পুনর্জন্ম

পুনর্জন্ম

অ্যাক্সিলেটরে পা রেখে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরে বসেছিল রাহুল। রাস্তাটা এগিয়ে চলেছে জঙ্গলমহলের বুক চিরে। দুপাশে হয় নানা গাছের জঙ্গল অথবা পতিত জমি। জনবসতি তেমন চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝে দু-একজন লোক চোখে পড়ছে গাছের ছায়াতে বসে থাকতে অথবা ছাগল চরাতে। সকাল আটটা নাগাদ শহর থেকে লালাজিকে নিয়ে রাহুল রওনা হয়েছিল এই জঙ্গলমহলের উদ্দেশে।

এখন প্রায় দশটা বাজে। জ্যৈষ্ঠ মাস, ইতিমধ্যেই মাথার ওপর থেকে সূর্যদেব যেমন অগ্নিবৃষ্টি শুরু করেছেন, চলন্ত গাড়ির ভিতরেও বাইরে থেকে গরম বাতাস ঢুকছে। লালাজিকে নিয়ে আজই প্রথম বেরিয়েছে রাহুল। আসলে লালা ফোপোটলালের কাছে আজই কাজে যোগ দিয়েছে সে। রাহুল ড্রাইভিংটা জানে, আবার তার পেটে কালির আঁচড়ও আছে। বি.এ.পাশ। ড্রাইভার কাম লালাজির অ্যাসিস্টেন্ট, এমনকী লালাজির ফাইফরমাশ খাটার কাজও করতে হবে রাহুলকে। এ চাকরির শর্ত এটাই।

বড় ব্যবসায়ী লালাজি। কাঠ, লোহালক্কড়, নানারকম ব্যবসা লালাজির। সম্প্রতি তিনি হোটেল, জমিজায়গা ইত্যাদিতেও টাকা লগ্নি করতে শুরু করেছেন। তার সব কাজ করতে পারবে এমন একটা লোকের দরকার ছিল লালাজির। বেশি লোক রাখা মানেই তো বেশি পয়সা খরচ। পরিচিত একজনের সুপারিশে লালাজির কাজে যোগ দিয়েছে রাহুল।

এদিকে এর আগে কোনওদিন আসেনি রাহুল। লালাজিই তাকে পিছনের আসনে বসে যাত্রাপথের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এক সময় তিনি বললেন, ‘ওই যে ওখানে, যেখানে রাস্তার পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে, ওখানে গাড়ি থামাও।’

লালাজির দৃষ্টি অনুসরণ করে রাহুল দেখতে পেল রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে। সে লোকটাও সম্ভবত লালাজির গাড়িটা চিনতে পেরে রাস্তার ওপর একটু উঠে এসে হাত নাড়াচ্ছে। লালাজির নির্দেশমতো লোকটার কাছাকাছি পৌঁছে গাড়ি থামিয়ে দিল রাহুল। লালাজি বললেন, ‘নামতে হবে।’

রাহুল ড্রাইভারের আসন ছেড়ে নীচে নেমে পিছনের দরজাটা খুলে দিল। গাড়ি থেকে নামলেন প্রৌঢ় লালাজি। পরনে তার পাঞ্জাবি আর হাঁটু পর্যন্ত ওঠানো ধুতি, মাথায় শেঠেদের মতো জরির পট্টি দেওয়া কাপড়ের টুপি, পায়ে পাম্পশু। গাড়ি থেকে নেমে তিনি গাড়ির ভিতরে রাখা তার ব্যাগটা ইশারায় দেখালেন। রাহুল সেই পেট-মোটা চামড়ার ফোলিও ব্যাগটা হাতে তুলে নিল।

যে লোকটাকে দেখে গাড়ি থামানো হয়েছিল সেই মধ্যবয়সি লোকটা এবার লালাজির সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেলাম করল লালাজিকে। লোকটার পরনে ধুতি আর হাফশার্ট। কালো লম্বা সিড়িঙ্গে চেহারা, দাঁতে পানের ছোপ, ট্যারা চোখ, মুখমণ্ডলে কেমন যেন একটা ধূর্ততার ভাব আছে। লালাজি লোকটার উদ্দেশে বললেন, ‘বনমালী খবর সব ঠিক তো?’

লোকটা জবার দিল ‘হ্যাঁ, সব ঠিক অছে। কাজ হয়ে গেছে। এবার আর ওরা মনে হয় আপত্তি করবে না। একমাস এখানে ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকতে হল ঠিকই, কিন্তু কাজটা হল। কাছে গেলেই বুঝতে পারবেন।’—এই বলে সে আঙুল তুলে দেখাল কিছু দূরে একটা বিরাট বটগাছের দিকে। রাস্তার পাশে বেশ অনেকটা ফাঁকা জমি। আর তার ঠিক মাঝখানেই দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বটগাছটা। অসংখ্য ঝুরি নেমেছে তার গা বেয়ে। ফাঁকা জমিটার ওপাশেও আবার নানা গাছের জঙ্গল আছে।

বনমালী নামের লোকটা এরপর লালাজি আর রাহুলকে নিয়ে উপস্থিত হল গাছটার নীচে। প্রাচীন গাছ। মোটা গুঁড়িটার মাঝখানে ঠিক যেন মানুষের মুখের মতো হাঁ করা একটা ফোকর আছে। চারপাশটা বাঁধানো। কাছির মতো অজস্র ঝুরি নেমেছে মাথার ওপর থেকে সেই বেদি পর্যন্ত। মৃদু মৃদু দুলছে সেগুলো। ছায়াঘেরা জায়গা। গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে বনমালী পানের ছোপওয়ালা দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘পাতাগুলো দেখুন।’

লালাজি তাকালেন গাছের পাতাগুলোর দিকে। রাহুলও তাকাল। পাতাগুলোর দিকে ভালো করে তাকিয়ে রাহুল ব্যাপারটা ধরতে পারল। গাছের পাতাগুলো হলদে হয়ে বোঁটা থেকে নুইয়ে পড়েছে। কিছু পাতা মাটিতেও ঝরে পড়েছে। কিন্তু এটা পাতা ঝরার মরশুম নয়। বনমালী বেদির ওপর উঠে হাত বাড়িয়ে একটা বটপাতা ভেঙে আনল। তারপর সেটা লালাজিকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখুন, পাতার বোঁটায় কোনও আঠা নেই। বটপাতা ভাঙলেই দুধের মতো আঠা বেরোয়। লোকেরা বুঝতে পারবে যে গাছটা মারা গেছে। তবে আরও দিন পনেরো অপেক্ষা করলে গাছটা একদম নেড়া হয়ে যেত। তখন আর কোনও চিন্তাই থাকত না।’

লালাজি বললেন, ‘না, আর দেরি করা যাবে না। ছ মাস হল জমিটা কিনে ফেলে রেখেছি। এই গাছটার জন্য কিছু করা যাচ্ছিল না।

কাল-পরশু গাছটা কাটা হয়ে গেলেই মিস্ত্রি মালপত্র সব আসবে। কাজ শুরু করে ফেলব।’

রাহুল কথাটা শুনে প্রশ্ন করে ফেলল, ‘কী হবে এখানে?’

লালাজি তার কথার জবাবে বললেন, ‘একটা রিসর্ট বানাব এখানে। জিম, সুইমিং পুল সব থাকবে। বড় প্রজেক্ট। আজকাল কলকাতা থেকে অনেক পয়সাঅলা লোক নিরিবিলিতে আমোদপ্রমোদ করার জন্য এসব জায়গাতে আসছে। তাদের আরামের জন্য সবরকম বন্দোবস্ত থাকবে এখানে। তোমাকেও আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে এখানে এসে থাকতে হবে। এই আজ যেমন এলে। আজকের দিনটা আমরা এখানে থাকব। কাল গাছের গুঁড়িটা কাটা হলে তারপর রওনা হব।’

রাহুল প্রশ্ন করল, ‘এখানে কোথায় থাকবেন লালাজি?’

বনমালী নামের লোকটা এবার রাস্তার উলটোদিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল, ‘ওই যে ওখানে। আমিও ওখানেই আছি।’

রাহুল সেদিকে তাকিয়ে দেখতে পেল মাথায় অ্যাসবেস্টসের ছাউনিআলা দুটো ঘর দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।’

লালাজি এরপর বনমালীকে বললেন, ‘তাহলে সব ঠিক আছে বলছ? তা সেই সাধুবাবার খবর কী?’

বনমালী বলল, ‘হ্যাঁ, সবই এমনিতে ঠিক আছে। গাছটা যখন মরেই গেছে তখন আর ওই সাধু লোক-খ্যাপাতে পারবে না গাছ-কাটা আটকাবার জন্য। আর গাছটা যারা কাটবে তারাও স্থানীয় লোক নয়। ইচ্ছা করেই তাদের কিছুটা দূর থেকে আনছি।’

বনমালীর কথা শুনে লালজি তবুও একটু সন্দিগ্ধ ভাবে বললেন, ‘শেষ মুহূর্তে আবার নতুন কোনো ঝামেলা পাকাবে না তো লোকটা?’

বনমালী একটু ভেবে নিয়ে বলল, ‘আপনি তো লোকটাকে কোনও দিন দেখেননি। কাছেই তার ডেরা। একবার লোকটার সঙ্গে কথা বলে তাকে বাজিয়ে দেখে আসা যায়। দু-পাঁচশো টাকা নজরানাও দেওয়া যেতে পারে, যাতে সে ব্যাপারটা নিয়ে বেশি নাক না গলায় সেজন্য।’

বনমালীর কথা শুনে লালাজি বললেন, ‘ঠিক আছে, লোকটার সঙ্গে একবার দেখা করে আসা যাক। দেখি লোকটা কী বলে। তবে গাছটা কিন্তু কাল কাটতেই হবে। আর তার জন্য যা যা করার তা করব।’

(২)

বনমালীর সঙ্গে লালাজি আর রাহুল বটগাছটার পিছনের ফাঁকা জমি পেরিয়ে এগোল জঙ্গলের দিকে। শাল পিয়াল আর অন্যান্য গাছের জঙ্গল। কেমন যেন গা-ছমছমে পরিবেশ বিরাজ করছে জঙ্গলের ভিতরে। বনমালী জঙ্গলের ভিতর সুঁড়িপথ বেয়ে তাদের দুজনকে নিয়ে এগোতে এগোতে বললেন, ‘এদিকে গ্রামের মানুষ সাধারণত আসে না। সাধুবাবাকে তারা যেমন ভক্তি করে তেমন ভয়ও করে। সাধু নাকি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। আর এমনিতেই তো মানুষ শ্মশানকে এড়িয়ে চলে। দাহকার্য করতে গ্রামের মানুষ দল বেঁধে এখানে আসে।

কথাটা শুনে বনমালী বলল, ‘হ্যাঁ, একটা ছোট নদী আছে। তার পাশেই দাহকার্য হয়।’

জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আরও কিছুক্ষণ চলার পর রাহুলরা জায়গাটাতে পৌঁছে গেল। জঙ্গল ঘেরা একটা ফাঁকা জায়গা। গ্রামের মানুষ যাকে নদী বলে সেটা আসলে নালার মতো সরু জলধারা। জায়গাটা যে শ্মশান তা বুঝতে অসুবিধা হল না লালাজি আর রাহুলের। এখানে-ওখানে পড়ে আছে চিতার পোড়া কাঠ, মেটে হাঁড়ি, মৃতদেহের কাপড় ইত্যাদি নানা জিনিস। এককামরার ছিরিছাঁদহীন ইটের একটা ঘরও জায়গাটার একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বনমালী সেটা দেখিয়ে বলল, ‘ওটাই সাধুবাবার মাথা গোঁজার আস্তানা। রাতে ও ওখানেই থাকে।’

লালাজি জানতে চাইলেন, ‘লোকটা কি এখন ওখানেই আছে?’

বনমালী বলল, ‘না, ওই যে ওখানে।’

তার দৃষ্টি অনুসরণ করে লালাজি আর রাহুল তাকাল কিছুটা তফাতে নালার পাড়ে একটা তেঁতুলগাছের দিকে। গাছটার নীচে একটা উঁচুমতো জায়গাতে বসে আছে একজন।

তাকে দেখার পর লালাজি, বনমালীকে বললেন, ‘দেখি লোকটা কী বলে? প্রয়োজনে নরমে গরমে কাজ সারতে হবে।’

বনমালী বলল, ‘আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে।’

তারা তিনজন এরপর এগোল লোকটার দিকে।

গাছের নীচে পৌঁছে লোকটার কিছুটা তফাতে এসে দাঁড়াল তারা। একটা ঢিপির মতো জায়গাতে ধ্যানস্থ ভঙ্গিতে চোখ বন্ধ করে বসে আছেন সেই সাধু। পরনে শুধু মাত্র একটা কৌপীন। সারা দেহে তাঁর চিতাভস্ম মাখা। লোকটার চারপাশে ছড়ানো আছে মানুষের মাথার খুলি, হাড়গোড়। ছোট একটা ধুনি জ্বলছে সন্ন্যাসীর সামনে। আর তার পাশে একটা ত্রিশূল গোঁজা। রাহুল ভালো করে তাকাল সাধুবাবার মুখের দিকে। মুখও সাদা ভস্ম মাখা।

সাধুবাবার চুলগুলো বেশ অদ্ভুত। চুলগুলো সরু বিনুনির মতো নেমে এসে কপাল আর ঘাড় বেয়ে ঝুলছে। ঠিক যেন রাহুলদের একটু আগে দেখে আসা বটগাছটার ঝুরির মতো। আর ঠিক সেই ঝুরির আড়াল থেকে যেমন উঁকি দিচ্ছিল গুঁড়িটার গায়ে মানুষের হাঁ করা মুখের মতো ফোকর বা কোটরটা, ঠিক তেমনই সাধুবাবার কপাল থেকে বুক পর্যন্ত বিনুনির মতো চুলগুলোর আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে তার উন্মুক্ত ওষ্ঠাধর। সব মিলিয়ে সেই প্রাচীন বটবৃক্ষের সঙ্গে এই প্রাচীন সাধুর মুখমণ্ডলের যেন একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পেল রাহুল।

সম্ভবত তাদের উপস্থিতি বুঝতে পেরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই চোখ মেললেন সন্ন্যাসী। চোখের পাতাগুলোও সাদা ভস্মমাখা। ঈষৎ রক্তাভ চোখ। তিনি স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাদের তিনজনের দিকে।

বনমালী এবার সাধুবাবার উদ্দেশে বলল, ‘ইনি লালাজি। শহর থেকে এসেছেন। ওই বটগাছ আর জমিটার বর্তমান মালিক।’

লালাজি এরপর হাতদুটো মৃদু উঠিয়ে প্রণামের ভঙ্গি করে বললেন, ‘ওখানে আমি একটা বড় হোটেল বানাব। স্থানীয় মানুষদের কিছু কাজের উপায় হবে তাতে।’

সাধুবাবা এবার শান্তস্বরে বললেন, ‘তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। জমি তো অনেকটা। গাছটাকে বাদ দিয়েও তো ওখানে বাড়িঘর বানানো যেতে পারে। শুধু ওই গাছটা কাটা নিয়েই আমার আপত্তি।’

লালাজি বললেন, ‘তাতে অসুবিধা আছে। পুরো জমিটাই ফাঁকা করতে হবে।’

সাধুবাবা আবারও শান্তস্বরে বললেন, ‘কত প্রাচীন ওই গাছ! পাঁচশো বছর বয়স ওর। কত পথিককে ও ছায়া দিয়েছে। ওর কোটরে, ডালপালাতে কত পশুপাখি বাস করে, নানা প্রাণী, মানুষের কত উপকার করে গাছটা…

সাধুবাবার দিকে তাকিয়ে এবার একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল করল রাহুল। বটের ঝুরির মতো মাথা থেকে নেমে আসা বিনুনিগুলো যেন মৃদু মৃদু দুলছে, বলা ভালো, নড়ছে!

সাধুবাবা বললেন, ‘তাছাড়া গাছেরও তো প্রাণ আছে মানুষেরই মতো। তাকে কাটা মানে একটা মানুষ খুন করা।’

বনমালী তার কথা শুনে দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘না, গাছটাকে আমরা মারব না, সেটাই আপনাকে জানাতে এলাম।’

সাধুবাবার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘তাহলে গাছটা কাটছ না তোমরা, ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করবেন।’

বনমালী বলে উঠল, ‘না, না, গাছটা আমরা কাটব। আসলে ক’দিন আগেই গাছটা মরে গেছে। ডালপাতা সব হলুদ হয়ে খসে পড়তে চলেছে। দেহে কোথাও এক ফোঁটা কষ নেই। আপনি গিয়ে দেখে আসতে পারেন। যদি ও গাছ না মরে থাকে তবে আমরা কাটব না।’

কথাটা শুনেই চমকে উঠলেন সাধুবাবা। রাহুল এবার স্পষ্টতই খেয়াল করল যে, সাধুবাবার বিনুনির ডগাগুলো যেন সাপের ফণার মতো নেচে উঠল! মানুষ কি এভাবে চুল নাড়াতে পারে? রাহুল অবশ্য একবার একটা টেলিভিশন শো-তে একজন মানুষকে কান নাড়াতে দেখেছিল। কিছু মানুষের এমন অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। ব্যাপারটা তেমনই কিছু নাকি সাধুবাবার কোনও অলৌকিক শক্তি, তা বুঝে উঠতে পারল না রাহুল। বিস্মিতভাবে সে তাকিয়ে রইল সাধুবাবার দিকে।

এই অদ্ভুত ব্যাপারটা লালাজিরা খেয়াল করলেন কিনা কে জানে! লালাজি বলে উঠলেন, ‘গাছটা যখন মরেই গেছে তখন নিশ্চয়ই গাছটা কাটতে আর আপনার আপত্তি নেই?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কী যেন ভাবলেন সাধুবাবা। তারপর বললেন, ‘আপত্তি আছে। গাছটা আবার বেঁচেও তো উঠতে পারে?’

তাঁর কথা শুনে বনমালী কৌতুকের ঢঙে বলল, ‘এ আপনি কী বলছেন? মরা কোনও দিন বাঁচে?’

সাধুবাবা বললেন, ‘হ্যাঁ, বাঁচে।’

‘কী ভাবে?’ জানতে চাইলেন লালাজি।

সন্ন্যাসী বললেন, ‘আত্মা তো অবিনশ্বর। গাছেরও আত্মা আছে, সব প্রাণীরই আছে। আত্মার মৃত্যু নেই, সে শুধু দেহধারণ করে মাত্র। নতুন নতুন দেহ। সে দেহ মানুষের হতে পারে, গাছের হতে পারে, অন্য কোনও পশুপাখি, এমনকি কীটপতঙ্গেরও হতে পারে। আত্মার দেহ পরিবর্তনের ব্যাপারটা পোশাক পরিবর্তনের মতো। আত্মা থাকে বলেই দেহ বেঁচে থাকে। এমন তো হতে পারে যে, কোনও আত্মা তার পুরাতন দেহ ত্যাগ করার পর ওই গাছের দেহে প্রবেশ করল। আবার বেঁচে উঠল গাছটা।’

সাধুবাবার কথা শুনে লালাজি এবার একটু যেন অসহিষ্ণুভাবেই বললেন, ‘দেখুন, আমরা জানি যে কালীপুজোর সময় ওই গাছকে ঘিরে একটা মেলা বসে। চারপাশের গ্রাম থেকে লোকজন আসে। প্রণামি বাবদ তখন আপনার কিছু উপার্জন হয়। আপনাকে আমি কিছু টাকা দিচ্ছি। আর ঝামেলা করবেন না। কাল গাছটা কাটা হবে।’

লালাজির কথা শুনে সন্ন্যাসী দৃঢ় কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘আমাকে টাকার লোভ দেখিও না। কাল ভোরে আমি গ্রামের লোকদের নিয়ে গাছের কাছে যাব। গাছ কাটতে দেব না।’

তাঁর কথা শুনে বনমালী বললল, ‘কী বোঝাবেন তাদের? তারাও তো গাছটাকে পরীক্ষা করলেই বুঝতে পারবে যে ও-গাছ মরে গেছে।’

সাধুবাবা বললেন, ‘তোমাদের যা বললাম, তাদেরও তাই বলব। আবার জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে ওই গাছ। আবারও বলছি, ওই গাছ তোমরা কাটতে যেও না। এবার যাও। আমাকে আর বিরক্ত কোরো না।’

লালাজি এবার বলে উঠলেন, ‘তাহলে আপনার সিদ্ধান্তেই অটল থাকলেন আপনি? আমার কথা শুনবেন না? কাল কোনও গন্ডগোল পাকাতে গেলে তার ফল কিন্তু ভালো হবে না।’

কথাটা শুনেই সন্ন্যাসীর মুখমণ্ডল পালটে গেল। তার চোখদুটো যেন দপ করে জ্বলে উঠল। তিনি ত্রিশূলটা মাটি থেকে উঠিয়ে নিয়ে বললেন, ‘এতক্ষণ তোদের কিছু বলিনি। ভদ্র ব্যবহার করছিলাম। আমি জানি ও গাছ এমনি মরেনি। আমি জানি তোরাই ওই গাছটাকে মেরেছিস গাছের কোটর আর গোড়ায় হিং আর অম্ল দিয়ে। ওকে খুন করেছিস তোরা। এখনই দূর হ এখান থেকে।’—এই বলে তিনি ত্রিশূলটা তুলে ধরলেন।

গাছটাকে কীভাবে মারা হল সে ব্যাপারে রাহুল কিছু না জানলেও ব্যাপারটা বনমালী আর লালাজি জানে। হ্যাঁ, এভাবেই হিং আর অ্যাসিড দিয়ে গাছটাকে মারা হয়েছে। তাই সাধুবাবার কথা শুনে মৃদু চমকে উঠল তারা দুজন। কিন্তু এর পরক্ষণেই লালাজি নিজেকে সামলে নিয়ে কর্কশভাবে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমরা এতক্ষণ তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছিলাম। না গেলে কী করবে? ওই ত্রিশূল দিয়ে মারবে নাকি?’

সাধুবাবা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, মারব। তোরা খুনি। এখনি দূর হ এখান থেকে।’

প্রচণ্ড রাগে কাঁপছেন সাধুবাবা। আর তাঁর বিনুনিগুলো যেন লাফাচ্ছে!

লালাজিও এবার রেগে বলে উঠলেন ‘না, যাব না।’

তার কথাটা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সন্ন্যাসী ত্রিশূলটা ছুঁড়ে মারলেন তাদের তিনজনের দিকে। সেটা অবশ্য কারো গায়ে লাগল না। রাহুলদের পায়ের কয়েক হাত তফাতে এসে পড়ল।

কিন্তু এর পরমুহূর্তেই লালাজি তার পাঞ্জাবির নীচ থেকে একটা পিস্তল টেনে বের করলেন। উত্তেজনায় তিনিও কাঁপছেন। সাধুবাবার উদ্দেশে তিনি বললেন, ‘দেখি, আজকে কে কাকে মারে?’

বনমালীও বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, ওকে এখন মেরে ফেললেও কেউ জানতে পারবে না।’

পিস্তল উঁচিয়ে লালাজি এক পা—এক পা করে এগোতে লাগলেন সাধুবাবার দিকে। সাধুবাবা যেন হতভম্ব হয়ে গেলেন ব্যাপারটা দেখে। নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।

রাহুলও হতভম্ব হয়ে গেছিল পুরো ব্যাপারটা দেখে। কিন্তু লালাজি যখন সাধুবাবার কাছে গিয়ে পিস্তলটা তাক করলেন তখন সম্বিত ফিরল রাহুলের। সত্যি একটা রক্তারক্তি কাণ্ড না ঘটে যায়!

রাহুল তাড়াতাড়ি লালাজি আর সাধুবাবার মাঝখানে এগিয়ে গিয়ে সাধুবাবাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে লালাজিকে বলল, ‘এ কী করছেন লালাজি! মাথা ঠান্ডা করুন।’

লালাজি বলে উঠলেন, ‘তুমি সরে যাও। ওর ত্রিশূল ছোঁড়া আমি এখনই বার করছি। লালা ফোপোটলালকে ও চেনে না। এখনই ওর সাধুগিরি ছুটিয়ে দেব। সরে যাও।’

রাহুল এবার হাতজোড় করে লালাজির উদ্দেশে বলল, ‘দোহাই লালাজি, একাজ করবেন না। মাথা ঠান্ডা করুন। শান্ত হোন, শান্ত হোন। এ কাজে হিতে বিপরীত হবে।’

রাহুল দ্বিতীয়বার এ কথা বলতে লালাজি যেন একটু থমকে গেলেন। ধীরে ধীরে তার পিস্তল ধরা হাতটা নীচে নেমে এল। সাধুবাবার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘ও যখন বলছে তখন এবারের মতো তোমাকে ছেড়ে দিলাম। কিন্তু কাল গন্ডগোল পাকাবার চেষ্টা করলে তার ফল ভালো হবে না।’

সাধুবাবা তার কথার কোনও জবাব দিলেন না। বেদিটা থেকে নেমে তিনি একবার শুধু রাহুলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে দেখে তো ভালো লোকই মনে হচ্ছে। এদের সঙ্গ ত্যাগ করো। নইলে তোমার বিপদ হবে।’ কথাটা বলে তিনি প্রায় ছুটতে ছুটতে গিয়ে শিকল খুলে তাঁর ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। রাহুলরা এরপর শ্মশান ছেড়ে ফেরার পথ ধরল।

(৩)

জঙ্গল থেকে বেরিয়ে সেই ফাঁকা জমি আর বটগাছের পাশ দিয়ে গাড়ি রাস্তায় উঠে টিনের চালঅলা ঘরটাতে পৌঁছোল রাহুল। এটা বনমালীর আস্তানা। লালাজি বললেন, ‘এ জমিটাও আমার। আরও কয়েকটা ঘর বানাতে হবে এখানে। মজুরেরা এখানে থাকবে।’

দুটো ক্যাম্পখাট পাতা আছে ঘরে। মানুষ তিনজন। রাহুল তাই দেখে বলল, ‘আমি রাতে গাড়িতেই থাকব।’

লালাজি বললেন, ‘আচ্ছা তাই থেকো। সেটাই ভালো।’

তারপর তিনি রাহুলকে বললেন, ‘পিস্তলটা দেখে তুমি ঘাবড়ে গেছ নাকি? এটা আমার লাইসেন্সড আর্মস।’

রাহুল বলল, ‘সেসময় কিছুটা ভয় তো সত্যি পেয়েছিলাম। যদি আপনি গুলি চালিয়ে দিতেন!’

লালাজি বললেন, ‘আমাদের কারবারে এসব ধমক চমক একটু-আধটু চলে। কাঁচা পয়সার কারবার তো। আমার সঙ্গে কিছুদিন থাকলে এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তবে প্রয়োজন হলে, আমার স্বার্থে ঘা লাগলে আমি নিশ্চয়ই গুলি চালাতে পারি। আগে কয়েকবার জখমও করেছি কয়েকজনকে। তবে সাধারণ মানুষ পিস্তল দেখলেই ভয় পায়। দেখলে না লোকটা কেমন দৌড়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকল?’

রাহুল এবার প্রশ্ন করে ফেলল, ‘ওই সাধুবাবা যেমন বললেন, তেমনভাবেই কি গাছটাকে আপনারা মেরেছেন?’

লালাজি কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, অনেকটা ওভাবেই। ফরেস্টেও অনেক সময় এভাবে বড় বড় গাছ মারা হয়। কারণ সরকার জ্যান্ত গাছ বিক্রি করে না। গাছ মেরে তারপর সরকারের থেকে অনুমতি নেওয়া হয় সে-গাছ কাটার। আমার কাঠের ব্যবসাও আছে, তাই ব্যাপারটা জানি। এই বনমালী এর আগেও এভাবে অনেক গাছ মেরেছে। তবে শুধু গাছ কেন, প্রয়োজনে আমি মানুষও মারতে পারি।’

এ-কথা শোনার পর রাহুল আর কিছু বলল না। তবে সে একটা জিনিস বুঝতে পারল, যে তার নিয়োগকর্তা খুব একটা সুবিধার লোক নন।

বনমালী এরপর বলল, ‘সাধুটা পিস্তলের ভয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল ঠিকই, কিন্তু কাল সকালে গিয়ে ও যদি গ্রামে ঢুকে লোকজন ডেকে আনে তখন? হয়তো আটকে গেল কাজটা। হয়তো গ্রামের লোক ‘গাছটা বেঁচে উঠবে’—সে কথায় বিশ্বাস করল। ওর চুলগুলো কেমন নড়ছিল খেয়াল করেছেন? ওর এই ক্ষমতাটার জন্যই ওর মধ্যে দৈবশক্তি আছে বলে গ্রামের লোকদের ধারণা।’

লালাজি বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও খেয়াল করেছি। নিশ্চয়ই ওর মধ্যে কোনও কৌশল আছে। তবে আমিও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। যদি সত্যি লোকটা লোকজন ডেকে আনে? কী করা যায় বলো তো?’

বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বনমালী বলল, ‘একটা কাজ করা যেতে পারে। সন্ধ্যা নামলেই লোকটা ভাঙ খেয়ে সারারাত অচৈতন্য হয়ে থাকে। বাইরে থেকে ওর ঘরের দরজায় শিকল দিলে কেমন হয়? ওর চিৎকার কানে যাবে না। ঘরবন্দি করে রাখা যাবে। রোজ তো আর ওই শ্মশানে কেউ মড়া পোড়াতে যায় না।’

লালাজি বললেন, ‘পরিকল্পনাটা মন্দ নয়। আগে গাছটা কাটা হয়ে যাক। তারপর যা হয় হবে।’

বনমালী বলল, ‘তাহলে অন্ধকার নামার সময় আমি জঙ্গলে ঢুকব।’ রাহুল বুঝতে পারল, এ কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত তার কথায় হবে না। বাকি দুপুরটা সেই ঘরের মধ্যেই কেটে গেল রাহুলদের। তারপর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামার উপক্রম হতেই পরিকল্পনামতো ঘর ছেড়ে জঙ্গলের দিকে রওনা হল বনমালী।

রাহুল তাকাল সেই প্রাচীন গাছটার দিকে। সূর্য ডুবে গেছে। তার ছেড়ে যাওয়া শেষ আলোটুকু এসে পড়েছে বটগাছটার মাথায়। একটা বড় পাখির ঝাঁক ফিরে এল বটগাছটাতে। কালকেই হয়তো বটগাছটা আর সত্যিই থাকবে না। আর পাখিগুলোর বাসাও থাকবে না। তবে ঘরের ভিতর থেকে গাছটার দিকে তাকিয়ে আবারও সত্যি সাধুবাবার মুখটার কথা মনে পড়ে গেল রাহুলের। সত্যিই কী অদ্ভুত মিল!

বনমালী জঙ্গলে প্রবেশ করার পরই দ্রুত অন্ধকার নেমে এল। সেই অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই বটগাছটা। সেই টিনের ছাদঅলা ঘরের ভিতর একটা লণ্ঠন জ্বালিয়ে নিয়ে বনমালীর ফেরার অপেক্ষা করতে লাগল তারা দুজন।

বনমালী যখন ফিরল তখন বাইরে চাঁদ উঠতে শুরু করেছে। ঘরে ঢুকে বনমালী দাঁত বার করে হেসে বলল, ‘কাজটা হয়ে গেছে। কোনো সমস্যা হয়নি। ঘরের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। মনে হয় ভিতরে নেশা করে শুয়ে আছে লোকটা। আমি শুধু বাইরে থেকে নিঃশব্দে শিকল তুলে তার মধ্যে একটা শক্ত কাঠের টুকরো গুঁজে এলাম। যাতে ভিতর থেকে ধাক্কা দিলে দরজা না খোলে।’

কথাটা শুনে লালাজি তার পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘রিসর্টটা হয়ে গেলে তার ম্যানেজার করে দেব তোমাকে।’

এরপর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খাওয়া সারা হয়ে গেল তাদের। রাহুল যখন ঘর ছেড়ে রাস্তার পাশে তার গাড়ির দিকে এগোল তখন চাঁদ মাথার ওপর। বেশ বড় চাঁদ। তার আলোতে দাঁড়িয়ে আছে বটগাছটা। দেখতে ঠিক যেন সাধুবাবার মুখের মতো।

(৪)

গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল রাহুল। বাইরে কোথাও কোনও শব্দ নেই। শুধু একবার জঙ্গলের দিক থেকে শিয়ালের ডাক ভেসে এল। সেই ডাক যেন রাত্রির নিস্তব্ধতাকে আরও বাড়িয়ে দিল।

কিন্তু কিছুতেই ঘুমোতে পারল না রাহুল। গাড়ির কাচ বন্ধ করলে অসহ্য গরম লাগছে আর দরজা জানলা খুললে মশার দল ভনভন করছে। তাছাড়া বাইরে কোনও বাতাস নেই, গুমোট গরম। একবার দরজা খোলা আর একবার গাড়ির কাচ বন্ধ করতে লাগল সে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

ঘণ্টা দুয়েক এভাবে কাটার পর রাহুল বুঝতে পারল, বাকি রাতটা তাকে জেগেই কাটাতে হবে। সে ভাবল, গাড়ির বদ্ধ পরিবেশে না থেকে ওই বটগাছের তলায় বেদিতে বসে কাটানো যেতে পারে।

গাড়ি থেকে নেমে পড়ল রাহুল। সে এগোতে যাচ্ছিল গাছটার দিকে। কিন্তু একটা জিনিস চোখে পড়তেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা আলো মাটির ফুটখানেক ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে বটগাছটার দিকে।

কীসের আলো ওটা? কে আসছে? আলোটা দেখে কিন্তু ঠিক টর্চ লাইট বা মশালের আলো মনে হচ্ছে না। অদ্ভুত উজ্জ্বল নীলাভ এক আলো। আকারে ছোট বলের মতো।

আলোটা এসে প্রথমে থামল বটগাছটার ঠিক নীচে, তারপর দুলতে দুলতে পাক খেতে লাগল গাছটার গুঁড়ি ঘিরে! আবার কখনও কখনও ওপর-নীচে ওঠা নামাও করতে লাগল, গুঁড়ির গায়ে ফোকরটা যেখানে আছে সেখানে।

অদ্ভুত এক দৃশ্য। ব্যাপারটা কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না রাহুল। আবার কাছে যেতেও ভরসা পেল না। সে তাকিয়ে রইল সেই দৃশ্যের দিকে। নেচেই চলেছে আলোটা! তীব্র উজ্জ্বল নীলাভ আলোর একটা বল!

রাহুলের হুঁশ ফিরল লালাজির চাপা কণ্ঠস্বরে। আলোটা তখনও একইভাবে নেচে চলেছে। আলোটা দেখতে পেয়ে লালাজিও বনমালীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। তারা রাহুলের কাছে পৌঁছতেই রাহুল চাপাস্বরে তাদের প্রশ্ন করল, ‘কীসের আলো ওটা?’

লালাজি আলোটার দিকে চোখ রেখে হাতের পিস্তলটা উঁচিয়ে ধরে বললেন, ‘ঠিক বুঝতে পারছি না। এমনও হতে পারে যে ওই সাধুটা কোনওভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছে, তারপর কোনও কৌশলে ওই আলো দিয়ে আমাদের ভয় দেখাবার চেষ্টা করছে। ও জানে যে ঘরের ভিতর থেকে জানলা দিয়ে আমরা আলোটা দেখতে পাব। এই গরমে জানলা খোলা রাখব। আলোটা দেখে অলৌকিক ব্যাপার ভেবে যাতে আমরা গাছটা না কাটি, সে চেষ্টাই হয়তো করছে লোকটা। চলো, কাছে গেলেই ব্যাপারটা আসলে কী তা বোঝা যাবে।’—এই বলে পিস্তল উঁচিয়ে লালাজি এগোলেন গাছটার দিকে। তাকে অনুসরণ করল বনমালী আর রাহুল।

গাছটার হাত-পনেরো কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। আর আলোটাও যেন তাদের দেখে গাছের নীচে বেদিটার কাছাকাছি স্থির হয়ে গেল। রাহুলের মনে হল চাঁদের আলোতে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাট গাছটাকে যেন এখন হুবহু সাধুবাবার মুখের মতো লাগছে! তার বেণীর মতো ওপর থেকে নেমে আসা ঝুরি আর তার আড়াল থেকে সাধুবাবার উন্মুক্ত ওষ্ঠাধরের মতোই উঁকি দিচ্ছে গাছের কোটরটা। আরও একটা জিনিস মনে হল রাহুলের, গাছের ঝুরিগুলো সাধুবাবার বিনুনির মতোই যেন মৃদু মৃদু নড়ছে! একফোঁটা বাতাস নেই তবে ঝুরিগুলো নড়ছে কীভাবে?

লালাজি কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালেন। তারপর এগোলেন গাছটার দিকে। আর তার পিছন পিছন এগোল বনমালী, আর সবার পিছনে রাহুল।

আলোটা এবার যেন তারা এগোচ্ছে বুঝতে পেরে ধীরে ধীরে বেদি থেকে গাছের গুঁড়ির গা বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করল। ওপর থেকে নেমে আসা গাছের ঝুরিগুলো যেন এবার আরও বেশি দুলতে শুরু করেছে। রাহুলরা গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াতেই সেই আলোটা যেন ওপরে উঠে গাছের ফোকরে অদৃশ্য হয়ে গেল!

লালাজি প্রথমে বলে উঠলেন, ‘আলোটা কোথায় গেল?’

আর তারপর বললেন, ‘গাছের ঝুরিগুলো এত দুলছে কেন? গাছের মাথায় কেউ বসে নেই তো?’

আর এর পরমুহূর্তেই একটা অদ্ভুত ঘটনার সূত্রপাত হল। একটা বটের ঝুরি যেন মানুষের হাতের মতোই এক ধাক্কায় সবার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা রাহুলকে ছিটকে ফেলল গাছের নীচ থেকে বেশ খানিকটা দূরে। মাটিতে পড়ে থাকা রাহুল এরপর কিছুক্ষণের জন্য এক অদ্ভুত দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল। সাধুবাবার বিনুনির মতো ওপর থেকে নেমে আসা ঝুরিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তারা পেঁচিয়ে ধরেছে লালাজি আর বনমালীকে। তারা ছটফট করলেও সেই নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। এরপর সেই কঠিন নিষ্পেষণে স্থির হয়ে গেল দেহদুটো।

গুঁড়ির গায়ের ফোকরটা বড় হতে শুরু করল। ঠিক যেন কোন মানুষ বড় করে মুখ হাঁ করছে! সাধুবাবার মুখ। ঝুরিগুলো এবার দেহদুটোকে টেনে তুলল সেই হাঁ করা মুখের দিকে। তারপর মানুষ যেভাবে হাত দিয়ে খাবার মুখে পোরে ঠিক সেভাবে দেহদুটোকে চালান করে দিল সেই ফোকরের ভিতর! এ দৃশ্য দেখে জ্ঞান হারাল রাহুল।

পরদিন রাহুলের যখন জ্ঞান ফিরল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। একটু ধাতস্থ হয়ে মাটি ছেড়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল গতকাল রাতে দেখা সেই ভয়ংকর দৃশ্যটা সত্যি না মিথ্যা? সে কি ঘুমের ঘোরে গাড়ি থেকে নেমে এখানে পৌঁছেছিল? কিন্তু লোকজন কোথায়? লালাজিরাই বা কোথায়? সকালেই তো এ-গাছ কাটতে লোকজনের আসার কথা।

রাহুল এরপর এগোতে যাচ্ছিল সে জায়গা ছেড়ে রাস্তা পেরিয়ে বাড়িটার দিকে। লালাজিরা সেখানে আছে কিনা তা দেখার জন্য। কিন্তু একটা জিনিস দেখে থমকে দাঁড়াল সে। একদল লোক জঙ্গলের দিক থেকে কী যেন একটা জিনিস বহন করে আনছে। লোকগুলো গাছের কাছে এসে থামল। তারপর খাটিয়াটাকে মাটিতে নামিয়ে রাখল একটু জিরোবার জন্য।

রাহুল চমকে উঠল খাটিয়ায় শোয়া দেহটাকে দেখে। তার মধ্যে রয়েছে সেই সাধুবাবার দেহ। লোকগুলোর কথাবার্তা শুনে রাহুল যতটুকু বুঝতে পারল তা হল এই লোকগুলো অন্য একটা মৃতদেহ নিয়ে জঙ্গলের ভিতর শ্মশানে দাহ করতে গেছিল। সাধুবাবাকে ডাকতে গিয়ে তারা দেখে ঘরের দরজা ভিতর এবং বাইরে থেকে বন্ধ। সাধুবাবার সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে সাধুবাবাকে এ অবস্থায় দেখতে পায়। যদিও সবাই বুঝতে পারছে যে সাধুবাবা মৃত তবুও একবার হাসপাতালে দেহটাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়। সেখানেই এখন যাবে তারা।

হঠাৎ একজন লোক মৃতদেহটাকে ওঠাবার আগে বলল, ‘দুদিন আগে আমি এ গাছটার কাছে এসেছিলাম। তখন কেন জানি এ-গাছটা দেখে আমার মনে হয়েছিল গাছটা মরে গেছে। পাতাগুলো সব ঝরে পড়ছিল। এখন দেখছি ব্যাপারটা ভুল।’

কথাটা শুনে রাহুল চমকে উঠে তাকাল গাছটার দিকে। সে দেখল, এক রাতের মধ্যেই গাছটা যেন সজীব হয়ে উঠেছে। পাতার বিবর্ণ হলদেটে নুইয়ে পড়া পাতাগুলো সবুজ হয়ে উঠে তাকিয়ে আছে সূর্যের দিকে। রাহুল একটা পাতা ভাঙতেই বোঁটা থেকে সাদা দুধের মতো রস গড়িয়ে পড়ল। গাছটা এখন জীবন্ত!

রাহুল এরপর তাকাল সাধুবাবার দিকে। তিনি মৃত হলেও তার ঠোঁটের কোণে জেগে আছে আবছা হাসির রেশ। তবে কি সাধুবাবা তাঁর এই মানবশরীরের বিনিময়ে গাছটাকে বাঁচালেন যেমন তিনি বলেছিলেন? অবিনশ্বর আত্মা এক খোলস ছেড়ে অন্য খোলসে প্রবেশ করল? শাস্তি দিল লালাজি আর বনমালীকে?

হয়তো তাই। সে রাতের অভিজ্ঞতার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না বলে রাহুল তা বলেনি কাউকে। তবে অনেক খুঁজেও লালাজি আর বনমালীর সন্ধান কেউ পায়নি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *