পূর্বখণ্ড- সংশয়
মধ্যখণ্ড— সংযোগ
উত্তরখণ্ড— সংকাশ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ— বিড়বিড়, একাকী

পঞ্চম পরিচ্ছেদ— বিড়বিড়, একাকী

(শ্রীযুক্ত তারিণীচরণ রায়ের ডায়রি থেকে)

সহরটা আজকাল বড় বিমর্ষ ঠেকচে। ঝড়ের আগে, বজ্রাঘাতের আগে, নিস্তব্ধ হয়ে থাকে, সহরটা ঠিক তেমনি তালঠান্ডা কচ্চে। কোথাও কিছুই কোথাও ধূমধাম নাই। অন্ধ জাগ, কিবা রাত কিবা দিন মতন কালও যেমন ছিল আজও তেমনি। খবরের কাগজে বাসি খবরে ভরভত্তি। কোন কারখানায় কে পটল ভুলেচে, কে বেগুন বেচচে, আঁতুড়ঘরের ছেলেপিলে চ্যাঁ ভ্যাঁ কচ্চে, অমুকবাবু লাপিয়ে রায়বাহাদুরে উঠলেন, কোন বাঙ্গাল দুপাতা ইংরিজি পাশ দিয়েচে, এই সব উৎসাহহীন খবর। চুঁচুড়া হতে এসেচিলাম বড় আশা নিয়ে। চার বচর আগেও কিচু করার সুবিধে ছিল। সেসব এখন বন্ধ। ড্রিসকল সাহেব গত হয়ে অবধি অপিসে ভাটা লেগেচে। কী করব বুদ্ধির থই পাইনে। কোনক্রমে অন্ন সংস্থান করি। মনকে বলি, সত্যকে প্রকাশ না হতে দিয়ে একদিন বড় পাপ করেছিলাম। চার বচর বাদে সেই পাপেই হয়ত কেবল দুর্গন্ধ পাঁক ও জঙ্গলের আধার হয়েচি। জানি না এই পোড়া অদৃষ্ট কবে ফিরবে।

মনে মনে এমন কল্পনা কচ্চি, সেই সময় এই ত্যাজ্য আমার স্থলে আজ বিধাতা প্রিয়নাথ মুখুজ্জেকে পাঠালেন। কিন্তু কেন? এখন রাত প্রায় তিন প্রহর, ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই। চরাচর সকলেই প্রায় নিস্তব্ধ। মনে হয় কোথাও কেউ যেন বেঁচে নাই। শুদু গোচ্ছা গোচ্ছা কঠিন প্রাণ জোনাকপোকা, কালপেঁচা, ঝিঁহ, কর্কশ ধ্বনিতে রাত সরগরম করার উদ্যোগ পাচ্চে। দূরে কোতায় এক বাড়ীতে এক বাবু ইয়ারকির হদ্দ কোরে ফিরে এসে সদর দোর ঠাংয়াচ্চেন। চারিদিকে নিবিড় অন্ধকার, ঘুরঘুটে অন্ধকার, কেবল বড় রাস্তা নতুন বিজলি বাতিতে ফুটফুট কচ্চে। কে যেন হেঁড়ে গলায় বারান্ডা থেকে “প্রেম করা নয় মানুষ মারা” গান গাইচে। এ গান যে লিখেচে সে গুঁড়ি মেরে আমার পাশের ফরাসে শুয়ে আচে। আমি টিমটিমে তেলের আলোতে ডাইরি লিখচি। আমি কি মানুষ! কলকাতায় এসে অবধি কত খুন, গলায় দড়ি, বিষ খেয়ে মরা, কত ভয়ানক চুরি, সিঁধ, মাতলামি, ঢলাঢলি দেখলুম স্মরণ কল্পে গা শিউরে উঠে। তবু চার বচর আগের মত অমন অসৈরণ ঘটনা দেকিনি কো। বাবুরা সাহেবরা তো নিজেদের নিয়েই খুশি। গত চার বচরে একবারটি এ পথ মাড়াননি। সোনাগাছির লক্ষ্মীমতি মরেচে। সে নাকি গলায় দড়ি দিয়েচিল। আমি গেচিলাম গণপতিকে নিয়ে। গোটা মুখ কালোবরণ। দেহ শুকিয়ে গেচে। কেউ বিষ খাইয়ে ঝুলিয়ে দিয়েচে। আমি লালবাজারে প্রিয়নাথবাবুর সঙ্গে দেখা কত্তে গেলাম। দারোয়ান ভাগিয়ে দিলে। উনি আমার মত পেঁচাপেঁচি লোকের সাথে কতা কন না। ময়নারও খোঁজ নেই। নিস্তারিণী বুজি চন্দননগরে পালিয়েচে।

গণপতির অবস্তা কিছু ভালো না। নবীন মান্না তাকে কেলাব ছাড়া করেচেন। এখন তার “ভোজনং যত্রতত্র শয়নং হট্টমন্দিরে।” এদানি নাকি হীরালাল নামে এক বড়ঘরের ছেলের সাতে আলাপী হয়ে শো করে দু পয়সা রোজকার কচ্চে। কিন্তু শৈল? সে কী পাপ কল্প যে তাকে এই শাস্তি ভোগ কত্তে হচ্ছে? কত গুণ তার। নীরদ ওস্তাদের কাচে খেয়াল টপ্পা এমন শিকেচে যে গেয়ে মোহিত কত্তে পারেন। চেহারা দেবশিশুর মতন। খাড়া নাক, রং ফুটে বেরুচ্চে, যেন পাকা আঁবটি— যেন দুদটুকু মরে ক্ষীরটুকু হয়েচে। ন্যাশনালের সেরা অভিনেতা ছিল। নলদময়ন্তী নাটকে নায়িকার ভূমিকায় শৈলর অভিনয় দেখে দানীবাবুর বাপ গিরিশ ঘোষ অব্দি ক্ল্যাপ দিয়েচেন। বলেচেন, “শৈলসুন্দরী একন সেরা নটী।” সেই শৈলর যখন মহা বিপদ, তখন দানীবাবু, গিরিশ ঘোষ সবাই তাকে পায়ে ঠেললে। তার কতা বিশ্বেস কল্পে না। অভাগা দ্বারে দ্বারে ঠোকর খেয়ে বেড়ায়। হায় রে! এমন প্রতিভার এ কী দুর্দশা! তবে চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়। হাসিকান্না রামসন্নার পিসতুতো মাসতুতো ভাই। আজ খারাপ যাচ্ছে, কাল ভালো যাবে। শৈল বড় অভিমানী। ভয় হয়। অভিমানের বশে কখন কী করে আর বিপদ ডেকে আনে। আমি তাকে বারবার বলি, অভিমানের বশে, রাগের বশে হিংসার পথে না যেতে। ও গা করে না। যাদের সঙ্গ পায় তারা সব সাক্ষাৎ কাঁচাখেগো শয়তানের বাচ্চা। ওর ঈশ্বর ওকে সুমতি দিন। প্রিয়নাথবাবুর থেকে খপ পেলুম সাইগারসন সাহেব আবার এসেচেন। তাও চুঁচড়োয়। আমায় যেতে নির্দেশ করচেন। সাহেবের ডাক উপেক্ষা করি সে সাধ্য আমার নেই। এই মূর্খ নেটিবকে সাহেব যে সম্মান দিয়েচেন তা চিরকাল মাতায় করে রাকব। বিধাতা হয়ত আমাদের ভাগ্যে যন্ত্রণাই লিখে গেছেন। বিধাতার লিখন বদলায় সে সাধ্য কার? মনের ভাব মনই জানে। উন্মত্তের খেয়ালের মত কী যে লিকলাম তার মাতামুন্ডু নেই। ভোর হতে চল্ল। কাল ভোরে প্রিয়নাথবাবু আমাকে নিতে আসবেন। শুতে যাই।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *