পারিবারিক : স্ত্রী – ২

রাতে ও নিচে নেমে আসে।

পলটু দত্ত ভাবছিল আর ভাবছিল। লোকসভার নির্বাচনে মেজ শরিকের প্রার্থী ওদের মদতে জিতেছে, কিন্তু ব্যবধান মাত্র চার হাজারের।

নির্বাচনী কেন্দ্রে বিরোধী দলের ভোট এত বাড়ল কেমন করে তা নিয়ে দুই শরিক পরস্পরের ওপর দোষারোপ, পঞ্চায়েত পর‍্যায়ে কিছু খুনোখুনি, এ সবও হয়ে গেছে।

মেজ শরিক মায়ের ভোগে যাক, তার ঘরে সব ঠিক আছে তো?

বেশ কিছু কর্মীর ব্যবহার ও কথাবার্তা পলটুকে সংশয়ে ফেলে দিচ্ছে।

যেমন রথীনরা। যুবকরা।

—এখন আপনার আর আমাদের দরকার নেই। ওই বাচচু এখন আপনার মদতে নেতা!

—কুকমারি জঙ্গলের ব্যাপারটা আমরা ছেড়ে দেব না।

—দুর্নীতি তদন্ত কমিশন বসাচ্ছেন না কেন?

—আপনি মন্দির উদ্বোধন করলেন কেন?

—এ শহরে পার্টির আপনজন কারা?

—পৌরসভা নির্বাচনের কি হল?

পলটু বুঝতে পারছে না রথীনদের কোন দলে ফেলা যাবে? বিক্ষুব্ধ? মানে উগ্রপন্থী? কে বিশ্বাস করবে? কি ভাবে কি কথা যায়?

এ সময়ে রায়বর্মা সঙ্গে থাকলে ভালো হত। শহরে ওঁর ভাল ভাবমূর্তি আজও আছে।

—কিন্তু উনি আসবেন না।

ভাবমূর্তি বলতে মনে পড়ল শহরের প্রাচীন ঐতিহাসিক গুণবর্ধন রায়ের মূর্তির কথা।

চাঁদা তোলা হয়েছিল, স্মৃতিরক্ষা তহবিলও হয়েছিল। সে সব খাতাপত্র এবং টাকা নিয়ে ভ্যানটা স্টুডিওর ছেলে ঘ্যান্টা মালদা চলে গেছে।

পলটু কেমন করে শহরবাসীদের ও রথীনদের বোঝাবে যে সে টাকা ও মারে নি।

লিখবে না কেউ, সে সাহস হবে না। কিন্তু কানে কানে প্রচার তো চলছে।

লাডিয়া বলছে, লাগান মুরত। টাকা আমি দিয়ে দেব। কিন্তু শহরের লোক খুব খচরা। সেবার সেই ডাক্তারের মুরত নিয়ে কত কথা বলল!

সত্যিই হারামজাদা শহর। প্রসূতিসদনের প্রতিষ্ঠাতা ডাক্তার সচ্চিদানন্দ রাহুতের মূর্তি নিয়ে কি হইচই, কি হইচই! তাঁর মুখ না কি নেতাজীর মতো ছিল না।

আসলে ভাস্কর ভাস্কর পাল সে সময়ে নেতাজীর মূর্তি গুটি দশেক করার ফলে রবীন্দ্রনাথ, বিপ্লবী তারক কান, মাইকেল, সকলের মূর্তিতেই নেতাজীর গোলালো মুখের আদল এসে যাচ্ছিল।

ও বলেও ছিল, গুণবর্ধন রায়ের ফটো দেখে কি হবে পলটুদা? সে তো পরে। সচ্চিদানন্দ রাহুতের মূর্তি যা হবে না! তবে সামনে নেতাজী গড়ছি, মুখটা নিয়ে…

নেতাজীর মুখ মনে রেখে ডাক্তার রাহুতের মূর্তি গড়ার ফলে শহরে বিপুল ঝামেলা হয়। কাগজে লেখা, জনসভা, পাবলিকের টাকা কি শস্তা, হেন রে তেন রে!

অবশেষে সে মূর্তি ভেঙে ফেলতে হয়। মূর্তি ভাঙার রাজনীতিতে একান্ত অবিশ্বাসী পলটুকেই নেতৃত্ব দিতে হয়। ডাক্তার রাহুতের মেয়ে আমেরিকায় বসে সব জেনে নতুন মূর্তির টাকা দান করে। ডাক্তার রাহুতের লণ্ঠনের মতো মুখ ও কদমছাঁট চুলের যথাযথ মূর্তি স্থাপিত হয়।

বাতিল মূর্তিটি এখন পলটুর বাগানের সামনে। মূর্তির গায়ে দড়ি দিয়ে গরু বাঁধা হয়, পিঠে ঘুঁটে দেয়া হয়। মূর্তির মাথায় গোবরের ঝুড়ি উপুড় করা থাকে।

এটাও ”কে বা কাহারা”দের খচরামি। এত জায়গা থাকতে পলটুর বাগানের পাঁচিল ও নেতাজী রোডের মাঝামাঝি ঘাসের ওপর মূর্তিটা রেখে যাবার মানে কি?

সে জন্যেই তো ”কৃপাণ” কাগজ লিখতে সাহস পেল, ”প্রথমে রাহুতের মূর্তি নেতাজী আদলে বানাইয়া প্রয়াত ডাক্তার ও মহান নেতাজীকে করা হল অপমান! সহে না সহে না আর দুঃসহ এ জ্বালা! তদুপরি বাতিল মূর্তিটির মাথায় গোবরমাখা ঝুড়ি, গলায় গরু বাঁধা, পিঠে ঘুঁটের চাপড়! হায়! ক্ষমতামত্ত জননেতার মনে নাই, ওই ডাক্তারের হাতেই তিনি প্রসব হইয়াছিলেন! আপাতদৃষ্টে প্রাণহীন শিশুকে পিঠে চাপড় মারিয়া তাহার ”ট্যাঁ” কান্না তিনি প্রথম শোনেন!”

এখন ”সত্যবার্তা” লিখছে, ”ভাস্কর ভাস্কর পাল ও নেতা পলটু দত্তের অশুভ আঁতাতের ফলে নগরটি বিকৃত দর্শন মূর্তিতে প্লাবিত। এক্ষণে গুণবর্ধন রায়ের মূর্তি কে করে তাহা দেখিতে আমরা উৎসুক। এ কথা কি সত্য, যে সরকারী হাসপাতালে অপেক্ষমাণ রোগীদের জন্য যে পাবলিক শৌচাগারটি ভাঙিয়া যায়, এবং যাহা বৃহদাকারে পুনর্নির্মাণের জন্যে চার লক্ষ একুশ হাজার টাকা বরাদ্দ হইয়াছে, তাহা আর হইবে না? সেই টাকাতেই নগরে মূর্তিগুলি হইতেছে ও হইবে?”

এ সবের পেছনে কে আছে, জানা দরকার। বড়ই দুঃখ ও চিন্তার বিষয়, শহরে ”কৃপাণ” ও ”সত্যবার্তা”ই চলে। পলটুদের ”গণমত” মানুষ বাধ্য হয়ে কেনে, কিন্তু পড়ে না। ঠোঙা খুলে দেখ, প্রায়ই দেখবে ”গণমত”।

শোনা যাচ্ছে দীনু আবার ‘প্রতিবাদ’ বের করবে। আগে দু’বার ঠ্যাঙা খেয়েছে, এবার পেছনে থাকবেন রায়বর্মা।

রায়বর্মার কাছে যেতে হবে। বলতে হবে, জমানা বদলে গেছে দাদা, জমানা এখন আমাদের। এখন ওসব প্রতিবাদী কাগজ বের করে কোনো লাভ হবে না।

দীনু, রায়বর্মা, রথীনরা, কোন অশুভ আঁতাতের গন্ধ টের পাচ্ছে পলটু। নাকটা ওর বরাবরই খুব ভালো। গন্ধ ও আগে ভাগেই পায়।

জয়া নেমে আসতেই পলটু বিপদের গন্ধ পেল।

—কি ব্যাপার তুমি?

—কথা আছে।

—কি এমন জরুরি কথা?

—জরুরি না হলে আসতাম না।

—বেশ তো, বোস।

জয়া চেয়ারে বসে। স্বামীকে দেখতে থাকে।

—কি দেখছ?

—তোমাকে?

—কেন?

—ভাবছি তোমার মূর্তি কে করবে, কার সে ক্ষমতা আছে।

—মূর্তি কেন করবে?

—করা দরকার। আবক্ষ মূর্তি। চারপাশে লেখা থাকবে তোমার জীবনী। যে লাডিয়ার কারণে তোমার একমাত্র মেয়ে জীবন্মৃত, সেই লাডিয়ার সঙ্গে তোমার রাজনীতিক দোস্তালি সব লেখা থাকবে। যারা পর্ণো পড়ে তারা জীবনী পড়বে। যারা পর্ণো ছবি দেখে ভি.ডি.ও—তে তারা তোমাকে দেখবে।

—আজেবাজে কথা শোনার সময় আমার নেই।

—আমার কথা তো তুমি শুনতে বাধ্য, তাই না? কেন না তোমার আসল কথা তো আমি জানি। কি, মারুতি চড়েই ফিরলে?

—মারুতিটা ও ব্যবহার করতে দিয়েছে।

—সত্যি, সবাই কত আপনভোলা তাই ভাবি। কেউ ভি.আই.পি., স্যুটকেস, কেউ মারুতি, কেউ আসবাব, কেউ ডানলোপিলো, কেউ এয়ারকন্ডিশনার, সবাই সব ব্যবহার করতে দেয় তোমাকে, ফিরিয়ে নিতে ভুলে যায়।

—একই কথা, জয়া!

—আগে দিত না, এখন দেয়। রায়বর্মাকে দেয় না, তোমাকে দেয়।

—রায়বর্মা রায়বর্মা কোর না। বোঝ না কিছু? ওঁর রাজনীতিক সততায়…

—কে প্রশ্ন করছে? পলটু দত্ত। চমৎকার।

—ওঁর বাড়িতে…

—একশো বার যাব। আমার যেখানে ইচেছ যাব, যার সঙ্গে ইচ্ছে সম্পর্ক রাখব, ওসব কথা বলে লাভ নেই।

—জয়া, জয়া, যা হয়ে গেছে তা ফেরানো যাবে না। এখন তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই।

—খুব লাভ আছে। আমার কাছে। আমাকে ভাবতে হচ্ছে। আমি লিলিকে দেখি।

—যাক! কি বলবে বলো।

—তনিমাকে চেনো নিশ্চয়।

—চিনি।

—আজ ও এখানেই আছে।

—ভালো তো।

—দেখ! তোমার জন্যে মেয়েটার জীবন আজ বিপন্ন। কোথাও ও থাকার জায়গা পাচ্ছে না।

—আমার জন্যে! জয়া, যা বলেছ যথেষ্ট। পলটু দত্তের জন্যে কোনো স্ত্রীলোকের…

—তুমি নিজে গিয়ে তাকে চটকাচ্ছ তা আমি বলি নি। সে রকম করার সাহস তোমার নেই। কিন্তু ইচ্ছে হয় কিনা তা আমি কেমন করে বলব?

—না, জয়া, না।

—হয় না সেটা আশ্চর্যও। সুযোগসুবিধে কম পাও না, আসলে সাহসে কুলোয় না। মফঃস্বলে সব বদমাশি চলে যাচ্ছে রাজনীতির নামে, তবে মেয়েবাজিটা বোধ হয়…না, চলবে না।

—জয়া, এই কি বলবে?

—হ্যাঁ। তোমার কারণেই ওর অস্তিত্ব বিপন্ন। ও যেখানে আছে…

—নিশীথ বাবুর বাড়ি।

—নিশীথ বাবু কে?

—মিউনিসিপ্যাল অফিসে ক্লার্ক।

—ওর বউ?

—প্রাইমারি টিচার।

—বাড়িটায় কি হয়?

—কর্মী ইউনিয়নের আপিস।

—চমৎকার! মিউনিসিপ্যালিটি একটা অকর্মণ্য বডি, দুর্নীতির আখড়া। আর কর্মী ইউনিয়ন যেহেতু তোমাদের, সে হেতু বাড়ি পেয়ে গেছে। এ শহরে কি না হয়।

—ওখানে ওর কোনো অসুবিধে হচ্ছে?

—হচ্ছে। তোমার কারণে।

—আবার!

—চেঁচিয়ে লাভ নেই। তোমার ডান হাত, ওই লম্পট বাচ্চু, যাকে যুবনেতা করেছ, এবং এটা অপ্রাসঙ্গিক মনে কোর না, তোমার সঙ্গে শহরের জঞ্জালগুলোর আঁতাতের জন্যেই লোকসভায় শহরের ভোট এত কম হল। যাক গে, ওই বাচ্চু ওর পেছনে লেগেছে।

—কে বলল?

—আমি বলছি। পার্টির মস্তান একটা নিরীহ মেয়ের পেছনে লেগে তার জীবন দুর্বিসহ করে তুলছে এ খবরটা ”গণমত” কাগজে বেরোলে কি বিশ্বাস করতে?

—নিশীথ তো কিছু বলেনি…

—সে কেন বলবে? বাচ্চুর বিরুদ্ধে সে কেন বলবে? তা ছাড়া, তোমাদের তো এখন পার্টিতে নানা শ্রেণী। শিল্প নগরীতে যেমন মাইনে ও পদমর‍্যাদা অনুযায়ী কোয়ার্টার হয়। কে কোথায় থাকে তাতেই বোঝা যায় তার পোজিশান।

—এ সব কথার সঙ্গে…

—আছে, যোগ আছে। নিশীথ বাচ্চুর নামে বলবে না, কেন না বাচ্চু চিরকালের মস্তান, বর্তমানে তোমার মদতে মদমত্ত নেতা।

—না না, সে কথা নয়।

—তোমার ভয়ে শহর কাঁপে! সুনীলা তার ওয়ার্কিং গার্লস হস্টেলে ওকে রাখতে ভয় পায়। ভানু তার সেন্টারে রাখতে ভয় পায়, নিশীথের বাড়িতে ও থাকতে ভয় পাচ্ছে, সব এক কারণে।

—আমার জন্যে?

—হ্যাঁ। ও যেখানেই যাবে বাচ্চু সেখানে ঢুকবেই ঢুকবে। তা নিয়ে কিছু বলতে গেলে তুমি ক্ষেপে যাবে। তুমি ক্ষেপলে কেমন শোধ নিতে পারো তা সবাই জানে।

—আমি তোমার চোখে কি? দানব না পিশাচ?

—আমার চোখে ও শহরের চোখে তাই।

—শহরের চোখে?

—নিশ্চয়।

না, তা হতে পারে না। ও শহরে একটি নাম, পলটু দা! পলটু দা!

সে সভা করলে সে সভায় কত মানুষ, কত!

জয়া আজ রাতে অন্য জয়া। তির্যক হেসে ও বলে, শহরে সভায় লোক হয়, তোমার পেছনে পার্টি আছে বলে। তোমার কাছে লোক আসে, পাবার জন্যে। না, দানব না পিশাচ নয়। তুমি আমাদের চোখে বর্তমান রাজনীতির প্রতিনিধি বিশেষ, বুঝলে?

—না জয়া, না।

—পাইয়ে দেবে, নিজে লুঠবে, এখানেই তো সবাই মিলে নামিয়েছ রাজনীতিকে। নইলে বাচ্চু! মেয়েবাজি বদমাশির জন্যে যার বিষয়ে ”গণমত” তিন বছর আগে চেঁচাত, আজ সে ”যুবসমাজের পথপ্রদর্শক।” কোন পথ ও দেখাতে পারে? তোমাকে টাকা খাইয়ে কি ভাবে টেন্ডার ধরাতে হয়। চমৎকার।

—তুমি বুঝবে না।

—বুঝব না, ক্ষমা করব না, এখন আমি জানতে চাই তনিমার ব্যাপারে তুমি কিছু করবে কিনা।

—হ্যাঁ…বলব…

—করছ কি না তা ওর কাছেই জানতে পারব।

—বলব, ব্যবস্থা করব।

—না করলে ওকে আমার কাছে রাখব।

—এ বাড়িতে?

—নিশ্চয়। লিলির আজ যে অবস্থা, ও অন্যলোক হলে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারত। তোমার কারণে আমার মেয়ে, আজ…এটা ক্ষতিপূরণ।

—জয়া! সম্পর্কটা কোথায় দাঁড়িয়েছে…

—সম্পর্ক? তুমি তোমার রাজনীতিক কেরিয়ারের জন্যে আমাকে ব্যবহার করেছ। তোমার সঙ্গে আজ আমার সম্পর্ক কি?

—তুমি…তুমি কি ডিভোর্স চাও?

—তাহলে শহরে তোমার মুখ খানিক পুড়বে। সেটা ভাবলে ভালো লাগে। তবে এ বাড়িতে থেকে তোমার কাছ থেকে আমার জীবনের ক্ষতিগুলোর পালটা আদায় করাই আমার এখনকার সিদ্ধান্ত।

—তুমি কত বদলে গেছ।

—মনে রেখো, অন্যথায় ও এ বাড়ি থাকবে।

—তা হয় না।

—খুব হয়। ও থাকলে লিলি ভালো থাকে, হাসে, অন্য রকম হয়ে যায়। লিলির মনে ও এরপরেও বাঁচার আশা জাগাতে পারে। তোমার কাছে অবশ্য লিলি মৃত। ওর ঘরেও তুমি ঢোক না, কথাও বলো না। রণিকে নিজের আদর্শে তৈরি করছ…ওকেও তুমি ছেড়ে দিলে পারতে। তোমার আদর্শ এখন যা, তাতে বাচ্চুই যথেষ্ট।

—বেশ! বাচ্চুকে আমি কড়কে দিচ্ছি, তাতে কাজ হবে। না হলে অবশ্যই…তুমি যা বলছ…

—কড়কে দেবে? পারবে? রথীনদের তুমি কড়কাতে পারো। বাচ্চুর বেলা তোমার অন্য গলা।

—রথীন…আসে?

—আসে, আমার কাছে।

—রথীনরা এখন…

—কি? বিক্ষুব্ধ? উগ্রপন্থী? দাও না লেবেল মেরে। তারপর তোমার ঠ্যাঙাড়েরা আর পুলিশ বুঝবে। কলকাতায় তোমার নাম আরো ”আপ” হবে। শহর তোমার দাপট দেখে ভয়ে কাঁপবে।

—না জয়া, না।

পলটু এতক্ষণ মুখোস খুলে রেখেছিল। এখন পরে। মোলায়েম হেসে বলে, রথীন কত সাচ্চা ছেলে তা আমি জানি।

—সেই জন্যেই ওর একটা চাকরি হয় না। অবশ্য সাচ্চা ছেলেরা তো মুফতে অনুগত থাকবে। হোলটাইমার ওয়েজ, চাকরি, ঠিকাদারি, এ সব তো অন্যদের দিতে হবে। যাতে দল বাড়ে।

—তা বলি নি।

—তুমি কখন কেমন হেসে কি উদ্দেশ্যে কোন কথা বলো তা আমি জানি। ভুলে যেও না বহুকাল ধরে আমি তোমার স্ত্রী।

জয়া বেরিয়ে যায়।

পলটু ভাবে, ভাবতে থাকে। আজ মম জন্মদিন? জন্মদিনে লাডিয়ার খাওয়ানো মুরগীর বিরিয়ানি, চিকেন ভর্তা, ফিশ ফিংগার, আইসক্রীম, সব এখন তেতো লাগবে। শিলিগুড়ি থেকে ও বাবুর্চি এনেছিল। জবা সব তেতো করে দিয়ে গেল।

না, লিলির ঘরে ও ঢুকতে পারে না। ঢুকতে গেলে ওর ভয় করে।

পলটু ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল, আরেকটা খায়। আলো নিভায়। বিছানায় ঢোকে।

এক থেকে গুণে যাও মনে মনে, ঘুম আসবে, ঘুম আসে, পলটু ঘুমিয়ে পড়তে থাকে। রায়বর্মা বলত, লৌহমানব পলটু। সব খেয়ে হজম করতে পারে, যে কোনো জায়গায় ঘুমায়। আমার একটা গর্ব পলটু।

ঘুম আসতে থাকে। এবং ঘুমের সঙ্গে সঙ্গে শত শত গাছ ওকে ঘিরে কর্ডন করে এগোতে থাকে। অসহায়, অসহায় পলটু। ও কি এখন কুকমারির জঙ্গলে? গাছ তো এগোতে পারে না?

হ্যাঁ, কুকমারির জঙ্গলে। পনেরো বছর আগেকার জয়া আর পলটু জঙ্গল বাংলার বাগানে বসে আছে। ছোট্ট রণি আর ছোট্ট লিলি খেলা করছে।

চার বছরের লিলির গলা।

—বাবা আমায় ধরতে পারে না!

পলটু মেয়েকে ধরে ফেলেছে, কোলে নিয়েছে, লিলি ওর গলা জড়িয়ে ধরেছে।

ছোট্ট, ছোট্ট লিলি।

পলটুর কোলেই লিলি হঠাৎ বড় হয়ে যায়, পাথরের মতো ভারি, মুখটা বদলে যেতে থাকে। আগাগোড়া ক্ষতচিহ্ন।

চোখ খোলা, দৃষ্টিহীন।

না, এ লিলিকে ও চায় না।

কিন্তু নামানো যায় না। লিলি ওর গলা জড়িয়ে ধরে, আমি বাবাকে ধরে ফেলেছি।

ঘুম মানেই দুঃস্বপ্ন।

গাছগুলো কত কাছে। ওরা ঝুঁকে পড়ে পলটুকে দেখছে। প্রতিটি পাতায় পাতায় চোখ।

ঘুমন্ত পলটু মাথা নাড়ায়, বিড়বিড় করে। হাত চলে যায় বালিশের নীচে। লিলির জন্যে পূজাউজা দেয়নি লাডিয়া। ওর গৃহদেবতার প্রসাদী ফুল বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে বলেছে।

ও আঙুল চালায়। আঙুলগুলো কি ভারি!

সেদিন ছিল বনমহোৎসব।

বনমহোৎসব করা হবে কি হবে না তা ভেবে পাচ্ছিল না পলটু।

কারণ রথীনরা।

শহরে ”কুকমারির জঙ্গল বাঁচাও” এ নিয়ে রথীনরা বেশ হইচই জুড়েছিল। আর এ বিষয়ে যথেষ্ট সাড়াও দিচ্ছিল শহরবাসী।

মাস তিনেক আগে থেকেই হাওয়া ঘুরতে থাকে। বুঝতে পারা উচিত ছিল পলটুর, বোঝেনি।

ঠিক তিন মাস আগেকার কথা। তারিখটাও মনে আছে পলটুর, পনেরোই মে।

এ শহরে বর্ষা নামার আগে, মে জুন মাসে দিনে থাকে ভ্যাপসা গরম। আবার দু’এক পশলা বৃষ্টি হলেই সন্ধ্যার পর তাপমাত্রা নামবে। রাতে তো হালকা কিছু গায়ে দিলেই ভালো।

গায়ে দেবার প্রসঙ্গে পলটুর মায়ের কথা মনে পড়ে। মায়ের হাতে সেলাই কাঁথা গায়ে দিয়ে ওর আরাম হত কত।

এখন অবশ্য বাড়িতে বালাপোষ, রাজস্থানী হালকা লেপ, আসাম ও মণিপুরের খেস, বেঙ্গল হোম—এর বিদেশে রপ্তানির জন্য তৈরি দুর্মূল্য কাঁথা, বিদেশী কম্বল, স্বদেশী লেপ, সবই অঢেল।

লেপ ছাড়া সবই উপহার। মানুষ দিতে যে এত ভালবাসে তা পলটু জানত না।

সেবার মে মাসে আবহাওয়া যথেষ্ট মনোরম। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, শিরীষ, সবই ফুলে ফুলে সুন্দর। বিশাল প্যান্ডেল করে পরিবেশ দূষণে গাছ লাগাবার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরকারী সভা হচ্ছিল।

আজকাল সরকারী বা দলীয় কোনো সভাই বিপুল ব্যয় ছাড়া হয় না। প্যান্ডেল, ডেকোরেশন, বিদ্যুৎ, আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্যে সার্কিট হাউসে থাকার ও রাজকীয় আহারের ব্যবস্থা, সব কিছুই বড় বাজেটে হয়।

সভায় কলকাতা থেকে সরকারী, বেসরকারী লোকজন, শহরের এস.ডি.ও, সদরের ডি.এম. ও বিভিন্ন মান্যগণ্যরা ছিলেন। বৃক্ষবন্ধু শ্যামাদাস গায়েন বিশেষ অতিথি।

উনি তো আসবেনই না। পশ্চিমবঙ্গে কোনো বৃক্ষ চেতনা নেই। সবাই মিলে প্রাকৃতিক বন ধবংস করছে আর সর্বনেশে ইউক্যালিপটাস লাগাচ্ছে। না, উনি জাপানে যাবেন। যাবেন আমন্ত্রণে।

অনেক বলে কয়ে ওঁকে আনা যায়। ওঁর শর্ত, রায়বর্মাকে আনতে হবে। কেন না ওঁকে এ কাজে ব্রতী করেন রায়বর্মা।

—কবে! কোথায়!

পলটু ঘাবড়ে যায়। রায়বর্মার জীবনের কতটা সে জানে না? অস্বস্তি, অস্বস্তি।

—কেন? উনিশশো সাতষট্টিতে?

শ্যামাদাস খ্যাঁক করে ওঠেন। অগত্যা পলটুকে দৌড়তেই হয়। রায়বর্মার বাড়িতে ঢুকে দীনুকে দেখে ও চমকে যায়।

—দীনু!

—হ্যাঁ, দীনু।

—কবে এল? আমি তো জানি না।

—তোমাকে না জানিয়ে শহরে এসেছে…দীনু। পায়ে পড়ো, ক্ষমা চাও।

—ছি ছি, আমি তাই বলেছি?

—কি জানি পলটু! আজকাল তোমাদের কথাবার্তা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়।

—যা বলবেন বলুন। আপনি যা বলবেন, আমাকে মেনে নিতেই হবে।

—ও রকম বোল না পলটু। উত্তেজিত হব, আলসারের জ্বালা বাড়বে, নানা ঝামেলা…

—তা দীনু আছ কেমন?

—ভালো।

—এখন কি থাকবে?

—বলা কঠিন।

—কেন?

দীনুর রং কটাশে, চুল ছাঁটা, চোখ ফ্যাকাশে, শরীরটা বড় হাড়চওড়া, কেমন যেন। কথা বলার আগে ও চেয়ে থাকে মুখের দিকে, সেটা বড় অস্বস্তির।

—বনানী যেমন করায়, তেমন করতে হবে।

—বিয়ে করেছ?

—বনানী ঔষধালয়। উত্তরবঙ্গে আমি ওদের সেলসম্যান। অতএব…

—তাই বলো, তাই বলো! আমি ভাবলাম…

—আবার কাজ করতে এসেছি?

—হ্যাঁ…করেছিলে তো!

—করেছিলাম। আপনি ঠেঙিয়ে তুলে দেন।

—আমি নয় দীনু। সে সময়ে…

—আমার কথা কি বলা যায়?

রায়বর্মা বলেন, আঃ দীনু, কি হচ্ছে!

—তা এখানে উঠলে।

—বাড়িতে কেন উঠলাম না?

—সেই তো…তিনু তো আমার সঙ্গেই…ও তো বলেনি যে তুমি এসেছ।

—নাঃ! তিনুটা বিশাল দালাল হয়ে গেছে, ম্যাটাডোর কিনেছে, অর্ডার সাপ্লাই করছে, এ সব জেনেই ওর কাছে উঠলাম না। যাব পরে।

—যেও।

—বাড়িতে আমার শেয়ারটা নিতে যাব।

—সে তোমার কথা। তিনু কিন্তু মোটেই যা ভাবছ তা নয়। ও খুব পরিশ্রমী ছেলে।

—আপনার এক রকম ধারণা, আমার আরেক রকম। বৈচিত্র্য নিয়েই তো জগৎ, না কি বলেন?

—সত্যি, তোমাকে দেখে যে কি ভালো…

—বিশ্বাস করি না।

—মানে?

—আমাকে দেখে আপনার ভালো লাগবে না, লাগতে পারে না।

—কেন?

—কেন না আপনাকে দেখে আমার ভালো লাগে না। তারপরেও যদি আপনার ভালো লাগে, তাহলে বলতে হবে আপনি শ্রীগৌরাঙ্গ হয়ে গেছেন। যাক গে, আমি গাছগাছড়ার হার্বাল চা করছি, আপনি খাবেন?

—না না, থাক থাক।

—আপনারা কথা বলুন।

দীনু ভেতরে চলে যায়। পরনে লুঙ্গি, কোমরে গামছা, পলটুর একদা পরমানুগত কর্মী দীনু! কর্মী সম্মেলনে যে পলটুকে বলেছিল, আপনি ক্ষমতালোভী হয়ে যাচ্ছেন, নেতৃত্ব দিতে পারছেন না…রাজনীতিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন…

সে কর্মী সম্মেলনে কি ফাটাফাটি ঝগড়া।

তার পরেই দীনু দল ছেড়ে দেয় ও ”প্রতিবাদী” কাগজ বের করে।

প্রতিবাদী! কি উগ্র নাম! শহরে প্রচুর সাড়া ফেলে কাগজটি। তারপর ”কে বা কাহারা” ওর কাগজ যেখানে ছাপা হত, সে প্রেস জ্বালিয়ে দেয়, দীনুকে মারে বেদম।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে দীনু, ”কে বা কাহারা”র একজনকে বেদম মেরে লিখিয়ে নেয় কি ভাবে কার নির্দেশে কাজটি করা হয়েছিল।

সে সমরও নেই, সে শিলিগুড়িতে চলে গেছে। শিলিগুড়ি এখন পয়সার সমুদ্র। ছিপ ফেলতে জানো যদি, নোট উঠে আসবে।

বছর দেড়েক দীনু নিপাত্তা থাকে।

তিনু বলে, দাদার মাথা আছে বটে! সাবানের গুঁড়ো…মানে ডিটারজেন্ট…ঝলক দেখেন নি? ঝলক সাবান তো দাদা আর তার বন্ধু এজেন্সি নিয়েছে।

—কোথায়?

—শিলিগুড়িতে।

—আছে কোথায়?

—সমরের কাছে।

—সমরের কাছে?

—হ্যাঁ পলটু দা।

এটা কেমন করে হতে পারে তা ভেবে পায় না পলটু। সমর দীনুকে মারল, দীনু সমরকে মারল, এ থেকে তা ”বাগে পেলেই খুন করব” এই ব্যাপারটা স্বাভাবিক। সেটাই এখনকার নিয়ম। সে নিয়ম পালটে গেল কেমন করে?

পলটু সমর বিষয়ে অত্যন্ত হতাশ হয়। সমর কি, মানুষ, না কেঁচো?

সমর শহরে এলে ও চেপে ধরে। সমর মৃদু হাসে, হাতের সময়, তারিখ, বছর, সব ডায়ালে শোভিত চোরাচালানী ঘড়ির দিকে তাকায় ও বলে, দীনু! দীনু আর আমি মিউচুয়াল করে নিয়েছি।

—দীনুর সঙ্গে মিউচুয়াল!

—হয়ে গেল!

—কি করছে ও?

—ঝলক সাবান। খুব চলছে।

যাক! তোমরাই দেখালে।

—ও আমাকে বাঁচিয়েছে পলটু দা। তিনটে মাতালের খপ্পরে পড়েছিলাম। তারা পেটাচ্ছিল। দীনু না থাকলে সেদিন…

—দীনু তোমায় বাঁচাল?

—হ্যাঁ। কতদিন ধরে সেবা করে…গলার হাড়, কবজি, সব ভাঙা। ও খাইয়ে দিত।

—যাক গে! ওই কাজেই লেগে থাকুক।

লেগে থাকে না দীনু। দীনু অনন্তমূল। যত উপড়াও, তত ফনফনিয়ে গজিয়ে উঠবে।

ঝলক এজেন্সিতে ওর অংশ বেচে দিয়ে ও চলে আসে। বলে, জন্মভূমির টান কি ছড়াতে পারি?

এবারে ও ছোট একটি প্রেস করে। জব প্রেস। টাইপ নেই। পলটু ওর ওপর নজর রাখে।

চলছে চলছে, দোকানের, সার্কাসের, মাখী মেলার ইস্তাহার ছাপা, লেটারহেড ছাপা, লন্ড্রীর বিল ছাপা।

দেখে শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে পলটু কুন্ডু স্পেশালে দক্ষিণভারত চলে যায় সপরিবারে। মন্দিরের দেশ, বেড়াবার দেশ। কন্যাকুমারিকা, রামেশ্বরম, মাদুরাই, পন্ডিচেরি, মাদ্রাজ থেকে মহাবলীপুরম।

ভ্রমণের ফলে মনে আনন্দ ও বাক্স বোঝাই উপহার সামগ্রী নিয়ে ফিরতে না ফিরতে পলটুর জীবন বিষময় হয়ে যায়। পাশের মহকুমা টাউন থেকে দীনু আবার ”প্রতিবাদ” বের করছে।

—গ্রামোন্নয়নের টাকা কোথায় গেল?

—হিমাচল রেডিও এজেন্সির মালিক কে?

—ময়াহাটা পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে চোলাই মদের ফলাও কারবার সম্পর্কে প্রশাসন নীরব কেন?

—আদালতের উলটো দিকে খাস জমিতে বেনামী দোকানগুলি ভাঙা হচ্ছে না কেন?

—প্রবীণ সমাজসেবী অমলকান্তি বর্মার হত্যা সম্পর্কে গোপন তদন্ত চালিয়ে জানা যায়…

দলীয় আপিসে চাঞ্চল্য। মেজ শরিক সন্দেহজনক ভাবে নীরব, যদিও হিমাচল রেডিও এজেন্সির ব্যাপারটি মেজ শরিকের এক পান্ডার। কিন্তু প্রথম, চতুর্থ ও পঞ্চম সংবাদটি তো পলটুর আঁতে ঘা দেয়া।

পলটু ক্ষেপে যায়। তার ক্ষমতার দৌড় সে দীনুকে দেখিয়ে ছাড়ে। অন্য মহকুমায় কাগজ ছাপা হবে, প্রকাশ হবে এই মহকুমা থেকে? শহরে ঢোকার মুখেই ”প্রতিবাদ” বাহী ম্যাটাডোর লুঠ হয়ে যায়, ড্রাইভার মার খায়, গাড়িটি জ্বলে যায়।

”অত্যাচারে প্রতিবাদী কণ্ঠ রোধ করা যায় না” হ্যান্ডবিল শহরে ছড়িয়ে দিয়ে দীনু আবার চলে যায়। এবারে পলটু ওর সম্পর্কে ”সন্দেহজনক; বিক্ষুব্ধ, উগ্রপন্থী” লেবেলগুলি সাজিয়ে ফেলে এবং দৃপ্ত আনন্দে বলে, সাপের কোমর ভেঙে দিয়েছি।

এতকাল বাদে বনানী ঔষধালয়ে সেলসম্যান হয়ে দীনু আবার এ শহরে।

রায়বর্মা বলেন, কি ভাবছ?

—না…কি আর…

—দীনুর কথা…

—একটু অপ্রত্যাশিত তো বটেই!

—হ্যাঁ, কথাবার্তাও ভালো নয়।

—আপনি বলছেন?

—আমাকে কি কম বলে?

—আপনি শুনে যান?

—কি আশ্চর্য পলটু! পৃথিবীর সকলে আমার কথামতো জল উঁচু, জল নিচু না করলে আমি বিচলিত হই না। তুমি অবশ্য হও। অন্যের নিজস্ব মতামত পছন্দ কর না। যাকগে, কি জন্যে এসেছিলে?

—পরিবেশ দূষণ বিষয়ে সভা…

—হ্যাঁ, গাছের ভূমিকা!

—শুনেছেন তা হলে?

—শুনেছি। কিন্তু দেশের যা অবস্থা, গাছ অবশ্য চাই, কিন্তু গাছ লাগালেও তো দূষণ কাটবে না।

—গাছ তো দরকার।

—কিন্তু রাজনীতি যে পার্থেনিয়াম। সেখানকার দূষণ কাটাবে কোন ওষুধে?

—চেষ্টা তো করতে হবে…

—কে চেষ্টা করবে? বাজে বোক না।

—শ্যামাদাস গায়েন আসছেন।

—পাগলা শ্যামাদাস?

—না না, বৃক্ষবন্ধু!

বুঝেছি। এখন তার আমাকে চাই।

—আমাদেরও।

—পলটু! শ্যামাদাস না বললে তুমি আমার কাছে আসতে কি?

—যেতে হবে দাদা।

—দেখি।

—আপনিই নাকি ওঁকে…

—আরে না না। মেধাবী ছেলে, অ্যাপ্লায়েড বটানি থেকে গাছপালায় ঝোঁক…তা আমিই বললাম, গাছ আমাদের কেন দরকার তা নিয়ে…তখন এত পরিবেশ চেতনা আসেনি এ দেশে। এল যখন, তদ্দিনে প্রাকৃতিক বনও সাফ, দেশ ঘরের গাছপালাও…ও শহরেই কি গাছ কম ছিল?

—তাহ’লে যাচ্ছেন?

—যাব…যথেষ্ট আড়ম্বর হবে নিশ্চয়ই…পলটু, আমি এখন আর কিছুতেই নেই। কিন্তু কৃষক সম্মেলনে মাছের মুড়ো, যে কোন সম্মেলনে আড়ম্বর, এগুলো ঠিক হচ্ছে না।

—চলি দাদা।

—এসো।

সে সভাতেও যথেষ্ট আড়ম্বর হয়েছিল। পরিবেশ দূষণ রোধে গাছের ভূমিকা নিয়ে শ্যামাদাস গায়েনের কথা সবাই খুব বোঝেনি। পলটু যখন বলে, তখনো সভা চুপচাপ। কিন্তু ওর কথা শেষ হতেই একটা গলা শোনা গিয়েছিল। চেনা গলা, চেনা মুখ। দীনু।

—একটা প্রশ্ন।

সবাই খুব চমকে যায়। সভাপতি বলেন, বলুন।

—পরিবেশ দূষণ রোধে গাছ যখন দরকার, তখন বন খুবই দরকার তা বক্তা বললেন এবং কুকমারি জঙ্গলে কি ভাবে বনসৃজন হচ্ছে তাও বললেন।

—হ্যাঁ, খুবই প্রশংসনীয়।

—আমার এবং অনেকেরই প্রশ্ন, অরণ্যনীতি এ মহকুমায় কি রকম? উত্তরবঙ্গের অন্যতম সমৃদ্ধ জঙ্গল কুকমারি থেকে প্রত্যহ গাছ কাটা হচ্ছে, এ শহরে চোরাচালান আসছে, বেআইনী স—মিলে চেরাই হচ্ছে, প্রত্যহ ট্রাকে চালান যাচ্ছে। সে বিষয়ে কারা জড়িত, কেন তা বন্ধ করা হচ্ছে না, ট্রাক কার, স—মিল কার, কেন এই চোরাকারবারীকে ধরা হচ্ছে না, আমরা তা জানতে চাই।

রথীন দাঁড়ায়, এ প্রশ্ন আমাদেরও।

তারপর হঠাৎ গণ্ডগোল বেধে যায়। পলটুর ছেলেরা ”সভায় ডিসটার্ব করা চলবে না” বলে ওদের টানতে থাকে। রথীন চেঁচায়।

—জবাব দিন পলটু দা। এ প্রশ্ন হাজার জনের। কুকমারি জঙ্গল ধবংস করছে কে?

—সভা চলতে দাও রথীন।

—না, আমরা অনেক কথা শুনছি, জবাব দিতে পারছি না।

সভাপতি কি বলতে যান। শেষ অবধি মারামারি ঠেকানো যায়। রায়বর্মা উঠে দাঁড়ান ও ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলেন, কুকমারি জঙ্গল বিষয়ে সব খবর এতেই পাবেন। সুপরিকল্পনায় কয়েক হাজার গাছ কাটা হয়েছে এক মাসে। বন নির্মূল করে কয়েকশো গাছ লোক দেখিয়ে লাগালে বন বাঁচবে না। চোরাচালান যাচ্ছে চোরাই শিকারের মাংস, চামড়া, সিং। এবং একথা শহরে কোন দলেরই অজানা নয়।

—নাম বলুন, নাম বলুন!

এটা মধুর গলা।

পলটু চোখ তোলে। সামনেই জয়া, লিলি। জয়ার চোখ বড় বড়। ওদের পাশে রায়বর্মার তিন মেয়ে, সীতা, গীতা, নীতা। বাবা পণ দেবে না বলে ওদের বিয়ে হয় নি। আর কোন দিন বিয়ে হবে না এটা ওরা যৌবনেই মেনে নেয়।

কারোই ভাব ভালোবাসা করে বিয়ে করার মানসিকতা ছিল না। মা ওদের দাদার কাছে থেকেই মারা যান।

তিনটে মেয়েই যৌবনেই বুড়িয়ে গেল। এখন ওদের দেখলে মনে হয় তিন বিধবা। বাবাকে কেন্দ্র করেই ওদের জীবন। যে যার টাকা যতটা পারে জমায়। বাপ মরে গেলে ওরা কি করবে কে জানে।

ওরা ওদের বাপের দিকে চেয়ে আছে।

মধু আবার ক্রুদ্ধ গলায় বলে, নাম বলুন।

রায়বর্মা তাকাল।

—এটা জনসভা, বাজার নয়। যা জানাবার, ম্যাজিস্ট্রেটকে জানালাম। নাগরিকদের আবেদন দিলাম। প্রশাসন কি ব্যবস্থা নেন, দেখার জন্যে আমরা অপেক্ষা করব।

”সত্যবার্তা” ও ”কৃপাণ” কাগজের পরের সংখ্যাতেই নাগরিকদের স্মারকলিপি বেরিয়ে যায়।

পলটুকে বাচ্চু বলে, মেরে টেংরি খুলে দিই?

—কার? রায়বর্মার? না।

—রথীন, দীনু, মধুর?

—না।

যথারীতি ম্যাজিস্ট্রেট এ বিষয়ে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেন না। কিন্তু ”কে বা কাহারা”র কথায় গাছ কাটতে গিয়ে সাতপুরুষে এদেশী হয়ে যাওয়া কিছু বাদিয়া, সাঁওতাল ও স্থানীয় রাজবংশী চালান যায়।

ওরা অরণ্য ধবংস করছিল।

পলটু শহরে যুবকদের দিয়ে একটা দৃপ্ত শোভাযাত্রা করায়, ”কুকমারির জঙ্গল ধবংস করা চলবে না। চলবে না!”

যারা ধরা পড়ে তাদের কথা সবাই ভুলে যায়। লাডিয়া অবিচলিত। কেন না গাছ কাটার জন্যে সকুঠার কালো হাত অনেক পাওয়া যাবে।

রায়বর্মার কাছে ধনচাঁদ মুর্মু, এসে হাজির হয়। তেভাগার কারণে ডুয়ার্স থেকে বিতাড়িত যে সব মুর্মু, টুডু, বাদিয়া, বর্মন কেরকেটা, খাওনি একদিন কুকমারি জঙ্গলের আশপাশে বসত করেছিল। তাদের বৃদ্ধ প্রতিনিধি ধনচাঁদ।

তারাই বলে, যাও, যাও তুমি। আমাদের ছেলেদের কি দোষ? তারা আটকে পচলে আমরা খাব কি?

—কোথা যাব?

—রায়বর্মার কাছে যাও।

রায়বর্মা ও ধনচাঁদ এক সময়েই জেল খেটেছিল। রায়বর্মা রাজনীতিক পেনশান প্রত্যাখান করেন। ধনচাঁদকে কেউ পেনশান নিতেই বলে নি।

দু’জনেই ক্ষমতাহীন, ব্যর্থ। তবু ধনচাঁদ ওঁর কাছেই আসে। বলে, রায়বর্মা বাবু হে! আর্জি আছে।

”আর্জি আছে” শব্দ দুটি বড় ভয়ংকর। কিসের আর্জি? কার কাছে আর্জি? এ কি অবিভক্ত পার্টির তেভাগার দিন। যে কৃষক সভার সম্পাদক রায়বর্মা মাঠে ঘাটে বসে বিচার করে দেবে। সে বিচার মানা হবে?

”জান দেব তো ধান দেব না”র দিন নয়! নয় ”ময়নবাড়ির রাখব মান তৈরি আছে শত কিষাণ”—এর দিন।

এখন সব কেনাবেচা বেচাকেনার দিন। তবু ধনচাঁদ ওঁর কাছেই আসে।

ধনচাঁদ লবণ ও কালো চা’র কড়া অনুপান খায়। ফাটাচটা পায়ের দিকে চেয়ে বিড়ি ধরায়। তারপর হলুদরঙা চোখ তুলে বলে।

—গোষ্ঠ বাদিয়া, কুটুম্ব বাদিয়া, সখীন বাদিয়া, মঙ্গল মুর্মু, লখা টুডু, হরতন বর্মন, যমরাজ বর্মন।

—চালান গেছে?

—লাডিয়া বাবু গাছ কাটাল।

—জানি।

—এখন উপায়?

রায়বর্মার একটা মন বলে ঘাড় পেত না। পরের ঝামালি ঘাড়ে নিও না।

মনের ভিতরের মন বলে, বাঁধনা পরবে গুরু জাগানিয়া গান হচ্ছিল। ধনচাঁদ মদ খেয়ে নাচছিল। তুমি, রায়বর্মা! তিনটি ছেলেকে নিয়ে গেলে।

—ধনচাঁদ বলল, পুলিশ মারবে, নয়?

—তুমি বললে, হ্যাঁ ধনচাঁদ।

—ও বলল, জঙ্গলে পশাই দিব?

—তুমি বললে, বন পারাই দাও।

—তো তাই করল ধনচাঁদ। কুকমারি বন ওদের পার করে দিল। তোমার কথায়।

পরে পুলিশ ওদের নকড়াছকড়া করে। সেই থেকে পুলিশের খাতায় গ্রামগুলি অপরাধ প্রবণ। চিহ্নিত কয়েকটি গ্রামে বর্গাদার নেই, উন্নয়ন নই, পঞ্চায়েতী কাজ নেই, বাঁচার উপায় নেই।

চিহ্নিত কয়েকটি গ্রাম থেকেই লাডিয়ারা সকুঠার হাত ভাড়া করে। চোরাচালানে কাজে লাগায়। চোলাই কারবারে নিযুক্ত রাখে।

রায়বর্মা বাবু হে! রাত কাটলে দিনের দিশা তোমরাও দেখাতে পারলে না, আমরাও আর খুঁজিনা দিশা, তবু সাত সাতটা মানুষ!

রায়বর্মা বলেন, কেস দিয়েছে?

—না, দেয় নি।

দেখি। দিনু, রথীনকে ডাকো।

রথীন আসে, মধু আসে। খুব আলোচনা হয়। রায়বর্মা নিজে সদরে যান।

ম্যাজিস্ট্রেট, দরবার, দৌড়োদৌড়ি। রায়বর্মা থাকাতে কেসটি অন্যরকম হয়ে যায়। অবশেষে ওদের নিয়ে শহরে ফেরেন রায়বর্মা।

বলেন, চলো। গ্রামে রেখে আসি।

দীর্ঘকাল বাদে গ্রামে যান রায়বর্মা। সঙ্গে দীনু ও রথীন। জঙ্গলের কোলে গ্রাম ছিল। কোথায় গ্রাম, কোথায় জঙ্গল।

রায়বর্মা বলেন, রথীন! তোমরা সক্রিয় না হলে কুকমারির যেটুকু আছে তাও থাকবে না।

—না, থাকবে না।

দীনু বলে, ওই পলটু দত্ত!

—জঙ্গল থাকবে না।

—দেখা যাক।

ধনচাঁদ বলে, আগে ট্রাকে বন্দুক থাকত, এখন তাও থাকে না। থাকবে কেন? কে ধরছে?

দীনু বলে, দেখা যাবে। কুকমারিতে থাকতে পারলে…

ধনচাঁদ বলে, থাক না কেন?

—কুকমারি গ্রামে।

কুকমারি জঙ্গল। কুকমারি গ্রাম। সেখানেই থানা, পোস্টাপিস, তালা বন্ধ গ্রামীণ কৃষি সমবায় লোন আপিস, পঞ্চায়েতের নতুন বিলডিং।

রায়বর্মা বলেন, বনানী ঔষধালয়?

দীনু বলে, বনানী ঔষধালয়ের কাজেই তো আসব যাব। ওষুধ বেচার কাজ কি ছাড়তে পারি।

রথীন বলে, কত পাও?

—মাইনে চারশো। কমিশন আছে।

—ওষুধ চলে?

—চালালেই চলে।

—দিনু দা! এ কাজটাও ছেড়ে আবার শহরে ফিরলে পলটুদা এবার কেলিয়ে দেবে।

—কাকে দিয়ে? বাচ্চুকে? বাচ্চুর পিঠে এখনো আমার চাবুকের দাগ আছে।

—বাচ্চুই তো পলটুদার…

—নির্বাচিত যুবনেতা।

—হ্যাঁ।

—স্বাভাবিক।

এ কথা এখানেই শেষ হয়। পলটু দেখে দীনু ওষুধের দোকানে ঘুরছে। উপহার দিচ্ছে ডেসক ক্যালেন্ডার, কাগজচাপা, হেনতেন?

সব ভেষজ ওষুধ ওদের। আমাশায় ওদের বাড়ি, কাশিতে সিরাপ, বাতে মলম না কি আশু ফলপ্রদ।

এই থাকছে দীনু, এই থাকছে না।

একদিন বলল, শতখানেক বিঘা জমির ব্যবস্থা করে দিন তো? নয়নতারা চাষ করব। শিকড় চালান দেব। একশো বিঘে জমি পেলে অনেক লোক কাজ পাবে।

—জমি কি আমার ট্যাঁকে থাকে?

—স্টেডিয়াম তো হবে না, ওই মাঠটাই…

—বাজে বোক না দীনু। তিনু বলছিল…

—কি?

—তুমি ওকে বাড়ি ছেড়ে দিতে বলছ?

—আমার অংশটা কিনতে বলছি।

—কেন দীনু?

—এ শহরে আমার কি বা আছে? টাকা নেব, যেখানে পারি জমি নিয়ে…

—নয়নতারা চাষ করবে?

—নয়নতারা।

—কিনবে কে?

—বিদেশে যাবে। যাচ্ছে তো।

—তিনু কিনতে পারবে?

—ও না পারে বাইরে বেচে দেব।

পলটুই তিনুকে চাপ দেয়। কিনে নিক তিনু। দীনু চলে যাক শহর ছেড়ে। দীনু মানেই হাওয়াবদল। রথীন, মধু, সব বিগড়ে যাওয়া। দীনু মানেই রায়বর্মার বাড়িতে থাকা। দীনু মানে হঠাৎ হঠাৎ পলটুর বাড়িতে ঢুকে পড়া ও লিলির মতো মেতে ওঠা।

বয়সের তুলনায় ছেলেমানুষ, উচ্ছল লিলি।

—দীনুদা কি বলে জানো বাবা?

—কি বলে?

—পেঙ্গুইনরা না কি স্বয়ংবর সভা ডেকে বিয়ে করে। ও নিজে দেখে এসেছে।

—বটে! ও গিয়েছিল?

—যাবে কেন? বাবা, তুমি কি বোকা! ও সিনেমায় দেখেছে বুঝলে?

জয়া ঈষৎ হাসে। বলে, লিলি! তোকে বোকা বানানো বড্ড সোজা।

—কেন?

দীনু বলে একটা বই কিনেছে। বিশ্ববিচিত্রা ও সাধারণ জ্ঞান, তাই থেকে সব বলে।

—দীনু আসে কেন?

—বাঃ! দীনুদা আমার বন্ধু। আমার সঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলে, অঙ্ক বলে দেয়।

—তোমার মাকে তো বলা না বলা সমান। বাড়িতে যে—সে ঢোকা…

—আমি ডেকেছি, তাই এসেছে। মা তো ডাকে নি। দীনুদা আগে আসত না?

জয়ার মুখে চাপা হাসি।

—দীনুদা, রায়বর্মা জেঠা, আমি আর মা কুকমারি যাব বেড়াতে, বুঝেছ বাবা?

—বটে?

—যাব, বেড়াব, সাঁওতালদের বাড়ি যাব।

—না, যাবে না। আমার সম্মতি না নিয়ে তুমি কোথাও যাবে না।

—বাবা! তুমি খুব ফিউডাল হয়ে যাচ্ছ।

—লিলি!

—ফ্যাসিস্তও হয়ে যাচ্ছ।

—এত কথা শিখলে কোথায়?

—তোমার তিনটে লেকচার শুনলেই এ সব কথা শেখা যায়, তাই শিখেছি।

—মায়ের মেয়ে হচ্ছ!

—বাঃ! মার মেয়ে হব না তো কার মেয়ে হব?

—তুমি যা হচ্ছ দিন দিন!

নির্ভয়, বেপরোয়া লিলি। ছোটবেলা থেকে ভূতের ভয় ছিল না, ভয় ছিল না অন্ধকারে।

বাবা মার ভেতরের সম্পর্ক যে খারাপ, তা ও ভালোই বুঝত। বুঝে ও মার দলে চলে যাচ্ছিল, মার দিকে। পলটু দত্তের সেটা মস্ত পরাজয়।

এমনি করেই তিনমাস কেটে যায়। এসে পড়ে পনেরোই আগস্ট।

স্কুল পরপর চারদিন ছুটি। স্বাধীনতা দিবস, স্কুল প্রতিষ্ঠা দিবস, স্কুল প্রতিষ্ঠাত্রীর জন্মদিবস। রবিবার। তার আগেই লিলির স্কুলে ছুটি নিয়ে জয়া আর লিলি শিলিগুড়ি চলে যায়।

জয়ার অধ্যাপিকা বন্ধু গায়ত্রীর বাড়ি।

গায়ত্রীর কাছে ও মাঝে মাঝেই যায়, থাকে। গায়ত্রীকে লিলিরও খুব পছন্দ। গায়ত্রীর মেয়ে ওর বন্ধু, দুজনেই খেলা পাগল।

গায়ত্রী খুব শক্ত মেয়ে, স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স মামলা করে মেয়েকে আদায় করেছে! ওর বাবা কার্শিয়াঙে থাকেন। অবসরপ্রাপ্ত জজ। ঘনঘন কার্শিয়াং যাওয়াও লিলির কাছে কম আকর্ষণের নয়।

পনেরোই আগস্ট সমারোহে বৃক্ষরোপণ হচ্ছে। পলটু দত্ত গাছ লাগাবে। জেলার সাতটা কাগজের সাংবাদিক হাজির। ভ্যান্টার স্টুডিও থেকে ছবি তোলা হবে। সংগীত বিদ্যালয়ের বালিকারা ”মরু বিজয়ের কেতন উড়াও” গাইবে। উবু হয়ে গর্তে গাছ বসানো, ক্যামেরার দিকে সহাস্য মুখে চাওয়া, গরদের পাঞ্জাবী বাঁচানো, পলটু সব সামলাতে গিয়ে ঘেমেঘুমে অস্থির।

এরই মধ্যে ভিড় ঠেলে বাচ্চু এগিয়ে এসেছিল। কানে কানে বলেছিল, জলদি সারুন।

—কেন?

—কেস বিলা হয়ে গেছে।

—কেন?

—কুকমারি থানায় লাডিয়ার চারটে ট্রাক আটকেছে দীনুরা। পুলিশ ওদের সাথে।

—পুলিশ।

—বিশ্বাসকে জানেন না? খচ্চরের গাছ শালা। সব জায়গায় কাজ দেখাতে যায়।

—বিশ্বাস তো বদলি হয়ে গেছে।

—ছাই! বদলি লোকই আসে নি।

বিশ্বাস! কুকমারি থানায় লাডিয়ার লরি আটক! দীনুরা ওখানে!

—রায়বর্মাও বসে আছেন।

সাংবাদিকরা এগিয়ে আসে।

—কি হয়েছে কুকমারিতে?

কিছু না…

পুলিশ কি করেছে?

পলটু পাঁচ পাবলিককে জটলায় ব্যস্ত রেখে বেরিয়ে আসে। বাড়ি, আগে বাড়ি।

—না, লাডিয়া বসে আছে, চলুন।

লাডিয়ার থমথমে মুখ। চাপা গলায় হিংস্র আক্রোশ।

—প্রোটেকশান ভি দেবেন না, বাট্টা ভি নেবেন, বেইমানি ভি করলেন?

—বেইমানি?

—নয় তো কি আছে?

চোরা ব্যবসায়ী ছাড়া আজ রাজনীতিক নেতাকে কে এমন দাবড়ে কথা বলতে পারে? নেতা কার দাবড়ানি সহ্য করে চোরা কারবারী ছাড়া?

—বেইমানি নয়? রথীন, মধু, ওই রায়বর্মাবাবু, সব আপনার পার্টির লোক নয়? ভাবছেন আমাকে ফাঁসাবেন? না দাদা, না। লডিয়া বেওসা বুঝে। আপনাকে ছেড়ে দিব, বাচ্চুর বাবাকে ধরব।

—আমি সত্যিই জানি না।

—আমার আপনাদেরকে থোড়াসে দরকার। আপনাদের আমাকে বহোত দরকার।

—আমি জানি না।

লাডিয়া ধমকে বলে, তবে যান। গিয়ে জানুন। গিয়ে সামলান। আমার কি! আমি ড্রাইভারের উপর দিয়ে চালিয়ে দিব। তবে আপনাকেও ফাঁসাব।

—রায়বর্মা দাদা!

—বহোত দিন সে খেল জমছে। আপনি খবর রাখেন নি কেন?

ইনটেলিজেনস ব্যর্থ, অক্ষম হয়েছে। সংবাদ সরবরাহকারী ইনটেলিজেনস বিভাগ যখন খবর দেয় না, তখন বিপর্যয় ঘটে যায়। জরুরি অবস্থার সময়ে উক্ত বিভাগ বলেছিল ”সব ঠিক হ্যায়। নির্বাচন হতে পারে।” সে জন্যেই প্রধান মন্ত্রী জরুরি অবস্থার অবসান ঘটান। নির্বাচন ডাকেন, এবং…এবং…

পলটু তো সে তুলনায় কীটপতঙ্গ।

তার চামচারা শুধু পকেট গুছিয়েছে, খবর রাখে নি কোনো। তার জন্যেই পবিত্র স্বাধীনতা দিবসে, বৃক্ষরোপণের মতো মহান কাজে বাগড়া পড়ে। কুকমারি জঙ্গলের চোরাই কাঠবাহী লাডিয়ার ট্রাক আটকা পড়ে।

প্রতি ট্রাকে আশি হাজার থেকে লাখ টাকার মাল। প্রাচীন মেহগনি, প্রাচীন শাল।

—কখন আটকা পড়ল?

—রাতে। খবর এখন এল।

—চলে যান স্পটে।

বাচ্চু বলে, আমাকে বলল মধু!

—মধু!

—হ্যাঁ। ওতো শহরে বলতে বলতে…

লাডিয়া বলে, আমি বাড়ি গেলাম। আপনি এই গাড়ি নিয়ে চলে যান।

শহরে সেদিন কি উত্তেজনা। পলটু লাডিয়ার গাড়িতে। ম্যাটাডোর করে বাচ্চুর বাবা সাংবাদিকদের পাঠায়। রাজনীতিতে কোন দয়ামায়ার জায়গা নেই। বাচ্চুর নয়। মধুও ম্যাটাডোরে। ও প্রকৃত ঘটনা বলতে বলতে আসছিল।

পলটু পাথর, পাথর, হিম, হিম।

বিশ্বাস!

অন্তর্দলীয় সংঘাতে, খুনোখুনির পর ”সত্যবার্তা” রিপোর্ট লিখল, মেজশরিক মিটিং করল।

বিশ্বাস কি ত্যাঁদড়ামিটা না করল! না, সে রিপোর্ট পালটাবে না। হ্যাঁ, সে খুনীদের ধরেছে। শহরের পি.টি.আই সংবাদদাতা কালুদা যদি খবরটি বড় কাগজে পাঠিয়ে থাকে সেবিষয়ে সে কিছু জানে না।

কোনো অন্যায় করে নি সে। নিজের যা ডিউটি তাই করেছে। হ্যাঁ, সে সগর্বে বলে থাকে উত্তরবঙ্গে তার মতো ঘনঘন বদলি কম লোকই হয়।

—ডিউটি করতে গেলেই বদলি, এ তো আপনাদের রাজত্বে নিয়ম এল। কি করব, বলুন?

কত দৌড়াদৌড়ি করে ওর বদলি করানো গেল। কেস তো মায়ের ভোগে গেলই। পলটু কি শহরে বসে নেই? পলটুকে নির্বাচনে দাঁড়াতে হয় না। নির্বাচন ব্যতীতই সে মহকুমা মুঠোয় রাখে।

বিশ্বাসের বদলি আসে নি, এ কেমন কথা? এ প্রশাসনকে নিয়ে পারে না, পারে না পলটু। এ তো তাকে অপমানও করা।

বাচ্চু বলে, আসবে কেন? এখানে কি আছে?

জঙ্গল আছে, লাডিয়া আছে, ট্রাক আছে। কুকমারি থানা এমন কি মন্দ? কুকমারি জঙ্গল ক্রমশ মরুপ্রান্তর হতে পারে, তবু জঙ্গলের কারণেই বহু কালোটাকার উজান ভাটা চলে।

থানাও খায়।

জঙ্গল আপিসের বিট অফিসার, গার্ড, কে না জানে কি হচ্ছে? কয়েকজন বনরক্ষী খুন হবার পর ওরা বনরক্ষার চেষ্টাও করে না।

ফরেস্ট বাংলোর মনোরম পরিবেশে লাডিয়ার আমন্ত্রণে যদি শহরের রুই কাতলারা আনন্দ করতে আসে, তাহলে ওই বাংলো প্রান্তে বাগানের কোয়ার্টারে বসে বনরক্ষীরা তো সবই দেখে।

ওরা নীরব থাকে।

বিট অফিসার বাড়ির হাতায় বেগুন লাগায়।

এখন শুধু অবাধ লুটোর দিন।

স্বাধীন সবাই, ভীষণ রকম স্বাধীন।

এখন শুধু দেখে যাওয়ার দিন।

কুকমারি থানার হাতায় আটক ট্রাক। মাল আটক।

থানার বারান্দায় অনেক চেয়ার।

বিশ্বাস সহাস্যে অভ্যর্থনা জানায়।

—আসুন, আসুন, সবাই। বাঃ, এটা যে লাডিয়ার নতুন গাড়িটা। আসুন সবাই।

পলটু বলে, কি হচ্ছে?

—গাড়ির নম্বরটা লিখে নিই। হাড়িকাঠে মাথা, খাঁড়া আপনার হাতে, নিজের দিক থেকে যতটা…

ম্যাটাডোর থেকে সবাই নামে। রায়বর্মা এক পা চেয়ারে তুলে এক পা ঝুলিয়ে বসে আছেন। রথীন, দীনু, তপু, ধনচাঁদ, আরো অনেক লোক। কুকমারি ভেঙে লোক আজকে থানায়।

কে বলে, পাবলিকের কি কম রাগ আছে? বারোআনা খাও, চারআনা দাও, সকলকে ঠান্ডা রাখো। তা লাডিয়া ষোলআনাই খাবে।

—মেড়া খায় আর খুঁটি খায়। মেড়া লড়ে খুঁটি জোরে, জানো না?

—মেড়া তো আসেনি, গাড়ি করে খুঁটিকে পাঠিয়েছে।

পলটু বিষে জ্বলে যায়। কিন্তু পাঁচ পাবলিকের সামনে ওকে অন্য ভূমিকা পালন করতে হবে, অন্য মুখোশ পরতে হবে।

—কি ব্যাপার, বলুন তো বিশ্বাসবাবু?

—আমাদেরও বলুন।

সাংবাদিকরা ভিড় করে আসে। মধু, রথীন, দীনু ও তপু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। বিশ্বাসকে ওরা মঞ্চ ছেড়ে দেয়।

—বলছি। অনেকদিন ধরেই সন্দেহ করছি, বিশেষ কয়েকটি ট্রাক কুকমারি থেকে গাছ পাচার করছে। মজা হচ্ছে, প্রতিবার ট্রাকে নতুন প্লেট থাকছে। চ্যাসিস নম্বর থেকে চেক করে জেনেছি…মানে সেবার যখন ট্রাক ধরে ওই বাচ্চুবাবুর হাতে বাজারে মার খেলাম…ট্রাকের মালিক লাডিয়া।

সাংবাদিকরা লিখতে থাকে।

—কুকমারি জঙ্গলের কাঠ পাচার নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। থানার নামেও অনেক দুর্নাম। তবে আমার আমলে থানা টাকা খায় নি। সেজন্য এবং অন্য কারণেও আমার বদলির ব্যবস্থা করা হয়। লিখছেন তো, লিখুন।

—বলে যান। খেলা জমছে।

—এবারে গত রাতে পাবলিকই ট্রাক ধরে, থানা থেকে আমি যাই।

পলটু বলে, কে কে ধরল?

—পাবলিক।

—পাবলিক মানে?

—পাবলিক।

পলটু চেনা চেনা মুখের সারির দিকে তাকায়। বিশ্বাস বলে, গ্রামের লোকজন ধরেছে। এঁরা তো সকালে এলেন। যাক…ট্রাক থানায় আনলাম। ট্রাক আটক থাকবে। ড্রাইভাররা চালান যাবে। এদের কাছে কোনো কাগজপত্র নেই। এরা কিছু বলছেও না।

—পলটুবাবু কিছু বলুন।

—আমি কি বলব?

—যেমন, যার ট্রাক ধরা পড়েছে, আপনি তার গাড়িতে কেন এলেন?

পলটু ঈষৎ হাসে।

—শহরে বনমহোৎসব হচ্ছিল…খবর পেয়ে এ গাড়িটা সামনে ছিল…চেয়ে নিলাম…

—লাডিয়াও কি গাছ লাগাচ্ছিল?

—না না, তা কেন?

—এখন কি হবে?

—কি আশ্চর্য! কুকমারি জঙ্গলকে চোরাকারবারীর হাত থেকে বাঁচাতে আমরা সকলে চাই। চোরাচালান ট্রাক ধরা পড়েছে…বিশ্বাসবাবু তো ঠিক কাজই করেছেন। ধন্যবাদ দিই জনগণকে যে তাঁদের সম্পত্তি তাঁরাই রক্ষা করেছেন।

—এখন কি হবে পলটু?

—রায়বর্মাদা! আইন যা বলে তাই হবে।

—আইন! তা এমন একটা ব্যাপার, তুমি নেতৃত্ব দাও না।

—কিসে?

—যাতে ওরা চালান যায়, কেস হয়, লাডিয়া শাস্তি পায়, এই কাঠ বনবিভাগে জমা পড়ে, বিশ্বাসের বদলি রদ হয়…

বিশ্বাস বলে, এটা কি বললেন দাদা! পলটুবাবু আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন বলেই জঙ্গলে ফেলে রাখতে চাইছেন না। সে জন্যেই তো…

রথীনরা বলে, আমরাও দেখছি। এবার আমরা কলকাতা যাব। ডেপুটেশন নিয়ে যাব।

দীনু বলে, আগে সদরে।

রায়বর্মা বলেন, আরে সব শর্মা সমান। ম্যাজিস্ট্রেটকে মেমোরেন্ডাম দিই নি?

”কৃপাণ” বলে, পলটু দা! আপনি তো হরদম কুকমারি আসেন লাডিয়ার সঙ্গে। জঙ্গল যে কাবার, তা দেখেন নি? অবশ্য দেখবেন বা কি করে!

—কাবার হত না, যদি বনরক্ষীরা সতর্ক থাকত।

অন্যতম বনরক্ষী রমনী বর্মন বলে, আমরা? চার পাঁচজন আমাদের খুন হয়ে গেছে, ট্রাক আসছে, সঙ্গে বন্দুক থাকছে, আমাদের বাঁচাবে কে?

—আপনারাই তো মদত দেন।

—না পলটুবাবু, মদত বনরক্ষী দেয় না। বনবিভাগে রিপোর্ট করলে কাজ হয় না, জীবন বিপন্ন হয় আমাদের। মদত দেয় বড় বড় মাথা, তিন পয়সার বনরক্ষী দেয় না। বলতে পারেন টাকা খায়।

—খান কেন?

—খায় নি বলে দুটো রক্ষী খুন হয়েছে। তখন সব ওপর তলায় টাকা খায় মশাই। বনরক্ষী যখন খায় তখন তাকে ভাবতে হয় টাকা নেব না গুলি খাব।

”সত্যবার্তা” বলে, কি করে কি হয় সে তো সবাই জানে। লাডিয়ার স—মিলে টাউন ছেয়ে গেল। তার বিরুদ্ধে যতই বলা হোক, তাকে মদত দেয় কে?

—পলটু দত্ত, আবার কে!

—পলটু দত্ত, আবার কে!

—পলটু দত্ত, আবার কে!

রায়বর্মা বলেন, যাক। পাবলিকের কাজ পাবলিক করেছে। থানার কাজ থানা করেছে। আমরা আশা করব, রাজনীতিক নেতারা তাঁদের কাজ করবেন।

পলটু বলে, নিশ্চয় করব।

বিশ্বাস সেপাইদের বলে, ড্রাইভারদের থানা হাজত থেকে সদরে নিতে হবে। রায়! তুমি সঙ্গে যাও। কাঠের ট্রাকও সদরে যাবে। আমি নিয়ে যাব। আগে কাগজ রেডি করি।

—সদরে কেন?

—সদরেই তো যাবে। টাউনে তেমন লকআপ কোথায়?

লকআপে খুনজখম…সদরেই ভালো।

কিছুই হাতে থাকে না পলটুর। সব ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সব ও নিয়ন্ত্রণে এনে ফেলবে। এ মুহূর্তে নয়।

—তুমিও যাও পলটু। পরিস্থিতি তেমনই।

—আমরাও যাব।

মোটর, জীপ, ম্যাটাডোর মিছিল সদরের দিকে। সদরে যেয়েও সহজে ছাড়া পায় না পলটু। পাঁচ পাবলিকের সঙ্গে তাকেও থাকতে হয়।

এম.পি.ও ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারেন না এ কেমন খেলা। পলটু দত্ত সঙ্গে আছে, লাডিয়ার ড্রাইভার লকআপে যাচ্ছে, থানা কেস করছে।

বিকেল নাগাদ পলটু লাডিয়াকে ফোন করতে পারে, তার আগে পারে না।

লাডিয়া কলকাতা চলে গেছে।

—চলে গেছে!

বাচ্চু বলে, এখানে বসে কি করবে?

—তুমি বোঝ না।

—আপনার ওপর লাডিয়া টেক্কা দিল। ব্যবস্থা ওই করে আসবে। যতক্ষণে এদের ডেপুটেশন যাবে, তার আগে কাজ হাসিল।

পলটুর মাথার মধ্যে সব ঘুরপাক খায়। বাচ্চু যা বলছে সব সত্যি। এ সব কাজ পলটুরই করার কথা ছিল। লাডিয়া আর ওর ওপর তত ভরসা করে নি। পরাজয়, পরাজয়!

—সব কাগজে আপনার নামও বেরোবে।

—চুপ করবে তুমি?

—দেখবেন, বউদিও জানত।

—কার কথা বলছ?

—জয়া বউদি।

—না, সে জানত না।

—আলবাৎ জানত। তার কাছে রথীনরা যায়। তিনি রায়বর্মাবাবুর বাড়ি যান।

—সে জানত?

—লাডিয়াবাবু বলছিল, এ সময়ে পলটুবাবু ইচ্ছে করেই ফ্যামিলি শিলিগুড়ি পাঠিয়েছে।

—আর কি বলেছে লাডিয়া?

—ইচ্ছে করে কুকমারিতে ঝামেলা ঘটিয়েছে। তো আমি বললাম, কেন? ও আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, বাচ্চু পোলিটিকাল আদমি গোখরো সাপ। হাত থেকে দুধও খাবে ছোবলও মারবে।

—আমার সম্পর্কে?

—হ্যাঁ, দাদা!

—কেন, কেন আমি এ কাজ করব?

—নিজের ইমেজ তোলার জন্যে।

—তুমিও তাই বিশ্বাস কর?

শহরের লাফাঙ্গা মস্তান বাচ্চু। ”কৃপাণ” কাগজের কট্টর কংগ্রেসী মালিকের লালটু ছেলে বাচ্চু বর্তমানে পলটুর দলের লোক। বাপ বলেছে, এখন তুই ওদিকে থাকগে যা। ওদের জামানা যখন, তখন ওদিকে থাকা দরকার।

বাচ্চুকে পেয়ে পলটু রথীনদের ডাউন করে বাচ্চুকে আপ করেছে। রাজনীতিতে এখন মস্তানি, পেশল শরীর, রোয়াবি ও রেলা করার ক্ষমতা দরকার। মার দাঙ্গা সন্ত্রাস করা দরকার। রথীনরা এ সময়ে অচল।

পার্টি ভাঙিয়ে চাকরি নেব না, দুর্নীতিকে আমল দেব না, জনগণের কাছ থেকে দূরে সরে এসেছি,—অচল এ সব কথাবার্তা।

সেই বাচ্চু বলে, নিশ্চয় বিশ্বাস করি।

—কেন?

পলটু অতল খাদে পড়ে যাচ্ছে।

—এটা আপনি ব্যক্তি স্বার্থে করেন নি। দলের স্বার্থে করেছেন। দারুণ দিয়েছেন একখানা। জানতেন সব, ভাঙেন নি। পাবলিককে বোকা বানিয়েছেন। এখন পার্টির ইমেজও উঠল।

—ওই রথীনরা…

—সে তো ভালো হল।

লাডিয়া, লাডিয়া, কলকাতা, কোনো ভয়ংকর ক্ষমতাশালী লোকের ফোন,—কেস মায়ের ভোগে যাচ্ছে,—বিশ্বাস বদলি হচ্ছে,—গ্রেপ্তার হবে কয়েকটা বনরক্ষী (জামিন পাবে),—গ্রেপ্তার হবে কয়েকজন ধনচাঁদ (জামিন পাবে না),—ট্রাক আবার কাঠ নিয়ে শহরে ঢুকবে।

হবে, সব হবে। শুধু গোটা ছবিটায় পলটু কোথাও থাকবে না।

রায়বর্মা দাদার খেলা!

পলটু? পাবলিক তোমার ভূমিকাকে প্রশংসা করছে। তুমি পক্ষ বেছে নাও। লাডিয়ার পক্ষে যাবে, না তোমার মসীলিপ্ত ভাবমূর্তি, যা পার্টির ভাবমূর্তিতে কালি ঢেলেছে, সে কালিমা ধোবে?

সুযোগ একবারই মেলে পলটু।

লাডিয়াকে শত্রু বানিয়ে ছাড়বে? পলটুর মাথায় আগুন জ্বলে যায়। ষড়যন্ত্র এ সব, ষড়যন্ত্র। এ ষড়যন্ত্রে জয়াও আছে।

—আমি শিলিগুড়ি যাব।

—এখন?

—হ্যাঁ, ওদের নিয়ে আসব।

পেট্রল ভরে নিয়ে শিলিগুড়ি। ড্রাইভার অসন্তুষ্ট। ঠিক আছে, আমিই চালাব।

পথ লম্বা হচ্ছে, কালো হচ্ছে। পলটুর মাথা কাজ করছে না আর।

গায়ত্রীর বাড়ি।

পলটুর জীবনে লালবাতি জ্বেলে দিয়ে লিলি, গায়ত্রী ও রিনার সঙ্গে স্ব্র্যাব্ল খেলছে জয়া?

—ভেবেছ কি তুমি?

—তুমি?

—শয়তানী, হারামজাদী,…….চলো, বাড়ি চলো। তোমাকে আজ…

—পটলবাবু!

—থামুন আপনি। নিজে স্বামী ছেড়ে এখানে ফুর্তি করছেন, আমার স্ত্রী মেয়েকে….

—বাবা।

—উঠে আয় শীগগির!

পলটু ফুঁসতে থাকে। জয়া চেয়ে থাকে। তারপর বলে গায়ত্রী! পরে কথা হবে।

গায়ত্রী চলে যায় ঘর ছেড়ে।

—চল লিলি।

—মা।

—চল শীগগির। তোর বাবা জানোয়ার হয়ে গেছে। এখানে থাকলে গায়ত্রীকে…

রিনা ওদের ব্যাগ নিয়ে আসে। জয়া ব্যাগ নেয়, বেরোয়।

—এর দাম তুমি দেবে। আমি আদায় করব।

—চল শীগগির।

—জানোয়ার, জানোয়ার, জানোয়ার।

—ওঠো গাড়িতে।

—এ কি! কার গাড়ি?

—লাডিয়ার।

—আমি ও গাড়িতে উঠব না।

—তুমি এ গাড়িতেই উঠবে।

—তুমি চালাবে না কি?

—আমি চালাব।

গাড়ি ছুটছে, ছুটছে। পলটুর কথা ছিটকে আসছে, হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে।

—তুমি সব জানতে।

—কি জানতাম?

—কিসের চক্রান্ত?

—কুকমারিতে…আমাকে প্যাঁচে ফেলার জন্যে…আমাকে ডোবাবার জন্যে…

—কি বলছ?

—বাবা! গাড়ি পিছলে যাবে।

—তোমার মতো স্ত্রীলোকের…

ড্রাইভার চেঁচিয়ে ওঠে, হোঁশিয়ার।

লিলির চীৎকার বাবা!

গাড়ি পথ ছেড়ে সরছে, সহসা ট্রাকটা প্রচণ্ড চেষ্টায় ধাক্কা সামলায়, গাড়ি গড়াচ্ছে, নামছে, সামনে কাঠের গুদাম, প্রচণ্ড ধাক্কা। পলটু জয়াকে ঠেলতে থাকে, ঠেলে দেয়, জয়া! এবার?

ভীষণ সংঘর্ষে সব তালগোল পাকিয়ে যায়? জয়ার চীৎকার, তুমি লিলিকে ফেলে দিলে?

তারপর সব অন্ধকার, অন্ধকার, অন্ধকার।

না, লাডিয়া কোনো কথাই বলে নি। অনেকদিন বাদে পলটুর সামনে বসে বলেছিল, দুশমনি বেইমানি যা করলেন, সব আমি মাপ করে দিয়েছি দাদা। উপরওয়ালা আপনাকে খুব বড় শাস্তি দিয়ে দিলেন। ইস্তিরি ভি ইনজুরি, মেয়ে ভি না—জিন্দা না—মরা। গাড়ি তো ইনসিওর ছিল। আমার কিছু দণ্ড গেল, ড্রাইভার মরে গেল। ওর পরিবারকে দিয়ে দিলাম টাকা! ছেলেটাকে কাজে লাগিয়ে নেব। আপশোস, আপশোস।

—আমার কিছু বলার নেই।

—পলিটিক্স করবেন, মাথাও গরম করবেন, এ তো চলে না।

বাচ্চু বলল আমি কলকাতা গেছি, তব ভি আপনি ক্ষেপে গেলেন, শিলিগুড়ি ছুটলেন, আর লগন চাঁদকে চালাতে দিলেন না…খুব ভুল করলেন! যাক! উপরঅলা আপনাকে শাস্তি দিয়েছেন, আমি কি বলব!

হাসপাতালে লিলি।

জ্ঞান ফিরতে আর্ত চীৎকার, না বাবা নয়! বাবা আসবে না। বাবা আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়ে দিয়েছিল।

না, পলটু লিলিকে ফেলে দেয় নি, ফেলতে চায়নি জয়াকে সে সময়ে ওর মাথায় লোডশেডিং হয়ে গিয়েছিল। কেন ও অমন করছিল, কি করেছিল, কোনো কিছুই পরে মনে করতে পারে নি।

জয়া আর লিলি ফেরার পর রায়বর্মা এসেছিলেন। লিলিকে দেখে নেমে এসেছিলেন।

পলটু তখন তিন মাস ধরে লোকের সমবেদনা আর সহানুভূতি কুড়োচ্ছে।

জয়া ফেরার পর অবশ্য ওর মুখের চেহারা বদলে যায়। জয়ার কথা খুব স্পষ্ট ছিল।

—লিলি তোমাকে সহ্য করতে পারবে না। ও ঘরে ঢুকবে না। আমার সঙ্গেও দরকারের বাইরে কথা বলবে না। তুমি ওপরে না উঠলেই ভালো।

—জয়া!

—আর কথা নয়। আরো কি চাও তুমি? লিলি অন্ধ, পঙ্গু, আরো কিছু চাও?

—আমাকে বলতেও দেবে না?

—না। তুমি কোন জীবন, কাদের সঙ্গ চাও, তা তো বেছেই নিয়েছ। আমরা তার বাইরে।

—এত ঘৃণা নিয়ে তুমি ফিরলে কেন?

—তোমাকে নিরন্তর মনে করিয়ে দেবার জন্যে। সবসময়ে যাতে মনে থাকে যে ক্ষমতা, টাকা, প্রতিপত্তি তুমি নিজের মেয়ের বিনিময়ে সংগ্রহ করছ। তা ছাড়া লিলি তোমার মেয়ে। আমি তোমার স্ত্রী! আমাদের ভার বহন করার দায়ও তোমার, অন্য কারো নয়।

—অসহ্য, অসহ্য।

—ঠিক সয়ে যাবে। তুমি তুমিই থাকবে। তোমার চামড়া যথেষ্ট পুরু।

রায়বর্মা ওর দিকে তাকান নি, বসেননি। দাঁড়িয়ে দরজার ওপারে বাগানের দিকে চেয়ে বলেছিলেন, অঙ্কের সব হিসেবই অঙ্কের নিয়মে মিলে গেল পলটু। ড্রাইভার মাতাল ছিল, তার জন্য দুর্ঘটনা। ট্রাক ছাড়া পেল, ড্রাইভারদের নামে কেস হল না। বিশ্বাস বদলি। দু’জন বনরক্ষী গ্রেপ্তার। লাডিয়া পার্টির দরদী বন্ধু!

—রায়বর্মাদা! আমি আর শুনতে পারছি না।

—সব অঙ্কের হিসেবে মিলে গেল। মিলে তো যেতই। তা তুমিও জানতে। জানতে যখন, তখন গাড়ি চালাতে গিয়ে তুমি…লিলির জীবনটা…বউমার মুখটা…ড্রাইভারের জীবনটা…

মাথা নেড়ে নেড়ে উনি বেরিয়ে যান। যেতে যেতে বলেন, লিলির এই পরিণামটাও কি অঙ্কের হিসেবে ছিল। না ঘটে গেল?

উত্তর শোনার জন্যে উনি দাঁড়ান নি।

তারপর তিন বছর কেটে গেছে। পলটুর দুঃস্বপ্নের কুকমারির জঙ্গল ও গাছ খুব সজীব, হিংস্র।

ট্রাউনের পরিচিত কুকমারি জঙ্গল এখন সরতে সরতে অন্য জেলার সীমান্তে পৌঁছেছে।

এক সময়ে, পুরনো লোকেরা বলে, জঙ্গল এত ঘন ছিল যে সামনের মানুষ পেছনের মানুষকে দেখতে পেতনা। তীক্ষ্ন কুক ডেকে সাড়া দিত।

অরণ্যভূমে বাঁশ বা সাবুই ঘাস লাগিয়ে এখানে ভবিষ্যতে কাগজকল করবার একটি দীর্ঘমেয়াদী বহু কোটি টাকার পরিকল্পনা করার কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়।

পলটুই বলে, তা করবে কেন? এ রাজ্যে কোনো কিছু হোক…ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র!

পাঁচ পাবলিক বোবা চোখে শুনে যায়।

বাচ্চুকে তনিমা প্রসঙ্গটি বলা যত সহজ হবে ভেবেছিল তত সহজ হয় না।

বাচ্চুকে পাওয়াই মুশকিল হয়। এ সময়ে ও কাছাকাছি দেশের বাড়িতে। ওর বাবা কৃপাণসিন্ধু (কৃপাসিন্ধু নয়) স্বনামের প্রথমাংশে কাগজের নাম দিয়েছেন। দ্বিতীয়াংশে টাউনের বাড়ির নাম ছিল ”সিন্ধুভিলা।”

দেশের বাড়ির নাম বাবার নামে ”গোবিন্দ নিবাস।” কৃপাণসিন্ধু বছরে চারবার কালী পুজো করেন। ঘোর শাক্ত পরিবার। শ্যামাকে মদ মাংস সবই দিতে হয়। পুজোর আগে থেকে অভিজ্ঞ লোক সাতু বাবু গিয়ে শুদ্ধ মতে কারণ বারি প্রস্তুত করে।

নিজেও ঘন ঘন খায়। হেলে না টলে না। কৃপাণসিন্ধুর হয়ে জোড়া পাঁঠা, ও অন্যদের মানসিকের পাঁঠা সাতুবাবুই বলি দিত, এখন বাচ্চু দেয়।

দেশের বাড়িতে শ্যামা মায়ের মূর্তি থাকে খড়ের চালের মন্দিরে। শ্যামা মায়ের স্বপ্নাদেশ, আমাকে পাকা মন্দিরে রেখো না।

এ সময়ে গোবিন্দ নিবাসে দুশো মজা। জালায় কারণ বারি। তাতে মানসিক করা বিবিধ জাতের মদের বোতল ঢালা হয়। ভক্তরা খায়।

কয়েক বছর এ উপলক্ষ্যে যাত্রাও হচ্ছে। এবার কলকাতার পার্টি। ”মেয়ে দস্যু রেশমা”, ”বিপ্লবী বিশে ডাকাত” ও ”কলঙ্ক কঙ্কাবতী”। প্রথমটি রক্ত গরম করবে। দ্বিতীয়টি বিপ্লব চেতনা জাগাবে, তৃতীয়টি নারীর আত্মত্যাগের মহিমা ঘোষণা করবে।

পলটু যেতে পারে নি। দীর্ঘকাল নীরব থেকে তার অর্শ আবার দেখা দিয়েছে। ফলে বাচ্চুই ”যাত্রা হল গণ শিক্ষার হাতিয়ার” বক্তৃতাটি দিয়েছে।

সমস্ত কর্মকাণ্ড শেষ করে তবে বাচ্চু শহরে উদয় হয়।

—বাপ রে বাপ! বড় পার্টির বায়নাক্কা কত। থাকার ব্যবস্থা শোয়ার ব্যবস্থা, নায়িকা রোজ মাগুর মাছ খাবে, তার ব্যবস্থা।

—সব মিটল?

—মিটল। আমাকে খুঁজছেন শুনলাম।

—হ্যাঁ, কথা ছিল।

—খুব গম্ভীর হয়ে গেছেন?

—কথাটা গুরুত্বপূর্ণ।

—বলুন।

—নিশীথের বাড়িতে একটি মেয়ে থাকে।

—দেখেছি! তনিমা নাগ। টীচার।

—তুমি ওর পেছনে লেগেছ কেন?

—আমি? ওর পেছনে? কে বলল?

—নিশীথ বলে নি।

—কে বলল?

—ওই বলেছে তোমার বউদিকে। আর, খবরটা যে সত্যি, তা তুমিও জানো।

—মাইরি বলছি…

—ওকে ফলো করো। স্কুল থেকে বেরোলে বলো তোমার মোটরবাইকে চাপতে!

—বাজে কথা।

—আমি খবর নিয়েছি বাচ্চু।

বাচ্চু গুম হয়ে যায়।

—তোমাকে আমি একটা কথাই বলেছিলাম! আগে যা করেছ, তা করেছ। আমাদের রাজনীতিতে এ সব নোংরামি চলবে না।

—পলটু দা! আমাকে চোখ রাঙাবেন না।

—তার মানে?

—আপনাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক, ফান্ডে টাকা দেব, যা বলবেন করে দেব, কিন্তু প্রাইভেট ব্যাপারে বাচ্চু কারো কথা শোনে না।

—এ ক্ষেত্রে তোমায় শুনতে হবে।

—আমি…আমি ওকে বিয়ে করব।

—আমি যতদূর জানি, মেয়েটি ভালো। ভাইকে দাঁড় করাবে বলে কাজ করছে। ভাই দাঁড়ালেই ও বিয়ে করবে। পাত্রও নিজেই ঠিক করেছে।

—কে, কে? টাউনের কেউ?

—না, বাইরে থাকে।

—বউদি বলেছে?

—হ্যাঁ বাচ্চু।

—এখানে আসে বটে।

—আসে, থাকে লিলির কাছে। লিলি ওকে খুব ভালোবাসে। ওর বিষয়ে আমার একটা দায়িত্ব আছে।

—বুঝলাম। তা, দায়িত্ব আছে তো ওকে ওই চোর নিশীথটার বাড়ি রেখেছেন কেন?

—নিশীথের স্ত্রী ওর সম্পর্কে বোন।

—বেশ! ভেবে দেখব।

—দেখব নয় বাচ্চু, কথা দিতে হবে।

—এটা মোহববতের ব্যাপার দাদা!

—না, এখানে নয়।

—ওকে যত ভাল ভাবছেন, তত ভাল নয়। কেন? রথীন, মধু, দীনু সকলের সঙ্গে কথা বলে, আমার সঙ্গে বলে না কেন?

—ওরা অন্যরকম ছেলে।

—কতকগুলো পার্টিবিরোধী ছেলেকে আপনি…

—সে জানি। তবে মদ খাওয়া, স্ত্রীলোকের ব্যাপার, এ সব তো ওদের নেই।

—আমার তো সবই আছে। সব জেনে শুনে আমাকে আপনি আনলেন কেন?

—বাচ্চু! আমি তোমাকে বলছি…

—শুনলাম। ভেবে দেখব।

—বিয়ে করবে! তুমি বিবাহিত নও?

—সে কালীঘাটের বিয়ে! ফুর্তিফার্তা করে টাকা দিয়ে ফুটিয়ে দিয়েছি।

—তোমার বাবা জানেন?

—সব জানে।

বাচ্চু সগর্বে বলে, বাবা জানে, মা জানে, টাউনসুদ্ধ লোক জানে, জানে না কে?

বাচ্চু বেরিয়ে যায়। পলটু উদ্বেগে থমথমে হয়ে থাকে। নিজেকে বড় একলা মনে হয় তার। রথীনের কথা মনে পড়ে, আমাদের দূরে সরালেন, কাছে টানলেন বাচ্চুকে। টাউন কেন, জেলাতেও আমাদের পার্টির যেটুকু ছিল, সব আপনি শিকড় ছিঁড়ে উপড়ে দিলেন।

যেহেতু বাচ্চুর কথাবার্তায় পলটু বোঝে যে বাচ্চু তাকে মানল না, সেহেতু ওর অহেতুক রাগ হয় তনিমার ওপরে। কি দরকার ছিল জয়ার কাছে আসার, নিজের সমস্যার কথা বলার?

যা হবার হত তনিমার। নিজেকে যদি বাঁচিয়ে চলতে না পারো, বাইরে চাকরি নিয়ে এলে কেন?

বাচ্চুকে উপেক্ষাই বা দেখাও কেন?

জয়া ঢোকে।

—বাচ্চুর সঙ্গে কথা হল?

—বললাম।

—কড়কাতে পারোনি। তাহলে তুমি চেঁচাতে।

—বলেছি।

—ও কি বলল?

—ভেবে দেখবে।

—ভেবে দেখবে! চমৎকার! মেয়েবাজ, লম্পট একটা ছেলে! লাথি মেরে যাকে বের করে দেওয়া উচিত ছিল…না, তা তো তুমি পারবে না।

—আমি দেখছি ব্যাপারটা।

—তোমার দেখার মানে তো আমি জানি। আলোচনায় বসবে, সিদ্ধান্ত নেবে, চামচারা ”হ্যাঁ হ্যাঁ” করবে। ছি ছি! তুমি কোথায় নেমে গেছ?

—ওকে বলেছি তো যা বলার।

—কিছুই বলোনি।

—বলেছি। তুমি তনিমার ব্যাপারে নিজেকে অতটা জড়িও না। মিছি মিছি…

—চমৎকার সিদ্ধান্ত। মেয়েটার জীবন গোল্লায় যাক। আমি আলগা হয়ে থাকি, কেমন?

—মুশকিলটা হল…

—বাচ্চু তোমার দলের ছেলে। রথীন, মধু, তপু, দীনু, সবাইকে সরিয়ে দিয়ে…বাচ্চু যেমন ছেলে…

—সেখানেই আমার ভয় জয়া।

ওর যদি আক্রোশ হয়…লিলি তো নড়তে পারে না…

যদি কিছু…

জয়া বলে, অনেকদূর ভেবেই ওর সঙ্গে অমন গলায় কথা বলছিলে…

—একেবারে ভেতরের ব্যাপার!

—না, আর সহ্য করা যায় না।

—তুমি ভেবে দেখ…

—ভেবেছি। দেখছি। একা তুমিই বহুজনের সর্বনাশের জন্যে দায়ী। তোমার মরা উচিত।

বেরিয়ে আসে জয়া। কি করবে? কেমন করে তনিমাকে রক্ষা করবে? কে তনিমাকে বাঁচাবে? বড় শরিকের আক্রোশকে সবাই ভয় করে।

রায়বর্মার কাছে যাবে?

ওঁর প্রধান ভরসা দীনু, সেই তো নেই। নিজের অংশ ভাইকে বেচে দীনু, ছোট প্রেস কিনেছে, ”প্রতিবাদ” বের করবে। রথীন, মধু, তপু সকলকে নিয়ে সমবায় ভিত্তিতে প্রেস চালাবে।

দীনু টাইপ কিনতে কলকাতায় গেছে।

আসুক, দীনু আসুক। কোনো না কোনো ব্যবস্থা জয়া করবেই। তারপর লিলিকে নিয়ে কলকাতা যাওয়া…ডাক্তার লাহিড়ীকে দেখানো…আর না ফিরলে কেমন হয়?

কিন্তু তনিমা, তনিমার কি হবে?

ভানুর সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। ভানু আরও আলোচনা করলে নিশ্চয় কোনো পথ বেরোবে।

বাচ্চু জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি ফেরে। বাড়িতে ওর মহলও আলাদা, সেখানে বাচ্চুর রক্ষার্থে দুই মস্তান কাবলি আর রাজা সর্বদা থাকে।

কাবলি বা রাজা কোনো পার্টির ধার ধারে না। বাচ্চু ওদের কাছে ”গুরু”। বাচ্চু যা বলবে ওরা তাই করবে।

বাচ্চু ওদের বলে, বিয়ার নিয়ে আয়।

—কিনে আনব?

—ফ্রিজ থেকে।

—গুরু গরম মনে হচ্ছে?

—চুপ করে থাক।

ওরা বিয়ার খায়।

—গুরু! তোমার তনিমা তো চলল।

—কোথায়?

—রথীনের বাড়ি যাচ্ছে। ওর বোনের সঙ্গে…সে অবশ্য লোক দেখানো…

—না তোদের খবর সত্যি নয়।

—কেন?

—রথীন সীমাকে বিয়ে করবে।

—নার্স সীমাকে?

—হ্যাঁ হ্যাঁ।

—করছে না কেন?

—করবে।

—ধুস, সীমাটা মুটকি।

—তাতে কি?

—তনিমাকে দেখছে…সীমাকে ফুটিয়ে দেবে।

রাজা বলে, না না। তনিমার ইয়ে আছে একজন।

—সে কে?

—খড়গপুরে আই.আই.টি—তে পড়ায়। দারুন আঁতেল? তনিমা নিজেও আঁতেল তো!

—আঁতলেমি আমি ঘুচিয়ে দেব।

—কেমন করে?

—চুপ কর। পলটু দত্ত আমায় দাবড়াচ্ছে। (বুকে চাপড় মেরে) আমি বাচ্চু! কোনো দাদার দাবড়ানি আমি সহ্য করি না।

—বাঃ! পলটু তোমার পোটেকশান দেয়।

—না দিলে কলা হত।

বাচ্চু লালচে ও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।

—পলটু দত্তকে বলে দিস, ওর আমাকে দরকার। আমার ও ছাড়াও চলবে। আমি বাপ কা বেটা! আমার বাবার ছেলের কোনো পোটেকশান দরকার করে না। পলটুই দীনু রথীনের ভয়ে মরে।

—কেন?

—তারা আদসসোবাদী। পলটু দু’নম্বরী। ওদেরকে পলটু ডরায়।

—রায়বর্মাকে?

—তাকেও। আর ডরায়…

—কাকে?

—নিজের বউকে। মেয়েছেলেকে বেটাছেলে কখন ডরায়? যখন সে মেনিমুখো হয়।

—বউদি কিন্তু হেভী গম্ভীর…

—আঁতেল। আঁতেল।

—আঁতেল?

—আমি যে এত যাই…কোনদিন ভালো মুখে একটা কথা বলল না। রথীন…দীনু…

—বউদি হেভি ফ্যামিলির মেয়ে…

—মানছি। কিন্তু…

—কি সিম্পল থাকে…রিক্সা চাপে…

—সোয়ামীকে ঘেন্না করে। মেয়েছেলেকে জুতোর নিচে রাখা দরকার। তা না করলেই…

—যা! দু’দুটো ব্যারিস্টারের বোনকে কেউ জুতোর নিচে রাখতে পারে?

—বাচ্চু হলে দেখিয়ে দিত।

—কি জানি…

—আসলে বউদি…তনিমা…সব এক গোত্তরের। আঁতেল। আমার যদি রথীনের মতো লেখাপড়ার ফান্ডা থাকত, তাহলে আমার কদর হত।

—আরো তো কত মেয়ে আছে।

—ও আমাকে অপমান করেছে।

—তুমি বদলা নেবে?

—ওকে তুলে এনে বিয়ে করব।

—তা পারবে না।

—কেন?

—তোমরা সব এক পাট্টির লোক।

—কিসে? আমি আঁতেল পাট্টি?

পাট্টি—পোটেকশান—আদসসোবাদী—রাজা ও কাবলি বোঝে গুরু রিয়ার খেয়েই নেশাগ্রস্ত হচ্ছে, কথা জড়াচ্ছে। বোধ হয় ট্যাবলেটও খেয়েছে।

—না না। মানে পলটুদা, তুমি, নিশীথ, তনিমা, সব তো এক পাট্টি!

—তাতে কি?

—নিজেদের মধ্যে…

—আমার কেউ নেই। (ঘন ঘন নিশ্বাস) আমার আমি আছি। যে মেয়েকে যখন মনে করেছি, তুলে এনেছি, ওর বেলা হিসেব পাল্টে যাবে?

—গুরু! দোষ নিও না। তা নিয়ে তো অনেক ঝামেলাও হয়েছে।

—হয়েছে! দীনু আমায় মেরেছে। কিন্তু বারবার পলটু আমায় পোটেকশান দিয়েছে।

—তারা বাইরের মেয়ে, গুরু!

এ পাট্টির মেয়ে?

—নয়? নিশীথের কুটুম্ব, ইস্কুলে ইউনিয়নও তোমাদের ইউনিয়ন!

—এখন আমার বুকে আগুন জ্বলছে রে রাজা। ভালো কথা ভাল লাগছে না। চল বেরোই।

—কোথা যাবে?

—ডিসকো হোটেলে। মাংস পরোটা খাব।

সিনেমা হলের নাম একদা ”উর্বশী” ছিল, এখন ”ডিসকো।” সময়ের হাওয়া সিনেমা মালিক ভালো বোঝে। এখন বাতাসে নোট উড়ছে, তুমিও ধরো।

সিনেমার সঙ্গেই হোটেল ও ডিসকো কেটারিং সার্ভিস। হোটেলের পিছনের ঘরে সকলের প্রবেশাধিকার নেই। সেখানে শুধু গণ্যমান্য নাগরিকরা ছোট একটি মিনি সিনেমা ঘরে বসে মদ ও ড্রাগ সহযোগে নীল ছবি দেখতে পারে। মদের লাইসেনস নেই।

এ রকম যে চলে তা সবাই জানে।

পুলিশ সব চেয়ে বেশি জানে।

বাচ্চু ডিসকো হোটেলে যায়। রগরগে মাংস চাই। মচমচে পরোটা। রগরগে মাংস।

যেতে যেতে ও বলে, ভালো কথায় না মানলে ওকে তুলে নিয়ে শিলিগুড়িতে ফেলব, ব্লু ফিলিম তোলাব। তখন অপসে মুরগি হাত থেকে ধান খাবে। অমন সতীপনা অনেক দেখেছি।

রাজা ও কাবলি চুপ করে থাকে। গুরুর মনে কত কথা জাগে মাইরি! গুরু! তুমি জিনিয়াস। কিন্তু গুরু! এ থেকে ঝামেলা বাধলে রাজা আর কাবলি টাউন থেকে ছুটে যাবে।

দুজনের নামেই বহু রেকর্ড আছে। নেহাৎ বাচ্চুর সঙ্গে আছে বলে গায়ে হাত পড়ছে না। নইলে দুজনকেই পুলিশ…

ওরা ডিসকো হোটেলে ঢোকে।

ম্যানেজার দৌড়ে আসে।

—কি দেব, বলুন?

বাচ্চু লালচে চোখে চেয়ে থাকে।

—যা চাইব তাই দেবে?

—নিশ্চয়।

—তনিমা দিদিমণিকে চাই।

রাজা তাড়াতাড়ি বলে, কষা মাংস আর পরোটা। দিব্যি ময়ান দিয়ে…।

এত কথার কিছুই জানেনি তনিমা।

স্কুল থেকে ফিরে এসে স্নান করে, চা খেয়ে ও আবার বেরোবার জন্যে তৈরি হল।

না, ঘরটা বড়ই। ওর ঘরের সঙ্গে বাথরুমও আছে। জানলা খুলে দিলে বেশ হাওয়া।

নিশীথ আর গীতুও ঠিকই আছে। ওরা সাধ্যমতো ওকে যত্ন করে।

পরিবেশটা ভালো নয়।

লম্বাটে গড়নের একতলা বাড়ি। সামনের ঘরটি পৌরকর্মী ইউনিয়ন আপিস। পরের দুটি ঘরে গীতুর সংসার।

শেষ ঘরটি তনিমার।

স্নানের ব্যবস্থা বাইরে। বাথরুম, রান্নাঘর। তনিমার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমে স্নান বা জলের ব্যবস্থা নেই।

বাইরের ঘরে সন্ধ্যার পর অদ্ভুত সব লোক আসে, জুয়ার আড্ডা হয়। যারা আসে তারা কেউ পৌরকর্মী নয়।

আগে আগে অনেক বলেছে তনিমা।

—কেমন করে সহ্য করো তোমরা?

—ওরা ওদের মতো থাকে…

—বাড়ি ছেড়ে যেতে পার না?

—কোথায় পাব এমন বাড়ি?

—আমি এসেই ভুল করেছি।

গীতু শুকনো মুখে কথা বলে, তোমার ঘর তো খুব ভেতরে ভাই।

—এত হট্টগোল…এত চেঁচামেচি…

গীতু নিচু গলায় বলে, কি করবো?

এ বাড়িতে যে ও থাকে, তা বাচ্চু আগে বোঝে নি। যেদিন বুঝল, সেদিন থেকেই বাচ্চুর ভাবগতিক পালটে গেল।

স্কুলে যাবে, বেরিয়ে রিকশায় উঠবে, বাচ্চু পাশে পাশে মোটরসাইকেলে।

স্কুল থেকে বেরবে, সামনে বাচ্চু।

রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানে গেছে তনিমা। সহকর্মীদের সঙ্গে। একটা ছোট ছেলে এসে এক ঠোঙা চানাচুর এগিয়ে ধরে বলল, বাচ্চুদা দিলেন।

চানাচুর ও ফেলে দিয়েছে, পাশে পাশে চলা উপেক্ষা করেছে।

তারপর কথা বলার চেষ্টা।

—শুনছেন? সিনেমা যাবেন?

—আমাকে বলছেন?

—হ্যাঁ, আপনাকে।

—লজ্জা করে না, ভদ্রলোকের মেয়েকে ডেকে ”সিনেমা যাবেন” বলতে?

রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ি ফিরেছে তনিমা। নিশীথকে বলছে, ওই লোকটি কে? ছোটলোকের বেহদ্দ একেবারে? পথে বেরোলেই কুকুরের মতো সঙ্গে আছে। আজ বলছে, সিনেমা যাবেন?

শুনে নিশীথের মুখ চুপসে গেছে।

—তুমি ওকে কিছু বলনি তো?

—নিশ্চয় বলেছি।

—কি বলেছ?

—ভদ্রলোক হলে আর কথা বলবে না।

—এমন বলেছ?

—ও যে স্তরের লোক, সে স্তরে নেমে কথা বলা তো সম্ভব নয়, তবু বলেছি। ও কে?

—ও…বাচ্চু…

গীতু, সম্পর্কে যে ওর বোন, শৈশবে যে তনিমার মায়ের কাছে থেকেছে, সে তনিমার ওপরই রেগে উঠেছে।

—কার সঙ্গে অমন করেছ তা জানো?

—কার সঙ্গে?

—ও পলটু দত্তের ডান হাত, যুবনেতা।

—ওই লোকটা?

—হ্যাঁ, ওই। ওর এ শহরে…ওর গায়ে হাত দেবে, ওকে দাবড়াবে, এমন ক্ষমতা কারো নেই। না না, এ তুমি ঠিক করো নি।

—আশ্চর্য, আশ্চর্য গীতু!

—তুমি বুঝবে না। ও ক্ষেপে গেলে আমাদের এখানে থাকা অসম্ভব হবে।

—ও!

তারপরেই তনিমা ভানুর কাছে যায়।

ভানু বলে, তনিমা! তোমার এখানে থাকার কোনো অসুবিধেই নেই। শুধু…

—কি?

—বাচ্চু মানুষ নয়, জানোয়ার।

—ওকে তুমিও ভয় পাও?

—কয়েকটা মেয়েকে নিয়ে বাস করি…বোম মারতে পারে…ঢুকে তোমাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে…থানা, পুলিশ, কেউ কিছু করবে না।

—সে কি ভানুদি?

—এ রকম ও আগেও করেছে।

—এ শহরে কি মানুষ নেই?

—কে ওকে কি বলবে ভাই? ওর খুঁটি যে বড্ড শক্ত।

—সুনীলাদির কাছে যাব?

—ওঁর হস্টেলের বকুলকেই তো…

—তুলে নিয়ে গিয়েছিল?

—তাই শুনেছি।

—বকুলের কি হল?

বকুল…সব লিখে রেখে আত্মহত্যা করেছিল…কেস হয়…কিছু হয় নি।

—আমি কি করব ভানু দি?

—জয়াদির কাছে চলো।

—জয়াদি!

—চলোই না।

জয়ার কাছে ও যেতে শুরু করে। তারপর জয়ার সূত্রেই রথীনদের সঙ্গে আলাপ।

রথীনকেও আজ সব কথা বলবে।

স্কুল থেকে ফিরে স্নান করে চা খেয়ে ও যখন বেরোচ্ছে, গীতু বলল বেরোচ্ছ?

—হ্যাঁ।

—কোথায়?

—নীপাদের বাড়ি।

—একলা ফিরো না।

—না। দেরি হলে লোক নিয়েই ফিরব।

গীতু এটা সেটা নাড়ে। কাপড় ভাঁজ করে।

—তনিমা!

—বলো।

—নীপা তো রথীনের বোন।

—হ্যাঁ।

—ওদের বাড়ি গেলে বাচ্চুর আক্রোশ তো বেড়েই যাবে। আমি যে বলেছি একথা কাউকে বোল না যেন। রথীনদের এখন…

—না, বলব না।

—তোমার জন্যে আমারও খুব চিন্তা। কি করব বলো। বাচ্চু এমন একজন লোক…

—আমি তোমাদের বেশি দিন জ্বালাব না। তেমন হয় তো চলেই যাব।

—কাজ ছেড়ে?

—দেখা যাক।

রথীনদের বাড়িতে অনেক লোক। রথীনের মা, বাবা, দাদা, বউদি, ভাইপো, এক পিসি, দুই বোন। নীপা স্কুলে তনিমার ছাত্রী।

নীপার বউদি এক আশ্চর্য মানুষ। ভাত রেঁধেই যাচ্ছেন, চা করেই যাচ্ছেন, কখনো বিরক্তি নেই। রথীনের দাদাও বেশ ভাল মানুষ।

তনিমাকে দেখে বউদি বলেন, এস ভাই। ওপরে যাও। আজ সীমাও এসেছে।

সীমা ও রথীনের সম্পর্ক সবাই জানে। সীমার ইচ্ছে, এখনি বিয়ে করা। রথীন তা করবে না। নিজে কিছু করতে পারলে তবে বিয়ে।

দীনুর সঙ্গে প্রেস করবে বলে রথীন বেশ উৎসাহিত। ওর মুখেও হাসি ফুটেছে।

রথীন বলে, আসুন।

সীমা বলে, এস ভাই।

—আমার যে কথা ছিল।

—কথা বলবেন বলেই তো ডাকলাম সীমাকে। সীমাও শুনুক।

তনিমা বলে, বাচ্চুর জন্যে আমার জীবন তো অসহ্য হয়ে উঠেছে রথীনবাবু। সীমাদি! আমি যে কিসের মধ্যে পড়েছি…

—বুঝতে পারছি ভাই।

—সবটা শুনলে…

সবই বলে চলে তনিমা। প্রতিদিনের ঘটনা, একটি কথাও বাদ দেয় না।

রথীন মাথা নিচু করে শুনে যায়। সীমাও শোনে সব। কথা বলে, তনিমা বলে, জয়াদি বললেন, কোনো অসুবিধে ছিল না, কিন্তু…

রথীন বলে, বাড়ি তো জয়াদির নয়।

সীমা বলে, কেউ সাহস পাচ্ছে না?

—না। সর্বত্র রাজনীতি।

রথীন ব্যাকুল ও ক্রুদ্ধ উদ্বেগে বলে, ওর নাম রাজনীতি নয় তনিমা, বিশ্বাস করো।

তনিমা সদুঃখ হেসে বলে, আসলে রাজনীতি যে কি, তা আমরা কেউই ভাবিনি। আমি স্কুলের ইউনিয়নে আছি, আপনাদের ইউনিয়ন। নিশীথবাবু পৌরকর্মী ইউনিয়ন করে, আপনাদের ইউনিয়ন। আমরা ধরেই নিয়েছি, এটাই যথেষ্ট।

রথীন বলে, আমরা তা ভাবিনি, এখনো ভাবিনি। কিন্তু রাজনীতি মানে যে শেষ অবধি কেরিয়ার করার, যে কোনো উপায়ে লুণ্ঠনের রাজনীতি হয়ে দাঁড়াবে…আমরা এ রাজনীতি চাই না। জনগণকে নিঃস্ব করে, তাদের মধ্যে দালাল তৈরি করে, মানুষকে ভয়ে দাবড়ে বোবা বানিয়ে রেখে চলতে চাই না।

সীমা বলে, যা বলবে ঘরে বলো। বাইরে বললে তোমাকে লেবেল এঁটে দেবে। বিক্ষুব্ধ, উগ্রপন্থী, বিচ্ছিন্নতাবাদী। বাপ রে বাপ, কপচাতেও পারে!

—বিচ্ছিন্নতাবাদীও বলছে?

—বাঃ! তোমরা কুকমারি জঙ্গল নিয়ে লড়বে, আর ”বিচ্ছিন্নতাবাদী/উত্তরাখণ্ডী” এ সব শুনবে না? সব শুনতে হবে। রাজনীতি।

—তনিমা, এটাই লজ্জা ও দুঃখের কথা, যে বর্তমানে বাচ্চুও বর্তমান রাজনীতির কাছে আমাদের চেয়ে অনেক দরকারী।

—সবই বুঝলাম। আমি কি করব?

রথীন ঈষৎ হাসে। বলে, বলতে পারতাম, দীনু ফিরছে। তারপর থেকে তুমি রায়বর্মার বাড়িতে থাকো। সীমার কোয়ার্টারে চলো, আজ তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি। বাড়িতে কথা বলে নিই।

—তারপর?

—এখানেই থাকবে।

—এখানে!

—খুব কষ্ট হবে।

—আপনাদের হবে না?

—না না। আমার বাড়ির লোকদের অভ্যেস আছে। এ বাড়ি বহুকাল আগেই শ্রীক্ষেত্র করে ফেলেছি।

সীমা বলে, তাই ভালো। আমাদের কোয়ার্টারও অরক্ষিত। আর হাসপাতালের বারান্দায়, কম্পাউন্ডে সন্ধ্যে থেকে তুমি সব পাবে।

—কি কি?

—চোলাই, ড্রাগ, সাট্টা, জুয়া, বেশ্যা।

রথীন বলে, সর্বত্র, সর্বত্র। কয়েক বছর ধরে সমানে রাজনীতিক স্বার্থে চাকরি দেয়া হচ্ছে। পলটুদা, নেপাদা (মেজশরিক) এরাও দিয়েছে, মহামান্য কৃপাণসিন্ধুও কম দেয় নি। বর্তমানে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তো লাডিয়া আর বাচ্চুর নির্দেশে চলে। পোলিটিকাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলে শিক্ষক, কেরানী থেকে ওয়ার্ডবয়, জমাদার কারোই আর কাজ করার দায় থাকে না, নিয়ম মানার ভয় থাকে না, খুঁটির জোরে লড়তে লড়তে ম্যাড়ারা হয়ে ওঠে হায়েনা, নেকড়ে।

—যাক নিশ্চিন্ত হলাম।

সীমা বলে, আমার হবু বরটিকে ভাঙিয়ে নিওনা ভাই। তোমার যা রূপ!

—যাঃ, কি যে বলেন!

—তুমি বিয়ে করবে কবে?

—সুবীর তো এখনি চায়।

—বাড়িতে অসুবিধা?

—খুব। আর দু’বছর না গেলে…

—এ শহরে সবাই এত ভয় পায়!

রথীন বলে, সময়টা পচে গেছে।

—নেতারাও দেখেও দেখে না।

—জেলার, না রাজধানীর?

—রাজধানীর।

—জেলার প্রত্যেকটি নেতার খুঁটি আছে রাজধানীতে। পলটু দত্তের খুঁটি খুব শক্ত।

—হ্যাঁ নিশ্চয়। ও রকম একটা দুর্ঘটনা…

—কোনটা নয় সীমা? আসলে এ শহরের একটা প্রচণ্ড আঘাত দরকার।

—আঘাত?

—চাবুক। চাবুক খেলে সাধারণ মানুষের ভয় কাটবে, বিবেক জাগবে।

—মনে তো হয় না।

—চলো, আজ তনিমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। কাল সকালে কিছু না বলে তনিমা কেটে যাবে।

তনিমা বলে, আপনি আমাকে খুব নিশ্চিন্ত করলেন রথীনদা, আজ আমি ঘুমোব।

রথীনের সঙ্গে তনিমা ফেরে। নিশীথ দরজা খুলে দেয়। রথীনের সঙ্গে একটা কথাও বলে না।

তনিমা ঢুকে যায়।

রথীন বেরিয়ে আসে। আজ ওর মনটা নিশ্চিন্ত। রায়বর্মাকে বলবে। জয়া বউদিকে জানাবে। একটা কথা রথীন খুব ভালো করে বুঝেছে যে, দীনু থাকলে রায়বর্মার বাড়ি থাকতে পারতো এ রকম ভাবে ভাবা মানে নিজের ওপর থেকে দায়িত্ব এড়ানো।

নিজে দায়িত্ব এড়িও না রথীন (রায়বর্মাদার কথা), সর্বদা নিজেকে শুধাবে যা করতে পারতাম তা নিজে কি করেছি?

নিজে যদি না করে থাকো, ”ও কেন করল না” এ কথা বলবে না।

মানুষের সুখ দুঃখে জড়িয়ে থাকো রথীন। মানুষের বিশ্বাস অর্জন করো। অন্য কোন পথ নেই। এইদিনও দিন নয়। দলমত নির্বিশেষে চেষ্টা করলে দিন ফেরানো যায়।

এ কথার জবাবে রথীন হেসেছিল।

—হেসো না। আমাদের ওপর বার বার আঘাত আসেনি?

—তারপরেও তো…

—তখন তো রাজনীতি অন্য রকম ছিল।

—হ্যাঁ, এখন লুটের দিন। যে যত পাইয়ে দেবে, সে তত বড় নেতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *