পঞ্চম পরিচ্ছেদ— চিনদেশীয় বিচিত্র চিহ্নসমূহ

পঞ্চম পরিচ্ছেদ— চিনদেশীয় বিচিত্র চিহ্নসমূহ

(সমাচারচন্দ্রিকা পত্রিকায় প্রকাশিত ‘চৈনিক দর্শন’ প্রবন্ধের অংশবিশেষ;

লেখক অজ্ঞাত)

“… এক্ষণে আমি চীনদেশীয় বিভিন্ন লিপি লইয়া আলোচনা করিব। চিনা সভ্যতার প্রাচীনতম লিপিদের মধ্যে অন্যতমটির নাম ই-চিং অথবা ই-কিং। চীন দেশের মূলত দুই ধর্ম, তাও এবং কনফুসিয়াস, উভয়েই ইহাকে পবিত্র বলিয়া মানিয়া থাকে। ইহার মূলে রহিয়াছে চৌষট্টিখানি চিহ্ন, যাহাদের পারিভাষিক নাম ‘হেকসাগ্রাম।’ এই চিহ্নসকল আবার সরলরেখা দ্বারা নির্মিত। প্রতিটি সরলরেখা অভগ্ন এবং ভগ্ন— দুই প্রকারের হইতে পারে। ভগ্ন রেখাটি স্ত্রী সত্তার প্রতীক। ইহা নেতিবাচক শক্তি বা ইন-কেও চিহ্নিত করে। অপরপক্ষে অভগ্ন রেখাটি পুরুষ, ইতিবাচক শক্তি বা ইয়াং-এর প্রতীক। এই ইন ও ইয়াং একত্রে মিলিয়া জগৎসংসারের সকল কার্যকারণ বা তা-আই-চি-র মূল। এই তা-আই-চি কোন স্থির অভিধা নয়, ইহা ক্রমাগত এবং সতত পরিবর্তনশীল। সকল বস্তু সমূহের উৎপত্তি ইহা হইতেই আবার ইহাতেই সকল বস্তুর লয়। তা-আই-চি-র সঙ্গে জড়িত অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা হইল ‘তাও’ বা সঠিক পথ। এই সঠিক পথের দিশা যেমন মহাজাগতিক তেমন তাহা মনুষ্যের অন্তরেও সমান বিদ্যমান। মনুষ্য অন্তরে তাও নাম পরিবর্তন করিয়া ‘তে’ নাম গ্রহণ করে। ই-চিং এর এক দর্শনে যদি তাওয়ের ধারণা রহিয়া থাকে, অন্যদিকে রহিয়াছে সুন-জু বা অতিউত্তম পুরুষের ধারণা। সঠিক পথ বা তাও মানিয়া চলিলে যে কোন সাধারণ মানুষে অসামান্য ক্ষমতা দেখা দিতে পারে, এবং সেও সুন-জু হইয়া উঠিবে। সেই পথ দেখাইবার চিহ্ন বা কৌশলই হইল ই-চিং। সংক্ষেপে পাঠকদিগকে ই-চিং এর চিহ্নসকল বুঝাইয়া দিবার প্রয়াস করিব। আদিকালে দুটি মাত্র চিহ্ন বিদ্যমান ছিল, ভগ্ন এবং অভগ্ন রেখা। ইন এবং ইয়াং। মিথ্যা এবং সত্য। ধীরে ধীরে ইহাদের সহিত আরও দুইটি করিয়া রেখা যুক্ত হইয়া তিনটি রেখার এক একটি বিন্যাস তৈরি করে। প্রতিটি বিন্যাস আবার এক একটি প্রাকৃতিক উপাদানের সহিত জড়িত। নিম্নের চিত্রে বিশদ বর্ণিত হইল—

চিত্রে ইহা প্রতীয়মান যে পৃথিবী, অগ্নি, বারি ও স্বর্গের চিহ্ন প্রতিসম (symmetrical)। ইহারা অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী চিহ্ন, যদিচ ইহাদের মধ্যে স্বর্গে তিনটি ইয়াং বর্তমান রহিয়াছে এবং পৃথিবীতে তিনখানি ইন। ফলে ইহাদের মধ্যেও সর্বাপেক্ষা উত্তম চিহ্ন স্বর্গের। নিম্নে এই আট বিভিন্ন চিহ্ন, তাহাদের চৈনিক নামসকল এবং উহাদের অর্থ প্রদান করা হইল।

১। পৃথিবী (কু’উন) — সমর্পণ, স্থির, বৃদ্ধি, রক্ষা করিয়া চলা

২। পর্বত (কে’এন)— উচ্চতা লাভ, আদর্শবান হৃদয়, জ্ঞান, প্রজ্ঞা

৩। বারি (কা’আন)— দুর্বলতা, গতি, পরিবেশকে পরিবর্তন করিবার ক্ষমতা

৪। বায়ু (সান)— দ্রুতগতি, অদৃশ্য শক্তি

৫। বজ্র (চে’এন)— স্বর্গ আর পৃথিবীর মিলন, আত্মার নতুন জীবন লাভ, সহস্র বিঘ্ন সত্ত্বেও সঠিক পথের দিশা

৬। অগ্নি (লি)— ধ্বংস, ভয়াবহ পরিবর্তন, ক্ষতি

৭। হ্রদ (তু’উই)— স্থিতাবস্থা, নতুন জীবনের সূত্রপাত, নিম্নগামী জীবন

৮। স্বর্গ (চ’ ইয়েন)— উন্নতি, প্রগতি, স্বপ্ন। ইচ্ছাপূরণ

এই সকল প্রাথমিক চিহ্ন ব্যতীত যত দিন গিয়াছে এক একটি করিয়া রেখা বৃদ্ধি পাইয়া ই-চিংকে আরও কঠিনতর করিয়া তুলিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যাইতে পারে চারটি ইন ও ইয়াং রেখা দ্বারা মোট ৬৪ প্রকার বিন্যাস সম্ভব, এই বিন্যাস…”

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ— দেবাশিসদা

২০ জুন, ২০১৮, কলকাতা

এই জগতে কারও কারও পরিচয় ঘটনাচক্রে হয়, আবার কেউ কেউ একে অপরকে খুঁজে নেন যেন। দেবাশিসদা ঠিক তেমনি আমাকে খুঁজে নিয়েছিলেন। বছর তিনেক আগের কথা। তিন-চারটে চাকরি করে বুঝে গেছি, আমার দ্বারা চাকরি হবে না। কলেজেরই এক বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেও স্থায়ী রোজগারে বিশ্বাসী। ঠাকুরদার বাবার অফিসটা ভাড়ায় দেওয়া ছিল। এক মাড়োয়ারি সেটাকে তাঁর গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতেন। তাঁকে ওঠাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। শেষে থানা পুলিশের ভয় দেখানোতে কাজ হয়। বাবার থেকে শুরুতে লাখ খানেক টাকা নিয়েছিলাম। সে টাকা গেল অফিস সাজাতে, গোপন ক্যামেরা, রেকর্ডার ইত্যাদি দরকারি জিনিসপত্র কিনতে, আর আনন্দবাজার, টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ব্যক্তিগত কলামে বিজ্ঞাপন দিতে। বড়দাদুর আমলের নামটা বদলাইনি, একই রেখেছিলাম। রে প্রাইভেট আই অ্যান্ড কোং। তবে ডিভোর্স কেসের স্পেশালাইজেশানটা দিতে প্রবৃত্তি হয়নি। আনন্দবাজারে সেই বিজ্ঞাপনটা দেখেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন দেবাশিসদা। দেবাশিস গুহ। চন্দনগরে বাড়ি। সেই সূত্রেই আমার প্রথম চন্দননগরে যাওয়া।

প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে ঝড়বৃষ্টিতে। অকাল সন্ধ্যা নেমেছে বেলা চারটেতেই। দেবাশিসদার বাড়ি যখন ঢুকলাম, তখন জামাকাপড় ভিজে একশা। বাড়িতে দেবাশিসদা একাই ছিলেন।

“আরে, এ তো পুরো ভিজে গেছ দেখছি। তোমাকে তুমিই বললাম। আমি সামনের মাসে পঞ্চাশে পড়ব। তুমি আমার অর্ধেক হবে বড়োজোর। আপনি ডাকার কোনও মানেই নেই।”

উনিই আমায় শুকনো টিশার্ট দিলেন একটা, সঙ্গে ধুতি, মাথা মোছার গামছা। তৈরি হতে না হতে দেখি ট্রে-তে আমার জন্য অপেক্ষা করছে ধোঁয়া ওঠা কফি। বললেন, “আজকে কি ফিরতেই হবে? একে তো জামাকাপড় সব ভিজিয়েছ, আর ওপর যা দুর্যোগ দেখছি, রাস্তায় একমাত্র লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ-ই ভরসা।”

“তিনি কে?”

“সে কী হে গোয়েন্দা? তুমি ইতিহাস বই-টই পড়ো না বুঝি?”

স্বীকার করতে বাধ্য হলাম মাধ্যমিকের পর আর পড়িনি। মাধ্যমিকেও যে খুব আনন্দের সঙ্গে পড়েছি তা নয়। আমাদের ইতিহাস মাস্টার অসীমবাবুর সাল তারিখ ধরা আর না পারলেই বেতের বাড়ি… ইতিহাস মানে আমার কাছে এ-ই। সেটাই বললাম ওঁকে।

“বুঝলাম।” কফির কাপে চুমুক দিয়ে এবার একটা সিগারেট ধরালেন দেবাশিসদা।

‘ব্যাসিলিকা অফ দি হোলি রোসারি’-র নাম শুনেছ?

“নাহ। শুনিনি কোনও দিন।” আমার সরল স্বীকারোক্তি।

“শুনেছ, শুনেছ। লোকে একে এখন ‘ব্যান্ডেল চার্চ’ বলে। তবে ১৫৯৯ সালে গির্জাটি ঠিক কোথায় নির্মাণ করা হয়েছিল, সে নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। যেহেতু সেই সময়ে পর্তুগিজদের শহর ছিল বর্তমান হুগলি জেলখানা সংলগ্ন অঞ্চলে, গির্জাও তাই তার আশেপাশেই কোথাও থাকা উচিত বলে মনে হয়। যুবরাজ খুররম দিল্লির সিংহাসন দখলের জন্য হুগলির পর্তুগিজদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু পর্তুগিজরা তাঁকে সাহায্য করেনি। ১৬২৮ সালে যুবরাজ খুররম সম্রাট শাহজাহান নাম নিয়ে মসনদে বসলেন। রাগ তো আগেই ছিল, এবার তাঁর নির্দেশে মুঘল সৈন্য হুগলি আক্রমণ করে। প্রায় সাড়ে তিন মাস যুদ্ধের পর পর্তুগিজরা মুঘলদের কাছে পরাজিত হয়ে হুগলি থেকে বিতাড়িত হয়। ৪,৪০০ জন পর্তুগিজকে বন্দি করে আগ্রা নিয়ে যাওয়া হল। তারপর আগ্রাতেই নাকি সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে, যার ব্যাখ্যা আজও কেউ দিতে পারেনি।”

“কী ঘটনা?” কফি খেতে খেতে আচ্ছন্নের মতো শুধু শুনে যাচ্ছিলাম আমি।

“পর্তুগিজ বন্দিদের মধ্যে ছিলেন পাদরি জোয়াও দা ক্রুজ। তাঁকে ফেলে দেওয়া হয় এক উন্মত্ত হাতির সামনে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই হাতি তাঁর কোনও ক্ষতি করার বদলে শান্ত হয়ে তাঁকে পিঠে তুলে বসায়। এই ঘটনায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট শাহজাহান বিপুল অর্থ, ক্ষমতা আর ৭৭৭ বিঘা জমি দান করে পর্তুগিজদের পুনরায় হুগলিতে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৬৩৩ সালে পর্তুগিজরা ফের হুগলিতে ফিরে এসে ধ্বংসপ্রাপ্ত হুগলি শহরের উত্তরে এক শহর স্থাপন করে। পর্তুগিজরা বন্দরকে বলত ‘বন্ডেল’, আর সেখান থেকেই এই শহরের নাম হয় ‘ব্যান্ডেল’।

“এর সঙ্গে সেই লেডির কী সম্পর্ক?”

“লেডি অফ দি হ্যাপি ভয়েজ আসলে মেরি মাতার এক মূর্তি। ১৬৩২ সালে মুঘলদের আক্রমণের সময় মূর্তিটিকে রক্ষা করার জন্য তিয়াগো নামে এক পর্তুগিজ বণিক মূর্তিটি নিয়ে হুগলি নদী পার করে অপর পারে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু মুঘলদের আক্রমণে তিয়াগো মাঝনদীতেই মারা যান । মূর্তিও নদীতে ডুবে যায়। নতুন গির্জা পত্তনের কিছুদিন পরে হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া সেই পাদরি জোয়াও দা ক্রুজ নাকি এক রাতে নদী থেকে দৈববাণীর মতো ডাক শুনতে পান। পরদিন সকালে তিনি নদীর ধারে গিয়ে আশ্চর্য হয়ে দেখেন যে মেরি মাতার মূর্তিটি নদী থেকে জেগে উঠেছে। এর কিছুদিন বাদেই এক রাতে, ঠিক আজকের মতো ঝড়বৃষ্টি। এক পর্তুগিজ জাহাজ ভয়ংকর ঝড়ের কবলে পড়ে এসে উপস্থিত হয় গির্জার সামনে হুগলি নদীতে। জাহাজের ক্যাপ্টেন লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ-এর কাছে মানত করেছিলেন যে ঝড়ের কবল থেকে প্রাণে বাঁচলে জাহাজের প্রধান মাস্তুলটি তিনি গির্জায় দান করবেন। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হোক বা যাই হোক, সে যাত্রা জাহাজটি ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা পায়, এবং ক্যাপ্টেন তাঁর মানত অনুসারে জাহাজের একটি মাস্তুল ব্যান্ডেল চার্চে দান করেন। সে মাস্তুলটা দীর্ঘদিন গির্জার সামনে কবরখানার ঠিক পাশেই ছিল। এই কিছুদিন আগে, ২০০৯ সালের কুখ্যাত আয়লা ঝড়ে মাস্তুলটি ভেঙে পড়ে। তাই বলছিলাম, আজ রাতে ফিরলে একমাত্র লেডি অফ হ্যাপি ভয়েজ তোমায় বাঁচাতে পারেন।”

বৃষ্টি গাঢ় হচ্ছিল। সঙ্গে বাড়ছিল ঝড়ের বাতাসও। বাড়িতে ফেরা মুশকিল। ইচ্ছেও করছিল না। এমন ইন্টারেস্টিং একজন মানুষের দেখা পাব ভাবিনি।

“বাড়ি না ফিরতে পারলে এখানে থেকে যেয়ো।” দেবাশিসদা বললেন।

“তার দরকার হবে না। আমাদের আদি বাড়ি আছে চুঁচুড়ায়। জগন্নাথ মন্দিরের কাছেই। রাস্তার ওপর। রায়বাড়ি বললে যে কেউ চেনে।”

“তাহলে তো তুমি আমার পাড়ার ছেলে হে”, বলেই হঠাৎ এক নিমেষে গম্ভীর হয়ে গিয়ে দেবাশিসদা আমায় প্রশ্ন করলেন, “তোমায় একটা কেস দেব, কিন্তু তার আগে যদি তোমায় একটু পরীক্ষা করে নি, তবে আপত্তি আছে?”

প্রথম কেস। হাতে টাকাপয়সা কিচ্ছু নেই। ফলে আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। মাথা নাড়লাম।

“তোমার অফিসের নাম রে প্রাইভেট আই অ্যান্ড কোং। তুমি কি জানো, আজ থেকে একশো বছরের কিছু আগে ঠিক এই নামে, এই জায়গায় আর-একটা অফিস ছিল?”

“আজ্ঞে জানি।”

“সে কী? তুমি না বললে ইতিহাস নিয়ে তোমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই, আর এটা জেনে গেলে কী করে?”

“আমার ঠাকুরদার বাবার অফিস ছিল। স্বর্গীয় তারিণীচরণ রায়। তিনিও প্রাইভেট ডিটেকটিভ ছিলেন।”

অনেকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন দেবাশিসদা, বজ্রাহত মানুষের মতো। তারপর অদ্ভুত হেসে বললেন, “তুমি জানো না তুর্বসু, কতদিন ধরে তোমায় আমি খুঁজছি।”

“কেন?”

“সব বলব। আগে বলো ঠাকুরদার বাবার সম্পর্কে তুমি কী জানো।”

“খুব বেশি কিছু না। ঠাকুরদা ছোটো থাকতেই বড়দাদু নিরুদ্দেশ হয়ে যান। আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বড়দাদুকে নিয়ে যতটা জানি, তা ওঁর ডায়রি থেকে।”

“তারিণীচরণের ডায়রি!!” প্রায় লাফিয়ে উঠলেন দেবাশিসদা। “সে জিনিস আছে তোমার কাছে?”

“আছে। ওটা দেখেই তো আমার গোয়েন্দাগিরির শখ জাগে। কিন্তু আপনি আমার বড়দাদুর কথা জানলেন কীভাবে?”

“সব বলব তোমায়। সে ডায়রি দেখা যায়? অক্ষত আছে?”

“আছে। ১৮৯০ থেকে ১৯০১, এই দশ বছরের নানা ঘটনার এন্ট্রি আছে। শুধু বছর দু-এক ছাড়া। ১৮৯২-৯৩-এর শেষ থেকে এন্ট্রি কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। একই অবস্থা ১৮৯৫-৯৬-এর। ডায়রিটাই নেই।”

“এমন কেন? ডায়রি তো জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর অবধি হয়?”

“না, তারিণী বৈশাখ থেকে নতুন বাংলা ডায়রিতে লিখতেন। ফলে তাঁর ডায়রি এপ্রিল থেকে মার্চ, বৈশাখ থেকে চৈত্র।”

একটা কালো ছায়া দেবাশিসদার মুখে দেখতে পেলাম। খানিক ভেবে বললেন, “আমার কেস আমি তোমাকেই দেব।”

“এবার আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি?”

“অবশ্যই। তুমি গোয়েন্দা, তুমিই তো প্রশ্ন করবে হে।”

“আমাকেই কেন?”

আবার সেই অদ্ভুত একপেশে হাসি হেসে দেবাশিসদা বলেছিলেন, “কারণ তুমি তারিণীচরণের প্রপৌত্র। গোয়েন্দাগিরি তোমার রক্তে।”

সপ্তম পরিচ্ছেদ— তারিণীচরণ

১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯২, কলিকাতা

পুলিশের ঝামেলা মিটিয়ে গণপতি যখন ছাড়া পেল, তখন প্রায় শেষ রাত। তাকে ছাড়ার আগে পুলিশ আবার তার বয়ান লিখে সই করিয়ে তবে ছাড়ল। শীতকাল বলে তখনও আলো ফোটেনি। এই সময়ে কোথায় ফিরবে বুঝতে পারছিল না সে। পাশের নহর থেকে ভিস্তিরা তাদের চামড়ার মশকে জল ভরছে। ভোরের আলো ফুটলেই রাস্তায় জল ছিটাবে। বৃষ্টি নেই, আকাশ মেঘলা। তবু জল ছিটানোর কী দরকার কে জানে। পথের ধুলো জলের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে তাল পাকিয়ে কাদার মতো হয়ে আছে। দুই পা চললেই সেই চ্যাটচ্যাটে কাদা পায়ে জড়িয়ে জুতোর সঙ্গে উঠে আসে। কর্পোরেশনের ভ্রূক্ষেপ নেই। সাতপাঁচ ভেবে গণপতি আর দর্জিপাড়ার দিকে গেল না। বাকি রাত ক্লাইভ স্ট্রিটে তারিণীর অফিসেই কাটিয়ে দেবে। তারিণী নতুন অফিস খুলেছে। ডিটেকটিভ এজেন্সি। সারা দিনরাত ওখানেই পড়ে থাকে। বিয়ে করেনি। বাড়িতে বিধবা মা ছাড়া কেউ নেই। ইচ্ছে হলে এক-দুই দিন চুঁচুড়ায় দেশের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসে। গণপতি ক্লাইভ স্ট্রিটের দিকেই পা বাড়াল। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধ জেতার পর লর্ড ক্লাইভ নিজেই এই রাস্তার নাম রাখেন ক্লাইভ স্ট্রিট। কোম্পানির কাউন্সিলের সদর দপ্তর এককালে পুরোনো ফোর্ট উইলিয়ামের মধ্যে ছিল। আর কেল্লা ছিল ক্লাইভ স্ট্রিটের মাঝবরাবর, প্রায় লালদিঘি অবধি। এই রাস্তা সোজা বড়বাজার অবধি যেত বলে ইংরেজরা একে ‘রোড টু গ্রেট বাজার’-ও বলত।

রে প্রাইভেট আই অ্যান্ড কোং-এর সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় বেশ কয়েকবার ধাক্কা মারার পর তারিণী দরজা খুলে দিল। চোখে ঘুম জড়ানো। প্রথমে গণপতিকে চিনতে পারছিল না। গণপতি বললে, “এত রাতে তোমায় বিপদে ফেললাম। এক কাণ্ড হয়েছে। ভিতরে গিয়ে বলছি, চলো।” তারিণী “এসো, এসো” বলে গণপতিকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করল। ঘরের ভিতর মিশকালো অন্ধকার। আজকাল গন্ধকের একধরনের কাঠি বেরিয়েছে। দেশলাই নাম। কিন্তু বাজে খরচা বলে লোকে ব্যবহার করে না। তারিণী হাতড়ে হাতড়ে চকমকি পাথর ঠুকে শোলা ধরাল। সেই শোলায় গন্ধকের সাদা কাঠি ঠেকিয়ে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনে শেষে একটা প্রদীপ জ্বালাল। ঘরে আলো হল কিছুটা। অফিসঘর বলতে যা বোঝায় তেমন কিছু না। একটা টেবিল, খান তিনেক চেয়ার, কিছু বই, ডাঁই করা পত্রিকা এলোমেলো রাখা। পাশে মাটিতে একটা গদি পাতা, তাতে একটা চাদর আর বালিশ। রাতের শয্যা।

চুঁচুড়া থেকে কলকাতায় এসে তারিণী প্রথমে নানারকম কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কিছুদিন রাধাবাজারে এক দোকানে খাতা লেখার কাজ করে। সেখানে বড্ড কম মাইনে দিত। খাটনিও বেশি। বুদ্ধিমান তারিণী নতুন চাকরি পেয়ে গেল। চাঁদপাল ঘাটে এক গুদামে মালের হিসেব রাখার কাজ। বেশ কিছু বছর আগে চন্দ্রনাথ পাল নামে একজন মুদির দোকানদার ছিলেন। যেসব ব্যবসায়ী আর দোকানদাররা এখানে নৌকা থেকে নামতেন, তাঁরা ওই দোকান থেকে জিনিস কিনতেন। তাঁর নামেই এই ঘাটের নাম হয় চাঁদপাল ঘাট। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদস্থ কর্মচারীরা এই ঘাটেই নামলে তাঁদের সম্মানে তোপধ্বনি করা হত কেল্লা থেকে। পরে লটারি কমিটি গঙ্গার ধার বরাবর পাকা রাস্তা বানিয়ে নাম দেয় স্ট্র্যান্ড ব্যাংক। এখন অবশ্য সবাই একে স্ট্র্যান্ড রোডই বলে। একপাশে সারি সারি গুদাম। সেখানেই একদিন ড্রিসকল সাহেবের সঙ্গে আলাপ। সাহেব তখন লালবাজারের পুলিশ ইনস্পেক্টর। তাঁর কাছে খবর ছিল বেআইনি পথে আফিম পাচার করা হচ্ছে কোনও একটা গুদাম থেকে। তিনি তারিণীকে পুলিশের খোঁচড় হওয়ার প্রস্তাব দেন। ভালো দস্তুরি। তারিণী চিরকাল অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করে। সেও রাজি হয়ে যায়। কিছুদিন বাদেই বুঝতে পারে প্রদীপের তলাতেই অন্ধকার। সে যে গুদামে কাজ করে, সেখানেই তার নাকের ডগা দিয়ে নুনের বস্তায় আফিম পাচার হচ্ছে। যথারীতি ড্রিসকল সাহেবকে খবর দেওয়ায় তিনি গুদামের মালিককে বমাল গ্রেপ্তার করেন। তারিণী কুড়ি টাকা বকশিশ পেলেও তাঁর চাকরিটা যায়। ভালো দিক একটাই। ড্রিসকল সাহেবের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে সে। এরপর প্রায় দুই বছর পুলিশের খোঁচড় হিসেবে কলকাতা, চন্দননগর, চুঁচুড়া, কালনা কোথায় না গেছে? সাহেব চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ক্রিক রো-তে নিজের ডিটেকটিভ এজেন্সি খোলেন। তারিণী বছর দু-এক তাঁরই সহকারী হিসেবে কাজ করেছিল। কিন্তু সাহেবের শরীর ভেঙে যেতে থাকল। মেমসাহেব মারা গেলেন। ছেলেরা ইংল্যান্ডে চলে গেল। সাহেব গেলেন না। রয়ে গেছেন এই দেশ আঁকড়ে। তবে এখন আর বেশি কেস নেন না। তিনিই নিজের হাতে তারিণীকে অফিস সাজিয়ে দিয়েছেন। এমনকি, তারিণী যে সুন্দর কাঠের চেয়ারটায় বসে, সেটাও সাহেবেরই দেওয়া। রোজ সকালে উঠে চেয়ারটাকে ভালো করে ন্যাকড়া দিয়ে মুছে তারপরই বসে।

“খাওয়াদাওয়ার কোনও ব্যবস্থা দেখছি না যে?” গণপতি প্রশ্ন করল।

“ও পাট আর রাখিনি ভাই। মোড়ের মাথায় একটা ছোটো দোকান খুলেছে। সকালের জলখাবার থেকে রাতের খাওয়া সব পাওয়া যায়। একটু বসো। তোমায় খাওয়াব। গুটকে কচুরি আর জিলিপি। গজাই ভাজে কতরকম। জিবেগজা, ছাতুর শুটকে গজা, কুচো গজা…” বলতে বলতেই গণপতির মুখের দিকে তাকিয়ে তারিণীর কথা বন্ধ হয়ে গেল। গণপতির মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর।

“কী হয়েছে গণপতি?”

“আজ একটা খুন হয়েছে। চিনা পাড়ায়। সেটা বড়ো কথা নয়। কিন্তু এই খুনে একটা বীভৎস ভয়ানক চক্রান্তের গন্ধ পাচ্ছি। কেন যেন মনে হচ্ছে এই খুন শেষের শুরু। পুলিশে আমার বিশ্বাস নেই। তুমি হালে গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছ। তোমায় সব খুলে বলতে এসেছি।”

“সিগারেট খাবে? মার্কোপোলোর টাটকা সিগারেট। সাহেব এক টিন দিয়েছেন।”

গণপতি মাথা নাড়ল। খাবে না। তারিণী নিজেই একটা ধরাল প্রদীপের আগুনে। তারপর বলল, “বলো কী বলবে?”

ঘণ্টাখানেক পরে যখন গণপতি তার কথা শেষ করল, তখন তারিণীর কপালেও চিন্তার ভাঁজ। আকাশেও সবে ভোরের আলো ফুটেছে।

“চিহ্ন বিষয়ে তুমি নিশ্চিত?”

“একশো শতাংশ।”

“তুমি পুলিশকে এই চিহ্নের অর্থ বলেছ?”

“বলেছি। কিন্তু বিস্তারিত কিছু বলিনি।”

“সে এক হিসেবে ভালোই করেছ। চিহ্নটা তো তোমার মনে আছে, এই কাগজে একটু এঁকে দেবে?” বলে একটা উড পেনসিল আর কাগজ এগিয়ে দিল।

গণপতি এঁকে দিতেই তড়িদাহত মানুষের মতো ছিটকে উঠল তারিণী। “এ কী! এই চিহ্ন তো আমারও চেনা!”

“তুমি চিনলে কীভাবে?”

“তিনদিন আগেই স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটা বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। তাতে এই চিহ্ন দেখেছি।”

“বলো কী? আছে সেই পত্রিকা তোমার কাছে?”

“দাঁড়াও দেখি”, বলে হাঁটকেপাঁটকে তারিণী একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে এল। “এই দ্যাখো।”

বিজ্ঞাপন দেখে গণপতির একগাল মাছি। এই অনুষ্ঠানে যাবে বলেই তো সে কবে থেকে হাপিত্যেশ করছে। জাদুকর রবার্ট কার্টার আর চিন-সু-লিনের ম্যাজিকের বিজ্ঞাপন। করিন্থিয়ান থিয়েটারে।

তারিণীকে সেটা বলতেই সে বলল, “তাহলে তো ভাই আমাকেও তোমার সঙ্গে যেতে হয়। যা বুঝতে পারছি, খুনের একটা বড়ো সূত্র এই ম্যাজিশিয়ান সাহেবের শো-তে লুকিয়ে আছে। এই ডিভোর্সের কেস আর ভালো লাগছে না। নতুন কিছু চাই। আজ মঙ্গলবার। সামনের শনিবার শো আছে। তারপর সাহেব আর কটা শো করবেন ঠিক নেই। চলো সামনের শনিবার যাওয়া যাক।”

“কিন্তু টিকিট? আর দাম? আমার কাছে তো কানাকড়িও নেই ভাই।”

“সে আমি ড্রিসকল সাহেবের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করব। আর টিকিটের এক টাকা নিয়ে চিন্তা কোরো না। সাহেব মেমসাহেবদের ডিভোর্স করিয়ে করিয়ে যা রোজগার করেছি, তাতে এই টাকা আমিই দিতে পারব। বরং তোমায় ধন্যবাদ। এতদিনে সত্যিকারের একটা কেস পেলাম। তুমি বসো। মোড়ের দোকানটা খুলেছে বোধহয়। আমি জলখাবার নিয়ে আসি।” গণপতি স্থির দৃষ্টিতে হাতের বিজ্ঞাপনের দিকে তাকিয়ে রইল।

অষ্টম পরিচ্ছেদ— কিছু বিচ্ছিন্ন প্রশ্ন

২০ জুন, ২০১৮, কলকাতা

প্রায় ঘণ্টা তিনেক বসে থাকার পর থানার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। সামন্ত অবশ্য এই সময়ে আমাকে দুবার চা বিস্কুট খাইয়েছেন। লাল চা। চন্দননগর থেকে তিনজন এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একটু উচ্চপদস্থ যাকে মনে হল, তিনি সামন্তকে বললেন, “আমরা একটু ইন্টেরোগেশান করব। ঘরটা খুলে দিন।”

আগে কোনও দিন থানার ইন্টেরোগেশান রুম দেখিনি। সিনেমায় যা দেখেছিলাম তাতে আমার স্থির ধারণা ছিল একটা অন্ধকার ঘর, যাতে ঢুকিয়ে আগাপাশতলা পেটানো হয়। সত্যি বলতে কী, পেটের ভিতরটা কেমন গুড়গুড় করছিল। গল্পের গোয়েন্দাদের পেট গুড়গুড় করে না। ফেলুদা বা ব্যোমকেশকে কোনও দিন পুলিশের সামনে ঘাবড়ে যেতে দেখিনি। আমারও যাওয়া উচিত নয়, এইসব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম। একবার ভাবলাম ফেলুর মতো দারুণ স্মার্ট কিছু একটা বলে পুলিশকে চমকে দেব, বদলে মুখ দিয়ে বেরোল, “একটু বাথরুমে যাব স্যার?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই।”

এক কনস্টেবল আমাকে টয়লেটের পথ দেখিয়ে দিল। হিন্দি সিনেমায় গোয়েন্দা এই টয়লেটের ছোটো জানলা গলেই পালিয়ে যায়। কিন্তু এই টয়লেটের কোনও জানলা ছিল না। খুব উপরে একটা ছোটো ঘুলঘুলি, যা দিয়ে মোটাসোটা একটা ইঁদুরও গলতে পারবে কি না সন্দেহ।

বেরিয়ে আসার পর ইন্টারোগেশান রুমে নিয়ে যাওয়া হল। একটা টেবিল। দু-তিনটে চেয়ার। একপাশে রেকর্ডার। আলোতে ঝলমল অফিস রুমের মতোই। মানে যেমন ভেবেছিলাম তা নয়। মনে একটু সাহস এল। চন্দননগরের অফিসার একটু হেসে বললেন, “চা খাবেন?”

পুলিশ কিছু অফার করলে না বলতে নেই। তাই উপরে নিচে মাথা নাড়লাম।

“আপনি তুর্বসু রায়? প্রাইভেট ডিটেকটিভ?”

আবার একইভাবে মাথা নাড়লাম। খবর নিয়েই এসেছেন বোঝা গেল।

“আপনি এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন বলুন তো? আপনাকে তো খুনের দায়ে গ্রেপ্তার করছি না। শুধু কয়েকটা হেল্প চাইছি। যিনি খুন হয়েছেন, দেবাশিস গুহ, লাস্ট কয়েক বছর আপনি তাঁর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ইন ফ্যাক্ট, অন্য কারও সঙ্গে তাঁর সেরকম কোনও সম্পর্ক ছিল না। আপনি বুদ্ধিমান ছেলে, নিজে গোয়েন্দাগিরি করেন, তাই যদি কিছু সাহায্য করতে পারেন এই কেসে…”

পেটের গুড়গুড়ানিটা কমছিল ধীরে ধীরে। সাহস করে জিজ্ঞেস করলাম, “কখন খুন হলেন দেবাশিসদা? কীভাবে?”

“সব বলব, তার আগে আপনি কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন। দেবাশিসবাবুর সঙ্গে আপনার প্রথম আলাপ কতদিন আগে?”

“বছর দু-এক… ২০১৬-র জুন মাসে আমি প্রথম ওঁর বাড়ি যাই।”

“মানে পুরো দুবছর। তা যোগাযোগ হল কীভাবে?”

“আমি আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। সেটা দেখেই দেবাশিসদা আমায় ডেকে কেস দেন। আমার প্রথম কেস।”

“কী কেস?”

“ওঁর বউকে ফলো করার। উনি সন্দেহ করছিলেন, ওঁর বউ অন্যের সঙ্গে প্রেম করে। প্রমাণ পাচ্ছিলেন না। আমি ওঁর বউকে সাতদিন ফলো করে গোপন ক্যামেরার ছবি তুলে ওঁকে দিই। সেই ছবির সূত্রেই নাকি উনি ডিভোর্স কেসটা ফাইল করছিলেন।”

“কী ছবি তুলেছিলেন?”

“ওঁর স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর কলিগের ছবি। সাউথ সিটিতে, ভিক্টোরিয়ায়… একটা চুমু খাওয়ার ছবিও তুলেছিলাম।”

“বাঃ, বেশ করেছিলেন। আপনি ওঁর স্ত্রীর নাম জানেন?”

“হ্যাঁ, অপর্ণা গুহ।”

“আর ওই প্রেমিকের নাম?”

“সুতনু ব্যানার্জি।”

“আপনি ওঁর স্ত্রীকে চিনলেন কী করে? ওঁর বাড়িতে দেখেছিলেন?”

“না, দুদিন গেছি ওঁর ডিভোর্সের আগে। বউদি বাড়ি ছিলেন না। আমাকে দেবাশিসদা বউদির ছবি দিয়েছিলেন।”

“আচ্ছা, কেস নেওয়ার আগে যে ক্লায়েন্টের বিষয়েও খোঁজ নিতে হয়, সেটা কি আপনার জানা আছে গোয়েন্দা মশাই?”

“মানে?”

“মানে আপনার ক্লায়েন্ট, দেবাশিস গুহকে নিয়ে কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন কি?”

“না… মানে…”

“নাকি, আপনি সেই… আমি দোকানদার, খদ্দের আমার ভগবান… এই নীতিতে বিশ্বাস করেন?”

এবার বেজায় রাগ হল। প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলে যা খুশি বলে যাবে নাকি?

“কী বলতে চান পরিষ্কার করে বলুন তো!”

“পরিষ্কার করে শুনে রাখুন”, ভদ্রলোকের গলায় এখন বেশ ধার, যদিও মুখটা হাসি হাসি, “এখনও আপনার সামনে অনেক পথ চলা বাকি। এরপর থেকে কোনও কেস এলে আগে ক্লায়েন্ট সম্পর্কে খোঁজ নেবেন। এখানেও যদি খোঁজ নিতেন তবে জানতেন, আপনার সঙ্গে আলাপের দেড় বছর আগে ২০১৪-তে অপর্ণা গুহ তাঁর স্বামীর নামে চন্দননগর থানায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশের কাছে এসে হাতে পায়ে ধরে দেবাশিস গুহ রক্ষা পায়। তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল রেড লাইট এরিয়ার, আমাদের কাছে খবর আছে। মুচলেকা দেবার পরও বউয়ের ওপর অত্যাচার কমেনি। সে বেচারি ২০১৬-র শুরুতে আর না পেরে বাপের বাড়ি থাকা শুরু করে। আর হ্যাঁ, ডিভোর্সের কেসটা অপর্ণাই করেন, দেবাশিস না। দেবাশিসবাবু খুব চেষ্টা করেছিলেন কেসটা যাতে না হয়। হলে তো খোরপোশ দিতে হবে… মানে আপনি যখন দেবাশিসবাবুর বাড়ি গেছিলেন, তখন অলরেডি কেস এবং সেপারেশান চলছে।”

মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। “তাহলে আমাকে পয়সা দিয়ে অ্যাপয়েন্ট করার মানে কী?”

“সেটাই তো আমরাও জানতে চাইছি। সেপারেশান চলাকালীন সুতনু ব্যানার্জির সঙ্গে অপর্ণার একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখন ওরা বিয়ে করে সুখে সংসার করছে। জানেন সেটা?”

মাথা নাড়লাম। জানি না। জানার কথা মাথাতেও আসেনি। ছবি তুলে দেবার পর সেটা নিয়ে দেবাশিসদা কী করেছেন জানার আগ্রহ হয়নি। উনি যখন যা বলেছেন বিশ্বাস করে গেছি।

“এবার বলুন দেখি, যার ডিভোর্স কেস চলছে সে আবার নতুন করে বউ-এর পিছনে গোয়েন্দা লাগাবে কেন?”

“হয়তো কেস জোরদার করতে… ওঁর মনে হয়েছিল স্ত্রীর সঙ্গে অন্য পুরুষের সম্পর্ক আছে প্রমাণ করতে পারলে কেসটা ওঁর পক্ষে জোরদার হবে।”

অফিসার এবার সোজা আমার চোখে চোখ রেখে তাকালেন। তারপর বললেন, “কাদাটা ঘাঁটব না ভেবেছিলাম। ঘাঁটতে বাধ্য করলেন। কিছুই যখন জানেন না, এটাও নিশ্চয়ই জানেন না যে দেবাশিস গুহর বিরুদ্ধে অপর্ণা গুহর অভিযোগ ঠিক কী ছিল। দেবাশিস ওঁকে বাধ্য করতেন দেবাশিসের বন্ধুদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে। অপর্ণার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। আর… আর নিজে সেইসব ছবি তুলে রাখতেন। সে তুলনায় আপনার তোলা ছবি তো নস্যি… ও দিয়ে কী হবে?”

আমি চুপ।

অফিসার এবার একেবারে কেটে কেটে বললেন, “বুঝতেই পারছেন, ডিভোর্সের ব্যাপারটা একেবারে বাহানা ছাড়া কিছু না। আপনার মতো আনাড়ি গোয়েন্দা ছাড়া যে কেউ দুদিনে ধরে ফেলত। হয়তো সেজন্যেই আপনাকে ডেকেছিলেন। জানতেন আপনি ধরতে পারবেন না। প্রথম ক্লায়েন্ট পেয়ে আনন্দে উদ্বাহু হয়ে নাচবেন। কত টাকা নিয়েছিলেন এই কাজের জন্য?”

“দশ হাজার”, মিনমিন করে বললাম।

“রসিদ দিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ।”

“গুড। যাই হোক, আমি আবার আমার প্রশ্নটা করছি, ভালো করে ভেবে জবাব দিন। কী মনে হয়, এত গোয়েন্দা থাকতে ঠিক কেন আপনাকেই ডেকেছিলেন দেবাশিস গুহ?”

নবম পরিচ্ছেদ— করিন্থিয়ান থিয়েটার

(সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয় পত্রিকায় প্রকাশিত চিঠি, ১৮.১১.১৮৯২)

মহাশয়,

আপনার ৩০শে অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত একটি পত্রে জনৈক শ্রী হরিদাস সাহা সর্ব্বরী মহাশয় কলিকাতাস্থিত করিন্থিয়ান থিয়েটারের বিষয়ে মন্তব্য করিয়াছেন, “ইহার মালিক কোন লণ্ডনের সাহেব হইতে পারেন।” ইহা সম্পূর্ণরূপে ভুল তথ্য। ভারতবাসীগণের গর্বের বিষয় ইহা কোন সাহেব কর্তৃক স্থাপিত নহে, নিতান্ত এক স্বদেশীয় ব্যবসায়ী ইহার স্থাপনা করিয়াছেন। তাঁহার নাম জামসেদজি ফ্রামজি মাদান। যতদূর জানিতে পারিয়াছি, এই মাদানের জন্ম সিপাহী বিদ্রোহের সালে, ২৭ এপ্রিল বোম্বের এক পারসী পরিবারে। পারিবারিক দারিদ্র্যের কারণে মাত্র এগারো বৎসর বয়সে তিনি বিদ্যালয়ের পাট চুকাইয়া এলফিনস্টোন ড্রামাটিক ক্লাবে প্রপ বয়ের চাকুরি লন। ১৮৭৫ সালে ইহা অ্যামেচার থিয়েটার হইতে প্রফেশনাল থিয়েটারে পরিণত হইলে বোম্বে ত্যাগ করিয়া গোটা ভারতবর্ষ ঘুরিয়া ঘুরিয়া ইহারা নাট্য প্রদর্শন করিতেন। ১৮৮২ তে মাদান স্বয়ং থিয়েটারের সংস্রব ত্যাগ করিয়া করাচীতে একটি ব্যবসা শুরু করেন। শোনা যায় ওই বৎসরই তিনি কলিকাতায় চলিয়া আসেন। কলিকাতায় আসিয়া চাঁদপাল ঘাটে জাহাজে মাল আমদানী রপ্তানীর গুদাম কিনেন। এক্ষণে ভাগ্যলক্ষ্মী মাদানের সহায় হন। কিন্তু আফিম সংক্রান্ত কিছু গণ্ডগোলের সূত্রপাত হওয়ায় তিনি অন্য ব্যবসার দিকে মনোনিবেশ করেন। তদুদ্দেশ্যেই প্রখ্যাত করিন্থিয়ান হলটি খরিদ করিয়া তিনি থিয়েটারের রূপদান করেন এবং করিন্থিয়ান থিয়েটার নাম প্রদান করেন।

এই থিয়েটারটি এক্ষণে পারসী নাট্য-গীত চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। শুধু তাহাই নহে সাহেবগণও এই থিয়েটারে আপনাপন কসরত দেখাইতে ব্যগ্র। এই থিয়েটার অন্যান্য দেশীয় অপেরা এবং থিয়েটার অপেক্ষা শতগুণে উত্তম। ইহাতে প্রবেশ করিলে ধরায় অমরাভ্রম হইয়া থাকে। কলিকাতায় এই একটিমাত্র থিয়েটার যাহাতে বৃহৎ টানাপাঙ্খার ব্যবস্থা থাকায় প্রখর গ্রীষ্মেও দর্শক সাধারণের কিঞ্চিন্মাত্র অসুবিধার সৃষ্টি হয় না।

এদানি শুনা যাইতেছে লন্ডনের বিখ্যাত বাজিকর কার্টার সাহেব অতি শীঘ্র এই থিয়েটারে আসিয়া আপন জাদুবিদ্যা প্রদর্শন করিবেন। কার্টার সাহেব বিশ্বের সেরা জাদুকর বলিয়া খ্যাত এবং উহার “পলায়নী বিদ্যা” যাহারা দেখিয়াছে, বলিয়াছে এমনটি আর হয় না। আপামর কলিকাতাবাসী এই অপূর্ব ঘটনার সাক্ষী হইবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করিতেছে।

শ্রী মহেন্দ্রনাথ দত্ত

সিমলা, কলিকাতা

Leave a Reply to Shariful islam sajal Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *