পারিবারিক : পিতা – ১

পিতা

সনকা যে চলে যাচ্ছেন, বিশ্বনাথ তা বুঝেছিলেন বলেই ওঁর পাশ ছাড়েন নি। এই সেদিন বিয়ের ষাট বছর পূর্ণ হল। মেয়ে জামাই, ছেলে বউ, নাতি নাতনি, বাড়ি ভরে উঠেছিল। মেজছেলে কলকাতার কেটারিংকে খবর দেয়। ফলে ভ্যানে খাবার এসেছিল।

সেদিন কত আলো, ক্যাসেটে সানাই, পোলারয়েডে বিশ্বনাথ ও সনকার কত ছবি তোলা হল। ওয়াশিংটন থেকে বড় ছেলে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিল, ছোট মেয়ে বন থেকে।

সনকাকে দিয়ে গান ওরা গাওয়াবেই। সনকা গাইবেন না। শেষে বিশ্বনাথ বলেছিলেন, ওঁর গান শুনবে? আমি শোনাতে পারি।

সনকা পঁচাত্তর বছর বয়সেও কি লজ্জা পাচ্ছিলেন। পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদূর, গলায় ফুলের মালা।

—না, ও গান তুমি শোনাবে না।

—আজ শোনানো যায়।

—তবে শুধু গান।

—গানই তো।

বড় মেয়ে বলেছিল, ব্যাপারটা কি?

—শোনোই না।

বিশ্বনাথ একটি শস্তার টেপরেকর্ডার আনলেন। বললেন, কিনে ফেললাম। ছয়শো নিল, বেশ জিনিস!

বড় মেয়ে বলে, এই দেখ! বাড়িতে তো কয়েকটা পড়েই আছে। কতবার ভাবি দিয়ে যাব একটা…

জামাই বলে, এগুলো তেমন…

বিশ্বনাথ বলেন, আমার কাজ চলে যায়।

—এ যে অনেক ক্যাসেট।

সনকা বলেন, ওঁর কথা বলো কেন। ওঁর কথা, আমার কথা, সব টেপ করছেন।

—বাঃ করব না। দু’জনে কে আগে যাই, কে পরে, গলাটা শুনতে পাব।

—ক্যাসেট কোথায় কেনো?

—সব দিলীপ। ও আমাদের ডান হাত।

—দিলীপ কে?

—ওই যে মীরা… কাজ করে… ওরই বর। তোমার মায়ের মেয়ে আর জামাই। গান শোনো।

—এই, সবাই চুপ! দিম্মার গান শোনো।

—বুমবা চুপ। তাম্মার গান শোনো।

সনকা আঁচলে মুখ ঢাকেন। ও কি গান?

কাঁপা কাঁপা গলায় গান, অথচ বেসুরো নয়। তাল লয়ের বালাই নেই। দমটা বারবার নেয়া হয়েছে।

—তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে…

গান শেষ হতে বিশ্বনাথ সপ্রংশস চোখে তাকান।

—কেমন, ভালো না?

—খুব ভালো।

—ওঁর খুব গানের কান ছিল। যা শুনতেন, তাই তুলে নিতেন। একটা ভক্তিগীতি শোনো।

সনকা বলেন, রাখো তো! তোমার নাতি নাতনিরা তো ইংরিজি আর হিন্দী গান ছাড়া কিছু চেনে না। ওদের ভাল লাগবে কেন? বেবিকে কীর্তন শিখিয়েছিলাম…

বড় মেয়ে বলে, মা, কীর্তন কি রাখা সম্ভব? সংসারের কীর্তন যা!

—কি জানি মা! ছেলেও বড়, মেয়েও বড়, বাড়িভর্তি কাজের লোক। গান গাওয়া যায় না?

জামাই বলে, হ্যাঁ, একটা গানই আপনার মেয়ে গাইতে জানে, টাকা ফুরিয়েছে, টাকা দাও।

ছোট ছেলের ছেলেটি সবচেয়ে ছোট। বছর ছয়েকের। ও বলে, তাম্মা, তোমার সিংগিং আমার লাভলি লেগেছে।

বউ বলে, এই বুবাই! বাংলায় বলতে পার না?

সনকা বলেন, ওতেই হবে।

সারাদিন আনন্দ করে ওরা সন্ধ্যায় চলে গিয়েছিল। তখনো বাড়িতে অনেক পোলাও, অনেক মাছের ফ্রাই, অনেক মাংস, দই, মিষ্টি।

মীরা আর মীরার মা বাড়ি পরিষ্কার করেছিল। সনকা বলেছিলেন, সব তোরা নিয়ে যা রে।

—রাখব না?

—একটু দই মিষ্টি। আর ওঁর জন্যে দু’খানা ফ্রাই। আজই অনিয়ম হল। কাল খেলে…

দিলীপ সলজ্জ হেসে বলেছিল, দিদমা, আমি একটা জিনিস এনেছি।

—কি রে?

—ফ্লাক্স। আপনারটা ভেঙে গেছে।

—ও বাবা, কত দাম নিল? বেশ জিনিস হয়েছে। কাজের জিনিস।

মীরা বলেছিল, দাদুর তো পঁচাশি হলো। পনেরো বছর বাদে দাদুর শতবার্ষিকী করবে।

আনন্দের দিন, উৎসবের দিন।

রাতে সনকা বা বিশ্বনাথ কিছু খাননি। রাতে উপোস, একটু লেবুর শরবত। মীরা সারাদিন থাকে, মীরার মা রাতে থাকে কিছুকাল ধরেই বিশ্বনাথ ভাবছেন, বাগানের কোণে ওদের দু’খানা ঘর তুলে দেবেন। ইঁটের ঘর, খোলার চাল। ওরাও বাঁচে, উনিও বেঁচে যান।

রাতে সনকা বলেছিলেন, বাড়িটা কি খালি হয়ে গেল? সবাই এলে যে কি ভরে ওঠে।

বিশ্বনাথ বলেছিলেন, হেসেই বলেছিলেন, সেই মনে করেই তো সোদপুরে ভালো পাড়ায় এ বাড়ি করা।

দুই মেয়ে, তিন ছেলে। ভিত পাঁচতলার। বাড়িটি দোতলা। নিচে চারটে ঘর, ওপরে দুটো ঘর, সবটা শেষ করেন নি।

বড় ছেলে বলেছিল, সব ভিতে ঢালছ?

—তোমরা পাঁচজন, পাঁচটা ফ্লোর করে নিও।

—দূর! কে থাকবে সোদপুরে? আসব যাব, তা নিচু তলাটাই যথেষ্ট।

—কেউ থাকবে না তোমরা?

—কে থাকবে?

—রিটায়ার করার পরেও নয়?

—বাবা! তখন বড়জোর কলকাতায় ফ্ল্যাট কিনবে, থাকবে। সোদপুরে কে থাকবে?

—সকলে থাকবে বলে…

—না বাবা, ওটা প্র্যাকটিকাল নয়।

—আমি ভেবেছিলাম…

—ভেবো না। গোবরডাঙ্গায় তোমার বাবা বাড়ি করেছিলেন তুমি কলকাতায় সরকারি বাড়িতে থেকে চাকরি করলে, সে বাড়ি বেহাত হয়ে গেল।

—আমারই বোন, ভাগ্নে, অনাথ সব…

—তুমি যদি কলকাতায় বাড়ি করতে…

—একটু মাটি, একটু বাগান…

—বেশ তো, তোমরা থাকো না।

সনকা বলেছিলেন, বড়খোকা, তোমাকে ইঞ্জিনীয়ারিং, মেজখোকাকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, ছোটখোকাকে সি এ পড়িয়ে, মেয়েদের বিয়ে দিয়ে… বড় কাজ যেমন করেছেন, তেমন কলকাতা বাড়ি করার সংগতি তো ছিল না। সেজন্যেই…

—বেশ তো। তোমরা থাকো।

বিশ্বনাথ সনকাকে বলেছিলেন, আমরাই থাকব যখন, তখন আর বাড়াব কেন?

ওপরে দুটি ঘরের সঙ্গে রান্নাঘর ও বাথরুম করেন। বিশ বছর আগে ভাড়া দেবার কথা ভাবেননি। সঞ্চয় বা কত। বছর দশেক আগে এক ডাক্তারকে ভাড়া দিয়েছেন। পেনশানের টাকা, ভাড়ার দুশো টাকা মিলিয়ে চলে যায়।

বড় ছেলে, বউ, ছেলে দীর্ঘকাল ওয়াশিংটনে। বাড়ি কিনেছে। ফেরে কি না সন্দেহ।

মাঝে মাঝে আসে। কয়েক বছরে একবার। গতবার তো ছেলেকেও আনেনি। ছেলে ভারতে আসতে চায় না। এখানে কোনো লাইফ নেই। গরিব, নোংরা দেশ।

বড় বউ এসেই জল ফোটাতে হুকুম দিল।

আমাদের টিউবওয়েলের জল তো ভালো।

—না বাবা, আমি পারব না।

সেবারই সনকা জানলেন, ওরা সানি পার্কে ফ্ল্যাট কিনেছে। বড়খোকা বলল, কিনেই ফেললাম বাবা। যদি কখনো আসি, থাকা যাবে।

বড় ছেলে সানি পার্কে ফ্ল্যাট কিনেছে। মেজ ছেলে নিজেই আমদানি—রপ্তানির ব্যবসা করছে। তার ফ্ল্যাট আলিপুরে। ছোট ছেলে সৌভাগ্যবান। ”ডলফিন” নামক বহুতল বাড়িটি ওর শ্বশুরের। ওর বউ দুটো ফ্ল্যাট পেয়েছে। গুরুসদয় দত্ত রোডের প্রায় ওপরই। ছোট ছেলে নিজেই সি এ ফার্ম করেছে।

বড় জামাই কন্ট্রাক্টর। লান্সডাউন ও লোয়ার সার্কুলারের মোড়ের কাছে সে বাড়ি কিনেছে। ছোট জামাই বন—এ থাকে, চাকরি করে। ওখানেই বাড়ি কিনেছে।

ওরা অকৃতজ্ঞ নয়। বাবা—মাকে নিয়মিত টাকা পাঠায়। বড় ছেলে সেবারে ফ্রিজ কিনে দিল। মেজ কিনে দিল টেলিভিশন।

সবাই ওঁদের সুখী দম্পতি বলে।

সবাই চলে যাবার পর সনকা বললেন, এটা কেমন হলো?

ও টেপ তুমি—আমি শুনব।

—বাজাব?

—আজকে থাক।

—কাল তুমি কি বলেছ শোনো।

—কি বলেছি?

—শোনো।

…পনেরো বছরে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুর দেখতে এসেই কথা দিয়ে গেলেন। বললেন, গোবরডাঙ্গার বাড়ি আলো হয়ে উঠবে আমার। তা…দাদা তো বলছে, সনুর বরকে দেখেছি, ইয়া বড় গোঁফ, মুশকো জোয়ান, কালো রং।

আমার মন তো খুব খারাপ। গোঁফ আমি দেখতে পারি না। বিয়ের দিন ছাঁদনাতলায় আমি যেন চাইতে পারছি না। শেষে শুভদৃষ্টির সময়ে দাদা বলছে, দেখে নে। গোঁফ দেখবি না?

ও মা! কোথায় গোঁফ, কোথায় কি? দেখি দিব্যি রং, দিব্যি চেহারা।

গোবরডাঙ্গার কথা বলি। ওখানে গিন্নি ছিলেন আমার বড় ননদ। মেয়ে নিয়ে বিধবা হয়ে থেকেই বাপের কাছে। ওখানে তখন অত ফুল মেলে না। দিদি কোথা থেকে যে অত ফুল এনেছিলেন। আমার এক খুড়শাশুড়ী ফুলের গয়না গড়েছিলেন। ফুলশয্যের দিনই পুকুরে নাইতে গিয়ে কানের দুল জলে পড়ে গেল।

আমি তো ঘাটে বসেই কাঁদছি। ও মা? ওই খুড়শাশুড়ী ঠিক তুলে আনলেন। বউভাতের পরদিন আমার শ্বশুর পুকুরের মামলায় জেতেন। তাতে সবাই বলল, লক্ষ্মী বউ। বউ ঘরে এল, মামলায় জিতলে।

উনি কলকাতায় চাকরি করতেন, শনিবার বাড়ি আসতেন। শনিবার খুব ঘর—বার করতাম। দিদি বলতেন, চুল বেঁধে কাপড় ছেড়ে বসে থাকো। আমার ভাই এসে কি এমন চেহারা দেখবে?

দিদি ওঁর চেয়ে আট বছরের বড়। প্রথমে ভেবেছিলেন, সংসারের গিন্নিত্ব আমি কেড়ে নেব। আমি কিন্তু তা করি নি। উনি যেন শাশুড়ী। আমি যেন বউ। এইরকম মান্য করতাম।

বিশ্বনাথ ক্যাসেট বন্ধ করেন।

—দিদিকে তোমার খুব মনে পড়ে?

—খুব।

—কি কপাল তাই দেখ!

—হ্যাঁ, তীর্থে যাব, একবার তীর্থ করব, সময় তো হলো সেই মেয়ের বিয়ের পর।

—তুমি বললে, কি বললে মনে আছে?

—কি বললাম?

—বললে, দেখ। বাবা খুব ধরেছেন এবার পুজোয় আমাকে পাটিহার দেবেন। এই সবে ভাগ্নীর বিয়ে হলো, খরচ—খরচা গেল, এবারে থাকুক।

—আমি বললাম, বাবাকে বলো।

শ্বশুরের সঙ্গে কথা বলার সময় ছিল শোবার আগে পায়ে বাতের তেল মাখানোর সময়টুকু।

সনকার এখনো মনে পড়ে, তেল মাখাচ্ছেন আর আস্তে আস্তে বলছেন, এবার আমি পাটিহার নেব না।

—কেন মা?

—পাড়ার সবাই যাচ্ছেন। দিদি ওঁদের সঙ্গে যান, প্রয়াগ গয়া, কাশী ঘুরে আসুন।

—সে যেতে চায়?

—হ্যাঁ বাবা। কোনদিন তো বেরোতে পারেন নি। আমি এখন সব পারি। নুটুরও বিয়ে হয়েছে…

—সঙ্গী কারা?

—ও বাড়ির দুই খুড়িমা, জ্যেঠাইমার ছেলে প্রভাস, আরো কয়েকজন।

—সত্যি! ওদের মা—ও গেল, ও যেন এসংসারের হাল ধরবে বলেই বিধবা হলো। সেই থেকে…

—শ্বশুরবাড়ির কিছুই পাননি…

—কিচ্ছু না। ভাসুরটা অমানুষ।

—দিদি যাবেন তাহলে?

—আমি ”না” বলতে পারি?

ষাট বছর বিবাহবার্ষিকীর রাতটি বড় মধুর হয়ে উঠেছিল। খাওয়ার হাঙ্গামা নেই। দু’জনে কত গল্প, কত গল্প। বিশ্বনাথ কি জানেন যে ওই শেষ অমন করে গল্প করা, কথা বলা?

ননদ কোনদিন কোথাও যাননি। তীর্থে যাবেন শুনে সে কি উৎসাহ। ট্রাঙ্ক কেনা হলো, নতুন বিছানা, অম্বলের ওষুধ, কাশির কবিরাজী বড়ি, সাবান, তেল, গামছা, পায়ে কাপড়ের চটি, সে এক সংসার।

শুধু বলেন, কত খরচ হচ্ছে।

যাবার দিন সনকাকে জড়িয়ে কত কাঁদলেন। তোমার জন্যেই যাওয়াই হলো।

শ্বশুর টিকিটের ওপর একশো টাকা দিলেন, বিশ্বনাথ দিলেন দু’শো।

তখন ওতেই অনেক হ’ত।

যাবেন, থাকবেন ভারত সেবাশ্রমে, ভোলাগিরি আশ্রমে। কোন অসুবিধে হবার কথা নয়। চিঠি লিখতেন পথ থেকে তা কি দেখছেন সে সব কথা খানিক। বেশি চিন্তা বাড়ি নিয়ে।

গরু কে বাঁধছে, মনো রান্নার জোগাড় দিচ্ছে কি না, সনকার কত কষ্ট হচ্ছে, এই সব।

তিন মাসের আগে ফেরার কথা নয়। দু’মাসও কাটেনি, খবর নিয়ে এল প্রভাস।

—সর্বনাশ হয়ে গেছে গো বউদিদি, কাকাকে বা কি বলব, বিশুদাকে বা কি বলব।

—কি হয়েছে অ প্রভাস।

—দিদি নেই গো কাকা! কাশীতে যেয়ে ঠিক তিনদিনের জ্বর, মাথায় রক্ত উঠে গেল। মণিকর্ণিকায় তাঁকে রেখে এলাম গো কাকা।

—অন্যেরা কোথায়?

—আমরা সবাই ফিরে এসেছি।

তারপর যেন দুঃস্বপ্ন সব। নুটুকে এনে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে মায়ের কাজ করানো, শ্বশুর সেই আঘাতেই বিছানা নিলেন। সনকার ওপর সমস্ত। বড় খোকা তখন ছোট, তবে এ—বাড়ি ও—বাড়ির পাঁচজন খুব সাহায্য করেন।

নুটুর কপালও মায়েরই মতো। বিয়ের সাত বছর না পুরতে সেও থান পরে ছেলেমেয়ে নিয়ে মামাবাড়িতেই ফিরে এল। অলক্ষুণে, অমঙ্গুলে বউয়ের ওখানে জায়গা হলো না। ওর বরকে ধরেছিল ম্যালিগনান্ট ম্যালেরিয়াতে।

শ্বশুর মারা যেতে তবে সনকা কলকাতায় আসেন। সরকারী কোয়ার্টার, সব সাজানো—গোছানো। রেলের কোয়ার্টার তখন ভালই হ’ত।

নুটু গোবরডাঙ্গাতেই থেকে যায়। ওর ছেলে বড় খোকার চেয়ে সামান্য ছোট। বিশ্বনাথই তাকে রেলে ঢুকিয়ে দেন। যুদ্ধের সময় রেলের চাকরি। সে খুব গুছিয়ে নিয়েছে। গোববডাঙ্গার বাড়ি ও মামার কাছে কিনে নিতে চেয়েছিল। বিশ্বনাথ বলেন, কিনবি কেন? ও তোরা আছিস, তোরাই থাকবি। তবে বেচিস না।

—মনে আছে। বড় খোকা বলেছিল, গোবরডাঙ্গার বাড়ি বেদখল হয়ে গেল?

—বলুক গে।

—আমাদের তো কোন অসুবিধে হয়নি।

—কিচ্ছু না।

—নটু, তোমার চেয়ে…?

—বছর তিনেকের ছোট।

—বাবা, কত বয়স হলো সব।

নটুর তো নাতি কেন, পুতিও হয়েছে।

—বেশ শক্ত আছি।

—হ্যাঁ। গোবরডাঙ্গা তো এখন বড় জায়গা।

—আমার পঁচাশি, তোমার পঁচাত্তর।

—বেশ কেটে তো গেল।

—ছেলে—মেয়েরা বোঝে না।

—না, ওদের জীবনযাত্রা, ধরন—ধারণ…

—যখনকার যা।

—নাও ঘুমোও এখন।

—দু’জনেই শক্ত আছি এখনো।

—তা আছি।

—পরের শতাব্দীটা দেখে যাব?

—দেখলেই বা কি, না দেখলেই বা কি। সত্যি ষাটটা বছর কাটল?

—ছেলে—মেয়েদের বিয়ে দেখ না। বড় খোকার আটচল্লিশ। মেজ খোকার বেয়াল্লিশ, ছোট খোকার চল্লিশ, বেবির ছত্রিশ, ডলির চৌত্রিশ।

—বিয়ে সব করলে বটে ছেলেরা… কারো ছেলেই দাঁড়ায় নি।

—মেয়েদের বিয়েটা দিতে পেরেছিলাম তবু।

—ছোট খোকার কথা ভাবলে কষ্ট হয়।

—কেন?

—বিয়ে হলো, বিয়ে ভাঙ্গল, আবার বিয়ে…

—এ সব তো এখন হচ্ছেই।

—প্রিয়া আবার বিয়ে করেছে।

—তোমার ছেলেও তো করেছে।

—বিয়ে করে ছেলেটাকে শুদ্ধু বোম্বে নিয়ে গেল। আমরা আর দেখতে পাব না।

—যা গেছে তা গেছে সনু। ভেবো না। আমাদের খুবই সৌভাগ্য যে, ওদের সঙ্গে থাকতে হয় না। ওদের কথা ভাবতে হয় না…

—ওরাই বা কতটা ভাবে?

—এই দেখ! যখনি আসে, দেখে আমরা দু’জনে দু’জনকে নিয়ে ভালো আছি। ভাববে কেন?

কলকাতা গেলে যেন হাঁপিয়ে উঠি। বাবা, ওদের জীবনে যা ছুটোছুটি।

—আর আমাদের এখানে?

—সব অন্যরকম।

বাড়ির বয়স তিরিশ। সাত কাঠার মতো বাগান। তাতে ইউক্যালিপটাস, বোগনাভিলিয়া, দেবদারু, সুপুরি, কিছু ফুল।

আসল বাড়িটা আড়াই কাঠার ওপর। বাগানের শখ সনকারই বেশি। রবিবার, রবিবার ভরত আসে, বাগান সাফ করে।

বিশ্বনাথের শখ ক্যাকটাসের। একটি বারান্দায় উনি নানা জাতের ক্যাকটাস লাগিয়েছেন।

মীরার মা বলে, তোমরা যেমন! তরকারি লাগালে কেমন হ’ত?

মীরা বলে, চোরে খেত।

বিশ্বনাথ বলেন, আজ ঘুমোও, কেমন?

—হ্যাঁ।

—তোমাকে যা দেখাচ্ছিল আজ!

—দূর, এই বয়সে…

—আমি তো সেই পনেরো বছরের সনকাকেই দেখলাম। তাই দেখি।

সে তোমার চোখ খারাপ হয়েছে।

—ছানি কাটালাম, দিব্যি দেখছি এখন…

সনকা ঘুমিয়ে পড়েন। বিশ্বনাথও। দু’জনের পক্ষেই দিনটি ছিল নিয়মছাড়া উত্তেজনার।

এমনিতে তো রুটিন—বাঁধা জীবন। সনকার প্রেসারের ধাত, বিশ্বনাথের সর্দি লাগে সহজে।

সময় ধরে মেপে যান, মেপে বেড়ান, বাগানে বসেন মোড়া পেতে, গল্প করেন, রেডিও শোনেন।

দূরদর্শনে সিনেমা, সংবাদ, তাও দেখেন।

অভ্যাসের বাইরে গেলেই অসুবিধে হয়।

পরদিন সকালে ওপর থেকে ডাক্তার দম্পতি নেমে আসে।

দু’জনেই ডাক্তার, নিঃসন্তান। চেম্বার বাজারের কাছে।

তুহিন আর বিদিশা দু’জনেই বলে, কাল খুব মিস করলাম আমরা। কলকাতা থেকে ফিরতে এত দেরী হলো।

—কালই কলকাতা গেলে?

—বিদিশার মা না খাইয়ে ছাড়লেন না।

বিদিশা হেসে ফেলল, এই। এঁদের সামনে মিথ্যেকথা? ন মাসিমা, কাল আমরা হঠাৎ একটা সিনেমা দেখে…বাইরে খেয়ে…

বিশ্বনাথ বললেন, বেশ করেছ!

—এখন চলি, কেমন?

ওরা চলে যায়। ওদের দু’জনকে বিশ্বনাথ ও সনকার বেশ লাগে। ছাত্র—জীবনের প্রেম। কিন্তু তুহিন বোনদের বিয়ে দিল, বিদিশা ভাইকে পড়িয়ে মানুষ করল, কর্তব্য কাজ সেরে তবে বিয়ে করল।

বয়স দু’জনেরই চল্লিশ মতো হবে। দেখলে মনে হয় না। ওরা থাকা একটা ভরসা।

বিশ্বনাথ তো জানতেনই না যে, কত তাড়াতাড়ি ওদের দরকার পড়বে।

বিবাহবার্ষিকীর পর সাতদিনও কাটে নি। বিশ্বনাথ ডেকেছিলেন, তুহিন! তুহিন!

তখন রাত এগোরোটা হবে।

—মেসোমশাই না?

—চলো চলো।

—কি হলো মেসোমশাই?

—তোমার মাসিমা… তোমার মাসিমা…

তুহিন দৌড়ে নেমেছিল, বিদিশাও।

—সরে যান মেসোমশাই।

—কি হয়েছে?

—দেখতে দিন।

ব্লাড প্রেসার দেখে তুহিন, সনকার চোখ দেখে টেনে বিদিশাকে কি বলে। বিদিশা দৌড়ে ওপরে যায়, নেমে এসে ইঞ্জেকশান দেয়।

বিশ্বনাথ বলেন, সেদিন থেকেই শরীরটা…আজও রাতে কিছু খায়নি…শুয়েই ছিল… হঠাৎ মাথা গেল, বুক গেল বলতে বলতে ওই যে বমি করল, ব্যাস, সাড়া নেই।

—বড়ো মতো অ্যাটাক হয়ে গেল।

—করোনারি, তুহিন?

—আপনি মাসিমার কাছে বসুন। বিদিশা! আরেকটা ইনঞ্জেকশান দাও। আমি ডক্টর অধিকারীকে ডেকে আনি…হাসপাতালে নিতে পারলে…

তুহিন স্কুটারে বেরিয়ে যায়।

বিশ্বনাথ পাশে বসেন। সনকার হাত ধরেন। ডক্টর অধিকারীকে নিয়েই আসে তুহিন। ওঁর নার্সিংহোম থেকে অক্সিজেন ওই আনে।

ডক্টর অধিকারী, সম্ভবত শুনেই ওষুধ, ইঞ্জেকশান সবই এনেছিলেন।

বিদিশা সনকার মুখটা মোছায়। অধিকারী নাড়ী দেখেন।

বিশ্বনাথ নিস্পন্দ, পাথর। অক্সিজেন যখন এসে পৌঁছায়, তার আগেই সনকা চলে যান।

ডক্টর অধিকারী উঠে দাঁড়ান।

—বিশ্বনাথবাবু!

বিশ্বনাথ হাত তোলেন। কথা বলতে নিষেধ করেন। বলেন

—করোনারি?

—হ্যাঁ বিশ্বনাথবাবু।

—কলকাতা…হলে কি…

—এমন হঠাৎ, এমন সিভিয়ার অ্যাটাক… কলকাতা না হলেও আমার নার্সিংহোমে তো সব ব্যবস্থাই আছে…অ্যাম্বুলেন্সও।

—সনকা সময় দিল না।

—না মেসোমশাই।

বিদিশা ওঁর হাত ধরে। তুহিনকে বলে, তুমি মীরার মাকে ডাকো। ও তো ওদিকের ঘরে দোর বন্ধ করে অজ্ঞান হয়ে ঘুমোচ্ছে।

বিশ্বনাথ সনকার হাত ধরে চেয়ে থাকেন, চেয়েই থাকেন।

বিদিশা ডক্টর অধিকারীকে বলে, আমি জানি কোন খাতায় লেখা আছে। আপনার নার্সিংহোম থেকেই ওঁর ছেলেদের ফোন করি, কেমন?

—নিশ্চয়।

বিশ্বনাথের সামনেই সব ঘটে, কিন্তু কিছুই ওঁর মাথায় ঢোকে না।

কোন এক সময়ে তুহিন ওঁকে তুলে নিয়ে যায়। ঘরে মীরা, দিলীপ, মীরার মা, পাশের বাড়ির নন্দীবাবু ও তার স্ত্রী (সনকা বলতেন নন্দী—ভৃঙ্গী), আরো কত লোক, কত।

বিশ্বনাথ যেন বুঝতে পারেন না ওরা কেন এখানে, উনি কেন বাইরের ঘরে।

কিছুক্ষণ বাদে বিদিশাই ওঁকে হাত ধরে নিয়ে যায়। এখন মশারি নেই। বিছানা খুব পরিষ্কার, পরনে ঢাকাই শাড়ি, চুল আঁচড়ানো, বুকের ওপর হাত ভাঁজ করে রাখা।

মীরাকে ধমকে—ধামকে সামলে রাখা গিয়েছিল। এখন ও ডুকরে কেঁদে ওঠে, ওর মা—ও। বিশ্বনাথ দেখেন ওঁর বালিশ চেয়ারে রাখা।

বিদিশা ওদের বলে, এই, এ ঘরে নয়। এ ঘরে নয়।

বিশ্বনাথ বলেন, বিদিশা! আমার বালিশটা দাও মা!

বালিশ নিয়ে সনকার পাশে শুয়ে পড়েন উনি। সনকার মাথায় হাত রাখেন, বুলতে থাকেন।

তুহিন আস্তে বলে, আপনার প্রেসারটা দেখব।

—কোন দরকার নেই তুহিন।

—দেখব মেসোমশাই।

—দেখ।

তারপর বলেন, প্রেসার ঠিক আছে তুহিন। না, আমাকে কামপোজ দিতে হবে না। ওঁর প্রেসারও তো তুমি পরশুই দেখেছ। তোমরাই তো বরাবর…

হাত বুলিয়ে চলেন, বুলিয়ে চলেন। বলেন, আজই বলছিল, দত্তবাবুর কথা। স্ত্রী মারা গেলে এই বয়সে…স্বামী বড় অসহায়…আর দেখ!

সকালে গাড়ির পর গাড়ি আসে। ছেলেরা, বউরা জামাই, মেয়ে, বৈবাহিকরা, ফুল।

মেজ খোকা বলে কলকাতায় থাকলে…

তুহিন ওর হাত ধরে নিয়ে যায় অন্য ঘরে। বেবি বলে, বাবা, ওঠো। আমি বসছি। ছোট ছেলে বলে, বাবাকে ও ঘরে শুইয়ে দে বেবি।

সকলেই খুব সংযত থাকে, খুব। মেজ খোকা বলে, কোন চেঁচামেচি নয়। বাবা আছেন মনে রেখো।

তারপর বলে, কি ব্যবস্থা হবে?

তুহিন একটু হেসে বলে, কলকাতা তো নয় যে কাচের গাড়ি পাবেন।

—ওঃ! সেই প্রিমিটিভ ব্যবস্থা।

বেবি বলে, কলকাতায় নেয়া যায় না?

বিশ্বনাথ মাথা নাড়েন, এখানেই, কলকাতায় নয়। এ—বাড়ি থেকেই।

নন্দীবাবু বলেন, বড় ছেলে তো বিদেশে। কনিষ্ঠকেই মুখাগ্নি করতে হবে।

—আমি! কি করতে হবে?

—মুখাগ্নি…শ্রাদ্ধ…

—যত প্রিমিটিভ রাইটস…

ছোট বউ শিপ্রা বলে, বাবা—মা যা বিশ্বাস করেন সে রকমভাবেই করতে হবে।

মেজ বউ মালিনী বলে, আমি একটু চায়ের ব্যবস্থা করি। ওঃ এখনো ভাবা যাচ্ছে না।

বিশ্বনাথ বলেন, তোমাদের ছেলেমেয়েরা?

বেবি তাড়াতাড়ি বলে, ওদের আমরা ইচ্ছে করেই আনিনি বাবা। মানে মৃত্যু তো ওরা দেখেনি…ওদের মনে একটা…

—প্রচণ্ড আঘাত লাগবে?

—হ্যাঁ বাবা।

মীরার মা বলে, সে কি গো। দিদমা হ’ত, ঠাম্মা হ’ত, আর দেখতে পাবে না, তা তাদের আনলে না?

 মেজ খোকার শাশুড়ী গেরস্ত মহিলা। তিনি বলেন, বেয়ান যে চলে গেলেন, তা তো সত্যিকথা মা! তোমার বাবা সইতে পারছেন, তোমরা সইতে পারছ, ওদেরি কি এমন ঘা লাগত?

 বেবি ধারালো হেসে বলে, আপনার মেয়েও তো ছেলেকে রেখে এসেছে মাসিমা!

—কি জানি!

শিপ্রার মা খুবই সুসভ্য, নাইলন শোভিতা, খুব কেতাদুরস্ত। তিনি মিহি গলায় বলেন, বাচ্চাদের এ সবে একটা ট্রমা…

এ সময়ে পাড়ার ছেলেরা মঞ্চে ঢুকে যায়। বেবির স্বামী দীপক ওদের বলে, ভাই। তোমরাই সব…

—হ্যাঁ হ্যাঁ। আমাদের দিদমা, আমরা নিয়ে যাব।

—আমিও যাব।

দেখা যায় দীপক এসব কাজে বিশেষ অভিজ্ঞ। সেই ছেলেদের বলে জুতো চটি ছাড়ো।

—খালি পায়ে যাব?

—হাওয়াই কিনে নাও। কাঁধও দিতে হবে।

জনৈক যুবক বলে, ওঁরা পারবেন না। ছুঁয়ে চললেই হবে। কষ্ট হবে বটে। তা মা তো রোজ মরছেন না।

তুহিন বলে, আঃ, নীপু।

—থামো তো তুহিনদা!

শিপ্রা বলে, ওরা তো ঠিকই বলছে। মার জন্যে একদিন…

দিলীপ! গাড়িতে ফুলগুলো আছে।

ছোট খোকা বলে, ছোট ছেলেকেই করতে হবে?

—আছ যখন, করবে নাই বা কেন?

বিশ্বনাথ বলেন, তুহিন, দেরী না করাই ভালো।—ওঁর মনে হয় সনকার সামনে ওরা এ সব কি বলছে?

শিপ্রা আস্তে বলে, কখন বেরোনো হবে?

তুহিন বলে, দশটা বাজল, এবারে বোধ হয়…

বিশ্বনাথ ছেলেদের, মেয়েকে যেন নতুন চোখে দেখতে পান।

নীপু অভিজ্ঞ চোখে সনকাকে দেখে।

তুহিনকে বলে, আর দেরি করলে…

বেবি বলে, কি হবে?

—রস কাটবে।

—মানে?

তুহিন ইংরেজিতে বোঝাতে চেষ্টা করে।

নীপু বলে, দাদু! যদি যান, গাড়িতে যাবেন।

মীরা বলে, দাদু! এই চা আর বিস্কুট খাও তো! কখন ফিরবে, শরীর এলে পড়বে।

দীপক বেবিকে বলে, তোমরা বাড়ি ধুয়েমুছে রেখো। নিমপাতা, মটরডাল, লোহা, আগুনের ব্যবস্থা…কিছু মিষ্টি…

দিলীপ বলে, আমাকে দিন।

দীপক দিলীপকে সব বোঝায়। বস্তুত অনেক লোক, অনেক কথা। বিশ্বনাথ আবার এসে সনকার পাশে বসেন। মাথায় হাত রাখেন।

সনকা দেখতে পাচ্ছেন না ওঁর ছেলেমেয়েরা এখন কত রকম কথা বলে নিজেদের আন্তরিকতা প্রমাণ করার চেষ্টা করছে। কারণ, পাড়ার লোকজনের কিছু মন্তব্য (যা বিদ্বেষপ্রসূত নয়, এমন পরিস্থিতিতে খুবই স্বাভাবিক)।

—এই বয়সে কেউ বুড়া বাপ—মারে দূরে রাখে?

—দুইটা ছেলে কলকাতায়, কারো জল পাইল না।

—এই যা উৎসবের সময়ে এল নইলে কোথায় আর…

—আজ অবশ্য এসেছে!

—কারেও তো তেমুন কানতে দেখি না।

—বিশ্ববাবু যেন পাথর!

—এইরকমই হয়।

এ সব কথাবার্তাই ছেলে—মেয়েদের কানে গেছে। সেজন্যে ওরাও বলতে থাকে।

—কতবার নিয়ে যেতে চেয়েছি!

—বাড়ি বলে মা’র সে কি টান ছিল…

—কলকাতায় থাকলে অন্তত চিকিৎসাটা হ’ত।

—তা বলতে পার না মেজদা। তুহিন আর বিদিশা এতটুকু ত্রুটি রাখতে দেয়নি।

 মেজ খোকার শ্বশুরও প্রবীণ, গৃহস্থ স্বভাবের ও অভিজ্ঞ। তিনি মাথা নাড়েন।

—এ রকম অ্যাটাক, মাসিভ হেমারেজ…আমার বড় বউমা তো আমাদের সকলের সামনেই …পাঁচ—সাত মিনিটের মধ্যে…কিছু করতে পারলাম কি? দেখ! এ সময়ে কোন কথা শুনো না, বোল না। যে যা বলছেন খোলা মনে গ্রহণ করো। এখনকার যা কাজ…

পাড়ার ছেলেরা একটু থতমত খাচ্ছিল। বাড়ির কোন লোক ভার নিয়ে নেতৃত্ব না দিলে তারাই কি সব করবে?

দীপক সে নেতৃত্বটা দেয়। দিলীপকে বলে, তুমি তো জানো সবই। বাড়ির দিকটা দেখ।

মীরার মা বলে, সে আমি আর মীরা সামলে নেব…ও দাদুর সঙ্গে যাক।

দীপক বলে, ওঁকে আগেই পাঠিয়ে দেব।

মালিনীর মাকে বলে, মাসিমা! আপনি এদিকটা একটু দেখুন।

—এরা কি হবিষ্যি করবে?

—ছেলেরা? কি জানি!

 বেবি এ সময়ে খুব গোঁড়া হয়ে যায়। ও বলে, করা তো উচিত। সবাই করে।

দীপক ঈষৎ হাসে। ও বলে, সবাই সব করে না বেবি।

তোমরা তো আবার অন্য জগতের লোক।

শিপ্রা মৃদুস্বরে বলে, এখন ওসব কথা থাক দীপকদা। দেখা যাবে পরে।

—নতুন ধুতি…উত্তরীয়…কিনে তো নিই।

মালিনীর মা বলেন, করলে তো নিয়ম অনেক…

শিপ্রা দরজায় হেলান দিয়ে সনকাকে দেখে। মহিলাকে ও খুব কম চিনত।

মালিনীও ওর পাশে দাঁড়ায়।

—কি সুন্দরই না দেখাচ্ছে, তাই না?

শিপ্রা বলে হ্যাঁ।…ওঁরা তো খুব সুখী ছিলেন।

—খুব।

—খুব সুখী হতে কি কি লাগে, কি কি লাগে না, তাই ভাবছিলাম। বোধহয়…

—কি?

—দু’জনে দু’জনকে ভালোবাসা, মন বুঝে চলা, সম্মান করা, এতেই বোধহয় সুখ, শান্তি।

মালিনীর এ কথায় কোথায় আঘাত লাগে, কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, ও বলে, বোঝে না…সবাই বোঝে না…

শিপ্রা ওর মাথায় হাত রাখে, ওঠো।

—মা আর বাবা যাদের এরকম…

—মালিনী!

মীরার মা বলে, কাঁদতে দাও ছোট বৌদি। এমন শাশুড়ী, পুণ্যবান মানুষ কাকে বলে…

ও কেঁদে ফেলে, কষ্ট পেল না…কষ্ট দিল না… রাতে আমি ঘরে জল রাখলাম…বলল, দরজা—জানালা বন্ধ করে দেখে নিও মীরার মা! কি কালঘুম গো! মা চলে গেল, জানতে পারি নি।

সব ব্যবস্থা হয়ে যায়। বিশ্বনাথের সঙ্গে তুহিন আর বিদিশাও গাড়িতে ওঠে। বৈবাহিকরা যে যার গাড়িতে ওঠেন। ওঁরা শ্মশান ঘুরে চলে যাবেন।

সনকাকে বের করা হয়। বিশ্বনাথ হঠাৎ বলেন মুখে রোদ লাগছে।

বিদিশা বলে, হেলান দিন মেসোমশাই।

—ছেলেরা হেঁটে যাচ্ছে?

—হ্যাঁ হ্যাঁ। আপনি ভাববেন না।

তখনো কাঁদেন না বিশ্বনাথ, তখনো ভাঙ্গেন না।

সব হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে সনকার ঘরের দরজার বাজু ধরে একবার বিশ্বনাথ হা—হা করে কেঁদে ওঠেন।

—আমাকে কার হাতে রেখে গেলে সনকা?

দীপক, তুহিন ও দিলীপ ওঁকে শুইয়ে দেয় পাশের ঘরে। তুহিন বলে, এবার একটু দুধ খাবেন, একটা কামপোজ, আমি একটু দেখব তার আগে।

—না তুহিন, না।

—মেসোমশাই, এখন তো আপনার অনেক কাজ বাকি…

—কি কাজ?

—অনেক। দেখি একটু হাতটা।

দীপক বলে, দেবেন কামপোজ?

—হ্যাঁ। কাল থেকে…

—আপনারাও তো…

—হ্যাঁ, এখন স্নান করব, বিশ্রাম নেব।

ওপরে গিয়ে বিদিশা বলে, ওঁকে কি রেখে যাবে?

—সেটা আমাদের চিন্তার বিষয় নয়।

—না। তা তো বটেই। জানো…

—কি?

—ওঁদের মতো সুখী দম্পতি দেখি নি।

—না।

—মাসিমা সেদিনের ধকলটা নিতে পারেন নি।

—হয়তো।

বিদিশা ঈষৎ হেসে বলে, মৃত্যুর একটা সামাজিক দিকও আছে। এবারে দেখো।

এরপর কিছুই আর বিশ্বনাথের হাতে থাকে না। বেবি সাড়ম্বরে চতুর্থী করে কলকাতায়, স্বগৃহে।

ওয়াশিংটন থেকে টেলিগ্রাম আসে, গ্রেট শক। রাইট ডিটেল’স।

—দীপ, রঞ্জা, জোজো।

বন থেকে টেলিগ্রাম আসে, মে হার সোল রেস্ট ইন পীস। —ডলি, নীলাভ, নীনা।

মালিনী ও শিপ্রা আজ এ—কাল ও থেকে যায়। ছেলেরা আসে রোজই বিকেলে। ওরা নাকি সব রিচুয়াল খুব ফেইথফুলি করছে।

আত্মীয়—স্বজনের নাম—ঠিকানা লেখা খাতা সনকারই ছিল। তাই দেখে দেখে চিঠি পাঠানো হয়। বিপিনানন্দ (স্থানীয় নেতা), দীপক চার্জে। অতএব নেতাজী হল ভাড়া নিয়ে সাড়ম্বরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়। জ্ঞাতিভোজন, নিয়মভঙ্গ, কিছুতেই ত্রুটি থাকে না। দুই ছেলে ঢেলে খরচ করে এবং দীপক কীর্তন পার্টি, গীতা পাঠক সব এনে ফেলে।

এ সবে বিশ্বনাথ বহিরাগত, বহিরাগত। তিনি শিপ্রাকে বলেন, তোমাদের মা ছিলেন ঘরের মানুষ। এত বড় পাবলিক অনুষ্ঠান…

মালিনী হঠাৎ বলে করুক না বাবা। কোনদিন কিছু করেছে, না করতে হয়েছে?

—কাগজে কাগজে ছবি…খবর…

নুটুর ছেলে গোবিন্দ, সেও এসেছে। নুটু আসতে পারেনি, তার আথ্রাইটিস।

গোবিন্দ বলে, দাদু! ওদের তো স্টেটাস আছে একটা। সে জন্যেই…

বিশ্বনাথ বোঝেন, ওর কথাই ঠিক। ছেলেরা মা’র জীবিত কালে যথেষ্ট আসতে পারে নি, আসত না। এখন শহরবাসীকে দেখিয়েও দিচ্ছে।

মীরার মা খুব অভিভূত।

—এমন যজ্ঞি, আমাদের জনে জনে এমন দামী কাপড়… না, দেখলাম বটে। শুনলাম বড়দাদাও নাকি টাকা দিয়েছে তার কলকাতার ব্যাঙ্ক থেকে।

বিশ্বনাথ মাথা নাড়েন। তিনি জানেন না। দেয়ালজোড়া সনকার ছবিটিকেও বড্ড বেশি বড়ো মনে হয়। ওঁর ছোট নাতি, ছোট খোকার ছেলে বুবাই ওঁকে বলে যায়, দাদু! তোমার এই ভিলেজের বাড়িটা আমার খুব ভালো লাগছে।

—এটা ভিলেজ?

—নিশ্চয়।

—কেন?

—কত গাছ…ঘাস আছে…মীরাদি আমাকে কাঠবেড়ালি দেখিয়েছে…ভিলেজই তো। এটা কি কলকাতা?

বিশ্বনাথ মাথা নাড়েন। শিশু যা শোনে তাই বলে। শিখছেন উনি, শিখছেন ক্রমে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *