পিশাচগড়ের পিশাচ বুরুজ

পিশাচগড়ের পিশাচ বুরুজ

মুঞ্জ খাটের উপর রাখা সুটকেসটা খোলার আগে সমুদ্রকে বলল, ‘মেসবাড়িতে তোমাদের সকলের আমার এই টিনের সুটকেসটা নিয়ে খুব আগ্রহ তাই না? কতবার তোমরা ইয়ারকি মেরেছ এর মধ্যে গুপ্তধন আছে বলে! এবার দেখো এর মধ্যে কী আছে৷’ এই বলে চাবি দিয়ে তালা খুলে সুটকেসের ডালা খুলল মুঞ্জ৷ কৌতূহলবশত সমুদ্র তাকাল তার ভিতরের জিনিসের দিকে৷ না, গুপ্তধন নয়, তার ভিতরে রাখা আছে জরির কাজ করা কিছু পোশাক, আর একটা পাগড়ি৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে জিনিসগুলো অনেক পুরোনো৷ ন্যাপথলিনের ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে সেই জামাকাপড়গুলো থেকে৷ পাগড়িটা বার করে নিয়ে মাথায় পরে মুঞ্জ বলল, ‘বাকি জিনিসগুলো যথাস্থানে গিয়ে পরব৷ আমি যে রাজপরিবারের সন্তান তা হয়তো তোমরা বিশ্বাস করতে না৷ নেহাতই ভাগ্যের দোষে বিকানির থেকে অতদূর তোমাদের মেসবাড়িতে থেকে কেরানির চাকরি করছি৷ এবার হয়তো ভাগ্য ফিরে যেতে পারে তোমরা থাকলে৷ সেজন্যই তোমাদের দুজনকে এতদূর টেনে এনেছি৷ যাই হোক, ওই বুরুজ ঘরে রাত কাটাবই আমি৷’

সমুদ্র আর সোমনাথ একটু বিস্মিত হল মুঞ্জর কথা শুনে৷ সমুদ্র জানতে চাইল, ‘বুরুজ ঘরটা কী?’

মুঞ্জ তার কথায় রহস্য আরও ঘনীভূত করে বলল, ‘কেল্লায় যারা থাকে তারা ও ঘরটাকে বলে ‘পিশাচ ঘর’৷ এখন এ ব্যাপারে কিছু বলব না৷ তোমরা তো গোয়েন্দাগিরি করো৷ দেখো ওই পিশাচ বুরুজের রহস্য উদ্ধার করতে পারো কিনা? তবে এখন আর এ ব্যাপারে কিছু বলব না৷ জায়গাটাতে পৌঁছালে সব বুঝতে পারবে৷ বাইরে টাঙ্গা দাঁড়িয়ে আছে, চলো, এবার আমরা সেখানে রওনা দেব৷’

তার টিনের সুটকেসটা বন্ধ করল মুঞ্জ৷ সমুদ্র আর সোমনাথ তৈরি হয়েই ছিল৷ মালপত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে টাঙ্গায় উঠে পড়ল তারা তিনজন৷ এর আগে একবার রাজস্থান বেড়াতে এলেও উত্তর-পশ্চিম রাজস্থানের বিকানিরে এর আগে কোনওদিন আসা হয়নি সমুদ্রের৷ গতকাল তারা জয়পুরে এসে পৌঁছেছে৷ তারপর রাতের ট্রেন ধরে বিকানিরে আজ সকালে এসেছে৷ স্টেশন সংলগ্ন হোটেল ছেড়ে টাঙ্গায় ওঠার পর মুঞ্জ টাঙ্গাওয়ালাকে নির্দেশ দিল ‘পিশাচগড় চলো৷’

সোমনাথ বিস্মিতভাবে বলল, ‘ও জায়গার নাম পিশাচগড়!’

মুঞ্জ হেসে বলল, ‘ও জায়গার আসল নাম ছিল ‘নিধনগড়’৷ সেই প্রাচীন নামের পিছনেও একটা কারণ আছে৷ সরকারি কাগজেও এখনও সেই নাম আছে৷ তবে স্থানীয় লোকদের কাছে কেল্লাটা পিশাচগড় নামেই পরিচিত৷’

মুঞ্জ রাওয়ের নির্দেশ পেয়ে চলতে শুরু করল টাঙ্গা৷ স্টেশন সংলগ্ন রাস্তার দু-পাশে নানা দোকান-বাজার, আধুনিক শপিং মল, আবার তার মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শনও—প্রাসাদ, দেউল, তোরণের ভগ্নাবশেষ৷ রাস্তায় যেমন দামি গাড়ি চোখে পড়ছে তার পাশাপাশি চলছে উট আর ঘোড়ায় টানা গাড়িও৷ মুঞ্জ তাদেরকে বলল, ‘সব যদি ঠিকঠাক থাকে, কেল্লা থেকে যদি আমি ফিরে আসতে পারি তবে এখানকার রাজপ্রাসাদটা ঘুরিয়ে দেখাব তোমাদের৷ জানো তো যে এই বিকানির হল রাজস্থানের অন্যতম প্রাচীন জনপদ৷’

সমুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ, জানি৷ রাজস্থানের জনপদগুলোর মধ্যে এই বিকানির, জয়শলমের, ভরতমেরু, মিবার, কোটা, বুন্দি, যোধপুর আর জয়পুরই সবচেয়ে প্রাচীন৷ কাঁটাগাছের জঙ্গলপূর্ণ এই মরুদেশকে একসময় জঙ্গলদেশ বলা হত৷ যোধপুররাজ জোধারাওয়ের পুত্র বিকারাও ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে নগরীর পত্তন করেন৷ রাঠের বংশীয় রাজারা এখানে রাজত্ব করেন৷ মোগলদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন তাঁরা৷ কিন্তু বিকারাজ রায়সিংহ আকবরের রাজসভায় উচ্চপদ লাভের বিনিময়ে তাঁর কাছে আত্মসমর্পণ করে রাজপুতদের মর্যাদাহানি করেন৷ এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে মহারানা প্রতাপ সিংহ রায়সিংহকে ‘পতিত ক্ষত্রিয়’ ঘোষণা করেন এবং বিকা রাজপরিবারের সঙ্গে মেবারের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ করেন৷ রায়সিংহ পরবর্তীকালে মোগল সেনাপতি হন৷ মধ্য এশিয়া থেকে গুজরাত বন্দরের সংযোগকারী এ পথে একসময় গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য নগরী হয়ে উঠেছিল এই বিকানির৷ রায়সিংহ এখানে এক বিশাল দুর্গ নির্মাণ করান৷ যার নাম ‘চিন্তামণি’৷ বর্তমানে যার নাম ‘জুনাগড় ফোর্ট’৷’

সমুদ্রের কথা শুনে মুঞ্জ বলল, ‘বাঃ, আমাদের ইতিহাস সম্বন্ধে তুমি বেশ খবর রাখো তো৷ তবে জুনাগড় ফোর্ট ছাড়াও এখানে অনেক ছোট ছোট কেল্লা আছে৷ তেমনই এক কেল্লায় যাচ্ছি আমরা৷ ট্যুরিস্টরা রাজস্থানের ফোর্ট মানেই জয়পুরের অম্বর ফোর্ট, চিতোরের ফোর্ট, জয়শলমিরের ‘সোনার কেল্লা’ বা এখানকার জুনাগড় কেল্লার কথা ভাবে৷ কিন্তু এখনও অসংখ্য কেল্লা বা ফোর্ট, বা তার ভগ্নাবশেষ ছড়িয়ে আছে সারা রাজস্থান জুড়ে৷’

সমুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ জানি৷ কিন্তু তুমি ওই ‘নিধনগড়’ বা ‘পিশাচগড়’ থেকে ফিরে না আসার কথা বলছ কেন?’

মুঞ্জ হেসে জবাব দিল, ‘সেটা ওখানে গেলেই জানতে পারবে৷’

টাঙ্গা এগিয়ে চলল, ঘোড়ার খুরের খটখট শব্দে৷ একসময় শহর ছেড়ে সেই কেল্লার পথ ধরল টাঙ্গা৷ শহর ছেড়ে বেরোবার পরই যেন চারপাশের পরিবেশ বদলে গেল৷ এই বিকানির থর মরুভূমিরই একটা অংশ৷ পথের দু-পাশে কোথাও উষর মরু অঞ্চল, আবার কোথাও ঘন কাঁটাগাছের জঙ্গল৷ বড় বাবলা গাছ থেকে, ছোট ফণিমনসা ধরনের কাঁটাগাছের জঙ্গল৷ রাস্তায় বাহন বলতে চোখে পড়ছে উট৷ মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভিতর থেকে ময়ূরের কর্কশ ডাক ভেসে আসছে৷ মাঝে মাঝে সেই মরুস্থলীর মধ্যে চোখে পড়ছে অনুচ্চ পাহাড়৷ তারা হয় ন্যাড়া, অথবা ছোট-বড় কাঁটাগাছে পরিপূর্ণ৷ তার মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলল সমুদ্ররা৷ এক সময় দিকচক্রবালে ফুটে উঠল একটা কালো রেখা৷ তা দেখে মুঞ্জ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, ‘ওই যে, ওটাই নিধনগড়৷ আমি ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার এসেছিলাম এখানে৷’

সোমনাথ জানতে চাইল, ‘ওখানে তোমার কে আছেন?’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘ওখানে বেশ কিছু লোকজন আছে ঠিকই, তবে তারা সে অর্থে আমাকে চেনে না৷’

সমুদ্র বলল, ‘তার মানে?’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘তবে অসুবিধার কিছু নেই৷ আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যা দেখে তারা আমাকে চিনতে পারবে৷’

ক্রমশ কাছে এগিয়ে আসতে লাগল দিকচক্রবালের সেই কালো রেখা৷ এক সময় সমুদ্রের চোখে ধরা পড়ল একটা ছোট পাহাড়ের মাথার উপর একটা প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ৷ ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়, যা এই পরিবেশের সঙ্গে একটু বেমানান৷ বিশেষ ভাবে সে জায়গার দিকে তাকিয়ে যে জিনিসটা চোখে পড়ল তা হল কেল্লার মাথায় অবস্থিত একটা বুরুজ বা নজর মিনার৷

মুঞ্জ বলল, ‘এই হল সেই ‘পিশাচ বুরুজ’৷ এই কেল্লা নির্মিত হয় সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে৷

কেল্লাটা এগিয়ে আসতে লাগল কাছে, আরও কাছে…৷ ছোট পাহাড়টার ধাপে ধাপে ওপর দিকে উঠে গেছে কেল্লাটা৷ যার শীর্ষদেশে দাঁড়িয়ে আছে সেই পিশাচ বুরুজ! ভগ্ন প্রাচীর ঘেরা কেল্লায় দূর থেকে সমুদ্রদের চোখে পড়তে লাগল ঘর-বাড়ি-দেউলের চিহ্ন৷ এক সময় সেখানে পৌঁছে গেল টাঙ্গা৷ পাথর বাঁধানো পাকদণ্ডী করে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেশ কিছুটা ওপরে উঠে ছোট্ট দুর্গনগরীর ভিতর একটা প্রশস্ত চত্বরে মুঞ্জের নির্দেশে থামল টাঙ্গা৷ মুঞ্জর কথাই ঠিক৷ তারা টাঙ্গা থেকে নামার পরই আশপাশের বাড়িঘর থেকে বেশ কিছু লোকজন এসে ধীরে ধীরে ঘিরে ধরতে লাগল তাদের৷ কেল্লারই মানুষজন সব৷ তাদের পরনে ধৌচারা বা ধুতি, গায়ে রঙিন কুর্তা, মাথায় লেইরিয়া বা পাগড়ি, কানে দুলের মতো দেখতে ‘লোঙ’, পায়ে নাগরা৷ আপাদমস্তক রাজস্থানী পোশাক৷ তাদের চোখে বিস্ময়ের ভাব৷ কারণ সাধারণত বাইরের লোক বা ট্যুরিস্টরা আসে না এখানে৷

জনা পঞ্চাশেক লোক হবে৷ সমুদ্র অনুমান করল তারা সবাই দুর্গের বাসিন্দাই হবে৷ তাদের মধ্যে একজন কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করল, ‘তোমরা কি দুর্গ দেখতে এসেছ?’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘আমি রাজ বংশধর৷ কাল তো অমাবস্যা তাই এসেছি৷ সর্দার সেনাপতিকে ডাকো৷ কথা বলব!’

রাজ বংশধর! বিস্ময় ফুটে উঠল সে লোকটা সহ সমবেত জনতার মুখ৷ তাদের সন্দেহ নিরসনের জন্য মুঞ্জ তার পকেট থেকে প্রমাণস্বরূপ একটা প্রাচীন সিক্কা বা ধাতুর তৈরি মুদ্রা বার করে প্রশ্নকর্তা লোকটার হাতে দিল৷ লোকটা সিক্কাটা নিয়ে একটু ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে মুঞ্জর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে বলল, ‘দাঁড়ান, তাকে ডেকে আনছি৷’

কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ন্যুব্জ অশীতিপর লোককে ধরে ধরে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হল প্রথমের লোকটা৷ বিরাট একটা তলোয়ারে লাঠির মতো ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পাগড়ির নীচ দিয়ে তাকিয়ে বৃদ্ধ লোকটা বললেন, ‘আপনি কোন শরিক? আপনার পরিচয় কী?’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘রাঠের ভগবান রাওয়ের শরিক৷ তিনি আমার ঊর্ধ্বতন দ্বাদশ পুরুষ ছিলেন৷’

বৃদ্ধ প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি আমার পরিচয় জানেন?’

মুঞ্জ বলল, ‘হ্যাঁ, জানি, আপনার পূর্বপুরুষ এ দুর্গের সেনাপতি ছিলেন৷ বংশ পরম্পরায় এ দুর্গ দেখভাল করেন আপনারা৷ রাজবংশের প্রাচীন দলিলে এ দুর্গের উত্তরাধিকারীর হাতে এ দুর্গ সমর্পণের অধিকার আপনাদেরই দেওয়া আছে৷ আপনার নাম জগমন সিং৷ আমার ঠাকুরদা রাঠোর মাধো রাও-ও এখানে এসেছিলেন দুর্গের অধিকার পাওয়ার জন্য৷’

বৃদ্ধ জগমন একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘মাধো রাও! এবার মনে পড়েছে৷ আমার যুব বয়সে সে এসেছিল৷ কিন্তু অন্যদের মতো সেও এখান থেকে ফিরে যেতে পারেনি৷ পিশাচ বুরুজ থেকে পরদিন তার কঙ্কালটা বার করে এনেছিলাম আমি৷’

এ কথা বলার পর বৃদ্ধ বললেন, ‘আপনি নিশ্চয় জানেন যে দলিল মোতাবেক আপনাকে তবে অমাবস্যার রাতটা ওই পিশাচ বুরুজ ঘরে কাটাতে হবে! বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে নীচে নেমে আসব আমরা৷ আপনি হাজার চেষ্টা করলেও বাইরে বেরোতে পারবেন না সূর্যোদয়ের আগে৷’

মুঞ্জ বেশ দৃঢ়ভাবে বলল, ‘হ্যাঁ, জানি৷ আমি রাজি আছি এ প্রস্তাবে৷’

বৃদ্ধ বললেন, ‘কিন্তু ও ঘর থেকে কেউ জ্যান্ত বের হয়নি কোনওদিনও৷ আমরা চাই না ওভাবে আপনার মৃত্যু হোক৷ ব্যাপারটা আমরা অন্যভাবে চাক্ষুষ করাতে পারি৷ তার জন্য আপনাকে আমাদের কাছ থেকে একটা ছাগল কিনতে হবে৷ সেটা ওই পিশাচ বুরুজে রেখে আসা হবে৷ পরদিন ভোরে দরজা খুললেই আপনি বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা কী৷ তা দেখেও আপনি যদি রাজি থাকেন তবে আর আমাদের কোনও দায় থাকবে না৷ আপনার সঙ্গীরা বা অন্য কেউ বলতে পারবে না যে জেনেশুনে আমরা আপনাকে মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছি৷’

মুঞ্জ হেসে বলল, ‘না, না, তেমন হলে আপনার কোনও দায় থাকবে না এ ব্যাপারে৷ আমার এই বন্ধু আপনার তরফে সাক্ষী দেবে এ ব্যাপারে৷ তবে ওই পিশাচের ব্যাপারে আমার ঠিক বিশ্বাস নেই৷’

বৃদ্ধ কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে৷ তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে আপনারা এখন একটা ঘরে বিশ্রাম নিন৷ বিকাল হলে, আপনাদের ওই বুরুজ ঘরটা দেখিয়ে আনা হবে৷ আর ছাগলকে সে সময় গিয়ে ওখানে রেখে আসা হবে৷ প্রয়োজনে আপনারা তালা দেবেন দরজায়৷ যাতে পরদিন ব্যাপারটা দেখে সেটা আমাদের কারসাজি মনে না হয়৷’

কিছুক্ষণের মধ্যে সমুদ্রদের এনে তোলা হল দুর্গেরই একটা ঘরে৷ লোহার গরাদ ঘেরা জানলা দিয়ে দুর্গশীর্ষের বুরুজটা দেখা যাচ্ছে৷ যারা সমুদ্রদের সেখানে পৌঁছে দিয়ে গেল তারা চলে যাওয়ার পর সমুদ্ররা এবার মুঞ্জকে চেপে ধরে বলল, ‘এবার তুমি ঘটনাটা খুলে বলো যাতে আমরা রহস্য উদ্ধারের জন্য ভাবনা শুরু করতে পারি৷’

মুঞ্জ বলল, ‘হ্যাঁ, সে জন্যই তো তোমাদের এখানে আনা৷ ওই যে পিশাচ বুরুজ দেখছ ওর এক অদ্ভুত কাহিনি আছে৷ আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন বিকারাজের অধীনে সামন্ত সর্দার৷ যদিও চলতি ভাষায় তাঁদের রাজা বলা হত৷ একসময় মোগলদের বিরুদ্ধে অনেক লড়েছেন তাঁরা৷ বিকারাজদের সঙ্গে তখন চিতোররাজদের সখ্যতা ছিল৷ একসঙ্গে মোগলদের বিরুদ্ধে লড়তেন তাঁরা৷ মোগলরা যতবার ওই দুর্গ বা গড় দখল করতে এসেছে ততবার সমূলে নিধন করা হয়েছে তাদের৷ এ জন্য এই গড়ের নাম ‘নিধনগড়’৷ আকবরও এ কেল্লা দখল করতে পারেননি৷ কিন্তু বিকারাজ রায়সিংহ শেষ পর্যন্ত পদের লোভে আত্মসমর্পণ করলেন আকবরের কাছে৷ আর ওদিকে মেবারেরও তখন পতন ঘটেছে৷ এক প্রতাপ সিংহ কোনওক্রমে লড়াই চালাচ্ছেন আকবরের সাথে৷ রাও যোধসিং তখন এ দুর্গের রাজা৷ তিনি প্রতাপকে শ্রদ্ধা করতেন৷ রায়সিংহ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করলেও রাঠের যোধ সিংহ তাতে রাজি হলেন না৷ কাজেই দুর্যোগ নেমে এল৷ বিকারাজ দাবি করলেন এ দুর্গ তাঁর হাতে বকলমে মোগলদের ছেড়ে দিতে হবে৷ যোধ সিংহ এ প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক রাজপুত সেনাপতির নেতৃত্বে তাঁর অনুগত বিরাট এক সেনাদলকে দুর্গ দখলের জন্য পাঠালেন বিকারাজ৷ সেই সেনাদলে মোগলরাও ছিল৷ ওই বিরাট সেনাদলকে প্রতিহত করার ক্ষমতা ছোট্ট ভূস্বামী আমার পূর্বপুরুষ যোধার ছিল না৷ তবে তিনি এক অদ্ভুত কৌশল করলেন৷ বিকারাজের সেনাপতিকে তিনি বললেন, ‘তুমি দুর্গের দখল নিতে এসেছ ভালো কথা৷ কিন্তু দুর্গ ছেড়ে চলে যাবার আগে দেখে যেতে চাই যে তুমি একজন প্রকৃত সাহসী রাজপুত এবং এই দুর্গ রক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি৷ তুমি যদি দুর্গের মাথায় ওই নির্জন বুরুজ ঘরে একলা রাত্রিবাস করতে পারো তবে বুঝব তুমি আর তোমার প্রভু বিকারাজ প্রকৃতই সাহসী রাজপুত৷’

কেউ কোনও রাজপুতের সাহস নিয়ে সন্দিহান হলে তা সহ্য করতে পারে না তারা৷ কাজেই সেই সেনাপতি রাজি হয়ে গেল৷ তাছাড়া এই সামান্য কাজ করে যদি বিনা যুদ্ধে দুর্গের দখল পাওয়া যায় তবে মন্দ কি? কাজেই রাজি হয়ে গেল সেনাপতি৷ সেদিন ছিল অমাবস্যা৷ সূর্য ডোবার আগে সেই সেনাপতি বুরুজ ঘরে ঢুকল৷ তাকে সে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে কেল্লার নীচের চত্বরে নেমে এল সবাই৷ পরদিন সেই সেনাপতির লোকজন উপরে উঠে সেই বুরুজের দরজা খুলে দেখল বুরুজ ঘরের মধ্যে পড়ে আছে সেনাপতির কঙ্কালটা! এরপর বিকারাজের আর এক সেনাপতি এল দুর্গের দখল নিতে৷ ওই ঘরে রাত কাটাতে গিয়ে তারও একই অবস্থা হল৷ এর কিছুদিনের মধ্যে দুর্গ লাভ করতে এসে একই ভাবে প্রাণ গেল এক মোগল সুবেদারের৷ যোধ সিংহের প্রস্তাবটা অস্বীকার করতে পারছিল না কেউই৷ কারণ তাতে তাদের কাপুরুষতা প্রমাণ হত৷ এই সব ঘটনায় রটে গেল যে ওই বুরুজে যোধ সিংহের অনুগত এক পিশাচ আছে যে হত্যা করে সবাইকে৷ এ ব্যাপারটা রটে যাওয়ার পর কেউ আর রাজি হল না এ দুর্গে তার সাহসের পরীক্ষা দিতে৷ বিকারাজ রায়সিংহও আকবরের সেনাপতি হয়ে দিল্লি চলে গেলেন৷ নানা কাজের চাপে তিনিও আর মাথা ঘামালেন না মরুরাজ্যের এই অপাংক্তেয় দুর্গটা নিয়ে৷ যোধরাও-ই এ দুর্গের রাজা হয়ে গেলেন৷ নিজের মৃত্যুর আগে তিনি বলে গেলেন যে এই দুর্গের ভূস্বামী সবাইকে একরাত ওই বুরুজ ঘরে থাকতে হবে৷ তারপর থেকে যোধা রাওয়ের উত্তরসূরীরা এই দুর্গ দখল নেবার আগে ওঘরে একটা রাত কাটাত৷ তাদের কিন্তু কিছু বলত না ওই পিশাচ…৷’

সমুদ্র বলল, ‘তাহলে তো ও ঘরে কি ভাবে রাত কাটাতে হয় তা বংশানুক্রমে তোমারও জানার কথা?’

মুঞ্জ হেসে বলল, ‘ওখানেই তো গণ্ডগোল৷ বুরুজের পিশাচকে কি ভাবে দূরে রাখতে হয় তা মৃত্যুর আগে যোধরাও বলেছিলেন তাঁর ছেলেকে৷ বংশপরম্পরায় দুর্গের মালিকরা তা জানিয়ে যেতেন তাঁর সন্তানকে৷ কিন্তু একবার এক রাজা সেই গোপন কথাটা তাঁর সন্তানকে জানাবার আগেই মারা গেলেন৷ ব্যস তাঁর সন্তানও বুরুজ ঘরে ঢুকে কঙ্কাল হয়ে বেরোল৷ আর তারপর থেকে কোনও রাজা মালিক নেই এই দুর্গের৷ যোধ সিংহের সে নিয়ম এখনও চালু৷ এ রহস্য উদ্ধারের জন্যই ডেকে এনেছি তোমাকে৷’

মুঞ্জর মুখে আশ্চর্য গল্পটা শুনে সমুদ্র তাকিয়ে রইল জানলার বাইরে দুর্গশীর্ষের বুরুজটার দিকে৷ সত্যি কি ওই বুরুজে কোনও পিশাচের বাস? এও কি কখনও সম্ভব? মনে মনে ভাবতে লাগল সমুদ্র৷

(৩)

বিকাল নাগাদ দু-জন লোক ডাকতে এল সমুদ্রদের৷ তাদের একজনের হাতে দড়ি বাঁধা একটা ছাগল৷ ট্রেনে মালপত্র বাঁধার জন্য সমুদ্ররা যে লোহার চেন আর তালা সঙ্গে এনেছিল, সেগুলো আর ক্যামেরা নিয়ে লোকগুলোর সঙ্গে তারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল৷ খণ্ডহর দুর্গ৷ কোথাও প্রাকার ভেঙে পড়েছে, কোথাও কোনও দেউলের ছাদ ধসে গেছে, সার সার অন্ধকার ঘরগুলোর মধ্যে কত যুগের কত স্মৃতি জমে আছে কে জানে! দুর্গপ্রাকারের গা দিয়ে ওপরে ওঠার যে পায়ে চলার পথ আছে, যা বেয়ে একসময় সেনারা টহল দিত, সে পথ বেয়েই লোক দুটোর পিছু পিছু ওপরে যেতে লাগল তারা৷ যত তারা ওপরে উঠতে লাগল তত ওপর থেকে স্পষ্ট হতে লাগল দুর্গের ভিতরের সবকিছু—ভগ্ন প্রাসাদ, জীর্ণ দেউল, হাতিশাল ইত্যাদি৷ সেনাদের কুচকাওয়াজ করার জন্য দুটো পাথুরে চত্বরও তাদেরকে দেখাল সঙ্গের লোকগুলো৷ সমুদ্র চলতে চলতে মাঝে মাঝে ছবি তুলছে চারপাশের৷ সোমনাথ এক সময় মুঞ্জকে বলল, ‘আচ্ছা ধরো, তুমি ওই বুরুজ ঘরে রাত কাটিয়ে এই দুর্গের মালিক হলে৷ তখন কি করবে এই দুর্গ নিয়ে? এ দুর্গ আর কেউ কিনতে আসবে না৷’

মুঞ্জ হেসে বলল, ‘এ দুর্গ কেউ কিনতে আসবে না ঠিকই, কিন্তু বড় বড় পাঁচতারা হোটেল ব্যবসায়ীরা রাজস্থানের প্রাচীন প্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি লিজে নিয়ে সেখানে হোটেল খুলছে ট্যুরিস্টদের এসব ঐতিহাসিক জায়গাতে রাত্রিবাসের স্বাদ দেবার জন্য৷ তেমন এক হোটেল ব্যবসায়ীর সঙ্গে এ দুর্গ নিয়ে কথাও হয়েছে৷ তারা ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহী৷ আমি ভাড়ার টাকা যা পাব তাতেই বড়লোক হয়ে যাব৷ তাছাড়া এ দুর্গের বাসিন্দা তাদেরও কর দিতে হবে আমাকে৷’

আস্তে আস্তে দুর্গশীর্ষে উঠে এল সমুদ্ররা৷ একটা জঙ্গলাকীর্ণ সমতল জায়গা৷ ঠিক তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন বুরুজ বা নজর মিনারটা৷ পিশাচ বুরুজ! বেশ বড় একটা কাঠের দরজা তার গায়ে৷ দরজাটা বাইরে থেকে লোহার খিল দিয়ে বন্ধ করা৷

সমুদ্র জানতে চাইল, ‘বুরুজের মাথাটায় ওঠা যায়?’

স্থানীয় লোকজনের একজন জানাল, ‘না, যায় না৷ ওপরে ওঠার সিঁড়িগুলো ধসে গেছে বহুকাল আগেই৷’

জঙ্গল ভেঙে বুরুজের নীচে এসে দাঁড়াল তারা৷ বুরুজটা উচ্চতায় পঞ্চাশ ফুট হবে৷ নীচে একটা ঘর৷ তার দরজা বন্ধ৷ স্থানীয় লোক বলল, ‘বছরে একবার এ ঘর খোলা হয়৷ ছাগ রাখা হয় ঘরের মধ্যে পিশাচকে খাবার দিয়ে সন্তুষ্ট রাখার জন্য৷ পরদিন ফিরে এসে কঙ্কাল নিয়ে যাই৷’

দীর্ঘদিন বুরুজের দরজাটা বন্ধ থাকায় বেশ একটু কসরত করতে হল ভারী দরজাটা খোলার জন্য৷ দরজা খুলতেই বাইরের সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরের ভিতর৷ লোক দুজন বলল, ‘আমরা কিন্তু ঘরের ভিতর ঢুকব না৷’

কাজেই সমুদ্ররা তিনজন ঢুকল ঘরের ভিতর৷ প্রমাণ আকারের একটা প্রাচীন পাথুরে ঘর৷ অন্য কোনও জানলা-দরজা নেই ঘরে৷ বয়সের ভারে দেওয়ালগুলোতে ফাটল ধরেছে, অসংখ্য ছিদ্র জন্মেছে মেঝেতে বসানো পাথরের ব্লকগুলোতে৷ বুরুজ ঘরের একপাশ থেকে ওপরে ওঠার যে সিঁড়ি ছিল তা খসে পড়েছে৷ তবে দরজাটা বন্ধ করে দিলে বাইরে থেকে কারো ভিতরে আসার পথ বন্ধ, এক যদি না সে মাথার উপর থেকে কোনও উপায়ে নীচে ঘরের ভিতর নেমে আসে৷ কিন্তু তাহলে তাকে বুরুজের গা বেয়ে বুরুজের মাথার অলিন্দে উঠতে হবে৷ যা প্রায় অসম্ভব৷ ভালো করে ঘরটা পরীক্ষা করার পর ঘরটার চারপাশের দেওয়াল, মাথার গহ্বর, মেঝের ছবি নিতে শুরু করল সমুদ্র৷ একসময় বাইরের লোকগুলো তাড়া দিল— ‘একটু পরেই সূর্য ডুববে৷ বাইরে আসুন৷’

সমুদ্ররা বুঝতে পারল লোকগুলো বেশিক্ষণ এখানে থাকতে চাইছে না৷ বাইরে বেরিয়ে এল তারা৷ লোক দুজন এরপর সঙ্গের ছাগলটাকে টেনে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজার বাইরে খিল দিল৷ আর সমুদ্ররা দরজার কড়ায় তাদের তালা-শিকল আটকাল৷ তারপর সদলবলে নীচে নামতে শুরু করল৷ ততক্ষণে সূর্যদেবও মুখ লুকাতে শুরু করল৷

দুর্গে এখনও বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই৷ সমুদ্ররা ঘরে আসার পর একজন লোক এসে একটা বড় কেরোসিন বাতি আর রাতের খাবার দিয়ে গেল৷ খাওয়া শেষ হবার পর মুঞ্জ বলল, ‘ঘরটা দেখে তোমরা কিছু বুঝতে পারলে?’

সমুদ্র বলল, ‘আপাতদৃষ্টিতে তো বাইরে থেকে কেউ ও ঘরে প্রবেশ করতে পারে বলে মনে হয় না৷ আবার পিশাচের ব্যাপারও এই একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বাসযোগ্য নয়৷’

সোমনাথ বলল, ‘এমনও হতে পারে যে এই দুর্গের লোকেরাই কোনো ভাবে হত্যা করে রাজবংশের উত্তরাধিকারীদের, যাতে তারা বংশানুক্রমে ভোগদখল করতে পারে এ জায়গা৷’

সমুদ্র বলল, ‘আমি কোনও সম্ভাবনার কথাই উড়িয়ে দিচ্ছি না৷ আপাতত আমি ক্যামেরাতে ঘরের ভিতরের যে ছবিগুলো তুলে এনেছি সেগুলো ল্যাপটপে নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি৷’

এরপর বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে সেই কাজ করল৷ তারপর একসময় সকলে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল৷ সমুদ্র কান পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগল বুরুজ থেকে ছাগলটার আর্তনাদ ভেসে আসে কিনা…….

(৪)

ভোরবেলা সমুদ্রদের ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল লোক তাদের ডাকতে এল৷ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে তারা রওনা হয়ে গেল পিশাচ বুরুজের দিকে ওঠার জন্য৷ গতদিনের মতোই দুর্গপ্রাকার সংলগ্ন পথ বেয়ে ওপরে উঠে এল তারা৷ দিনের প্রথম আলো এসে পড়েছে বুরুজের মাথায়৷ বুরুজ ঘরের দরজাটা আগের মতোই বন্ধ৷ সোমনাথ প্রথমে চাবি দিয়ে শিকল-তালাটা খুলল৷ লোহার ভারী খিলটা সরিয়ে কপাটটাও খুলে ফেলা হল৷ আলো ছড়িয়ে পড়ল ঘরটাতে৷ ঘরের ভিতর পা রেখেই সমুদ্ররা চমকে উঠল৷ ঘরের মাঝখানে পড়ে আছে ছাগলের কঙ্কালটা৷ এক টুকরো মাংস-চামড়া লেগে নেই তার গায়ে৷ ফ্যাটফেটে সাদা একটা কঙ্কাল৷ মুঞ্জর মুখটা বিবর্ণ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে৷ তবে কি পিশাচের গল্পটাই ঠিক? সমুদ্র গম্ভীর মুখে কঙ্কালটা পর্যবেক্ষণ করল কিছুক্ষণ ধরে৷ ক্যামেরা দিয়ে বেশ কয়েকটা ছবিও তুলল কঙ্কালটার৷ দরজার লোহার খিল দিয়ে দেওয়াল-মেঝেতে ঠুকে ঠুকে দেখার চেষ্টা করল কোথাও কোনও ফাঁপা জায়গা বা গুপ্ত গহ্বর আছে কিনা যা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা যায়৷ কিন্তু তেমন কিছুই মিলল না৷ এরপর স্থানীয় লোকগুলো একসঙ্গে ঘরে ঢুকে ছাগলের কঙ্কালটা বার করে আনল৷ সমুদ্ররা বেরিয়ে এল ঘর থেকে৷ তারপর কঙ্কালটা নিয়ে নীচে নামা শুরু করল৷

নীচের চত্বরেই তাদের জন্য তলোয়ারে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ সর্দার৷ তাঁর কাছে যেন প্রত্যাশিতই ছিল ব্যাপারটা৷ কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে তিনি মুঞ্জকে বললেন, ‘নিজের চোখেই তো আপনারা দেখলেন ব্যাপারটা৷ যুগ যুগ ধরে ওই বুরুজের পিশাচ আগলে রেখেছে এই দুর্গকে৷ উপযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া কাউকে সে এই দুর্গের মালিকানা তুলে দেবে না৷ বিকাল পর্যন্ত সময় আছে৷ ভেবে দেখুন আপনি পিশাচ ঘরে রাত কাটাবেন কিনা৷ দরজা কিন্তু বাইরে থেকে বন্ধ থাকবে৷’

মুঞ্জ একবার সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে দেখা যাবে৷’

সে কথাটা বললেও তার গলার স্বর শুনে সমুদ্র আর সোমনাথ দুজনেই বুঝতে পারল যে ছাগলের কঙ্কালটা দেখবার পর সে যেন কিছুটা হলেও ধন্দে আছে৷ লোকগুলো এবার কঙ্কালটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিল চত্বরের একপাশে একটা আবর্জনার স্তূপে৷ আর সমুদ্রদের নিয়ে মুঞ্জ এগোল তাদের ঘরের দিকে৷

ঘরে ঢুকে মুঞ্জ বলল, ‘তোমাদের এবার একটা সত্যি কথা বলি৷ কঙ্কালটা দেখার পর থেকে আমার মনেও যেন এবার একটা ভয় জন্মাতে শুরু করেছে৷ তোমরা কি কিছু বুঝতে পারলে? আমার কী করা উচিত?’

সমুদ্র রুমাল দিয়ে চশমার কাচটা মুছে নিয়ে বলল, ‘না, এখনও কিছু বুঝতে পারিনি৷ তবে সত্যি যদি তোমাকে ওই বুরুজে রাত কাটাতে হয় তবে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে নেবার চেষ্টা করো৷ শত্রু এলে যাতে তুমি তলোয়ার হাতে অন্তত প্রতিরোধ করতে পারো৷’—এ কথাগুলো বলে ক্যামেরা আর ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ল সমুদ্র৷ ছবিগুলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে ফেলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল৷ সময় এগিয়ে চলল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেল একসময়৷ জানলার বাইরের চত্বরে পিশাচ বুরুজের যে ছায়া পড়ে সেটা ক্রমশ দীর্ঘ হতে লাগল৷

বেলা তিনটে নাগাদ মুঞ্জ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে৷ সোমনাথ জানলা দিয়ে বুরুজটার দিকে তাকিয়ে ছিল আর সমুদ্র কাজ করছিল তার ল্যাপটপ নিয়ে৷ হঠাৎ সমুদ্র বলল, ‘চলো তো একবার বাইরে থেকে ঘুরে আসি৷’

ঘুমন্ত মুঞ্জকে ঘরে রেখেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোল তারা৷ সোমনাথকে নিয়ে প্রথমে হাজির হল আস্তাকুঁড়েতে যেখানে ছাগলের কঙ্কালটা ফেলা হয়েছে৷ কঙ্কালটা দেখার পর সমুদ্র পকেট থেকে রুমাল বার করে সোমনাথকে কয়েক-পা পিছনে ফেলে এগিয়ে গিয়ে কঙ্কালটার গা থেকে কী যেন একটা নিয়ে রুমালের ভাঁজে রেখে রুমালটা পকেটে পুরল৷ তারপর এগোল সেই বৃদ্ধ সর্দারের খোঁজে৷ লোকজনকে জিগ্যেস করতেই সন্ধান মিলে গেল তার৷

বৃদ্ধ তাদের দেখে একটু ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ‘আপনাদের বন্ধু মত পরিবর্তন করেছেন সে খবর জানাতে এলেন?’

সমুদ্র জবাব দিল, ‘সে খবর নয়, কয়েকটা অন্য খবর জানতে চাই আপনার থেকে৷ আচ্ছা ওই বুরুজ ঘরে কোনও চিৎকার হলে তা দুর্গের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে তাই না? ওখান থেকেই তো একসময় হাঁক দিয়ে দুর্গবাসীকে সতর্ক করত প্রহরীরা?’

বৃদ্ধ জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ৷ বিশেষত নিঝুম রাতে ওখানে সামান্য শব্দ হলেও নীচ থেকে শোনা যায়৷ বুরুজগুলো ওভাবেই নির্মাণ করা হত৷’

সমুদ্র এবার প্রশ্ন করল, ‘আপনি তো ও ঘরে বেশ কয়েকজনকে রাত্রিবাস করে পিশাচের খাদ্য হতে দেখেছেন৷ সে সব রাতে সেই লোকগুলোর কোনও মৃত্যু আর্তনাদ নীচে ভেসে এসেছিল কি? আশা করি আপনি ভেবেচিন্তে জবাব দেবেন৷’

বৃদ্ধ একটু চুপ করে থেকে জবাব দিলেন, ‘না, শুনিনি৷ কারণ সম্ভবত অন্ধকারে পিশাচ এসে প্রথমেই লোকটার ঘাড় মটকে দেয়৷’

বৃদ্ধের কথা শুনে হাসি ফুটে উঠল সমুদ্রের ঠোটের কোণে৷ সে বলল, ‘আপনার লোকজনকে তৈরি হতে বলুন৷ আমার বন্ধু রাত কাটাবে ওখানে৷’

সমুদ্ররা যখন ঘরে ফিরল তখন মুঞ্জ ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে৷ সমুদ্র তার উদ্দেশে বলল, ‘তৈরি হয়ে নাও৷ তোমাকে ও ঘরে রাত কাটাতে হবে৷ শুধু যা যা বলব তা মেনে চললেই ও ঘর থেকে কাল বেরিয়ে আসতে পারবে তুমি৷’

সমুদ্রের কথা শুনে উজ্জ্বল হয়ে উঠল মুঞ্জর মুখ৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই সে তার সুটকেস খুলে তার রাজপোশাক পরতে শুরু করল৷ আর সমুদ্র তেলের বড় বাতিটা নিয়ে তার থেকে একটা বোতলে তেল ঢালতে শুরু করল৷

পোশাক পরে কোমরে তলোয়ার গুঁজল মুঞ্জ৷ তাকে সত্যি এবার প্রাচীন রাজপুতদের মতো দেখাচ্ছে৷ ঘর ছেড়ে বেরোবার আগে তেলের বোতল মুঞ্জর হাতে দিয়ে সমুদ্র বলল, ‘এটা সঙ্গে নাও৷’

মুঞ্জ বলল, ‘কী হবে তেল দিয়ে?’

সমুদ্র হেসে বলল, ‘তুমি হয়তো শুনেছ যে বাংলাদেশে ওঝারা ভূত তাড়াবার তেল দিত৷ সে তেল গায়ে মাখলে নাকি ভূতে ধরত না৷ এটা তেমনই পিশাচ তাড়াবার তেল৷ ও ঘরের দরজা বন্ধ হবার পরই এ তেল মাথায়, গায়ে ঢেলে নেবে৷ আর সারারাত ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করবে৷ কোথাও বসবে বা দাঁড়াবে না৷ এ দুটো কাজ করতে পারলেই কাল এ দুর্গ তোমার৷ আর না করলে কঙ্কাল হয়ে বেরিয়ে আসতে হবে৷’

মুঞ্জ বলল, ‘আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলব তোমার কথা৷’

ঘর ছেড়ে বাইরে চত্বরে বেরিয়ে এল সকলে৷ কেল্লার বেশ কিছু লোক প্রস্তুত হয়েই ছিল৷ তাদের সঙ্গে সমুদ্ররা রওনা হল ওপর দিকে৷ একসময় ওপরে উঠে পিশাচ বুরুজের দরজায় পৌঁছে গেল সবাই৷ সূর্য ডোবার কিছু আগে মুঞ্জ প্রবেশ করল বুরুজ ঘরে৷ দরজা বন্ধ হবার আগে সমুদ্র শুধু বলল, ‘আমার কথাগুলো মনে রেখ৷’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘নিশ্চয়ই৷ কাল ভোরে দেখা হবে৷’

দরজা বন্ধ হয়ে গেল৷ বাইরে থেকে খিল পড়ল দরজায়৷ মুঞ্জকে পিশাচ বুরুজে একলা ফেলে রেখে নীচে নামতে শুরু করল সবাই৷ সমুদ্ররা ঘরে ফিরে আসতেই অন্ধকার নামল দুর্গে৷ ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল পিশাচ বুরুজ৷ রাত নামল৷ অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকার রাত৷ অন্ধকার সেই রাতে জানলা দিয়ে মাথার উপর দুর্গের বুরুজটা কোথায় অনুমান করে সমুদ্র সেদিকে তাকিয়ে রইল, সেদিক থেকে কোনও আর্তনাদ ভেসে আসে কিনা তা শোনার জন্য৷ এভাবেই রাত কেটে গেল৷ একসময় শুকতারা ফুটে উঠল আকাশে৷

(৫)

ভোরের আলো একটু ফুটতেই চত্বরের বাইরে বেরিয়ে এল সমুদ্ররা৷ কেল্লাবাসীরাও কয়েকজন তখন বেরিয়ে এসেছে যারা গত বিকালে ওপরে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল৷ তাদের সকলের চোখেমুখেই স্পষ্ট উত্তেজনার ছাপ৷ উত্তেজনা সমুদ্র আর সোমনাথের মুখেও৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই চত্বর ছেড়ে ওপরে উঠতে শুরু করল সকলে৷ যথাসম্ভব দ্রুত কিন্তু নিশ্চুপ ভাবে৷

সমুদ্ররা যখন পিশাচ বুরুজের সামনে এসে দাঁড়াল তখন ভোরের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে বুরুজে৷ দরজার খিলটা বাইরে থেকে একইভাবে বন্ধ৷ সমুদ্র ইশারা করতেই সোমনাথ একটু কাঁপা কাঁপা হাতে দরজার খিলটা খুলল৷ আর তারপরই দরজা ঠেলে বেরিয়ে এল মুঞ্জ৷ রাজা মুঞ্জ!

তাকে দেখে প্রথমে কয়েক পা পিছিয়ে গেল সঙ্গের লোকগুলো৷ তারা ঠিক দেখছে তো? এ কি মুঞ্জ, নাকি তার প্রেত রূপ! এর আগে তারা কোনও মানুষকে জ্যান্ত বেরিয়ে আসতে দেখেনি এই পিশাচ ঘর থেকে! তবে সে রক্তমাংসের মুঞ্জই, কঙ্কাল নয়৷ ভোরের সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়েছে তার গায়ে৷ রাত্রি জাগরণের ফলে তাকে একটু ক্লান্ত দেখালেও এমনিতে সে ঠিকই আছে৷ বাইরের সূর্যালোকে কয়েক মুহূর্ত ধাতস্থ হবার পর সে জড়িয়ে ধরল সমুদ্র আর সোমনাথকে৷ সঙ্গী লোকগুলো তা দেখে বুঝতে পারল যে মুঞ্জ কোনও অশরীরী নয়৷ মাথা ঝুঁকিয়ে তারা এবার তার উদ্দেশে জয়ধ্বনি করে উঠল, ‘জয় দুর্গাধীপ মুঞ্জ রাওয়ের জয়! রাজা মুঞ্জের জয়!’

মুঞ্জ এখন রাজা৷ তাই সে এবার গম্ভীর ভাবে নির্দেশ দিল, ‘তোমরা নীচে গিয়ে সর্দার আর দুর্গের লোকজনদের খবরটা দাও৷ আমার অভিষেকের প্রস্তুতি শুরু কর৷’

তার নির্দেশ পালন করতে তৎক্ষণাৎ নীচের দিকে ছুটল লোকগুলো৷

তারা চলে যাবার পর সমুদ্র হেসে মুঞ্জকে প্রশ্ন করল, ‘রাত কেমন কাটালে?’

মুঞ্জ জবাব দিল, ‘গায়ে কেরোসিন তেল ঢালায় গা কুটকুট করছিল ঠিকই, আর একদণ্ড না বসায় পা ব্যথা আর ক্লান্তি ছাড়া অন্য কোনও সমস্যা হয়নি৷ কোনও পিশাচেরও দেখা পাইনি৷ কেন যে ওই ঘর থেকে কেউ ফেরেনি তা বুঝতে পারছি না!’

সমুদ্র বলল, ‘ফেরেনি কারণ ও ঘরে সত্যিই মাংসাশী পিশাচের আনাগোনা আছে৷’

এই অদ্ভুত কথা শুনে মুঞ্জ আর সোমনাথ একসঙ্গে বলে উঠল, ‘তার মানে?’

সমুদ্র তার পকেট থেকে রুমালটা বার করে তার ভাঁজ খুলল৷ সাদা রুমালটার ভাঁজে আটকে রয়েছে ডেঁও পিঁপড়ের মতো একটা মৃত পিঁপড়ে৷ তার মাথার অংশটা আগুনের মতো লাল, উদরের অংশটা কালো৷ সেটা দেখিয়ে সমুদ্র বলল, ‘এরাই হল এই পিশাচ বুরুজের পিশাচ৷ ঘরের নীচে বাসা আছে ওদের৷’

মুঞ্জ বলল, ‘তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না৷ খোলসা করে বলো৷’

সমুদ্র এবার বক্তৃতার ঢঙে বলল, ‘এই রুমালের মধ্যে যাকে দেখতে পাচ্ছ, এই পিঁপড়ের নাম ‘ফায়ার অ্যান্ট’৷ আমেরিকা ও এশিয়ার মরু অঞ্চলে দেখা যায়৷ বিভিন্ন প্রজাতি আছে এদের৷ এরা মাংসাশী ও আক্রমণাত্মক৷ শিকারের খোঁজ পেলে তারা ঝাঁকে ঝাঁকে তাকে আক্রমণ করে৷ এদের মধ্যে কয়েকটা প্রজাতির শিকার ধরার কৌশল খুব অদ্ভুত৷ প্রথমে তারা যখন কামড়ায় তখন কোনও ব্যথা টের পাওয়া যায় না৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সে জায়গা অবশ হয়ে আসে৷ এই পিঁপড়ের সংঘবদ্ধ কামড়ের ফলে একসময় অবসন্ন হয়ে পড়ে শরীর৷ তারপর নিজের অজান্তেই মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ে শিকার৷ তারপর লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ে কুরে কুরে তার মাংস খায়৷ এভাবে একরাতের মধ্যে তারা একটা বিরাট উটকেও সাবাড় করে দেয়৷ পড়ে থাকে শুধু তার কঙ্কালটা৷ রুমালের মধ্যে যাকে দেখছ সে তাদেরই কোনও প্রজাতি৷ তোমার গায়ে কেরোসিন তেল মাখা না থাকলে আর হেঁটে-চলে না বেড়ালে তোমাকেও কঙ্কাল বানিয়ে দিত এরা৷ তুমি বুঝতেই পারতে না যে কখন মৃত্যু হল তোমার৷ যে কারণে কোনওদিন মৃত মানুষদের আর্তনাদ শোনা যেত না এ ঘর থেকে৷ সামন্তরাজ যোধ সিংহ ব্যাপারটা জানতেন, তাই তিনি বিকারাজের সেনাপতিদের ও ঘরে রাত কাটাতে বলতেন৷ আর তাঁর উত্তরপুরুষরাও বংশানুক্রমে ব্যাপারটা জানতেন৷ তাঁরাও কোনও তেল বা রাসায়নিক মেখে ঘরে ঢুকতেন যাতে তাঁদের পিঁপড়ে বাহিনী আক্রমণ করতে না পারে৷’

সমুদ্রর কথা শুনে সোমনাথ অবাক হয়ে বলল, ‘তুমি কী করে ধরলে ব্যাপারটা?’

সমুদ্র বলল, ‘প্রথমে আমার মাথাতেও কিছু আসছিল না৷ নিরেট ঘর, কোথাও দিয়ে কারও ভিতরে ঢোকার উপায় নেই৷ আবার পিশাচের ব্যাপারটাও কোনও ভাবেই বিশ্বাস করা সম্ভব নয়৷ তবে? ক্যামেরায় তোলা ছাগলের কঙ্কালের ছবিগুলো ল্যাপটপের পর্দায় বড় করে দেখতে দেখতে হঠাৎই চোখে ধরা পড়ে গেল কঙ্কালটার গায়ে তখনও আটকে থাকা কয়েকটা পিঁপড়ের ছবি৷ আপাতদৃষ্টিতে সামান্য ব্যাপার৷ কঙ্কালের গায়ে পিঁপড়ে থাকতেই পারে৷ কিন্তু তখনই হঠাৎ মনে পড়ে গেল কোথায় যেন পড়েছিলাম রাক্ষুসে পিঁপড়েদের কথা যারা চেঁচেপুঁছে পশুদের মাংস খেয়ে কঙ্কালটা শুধু ফেলে রাখে৷ ব্যস ইন্টারনেট খুলে বসলাম আমি৷ কিছুক্ষণের মধ্যে বেরিয়ে এল সব তথ্য৷ আর ইন্টারনেটে দেওয়া ফায়ার অ্যান্টের সঙ্গে মিলেও গেল ছাগলের গায়ে লেগে থাকা পিঁপড়েদের ছবি৷ হ্যাঁ, পিঁপড়েরাই একমাত্র এমন ভাবে কুরে কুরে মাংস খেতে পারে৷ এরপর এই ঘরের মেঝের ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম যে মেঝেতে যে ছিদ্র বা ফাটলগুলো আছে তা সব বয়েসের ভারে হয়নি৷ কিছু ছিদ্র মানুষের হাতেরও তৈরি৷ সামন্তরাজ যোধরাও ও ঘরে একটা ফাঁদ বানিয়ে রেখেছিলেন৷ তবুও শেষ সন্দেহ নিরসনের জন্য বৃদ্ধ সর্দারের কাছে জেনে নিলাম যে ওই ঘর থেকে কোনও শেষ আর্তনাদ শোনা যায় কিনা৷ তিনি যখন ‘না’ বললেন তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম আরও৷ কারণ ততক্ষণে আমি ফায়ার অ্যান্টের নিধন পদ্ধতি জেনে গেছি৷ ইতিপূর্বে এ ঘরে যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা নিশ্চয় শুয়ে বসে রাত কাটাত৷ তারপর মৃত্যু নিঃশব্দে হানা দিত তাদের ওপর৷’

সমুদ্রর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বাজতে শুরু করল নীচের চত্বরে৷ খবর পৌঁছে গেল নীচে৷ মুঞ্জর অভিষেকের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে৷ সমুদ্র এবার নীচে নামার পথ ধরে মুঞ্জর উদ্দেশে বলল, ‘এবার থেকে তোমাকে কী বলে সম্বোধন করব? ইয়োর এক্সিলেন্সি? রাজা মুঞ্জ?’

কথাটা শুনে রাজা মুঞ্জ ঈষৎ লজ্জা পেয়ে সমুদ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘না, আমি তোমাদের কাছে কলকাতার মেসবাড়ির মুঞ্জই৷ মেসবাড়ির ভাড়ার টাকাটা তিনমাস বাকি পড়েছিল৷ এবার গিয়ে মিটিয়ে দেব৷ আমি এখন পিশাচগড় বা নিধনগড়ের রাজা৷ তবে এ নাম দুটো আমার পছন্দ নয়৷ ভাবছি এ কেল্লার নতুন নাম দেব— ‘সমুদ্রগড়’৷’

রাজা মুঞ্জর কথা শুনে হেসে উঠল সমুদ্র আর সোমনাথ৷ আর সেই শব্দে একঝাঁক পায়রা ডানা ঝাপটে উড়ে গেল সূর্যালোকে উজ্জ্বল বুরুজটার দিকে৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *