পরিশিষ্ট
দেশ স্বাধীন হলে পুলিশ-কর্মীরা নতুন করে আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছিলেন। মহাদাঙ্গার সময় যে শহরকে তাঁরা রক্ষা করেন সেই শহরে পুলিশের মর্যাদা রাখতে তাঁরা তখন ব্যস্ত। এঁদের প্রত্যেকের গঠনমূলক মনোভাব, সততা ও দক্ষতা তুলনাহীন। ইতিমধ্যে তাঁদের প্রভূত স্বদেশ-প্রেম ও ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছে।
মুশ্লিম ও ইংরাজ-কর্মীরা চলে যাওয়ায় কর্মক্ষেত্রে বিরাট ভ্যাকুয়ামের সৃষ্টি হয়। কলিকাতা-পুলিশকর্মীদের আশা, শহর রক্ষার পুরস্কার-স্বরূপ এই-সব শূন্যপদে তাদের উন্নীত করা হবে। শিক্ষাদীক্ষা ও বংশগরিমায় তাঁরা কেউই কম নন। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল যে পুলিশ-পদগুলিকে শ্রেণীহীন না করে শ্রেণীযুক্ত করা হ’ল। সর্বভারতীয় সার্ভিসের জন্য (আই. পি.এস্.) তরুণদের ভর্তি করে অভিজ্ঞ প্রবীণদের উপর-ওয়ালা করা হ’ল। একজন ইংরাজ-কর্মীকে যে পদে পৌঁছতে বিশ বৎসর অপেক্ষা করতে হয়েছে সেই-সব গুরুত্বপূর্ণ পদে মাত্র দুই বৎসর অভিজ্ঞ তরুণদের বসানো হ’ল। এঁদের ঠাট্টা করে বলা হ’ত: ‘পার্টিশন প্রোডাক্টস্।’ ফলে অভিজ্ঞ ব্যক্তির অভাবে পুলিশের দক্ষতা ম্লান হয়। প্রবীণ কর্মীরা তাঁদের দীর্ঘদিনের অর্জিত ব্যক্তিত্ব একটু-একটু করে হারিয়ে এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততার শিকার হয়ে যান। আশাভঙ্গ হওয়ায় ওদের কেউ-কেউ আগের মতো আখের গুছাতে মন দেন। পরবর্তীকালে অভূতপূর্ব পুলিশ-স্ট্রাইক তার ফলশ্রুতি। সেই সময় কিছু ডিপার্টমেন্টাল পোস্ট সৃষ্টি না-হলে বিপর্যয় ঘটতো। প্রমোটেড, অফিসাররা ডিরেক্ট রিক্রুট ঊর্ধ্বতন অপেক্ষা প্রায়শঃ ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করেছেন। তবে সুষ্ঠু প্রশাসনের জন্য কিছু-সংখ্যক তরুণ-ঊর্ধ্বতনদের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু তাদের ইংরাজ-উর্ধ্বতনদের মতো নম্র অথচ কঠোর এবং ট্যাক্টফুল নিশ্চয় হতে হবে।
আমি বহু দুরূহ মামলা তদন্ত করে হাইকোর্টে বারে বারে প্রশংসিত হই। এক অনভিজ্ঞ তরুণ-ঊর্ধ্বতনকে একটি মামলায় আমাকে অবান্তর উপদেশ দেবার স্পর্ধা দেখে অবাক হয়ে যাই। পুঁথিগত অধীত বিদ্যায় যে শেষ-কথা লেখা নেই তা তারা জানেন না। এতে পুলিশী তদন্তের মানের দ্রুত অবনতি ঘটেছিল। আমার সৌভাগ্য এই-যে আমার পূর্বতন পুলিশী গুরু রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথের বিভাগ থেকে উন্নীত হয়ে পরে ওঁদের মতোই ঊর্ধ্বতন অফিসার হতে পেরেছিলাম। তাই অপমানের বোঝা আমাকে কিছুমাত্র বইতে হয় নি।
স্বাধীনতার পর প্রকৃত কংগ্রেসীরা খদ্দর ও গান্ধী টুপি পরিত্যাগ করেন। তাঁদের স্থলে হঠাৎ একদল দালাল-শ্রেণীর লোক খদ্দর ও গান্ধীটুপি পরে থানাদের উত্যক্ত করতে থাকে। এই ভূয়া-কংগ্রেসীদের বক্তব্য এই-যে তারা মন্ত্রীদের প্রিয়পাত্র হওয়ায় কর্মীদের উপকার করতে অক্ষম। স্বাধীনতার পূর্বেই আমি অ্যাসিসটেন্ট কমিশনার হয়েছি। এই দলটিকে আমার অধীন-থানাগুলি থেকে উৎখাত করতে বেগ পেতে হয়েছিল। বহু মন্ত্রী দীর্ঘকাল জেল খাটায় জনগণকে ঠিকমতো চিনতেন না। উপরন্তু স্বাধীনতা-উত্তর জনগণের রূপ ছিল ভিন্ন। তাই এই সব-দালাল ভূয়া-জননেতার দাবী মন্ত্রীদেরও বিভ্রান্ত করতো। কিছু ঊর্ধ্বতন-কর্মীরাও এদের প্রকৃত-নেতাভ্রমে খুশি করতে অধীনস্থ কর্মীদের হুকুম দিতেন।
মহাদাঙ্গার সময় কোনও শাস্তিসেনা না-থাকলেও দাঙ্গাশেষে হঠাৎ বহু পল্লীতে শাস্তিসেনা সংগঠিত হয়েছিল। সৎলোকের সংখ্যা সর্বদেশে কম। জনসংখ্যা বেশি হলে মন্দলোক আসবেই। তাছাড়া, নবগঠিত শাস্তিসেনার প্রত্যেকে ট্রেনিংহীন অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তি। শ্রীপ্রণব সেন প্রতি থানায় অনুরূপ একটি ছোট সংস্থা গড়ে নাম-রেজিস্টারের অজুহাতে ওদের হাটিয়ে একটি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করেছিলেন। এইরূপ ট্যাক্ট তথা কায়দার জন্য তিনি প্রখ্যাত ছিলেন। বিঃ দ্রঃ-স্বাধীনতার পর আমার অধীন থানাগুলিতে আমি সম্পূর্ণ বাংলা ভাষার মাধ্যমে কাজকর্মের প্রবর্তন করেছিলাম। প্রয়োজনীয় পরিভাষা তৈরি করে কর্মীদের লিখন-ব্যাপারে শিক্ষা দিই। এমন-কি ডিসট্রিক্ট প্যারেডে বাংলা-ভাষায় কম্যাণ্ডেরও প্রচলন করি। যেমন: অ্যাটেনশন = প্রস্তুত, স্ট্যাণ্ড অ্যাট ইজ= আরাম, রাইট টার্ণ=ডানে ফ্রো, লেফট হুইল = বামে বৃত ইত্যাদি। কিন্তু আদালতের ভাষা ইংরাজি এই ওজুহাতে কর্তৃপক্ষ পরে তা বন্ধ করে দেন।
যুদ্ধ ও দাঙ্গা থামার আগেই, পরে কি করা হবে তার পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল—অথচ দেশবিভাগের মতো এত বড়ো ঘটনার পরে কি ঘটতে পারে কেউ তার পরিকল্পনা রচনা করলেন না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বোঝা উচিত ছিল এ-বিষয়ে প্রস্তুত না-হয়ে দেশ-বিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করা যায় না। তারই ফলস্বরূপ পার্টিশনের পর হাজার-হাজার ব্যক্তি উৎপীড়িত হয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হ’ল। তখনই, এই একমুখী বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জন্য কিছু জমি হুকুম-দখল না-করায় এদেরকে বরং জমি-দখলে উৎসাহিত করে স্থানীয় লোকেদের মনে বিরূপতা এবং এদের মনে অপরাধপ্রবণতার বীজ বপন করা হ’ল। স্থানীয় ব্যক্তিদের ওদের প্রতি পূর্ব-সহানুভূতি হারানোর ফল শুভ হয় নি। অথচ বাস্তুহারারাও খুশি নয়। ফলে উভয়-শ্রেণীর জনগণ ধীরে-ধীরে সরকার-বিরোধী হতে থাকে। কিছু রাজনীতিবিদেরা এই অবস্থার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেসকে গদী হতে হটাবার জন্য হাঙ্গামার সৃষ্টি করা ওদের পক্ষে সহজ হয়।
[কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেলে রাজনৈতিক দাঙ্গা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর জনৈক বাঙালী শিখের হত্যা-উপলক্ষে স্থানীয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা আমি নিমেষে দমন করেছিলাম। নাড়ীর টান এমনই যে এ-বঙ্গে কিছু ঘটলে ও-বঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া হবেই। ১৯৫২ খ্রীঃ বরিশালে ও পূর্ববঙ্গের অন্যত্র হিন্দু-নিধন শুরু হয়েছিল। বহু হিন্দুনারী অপহৃতা হন। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা শূন্য ট্রেনগুলিতে শুধু ভাঙা কাচের চুড়ি ও রক্তের দাগ। আমার একদা অনুগত পূর্ববঙ্গের পূর্বতন কলিকাতা-পুলিশের কর্মীদের পত্র লিখে আমি বিভিন্ন এলাকার বহু পরিবার ও অপহৃতা কন্যাদের উদ্ধারে সাহায্য করেছিলাম। এদিকে তার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মধ্য-কলকাতা অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে আমি ও সত্যেন্দ্রবাবু তা কঠোরহস্তে দমন করে স্থানীয় মুশ্লিমদের রক্ষা করেছিলাম।]
এর মধ্যে মুল্লুকী আইনে অন্য প্রদেশে বাঙালীদের চাকুরি বন্ধ। গভর্নমেন্টে সাম্প্র দায়িক নিয়োগ হলেও, কলকাতার ইংরাজ-সওদাগরী অফিসগুলিতে বাঙালী মাত্রেই চাকুরি হ’ত। কেউ মারা গেলে ওরা গ্রামে লোক পাঠিয়ে তার পুত্র বা স্বজনকে ডেকে এনে চাকুরি দিতেন। কলকাতার ব্যবসায়ী-সম্প্রদায় বিদেশী কোম্পানীগুলি ক্রয় করায় এখানেও বাঙালীদের চাকুরি বন্ধ হ’ল। এদিকে মহিলারাও তরুণদের অবশিষ্ট চাকুরিতে ভাগ বসাতে শুরু করেছেন। বহিরাগত কর্মীরা নিজদেশের খাদ্যের চাপ কমিয়ে এই প্রদেশে খাদ্য ভাগ নেওয়ায় এবং মনি-অর্ডারে মুল্লুকে প্রতি সপ্তাহে অর্থ পাঠানোয় এখানে খাদ্য ও অর্থের যথেষ্ট অভাব হ’ল।
ফলে এক বিরাট খাদ্য ও অর্থহীন বাঙালী বেকার চমু বিরোধী-রাজনীতিবিদের অফুরন্ত রিক্রুটিং গ্রাউণ্ড তৈরি করেছিল। তৎসহ ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ-কর্মও এরা বৃত্তিরূপে গ্রহণ করে। এদের মধ্যে মাত্র দুই বা চারজন বেপরোয়া তরুণই সমাজ-ব্যবস্থা বিপন্ন করে তোলে। এতে রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এয়াসীদের যথেষ্ট সুবিধা হয়। কোনো বেকার যুবক কৃষিকাজ কিংবা ছোট শিল্প বা দোকান করলে তার ফসল বা দ্রব্যগুলি অন্য বেকার যুবকের। লুঠ করতো। এই ছোট্ট দেশে সমগ্র ভারতের লোকেদের চাকুরি ও ব্যবসাস্থল কোনোমতেই সংকুলান-সাধ্য নয়। অথচ স্থানীয় তরুণদের জন্য কোনও রক্ষাকবচের বা অগ্রাধিকারের ব্যবস্থা নেই।
[বাঙালীর ব্যবসা সাম্প্রতিক ঘেরাও-নীতির ফলে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনও এক মাড়োয়ারী শিল্পপতি আমাকে বলেছিল: ‘সাময়িক অসস্থবিধা সত্ত্বেও এতে আমাদের যথেষ্ট লাভ হয়েছে। বহু ছোট ছোট বাঙালী ব্যবসায়ী একত্রে আমাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উদ্যোগী হচ্ছিল। আমরা অর্থের জোরে টিকে গিয়েছি, কিন্তু ঘেরাও ও কারবার বন্ধের ফলে এখন আমাদের আর কোনো প্রতিযোগী নেই।’
এইরূপ এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে জল সিঞ্চনের ব্যবস্থা না করে আমরা ওদের দমনে ব্যাপৃত হলাম। আমরা কেউ বুঝলাম না যে অন্য কোনো কাজ না-থাকায় ওরা বিক্ষোভে ও মিছিলে যোগদান করতে বাধ্য হয়। আমি আমার কংগ্রেসী বন্ধুদের বলেছিলাম যে আপাতত পথ-ঘাট তৈরি বন্ধ রেখে ওই টাকায় ওদের জন্য ফ্যাক্টরি ও ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি করো, ওরা জল-কাদা ভেঙে অফিস-কাছারী না-করলে ক্ষতি নেই।
এই-সব আন্দোলন মধ্যে-মধ্যে ভীষণ আকার ধারণ করতো। পলায়ন-বিশারদরা শাস্ত্রবাক্য অনুসরণ করে আত্মরক্ষা করলে, পুলিশের প্রতি-আক্রমণে নিরীহ পথচারী বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতো। ফলে সরকার-বিরোধীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যায়। এজন্য আমি ঠিক-ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে অধীনদের উৎসাহিত করি।
ট্রাম ও বাস পোড়ানো দুষ্কর্ম বন্ধের জন্য ট্রাম ও বাসের মধ্যে সশস্ত্র ছদ্মবেশী পুলিশ থাকতো। কেউ দুষ্কর্ম করতে আসামাত্র ওঁরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। দুষ্কৃতকারীদের মধ্য হতে গুপ্তচর সংগ্রহ করে ক্ষেত্রবিশেষে আমরা প্রকৃত-অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছি। ওদের গোপন সভায় ছদ্মবেশী পুলিশ পাঠিয়ে নাটের গুরু ও তার চেলাদের আমরা গ্রেপ্তার করতাম।
একবার লক্ষ্য করলাম রাত্রিকালে সাংবাদিকদের গাড়ি দেখলে গলি থেকে বেরিয়ে ওরা গাড়ি থামায় ও নিজেদের বক্তব্য রাখে। সাংবাদিকরা সেইমতো পুলিশ-বিরোধী রিপোর্ট পত্রিকাতে বাহির করেন। আমি সাংবাদিকদের সঙ্গে বিরোধের পক্ষপাতী না থাকায় অন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলাম। অন্ধকারে একটি সাদা জীপগাড়িতে ‘রিপোর্টার’ লিখে ওদের ঘাঁটিতে গেলে ওরা পূর্বের মতো ছুটে আসে এবং বোমা-সহ ওদের আমরা গ্রেপ্তার করি। পরদিন রাত্রে প্রকৃত-সাংবাদিকরা ওখানে গেলে ওরা তাদের পুলিশ মনে করে যথেচ্ছ পিটোয়। প্রভাতী পত্রিকার সাংবাদিকরা ওই গুণ্ডাদের দমন না করার জন্য উলটো অভিযোগ করেন।
একবার বহুবাজার স্ট্রীটের দুপাশে দুটি বাড়ি দখল করে কিছু লোক বোমাবর্ষণে পথ-চলা অসম্ভব করে তোলে। আমরা বোমা বর্ষণের মধ্যেই ছুটে গিয়ে ওদের বার করে আনার সময় বোমার স্পিলিন্টার আমাদের শরীরে ঢুকে যায়। আমি রক্তাপ্লুত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হই এবং অজ্ঞান করে দুবার অস্ত্রোপচার করে। তা সত্ত্বেও কিছু স্পিলিন্টার শরীরের ভিতরে রয়ে যায়! আমার কানটি সেলাই করে আগের মতো করা হয়।
স্বর্গত ডঃ বিধানচন্দ্র রায় আমাকে দেখতে এলেন রাজ্যপালকে সঙ্গে নিয়ে। তিনি আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘আরে, তোমাকে তো কেউ দুকান-কাটা বলবে না!’ জনৈক ডাক্তার বাকী স্পিলিন্টারগুলি যার করবার জন্য পুনর্বার অস্ত্রোপচারের কথা বললে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘পরের দেহে সবাই ছুরি চালাতে চায়। এর কোনও প্রয়োজনই নেই।’ তারপর তিনি সস্নেহে বলেন, ‘তুমি তো লৌহ-মানব হে। এতো বড়ো শরীরে একটু স্পিলিন্টার থাকলে ক্ষতি নেই। ছত্ৰপতি শিবাজী, রাণা প্রতাপ ও মহারাজ রণজিৎ সিংহের শরীরে এমন কতো গোলা-গুলির টুকরো ছিল। কই তাঁদের কাজে-কর্মে তো কোনো ক্ষতি হয়নি। ওহে, তুমি জলদি উঠে পড়ো, কাজ-কর্ম আরম্ভ করে দাও।’ আমাকে ভড়কে যেতে দেখে তিনি বুঝিয়ে বলেন, ‘বাড়িতে অবাঞ্ছিত কেউ ঢুকে পড়লে তোমরা কি করে।?—সবাই মিলে ঘিরে ধরো তো। সেই রকম মানুষের শরীরে অবাঞ্ছিত কিছু প্রবেশ করলে চতুর্দিকের সেল (Cell) -গুলি তাকে ঘিরে ধরে শক্ত হয়ে যায়। তারপর ক্রমে ক্রমে অবাঞ্ছিত বস্তু গ’লে রক্তের সঙ্গে মিশে শরীরের মধ্যেই লীন হয়।
[কখনও খুনে-গুণ্ডা ধরতে গিয়ে, কোনোদিন দাঙ্গা থামাতে, কখনও-বা রাজনৈতিক হাঙ্গামা থামাতে গিয়ে আমি বহুবার আহত হয়েছি। আমার অভিজ্ঞতা এই-যে সামান্য আঘাতে ব্যথা পেলেও, বড়ো আঘাতে শক-এর দরুন ব্যথা কম হয়। আমার আঘাত প্রাপ্ত ঘটনাগুলি আর উল্লেখ করলাম না।]
আমি ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি বিষয়ে গবেষণা করে বহুদূর এগিয়েছিলাম। এ বিষয়ে দুটি পুরনো থিওরী বাতিল করে নতুন থিওরী রচনা করি। সেগুলি একাধিক বিজ্ঞানী স্বীকার করেছেন। এ সম্পর্কে পিওর-লাইন ক্রিমিন্যাল হেরিডিটি গবেষণার জন্য আমি ছুটি নিয়ে আন্দামানে কিছুদিন ছিলাম। সেখানে পিতা-মাতা উভয়-পক্ষই অপরাধী এমন কেস পাওয়ায় ওই বিষয়ে গবেষণার কাজে সুবিধা হয়। আমি ফিরে এসে আন্দামানে বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের সুবিধার কথা রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জিকে বলি। তিনি নিজে তারপর আন্দামান ঘুরে এসে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়কে বুঝিয়ে বলেন। কিছুদিন পরে কাগজে দেখলাম যে আন্দামানে বাস্তুহারাদের পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে। গবেষণার জন্য দ্বিতীয়বার ওখানে গিয়ে বাস্তুহারাদের বসবাসে উৎসাহিত করে এসেছিলাম। আমি ও সত্যেন্দ্রবাবু ওদের বসবাসের ব্যাপারে কিছু অসুবিধার কথা ডঃ রায়কে জানালে তিনি তার বিহিত করেছিলেন।
এ সময়ে শিল্পক্ষেত্রেও অশান্তির সৃষ্টি করা হয়। বিখ্যাত জোসেফ কোম্পানি এবং অন্য এক কোম্পানির ইংরাজ ও দেশীয় ম্যানেজারদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমি মধ্য-কলকাতার এক কারখানায় খণ্ডযুদ্ধ করে আহত হলেও, অসহায় ম্যানেজারকে ফারনেস-এ ঢোকাবার পূর্বে উদ্ধার করতে সক্ষম হই। প্রতিটি ধর্মঘট ভাঙার পর আমি সেই-সব কারখানায় স্থানীয় বেকারদের চাকুরির ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু ওদের কেউ-কেউ অনুগত না-থেকে চাকুরিক্ষেত্রে উৎপাত শুরু করে দেয়।
কলকাতা কর্পোরেশনের সামগ্রিক ধর্মঘটের কালে আমি মধ্য-কলকাতায় পুলিশ ও জনগণকে সমবেত করে থানা-ভিত্তিক বিকেন্দ্রিক পৌর-কর্মের ব্যবস্থা করি। কর্পোরেশনের কিছু ময়লা-ফেলা লরী প্রতি-থানায় রেখে ময়লা সাফ করাই। উপরন্তু, ওদের কাছ থেকে চাবি সংগ্রহ করে প্রতি রাত্রে বিভিন্ন পথের বাতি জ্বালাতে সক্ষম হই।
কিছু ঊর্ধ্বর্তন-কর্মীর সৎ-ব্যবহার বারে বারে আমার মনে পড়ে। হঠাৎ একদিন আমার ৩১ নং জীপগাড়িটির বদলে অন্য একটি গাড়ি আমাকে দেওয়া হ’ল। ৩১ নং জীপগাড়িটি বোমার আঘাতে বিক্ষত শরীর হলেও আমি বহুবার এতে চড়ে নিরাপদে দূরে চলে এসেছি। এই সেন্টিমেন্টের কথা বলে হেড কোয়ার্টারস-এ ডেপুটি রঞ্জিৎ গুপ্তের নিকট আর্জি পেশ করে ওটা ফেরত চাইলাম। উনি আর্জি প্রত্যাখ্যান করে বললেন যে মানুষের মতো কোনো বস্তুও অপরিহার্য নয়। কিন্তু রাত্রি দশটার সময় তিনিই আবার ফোন করে বললেন যে আমি ওটা ফেরত পেতে পারি।
সাউথের ডেপুটি কমিশনার চন্দ্রশেখর বর্মন হল্লা-ডিউটির শেষে সারাক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিটি সিপাহীকে ট্রাকে তুলে দিয়ে তবে নিজের গাড়িতে উঠে বাড়ি ফিরেছিলেন, মনে পড়ে।
পুলিশ-কমিশনার উপানন্দ মুখার্জি তাঁর ডেপুটি কমিশনারদের কাছে একবার বলেছিলেন, ‘অধীনস্থ কর্মীদের প্রতি বিরূপতা দেখানো তোমাদের পক্ষে সামান্য ব্যাপার হলেও ওদের পক্ষে যথেষ্ট উৎকণ্ঠা ও ক্ষতির কারণ হয়। ওদের প্রতি অকারণে রূঢ় হলে সমগ্র বাহিনী বানচাল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা।’
পুলিশ কমিশনার হরিসাধন চৌধুরী তাঁর ডেপুটিদের প্রায়ই বলতেন যে অধীনস্থ কর্মীদের পারিবারিক অসুবিধা ও অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রে ওদের সাহায্য করবে। রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ মুখার্জির মতে সাধারণ সিপাহীদের কাছেও পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত।
ডেপুটি-কমিশনার খোন্দকার হোসেন রেজা অতিথিদের খাওয়ানোর পর নিজে মুশ্লিম সিপাহীদের সঙ্গে একত্রে ভোজনে বসতেন।
কমিশনার সুরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি তাঁর ডেপুটিদের বলেছিলেন, ‘আমার কাছে তোমরা যে রকম ব্যবহার প্রত্যাশা করো, তোমাদের অধীনস্থ কর্মীদের প্রতি সেই রকম ব্যবহার করবে।’
আমি থানা-বিভাগ থেকে বদলি হয়ে তারপর এনফোর্সমেন্ট তথা আরোপক বিভাগে এলাম। ব্রিটিশ শাসনে দ্বিতীয় যুদ্ধকালে এই বিভাগ সৃষ্টি হয়। তখন সিভিল সাপ্লাই থেকে আসা নতুন রিক্রুট দ্বারা ভর্তি অফিসারদের প্রশিক্ষণের ভার আমি নিই। এতদিন পরে উচ্চপদী হয়ে এই বিভাগে যোগ দিলাম।
এইখানে আমি ভেজাল নিবারণে ও মুনাফা রোধে কিছু ব্যবসায়ীর কাছে বিভীষিকাস্বরূপ হয়েছিলাম। কিছু ব্যবসায়ী নির্লজ্জের মতো সরকারকে ভেজাল দেওয়ার পরিমাপ বেঁধে দিতে অনুরোধ করে এবং আমাকে লক্ষ লক্ষ মুদ্রার বৃথা প্রলোভন দেখায়। আমি বহুদ্রব্যের কৃত্রিম ঘাটতি প্রমাণ করার ফলে কয়েকবার কন্ট্রোল বাতিল করা হয়। আমরা নিজেরাই অফিসে ভেজাল নিরূপণের যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করি। বহুস্থানে প্রদর্শনী খুলে জনগণকে ভেজাল ঔষধ ও পণ্যদ্রব্য চিনতে সাহায্য করি। এই সময় আমাদের সাহায্যে শহরে জনসংযোগেরও ব্যবস্থা করা হয়। শহরের মেসেজ হোম ও নাইট ক্লাবগুলি বন্ধেরও আমরা পথপ্রদর্শক হয়েছিলাম। (টালিগঞ্জ মেডিকেল ইউনিটেরও আমি তখন সেক্রেটারি।) ভারত-সরকারের অধীন কলকাতার ডিটেকটিভ ট্রেনিং কলেজে আমার সংগৃহীত দুইশত প্রদর্শনী-দ্রব্য সহ ক্রাইম-মিউজিয়মটি স্থাপন করা হয়। আমারই পরিকল্পিত স্ট্যাণ্ড তৈরি করে সাজানোর কায়দায় সেটি বেশ শিক্ষাপ্রদ হয়েছিল। ক্রিমিন্যাল সাইকোলজি, অ্যাপ্লায়েড ক্রিমিনোলজি, ফরেনসিক সায়ান্স, কমার্শিয়াল ক্রাইম এবং নিষিদ্ধ পণ্য, ভেজাল ও আবগারী বিভাগসমূহে এগুলি বিভক্ত করা হয়। প্রাচ্য, পাশ্চাত্য এবং ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের অপরাধীদের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সমূহের একটি কমপারেটিভ স্টাডির ব্যবস্থা আমি ওখানে করেছিলাম। তাছাড়া, ব্যারাকপুর ট্রেনিং কলেজ এবং মাউন্ট আবু কেন্দ্রিয় পুলিশ-ট্রেনিং কলেজের মিউজিয়মে বহু মডেল, চার্ট ও যন্ত্রপাতি আধার-সহ আমি দান করি।
উপরোক্ত তিনটি সংস্থাতেই বহুবার মধ্যে মধ্যে অধ্যাপনার কাজ ও আমাকে করতে হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনও কয়েকবার আমাকে পেপার-সেটার ও পরীক্ষকরূপে নিয়োগ করে। এই সময় সরকারের অনুমতি নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগে কয়েকটি পর্যায়ে বক্তৃতা দিই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আমার অধীনে কিছুকাল গবেষণাও করে। শিবপুর কলেজ থেকে এনভারমেন্টাল ইঞ্জিনীয়ারিং গবেষণার জন্যও আমার কাছে ছাত্র পাঠানো হয়। বহুস্থানে গভর্নমেন্টের পক্ষ থেকে পাবলিক প্রদর্শনী করা হলে আমার সংগৃহীত দ্রব্য ও মডেলাদি সংবাদপত্র ও জনগণ কর্তৃক বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
সেন্টাল ক্যালকাটা রাইফেল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে আমি ও সত্যেন্দ্র মুখ্যার্জি অন্যতম ছিলাম।
আমি কলিকাতা-পুলিশের স্পেশাল-ব্রাঞ্চের ডেপুটি পুলিশ কমিশনার (আই.পি.এস.) হয়ে এলাম। তার পরদিনই খবর পেলাম যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে ক্রিমিন্যাল সাইকোলজিতে ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেছেন। আমি দীর্ঘকাল নীরবে গবেষণা করে গোপনে থিসিস সাবমিট করেছিলাম।
কিছুকাল পরে এনফোর্সমেন্ট ও অ্যান্টিরাউডির ডেপুটি কমিশনার পদে আমি বহাল হলাম। ততদিনে শহরের উঠতি-গুণ্ডা ও মস্তানদের উপদ্রব বন্ধ করে দিয়েছি। পরে ই. বি. (হোম) অ্যান্টিকরাপশনের স্পেশাল অফিসার হয়েছিলাম। উল্লেখ্য এই-যে গভর্নমেন্ট আমাকে প্রথম কলিকাতা সহ চব্বিশ পরগণা, হাওড়াও হুগলী জেলাতেও জুরিসডিকশন প্রদান করেন। বহু উচ্চপদী ও নিম্নপদী কর্মীর উৎকোচ-গ্রহণ বন্ধ করেও যোগ্যতা দেখিয়েছিলাম। কিছুকাল পরে অলক্ষ্যে আমি অবসর গ্রহণ করে জনগণের সঙ্গে মিশে গেলাম। কেউ জানতেও পারলো না যে কলিকাতা-পুলিশে আমি আর নেই।
কিন্তু যাকে বলে অলস জীবন-যাপন তা আমার দ্বারা সম্ভরপর হয় নি। অবসর-গ্রহণের পরেও অনেক বড়ো-বড়ো মিল, ফ্যাক্টরি ও কোম্পানিতে জেনারেল-ম্যানেজার বা অনুরূপ গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থেকে সুনাম অর্জন করেছি। প্রকৃতপক্ষে আমি ইউনিফর্মড ডিউটির পক্ষপাতী।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, টাটা স্টাফ ট্রেনিং ইনষ্টিটিউট, ইণ্ডিয়ান ল’ ইনষ্টিটিউট, কলিকাতা ডেফ এণ্ড ডাফ স্কুলের সর্বভারতীয় ট্রেনিং সেন্টার, মাউন্ট আবুর কেন্দ্রীয় পুলিশ ও ব্যারাকপুর ট্রেনিং কলেজে আমি ভিজিটিং লেকচারার-এর কাজ করেছি। অল ইণ্ডিয়া ইনডাসট্রিয়াল সাইকোলজিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হই। গভর্নমেন্ট আমাকে স্থানীয় ‘জাস্টিস অফ পীস’ও করেছিলেন। হাওড়া হনুমান হাসপাতালের এক্সিকিউটিভ মেম্বাররূপে ওখানে মনোরোগের একটি কেন্দ্র স্থাপন করেছিলাম।
সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও আমার কিছু অবদান আছে। আট খণ্ড অপরাধ-বিজ্ঞান, এক-এক খণ্ড হিন্দু প্রাণীবিজ্ঞান ও শ্রমিক-বিজ্ঞান, কিশোর-অপরাধী, পুলিশ-কাহিনী (প্রথম খণ্ড) এবং চল্লিশটি উপন্যাস ও রম্যরচনা ইত্যাদি যথেষ্ট প্রশংসা অর্জন করেছে।
বর্তমানে একটি জেনারেল কলেজ ও এগ্রিকালচারাল স্কুল এবং বেকারদের জন্য কিছু শিল্প-কেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা করছি। এজন্য আরও কয় বৎসর জীবিত থাকা আমার প্রয়োজন।
[আমি পূর্বে সরকারের নিকট হতে পারমিট গ্রহন করে একটি টেপ-লুম্ কারাখানা স্থাপন করে পঞ্চাশ জন বেকারের অন্নসংস্থান করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সাম্প্রতিক মার-দাঙ্গাকালে বিবিধ উৎপীড়নে সেটি বন্ধ হয়ে যায়।
তবু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত-সম্প্রদায় দ্বারা কৃষি-ব্যবস্থাটি এখনও চালু রয়ে গেছে। এখানে উচ্চবর্ণের তরুণেরাও কৃষিকাজ ও পশুপালন করে থাকে।]
প্রত্যেক মানুষ বেশি উঁচুতে উঠলে সমাজের ক্ষতিসাধন হয়। তাতে মূল সমাজ-বন্ধন হতে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমার জীবনের লক্ষ্যস্থল ছিল খুব উঁচুও নয় খুব নিচুও নয়। তাই জীবনের সীমিত ক্ষেত্রে আমি সফল হয়েছি বলে মনে করি।