পুষ্পহার

পুষ্পহার

(এক) উপক্রম

বৈশাখশেষের মধ্যাহ্ন ম্লান নিথর হয়ে চেয়ে আছে। এসব বাড়ি ভাড়া-দেওয়ার জন্যেই তৈরি হয়েছিল বোধহয়; ঘরগুলো একেবারেই চিনা মেয়েদের চোখের পাতার মতন একরত্তি, অপরিসর। দুটো জানালার একটা খোলা যায় না, অন্যটায় রোদের তাপ থেকে বাঁচতে ভারী পর্দা টেনে রেখেছি, পাখার হাওয়ায় সেই পর্দা সামান্য থিরথির করে কাঁপছে। সিলিংফ্যান ঘোরার শব্দ ছাড়া এত বড়ো দুপুর কেমন নিঃসাড়, নিঃস্পন্দ হয়ে আছে। চৈত্র গেল, বৈশাখও যাব যাব করছে, একদিনও বিকেলবেলায় ঝড়বৃষ্টি হয়নি এবছর। বাতাস এত রুক্ষ ও গরম যে, ফ্যান চালানো বা না-চালানোর মধ্যে তফাত কিছুই নেই । বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে ঘুম আসবে না বুঝতে পেরে খাটের ওপর আসনপিড়ি হয়ে সোজা উঠে বসলাম। জানালার পর্দা সামান্য সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝতে পারছি, বিকেল হয়ে আসছে, অথচ রোদের তাপ একটুও কমেনি।

কালো পুঁতির মতন চোখওলা একটা ছাই ছাই রঙের টিকটিকি বইয়ের র‍্যাকের আড়াল থেকে আমাকে দেখছে। এই ঘর ও বিছানার ওপর বসে থাকা আমি—এই সব কিছুই টিকটিকিটার চোখে ছায়া ফেলছে নিশ্চয়ই। তবু আমার জগৎ আর ওই টিকটিকিটার জগৎ—এ দুয়ের মধ্যে মিল যতখানি আছে, অমিল তার থেকেও ঢের বেশি। আমার জগতের থেকে ভিন্নমাত্রিক কোনো বিশ্ব টিকটিকিটা দেখে চলেছে হয়তো। এ সত্ত্বেও টিকটিকির জগতের মধ্যে আমি ঢুকে বসে আছি, আর আমার জগতের ভিতর টিকটিকিটা ঢুকে বসে আছে।

এই সব স্তব্ধবাক দুপুরে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে খুব। সেসব দিন এখন কোথায়? আমার মনের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে তারা। আবার অতীতের সেই দিনগুলির ভিতর আমার আজকের দিনটা ঢুকে ছিল না কি? ছিলই তো! বীজের ভিতর যেমন ঘুমিয়ে থাকে গাছ। আজকের এই দুপুরটার মধ্যে যদি ডুব দিতে পারি, তাহলে ফেলে আসা জীবনের সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে। তখন হয়তো মনে হবে, আজকের এই দুপুরটা যতটা সত্যি, অতীতের স্মৃতিগুলোও তেমনই সত্যি—জীবন্ত।

ধরা যাক, বিশ-বাইশ বছর পরে আজ বিকেলে হঠাৎই আবার আমি চেন্নাই গিয়েছি। ধরা যাক, যা বলছি এখানে, এসব আসলেই সব সত্যি। বিশ-বাইশ বছর আগে চেন্নাইকে, তখন বলত মাদ্রাজ, সেখানে আমি ছিলাম তো বছর চারেক! তারপর একদিন সমাসন্ন সন্ধ্যাকালে সেই প্রাচীন শহর ছেড়ে চলে এসেছিলাম আমি। তারও পরে জীবনের কত পথ, কত বাঁক-বদল, কত রৌদ্রপ্রখর দ্বিপ্রহর, কত অপরাহ্ণকালীন কালবৈশাখী ঝড়, কত অশ্রুসজল সন্ধ্যার মেঘ। এতদিন পরে, জীবনের এত বিচিত্র হিসেবনিকেশ সমাধার পর, আবার কেন প্রথম যৌবনের সেই চেন্নাই শহরে ফিরে যেতে হবে?

যদি যাই মনে মনে? তাতে কার কী লাভ-ক্ষতি? সে-শহর জানে আমার প্রথম যৌবনের গৃহত্যাগী দিনগুলিকে। যখন আমি ঘর ছেড়ে এর পথে পথে ঘুরেছি। আয়তধূসর সমুদ্রতীরে বাতিঘরের নীচে বসে থেকেছি ঊর্মিমালার চোখে চোখ রেখে একা প্রহরের পর প্রহর। সমুদ্রবেলায় অতি প্রাচীন স্যান্থোম-চার্চের প্রার্থনালয়ে বিকেলবেলায় একা একা ঢুকে দেওয়ালের অনেক উপরে কারুকার্যখচিত কাচের জানালার নীচে ফ্রেশকোতে যীশুজীবনের আলোছায়ামাখা বর্ণিল সব ছবি দেখে চলেছি আপনমনে। তারপর চার্চ থেকে বেরিয়ে এসে অন্যমনস্ক পায়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন পৌঁছে গেছি অতীত পৃথিবীর গন্ধমাখা সেই মায়লাপুরম্… কপালীশ্বর মন্দির…. আজও আবার তেমন হয় না কি?

হ্যাঁ, এই তো হয়েছে! আরেহ্, কী অদ্ভুত! কল্পনায় নয়, সত্যিই তো আমি দাঁড়িয়ে আছি কপালীশ্বর মন্দিরের অঙ্গনে এখন! অবাক হয়ে সামনের গোপুরমের দিকে চেয়ে আছি। ভাবি, কীভাবে এমন সম্ভব হল? এই তো একটু আগে কলকাতায় বসে ভাবছিলাম চেন্নাইয়ের কথা। ভাবতে ভাবতে মাথার ভিতরে একটা আলোর পর্দা খুলে গেল যেই, আর তার পরেই….এসব তাহলে, বলো শুকশারি, কেমনতরো অপার্থিব ম্যাজিক?

ভাবি, স্বপ্ন দেখছি না তো? কিন্তু স্বপ্ন কি এত স্পষ্ট হয় ? ওই তো সেই প্রবেশপথে বিশাল গোপুরম! শিব-সতীর কাহিনি, গণেশ-কার্তিক-শিব-মার্কণ্ডেয়র কত বিচিত্র পুরাণকথা রূপ পেয়েছে অগণিত দক্ষিণ ভারতীয় ভাস্কর্যে—উজ্জ্বল ময়ূরকণ্ঠী নীল, অনুগ্র জর্দা, পাথুরে সবুজ, ম্লান হলুদ, জীবনানন্দীয় ধূসর, ঝিলমিল সোনালি…. নানা রঙে চিত্রিত মূর্তি সব গোপুরমের গায়ে থরে থরে ওই তো উপরে উঠে গেছে !

মন্দির তো নয়, যেন একটা সুপ্রাচীন সুরক্ষিত দুর্গ; কয়েক বিঘা জমি সু-উচ্চ পাথরের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মন্দিরচত্বরে মূল মন্দিরকে কেন্দ্র করে ওই তো ছোটো ছোটো অনেকগুলো মন্দির! কোনোটি দেবী পার্বতীর, কোনোটি গণপতির তো কোনোটি আবার মুরুগণ বা কার্তিকেয়র। ওই তো ওইদিকেই তো মন্দিরের নহবতখানা, ওখানেই তো রাত্রিদিন তালবাদ্য সহকারে গায়ক-গায়িকারা গেয়ে চলতেন ঈষৎ কম্পিত, দীর্ঘলয়িত সামুদ্রিক তরঙ্গের মতো দক্ষিণী মার্গসঙ্গীত….

কিন্তু এ কী আশ্চর্য! কই আজ সেই নহবতখানা থেকে ভেসে আসছে না তো দক্ষিণী সঙ্গীতের সুর? পরিবর্তে খুবই পরিচিত অন্য একটা গান শুনছি যে! কে যেন গাইছে—

‘আজু সখি, মুহু মুহু

গাহে পিক কুহু কুহু,

কুঞ্জবনে দুঁহু দুঁহু

দোঁহার পানে চায়।…’

কপালীশ্বর মন্দিরে বাংলা ভাষায় গান হচ্ছে? তাও আবার ভানুসিংহের পদাবলী ? এ কেমন কথা !

তাহলে নির্ঘাত স্বপ্ন দেখছি আমি। সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ কতকগুলো অভিজ্ঞতার উপাদান মনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে মিশে গিয়ে এমন একটা ‘দেখা’ তৈরি করে চলেছে। মন্দিরের প্রবেশপথের ওই বহুস্তরিত আলেখ্যমণ্ডিত গোপুরমটার মতোই। এ স্বপ্ন নয় তো কী আর ?

কিন্তু ‘আমি স্বপ্ন দেখছি’— এটা একবার বুঝতে পারলেই সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্ন ভেঙে যায়, এমনই জানি । অথচ আজ কই, ‘স্বপ্ন দেখছি’– একথা বোঝার পরেও এই স্বপ্নটা ভেঙে গেল না তো? এ তবে কেমনধারা স্বপ্ন?

স্বপ্ন শুরু হওয়ার আগে যেমন ছিলাম— কলকাতা শহরের সেই ভাড়াবাড়িতে একটা ছোটো খাটের উপর বিছানায় আসীন হয়ে মাদ্রাজের ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম—এখন সেই আগের অবস্থাটাতেই ফিরে যেতে চাইছি আমি জোর করে। ভাবটা এই—স্বপ্ন যখন আমিই দেখা শুরু করেছি, তখন এ স্বপ্ন ভেঙে ফেলার ক্ষমতাও আমারই আছে। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও আগের সেই অবস্থাটায় কিছুতেই ফিরে যেতে পারলাম না আর। চোখের সামনে কপালীশ্বর মন্দিরের দৃশ্য, যেমন ছিল তেমনই জ্বলজ্বল করতে লাগল ।

নিজের উপর প্রথমে বড়ো বিরক্তিবোধ হল। মন আমার কথা না শুনে এসব কীসব দেখাচ্ছে, এই কথা ভেবে। তারপরেই খুব ভয় হল আমার। তাহলে কি এই স্বপ্নের মধ্যে আটকে থেকে যেতে হবে আমাকে অনন্তকাল? রূপকথার সোনার কৌটোয় যেমন আটকে থাকে রাক্ষসের প্রাণপাখি?

ভয় জিনিসটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বারবার চেষ্টা করেও যখন কিছুতেই আগের অবস্থায় ফেরা যাচ্ছে না, তখন স্বপ্নটাকে মেনে নেওয়াই যাক, মনে হল । তা ছাড়া তো এখন অন্য কোনো উপায়ও নেই আর আমার হাতে।

দেখলাম, বিকেল হয়েছে। গোপুরম পেরিয়ে পুজো দিতে আসছেন কত সুবেশ নারীপুরুষ। পুরুষদের পরনে প্রায়শই মোটা পাড়ের মুক্তকচ্ছ বস্ত্র, গায়ে উত্তরীয় জড়ানো কপালে ভস্মকুঙ্কুমের প্রলেপন। মেয়েরা অলংকৃত পাড়ের শাড়ি পরে আছেন। তাঁদের দুই নাসাপুটে উজ্জ্বল মুক্তার নাসাভরণ, বৃদ্ধা কিংবা যুবতী—সকলেরই বিনুনিতে বেলিফুলের মালা, অনেকের মুখমণ্ডল হরিদ্রাচূর্ণে চর্চিত। সঙ্গে পূজার সামগ্রী ভারী কাঁসার থালায় সাজানো। গোপুরমের নীচ দিয়ে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে স্তিমিত স্বরে স্তোত্রাদি আবৃত্তি করতে করতে তাঁরা যাচ্ছেন মন্দিরের দিকে। কান পেতে শুনছি সেই সুস্বর উচ্চারণ। কেউ পড়ছেন ললিতা-সহস্রনাম, কেউ-বা শিবতাণ্ডবস্তোত্র। মন্দিরের দরজার সামনে গিয়ে দুই হাতে কর্ণমুল ধরে উঠবোস করে তাঁরা প্রণাম জানাচ্ছেন দেবতাকে এখানকার প্রচলিত প্রথামাফিক।

প্রথমে আমার মন আমাকে বলেছিল, ‘ভয় করছে। আটকে পড়লাম না তো চিরকাল ? খানিক পরে মন বলল, ‘আচ্ছা, এর থেকে যখন চেষ্টা করেও আর বেরোতে পারছি না, মেনেই নেওয়া যাক তবে এই অবস্থাটা। নিজের থেকে যদি এ স্বপ্ন ভাঙে তো ভাঙুক!’ এখন মনের সেই অসহায় অবস্থাটাও দেখছি চলে গেছে। মন এখন বলছে, ‘আচ্ছা, হতেও তো পারে এমন যে, অসম্ভবটাই সম্ভব হয়েছে। আচম্বিতেই না হয় এসে পড়া গেছে মাদ্রাজে। হয়তো এটা কল্পনা নয়, স্বপ্ন নয়; হয়তো এটাই সত্যি। চলুক না, যেমন চলছে চলুক। কী হবে কী কলকাতার সেই শ্রীহীন ঘরে ফিরে গিয়ে? তার থেকে এই মাদ্রাজে থেকে যাওয়াই ভালো। শতগুণে ভালো।’

বাচাল মন এসব বলছে ঠিকই। কিন্তু ওর বাচালতার উত্তরে আমি কিছুই বলছি না । নিষ্পলক চেয়ে আছি ওর দিকে। কত কী বলে সারা দিন ! কত কী দেখায় ! আমি অবশ্য কখনোই কিছু বলি না, শুধু দেখি। গ্রীষ্মদুপুরের বাতাস বেয়ে ভেসে আসা উদাসী আজানের মতো আমি নিঃসঙ্গ…চির একাকী। আমি—স্থির, চির নীরবতা।

মূল মন্দিরের দেওয়াল মোটা পাথরের। সেই দেওয়ালের গায়ে খোদিত বিশাল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম। অল্প আলো, আধেক অন্ধকারের ভিতর দুলছে রাবণরাজার মুকুটের মতন সব প্রাচীন পিত্তলের ঘণ্টা। মন্দিরের ছাদ থেকে প্রলম্বিত এই সব বিশালকায় ঘণ্টাসমূহ দর্শনার্থীদের হাতের টানে দুলে দুলে উঠছে মাঝে মাঝে। আলো-আঁধারির মধ্যে জেগে উঠছে বিরহাতুর আত্মার দীর্ঘস্বরিত আর্ত বিলাপধ্বনি ট..অ..ম্, অ..উ..ম্‌, ও….ম্!

এই ঘণ্টাশ্রেণীর পর, এখান থেকেই আবছা দেখা যায়, মন্দিরের গর্ভগৃহটি। মেঝে থেকে ধাতব পাতে মোড়া সোপান উঠে গেছে উপরে। গ্রিক বীর স্পার্টাকাসের বুকের বর্মের মতন ধাতব দ্বারপথ গর্ভমন্দিরের। তার ভিতরে গূঢ়তর পরামর্শের মতন রহস্যময় অন্ধকার । কেবল ছাদের থেকে দীর্ঘ পিতলের জিঞ্জির দিয়ে ঝোলানো কতগুলো ইতস্তত তামার প্রদীপ জ্বলছে। তাদের আলোর ইশারা যেন চোখ টিপে আমাকে বলছে, ‘হ্যাঁ, এখানেই… এখানেই তো… এখানেই… ইহৈব ! ‘

কর্পূর-অগুরুর সুঘ্রাণে গন্ধমধুর সেই অন্ধকার। কখনও গর্ভমন্দিরের ভিতর পূজারীদের কেউ আরতিদীপ তুলে ধরছেন নীচ থেকে ওপরে। প্রদীপের সেই ঊর্ধ্বমুখী আলোয় একবার দেখা দিয়েই, পরম ব্যাকুলতা সূচীত করে পরক্ষণেই চকিতে নিভে যাচ্ছে পার্বতীপতির কমনীয় মুখশ্রী ।

এই গর্ভমন্দিরের চারিপাশে স্বল্পপরিসর প্রদক্ষিণপথ। এই পথ গর্ভগৃহটিকে বেষ্টন করে আছে, শিবলিঙ্গকে যেমন আবেষ্টন করে থাকে গৌরীপীঠ। স্বপ্নালোকিত পন্থা । আলো আছে যে, তা খেয়াল হয় না। পথের পাশে দেওয়ালের সারি সারি কুলুঙ্গিগুলোতে পর পর সুসজ্জিত তেষট্টিটি কালো কষ্টিপাথরের মূর্তি। মূর্তিগুলি ক্ষুদ্রাকার, এক হাত বা তার চেয়ে সামান্য বেশি উচ্চতা হবে। কেউ নারী, কেউ-বা পুরুষ। প্রত্যেকের পরনেই দক্ষিণভারতীয় ক্ষৌম বস্ত্র, গলায় সাদা ফুলের মালা। সিন্দূর-চন্দনে তাঁদের পূজা হয়েছে। এঁরা তেষট্টিজন শৈব নায়ানমার সাধক-সাধিকা। সাধ্বীদের পরনে অরুণবর্ণ বস্ত্রাবরণ। বস্তুত সকলেই শৈব কবি। কারও কাঁধ অবধি প্রলম্বিত কবিজনোচিত কেশভার। কেউ-বা মুণ্ডিত মস্তক। কেউ বেশ ঘনজটিল কেশশ্মশ্রু-সমন্বিত। কেউ-বা পরিষ্কারভাবে ক্ষৌরিত। কেউ স্থূল তো কেউ শীর্ণাকার। কেউ বালক বা বালিকার মতন সহাস্য, কারও আনন প্রসন্নগম্ভীর। কবিসাধিকাদের আলুলায়িত কুন্তল। শ্রীঅঙ্গে মুক্তার আভরণ। মূর্তিগুলির নীচে তামিল হরফে তাঁদের নাম লেখা। তিরুজ্ঞানসম্বন্ধর, মানিক্যবাসগর, সুন্দরর, কারাক্কাল আম্মাইয়া…। প্রত্যেকের সামনে একটি করে প্রায় তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘিয়ের প্রদীপ। এঁদের মধ্যে একজনের অবয়ব ঠিক ঋষির মতন। পাথরের পুথিতে পাথরের লেখনী দিয়ে কী যেন লিখছেন তিনি গভীর মনোযোগে। মুখে চিন্তার রেখা। ইনি কবি তিরুভাল্লুভার। এঁর দ্বারা প্রণীত কাব্যগ্রন্থটিরই নাম তিরুককুরল। তৃতীয় সঙ্গম যুগের অন্তিম নিদর্শন সে-কাব্য পৃথিবী-বিখ্যাত ।

যেন এই স্বপ্নাচ্ছন্ন প্রদক্ষিণপথের পাশে আজ কবিসম্মেলন বসেছে। যেন এই সব প্রাচীন কবিরা পরস্পর সানন্দে কাব্য-আলোচনা করে চলেছেন।

প্রণাম জানিয়ে মূল মন্দির থেকে বেরিয়ে এলাম। মন্দিরের ছাদে অনেক উপরে কোথা থেকে সুর টেনে টেনে একটা ঘুঘুপাখি ডেকে চলেছে স্বপ্নবিজন অপরাহ্ণবেলায়…. ঘু-উ, ঘু-উ!

মন্দিরচত্বরে এসে নামতেই কানে এল নহবতখানা থেকে ভেসে আসা গানের সুর। না, এবার আর ভানুসিংহের পদ নয়, তামিল কোনো গানের সুর। গান পালটে গেছে এর মধ্যেই।

গোপুরম্ দিয়ে রাজপথে বেরিয়ে এলাম। শেষবেলার তামাটে আলো ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। রাস্তার দুপাশে দোকান। তুলসিপাতা, বেলপাতা, জুঁইফুল আর পূজার অন্যান্য সামগ্রীর সব দোকান। রাস্তার ওধারে প্রকাণ্ড হোর্ডিং। দক্ষিণী সিনেমার বিজ্ঞাপন। প্রায়শই রজনীকান্ত-এর নানা ভঙ্গিমার ছবি। দোকানের সাইনবোর্ডে জড়ানো জড়ানো গোলাকার তামিল বর্ণমালা । খানিকটা এগিয়ে রাস্তার পাশে মামুলি একটা কফির দোকান। কানা-উঁচু বাটিতে কফিভর্তি টাম্বলার নিয়ে মানুষজন আয়েশ করে খাচ্ছে। আমিও একটা কফির অর্ডার দিলাম। চতুর্দিকে দুর্বোধ্য তামিল ভাষায় বার্তালাপ, কখনও-বা বাদানুবাদ চলছে।

কফি খেতে খেতে ভাবছিলাম, আমার এখন যা হয়েছে, এটা তো ঠিক স্বপ্ন নয় । স্বপ্ন-চলাকালীন কখনও পূর্ববর্তী জাগরিত দশার স্মৃতি থাকে না। আমার কিন্তু দিব্যি মনে আছে, কপালীশ্বর মন্দিরে এসে পড়বার কয়েক মুহূর্ত আগেই আমি কলকাতায় খাটের উপর বসে ছিলাম। অথচ স্বপ্ন দেখার সময়ে যেমন স্বপ্নটাকেই সত্যি মনে হয়, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই-ই হচ্ছে। এই পথ-ঘাট-মন্দির, দৃশ্য-শব্দ-ঘ্রাণ সব সত্যি বলেই মনে হচ্ছে আমার। সত্যি সত্যিই মাদ্রাজে এসে পড়েছি, মনে হচ্ছে। অর্থাৎ আমার এ অবস্থাটা স্বপ্নের মতনই খানিকটা, আবার ঠিক স্বপ্নের মতনই নয় হুবহু। স্বপ্নের সঙ্গে প্রচুর সাদৃশ্য আছে, আবার স্বপ্নের সঙ্গে এর বৈসাদৃশ্যও প্রচুর। আমার ঠিক কী হয়েছে, কে জানে!

হঠাৎ কানের কাছে আমার নাম ধরে পরিষ্কার বাংলা ভাষায় কে যেন বলে উঠল, ‘আরে, স্বয়ম যে ! চেন্নাইতে কবে এসেছ? তুমি যে একেবারে ভোল পালটে ফেলেছ হে স্বয়ম!’

চমকে উঠে পেছন ফিরে চেয়ে দেখলাম। সেই চিরপরিচিত প্রায়-চতুষ্কোণ মুখাবয়ব। কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। আমার দিকে হাসি হাসি মুখে উজ্জ্বল চোখে চেয়ে আছেন বাসবান্না ।

(দুই) বিতর্ক

এম বাসবেশ্বরণ। আমরা কেউ তাঁকে ডাকতাম, বাসুদা। কেউ-বা বলতাম, বাসব আন্না । কিংবা আরও সংক্ষেপে বাসবান্না। তমিড় ভাষায় ‘আন্না’ শব্দের অর্থ দাদা। আমার সঙ্গে বাসবান্নার আলাপ আজ তো নয়, সে বহুদিন হল । আজকের দিনটাকে যদি ধরি, তাহলে বাসবান্নার সঙ্গে আমার আলাপ হতে যাচ্ছে জীবনের তৃতীয় পর্বে।

সে কত দিন আগের কথা। আমরা তখন ইউনিভার্সিটির বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে ছাত্র। ল কলেজের পেছনে একটা চায়ের দোকান ছিল তখন। সেখানেই বাসবান্নার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়। জন্মসূত্রে বনেদি তামিল পরিবারের সন্তান হলেও বাসবান্না বড়ো হয়েছিলেন কলকাতায়। উচ্চারণে একটা দক্ষিণী টান ছিল ঠিকই, কিন্তু খুব মন দিয়ে না শুনলে সেটা বোঝা যেত না। বাংলা বলতেন বাঙালিরই মতন। ল কলেজের ক্লারিকাল সেকশনে চাকরি করতেন বাসুদা ওরফে বাসবান্না। অসম্ভব ভালো গল্প বলতে পারতেন তিনি। আর গল্প বলতেন একেবারে আলংকারিক বাংলায়। ওঁর প্রতি আমাদের আকর্ষণের সেটাই মুখ্য হেতু। কতদিন বাসুদাকে নিয়ে আমরা ক-জন হাঁটতে হাঁটতে আর তাঁর গল্প শুনতে শুনতে বিকেলের আলো গায়ে মেখে হাজরার মোড় অবধি চলে যেতাম। বাসবান্নার গল্পের সব সময়েই একটা কোনো ভ্যালিড সোর্স থাকত, হয়তো কোনো পুরাণ কিংবা প্রাচীন কোনো আখ্যান বা মিথ। কিন্তু বাসবান্না সোর্স-এর সেই গল্পটা অবিকল বলতেন না কখনও। নিজের মনের কল্পনা মিশিয়ে মূল আখ্যানের সঙ্গে অনেক নতুন উপ-আখ্যান বুনে দিতেন। কখনও-বা গল্পটা বলতেন মূল আখ্যানের কোনো অপ্রধান চরিত্রের দিক থেকে। তাতে চেনা গল্প শুনতে গিয়েও অচেনার আস্বাদ পাওয়া যেত। আলিবাবা ও চল্লিশ চোরের বিখ্যাত গল্পটা কেউ যদি বুড়ো দরজি বাবা মোস্তাফার দিক থেকে বলে, তাহলে যা হয় আর কি!

তারও পরে কত দিন গেছে। বাসবান্নার সঙ্গে আমার দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা হয়েছিল বিশ-বাইশ বছর আগে, ঘর ছেড়ে আমি তখন পথে নেমেছি, চলে এসেছি এই মাদ্রাজ শহরে। আমি তখন ধুতি আর ফতুয়া পরি, মাথা কামিয়ে একটা টিকি রেখেছি; সংস্কৃতে যাকে বলে ‘শিখা’ আর তামিলে বলে ‘কুড়মি’। দেখা হয়েছিল পি এস শিবস্বামী সালাই-এ একটা দোকানের সামনে। শুনলাম, বাসবান্না নাকি ততদিনে কলকাতা ছেড়ে পাকাপাকিভাবে ফিরে এসেছেন মাদ্রাজে তাঁর পৈতৃক আবাসে। মাদ্রাজ ক্রিশ্চান কলেজে চাকরি নিয়েছেন। আমাকে গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর বেশে দেখে অবাক হয়েছিলেন, তবে খুশিও হয়েছিলেন খুব। মাঝে মাঝে ওঁদের বাড়িতে যেতাম আমি। সেই একই গল্প শোনার আকর্ষণে।

আর আজ এই তৃতীয় পর্যায়ে কপালীশ্বর মন্দিরের সামনে যখন বাসুদার সঙ্গে দেখা হল, তখন আমার পরনে প্যান্ট আর তার ওপর একটা লম্বা ঢোলা পাঞ্জাবি, মাথায় অবিন্যস্ত চুল—সঙ্গত কারণেই বাসবান্না চমকে উঠে বলে ফেলেছেন, তুমি যে একেবারে ভোল পালটে ফেলেছ হে স্বয়ম!’

এ মুহূর্তে আমরা বসে আছি বাসুদার বাড়ির বৈঠকখানায়। ঠিক কখন যে, কীভাবে যে কপালীশ্বর মন্দির থেকে বাসবান্নাদের সিআইটি কলোনির বাড়িতে এসে পড়লাম, মনে করতে পারছি না। ঠিক যেন এক লহমায় ! ছমছমে রহস্যময় ।

পুরোনো কার্পেটে মোড়া মেঝে, পুরোনো দেওয়ালে অনেকগুলো প্রাচীন দেবদেবীর বাঁধাই করা ছবি, মধ্যে মধ্যে দেওয়ালে ড্যাম্প লাগার দাগ, উঁচু ছাদ থেকে নেমে আসা সাবেক আমলের সিলিংফ্যান, ঘরের জানালায় জানালায় মাদ্রাজের দুর্ধর্ষ গরম থেকে বাঁচতে খসখসের আবরণ, ঘরের এককোণে আধমানুষ-সমান উঁচু ময়ূরের মুখওলা পিতলের প্রদীপদান, দেওয়ালজোড়া আবলুসকাঠের ভারী বুককেস, জলপাই রঙের টেবিলক্লথে ঢাকা ছোটো এই টেবিল, কয়েকটা সোফা, একটা আর্মচেয়ার, জীর্ণ কয়েকটা বেতের আসন—এ ঘর আমার চেনা—যেমন ছিল আগে, তেমনই আছে। টেবিলের ওপর জলভরা কাঁসার ফুলদানি আর রঙিন পাথরের পেপার-ওয়েটটি পর্যন্ত। আরেক প্রস্থ কফি এসেছে। সঙ্গে মেদুবড়া কয়েকটা। কফির পাত্রে চুমুক দিয়ে বাসবান্না স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হেসে আমাকে শুধোলেন, ‘ভোল পালটালে কবে?’

‘বছর সাতেক তো হলই,’ আমি উত্তর দিলাম।

‘কেন?’ বাসুদা জিজ্ঞেস করলেন।

‘মঠ আমি ছেড়ে দিয়েছি, বাসবান্না!’ বললাম।

“বুঝলাম। মঠ ছেড়েছ, মনটাকেও কি পালটে ফেলেছ ? সাধুজীবনও কি ছেড়ে দিয়েছ তুমি ?”

‘না, বাসবান্না। মঠই ছেড়েছি। মনটা পালটাইনি। ভেতরের জীবন পালটাতে পারিনি।’ বাসবান্না এলানো অবস্থা থেকে এবার সোজা হয়ে বসলেন। কোমল স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে পোশাক বদলালে যে?”

‘কী করব, বাসবান্না ? ব্রহ্মচারীর সাদা কাপড়ই হোক আর সন্ন্যাসীর গেরুয়া কাপড়ই হোক, সেসব পরে মঠের বাইরে ঘুরে বেড়ালে লোকজনের চোখ খুব টানে। তাই সাধারণ পোশাকেই থাকি,’ আমি উত্তর দিলাম।

‘তাও ঠিক। কিন্তু মঠবাস ছেড়ে দিলেই বা কেন তুমি?’ বাসবান্না প্রশ্ন করেন।

‘সে অনেক কথা, বাসুদা। আপনি তো জানেন আমি কম বয়েস থেকেই লেখালিখি করতাম!’

‘তো?’

‘একটা সময় এল, যখন কবিতা বা প্রবন্ধ লেখা ছেড়ে গল্প, উপন্যাস লিখতে শুরু করলাম। সেসব গল্প লেখা মঠের সাধুর উপযোগী কাজ বলে বিবেচিত হল না । মঠের অনুরাগী ভক্তরা আপত্তি জানাতে লাগলেন।’

কফির পাত্রে আবার দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বাসবান্না বললেন, ‘তার মানে কী? তুমি কি অশালীন জিনিসপত্তর লিখছিলে নাকি? তোমাকে যতদূর জানি, তা তো তোমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই মনে হয়, স্বয়ম। তাহলে আপত্তি উঠল কেন?’

আমি বললাম, ‘দেখুন, বাসবান্না। শ্লীল-অশ্লীলের বিতর্ক খুব পুরোনো। তবু অশ্লীল বলতে সচরাচর যা বোঝায়, তেমন কিছুই আমি লিখিনি। সাধারণ মানুষের বহমান জীবন নিয়েই গল্প লিখেছিলাম কতকগুলো । এখন আমাদের গল্পসাহিত্যে তো জীবনের কোনোকিছুই বাদ দিয়ে লেখা সম্ভব নয়। ওরকম ‘স্ত্রীভূমিকা-বর্জিত নাটক’টাইপের কিছু লেখা খুবই কৃত্রিম ব্যাপার। সাহিত্যে মানুষের জীবন, তার সংকট, মনস্তত্ত্ব, প্রেম, যৌনতা, রাজনীতি, হতাশা, অত্যাচার, প্রতিরোধ, অবদমন…এই সবই তো আসবে। শুধু আসবেই নয়, এগুলো অত্যন্ত জরুরি। এসব বাদ দিয়ে কী লেখা হবে? কিন্তু মঠে বসে এগুলো লেখা কি ঠিক?’

বাসবান্না তীক্ষ্ণভাবে আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘কেন ঠিক নয় ?’

“ঠিক নয়, কেননা মঠে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সন্ন্যাসী। এসব বিষয়ে তো সন্ন্যাসীর আগ্রহ থাকতে পারে না। মানে থাকা উচিত নয়। সেরকমই অন্তত সবাই ভাবেন,’ আমি বললাম।

‘কেন? গ্রেগর জোহন মেন্ডেল নামক ভদ্রলোকটি সেন্ট থমাস অ্যাবে-র ক্যাথলিক সন্ন্যাসী হয়ে আধুনিক বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিক্সের জনক হতে পারলেন আর তুমি একটা মঠে গেরুয়া-পরা হিন্দু সাধু হয়ে থেকে সাহিত্যচর্চা করতে পারলে না ?’বাসবান্নার কণ্ঠস্বরে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ল।

আমি বললাম, ‘ও বাসুদা! সে তো অস্ট্রিয়া। তায় আবার ক্রিশ্চানিটি। আমাদের হিন্দুধর্মের ইতিহাসে সন্ন্যাসীরা এসব অব্যাপারেষু ব্যাপার করলে… সেটা তো…’

আমার মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বাসবান্না উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘তুমি হিন্দুধর্মের জানোটা কী, বাপু? আর যেটুকু জানতে, তাও কি ভুলে মেরেছ? বলি, বিদ্যারণ্যমুনির কথা মনে নেই তোমার? তিনি হরিহর আর দ্বিতীয় বুক্কর মন্ত্রিত্ব করলেন, বিজয়নগর সাম্রাজ্যকে সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন, মনে নেই? গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, রাজনীতি—এসব আরও নানা বিষয়ে তাঁর যা লেখাপত্তর আছে, তা দেখলে তো ভিরমি খাবে! শুধু বিদ্যারণ্যমুনির রচনা দিয়েই একটা লাইব্রেরি ভরে যায়। তো এসব কি সমস্ত আধ্যাত্মিক ব্যাপার নাকি হে? শৃঙ্গেরী মঠের মঠাধ্যক্ষ দশনামী সন্ন্যাসী হয়ে মাধব বিদ্যারণ্য তা হলে এগুলো লিখলেন কীভাবে?’

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘সে যাই বলুন, সেসবও তো বিজ্ঞান, অর্থনীতি, দর্শন, রাজনীতি। সাহিত্য তো নয়। আমাদের দেশে সাধুসন্ন্যাসী মানুষ গল্প-উপন্যাস লিখলে, প্রেমের কবিতা লিখলে সমাজে তো একটু তোলপাড় পড়ে যায়ই।’

বাসুদার গলায় আক্ষেপ ঝরে পড়ল, ‘তোলপাড় পড়ে আজকের দিনে হে ! আগে হলে পড়ত না ৷ যেহেতু আজ আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসটাই ভুলে গেছি। ভুলে গেছি এদেশের ঐতিহ্য। এদেশে লৌকিক আর লোকোত্তরে বিরোধ কোনোদিনই ছিল না। এসব পরবর্তীকালের পিউরিটানদের আমদানি। তুমি ইলাঙ্গো আডিগল-এর নাম শুনেছ?’

আমি নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, ‘না, বাসবান্না। আমি এঁর কথা শুনিনি। কে ইনি?’

বাসবান্না এবার চেয়ারে এলিয়ে বসে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইলাঙ্গো আডিগল হচ্ছেন একজন জৈন সন্ন্যাসী। ‘আডিগল’ শব্দের অর্থ উত্তর ভারতে যেমন হিন্দি বা সংস্কৃতে বলা হয় ‘স্বামী’, সেই একই অর্থ। সন্ন্যাসীদের নামের সঙ্গে যুক্ত থাকে অভিধাটি। এই ধরো, কোনও সাধুর নাম হল সচ্চিদানন্দ স্বামী। ওরকমই এই জৈন সাধুর নাম ইলাঙ্গো আডিগল। কঠোর তপস্যার জন্য ইলাঙ্গোকে এই ‘আডিগল’ উপাধি দেওয়া হয়। যাই হোক, তাঁর নামটি স্মরণীয় হয়ে আছে তামিল মহাকাব্য ‘শিলপ্পদিকরম’-এর কবি হিসেবে। শিলপ্পদিকরম আর মণিমেখলাই—এই দুটো হচ্ছে তামিল এপিক। তার প্রথমটা ইলাঙ্গো আডিগলের লেখা। বুঝলে, কী বলতে চাইছি ?”

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, বুঝেছি। আপনি বলতে চাইছেন, কঠোর তপস্বী ইলাঙ্গো আডিগল যদি সন্ন্যাসী হয়েও মহাকাব্য লিখতে পারেন, তাহলে আমিই-বা কেন মঠে সাধু হয়ে থেকে গল্প-উপন্যাস লিখতে পারলাম না? কিন্তু আমাদের এখনকার সময়টাকেও তো বিবেচনা করতে হবে, নাকি ?’

বাসবান্না হাসতে হাসতে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘তা সময়টা কি পিছোচ্ছে না এগোচ্ছে, ভাই? এই ইলাঙ্গো আডিগল হচ্ছেন সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক অর্থাৎ কিনা সেকেন্ড সেঞ্চুরির শেষের দিকের মানুষ। চেরদেশ অর্থাৎ কেরালার রাজা শেঙ্গুত্থুবানের ভাই তিনি। রাজ্য পরিত্যাগ করে ইলাঙ্গো জৈন সাধুদের মঠে সন্ন্যাসী হন। এবং সন্ন্যাসজীবনে স্থিত থেকেই তিনি এই মহাকাব্য শিলপ্পদিকরম রচনা করেন, যা কিনা কবিতায় লিখিত দীর্ঘ একখানা উপন্যাস ছাড়া আর কিছুই নয়। এসব হল গিয়ে তোমার সেকেন্ড সেঞ্চুরির ব্যাপার! আর আজ ইলাঙ্গোর সময়ের থেকে আঠেরোশো বছর পরে এই প্রগতিশীল একুশ শতকে এসে তোমরা কিনা বিচার করতে বসেছ, একজন মঠের সাধুর পক্ষে গল্প-উপন্যাস রচনা করা বৈধ না অবৈধ! ছি-ছি, শেম আপন ইয়োর সো-কলড প্রগ্রেস, ব্রাদার!’

বাসবান্নার কথায় বিদ্রূপের ঝাঁজ ও ক্ষোভ ঝরে পড়ছিল। মুশকিল হল, ইলাঙ্গো আডিগল ও শিলপ্পদিকরম—এ দুয়ের কোনোটাই আমার জানা জিনিস নয়। তাই কিছুটা তো-তো করে বললাম, ‘ইলাঙ্গো আডিগলের লেখা যখন, তখন এই শিলপ্পদিকরম নিশ্চয়ই কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ গোছের কিছু, নাকি?’

‘মোটেই নয়,’ চোখ গোল গোল করে বলে উঠলেন বাসবান্না, ‘শিলপ্পদিকরম-এ সেকালের সমাজ, বাণিজ্য, রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য, মানবিক প্রেম, সৌন্দর্যচেতনা, শারীরিক উন্মাদনা, যৌনতা, বেশ্যাবৃত্তি, বিচ্ছেদ, বিরহ—সমস্তই স্থান পেয়েছে। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে এক জৈন সন্ন্যাসিনী কাভুন্দি পরের দিকে এসেছেন বটে, কিন্তু তা খুবই অল্প সময়ের জন্যে।’

আমার মন আমার দিকে চোখ মটকে প্রশ্ন করল, ‘আরও বিতর্কে জড়াবে, নাকি গল্প শুনবে? তক্কো চাও, নাকি গপ্পো চাও ?’ বিশেষত বাসবান্নার কথার মধ্যেই একটা গল্প শোনার আমন্ত্রণ টের পেলাম। আহার, নিদ্রা প্রভৃতি আদিম প্রবৃত্তির মতো গল্প শোনার ইচ্ছেটাও মানুষের এক আকর্ষণীয় অপ্রতিরোধ্য আদিম প্রবৃত্তি। তবু সেই প্রবৃত্তিটাকে খানিক অবদমিত করে প্রশ্ন করলাম, ‘শিলপ্পদিকরমকে আপনি এপিক বলছেন?’

‘হ্যাঁ, বলছি। শুধু আমিই না, আমি তো নিতান্ত সাধারণ মানুষ, অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিই সেকথা বলেছেন। যদিও তা নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। সংস্কৃত ভাষায় যেমন রামায়ণ বা মহাভারত, দ্রাবিড় ভাষায় তেমনই শিলপ্পদিকরম ও মণিমেখলাই। কিন্তু মজা কী জানো, বেশির ভাগ সংস্কৃত কাব্য বা মহাকাব্য প্রধানত রাজা-রাজড়া বা রাজবংশের কাহিনি, সেখানে এই দুই তামিল এপিক শিলপ্পদিকরম ও মণিমেখলাই সাধারণ নাগরিকের জীবন-উপাখ্যান। উপরন্তু মণিমেখলাই হচ্ছে শিলপ্পদিকরম-এর সিকুয়েল। দ্বিতীয় কাহিনিটা প্রথম কাহিনিরই অনুক্রম। বণিক শাত্তান দ্বিতীয় মহাকাব্যটি লেখেন ইলাঙ্গোর অনুমতি নিয়েই। সন্ন্যাসী ইলাঙ্গোর লেখা শিলপ্পদিকরম যেখানে প্রেমকথা, গৃহী শাত্তানের লেখা মণিমেখলাই সেখানে বৈরাগ্যকাহিনি। আশ্চর্য বৈপরীত্য!’

গল্প শোনার প্রবৃত্তিটাকে আর চেপে রাখা যাচ্ছে না। বললাম, ‘শিলপ্পদিকরম-এর গল্পটা আমাকে বলবেন নাকি, বাসবান্না ?’

বাসবান্না হেসে বললেন, ‘তুমি শুনতে চাইলে বলব বই-কী! কিন্তু জানোই তো, আমি তো আবার গল্পগুলো একটু নিজের মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে বলি।’

বললাম, ‘তা হোক গে। আমার তো আর মূলে গিয়ে শিলপ্পদিকরম পড়া হবে না । আমি তামিল ভালো জানি না। আপনার মুখেই শুনি ।’

বাসবান্না এবার বেশ গুছিয়ে বসলেন। এ সেই কথকচূড়ামণি বাসবেশ্বরণ, যাঁর গল্প আমরা দিনের পর দিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনেছি। গল্প বলার সঙ্গে সঙ্গে মুখচোখের ভঙ্গিমা তাঁর বদলে বদলে যায়। তিনি নিজেই তখন গল্পের চরিত্র হয়ে উঠতে থাকেন ।

বাসবান্না আরম্ভ করলেন, ‘আজ নয়, সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। কাবেরী নদীতীরে পুষ্পহার নামে এক বর্ণাঢ্য নগরী ছিল। কাবেরী সমুদ্রগামিনী, তাই সাগর থেকে নদীপথ দিয়ে কত বাণিজ্যতরী এসে লাগত এই পুষ্পহার বন্দরে। গ্রিস থেকে, রোম থেকে, মিশর থেকে, আরও কত দূর দেশ থেকে বণিকেরা আসতেন তখন ভারতবর্ষে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। সে-সময় পুষ্পহার বন্দর ছিল ভারতে প্রবেশের অন্যতম সিংহদ্বার। এই নগরীতেই বাস করতেন এক বিত্তবান বাণিজ্যতরীর অধিকারী, নাম তাঁর মানাইক্কন। মানাইক্কনের কিশোরী মেয়ে কন্নকী; রূপে সে যেন থির বিজুরি, যেন এক দ্রাক্ষালতার শাখা, যেন কোন অমূল তরুর ফুল, তার অঙ্গে অঙ্গে বিষাদের আশ্চর্য মর্যাদাঘন লাবণ্য…’

অলংকৃত ভাষায় বাসবান্না গল্প বলে চলেন স্বকীয় ভঙ্গিমায়। বাইরে নিশ্চয়ই বিকেল গাঢ় হয়ে সন্ধে নেমেছে। অথবা এই ঘোরের মধ্যে সময়ের হিসেব নেই কোনো। আমি সম্মোহিত হয়ে বাসবান্নার গল্প শুনতে লাগলাম। এর আগেও কত অসংখ্যবার বাসবান্নার গল্প শুনেছি। অনন্য তাঁর গল্পকথন, কিন্তু আজকের গল্পবলাটি যেন অন্যরকম। আজ আমি শুধু শুনছিলামই না, দেখছিলামও। যেন বাসবান্নার সেই প্রাচীনকালের সুগন্ধিত উপাখ্যান আমার চোখের সামনে পুনরভিনীত হয়ে চলছিল। আমি শুনতে পাচ্ছি বাসবান্নার মন্দ্রস্বরে উচ্চারিত শব্দাবলী, কিন্তু বাসবান্নাকে আর আমি দেখতে পাচ্ছি না। পরিবর্তে চোখের সামনে দেখছি আমি সেই বিগত সময়কে; সেই সময়ের সমৃদ্ধি ও বেদনা নানা চরিত্রের রূপ ধরে একেবারে আমার চোখের সামনে উঠে দাঁড়াচ্ছে, হেঁটে বেড়াচ্ছে, কথা বলছে, প্রণয়লীলায় আবদ্ধ হচ্ছে, বিষম বিষাদে পরস্পরকে আঘাত করে দূরে সরে যাচ্ছে, পুনরায় মিলিয়ে যাচ্ছে আমার মনের মধ্যেই। বুঝতে পারছিলাম, এ কোনো সাধারণ গল্প আমি শুনছি না, এ যেন কেমন ঘোরের মধ্যে, ঘুমের মধ্যে, আচ্ছন্নতার ভিতর জেগে ওঠা এক আশ্চর্য প্রহেলিকা। যেন কোনো নাগরদোলায় চেপে ঘুরতে ঘুরতে একবার ওপর থেকে, একবার নীচ থেকে, একবার পাশ থেকে দেখে চলেছি জনসমাগমে সমৃদ্ধ এক উৎসবমুখর গ্রাম্য মেলা, দূরের মাঠ, শহর, জনপদ, দিগন্ত, আকাশকে খণ্ড খণ্ড করে অন্তহীন। আর দেখতে দেখতে শুনতে পাচ্ছি, কোথায় যেন অদৃশ্য হয়ে থেকে সুগভীর স্বরে বাসবান্না গল্প বলে চলেছেন…..

বাসবান্নার সেই কথনকে তাই আমি এখন থেকে মুক্তি দিলাম উক্তি চিহ্নের বন্ধন (“ ”) থেকে। যেভাবে তিনি গল্প শোনাতে চান, সেভাবেই গল্প শোনান। যেভাবে গল্প দেখাতে চান, সেভাবেই গল্প দেখান। শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে লাগলাম… শেষে যেন অনুদ্ধারণীয়ভাবে মিলিয়ে গেলাম সুপ্রাচীন সেই আখ্যানমঞ্জরীর ভিতর।

(তিন) মণিকণ্ডন

অতি দূর সমুদ্রপারের দেশ থেকে পুবালি বাতাস আর পশ্চিমি ঝঞ্ঝার ঝাপটা কাবেরীর স্রোত বেয়ে সেই পুষ্পহার নগরীতেও এসে লাগত। সুনীল ফেনপুঞ্জ পর্বতসদৃশ ঢেউ পার হয়ে আসত গণনাতীত বাণিজ্যতরণী প্রাচী ও প্রতীচী থেকে। আসত ব্রহ্মদেশ থেকে, মালয় থেকে, সুবর্ণদ্বীপ থেকে, যবদ্বীপ থেকে। আসত রোম থেকে, আরব থেকে, ব্যাবিলন থেকে, আলেকজান্দ্রিয়া থেকে, অজ্ঞাত পৃথিবীর কত না বিচিত্র প্রান্ত থেকে ! সেসব দেশের বণিকদের ভাষা, আচরণ, বিশ্বাস, কৌশল—সবই বিচিত্র, কৌতূহলোদ্দীপক। তিন মাস্তুলবিশিষ্ট বৈদেশিক বাণিজ্যপোত—কাঠের তক্তাগুলো সব শক্ত কাছি দিয়ে বাঁধা; কেননা পেরেক বা আংটা দিয়ে জোড়া হলে সামুদ্রিক বিরাট তুফান বা ভারত সাগরের প্রবালদ্বীপের সংঘাত সেই অর্ণবপোত সহ্য করতে পারত না। সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস গায়ে মেখে ভিনদেশী বণিকের দল নিয়ে আসত উত্তম তেজোবর্ধক সুরা, টিনের ধারালো পাত, সিসার সম্ভার, উজ্জ্বল প্রবাল, শুভ্র মুক্তারাজি আর তরুণী ক্রীতদাসীর দল। আর ভারত থেকে তারা নিয়ে যেত সোনা-লোহা-মণিমানিক্য, গজদন্ত, মশলা-সুগন্ধি-শর্করা, ঘৃত-চাউল, লাক্ষা ও নীল ।

শুধু এই পুষ্পহার বন্দরই নয়; ভৃগুকচ্ছ, সুপারা, গাঙ্গেয় উপত্যকার চম্পা ও তাম্রলিপ্ত—এমন নানা বন্দরনগরী ছিল সেদিন এদেশে, যেগুলোতে এসে ভিড়ত সমুদ্রপথে বহির্ভারতের বাণিজ্যতরণী। শুধু সমুদ্রপথেই নয়, রেশম পথেও ভারতের সঙ্গে চিন ও রোমের ব্যবসায়িক সংযোগ ছিল। এ ছাড়াও লবণ-পথ, সুগন্ধি-পথ এমনি কত বিচিত্র পথরেখা ধরে ব্যাপারীরা ভারত ও বহির্বিশ্বের মধ্যে যাতায়াত করতেন সেদিন। এসব বাণিজ্যসূত্রে তাই ভারতে গড়ে উঠেছিল বহু বাণিজ্যনগরী—উজ্জয়িনী, মিথিলা, সুরাট, কাঞ্চী, থানেশ্বর, পাটলিপুত্ৰ—এমন কত না। তবু এদের মধ্যে পুষ্পহার ছিল তখন একটি অনুপম পুষ্পহারেরই মতন। দেশের সমস্ত বন্দরের মধ্যে কাবেরীতীরে প্রধান বন্দর ছিল তখন এই পুষ্পহার। কেউ একে আদর করে ডাকত ‘পুপ্পহার’ নামে, কেউ-বা বলত শুধুই ‘পুহার’। সমস্ত নগরীটি চোল রাজাদের কীর্তি ও বৈভবে সমুজ্জ্বল ছিল। এর পথঘাট, রাজপ্রাসাদ, ঘরবাড়ি, আপণভবন, মন্দির, নৃত্যশালা ও গীতবাদ্যমুখরিত নগরনটীদের ঘরগুলি দেশীয় ও বৈদেশিকদের অপূর্ব কলতানে নিয়ত মুখরিত ছিল।

পথের পাশে ছিল এক দক্ষ স্বর্ণকারের আপণ, কত বিচিত্র আভরণ রচনা করতে পারতেন সেই প্রতিভাবান স্বর্ণকার। নাম তাঁর বাদ্য মণিকণ্ডন। এদেশের সমস্ত মণিকারদের সঙ্গে ছিল বাদ্য মণিকণ্ডনের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। শুধু এদেশেরই নয়, সমুদ্রপথে বাণিজ্যতরীতে পাল তুলে সুদূর বিদেশভূমি থেকে যে-বণিকেরা আসতেন এখানে, তাঁদের সঙ্গেও মণিকণ্ডনের ছিল প্রধানত মুক্তার কারবার। আবার এদেশের ব্যাপারীদের সঙ্গে মণিকণ্ডনের কারবারও বেশ জমে উঠেছিল। গুর্জর থেকে আসত রুপা, কর্ণাট থেকে সোনা। তামিল দেশের করুর নগরী থেকে এসে পৌঁছোত লাল পদ্মরাগমণি বা চুনি । অশ্মকদেশের কৃষ্ণা নদীর তীরবর্তী খনি থেকে আসত উজ্জ্বল দ্যুতিময় হীরকখণ্ড । সারা ভারতে এমন কোনো রাজ্য ছিল না, যেখান থেকে স্বর্ণকার মণিকণ্ডনের কাছে বহুমূল্য রত্নরাজি এসে পৌঁছোত না। সেই সব রত্নসমূহ গেঁথে গেঁথে মণিকণ্ডন নির্মাণ করতেন একেকটি নয়নাভিরাম অলংকার ।

সে প্রায় বিশ বছর আগেকার কথা, মণিকণ্ডন তখন সমর্থ পুরুষ। এই সব মহার্ঘ উপাদানে তিনি একজোড়া শিল্পিত নূপুর রচনা করেছিলেন। কী তার চোখ-ঝলসানো জলুস যে! মাদুরার পাণ্ড্যবংশের মহারাজার বিয়েতে তরুণী মহারানির জন্য সেই নূপুরটি মণিকণ্ডন উপহার পাঠিয়েছিলেন গোপনে। পাণ্ড্য রাজকুল সেই উপহার স্বীকার করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে শিল্পীর সাম্মানিকও দিয়েছিলেন তাঁরা। সাম্মানিক হিসেবে মণিকণ্ডনকে তাঁরা পাঠিয়েছিলেন কল্পনাতীত কালাঞ্জু। সে যাই হোক, তারপর বহু বছর চলে গেছে, মণিকণ্ডন হয়েছেন বুড়ো, নিজে হাতে আর কাজ করতে পারেন না। এখন তিনি পরিকল্পনা দেন আর তাঁর পরিকল্পনা-অনুযায়ী তাঁরই অধীনস্থ দক্ষ শিল্পীরা অলংকারের রূপ দিয়ে থাকেন।

একদিন গ্রীষ্মদুপুরে মণিকণ্ডনের হাতে অন্য কাজ ছিল না। বসে থেকে থেকে হারানো দিনের সেই নূপুরটির কথা মনে পড়ছিল তাঁর। পাণ্ড্যরাজার মহিষী আজও কি সেই নূপুরটি পরেন তাঁর পায়ে ?

ভাবতে ভাবতে ইচ্ছে হল, আবার মণিকণ্ডন অমন আরেকটি নূপুর নির্মাণ করবেন। অধীনস্থ কর্মীদের দ্বারা নয়, এবার তিনি রচনা করবেন নিজের হাতে। কয়েক মাসের চেষ্টায় নূপুর নির্মাণ সম্পন্ন হল। কর্ণাট দেশের সোনা গালিয়ে তিনি বহুদিন ধরে সঙ্গোপনে তৈরি করতে লাগলেন ছোটো ছোটো সোনার ফুল। তারপর গুর্জর দেশের রুপোর তার দিয়ে সোনার সেই ফুলগুলো তিনি গাঁথলেন। দুটি দুটি সোনার ফুলের মাঝখানে বসালেন একটি করে মুক্তো। তারপর সোনার ফুলগুলোর বুকে পর্যায়ক্রমে একটি করে চুনি আর একটি করে হিরে বসাতে লাগলেন। চুনি-হিরে-চুনি-হিরে-চুনি-হিরে। এইভাবে একজোড়া আশ্চর্য সুন্দর নূপুর তৈরি হয়ে এল। বিশ বছর আগে পাণ্ড্য রাজমহিষীর জন্য যে-নূপুর তিনি বানিয়েছিলেন, তার থেকে অনেক সুন্দর, অনেক মহার্ঘ-মোহক এই নবনির্মিত একজোড়া চরণমঞ্জীর।

নুপুর দুটি গড়ে তাদের দিকে হৃষ্ট চিত্তে তাকিয়ে ছিলেন শিল্পী। কিন্তু কিছু পরে তাঁর মন থেকে আনন্দের ভাব চলে গেল। বুক ভরে উঠল করুণ বেদনায়, চোখ দুটি কেমন ভরে উঠল জলে। কেন জানি মণিকণ্ডনের মনে হল, এই যে নূপুর দুটি তিনি গড়েছেন, এর অর্থ সাধারণ নয়, এর অর্থ বড়ো বেদনায় মাখা। সোনা যেন শূন্যতার প্রতীক, আর রুপা এই রূপময় জগৎসংসারের দ্যোতক। রূপের সূত্রে বাঁধা পড়েছে কেবল শূন্যতা । আর সোনার ফুলের বুকে রাঙা চুনিগুলো যেন জমাট রক্তবিন্দু আর হিরের কুচিগুলো যেন ঘনীভূত কার চোখের জল। এই হচ্ছে সংসার—এখানে রূপের সূত্রে চিরকাল শূন্যতাই গাঁথা হয়, আর শূন্যতার বুকে জমে থাকে অশ্রু ও রুধির। সোনার ফুলগুলির মাঝে ওই যে একটি করে মুক্তা–ও যেন মানুষের মুক্তির বাসনা, জীবনের পায়ে পায়ে ওই মুক্তিবাসনা কেঁদে মরে অবিরল। মণিকণ্ডনের মনে হল সদ্যোনির্মিত এই নূপুরযুগল যার পায়ে বাঁধা পড়বে, সেই মেয়ে জীবনে কখনও সুখী হতে পারবে না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিল্পী মণিকণ্ডন নূপুর দুটি সিন্দুকে তুলে রাখলেন।

নূপুর দুটি কিন্তু জানত না এত সব কথা, জানত না শিল্পীর দুঃখ। নূপুর দুটি যমজ বোনের মতো এ ওর দিকে তাকিয়ে নীরবে অশ্রুমোচন করতে করতে ভাবতে লাগল, কবে তাদের এই সিন্দুক থেকে বন্দিদশা ঘুচবে, কবে তারা বেজে উঠবে কোনো সুন্দরীর পায়ে পায়ে ঝম্ ঝম, ঝম্ ঝম্ !

পুষ্পহার নগরীর বিত্তবান পোতাধিকারী মানাইক্কনের কিশোরী কন্যা কন্নকী ধীরে ধীরে পুষ্পিত লতার মতো যৌবনে প্রবেশ করল। রূপসী মেয়ের জন্মতিথিতে উপহার দেওয়ার জন্য পিতা মানাইক্কন সারা নগর ঘুরে ঘুরে মণিকণ্ডনের স্বর্ণবিপণিতে এলেন অলংকারের সন্ধানে ।

মণিকণ্ডন তাঁর আপণের এ অলংকার দেখান, ও অলংকার দেখান, কিন্তু মানাইক্কনের মন মানে না। কোনো অলংকারই যেন যথেষ্ট নয় তাঁর মেয়ে কন্নকীর জন্যে। এমন কিছু চাই, যা অভিনব এবং দুর্মূল্য। মণিকণ্ডন তাঁর সিন্দুক থেকে একটি একটি করে অলংকার বের করে মানাইক্কনকে দেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ মানাইক্কনের চোখ একটা রুপোর পেটিকার উপর গিয়ে পড়ল। মানাইক্কন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ও পেটিকাতে কী আছে, স্বর্ণকার? আমাকে দেখান!’

মণিকণ্ডন যতই না-না করে আপত্তি করেন মানাইক্কনের ততই আগ্রহ বেড়ে যায় ৷ শেষে মানাইক্কনের পীড়াপীড়িতে পেটিকা খুলে নূপুর দুটো দেখাতেই হল মণিকণ্ডনকে। সেই নূপুর দুটি দেখে মানাইক্কন তো হতবাক! কী অপূর্ব রূপ তাদের! কন্নকীর জন্য এমন চরণমঞ্জীরই তো চাই!

কল্পনাতীত কালাঞ্জু মূল্য দিয়ে মানাইক্কন নূপুরজোড়া মণিকণ্ডনের থেকে কিনে নিলেন । নূপুর বিক্রয়ের পরে শিল্পী মণিকণ্ডন এই নূপুরের নির্মিতি সম্পর্কে একটি গোপন রহস্য খুলে বললেন মানাইক্কনকে। সেকথা বলবার পরে মণিকণ্ডন আবার যোগ করলেন, ‘একথা কিন্তু আপনি নিজের কাছেই রাখবেন, অন্য কাউকে বলবেন না যেন! একান্তই যদি বলতে হয়, তবে একথা আপনি আপনার কন্যা কন্নকীকেই শুধু বলতে পারেন; অন্য কেউ যেন তা জানতে না পারে।’ মানাইক্কন শিল্পীর কথায় সম্মতি দিয়ে নূপুরজোড়া নিয়ে গৃহে ফিরলেন।

নুপুরযুগল এবার গিয়ে উঠল কন্নকীর পায়ে। যেন দুটি যমজ বোন খিলখিল করে হাসতে হাসতে বেজে উঠল কন্নকীর চরণসম্পাতে। সরল বালিকার উল্লাস প্রতি পদক্ষেপে রচনা করতে লাগল এক অনুপম সঙ্গীত। যে-সঙ্গীত আপাতত জীবনের। পরে কী হবে, তা এখনই বলা যায় না। এখন তা বলা উচিতও নয়।*

(চার) পূর্বরাগ

পুষ্পহার নগরীর অপর প্রান্তে ছিল মাশাত্তুবান নামে এক বিভবশালী বণিকের প্রাসাদ। বণিক মাশাত্তুবান অল্প অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে বহু পরিশ্রম করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল সব দিকে। উপার্জনের বহুলাংশ তিনি দরিদ্র মানুষের সেবায় নিয়মিত ব্যয় করতেন। এই কারণেই পুষ্পহারের সাধারণ মানুষ তো তাঁকে ভালোবাসতই, উপরন্তু তিনি ছিলেন চোলরাজাদের দ্বারা সবিশেষ অনুগৃহীত ।

মাশাত্তুবানের যুবক পুত্র কোভালন; বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, রূপে, গুণে তার মতো উদ্যমী যুবক তখন এ পুষ্পহার নগরে চোখে পড়ত না। বিত্তবান বিখ্যাত ব্যক্তিদের পুত্রকন্যারা সাধারণত নিষ্ফল অহংকারী দুর্বিনীত হয়ে থাকে। কিন্তু কোভালন ছিল এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম। পিতার বিত্তবৈভব, সামাজিক মর্যাদা কোভালনকে দর্পিত করেনি। বরং শিশুকাল থেকেই কোভালন ছিল বিনয়ী, কোমলস্বভাব। তার কথাগুলি নম্র আর সুমিষ্ট। আচরণে কোথাও রুক্ষতার স্পর্শ ছিল না তার। সঙ্গীত-নৃত্য-কাব্যে তার আন্তরিক আগ্রহ ও সূক্ষ্ম রুচি—বড়ো শিল্পীস্বভাব যুবক ছিল কোভালন। সে কবিতা লিখত, গান গাইত, যেখানেই কোনো নৃত্যগীতশিল্পীর সংবাদ পেত, ছুটে যেত সেই দিকে। উদাসীন শিল্পীস্বভাব হলেও কোভালন তার পিতার ব্যবসায় অমনোযোগী ছিল না, যদিও বিত্তকোশ স্ফীততর করে তোলাতে তার অধিক লোভও ছিল না। এমন যে সুন্দর যুবক কোভালন, তার দিকে চেয়ে কত সুন্দরী যুবতীরা দীর্ঘশ্বাস ফেলত, শরতযামিনীর বিদায়ী চাঁদের মতন ম্লানমুখ সেই সব সুশ্রী মেয়েরা তাদের সখীদের কাছে আক্ষেপ করে বলত, ‘প্রিয় সখী ! ও যেন রে প্রভাতবেলার সূর্য, সারারাত অপেক্ষা করে শেষে চাঁদ ডুবে যায়, তবু উদয়াদিত্যের সঙ্গে দেখা তো হয় না। বোধহয় যৌবন ও সৌন্দর্যের তরুণ দেবতা কার্তিকেয় এ পুষ্পহার নগরীতে কোভালন হয়ে জন্মেছেন! যে-মেয়ে ওকে পাবে, ধন্য তার জীবন !’

এত যে রূপগুণ কোভালনের, তবু তার স্বভাবের এক বিচিত্র বৈশিষ্ট্য যেন তার জীবনের উজ্জ্বল মার্গের ওপর বক্র দৃষ্টির ছায়াপাত হেনেছিল। সেই বৈশিষ্ট্যটি তরুণ বয়সে তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে না, বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমশ আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। প্রায়শ শিল্প-উন্মুখ সংবেদনশীল মানুষদের মধ্যে এই বিশেষত্ব দেখা যায় । কোভালন কোনো জিনিসই একটানা উপভোগ করতে পারত না। তার মন ছিল বৈচিত্র্যমুখী, অভিনবত্বে মাত্রাতিরিক্ত আগ্রহ ছিল তার। কোনো ভাব, যতই মহান হোক না কেন, কোভালন অনেকক্ষণ ধরে তা সহ্য করতে পারত না। সে খুঁজত বিচিত্রমুখী সব চিন্তার উপাদান; মনের এক স্তর থেকে অন্য স্তরে তার মন উল্লম্ফন করে বেড়াত। এর ফলে সে কোনো মোহে জড়িয়ে পড়ত না ঠিকই, কিন্তু মানসিকভাবে সুস্থিরতার প্রসাদও সে পায়নি। সাদামাটা জীবনে সুখী হওয়া তাই কোভালনের ভাগ্যে ছিল না। সততার থেকে প্রতিভা তাকে আকর্ষণ করত বেশি, সারল্যের থেকে বেশি আকর্ষণ করত মেধা। কিন্তু অবচেতনের এই অস্পষ্ট পরামর্শ সেই তরুণ বয়সে কোভালন অনুধাবন করতে পারেনি। যদি পারত, তবে এ কাব্য ‘শিলপ্পদিকরম’ লেখা হত না তাকে নিয়ে।

একদিন প্রভাতবেলায় সুবর্ণদ্বীপ থেকে সমুদ্র পেরিয়ে কাবেরী নদী বেয়ে অনেকগুলো বাণিজ্যপোত এসে লাগল পুষ্পহারের ঘাটে, বণিক মাশাত্তুবান তাঁর সুযোগ্য পুত্র কোভালনকে পাঠিয়েছিলেন নদীতীরে আগন্তুক বিদেশী বণিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। খুবই দক্ষতার সঙ্গে সেই দায়িত্ব সম্পাদন করার পর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে কোভালন বাড়ি ফিরছিল নদীতটরেখা ধরে। কিছুদূর আসার পর, সেখানে কাবেরীর এক নির্জন ঘাট, কোভালন দেখল, বালুকাভূমির ওপর একটি সুন্দর শিবিকা কার জন্যে যেন অপেক্ষা করছে।

কিছুক্ষণ পর ঘাটের সোপান বেয়ে উঠে এল জলচরী পক্ষিণীর মতো একটি মেয়ে । স্বচ্ছ অবগুণ্ঠন ভেদ করে তার রূপের আলো যেন ছিন্ন মেঘাচ্ছন্ন জ্যোৎস্নার মতো নদীতীর আলোকিত করে রেখেছে। সে যেন মাটির উপর পা ফেলে হাঁটছে না, যেন হাওয়ার মধ্যে ভেসে যাচ্ছে শ্বেতহংসের একটি পালক। তবু মৃদু মৃদু শোনা যাচ্ছে তার পায়ের নূপুরের রুনুঝুনু সঙ্গীত। পায়ের নূপুর দুটি কী কথা বলছে পরস্পর ?

কোভালন শুনল, মেয়েটির বাঁ-পায়ের নূপুর ডানপায়ের নূপুরটিকে ডেকে বলছে, ‘ও রে বোন! তুই আছিস মহাসুখে। আমাকেই সব ভার আগে নিতে হয়। নারীর অন্য নাম বামা। আমাদের এই সুন্দরী প্রিয়সখী হাঁটতে গিয়ে তার মাঙ্গলিক বামচরণ সর্বদাই আগে ফেলে। আমি ওর বাঁ-পায়ের নূপুর, আমাকে আগে ওর তনুলতার ভার নিতে হয়, আর তুই পরে এসে আমার সঙ্গে যোগ দিস।’

ডানপায়ের নূপুর অমনি কলহাস্যে উত্তর দিল, ‘ভারের কথা আসছে কেন? ভারের কথা আসছে কেন? এ মেয়ে তো লঘুভার। আসল কথা তো সঙ্গীত ! আমাকে যে কত সুর তুলতে হয়, তুই তো শুধু তাল মেলাস!’

বাঁ-পায়ের নুপুর ছদ্মরোষে বলল, ‘কে সুর দেয় আর কে তাল দেয়, সেই তর্ক থাক। আমি তো বলব, ভারও নয়, সুরও নয়। অলংক্রিয়তে ইতি অলংকারঃ। কিন্তু তরুণী সখীর চরণযুগের শোভা আমরা বাড়িয়ে তুলছি, নাকি ওর এই কমনীয় চরণপল্লব আমাদের শোভা বাড়িয়ে তুলছে, তাই তো আমি আজও স্থির করতে পারলাম না।’

ডানপায়ের নূপুর এবার বামনূপুরের কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছিস, ভাই ! এমন কোমল অলক্তরাগরঞ্জিত চরণ জড়িয়ে ধরে যেন সুখাবেশে মরে যেতে ইচ্ছে করে আমার !’ নূপুরদ্বয় এসব বলছিল কি না, কে জানে! কিন্তু যুগ্ম নূপুরের শিঞ্জনশব্দের ভিতর কোভালন এসব কথাই শুনছিল। সোপানদ্বার পেরিয়ে মেয়েটি ততক্ষণে শিবিকার কাছে এসে পৌঁছেছে। আশেপাশে শিবিকাবাহকেরা বালুর চড়ায় বসেছিল। মেয়েটিকে দেখতে পেয়ে তারা দ্রুত উঠে এল শিবিকার কাছে। কোনো বিত্তবান মানুষের কন্যা হবে বোধহয় মেয়েটি, কোভালন ভাবল। শিবিকার দ্বার ধরে উঠে বসবার সময় অতর্কিতে অবগুণ্ঠন খসে পড়ল, মেয়েটির মুখাবয়ব, উন্মুক্ত স্কন্ধদেশ, কমনীয় বাহুযুগ সহসা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। একটি মুহূর্ত শুধু। তারপরেই মেয়েটি শিবিকায় উঠে বসল, তৎক্ষণাৎ শিবিকার দ্বার অর্গলবদ্ধ হয়ে গেল।

কোভালন নিম্নস্বরে পার্শ্ববর্তী সহচরকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ মেয়েটি কে? এখানে কোথা থেকে এল?’

সহচর শিবিকার ওপর অঙ্কিত চিহ্ন দেখে উত্তর দিল, ‘শিবিকাটি তো দেখছি, পোতাধিকারী মানাইক্কনের। মেয়েটি তাহলে বোধহয় মানাইক্কনের কন্যা কন্নকীই হবে।’

সহচর বন্ধুটি আরও অনেক কথা এ-বিষয়ে, সে-বিষয়ে বলে যাচ্ছিল। কিন্তু সেসব কথা আর কোভালনের কানে ঢুকছিল না। সে কেমন আবিষ্ট চেতনায় বাড়ি ফিরল, যন্ত্রের মতো স্নান-খাওয়া সারল, নিত্যদিনের কাজকর্মে যোগ দিল…কিন্তু তার মন এসব কাজে ছিল না। তার শুধু মনে পড়ছিল, নদীতীরে দেখা সেই একখানি অপরূপ মুখ, লুকোনো রহস্যময় ঝিলের মতো কাজলকালো দুটি ডাগর দিঠি, ওষ্ঠাধরের ওপর থমকে থাকা মৃদু স্বেদবিন্দু, আয়ত স্কন্ধযুগ, সেই কমনীয় বাহুলতা আর কলতানমুখরিত নূপুর দুটির ছদ্ম বিবাদ-সংবাদ। কোভালনের মনে হল, কন্নকী নয়, সে বুঝি আজ কাবেরীদেবীকেই জলতল থেকে উঠে আসতে দেখেছে। অথবা তাও নয়। এ মেয়েটি যেন মানুষী নয়, দেবীও নয়, এ যেন প্রভাতনলিনীর উপর আপতিত উদয়-আকাশের অরুণিমা।

দিন আসে, রাত্রি যায়। দিনের পর দিন মেয়েটির মুখ কোভালনের মনকে অধিকার করে রাখে। মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে উঠে সে ঘৃতদীপ জ্বালে। তালীপত্র টেনে নেয়। উৎপীঠিকার উপর পত্র রেখে মস্যাধারে লেখনী ডুবিয়ে নিয়ে কেমন ঘোরগ্রস্ত হয়ে লিখে চলে শ্লোকের পর শ্লোক । লিখতে লিখতে কখনও কোনো চরণের শেষে অস্ফুটে নাম লেখে কন্নকীর:

“ঘাট বেয়ে উঠে এসে শিবিকা-বাহিত হয়ে চলে গেলে তুমি,

অতর্কিতে একবার দেখলাম, সরল জলের মতো মুখ।

যেন কোনো নগরীর স্পর্শযোগ্য ঘুম তুমি, সখী,

নিষিদ্ধ সে দরশন—কদাচিৎ জানলে না কে দেখেছে বিকচ কুসুম।

চলে গেলে, জানলে না, এ যে কী ভুবনমায়া রচেছ, কন্নকী!”

(পাঁচ) দৰ্পণা

এ সংসারে কবিতার মতো দুঃখজনক সমস্যা আর একটিও নেই। ভগবান তথাগত বলেছিলেন, দুঃখের কারণ আছে। সুগত-প্রচারিত চতুরার্য সত্যের সেটিই দ্বিতীয় আর্য সত্য। কিন্তু কবিতা বোধহয় কবির মনের সেই দুঃখ, যার কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ নেই। অহেতুক দুঃখ বলেই বোধহয় সৃজিত হওয়ার একটু পরেই কবিতা কবিকে ভিতরে ভিতরে অহেতুক পীড়ন করতে আরম্ভ করে। কবিতা লেখার খানিক পরেই কবির ইচ্ছা হয়, সে-কবিতা কাউকে পড়ে শোনানোর। খুব কম কবিই এর অপ্রতিরোধ্য আবেশ থেকে বাঁচতে পারেন। কোভালনেরও তাই হল। রজনীর নিভৃত প্রহরে সে যা যা লিখছিল, কিছুদিনের মধ্যেই সেসব পদ সে তার কবিবন্ধুদের শোনাতে গেল ৷

কবির জীবনে কবিতা যদি প্রথম সমস্যা হয়, তবে তাঁর জীবনে তাঁর কবিবন্ধুরা ততোধিক প্রবল সমস্যা। কোভালনের তরুণ কবিবন্ধুরা গভীর মনোযোগে কোভালন-প্রণীত পদগুলি শুনতে লাগল। নানা বিজ্ঞজনোচিত মতামতও দিল তারা। কিন্তু প্রায় প্রতি কবিতাতেই যে কন্নকীর নাম উঠে আসছে, সে-ব্যাপারটা তারা খুবই সচেতনভাবে লক্ষ করল, যদিও তখনই মুখে কিছু বলল না। পরে কোভালনের আড়ালে এই নিয়ে তারা কানাকানি করতে লাগল। ধীরে ধীরে কথাটা মাশাত্তুবানের কানেও গিয়ে পৌঁছোল।

কবিতা সম্বন্ধে ওপরের কথাগুলো যে বস্তুত রসকথা মাত্র, সেটা কি অরসিকজনের জন্য আলাদা করে বলে দিতে হবে? সে যাই হোক, কন্নকীর পিতা মানাইক্কন ও কোভালনের পিতা মাশাত্ত্ববান ব্যবসার সূত্রে মিত্রতা-সম্বন্ধে প্রথমাবধি আবদ্ধ ছিলেন। মানাইক্কনের কন্যা কন্নকীকে মাশাত্তুবান আগেও দেখেছেন, কখনও সুরূপা সুশীলা মেয়েটিকে আপন পুত্রবধূ করে নিয়ে যাওয়ার চিন্তাও চকিতে তাঁর মনকে অধিকার করেছিল। কাজেই এবার যখন কোভালন কন্নকীর প্রতি আকৃষ্ট, একথা জানলেন, তখন ভেতরে ভেতরে হৃষ্ট হয়ে উঠলেও বাইরে সেই ভাব প্রকাশ করলেন না। বরং গোপনে মানাইক্কনের কাছে কথাটা পাড়লেন। সব শুনে মানাইক্কনও খুবই খুশি হলেন, কিন্তু তাঁর মনে হল, ব্যাপারটা কন্নকীর জানা দরকার। এ বিবাহে কন্নকী কি সম্মত?

        সখীদের মুখে, মায়ের মুখে অচিরেই কন্নকী জানল, বণিক মাশাত্তুবানের পুত্র কোভালন তার প্রতি আকৃষ্ট। সে নাকি কন্নকীকে নদীপথে দেখেছে এবং তারপর থেকেই কোভালনের মন নাকি কন্নকীময় হয়ে আছে। সব শুনে বড়ো লজ্জা পেল মেয়েটি। বারবার স্মৃতিপথে কন্নকী খুঁজে ফিরতে লাগল তেমন কাউকে, কাবেরীতে স্নান করতে যাওয়ার পথে যার উৎসুক চোখ কন্নকীকে ছুঁয়েছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তেমন কারও কথা মনে পড়ল না কন্নকীর।

আসলে এই মেয়েটি বড়ো অন্যরকম, এই কন্নকী। সে যেন মাটির মেয়ে। পৃথিবীর মতনই সুন্দরী, পৃথিবীর মতনই উদাসীন। সে যে সুন্দরী, সেকথা যে সে বুঝত না, তা নয়। কিন্তু ওদিকে সে যেন তেমনভাবে নজরই দেয়নি। অন্য পাঁচজন মেয়ের থেকে রূপে, গুণে, সামাজিক পরিচয়ে সে যে বিশিষ্ট, এমনটা সে কখনও ভাবতে চায়নি। মাটির মতো, জলের মতো বেড়ে উঠেছিল সে, মাটির বুকে বনলতার মতো সবই তার সহজ, স্বাভাবিক ছিল। জীবন নিয়ে সে খুব বেশি কিছু ভাবেনি। খুব বেশি কিছু স্বপ দেখেনি ভবিষ্যৎ নিয়ে। সে জানত, একদিন তার বিয়ে হয়ে যাবে। যদি ভগবতীর আশীর্বাদ বর্ষিত হয়, তাহলে সে-বিবাহ সুখের হবে। যখনই এসব কথা মনে উঠত তার, সে প্রাণভরে প্রার্থনা করত, যেন তার ভাবী জীবন স্বস্তিপ্রদ হয়। আর যিনি তার স্বামী হবেন, তাঁর প্রতি সে যেন চিরবিশ্বস্ত থাকতে পারে।

আমাদের দেশের প্রকৃতির মধ্যেই এই সহজ আবর্তনের ভাব আছে। শীতঋতুর পরেই এখানে অমোঘ নিয়মে বসন্ত আসে, তপ্ত নিদাঘের পরেই আসে বরিষণমুখরিত প্রাবৃট। শরতের প্রসন্নতাকে অনুসরণ করে এখানে হিমঋতুর রহস্যময়তা। এদেশে বৈচিত্র্য আছে ঠিকই, কিন্তু সেই বৈচিত্র্য নৈরাজ্যমূলক নয়। এমনকি ঋতুবৈচিত্র্যও এখানে সরল শৃঙ্খলানির্ভর। যে-সময়ের কথা হচ্ছে, অন্তত তখনও আজকের মতো ঋতুসম্পাত অনিয়মিত হয়ে ওঠেনি। হয়তো ওই জন্যেই প্রকৃতির নিকটবর্তিনী নারী আমাদের দেশে সচরাচর নৈরাজ্যপ্রিয়া হয়নি, জীবনের সুখ-দুঃখের সরল আবর্তনকে সে সহজভাবেই মেনে নিয়েছে। এ নিয়মের যে ব্যতিক্রম ছিল না, তা বলব না। তবে আমাদের দেশের সেকালের মেয়েরা প্রায়শই যেমনটি ছিল, যেকোনো সমস্যারই যারা সহজ বাস্তবোচিত সমাধান খুঁজে নিতে পারত, তেমন মেয়েদেরই একজন ছিল কন্নকী।

ফুলের পাশে যেমন মধুমক্ষিকার গুঞ্জরন, রূপসী কন্নকীর চারিপাশেও তেমনই তার বান্ধবীরা গুনগুন করে বেড়াত রাত্রিদিন। সেই সব বান্ধবীদের মধ্যে কন্নকীর প্রিয়তমা সখী ছিল কুরিঞ্জী। তামিল ভাষায় ‘কুরিঞ্জী’ একটি বেগুনি-নীল ফুলের নাম; পশ্চিমঘাট পর্বত-উপত্যকায় যা গণনাতীতভাবে পুঞ্জে পুঞ্জে ফুটে ওঠে প্রতি শ্রাবণের শেষে। কুরিঞ্জী মেয়েটিও ঠিক ওই কুরিঞ্জীফুলের মতোই প্রাণোচ্ছলা ছিল। কুরিঞ্জীর পিতা রক্ষণশীল পরিবারের বাঁধনে কুরিঞ্জীকে ছোটোবেলা থেকেই বাঁধেননি। পুষ্পহার নগরীর সুধীজনগম্য যেকোনো স্থানে কুরিঞ্জী সখীদের নিয়ে যেতে পারত। নগরীর সমস্ত সংবাদ, সব কানাকানি কুরিঞ্জীর নখদর্পণে থাকত। উপরন্তু কুরিঞ্জী কবিতা লিখত, এ নগরের কবিসমাজের সব সংবাদও সে রাখত। বস্তুত কোভালনের সংবাদও কন্নকীর কাছে কুরিঞ্জীই প্রথম এনেছিল। পরে পিতা মানাইক্কনের কাছ থেকে বণিক মাশাত্তুবান-প্রদত্ত প্রস্তাব শুনেছিল কন্নকী।

কুরিঞ্জী প্রায় প্রতিদিনই কন্নকীকে শোনাত যুবক কোভালনের রূপগুণের ব্যাখ্যান । কেমন করে কোভালন কাবেরীতটে কন্নকীকে প্রথম দেখেই প্রণয়পীড়ায় আক্রান্ত হয়েছে, কেমন করে কন্নকীর মুখ ভেবে ভেবে রাতের পর রাত ঘিয়ের প্রদীপের আলোয় লিখে চলেছে প্রণয়কোমল শ্লোকের পর শ্লোক, সেসব কবিতায় হৃদয়ঘটিত প্রেমার্তি কেমন করে প্রতিদিন স্পর্শ করে চলেছে কবিতার আকাশ—এই সব কথা কুরিঞ্জী শতমুখে বলত।

এমনই একদিন। বৃহৎ দর্পণের সামনে বসে কন্নকীসুন্দরী বৈকালিক প্রসাধন সারছিল আর তার ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে কুরিঞ্জী কলকল করে বলে চলছিল কোভালনের কথা । কুরিঞ্জীর ছায়া দর্পণে প্রতিবিম্বিত হচ্ছিল, সেই ছায়ার দিকে তাকিয়েই কুরিঞ্জীর কথার উত্তর দিচ্ছিল কন্নকী মাঝে মাঝে। কখনও-বা শুনতে শুনতে মুখ টিপে মৃদু হেসে চুপ করে থাকছিল। কন্নকীর কপোলে, চিবুকে এসে লাগছিল লজ্জারুণ আভা।

কুরিঞ্জীর অনর্গল কলতান শুনতে শুনতে ওষ্ঠাধরে লাক্ষারস প্রলেপন করছিল কন্নকী । চকিতে ঊর্ধ্বে ডানদিকে একবার চোখ তুলে দর্পণে কুরিঞ্জীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে কন্নকী জিজ্ঞাসা করল, ‘কবিরা যা লেখেন, তা কি সব সত্যি?’ কথাটা বলেই সে আবার মনোনিবেশ সহকারে ওষ্ঠে লাক্ষারসের প্রলেপন দিতে লাগল।

কুরিঞ্জী উত্তর দিল, ‘সত্যি বই-কী! সেই সত্যই তো কবির সত্য। কল্পনার সত্য। কেন, একথা জিজ্ঞেস করছিস, কেন?’

ওষ্ঠলেপন কার্য সমাধা করতে করতেই বলতে লাগল কন্নকী, ‘এই যে তোর কোভালন….’

কন্নকীর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কুরিঞ্জী অমনই বলে উঠল,’আমার কোভালন? আমার কোভালন আবার কী রে? বরং তোর কোভালন বল…’

‘আচ্ছা, আচ্ছা, বেশ!’ হাসতে হাসতে বলল কন্নকী, ‘এই যে কবি কোভালন আমাকে নিয়ে এত কবিতা লিখছেন, এসব কবিতা সত্যি নাকি?’

‘কেন, তোকে নিয়ে কোভালন যা লিখছেন, তা কি তাঁর মন থেকে আসছে না?’

বিদ্যুৎগতিতে ঘাড় ঘুরিয়ে সখীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল কন্নকী, ‘মন থেকে এলেই বুঝি সব সত্যি হয়?’ তারপরই ঘাড় সোজা করে সামনে দর্পণের দিকে তাকাল ।

‘কী বলতে চাইছিস বল দেখি? কোভালনের শ্লোক কি তোর পছন্দ নয় ?’কুরিঞ্জীর গলায় ক্ষোভের অবভাস ফুটে উঠল।

‘আহা, তা কেন? পছন্দ হবে না কেন? খুবই ভালো কবিতা এসব। কিন্তু…’ বলতে বলতে সামনে দর্পণের দিকে সামান্য ঝুঁকে পড়ে দুই ভ্রূ-র মাঝখানে কুঙ্কুমের সূক্ষ্ম বিন্দু আঁকতে লাগল কন্নকী। শ্বাসধারণ করায় তার কোমল নাসাপুট দুটি ফুলে উঠেছিল। তারপর ভ্রূসঙ্গমে কুঙ্কুম ফোঁটা সম্পূর্ণ করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কথা সম্পূর্ণ করল কন্নকী, ‘…কিন্তু তুই যে বললি, তিনি আমাকে একবার এক পলক শুধু দেখেছিলেন ? তো সেই দেখা থেকে মনে মনে তিনি আমার ছবি গড়ে নিয়েছেন, তাই তো? কিন্তু এ ছবি তো তাঁর মনের কল্পনা । এর সঙ্গে বাস্তব আমার যোগ কি আছে? আমি কেমন মানুষ, কেমন আমার মন, এসব কিছুই তো তিনি জানেন না। আমার সঙ্গে তো তাঁর কোনো কথাই হয়নি!’

কুরিঞ্জী অমনি উল্লসিত উচ্চস্বরে বলে উঠল, ‘ও ! তার মানে তুই কোভালনের সঙ্গে এখন দেখা করতে চাস? ও-ও, আচ্ছা -আ !’

‘মোটেই না। কী বলছি আর কী বুঝছে, দ্যাখো!’ বলতে বলতে দর্পণের সামনে থেকে উঠে এবার সরাসরি সখীর মুখোমুখি হল কন্নকী ।

‘তুই-ই তো এক্ষুনি বললি কোভালনের সঙ্গে তোর কথা হয়নি, তোর সঙ্গে কথা না-বলে লিখলে কোভালনের কাব্য কীভাবে প্রাণ পাবে, কীভাবে সম্পূর্ণ সত্য হবে ! কী রে বল, বলিসনি?’

‘মোটেই আমি ওই অর্থে কিছু বলিনি,’ কন্নকী রাগত স্বরে উত্তর দিল। অতঃপর দুই বান্ধবীর মধ্যে প্রণয়-কলহ শুরু হয়ে গেল ।

নারীসুলভ সেই প্রণয়-বিসংবাদে আমাদের তেমন আগ্রহ নেই। কিন্তু এর মধ্য থেকে কাজের কথাটুকু এই, কলহের অন্তে কন্নকী সুকৌশলে কুরিঞ্জী-মারফত তার পিতামাতাকে জানিয়ে দিল, কোভালনের সঙ্গে বিবাহ-প্রস্তাবে তার আপত্তি নেই ।

তখন পাত্র-কন্যা উভয়পক্ষের কর্তাদের পারস্পরিক আলোচনায় ও জ্যোতিষীদের পরামর্শ অনুযায়ী শুভক্ষণ নির্ধারিত হল। আকাশের চাঁদ যে-লগ্নে সুখপ্রদা রোহিণী নক্ষত্রের সর্বাধিক নিকটে সরে আসবে, সেই লগ্নে কোভালন ও কন্নকীর বিবাহ হবে, স্থির হল।

পাত্রপক্ষ ও কন্যাপক্ষের তরফে সুন্দরী তরুণীরা মধুদিবসের পক্ষকাল আগে থেকে সুসজ্জিত হস্তীপৃষ্ঠে নগরীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে বিবাহ-অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানাতে লাগল। অবশেষে শুভযোগে শঙ্খঘণ্টা ও তালবাদ্যের মধ্য দিয়ে পাত্র-পাত্রীকে নিয়ে অগণিত নরনারীর এক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা রাজপথ ধরে অগ্রসর হতে লাগল । চতুর্পার্শ্বে পুষ্পদল বর্ষিত হতে লাগল, শোভাযাত্রার মধ্যে রত্নখচিত উজ্জ্বল শ্বেতছত্রগুলি সমবেত জনতার আনন্দছন্দে ও নদীসমুত্থ বায়ুবেগে আন্দোলিত হতে লাগল। ধীরে ধীরে সে-শোভাযাত্রা গিয়ে পৌঁছোল উৎসব-শিবিরে। শিবিরটি সুনীল ক্ষৌমবস্ত্র-নির্মিত ও শুভ্র মুক্তামালা-খচিত। স্তম্ভসমূহ নানা রত্ন ও মাঙ্গলিক পুষ্পমালায় সুশোভিত ছিল। সেখানেই বিবাহমণ্ডপ রচিত হয়েছিল।

বিবাহ-অনুষ্ঠান যদিও বৈদিক প্রথানুগ, তবু তার ব্যতিক্রম তো ছিলই। দেশের নানা স্থানে স্মার্ত আচার ও লৌকিক ক্রিয়াগুলি ভিন্ন ভিন্ন। সর্বথা সর্বদা একই প্রথা সমভাবে অনুষ্ঠিত হয় না। পুত পাবককে কেন্দ্র করে কোভালন পরিক্রমা করছিল, বৈদিক মন্ত্ৰাদি সমস্বরে উচ্চারণ করে চলেছিলেন পুরোহিতবর্গ। অগ্নিপরিক্রমা শেষ হলে কোভালন তরুণী কন্নকীর সম্মুখে এসে দাঁড়াল। তখন নম্র পুষ্পস্তবকের মতো মন্দাক্রান্তাছন্দিত শ্লোকঅন্তিমে শান্ত কোনো বিরতিচিহ্নের মতো, বশিষ্ঠের পাশে সতী অরুন্ধতীর মতো কন্নকী লাজনতমুখে দাঁড়িয়ে রইল কোভালনের সন্নিকটে। তারপর পবিত্র প্রতিজ্ঞাবাক্যের উচ্চারণ।

স্তিমিতনয়না সুচরিতা কন্যার দল বর-বধূর শিরে মুহুর্মুহু পবিত্র কাবেরীবারি, আর্দ্র পুষ্পরেণুকুঙ্কুম, সুগন্ধিত হরিদ্রাচূর্ণ বর্ষণ করতে লাগল। স্তনভারনম্রা সীমন্তিনীরা অগুরুচন্দনধূপের সুবাসিত ধূমে পূর্ণ করে তুলল বিবাহমণ্ডপ। সুবর্ণপ্রদীপ হাতে স্মিতাননা পুরললনাগণ বরবধূকে নিয়ে গেল বিশ্রামশয্যায়, হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে প্রগল্ভা তরুণীর দল পুষ্পকোরক বিছাতে বিছাতে বলতে লাগল, ‘তোমাদের এই নিষ্কলুষ প্রণয় শাশ্বত হোক, তোমরা এই এক পর্যঙ্কে অমলিন আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে চিরকাল শয়ন কোরো, বিধাতা যেন এই শয্যার ঊর্ধ্বে তাঁর কৃপাকরুণার চিরন্তন চন্দ্রাতপ রচনা করেন।’

তখন কন্নকীর চরণনিবদ্ধ সেই দুটি নূপুর পরস্পর গলা জড়িয়ে ধরে গাইতে লাগল :

‘হে বর্ষার জলভার ছন্দোময় মেঘ,

আমার কবিতাকে তুমি এইবার সেই ছন্দ দাও,

যার স্পর্শে জেগে ওঠে হারানো ভালোবাসাবাসির সুশ্যাম গিরি-উপত্যকা…’

(ছয়) স্বপ্নবাস্তব

আবাল্য যতবার এমন নদীপথে কোথাও যাত্রা করেছে কোভালন, ততবারই সে নিতান্ত বিস্ময়ের অভিঘাতে আহত হয়েছে। যাত্রারম্ভের পাঁচ-ছয় দিন আগে থেকে তার মনে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়; মনে মনে কাবেরীর কল্পনারঙিন ছবি সে অগ্রিম এঁকে রাখে, স্বপ্ন দেখে কাবেরীকে নিয়ে। কিন্তু তারপর যখন যাত্রা শুরু হয়, ঘাট পেরিয়ে নাও যখন মধ্যস্রোতে এসে পড়ে, তখন উন্মুক্ত পোতবক্ষে দাঁড়িয়ে কাবেরীর শোভা দেখতে দেখতে সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। এমন বিপুল অতলস্পর্শী জলভার, নদীর এমন দিগন্তলগ্ন বিস্তার, তটপ্রান্তে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামের শোভা, নদীপথের বিচিত্র রোমাঞ্চ—সমস্ত অভিজ্ঞতাটাই যেন তার পূর্বতন কল্পনাকে হার মানিয়ে ক্রমে ক্রমে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে। প্রত্যেকবারই সে নিজেকে বলে, কাবেরীকে কী ভেবেছিলাম আর কাবেরী আসলে কী। নিজের কল্পনার এই পরাভব তাকে একদিকে যেমন ব্যথিত করে, অন্যদিকে বাস্তব কাবেরীর রূপের প্রতি তন্ময় ভাবমুগ্ধতার আবেশ তাকে দিনে দিনে গ্রাস করে নেয় ।

এবারেও তার ব্যতিক্রম হল না। এবার তারা চলেছে নদীপথে উরায়ুর, সে আর কন্নকী। উরায়ুরে এক প্রাচীন শিবমন্দির আছে। বিবাহের পরে প্রত্যেক নবদম্পতি সেখানে শিবের আশীর্বাদভিক্ষা করতে যায়। কোভালনের পরিবার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, কন্নকীর পিত্ৰালয় নির্গ্রন্থ নাথপুত্ত-প্রচারিত জৈনমতানুসারী, কিন্তু যাবতীয় লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানে উভয় পরিবারই বৈদিক। আসলে এ একটা এমন সময়, দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধ, যখন বৈদিক বা বৌদ্ধ বা জৈন মতের মধ্যে তেমন কোনো বিভেদের শক্ত প্রাচীর ওঠেনি। সুগত-প্রচারিত বৌদ্ধমত কিংবা নাথপুত্ত মহাবীর-প্রবর্তিত জৈনমতকে তখনও জনসাধারণ, অন্তত দক্ষিণ ভারতীয় লোকসাধারণ, বৈদিক মতেরই একেকটা অন্য প্রকারের রূপ বলেই জানত। আচার-বিচারে তারা ছিল বৈদিক, অথচ শীলানুশীলনে কেউ-বা ছিল বৌদ্ধ, কেউ আবার জৈন। প্রাচীর উঠেছিল কিছুটা পরে, যখন মতবিশেষের দার্শনিক বিশিষ্টতা জনমানসে পুরোহিত ও আচার্যগণ দৃঢ়াঙ্কিত রেখায় চিহ্নিত করতে যত্নপর হন।*

উরায়ুর যাওয়া হচ্ছে জলপথে; কাবেরীর স্রোত বেয়ে। স্থলভাগেও যাত্রাপথ ছিল, তবু নদীপথই বেছে নেওয়া হয়েছে নবদম্পতিকে অন্তরঙ্গ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য । বস্তুত এ তরণীতে নাবিকরা ছাড়া কোভালন-কন্নকীর মাঝখানে এসে পড়ার মতো অন্য কেউ নেই। বিবাহ-অনুষ্ঠানের পরে সবেমাত্র তারা ঘনিষ্ঠ হয়েছে, প্রাথমিক ঘনিষ্ঠতাটুকু ক্রমশ নিবিড়তর হচ্ছে, তবু অপরিচয়ের জড়তা এবং অভিনবত্বের আকর্ষণ এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। এ মুহূর্তে তারা তরণীর উন্মুক্ত পাটাতনের উপর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রভাতবেলার নদীশোভা নিরীক্ষণ করছে । কোভালনের পরনে একটি শ্বেতবস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গে বাসন্তী রঙের উত্তরীয়। তার কেশভার মাথার উপর চূড়াকৃত রয়েছে। কন্নকী একটি সোনালি রঙের দুকূল ও ঊর্ধ্বাঙ্গে রাঙা চেলাঞ্চল পরে আছে। কন্নকীর কেশপাশ কবরীবদ্ধ। উভয়ের দৃষ্টিই নদীজলের দিকে।

দিনের প্রথম রৌদ্র নদীস্রোতের উপর পড়ে ঝকমক করছে। দূরস্থ তটরেখা তাল, তমাল, নারিকেল ও অন্যান্য বহু বৃক্ষসমন্বিত শ্যামবঙ্কিম হয়ে পড়ে রয়েছে। এ জলপথ পাখিদেরই জগৎ, কাবেরীর পাবন জলরাশির উপর দিয়ে তটের দিকে উড়ে যাচ্ছে পাখিরা। কেউ দলবদ্ধ, কেউ-বা একক। যেমন ক্রৌঞ্চরা প্রায়শই একক বা যুগ্ম, দলবদ্ধ কখনোই নয়। কিন্তু ডাহুক, মদগু বা তিতির রীতিমতো দলবদ্ধ; এক ঝাঁকে অনেকে মিলে থাকে। নদীর অনেক উপরে রৌদ্রালোকিত আকাশে চাতক পাখি একা একা আর্তনাদ করে উড়ছে; বর্ষার প্রথম জলের জন্য তার ব্যাকুল ভিক্ষা। চিলও তাই—একাকী। তরণী যখন তটপার্শ্বে যাচ্ছে, তখন তীরের কাছে ধ্যানস্থ বকেদের যূথচারিতা লক্ষ করা যায় । আবার তট হতে দূরে সরে এলে সে-বলাহকশ্রেণী দুধের উপর সরের মতন ক্রমশ মিলিয়ে আসছে। নদীতীরে কোথাও কোথাও গ্রামপ্রান্তে শ্মশানক্ষেত্র ঊর্ধ্বমুখ চিতাগ্নি বা ধূমরেখায় চিহ্নিত, ওইখানে শকুন, শ্যেন, চিল ও কঙ্কের রাজত্ব।* এসব শ্মশানের রূপ-সৌন্দর্যের মধ্যে বিরূপতার দৃশ্য ফুটে উঠে মধ্যে মধ্যে পীড়িত করছে বটে, তবু মোটের উপর এ নদীপথ সৌন্দর্যেরই আলেখ্য। কাল রাত্রে জ্যোৎস্না উঠেছিল খুব, তরণীর শয়নকক্ষে কোভালন অগাধ ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছিল কখন। কন্নকী শয্যা থেকে উঠে পায়ে পায়ে এই উন্মুক্ত পোতবক্ষে অপরিসীম জ্যোৎস্না পান করেছে। এই নিয়ে প্রভাতবেলাতেই খানিক মান-অভিমান হল, যখন কন্নকী বলেছিল:

‘জানো, কাল আমাদের নাওয়ের ছইয়ের উপর চকোর-চকোরী উড়ে এসে বসেছিল!’

কোভালন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি দেখলে কী করে ?’

‘ও মা! আমি দেখব না? আমি তো রাত্রে নাওয়ের পাটাতনের ওপর গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম!’

কোভালন মুখভার করে বলল, ‘আমাকে ডাকলে না কেন ?’

কন্নকী উত্তর দিল, “ডাকব কাকে? আপনি তো তখন নিদ্রাদেবীর গভীর আরাধনায় নিরত।’

শেষ কথাটা বলার সময়ে সে এমন একটা মুখভঙ্গী করল, যা দেখে অন্য সময় হলে মুগ্ধ কোভালন প্রণয়বিহ্বল হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন অভিমানের মুহূর্তে ওই মুখভঙ্গিমা দেখে তার বেশ রাগই হল। বলল, ‘কী এমন আমি ঘুমোচ্ছিলাম যে, আমাকে জাগানো যেত না? একা একা সব সুন্দর জিনিস দেখে বেড়াচ্ছ—এমনই কি কথা ছিল ?’

কন্নকী উত্তর দিল, ‘কথা তো আরও অনেক কিছুই ছিল! কাল দ্বিপ্রহরে নৌকা যখন একটি সুশ্যাম গ্রামের ঘাটে ভিড়েছিল, তখন একা একা নাও থেকে নেমে তুমি নদীতে স্নান করলে । তখন আমাকে ডেকেছিলে একবারও ?’

কোভালন বলল, ‘কীসব বলছ তুমি, কন্নকী? এমন উন্মুক্ত নদীঘাটে মাঝিমাল্লাদের সামনে তুমি নদীতে স্নান করবে?’

‘কেন, করলে কী দোষ?’

‘পালকি ছাড়া কখনও কাবেরীঘাটে স্নান করতে গিয়েছ তুমি বিবাহের আগে ?’

কন্নকী আবার সেই সুন্দর মুখভঙ্গী করে বলল, ‘আহা ! সে তো বিয়ের আগে ! বিয়ের পরে তো অন্য কিছু হতেই পারে। পারে না?’

‘তাই বলে মাঝরাতে একা একা নৌকার উন্মুক্ত পাটাতনের ওপর গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে?’

‘কী করব? শয়নকক্ষের গবাক্ষপথ দিয়ে দেখলাম নদীর বুকের উপর অনর্গল জ্যোৎস্না নেমেছে। সে এমন যে, কক্ষে থাকতে পারলাম না। ভেবেছিলাম, তোমাকে ডাকব, কিন্তু পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছ দেখে মায়া হল। তাই আর ডাকিনি। বেরিয়ে এসে দেখলাম, ছইয়ের ওপর চকোর-চকোরী ঘুমঘুম চোখ নিয়ে বসে আছে।’

কোভালন ঝটিতি প্রশ্ন করল, ‘পরিশ্রান্ত! আমি? কেন, কী আবার পরিশ্রম করলাম ?’

চেলাঞ্চলখানি মুখের উপর টেনে নিয়ে লজ্জারুণ মুখে কন্নকী বলল, ‘জানি নে, যাও।’ তারপর সেই একই ব্রীড়াভারানত মুখে কথা পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা জ্যোৎস্নায় আসে কেন বলো তো?’

একটু আগের প্রগল্ভতা ভুলে গেল কোভালন প্রশ্ন শুনে। খুব ভাবুকতার সঙ্গে চিন্তা করতে করতে বলল, ‘চকোর-চকোরী অত্যন্ত জ্যোৎস্নাপ্রিয়। শুনেছি, ওরা নাকি চাঁদের সুধা পান করে।’

কন্নকী অমনি দূরে সরে গিয়ে বলল, ‘যাঃ ! তা আবার হয় নাকি? চাঁদের আলো কি তরল দুগ্ধ যে, পাখিতে পান করবে? কেউ কখনও দেখেছে নাকি চকোরকে জ্যোৎস্না পান করতে?’

কোভালন আহত হয়ে বলল, ‘মানুষ যেগুলো দেখে, শুধু সেইগুলোই কি সত্যি? মানুষ যা ভাবে, যা কল্পনা করে, তাও তো কোনোভাবে সত্যি হতে পারে? পারে না কি?’

কন্নকী বলল, ‘না, পারে না। কোনোকিছু সত্যি হতে হলে তা কারও না কারও চোখের সামনে ঘটতে হবে। কেউ দেখল না, কিছু ঘটল না, শুধু তুমি মনে মনে ভেবে নিলে আর অমনি সব সত্যি হয়ে গেল—তা আবার হয় নাকি?’

কোভালন সামান্য উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তাহলে কল্পনা, চিন্তা, স্বপ্ন—এসবের কোনো দাম নেই ?’

‘না-না, দাম থাকবে না কেন? কবিতার মধ্যে কল্পনার দাম অবশ্যই আছে। কিন্তু বাস্তব সত্যের কথা যদি বলো, তাহলে…’

এসব কথার মধ্য দিয়ে ওদের তর্ক-বিতর্ক, শেষে মান-অভিমান সকালে বেশ জমে উঠেছিল। কোভালন কিছুতেই মানবে না যে, কল্পনা শুধু মানসিক ব্যাপার। তার বক্তব্য, কল্পনা থেকেই বাস্তবের জন্ম। আর কন্নকীও মানবে না যে, নিছক কল্পনার কোনো সত্যতা আছে। যতক্ষণ না বাস্তবের সঙ্গে মিলছে, ততক্ষণ কল্পনা কল্পনাই। কাব্যে মূল্যবান হতে পারে, বাস্তবে নয়। এই নিয়ে দুজনের তুমুল বাগ্‌বিনিময়। অবশেষে খানিকক্ষণ কথাবন্ধ তারপর রোদ উঠতে আবার সব কেমন ঠিক হয়ে গেল। এখন যেমন ভাব করে দুজনে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আধপ্রহর আগে যে কোনো মতান্তর হয়েছিল, তা বোঝার উপায় নেই ।

স্বচ্ছ রৌদ্রের ভিতর আকাশপথে কতকগুলো কপোত পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে। কখনও তারা এসে বসছে তরণীর মাস্তুলের উপর। সেই সব চিত্রগ্রীব পায়রাদের উড়ে আসা, মাস্তুলে বসা, এ ওর চঞ্চুতে চঞ্চু ঘষে ঘষে প্রেম-নিবেদন করা—এই সব মুগ্ধ হয়ে দেখছিল নবদম্পতি। তীরের কাছে বনস্পতিশীর্ষ থেকে বক্রপথে নেমে মাছরাঙা জল ছুঁয়ে ত্বরিতগতিতে মাছ তুলে নিয়ে পুনরায় তীরে ফিরে যাচ্ছিল। কাবেরীর জলে মাছেদেরও বেশ ভিড়, বোঝা যায়। সহস্রদংষ্ট্র বোয়াল এত বড়ো হয় যে তাদের দংশনে নিমজ্জিত মানুষের প্রাণও যেতে পারে। এ ছাড়াও গড়ুক, উলুপি, শফরী, মৎস্যরাজ রোহিত, কলক, চিলিচিম,জলাণুক—মাছের কোনো অভাব আছে ?*     নাম-না-জানা মাছও যে কত! নদীবক্ষে মধ্যে মধ্যে যেমন মাছেদের ঝাঁক লাফ দিতে দেখা যাচ্ছে, তেমনই আবার মাঝে মাঝে জলের গভীর থেকে লাফ দিয়ে উঠে এসে স্রোতের উপর উড়োপাক খেয়ে জলে ডুবে যাচ্ছে শুশুক। এ নদীতে গ্রাহ, মকর প্রভৃতি জলজন্তুর ও অভাব নেই। গতকাল কোভালন যখন স্নান করছিল, নাবিকেরা সাবধান করে দিয়েছিল।

এই সব জলদৃশ্য দেখতে দেখতে তরণীপৃষ্ঠে গন্তব্য উরায়ুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল ওরা। সেখানে পৌঁছোতে কয়েকদিন লাগবে। এ আনন্দযাত্রায় ভরে উঠছিল ওদের তনুমন। কোভালন ভাবছিল, এমন নিবিড় করে কন্নকীর মতন এক নারীকে যে সে কোনোদিন পাবে, তা বুঝি স্বপ্নেও ভাবেনি। চিন্তাটা উঠতেই সে মনে মনে প্রশ্ন করল নিজেকে, কিন্তু স্বপ্নেও সে ভাবেনি কি? স্বপ্ন কত সাবলীল, অনায়াস; সেই স্বপ্নে কি আর সে দেখেনি কোনোদিন প্রিয়ার মুখ? নিবিড় করে পায়নি কি সে স্বপ্নে? পেয়েছে তো! তবু সেই পাওয়া আর এই পাওয়ার মধ্যে কীসের যে তফাত ?

একটু পরে কোভালন বলল, ‘পাখিরাও স্বপ্ন দেখে, জানো?’

কন্নকী জিজ্ঞেস করল, ‘কী দেখে ওরা স্বপ্নে?’

‘ওরা স্বপ্ন দেখে, একদিন ওরা আর আকাশ থেকে নেমে আসবে না। উড়তে উড়তে উড়তে…. এত উপরে চলে যাবে ওরা, আর ফিরতে পারবে না। তখন সেখানে পাখিরা মেঘের মধ্যে পাখিনগর বানাবে। কালো মেঘ দিয়ে বানাবে ঘরবাড়ি, সোনালি মেঘ দিয়ে বানাবে মন্দির, ধূসর মেঘ দিয়ে পথঘাট, পাটল মেঘ দিয়ে নদী আর নীল মেঘ দিয়ে সমুদ্র। সেখানেই থাকবে তারা, পৃথিবীতে আর ফিরবে না।’

কন্নকী মন খারাপ করে বলল, ‘তাহলে পৃথিবী যে পাখিশূন্য হয়ে যাবে। কী দশা হবে তখন পৃথিবীর?’

‘খুবই শোচনীয় দশা। কেননা ঋতুচক্র আবর্তিত হবে না তখন আর।’

‘কেন, ঋতুচক্র থেমে যাবে কেন?’

‘জানো না বুঝি? পাখিরা আছে বলেই তো ঋতুচক্র ঘোরে! পাখিরাই তো ঠোঁটে করে নিয়ে আসে একেকটি ঋতুকে। গ্রীষ্মকে ঠোঁটে করে নিয়ে আসে শঙ্খচিল। বর্ষাকে নিয়ে আসে চক্রবাক। শরতকে মুখে করে আনে টিট্টিভ। হিমঋতুকে আনে পেচক ৷ বসন্তকে ময়ূর। পাখি না থাকলে এ ধরণী স্তব্ধ, ঊষর হয়ে যাবে।’

‘সত্যিই তাই? পাখি না থাকলে পৃথিবীর খুবই দুঃখজনক দশা হবে, এ আমিও মানি । কিন্তু পাখিরা ঋতু মুখে করে আনে—এ তুমি কি নিজে কল্পনা করলে?’

কোভালন হাসিমুখে বলল, ‘হ্যাঁ। কল্পনা করলাম। আর সেই জন্যেই এসব সত্যি। পাখিরা রোজ রাতে নীড়ে শুয়ে শুয়ে ওই পাখিনগরের স্বপ্ন দেখে। আকাশে তারা বানাবে পাখিনগর। আবার ঘুম থেকে উঠে পাখিরা নিজেদের মধ্যে সেই স্বপ্ন বলাবলি করে, জানো? বলে, আমি কাল রাতে পাটল মেঘ দিয়ে কাবেরী বানিয়েছি! তখন অন্যজন বলে, আমিও তো একই স্বপ্ন দেখেছি রে! সেই মেঘকাবেরীর মধ্যে একটা সবুজ মেঘদ্বীপ, চারিপাশে ময়ূরপঙ্খী রং। ওই যে দ্যাখো দ্যাখো, ওই দূরে মাস্তুলের উপর বসে একটা পায়রা কেমন আরেকটা পায়রাকে গলা ফুলিয়ে ওর স্বপ্নের কথাই বলছে !’

কন্নকী পায়রাগুলোর দিকে মুখ তুলে দেখল। বলল, ‘তাই কি? কই, আমার তো মনে হচ্ছে ওরা এবার উড়ে পালাবার পরিকল্পনা আঁটছে। ওই যাঃ, ওই তো উড়ে গেল ! দেখলে ! আমি বললাম না, ওরা ওসব স্বপ্নের কথা বলছিল না। ওসব তোমার কল্পনা, কোভালন।’

কোভালন অপ্রসন্ন মুখে তাকাল কন্নকীর দিকে। গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ওরা যে উড়ে পালাবার পরিকল্পনা করছিল—সেটাও তো তোমার কল্পনা ।’

‘হ্যাঁ। হতেই পারে। আমার কল্পনা। সত্যি নয়। ওরা হয়তো ওসব কিছুই ভাবে না । আমরা কি পাখি যে, পাখিদের মনের কথা বুঝব?’

কোভালন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার কি মনে হয়, জানো ? এই কল্পনার বাইরে আমরা কেউই যেতে পারি না। কক্ষনো না !’

কন্নকী বলল, ‘তাহলে ওই রোদ, এই নদী, নৌকা, জলপথ, দূরের গ্রাম, আমি, তুমি, মাঝিমাল্লা—সবই কল্পনা নাকি? এদের বাস্তবতা নেই?’ কথা বলতে বলতে ওরা কক্ষের ভিতরে এল।

‘নাহ্ নেই। কল্পনার বাইরে কিচ্ছু নেই,’ বলতে বলতে কন্নকীর গলার মধ্যে মুখ গুঁজল কোভালন । সেই আশ্চর্য সুরভি ! এই ঘ্রাণ কোনো প্রসাধনের নয়। এই ঘ্রাণ কন্নকীর নিজস্ব ঘ্রাণ। একটু আগেই কথা বলতে বলতে এই সুগন্ধটাকেই মনে মনে কল্পনা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল কোভালন। ভেবেওছিল সে কিছু। কিন্তু এখন সে যখন কন্নকীর গলার মধ্যে, বুকের মধ্যে, নাভির মধ্যে সেই সুরভিকে খুঁজছে—তখন কেন জানি মনে হচ্ছে, এ তার সেই কল্পনার কন্নকীগন্ধ নয়, এ ভিন্ন, এ পৃথক–এ এক অন্য কন্নকীর সুঘ্রাণ। শরীর-সুরভি। কেন এমন হয় তার? কেন কল্পনার সঙ্গে বাস্তব মেলে না? নাকি এমন সকলেরই হয়? কাকে একথা জিজ্ঞাসা করবে সে?

ভাবতে ভাবতে খুঁজতে খুঁজতে কোভালন প্রণয়-আকুল কন্নকীকে উথালপাথাল করতে লাগল।

(সাত) বণিক

মধ্যগগনে মার্তণ্ড আর পুষ্পহারে বণিক সর্বাধিক সক্রিয় হয়ে ওঠে দিনের একই সময়ে । মধ্যদিনের এই প্রহরটি বাণিজ্যিকভাবে সর্বাধিক সক্রিয় সময়। এ বিপণির প্রবেশপথে ও বহির্মুখী কক্ষে মক্ষিকাসম মানুষের অধিকাধিক ভিড়, দ্বিপ্রহরবেলায় নানা মানুষের নানা বচসায় কান পাতা দায়। এই ভিড়টুকু অতিক্রম করে গেলে একটি নিভৃত অন্তরাল, অন্তরালের ওধারে একটি অপেক্ষাকৃতভাবে নির্জনতর ও শীতলতর কক্ষ। এই ভিতরের ঘরটিতেই একটি ক্ষুদ্রাকার পর্যঙ্কের উপর এ সময়ে প্রতিদিন বসে থাকেন মাশাত্তুবান। পর্যঙ্কের উপর কোমল আস্তরণ, আস্তরণের উপর উৎপীঠিকা, তার উপর ভুর্জপত্র ও অন্যান্য লিখন-সামগ্রী রাখা আছে। একপাশে ধাতুনির্মিত বিপণিকোশ ও অন্যধারে কতগুলি ভুর্জ ও তালীপত্রের গ্রন্থিবদ্ধ সূচনা। এ মুহূর্তে উৎপীঠিকায় রক্ষিত একটি তাম্রশাসনের উপর ঝুঁকে পড়ে গভীর অভিনিবেশ সহকারে মাশাত্তুবান কিছু পরীক্ষা করছেন। গ্রিক বণিকদের সঙ্গে তাঁর আদানপ্রদান বিষয়ে পাঁচ বৎসর পূর্বে যেসব চুক্তিপত্র হয়েছিল, পরীক্ষার বিষয়বস্তু এখন সেইগুলিই। এসব বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়, বৈদেশিক বণিক সততই তঞ্চকতার পরাকাষ্ঠা, সামান্য বেচাল দেখলেই ওদের থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ; অন্যথায় নিঃস্ব হয়ে পথে বসতে অধিক সময় লাগবে না।

একদণ্ড পরে এক বয়স্ক ব্যক্তি আরও কতগুলি তাম্রশাসন ও তালীপত্র নিয়ে এ কক্ষে মাশাত্তুবান-সকাশে উপস্থিত হলেন। সহাস্যে আপ্যায়ন করে পর্যঙ্কের উপর নির্দিষ্ট আসনে তাঁকে উপবেশন করতে বললেন মাশাত্তুবান। করধৃত একটি তাম্রপত্রে মাশাত্তুবানের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘মিত্র! রোমক বণিকরা পুনরায় আমদানিকৃত প্রবালের মূল্য বৃদ্ধি করছে। এদিকে রপ্তানির উপর রাজার শুল্ক এ বছর অত্যধিক। এতদিকে সামলানো তো কঠিন হয়ে পড়বে!’

এই বৃদ্ধের নাম কলানিধি, ইনি মাশাত্তুবানের আবাল্য মিত্র, এসব হিসেবের ব্যাপার ইনিই দেখাশোনা করেন। আজন্ম ভাগ্যহত কলানিধি ! নিতান্ত দরিদ্র পরিবারে মেধাবী মানুষটির জন্ম। যদি কলানিধির পিতা বিত্তবান বণিক হতেন, তাহলে কোন সমৃদ্ধির শিখরে উঠতেন যে!

কৈশোরকাল থেকেই মাশাত্তুবান মিত্র কলানিধির ঘনিষ্ঠ। তিনি জানেন, কলানিধির বৈষয়িক বুদ্ধি প্রখর। বহু বর্ষ পূর্বে মাশাত্তুবান যখন এ ব্যবসা সামান্যভাবে আরম্ভ করেছিলেন, এতে চার-পাঁচ জন ব্যক্তির অংশীদারিত্ব থাকলেও বিত্তহীন কলানিধির কোনো অংশ ছিল না। তখনই উপদেষ্টা পদে সূক্ষ্মবুদ্ধি কলানিধিকে ডেকে নেন মাশাত্তুবান । তাঁরই অনুরোধে কলানিধি হিসাব-পরীক্ষার দায়িত্বও নেন। বর্তমানে কলানিধিও বণিক মাশাত্তুবানের মতোই বৃদ্ধ হয়েছেন। অবশ্য তাতে কিছু আসে-যায় না, কলানিধির গাণিতিক জ্ঞান ও বিষয়বুদ্ধি এখনও যথেষ্ট প্রখর। তবুও সমস্ত চুক্তি ও হিসাবের স্বীকৃতিপত্রে মাশাত্তুবানকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কখন যে বিত্তকোশের ছিদ্রপথে অনবধানের মূষক প্রবেশ করবে, বলা যায় না। সজাগ সতর্কতাই ব্যবসার প্রকৃত মূলধন ।

মাশাত্তুবান খানিক ভেবে কলানিধির কথার উত্তর দিলেন, ‘আমরাও মশলার দাম বাড়াব। ওরা তো ইদানীং খুব মশলা আর সুগন্ধি কিনছে। কস্তুরীর মূল্যবৃদ্ধিতে অসুবিধা কী?’

‘অসুবিধা এই যে, তখন ওরা কস্তুরীর জন্য অন্য বিপণিতে যাবে, যেখানে মূল্য কম পাবে সেখানেই। প্রকৃতপক্ষে পুষ্পহারে প্রতিদিন বিত্তের যে-লেনদেন হয়, সমষ্টিগতভাবে তা কিন্তু প্রায় ধ্রুবক। এখানে না কিনে সেখানে যাবে,’ কলানিধি বললেন।

‘কিন্তু অন্য বিপণিপালরা আমাদের কস্তুরী পাবে কোথায়? আমাদের বিপণির কস্তুরীর মান অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। রোমকদের প্রীতি কিন্তু গুণমাননির্ভর। খাঁটি জিনিস যেখানে পাবে, সেখানেই অধিক দাম দিয়ে হলেও কিনবে।’

‘তা অনেকটা সত্যি। তারপরেও ব্যাপারীর চরিত্র সব দেশেই কিন্তু কম-বেশি একই প্রকার । রোমক হোক, গ্রিক হোক, মিশরীয় হোক, চৈনিক হোক বা মূর হোক–ব্যবসায়ী মাত্রেই হিসাবনিষ্ঠ হয়, বন্ধু। ধরো, আমাদের নিকট হতে উচ্চমানের কস্তুরী অল্প পরিমাণ ক্রয় করল আর অন্য বিপণি থেকে নিম্নমানের কস্তুরী অধিক পরিমাণে কিনে নিয়ে দেশে ফিরল। তারপর সেখানে খোলা হাটে লোকসাধারণের জন্য নিম্নমানের কস্তুরী দাম বাড়িয়ে বিক্রয় করবে আর উচ্চমানের কস্তুরী নিজেদের কাছে বহু দিন লুকিয়ে রেখে পরে আরও অধিক চড়া দামে রোমক সেঞ্চুরিয়নদের কাছে বিক্রয় করবে। দুদিক থেকেই লাভ তুলবে ধূর্ত ধুরন্ধরের দল,’ কলানিধি উত্তর দিলেন।

কলানিধির কথা শুনে মাশাত্তুবান উচ্চরোলে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ঠিকই বলেছ, মিত্র। কথাটা খানিক ঠেস-দেওয়া হলেও নির্জলা সত্য কথা। ব্যবসায়ী মাত্রেই হিসাবনিষ্ঠ। এ না হলে ব্যবসা চলে না,’ এই কথা বলেই সহসা হাস্য-সংবরণ করে নিয়ে চিন্তান্বিত স্বরে মাশাত্তুবান যোগ করলেন, ‘আর সেইটেই তো এখন আমার প্রধান চিন্তা, ভাই । প্ৰায় শূন্য থেকে এ ব্যবসা আমি আরম্ভ করেছিলাম। আজ কুবেরজীর কৃপায় ব্যবসাপাতি দাঁড়িয়েও গিয়েছে। কিন্তু আমাদের অবর্তমানে এ ব্যবসার কী ভবিষ্যৎ, কে জানে!’

মাশাত্তুবানের কথায় ভিন্ন প্রসঙ্গের গন্ধ পেয়ে কলানিধি তাঁর দিকে শূন্যচোখে তাকিয়ে শুধোলেন, ‘কেন, কী ব্যাপার ?’

মাশাত্তুবান বললেন, ‘কী আর? আমি ভাবছি আমার পুত্ররত্নটির কথা!’

‘কোভালন? কেন, কোভালনকে নিয়ে চিন্তা কী? তার স্বভাবচরিত্র এখনও অবধি যা দেখেছি, যথেষ্ট সন্তোষজনক। সুন্দর ছেলে। তাকে নিয়ে ভাবনার কী আছে ?’

‘আছে, বন্ধু, আছে। তুমি ওর চোখ দুটো দেখেছ?’

কলানিধি বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘দেখব না কেন? ওকে ওর শৈশব থেকেই দেখছি। কম দিন তো আর তোমাদের পরিবারের অন্তরঙ্গ নই আমি, বন্ধু!’

‘ভ্রাতঃ! গণিতে তুমি অদ্বিতীয় হলেও মনস্তত্ত্বে কাঁচা—একথা আমাকে বলতেই হচ্ছে। কোভালনের চোখে ব্যবসাবুদ্ধির অণুমাত্র ছিটেও আমি দেখতে পাই না, কলানিধি ওর দৃষ্টিতে শুধু কবিতার ফেনা আর কল্পনার অসার কুয়াশা।’

তুমি কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত চিন্তা করছ, বন্ধু ! অনর্থক ছেলেটাকে নিয়ে ভাবছ,’ কলানিধি বললেন।

‘অনর্থক নয়, কলানিধি, অনর্থক নয়। খুব বাস্তবঘনিষ্ঠ হয়েই ভাবছি। তুমি এ পর্যন্ত ক-টা দিন কোভালনকে বিপণিতে নিয়মিত আসতে দেখেছ?’

‘সেটা হয়তো এই বয়সের পক্ষে স্বাভাবিক। ধীরে ধীরে কোভালনও ব্যবসায় নিয়মিত হয়ে যাবে।’

মাশাত্তুবান গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘হলেই মঙ্গল, ভাই, সে হলেই মঙ্গল। কিন্তু তা হবে কি আমার কপালে? তুমি জানো, কোভালন অনেক সময় ন্যায্য লাভ হাতে পেয়েও ছেড়ে দেয়? বিপণিকোশ সমৃদ্ধ করার দিকে ওর মন নেই। ও কীসব কবিতা ইত্যাদি লেখে। গান গায়। বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় না কোথায় ঘুরে বেড়ায়। এই সব সর্বনাশা অভ্যাস ব্যবসার পক্ষে মোটেই মঙ্গলজনক নয় । আমার উত্তরাধিকারীটিকে নিয়ে আমি বেজায় চিন্তিত, বন্ধু।’

কলানিধি বললেন, ‘এখন তো বিবাহ দিয়েছ। এখন হয়তো বহির্মুখী ভাবটা কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে।’

‘হ্যাঁ। সেটাই আমার আশা। পুত্রবধূটি আমার হয়েছে বড়ো খাঁটি। বণিক মানাইক্কনের কন্যা কন্নকী। মেয়েটা পুরোপুরি তার বাপের ধারা পেয়েছে। সুচিন্তক, বিবেচক, বাস্তববোধসম্পন্ন। এখন এই বধূর সংস্পর্শে এসে যদি আমার ছেলেটা খানিক শুধরোয়!’

‘তা তুমিই-বা কোভালনকে বিপণিতে আসার ব্যাপারে আরও নিয়মিত হতে বলছ না কেন? দু-চার দিন ব্যবসার কার্যে ওকে ডোবাতে পারলে তখন নিশ্চয়ই ওর আগ্রহ বাড়বে।’

কলানিধির কথা শুনে মাশাত্তুবান হাসতে লাগলেন। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি বললে যতটা শুনবে, তার থেকে ওর বউ বললে এখন কথা শুনবে বেশি। ওই জন্যেই আমি কোভালনকে এখনই ব্যবসায় বেশি টানাটানি করছি না। এই বয়সটা আমি বুঝি। এখন সবে বিয়ে করেছে। স্ত্রীর সঙ্গে ভালোভাবে ঘনিষ্ঠতা, ভাব-ভালোবাসা হোক । তাহলে পরে স্ত্রীর নির্দেশেই কোভালন এ ব্যবসায় অধিকাধিক মন দেবে। পুত্রবধূটির উপর আমার অগাধ আস্থা আছে। ও ঠিক কোভালনকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে। বুঝলে বন্ধু? হা হা হা!’

দুই বৃদ্ধ খোলা মনে হাসতে লাগলেন। পূর্ব প্রজন্মের মানুষ সব, সাংসারিক বুদ্ধিতে পাকা হলেও প্রজন্ম-ব্যবধানের ব্যাপারে তেমন চিন্তা করেননি। বর্তমান প্রজন্মের উপরে যে বিগত প্রজন্মের নিয়ম তত খাটে না, অধুনাতন কালের ছেলেমেয়েদের উপর যে সংসারের বাঁধন ক্রমশ শিথিলতর হচ্ছে, মাশাত্তুবান বা কলানিধি কেউই সেকথা ভালো করে ভেবে দেখেননি ।

তাঁদের কথালাপ ও মিলিত হাস্যের মধ্যে বিপণির এক কর্মী উপস্থিত হল। লোকটি সবিনয়ে জানাল, জনৈক মিশরীয় পুরুষ মাশাত্তুবানের দর্শনপ্রার্থী। মাশাত্তুবান দর্শনার্থী মিশরীয়কে এ কক্ষেই নিয়ে আসতে বললেন। কর্মীটি ধীর পায়ে কক্ষ পরিত্যাগ করে বাহিরে চলে গেল।

কলানিধির দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি মেলে মাশাত্তুবান বললেন,

‘একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ, সখা?’

‘কী?’

‘সম্প্রতি পুষ্পহারে বিদেশী ব্যক্তিদের গমনাগমন কী প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে?’

কলানিধি বললেন, ‘সে তো ভালোই। এতে তো আমাদেরই সুবিধা। বিদেশীরা যত আসে, ব্যবসাবাণিজ্যের পক্ষে ততই মঙ্গল।’

মাশাত্তুবান মাথা নেড়ে বললেন, ‘না-না, সেকথা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্যের কথা বলছিই না আমি এখন। বলছি আমাদের সমাজের কথা। ব্যবসার সূত্রেই পৃথিবীর যেকোনো দিক থেকে বিদেশীরা জলপথে পিলপিল করে এই চোলমণ্ডল আর চেরমণ্ডলে এসে ঢুকছে। কেউ কেউ আবার এখানেই সংসারাদি করে আমৃত্যু থেকেও যাচ্ছে। বিদেশীদের আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি সমস্তই আমাদের থেকে আলাদা। কিন্তু এদের সঙ্গে এই যে আমাদের এত মেশামিশি হচ্ছে, তার ফলে আমাদের সমাজের নিজস্ব প্রথাপ্রকরণ সমস্তই গুলিয়ে যাচ্ছে না কি? কেমন যেন একটা নৈরাজ্যের অবস্থা! এখনই সমাজকে পূর্বতন কঠোর বাঁধনে বাঁধতে না পারলে…’

এসব কথাবার্তার মধ্যেই সেই আগন্তুক মিশরীয় কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করল। আগন্তুকের কোমর থেকে পা পর্যন্ত ধূসর শনের কাপড়, পায়ে প্যাপিরাসের পাদত্রাণ, বলিষ্ঠ তামাটে ঊর্ধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত, কণ্ঠে ও বাহুতে বিশুষ্ক পত্রবৃত্তের কণ্ঠি, দুটি বড়ো বড়ো কালো চোখে প্রগাঢ় কজ্জলরেখা, কর্ণে কুণ্ডল, মুণ্ডিত শিরোদেশের এক পার্শ্বে সুদীর্ঘ বেণী লম্বমান । মিশরীয় আগন্তুক নিজদেশীয় ভঙ্গীতে অভিবাদন জানাল। তারপর সুস্পষ্ট তামিল ভাষায় কুশল জিজ্ঞাসা করল।

মাশাত্তুবান কথঞ্চিৎ অবাক হলেন। মিশরীয় অতিথি তামিল ভাষায় কথা বলছে বলে তত নয়, কেননা পুষ্পহারে অনেক বিদেশীই বহুদিন ধরে থাকতে থাকতে তামিল শিখে যায়। মাশাত্তুবান অবাক হলেন মিশরীয় লোকটির কুশলপ্রশ্ন করার ভঙ্গিমা দেখে । তার ভাষায় ও ভাবে এমন কিছু ছিল, যার থেকে মনে হয় যেন এ লোকের সঙ্গে মাশাত্তুবানের আগে কোথাও পরিচয় হয়েছে। কিন্তু সে কবে কোথায়, মাশাত্তুবান কিছুই মনে করতে পারলেন না।

প্রত্যভিবাদন জানিয়ে মাশাত্তুবান প্রশ্ন করলেন, ‘মহাশয়ের সঙ্গে কি আমার আগে দেখা হয়েছে?’

মিশরীয় উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, মহাশয়। আমার নাম আমেনহোটেপ। বহু বৎসর পূর্বে এই বিপণিতেই আমি আপনার সঙ্গে একটি বিশেষ প্রয়োজনে দেখা করেছিলাম।’

এতক্ষণে পুরোনো কথা সব মনে পড়ে গেল মাশাত্তুবানের। বহু বছর আগের কথাই বটে! এই মিশরীয় ব্যক্তি এসেছিল কী একখানা পুথির খোঁজে। জ্যোতিষশাস্ত্রের পুথি । যত দাম লাগে লাগুক, সে কিনতে চায়। কিন্তু সেই পুথির খোঁজ মাশাত্তুবান দিতে পারেননি। বলেছিলেন, ও পুথি তাঁর কাছে নেই। তাতে লোকটি মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে চলে যায়। এইটুকুই মনে আছে ।

মাশাত্তুবান বললেন, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। আপনি কী যেন একটা পুথির সন্ধান করছিলেন, তাই না?’

মিশরীয় বলল, ‘হ্যাঁ। সে অনেক বছর আগের কথা।… কিন্তু আজ এসেছি অন্য কারণে।’

কলানিধি বলল, ‘হ্যাঁ, বলুন, কীভাবে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’

মিশরীয় কিন্তু কলানিধিকে অগ্রাহ্য করে সরাসরি মাশাত্তুবানের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘আপনি কি বলতে পারেন, অনুরাধাপুর যাওয়ার অর্ণবপোত কবে নাগাদ পাওয়া যেতে পারে? আমি শুনেছি, আপনাদের নিজস্ব বাণিজ্যপোত আছে। মাঝে মাঝে সিংহলেও যায়।’

‘আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন?’ মাশাত্তুবান বললেন।

‘করছি, কেননা সেই পোতসহায়ে সিংহল যাত্রা করতে চাই।’

‘কিন্তু সে-পোত তো বাণিজ্যপোত, লোকসাধারণের যাতায়াতের জন্য নয়,’ মাশাত্তুবান বললেন।

‘জানি, কিন্তু বাণিজ্যপোতে মাঝিমাল্লাদের সঙ্গেই কোনোমতে একপাশে স্থান করে নিয়ে সিংহল যেতে চাই। তার জন্য যা অর্থ লাগে, আমি দেবো, চিন্তা করবেন না। আমি ব্যয়কুণ্ঠ নই,’ মিশরীয় উত্তর দিল।

একটু আগেই আগন্তুক প্রকারান্তরে কলানিধিকে উপেক্ষাই করেছিল। তথাপি এখন কলানিধি আলোচনায় নিজ তাগিদেই প্রবেশ করলেন, ‘আচ্ছা, বন্দরে তো তীর্থযাত্রীদের জন্য পৃথক তরণী আছে। আপনি তাতে করে অনুরাধাপুর যাচ্ছেন না কেন?’

মিশরীয় কিঞ্চিৎ ইতস্তত ভঙ্গিমায় বলল, ‘কারণ আমার সিংহলযাত্রার সংবাদ আমি অন্যদের কাছে প্রকাশ করতে চাই না।’

মাশাত্তুবানের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। গোপনে যেতে চাইছে ! কেন?

মাশাত্তুবান জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি একাই যাবেন?’

‘না। একা নই, সঙ্গে একজন আত্মীয়াও থাকবেন। অনুরাধাপুরে তীর্থে যাব।’

কলানিধি শুধোলেন, ‘আত্মীয়া? বয়স্কা মহিলা? সমুদ্রপীড়া আদি যদি হয়…’

মিশরীয় তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না-না। এই আমারই সমবয়স্কা হবেন তিনি !’

মাশাত্ত্ববান আর অধিক চিন্তায় কালক্ষেপ করলেন না। নিজের দায়িত্বে যেতে চাইছে, যাক। গোপনে যাবে না প্রকাশ্যে যাবে, কাকে নিয়ে যাবে, সেসব ওর ব্যাপার। মাশাত্তুবান বললেন, ‘এক পক্ষকাল পরে আমাদের একটা বাণিজ্যপোতের অনুরাধাপুর যাওয়ার কথা আছে। আপনি দশ দিবা পরে এখানেই আমার সঙ্গে দেখা করতে পারেন? দেখি, যদি কোনো ব্যবস্থা করতে পারি!’

মিশরীয় সানন্দে উত্তর দিল, ‘অনেক ধন্যবাদ, মহাশয়। আমি দশ দিবা পরেই আসব।’

এই বলে দুজনকেই পুনরভিবাদন জানিয়ে মিশরীয় ব্যক্তি খুশি মনে বিদায় নিল।

তার গমনপথের দিকে একবার তাকিয়ে পরমুহূর্তেই কলানিধির প্রতি অপাঙ্গ দৃষ্টি হেনে মাশাত্তুবান বললেন, ‘বোঝো! অনুরাধাপুর যাবে, তাও আবার গোপনে!’

কলানিধিও বঙ্কিম হেসে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ। সঙ্গে আবার সমবয়স্কা একজন সঙ্গিনী ও যাবেন। স্ত্রী নন, আত্মীয়া!’

দুই বৃদ্ধ একই সঙ্গে তরল অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন।

(আট) পরাভব

এর বছর দুয়েক পরের এক গ্রীষ্মকালীন রাত্রি।

     নিশান্তিক প্রহর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল; শয্যার ওপরে ধীরে উঠে বসল কোভালন। কক্ষে আবছা আলো-অন্ধকারের কুহকজাল রচিত হয়েছে। দেওয়ালের কুলুঙ্গিতে দীপদানে প্রদীপের স্তিমিত শিখা দীপ্তি ছড়াচ্ছে। বাতাসে কর্পূরের মৃদুস্থির আঘ্রাণ। প্রদীপের সেই স্তিমিতালোকে শয্যাপার্শ্বে চেয়ে দেখল কোভালন। উপাধানে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমিয়ে আছে কন্নকী। সে সম্পূর্ণ নগ্নশায়িতা। যেন এই পর্যঙ্কে জগতের সমস্ত সৌন্দর্য, সমস্ত কামনা ঘনীভূত, মূর্ছিত হয়ে পড়ে রয়েছে। কোভালনের মনে পড়ল, তারা উভয়েই মধ্যনিশীথে তুমুল কামক্রীড়ার পর রতিসুখাবেশে আতুর হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

বাতায়নপথে দূরের আকাশের দিকে, স্তব্ধবাক অন্ধকারে সমাহিত নগরীর দৃশ্যমান ছায়ানুকৃতির দিকে তাকিয়ে রইল কোভালন কিছুক্ষণ। সমস্তই ছায়াময়, নগরী সুপ্তিমগ্ন। এ মুহূর্তে শুধু এই ছায়ারাশির থেকেই নগরীর বাস্তব অস্তিত্ব অনুমিত হয়। নিকটস্থ উন্নতশীর্ষ বৃক্ষগুলি ওই ছায়ার মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে, হয়তো-বা দক্ষিণ-সমুদ্ৰাগত বাতাসে তাদের শাখাপ্রশাখা সামান্য কম্পিত হচ্ছে; ফলত সন্নিহিত অন্ধকার ঈষৎ কম্পমান। বহুদূরে প্রাকার পেরিয়ে রাজপথের ধারে যেসব দীপদণ্ডগুলি আছে, তাদের শিরোভূমিকায় স্থাপিত প্রদীপের তির্যক আলোকরশ্মি অন্ধকার-সমুদ্রের বুকে কম্পমান নক্ষত্রের দীপ্তির মতন যেন এসে পৌঁছোচ্ছে কোভালনের চোখে। মনে হল কোভালনের— যেন কোন অন্ধকার নিশীথসমুদ্রের ঢেউ ঠেলে সে আর তার প্রিয়তমা কন্নকী অতিদূর দ্বীপময় পৃথিবীর উদ্দেশে যাত্রা করেছে আজ, তাদের দ্বিতলের শয়নকক্ষটি যেন সমুদ্রগামী তরণীর একটি ক্ষুদ্র কক্ষ, পোতনিম্নে তমসাসমুদ্রের ঊর্মিমালা সগর্জনে উঠছে, পড়ছে।

কোভালন-কন্নকীর বিবাহের পরে দুই বর্ষকালপ্রায় অতীত হয়ে গেছে। বিবাহের কিছুদিন পরেই কোভালনের জননী দ্বিতলবিশিষ্ট এই সুন্দর প্রাসাদটি পুত্র ও পুত্রবধূকে উপহার দেন। অবশ্য এ প্রাসাদ আগে যে এখানে ছিল না, তা নয়। বহু বর্ষপূর্বে, কোভালনের পিতামহের আমলে এই সৌধ নির্মিত হয়েছিল। কালের নিয়মে প্রাসাদটি প্রাচীনও হয়ে পড়েছিল। কোভালনের বিবাহ-উপলক্ষ্যে এ প্রাসাদের সংস্কারসাধন ও পুনর্নবীকরণ করা হয়। এখন বহু দাস-দাসীতে পরিপূর্ণ, সুসজ্জিত প্রাসাদটি কন্নকী ও কোভালনের প্রেমের স্পর্শে দিনে দিনে যেন চিন্ময় হয়ে উঠেছে। এ গৃহ থেকেই আজকাল কোভালন তার পিতার ব্যবসায় দেখাশোনা করে। তবে কাজকর্মে আগেকার মতো মনোনিবেশ করতে পারছে না কোভালন আজ এক বছর। এ নিয়ে পিতা মাশাত্তুবানের মনে আক্ষেপ থাকলেও ক্ষোভ নেই। কেন কোভালন ইদানীং কাজে তেমনভাবে মন দিতে পারছে না, তা তো দুর্বোধ্য কিছু নয়। কোভালনের বয়স ও অভিজ্ঞতা-পর্যায় মাশাত্তুবান নিজেও তাঁর প্রথম যৌবনে অতিক্রম করে এসেছেন ।

কন্নকীকে পেয়ে যেন একটা দুর্গম নতুন দেশ আবিষ্কার করার উত্তেজনা কোভালনের চেতনাকে অধিকার করে রেখেছে। অথবা পূর্ণযৌবনা কন্নকী যেন একটা রহস্যময় দুর্গ; বহু অলিন্দ, খিলান, প্রাকার, পরিখা সমন্বিত যেন এক বিস্ময়কর প্রাসাদ। সেই প্রাসাদের অনির্বচনীয় দ্বারপথসমূহে কে এক রহস্যময়ী নারী ওষ্ঠে অঙ্গুলী রেখে কোভালনকে ক্রমাগত যেন আরও শঙ্খিল, আরও রোমাঞ্চকর পন্থায় অহোরাত্র আকর্ষণ করে চলেছে। প্রণয়লীলা সম্পর্কে কোভালনের মনে এতদিন যে অস্পষ্ট পরোক্ষ-জ্ঞান ছিল, এখন তা দিনে দিনে প্রত্যক্ষগোচর হয়ে উঠছে। এমন হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা যে-দেশে ইতিহাসের প্রাগূষালগ্ন থেকে ধর্ম-অর্থ-মোক্ষের সঙ্গে কামকেও জীবনের তৃতীয় পুরুষার্থ হিসেবে উচ্চমান দেওয়া হয়েছে, যেখানে এই তৃতীয় পুরুষার্থের সুনিয়ন্ত্রিত বিজ্ঞান, পরিশীলিত কলা ও সম্যক উপলব্ধির নিয়মিত চর্চাকে আশ্রয় করে ‘কামশাস্ত্র’ রচিত হয়েছে, যে-জাতির শাস্ত্রগ্রন্থে ‘ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি’  ইত্যাদি বাক্যের দ্বারা প্রতিটি জীবদেহে উপস্থিত ধর্ম-অবিরুদ্ধ স্বাভাবিক কামচেতনাকে স্বয়ং শ্রীভগবান নিজের একটি রূপ বলে ঘোষণা করেছেন, এবং যে-দেশের চেতনা তখনও পর্যন্ত সেমিটিক ধর্মের দ্বারা প্রচারিত
‘পাপবাদ’ ও তারই ফলস্বরূপ পাশ্চাত্যদেশাগত শরীরসর্বস্ব কলুষতার কুশ্রী প্রভাবের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি, সমগ্র জীবনকে যে-দেশের মানুষ আনন্দ হতে উৎসারিত, আনন্দে স্থিত ও আনন্দে বিলীয়মানরূপে জানার জন্য বাল্যকাল হতে স্বার্থশূন্য হওয়ার ক্রমান্বয়িত শিক্ষা পেয়ে এসেছে
—সেই দেশেরই এক যুবক কোভালন, সেই দেশেরই এক যুবক কন্নকী—বাস্তব জীবনকে ভানহীনভাবে জানার আনন্দ থেকে কখনও তারা বঞ্চিত হয়নি। প্রেমে, বিচ্ছেদে, তপস্যায়, দারিদ্র্যে, আত্মবিলয়ে, জীবনে ও মৃত্যুতে তাদের সেই এক আন্তরিক ভানহীনতারই সাধনা।

কিন্তু এত কথা সম্যকভাবে জেনে-বুঝে তারা বিবাহোত্তর দাম্পত্যজীবনে প্রবেশ করেছিল, একথা বললে নিতান্ত অমূলক, অর্থহীন কথাই বলা হবে। তা কখনোই হতে পারে না। বরং উপরিলিখিত কামচেতনা আমাদের দেশের সমষ্টিচেতনায় এমন অজ্ঞাতসারে মিশে ছিল যে, প্রায় অর্ধচেতন বা অসচেতনভাবেই এ দেশের যুবক-যুবতীরা সুস্থ, স্বাভাবিক প্রণয়লীলার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারত। তারা জানত না, তাদের প্রত্যেকটি ক্রিয়া, প্রত্যেকটি ভঙ্গিমা, প্রতিটি নিবেদনের ভিতর সুদূরকালের পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীদের আশীর্বাদ ও অভিজ্ঞান জড়িত হয়ে আছে।

এই যেমন আজ রাত্রির দ্বিতীয় যামে কোভালন ও কন্নকী প্রবল সংরাগে মিলিত হচ্ছিল। সন্ধ্যা থেকেই কালবৈশাখীর মেঘাড়ম্বর, বাইরে অবিরত বৃষ্টিপাত, ঘনাচ্ছন্ন আকাশ চিরে থেকে থেকে বজ্রবিদ্যুতের আস্ফোট। রতিক্রীড়ায় নিরত প্রণয়ী-প্রণয়িনী আনন্দসাগরে ভেসে যাচ্ছিল। গবাক্ষ বেয়ে ধেয়ে আসছিল বৃষ্টিভেজা শীতল বাতাস । বাতায়নে তিরস্করণী-সংলগ্ন সুন্দর রত্নমণিগুলি বাতাসের বেগে বেজে উঠছিল–ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ ঝুম্ । কাচাবরণে রক্ষিত প্রদীপের শিখা বাতাসের বেগে কাঁপছিল—থির্ থির্ থির্ থির্। সে-বাতাস তো আর শুধু পুষ্পহারের নয়, সে যে কত দূরদেশের বাতাস! সে কোথায় যেন এক নিভৃত পুষ্পোদ্যান, ভ্রমরপঙক্তি গুনগুন করছে সেখানে ফুলের চারপাশে, বাতাসের মধ্যে মিশে আছে সেই সব নীল ভোমরাদের গুঞ্জন। কোথাও হয়তো নির্জন জলাশয়ের উপর বৃষ্টিধারা পুলকশর বর্ষণ করছে, সেই জলাশ্রয়ে ভাসমান কমলবনের সুরভিও মিশে গেছে এই বাতাসে, কোথাও-বা এসে মিশেছে সদ্যোপ্রস্ফুটিত রক্ত-কুমুদিনীর সৌরভ। কত তড়াগ, কত পুষ্করিণী, কত হ্রদের পুষ্পবৈভব সমৃদ্ধ করে রেখেছে এই বাতাসের শরীর। অজানা কোন মাঠের ধারে, নির্জন পথের পাশে সারি সারি কত স্বর্ণচাঁপার গাছ প্রভূত বৃষ্টিসম্পাত সইছে। সেসব চম্পকের উষ্ণ হৃদয় থেকে মধুলুণ্ঠনকারী মৌমাছিরা মাতাল হয়েছে আজ, তাদের মত্ততা এই বাতাসের সঙ্গে মিশে এই ঘরের মধ্যে এসে কামক্রীড়ারতা কন্নকীসুন্দরীর বিস্রস্ত কেশ ও মৃদুহসিত মুখপদ্মের চারিপাশে নৃত্য করে চলেছে। কন্নকী ও কোভালনের উন্মুক্ত শরীরে সেই সুগন্ধিত বায়ুস্পর্শ সুখাবেশ সঞ্চার করছিল ঠিকই। কিন্তু ওরা কি জানত বায়ুবাহিত সুগন্ধির মধ্যে মিশে আছে কত দূরের সব নীরবিন্দু, পুষ্পরেণু, কত দূরের সেই জলদাশ্রয় আকাশের আশীর্বাদ, কত অশান্ত মধুমক্ষিকার গুঞ্জরন, কত উন্মথিত ভ্রমরভাষা? বাতাসের এসব উপাদান যেমন তারা অজান্তেই উপভোগ করছিল, ঠিক তেমনই সুদূর কালের সব মানুষ, অতীতের সব পূর্বপুরুষ-পূর্বনারীদের অভিজ্ঞতা ও আশীর্বাদও সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই তাদের রক্তস্রোতে বিস্পন্দিত হচ্ছিল। তারা এসব জানতে পারছিল না কিছুই, শুধু তাদের অস্ফুট শীৎকারধ্বনি বৃষ্টি-উন্মত্ত বাতাসের বিপুল ঝঞ্ঝাশব্দের মধ্যে অজান্তেই মিশে যাচ্ছিল…

ধীরে ধীরে বৃষ্টিবেগ স্তিমিত হয়ে এল, তারই সঙ্গে শিথিল হয়ে এল প্রণয়ীযুগলের আলিঙ্গন। আরও একটু পরে বর্ষণ থেমে গেল একসময়, মেঘ সরে গিয়ে আকাশে বেরিয়ে এল পূর্ণ চাঁদ। বৃষ্টিধোয়া বাতাস বইছিল খুব, শয্যা থেকে নেমে কোভালন আর কন্নকী পরস্পর হাতে হাত রেখে প্রাসাদের ছাদে গিয়েছিল। আকাশে ছিন্ন মেঘের স্তর ভেদ করে চন্দ্রমা কিরণসুধা ঢেলে দিচ্ছিল যেন। দূরের গাছগুলো এতক্ষণের বর্ষণসম্পাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল, এখন যেন তারা সামান্য বিশ্রামের অবসর পেয়েছিল। কোনো এক রাত্রিচরা পাখি চান্দ্র বিভাবরীর মায়া ডানায় মেখে সহসা নৈশ সংকেতে ভরে দিচ্ছিল নৈঃশব্দ্যের জঠর। কন্নকীর কাছে সরে এসে তার কপালের পাশে চূর্ণ কুন্তলগুচ্ছ সরিয়ে আদর করতে করতে কত মৃদু প্রণয়গুঞ্জন করে চলছিল কোভালন, কুসুমবিহারী কোনো ভ্রমরেরই মতন। সেসব প্রণয়কথার প্রত্যুত্তর দিচ্ছিল কন্নকী কখনও মৃদু হেসে, কখনও ঈষৎ মাথা নেড়ে, কখনও-বা অস্ফুটস্বরে কোভালনের কানে কানে। এই বর্ষণান্তর জ্যোৎস্নাধোয়া ছাদে কোথাও কি তাদের জন্য কুসুমায়ুধ হস্তে অদৃশ্য হয়ে অপেক্ষা করছিলেন পুরাণকথিত দেব পুষ্পকেতন ? তা না হলে কেন-বা বারংবার কন্নকীর উন্মুক্ত স্কন্ধদেশে কোভালন অন্যমনস্ক হয়ে আঁকছিল কামদেবের ধনু যা দিয়ে নির্মিত হয়, সেই কোমল ইক্ষুদণ্ডের ছবি?

সহসা প্রণয়জ্বরে পীড়িত হয়ে কন্নকী কোভালনের ওষ্ঠাধরে চকিত চুম্বন এঁকে দিয়েছিল। আর অপেক্ষা না করে কামজর্জর প্রণয়ী-প্রণয়িনী ছাদ থেকে ফিরে এসেছিল ঘরে। গভীর আবেগে পুনরায় তারা রতিক্রীড়ায় মগ্ন হয়েছিল। দিনকর ও নিশানাথের কিরণবেণীবন্ধনে উন্মথিত হয়ে উঠেছিল পুনর্বার ধরিত্রীর নীবিবন্ধ—উত্তাল ঊর্মিমালা। কন্নকীর কন্ঠের নীলপদ্মমালিকা কোভালনের গলদেশে লম্বিত যূথীহারে জড়িয়ে গিয়েছিল আলিঙ্গনের প্রাবল্যে। অবশেষে রতিক্রীড়া-অবসানে সন্তৃপ্ত দম্পতি ডুবে গিয়েছিল নিঃসাড়ে, অকাতরে শ্রান্তিহরা সুষুপ্তির ভিতর।

এখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠে নিদ্রিত কন্নকীকে মুগ্ধ নেত্রে দেখছে কোভালন। দেখতে দেখতে তার মনে কবিত্বের ফেনিল আবেশে জেগে উঠছে উপমার বাষ্পবেগ। মনে হচ্ছে, আহা! দেবতাদের মধ্যে যিনি পরমসুন্দর, সেই আদিদেব শিব কন্নকীকে নির্মাণ করতে গিয়ে তাঁর কপালের আধোচাঁদখানি হারিয়ে ফেলেছেন, কেননা এই সুধামুখী সুন্দরীর উজ্জ্বল ললাটফলকে ওই চন্দ্রার্ধই তো তিনি উলটোমুখে স্থাপন করেছেন।

হায়, সেই কামের দেবতা কন্দর্পেরই-বা কী দশা ! রূপসী কন্নকীর সঙ্গে যুদ্ধে কন্দৰ্প বুঝি পরাস্ত হয়েছেন, তাঁর পুষ্পধনুখানি হরণ করে নিয়ে কন্নকী এই আকর্ণবিস্তৃত অনুপম ভ্রূলতা রচনা করেছে।

যুদ্ধের সুদর্শন দেবতা ষড়ানন কার্তিকেয় তাঁর আগুন-ঝরানো তীক্ষ্ণ তির দুটি প্রদান করেছেন বুঝি কন্নকীকে; তাই বুঝি কন্নকীর দুটি আয়ত আরক্তপ্রান্ত নয়ন ক্রমাগত শানিত পার্শ্বদৃষ্টি হেনে মেঘের মতন কজ্জলিম অলকগুচ্ছকে মুহুর্মুহু শাসন করে চলে।

দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর দ্বিমুখী বজ্ৰত্রিশূল দিয়ে বুঝি নির্মাণ করেছেন অপরূপা কন্নকীর সুবঙ্কিম কটিদেশ; বজ্রহীন ইন্দ্রের রাজ্য কি তবে এবার বিপন্ন হবে অসুরের আক্রমণে? অমরলোকের অস্পরাদের চেয়ে এ মরলোকের কন্নকীসুন্দরী কি তবে মহেন্দ্রের প্রিয়তরা হয়ে উঠেছে? তা হলে তো ভয়ের কথা !

এই নারীর দেহসৌষম্যে লজ্জিত ময়ূর অরণ্যের অন্ধকারে বুঝি লুকিয়ে ফেলেছে তার রত্নখচিত পেখমরচিত আবরণ। হায়, কার্তিকেয়র বাহনের কী নিদারুণ দশা !

এ কবিতায় সরস্বতী সুস্থিরা, কেননা তাঁর বাহন রাজহংসটি মরালগমনা কন্নকীকে দেখে লজ্জা পেয়ে লুকিয়েছে গিয়ে স্নিগ্ধ কমলবনের অন্তরালে! এমতাবস্থায় দেবী ভারতী আর এখান থেকে অন্যত্র যাবেন কী উপায়ে?

অথবা এই সব অতিরিক্ত আভূষণেরই-বা কী প্রয়োজন? এসব তো স্বভাবসুন্দর কাব্যের গায়ে অতিশয়োক্তি অলংকারের মতন। যে স্বভাবতই সুন্দরী, তার এত সাজেরই কী দরকার? অমন আঁধার-মেঘের মতো সুগন্ধিত কেশভার, তাতে আর এত পুষ্পমালা পরিধানের কী প্রয়োজন? গুগ্‌গুল ধূপের সুগন্ধে যে-অলকরাজি আগে থেকেই ঘ্রাণমেদুর হয়ে আছে, তাতে নানা বর্ণের প্রলেপ কোন কাজে লাগে আর ? সমুন্নত স্তনযুগ্মে কী প্রয়োজন গুরুভার মুক্তামালার, যখন আগে থেকেই চন্দন-আলিম্পনে কুচগাত্রে আঁকা আছে মধুমাঙ্গলিক? একে তো মৃদুল কটিতট ভেঙে পড়তে চায় স্তনভারে নমিতাঙ্গীর, তার ওপর আবার এসব বহুমূল্য আভরণের ভারে তাকে আর অতিরিক্ত পীড়িত করা কেন? দ্যাখো তো, নাভিপদ্মে কেমন জমেছে শিশিরের মতো পুঞ্জ পুঞ্জ স্বেদবিন্দু, শ্ৰমজ সলিল! এসব অলংকার আসলে অতিরেক, এসব বাদ দিয়ে নিরাবরণা, নিরাভরণা প্রিয়তমাই তো সুন্দরের প্রতিমা।

এইভাবে প্রেমাস্পদা কন্নকীর অস্তিত্বের উপর প্রথমে ক্রমান্বয়ে নানা উপমা-কল্পনা আরোপ করে, পরে এক এক করে সেসব কল্পনার উপাদান নিঃশেষে সরিয়ে নিয়ে শুদ্ধ কেবল কন্নকীকেই মনে মনে আবিষ্কার করতে লাগল তৃপ্ত কোভালন। নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মের উপর মায়াকল্পনা আরোপ করে আমরা যেমন এ জগৎপ্রপঞ্চ দেখি, পরে আবার এসব কাল্পনিক উপাধি সরিয়ে নিয়ে নিষ্কল নিরুপম ব্রহ্মকে নিজস্বরূপে আবিষ্কার করি—এও ঠিক তেমনই। সুন্দরের বুকে অলংকার পরানো হল প্রথমে, তারপরে সেসব অলংকার অপ্রয়োজনবোধে সরিয়ে নিয়ে পরমপ্রেমাস্পদাকে নিজ-অস্তিত্বের গভীরে আবিষ্কার করে কৃতকৃতার্থ হওয়াই তো প্রেমিকের লক্ষ্য!

কিন্তু এই চিন্তাপ্রণালী পরিপক্ক হওয়ার আগেই চঞ্চল কোভালনের চিত্তে আরেকপ্রকার চিন্তাস্রোত উঠতে লাগল। তার মনে হল, কল্পনার কন্নকী আর বাস্তবের কন্নকীর মধ্যে কী বিপুল পার্থক্য।

নিজেই নিজেকে বলল কোভালন, কী ছার কবিতা যে লিখে চলেছি আমি এতদিন! কল্পনায় যে-কন্নকীকে এতদিন ধরে আমি খুঁজে বেড়িয়েছি, সেসব যে কত নিঃসার, তা বুঝতে পারলাম এখন, যখন কন্নকীকে আমি বাস্তবে আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে পেলাম। কী সব ছেলেমানুষি করে বেড়িয়েছি রাত্রিদিন শব্দ সাজিয়ে সাজিয়ে! শব্দময়, ধারণাময় সেই কবিতার কন্নকীর চেয়ে এই প্রাণবন্ত বাস্তবতার কন্নকী কত বেশি সত্য! কত বেশি সুন্দর!

অধিকতর সত্য? অধিকতর সুন্দর বাস্তবের এই কন্নকী? কিন্তু তাহলে আমার কবিতার কী হবে? তবে কি কবিতার কোনো অর্থ ছিল না আমার? সবই কি ছিল তবে কল্পনার নিঃসার বুদ্বুদ? কোনো সার্থকতা ছিল না সেসব শ্লোকের, যা আমি আমার সত্তা মোক্ষণ করে আবিষ্কার করেছিলাম? শুধু এই ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষের বাস্তবতাই কি তবে সত্য? কল্পনার কোনো দাম নেই?

কন্নকীর নগ্ন রূপের থেকে অপ্রসন্ন মুখে চোখ সরিয়ে নিল কোভালন । প্রশ্নখচিত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল বাতায়নের দিকে। সেখানে নিরবয়ব অন্ধকার কোনো উত্তর দিতে পারল না। শুধু অলংকৃত তিরস্করণী পেরিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে লাগল রাত্রির অন্তিম প্রহরে মনখারাপের বাতাস।

(নয়) জিজ্ঞাসা

সহসা আনন্দের তুঙ্গনাথ থেকে নীচে বিষাদ-উপত্যকায় যেন গড়িয়ে পড়ল কোভালনের মন। বাস্তবের কন্নকী সত্য, জীবন্ত। আর কবিতার কন্নকী শুধু কল্পনার নিঃসার ফেনা—এই কথা বিষণ্ন মনে ভাবতে ভাবতে কখন যেন সেই মনখারাপিয়া আকাশ বেয়ে ভেসে এল অনেক দিন আগের এক টুকরো স্মৃতিমেঘ।

সে অনেক দিন আগের কথা। কোভালন তখন কিশোর। পুষ্পহার নগরে এসেছিল উন্মাদপ্রায় একটি মানুষ। পরনে শুধু একখানি ছিন্ন বস্ত্র, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। নিস্তেল রুক্ষ কেশ, শীর্ণ দেহ। তবু তার মুখখানি সব সময়েই আনন্দে উদ্ভাসিত। লোকে বলত, এ উন্মাদ। নগরের দুষ্ট বালকেরা লোষ্ট্র নিক্ষেপ করে তাকে আক্রমণ করত বলে মানুষটি কাবেরীর একটি জনবিরল ঘাটের কাছে এক বৃক্ষতলে বসবাস করত। কেউ ভিক্ষা দিলে আহার করত, অন্যথায় নিরম্বু উপবাস। কিন্তু সব অবস্থাতেই তার মুখাম্বুজশ্রী আনন্দময়, মঞ্জুল, মঙ্গলপ্রদ।

তার সদাপ্রসন্ন মুখে লেগে থাকত শুধু একটি কথা। বারবার বলত, ‘লাগ ভেলকি, লাগ!’ কোনোদিন ঝড়বৃষ্টি হলে প্রকৃতির সেই তাণ্ডবের মধ্যে দুহাত তুলে নাচত আর চিৎকার করে বলত, ‘ভেলকি! ভেলকি! সব ভেলকি ! লাগ ভেলকি, লাগ !

কিশোর কোভালন একদিন গিয়েছিল মানুষটির কাছে। জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোন ভেলকির কথা বলছ তুমি, পান্থ?’

মানুষটি অমনি চেঁচিয়ে উঠে বলেছিল, ‘ভেলকি। ভেলকি। সব ভেলকি ! আকাশ ভেলকি, বাতাস ভেলকি, আগুন ভেলকি, জল ভেলকি, মাটি ভেলকি। পৃথিবী ভেলকি, মানুষ ভেলকি, পশুপাখি, গাছপালা, যা দেখছ, যা অনুভব করছ—সব ভেলকি!’বলতে বলতে মানুষটির মুখ আনন্দে যেন একেবারে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল।

কোভালন জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তবে তোমার এই আনন্দটাও ভেলকি?’

এক লহমায় হঠাৎ মানুষটা গম্ভীর হয়ে গেছিল। একটু পরে আবার হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘না। এই আনন্দই শুধু ভেলকি নয়, বাবু ! এ আনন্দ সত্য। আর সব ভেলকি। এসব ভেলকি একেবারে ছেড়ে দিতে পারলে, নিজের বলে কিছুই আর না রাখলে, তবেই এই সত্যিকারের আনন্দ হয়। সেই আনন্দ একবার এলে আর যায় না।’

কিশোর কোভালন বলেছিল, ‘ভেলকি মানে তো ভ্রম। তোমার কথা-অনুযায়ী, সবই যদি ভেলকি হয়, তবে তো আমরা সবাই ভেলকির মধ্যেই আছি। ভেলকির মধ্যে থেকে ভেলকিকে ভেলকি বলে বুঝব কী করে? ভেলকির বাইরে গিয়েই বা আনন্দ পাব কী প্রকারে?’

এই প্রশ্নে লোকটা যেন ভারি খুশি হল। কাছে এসে কোভালনের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘সে আছে একটা উপায়। দ্যাখো বাবু, ভেলকির মধ্যেও দুরকম আছে। এক ধরনের ভেলকি আনন্দের খবর দেয়, আনন্দের কাছে নিয়ে যায়—তাকে বলে সংবাদী ভেলকি। আরেক ধরনের ভেলকি আনন্দের খবর দেয় না, আনন্দের কাছে নিয়ে যায় না, বরং ঠিক তার উলটোদিকে নিয়ে যায়—তাকে বলে বিসংবাদী ভেলকি।’

কোভালন বলল, ‘কী বলছ, ঠিক বুঝতে পারছি না।’

মানুষটি আরও আন্তরিক সুরে বলল, ‘এই যেমন ধরো, ওই দূরে একটা মন্দির আছে। তুমি দাঁড়িয়ে আছ এখানে। হঠাৎ মন্দির থেকে একটা আলোর রশ্মি এসে তোমার চোখে লাগল—মনে হল, মন্দিরের ভেতর কী যেন একটা চকচক করছে। তুমি ভাবলে, গিয়ে দেখি তো কী চকচক করছে! তখন ওই আলোর রেখাটা ধরে ধরে এগিয়ে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে দেখলে একটা উজ্জ্বল দুর্মূল্য মণি আলো ছড়াচ্ছে। তাহলে আলোর রশ্মি তোমাকে মহার্ঘ মণির কাছে নিয়ে গেল। একে বলে সংবাদী ভেলকি। আর ধরো, যদি আলোর রশ্মিকে অনুসরণ করে মন্দিরে ঢুকে দেখলে খালি একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছে, আর কিছুই নেই—ভোঁ ভাঁ! তাহলে লাভ হল লবডঙ্কা, মানে কিছুই না ! একেই বলে বিসংবাদী ভেলকি। বুঝলে, বাবু?’

মানুষটি কিছুদিন পরেই পুষ্পহার ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তাকে আর কোনোদিন দেখেনি কোভালন ৷

তার কথার অর্থ সেদিন কোভালন কিছুই বুঝতে পারেনি। কিন্তু আজ বোধহয় বুঝতে পারছে কিছুকিছু।*

কন্নকীকে নিয়ে কোভালনের কবিতা—সেসব এক ধরনের ভেলকি তো বটেই। কারণ কবিতার কন্নকী নিতান্তই মনসিজ। বাস্তব কন্নকীর সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। তবু মনের ওই কবিকল্পনাই কোভালনকে বাস্তবে কন্নকীর কাছে নিয়ে এসেছে। সে এখন আসল কন্নকীকে আস্বাদ করছে। জানছে, কন্নকী মহার্ঘা। অতএব, কন্নকীকে নিয়ে কোভালন যেসব কবিতা লিখেছিল, সেসব ভেলকি বা ভ্রম হলেও, বস্তুত সংবাদী ভ্রম। সংবাদী ভেলকি।

কিন্তু তাহলে অনির্বাপিত আনন্দ হচ্ছে কই তার? যে-আনন্দ সেই কাবেরীতটস্থ পান্থের মুখে কোভালন দেখেছিল, সে আনন্দ তার হল কোথায়?

হয়তো সেই পান্থ পরম-আনন্দের কথা বলেছিলেন। হয়তো নয়, নিশ্চয়ই। কন্নকী সুন্দরী, কন্নকী অপরূপা, কন্নকী ভোরের আলোর চেয়েও মোহময়, তবু কন্নকী পার্থিবা। কন্নকী মানবী। পরম নয়, অসীম নয়। যতটুকু কন্নকীকে জানতে পেরেছে কোভালন, ততটুকু সীমায়িত। এর পরেও যতদূর অবধি জানবে, ততদূর অবধি কন্নকী কোনো-না-কোনো সীমার মধ্যেই আটকে থাকবে। কেননা, জানা মানেই সীমিত করা।

চাইলেই কি কন্নকীকে অন্যরকম করে দেখতে পারে কোভালন? কন্নকী কি পালটে যেতে পারবে কোভালনের ইচ্ছেখুশিমতো? না, পারবে না। প্রতিবারই কোভালনের কল্পনাকে তাচ্ছিল্য করে কন্নকী দেখা দেবে তার নিজস্ব বাস্তবতা নিয়ে। প্রতিবারই কোভালনের কল্পনাকে উপেক্ষা করবে বাস্তবের কন্নকী।

এর থেকে কত ভালো ছিল সেই সব মধ্যযামিনী, যখন ঘুম আসত না তার, উত্তপ্ত মস্তিষ্কে উঠে বসে ঘৃতপ্রদীপের কাছে তালীপত্র আর মস্যাধার টেনে নিয়ে কন্নকীর মুখ ভেবে ভেবে সে লিখে চলত শ্লোকের পর শ্লোক। সেই কন্নকী ছিল তার মানসপ্রতিমা । যেভাবে ভাবত কোভালন, সেইভাবেই তাকে দেখা দিত কল্পনার সেই কন্নকী। সেই কল্পনার কন্নকীর কোনো সীমাই ছিল না প্রায়। কেন সে বাস্তবে কন্নকীকে খুঁজতে গেল ? কেন সন্তুষ্ট হয়ে থাকল না তার মানসী কন্নকীসুন্দরীকে নিয়ে? তাহলে তো বাস্তব অভিজ্ঞতার অভিঘাতে তার কল্পনাকে এমন উপেক্ষিত হতে হত না। লাঞ্ছিত হত না কবির স্বাধীনতা।

কেন সে কবিতার কন্নকীকে বাস্তবের কনকীর সঙ্গে মেলাতে গেল যে! কেন উপমার পর উপমা দিয়ে বাস্তবের কন্নকীকে আবৃত করছে সে আজ? অথবা কেনই-বা উপমার নির্মোক সব খসিয়ে আসল কন্নকীকে খুঁজে পেতে চাইছে বারবার? কেন বলতে পারছে না, ‘কন্নকী কন্নকীরই মতন। কন্নকী অনুপমা?’

যদি তা সে বলতও, তাহলেও উপমাই দেওয়া হত। ‘তুমি তোমারই মতন, তোমার তুলনা তুমিই’–একথা বললেও উপমাই দেওয়া হয়। নিজের সঙ্গে নিজেরই সে-তুলনা। স্বাশ্রিত উপমা ৷

আসলে তার কল্পনা তৃপ্ত হচ্ছে না বলেই তো এত উপমার আড়ম্বর। এত ক্লান্তি !

সব উপমানকে প্রত্যাখ্যান করে দেয় যে-উপমেয়, তা যদি শুধু রক্তমাংসের বাস্তব হয়, যদি পরম না হয়, তবে ক্লান্ত কবিমন ফিরে যেতে চায় অসীমপ্রায় কল্পলোকে, যেখানে কবির একান্ত স্বাধীনতা। কিন্তু একবার পার্থিব বাস্তবতাকে আস্বাদ করবার পর সেই কল্পলোকে ফিরে যাওয়া আর কি সম্ভব? সম্ভব নয়। বাস্তবের এই কন্নকীকে নিয়ে ব্যর্থ কবি কোভালনের তাই এখন থেকে চিরনির্বাসন !

বাস্তব সত্যের কাছে কবিকল্পনা হেরে গেলে, কবিতা হতমান হয়ে পড়লে, কবির অস্মিতা যে নিদারুণ আঘাতে বিপর্যস্ত হয়, তার মতো মর্মন্তুদ আঘাত সংবেদনশীল মানুষের জীবনে আর কী আছে?

       দীর্ঘশ্বাস ফেলল কোভালন, সেই শ্বাসাঘাতে বুঝি কেঁপে উঠল প্রদীপের
শিখা ? কোভালন শুনতে পেল না, শয্যার পায়ের দিকে অনাদরে পড়ে থাকা কন্নকীর পরিত্যক্ত নুপুর দুটি বিষণ্ণ সুরে গাইছে:
 

“বুঝি এই পৃথিবীতে নেমে এসে কাম আর রতি

কোভালন-কন্নকীর রূপ ধরে মহার্ঘ এ মিলন-শয্যায়

প্রণয়ের পানপাত্র করেছে নিঃশেষ ….

যেন দুই কৃষ্ণ সৰ্প আলিঙ্গনে আলিঙ্গনে তীব্র কামাতুর

তবু এ প্রণয়কাব্যে অনিবার্য যতি

টেনে দেন ক্রান্তদর্শী কবি পরমেশ।

কোভালন-কন্নকীও জেনেছে যে হায়,

এ জীবন,মধুমাস—সকলই ভঙ্গুর !”

(দশ) বিষাদঝিনুক

এতদূর অবধি বলে বাসবান্না হঠাৎ চুপ করে গেলেন। অনেকক্ষণ কিছুই আর বলছেন না। শুনতে শুনতে আমিও তাঁর কথনবিশ্বের ভেতর একেবারে ডুবে গেছিলাম । আশ্চর্য অলংকৃত তাঁর গল্পকথন-ভঙ্গিমা। যেন বাংলার কথকঠাকুর, পারস্যের দাস্তানগো, তুরস্কের মেদ্দা, মরক্কোর হালাইকুই—পৃথিবীর সমস্ত গল্পবলিয়েরা বাসবান্নার জিহ্বায় ভর করেছিলেন। তামিল মহাকাব্য শিলপ্পদিকরম আশ্রয় করে বাসবান্না গল্প বলছিলেন ঠিকই, তবু তাঁর স্বভাববশত সে-গল্পকে তিনি উলটেপালটে নিয়েছেন, একথা মূলকাব্যটি না পড়েও আমি অনুমান করতে পারি। তবু সে-রূপান্তরিত কথনের মধ্য দিয়েও আমার চোখে জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ছিল এক প্রাচীন ভারতবর্ষ—দ্বিতীয় শতকের দক্ষিণ ভারত, তার সমাজ-সমৃদ্ধি-অবসাদ-ক্লান্তি-প্রণয়-মনস্তত্ত্ব—এমন আরও কত কী। সেযুগের কোভালন-কন্নকী যেন বড়ো আপন হয়ে ধরা দিচ্ছিল এতক্ষণ ধরে।

অনেকক্ষণ চুপ করে আছেন দেখে আমি ধীরে ধীরে নীরবতা ভেঙে বললাম, ‘তারপর? তারপর কী হল, বাসবান্না? নাকি এখানেই শেষ?’

বাসবান্না হেসে বললেন, ‘শেষ নয়, এখান থেকেই তো শুরু। এই ক্লান্তির উপত্যকা পেরোতে পেরোতে আরও বহুবার ভুল করেই তো কোভালন সত্যিকারের ভালোবাসাকে চিনতে পারবে। কন্নকীও জীবনের বহু পথ ভেঙে গাইতে শিখবে সমুচ্চ কল্পনার মহিম্নস্তোত্র। কিন্তু সে অনেক দূরের পথ। অনেক পরের কথা।’

আমি বললাম, ‘হোক দূরের পথ। আপনি বলুন। আমি শুনব।’

বাসবান্না তাঁর পলিত কেশের মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে অন্যমনস্ক সুরে বললেন, ‘বলব। তবে আজ আর নয়। অন্য কোনোদিন। আজ সারাদিন আমরা না হয় কোভালনের অস্তিত্ব-বিলগ্ন বিষাদের মধ্যেই থাকি। ভাবি এসব নিয়ে…’

বাসবান্নার বাড়ি থেকে কখন যেন বেরিয়ে এলাম, টের পেলাম না। রাত হয়েছে। বড়ো রাস্তা ধরে হাঁটছি। পথের পাশে দোকানগুলোতে আলো ঝলমল করছে। রাস্তা দিয়ে সশব্দে গড়িয়ে যাচ্ছে যানবাহনের স্রোত। সমুদ্রের দিক থেকে উঠে আসছে লোনা বাতাস।

এখনও আমি জানি না, এ কী চলছে আমার মধ্যে। এ কি স্বপ্ন, নাকি মানসিক বিভ্রম? সংবাদী ভ্রম, নাকি বিসংবাদী ভ্রম ? বাসবান্নার গল্প আমাকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? অতীতের দিকে, নাকি সাম্প্রতিকেরই অভিমুখে? কোভালন-কন্নকী দ্বিতীয় শতকের অন্তিম পর্বের মানুষ হতে পারে, কিন্তু তাদের মনস্তাত্ত্বিক দুঃখ কি নয় আজও সমানভাবে বহমান? আজও কি মানুষের মনে এই কল্পনা আর বাস্তবেরই লড়াই চলছে না? লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে এ ওকে আঘাত করছে না আজও? ভেঙে যাচ্ছে না আজও প্রণয়-সম্পর্কগুলো প্রতিদিন? তবে কি মানুষের দুঃখের কোনো বিবর্তন নেই? সময়-প্রতিবেশ-আবহ পালটে যায়, কিন্তু প্রতি কালপর্বেই মানুষকে চক্রাকারে ফিরে আসতে হয় বারবার বুকে নিয়ে সেই এক বিষাদঝিনুক?

সামুদ্রিক লবণাক্ত বাতাস গায়ে মেখে আমি ফিরে যাচ্ছি কোথায় যেন। তবু জানি, কন্নকী-কোভালনের কী হল এর পরে, তা জানতে আমাকে আবার বাসবান্নার কাছেই ফিরে আসতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *