পঞ্চম পুরুষ – ১৭

১৭

যত সহজে ত্যাগ করব বলা যায়, তত সহজে করা যায় না। তাছাড়া, প্রাত্যহিকতা থেকে দূরে গিয়ে পড়লেই বিভ্রম ঘটবার সম্ভাবনা থাকে। সেই সময়কার অনুভূতিই চূড়ান্ত নয়। দুশ তেত্রিশ নং, প্রিয়লকরনগর, ব্লক বিতে ফিরে তালা খুলে যখন ঢুকল নীলম, বদ্ধ জানলাগুলো খুলে দেবার একটু পরেই হাওয়া পরিষ্কার হয়ে গেল, ওপরের মারাঠি ভদ্রমহিলাকে চাবি দেওয়া ছিল, তিনি প্রতিদিন ঘর পরিষ্কার করিয়ে রেখেছেন। রুম ফ্রেশনার স্প্রে করে দিল নীলম ঘরে ঘরে, আলো জ্বালিয়ে, ধূপ জ্বালিয়ে দিল। ঝকঝক করে উঠল টেবিলের ওপর, চেয়ারের মাথা, দেয়ালে গোয়ার ছবি। নীলমের মনে হল তার সম্মোহাৎ স্মৃতি বিভ্রম হয়েছিল, নয়ত, এই তিল তিল যত্ন আর ভালোবাসায় গড়া ঘরকে সে অপবিত্র ভাবল কি করে! স্মৃতিভ্রংশাদ্‌ বুদ্ধিনাশ হবারও যোগাড় হয়েছিল, বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতিটা সময়মত মনে পড়ে যায় তাই রক্ষা। আঠার বছরের পুপু নির্মল, শুচি, শুদ্ধ, কি করে তার মধ্যে জীবনের জটিলতার বিষ ঢুকিয়ে দেবার কথা সে ভেবেছিল? পুপুকে ফোন করতে তার প্রথম কথা—‘বাবা ঠিক আছে তো? খোঁড়াচ্ছে না?’ ‘—হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুই চলে আয়, আমি এসে গেছি।’ —‘তুমি একা চলে এলে কেন মা? বাবা কিন্তু পুরোপুরি ফিট নয় এখনও, তাছাড়া জানোই তো হী ইজ আ বিট ক্র্যাঙ্কি!’ নীলমের মনে হল একবার জিজ্ঞেস করে—‘পুপু, মা কি তোর কেউ না?’ কিন্তু প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় এসে থমকে যায়। পুপু এমনিতেই বলে—‘তোমরা বড্ড সেন্টিমেন্টাল।’

একবার গুপ্ত কথাটা বলে ফেলবার সংকল্প করায় কথাটাও বারবারই মুখে এসে যাচ্ছে। —‘জানিস পুপু, তোর বাবা কিন্তু তোর আসল বাবা নয়। আগে আমার একবার বিয়ে হয়েছিল, সেই বাবার মেয়ে তুই।’ এইভাবে বলা হলে অশুচিতাটা চলে যায়, কিন্তু আঘাত? আঘাতটা বোধহয় থেকেই যাবে। পুপুর যে কী প্রতিক্রিয়া হবে তাও গণে গেঁথে কিছুতেই থই পাচ্ছে না নীলম। অথচ পুপুর পিতৃধন এতো মূল্যবান যে ওকে সেটা অবহিত করানো দরকার। আসলে পুপুর যতটা দরকার, নীলমের দরকার তার চেয়েও বেশি। সত্যের ভার এতো বেশি যে নীলম কিছুতেই আর তাকে সহজে বইতে পারছে না।

এষারা বাড়ি ফিরতে তাই যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল নীলম। বাড়ি ঢুকেই অরিত্রর প্রথম কথা—‘পুপ্‌ কোথায়?’ সঙ্গে সঙ্গে পুপু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

‘বাবা, তুমি মাত্র দুদিনেই কি রোগা হয়ে গেছো। কি কালো!’ অরি হেসে বলল—‘ওকে বলে দুধে-রং। তাই সামান্য রোদেই জ্বলে যায়। তোর বাবা কবে গোরা-সাহেব ছিল পুপু? তোর পরীক্ষা কেমন হল?’ এষা তখন নীলমকে বলছিল—ডাঃ রায়, বাড়ির চৌকাঠ থেকে ফিরে গেলেন। কত করে বললুম, এক কাপ চা অন্তত খেয়ে যান। শুনলেন না।’

পুপু বলল— ‘মা, ফিরে যাবার আগে ওঁকে আরেকবার ডাকবে না? অল্প আইটেম করো। না হলে কথা বলবার সময় পাওয়া যায় না।’

নীলমকে ভীষণ ক্লিষ্ট দেখল এষা। এষাকেও ভীষণ ক্লান্ত, বিরস দেখল নীলম। মহানাম তাদের সঙ্গে সারাক্ষণ ছিলেন, বাড়ির চৌকাঠ পর্যন্ত, এই কথাটা নীলমকে জানানো ভীষণ জরুরি ছিল, সেই কর্তব্যটা করে এষা আর একটুও দাঁড়াল না। স্নান করতে ঢুকে গেল। ধারা স্নান। ভীষণ ক্লান্তি, ভীষণ ক্লেদ, খেদ, সব নবধারাজলে ধুয়ে যাক, ধুয়ে যাক।

মাথাসুদ্ধু ভিজিয়ে বেরোল এষা। পুপু তাড়াতাড়ি ওর হেয়ার-ড্রায়ার বার করে বলল—‘তুমি প্রায়ই এরকম মাথা ভিজিয়ে চান করো নাকি এষা মাসি? চুল শুকিয়ে নাও।’ নিজের পড়ার চেয়ারে এষাকে উল্টো মুখে বসিয়ে নিজেই চুলটা শুকিয়ে দিল ওর।

এষা বলল—‘তুই কি খুব বেশি ব্যবহার করিস নাকি ড্রায়ারটা? চুল কিন্তু ভেতরে ভেতরে পেকে যাবে তাড়াতাড়ি। ওইজন্যেই আজকাল ফ্যাশনেব্‌ল মেয়েদের তাড়াতাড়ি চুল পাকে।’

পুপু বলল—‘ওহ্‌, হাউ আই উড লাভ ইট।’

এষা হেসে বলল—‘তোর সবই উল্টোপাল্টা না কি রে?’

পুপু বলল—‘ডোন্ট য়ু সি মাসি? ইট উড মেক মি লুক লাইক ডক্টর মহানাম রয়।’

নীলম এমন ভীষণ ভাবে চমকে উঠল যে এষা আর পুপু দুজনেরই নজর পড়ল তার দিকে। এষা মুখ ফিরিয়ে পুপুর দিকে তাকাল, তারপর বলল—‘সত্যিই তো! মহানামদার সঙ্গে তোর তো ভীষণ মিল?’

পুপু বলল—‘আই মাস্ট হ্যাভ বীন হিজ ডটার ইন সাম আদার লাইফ। অলদো আই ডোন্ট বিলিভ ইন রি-ইনকারনেশন।’

এষা বলল—‘তোর বিশ্বাস অবিশ্বাসগুলোকে এই বয়স থেকেই খুব রিজিড করে ফেলিস নি পুপু। জন্মান্তর থাকলে জীবনের কত দুরূহ সমস্যার সমাধান হয়ে যায় তুই এখনও জানিস না।’

নীলম মৃতের মতো বসেছিল, সেদিকে একপলক তাকিয়ে এষা বলল— ‘বয়স আমার অন্তত পঁয়ত্রিশ,

পনের বছরে পা দিয়েছ তুমি সবে

তবু গূঢ় ক্ষতে চোয়ায় স্মৃতির বিষ;

তাকালে তোমার তরুণ মুখাবয়বে।’

নীলম চোখ মেলে তাকাল। চোখের কোলে কোলে জল। পুপু মন দিয়ে কবিতাটা শুনছিল। বলল—‘ছন্দটা সুন্দর। কিন্তু বাংলা কবিতা আমাকে ট্রানস্লেট করে বুঝতে হয়। “গূঢ় ক্ষতে চোয়ায় স্মৃতির বিষ”—এই জায়গাটা বুঝতে পারলুম না। “গূঢ়” মীন্‌স?’

‘সিক্রেট’

“ক্ষত’, উন্ড আর ‘চোয়ায়’?’

“ঊজেস’ বলতে পারিস।

‘ইয়েট দা পয়জন অফ মেমরি ঊজেস ফ্রম দা সিক্রেট উন্ড! বাঃ! এষা মাসি, য়ু মেক বিউটিফুল পোয়েট্রি।’

‘কি আশ্চর্য! আমি যা বলি সবই অন্যের রে। এটা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের করা হাইনরিখ্‌ হাইনের অনুবাদ।’

নীলম বুঝতে পারল এষা বুঝেছে। উপরন্তু মহানাম তাঁর দাবী কোনদিনই পেশ করবার কথা মনেও আনেননি। এবং পুপু কোন না কোনদিন সত্য জানবেই। সেটা ওকে নিজেকে জানতে দেওয়াই ভালো।

এষা টেবিলে বসল না। এক গ্লাস দুধ ওকে দিয়ে এলো পুপু শোবার ঘরে। অনেকদিন পর যেন তিনজনের পারিবারিক নৈশভোজ। অরিত্র খেয়েই শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম। শুতে যাবার আগে নীলম পুপুদের ঘরে গিয়ে দেখল এষা নেই। খুঁজতে খুঁজতে পাঁচতলার ওপর ছাদে ওকে আবিষ্কার করল নীলম। মোজেইক করা ছাদটা ওদের। আকাশটাকে খুব কাছে মনে হয়। মৃদু হাওয়ায় এষার আঁচল উড়ছে দেখতে পেল নীলম।

‘কি হল এষা, ঘুমোও নি?’

‘ঘুম আসছে না। সত্যি তোমাদের খুব জ্বালাতন করে গেলাম নীলম। ক্ষমা করে দিও।’

‘সে কি? তোমাকে তো আমার ধন্যবাদ দেবার কথা? তুমি যে কত দিয়ে গেলে? সুন্দর অভিজ্ঞতা, সুন্দর সঙ্গ, ক্ষমা, ভালোবাসা, কতো সত্য যে বোঝাই হত না তুমি না এলে! পারলে তুমি-ই আমাকে মাপ করো। আমি শুধু নিয়েই গেছি। এখন দেবার চেষ্টা করলেও তেমন মূল্যবান কিছু খুঁজে পাই না।’ নীলমের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।

এষার মনে হল যা অরিত্রর মুখ থেকে শোনবার কথা ছিল, নীলমের মুখ দিয়ে তা কেউ তাকে শোনালো। তার এসব কথা শোনার জরুরি দরকার ছিল বলে। বলল—‘পুরনো কথা মনে করে কষ্ট পাবার আর কিছু নেই নীলম। এখন অন্য দিন।’

নীলম বলল—‘পুপুর ব্যাপারটায় তুমি আবার নতুন করে কষ্ট পেলে তাই না?’ বলতে বলতে নীলম অনুভব করল তার লজ্জা এবং দুঃখের মধ্যেও একটা গর্ববোধ কাজ করে যাচ্ছে। সে যখন যা চেয়েছে, পেয়েছে। পাওয়ায় তার অঞ্জলি ভরে আছে। এষার হাতে শুধুই শূন্য।

এষা বলল—‘এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। আমরা, আমাদের গ্রুপের ছাত্র-ছাত্রীরা সব্বাই জেনে গিয়েছিলাম তুমি মহানামদার। যখন ব্যাপারটা অন্যরকম ঘটল তখনই সকলে অবাক হয়ে গিয়েছিল।’

নীলম মুখ ফিরিয়ে বলল—‘আমি কি সাঙ্ঘাতিক খারাপ এবার তাহলে পুরোপুরি জানলে তো এষা, নিশ্চয় আমাকে ঘৃণা করছো?’

এষা বলল—‘কিছু যদি মনে না করো ব্যাপারটা আমার কাছে একটু পরিষ্কার করবে নীলম? চয়েসটা কি তোমার? মহানামদার জায়গায় অরিত্র? না মহানামদাই তোমাকে, তাঁর সন্তানকে গ্রহণ করতে চাননি!’

‘মহানাম তাঁর সন্তানের কথা আজ আঠার বছর পরে জানলেন এষা। পাছে তিনি আমায় আটকান, তাই তাঁকে আমি জানাই-ই নি। চয়েসটা আমারই। দায়িত্ব সম্পূর্ণই আমার। অরি সে সময়ে মহানামের সম্পর্কে নানা রটনার কথা বলে আমাকে একেবারে বিমুখ করে দিয়েছিল, তাছাড়া তুমি তো জানোই তার প্রেম করবার তুমুল ধরন-ধারণ। যে কোনও মেয়েকে যে কোনও বয়সে সে যাদু করতে পারে। যদি চায়।’

এষা অনেকক্ষণ পরে বলল—‘আমাকে আর পারবে না নীলম, এটুকু বিশ্বাস রেখো আমার ওপর।’

‘পারবে না জানি। কিন্তু চায় যে সেখানেই আমার অপমান, বোঝো না?’

এষা বলল—“না অপমান নয়। বড্ড বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছ ওকে। একটু অবহেলা করো, একটু বঞ্চিত করো। লড়াই করো। ওকে জিততে দিও না সব সময়ে। কারণ তাহলেই ও সবচেয়ে বেশি করে হারবে।’

নীলম বলল—‘বঞ্চিত যিনি করবার তিনি তো করেইছেন। আমি তো এখন জরায়ুহীন, ডিম্বকোষহীন, নারীত্বহীন নারী।’

এষা বলল—‘শুনেছি। তুমি এই মেডিক্যাল, ফিজিওলজিক্যাল তথ্যটা নিয়ে এতো মাথা ঘামাচ্ছো কেন বলো তো? আমি বলছি তুমি নারীই আছো। এবং তারও ওপরে মানুষ। মানুষের কাছে মানুষের যা না পেলে চলে না, সেইখানে তুমি ওকে বঞ্চিত করো নীলম। তোমার দাক্ষিণ্য, এতো অবারিত করো না।’

‘করছি না। মোটেই আর করছি না। অনেক ভুলই এখন বুঝতে পারি, যা কদিন আগেও বুঝিনি। তাই-ই তোমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। কিন্তু এষা তোমাকে আমি কি দেবো? তোমার জন্যে আমার বুক যে খাঁ খাঁ করছে!’

আর্দ্র গলায় এষা বলল—‘এটাই তো আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া হল তোমার কাছ থেকে। এবার যত দূরেই যাই তোমার লক্ষ্মীর পা আমার সঙ্গে সঙ্গে চলবে।’ জ্যোতিষ্কভরা আকাশের তলায় এ যেন এক নতুন অঙ্গীকার।

অরিত্র জানছে না। কিন্তু লড়াই শুরু হয়ে গেছে। কামানের মুখগুলো সব তার দিকে ফেরানো। গাছপালার আড়ালে সেগুলো লুকিয়ে আছে। গুপ্ত চোখ পাহারা দিয়ে ফিরছে তাকে। অশ্বারোহী সৈন্যদল দূর থেকে টহল দিয়ে গেল। অরিত্র চৌধুরী তুমি জানো না, বড় ফ্যাসাদেই পড়েছ।

নীলম বলল—‘বিক্রম আর সীমা অনেক করে বলে গেছে। ওদের বাড়িতেই আমরা গিয়ে উঠছি বম্বেতে।’

উত্তেজিত অরিত্র বলছে—‘এখুনি ফোন করে ক্যানসেল করে দাও। কোম্পানির গেস্ট-হাউসে আমি ব্যবস্থা করেছি।’

নীলম বলল—‘ওরা অনেক আশা করে আছে। আমি ওদের কষ্ট দিতে পারব না। এক কাজ করো, তুমি গেস্ট হাউসে থাকো। আমি এদের সবাইকে নিয়ে ওদের বাড়ি থাকি।’

‘অর্থাৎ তুমি মন ঠিক করে ফেলেছো?’

‘মন ঠিক করে ফেলাফেলির কি আছে? বলে গেছে। আয়োজন করে রাখবে। ফেরাব কেন?’

‘ফেরাবে এইজন্যে যে বিক্রমের বর্বরতা মাঝে মাঝে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।’

‘আমি নিজেও তো বর্বর শ্রেণীর, ওটা আমি সামলাতে পারবো।’

‘কিছুই সামলাতে পারবে না। আসলে বর্বরতা তোমার ভালো লাগে। বিক্রমকে প্রশ্রয় দিচ্ছ অনেকদিন থেকে।’

‘বর্বরতা ভালো লাগে কি না জানি না, তবে সমাদর ভালোই লাগে। স্বীকার করছি। সীমা ওর বাড়ি গেলে যা যত্ন করে, বিক্রম যে ভাবে সব সময়ে এক পায়ে খাড়া থাকে সেটা একেবারেই ফ্যালনা নয়। আর, আমি না হয় বিক্রমকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, তোমাকে কে প্রশ্রয় দিচ্ছে বলো তো?’

‘আমার আচরণে বিক্রমের মতো বর্বরতা প্রকাশ পাচ্ছে না কি?’

‘তুমি বোধহয় ওকেও ছাড়িয়ে যেতে পেরেছ।’

অরিত্র উঠে দাঁড়িয়েছে। ভীষণ উত্তেজিত। চড়া কথা বলতে গিয়ে থেমে গেল। এষা কি কিছু বলেছে নীলমকে? অরিত্রর মুখ নীল হয়ে গেছে।

পুপু বলল—‘কদিন আগেই তো আমি গোয়া ঘুরে এসেছি। আর যাবো না। আমি বিক্রমকাকুর বাড়ি থেকে যাবো।’ নীলম মনে মনে ভাবল সেও থেকে যাবে কিন্তু সে কথা এখনই অরিত্রকে বলার দরকার নেই। অনেক সুতো ছাড়তে হবে ওকে এখন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *