পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

পঞ্চম পর্ব— ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা

পঞ্চম পর্ব— ভয়াবহ স্বাভাবিক কথা

১।

আজ রবিবার। লালমোহন মল্লিকের বাড়িতে ভিড় অন্যদিনের তুলনায় ঢের বেশি। একে তো আজই গণপতির জাদু দেখানোর শেষ দিন, তার উপরে ঘোষণা করা হয়েছে আজ নাকি গণপতি কিছু “ইস্পেশাল” খেলা দেখাবেন বাড়ির বাইরে প্রচারপত্র পড়েছে সেইমতোই।

সন্ধ্যা হতে না হতেই আজ ভিড় বাড়ছে। এমনিতেই গণপতির খেলায় লোকের অভাব হয় না। তার উপরে আজ আবার স্পেশাল কী হতে পারে তা ভেবে যাঁরা আগে একবার দেখে গেছেন, তাঁদের অনেকেই আবার টিকিট কেটেছেন। দুপুর হতে না হতেই টিকিট শেষ। লালমোহন মল্লিকের বাড়ির পাশের টিকিটঘরের ঝাঁপ পড়ে গেছে। সবাই গুনগুন করে আলোচনা করছেন এই গণপতি নাকি প্রেতসিদ্ধ। হিমালয় থেকে একটা ভূত এনে পুষে রেখেছেন। আত্মারাম নামের সেই পোষা ভূত নাকি আজ সশরীরে মঞ্চে আসবে। এর আগে তার গলার আওয়াজ শুনে গেছেন অনেকেই। স্টেজে নীল আলোর সামনে দাঁড়িয়ে গণপতি তার পোষা ভূতকে ডাকে, “আত্মারাম, এবার আমার গেলাসের ভিতর চলে এসো।” ভূত সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, “এঁসেছি হুজুর, কী বলব বলুন।” গণপতি জিজ্ঞেস করে, “তা তুমি এখন আসছ কোথা থেকে?” ভূতের উত্তর নেই। গণপতি রেগে যায়, “বলি কানে কি ঠুলি গুঁজেছ? আসছ কোথা থেকে?” আবার উত্তর নেই। শেষে জানা যায় এতদূর থেকে আসতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে হেঁচকি উঠছিল। তাই সে উত্তর দিতে পারেনি। সমবেত দর্শক হো হো করে হেসে ওঠেন। গণপতি হেসে হারমোনিয়াম টেনে গান ধরে,

“জীবন ফুরায়ে এল কোথা প্রাণধন/ প্রাণ লয়ে পলাইল, না এল এখন।” গণপতির জাদুতে এই হাসি ঠাট্টার পরিবেশ শুরু থেকেই থাকে।

কিন্তু আজ যাঁরা বাঁধা মঞ্চে ঢুকলেন, তাঁরা সবাই বুঝলেন গুরুতর কিছু একটা হতে চলেছে। আগে যাঁরা এসেছেন তাঁরা জানেন শুরুতে সানাই বাজে পুরিয়া ধানেশ্রীতে। আজ তার বদলে খুব ধীর লয়ে কোথাও একটা ড্রাম বাজছে গুমগুম শব্দে। গোটা মঞ্চের আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। উজ্জ্বল হলুদ পর্দার জায়গা নিয়েছে কালচে লাল ভারী পর্দা। উৎসবের যে মেজাজ এতদিন ছিল, তা আজ একেবারে ভ্যানিশ। সকাল থেকে নিজের ঘর ছেড়ে বেরোয়নি গণপতি। বারবার ধ্যানে বসার চেষ্টা করেছে। ইষ্টনাম জপ করেছে। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। আজকেই হয়তো শেষবারের মতো তার মঞ্চে খেলা দেখানো। যে জাদুর খেলা দেখাবে বলে সে জীবনের অনেক কিছুকেই বাজি রেখেছিল, আজ বুঝি সব শেষ হতে চলেছে। গণপতি জানত এই দিনটা একদিন না একদিন আসবে। কিন্তু এত দ্রুত, তা টের পায়নি। সেদিন তারিণী তার হ্যান্ডবিলের সঙ্গে আরও একটা পাতলা বিজ্ঞাপনের কাগজ দিয়ে গিয়েছিল। সাদা চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু সেই “টাইট ব্রেস্টের” বিজ্ঞাপনে এমন কিছু ছিল, যাতে গণপতি বুঝতে পেরেছে শিয়রে শমন। এবার তার ডাক এসেছে। সংঘের ডাকে দরকার হলে তাকে প্রাণও দিতে হতে পারে। বহু বছর আগে হরিদ্বারে এমনটাই তো কথা দিয়েছিল সে লখনকে। কথার খেলাপ করার উপায় নেই। খুনের মামলা তামাদি হয় না। ওখানকার পুলিশ হয়তো এখনও তাকে পিন্ডারী বাবার খুনের মামলায় খুঁজে বেড়াচ্ছে! এদিকে লখনের কথা শোনা মানে নিজের বিবেককে আবার বিসর্জন দেওয়া।

তবে গণপতি ঠিক করে নিয়েছে। আজকে তার শেষ খেলা। আর এই খেলাই হবে তার জীবনের সেরা খেলা। যাতে সে মারা গেলেও লোকে বলতে পারে খেলার মতো খেলা দেখাত একজনই। জাদুকর গণপতি চক্রবর্তী। আজকের খেলার জন্য কাঠের বিরাট একটা ক্যাবিনেট বানানো হয়েছে। যে খেলা আজ সে দেখাবে, ভারতে আজ অবধি তেমন খেলা কেউ দেখেনি দেখবেও না। উইংসের পাশ থেকে ভাবলেশহীন চোখে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে ছিল গণপতি। উদ্বোধনী সংগীত শেষে মঞ্চের পিছনে চুন পোড়ানো আলো জ্বালিয়ে পর্দায় প্রোজেক্টার দিয়ে নিজের তোলা নানা অদ্ভুত অদ্ভুত ফটো দেখাচ্ছে হীরালাল। খুব হালকা চালে পিয়ানো বাজছে। আমোদগেঁড়ে দর্শক সেসব ফটোগ্রাফ দেখেই বেজায় জায় হাততালি দিয়ে “বাহবা বাহবা” করছে। বেশিরভাগই কলকাতা শহরের ছবি। রাস্তাঘাট, মানুষ, সাপুড়ে, এক্কাগাড়ি, মানুষজন। তারপরেই কলকাতার বিখ্যাত সব জায়গার ছবি। মেডিক্যাল কলেজ, মনুমেন্ট, বোটানিক্যাল গার্ডেন, ওয়াজেদ আলির মিনাজারি, হাওড়া ব্রিজ, দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির (যা দেখেই দর্শকরা প্রায় সকলেই মাথায় হাত ঠেকাল), রাজভবন। এতক্ষণ বেশ নিরাসক্তভাবেই ছবি দেখছিল গণপতি। রাজভবনের ছবিটা দেখাতেই চমকে উঠল। রাজভবনের সামনের পথে একটা লোক। একটা লোক, যাকে সে চেনে। জানে সে সবার চোখের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে। খুনি মাকড়সা যেমন জালের ঠিক মাঝে বসে থাকে, আর পায়ের সামান্য নড়াচড়ায় জালের যে-কোনো প্রান্তের সামান্য কম্পন টের পায় এও সেরকম। গত চার বছর গণপতি একে দেখেনি। শুধু নানা ইঙ্গিতে বুঝেছে সে আছে। শুধু আছেই না। মাটির তলায় জমতে থাকা আগ্নেয়গিরির লাভার মতো শক্তিবৃদ্ধি করছে। হয়তো এবার চরম আঘাত হানার পালা। তাই গণপতির ডাক এসেছে।

গণপতি বুঝতে পারল হীরালাল নিজের অজান্তেই ভয়ানক একটা কাজ করে ফেলেছে। যে লোক মানুষের স্মৃতিতেও থাকতে নারাজ, সিলভার ব্রোমাইডের কাচের প্লেটে হীরালাল তার ছবি তুলে নিয়েছে। খুব সম্ভব সে এটা জানে না। জানলে…প্রবল করতালিতে ভরে উঠল প্রেক্ষাগৃহ। হীরালালের ছবি দেখানো শেষ।

এবার ঘোষক এসে ঘোষণা করলে, “হিমালয় থেকে আসল ভারতীয় জাদু শিখে আসা গণপতি এখন তাঁর অতি অপূর্ব জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করবেন।” নাম ঘোষণা মাত্র আবার করতালি। প্রতিদিন গণপতি স্টেজের পাশ থেকে প্রায় লাফিয়ে ভিতরে ঢোকে। আজ ঢুকল অতি শান্তভাবে। উইংসের পাশ থেকে। মুখমণ্ডল গম্ভীর। যেন কোনও অনাগত বিপদের প্রতীক্ষায়। গণপতির প্রবেশের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মঞ্চের পিছনে দিকে বিরাট এক কাঠের ক্যাবিনেট ঢুকিয়ে। ক্যাবিনেটের গায়ে বিচিত্র সব চিত্র। যেন একদল প্রেত মহানন্দে দেওয়া হল। নৃত্য করছে। গণপতির সেদিকে খেয়াল নেই। সে প্রথমে দর্শকদের প্রণাম করেই শুরু করল তাসের ম্যাজিক। এক হাত ভর্তি তাস মুহূর্তে অন্য হাতে চলে যাচ্ছে, হরতনের বিবিকে আকাশে ছুড়তেই রুইতনের টেক্কায় পরিণত হচ্ছে, এক বান্ডিল তাস থেকে যতই তাস ফেলা হোক, হাতের তাসের সংখ্যা কমছে না। শেষে গণপতির পায়ের কাছে তাসের পাহাড় জমে গেল। কিন্তু হাতে সেই সাতটা তাস। এমন খেলা আগে দেখেনি। যারা দেখেছে তারা আবারও মুগ্ধ।

এবার প্রিজন অ্যাক্ট বা বসুদেবের কারামুক্তি। গণপতি উইংসের ভিতরে গিয়েই বেরিয়ে এল অন্য পোশাকে। খালি গা। পরনে খাটো ধুতি। এত দ্রুত সাহেবি পোশাক থেকে এই পোশাক পরিবর্তন-ও এক ম্যাজিক বইকি! দর্শক আনন্দে হাততালি দিল। গণপতি বসুদেব সেজেছে। তার কোলে শিশু শ্রীকৃষ্ণ মঞ্চের পিছন থেকে ভেসে আসছে সেই শিশুর কান্নার আওয়াজ। হলের সবাই একসঙ্গে হরি হরি করে উঠল। ধীর পায়ে বসুদেবরূপী গণপতি কারাগারে প্রবেশ করল। তার দুই হাত, দুই পা, কোমরে দশ গাছা ভারী ভারী মোটা লোহার শেকল, হাতকড়া, লোহার বেড়ি দিয়ে বেঁধে দেওয়া হল। ফেলে দেওয়া হল পর্দা। বিবেক এসে করুণ স্বরে গাইতে লাগল, “যাও যাও বসুদেব, যাও ত্বরা গোকুলে/ এমনি নিঠুর কংস/ এখনি করিবে ধ্বংস/ পায় যদি তোমার ওই কালো ছেলে।” গান শেষ হতেই পর্দা উঠে গেল। কেউ নেই। বসুদেব নেই। কৃষ্ণ নেই। কারাগার ফাঁকা। দর্শকরা হতবাক। কোথায় গেল গণপতি?

এমন সময় চারিদিকে বেজে উঠল শঙ্খ। উলুধ্বনি। মঞ্চের একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে দর্শকদের মধ্যে দিয়ে ছেলে কোলে হেঁটে আসছেন, উনি কে? গণপতি না? চারিদিকে হাততালির শব্দ আর “হরি, হরি” আওয়াজে কান প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। অন্যদিন গণপতি এইখানে দর্শকদের সঙ্গে কিছু রহস্যালাপ করে। আজ সে সময় নেই। ইচ্ছেও নেই বোধহয়। অতি দ্রুত আবার সাহেবি পোশাকে ফিরে এসে টেবিল ওড়ানো, মড়ার খুলির মুখে সিগারেট দিয়ে সিগারেট খাওয়ানো, একটা লোহার বলকে ইচ্ছেমতো দিকে চালনা ইত্যাদি সহজ জাদুগুলো দেখিয়ে সরাসরি চলে এল সেদিনের স্পেশাল জাদুতে।

শুরু থেকে তখন অবধি একটাও শব্দ উচ্চারণ করেনি গণপতি। যারা তার নিয়মিত দর্শক তাদের কাছে এটা বেশ আশ্চর্যের। স্পেশাল অ্যাক্ট দেখাবার ঠিক আগে বুকের কাছে দুই হাত জোড় করে মঞ্চের মাঝে এসে দাঁড়াল গণপতি। পরনে সাহেবি ফ্রক কোট। বুকে খানকয়েক মেডেল। এর আগে নানা জায়গায় ম্যাজিক দেখানোর পুরস্কার। গম্ভীর গলায় কথা বলতে শুরু করল গণপতি—

“মশাইরা, আমি নেহাতই সাধারণ এক জাদুকর। ভোজবাজির খেলা দেখাই। এমন দিন গেছে যখন রাস্তায় মাদারির সঙ্গে খেলা দেখিয়েছি। বেদেদের কাছে খেলা শিখেছি। কোনও দিন ভাবিনি মঞ্চে এত মানুষের সামনে খেলা দেখানোর সুযোগ পাব। যাঁদের দয়ায় এ সুযোগ পেলাম তাঁরা আমার কাছে ভগবানের মতো। সেই ভগবান যেমন দুই হাত উপুড় করে দেন, তেমনি আবার ফিরিয়েও নেন মর্জিমতো। যে বিদ্যা তাঁরা আমায় দিয়েছেন আজ হয়তো তাঁরাই আবার সেটা ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। ভাগ্যের উপরে কার হাত আছে? তবে মঞ্চ ছেড়ে যাবার আগে আজ আমি আমার সেরা খেলাটা দেখিয়ে যাব। এ খেলার নাম ভৌতিক জাদুর গৃহ। এই যে গৃহটি দেখছেন সেখানে আমাকে বেঁধে রাখা হবে চোখ বন্ধ করে।”

গণপতি মঞ্চের মাঝে রাখা ক্যাবিনেটের সামনে গিয়ে ডালা খুলে দেয়। ক্যাবিনেটের তিনটে অংশ। দুইপাশে বেহালা, বাঁশি, তবলা, হারমোনিয়াম, সেতার ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ঝোলানো। মধ্যিখানে বসানো দুটো কাঠের চেয়ার।

“আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন এই ক্যাবিনেট খালি। পিছনে কাঠের দেওয়াল। কেউ ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না। আপনারা এসে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ফলে ঢোকার বা বেরোবার একমাত্র উপায় আপনাদের চোখের সামনে দিয়ে। এর মধ্যে একটা চেয়ারে বসব আমি। আমার হাতে প্রথমে হাতকড়া পরিয়ে দেবেন দর্শকদের মধ্যেই কেউ। তারপর অন্য একজন এসে এই চেয়ারের পিছনে দড়ি দিয়ে আমার হাতদুটো বেঁধে দেবেন। অন্যজন চেয়ারের পায়ার সঙ্গে বেঁধে দেবেন পা। চতুর্থজনের কাজ সবচেয়ে কঠিন। তিনি আমার চোখ আর মুখ একখণ্ড কাপড়ে বেঁধে গোটা দেহ এই চেয়ারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেবেন। দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। আমার সামনের এই চেয়ারে আমি আমার গুরুদেবের প্রেতাত্মাকে আহবান করব। তিনি আসবেন। তিনি যে এসেছেন তাঁর সংকেত আপনারা পাবেন এই বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে। তিনি এই প্রতিটি বাদ্যযন্ত্র নিজে বাজাবেন। তারপর বিদায় নেবেন। তিনি বিদায় নিলে সামনের চেয়ারে রাখা ঘণ্টা বেজে উঠবে। তখন দর্শকদের কেউ ভিতরে এসে আমায় উদ্ধার করবেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও পরীক্ষা করে দেখতে পারবেন এই বন্ধন সব অটুট আছে কি না। তবে একটাই অনুরোধ। আমার গুরুদেব বড়ো সিদ্ধপুরুষ ছিলেন। বাজে লোকেদের সংস্পর্শ পছন্দ করতেন না বিশেষ। আপনারা এই গোটা অ্যাক্টোতে কেউ কোনও শব্দ করবেন না। এমনকি নিঃশ্বাসও জোরে ফেলবেন না। বাবার আত্মার কষ্ট হবে।”

আবার গমগম করে ড্রাম বেজে উঠল। গোটা ঘরে শ্মশানের নীরবতা। গণপতি চেয়ারে গিয়ে বসল। দর্শকদের থেকে চারজন উঠে গিয়ে তার হাত,পা, চোখ, দেহ বেঁধে দিল। এত আঁট করে যে, গণপতির নড়াচড়া তো দূরে থাক, শ্বাস নেওয়াই দুষ্কর। এরপর দুই সহকারী এসে কাঠের ক্যাবিনেটের ডালা বন্ধ করে দিল। ড্রামের আওয়াজও বন্ধ। একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে। আচমকা মনে হল কাঠের ক্যাবিনেটটা যেন নড়ে উঠল। তারপরেই ধাঁই ধপাধপ বেজে উঠল তবলা। ব্যাপারটা এতই আকস্মিক, দর্শকদের অনেকেই চিৎকার করে উঠল ভয়ে। তারপর যা হল তা আর কহতব্য নয়। একইসঙ্গে বাজতে লাগল বাঁশি, হারমোনিয়াম আর সেতার। করুণ সুরে বাজছে বেহালা। কেউ যেন পাগল হয়ে গিয়ে এক রসাতলের সুরে বাঁধতে চাইছে গোটা জগৎসংসারকে। মহিলাদের অনেকে ভয়ে রামনাম শুরু করলেন। কেউ কেউ কান চেপে ধরে রাখলেন এই নারকীয় সংগীত শুনবেন না বলে। মায়ের কোলের শিশুরা কেঁদে উঠল। আওয়াজ চলছেই। আর সঙ্গে সঙ্গে দুলে দুলে উঠছে সেগুন কাঠের ভারী ক্যাবিনেট। যেন হালকা শোলার খেলনা। খানিক বাদেই দর্শকদের থেকে ভয়াল চিৎকার শুরু হল, “বন্ধ করো। বন্ধ করো।” কেউ কেউ উঠে পালাবার উপক্রম করলে। এমন সময় ঘণ্টার আওয়াজ। সব স্তব্ধ। আবার আগের মতো। যেন এতক্ষণ ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন চলছিল গোটা মঞ্চে।

সহকারীরা এসে দুইদিকের দুটো পাল্লা খুলে দিল। বাদ্যযন্ত্ররা একেবারে আগের জায়গায়। যেন কুটোটিও তাদের স্পর্শ করেনি। শুধু মাঝের পাল্লাটি বন্ধ। এবার সহকারীদের একজন অনুরোধ করল দর্শকদের মধ্যে থেকে কাউকে উঠে এসে পরীক্ষা করে দেখতে যে বাঁধন সব ঠিক আছে কি না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কেউ কিছু বোঝার আগেই দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন মঞ্চে উঠে সহকারীকে প্রায় ঠেলে পাশের দরজা দিয়ে ক্যাবিনেটের মধ্যে ঢুকে গেল।

মাঝের দরজা বন্ধ। ড্রিম ড্রিম করে আবার ড্রাম বাজা শুরু হয়েছে। সহকারীরাও বুঝতে পারছে না করবে। এমন অবস্থায় কী করতে হবে সে নির্দেশ তাদের দেওয়া নেই।

এক মিনিট। দুই মিনিট। পাঁচ মিনিট বাদে দুই সহকারী দুই দিক থেকে খুলে দিল মাঝের ক্যাবিনেট। এ যেন সেই আগের ম্যাজিকেরই পুনরাবৃত্তি। একগাদা দড়িদড়া পড়ে আছে। হ্যান্ডকাফ গড়াগড়ি খাচ্ছে। ভিতরে গণপতি নেই। শুধু গণপতি না, যে লোকটি এইমাত্র ঢুকল সেও ভ্যানিশ।

সব দর্শকের দৃষ্টি গেল দরজার দিকে। এই বুঝি আগের মতো দরজা দিয়ে ঢুকবে গণপতি। তারা জানত না, ম্যাজিশিয়ান এক ম্যাজিক দুইবার দেখায় না।

“সর্বসমক্ষে গণপতি অন্তর্হিত হইলেন।”

.

২।

লালবাজারে প্রিয়নাথের কামরার আলোটা আজকেও জ্বলছে। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে। প্রিয়নাথের সামনের চেয়ারে গণপতি বসা। তার মুখের হতভম্ব ভাব কাটেনি এখনও। অনেক সময় জাদুকরকেও যে কেউ ভ্যানিশ করে দিতে পারে, তা তার দূরাগত কল্পনাতেও ছিল না। জাদুশেষের পর ঘণ্টা বাজতেই গণপতি আবার ঠিক আগের মতো নিজেকে বেঁধে ফেলেছিল। এই বন্ধন খোলা- বন্ধ করা তার কাছে ছেলেখেলার মতো। যেটা কষ্টকর সেটা হল একসঙ্গে এতগুলো বাদ্যযন্ত্র বাজানো। তাও এমন ছোটো জায়গায়। কিন্তু ঠিকঠাক করতে পারলে ফল হয় মারাত্মক। দর্শকদের চিৎকার, ভয়ার্ত আর্তনাদের আওয়াজ মোটা কাঠের পাল্লা ভেদ গণপতির কানে গেছে। এত কষ্টের মধ্যেও গণপতির মন ভরে গেছে। অন্তত তার শেষ খেলায় সে মানুষের মন জয় করতে পেরেছে। এবার দর্শকদের থেকে মধ্যে থেকে একজন উঠে এসে তার বন্ধন পরীক্ষা করে জানাবেন সব ঠিক আছে। তারপরেই গণপতির দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। খুললে দেখা যাবে সে বন্ধনমুক্ত। আবার দরজা বন্ধ হবে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে দেখা যাবে কেউ নেই। গণপতি বিদায় নেবে।

কিন্তু এই শেষটাই অন্যরকম হয়ে গেল। দর্শকদের থেকে একজন উঠে এল। তারপর নিয়মমাফিক মাঝের দরজা দিয়ে না ঢুকে পাশের দরজা দিয়ে এসে সোজা বসে পড়ল গণপতির সামনে। চোখ বন্ধ থাকলেও সব বুঝতে পারছিল গণপতি। কিন্তু সে কিছু করার আগেই তার বাড়ানো দুই হাতের হাতকড়ার ঠিক ওপরে ক্লিক করে পরিয়ে দিল আরও একজোড়া হাতকড়া। নিজের হাতে এই কড়াকে আজ অবধি অনুভব করেনি গণপতি। কিন্তু হাত সামান্য নাড়তেই সভয়ে টের পেল এটা কী জিনিস। ম্যাজিক সার্কেলে এই হাতকড়াকে এখনও জব্দ করতে পারেনি কেউ। শোনা গেছে হুডিনিও নাকি পরাস্ত হয়েছিলেন। এ জিনিস ইংরেজদের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসন না। খাঁটি ফরাসি। নাম পুসে। যত হাত নাড়ানো হয় কড়ার লোহা হাতের মাংস কেটে বসে যেতে থাকে। এই হাতকড়া তো একমাত্র পুলিশের কাছে থাকাই সম্ভব! তবে কি?

এই গোটা চিন্তাটা গণপতির মাথায় আসতে কয়েক সেকেন্ড মাত্র লাগল। তারপরেও যা সন্দেহ ছিল দূর হল আগন্তুকের কণ্ঠস্বরে। “তোমার কাছে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে জাদুকর গণপতি। যা যা জানো সত্যি করে বলবে, না চার বছর আগে সেই চিনাপাড়ায় যেমন মিথ্যে কথা বলে চোখে ধুলো দিয়েছিলে, তেমন দেবে?”

গলার স্বরেই গণপতি প্রিয়নাথকে চিনতে পেরেছিল, চিনাপাড়ার উল্লেখে সেই সন্দেহও রইল না। সে উত্তর দিল না। চুপ করে বসে রইল। বাইরে ড্রামের শব্দ বাড়ছে।

প্রিয়নাথই আবার কথা বলা শুরু করল, “শৈলকে কাল কেউ খুন করে তারিণীর দেশের বাড়ি ফেলে এসেছে। বীভৎস খুন। তারিণীকেও খুন করার চেষ্টায় ছিল। কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান এসেছে।”

এইটুকু বলে প্রিয়নাথ অপেক্ষা করল গণপতি কী বলে তা দেখার জন্য। গণপতি সেই চোখ বাঁধা অবস্থাতেই একটু চমকে উঠল।

“আমার কথা আপনাকে কে বলল?”

“তারিণী। জ্ঞান ফেরার পর শুধু তিন-চারটে কথাই বলতে পেরেছে। তার মধ্যেও বারবার বলছিল, গণপতিকে বাঁচান। ওরা এবার ওকে মারবে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম আজকেই তোমার শেষ শো। আর তারপর তুমি হয়তো গায়েব হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে এখানেই তোমায় ধরলাম।”

বাইরে ড্রামের শব্দ বাড়ছে। অস্থির দর্শকদের কেউ কেউ বলছে দরজা খুলতে। সহকারীরা খুলছে না। তারা জানে দরজা খোলার কথা গণপতির নিজের। ম্যাজিকে একটু এদিক ওদিক হলে প্রাণসংশয় অবধি হতে পারে।

“আমাকে কী করতে হবে?”

“দুটো পথ তোমার কাছে খোলা। এক, আমি সবার সামনে দিয়ে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে তোমাকে টানতে টানতে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তুলব। তাতে যা বদনাম হবে, তার জেরে তোমার জাদু দেখানো চিরকালের মতো শেষ হয়ে যাবে। অথবা…”

“অথবা?”

“আমি জানি প্রতি জাদুকর পালানোর জন্য একটা গোপন পথ খোলা রাখে। এই বাক্সতেও নির্ঘাত তেমন আছে। আমরা দুইজন সেই পথে পালিয়ে সোজা লালবাজার যাব। সাইগারসন সাহেবও সেখানেই অপেক্ষা করছেন। এবার বলো তুমি রাজি কি না।”

“কিন্তু আমার ম্যাজিক?”

“তুমি যা ঘোষণা করেছিলে তাই তো হচ্ছে। সকলের সামনে থেকে তুমি অদৃশ্য হয়ে যাবে।”

দর্শকদের আওয়াজ বেড়েই চলছে। সবাই বলছে দরজার পাল্লা খুলে দিতে। এখুনি হয়তো দরজা খোলা হবে।

“এই মেঝেটা আলগা। ফলস স্টেজ। ঠেলে সরিয়ে দিলেই আমরা নিচের একটা গুপ্তঘরে গিয়ে পড়ব। এমনভাবেই স্টেজ বানানো। সেই তৈমুরের মতো।”

“বুঝে গেছি।” বলে এক ধাক্কায় মেঝেটা সরিয়ে প্রিয়নাথই বলল, “এসো তবে।”

.

৩।

সামনে রাখা জলের গেলাস থেকে এক ঢোক জল খেয়ে গণপতি বলা শুরু করল।

“আমায় ক্ষমা করুন। আমি বুঝতে পারিনি। আমি শুধু আদেশ পালন করেছিলাম। আমাকে ওটাই করতে হবে। কিছু জানা যাবে না, কিছু জিজ্ঞাসা করা যাবে না। শুধু আদেশ পালন। বুঝতে পারিনি সেটা করতে গিয়ে আমার খুব কাছের দুই বন্ধুর প্রাণসংশয় হবে।”

গণপতির কথাগুলো সাইগারসনকে সংক্ষেপে ইংরাজিতে বুঝিয়ে বলছিল প্রিয়নাথ। সাইগারসন বললেন, “শুরু থেকে বলতে বলো।”

প্রিয়নাথ সেটা বলতেই গণপতি বলল, “হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন…. শুরু থেকে। জানেন তো অর্ধেক সত্য মিথ্যার চেয়ে ভয়ানক। চার বছর আগে সেই শীতের রাতে চিনাপাড়ায় আমি আপনাকে মিথ্যে কথা বলিনি। যা বলেছি, তা অর্ধেক সত্য। আর সেটাই তদন্তকে ভুল পথে চালানোর জন্য দরকার ছিল। আমাকে আমি বড়ো তেমনই আদেশ দেওয়া হয়েছিল। যেমন  আপনাকে বলেছিলাম, বাড়ির ছেলে, বাড়ি থেকে পালিয়েছিলাম, সব সত্যি। পালিয়ে হরিদ্বারের কাছে এক বেদের শিষ্য হই। তাঁর নাম পিন্ডারী বাবা। আমার আগে তাঁর আরও এক চ্যালা ছিল। তার আসল নাম কেউ জানে না। সবাই তাকে লখন বলে ডাকে।”

এটা শুনেই প্রিয়নাথ চমকে উঠল একটু। সাইগারসনকে জানাতে তিনি মুখে কিছু না বললেও বোঝা গেল তিনিও আগ্রহী হয়েছেন। নিজের চেয়ারে একটু এগিয়ে বসলেন তিনিও। মুখে কোনও কথা নেই। নিষ্পলক দৃষ্টি সোজা গণপতির দিকে। প্রিয়নাথ জানে তার মতো সাইগারসনও ডালান্ডা হাউসের লখনকে ভোলেননি।

“তারপর?”

“আমি যখন প্রথম দেখি, লখনের বয়স কুড়ির নিচে। পিন্ডারী বাবার চেলা হলেও দারুণ ইংরাজি আর হিন্দি বলতে পারত। মিশত ফিরিঙ্গি ছেলেদের সঙ্গে। এমনকি আমার মনে হত পিন্ডারী বাবাও ওকে সমঝে চলতেন। একদিন পিন্ডারী বাবা আমায় বলেন আমাকে হাতকড়া থেকে মুক্ত হওয়া শেখাবেন। কিন্তু কিছুতেই হাতকড়া খোলা গেল না। লখন খুলে দিল… সেই রাতেই ওরা পিন্ডারী বাবাকে খুন করল।”

“ওরা কারা?”

“লখন আর ওর দলবল। আমাকে রাতে কিছু খাইয়ে দিয়েছিল। সকালে উঠে দেখি ঘাটে পিন্ডারী বাবাকে ঘাটে চিরে ফেলে রেখেছে। পাশে আমি শুয়ে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওরা বলল পুলিশ নাকি আমাকে খুনের জন্য ধরবে। লখন সেই রাতে ডেরায় ছিল না। ওর বন্ধুরা সাক্ষী দেবে। বাঁচার উপায় একটাই। ওদের কথামতো চলা।”

“তোমাকে ওরা ওদের দলে নিয়েছিল?”

“কোনও দিনও না। ওরা সবাইকে দলে নেয় না। আমাকে শুধু ভয় দেখিয়ে কাজ করাত। নানা জায়গায় ঘুরিয়েছে ওরা। হৃষীকেশ, কাশী, দিল্লি, মথুরা, লখনউ। সব জায়গায় আমার একটাই কাজ ছিল। আমি গেরুয়া বসন পরে সাধু সেজে বসতাম। নাম ছিল “বাবা বাঙ্গালি”। তাঁবু ফেলে জাদু দেখাতাম আর ওষুধ বেচতাম। যেখানেই যেতাম লখন আমায় চোখে চোখে রাখত। তবে পিন্ডারী বাবার ঘটনার পর আমিও ওকে ভয় পেতাম।”  

“পিন্ডারী বাবাকে খুন করল কেন?”

“কারণ আজও জানি না। তবে আমাকে বলেছিল বাবা নাকি বাচ্চা ছেলেদের জাদু শেখানোর নামে হাত বেঁধে ভোগ করত। লখন আগে বাবাকে মানা করেছে। ও এসব পছন্দ করত না। বাবা বলেওছিল আর করবে না। তবু আমার সঙ্গে ওইসব চেষ্টা করায় ও বাবাকে মেরে ফ্যালে। বলে ওর দলে নাকি নিয়ম ভাঙলে শাস্তি একটাই। মৃত্যু।”

“ওর দলে আর কে কে ছিল?”

“তা আমার জানা নেই। তবে বেশিরভাগই ফিরিঙ্গি। কখনও একজনকে বেশিদিন দেখিনি। হাবেভাবে যতটুকু মনে হত, ও লোক জোগাড় করছে।”

“কীসের জন্য?”

“জানা নেই। তবে এটা জানি ওর উপরেও কেউ ছিল।”

“কে সে?”

“নাম জানি না। ওদের কথাবার্তায় বুঝতাম। ওরা ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বলে ডাকত। এই গ্র্যান্ডমাস্টারকে ওরা ভগবানের মতো ভক্তি করত।”

“তোমার কাজ কী ছিল?”  

“ইংরেজ রাজত্বে সবাইকে সন্দেহ করা হয়। শুধু গেরুয়াধারীরা ছাড় পায়। আমি জাতে ব্রাহ্মণ। ত্রিসন্ধ্যা আহ্নিক করি। ধরা পড়লেও গড়গড়িয়ে মন্ত্র বলে যেতে পারব। তাই হয়তো আমায় দরকার ছিল। আর সাধুরা যখন খুশি, যেখানে খুশি ঘুরেও বেড়াতে পারে।”

“এভাবে চলল কতদিন?”

“বেশ কয়েক বছর। তারপর একবার, আমরা তখন বোম্বেতে। একদিন লখন উত্তেজিত হয়ে আমার কাছে এল। বলল আমাদের আর ঘুরে বেড়াতে হবে না। এতদিনের কষ্ট ফল দিয়েছে। আমি বললাম, কী হয়েছে? ও বলল, এতদিনে ভূতের সন্ধান পাওয়া গেছে। আমাদের এবার কলকাতা ফিরতে হবে। গ্র্যান্ডমাস্টার আদেশ দিয়েছেন। বললাম, ভূত কী করে? উত্তর দিল, মাথায় ভর করে মাথা চিবিয়ে। আর কিছু বলেনি।”

“সেটা কত সাল?”

“১৮৮৯ কি ৯০ হবে।”

“হিলি নামে কাউকে চেনো?”

চমকে উঠল গণপতি, “হ্যাঁ। এই হিলির থেকেই নাকি ভূতের সন্ধান পাওয়া গেছে। আপনি হিলিকে চেনেন?”

“চিনতাম। সামান্য। তুমি বলতে থাকো। তারপর কী হল?”

“তারপর আমরা কলকাতায় চলে এলাম। কলকাতায় এসে লখন বলল এবার আমার মুক্তি। লখন নিজে কলকাতায় ম্যাসনারিতে যোগ দিল। আমি দিলাম উইজার্ড ক্লাবে। ক্লাবের সন্ধান আমাকে লখনই দিয়েছিল। আমারও স্বপ্ন ছিল জাদুকর হব। ভাবলাম এতদিনে সেই স্বপ্ন সফল হল। কিন্তু লখন আমাকে দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল। আবার যবে ডাক আসবে, সব ছেড়েছুড়ে আবার রাস্তায় বেরোতে হবে। না হলে আমার অবস্থা পিন্ডারী বাবার মতো করে ছাড়বে।”

“তারিণীর সঙ্গে আলাপ হল কীভাবে?”

“আপনি মনে করে দেখুন, আপনাকে সেই প্রথম দিনই বলেছিলাম দর্জিপাড়ায় রামানন্দ পালের বাড়ি ‘নাট্যসমাজ’ নামে এক নাট্যচর্চার কেন্দ্র ছিল। সেখানে আমি জাদুকরের ভূমিকায় অভিনয় করতাম। সেই নাটক লিখত শৈল। শৈলচরণ সান্যাল। আগে বামুন ছিল। বাবা তাড়িয়ে দিল। ছেলে নাকি মেয়েলি। চুঁচুড়ায় অক্ষয় সরকারের দল থেকেও তাড়িয়ে দিল। তারপর ন্যাশনাল থিয়েটারের সেই ঘটনা। রেগে গিয়ে শৈল খ্রিস্টান হয়ে গেল।”  

“শৈলচরণ খ্রিস্টান?” নিজের অজান্তেই প্রিয়নাথ প্রায় চিৎকার করে বলে উঠল।

“হ্যাঁ। ওর পুরো নাম ডেভিড শৈলচরণ সান্যাল।”

“কিন্তু সে নাম তো ও ব্যবহার করত না।”

“দরকারে করত। বাঙালি হিন্দুদের কাছে বামুনের ছেলের পরিচয়ই দিত। আবার ম্যাসনারিতে গিয়ে নিজের নাম বলত ডেভিড। আমায় তারিণী নিজে বলেছে।”

“ওর সূত্রেই তোমার সঙ্গে তারিণীর আলাপ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ। তবে তারিণী ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসত। বিশেষ করে ন্যাশনাল থিয়েটারে ওর সঙ্গে ঘটনাটা ঘটার পর।”

“কী ঘটেছিল?”

“শৈল একটু মেয়েলি। সেই সুযোগে ন্যাশনালের কিছু পুরুষ অভিনেতা ওকে ধর্ষণ করে। শৈলই আমায় বলেছে। প্রায় পাঁচ-ছয় বছর আগের কথা।”

“সে কী? পুলিশে জানানো হয়নি?”

“পুলিশ নাকি সব জেনেশুনেও চুপ করে যায়। আসলে ন্যাশনালের প্রচুর পয়সা। ওরা বলে সেদিন নাকি ওই অভিনেতারা আসেইনি। তবে তারা শাস্তি পেয়েছিল।”

“কীভাবে?”

“বছরখানেকের মধ্যে সবাই অপঘাতে মারা পড়ে। এটাও শৈলর মুখেই শুনেছিলাম।”

“শৈলকে কি তারিণীই প্রথম ম্যাসনারিতে নিয়ে যায়?”

“সেটা সঠিক আমিও বলতে পারব না। হতে পারে। নাও পারে। হয়তো ও নিজেই গেছিল। কিন্তু ওর কিছু একটা উদ্দেশ্য ছিল। এটা তারিণী বারবার ওদের পাল্লায় পড়ে।” আমা বলেছে। এই ম্যাসনারিতেই শৈল ওদের পাল্লায় পড়েছিল।”

“ওদের মানে?”

“দেখুন স্যার, আমি ম্যাসনারির সদস্য না। জানিও না ওখানে কী হয়। তারিণী সদস্য হলেও খুব বেশি জড়িয়ে থাকে না। নিজের পেটের তাগিদে ঘুরে বেড়ায়। শৈল তা না। ম্যাসনারিতে বেশ কিছু বন্ধু জোটে ওর। যারা মোটেই খুব একটা ভালো না। আর তাদের নেতা ছিল লখন।”

“সেটা কীভাবে বুঝলে?”

“একদিন ও আমার কাছে বার্তা নিয়ে এল।”

“কী বার্তা?”

এতক্ষণে গণপতি একটু উশখুশ করতে লাগল।

“কী বার্তা?”

“কলকাতায় ফিরে আসার পরে আমি আর লখনকে কোনও দিন দেখিনি। ভেবেছিলাম দুঃস্বপ্নের মতো ঝেড়ে ফেলতে পেরেছি। চার বছর আগে একদিন শৈল নিজে উইজার্ড ক্লাবে এসে জানাল ডাক এসেছে। লখনের। আমি প্রথমে বিশ্বাস করিনি। পরে ও আমাকে গোপন নামটা বলল। এটা ওর জানার কথাই না। আমি বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম।”

“কী নাম?”

“নীবারসপ্তক। আমারই দেওয়া নাম।”

“মানে কী এর?”

“ম্যাসনদের সদস্য না হলেও লখনের মুখে ম্যাসনদের অনেক কথা শুনেছি। আমাকে ও বলেছে সদস্য হতে। হইনি। বামুনের ছেলে হয়ে ওইসব সংঘে যেতে মন চায়নি। তবে ওদের নিয়ে জানি কিছু কিছু। প্রাচীনকালে তাদের নাকি এক দেবতা ছিলেন। নাম জাবুলন। এই জাবুলনের প্রথম তিন অক্ষর JAH, মানে স্বর্গ। ইংরাজি বর্ণমালার অবস্থান অনুযায়ী এদের যোগ করুন, হবে ১০+১+৫। মানে ১৬। আবার ৬+১ হয় ৭। তাই সাত সংখ্যাটা ম্যাসনদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র। প্রাচীন হিব্রুতে বুলো বা বুলন মানে উড়ি ধান, বুনো ধান। আমাদের হুগলীতে অমন বুনো ধানকে বলে নীবার। তাই একদিন ঠাট্টা করেই বলেছিলাম, তোমাদের দেবতার বাংলা

নামও হয়। সপ্তনীবার বা নীবারসপ্তক। নামটা শুনে লখন গম্ভীর হয়ে যায়। খানিক ভেবে বলে, ভালো ভেবেছ। কিন্তু আর কাউকে বোলো না। তাই শৈলর মুখে ওই নাম শুনে আমি চমকে গেছিলাম।”

“লখন নিজে তোমার সঙ্গে দেখা করে?”

“হ্যাঁ।”

“কোথায়?”

“সোনাগাছি। জানেনই তো ওই পাড়ায় আমার অল্প যাতায়াত আছে। ওখানেই লক্ষ্মীমতির বাড়ি।”

“তুমি ওখানে যাও সেটা লখন জানল কেমন করে?”

“ও সব জানে। এই যে আমায় ধরে নিয়ে এলেন, সে খবর এতক্ষণে ওর কাছে পৌঁছে গেছে। আমার দুই বন্ধুকে মেরেছে। আমাকেও আর রাখবে না। তাই যা জানি সব উগরে দিচ্ছি।”

“সোনাগাছিতে নিয়ে গিয়ে লখন কী বলল?”

“তখন শীতকাল। ঘরে লখন ছাড়াও একটা মেয়ে ছিল। লখন বলল এর নাম নাকি ময়না। ওর সামনেই কথা হল। ময়না নাকি ওর দিদি। সত্যি মিথ্যে জানি না। ও আমায় বলল, আগামী হপ্তায় ১২ ডিসেম্বর সন্ধে থেকে চিনেপাড়ায় উপস্থিত থাকতে। চিনা মন্দিরটার থেকে একটু দূরে একটা ছ্যাকড়াগাড়ি এসে দাঁড়াবে। সেখান থেকে একটা মড়া নামিয়ে দেওয়া হবে। আমার কাজ হবে সেটাকে শুইয়ে দিয়ে অপেক্ষা করা। কেউ না কেউ খুঁজে পাবেই। তখন পুলিশকে যেন আমিই খবর দিই। আর একজন বাঙালিকে পেলে পুলিশ চিনাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। আর তখনই…..”

“তখনই কী?”

“তখনই পুলিশকে চিনা চিহ্ন ইত্যাদি বলে বিভ্রান্ত করে দিতে হবে।”

“কিন্তু তুমিই কেন?”

“আজ্ঞে আমিও সেটাই জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলেছিল পুলিশ নাকি এখনও বড়ো ঘরের ব্রাহ্মণদের সত্যবাদী মনে করে।”

“তারপর আর দেখেছ লখনকে?”

“লখনকে আর একদিনই দেখেছিলাম। এক ঝলক। সেই কার্টারের ম্যাজিক শো-র দিন। কাউকে বলিনি। কিন্তু ও আমায় ভোলেনি। কিছুদিন আগেই তারিণীর হাত দিয়ে শৈল এক বিজ্ঞাপন পাঠায়। সেখানে স্পষ্ট গোপন সংকেতের উল্লেখ আছে। আমায় আবার ডেকেছে।”

“কোথায়?”

“নিচে মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের একটা ঠিকানা আছে। ওখানেই।”

“কবে? কখন?”

টেবিলে পড়ে থাকা বিজ্ঞাপনটা হাতে নিয়ে গণপতি বলল, “এই বিজ্ঞাপন সবার জন্য না। যারা বুঝবে তাদের জন্য। অন্যদের কাছে নেহাত বিজ্ঞাপন। এই দেখুন কী লেখা, সন্ধ্যায় দুই স্তনে তিনবার করিয়া পাঁচদিন মাত্র, মানে সন্ধে ছটায়, পাঁচদিন পরে।”

“তাহলে কবে দাঁড়ায়?”

“আজ সন্ধে ছটা। আমি যাইনি। ঠিক করেছিলাম শেষ শো করে পালাব। তাও ওদের খপ্পরে আর না। অনেক হয়েছে। আবার আমাকে দিয়ে কোনও পাপকাজ করাত। আপনিই আমায় পালাতে দিলেন না।” কাষ্ঠহাসি হেসে বলল গণপতি।

“শৈল আর তারিণীকে মারার কারণ জানো?”

“ওদের দলের একটা খুব কঠিন নিয়ম আছে। দলের কেউ বেইমানি করলে তাকে মরতেই হবে। সে যে-ই হোক। শৈল গোপন কিছু জেনে ফেলেছিল। হয়তো ওরা ভয় পাচ্ছিল ও বলে দেবে। কিংবা কাউকে বলে দিয়েছিল। তাই ওকে মরতে হল। তবে তারিণীকে কেন মারল বুঝতে পারছি না। অবশ্য যা শুনলাম, খুন করেনি। ডান্ডার বাড়ি মেরেছে। ওরা খুন করতে চাইলে খুনই করে। আধমরা করে রাখে না। হয়তো তারিণীর আপিসে কিছু খুঁজতে এসেছিল। তারিণী এসে পড়ায় কাজের বাধা ঘটে…..

পাশ থেকে গলা খাঁকরানোর আওয়াজ পেতেই প্রিয়নাথ খেয়াল করল, আলোচনার অনেকটাই সাইগারসনকে ইংরাজিতে বলা হয়নি। লজ্জিতভাবে গোটাটা বলতেই সাইগারসন আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। তাঁর চিবুক বুকের কাছে। দুই ভুরু প্রায় জোড়া। অনেক পরে ধীরে ধীরে সাইগারসন বললেন, “তার মানে চার বছর আগে পলের হত্যা নেহাত দুর্ঘটনা না, যেমনটা আমরা ভেবেছিলাম। এক সপ্তাহ আগেই পরিকল্পনা করা ছিল, কবে, কখন, কীভাবে খুন করা হবে। কার্টার স্টেটসম্যানে চিঠি লিখে যা জানাবে বলেছিল সেটা কি তবে আরও ভয়ানক কিছু? বড়োলাটই বা সেদিন আমাদের ও কথা বললেন কেন? উনিও বিভ্রান্ত করতে চাইলেন? দুটো কারণ হতে পারে। এক, বড়োলাট নিজেও এই খুনের সঙ্গে যুক্ত। আর যদি সেটা না হয় প্রিয়নাথ, দ্বিতীয় যে কারণটা খোলা থাকতে পারে সেটা ভাবতেও পারছি না। যে করেই হোক, গণপতি আর তারিণীকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। জাবুলন শত্রুর শেষ রাখে না। আমার কাছে এসেছিল বলেই হয়তো শৈলকে মরতে হল। খেলা যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে হাজার গুণ ভয়ংকর। যা ভাবছি তা যদি সত্যি হয়, অফিসার তবে চার বছর আগে খেলা শেষ হয়নি। সবে শুরু হয়েছিল। এতদিনে আমি শেষটা আন্দাজ করতে পারছি। ওফফ! কী ভয়ানক!”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *