পাতা ঝরার দিনে
শীত তার আগমন বার্তা জানায় মনখারাপের গান গেয়ে, শীতের দুপুরে পাতা ঝরার আওয়াজে… অয়ন চলে যায় সেই ফেলে আসা অনেক বছর আগের একটা ছোট্ট মফস্বলে৷
চাকরি সূত্রে অয়নের বাবা-মা থাকতো মনিপুরে৷ পড়াশোনার প্রয়োজনে অয়ন ওর বড়োমামার বাড়ি রায়গঞ্জেই থাকতো৷
মামার বাড়ির খুব কাছেই ছিল স্কুল, ক্লাস ইলেভেন আর টুয়েলভ ছিল কোয়েড৷ প্রথম মেয়েদের সাথে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা মোটেও ভালো নয়৷ টিচাররা নির্দ্ধিধায় অবলা বালিকাদের সামনেই চূড়ান্ত অপমান করতো হোমওয়ার্ক-এর জন্য৷ বালিকারা মোটেই অবলা ছিল না, রীতিমতো লেগপুলিং করতো ছেলেদের৷
রায়গঞ্জ বিদ্যাসাগর বিদ্যাপীঠের ইলেভেনের-এর ফার্স্ট বয় অয়নকে একদিন ফিজিক্সের টিচার পকেটে চিরুনি রাখার জন্য রীতিমতো অপমান করলেন৷ টিফিন টাইমে অয়ন একটা বই নিয়ে পড়ছিলো ,কানের কাছে একটা রিনরিনে গলায় শুনতে পেলো, ‘দিনরাত হিরোদের মতো হেয়ার স্টাইল না বদলে লেখা পড়ায় মন দাও৷’
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো একটু আগেই ঘা খাওয়া আহত অয়ন৷
মুশকিলটা হলো মেয়েটার মুখের দিকের তাকাতেই সব রাগ কমে গেল, এই মেয়েটিই! কি যেন নাম…? সমাপ্তি… সেদিন নবীন বরণে গান গেয়েছিল৷ অয়ন মোহিত হয়ে শুনেছিল৷
‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝরে’…
এই শোন, পিছন ফিরে চলে যাচ্ছিল সমাপ্তি, অয়নের ডাকে থমকে দাঁড়ালো৷
‘তুমি কি জানো আমি ক্লাসের ফার্স্ট বয়?’ সেই মিষ্টি গলার সোজা উত্তর, জানি বলেই তো বললাম, পড়াশুনায় আরো মনোযোগ দিতে৷ আমি সেকেন্ড হলে আনন্দ পাবো তুমি সেকেন্ড হলে কষ্ট পাবে, তাই না?
সাধারণত ক্লাসের ছেলে মেয়েদের তুই বলেই ডাকে অয়ন, কিন্তু সমাপ্তির বেলায় শুধু তুমি৷
সমাপ্তি মেয়েটিও পড়াশোনায় ভালো ৷
সবার চোখের অলক্ষে, সবার মনের অজান্তে একটা ভালোলাগার ছোঁয়াচে আবেশ ছড়াচ্ছিল কেবল দুটো মনে… অয়ন আর সমাপ্তি কবে যেন শুধু ক্লাসমেট থেকে বন্ধুত্বের সিঁড়িতে পা না দিয়েই মনের কাছাকাছি চলে এসেছিল৷
প্র্যাকটিকাল রুমের জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের মরা আলোটা কখন যেন দুজনকেই একসাথে ছুঁয়ে গিয়েছিল৷
কোনো বিশেষ সম্বোধন নয়, কানের কাছে প্রেম নিবেদনের আকুতিও নয়, তবুও ওরা জানতো ওরা বড্ড কাছের৷
দেখতে দেখতে ওদের টেস্ট হয়ে গিয়ে উচচমাধ্যমিকের প্রিপারেশন৷ দুজনেই ব্যস্ত হয়ে গিয়েছিল পড়াশোনায়, কখনো পড়তে পড়তে হঠাৎ অন্যমনস্ক অয়ন ডায়াল করত একটা চেনা নম্বর৷ ওই একটি গলার স্বরই ওকে দিত অফুরন্ত অক্সিজেন৷
পড়তে পড়তে চোখের পাতা যখন বুজে আসতো সমাপ্তি ওর গোপন ডায়রির মধ্যে লুকোনো গম্ভীর মুখের চশমা চোখে ছেলেটার মুখটা একবার দেখে নিতো প্রাণ ভরে৷
অয়নের বাবা ততদিনে বদলি হয়ে চলে এসেছেন কলকাতায়৷ পরীক্ষাও শেষ তাই মামার বাড়ি রায়গঞ্জের পাট এবার মেটাতেই হবে অয়নকে৷
গ্রামের শেষ প্রান্তে একটা মজা নদীর ধারে যখন দুজনের দেখা হলো, কারোর মুখেই কোনো কথা নেই৷ সমাপ্তির দু চোখে টলটল করছে জল, অয়ন বহু চেষ্টায় চেপে রেখেছে জমানো কষ্টগুলো৷
ডক্টর জ্ঞান ফিরে এসেছে ৭ নম্বর কেবিনের পেশেন্টের৷
সম্বিৎ ফিরে পেয়ে, ছুটলো ডক্টর অয়ন মিত্র৷ ক্লান্ত দুটো চোখ তাকিয়ে আছে, মাথার বাঁ দিকটা ব্যান্ডেজ করা৷ কাল রাতে ইমার্জেন্সি ডিউটিতে অয়ন ছিল, তখনই…
এখন কেমন আছেন? ছোট্ট উত্তর, ভালো৷ পাশেই যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তিনি সম্ভবত পেশেন্টের স্বামী৷ অয়ন ওনাকে কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বললেন, কি মুশকিল ম্যাডাম, এমন ভাবে রাস্তা ক্রস করছিলেন, আরেকটু হলে তো জেলে যেতে হত৷ এবার কি আমি যেতে পারি ডক্টর? অ্যাকসিডেন্টের পর থেকে আমিও আর বাড়ি ফিরিনি, সকলে চিন্তা করছে৷’
পেশেন্টের বিভ্রান্ত চোখের চাহনি, গলার স্বরটা কিন্তু একই আছে৷ এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে অয়নের দিকে৷ মেডিসিনের চার্টটা নার্সকে বুঝিয়ে দিয়ে, পরিবারের লোকেদের খবর দিতে বলে বেরিয়ে গেল অয়ন৷
আরেকটু অপেক্ষা করতে বলেছিল অয়ন, সমাপ্তিকে৷ অয়নের মা কোনো ভাবেই মেনে নিচ্ছিল না, সমাপ্তিকে৷ একজন দর্জির মেয়েকে কোনোভাবেই তার ডাক্তার ছেলের বউ করবে না সে৷ সমাপ্তির বাবার টেইলারিং দোকান ছিল৷
বলেছিল অয়ন, একটু অপেক্ষা…ফোনটা এসেছিল কোনো অঘ্রানের পাতা ঝরার বিকেলে৷ হঠাৎ করেই নাকি ঠিক হয়ে গিয়েছিল সমাপ্তির বিয়ে৷ নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিল অয়ন৷
নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করেনি সেদিন৷ শেষের দুটো কথা আজও মনে আছে অয়নের, সেই মিষ্টি গলায় বলেছিল সমাপ্তি, মা আর ছেলের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটানো আমার লক্ষ্য নয়, আমার নাম সমাপ্তি, তাই দাঁড়িটা না হয় আমিই টানলাম…
তারপরও অনেক ফোন করেছে অয়ন, নট রিচেবেল বলেছে ওর চির চেনা নম্বরটা৷
আজ পাঁচবছর পর আচমকা সেই চোখের অমোঘ চাহনি উতলা করে দিচ্ছে অয়নের মন৷
নার্স এসে খবর দিলো, ৭ নম্বর কেবিনের বাড়ির লোক এসে গেছে৷ রিলিজ অর্ডার কি দিয়ে দেবেন?
কেবিনে ঢুকতেই একটা ছোট্ট ছেলে, বছর তিনেক বয়স, ছুট্টে এসে জড়িয়ে ধরলো সম্পূর্ণ অচেনা অয়নকে… ‘আঙ্কেল মামমামকে কবে বাড়ি নিয়ে যাবো?’ বাচচাটির বাবা ক্ষমা চাওয়ার ঢঙে বললেন, ‘প্লিজ ডক্টর কিছু মনে করবেন না৷’
কেবিনে একজোড়া দীঘল গভীর চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি অয়নের অস্বস্তির কারণ৷
ফর্মালিটিস মিটিয়ে বেরিয়ে যেতে যাবে ঠিক সেই সময়, অয়ন বলে ডাকলো, কোনো দূর অতীতের রিনরিনে গলাটা৷ পিছন ফিরতেই দেখলো ছোট্ট বাচচাটা তার মায়ের ডাকে সাড়া দিচ্ছে৷
‘আমার ছেলের নাম অয়ন৷’ সমাপ্তির গলায় এখনো যেন অভিমানের সুর৷
অনেকক্ষণ ধরেই মুঠোফোনটা ভাইব্রেট করছিল অয়নের, ওপ্রান্ত থেকে লীনা মনে করিয়ে দিলো আজ মিসেস কাপুরের এনিভার্সারি পার্টিতে ওদের হাসব্যান্ড ওয়াইফ দুজনেরই নিমন্ত্রণ, অয়ন যেন ঠিক সময়ে পৌঁছে যায়৷ লীনা রেডি হয়ে অপেক্ষা করবে৷
ক্লান্ত দুটো পা, ছুটে চলে যেতে চাইছে রায়গঞ্জের ক্লাস ইলেভেনের ক্লাস রুমে৷ যদি সেখানে খুঁজে পেত স্মৃতির কিছু টুকরো, যেগুলো জমানো যেত কষ্ট কষ্ট সুখের মতো তাহলে হয়তো বুকের বাঁ দিকের জমাট বাঁধা নিঃশ্বাসটা একটু হলেও হালকা হত৷