনও রেস্ট্রোতে গিয়ে। এই মফস্বল শহরে এসবের রেওয়াজ নেই। তাই বলে দিনটা মনে থাকবে না!

আজ পেলেকে ভীষণ দরকার ঋষির। বারো ইঞ্চি ক্রিস্টাল ট্রফিটা বুকে জড়ানোর পর সামনের অডিটোরিয়ামটা মুছে গেল চোখের সামনে থেকে। হুড়মুড়িয়ে ভেসে উঠল পেলের আবছা মুখ। ও না থাকলে এই দিনটা দেখা হত না ঋষির! স্বপ্ন জড়ানো এই মুহূর্তগুলো খুব দুর্লভ হয়। সুখ আর তৃপ্তি রোমকুপ দিয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে তার। আনন্দ হচ্ছে। চোখে জল আসছে। এই দিনটাই দেখতে চেয়েছিল সে। যার জন্য এখন এই আলো ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঋষি, তার কথা ভিড় করে আসছে মনে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটা নিতে নিতে বিড়বিড় করে সে বলল, ‘তোর জন্যই সব হল! থ্যাঙ্ক ইউ পেলে!’

এক পরম ভালোবাসা অবরুদ্ধ করে তুলছে ঋষিকে। গলা আঁকড়ে ধরছে কৃতজ্ঞতা। অডিটোরিয়াম জুড়ে হাততালির ঝড়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। ঋষি খুব ভালো করে জানে, পেলেকে এখানে দেখতে পাবে না। তবু ইলশেগুড়ি বৃষ্টিতে ভেজা ওর দুটো চোখ তন্নতন্ন খুঁজছে পেলেকেই!

আশপাশের লোকজন এখনও অদ্ভুত চোখে দেখছে ঋষিকে। ভারী অস্বস্তি হচ্ছে ওর। সমবয়সীরা তো বটেই, এমনকি তাদের অভিভাবকরাও অবাক হয়ে গিয়েছে ঋষির খেলা দেখে। ছয় রাউন্ডের টুর্নামেন্টে একটাও গেম হারেনি। সবচেয়ে বড় কথা, কোনও গেমের আয়ু কুড়ি-তিরিশ মিনিটের বেশি ছিল না। যেন র‍্যাপিড চেস খেলছিল! গেমের শুরুতে ওর প্লেয়িং স্টাইল দেখে বোঝা যায়নি, অ্যাটাকিং না ডিফেন্সিভ, কোন মোডে খেলবে! এই দ্বিধাটাই বিভ্রান্ত করে ফেলেছে প্রতিপক্ষদের।

ফাইনাল ডে-তে বিশেষ অতিথি হয়ে এসেছেন নর্মদা চক্রবর্তী। উনি বাংলার প্রথম ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার। একসময় দেশজোড়া নাম ছিল। এখন সল্টলেকে একটা অ্যাকাডেমি চালান। তিনিও কিছুক্ষণ দেখেছেন ঋষির ফাইনাল রাউন্ডের গেম। টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর যখন নিজের ব্যাগপত্র গোছাচ্ছিল, এমন সময় কানে এল অ্যানাউন্সমেন্ট, ঋষি রায়, তুমি যেখানেই থাকো, অডিটোরিয়ামে চলে এসো। নর্মদা ম্যাডাম তোমাকে খুঁজছেন!

ঋষি অবাক হল। নর্মদা ম্যাডাম খুঁজছেন কেন ওকে? কোনও ভুল করেছে নাকি? দ্রুত ব্যাগপত্র তুলে ভয়ে ভয়ে নর্মদা চক্রবর্তীর সামনে গিয়ে ঋষি বলল, ‘আমাকে খুঁজছিলেন ম্যাডাম?’

যেন ঘোরের মধ্যে রয়েছেন নর্মদা! চোখেমুখে অপারবিস্ময়। তাকে আপাদমস্তক দেখে বললেন, ‘মিশার স্টাইল তুমি শিখলে কী করে?’

মিশা নামটা প্রথমবার শুনল ঋষি। তাকে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি ফের বলে উঠলেন, ‘মিখাইল তাল, রাশিয়ান দাবাড়ু। ওঁকে ম্যাজিশিয়ান বলা হত। নাম শোনোনি?’

ঋষি মাথা নীচু করে নিল। কোনওরকমে মাথাটা ডানদিক-বাঁদিকে নাড়াল। দাবা খেলাটা মনপ্রাণ ঢেলে ভালোবাসে সে। বিশ্বনাথন আনন্দ আইডল তার।

নর্মদাম্যাম এক নিঃশ্বাসে বললেন, ‘দশ-বারো চালের আগে তোমার খেলা ধরতে পারছে না অপন্যান্ট। মিশার মিস্ট্রিয়াস স্ট্র্যাটেজি এইরকম ছিল! তুমি শিখলে কী করে?’

বর্ধমান সিএমএস হাইস্কুলে ক্লাস সিক্সে পড়ে ঋষি। মিশা বা মিখাইল তাল কোন রহস্যময় স্ট্র্যাটেজিতে খেলত, সে জানবে কী করে? স্কুলে একটু আধটু কম্পিউটারে দাবা খেলে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তাকে কেউ দাবা শেখায়নি শুনে আরও অবাক হলেন নর্মদা। ব্যাগ খুলে ঋষির হাতে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললেন, ‘তোমার বাবা-মাকে বলো, আমাকে ফোন করতে।’

দাবা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, নর্মদা চক্রবর্তীর ‘বাবা-মাকে ফোন করতে বলো’, সবটাই চেপে গেল ঋষি। সে খুব ভালো করে জানে, তার দাবা টুর্নামেন্ট খেলার কথা শুনলেই প্রচণ্ড রেগে যাবেন বাবা ও মা। হয়তো মারও জুটতে পারে।

আলমগঞ্জকে বর্ধমান শহরের ম্যাঞ্চেস্টার বলা হয়। রাইসমিল, চিড়েমিল, লেদ কারখানায় ভর্তি। সেখানকার একটা রাইসমিলের ম্যানেজার ঋষির বাবা সম্বুদ্ধ রায়। নানা কোয়ালিটির স্পেশাল মিনেকিট, দুধেরসর, চামড়মণি, গোপালমণি, বাঁশকাটির মতো চাল মিলে তৈরির পর বিদেশে রপ্তানি হয়। কিন্তু সম্বুদ্ধদের মতো কর্মচারিদের বিশেষ লাভ হয় না। হাড়ভাঙা খাটনির পর জোটে সামান্য মাইনে। টানাটানির সংসারে স্বপ্নগুলো বিলাসিতা মনে হয়। ঋষির দাবাড়ু হওয়ার ইচ্ছে তাই প্রশয় দিতে পারেন না সম্বুদ্ধ। চান, ছেলে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হোক। অন্তত তাঁদের মতো অভাবে যেন জীবনটা না কাটে।

বাবাকে ছেলেবেলা থেকে রাগিই মনে হয়েছে ঋষির। একটু বড় হওয়ার পর থেকে ‘পড়তে বসো’, ‘অঙ্কের খাতাটা নিয়ে এসো’, ‘ক্লাস টেস্টের রিপোর্ট দেখি’, ছাড়া বাবার মুখে আর কিছু শোনেনি সে। তার মা সুরঞ্জনাও তাই চান। বইয়ের জঙ্গলে ডুবে থাকতে থাকতে ঋষি হাঁপিয়ে ওঠে। কষ্ট হয়।

বাবা-মা জানলে রাগ করবে বলে লুকিয়ে অল বেঙ্গল ওপেন চেস টুর্নামেন্টে নাম দিয়েছিল ঋষি। তিনদিন স্কুলবাঙ্ক করেছে এর জন্য। বাবা যদি জানতে পারলে আস্ত রাখবেন না! বাড়িতে ঢুকে সোজা নিজের বেডরুমে চলে গেল সে। স্কুল ব্যাগের ভিতর ক্রিস্টাল ট্রফিটা মাথা উঁচু করে রয়েছে। ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ট্রফিটা বের করল ব্যাগ থেকে। ট্রফিটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল ঋষির। এটাকে লুকিয়ে রাখতে হবে কোথাও!

বাথরুম বেরিয়েই চমকে গেল ঋষি। রিডিং টেবলের সামনে কাঠের চেয়ারে বসে রয়েছেন সুরঞ্জনা। তাঁর হাতে ঋষির প্রথম জেতা ক্রিস্টাল ট্রফিটা! সুরঞ্জনা পরম মমতায় হাত বোলাচ্ছেন ট্রফিটায়। যেন ঋষিকেই আদর করছেন। মায়ের ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে সম্বুদ্ধ! বাবাকে কখনও বিকেলে বাড়িতে দেখে না ঋষি। রাইসমিল থেকে বেরোতে বেরোতে রাত আটটা বেজে যায়। আজ অফিস যাননি নাকি? আশঙ্কায় পা ভারী হয়ে এল ঋষির। সে তাকিয়ে দেখল, বাবা মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন, টুর্নামেন্টে ফার্স্ট হওয়ার জন্য পাওয়া সার্টিফিকেটটা!

তাহলে সব জেনে গিয়েছে ওঁরা? তিনদিন স্কুল না যাওয়া, দাবা টুর্নামেন্ট খেলা— সব! ভয়ে হাতের তালু ঘেমে গেল ঋষির। খুব জল তেষ্টা পাচ্ছে! প্রচণ্ড টেনশনে প্রায় কেঁদে ফেলল ঋষি। ঢোঁক গিলে কোনওরকমে বলল, ‘আর কোনওদিন খেলব না, কথা দিচ্ছি!’

ঋষির কথা শুনে অদ্ভুতভাবে হাসলেন সম্বুদ্ধ। বাবা এগিয়ে আসছে তার দিকে, এক পা-এক পা করে। ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিল সে। তখনই মায়ের শরীরের চেনা মিষ্টি গন্ধটা ঝাপটা মারল ঋষির নাকে। চোখ খুলে দেখল, মা জড়িয়ে ধরেছেন তাকে। আর বাবা হাত বোলাচ্ছেন মাথায়।

সুরঞ্জনা বললেন, ‘কেঁদো না সোনা। আমরা বুঝতে পারিনি তোমার মনে কথা।’

ঋষি অবাক চোখে তাকাল বাবা-মায়ের দিকে। এ যেন আশ্চর্য ঘটনা ঘটছে তার সঙ্গে। সে কি স্বপ্ন দেখছে?

সম্বুদ্ধ বলে উঠলেন, ‘তুই যে দাবা টুর্নামেন্টে খেলেছিস, তাতে স্পনসর করেছেন আমাদের মিলের মালিক গৌতম হাজরা। তুই বিশ্বকর্মা পুজোয় আগে কয়েকবার মিলে গিয়েছিলি। তোর মুখটা দেখে গৌতমদার চেনা-চেনা লাগে। তোর মুখে আমার নাম শুনে নিশ্চিত হন।’

সম্বুদ্ধ এ বার হেসে বললেন, ‘নর্মদা চক্রবর্তী এসেছিলেন তোদের ওখানে? উনি তোর কথা বলেছেন গৌতমদাকে। তুই নাকি খুব ট্যালেন্টেড! গৌতমদাকে উনি বলেছেন, তোকে স্পনসর করতে। গৌতমদা রাজি।’

ঋষি এবার আর নিতে পারছে না। দাবা টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটাই ওর কাছে বিরাট প্রাপ্তি। এখন আবার বাবা কীসব বলছে! তার জীবনটা কি হঠাৎ করে পাল্টে গেল?

সম্বুদ্ধ বললেন, ‘রবিবার তোকে নিয়ে কলকাতা যাব। তোর নর্মদাম্যাডাম ফোন করে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। কী রে যাবি তো?’

ঋষি এবার সত্যিই কেঁদে ফেলল। ভয়ে নয়। আনন্দে।

পেলের সঙ্গে ঋষির প্রথম দেখা হয়েছিল মাসতিনেক আগে এক সন্ধেয়। সেদিন সকাল থেকে মুখ ভার ছিল আকাশের। ঝেঁপে বৃষ্টি পড়ছিল। রেনি ডে হয়ে যেতে পারে বলে স্কুলে যায়নি। দুপুরের পর বৃষ্টিটা ধরে এলেও বিকেলে কোচিংয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। এবার জন্মদিনে পিসি একটা ম্যাগনেটিক চেস উপহার দিয়েছে তাকে। সেটা নিয়ে ঋষি বসেছিল। ছোট ফোল্ডিং চেস বোর্ড। এটা স্কুল ব্যাগেই থাকে তার। কিন্তু একসময় মায়ের ধমক খেয়ে ছাতামাথায় কোচিংয়ে বেরোতেই হল ঋষিকে। তাদের পাড়া ছাড়িয়ে একটু এগোলে আরামবাগমুখী জাতীয়সড়ক। রাস্তা ক্রস করে বেশ কিছুটা গেলে ছোটোনীলপুর। হেঁটে অন্তত আধঘণ্টা লাগবে বিজনস্যরের কোচিংয়ে পৌঁছতে। হঠাৎই ঝাপসা হয়ে এল চারদিক। কালবৈশাখীর সময়। শুধু বৃষ্টি তাও সামলে দেওয়া যায়, ঝড়ের তাণ্ডব হলে কিছু করার থাকে না। সামলানোর আগেই ছাতাটা জ্যাভলিনের মতো হাত থেকে ছিটকে অদৃশ্য হয়ে গেল। ঝড়-বৃষ্টির দিনে রাস্তায় লোকজন নেই। বৃষ্টির প্রথম দমকেই চুপচুপে ভিজে গেল ঋষি। দিশেহারা হয়ে একছুটে একটা দোতলা বাড়ির রোয়াকে উঠে দাঁড়িয়েছিল সে।

ঘোর কালো মেঘের জন্য আস্ত বিকেলটাকে রাত মনে হচ্ছিল তখন। দোতলা বাড়িটা বেশ পুরোনো। অনেকদিন কেউ থাকে না। বৃষ্টি বাড়তে থাকায় ঋষি ওই বাড়িটার ভিতরে ঢুকে পড়েছিল। বৈঠকখানা যেমন হয়, এটাও তেমনই। দীর্ঘদিনের অব্যবহারের ফলে জানলা ভেঙে গিয়েছে। পলেস্তারা খসে পড়েছে ঘরের। পুরু ধুলো জমে মেঝেতে। দেওয়াল ফাটিয়ে বটঝুরি নেমেছে।

মাঝেমাঝেই বাজ পড়ছিল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল ঘনঘন। ঘরটা ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফিল্মের মতো লাগছিল। ভয়ভয় করছিল ঋষির। কিন্তু বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে আর কোনও উপায় ছিল না। এমন সময় আলোর একটা ক্ষীণরেখা দেখতে পেয়েছিল ঋষি। অনেক ভিটেহারা মানুষ পরিত্যক্ত বাড়ি পেলে তাতেই আশ্রয় নেয়। এই বাড়িতেও তাহলে কেউ থাকে! ভিতরের ঘরের দিকে মুখ বাড়িয়ে সব ভয় মুছে গিয়েছিল তার। ভিতরের ঘরটার দশাও বৈঠকখানার মতো হলেও তুলনায় পরিষ্কার। ঘরের এক কোণে মাদুর বিছিয়ে বসে রয়েছে একটা ছেলে। রোগাপাতলা, শ্যামলা চেহারার একটা ছেলে। তার থেকে বয়সে ছোটই হবে। একপাশে লম্ফ জ্বলছে। শিখাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বাইরে থেকে ছুটে আসা হাওয়ায়। সেই আলোতেই ঋষি দেখেছিল, ছেলেটার সামনে কোনও বই নেই। রয়েছে একটা দাবার বোর্ড! সে এক মনে দাবা খেলছে!

ঋষি কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল কে জানে। হঠাৎই তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল ছেলেটা। পায়েপায়ে ছেলেটার কাছে পৌঁছনোর পর ছেলেটা বলেছিল, ‘দাবা খেলবে?’

‘কী নাম তোর?’ জিজ্ঞেস করেছিল ঋষি।

‘পেলে।’ মিহি স্বরে জবাব দিয়েছিল ছেলেটা।

ঋষিকে তার ক্লাসের কোনও ছেলে দাবা খেলায় হারাতে পারেনি কখনও। তার অঙ্কের টিচার সাগ্নিকস্যরও। শ্যামলাটে ছেলেটা সঙ্গে দাবা খেলতে বসার সময় মনে মনে অবজ্ঞাই করেছিল তাকে। ঋষি শুধু অবাক হল না, রীতিমতো চমকে গেল পর পর তিনটে গেমে মাত্র সাতচালে চেকমেট হয়ে। পেলে ঠিক কীভাবে খেলছে, সেটাই বুঝতে পারছে না সে! জেদ চেপে গিয়েছিল ঋষির। পরপর কুড়িটা গেমে গো-হারান হল।

এই বয়সে কেউ এমন দাবা খেলে কেউ, ঋষির জানা ছিল না। সত্যিই পেলে, ফুটবলের নয়, দাবার!

‘তোকে কে শিখিয়েছে দাবা খেলা?’ জিজ্ঞেস করেছিল ঋষি।

পেলে হাসতে হাসতে জবাব দিয়েছিল, ‘কেউ না গো, নিজে নিজে শিখেছি।’

সেই শুরু। গত তিনমাসে পেলের সঙ্গে নিয়মিত দাবা খেলেছে সে। প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও ধীরেধীরে ধরতে পেরেছে। অল বেঙ্গল দাবা টুর্নামেন্টে ঋষি নাম দিয়েছে শোনার পর পেলে শিখিয়েছে, সে কীভাবে দাবা খেলে। বলেছে, ‘আমার মতো খেলার চেষ্টা করো। দেখবে তোমাকে কেউ হারাতে পারবে না।’

তা-ই হয়েছে। পেলের মতো খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাই তো ঋষি বেরিয়ে পড়েছে পেলেকে খবরটা দেওয়ার জন্য।

সন্ধের মুখে পুরোনোপল্লির সেই দোতলা পোড়ো বাড়িটাতে এসে পেলেকে খুঁজে পেল না ঋষি। এই বাড়িতে সে নিয়মিত এলেও পেলে ছাড়া আর কাউকে দেখেনি। সবচেয়ে অবাক করার হল, দিনেরবেলা কখনও পেলেকে দেখেনি ঋষি। সন্ধেবেলাতেই দেখা হয় দুই বন্ধুর। হয়তো ছেলেটা একাই থাকে এখানে। ঋষি অনেকবার জানতে চেয়েছে, ওর বাবা-মা কোথায়? পেলে মিটিমিটি হেসেছে। জবাব দেয়নি। বাড়িটার পিছনে একটা বড় মাঠ রয়েছে। পেলেকে ওখানে পাওয়া যাবে কী? মাঠের দিকে রওনা দিল ঋষি।

বিকেলে ফুটবল খেলা হয় এই মাঠে। ক্রিকেট প্র্যাক্টিসের জন্য একটা কংক্রিটের পিচও আছে। কেউ একসময় ক্রিকেট কোচিং দিত। বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেকদিন। সন্ধে হয়ে গেলে এদিকে বিশেষ কেউ আসে না। বদনাম আছে জায়গাটার। মাঠে এসে ঋষি দেখল, চাপ চাপ অন্ধকার ঘিরে রেখেছে মাঠটাকে। এখানে আর কে থাকবে? তখনই শুনতে পেল, বটগাছের তলায় কংক্রিটের পিচ থেকে ঠকঠক আওয়াজ ভেসে আসছে। ডিউস বলে ব্যাটিংয়ের সময় ব্যাট-বলের সংঘর্ষে যেমন শব্দ হয়। সন্ধে প্রায় নেমে এসেছে। এখন কে প্র্যাক্টিস করছে এই মাঠে? কৌতুহল হল ঋষির। সে কয়েক পা এগিয়ে গেল মাঠের পশ্চিম কোণের পিচটার দিকে। তার কানে ভেসে এল দুটো বাচ্চা ছেলের গলা।

আবছা অন্ধকারে ঋষি দেখল একটা ছেলে বাঁহাতে পেস বোলিং করছে। বেশ জোর রয়েছে ছেলেটার বলে। কিন্তু প্রায়ান্ধকারেও সেই বল অবলীলায় খেলে দিচ্ছে বছর সাত-আটের একটা ছেলে। বোলারটা খুব অবাক হচ্ছে। সে ফিরে যাচ্ছে রানআপে। পূর্ণগতিতে বল করছে আবার। কিন্তু ড্রাইভ অথবা কাট করে দিচ্ছে সেই বাচ্চা ছেলেটা। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই ছেলেটা প্যাড, গ্লাভস পরে নেই। তবু তার খেলতে অসুবিধা হচ্ছে না।

—তুই কি অন্ধকারেও আমার বল দেখতে পাচ্ছিস?

—কই, অসুবিধা হচ্ছে না তো!

—বলটা কি ঠিকঠাক করতে পারছি?

—হচ্ছে। তবে লাইন আর লেথে সমস্যা আছে। তুমি বলটা গুডলেংথ থেকে কোণাকুণি অফস্টাম্পের মাথায় রাখো। তাহলে খেলতে সমস্যা হবে।

—চেষ্টা করছি তো। হচ্ছে না।

—হবে, হবে।

—স্কুল টিমে এবার চান্স পাবো তো রে?

—আমি যেমন বলছি, করে যাও। স্কুল টিমে ঠিক চান্স পাবে।

ছেলেটা আবার রানআপে ফিরছে। অন্ধকার ছেয়ে গিয়েছে চারদিকে। তবু বড্ড প্রত্যয়ী দেখাচ্ছে বাঁহাতি পেস বোলারটাকে। পেলের কাছে রোজ দাবায় হারতে হারতে এইরকম জেদ ফুটে উঠত ঋষির মধ্যেও।

ঠান্ডা হাওয়া বইছে। আকাশের কোণে মস্ত কালো মেঘ ঝুলছে। বৃষ্টি আসছে। বাঁহাতি পেস বোলারটা রানআপে দৌড় শুরু করার ঠিক মুখে আকাশের এককোণে বিদ্যুতের চিলতে রেখা ঝলসে উঠেই মিলিয়ে গেল। ক্ষণিকের ওই আলোয় ঋষি দেখল, পিচে আবার স্টান্স নিচ্ছে শ্যামলা মতো রোগাপাতলা একটা বাচ্ছা ছেলে।

পেলে!

সমাপ্ত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *