কবিতা
উপন্যাস
গল্প
প্রবন্ধ

পৃথিবীর শেষদিন • প্রবোধবন্ধু অধিকারী

পৃথিবীর শেষদিন – প্রবোধবন্ধু অধিকারী

এক

গোটা দক্ষিণ দিগন্ত জ্বলছিল। দাউ দাউ আগুনে। যেন একখণ্ড গাঢ় নীল কাগজের কোনায় কোন ধূর্ত বালক অগ্নি সংযোগ করবার পর, শিখা অত্যন্ত আচমকা গোটা কাগজ খণ্ড গ্রাস করতে চাইছে। কিংবা বলা যায় বৃহত্তর কোনো উৎসব হচ্ছিল বিশাল নীল সামিয়ানার নীচে—দৈব দুর্ঘটনায় তার কোনে লাগা আগুন সূর্যরথের তীব্র গতিবেগ নিয়ে সমগ্র সামিয়ানাময় ছড়িয়ে পড়তে যাচ্ছে। আর তখন, ঠিক তখনই উৎসব আঙিনার অসংখ্য মানুষ যেমন পরিত্রাস চিৎকারে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে চায়, ঠিক তেমনি করেই সেদিন গোটা পৃথিবী শিউরে উঠেছিল। জাভরেল ব্যাংক থেকে প্রথম ঘোষণা এল: পৃথিবী বিপন্ন… পৃথিবী বিপন্ন… দক্ষিণ দিগন্তে আগুন। ইংলণ্ডের অযুত খ্রিস্টধর্মী ভ্রাতৃবৃন্দ… হ্যালো আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, জার্মান… পৃথিবী বিপন্ন… কারণ এরূপ অনুমেয় যে, সম্ভবত কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কি দুর্বিপাকে ইথারে আগুন লেগেছে। …কিংবা এমনও হতে পারে এই অগ্নিসংযোগ ঘটে বায়ুস্তরে। আমরা এক ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়েছি।

ভারত সাড়া দিয়েছে; হ্যালো হ্যালো বিশ্ববাসী বিশ্বের তামাম বিজ্ঞানী ভ্রাতৃবৃন্দ, সম্ভবত কলির শেষ অদ্যই। এ-পৃথিবীর শেষ দিনটি আজই। ১৪ই অক্টোবর… আজ মহাষ্টমী—দশভুজার করাল গ্রাসে…

আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন, আরব প্রাচ্য—সর্বত্রই ওই এক কথা—আজ ১৪ই অক্টোবর… পৃথিবীর শেষ দিন। কারণ দক্ষিণ দিগন্তে লাগা আগুন ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তার লকলক লেলিহান জিহ্বা গোটা আকাশ গ্রাস করে ফেলবে মুহূর্তের মধ্যে।

দেখতে দেখতে কথা অন্য রকম। বক্তব্য রূপান্তরিত। জাভরেল ব্যাংক ঘোষণা করল—না, ইথারে কি বায়ুস্তরে অথবা আকাশপটে আগুন ধরে নি। ব্যাপারটি অন্য রকমের। একটি আগুনের রকেট, অস্বাভাবিক ধরনের আকারের—সেটি দক্ষিণ দিগন্তের দিক থেকে তীব্র গতিতে ছুটে আসছে। সম্ভবত গতিবেগ ঘণ্টায় ৬৩ হাজার মাইল।

ভারত বলল: এই মাত্র, এই আর কি, অদ্ভুত দর্শনের একটি কিম্ভূত অগ্নি-রকেট আমাদের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেল। নিমেষের মধ্যে। চীন বলল: ওই যাচ্ছে, ওই। রাশিয়া বলল, আমাদের তৈরি, আমাদের দিকেই আসছে। ফ্রান্স বলল, ওটা আমাদের ওখানেই নামবে। হে মিত্ররাষ্ট্র, যে কোনো সময়ে তোমাদের সাহায্য আমাদের প্রয়োজন। ডাকলেই আসবে। আমেরিকা বলল: অগ্নি-রকেটের গতি দেখে মনে হচ্ছে আমাদের এখানেই নামবে। জাপান বলছিল, আসলে ওই অগ্নিশলাকাটি গোটা আকাশে চক্কর খেতে খেতে নেমে আসছে। বাস্তবিক পৃথিবীর ওপরের বিশাল নীল সামিয়ানা তথা নভোমণ্ডলের কখনও পুবদিক, কখনও পশ্চিম, এই উত্তর ওই দক্ষিণ এবং মধ্য ভাগে দাউ দাউ আগুন জ্বলছিল। আর সে আগুন নেমে আসছিল ক্রমশ নীচে। আরও নীচে, আরও…

অগ্নি-রকেটটি অবশেষে আমেরিকার মাথার ওপরে এসেছে। নামল, নামল, নেমে আসছে। সারা আমেরিকায় শহরে শহরে সোরগোল, সেনাবাহিনীর লোকেরা ছুটোছুটি করছে। বিজ্ঞানীরা তটস্থ। নিউইয়র্কের মাথার ওপর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়েছিল অগ্নি-রকেট। তারপর নিমেষে সে প্যারেড গ্রাউণ্ডে নেমে এল। দু’মুহূর্তের মধ্যে আধুনিক সমরাস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে গোটা প্যারেড গ্রাউণ্ড। শান্ত স্তব্ধতা। একটি আদেশের অপেক্ষা কেবল।

অগ্নি-রকেটটি মাটিতে নামলে, তার দ্যুতি নিভে গিয়েছিল। নিভন্ত রকেটটি বাস্তবিক অদ্ভুত-দর্শনের। কোন্ ধাতুর তৈরি ধরা মুস্কিল। আকার অনেকটাই ভারতীয় ছিপ নৌকার মতন। উঁচু চৌদ্দ কি পনের ফুট। লম্বা ত্রিশের ওপরে। ওর ভেতর থেকে কথা আসছিল: আপনারা হে পৃথিবীর শান্তিকামী, অগণন অজ্ঞ অশিক্ষিত এবং নিরীহ মানুষ, আপনারা ভীত হবেন না। ভীত হবার কোনো কারণ নেই। আমি কোনো ক্ষতি করতে আসিনি। শনি গ্রহের শান্তিকামী, অসংখ্য মানুষ ও বিজ্ঞানীরা আপনাদের প্রতি প্রকৃত দয়াপরবশ। তাঁরা আমাকে দূত রূপে প্রেরণ করেছেন। না করে থাকতে পারেন নি। কারণ পৃথিবী শিগগীরই নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। অচিরেই সেটা হবে। সম্ভবত আপনারা জানেন না; এই পৃথিবী অধিকারের প্রশ্ন নিয়ে মহাকাশে এক তীব্র বিরোধ চলছে। মঙ্গলগ্রহ দাবী জানিয়েছে, পৃথিবী তাদের। চাঁদের বিজ্ঞানীরা বলছে পৃথিবী যেহেতু তাদের গ্রহ অতএব এর সকল স্বত্ব তাদের। বৃহস্পতি, নেপচুন, শুক্র পর্যন্ত দাবি জানিয়েছে। আপনারা জ্ঞাত নন যে, অচিরে এক লড়াই বাধবে। গ্রহের সঙ্গে গ্রহের হবে ভয়ানক যুদ্ধ। ফল স্বরূপ বলা যায়, সমগ্র পৃথিবীটাই ধ্বংস হবে…

প্যারেড গ্রাউণ্ড ঘেরা সৈন্যদলে গুঞ্জন উঠল। কমাণ্ডার জানাচ্ছিলেন, এ-সকল কথাই ভুয়া, বানানো কথা। আসলে অদ্ভুত যানে আগন্তুক ব্যক্তিটি পৃথিবীর তথ্য নিয়ে ফিরে যেতে চায়। আমরা কিছুতেই তাকে ফিরে যেতে দিতে পারি না।

‘আমি এবার আপনাদের সামনে বেরোবো। আমার কথাগুলি মিথ্যে বলে

গ্রহণ করলে আপনারা ভুল করবেন। কারণ আমরা শনি গ্রহের মানুষরা মিথ্যে বলে কোনো শব্দ জানতাম না। কেবলমাত্র কতিপয় ব্যক্তি ভারতীয় ভাষা থেকে ঐ কথাটি আমার শিখেছি…’ প্যারেড গ্রাউণ্ডের মধ্যে অদ্ভুত যানের ভেতর থেকে লোকটি বলছিল। ‘আমি এসেছি পৃথিবীর সকল বিজ্ঞানীদের ডেকে একটি সমাধানে পৌঁছোতে। আপনারা বাধা না দিলে খুশীর কারণ হবে…’

গ্রাউণ্ড ঘেরা সৈন্যদল ততক্ষণে তৈরি। চারপাশে ট্যাঙ্কে ট্যাঙ্কে ঘেরাও করা হয়েছে। সৈন্যদল আধুনিক মেশিনগান তুলে আছে। একটি পারমাণবিক কামানও তৈরি। লোকটি বলে যাচ্ছিল। গোটা এলাকা নিঃশব্দ। উৎকণ্ঠা উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষমান গোটা বাহিনী।

ওরা ভেবেছিল শব্দ হবে। কিন্তু শব্দ হল না। বিস্ময়ের সঙ্গে সবাই দেখল একটি দরজা খুলে গেল। ভেতর থেকে যে বেরিয়ে এল, সে কিম্ভুতদর্শন জন্তু নয়, মানুষ। ছ ফুটের চেয়েও কিছু বেশি লম্বা। চওড়া কাঁধ। প্রশস্ত বক্ষ, মাথায় টুপি। সারা শরীর অভ্র রঙের শক্ত পোশাকে ঢাকা। লোকটি বেরিয়ে এসে কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে পৃথিবীর লোকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাল। সে দেখল, হয়ত অনুমানও করেছিল যে, এর বেশি এগুতে গেলে তার ওপর আক্রমণ চলবে।

কুর্নিশ সেরে লোকটি মাথা তুলে হাসল। বলল, ‘বৃথাই এত আয়োজন। প্রথমত, হে পৃথিবীবাসী, বন্ধু আমেরিকাবাসী, আমি লড়াই করতে আসি নি। আপনাদের সামনে সমূহ বিপদ, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী এবং মনীষীদের ডেকে আপনারা সম্মেলন করুন। সেই সম্মেলনে আমি আমার বক্তব্য রাখব। সব শুনে আপনারা নিজেদের কর্তব্য স্থির করবেন। আমি তার ওপর জোর করব না। বরং আমাকে আপনারা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ করে দিন। আমি তাঁর আতিথ্য…’ বলতে বলতে লোকটি দু’পা এগোল। আর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটে গেল ঘটনাটা। দুটি ট্যাঙ্ক গর্জে উঠল। অব্যর্থ আঘাত।

না, লোকটি পড়ল না। গোলা দেহ ছুঁতে পারে নি। লোকটির সারা দেহের ফুট দুয়েক আগে ধাক্কা খেয়ে দুটি গুলি উর্ধ্বে উঠে গিয়ে ফেটেছিল। তাবৎ সৈন্যরা অবাক।

লোকটি হাসছিল। সে বলছিল, ‘হে পৃথিবীর অজ্ঞ অশিক্ষিত বন্ধুগণ, আপনারা ভুল করেছেন। সমস্ত পৃথিবীতে এমন অস্ত্র তৈরি হয় নি, যা দিয়ে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় শনিগ্রহের মানুষকে আপনারা ঘায়েল করতে পারেন। আমার শরীরে পাওয়ার নাইন রয়েছে। এ এক ধরনের বিজলী আবরণ। সকল আঘাতই, যে কোন ধাতুর তৈরি হোক তা এই পাওয়ার ফিরিয়ে দিতে পারে। পরন্তু জেনে রাখুন, ইচ্ছে করলে আপনাদের সকল মারণাস্ত্রকে আমি তরল পদার্থে

পরিণত করতে পারি…’

বাস্তবিক বলার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ। লোকটির শরীর থেকে অনেকগুলি সবুজাভ আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হল। এবং তা সবগুলি ট্যাঙ্ক, সকল সৈন্যের হাতের অস্ত্র, কামানকে গলিত ধাতুতে পরিণত করল। এবং সেই গলিত ধাতু স্রোতের মতন বয়ে যেতে লাগল। লোকটি হাসছিল। ‘বন্ধুগণ, আপনারা ভয় পাবেন না। আমি পাওয়ার নাইন গুটিয়ে নিচ্ছি। আপনারা আসুন, করমর্দন করুন। দেখবেন আমি আপনাদের মতোই সহজ সাধারণ মানুষ।’

লোকটি এসেছিল।

কর্নেল স্মিথ অসহায় সেনাবাহিনীর ক-জনকে ডেকে ততক্ষণ পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। মাইকে স্মিথ বললেন, তাঁরা লোকটিকে বন্ধুভাবে গ্রহণ করছেন। স্মিথ এগারোজন সামরিক নেতা নিয়ে লোকটির দিকে এগোতে থাকলেন। লোকটিও আসছিল। কিন্তু সে জানত না, পৃথিবীর লোক তার চেয়ে অনেক বেশি ধূর্ত। লোকটি আসতে আসতে বলছিল, ‘আমি জানতাম, অজ্ঞতা আপনাদের সরল করে রেখেছে। আপনারা সত্যাগ্রহের দেশের লোক। শান্তিকামী জনতা! হে বন্ধুগণ…’

কাছাকাছি হতেই ঘটনাটা ঘটে গেল। ন-জন সামরিক নেতা আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল শনিগ্রহের মানুষটির ওপর। দু’ মুহূর্ত বুঝি ঝাপটাঝাপটি হয়েছিল। ততক্ষণে আমেরিকান সামরিক জোয়ানরা লোকটিকে কাবু করে ফেলেছে। ওরা আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে শনিগ্রহের আগন্তুককে।

স্মিথ বললেন, ‘অমন বিপদের কথা আমরা হাজারবার শুনেছি। আসলে তুমি অন্যগ্রহের গুপ্তচর। পৃথিবীর তথ্য নিয়ে তোমাকে আমরা ফিরে যেতে দিতে পারি না।’

লোকটি অসহায়ের গলায় বলল, ‘আপনারা ভুল করছেন।’

‘এরকম ভুল করতে আমরা ভালবাসি…’ স্মিথ হাসছিলেন।

‘আমাকে আটকে রাখার ব্যাপারটা আকাশ-কুসুমের মতন কল্পনা।’

‘বাঙালীকে দোষ দিলেও আমরা অর্থাৎ তামাম বিশ্বের মানুষরাই কল্পনা বিলাসী।’ স্মিথ তাঁর মাথার টুপিটি খুলে বগলে নিয়ে চুরুট ধরালেন। ‘বিজ্ঞানে আমরা খুব পিছিয়ে নেই। তোমার শরীরের কোথায় কি আছে তা না জানলেও এটা বুঝতে পারছি, হাত মুক্ত হলেই তুমি আমাদের নাগালের বাইরে চলে যাবে। অতএব তোমার হাতকে এখন অকেজো করে রেখেছি। রেখেছি এ-জন্যে যে, আঙুল দিয়ে শরীরের কোনো বোতামই তুমি টিপতে পারবে না।’

লোকটি অসহায়ের মতন হাসল। বলল, ‘কথাটা ঠিক।’

‘তবে এবার লক্ষ্মী বাছাধনের মতো চলো…’ স্মিথ সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছিলেন।

.

দুই

লোকটিকে সবচাইতে সুরক্ষিত সেলে রাখা হয়েছিল। যেখানে দাঁড়িয়ে শনিগ্রহের মানুষ পিক ০০৯২ ভাবছিল, অভিনয় করে সে ভালই করেছে। বাধ্য ছেলের মতন ধরা না দিলে, লোকক্ষয় অস্ত্ৰক্ষয় হত। সে কারো ক্ষতি করতে আসে নি। তা ছাড়া সে একথাও ভেবে নিয়েছিল যে, তার শক্তির প্রমাণ বার বার দিলে পৃথিবীর মানুষরা হয়ত জব্দ হত। কিন্তু সুরাহা কিছু হবার রাস্তা থাকত না। শনিগ্রহের প্রেসিডেন্ট ‘লুকো’ তাকে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় দিয়েছেন। এর মধ্যে কাজ সেরে যেতে না পারলে তার কঠিন দণ্ড হবে। অতএব পিক ০০৯২ এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, বাধ্য ছেলের মতন ধরা দিয়ে, কৌশলে তাকে আইনস্টাইনের বাড়ীতে পৌঁছতে হবে। পৃথিবীর এই বিজ্ঞানীর প্রকৃত ঠিকানাটি সে ভুল করে ফেলে এসেছে। যে ভুলের জন্যও তার দণ্ড হওয়া স্বাভাবিক।

পিক ০০৯২ সেলের মধ্যে অপেক্ষা করছিল। কারণ কৌতূহলী জনতার ভিড় কয়েক ঘণ্টা থাকবে। সামরিক বাহিনীর লোকরাও তৎপর থাকবে কয়েক ঘণ্টা। এর মধ্যে বেরিয়ে পড়া মানেই আবার জটিলতার সৃষ্টি। পিক ভাবছিল, লোকজনের উত্তেজনা কমলে, ঠিক সন্ধ্যা নাগাদ সে বেরোবে। এমনভাবে বেরোবে যাতে কেউ ধরতে না পারে।

সমগ্র নিউইয়র্কে তখন হৈ-চৈ। পথে জনতা গিজগিজ করছে। একসঙ্গে সকল দৈনিক পত্রের টেলিগ্রাম বেরিয়েছে। বিচিত্র ব্যানার হেডিং দিয়ে। স্টেট সাকুর্লার বেরিয়েছে। ওরা বলেছে আন্তঃগ্রহ গুপ্তচরের আমেরিকা অবতরণ, কৃতি সেনাবিভাগ কর্তৃক গুপ্তচর ধৃত ইত্যাদি ইত্যাদি…

রাষ্ট্রসংঘ ভবনে বিশেষ জরুরী বৈঠক বসেছে।

আমেরিকান সেনাবাহিনী ঘিরে রেখেছে প্যারেড গ্রাউণ্ড।

বিকেলের দিকে আর একটি সাকুর্লার বেরুলো। জনসাধারণকে সাবধান করা হয়েছিল। রেডিও স্টেশন থেকে ঘোষণা করা হল। সেই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, প্যারেড গ্রাউণ্ডে নামা রকেটটির কাছে কিছুতে যাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়ার লাইনের বেড়া রয়েছে। বিজ্ঞানীরা বৈঠকে বসেছেন। তাঁরা রকেটটির সকল গুপ্ত রহস্য ভেদ করতে আগ্রহী। হয়তো আরও কয়েক ঘণ্টা পরে আমরা জানতে পারব পাওয়ার লাইন অতিক্রম করে বিজ্ঞানীরা রকেটটির সকল গুপ্ততথ্য আবিষ্কার করেছেন।

পিক সেলে বসে রেডিও-র ঘোষণা শুনে হাসছিল। সন্ধ্যা না নামাপর্যন্ত সে

অসহায়।

রাশিয়া, ফ্রান্স, লণ্ডন, ভারত, জাপান থেকে বিজ্ঞানীদের সবগুলো আকাশ যান নিউইয়র্কে পৌঁছালো সন্ধ্যা নাগাদ। সমগ্র আমেরিকার ঘরে ঘরে তখন প্রবল উত্তেজনা। রেডিও বলছিল: পাওয়ার লাইন অতিক্রম করতে গিয়ে এ-যাবৎ ১১৪ জন বিজ্ঞানী মারা গেছেন…

রাষ্ট্রপুঞ্জভবন থেকে বিজ্ঞানীর দল বেরোলেন। তখন সন্ধ্যা সামান্য ঘন হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোক সেল এলাকার চৌহদ্দির বাইরে চিৎকার করছে। তারা আন্তঃগ্রহ গুপ্তচরের সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রার্থী। অথবা দূর থেকে দেখতে পেলেও জনতা খুশি হবে এমন জিগির উঠছিল।

কিন্তু হায়, সকল প্রয়াস ব্যর্থ হ’ল।

বিজ্ঞানীরা যখন পৌঁছলেন, সেল তখন শূন্য। সেখানে কেউ নেই। পিক ০০৯২ অন্তর্হিত। দেওয়ালটা কেবল এমনভাবে কাটা আছে, যেন একটি মানুষের মতন। একটা দেওয়ালই শুধু নয়। পেছন দরজা পর্যন্ত যতগুলো দেওয়া আছে সবগুলোরই এক অবস্থা। দেখলে মনে হবে, পিক অনায়াসে এবং অক্লেশে তার শরীরে শক্তির ধারে দেওয়াল কেটে হেঁটে গেছে।

এক সেকেণ্ড কাটল না, সঙ্গে সঙ্গে রেডিও-র ঘোষাণা। আমেরিকার গুপ্তচর নিয়োজিত হল! সেল থেকে প্যারেড গ্রাউণ্ডে ফোন করে জানা গেছে, না রকেটটি উধাও হয়নি। অতএব পিক নিউইয়র্কেই আছে। সে আত্মগোপন করেছে। মার্কিন সরকার জরুরী ঘোষণা করলেন যে, লোকটিকে যে ধরে দেবে তাকে আড়াই লক্ষ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। রেডিও লোকটির দেহগত বিবরণ দিচ্ছিল।

সমগ্র নিউইয়র্কে তখন অধিক উত্তেজনা। যেন গোটা দেশ ফেটে পড়বে এই মুহূর্তেই। কয়েক হাজার গাড়ি আর মোটর সাইকেল ছুটল। কয়েক শো হেলিকপ্টার তুলে দেওয়া হল আকাশে। এরোপ্লেনে গোটা আকাশ এর মধ্যে ছেয়ে ফেলেছিল।

সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে সবে রাত ঘন হচ্ছে, এমন সময় পিক ০০৯২ আইনস্টাইনের বাড়িতে উপস্থিত। গোটা বাড়ি নিস্তব্ধ। লোকজন নেই। কাউন্টির এ দিকটা এমনই। পিক এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। তার খুব ভাগ্য ভাল যে, নম্বরটি মনে করতে পেরেছিল। এবং ট্যাক্সিওয়ালা তাকে চিনতে পারেনি। আসবার সময় পিক ভেবেছিল, সে ট্যাক্সিওয়ালাকে ধন্যবাদ জানাবে। কারণ আইনস্টাইনের এই কাউন্টির বাড়িটির খবর সে পিককে না দিলে পিক নির্ঘাৎ আবার সেই ঝামেলায় পড়ত। ধরা পড়ত। ধরা পড়া মানেই বিলম্ব।

পাম সারির মধ্যেকার সবুজাভ আলোয় আলোকিত পথ ছেড়ে পিক বারান্দায়

উঠে এল। কেউ নেই। কেমন ফাঁকা ফাঁকা সব। পিক বাস্তবিক চিন্তায় পড়ল। কারণ সে ভেবে নিচ্ছিল, আইনস্টাইন সম্ভবত শহরে ফিরে গেছেন। বারান্দা ধরে হাঁটতে হাঁটতে পিক হতাশ হচ্ছিল।

না, আলো জ্বলছে। পিক দাঁড়াল। বাঁ পাশের রুমে আলো জ্বলছিল। কাচের দরজার ফাঁক দিয়ে পিক দেখল। সে খুশি হতে পেরেছে।

দরজা বন্ধ না। ঠেলতেই খুলে গেল! পিক ভেতরে ঢুকেছে…

এখানেও কেউ নেই। এদিক ওদিক আতিপাতি করে খুঁজল পিক। না, নেই। হতাশ হয়ে সে সোফায় বসেছিল। ঠিক তখনই তার নজরে পড়ল টেবিলের ওপরের একটি কাগজ। নতুন থিওরীর একটি অঙ্কের খানিকটা করা রয়েছে। অসমাপ্ত অঙ্ক। পিক কাগজটি টেনে নিয়ে, পেন্সিলে বাকিটুকু করে ফেলেছিল মুহূর্তেই। শেষ করা অঙ্কের কাগজটি টেবিলে রাখতে যাবে এমন সময় গলা। হ্যাঁ মানুষের। পিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ।

‘কী চাও?’ বৃদ্ধ বলছিল।

‘আইনস্টাইনের সঙ্গে দেখা করব।’

‘কাগজ নিয়েছ কেন? জানো, আমার মনিব ওই নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।’

‘দেখছিলাম।’ পিক হাসল। ‘ভারী কঠিন অঙ্ক তো!’

‘নির্বোধ।’ বুড়ো লোকটি পিককে গাল দিল। ‘বিজ্ঞানের ব্যাপার। আমার মনিব পাওয়ার নাইনের ব্যাপারটা সলভ করতে গিয়েছিলেন।’ বুড়ো এগিয়ে এল। ‘জানো না বুঝি এক রকেটে আন্তঃগ্রহের এক গুপ্তচর…’

‘তাই নাকি…’ পিক বোকার মতন ভান করল।

‘মূর্খ…’ বুড়ো লোকটি আবার গাল দিল। ‘সরে যাও। কর্তা আজ ওই অঙ্ক নিয়ে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন। মেলাতে পারেন নি। মাথার চুল ছিঁড়েছেন। দেখা হবে না আজ। তিনি রাষ্ট্রসংঘের জরুরী তলবে…’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে।’ পিক বুড়ো লোকটিকে থামাল। ‘খুব জরুরী দরকার আমার। তা না হয় সকালে আসব। কখন এলে দেখা…’

‘একটু বেলায়। কর্তার ঘুম ভাঙে একটু দেরীতে।’

‘আচ্ছা।’ পিক বিদায় নিল। ‘পারলে বলো আমি এসেছিলাম। কাল আবার আসব…’

‘বলব।’ লোকটি বলল। ‘শুভরাত্রি…’

রাস্তায় এসে পিক ভাবল, এবার সে কোথায় যাবে।

আইনস্টাইন ফিরে এলেন অনেক রাত্রে। সারা কাউন্টি তখন ঘুমে অচৈতন্য। গাড়িটি গেট পেরিয়ে ঢুকলে বৃদ্ধ চাকর ছুটে গিয়েছিল। কিন্তু কর্তার মুখ চোখ পাংশু। চুল এলোমেলো। খুব বেশি চিন্তিত আছেন। চাকরটা তৎক্ষণাৎ কিছু বলে নি।

কর্তা সরাসরি বসবার ঘরে ঢুকলেন। টেবিলের দিকে যাচ্ছেন। বুড়ো চাকরটি বাইরে থেকে দেখছিল। এবং কর্তা হুমড়ি খেয়ে যেন টেবিলের ওপর পড়লেন। একটা মুহূর্ত। হঠাৎ কর্তা কাগজ তুলে নিলেন। চোখের সামনে ধরলেন। তারপরই ডাক। বুড়ো চাকরটা ভয় পেয়েছিল। সে কাঁপছিল। কারণ সে ধরে নিতে পেরেছে যে, আগের আসা লোকটি নিশ্চয় কাগজে কিছু আঁকিবুকি এঁকেছে।

‘কে ধরেছিল এ কাগজ?’ আইনস্টাইন শুধোলেন।

‘আজ্ঞে, একটি লোক।’

কর্তার সারা মুখ কুঁচকে এল, ‘লোক!’

‘আজ্ঞে…’

‘কোথা থেকে এসেছিল?’

‘জানি না।’

‘গিয়েছে কোথায়?’

‘জানি না। বলে যায় নি।’

‘কেন এসেছিল?’

‘দেখা করতে।’ বৃদ্ধ চাকরটি তখনও কাঁপছে। ‘বললে, জরুরী কাজ। কাল সকালে আসবে বলেছে।’

কর্তা খানিক চুপ করে থাকলেন। কাগজটা বার বার তুলে তুলে দেখছিলেন।

‘অপদার্থ’, বুড়ো চাকর আপন মনে বলছিল। ‘বেশি মাতব্বরি। ব্যাটা কাগজটা ধরে শেষ পর্যন্ত গোলমাল বাঁধিয়েছে!’ সে পিকের উদ্দেশ্যে গালাগালি করছিল।

.

তিন

পিক ০০৯২ শহরে ফিরে যায়নি। যায়নি প্রধানত একটি কারণে। সে জানত ওখানে ফিরে যাওয়া মানেই ধরা পড়া। অতএব পিক কাউন্টির পথে হাঁটছিল। তাকে এখানে কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। রাতটার মতন। কিন্তু কোথায়, কেমন করে সে আশ্রয় মিলবে পিক জানত না। সে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে অবশেষে সে এরূপ সিদ্ধান্তে পৌঁছল যে, কোনো ভিলার মালিককে সে সরসরি গিয়ে প্রস্তাব করবে যে, সে বিদেশী। রাত্রির মতন তার আশ্রয় চাই। পিক ভেবেছিল। কিন্তু তার বরাত ভাল। কারণ পথেই এক তরুণীর সঙ্গে দেখা। সে-ও এপথে ফিরছে।

পিক সাহস সঞ্চয় করে কথা বলল।

‘আপনাকে সামান্য বিরক্তি করতে পারি কি?

‘বলুন।’

‘দেখুন, আমি শনি… মানে শনিগ্রাম থেকে আসছি। দূরে যাব। পথঘাট সব অচেনা…’

তরুণী ভ্রূকুঞ্চিত করে তাকাল, ‘কোথা থেকে বললেন?’

‘শনিগ্রাম।’

‘সেটা আবার কোথায়?’

‘কেন, কেন… ও আপনি বুঝি নামই শোনেন নি… তা হ্যাঁ, অত ছোট কাউন্টি—নাম না শোনবার মতোই…’

‘বাড়িতে আমি একা।’ তরুণী বলছিল। ‘আমার স্বামীর নাইট ডিউটি। সম্ভবত তিনি এতক্ষণ রওনা হয়ে গিয়েছেন। এ অবস্থায়…’

‘দেখুন, আমি খুব অসহায়…’

পিকের ভাগ্য ভাল, তরুণী জিনা শেষ অবধি তার প্রার্থনা রেখেছিল। রাতটা ভালভাবেই কেটেছিল তার। জিনা অতিথি সমাদর করেছে। খাইয়েছে। এবং রাত্রের শোবার ব্যবস্থা ভাল থাকায় অনেক বেলা পর্যন্ত সে ঘুমিয়েছিল। পিক জানত না বেলা অনেক। জিনা তাকে এসে ডাকল। বলল, সমূহ বিপদ। পিক নাকি ধরা পড়লেও পড়তে পারে। কারণ জিনার স্বামী ভোর ভোর সকালে ফিরেছে। পিককে দেখার পর সে অনেক কথাই শুধেছিল। ‘এমন কি একথাও বলেছিল যে, তুমিই সেই শনিগ্রহের মানুষ। অত লক্ষ লক্ষ ডলার… আমার স্বামী লোভী মানুষ—তুমি পালাও।’

পিক লাফিয়ে উঠল। বলল, ‘সব কথাই কি বলে দিয়েছ নাকি?’

‘হ্যাঁ’, জিনা অপরাধীর মতন মাথা নীচু করল। ‘এমন কি সকালে যে তুমি আইনস্টাইনের ওখানে যাবে তাও…’

‘সর্বনাশ!’ পিক তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিয়েছে। ‘বিদায় জিনা। বিদায়… বিদায়… তোমার কথা আমার মনে থাকবে।’

‘বিদায়…’ জিনা বলল। ‘তুমি নিশ্চিন্তে মহাকাশে না ওঠা পর্যন্ত আমার দুঃশ্চিন্তা ঘুচবে না। আমার স্বামী তোমাকে না জাগাতে বলেছিল। কারণ তা হলে তোমাকে ধরিয়ে দেবার রাস্তাটা সোজা হত।’

‘আমি কৃতজ্ঞ…’ পিক পড়িমরি করে ছুটল। নির্জন পথে।

‘তা হলে তুমিই…’

‘হ্যাঁ’

‘কিন্তু অঙ্কটা তুমি অত সহজে, মানে কাটাকুটি না করে করলে?’ আইনস্টাইন পিকের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকল।

পিক অল্প অল্প হাসছিল। বলল, ‘আমাদের গ্রহে এ অঙ্ক প্রাইমারী কোর্স…। ভাল ছেলেরা কিণ্ডারগার্টেনেই…’

‘ও।’ আইনস্টাইন চুপ। ‘তা পৃথিবীর ভাষা তুমি শিখলে কি করে?’

‘ট্রান্সমিটারেধরে ধরে। এই করে আমরা সকল গ্রহের ভাষা শিখেছি। স্কুল কোর্সেই এ-সব আমাদের শেখান হয়।’

আইনস্টাইন চিন্তিত হলেন। বললেন, ‘চাঁদ-টাদ নিয়ে আপাতত আমরা ভাবছিলাম। শনিগ্রহে মানুষ আছে এবং তাঁরা…’ আইনস্টাইন থামলেন। বললেন, ‘তা হলে পৃথিবীকে বাঁচাবার জন্য তোমরা কি ভাবছ?’

পিক আবার হেসে ফেলল। ‘মিঃ আইনস্টাইন, পৃথিবী বাঁচবে না। বাঁচতে পারে না। শনিগ্রহের শান্তিকামী মানুষ চায়, পৃথিবীর সকল লোককে শনিগ্রহে পুনর্বাসিত করা হোক…’

‘হুঁ’ আইনস্টাইন আবার চিন্তিত হলেন। খানিক পরে বললেন, ‘যুদ্ধটা কোন্ সময়ে শুরু হবার সম্ভাবনা। কোন্ সালে?’

‘১৯৬৫ সালের জানুয়ারীতে। বৃহস্পতি ও সময় পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করতে নামবে বলে জানিয়েছে।’

‘তোমরা?’

‘আমরা বাধা দেব।’ পিক ০০৯২ বলল। ‘আর সকল গ্রহই চায় পৃথিবী তাদের হোক। আমরা এর কোটি কোটি অশিক্ষিত লোককে পুনর্বাসন দিয়ে শিক্ষিত করতে চাই। যাতে তারা শনিগ্রহের সভ্য নাগরিক হতে পারে।’

‘আমাদের ভাবতে সময় দিতে হবে।’ আইনস্টাইন বললেন। ‘প্রথমত আমরা ভাবব, কোন উপায়ে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারি। ভিন্ন গ্রহের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারি…’

‘অনেক বছর লাগবে।’ পিক হাসল। ‘তোমরা ছ’হাজার বছর পিছিয়ে আছ! ও সময়েও প্রতিরোধ শক্তি গড়া সম্ভব কিনা বিচার্য।’

পিক শেষ কথা বলেছিল যে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জানাতে হবে। তা না হলে এত উদ্বাস্তুকে শনিগ্রহে নিয়ে যাওয়ার কাজটি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে।

জিনার স্বামী বেরিয়ে এসেছিল। সে পাকা খবর পেয়েছে। খবরটা সে দপ্তরে পৌঁছেও দিয়েছিল। হ্যাঁ, স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়েই সে এসেছে। জিনাকে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল।

গুপ্তচররা ঘোরাঘুরি করছিল। শহরের উপকণ্ঠে তারা পিককে ধরতে

গিয়েছিল। পারে নি। কারণ পাওয়ার নাইনের বোতামটি পিক ০০৯২ আগেই টিপে দিয়েছিল। ধরতে না পারলেও, খবর চলে গিয়েছিল প্রধান দপ্তরে। আবার তটস্থ অবস্থা।

পিক সবুজ আলোর রশ্মির বোতামটাও টিপে দিয়েছিল। ফলে নিউইয়র্কের সারা শহরের পথ দিয়ে গলা ধাতু জলস্রোতের মতন বইতে লাগল। বাড়ি, গাড়ি, অস্ত্র তৈরি যা ছিল সব গলে গিয়েছে। সমর বিভাগ তবু ক্ষান্ত নয়। তারা প্যারেড গ্রাউণ্ড ঘিরে অন্য সমরাস্ত্র নিয়ে তৈরি। জিনার স্বামীও স্ত্রীকে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন।

পিক সকল বাধা অতিক্রম করে প্যারেড গ্রাউণ্ডের দিকে আসছিল। সারা নিউইয়র্কে তীব্র হল্লা এবং উল্লাসের পরিবর্তে হাহাকার পড়েছে। লোহা বা অন্যান্য ধাতুর তৈরি বাড়িগুলো গলে গলে যাচ্ছে। সারা পথে গাড়ি নেই। মাথার ওপরে বিমান ও হেলিকপ্টার গলে গিয়ে বৃষ্টির মতন গলা তরল ধাতু নেমে আসছে। একটানা সাইরেন বেজে যাচ্ছিল। মার্কিন বিজ্ঞান পরিষদ এবং সামরিক মহল তৎপুর। এমন সময় অঘটন ঘটল। পিক ০০৯২ প্যারেড গ্রাউণ্ডে ঢুকতেই আণবিক ছররা ছাড়া হয়েছিল। মুহূর্তে পিকের শরীর চালুনির মতন ঝাঁঝরা হল। পিক ০০৯২ নিহত হয়ে প্যারেড গ্রাউণ্ডে লুটিয়ে পড়ল। স্মিথ সোল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। সমবেত বাহিনী জয়ধ্বনি করছিল।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আর এক ঘটনা ঘটল।

অমনি রকেটটি সামান্য নড়ে উঠল। তারপরেই সেই স্বর। ‘…পৃথিবীর অজ্ঞ অশিক্ষিত বন্ধুগণ, আপনারা ভুল করছেন। শনিগ্রহের মানুষের মৃত্যু নেই। পিক ০০৯২ এখন মরে পড়ে আছে। এ ওর ঘুম মাত্র। আমরা শনিগ্রহ থেকে সকল ব্যাপারটি লক্ষ্য করছি। পিককে আমরা এখনই সুস্থ করে তুলতে পারি। তাতে পাওয়ার তেরোর বিকিরণ ছাড়তে হবে সি নাইন থ্রি এক্স ফাইভ ট্রিপল জিরো ওয়ান ওয়ান রকেট থেকে। রকেটটি আপনাদের সকলের সম্মুখে রয়েছে। অসুবিধে এই, পাওয়ার তেরো ছাড়লে পৃথিবীর তামাম যানবাহন, কল-কারখানা সবকিছু অচল হয়ে পড়বে। ট্রেন থেমে যাবে। এরোপ্লেন বা শূন্যযান স্থাণুর মতন শূন্যে স্থির হয়ে থাকবে। সমস্ত পাওয়ার হাউসের কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। বিজলী কাজ করবে না। আপনারা যদি এরূপ পরিস্থিতি করতে আমাদের বাধ্য না করান তবে জিনাকে ছেড়ে দিন। ওকে রকেটের দিকে আসতে উৎসাহিত করুন। আমরা শনিগ্রহ থেকে রকেটের মাধ্যমে কথা বলছি। নির্দেশ দিচ্ছি। সেই মতন কাজ করলে পিক ০০৯২ বেঁচে উঠবে। এবং সে রওনা হবে। তার দেরি হয়ে যাচ্ছে ফিরতে… জিনা, জিনা—হে প্রিয়ভগিনী, আপনি এগিয়ে আসুন। পিক ০০৯২কে বাঁচান… বাঁচান… সোজা চলে আসুন রকেটে। সামনে রকেট… বাঁ দিকে নীল বোতাম টিপুন… দরজা খুলে যাবে… টিপুন দরজা খুলে যাবে…’

আশ্চর্য, জিনাকে আটকে রাখা যায় নি। যন্ত্রচালিতের মতন জিনা এগিয়ে গিয়েছিল। সে বোতাম টিপল। দরজা খুলে গেল। নির্দেশ মতন জিনা ভেতরে ঢুকল।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর পিক ০০৯২ উঠে বসল। দাঁড়াল। জিনা তখনও রকেটের ভেতর।

‘হে অজ্ঞ অশিক্ষিত পৃথিবীবাসী বন্ধুগণ, মনে রাখবেন উনিশ শ পঁয়ষট্টির একুশে জানুয়ারী আপনাদের পৃথিবীর শেষ দিন।’ পিক কুর্নিশ করার কায়দা করে বলছিল। ‘কোনো গ্রহ পৃথিবীর দিকে হাত বাড়ালে পাওয়ার জিরো দিয়ে আমরা পৃথিবী নিশ্চিহ্ন করব। অতএব বিদায়কালে অনুরোধ, আপনারা আমাদের প্রস্তাবটা পবিত্র মনে ভেবে দেখবেন।’ …পিক রকেটের দিকে যাচ্ছিল। কাছে যেতে জিনা বেরিয়ে এল। পিক করমর্দন করল। বলল, ‘ভগিনী জিনা, তোমার কথা শনিগ্রহের সকল মানুষকে আমি জানাব…।’

অমনি রকেটটি নিমেষে শূন্যে উঠল। সারা আকাশে আগুন জ্বলল আবার। শব্দ নেই। সাড়ে সতেরো সেকেন্ডে আকাশের আগুন নিভে গেল। সমগ্র পৃথিবী দেখল গোটা আকাশ নীল। ঘন নীল। আকাশে সন্ধ্যাতারা ফুটেছে।

.

প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, ১৯৬৪, অক্টোবর

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *