না, ভয় পাবেন না। লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিভলবার তাঁর আছে। ব্যবহার করার দরকার পড়ে নি। আর জীবন তো তাঁর একেবারে অপচিত নয়। কত ঘুরেছেন, কত জায়গায় বনের সীমানা বাড়িয়েছেন, কত পশুপাখিকে নিরাপত্তা দিয়েছেন, স্ত্রী সঙ্গে কত ছুটি কাটিয়েছেন কত বন বিভাগের বাংলোয়। সে সব বন, সে সব গাছ, সে সব পাখি, আজ থাক বা না থাক, তাঁর মনে তো বেঁচে আছে।
সুপ্রভাত শান্ত হয়ে যান। খুব শান্ত।
পরদিন সকালেই কেডিয়া দম্পতি এসে পড়েন। অন্তত দ্রুত বাড়ি বন্ধ করে ছেলেমেয়েকে নিয়ে আবার চলে যান কোথায়। দুপুরে নিজেরা ফিরে আসেন।
বাহাদুর বলে, মেয়ের জন্যে ভয় পাচ্ছে।
—কেন?
—ওর মেয়েই তো সেই বদমাসের নাম বলে দিয়েছিল। তাতেই তো সে ধরা পড়ে। সে যখন বেরোবে, তখন তো ওই বদমাস লেড়কির মুখ অ্যাসিডে জ্বালিয়ে দেবে।
—তোকে কে বলল?
—ওদের চাকর, আবার কে!
তবে তিনিও র্যাট, মুনও র্যাট। তাঁর র্যাটিংয়ে পুলিশ এসেছে (ওদের বিশ্বাস) মুনের র্যাটিংয়ে সেই বদমাস ধরা পড়েছে।
সুপ্রভাত নিজেকে নিরাপদ বোধ করেন।
—তুই এসব নিয়ে কোনো কথা বলিস না।
—না না। আমি হাওয়া বুঝি।
.
এখন হাওয়া কেমন তা বোঝা আবহাওয়া দপ্তরের একার দরকার নয়। মানুষদেরও চলার জন্যে অন্যদের মেজাজের হাওয়া বোঝা দরকার।
তোতার কথা মালিনী মেজখোকাকে বলবে, অনুরোধ করবে, ”কাজ দিতে পারো না পারো, খেঁকিয়ে উঠো না”, সে সময় তোতা দেয় না।
বকুলবাগানের ”বিপিন স্মৃতি” থেকে আলিপুরের ”সৈকত” লক্ষ যোজন মাইল দূরে। সভয়ে তোতা এসে ঢোকে। ভীষণ বড়লোকদের ওর ভীষণ ভয়ভক্তি। খুব অনন্যসাধারণ না হলে কেউ এত বৈভব করতে পারে না। মেজখোকা সম্পর্কে ওর কাকা হতে পারে কিন্তু নিশ্চয় সে নমস্য ব্যক্তি।
মেজখোকা বিদেশে গেলে স্টেটসম্যানে ব্যক্তিগত খবরাখবরে সে খবর থাকে। পার্সোনাল কলামের খবর যে পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয় তা তোতা জানে। তাই সে কাকার নাম দেখলেই ক্লাবে গিয়ে হামবড়াই করে।
ফলে ওর অবস্থা সঙিন, সঙিন। সবাই বলে, কাকার মতো কাকা হলে চাকরি করে দিত।
সেদিন মালিনীও গেল, ঠাকুমাও তোতার কথা বলল, কাগজের রাশিফলে তোতার সময়টাও ভালো, তোতা অনেক আশা নিয়ে ঢোকে।
ঢুকেই মেজখোকাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, মালিনীকেও, বিশ্বনাথকে তো বটেই।
বহুকাল পরে মেজখোকা বাপের ঘরে ঢুকেছে এবং সোদপুরের বাড়ি বিক্রি করার দরকার বোঝাচ্ছে। ক্রেতা বেনামে মেজখোকা! ওখানেও এখন আট—দশতলা বাড়ি তুলে ফ্ল্যাট বিক্রি করলে…অতটা জমি…সনকাবাস ভেঙে ফেললে…
বিশ্বনাথ শুনে যাচ্ছিলেন।
এ ঘরেই ঢোকে তোতা। কথায় বাধা পড়ে। মেজখোকা বলে, কে? একেবারে ভেতরে?
সেদিন স্বামী—স্ত্রীর কথাবার্তা শোনার পর থেকে বিশ্বনাথ যেন অন্যরকম হয়ে গেছেন। কি যেন ভেবে নিয়েছেন এবং কথা—বার্তার ধরণ বদলে গেছে।
বিশ্বনাথ বলেন, তোমার বড়মাসিমার নাতি। প্রমথেশের ছেলে, তোমার ভাইপো তোতা।
—অ! তা হঠাৎ?
—হঠাৎ নয়। আমরা সেদিন গিয়েছিলাম…
—বড়মাসিমার বাড়ি?
—হ্যাঁ।
—তুমি, আর কে?
—বউমা। আমিই নিয়ে গেলাম।
—তা…এ ছেলেটি?
—কমার্সে এম এ…টাইপ জানে…
—চাকরি?
—হ্যাঁ।
—প্রথমত আমার হাতে কোনো চাকরি নেই। আর কাজের কথাবার্তা আমি বাড়িতে বলি না।
—মেজখোকা।
—তোমার নাম কি?
—অ…অনিমেষ।
—কোন, স্কুল, কোন কলেজ?
—মিত্র ইনস্টিটিউশন, শ্যামাপ্রসাদ।
—ছি ছি ছি! এ সব স্কুল কলেজে এখন কেউ পড়ে? একটা ভালো স্কুল…ভালো কলেজ…
—তুমি তো সোদপুর স্কুল, আর রিপনের ছাত্র মেজখোকা!
বাংলা স্কুলেও অনেকে পড়ে।
—সে সময় আর এ সময়ে অনেক পার্থক্য বাবা…যাক, আর কি করেছ? কোনো সেক্রেটারিয়াল কোর্স? বিজনেস ম্যানেজমেন্ট? কস্টিং?
—টা…টাইপ শিখেছি।
—দেখ, তোমার মতো ছেলেকে…পার্ক স্ট্রীটে আপিসে এসো একদিন, দেখব কোথাও বলা যায় কি না…বাড়িতে নয়, বাড়িতে নয়!
—কবে আসব?
—যে কোনো দিন। লাঞ্চের আগে।
—তবু…
—বিষ্যুৎবার এসো।
—আচ্ছা।
মালিনী বলে, চলো তোতা! প্রথম এলে, একটু মিষ্টি খেয়ে যেতে হয়।
ওরা বেরিয়ে যায়।
—মেজখোকা!
—বলো।
—বিষ্যুৎবার তো তুমি বম্বে যাচ্ছ।
—হ্যাঁ, যাচ্ছি।
—ওকে আসতে বললে?
—তুমি ভেবো না তো। ওর দরকার, ও আসবে, ঘুরবে, তুমি ভেবো না।
—সোজাসুজি বললেও পারতে।
—দেখাই যাক না।
মেজাখোকা বলে, আসছি।
মালিনী তোতাকে নিয়ে ঢোকে। বিশ্বনাথ বলেন, তোতা। তুমি পরীক্ষায় বস না?
—কয়েকটা দিয়েছি।
—আমার মনে হয়…ওগুলোতেই বোস। পরীক্ষার খাতা না কি কমপ্যুটারে দেখা হয়… মানুষের কোনো ব্যাপার নেই…
—আগেও দিয়েছি, এবারও বসছি।
—ঠাকুমা ভালো আছেন?
—আছেন। আপনাকে আবার যেতে বলেছেন।
—যাব।
আরেকটু বসে তোতা উঠে পড়ে। মালিনী বেরিয়ে যায়। বিশ্বনাথ বলেন, দরজাটা খোলা থাক মা।
—বাবা…
—খোলাই থাক।
মেজখোকা বেরোবার জন্য তৈরি। মালিনী আসবে বলে ও বেরোতে পারছে না।
—তুমি বাবাকে নিয়ে ও বাড়ি গিয়েছিলে?
—শুনলেই তো।
—তুমি জানো আমি কোনো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া পছন্দ করি না?
—উনি হয়তো করেন।
—না! তুমি…বাবা…
মেজখোকা এ ঘরে ঢোকে।
—বাবা!
—বলো।
—তুমি এখানে থাকবে…একশোবার থাকবে…কিন্তু দোহাই তোমার, ওই সব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেও না। তুমি যাবে…ওরা আসবে…
—সেটা তুমি চাও না।
—না বাবা। এ সব আত্মীয়রা কাজ বাগাতে আসে, মনে মনে হিংসে করে…আমাদের সঙ্গে মেলেও না কিছুতে…
—ছেলেটি কাজের জন্যেই এসেছিল বটে।
—কে বলল আসতে?
—আমিই বললাম।
—বাবা! আমার যা ব্যবসা, তাতে কোনো আত্মীয় ঢোকানো আমার নীতিবিরোধী। আমি চাই না, আমার ব্যবসা নিয়ে কথা হোক।
—আমার কোথাও যাওয়াও…
—যাবে কেন? ওরা কারা? এখানে তোমার অসুবিধে কি? ঘর বিছানা, টেবিল…বিকেলে হাঁটছ…বেড়াতে চাইলে ময়দানে যাও…গঙ্গার ধারে…
—না, সকলই সুবিধা।
—সোদপুরের ব্যাপারটা ভেবো।
—আরেকবার বলো।
—ধরো আমিই কিনলাম…
—কিনবে কেন? বাড়ি তো সকলের।
—বাড়িটার দাম কষলাম, প্রত্যেকের শেয়ার কিনলাম, টাকাটা তুমিই তো পেলে…
—কেমন করে? তুমি তো ওদের দিচ্ছ।
—আমি তোমার কাছেই কিনছি, তুমি ওদের যা দেবার দিও, নিজেরও রেখো…
—এত জটিলতা করবে কেন?
—কি করে বোঝাই! এখন জমি, বাড়ি, এ সবে যা টাকা…ও বাড়ি ভেঙে ফেললে…
—অনেক ফ্ল্যাট উঠবে।
—নিশ্চয়ই। সর্বত্র হচ্ছে। ফ্ল্যাট বাড়ির প্রোমোটার হলে এখন ঢেলে টাকা আসবে…
—অনেক টাকা?
—অনেক।
—বেশ, ভাবব।
—ভাবো, ভাবো। ঝটপট করো।
—ধরো, তুমি এটা করলে।
—কলকাতাতেও করছি।
—ভালো। কোথায়?
—গড়িয়া, চেতলা…
—ধরো অনেক টাকা হল।
—হবেই, হতেই হবে।
—তখন তুমি কি করবে?
—আমি? আমি এখানেই থাকব। প্রতি বাড়িতে ফ্ল্যাট রাখব একটা ভাড়া দেব।
বিশ্বনাথ বলেন, ভেবে দেখব? কি বলে বউমা? ভাবব না? বয়স পঁচাশি, ছেলেকে বাড়ি বেচে টাকা পাব…
—বাবা! ওখানে তো কেউ থাকবে না। তোমার যা আছে না আছে, তাতে তোমাদের কোনো দরকারও নেই। তোমাকে আমার আগেই…
—এ সব ভেবেছিলে?
—মনে হয়েছিল।
—সে জন্যেই আননি তো?
—না না…হে হে…তুমি ঠাট্টা করছ।
—ভালো, খুব ভালো।
মেজখোকা বেরিয়ে যায়। মালিনী ওঁর দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
—বউমা!
—বাবা!
—কোথায় কোথায় যাব বলেছিলাম…
—যাবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাব।
—না মা, তা হয় না। হুকুম হুকুমই।
—ও আপনাকে হুকুম দেবার কে?
—মা! আমরা গেলেই তারাও আসবে। তোমাদের বৈভব দেখে কারো হয়তো চোখ টাটাবে, কেউ হয়তো এমনিতেই বেশি বেশি যাবে আসবে…ধরো কেউ যদি অপমানই হয়ে যায়…তুমি আমি কি করব?
—আমার…আমার যে কেমন লাগে। মন খারাপ কোর না।
—রবিবার দিলীপ আসবে।
—হ্যাঁ, ওটা ঠেকাবার উপায় নেই।
—আমি আপনার কাছে অপরাধী হয়ে থাকলাম।
—না, তোমার কোন দোষ নেই। একটা জিনিস শুনবে? শোনো।
কি বাবা?
—শোনোই না।
এক বাক্স ক্যাসেট। ক্যাসেটের ওপর তারিখ ও বিষয় লেখা। বেছে বেছে বের করেন বিশ্বনাথ।
—ও কি?
—শোনো, বুঝবে।
মালিনী শোনে।
—বলো তো দিনটা কেমন কাটল?
—খুব ভালো। মেজখোকা বউমা বাবি…সারাদিন কি ভালো লাগলো।
—ভালই তো লাগে সনকা।
—মেজখোকা ঠিক তেমনি আছে তাই না? মাছ কিনে আনবে ফরমাশ করে রাখবে, মেজবউমাও এতটুকু বদলায় নি। ওই চুলটা যা কেটেছে।
—মেজবউমা মানুষটা ভারি ঠাণ্ডা।
—আমার পছন্দ করা মেয়ে, হবে না? মেজখোকা কেমন সাদাসিধে, বউও তেমনি। আমি তো ছবি দেখেই বললাম, আর কোনো কথা নয়। এখানেই বিয়ে হবে।
—আমি কি বললাম?
—তুমি বললে, তুমি লক্ষ্মী, তোমার পছন্দে লক্ষ্মীই আসবে। তোমার তো আমার কথা বলতে…
—মেজবউমা কাছে থাকত যখন…
—বড় ভাল লাগত গো! বউ নয় তো, মেয়ে!
বিশ্বনাথ বন্ধ করে দেন।
—বন্ধ করে দিলেন?
—এরপর শুধু আমাদের কথা।
—আপনার কাছে এরকম ক্যাসেট ক’টা আছে বাবা? অনেক?
—অনেক। আমাদের তো শর্তই ছিল, যে আগে যাবে, তার কথা আরেকজন শুনবে।
শস্তার রেকর্ডার, শস্তার ক্যাসেট, বড্ড দামী জিনিস। মালিনী বলে, ভালো ক্যাসেটে রি—রেকর্ড করিয়ে দেব, ভালো রেকর্ডার দেব, শুনবেন।
বিশ্বনাথ বলেন, ও বাবা! অত টাকা তোমাদের আছে, যে ওঁর কেনা শস্তার রেকর্ডার, শস্তার ক্যাসেটকে টেক্কা দিতে পারে এমন মেশিন কিনবে? এর দাম কত জানো?
মালিনী জলভরা চোখে তাকায়। ঘাড় নাড়ে। এমন ক্যাসেটের দাম ও জানে না।
আজকাল কেউই জানে না।
৫
ক্যাসেটটা শোনার পর মালিনীর মন যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে। শান্তি পায় ও। মনে হয় না গুরুদেবের ধ্যান করি, তাঁর ছবি দেখি, ক্যাসেটে শুনি গুরুবাণী।
মনে যেন জোরও পায় ও।
এ বাড়িতে পাশাপাশি বাস করলেও কেউ কারো আপন নয়, তেমন হওয়াটা নিয়মও নয়। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, লাঞ্চ, ডিনার, ককটেইল (আজকাল কেউ চা খেতে ডাকে না) এ সবে ডাকলে যেতে পারো।
তেমন ডাকাও সকলকে ডাকা চলে না। যে—যার সে—তার মতো থাকো।
এ বাড়িতে খবর চালাচালি হয় দাসদাসী—জমাদার—ড্রাইভার মারফত।
গোপালও বলে যায়, কেডিয়াদের ছেলেমেয়ে এখন বাইরে, অন্য এলাকায়। কেন না বিগ জনি খুব মস্তান ছেলে। মুন ওর নাম পুলিশকে বলেছে, ওর শোধ ও নেবেই নেবে। মুন বলেছে যে পুলিশকে খবর দিয়েছে সেই বুড়োবাবু কি ছাড় পাবে।
বাবি নিবিষ্ট মনে সকালে জগিং ও তিনটে থেকে জিমন্যাশিয়াম চালিয়ে যায়। মা বলেছে, পাশ করলেই সকালে সেন্ট জেভিয়ার্সে কমার্স পড়বে, দুপুরে বিশ্রাম, তিনটে থেকে জিমন্যাশিয়াম।
মালিনী এখন নিশ্চিন্ত। মুনরা নেই। বাবি কথা শুনছে। মেজখোকা বাড়িতে এমন কিছু করছে না যাতে বিশ্বনাথ বিরূপ হন।
বরঞ্চ বলেছে, তোমার সঙ্গেই তো বনে বেশি বাবার। ওঁকে নিয়ে বেড়াও, ঘোরো, আর মাঝে মাঝেই বোলো সোদপুরের বাড়িটার কথা।
—আমি কেন বলব?
—কি আশ্চর্য, টাকাটা কার হবে?
—তোমার।
—বাঃ. মালিনী, বাঃ।
—টাকার হিসেব আমি রাখি, না জানি! তুমি যখন বলো, কাগজে সই করি। কিসে সই করছি তাও জানি না।
—তোমারই তো সব।
—এক সময়ে এত ছিল না। যা দিয়েছ তাতেই চালিয়েছি। এখন এত হয়েছে যা দিচ্ছ তাতেই চালাচ্ছি।
—সোদপুরে আজ ফ্ল্যাট তোলা মানে জনসেবা করা। মানুষের বসবাসের একটু জায়গা…
—বাবার ওই বাড়ি বাদ দিলে সোদপুরে আর জায়গা কি নেই?
—সর্বত্র ফাটকাবাজ।
—বাবার যা বয়স…
—হ্যাঁ, কদ্দিন বাঁচবেন।
—জানোই যখন, সবুর করো না।
—সবুর করলে বাড়ি পাঁচ ভাগ। তখন সকলকে রাজী করানো কাজে এগোনো…বাবির ভবিষ্যৎটাও ভাবো।
—বাবির ভবিষ্যৎ কি খুব অনিশ্চিত। জানি না তুমি এত নিশ্চিন্ত হয়ে থাকো কেমন করে। আমি তো ভাবলে কূল পাই না…
এই ফ্ল্যাট তিন হাজার বর্গফুট, অন্যটি বড্ড ছোট, আঠারো শো বর্গফুট। পার্ক স্ট্রীট, ডালহৌসিতে নামী—বেনামী দুটি অফিস গোলডিলক ম্যানসনে লীজ নেয়া ফ্ল্যাট (উদ্দেশ্য এনটারইনমেন্ট। সব মক্কেলকে বাড়িতে আনা যায় না), দুটি আপিসে ছয়টি গাড়ি বাড়িতে দুটি…
এই সব কিছুর মালিক মেজখোকা ভাবলে কূল পায় না কিছুতে মালিনী, স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, দেখব।
—দেরি কোর না।
—সে আমি বলতে পারি না।
আঁচল উড়িয়ে চলে যায় মালিনী। মেজখোকা দেখে, যেন বদলে যাচ্ছে মালিনী।
দুপুরে ছেলে ও শ্বশুরের সঙ্গে খাচ্ছে। ডায়েট ছেড়ে দিয়েছে। আবার সুতির শাড়ি পরছে। চুল টেনে দেখছে কতটা লম্বা হল।
সেদিন বেশ জোর দিয়েই বলল, গোপালকে চাকরি করে দেবে বলেছিলে, কবে দেবে।
—দেব, দেব।
—ও তো অফিসার হবে না। হবে পিওন বা বেয়ারা। —সেটা করে দাও।
—এত তাড়া কিসের।
—চার বছর হল, ও আর থাকবে।
—দেখছি, দেখছি।
—লোক গেলে লোক আমি খুঁজতে যাব না।
—আমি যাব।
—এদিকে লোকজন পাওয়া, রাখা, খুব বিপজ্জনক। ওই তো কপোত কমপ্লেক্সের মালীটা সবাইকে লোক দেয়। পোর্ট এলাকার লোক যত। জাল সার্টিফিকেট দেখায় সব। ও বাড়িতে কতগুলো বড় চুরি—ডাকাতি হল বল তো। গোপালের মত লোক গেলে পাব।
—এবার ওকে করে দেব।
—টাকা আনছ, রাখছ লকারে, ও বোঝে না।
—দেব, বলছি তো!
বিশ্বনাথ যেন বদলে যাচ্ছেন। সোদপুরের কথা বললেই বলেন, ভাবছি মেজখোকা।
সত্যি বলতে কি, ছোটখোকা, বেবি, কাউকে বিশ্বাস পাচ্ছে না মেজখোকা। ”বাবা এসে ক’দিন থাকুন” এ হেন সন্তানোচিত প্রস্তাবকে ও নাকচ করে দিচ্ছে।
—না না, আমার ওখানে উনি চমৎকার আছেন। মালিনী সর্বদা দেখছে পার্কে বন্ধু হয়েছে কিছু…
—বাঃ, আমরা ওঁকে কাছে পাব না।
—তোমরাই এসো না ঘন ঘন।
দীপক বলে, অযথা উদ্যম খরচে আমি নেই ভাই। সামনে তোমার বিবাহবার্ষিকী…কত বছর হল। আঠারো না উনিশ।
—আঠারো।
—শ্বশুরমশাই যেমন আছেন থাকুন না। উনি ঠিক সেঞ্চুরি করবেন। পাঁচ বছর তুমি, পাঁচ বছর ছোটখোকা, শেষ পাঁচ বছর বেবি।
বেবি বলে, বাবা জামাই বাড়িতে থাকবেন না।
দুটি গোলমেলে টেন্ডার ধরিয়ে দীপক এখন খোসমেজাজে। দীপক বলে, আরে দশ বছর বাদে জামাই কোথায়। উনি তো মেয়ের কাছেই থাকবেন।
—তুমি কোথায় থাকবে।
—মরদ কা বাৎ হাতি কা দাঁত প্রেয়সী! তখন আমি ”আশ্রয়” হোমে থাকব। মোটা টাকা ফেলব, আলাদা কটেজ নেব, ভিডিও থাকবে। ওয়েস্টার্ণ ছবির ক্যাসেট আর পাঁচশো ডিটেকটিভ বই, ব্যস। টা টা গুড বাই!
—ছেলে—মেয়ে।
—তখন তোমার আটচল্লিশ, ছেলে—মেয়ের ত্রিশ—একত্রিশ। আমি ভাবব কেন। মেয়েকে তো কুড়ি না হতে বিয়ে দেব, তখন তুমি হয়তো দিদিমা!
—দীপকদা! কুড়ি না হ’তে।
—শিপ্রা! সবাই তুমি নয় ভাই। আমার কন্যা ও পুত্রের পেছনে যা খরচ করি তাতে দশটা ছেলে মানুষ করা যায়। কিন্তু কন্যাটি কোনমতে পাশ করে।
কৃতজ্ঞ মেজখোকা দীপকের কাছে। বাবা প্রসঙ্গটি ঘুরিয়ে দেবার জন্যে।
দীপক বলে, মালিনী এল না।
—না। ওর খুব স্বাধীন মতামত হয়েছে।
শিপ্রা ঈষৎ হেসে বলে, ভালো।
—ভালো নিশ্চয়, তবে বাড়াবাড়ি ভালো নয়। আমাদের ক্লাবের বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় কিছুতে জজ হল না। বলল, তোমার বউ বলেই এতদিন হয়েছি! আর না। আঁকার কিছু জানিই না যখন…অথচ একসময়ে মালিনী বেশ আঁকত…
ছোটখোকা ঈষৎ হাসে। বলে, আঁকত বড়বউদি। মেজবউদি সেলাই—টেলাই করত এক সময়ে…খুব গোছালো সংসারী ছিল।
বেবি বলে, সে এখনো আছে।
দীপক বলে, তোমরা এমনভাবে বলছ যেন গোছানো সংসারী হওয়াটা কিছু নয়। ওটা খুব বড় গুণ। মালিনীকে আমি খুব তারিফ করি।
এখানেই কথাটা ফুরোয়।
বিবাহবার্ষিকীর কথা বলতে মালিনী বলে, থাকুক এবার।
—কেন।
—মা গেছেন আজ সাত মাস…
—তা ব’লে আমরা কেন…।
—মা—বাবা কোনদিন বিবাহবার্ষিকী করেননি। আমরাই ষাট বছর হতে…সুখী দম্পতিদের বিজ্ঞাপন দেবার দরকার করে না।
—এ সবের সামাজিক দিকও তো আছে।
—দেরি তো আছে, দেখা যাক।
—এই রবিবার বেবিদের ডাকবে।
—না, এ রবিবারটা থাক।
—বেবি বলছিল।
—তা তুমিই যাও না। বাবিকেও নিয়ে যাও। ও তো সোনা রূপার সঙ্গে ভালই থাকে। ওখানে গেলে তোমরাও বিয়ার খেতে পারবে।
—ব্যাপারটা কি বলো তো।
—কিছুই না। সোদপুর থেকে বাবার কাছে দিলীপ আসবে বাড়ির খবর নিয়ে।
—দিলীপ কে।
—আশ্চর্য! মীরার বর।
—মীরা!
—বাবা—মার কাছে থাকত, ও বাড়িতে থাকে।
—ও!
—আমি না থাকলে…
—হ্যাঁ…আমি না থাকলে চলবে। কিন্তু তুমি না থাকলে…সে কি খবর আনবে।
—বাড়িটার খবর, আর কি!
—তা আসুক। বেশিক্ষণ যেন না থাকে। আসলে বাবাকে আমার কথাটা বুঝতেই হবে।
—কি কথা।
—সোদপুরের বাড়ির কথা। তখন বাবা উদার হলেন, গোবরডাঙার বাড়ি বেহাত হল।
—সে তো তোমাদের পিসীমার মেয়ে…সে সময়ে তার কিছু ছিল না…তোমাদের তো অনেক আছে…
—তুমি বুঝবে না।
—কেমন করে বুঝব। আমার মা—বাবাকেও কতজনের ভার নিতে দেখেছি…
—দেখ মালিনী, গোবরডাঙার বাড়ি মায়ের ভোগে গেছে। সে যাক। কিন্তু জমি মানে সোনা। সে বাড়ি তো আমাদেরই প্রাপ্য ছিল, তাই না।
—জানি না।
—সোদপুরের বাড়িও মায়ের ভোগে যাবে, দেখো। ওই সব মীরা, দিলীপ! ওপরের ভাড়াটেরা…
—কাকে কি বলছ? ওঁরা ডাক্তার। তোমার মা যেটুকু চিকিৎসা পেলেন, ওঁরাই করেন। মীরার মা, মীরা, দিলীপ, এরা বাবা—মাকে কিভাবে আগলে রাখত। মাইনে তো ওঁরা ভাড়ার থেকেই দিতেন, দেন।
—মাইনে, কতভাবে বাগাত, বাগাচ্ছে…
—দেখ! সোদপুরের চিঠি পান না বলে বাবাই ওকে আসতে লিখেছেন। তাই তুমি যদি থাকো, তাহলেও কোনভাবে অশান্তি কোরো না।
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। …কি জানো…আমারই ভুল! চিঠি বোধ হয় এসেছিল…
মালিনী ফ্যাকাসে হয়ে যায়।
—ওদের চিঠি এসেছিল?
—বোধহয়।
—কোথায় গেল?
—আমিই কোথাও…দেখব…
হতাশ গলায় মালিনী বলে, না। এখন দিও না। বরঞ্চ চিঠি আসে নি, বাবা তাই জানুন। চিঠি যদি দিতে, তাহলে হয়তো উনি ওকে আসতে লিখতেন না। কিন্তু…সে চিঠিতে কি ছিল যে তুমি বাবাকে দাও নি।
—গেঁয়ো লোকদের কৌশল যত। বাবাকে ওখানে নিয়ে যাবার চেষ্টা। ওঁকে না দেখে মন কত খারাপ হচ্ছে, মায়ের নামে ওরা তুলসী দিচ্ছে! রাবিশ! তোরা, তোরা দেবার কে? বাবার ছেলে, না নাতি?
—তোমরা তো কিছু করছ না। ওরা যদি…
—আরে যত ননসেনস। কোন গাছে কি ফুল ফুটছে, পাম্পটা তুহিন সারিয়ে নিয়েছে…বাৎসরিক যেন ওখানে করা হয়…
—এগুলো তো খুব নির্দোষ কথা।
—না। প্যাঁচ কষে বাবার মন গলিয়ে ওঁকে নিয়ে যাবার চেষ্টা। সেজন্যেই দিই নি। আমি চাইনি যে বাবার সঙ্গে সোদপুরের কোনো যোগাযোগ থাকুক।
—আমার কিছু বলার নেই। শুধু দোহাই তোমার, এ সব নিয়ে মাথার জট পাকিয়ে রবিবার বিয়ার—টিয়ার খেয়ে অসময়ে এসে পোড় না।
—এলে আসব।
—বাবার সামনে!
—আমি বাবার বাড়িতে নেই। বাবা আমার বাড়িতে আছেন। আমার জীবন যেমন তা জানলে জানবেন। আমি তো পাপ করছি না।
—আমার কিছু বলার নেই।
রবিবার এসে পড়ে। মালিনী যন্ত্রচালিত, যন্ত্রচালিত। মেজখোকা বাবিকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। বিশ্বনাথ মালিনীকে বলেন, দিলীপ ভাত একটু বেশি খায় মা, খাটাপেটা মানুষ।
—হ্যাঁ বাবা। ভাববেন না।
—তুমি কি ভাবছ বল তো?
—কই কিছু না তো।
—কোনো আড়ম্বর কোর না।
—না না, মাছ দু’রকম…
—ওরা তো মাছ পায়ও না। খায়ও না বলতে গেলে। দু’রকম মাছ। দিলীপের মহাভোজ।
বিশ্বনাথ আজ অসম্ভব খুশি। ছোট ছেলের মতো। বলেন, তোমাকে তো বলাই হয় নি একটা কথা।
—কি, বাবা?
—আজকের দিনটা কি, তা জানো?
—না, বাবা।
—আজ ওঁর জন্মদিন। যদি থাকতেন, আজ পঁচাত্তর পুরে ছিয়াত্তরে পড়তেন। দেখ কি যোগাযোগ। আজকের দিনেই দিলীপ আসছে।
—দিলীপ তো মাকে খুব ভালবাসত।
—খুব। ছেলেটা এমন সৎ! এটা ওটা কেনা—বেচা করে পেট চালায় তা বাজারে কোন ফড়ের ব্যাগ পড়ে যায়। ও সেটা খুলেও দেখে নি। ঠিক তাকে পৌঁছে দিয়েছিল। কতজন বলল। নিয়ে নে।
—ও নেয় নি?
—সে ছেলেই নয়। ফড়ে তো অবাক। বাজারিয়া একটা ছেলে। দেড় হাজার টাকা। ছোট ব্রিফ ব্যাগ, তা একটা নোট সরায় নি? সে ওকে দুশো টাকা দেয়। তাই নিয়ে ও কারবার শুরু করে।
—কিসের কারবার?
—শস্তার লাইটার…টর্চ…হাতের কাজও জানে নানা রকম। আমরা তো কোনোদিন ইলেকট্রিকের কোন ব্যাপারে ছোটখাট মেরামতিতে কারিগর মিস্ত্রিকে পয়সা দিই নি।
স—ব দিলীপ!
—বাবা! মার সন্তান বেশি বয়সে হয়েছিল। তাই না? আজ ভাবছিলাম। বড়দার তো আটচল্লিশ।
—হ্যাঁ মা! প্রথম দিকে তিনবার হয়েই মরে যায়। অনেক চিকিৎসার পর…বড়খোকা হয় যখন, ওঁর প্রায় সাতাশ।
—সাতাশ!
—হ্যাঁ…সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিল। সেই জন্যেই তো উনি বলতেন। ওরা আমার তপস্যার ফল, বিধাতার আশীর্বাদ!
—অত্যধিক আদর দিতেন?
—না না। বেশ শাসন করতেন। মারেননি কখনো, তবে রাগ ছিল।
কারা তপস্যার ফল, বিধাতার আশীর্বাদ? নির্লিপ্ত বড় ছেলে। টাকার নেশায় নির্লজ্জ মেজ ছেলে। অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক ছোট ছেলে। কখনো অস্থির কখনো শান্ত স্বার্থপর বড় মেয়ে। বিদেশে নিজের জীবন গড়তে ব্যস্ত ছোট মেয়ে?
—মারো না মারো, রাগটা দরকার।
—হ্যাঁ, বাবা।
—বাবি তো বেশ শান্ত হয়ে গেছে।
—হ্যাঁ।
—না চাইতে সব পেয়ে যায় তো। তাই এখনকার বড়লোকের ছেলে—মেয়েরা কোনো কিছুর মূল্য বোঝে না।
—আমরাও তো মন দিতে পারি না বাবা। তাই সর্বদা যা চায় দিয়ে…
—ওই ভুল কোর না। ঘুষ দিও না।
—বড় ভাবনা হয়। দেখি, কতদূর পারি।
—তোমার মা ছিলেন সম্রাজ্ঞী। আমি ওঁর সংসার সাম্রাজ্যে একটি কথাও বলতাম না।
—ওরা সোদপুরে পড়ল কেন? বাড়ি তো করলেন অনেক পরে।
—ঘোরার চাকরি। ওখানে জমি কিনলাম…জায়গাটাও ভালো লাগল…বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওঁকে রাখলাম…আমারও রিটায়ার করার সময় হলো…এক্সটেনশান আরো ক’বছর তারপর…
—কলকাতায় ওরা?
—হস্টেলে থাকত।
—আপনাদের নিজেদের খুব মিল ছিল।
—তা ছিল। কোনো কাজেই উনি বা আমি, যেন সঙ্গে আছি, যেন একলা নই, এরকম একটা…কলকাতায় ছোট খোকার জন্যে ঘর ভাড়া…সে অনেক ইতিহাস। বললে ফুরোবে না।
—তারপরেও তো বাড়ি করলেন!
—উনি ছিলেন ব’লে। কত টেনে চলতেন। সংসারে কিসে সাশ্রয় হয়…সব উনি!
আর মালিনী নিঃসঙ্গ, নিঃসঙ্গ। এমন একাকিত্ব বড় দুঃসহ।
দিলীপ এসে পড়ে।
দিলীপ, তুহিন, বিদিশা।
—আসুন আসুন। এসো দিলীপ।
বিদিশা বলে, মেসোমশাই আছেন। লিখেছেন, ও আসবে। তা ও তো ভয়ে সারা।
—কিসের ভয়?
—এ সব বাড়িতে ঢুকতে আমাদেরই একটু সাহস লাগে, ওর তো লাগবেই।
—চলুন বাবার ঘরে।
ঘরদোর দেখতে দেখতে ওরা ঢোকে বিশ্বনাথের ঘরে।
দিলীপ আড়ষ্ট, বিশ্বনাথ খুশিতে উচ্ছল।
—এ যে সবাই মিলে!…বউমা!
—সব ঠিক আছে বাবা।
—বিদিশা বলে, আমরা খেয়ে এসেছি।
মালিনী বলে, শুনছে কে? আবার খাবেন। দিলীপ এত চুপচাপ কেন?
তুহিন বলে, ও ওর দাদুর সঙ্গে গল্প করবে।
—বিশ্বনাথ বলেন, দিলীপ চিঠি লিখেছিল বলছে?
—লিখেছি দাদু। তিনটে চিঠি।
—পাই নি তো। ঠিকানা ঠিক ছিল?
—ডাক্তার মামী লিখে দিয়েছিলেন।
—কি জানি ডাকের তো গোলমাল হয়। থাক, বাড়ির খবর বলো।
মালিনী বলে, আমরা ও ঘরে যাই?
—না না, তুমি থাকো। বুঝলে তুহিন। কলকাতায় বাস, সে আমার পক্ষে…এই বউমা আমাকে ভুলিয়ে রাখে। সব সময়ে আগলায়।
—বাবার যেমন কথা।
—যেন আমি ওর ছেলে।
বিদিশা বলে, সে তো হবেই। আপনার ছেলে বউয়ের কাছে থাকবেন…মীরার মা, ওরাও তা মানে কিন্তু আপনাকে দেখতেও…আমাদেরও ইচ্ছে হয়।
—আসেন না কেন? কলকাতায় তো আসেন।
—কাজ নিয়ে আসি তো…
দিলীপ বলে, বাড়ি যেমন ছিল তেমনই আছে দাদু। বাতাপি লেবুর গাছের গোড়ায় উই লেগেছিল, ওষুধ দিয়েছি। নারকেল গাছ ছাড়াতে হবে, ফল পাড়তে হবে…
—সে তো ভাদ্র মাসে রে!
—এই সাত মাস মা দিদিমার নামে তুলসী দিয়েছে। তা বছুরকির কাজ কোথায় হবে!
—বাৎসরিক! দেখি কোথায় হয়।
রব উঠে গেছে, বাড়ি ভাড়া দেবেন। সামনে লোক আসছে, খোঁজ নিচ্ছে। তা আমি বলি, আমি কিছু জানি না।
—তোরা কোন ঘরে আছিস?
—আছি রান্নাঘরের বারান্দায়! তবে রাতে আমরা বাইরের ঘরে শুই, মা ওদিকে দুটো দিকেই পাহারায় থাকে। মীরা একটা নেড়ি কুকুর পুষছে, সে বাগানে…
—বাগানের আলো তো জ্বালা থাকে?
—হ্যাঁ, হ্যাঁ।
তুহিন বলে, আপনি বলেছিলেন নিচের ইলেকট্রিক বিল, বাড়ির ট্যাক্স ভাড়া থেকে কাটান করে ব্যাঙ্কে জমা দিচ্ছি।
—কি রকম বোঝ? মিস্ত্রি লাগানো দরকার।
—একবার লাগলে ভালই হত…
—হ্যাঁ, পাঁচিলটা…বাইরের কলতলা…
—এই থলিটা কোথায় রাখব মামীমা?
—কি আছে?
—এই…
ডাঁটা, লেবু, লঙ্কা, বেগুন, হলুদ, জবা ফুল সেলোফেন মোড়কে বিশ্বনাথ হাত বোলান বারবার ফুলে।
বউমা! এখন নীল জবা, সাদা জবা, হলুদ জবা, রক্তজবা, গোলাপী জবা…ওঁর হাতে লাগানো।
—আমি সাজিয়ে রাখি আপনার ঘরে। দিলীপ, তরকারি নিয়ে এসো ভাই।
—এ সব জিনিসের স্বাদই আলাদা। আর কিচেন গার্ডেন তো মীরার মায়ের। উনি আর মীরার মা পরামর্শ করে করে…
আগে আগে আমিও কত এনেছি।
মালিনী বেরিয়ে যায়। বিদিশা ওর পেছন পেছন আসে। বলে, একটু দেখি। বিজ্ঞাপন ছাড়া তো দেখতে পাই না। এ সব।
নিকিতাশা ওভেন, কতরকম বাসন, ডীপ ফ্রিজ, এমনি ফ্রিজ। রান্নার ঘর বিদিশার শোবার ঘরের সমান।
মালিনী বলে, আমি অত কিছু সব সময়ে ব্যবহার করি না। গ্যাসেই কাজ চালাই। সুবিধে বোধ করি।
—বউদি! একটা কথা ছিল।
—বলুন না।
—কোথাও বসি।
—আমার ঘরে চলুন।
—চলুন।
মালিনীর ঘরে বিশাল আলমারি, বিশাল খাট, ড্রেসিং টেবিল, সবই পুরনো আসবাব।
—ওর সখ। নিলাম থেকে পুরনো জিনিস কিনবে, পুরনো ডিজাইন হবে, সে শুধু আমার ঘরে।
—একেক ঘরে একেক রকম?
—বলো কেন?
মালিনী কি যেন ভাবে। বলে, বিয়ের ফার্নিচার তো ফেলেই দিল। এ বাড়ির ঘর—দোর কারা যেন…নবীনা ইনটেরিয়ার ডেকোরেটর্স সাজিয়ে দিয়েছে!
—খুব সুন্দর তো।
—ওর শখ!
বিদিশা দেখে নেয় ঘরে ঘরে টিভি, ভি সি আর। না, বিলাসের উপকরণ অঢেল।
—কি বলছিলেন?
—মেসোমশায়ের সামনে বলা ঠিক হত না…একটু ডেলিকেট ও একদিন নন্দন (মেজখোকা) বাবুর আপিসে গিয়েছিল, ওদিকে কাজ ছিল ওর…
—ও কিছু বলেছে?
—বলেছিলেন—বাড়ি বেচে দেবেন…ওপর—নিচ খালি করবেন…মানে…
—কবে? সময় দিয়েছে?
—ওই বলেছে, মানে তুহিন, অন্তত তিন মাস সময় দিতে। উনি বলেছেন, সে সময় পাবেন আর এ কথা মেসোমশাই যেন না জানেন।
মালিনী বলে, কতদিন আগে?
—মাস চারেক তো বটেই।
মেজখোকা! ওর স্বামী!
—আপনাকেই বললাম।
—দিলীপরা জানে?
—না, ওদের বলি নি। আমরা বলার কে? আপনাদের বাড়ি, আপনারা যা কিছু করবেন তাই হবে। আমরা কেন বলব?
—এ কথা আমার—আপনার মধ্যেই থাকুক ভাই। এখনি এ কথা উঠছে না। বাবাকে বললে বাবা মনে ভীষণ আঘাত পাবেন।
—মাসীমার কাজ?
মালিনী অনেক দূরে চলে যায়। বেদনার্ত ওর হাসি। ও বলে আমার কথায় তো কিছু হবে না। ছোটছেলে বোধ হয়…সে ওরা ভাইবোনে যা ঠিক করবে…মা বাবা বিশ্বাস করতেন, আমিও করি, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার কোন কথাই খাটবে না।
—আপনি তো স্ত্রী।
—ওদের মা, ওদের বাবা, ওর বাড়ি।
—এসব খাওয়াটাওয়া…
—বাবা কত খুশি হয়েছেন! বাবাকে তো এই কাছে পেলাম! ওঁর জন্যে কি বা করতে পারি…
—ওঁর প্রাণটা সনকাবাসে পড়ে আছে।
—একেবারে।
—ওঁদের মতো সুখী…
—দেখা যায় না।
—চলুন, ও ঘরে যাই।
—হ্যাঁ, আমি খাওয়ার ব্যবস্থা দেখি।
—আমরা চারটের মধ্যে পৌঁছতে চাই।
আজ বিশ্বনাথের পছন্দমতো সব রান্না। মোচার ঘন্ট, মটর ডাল, সুক্তনি, রুইমাছ ভাজা, রুইমাছের ঝোল। টক, দই, মিষ্টি বিশ্বনাথ খাবেন না ওরা খাবে।
টেবিলে ওঁরাই বসেন। দিলীপ এখানে বসে খাবে না। ওকে রান্নাঘরে বসিয়ে খাওয়ায় মালিনী। ও শুধু বলে, এত পারব না মাসীমা। অভ্যেস নেই।
তুহিন হেঁকে বলে, সব খাও দিলীপ। অসুখ হলে আমি দেখব। আর মাদুলি নয়।
বিদিশা বলে, বলেন কেন! আমাদের দেখাবে, ওষুধ খাবে, সব করবে। কিন্তু মীরার মা টোটকা—তাগা—মাদুলি ঠিক আনবে। বিশ্বনাথ বলেন, আমাদের কম জ্বালাত?
মালিনী মনে মনে বলে, চলে যাক, চলে যাক ওরা। ও আসার আগে চলে যাক।
যাবার সময় হয়ে আসে। বিশ্বনাথ দিলীপের ঘাড়ে হাত রেখে বলেন, আবার আসবি। তোর চিঠি আমি এবার যেন পাই।
এবং মেজখোকা ঢুকে পড়ে।
ওকে দেখেই বোঝে মালিনী, ও বেশ তৈরি হয়ে এসেছে। শুধু বিয়ারে মেজখোকা এমন প্রমত্ত হয় না।
—এই তো! ফুল হাউস।
—তুমি ঘরে চলো।
—চুপ করো।
—বাবি কোথায়?
—পরে আসবে।
—তুমি ঘরে চলো।
—কেন?
—তুমি এখন…
—না, মাতাল নই। সরে যাও।
মালিনীকে ঠেলে দেয় ও।
বিশ্বনাথ বসে পড়েন ডিভানে। ছেলের দিকে তাকান।
—এই যে! তুহিন ডাক্তার এবং বিদিশা এবং দিলীপ। তোমরা ভেবেছ কি?
—ছি ছি ছি। চুপ করো।
—এটা কি হোটেল?
—নন্দনবাবু!
—ওখানে তো জেঁকে বসেছ। ভেবেছ ওপরে তিন পয়সা ভাড়া দেবে, নিচে বিনা পয়সায় কয়েকটা বস্তির লোক…না, তা হবে না।
—আমরা চলে যাচ্ছি।
—হ্যাঁ, এখান থেকেও, সোদপুর থেকেও। ওপর নিচ সবটা খালি চাই আমার।
—বাড়ি তোমার নয়। বাড়ি বাবার। বাবা যা বলবেন তাই হবে। তুমি বলার কে?
—চুপ করো। বাবা…বাবা…বাবা…বাবা আছেন এটা কোর না, বাবা আছেন ওটা কোর না…বাবাকেও বলে দিচ্ছি এ বাড়িতে তুমি আমার লাইফপ্যাটার্ন মেনে নেবে…বাবা!
—নইলে কি আমাকেও চলে যেতে হবে মেজখোকা? সেটাও বলো।
—ভেবো না ওখানে ফিরছ। এখানে না রাখি, তুমি ”আশ্রয়” হোমে যাবে। তোমার জন্যে আমার জীবন যাত্রা আপসেট…
মালিনী বলে, চুপ করো।
—করব না।
—বেশ। তাহলে জেনে রাখো…
কি জানবে তুমি?
মেজখোকা মাতালের পক্ষে স্বাভাবিক, এমন ধূর্ত হাসি হাসে, আমিই বলছি। ওই দিলীপ বদমাশ তোমায় চিঠি লিখেছিল…
—লিখেছিল।
—আমি ছিঁড়ে ফেলি। আমি চাই না ওরা তোমার সেন্টু—মেন্টুতে সুড়সুড়ি দিয়ে তোমাকে নিয়ে যাক। ও সব বদমাশিয়ে আমার জানা আছে। তুলসী দিচ্ছি! মার বাৎসরিক!
যত্তো সব…
—চলো বিদিশা।
—নিয়ে গিয়ে, তুমি চোখ বুজলে বাড়িটি ওপর—নিচে মিলে হাতিয়ে নিয়ে…নো! তা হবে না। এ বাড়িতে থাকতে হবে বাবা!
—বলো বলো। বিশ্বনাথের বিশ্বদর্শন হচ্ছে।
—নো আত্মীয়স্বজন, নো যোগাযোগ উইথ সোদপুর, ওরা তোমাদের দেড়েমুশে অনেক খেয়েছে। এখন আর অতীতের সঙ্গে…
—কোনো যোগাযোগ নয়।
—না। তোমার সময়ও হয়ে এসেছে। একটা বাড়ি ভিখিরিদের দিয়ে এসেছ, এ বাড়িটা আমি চাই। এরা ফুটে যাক।
—মেসোমশাই! কাঁপছেন কেন?
মালিনী বলে, বাবা!
বিশ্বনাথকে ওরা শুইয়ে দেয়। তুহিন নাড়ী দেখে।
বিদিশা বলে, ঠান্ডা জল! তোয়ালে!
মালিনী বলে, বাবার ঘরে নিয়ে চলুন।
বিশ্বনাথকে ওরা ঘরে এনে শোয়ায়। তুহিন বলে, না নার্ভাস হবেন না বউদি।
বিশ্বনাথ চোখ খোলেন। আস্তে বলেন, ব্যস্ত হয়ো না। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল।
তুহিন বলে, বউদি! এ ফ্ল্যাটে কোনো ডাক্তার নেই? আমাদের সঙ্গে তো…
বিদিশা বলে, নাড়ী ভালো…তবু একটা কোরামিন ড্রপ দিলে ভালো হত।
মালিনী বলে, আমি আসছি।
ফ্ল্যাটের ডাক্তার গাইনি। রবিবার ওঁরা ভীষণ ব্যস্ত।
মালিনী বলে, একবার আসুন। বাবার প্রেসারটা…
মেজখোকা এখন ডিভানে চিৎ। ওর চোখ বোজা। ও বলে, ওসব বাবার অভিনয় মালিনী! তোমার সেন্টুমেন্টু…
মালিনী বলে, গোপাল! ভুবন! সায়েবকে তার ঘরে নিয়ে যা।
—আমার ঘরে? বেশ? প্যারাসাইটগুলো গেছে? ওদের তাড়াও, তবে তো যাবো।
মালিনী ঝুঁকে পড়ে বলে, এখনি যাবে। না গেলে তোমাকে আমি কি করি…
—বড্ড বেশি মারদাঙ্গা ফিলম দেখ…
ওর কথা জড়িয়ে আসে। নাক ডাকে।
ডাক্তার রুদ্র ঢোকেন। বিশ্বনাথকে দেখেন। না, তেমন কোনো ব্যাপার নয়। প্রেসারটা যৎসামান্য…এই সব ওষুধ…
তুহিনই চলে যায় আনতে। দিলীপ নীরবে কাঁদে। বিদিশার মুখ অপমানে লাল।
মালিনী বলে, ওর কোনো কথা আমল দেবেন না। বাড়ি বাবার। আপনারা থাকবেন।
বিশ্বনাথ বলেন, হ্যাঁ।
—চিঠির ব্যাপার আমি দেখব।
বিশ্বনাথ ক্ষীণ হাসেন। বলেন, তুমি!
—কথা বলবেন না মেসোমশাই। বিশ্রাম করুন।
—তোমরা তো জানো, আমার কোনো…
—অসুখ নেই, জানি।
তুহিন ফিরে আসে। ওষুধ পড়ে। বিশ্বনাথ ঘুমোন।
বিদিশা বলে, ওঁকে আজ…
—কেউ ঘরে ঢুকবে না। আমি থাকব।
—আমরা চলি।
—আসুন। আমার তো আর কোন ক্ষমতা নেই। আমি শুধু ক্ষমা চাইতে পারি।
—আপনি কেন ক্ষমা চাইবেন?
—আপনাদের শেয়ালদায় পৌঁছে দিই?
বিদিশা হাসে! বলে, আপনার গাড়ি হলে ‘হ্যাঁ’ বলতাম। ভাববেন না, চলে যাব।
দিলীপ হঠাৎ কেঁদে মালিনীর পা ধরে। বলে, যেদিন বলবেন, ও বাড়ি ছেড়ে চলে যাব মামীমা। আমাদের দাদুকে শুধু দেখবেন।
—ওঠো দিলীপ। দেখব।
—কোথায় পাঠাবে বলল।
—আমার কাছ থেকে?
মালিনী বেরিয়ে আসে। ঈষৎ হাসে। বলে, ওকে আমি জানি। তবু ওর হয়ে বাবার কাছেও ক্ষমা চেয়েছি সেদিন। মনে করতাম…কিছু মনুষ্যত্ব ওর তবু আছে…
বিদিশা বলে, ভাববেন না। আপনার তো কিছু করার নেই।
—আমি বাবাকে আনতে চাইনি। জানতাম একদিন না একদিন…আমার মতের কোনো দাম তো নেই। কি করব বলুন? আজ আপনারা যা দেখলেন…
—এটা আপনার প্রত্যহের অভিজ্ঞতা! চলি।
ওরা বেরিয়ে যায়। মালিনী পাথর, পাথর। বিশ্বনাথের ঘরের দু’টি দরজা বন্ধ করে। তারপর গোপালকে বলে, তোরা খেয়ে নে। কেউ এলে, যদি আমি ঘুমিয়েও পড়ি আমাকে ডাকবি।
—হ্যাঁ মা।
—সায়েব?
—ঘুমোচ্ছেন।
মালিনী বিশ্বনাথকে দেখে আসে। ঘুমোচ্ছেন। তারপর ডিভানে শুয়ে পড়ে। ঘুম আসে না, ঘুম এলে হবে না। এখন ওকে জেগে থাকতে হবে।
—মা!
—কি গোপাল?
—আমি দাদুর ঘরে শোব?
—না না। শুলে তো ঘুমোবি।
—মা!
—আবার কি?
—দিলীপদা বলছিল…
—কি?
—সোদপুরে গেলে ও মাদুলি দিতে পারে।
—মাদুলি!
—হ্যাঁ গো মা। খুব তেজী মাদুলি। বেকারের চাকরি হয়, আপাই ক্ষেতি দোষ কেটে যায়…
—যাস একদিন।
—আচ্ছা।
মালিনী জেগে থাকে। বিশ্বনাথকে সে কার হাত থেকে আড়াল করবে? ”আশ্রয়” হোম! নিশ্চয় এ বিষয়ে ওখানে কোনো কথা হয়েছে। বেবির কথায় যত বিষই থাক, দাদারা ওর মতামত ছাড়া কোনো কাজ করবে না। দীপক কিছু বলতে যাবে না, খানিক বাঁকা পথ বলবে। ছোটখোকা ”হ্যাঁ” বলবে। শিপ্রা কি বলবে?
বিকেলের অনেক পর, সন্ধ্যা হলে ওরা আসে। দীপক, বেবি, ছোটখোকা, বাবি।
—শিপ্রা?
—সে কথা কাটাকাটি করে বাড়ি চলে গেছে।
ছোটখোকা বলে, আমিও যাই।
—বাবার সঙ্গে দেখা করে যাও।
মালিনী বলে, আমার ঘরে চলো।
—কেন?
—বাবার শরীর ভালো নয়। ওঁর ঘরে আজকে কেউ যেও না। বাবার…
—মেজদা কিছু বলেছে?
—আমার ঘরে চলো।
—মেজদা কোথায়?
—নিজের ঘরে ঘুমোচ্ছে।
—বাবাকে দেখব না, এ কেমন কথা। উনিই বা কি ভাববেন?
—এক ছেলে ওঁকে আজ…ওরা এ—ওর দিকে তাকায়। মালিনী ঘরে যায়। না, কফি, আতিথ্য, সৌজন্যের দরকার নেই। বেবির বাড়ি রবিবার মানে ছেলে—মেয়েরা দোতলায়।
বড়রা একতলায়। বিয়ার, রাম, স্কচ, মাংস, ভাত। এরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট তৃপ্ত।
দীপক বলে, মালিনী!
—বলো।
—কালো কফি।
—বলছি, তোমরা?
—না, নাথিং।
—গোপাল! একটা কালো কফি।
—বউদি! মেজদা এসে কি…
—তাকে আসতে দিলে কেন?
—সে শুনল কারো কথা?
—ভালো।
সবাই আবার চুপ। মালিনী ওদের দেখছে।
—মেজদা এসে কি খুব…
—ওখানে বাবার বিষয়ে তোমরা কি কিছু ঠিক করেছ? কোন আলোচনা হয়েছিল?
—কথা তো মেজদাই বলছিল।
—আমি সঠিক জবাব চাই বেবি।
—ছোড়দা বলুক।
—বলছি মেজদা খুব হাই হয়ে যায়…
—সেটা তো তোমরা জানো। যখন ও বাড়িতেই ফিরবে, বাবা বাড়িতেই থাকবেন, সেটা তোমাদের দেখা দরকার ছিল।
—মেজদা কি খুব…
—আজ বাড়িতে দিলীপ, তুহিন আর বিদিশা এসেছিল। বাবা দিলীপকে আসতে লেখেন। কেন না, উনি লিখেছেন, ওর জবাব পাননি, উদ্বেগ হয়েছিল।
দীপক বলে, স্বাভাবিক।
—আজ সকালেই আমি ওকে বলি, দিলীপ আসবে। তখন ও ক্ষেপে যায়। তখন জানতে পারি চিঠি ঠিকই এসেছে ও বাবাকে দেয়নি।
—কারণ? দীপকই কথা বলছে।
—কারণ হল, ও চায় না সোদপুরের সঙ্গে বাবার কোনো সম্পর্ক থাকুক।
—তারপর?
—ফিরে এসে কদর্য ভাষায় ও ওদের তিনজনকে বেরিয়ে যেতে বলে। ওরা নাকি বাড়ি দখল করবে বলে ব’সে আছে! প্রথমেই বলে, এটা হোটেল নয়। যেহেতু ওরা খেয়েছে। তারপর ওদের যথেচ্ছ অপমান! বাবাকে বলে এ বাড়ি ওর। এ বাড়ির জীবনযাত্রা মেনে নিতে উনি বাধ্য। সোদপুরের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ওর টার্মসে। নইলে ওঁকে ”আশ্রয়” হোমে পাঠাবে।
—তারপর?
—বাবার মাথা ঘুরে যায়। প্রেসার সামান্য হাই। ডাক্তার দেখেছে, ওষুধ পড়েছে, বাবা ঘুমোচ্ছেন। বাবার ঘরে আজ কেউ যাবে না।
বেবি বলে, তুমি বড় মাসীমার বাড়ি…
—হ্যাঁ, সেটা ও বাবাকেই বলেছে। এখানে থাকতে হলে কোনো আত্মীয়—স্বজন নয়।
দীপক বলে, ”কেন না তারা ভিখিরি।” মেজখোকার ভাষা আমি জানি।
—আমাদের কাছে কি জানতে চাও?
—ওঁকে হোমে পাঠানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা করেছ?
বেবি বলল, মেজদা যখন বলল, বাবাকে রাখার জন্যে তোমার স্ট্রেইন হচ্ছে, তখন অবশ্য ও কথাটা আমি বলি। ছোড়দাও সায় দেয়।
দীপক বলে, শিপ্রা ক্ষেপে যায়। বলে, মালিনী এ কথা বলতে পারে না। তোমরা সবাই অমানুষ। তোমার হয়ে ঝগড়া করে ও চলে যায়। এটা হল পাদটীকা বা ফুটনোট, যাই বলো।
মালিনী বলে, আমার দোহাই দেয়! ছি—ছি, কোথায় নেমে গেছে ও, কোথায়।
বেবি বলে, তোমার অসুবিধে না হলে তো চুকেই গেল। আর কথা কি?
মালিনী জীবনে প্রথম তিক্ত ও তির্যক হাসে। বলে, কথা আছে বই কি? বাবাকে আনার সময়ে আমার সম্মতি ছিল না। কেন না, আমি জানতাম দূরে থাকেন, সব জানেন না। কাছে থাকলে…
মালিনী উঠে যায়, জল খায়, ফিরে আসে।
—এ বাড়িতে ওঁকে আনার পর হুকুম হল, বাবা যেন কিছু না জানতে পারেন। মদের পার্টি, অমন ফ্ল্যাট, কল গার্ল! সন্ধ্যে থেকে ওকে ও ঘরে বন্ধ করে রাখো। ও—সব চেষ্টা করেছি, পারিনি। দু’দিন রাখতেই কি শুধু স্ট্রেইন আমার? বাবিকে কুসঙ্গ থেকে আগলানো, এ বাড়ির জীবন—পদ্ধতি থেকে বাবা আর বাবিকে রক্ষা করা…স—ব করে গেছি।
—খুব কষ্টকর।
—এ রকম হবে তোমরা জানতে। তবু…যাক, ওঁর ছেলেই ওঁর সামনে নিজেকে নগ্ন করে দিল। আমার লাভ কোথায় জানো? বাবাকে কাছে পেয়ে তবে আমি বুঝলাম তোমাদের মেজদার এই উন্মত্ত জীবনে তালে তাল দিয়ে আমার কি দুঃসহ ক্লান্তি বলো, ঘৃণা বলো, এসে গেছে। আজ সবাই ঠিক করেছ ওঁকে হোমে দেবে? তা বেবি, না ছোটখোকা, তা আমি হতে দেব না।
—কি করবে?
—দরকার যেমন বুঝব, তাই করব।
—বাবার বিষয়ে অবশ্য সকলেরই কর্তব্য আছে, কিন্তু তোমার বাড়িটাই বড় বলে…
—বাড়িতে তিন জনেরই জায়গা আছে। মনের দিকে…যেমন লাইফ প্যাটার্ন, সেখানে স্থানাভাব। কার স্থানাভাব? যিনি সকলের বাবা। যাঁর জীবন সম্পর্কে ধ্যানধারণা খুব অন্য রকম। যাঁর কোনো চাহিদা নেই। যিনি রাতে শুয়ে ওঁর আর মার কথাবার্তার কাসেট শোনেন। সেই লোকটাকেই তোমাদের মেজদা…
ওরা অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। এ কি সেই মালিনী? ওরা তো যে—যার মতো তেমনি আছে। একা মালিনী এত বদলে গেল?
দীপক বলে, ও সব কথা থাক।
—না সবটাই শোনো। বাবার বিষয়ে এই হুকুম কেন? কেন না মেজদা চায়, সোদপুরের বাড়ি ভেঙ্গে ফেলে ফ্ল্যাটের ওপর ফ্ল্যাট তুলবে। কই! অবাক হলে না? তাহলে এ বিষয়েও কথা হয়েছে।
—আমি ও কথার মধ্যে যাই নি।
—তুমি না গেলে। বেবি? ছোটখোকা?
—কথাটা তো…
—খারাপ নয়…
—বাবার পঁচাশি। আর ক’বছর বাঁচবেন? যদি বা বাঁচতেন, ছেলে—মেয়েদের এ সব সিদ্ধান্তের ফলেই আগে মারা যাবেন।
দীপক বলে, ও সব কথা থাক। কিছু অন্য রকম হোক। তোমাদের বিবাহবার্ষিকীটা এবার…
মালিনী হাসে। বলে, আর তো হবে না দীপক। হলে তোমরা কোর। আমি তাতে থাকব না। হবেই না। যে সম্পর্কে…আমার এত চেষ্টার পর…এমন অপমান…আমার বাড়িতে ক’টা লোক ভাত খেয়েছে বলে…না আর নয়।
ওরা চেয়ে থাকে, চেয়ে থাকে।
—আর কোনো কথা আছে?
না, ওদের আর কোনো কথা নেই। ওরা বেরিয়ে যায়। বেবি বলে, কাল খবর নেব বাবা কেমন আছেন।
—বাবার কাছে যে আসবে, দয়া করে ও’কে আর আঘাত দিও না।
ওরা নিরুত্তর।
মালিনীর মনে মুক্তির বোধ, শান্তি। জীবনেও ও ভাবেনি এসব কথা ওদের বলতে পারবে।
ও বিশ্বনাথের ঘরে ঢোকে।
—বাবা।
—ওরা চলে গেছে?
—আপনি কতক্ষণ জেগেছেন?
—খানিকক্ষণ।
—ওরা চলে গেছে।
—তোমার শাশুড়ির তপস্যালব্ধ তিনটি রত্ন।
—আপনি শুনেছেন কোন কথা?
—উঠেছিলাম। তোমার কথা শুনছিলাম।
—আমার কথা…
—হ্যাঁ। এখন তোমার অনেক কাজ।
—উঠেছেন কেন?
—বারান্দায় বসি একটু।
—চলুন।
বিশ্বনাথ আর মালিনী বারান্দায় বসেন।
—বউমা।
—বলুন?
—তোমার সাহায্য চাই।
—যা সাধ্য সব করব।
—তবে শোনো।
বিশ্বনাথ বলতে থাকেন। মালিনী শুনে যায়। ঘাড় নাড়ে বারবার।
—আর দেরি নয়।
—না, দেরির কি?
৬
শুক্রবার সকালে সৈকত বাড়ি আরেকবার চমকে ওঠে। এবারে আর পুলিশকে ঠেকিয়ে রাখা যায় না। কেন না বাহাদুর থানায় গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
—মেরা সাব…মেরা সাব…
—মালিনী বলে, বাবা যেন না শোনেন।
—না না, কে বলবে? কি ডেঞ্জারাস!
সেদিনের পর মেজখোকা খুব সংযত। মালিনী খুব স্বাভাবিক।
অবশ্য আজকের সকালটা অন্য রকম।
বিশ্বনাথই বলেন, কি তোমরা লুকোচ্ছ বলো তো? কি এমন কথা?
—কিছু না বাবা…
—আমি শুনেছি।
—শুনেছেন?
—হ্যাঁ। কেডিয়া গৃহিণীর মুখে অ্যাসিড বালব। পার্কের পেছনে সুপ্রভাত দত্তের মৃতদেহ।
—কে বলল? ছি ছি ছি…
—যতটা বিচলিত হব ভেবেছিলাম…তা হইনি মা! যা প্রত্যাশিত তাই ঘটেছে।
—আপনি তো ওঁর ঘরে গেছেন।
—হ্যাঁ। নিজের মনে নিজে থাকেন, গাছের ছবি দেখেন, নিঃসঙ্গ লোক।
—বাহাদুরকে ধরে নিয়ে গেল।
—সেটাও প্রত্যাশিত। আসল অপরাধীকে তো ধরা যাবে না, ধরলেও ধরে রাখা যাবে না…
মালিনী ভয়ে বিবশ হয়ে থাকে।
কোন সমাজে বাস করছে ওরা, কোন ব্যবস্থায়? বলে বাহাদুর কাল সন্ধ্যার পর থেকে ওঁকে খুঁজছে আর খুঁজছে। ও নিজেও তো ভালো দেখে না।
—শুনলাম। সকালে পেয়েছে।
—আর মিসেস কেডিয়া…
—উনি এখন তো…
—বাঁচবেন?
—জানি না।
—তুমি এখন কি করবে?
—আমি বাবিকে আমার মায়ের কাছে রেখে আসি বাবা। এ বাড়িতে রাখতে ভয় লাগছে।
—মেজখোকা?
—ওকে বলেছি।
—রাজী হল?
—খুশি হল না, রাজী হল।
—তা হলে তো…
—আমাদের কথা ঠিকই থাকছে।
—চিঠি লিখেছ?
—পরদিনই।
—ভালো। খুব ভালো।
মালিনী বাবিকে নিয়ে চলে যায়। বিশ্বনাথ একটি নতুন ক্যাসেট বের করেন। মানুষ কোথায় নিরাপদ? নিজের ঘরে নয়, নিজের নৈঃসঙ্গ নয়। সর্বত্র শান্তিকামী মানুষ বিপন্ন, বড় বিপন্ন।
আজকের দিনটা খুব দরকারী। নিজের গলা নিজে রেকর্ড করবেন।
সুপ্রভাত দত্তের হত্যা ও মিসেস কেডিয়ার ঘটনা নিয়ে সৈকত গুজবে ফেটে পড়ে।
ওঁদের মধ্যে কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল।
সুপ্রভাত পার্ক থেকে ড্রাগ আনতেন।
এর মধ্যে কেডিয়ার মেয়ে…
বাহাদুর কিছু জানে।
সুপ্রভাত কিছু জানতেন।
ভদ্রমহিলার একটা চোখ গেছে।
আসলে কে কোন ফ্ল্যাট কিনছে…
ফ্ল্যাট মালিকরা সৈকতের জন্যে সিকিউরিটি এজেন্সিকে খবর দেয়।
প্রেসের লোকেরা ভিড় করে থাকে।
এসব নিয়ে মেজখোকাও বিব্রত, বিব্রত। প্রেসের লোকজনকে বিশ্বাস নেই। সৈকত বাড়ির আদ্যোপান্ত ইতিহাস লিখে বসে থাকবে।
কার ক’টা ফ্ল্যাট, কে কি করে…
—প্রেস এলে ঢুকতে দিও না।
—না না, তাই দিই?
—বাবা ওকে চিনতেন না জানলে তা থেকেই একটা গল্প বানাবে।
—বানাবে না।
—আমি যাচ্ছি, তাড়াতাড়ি ফিরব।
—বিকেলে!
—হ্যাঁ, হ্যাঁ।
—আমিও বেরোব।
—কোথায়!
—মার্কেটিংয়ে।
—দেরি কোর না।
—তাই করি!
মেজখোকা বেরিয়ে যায়। না, মালিনী খুব শান্ত আছে। যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। বাবাও চুপচাপ হয়ে গেছেন খুব।
বেরোবার সময় মেজখোকা বাবাকে বলে যায়, বাবা আসছি।
—এসো।
এ রকম কয়েকদিন ধরেই বলছে ও।
এক উত্তরই পাচ্ছে।
বিকেলে ফিরে এসে তবে মেজখোকার মনে হয়েছিল বাড়ি যেন বড় বেশি চুপচাপ।
—ভুবন! গোপাল! রাজু!
—সায়েব!
—সব গেল কোথায়?
—মা তো সকালেই দাদুকে নিয়ে…
—গোপাল!
—গোপালও সঙ্গে গেছে।
—কোথায় গেছেন!
—দাদুর জিনিসপত্র নিয়ে…
—কি!
বাবার ঘর শূন্য, শূন্য। মায়ের ছবি…ওঁর ওষুধ…চটি…মেজোখোকা টেলিফোনের কাছে ছুটে যায়। ছোটখোকা! শিপ্রা! বেবি! দীপক! এটা এস ও এস!
দীপকের গড়ানো গলা, কি হল! আবার কাউকে খুন করলে না কি!
—ঠাট্টা—তামাসা নয় দীপক।
—কি হল!
—বাবা…বাবা…
—মারা গেছেন!
—ও, নো নো নো। পালিয়েছেন।
—পালিয়েছেন!
—সঙ্গে মালিনী।
—মালিনী।
তোমরা এসো।
সবাই ছুটে আসে। সবাই কৌতূহলী। মেজখোকা চুল খামচাতে থাকে। দীপক বলে, হ্যাভ ওয়ান। মেজখোকা ক্ষেপে যায়।
—এটা ইয়ার্কির সময় নয়। বুঝতে পারছ বাবা সোদপুরে গেছেন…মালিনী নিয়ে গেছে…
দীপক হাসতে শুরু করে। বলে, বুড়োর হাড়ে হাড়ে ভেলকি ভাই। কোনো কিছু না জানিয়ে…
ছোটখোকা বলে, পরিষ্কার।
—কি পরিষ্কার।
—খুনটুন দেখে…
—ভয় পেয়েছেন।
—তা ছাড়া কি!
বেবি বলে, তোমারই দোষ মেজদা। সেদিন ওরকম কাণ্ড না করলে…
—তা বলে চলে যাবেন।
—যাবেন নয়, গেছেন।
—কোনো চিঠি নয়…কিছু নয়…
—দাঁড়াও দেখে আসি।
দীপক দেখতে যায়। তারপর হো—হো করে হাসতে হাসতে ঢোকে। বলে, ভাই। শ্বশুরমশাই যে এরকম মডার্ন, কে জানত। ভাবতে পারো ওঁর ছেলেমেয়েদের জন্যে…একটি ক্যাসেট। উপরে লেখা চিলড্রেন্স।
বেবি বলে, গুরুবাণী তো শোনো। এবারে বাবার বাণী শোনো। তুমি মেজদা। হড়বড়িয়ে সব করতে গিয়েই সব গোল পাকালে।
—মালিনীর আস্পর্ধাটা দেখলে! ওকে…
ছোটখোকা বলে, বউদি সে বউদি নেই আর।
—কি বলেছেন উনি!
বাবির ঘর থেকে প্লেয়ার আনে দীপক। বলে, শোন তোমরা।
—তুমিও শোনো।
—হ্যাঁ হ্যাঁ…ওঃ ক্লাবে যখন গল্পটা ছাড়ব, যা জমবে না?
—খবরদার!
—চোখ পাকিও না বেবি।
এতক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এখন শিপ্রা বলে, চালাচ্ছি।
মেজখোকা, ছোটখোকা, বেবি।
আমি বেশ কিছুদিন আগেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
সেদিন মেজখোকা আমাকে সাহায্যই করেছে। বেশ পরিষ্কার হয়ে গেছে সব।
চলে যাব বলে আসি নি। হয়তো চলে যেতাম না। কিন্তু এখানে এসে পরিষ্কার বুঝলাম, তোমাদের বাড়ি যত বড়ই হোক, তোমাদের জীবনে আমার জন্য কোনো জায়গা নেই।
দোষ দিই না। তোমাদের জীবনযাত্রা অন্য রকম, মূল্যবোধ অন্য রকম, সেখানে আমি খুবই বেমানান।
সেদিন বৌমার সঙ্গে তোমাদের কথা বাইরে দাঁড়িয়ে শুনলাম। শেষ অবধি হোমের কথাও ভেবেছ।
তোমাদের মা বলতেন, তাঁর তপস্যার ফল পাঁচ সন্তান, পাঁচটি রত্ন। তাই জেনেই গেছেন।
যার কেউ নেই সে হোমে যায়। আমি কেন যাব? আমার বাড়ি আছে, চিরকাল আমাদের দেখেছে, সে সব লোকজন আছে। উপরে ডাক্তার আছে, নীচে আমার ঘর, আমার বাগান, তোমার মায়ের লাগানো গাছ…
না, মেজখোকা, ছ’মাস বাঁচি, ছ’বছর বাঁচি, ”সনকাবাস” ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার মৃত্যুর পর এ বাড়িতে আমার ও তোমার মায়ের নামে নার্সিং হোম হবে। তেমন লেখাপড়াই করব। শর্ত দিলীপ, মীরা ও মীরার মা থাকবে কর্মী হিসবে। তোমাদের প্রত্যেকের যথেষ্ট আছে, আরো হবে। আমার স্বোপার্জিত যা তার ব্যবস্থা আমি ইচ্ছামতো করব। ”সনকাবাস”—এ আমাকে নিয়ে কেউ লজ্জায় পড়বে না, কারো জীবন এমন নয়, যে আমার চোখ থেকে লুকোতে হবে। লুকোতে তোমরা পারনি। বাপের চোখে এড়ানো কি যায়?
ইচ্ছা হলে দেখতে এসো। ইচ্ছা না হলে এস না আমি কোনো রাগ রাখিনি মনে। তোমার মায়ের কাজ। সে আমিই যেভাবে হয় করব। মেজখোকা। বৌমাকে কোনো অপমান কোর না। আমার বার্ধক্য ও বয়সের কারণে তাঁর সাহায্য নিয়ে এসেছি, এই মাত্র। পারলে তাকে মর্যাদা দিও, না পারলে অপমান কোর না, এটা অনুরোধ মাত্র। সকলে আমার আশীর্বাদ জেনো। ইতি, তোমাদের বাবা বিশ্বনাথ চৌধুরী। প্রার্থনা করি, তোমাদের সন্তানরা যেন আমাদের সন্তানদের মতো না হয়।
ঘস ঘস শব্দ। শিপ্রা রেকর্ডার বন্ধ করে।
মালিনী ঘরে ঢোকে।
বলে, সবাই এসেছ? বাবা, সোদপুর কি এখানে? ভালই হল। এত এত বেগুন লঙ্কা, ডাঁটা এনেছি।
—বাবা?
—আবার বাবার কথা কেন?
সহাস্য মালিনী বলে, বাবার অধ্যায় তো শেষ।
মালিনী ওদের দিকে তাকায়, ওরা মালিনীর দিকে। মেজখোকা মালিনীকে যেন প্রথম দেখে।
”বাবার অধ্যায় তো শেষ।”
কথাটাতে যেন কোনো ইংগিত থাকে। আর কোন অধ্যায়ের কি শুরু?
মালিনী কিছু বলে না। কিন্তু ঘরের হাওয়া যেন কোনো ছিলা—টান—টান উত্তেজনায় বিদ্যুৎতাড়িত হয়ে ওঠে।