পারিবারিক : স্ত্রী – ৩

রায়বর্মার কাছে ও সকালে গেল?

তনিমার চলে আসা পর্ব মিটলে পরে। রথীনের বউদি বললেন, কষ্ট হবে, নীপাদের ঘরে থাকবে। তবে নিচের ঘরে রথীন, মধু, তপু তো থাকে।

—অনেক নিরাপদ।

—এ পাড়াতেই ওরা আছে বলে…

ওদের অত্যন্ত বিস্মিত করে বিকেলে মেজশরিকের উৎসাহী কর্মী ও ট্রেনিং কলেজের শিক্ষিকা দীপালি আর আদি মহিলা সেবাসমাজের ভারতী আসেন। দুজনেই প্রৌঢ়, দুজনেই অবিবাহিত, শহরে ওদের যথেষ্ট সুনাম আছে।

—রথীন কোথায়, রথীন?

—বেরিয়েছে।

—কখন ফিরবে?

—এখনি। আবার বেরোবে।

রথীনের সঙ্গে দেখা করব।

—বসুন। চা খাবেন?

ভারতী বলেন, না। চা আমিও খাব না, তুমিও খাবে না, লোকজনকেও দেবে না। চা পান মানে বিষ পান। এখন চায়ে চামড়ার কুচি থাকছে।

—কি খাবেন?

—জল। বিশুদ্ধ পানীয় জল।

—কোত্থেকে আসছেন?

—কত জায়গা ঘুরে।

রথীন এসে যায়। যে সব কথাবার্তা হয়, তনিমা খুবই অবাক। তাকে নিয়ে অত কথা হচ্ছে? রথীন কত কি করেছে?

দীপালি আর ভারতী কথা বলতে থাকে।

—তনিমার সমস্যাটা আমরা সমাধান করতে পারি নি।

—রথীন যা করল…

—এখন আমরা লড়ে যাব।

—লড়ে যাবেন দীপালিদি?

—হ্যাঁ রথীন। এতদিন তনিমা ওখানে, পারিনি। এবার বাচ্চু আর তার মস্তানদের নামে লিখে স্বাক্ষর সংগ্রহ করব। ম্যাজিস্ট্রেট, এস.পি. কলকাতায় মন্ত্রীদের দেব।

—সবাই সই করবে না।

—পলটু করবে না, রায়বর্মাদা সই করবে। আমি, নেপুদা, ডাক্তারদের মধ্যে অধীপ, বিমলেন্দু, উকিলদের মধ্যে তো অনেককেই পাব। মহিলা সংগঠনগুলি…

—পলটুদাদের কোনো সংগঠন করবে না।

—সে তো ভালই! পরিষ্কার বোঝা যাবে, টাউনের লোক বুঝবে কারা বাচ্চুর কাজে মদত দিচ্ছে।

—তা হবে।

—তোমরা, রায়বর্মাদা, তোমরাও চিহ্নিত হয়ে যাবে। কিন্তু একাজ করলে পলটুর দলের ইমেজটা কেমন দাঁড়াবে? সমাজবিরোধীকে কোনো ব্যক্তি মদত দিতেই পারে। কিন্তু গোটা দলটাকে জড়ানো…

তনিমা ক্ষীণস্বরে বলে, কেন? এত সব?

—তুমি যে এ বাড়িতে এসেছ, এ খবর তো শহরে রটে গেছে। কেন এসেছ, তাও সবাই বুঝছে। তুমি বাইরের মেয়ে। তুমি বাইরের মেয়ে শহরে কাজ করতে এলে বিপন্ন হবে কেন? নাগরিকদের কোনো কর্তব্য নেই? সেজন্যেই…

—রথীন! রায়বর্মাদা কি বললেন?

—আপনারা যা বলছেন।

—জয়াদি?

—বউদি আমার হাতটা চেপে ধরলেন। বললেন, রথীন! তোমার ঋণ আমি জীবনে ভুলব না।

—জয়াদির জন্যে কষ্ট হয়।

—উনি সই দেবেন।

—দেবে?

—হ্যাঁ, দেবেন।

—কি ভাবছ হঠাৎ?

—একটু অবাকই হলাম।

—কেন?

—বউদি সই দিলে পলটুদা কি বলবে তা জানি না। তবে তনিমাকে আমাদের বাড়িতে এনেছি শুনে পলটুদা যেন স্বস্তি পেল। বলল, খুব ভালো করেছ রথীন। তোমার বউদি ওর জন্যে খুব চিন্তিত ছিল…আমিও…।

—খুবই আশ্চর্য কথা।

—যেন মুখোশ খুলে আগেকার পলটুদা কয়েক মিনিটের জন্যে…বলল, ভুল বোঝাবুঝি তো হতেই পারে রথীন। তা বলে আমাকে একেবারে ত্যাগ করলে!

—তুমি কি বললে?

—বললাম, ভুল তো আপনিই বুঝলেন পলটুদা। আমরা কবে অন্যরকম ছিলাম বলুন?

দীপালি মাথা নাড়ে বার বার। বলে, বাম রাজনীতিটা একেবারে দেউলে করে দিলাম সকলে মিলে…নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস…সন্দেহ…

—বেনোজল ঢুকে গেল।

—বাঁধ ভাঙছে তা আমরা দেখেও দেখিনি রথীন। কেউই দেখিনি। বেনোজল যদি ঢুকে থাকে, সেও আমরাই ঢুকিয়েছি।

—ওই বাচ্চু আর লাডিয়া…

—ওরাই যদি এখানকার রাজনীতিতে প্রয়োজনীয় হয় তাহলে ওরা গেলে আরেক বাচ্চু, আরেক লাডিয়াকে সময়ই তৈরি করে নেবে।

—হ্যাঁ, তাও সত্যি। তবু দুঃখ হয়।

—দুঃখ কোরনা, —দীপালি সান্ত্বনা দেয়, অন্ধকারের পর আলো আসেই। প্রকৃতির নিয়ম।

—প্রকৃতির নিয়মে বর্তমান অবস্থার কোন সমাধান হবে না দীপালিদি। এ শহর এখন সমগ্র রাজ্যের দর্পণ। এ শহরের সামাজিক রাজনীতিক অবস্থা যা, সমগ্র রাজ্যে তাই।

—আশা হারিও না।

রথীন তনিমাকে রায়বর্মার বাড়িতেও নিয়ে যায়। সে এখন এতবড় একটা আলোচনার বস্তু হয়েছে, তাতে তনিমার বড় সংকোচ।

—এস মা, বোস।

”মা” শুনে তনিমা হঠাৎ অভিভূত হয়। ওর চোখে জল আসে। বাবার মৃত্যুর পর ওকে ”মা” কেউ বলে নি।

বাবা বলতেন, তোকে নিয়েই আমার ভাবনা মা! তুই এত নরম!

মা ওকে ”মা” বলেন না।

মার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা খুব অদ্ভুত। সুবীরকে বিয়ে করবে শুনে মা খুশি হননি।

—মা ভাইকে ভাসিয়ে দিবি?

—না মা, ভাই আগে দাঁড়াক।

—দেখিস! এ টুকু দয়া করিস।

—দয়া কেন বলছ মা? কর্তব্য…

—তোর বড়দির ছিল কর্তব্যজ্ঞান। বিয়ে করেনি, নিজের কথাও ভাবে নি…

—মা! বড়দি যদি বেঁচে থাকত তাহলে একদিন তো সেও দেখত যে ভাই সংসারী হল, তুমিও থাকলে না, তার জীবনটা শূন্য হয়ে যেত না?

—সে অন্য আদর্শ বুঝত।

বড়দিই তনিমাকে বলত, আমার মতো ভুল করিস না তনিমা। বিয়ে করিস। নইলে বড় শূন্য লাগবে।

সে কথা তনিমার মাকে বলে নি। মেয়ের রোজগারের ওপর যখন নির্ভর করতে হয়, তখন মেয়ের বিষয়ে মা স্বার্থপর হবেই। এটাই হয়তো নিয়ম।

এইতো দীপালিদি! দেখতেও সুন্দর ছিল, মানুষটাও কত ভালো।

—কেন বিয়ে করেন নি দীপালিদি?

—ভাইবোনদের মানুষ করতে করতে, ওদের বিয়ে দিতে দিতে, আমার আর হল না।

—দুঃখ হয়?

—না না। ভাবিই না।

রায়বর্মা বলেন, রথীন আমাদের মুখ রেখেছে মা। যেদিন থেকে শুনেছি…

—আমাকে বাঁচিয়েছেন।

—আমার কাছে দীনু থাকলে…

—দীনুদা তো আসবেন।

—ক’দিন বাদে। যাক! প্রমাণ হল যে এ শহরে এখনো মানুষ আছে, সাহস আছে। থাক, তবুও সাবধানে চলাফেরা কোর।

—হ্যাঁ, নিশ্চয়।

—এই যে তনিমা।

—জয়াদি!

—রায়বর্মাদার জন্যে একটু…

—কি, আমলকীর মোরববা?

—ভালো হয় নি।

—ওই আমার খুব ভালো।

—তনিমা, আমি যে কি নিশ্চিন্ত হয়েছি…

রথীন বলে, পলটুদাও।

জয়া তির্যক হাসে। বলে, পলটুদার ব্যাপারটা আলাদা। আমার কথায় ও বাচ্চুকে ডেকেছিল।

—ডেকেছিলেন?

—হ্যাঁ। মিনমিনে গলায় বলেও ছিল। বাচ্চু ওকেই দাবড়ে দিয়ে বেরিয়ে যায়।

—তারপর?

—আমি ওকে যা নয় তাই বললাম।

—উনি কিন্তু খুশিই হয়েছেন।

—ও একটু ভাল করে কথা বলল, তাতেই গলে গেলে? সত্যি! নেতারা তোমাদের ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ে। ওকে তুমি চেন না, আমি চিনি।

—বেশ তো বউমা। তুমিই বলো।

—ওর সবটাই একসঙ্গে জটিলতা আর ধান্দাবাজি। বাচ্চুকে ও থামাতে পারত না। আবার তনিমার কিছু যদি বাচ্চু থেকেই হয়, তাহলে ওর একটা পরিষ্কার স্ট্যান্ড নেবার প্রশ্ন এসে যেত। বাচ্চু, লাডিয়া, মহীন্দর, এদের বিরুদ্ধে স্ট্যান্ড নেয়া ওর পক্ষে অসম্ভব। কেন না সেখানে টাকাকড়ি, দশ আনা—ছ’আনার ব্যাপার। তুমি তো ওকে বাঁচিয়ে দিলে।

—পলটুদাকে?

—নিশ্চয়। এখন ও বলতে পারবে রথীন নিয়ে গেছে, আমি কি করব? ও জানে যে বাচ্চু তোমাদের সঙ্গে খোলাখুলি সংঘর্ষে নামবে না। ও তো নিজের বাড়িতেই রাখতে পারত তনিমাকে। ওকে কিছুই করতে হল না। এখন ও বলতেও পারবে যে আমাদের রথীনই কাজটা করেছে।

—ওঃ! কত ঘোরপ্যাঁচ।

—বাচ্চু ওকে সেদিন দাবড়ে অপমান করে। তোমার এ কাজটার ফলে বাচ্চু খানিক দাবড়া খেয়েছে এ জন্যেও ও খুশি। অথচ লোকটা নিজের ফাঁদে এমনই বন্দী যে সে কথা খোলাগলায় বলে বাচ্চুকে চটাতে পারবে না।

রথীন বলে, এ শহরে একটা কিছু ঘটা দরকার। যাতে সব পর্দা ছিঁড়ে যায়। মানুষকে বিবেকীর বা অবিবেকীর, একটা স্ট্যান্ড নিতে হয়।

রায়বর্মা বলেন, বর্তমানে তা অসম্ভব।

—কেন?

—সব তুষচাপা আগুন। দাবানল নয়।

বাচ্চু মনে মনে জ্বলছিল।

আগুন জ্বালিয়ে দেবে ও, সইবে না এমন অপমান। ”ওকে যেতে দিলে কেন শুওরের বাচ্চা” বলে নিশীথকে লাথির পর লাথি মেরে ও শান্তি পায় নি।

পাঁজরা ও হাড় ভেঙে নিশীথ এখন হাসপাতালে। ”কে বা কাহারা”র আক্রমণে নিশীথ জখম হবার প্রতিবাদে শহরে বড় শরিক উৎকৃষ্ট কাগজে ছাপানো ইস্তাহার মেরেছে, উচ্চ পর‍্যায়ে আলোচনা করেছে এবং শহরে আইন শৃঙ্খলা উন্নত না করলে কপালে দুর্ভোগ আছে বলে এস.ডি.ও—কে শাসিয়েছে।

এ কারণে পৌরসভা কর্মীদের মধ্যে কৃপাণসিন্ধুর লোক ও পলটুর লোকদের মধ্যে মারামারিও হয়েছে।

কৃপাণসিন্ধুও ইস্তাহার ছেড়েছে, বড় শরিকের গুন্ডাবাজির প্রতিবাদে বন্ধ ও হরতাল পালন করুন।

কবে ”পালন করুন” তারিখ ঠিক হয়নি।

বাচ্চু বর্তমানে রাজা ও কাবলি ছাড়া কারো সঙ্গে কথা বলছে না।

পলটু ডাকলে যাচ্ছে না।

পলটু ওকে বোঝাতে পারছে না, নিশীথের ওপর হামলা নিয়ে বাচ্চুর নেতৃত্বে যুবোদের প্রতিবাদ মিছিল করা দরকার।

বাচ্চু বলেছে, মাইরি আর কি! ”সত্যবার্তা” দেখেছেন? ওরা তো লিখেই দিয়েছে যে আততায়ীকে সবাই চেনে, ভয়ে মুখ খুলছে না।

—তুমি এসো।

—না।

ফোন নামিয়ে রেখেছে বাচ্চু।

রথীনের বাড়ি! এত বড় ঔদ্ধত্য। বিয়ে তোমায় করব না তনিমা নাগ, শিক্ষা দেব।

আমার হাত ছাড়িয়ে…

রাজা ও কাবলি প্রমাদ গণেছে।

—কত মেয়ে তো আছে গুরু!

—চুপ করে থাক।

গুরু এখন ক্ষ্যাপা কুকুর। না, কোনো একটা হাঙ্গামা বাধতে চলেছে।

—আমরা কেটে যাব।

—কোথায়?

—নেপাল, বাংলাদেশ।

—হ্যাঁ, এখানে আর নয়।

—গুরু কিছু একটা করে বসবে।

তনিমা এত কথার কিছুই জানে নি। এখন ওর জীবন কত আতঙ্কমুক্ত। রথীনকে ও বাধ্য করেছে কিছু টাকা নিতে। দীনু বলেছে,

—প্রেসটা দাঁড়াক। মধু বিয়ে করবে। বউ নিয়ে থাকবে ওখানে। আমিও থাকব। ওখানে আপনি থাকতে পারবেন? কোনো ঝামেলা হবে না।

—ওই বাচ্চু?

—বাচ্চু আমায় চেনে। ভয়ের তো শেষ থাকে না তনিমা ভয় কাটাতে হয়।

তনিমা সে জন্যেই সুবীরকে সব খুলে মেলে লিখতে পেরেছে।

”আর তো দেড় বছর। তারপরেই আমরা বিয়ে করতে পারব। এখন তুমি খুব নিশ্চিন্ত হতে পারো, জানো? আমি ভাবতাম, এ শহরে বুঝি সবাই ভিতু। কিন্তু জানো, মানুষের মতো মানুষও অনেক আছে। এটা কি কম পাওনা? তুমি এবারে এলে সবায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।”

—মানুষের মতো মানুষ!

রথীন, দীনু, তপু, মধু, দীপালি, সীমা, জয়া, ভারতী, রায়বর্মা।

মানুষের মতো মানুষরা কিছুই করতে পারে না।

সেদিন শহরে সাতদিন ব্যাপী মুক্ত মঞ্চে নাট্যোৎসবের আসর থেকে তনিমা উঠে যায় হঠাৎ।

একটা চিরকুট পেয়ে।

—একবার আসবে তনিমা? লিলি খুব অসুস্থ।

—জয়াদি।

লেখাটা কার, জয়াদির কি না তা তনিমা ভেবে দেখেনি। লিলির শরীর খারাপ যাচ্ছে জানে। জয়া নাটক দেখতে আসে না, জানে। নীপাকে ও বলে, এই! লিলি বোধ হয় অসুস্থ। জয়াদি লিখে পাঠিয়েছে। এই দেখ।

স্থানীয় নাট্যদলের ”সাজানো বাগান” দেখতে নীপা তখন মশগুল। চিরকুটটা ও নেয়, ব্যাগে রাখে।

—আমি একটু যাচ্ছি, কেমন?

নীপা ঘাড় হেলায়।

তনিমা বেরিয়ে আসে। মুক্তমঞ্চ, ময়দানে মঞ্চ। চা, পান, ঝালমুড়ি, বাদাম, চপ ও রোলের দোকান, কোলড্রিংক। তপুর ভাই দীপু চা খাচ্ছিল।

—তনিমাদি?

—তুমি নাটক দেখছ না?

—এ নাটক আগেও খোদ কলকাতায় বসে দেখা। আপনি?

—লিলি খুব অসুস্থ ভাই, জয়াদি ডেকেছে।

—চলুন, এগিয়ে দিই।

…না না। আমি যেতে পারব।

—অন্তত চেনা রিকশায় তুলে দিই।

—রিকশায় যাব? সামনেই তো?

—তবে সাইকেলের পেছনে বসুন।

—বেশ, চলো।

—একা যাবেন কেন?

দীপুর সাইকেলের পেছনে তনিমা বসে। ময়দানের পর রাস্তা। নীরব ও অন্ধকার পৌরভবন। রাস্তা বেঁকে যায়। নীরব ও অন্ধকার স্কুল বাড়ি। তারপর পথ। পলটুর বাড়ি ওই বাঁক ঘুরলেই।

দীপ বাঁক ঘুরতে পারেনি।

কি যে হল ও বুঝতেও পারেনি। সামনে গাড়ি আড়াআড়ি করে রাখা, স্টার্ট নিয়েই আছে।

সাইকেল দাঁড় করাতেই ওর মাথায় রড পড়ে। পড়ে যেতে যেতে…পড়ে যেতে যেতে …ও দেখছিল একটা মাংসল মুখ ও আর্ত চীৎকার হঠাৎ থেমে যেতে শুনেছিল তনিমার।

—দীপু—উ—উ—উ—উ।

স্কুলের দারোয়ান সবই দেখে ও ”রাম রাম” বলে ঘরে ঢুকে যায়।

—কি হল?—বউ বলে।

—কিছু নয়।

—কে চেঁচাল?

—কেউ না। কিছু বলবিনা কাউকে, কিচ্ছু না, রাম রাম!

—কি হল?

—ওহি বাচ্চু বাবু!

—কাকে মারল? আওরৎ?

—আওরৎকে তুলে নিল। ঔর সাইকেল ওয়ালাকে…

—মেরে ফেলেছে?

—জানি না।

—বাবা রে বাবা! কুছ তো করিও।

—না। বাচ্চু বাবু কা কাম। আমাদের জীবনের কা ভরোসা? দেখতে যাব তো আমাদেরও…

—হা ভগবান!

দীপু পড়ে থাকে, পড়ে থাকে। মাথার পিছনে কান ঘেঁষে রড পড়েছে। দীপু অজ্ঞান।

একটি ট্রাক ঘণ্টাখানেক বাদে দীপুকে আবিষ্কার করে। শহরের ট্রাক। দীপুকে চেনে।

দীপুকে হাসপাতালে পৌঁছে তবে ড্রাইভার তপুর খোঁজে যায়।

নাট্যোৎসবের ভিড় থেকে তপুকে পেতে পেতে আরো সময় যায় এবং নাটক ভাঙলে তবে নীপার খেয়াল হয় যে তনিমা ফেরে নি।

নীপাকে রথীন ধমকাতে থাকে, ভীষণ ধমকাতে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে নীপা চিরকুটটি বের করে দেয়। নাটক ভাঙলেও ওদের ঘিরে ভিড় ভাঙে না।

অবশেষে চায়ের দোকান থেকে জানা যায় যে দীপু তনিমাকে নিয়ে সাইকেল নিয়ে কোথায় যেন গেল। হ্যাঁ তনিমা কি বলছিল বটে!

এই চিরকুট!

দীপু রড খেয়ে অজ্ঞান। তবে মাথা ফাটার ওর দিয়েই গেছে। ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়তো হয় নি। রথীন বলে তপু, তুই এখানে থাক। তনিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

—পাওয়া যাচ্ছে না।

—সার্চ পার্টি চাই।

—তুই, দীনু, মধু…শান্তিদার চায়ের দোকানে খবর দে, আর শোন, দীপালিদির ভাইপোরা আছে।

খোঁজ চলতে থাকে, চলতে থাকে। দীপুর জ্ঞান ফেরে রাত দুটো নাগাদ।

তিনটে নাগাদ ও বলতে পারে, দাদ…বাচ্চু…গাড়িতে তনিমাদিকে…

—গাড়ি কোথায় ছিল?

—স্কুলবাড়ির সামনে…

জয়ার বাড়িতে তার আগেই যায় রথীন। জয়া পাথর হয়ে যায়।

—বউদি!

—এ আমার লেখা নয় রথীন।

—তনিমা আপনার লেখা চেনে না?

—জানি না…মনে করতে পারছি না…

—পলটু কোথায়?

—নেই। নিউ জলপাইগুড়ি গেছে।

—আমরা খুঁজতে বেরোচ্ছি?

—শুধু তোমরা কেন? পুলিশও খুঁজুক! জয়া ফোন তোলে।

—হ্যাঁ, আমি জয়া দত্ত। আমার নাম লেখা জাল চিঠি দেখিয়ে কেউ আজ নাট্যোৎসব থেকে তনিমা নাগকে আমার বাড়ি আসতে বলে।

—কে?

—জানি না। তনিমাকে দীপক পাল, তপন পালের ভাই সাইকেলে পৌঁছে দিচ্ছিল।…দীপু মাথায় রড খেয়ে হাসপাতালে। আপনারা এখনি তনিমার খোঁজ করুন। বুঝলেন? আমি প্রমট অ্যাকশন চাই।

রথীন বলে, বউদি! চিরকুটটা দিন। ওটা নজীর। পুলিশ নিলে চেপে দেবে।

—নাও।

—এটা জেরক্স করিয়ে…

—তোমরা কেউ গাড়ি চালাতে জানো?

—মধু জানে।

—চলো। গ্যারেজ খুলে দিচ্ছি। ওর গাড়ি নিয়ে যাও।

—পলটুদার গাড়ি?

—একদিন আমার কাজে লাগুক।

—মারুতি চালানো…

—মারুতি নিয়ে ও গেছে।

—বেশ! চাবি দিন।

দীনু বলে, তাড়াতাড়ি।

ওরা খুঁজতে থাকে। খুঁজতে থাকে। তারপর ভোর নাগাদ শহরের উপকণ্ঠে। পি.ডবলিউ.ডি—র গুদামের মাঠে ওরা তনিমাকে পায়।

উলঙ্গ। কাপড় জামা পাশে পোঁটলা করে রাখা। অজ্ঞান। মুখ থেকে উরু কামড়ে কামড়ে রক্তাক্ত। দুই উরুর মাঝখানে রক্তের ধারা। কাপড় দিয়ে মুড়বে বলে নিচু হতে ওরা অদ্ভুত গন্ধ পায় মুখে।

একটা তেল ঢালার ফানেল। জ্বলে গেছে যেন। দীনু বলে, ”আদালত ও একটি মেয়ে!” তুলে নে আস্তে। যত্ন করে তুলবি।

হাসপাতালে তনিমা। অজ্ঞান, অজ্ঞান। অক্সিজেন কোথা দিয়ে দেয়া যাবে? গলায় ফানেল ঢুকিয়ে অ্যাসিড ঢাললে গলনালী পুড়ে যায়। গলা ফুটো করা যাবে না। নাক দিয়ে?

তনিমাকে ঘিরে দীপালি, জয়া, ভারতী, স্কুলের শিক্ষিকারা। রথীন, মধু, দীনু।

রায়বর্মা সীমাকে ডাকেন!

—বলুন!

—পুরুষরা সরে যাও। চাদর সরিয়ে দাও সীমা। কোথায় কি ক্ষত, সব লিখে নাও দীপালি। দেখে নাও।

—কি দেখব আর!

—বউমা!

রায়বর্মা মাথা নাড়তে থাকেন।

—সব ওরা রিপোর্টে ঘুরিয়ে দেবে। সব চেপে দেবে। থাকবে শুধু মিথ্যা!

—শুধু মিথ্যা।

—হ্যাঁ। তোমরা যা দেখবে, দীপালি যা লিখে নেবে, দীপু যা বলেছে, ওই চিরকুট, এগুলোই নজীর। একটা বিশাল মদমত্ত ক্ষমতাচক্রের মার আসছে সর্বশক্তি নিয়ে। এই নজীর দিয়ে তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।

—কি করে বেঁচে আছে!

—ও তো কিছু বলতে পারবে না। পাছে বলে, সেজন্যেই তো অ্যাসিড ঢালা। আমরা পারলাম না, পারলাম না মেয়েটাকে বাঁচাতে। আমাদের সকলের কাছে ও নিরাপত্তা চেয়েছিল।

দীনু ছটফট করে ওঠে।

রথীন বলে, সিগারেট খা।

—আমি একাই পারব।

—লাভ নেই দীনু দা। বাচ্চু শহরে নেই। ভোরে কেটে গেছে।

—কোথায় যাবে ও? কতদিন সরে থাকবে?

—দীনু দা…আমি বারবার বলতাম, এ শহরে মানুষ সবাই বিকিয়ে গেছে কিনা যাচাই করার জন্যে একটা ভয়ঙ্কর কিছু ঘটা দরকার। কিন্তু সেটা তনিমাকে নিয়ে ঘটুক…তনিমাকে নিয়ে…

রথীন কাঁদতে থাকে।

জয়া বসে থাকে বারান্দায়, বসেই থাকে। আরো কত লোক, কত লোক! আজ ও লিলির কথাও ভাবছে না। লালুর মাকে বসিয়ে রেখে এসেছে।

এর পরে কি? এর পরে?

ভিড়ের মধ্যে থেকে কথা কানে আসে।

—পলটু দত্তের বউ এখানে কেন?

—মুখ দেখাতে এসেছে।

—বাচ্চু তো পলটু দত্তের লোক।

—বাচ্চুর টাকায় তো সংসার চালায়।

—লজ্জা করে না?

—থুতু দিতে হয়।

জয়া চোখ বোজে। চোখ দিয়ে জল পড়ে ওর। হ্যাঁ, তোমরা আরো বলো। আমাকে অপমান করো। পলটু দত্তের স্ত্রী হয়ে থাকার জন্যে তোমাদের ঘৃণা আমার ওপর নেমে আসুক।

—কাঁদছে…ঢং দেখাচ্ছে।

—পলটুই বাচ্চুকে বাঁচাবে রে ভাই। দুধেল গাই কি হাত ছাড়া করে কেউ?

ওরা ঠিক বলছে। ওরা পলটুকে চিনেছে। শান্তি, তাতেও শান্তি।

জয়া কি করবে?

লিলিকে নিয়ে চলে যাবে।

কোথায়?

কলকাতায়।

তারপর?

আর ফিরবে না।

আর না, আর না। তনিমা ওকে পথ বলে দিয়ে গেছে।

তনিমা অজ্ঞান অবস্থাতেই বেলা একটা নাগাদ মারা যায়।

রায়বর্মা সরেন না।

—তোমরা থাকো। পোস্টমর্টেম দুরকম হবে। আসল রিপোর্টটা দরকার হলে…

দীনু বলে, বের করব।

—কি করে?

—তা আপনার জানার দরকার নেই। আমি অ্যাকশান করা ছেলে দাদা। এখানে আমারও চেনাজানা আছে। চিরবে কাটবে তো লখীন্দর ডোম!

—হাসপাতাল ছেড়ো না।

—তাই ছাড়ি?

—চলো বউমা।

—কোথায়?

—বাড়ি চলো, আবার এসো।

আজ শহরে কোথাও মানুষ নেই। সবাই হাসপাতালে। জয়া শুনতে শুনতে বেরোয়।

কাল মিছিল করে তনিমাকে শহরে ঘোরানো হবে। কাল সব বন্ধ থাকবে।

আজ কি হবে, আজ?

একটা বিশাল মদমত্ত ক্ষমতাচক্র বাচ্চুকে বাঁচাতে, হাসপাতাল ও মর্গের রিপোর্ট পালটে দিতে ঝাঁপ দিল বলে।

আজ শুধু পাহারা দেবার দিন।

জয়া বাড়ির দিকে চলে। হেঁটে। কোথায় সময় বাজে। কোতোয়ালিতে? সময় থেমে যায় নি? ঘড়ি চলছে? কেমন করে?

বাড়িতে পলটু।

পলটু, সামন্ত শ্রীমতী আশা রায়, হরি বোস। বড় শরিকের জরুরি মিটিং না কি?

জয়া আস্তে আস্তে ওপরে ওঠে।

পলটু বেরিয়ে আসে, জয়া!

লিলি শুয়ে আছে। মুখ পাথর পাথর।

—মা?

—লিলি?

—আমি এখানে থাকব না মা।

—না লিলি, থাকবে না।

—তনিমাদি…তনিমাদি…

—কে বলল?

—লালুর মা।

—না লিলি। তুমি আর আমি চলে যাব। চলে তো, যেতামই। ডাক্তার লাহিড়ীকে দেখাবার জন্যে আমরাই যাব। তারপর…

—আর আসব না?

—না লিলি।

—ঠিক বলছ?

—আমি তো তোমার কাছে মিথ্যা বলি না।

—মা।

—বলো?

—তনিমাদি…খুব কষ্ট তো পায় নি?

—ওর তো জ্ঞানই ফেরে নি লিলি।

—না লিলি।

—তোমার নাম করে কে ওকে লিখেছিল মা? আমার অসুস্থতা জেনেই তো ও আসছিল…

—জানি না লিলি। শোনো, যদ্দিন না চলে যাই, তদ্দিন এ সব নিয়ে কোনো কথা বোল না কেমন? একটা কথাও না।

—বলব না।

—আমি স্নান করি?

—করো।

—জয়া স্নানের ঘরে ঢুকে যায়।

.

পরদিন শহর বন্ধ।

পরদিন শহর ভেঙে শোক মিছিল।

প্রতিবাদ মিছিলও বটে।

প্রতিটি মানুষ নীরব। মিছিলের মাঝে মাঝে উত্তোলিত ব্যানার।

—তনিমা নাগের ধর্ষণ ও হত্যার জবাব চাই।

—অপরাধীকে আশ্রয় দেয়া চলবে না।

—সম্পূর্ণ তদন্ত ও বিচার চাই।

—তনিমা নাগের হত্যাকারীর চরম দণ্ড চাই।

পলটু বেরিয়ে আসে।

—তুমি কোথায় যাচ্ছ?

—মিছিলে।

—না না। আমরা মিছিলে যাচ্ছি না।

—তোমরা মানে?

—আমাদের পার্টির কোনো সংগঠন মিছিলে যাবে না।

—ভালো। শহরবাসী পরিষ্কার জানবে, দেখবে কারা অনুপস্থিত থাকছে।

—তুমি গেলে জয়া…

—সরে যাও।

—আমার এ শহরে…

—থাকা চলবে না?

—যেওনা জয়া।

—আস্তে, চেঁচিও না। তুমি থাকবে। তোমরাই থাকবে। স্বসৃষ্ট সাম্রাজ্যে থাকবে।

—তুমি?

—আমি থাকব না, আমি থাকব না। লিলি থাকবে না। টেলিগ্রাম করেছি, ছোড়দা আসছে, আমাদের নিয়ে যাবে।

—চলে যাবে?

—এই তো যাচ্ছি। এখনো তো যাচ্ছি।

বেরিয়ে আসে জয়া। আসছে, মিছিল আসছে। পলটু দত্ত পরাজিত, বিধবস্ত। ও জানালা দিয়ে চেয়ে থাকে।

মৃতদেহ নিয়ে মিছিল আসছে। ওর বাড়ির সামনে দাঁড়াচ্ছে কেন? কেন ওর বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে?

মিছিলের দিকে এগিয়ে যায় ওর স্ত্রী। পলটুর দিকে সারি সারি ব্যানার উঁচানো।

প্রতিটি ব্যানার বেয়নেট।

জয়াও একটি ব্যানার উঁচিয়ে ধরে।

—তনিমা নাগের হত্যাকারীকে আশ্রয়দাতাদের শাস্তি চাই।

জয়ার চোখে কিসের ঝলক? ইস্পাতের? পলটু দত্ত ওর স্ত্রীর দিকে তাকাতে পারে না, তবু চেয়ে থাকে।

বারবার বিদ্ধ হয়, বারবার।

***

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *