২
সনকার মৃত্যুর পরেই ছেলেরা, বউরা মেয়ে সম্মেলনে বসে। সম্মেলনটি হয় দীপকের বাড়িতে।
বিষয়, বিশ্বনাথ।
ওঁকে তো ওখানে একলা রাখা চলে না।
বেবি প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিয়ে কথা শুরু করে, মা নেই। ওঁর ওই বয়স।
—বেবি, আমরা আলোচনা করছি, ঝগড়া নয়।
—ঝগড়া আমিও করছি না মেজদা।
—দীপক, কি বলো।
—আমি কি বলব? তোমাদের বাবা, তোমরাই ঠিক করবে। এখানে আমি কথা বলতে পারি না।
—আমি মনে করি, ওঁর ছেলেদের বাড়িতে থাকাই ভালো। সেটাই সম্মানজনক।
—বেবি!
—সেটাই নিয়ম ছোড়দা। তোমরা যদি ওঁদের দু’জনকেই আগে নিয়ে আসতে, মা হয়তো বিনা চিকিৎসায় ও রকম একটা জায়গায় মারা যেতেন না।
—চিকিৎসা করার চেষ্টা তো হয়েছিল।
—শিপ্রা! ও রকম জায়গায়…কয়েকটা হাতুড়ে ডাক্তার…ওখানে কি বেলভিউ আছে, না উডল্যান্ডস, না ক্যালকাটা হসপিটাল?
দীপক ব্যঙ্গভরে হাসে। বলে, তুমি তো ওখানেই থাকতে বেবি। বিয়ের আগে কোন উডল্যান্ডসে চিকিৎসা করাতে? সত্যি!
—তোমার কাছে সোদপুর, মধ্যমগ্রাম এ সব জায়গা খুব ভালো হতে পারে, আমার কাছে নয়।
—আবার সেই কথা?
—বলব না? মধ্যমগ্রাম থেকে তুলে এনেই তো তুমি সেই ডাইনিটাকে পার্ক স্ট্রীটে রেখেছ।
সে আমার…অফিসে…চাকরি করে।…
—ও নো, নো নো। সে তোমার ব্যবসার জন্যে ওখানে…ওখানে কারা আসে, কি হয়, তা আমি জানি না?
—কি জানো?
—এটা জানি যে, তুমি ওকে ভাঙ্গিয়ে কাজ জোগাড় করো, ওকে পার্সেন্টেজ দাও।
দীপক অত্যন্ত রেগে যায়। সামনের টেবিল থেকে ও দ্বিতীয় হুইস্কিটি খায় তাড়াতাড়ি।
মেজ খোকা বলে, দীপক! গো স্লো!
—তোমার বোনকে বলো। কি দিইনি আমি তাকে? জীবনে ভেবেছে, এ রকম বাড়িতে বাস করবে? নিজের গাড়ি, ড্রাইভার থাকবে? কণ্টিনেণ্টে যাবে বেড়াতে?
মালিনী হতাশ হয়ে বসে থাকে ও সকলের দিকে তাকায় বারবার।
আর শিপ্রা বলে, আমি বরং বাড়ি যাই। মালিনী যাবে না কি? গেলে নামিয়ে দেব।
মেজ খোকা বলে, বাড়ি যাবে মানে?
—আলোচনা তো হচ্ছে না মেজদা।
—দীপক আর বেবি…
—দীপকদা!
—কি, বলো?
দীপকদা! আপনি না থাকলে সেদিন সোদপুরে…তারপর কাজের সময়ে…আপনি যদি অবুঝ হন…
—শিপ্রা অবুঝ আমি নই। অবুঝ হলে আর…কিন্তু বেবিকেও বলো। তার বাড়িতে তোমরা এসেছ…
বেবি বলে, ঠিক আছে।
উঠে যায় ও। মুখে—চোখে জল দিয়ে ফিরে আসে আবার। বলে, সরি। আমার যে কি হয়েছে…
ছোট খোকা বলে, আসল কথা হল মা নেই। ওঁরা কলকাতায় ছিলেন না, তাই কলকাতার মতো চিকিৎসা হয়নি, একথা বলা অর্থহীন। মা নেই। বাবার বয়স পঁচাশি। আমদের স্বীকার করাই ভালো যে, মা থাকতেও সোদপুরে আমরা কমই যেতে পারতাম…
দীপক বলে, যেতে না তাই বলো। হ্যাঁ আমি আলাদা বাড়ি করেছি! তবু বাগবাজারের বাড়িতে প্রতি রবিবার আমি যাই। বেবিও জানে যে, আমার জ্যাঠামশাই মারা যেতে আমি মুখাগ্নি করি, শ্রাদ্ধ করি, মাসিক শ্রাদ্ধ প্রতি মাসে করে তবে বার্ষিক করি।
ছোট খোকা বলে, আমরা সে রকম নই।
শিপ্রা হঠাৎ বলে, কিন্তু দীপকদা! আমি যতটুকু দেখেছি, ওঁরা দু’জনে দু’জনকে নিয়ে খুব সুখী, খুব পরিপূর্ণ ছিলেন। কলকাতায় থাকতে কখনো চাননি।
—সে কথাও সত্যি?
—এখন যদি মা থাকতেন…
—তাহলে এ কথা উঠত না।
—মা নেই বলেই…
—তাই বলো। যুক্তি দিয়ে কথা বলো, দীপকদা আছে। এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। ওই বৃদ্ধকে একা ফেলে রাখা…অবশ্য উনি আসতে চাইবেন না। তবু ওখানে ওঁকে রাখবে কি না, কোথায় রাখবে, সেটা তোমরাই ঠিক করো।
মালিনী বলে বাবারও তো একটা মত আছে।
—সেটাকে কতটা গুরুত্ব দেবে তাও ভাবো।
মেজ খোকা বলে, আনতে হলে…সোদপুরের বাড়ি?
—আমার একটা কথা শুনবে?
—বলো দীপকদা।
—আনো, রাখো, দেখো। তোমাদের জীবন এক রকম, ওঁর জীবন আরেক রকম…
মালিনী বলে, ওঁকে কে কতটা সময় দিতে পারবে, সেটাও ভাবা দরকার।
মেজ খোকা বলে, কেন? আমার বাবা আসবেন, থাকবেন, তাতে তোমার তেমন ইচ্ছে নেই মনে হচ্ছে?
মালিনী স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবারের মেয়ে। স্বামীর ইচ্ছেই সব, এ রকম ধারণা ওর ছোটবেলা থেকেই। ওর কোন বোনই ওর মত এত ধনী হয়নি, আর কাউকে নিজেকে বদলে বদলে অন্যরকম করতে হয়নি।
তবু ও যেন দিশেহারা, ভীষণ ক্লান্ত, জোর করে কিছু বলতে পারে না।
বেবি বলে, মেজদাই এখন বড়। ওর বাড়িই যথেষ্ট বড়। মেজদারই উচিত…
মেজ খোকা বলে, বেশ।
ছোট খোকা বলে, আমার বাড়িতেও থাকবেন। ওখানে কয়েক মাস, এখানে কয়েক মাস…
শিপ্রা বলে, আসতে চাইবেন?
বেবি বলে, তুমি ওঁকে আর ক’দিন দেখছ শিপ্রা? ছেলেরা আনলে বাবা আসবেন না?
শিপ্রা ঈষৎ হাসে, কথা বলে না।
বেবি বলে, রাজাকেও আমি জানিয়েছি।
ছোট খোকা বলে, কবে?
—জানিয়েছি।
দীপক বলে, কি দরকার ছিল?
—ছিল। ওরও ঠাকুমা গেছেন।
ছোট খোকা বলে, ঠাকুমা!
—নিশ্চয়।
দীপক বলে, জানি না বেবি। প্রিয়া এক সময়ে ছোট খোকার স্ত্রী ছিল। রাজার এক বছর বয়সে ডিভোর্স! প্রিয়া বহুদিন মারাঠী না মাদ্রাজী বিয়ে করে বম্বেতে। রাজার নামও পাল্টে গেছে। তার বয়সও দশ হলো। তোমাদের কারো সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। সেখানে…
—জানানো কর্তব্য মনে হলো, জানিয়েছি।
ছোট খোকা যখন রাগে, তখন ওর গলা নীচু হয়ে যায়। ও বলল, রাজাকে জন্মদিনে টাকা পাঠালে মানিঅর্ডার ফেরত আসত। কোন প্রেজেন্ট পাঠালে… দেখ বেবি! আমার তখন রাগ হয়েছিল। কিন্তু পরে বুঝেছি ওটাই ভালো। ও যেখানে আছে, সেখানেই ওকে মানিয়ে নিতে হবে।
—হঠাৎ তাকে এ খবরটা জানালে কেন?
মালিনী বলে, রাজার মা’র সঙ্গে তো আমার মেজদির দেখা হয়েছিল। রাজাকে ওরা কোথায় সিমলার কাছে কোন হস্টেলে রেখেছে।
শিপ্রা হঠাৎ হাসে। বলে, আমার বলা ঠিক হবে না, কিন্তু এটা তো বলতে পারি যে, রাজার মা আমাকেই লিখেছিল, তোমার স্বামীকে দয়া করে বোলো, রাজার সঙ্গে কোন যোগাযোগ না রাখতে। আমি মনে করি না, হঠাৎ এ রকম একটা খবর পেলে সে আবার চিঠি লিখবে কি না।
—অত ভেবে দেখিনি…
ছোট খোকা বলে, যথেষ্ট উপকার করেছ। আর কোর না বেবি। যা বোঝ না…
দীপক বলে, এ সব কথা এখানেই শেষ হোক।
মেজ খোকা বলে, তা’হলে বাবা আমার কাছে আসছেন। অর্থাৎ মালিনীর কাছে। আমি আর কতটা সময় বাড়িতে থাকি বা থাকব।
মালিনী বলে, বেশ। তাই হবে। কিন্তু তোমাকেও মনে রাখতে হবে যে, বাড়িতে বাবা আছেন।
—আমাকে মনে রাখতে হবে কেন? গেস্টরুম আছে, সঙ্গে বাথরুম, বাড়ির সঙ্গে কোন সম্পর্ক নেই। ওঁর মতো উনি থাকবেন।
দীপক ঈষৎ হাসে। বলে, এই বয়সে মানুষ কিন্তু সঙ্গ চায়। নিঃসঙ্গতা সহ্য করতে পারে না।
—সব সময় সঙ্গ কে দেবে? তা হ’লে তো… তোমার না বেবির বন্ধু সেই মহিলার… কি যেন… সেখানে রাখতে হয়।
মেজ খোকা হাসে।
বেবি বলে, হাসার কি আছে? কতখানি জমি নিয়ে কি চমৎকার হোম করেছেন মিসেস দেশাই, বৃদ্ধ—বৃদ্ধাদের জন্যে…একেবারে বিদেশী মডেলে…
—নামটা কি যেন?
—আশ্রয়।
—আর চার্জটা?
—সে তুমি বলতে পার না মেজদা। ও রকম থাকা, ও রকম খাওয়া, কম্যুনিটি হলে টিভি দেখা, কতরকম লোক যায়, আলোচনা, গান, কত কি হয়। ডাক্তার, নার্স, কি নেই? তাতে হাজার টাকাটা বেশি হলো?
দীপক বলে, না না, সত্যিই ভালো। আমি তো ভাই দশ হাজার টাকা দান করেছি। বুড়ো হলেই যাতে একটা জায়গা পাই। যাইও মাঝে মাঝে।
—কি রকম? ভালো?
—থাকতে কেমন জানি না। দেখতে তো ভালই লাগে। বাগান আছে, বেড়াও। লাইব্রেরি আছে, পড়ো।
মালিনী বলে, বাব্বাঃ! বাপ—মা বুড়ো হলে সঙ্গে রাখা যাবে না, মাসে হাজার টাকা দিয়েও..
দীপক বলে, আহা! বুঝছ না? আমরা তো অন্য যুগে পৌঁছে গেছি। ঘরে জায়গা থাকলেও মনে জায়গা দিতে পারছি না। সে জন্যেই অনেক বুঝেই মহিলা ব্যবসা ফেঁদেছেন।
বেবি বলে, ওটা ব্যবসা হলো?
—নিশ্চয়! ফান্ড কত টাকার তা জানো?
মালিনী বলে, কারা যায় ওখানে?
—সমাজের সুপারস্ট্রাকচার থেকেই যায়। সীটও গুণতি করা। নাম লেখাতে হয়।
—এই কলকাতায়!
—নয় কেন? এখন ভারতবর্ষ জেট গতিতে এগোচ্ছে। কলকাতা কি ভারতের বাইরে, না কলকাতায় টাকাওলা লোক কম আছে?
—তবু!
—আরে, তোমরা, আমি সবাই তো সমাজের ওই স্ট্রাকচারে যাচ্ছি, পৌঁছে গেছি প্রায়। তোমাদের কথা জানি না। আমি যেই বুড়ো হব, অমনি ভি ডি ও ক্যাসেট, ভি সি আর, পাঁচশো না পড়া ক্রাইমের বই নিয়ে আশ্রয়ে ঢুকে যাব। সব ব্যবস্থাই আছে হেঁ। তেমন টাকা দাও, আলাদা কটেজ করে দেবে।
শিপ্রা বলে, থাক। কি কথায় কি কথা।
দীপক বলে, দেখ! শেষ অবধি ওঁকেও…
মেজ খোকা একটি নীট হুইস্কি খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, তুমি যা বলছ, তা আমি করব না।
ছাত্র ইউনিয়নে একদা বক্তৃতাবাজ মেজ খোকা টেবিল চাপড়ে বলে, আমার বাবা কোন বোঝা হবেন না। অসম্ভব যত্নে থাকবেন, ডাক্তার, চিকিৎসা, ওঁর জন্যে আলাদা লোক… দেখে নিও। ওল্ড ম্যান ইয়ং হয়ে যাবেন। আমাদের বাড়ির সামনেই পার্ক। রোজ বেড়াবেন।
—থ্রি চিয়ার্স মেজ খোকা।
বেবি বলে, আমি বাবার ঘর গুছিয়ে দিয়ে আসব।
মালিনী বলে, তার দরকার হবে না। তুমি গেলেই হবে। ছেলে—মেয়েকেও নিয়ে যেও।
—যাব।
—বাবারও জেদ আছে। দাদা কতবার বলল, বাবা—মা গেলেন? ওখানে থাকতেই ওঁদের ভাল লাগত।
শিপ্রা বলে, এখন ওঁর যা মনের অবস্থা। হয়তো চলে আসতে পারলে খুশিই হবেন।
—নিশ্চয়। ছেলের কাছে আসছেন!