পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

পঞ্চম পর্ব- জনবিরল গভীর বাতাস

পঞ্চম পর্ব- জনবিরল গভীর বাতাস

বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর পেরিয়ে গেল অপর্ণার। উর্ণাদের সঙ্গে থানায় গেছিল। ভেবেছিল আরও খানিক থাকবে। কিন্তু কাল প্রায় সারারাত জাগা। সকাল থেকে তেমনভাবে কিছু খাওয়া হয়নি। পেট গুলিয়ে বমি শুরু হল। ঊর্ণা আর তার মা মিলে একরকম জোর করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিল তাকে। সুতনু ওকে পৌঁছে দিয়ে নিজে অফিস চলে গেছে। সল্টলেকের এই গোটা ফ্ল্যাটে এই মুহূর্তে অপর্ণা একা। নিশীথ দত্তকে পুলিশ ধরেছে। তাও আবার যে সে পুলিশ না, অমিতাভ মুখার্জি। আজ থানায় গিয়ে ভেবেছিল অমিতাভর দেখা পাবে। পায়নি। একবার কল করে নেবে? চেনা নম্বরটা ডায়াল করল অপর্ণা। ফোন বেজে চলেছে। যে নিশীথ দত্তের জন্য ফোন করা, সেই লোকটা দুঃখ ছাড়া কিছু এনে দেয়নি তার পরিবারে। মা তাদের ছেড়ে চলে গেছেন। বাবা কিচ্ছুটি করতে পারেননি। তারপরেও যখন নীবারের দরকার হয়েছে, তার বাবাকে ব্যবহার করেছে। কলকাতা ছেড়ে চন্দননগরে প্রতি মাসে বাবাকে যেতে হত নীবারের সভায়। মেনে চলতে হত নিশীথ দত্তের প্রতিটা নির্দেশ। এককালে বাবাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করত। প্রতিবাদ করত। একসময় বুঝে গেছিল এসবে লাভ হবে না। নীবারের সূত্রেই দেবাশিসের সঙ্গে আলাপ। প্রথমে ভেবেছিল এতদিনে সুখের দিন শুরু হল। কিন্তু….

বাজতে বাজতে কেটে যাবার ঠিক আগে ফোনটা ধরল অমিতাভ।

“বলুন বউদি।”

অমিতাভ এখনও তাকে দেবাশিসের বউ বলেই ভাবে।

“আমি নিশীথ দত্তদের বাড়ি গেছিলাম। আমাকে মা ফোন করেছিল। সব শুনলাম।” ওদিকে চুপ।

“আমি শিওর নিশীথ দত্ত খুন করতে পারে না। ওর সেই গাটস নেই। ও অন্যের বউ ভাগাতে পারে। কিন্তু খুন ওকে দিয়ে হবে না।”

“কিন্তু ফুটেজ?”

“আমি ফুটেজের কথা শুনলাম। কিন্তু বাড়ির পিছনেও তো একটা দরজা ছিল। আমি শেষবার যখন গেলাম, দেখি বাথরুম রিনোভেট হচ্ছে। কী হচ্ছিল জানি না। তুমি প্লিজ ওদিকটা আর-একবার দ্যাখো। দেবাশিস শক্তসমর্থ লোক ছিল। ওকে কাবু করা নিশীথ দত্তের কাজ না।”

“হুমম। আপনি এটা আর কাউকে বলেছেন?”

“নাহ, তোমাকেই বললাম। আর ও হ্যাঁ, ওই তুর্বসু নামের ছেলেটাকে বলেছি।”

“ও.কে…”

খানিকক্ষণ দুই পক্ষই চুপ। প্রথম কথা বলল অপর্ণাই।

“কী বুঝছ অমিতাভ? চেনা কেউ?”

“সেটার সম্ভাবনাই বেশি। নীবারের কাজের জন্য দেবাশিসদা অনেক ভুলভাল জায়গায় ঘুরতেন। ঠিক কী করতেন জানি না। জানার চেষ্টা করছি।”

“তুর্বসুকে তোমার কেমন মনে হয়?”

“বুঝতে পারছি না। ছেলেটা হয় একেবারে বোকা, নয় চরম সেয়ানা।”

“আমার তো ভালো বলেই মনে হল। মানে আপাতদৃষ্টিতে।”

“শুনুন বউদি, আমার ধারণা দেবাশিসদার খুনিকে ও সামহাউ চেনে। এটা আমার বিশ্বাস। মে বি বুঝতে পারছে না। সেইজন্যেই আমি ওকে সব জায়গায় নিয়ে ঘোরাচ্ছি। দেবাশিসদা প্রচণ্ড বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। খুব ভেবেচিন্তেই উনি ‘তুর্বসু জানে’ লিখে গেছেন। ভেবে দেখুন বউদি, প্র্যাকটিক্যালি ওটাই ওঁর শেষ কথা।”

“আমি ইনসিস্ট করছি না, কিন্তু বাই এনিচান্স তুর্বসু কি……”

“খুনি কি না? আমি কোনও চান্সই ছেড়ে দিচ্ছি না, তবে গাঁট ফিলিং বলছে হবে না।”

“নিশীথ দত্তের বেলায় আমার সেম ফিলিং হচ্ছে। আর যদি সেটাই হয়, তবে…” অপর্ণা চুপ করে গেল। “হ্যাঁ। সেই আননোন ফ্যাক্টর। এক্স। যাকে কেউ দেখেনি, যাকে কেউ চেনে না, শুধু নাম শুনেছে। তাও ছদ্মনাম।”

“বাসু। বাসুকী”, বলতে গিয়ে অজান্তেই গলাটা যেন কেঁপে গেল অপর্ণার।

“হ্যাঁ। খুব সম্ভব দেবাশিসদার হেঞ্চম্যান। আপনি বলায় একটা নতুন পয়েন্ট আমার মাথায় এল। সিসিটিভির ফুটেজে আমাকে, তুর্বসুকে বেশ কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখা গেছে। কিন্তু এই লোকটাকে না। সে হয়তো পিছন দিয়েই আসত। চলে যেত। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন, দেবাশিসদা মারা যাবার পরে লোকটা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। যে কটা ক্লুরেখে গেছিল সেগুলোও মিটিয়ে ফেলছে একে একে। এখন তো একেবারে ছায়া হয়ে গেছে লোকটা। আসলে…’

“থাক অমিতাভ, আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না। তুমি তো জানো…..”

“আয়্যাম সরি বউদি। কিন্তু আপনি কি শিওর, একে দিয়েই আপনার সঙ্গে সেদিন দেবাশিসদা অমন করিয়েছিলেন?”

“আর কে হবে বলো? ওর বন্ধু বা কাছের লোক খুব বেশি ছিল না। তুমি ছিলে। তুর্বসু আমাদের বাড়ি যাতায়াত করত সেটা দেবাশিস মারা যাবার পরে শুনলাম। আর সেই বাসু।”

“নীবারের অন্য কেউ?”

“নীবার একটা বন্ধ কুঠুরির মতো। ওর ভিতরে ঠিক কী হয় কেউ জানে না। বিশেষ করে মহিলারা। ওরা ম্যাসনিক ব্রাদারহুড ভেঙে এসেছে, জানো তো। মহিলাদের কোনও স্থান নেই ওখানে।”

“কিন্তু দেবাশিসদা যে বেশ্যা আর হিজড়াদের সঙ্গে এত কাজ করতেন!”

“এটা আমাকেও জানতে হবে। এতদিন ভেবেছিলাম এড়িয়ে থাকব। এখন আর থাকা যাচ্ছে না।”

“কোথা থেকে জানবেন?”

“আমার মাফ করো অমিতাভ। আমি বলতে পারব না। আমি চিরকাল তোমার কাছে তোমার দেবাশিসদার বউ। এখনও তাই। বউদি বলেই ডেকে যাচ্ছ। আমার সঙ্গে যখন চরম অন্যায় হল, তখন তুমিই বলেছিলে চেপে যেতে, কারণ দেবাশিসের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। তুমি এখনও যে এত দৌড়াদৌড়ি করছ, তার একটাই কারণ, দেবাশিস মারা গেছে। তোমার লয়ালটি দেবাশিসের কাছে। আমার কাছে না। আমি তোমাকে সব বলতে বাধ্য নই।”

ফোন কেটে দিল অপর্ণা। রাগে কান মাথা গরম হয়ে গেছে। ফ্রিজ থেকে জলের বোতল বার করে ঠান্ডা জল নিয়ে খেল। পাখা চালিয়ে বসে থাকল খানিক। শরীরের আইটাই ভাবটা একটু কমল এতে। সব রাগ অমিতাভর উপরে গিয়ে পড়ল। দরকার ছিল না।

দ্বিতীয় ফোনটা করার আগে প্রায় মিনিট পনেরো নম্বরটার দিকে তাকিয়ে রইল অপর্ণা। সে ছোটোবেলা থেকে জানে, এই নম্বরের ওপারে যিনি আছেন তিনি সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার বাবা আমৃত্যু এই মানুষটাকে শ্রদ্ধা করে গেছেন। সে শ্রদ্ধা এতই বেশি যে, তাকে ভয় বললে খুব বেশি ভুল হয় না। একই ঘটনা ঘটত দেবাশিসের বেলায়। ও দেখেছে এই নম্বর থেকে ফোন এলেই দেবাশিস কেমন একটা অ্যাটেনশন মোডে চলে যেত। বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়ত। অনেকসময় ঘরের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে কথা বলে ফিরে আসত। অবস্থাটা বদলাতে থাকে বিয়ের বছর দু-একের মধ্যে থেকে। অপর্ণা দেখেছে, এই নম্বর থেকে ফোন এলে দেবাশিস ধরছে না। কেটে দিচ্ছে। অপর্ণা নিজে কোনও দিন একে দেখেনি, শুধু গোপনে দেবাশিসের মোবাইল থেকে এর নম্বরটা নিজের মোবাইলে সেভ করে নিয়েছিল। কিছু ভাবনাচিষ্টা না করে। এমনিই। এই নম্বরের মালিকের নাম সে জানে না। তাই যে নামে দেবাশিস সেভ করেছিল, সেই নামেই তার মোবাইলে নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে। ‘মাস্টার’। আরও মিনিট পাঁচেক ভেবে নম্বরটা ডায়াল করল অপর্ণা। ঠিক দুবার রিং হবার পরেই ফোনটা ধরল এক গম্ভীর গলার পুরুষ। গলা শুনে মনে হয় ভদ্রলোক প্রৌঢ়। অপর্ণা ফোনের রেকর্ডারটা অন করে দিল।

“বলো।”

অপর্ণা একটু চমকে গেল। ভদ্রলোক কি তার নম্বর চেনেন?

“আমি…. আমি অপর্ণা বলছি। অ্যালিস অপর্ণা। ফার্গাস অ্যাভেরির মেয়ে।”

“সেটা আগেই বুঝেছি। বলো কী বলতে চাও? ফোন করেছ কেন?”

“নিশীথ দত্তকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।”

“জানি। তবে ধরে রাখতে পারেনি। পাঁচ মিনিট আগে জামিন পেয়ে গেছে। তুমি এইজন্যে ফোন করেছ?”

অপর্ণা দেখল তার মোবাইলে একটা কল ওয়েটিং দেখাচ্ছে। উর্ণার নম্বর। কারণটা বুঝতে পারল অপর্ণা।

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করার ছিল।”

“বলো।”

“দেবাশিসের সঙ্গে নীবারের সমস্যাটা ঠিক কোথায় হয়েছিল?”

“ও তোমায় বলেনি?”

“না। নীবারের ব্যাপারে বাড়িতে কোনও আলোচনাই হত না। বাবাও করতেন না। দেবাশিসও না। তবে আন্দাজ করতে পারছিলাম কিছু একটা সমস্যা চলছে।”

“দেবাশিস নীবারের মূল নীতি থেকে এই হয়েছিল। তাই ওকে বহিষ্কার করা হয়। এতে ও রেগে গিয়ে এমন কিছু করে, যার পরিণামে আজ ওর এই দশা। ও শয়তানকে নিজের সঙ্গী বানিয়েছিল…” ভদ্রলোক উত্তেজিত হয়ে উঠছেন, ফোনে তাঁর গলা চড়ছে।

“কে শয়তান? বাসু?”

“তুমি বাসুকে চেনো?”

“চিনি না। নাম শুনেছি। দুই-একবার। দেবাশিসের মুখেই।”

“সবাই তাই শুনেছে। কেউ তাকে দেখেনি। তবে আমি বাসুর কথা বলছি না।”

“তাহলে?”

ভদ্রলোক যেন সংবিৎ ফিরে পেলেন। একেবারে ঠান্ডাগলায় কাটা কাটা উচ্চারণে বললেন, “শোনো অ্যালিস অপর্ণা, তোমায় এখন যা বলছি, অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। আমি এবার ফোনটা কাটব। কাটার সঙ্গে সঙ্গে পরের ফোনটা করবে তোমার স্বামীকে। ও আধঘণ্টা আগে অফিস পৌঁছে গেছে। ওকে ফোন করে বলবে তোমার শরীরটা বিশেষ ভালো লাগছে না। তুমি ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছ।”

“কিন্তু আমার ডাক্তার তো…..”

“দিল্লি গেছেন। তাই তো? সুতনু তোমাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করবে। তুমি বলবে, তুমি রাসবিহারীতে ডাক্তার অশোক মল্লিকের ‘ব্লু ফ্লাওয়ার’ নার্সিং হোমে যাচ্ছ। ও যেন ফেরার সময় ওখান থেকেই তোমাকে পিক আপ করে। তাড়াহুড়ো করে আগে আসার দরকার নেই। তারপর তুমি সোজা নিচে নেমে এসো। নিচে একটা উবের দাঁড়িয়ে আছে। সেটাতে উঠে চলে যাও। ওখানে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পাবে।”

অপর্ণার হাত পা কাঁপছিল। কারা এরা? প্রতি মুহূর্তে অনুসরণ করছে তার প্রতিটা নড়াচড়া! অপর্ণাকে চুপ থাকতে দেখে আবার সেই গম্ভীর গলা বলে উঠল, “সময়বেশি নেই। তাড়াতাড়ি নেমে এসো।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *