পুনরাবৃত্তি

পুনরাবৃত্তি

ম্যাডাম এবারে অন্তত পেন্সিল হিল ট্রাই করুন৷ আপনার অপজিটের হিরো কিন্তু পাক্কা ৬ ফিট৷ প্ল্যাটফর্ম হিলে কাজ চলবে না৷ ৫.৫ কে পেন্সিল হিলই পরতে হবে৷ ফ্যাশন ডিজাইনার রাহুলের প্রশস্ত কপালে চিন্তার হালকা ছাপ৷

ইলোরা ঠোঁটের পিচ কালারের লিপস্টিকটা বাঁচিয়ে একঢোক জল খেয়ে বললো, জানি রাহুল… পরিচালক রিতেশ এবারে হিরো হিসাবে অভিষেক রায়কে চুজ করেছেন৷

তবে ডোন্ট ওয়ারি৷ আই ক্যান ম্যানেজ৷

ইদানিং নিজের মধ্যে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন খেয়াল করেছে ইলোরা৷ একটা ওভার কনফিডেন্স৷ কিছুতেই যেন টেনশন নেই ওর৷ এটা ওকে শিখিয়েছে পরিচালক রিতেশ মিত্র৷ আসলে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে নিজের জায়গা ধরে রাখতে গেলে একটা বাস্তবকে মানতেই হবে, আজ আছি কাল নেই৷ তাই চুটিয়ে কাজ করে নাও৷

বেশ কিছু বড়ো ব্যানারে কাজ করার পর ইলোরা এখন বেশ পরিচিত একটা নাম৷ নায়িকা মহলে ঈর্ষার পাত্রী অবশ্যই৷ কানাঘুষোতে… প্রযোজক আর পরিচালকদের সাথে বেড শেয়ার করেই নাকি কাজ জুটিয়েছে ইলোরা মজুমদার৷ ছিল তো দুটো বিজ্ঞাপনের মডেল, আর দুটো সিরিয়ালের সাইড ক্যারেক্টার৷ তার থেকে একেবারে টপ নায়িকা তালিকায় আসতে নাকি ওকে এসব করতেই হয়েছে!

আগে কষ্ট হত, অপমানে চোখে জল এসে যেত৷ এখন এসব গসিপকে পার্ট অফ লাইফ ভেবে নিয়েছে৷

এবারের মুভিটার নাম— ‘কিছুক্ষনের আলাপ’৷

বড়ো ব্যানার, তাই খাটনি একটু বেশি৷ ইলোরা বরাবরই নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের খেঁটে খাওয়া মেয়ে৷ নিজেদের ‘দিন আনে দিন খাই’ বলতে কেমন একটা অস্বস্তি হয়৷ তাই সুন্দর একটা নামের মুখোশ— নিম্নমধ্যবিত্ত৷

বাড়িতে প্যারালাইজড বাবা আর মা৷ মা বয়স্ক হলেও মা দিনরাত কাজ করতে ভালোবাসে৷ বাবার পা দুটো পঙ্গু হলেও পৌরুষত্ব বোধটা রীতিমতজাগ্রত৷ তাই ইলোরা শুটিং সেরে বাড়ি ফেরার পরে প্রায়ই বলে, মেয়ের রোজগারে বসে বসে খাওয়ার থেকে মৃত্যু ভালো৷ প্রথম প্রথম ইলোরা কাঁদতো৷ মায়ের কাছে অভিযোগ করতো৷ কেন বাবা এমন বলে? মেয়ে বলে কি বাবা মায়ের দায়িত্ব নিতে সে অক্ষম?

এখন আর কাঁদে না৷ মনে মনে হাসে৷ বাবা নিয়ম করে ফল, ছানা খায়৷ যদি পঙ্গু পা দুটো সেরে ওঠে৷ তাহলে নাকি নিজেই রোজগার করবে৷ ইলোরা জানে বেশিরভাগ মৃত্যুকে আহ্বান করা মানুষরাই দীর্ঘজীবন কামী হয়৷ বাবাও ব্যতিক্রম নয়৷

ইলোরার একমাত্র গোপন জায়গা মায়ের কোল৷ মায়ের কোলে মুখ গুঁজে সে সব নোনতা জল ঝরিয়ে আবার নতুন করে বেঁচে ওঠে৷ প্রস্তুত হয় নতুন জীবনের জন্য৷

আজও বাড়িতে ঢুকতেই বাবার মুখের অতর্কিত আক্রমণটা ধেয়ে এলো৷ নামের সাথে সাথে তো চরিত্রটাও পাল্টে ফেলেছো৷ রাত ১০-টার আগে বাড়ি ফেরার প্রয়োজন বোধ করো না৷ কি করে বোঝাবে ইলোরা, গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডে রাত এগারোটা মানে সন্ধ্যে৷ পার্টি শুরুই হয় দশটায়৷ আর এইসব পার্টিগুলো অ্যাটেন্ড না করলে ইলোরাকে পিছিয়ে পড়তে হবে৷ নিন্দুকেরা যাই বলুক, ইলোরা জানে ও কতটা সৎ ভাবে এখনও আছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে৷ শুধু অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছে একটা ব্রেক পাওয়ার জন্য৷ এই যে দু কামরার সাজানো ফ্ল্যাটে এখন বাবা শুয়ে শুয়ে ওর নামে নিন্দে করছে… এটার টাকাও কিন্তু এসেছে ইলোরার অভিনয় জীবন থেকেই৷

ইলোরা অহংকারী নয় তবে খুব সাবধানী৷ কেজো বিষয় ছাড়া খুব একটা ঘনিষ্ঠ হয় না ও কারোর সাথে৷ পাছে মন দিয়ে ফেলে কাউকে৷ হূদয় বড়ো বেইমান৷ কাউকে একবার মন মন্দিরে বসিয়ে ফেললে তখন মাথার ইঙ্গিতেও সাড়া দিতে নারাজ থাকে মন৷

আগামী কালই আছে ‘কিছুক্ষনের আলাপ’-এর ফাইনাল সিলেকশন৷ ইলোরা ছাড়াও রিতেশ মিত্র আরো দুজন নায়িকাকে কেন কালকের মিটিংয়ে ডেকেছেন সেটা নিয়েই ফিসফাস চলছে স্টুডিও পাড়ায়৷

তবে কি ইলোরা সিলেক্টেড নয়৷ রিতেশ বরাবরই একটু খামখেয়ালি৷ হয়তো দেখা যাবে একটা কোনো সংলাপ তিনজনকে দিয়ে থ্রো করিয়ে দেখে নেবে কে পারফেক্ট৷ তাই এখন কিছুক্ষণের আলাপে যে ওই নায়িকা হচ্ছে সেটা কিন্তু নির্দিষ্ট নয়৷

রাতটা ভালো করে ঘুমাতে হবে ইলোরাকে৷ চোখ মুখ যেন ফ্রেস লাগে কাল৷ টায়ার্ডনেস মোটে সহ্য করতে পারে না রিতেশ৷ রিতেশের এই ফিল্মে সুযোগ পেলে বেশ কয়েকধাপ এগুনো যাবে৷

ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লো ইলোরা৷

ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখলো, কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে ইটগুড়ি রঙের সাধারণ চুড়িদার পরে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে৷ যার চোখে মুখে লজ্জা৷ সামনেই ছেলেটি বলছে, আর মাত্র এক বছর পরেই আমরা বিয়ে করবো৷ তখনও আমাকে লজ্জা পাবে তুমি? আবেশে গলা বুজে আসছে মেয়েটির৷ মেয়েটি বলছে সত্যি বিয়ে করবে তো?

মায়ের ডাকে ঘুমটা ভেঙে গেল ইলোরার৷ না, এই স্বপ্নটা সে আজ প্রথম দেখলো না৷ গত আট নয় বছর ধরে ক্রমাগত দেখেই চলছে৷

আজ সকালে একটা শুটিং আছে ওর৷ মাকে বলাই ছিল ডেকে দেবার জন্য৷ ভোরবেলায় ডিস্কো থেক খোলানো হবে শুধু শুটিংয়ের জন্য৷ যদিও খুব কম সময়ের একটা সিন৷

শুটিং ফ্লোরে ঢুকতেই কানে এলো, রিতেশের নতুন নায়িকা৷ অভিষেক রায়ের মতো হ্যান্ডুর পাশে একটু বেমানান তাই না?

আরেকজন বললো, আরে অভিনয়টা ফাটিয়ে করে ইলোরা মজুমদার৷ শুধু অভিনয়ের জোরেই ওই ৫.৫ ফুট হাইট নিয়ে অভিষেকের নায়িকা হতে চলেছে৷

পেটের মধ্যে একটা হাসি ঘুরপাক খাচ্ছিলো অনেকক্ষন ধরেই৷ ইলোরাদের পুরোনো পাড়ায় অনেকেই মা-কে বলতো, বেশি ধ্যাঙা মেয়েদের কিন্তু বর জোটে না৷ তোমার মেয়ে যা লম্বা হচ্ছে!

ওই নজরেই বোধহয় ইলোরার বৃদ্ধিটা থমকে গিয়েছিল ৫.৫-এ এসে৷

ডিজাইনার রাহুলকে একবার দরকার ইলোরার৷ আজ রাতের পার্টিতে ও কি পরবে সেটা ওই ঠিক করে দেবে বলেছিল৷ ফোনটা খুলে রাহুলকে একটা ফোন করতে যাবে এমন সময় দেখলো, একটা কিম্ভুত ইয়েলো জিন্সের ওপরে টমেটো রঙের টিশার্ট পরে রাহুল ঢুকছে৷ অন্য যে কেউ এই ড্রেস পরলে আওয়াজ খেত৷ কিন্তু চেহারার স্মার্টনেসের জন্যই যেন মনে হচ্ছে এই মহূর্তে এই পোশাকটাই পারফেক্ট ফ্যাশন৷

রাহুল এগিয়ে এলো ইলোরার দিকে৷ এসে ইশারায় ডেকে নিলো ওকে৷ সিলভার গাউন, অক্সিডাইসের জুয়েলারী, হাতে ব্ল্যাক ক্লাচ… কি বলছো?

ইলোরা হেসে বললো, এটা তোমার দায়িত্ব৷ খেয়াল রেখো যেন ভিড়ে মিশে না যাই৷ ভিড়ে মিশতে আমার বড্ড আপত্তি৷ মোঘল আমলের সম্রাটদের হারেমের বেগম ছিলাম মনে হয় কোনো জন্মে৷ তাই হয়তো আর এ জন্মে কোনো কিছুর ভাগীদার পছন্দ করি না৷ রাহুল বললো, কষ্ট? নাকি অহংকার?

ঘাড় নেড়ে ইলোরা উত্তর দিলো, আত্মসম্মান৷ আসলে কি জানো রাহুল,অনেকেই আছে যারা আত্মসম্মানকে অহংকার বলে গুলিয়ে ফেলে৷

স্রাগ করে রাহুল বললো, জাস্ট ৫ মিনিট মিট করছি৷

ড্রেসিংরুমের বড়ো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইলোরা৷ রাহুলের পছন্দের ড্রেস পরে৷ নিজেকে মাঝে মাঝে বড়ো অচেনা মনে হয় ওর৷

এর থেকে অনেক পরিচিত ছিল সেই ইটগুড়ি রঙের চুড়িদার পরা অতি সাধারণ চেহারার মেয়েটা৷ সে অন্তত তার মনের হদিসটা জানতো৷

আজকের ইলোরার সামনে শুধুই একটা উঁচু সিঁড়ি৷ যার মাত্র কয়েকটা ধাপ উঠেছে ও৷ এখনো অনেকটা বাকি৷ চোখের সামনে শুধু ওই সিঁড়ির ধাপগুলোই প্রকট হয় ওর৷

পার্টি জাস্ট শুরু হয়েছে৷ একটু দেরি করে ঢুকলে নিজের গুরুত্ব বোঝানো যায়৷ এতদিন এই ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে এই ছোট্ট ছোট্ট ট্রিক্সগুলো জেনে গেছে ইলোরা৷

সময়ের একটু পরে পার্টিতে ঢুকে একটু ব্যস্ততা দেখানো৷ এগুলো আজকাল শিখে গেছে ও৷

রিতেশ মিত্রের পাশেই একটা বছর তেত্রিশের ছেলে৷ হাতে একটা ফাইল নিয়ে ঘুরছে৷ মুখে চোখে একটা গদগদ ভাব৷ রিতেশ একবার তাকালেই যেন ধন্য হয়ে যাবে৷

ইলোরা ঢুকতেই রিতেশ বললো, গর্জিয়াস৷ ঠোঁটের কোণের মোহময়ী হাসিটাকে ছড়িয়ে দিয়ে অভিমানী গলায় ইলোরা বললো, ইয়েস, গর্জিয়াস৷ বাট নট সিলেক্টেড৷ তাই না মিস্টার মিত্র?

রিতেশ বেশ গলা চড়িয়ে বললো, হু ইস দ্য বাস্টার্ড বেবি? কে বলেছে তোমাকে তুমি ‘কিছুক্ষনের আলাপ’-এর হিরোইন নয়?

ইলোরা বললো, মিস্টার মিত্র ওই ছেলেটা কে?

রিতেশ চমকে বললো, কে?

ইলোরার চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো রিতেশ৷

ওহ! ওই ছেলেটা, ও তো কিংশুক ব্যানার্জি৷ আরে নিজেকে বিশাল স্ক্রিপ্ট রাইটার ভাবে৷ পরিচালকদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো৷ আজ আমার হাতে পায়ে ধরে এই পার্টিতে এসেছে৷ বিভিন্ন পরিচালকরা আসছে৷ তাদের সাথে পরিচয়ের ধান্দায়৷ আরে যেমন হয়৷

ইলোরা আস্তে করে বললো, দিয়েই দেখুন না একটা ব্রেক৷

হয়তো সত্যিই কিছু ক্ষমতা রাখে৷ অনেক সময় নতুনদের মধ্যেও কিছু প্রতিভা লুকিয়ে থাকে৷

রিতেশ একটু চোখটা ছোটো করে তাকালো ইলোরার দিকে৷ বলছো?

ইলোরা মজুমদার এখন ইন্ডাস্ট্রির সব থেকে প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী৷ তার কথার মূল্য দেবে না এমন পরিচালক আছে নাকি?

অভিমানী আদুরে গলায় ইলোরা বললো, এত সার্টিফিকেট যখন দিচ্ছেন, তখন ওই কিংশুক ব্যানার্জিকে একটা ব্রেক দিয়েই দেখুন আমার আব্দারে৷

‘কিছুক্ষণের আলাপ’ মুভির কিছু সংলাপ নিয়ে আলোচনা৷ শুটিং স্পট নিয়ে আলোচনার পরেই শেষ হলো পার্টি৷

বেশ কয়েকদিন পরের ঘটনা৷

চোখের সামনে দিয়ে ইলোরা মজুমদার চলে গেলো৷ একবার কৃতজ্ঞতা জানাতে চায় কিংশুক৷

কিংশুক শুনেছে ওনার জন্যই রিতেশ মিত্র রাজি হয়েছে ওর স্ক্রিপ্ট-এ নেক্সট মুভি বানাতে৷

অনেক বছর পর ওর স্বপ্নটা পূরণ হতে চলেছে৷ যিনি ওকে সাহায্য করলেন তাকে এতটা সামনে পেয়েও কৃতজ্ঞতা জানাবে না, এটা কি হয়?

দু-পা এগিয়ে ডেকে উঠতে গিয়েও থমকে গেল কিংশুক৷ মেক ওভারে অনেক কিছুর পরিবর্তন হলেও গলার ঠিক নিচের লালচে তিলটা একই রয়ে গেছে৷ নাম বদলের সাথে ওটার পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি ইলোরা৷

রাত্রে একলা বিছানায় শুয়ে আছে কিংশুক৷

ফিরে গেছে বছর দশেক আগের সেই সন্ধ্যেতে৷ করুণ মুখের সেই মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে কিংশুককে ভরসা করে৷

সবিতা মজুমদার৷

একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত বাড়ির অতি সাধারণ একটা মেয়ে৷ কিংশুক বেশ অবস্থাপন্ন বাড়ির একমাত্র সন্তান৷ তাছাড়া ছোটো থেকেই ওর স্বপ্ন ছিল ফিল্ম বানানোর৷ ওর লেখা গল্পের চরিত্ররা কথা বলবে, বাঙময় হয়ে উঠবে রঙিন পর্দায়৷

কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই পরিচয় হয়েছিল সবিতার সাথে৷ নিজের রঙিন স্বপ্নগুলোর সফলতা দেখতো একমাত্র সবিতার চোখে৷

যখন গোটা কলেজের সকলে ওর লেখা নিয়ে জাস্ট খিল্লি ওড়াতো, তখন ওই নিরীহ মেয়েটা ওর হাতে হাত রেখে বলতো, দেখো তুমি একদিন ঠিক পারবে কিংশুক৷

আমি থাকবো তোমার স্বপ্ন পূরণের সাথী হয়ে৷ মেয়েটার কাজল কালো চোখ দুটোতে ছিলো একরাশ আশার বাণী৷

তবে মুস্কিল ছিলো মেয়েটা ছিল বড্ড সাধারণ৷ কিংশুক যেটা চাইতো সেটা নয়৷ যেন কোনো চমক ছিলো না ওর মধ্যে৷ সবিতা কোনোদিনই উচ্ছল ঝর্ণা হতে পারতো না৷ নিস্তরঙ্গ নদী হয়েই রয়ে গিয়েছিলো৷

কিংশুক হাঁপিয়ে উঠেছিলো সবিতার ভালোবাসার অত্যাচারে৷ সবিতা যেন সব সময় ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতে চাইছিলো কিংশুককে৷

আস্তে আস্তে সম্পর্কের সুতোটা কাটতে চাইছিলো কিংশুক৷ ততদিনে লাবণ্যর সাথে পরিচয়টা হয়ে গিয়েছিলো কিংশুকের৷ লাবন্যর কোনো এক খুড়তুতো কাকা ছিলো ফিল্ম পরিচালক৷ কিংশুক চেয়েছিলো লাবণ্যের মারফত ওনার কাছে পৌঁছাতে৷

সবিতা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো, কিংশুক একটু একটু করে সরে যাচ্ছিলো ওর কাছ থেকে৷ কাঁদো কাঁদো মুখে বলেছিলো, তুমি আমাদের সম্পর্কটা রাখতে চাও না?

কিংশুক পরিষ্কার করে বুঝিয়েছিলো সবিতাকে৷ যে সবিতার মতো অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে শুধু পার্ট টাইম প্রেমিকা হতে পারে৷ কিন্তু সারাজীবনের সঙ্গী নয়৷ কিংশুক উঁচুতে উঠতে চায়৷ সবিতার মতো মাটি ছুঁয়ে থাকতে চায়না৷

সবিতা শেষ চেষ্টা করেছিল৷

আমি নিজেকে বদলে ফেলবো কিংশুক৷ তোমার মনের মতো করে তৈরি করব নিজেকে৷

না, ওর ডাকে সেদিন সাড়া দেয়নি কিংশুক ব্যানার্জি৷ লাবণ্যর আকর্ষণী শক্তি তীব্র ভাবে হাতছানি দিচ্ছিলো কিংশুককে৷ ওই সাধারণ আটপৌরে সবিতাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিলো কিংশুক৷

না, পিছনের দিকে তাকানোর চেষ্টাও করেনি আর!

মা, আজ কিংশুককে দেখলাম পার্টিতে৷ রোগা হয়ে গেছে জানো৷ কেমন একটা অগোছালো হাবভাব৷

মা অবাক চোখে বললো, সবি, তুই কি আজও ওকে…

কথাটা কমপ্লিট করতে দিলো না ইলোরা৷

জানো মা আজ ওকে দেখে অনেকটা পথ পিছনে হেঁটে গেলাম৷ আমাদের সেই পুরোনো ভাড়া বাড়ি, আমার সেলস গার্লের চাকরি, বাবার কার্ডিও অ্যারেস্ট, তারপর প্যারালাইজড৷ কত কষ্টে কাটিয়েছি মা আমরা৷

সেদিন যদি ওই ফেয়ারনেস কোম্পানির সেলস থেকে মডেলের কাজটা না পেতাম তাহলে হয়তো কোনোদিনই ইলোরা মজুমদার হওয়া হতো না৷

মা মাথার চুলে হাত বোলাচ্ছে৷

কিংশুক কথা বললো নাকি তোর সাথে?

না মা, বলে নি৷ হয়তো চিনতেই পারেনি৷ সবিতা আর ইলোরার মধ্যে যে কয়েক আলোকবর্ষ-এর দূরত্ব মা৷

ইলোরাই ভুলে গেছে তোমার সবিকে৷

ভুলে গেছে? সত্যিই কি ভুলতে পেরেছে ইলোরা?

কেউ বোধহয় বলেছিলো, প্রথম ভালোবাসায় প্রবঞ্চিত হলে সেই মানুষটা বাঁচতে হয়তো ভোলে না, কিন্তু ভালোবাসতে ভুলে যায়৷

এতগুলো বছরে স্মার্ট সুন্দরী ইলোরা প্রপোজাল তো কম পেলো না৷ কিন্তু আজ অব্দি কাউকে বিশ্বাস করে মনে বসাতে পারলো কই৷

আজও মনে পড়ে কিংশুকের শেষ কথাটা৷ তুমি বড্ড সাধারণ সবিতা৷ আমার যোগ্য নও৷

সবিতা সেদিন প্রথম জেনেছিলো, তিন বছরের ভালোবাসার পরেও কেউ রিজেক্ট হয় হূদয় অলিন্দ থেকে৷ তিনবছর পরেও শুনতে হয় জীবন সঙ্গী হিসেবে সে অযোগ্য৷

চোখ দুটো হঠাৎ করেই খুব জ্বলছে ইলোরার৷

ঘুমাতেই হবে ওকে রাতে৷ নিশ্চিন্ত ঘুম৷ চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল আসতে দিলে চলবে না৷

স্টুডিওতে ঢুকতেই সামনেই দাঁড়িয়ে আছে কিংশুক৷

এড়িয়ে যেতে চেয়েও পারলো না ইলোরা৷

কেমন আছো সবিতা?

ইলোরা হেসে বললো, সরি… সবিতা নয়৷ ইলোরা মজুমদার৷

কিংশুক ওর কথায় গুরুত্ব না দিয়েই বললো, বছর পাঁচেক আগে যেদিন সিরিয়ালে প্রথম তোমার মুখ দেখলাম সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম৷ তুমি যে কোনোদিন গ্ল্যামার দুনিয়ায় আসতে পারো জাস্ট ভাবতেই পারিনি৷

ইলোরা বললো, আমি অভিনয়টা বেশ ন্যাচারাল করি কিংশুক৷ মনেই হয় না আমি অভিনয় করছি৷ আসলে অতি সাধারণ কিনা…

কথা শেষ করতে না দিয়েই কিংশুক বললো, তুমি জানো সবিতা, বাবা মারা গেছেন৷ আমি একটা সামান্য প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি করি৷ মা, ভাইকে নিয়ে আমার সংসার৷

ইলোরা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো, লাবণ্য?

বিয়েটা করোনি এখনো?

কিংশুক বললো, না লাবণ্যর অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেছে৷

কিংশুক মায়াবী গলায় বললো, আমি বোধহয় এখনো তোমাকেই ভালোবাসি ইলোরা৷

হৃৎপিন্ডটা মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সবিতার৷

ইলোরা এসে জোরে একটা ধাক্কা দিলো৷

সামলে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক হাসি হেসে ইলোরা বললো, কিংশুক আমি রিতেশ মিত্রকে বলেছি তোমাকে সুযোগ দেবার জন্য৷ একদিন কথা দিয়েছিলাম, তোমার স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হবো৷ তাই আমি আমার কথা রাখলাম৷ কিন্তু তুমি সবিতাকে ভালোবাসতে না৷ তুমি আজ প্রতিষ্ঠিত নায়িকা ইলোরা মজুমদারকে সিঁড়ি বানাতে চাইছো কিংশুক৷ মুশকিলটা কি বলতো, সবিতা ছিলো বড্ড সাধারণ, তোমার জীবনসঙ্গীর অযোগ্য৷ আজ ইলোরা অনন্যা, প্রতিষ্ঠিত৷ কিংশুক ব্যানার্জি যে আবার ইলোরার অযোগ্য৷ এখন আমি যদি তোমায় বিয়ে করি গোটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি হাসবে, ইলোরার পাগলামি দেখে৷

নিজের চেষ্টায় বড়ো হও কিংশুক৷ ভালোবাসা নামক পবিত্র অনুভূতিকে ব্যবহার করে নয়৷

অনেকগুলো জমা কথা বলতে পেরে বেশ হালকা লাগছে ইলোরার৷ এতগুলো বছরের অপমানের কষ্টটা যেন বেশ কিছুটা কমে গেছে এক নিমেষে৷

পিছনের দিকে না তাকিয়েই এগিয়ে গেলো ইলোরা৷

অনেক বদলে গেছে সবিতা, এত বছর ধরে সিনেমায় ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয় করতে করতে চিনে গেছে সত্যি-মিথ্যের ফারাকটা৷ আজ আর ভালোবাসি কথাটাতে বুকের রক্ত ছলকে ওঠে না৷ আজ আর কিংশুক নামটাতে হাজারটা পদ্ম একসাথে ফোটে না মনের ঘরে৷ এই মুহূর্তে কিংশুক শুধু একটা লোভী মানুষের নাম ছাড়া কিছুই নয় ইলোরার কাছে৷ ইলোরা জানে, বেইমানরা দ্বিতীয় সুযোগেও স্বরূপ দেখাবেই৷ এগিয়ে চলেছে ইলোরা… সামনের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের হাতছানিতে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *