পঞ্চম অধ্যায় – দেশভাগ

পঞ্চম অধ্যায়

উদ্দেশ্য সিদ্ধির ক্ষেত্রে শোভান সাহেবকে প্রতিবন্ধক বুঝে দোহা সাহেবকে তাঁর স্থলে কলিকাতায় ডেপুটি কমিশনার করে আনা হ’ল। কিন্তু এঁকেও আমি উগ্র সাম্প্রদায়িক বলতে রাজি নই। এঁকেই আবার পরে বহু বদনামের ভাগী হতে হয়েছিল।

অন্যদিকে-প্রত্যক্ষ-সংগ্রাম বা মহাদাঙ্গার নায়ক জনাব নাজিমুদ্দিন হলেও সুরাবর্দি সাহেবকে তার জন্য দায়ী করা হয়। ইংল্যাণ্ডে অবস্থানকালে নাজিমুদ্দিন সাহেব ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁর ভারতে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই প্রত্যক্ষ-সংগ্রাম শুরু হবে। সুরাবর্দি সাহেব তৎকালীন অবস্থার ক্রীড়ানক হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি পূর্ব-মত হতে ফিরে এসে বাংলাকে অখণ্ড রাখার মানসে গান্ধীজীরও শরণ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার গণ-উন্মাদনায় তাঁর ও শরৎচন্দ্র বসুর সকল শুভ-প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।

[সকলের ভয় হয় যে তাহলে বিহার ও অন্যান্য রাজ্য হতে মুশ্লিমদের এনে পশ্চিমবঙ্গকেও মুশ্লিম-প্রধান করা হবে এবং হিন্দু-বাঙালীদের উদ্বাস্তু করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো হবে। বাঙালীরা নিজ বাসভূমে পরবাসী হয়ে থকেবে।]

কেবলমাত্র জিন্না সাহেবকে সর্ববিষয়ে দায়ী করা অন্যায়। ঐতিহাসিক কারণে দাহা উপাদান সমূহ স্তূপীকৃত অবস্থায় ছিল, তিনি তা উদ্বেলিত করে অগ্নিসংযোগ করেছিলেন। ভুল ইতিহাস পঠন-পাঠনই ভ্রান্ত-ধারণার জন্য দায়ী। বহিরাগত ধর্মান্ধ ও বিদ্বেষপরায়ণ মুষ্টিমেয় মুশ্লিম-সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ দেখে সকল দায়িত্বভার ধর্মপরায়ণ বিপুল সংখ্যক মুশ্লিম-সমাজের উপর ন্যস্ত করে তাঁদের অযথা দোষারোপ করা হ’ত। অথচ ধর্মপরায়ণ গরিষ্ঠ মুশ্লিম-সমাজকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের বীরত্ব ও ঐতিহ্য সম্বন্ধে অবহিত না করে বরং বঞ্চিত করা হয়েছে। সেই সময় এক অদ্ভুত মতবাদ প্রচারিত হতে থাকে: বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমান দুই’ পৃথক জাতি। কিন্তু ভিন্নভাষী ও ভিন্নরক্ত হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবি শিখ ও পাঞ্জাবি মুশ্লিম একজাতি। অথচ খৃষ্টান হলেও জার্মান ও ইংরাজ দুই জাতি। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতার জন্য উভয় সম্প্রদায়ই শিকার হয়েছিলেন। এই সুযোগে ইংরাজরা সাম্রাজ্য-রক্ষার শেষ হাতিয়ার হিসাবে কলকাতার মহা-নিধনযজ্ঞ তথা গ্রেট ক্যালক্যাটা কিলিঙের ব্যবস্থা করলেন। সেজন্য দীর্ঘদিন যাবৎ নির্লজ্জের মতো তাঁদের প্রস্তুত হতে হয়েছিল। নিম্নে তার একটি ক্রমিক-তালিকা পেশ করা হ’ল।

প্রস্তুতি-পর্ব

এক. কলিকাতা পুলিশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ডেপুটি পুলিশ কমিশনারদের নিজস্ব এজলাস ‘রিপোর্ট সিস্টেম’ বাতিল করা হ’ল। একমাত্র আমি সংশ্লিষ্ট পুলিশ-সভায় এর প্রতিবাদ করি। আমাকে সমর্থন জানান বাংলা-পুলিশ থেকে সদ্য আগত ডেপুটি কমিশনার দোহা সাহেব। তখনও পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের মধ্যে না-থাকায় তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষদের ওই সভায় বলেছিলেন: ‘কলকাতা-পুলিশে এই সিস্টেমটাই সববেয়ে ভালো জিনিস।’ জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী হবে জেনেও কমিশনারগণ ওটা বাতিল করবার জন্য গভর্নমেন্টের কাছে প্রতিবেদন পাঠালেন।

[বিঃ দ্রঃ-প্রশাসনিক অদল-বদল সুবিবেচনার সঙ্গে না করলে প্রভূত ক্ষতি হয়। এই ভুল লক্ষ্মণসেন প্রথম করেছিলেন মহাসামন্ত পদগুলি বিলোপ সাধন করে। ফলে তদারকির অভাবে অধীনস্থ সামন্ত রাজারা তাঁর আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। এই ভুল বহুদিন পরে কলিকাতা পুলিশের ‘রিপোর্ট সিস্টেম’ বাতিল করে দ্বিতীয় বার করা হ’ল। ফল হ’ল এই-যে পুলিশের উপর থেকে জনগণ আস্থা হারালো। দৈনিক তদারকির অভাবে অসাধুতা ও স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যায়।]

দুই. থানাওয়ারী সিভিক-গার্ডদের হঠাৎ বাতিল করা হ’ল। এদের ভিতরকার হিন্দু ও মুশ্লিম সদস্যরা অসম্প্রদায়িক ছিল। এরা পল্লীতে-পল্লীতে সক্রিয় থাকলে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিছুতেই হতে পারতো না। যুদ্ধ বন্ধ হলেও এদের স্থায়ী করার যে প্রস্তাব ছিল তা অগ্রাহ্য করে সকলকেই বাতিল করা হয়।

[এদের বিদায় সভায় পুলিশ কমিশনার যে ভাষণ দেন সেটি আমি ইংরাজী হরফে বাংলা ভাষায় লিখে দিয়েছিলাম।]

তিন. থানা-ইনচার্জদের মধ্যে তখনও অধিকাংশ হিন্দু। বহু মুশ্লিম অফিসারকে দ্রুত ভর্তি করা হলেও তখনও তারা জুনিয়র। সিনিয়রদের টপকে তো তাদের ইনচার্জ করা যায় না সেজন্য প্রতি তিনটি থানার উপর একজন ডি. ডি. ওয়ান ইনস্পেক্টরের পদ সৃষ্টি করা হ’ল। বাহ্য উদ্দেশ্য—অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ও ইনভেস্টিগেশন পৃথক করা। কিন্তু মহাদাঙ্গার মধ্যেই এই অবান্তর ডি. ডি. ওয়ান প্রথা বাতিল করা হয়। হিন্দু অফিসারদের প্রমোশন দিয়ে গোয়েন্দা বিভাগের ইনস্পেক্টর কিংবা উপরোক্ত ডি. ডি. ওয়ান ইনস্পেক্টর করে থানা হতে সরিয়ে প্রায় প্রতি শূন্যস্থানে জুনিয়র মুশ্লিম কর্মীদের ইনচার্জ করা হয়েছিল। স্বল্পকালীন চাকুরির জন্য স্বভাবতই এরা অনভিজ্ঞ। অন্তত মহাদাঙ্গা থামানোর মতো অভিজ্ঞতা এদের কারোরই ছিল না।

[কিন্তু তখনও কলিকাতা পুলিশে কোনও সাম্প্রদায়িক বোধ অংকুররূপেও দেখা দেয় নি। সমগ্র পুলিশ-বাহিনী নিজেদেরকে পৃথক পুলিশ-সম্প্রদায় বলে মনে করতো।]

চার. উপরোক্ত কারণে বিহার ও পাঞ্জাব হতে বহু মুশ্লিম-অফিসার এবং সেই সঙ্গে সশস্ত্র পাঠান পুলিশ-বাহিনীকে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে কলিকাতা-পুলিশ-বিভাগে আমদানী করা হ’ল। কারণ আর-কিছু নয়, বাঙালী মুশ্লিম পুলিশ-অফিসারদের অনেককেই সংশ্লিষ্ট পক্ষ বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। দোহা সাহেবকে লালবাজারে অতিরিক্ত হেড কোয়ার্টারস-এ ডেপুটি করা হ’ল। এই পদটি তখনই প্রথম তৈরি করা হয় এবং দাঙ্গার পর বাতিল করা হয়।

পাঁচ. ট্রাম-কোম্পানীর অনুকরণে লালবাজারে প্রথম কণ্ট্রোল-রুম স্থাপিত হ’ল। ইনচার্জদের বলা হ’ল যে কন্ট্রোল-রুম থেকে হুকুম না এলে কোথাও যেন ফোর্স পাঠানো না হয়। উদ্দেশ্য—ঠিক সময়ে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা। অধিকাংশ হিন্দু অফিসার ও অন্য কর্মীদের কন্ট্রোল-রুমে এনে জড়ো করা হ’ল।

উদ্যোগ-পর্ব এইভাবে পরিকল্পনা মতো সুসম্পন্ন করা হয়। কিন্তু সকল ঊর্ধ্বতন ইংরাজ-অফিসার এতে সম্মতি দেন নি। তাঁরা একে-একে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন।

কমিশনার ফেয়ার ওয়েদার সাহেব হঠাৎ চলে গেলে তাঁর স্থলে রে (Rey) সাহেব স্বল্পকালের জন্য আসেন। তাঁর পরে পুলিশ-কমিশনার হয়ে এলেন হার্ডিক সাহেব। কার্য উদ্ধারের জন্য এ কেই উপযুক্ত ব্যক্তি মনে করা হয়। অন্যদিকে—দরদী অস্ট্রেলিয়ান গভর্নরকে বিদায় দিয়ে তাঁর স্থলে বারোজ সাহেবকে নিযুক্ত করা হ’ল।

তকাল কলিকাতা উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগে বিভক্ত ছিল। এবার মধ্য বিভাগ সৃষ্টি করে একজন মুশ্লিম ডেপুটির অধীন করা হ’ল। উত্তর বিভাগটি পূর্ব হতেই জনৈক মুশ্লিম ডেপুটির অধীন ছিল।

কলিকাতায় মহাদাঙ্গা বাধানোর অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল। সম্ভবত সমগ্র ভারতে ওঁরা অনুরূপ একটি দাঙ্গা বাধাতে চেয়েছিলেন। তৎপূর্বে ফিলার (Feeler) দ্বারা তার ফলাফল বোঝাবার জন্য ল্যাবরেটরি পরীক্ষার প্রয়োজন হয়। কলিকাতা শহর বস্তুত একটি মিনিয়েচার ইণ্ডিয়া, এখানে হিন্দু-মুসলমান-শিখ-খৃস্টান-বৌদ্ধ-অচ্ছুৎ প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষাভাষী লোকের বাস। ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৃষ্টির বিচিত্র সমন্বয় সাধন এই শহরেই। বিশাল ভারতের সামান্যতম ভূ-ভাগ এই শহরে সত্তর ভাগ হিন্দু এবং তিরিশ ভাগ মুশ্লিম বাস করে। এজন্য শহর-সীমানার বাইরে হাওড়া ব্যারাকপুর ও বারাসাত প্রভৃতি স্থানে দাঙ্গা বাধে নি। পরীক্ষা দ্বারা কর্তৃপক্ষ বুঝতে চাইছিলেন যে সঙ্ঘবদ্ধ প্রস্তুতিপূর্ণ লড়াকু মুশ্লিম সংখ্যা-লঘুর আক্রমণ অন্যপক্ষ কতো শীঘ্র প্রতিরোধে সমর্থ হয়। ওই বিপদে হিন্দু-শিখ-মাদ্রাজী-ওড়িয়া মারাঠী প্রভৃতি অ-মুশ্লিম সম্প্রদায় একত্রিত হয় কিনা! সমগ্র দেশব্যাপী দাঙ্গা বাধালে তার ফলাফল বুঝতে এটি তাঁদের জরুরি পরীক্ষা। কলিকাতা দাঙ্গার ফল প্রভুদের আশানুরূপ হয় নি। হিন্দুরা বারো ঘণ্টার মধ্যে প্রতিরোধ-দল তৈরি করে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়। হিন্দু শিখ বাঙালী মারাঠী মাদ্রাজী গুজরাটী প্রভৃতি সকল হিন্দু এক হয়। অন্যদিকে বাঙালী মুশ্লিমরা উসকানি সত্ত্বেও সক্রিয় অংশ নিল না। বিপাক বুঝে ব্রিটিশ এই মহাদাঙ্গা থামাতে শহরে মিলিটারি নামালেন। এও স্থির করলেন যে তাহলে দেশটা বিভক্ত করতে হবে। তাঁরা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন যে হিন্দু-মুশ্লিম পরস্পরকে লড়িয়ে দিয়ে সাম্রাজ্য রক্ষা আর সম্ভব নয়। লীগ-নেতারা ব্রিটিশ ও মুশ্লিমদের সমবেত শক্তির বিরুদ্ধে হিন্দুদের জয়ী হতে দেখে, শংকিত হয়ে, পাকিস্তানের দাবিতে আরও স্বোচ্চার হলেন। রাজনীতিকে ধর্মান্ধতার পংকিল আবর্তে ডুবিয়ে তখন এক নতুন মানসিকতার সৃষ্টি করা হয়েছিল।

জনৈক কায়স্থ অফিসার

দুজন মুশ্লিম-কর্মী অফিস-বিলডিঙের একস্থানে হঠাৎ নমাজী হয়ে জায়গাটিকে নমাজের স্থান করে নিয়েছিল। উক্ত অফিসার-ভদ্রলোক একদিন তাঁর সহকারী মুশ্লিম-কর্মীটিকে বললেন, ‘এতদিন যা হয় নি তা করতে আমি দেবো না। অফিসের সময়ে পুলিশ-কর্মীদের এই ওজুহাতে ঘুরে বেড়ানোও চলবে না।’ সহকর্মীটি ইংরাজ-কমিশনারের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। ইংরাজ-কমিশনার অফিসারকে ডেকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘আপনার জানা উচিত, কারো ধর্মে হস্তক্ষেপ করলে আমরা তা বরদাস্ত করব না।’ তিনি মাথা হেঁট করে ফিরে এলেন। কিন্তু কায়স্থ বুদ্ধি! পরদিন তিনি অফিসে এসে দুপুরবেলা ইউনিফর্ম ছেড়ে পটু-বস্ত্র ও নামাবলী পরিধান করলেন এবং টেবিলের উপর রাখা কোষাকুষি হতে গঙ্গাজল ছিটিয়ে কুশাসনে উপবিষ্ট হয়ে জোরে জোরে মন্ত্র আউড়ে পূজা শুরু করে দিলেন: ‘ওঁ। ভূরভূরবো ওঁ।’ অফিসে মন্ত্রোচ্চারণ শুনে সকলে দৌড়ে এলেন। তিনি তাঁদের যেতে বলে ঘোষণা করলেন, ‘খবরদার! আমার মধ্যাহ্ন-আহ্নিকের সময় বিরক্ত করো না। ওঁ ভূরভূরবো ওঁ…।’ তাঁকে কমিশনার সাহেবের কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলে তিনি পালটা অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘স্যার, এঁরা আমার ধর্মে হস্তক্ষেপ করেছে। আপনি বিচার করুন।’

কমিশনার সাহেব সব-কিছু বুঝতে পারলেন, হেসে বললেন, ‘তোমরা ভুলে যেও না যে তোমরা হাজার-হাজার বছরের সভ্যতার উত্তরাধিকারী।’ অবশ্য এ-কথাও তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে এই সাহস অন্যত্র দেখালে উনি কনডেমেনড ও সাসটেনডেনড না হয়ে পুরস্কার পেতেন।

[একবার এক কনস্টেবল নিহত হলে অন্য কনস্টেবলরা ক্ষেপে গিয়ে সংশ্লিষ্ট বস্ত্রের দোকানটি লুঠ করে। তাতে ইংরাজ ডেপুটি কমিশনার স্বয়ং থানা-বাড়ি ও কোয়ার্টারগুলি তল্লাসী করেন। এক কনস্টেবলের কক্ষে ঢোকামাত্র ডেপুটি-সাহেব চিৎকার করে পিছিয়ে গিয়ে বলেন, ‘পুট অন ইওর ক্লথস্।’ কনস্টেবলটি নাঙ্গা অবস্থায় পিস্তল ও মদের বোতল হাতে নিয়ে তাঁকে বলেছিলেন, ‘উঁহু প্রাইভেট কোয়ার্টার-এ এভাবেই আমার থাকা অভ্যেস।’]

বস্তুত, দেশ-বিভাগের পূর্বে অফিসের টেবিলগুলি পর্যন্ত বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, তখনও জাতিধর্ম-নির্বিশেষে বহু পুলিশ-কর্মী অসম্প্রদায়িক ছিল। প্রত্যক্ষ-সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর কিছু ক্ষেত্রে এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম

ছুটি ঘোষণা করায় মুশ্লিমরা গড়ের মাঠে বিরাট সভার আয়োজন করলো। হিন্দুরা আতংকগ্রস্ত হলেও সাংঘাতিক কিছু ঘটার আশংকা করে নি, সেজন্য কোনও রকম প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজনও বোধ করে নি। আমরা গোয়েন্দা-বিভাগের কর্মী হওয়ায় আমাদেরও ছুটি। রসা রোডের বার-বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখছিলাম একটি মুশ্লিম প্রসেশন ঝান্ডা উঁচিয়ে মাঠের দিকে চলেছে আর ক্ষুদ্র এক উৎসুক হিন্দু জনতা তার পিছন পিছন। মিছিল থেকে ধ্বনি উঠছিল: ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।’ অনুসরণকারী হিন্দু-বালকেরা উত্তর দিচ্ছিল: ‘নেহী দেঙ্গে পাকিস্তান। নেহী দেঙ্গে পাকিস্তান।’ বস্তুত পাকিস্তান শব্দটিই তখন হিন্দু বাঙালীকে প্ররোচিত করার পক্ষে যথেষ্ট। মাত্র এক পুরুষ পূর্বে এই হিন্দুরাই বঙ্গ-ভঙ্গ রদের জন্য প্রাণপাত করেছে। সেদিনের স্মৃতি কি সহজে কেউ বিস্তৃত হয়?

মিছিল দূরে চলে গেলে হঠাৎ একটা লণ্ড-ভণ্ড কাণ্ড নজরে পড়লো। পথচারীদের মধ্যে সন্ত্রস্ততা। বহুলোককে এদিকে-ওদিকে ছুটতে দেখি। ব্যাপার কি বুঝতে পারি নি। শহরের প্রতিটি মহল্লা শূন্য করে মুশ্লিম জনতা মাঠে জমায়েত হয়। সেখানে লীগ-মন্ত্রীবৃন্দ ও মুশ্লিম নেতৃবর্গ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন খবরের কাগজে তা প্রকাশ পায় নি। কোনও স্পেশাল ব্রাঞ্চ বা অন্য কোনও গোয়েন্দা-কর্মী অথবা খবরের কাগজের রিপোর্টরা ওখানে যেতে সাহস পান নি। একমাত্র ভারত-সরকারের গোয়েন্দা-কর্মী প্রফুল্ল মণ্ডল বুদ্ধি করে মাথায় গামছা বেঁধে, লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে, কোমরে ছুরি গুঁজে যথারীতি বরিশালের বুলি আউড়াতে-আউড়াতে ছদ্মবেশী মুশ্লিম সেজে ওখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যকই ওই সভায় যোগদান করেছিলেন। তাঁরা উদ্বেগজনক খবর পাওয়ায় সেই সময় পরিবারবর্গকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে ব্যস্ত। আমিও টেলিফোনে কিছু আত্মীয়-স্বজনকে পার্ক সার্কাস অঞ্চল থেকে অন্যত্র সরে যেতে বলি। কারণ পুলিশ ও সৈন্যদল লীগ-গভর্নমেন্টের আয়ত্তে, তাদের সাহায্য লাভ তখন আশার অতীত ছিল।

লীগ-নেতারা সভাস্থলে উত্তেজনা সঞ্চার করে সরাসরি নির্দেশ দিয়েছিলেন: ‘যাও, আপনা-আপনা মহল্লা বাঁচাও। হিন্দুলোক শুরু কর্ দিয়া।’ গুণ্ডাদের পারিবারিক প্রীতি অল্প, বরং লুঠপাটের দিকেই তাদের মনোযোগ বেশি। ইংগিত ও নির্দেশ পেয়ে তারা পথের দুধারে দোকানগুলি লুঠ করে আগুন ধরিয়ে এগিয়ে চললো। রাতের অন্ধকারে মহাদাঙ্গা ওরাই শুরু করে দিলে। কমলালয় প্রভৃতি বড়ো-বড়ো প্রতিষ্ঠানগুলি লুঠের পর চৌরঙ্গীতে বন্দুকের দোকানগুলিও লুণ্ঠিত হ’ল। চতুর্দিকে শুধু আগুন আর চিৎকার। নারী আর নারীদের করুণ আর্তনাদ। দোকানগুলির দুয়ার ভাঙার খটখট শব্দ আর লুঠেরাদের সহর্ষ উল্লাসধ্বনি। ভয়ার্ত নরনারী থানায় ফোন করলে তাদেরকে লালবাজারে কণ্ট্রোল-রুমে যোগাযোগ করতে বলা হয়। কলিকাতা নিধন যজ্ঞে যে বর্বরতা দিল্লিতে নাদিরশাহী হত্যাকাণ্ডকেও লজ্জা দেয়। সুপরিকল্পিতভাবে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হ’ল। এ অবস্থায় নিয়ম-শৃংখলার অজুহাতে আমরা তিনজন কিন্তু নীরব থাকতে পারি নি।

আমি, হীরেন্দ্রনাথ সরকার ও সত্যেন্দ্র মুখার্জি কলিকাতা পুলিশের একটি বিশেষ আঁতাতের অন্তর্ভুক্ত ছিলাম। হীরেন্দ্র সরকার ও সত্যেন্দ্র মুখার্জি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। দাঙ্গার মধ্যে এসে এঁরা দুজন রাত্রিবেলা আমাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিলেন সঙ্গী হিসাবে। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাকে সমীহ না-করে আমরা তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে তখন বেরিয়ে পড়েছিলাম। কখনও প্রধান সড়কে পল্লীর অভ্যন্তরে উল্কার মতো জিপ-গাড়ি ছুটিয়ে গুলিবর্ষণ করে ওই রাত্রিটা যথাসম্ভব সামাল দিয়েছিলাম। এই সুযোগে একপক্ষের অতর্কিত আক্রমণে বিহ্বল অন্যপক্ষ তৈরি হতে পারলো। আমরা তখন উভয়পক্ষকে তফাৎ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সারকুলার রোডের পূর্বপার হতে এতক্ষণ ধ্বনি ছিল শুধু—‘আল্লা হো আকবর।’ এবার পশ্চিমদিক হতে শোনা যেতে লাগল—‘বন্দে মাতরম।’ কন্ট্রোল-রুমে কিছু আগে পর্যন্ত শুধু হিন্দু-নাগরিকদের একতরফা টেলিফোন আসছিল: ‘হ্যালো কণ্ট্রোল-রুম! শীঘ্র আসুন। আমরা মৃত্যু-মুখে। রক্ষা করুন।’ লীগ-মন্ত্রীরা কণ্ট্রোল-রুমে বসে নীরবে তা শুনছিলেন। এইবার মুসলিমদেরও একটানা আহ্বান আসতে লাগল। শুধু তাই নয় টেলিফোনে সকল শ্রেণীর নাগরিকদের করুণ আর্তনাদ। ইংরাজ কর্তৃপক্ষ তখনও নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকলেও লীগ-নেতারা হতভম্ব। এ কী হ’ল? এ যে প্রবল পাল্টা আক্রমণ! নিজ-নিজ বাড়ির ভাবনায় তাঁরা বিব্রত হয়ে উঠলেন। যে ঘৃণ্য অপশক্তিকে তাঁরা জাগ্রত করেছেন তার ভয়াবহ প্রসার ও ক্ষয়ক্ষতি সম্বন্ধে বিচলিত। বাস্তবিক উভয় সম্প্রদায় তখন মহা-তাণ্ডবে মেতেছে। আমরা তিনজনে যতদূর সম্ভব, বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এই তাণ্ডব সংহত করার চেষ্টা করেছি।

[সেই রাত্রে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও ফজলুল হক সাহেব ব্যতীত অন্য কোনও লীগ বা কংগ্রেসী নেতাকে আমরা রাজপথে দেখি নি। ওঁরা উভয়ে একত্রে উত্তেজনা শাস্ত করার জন্য পথে-পথে ব্যর্থ• অনুরোধ করছিলেন। সে-রাত্রে পথে জনগণ কোথায়, শুধু গুণ্ডাদেরই তাণ্ডব নৃত্য। বাঙালী মুশ্লিমরা তাতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ না-করলেও বাঙালী হিন্দুদের মতো তাঁরাও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হন।] পরদিন কর্তৃপক্ষ সব-কিছু বুঝে হীরেন্দ্র সরকার ও সত্যেন্দ্র মুখার্জিকে কণ্ট্রোলরুমে আটক করে ফেললো। তার মানে তাঁদের দুজনকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হ’ল।

আমি বা আমার মতো অনেকের খোঁজ-খবর কেউ আর রাখে না। সেই সময়ে আমি, মহুম্মদ মহসীন, নীহার রঞ্জন বর্ধন ও দিনেশচন্দ্র চন্দ এক-পল্লীতে বাস করতাম। এই চারজনে একত্রিত হয়ে তখন পরামর্শ করলাম। পরামর্শ মতো আমরা চার বন্ধু-অফিসার ব্যক্তিগত মুনিফর্ম ও পিস্তলে সজ্জিত হয়ে অধীনস্থ কয়জন কর্মীকে সংগ্রহ করে এক দল তৈরি করলাম। তারপর শ্রীজয়দাকারের নিকট হতে আটখানি বাস সংগ্রহ করে আমরা শহরে বেরুলাম। আমরা চারদিন ধরে দিনরাত্র হিন্দু এলাকা হতে মুশ্লিমদের এবং মুশ্লিম এলাকা হতে হিন্দুদের উদ্ধার করে স্থানান্তরিত করেছিলাম।

পথে-ঘাটে তখন উভয় সম্প্রদায়ের সংখ্যাহীন মৃতদেহ। কাউকে অস্ত্রাঘাতে কাউকে ঠেঙিয়ে মারা হয়েছে। পথ এমন অবরুদ্ধ যে গাড়ি থেকে নেমে মৃতদেহগুলি দুপাশে সরিয়ে তবে এগোন যায়। চতুর্দিকে দগ্ধ গৃহ ও গৃহহীনদের করুণ দৃশ্য। থানাগুলির বেষ্টনীর মধ্যে বহু পরিবার তখন আশ্রয় নিয়েছে।

পথে দুটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমাদের বাসগুলি থামাতে হ’ল। চাঁদনি-মার্কেটের ঘাঁটি হতে মুশ্লিম-গুণ্ডারা অতর্কিতে বার হয়ে পথচারী হিন্দুদের ছুরিকাঘাত করে ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। অ্যাংলো-ইণ্ডিয়ান পথচারীগণ ছুরিকাঘাত সত্ত্বেও যারা জীবিত তাদের হাসপাতালে বহন করছে। প্রতি ঘটনার পর ত্বরিত গতিতে ঘাঁটিতে ফিরে তারা চিৎকার করে উঠছিল: ‘লঢ়ি তগদীর লঢ়ি তগদীর।’ কিন্তু ওরা ভুল করে বাঙালী মুশ্লিমদেরই বেশি ছুরিকাঘাত করছিল। বেশভূষায় বাঙালী মুশ্লিম নাকি হিন্দু চেনার ক্ষমতা ওদের ছিল না।

এর ঠিক উলটো দিকের গলির পার্শ্ববর্তী খাটালটি দেহাতীদের একটা ঘাঁটি। কর্পোরেশন স্ট্রীট হতে একজনকে ধরে সেখানে পুরে তারা চিৎকার করছিল: ‘ব্রজরঙবলী-কি জয়।’ খানিকক্ষণ ধপাধপ শব্দের পর নীরবতা। তারপর একটি করে মৃতদেহ ধর্মতলা স্ট্রীটে ফেলে দিয়ে তারা স্বস্থানে ফিরে যাচ্ছিল।

আমরা এই দুটি ঘাঁটি হতে গুণ্ডাদের উচ্ছেদ করবার জন্য থানায় খবর দিলে কর্তৃপক্ষ আমাদের বলেছিলেন যে কণ্ট্রোল-রুমের হুকুম ছাড়া তাঁদের করণীয় কিছু নেই।

[বালিগঞ্জের যশোদা-বিলডিং ও মিলিটারী কর্তৃক সদ্য-পরিত্যক্ত আরও কয়েকটি বাড়ি তখন খালি পড়েছিল। আমরা বহু হিন্দুকে উদ্ধার করে ওই বাড়িগুলিতে ঢুকিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলাম। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস সে স্বাধীনতার ক-বছর পরে কর্তৃপক্ষের হুকুমে সেই-সব আশ্রিত জনদের উচ্ছেদ করতে হয় আমাকেই। জনৈকা তরুণী আমাকে তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন যে সেদিন সে একটি ছোট্ট মেয়ে ছিল। আমি তাকে দুহাতে উঁচু করে ধরে লরীতে তুলেছিলাম। এখানে এসে সে একটু একটু করে বড়ো হয়ে এখন কলেজে পড়ছে।]

সুবোধ সাহা নামে এক ব্যক্তি ফুটপাত ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একজন তার পেটে ছুরি মেরে পিছিয়ে দাঁড়ালো। ভদ্রলোকের নাড়িভুড়ি বেরিয়ে পড়ে। তিনি দুহাতে নাড়িভুড়ি সামলে ভিতরে ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁর আততায়ী তাই দেখে পুনরায় ছুরি তুললে আমি গুলি ছুঁড়লাম। আহত ব্যক্তিকে তারপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে তিনি ক্রমে আরোগ্যলাভ করেছিলেন। (ভদ্রলোক প্রতি সপ্তাহে আমার সঙ্গে দেখা করতেন।)

কজন কিশোরের একটি দল ইটের ঘায়ে পড়ে যাওয়া এক প্রৌঢ় ব্যক্তিকে খেঁটে-লাঠি দিয়ে ঠেঙিয়ে জ্ঞানহারা করে ফেললো। ওদের মধ্যে হঠাৎ একজন বলে উঠলো, ‘আরে নড়ছে রে নড়ছে।’ তাই শুনে লুঙ্গি ও লাল গেঞ্জি পরা ও কানে বিড়ি গোঁজা এক যুবক এগিয়ে এসে ছুরি বসিয়ে তাকে একেবারে নীরব করে দেয়। কিন্তু লরী হতে নেমে ছুটে ওদের কাউকে ধরতে পারি নি।

অন্যত্র এক জায়গায় দেখি, সমগ্র পরিবারকে ম্যানহোলের মধ্যে পুরে উপরে কর্তা-ব্যক্তিটিকে দাঁড় করিয়ে তাঁর গলায় ঢাকনি পরিয়ে গুণ্ডারা নাচছে আর তাঁর গলা একটু একটু করে কাটছে। এক্ষেত্রেও আমি গুলি করে ওদেরকে উদ্ধার করেছিলাম। ওঁরা বাড়ি ফিরে যাবার পর ওঁদের এক বয়স্কা কন্যাকে ভোগ-দখলের ইচ্ছায় দুদলে কাড়াকাড়ি করছিল। ঠিক সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়ে তাকে আমি রক্ষা করতে পেরেছিলাম।

টেরেটি বাজারের এক মসজিদে হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়া হলে কাটাকাটি শুরু হয়ে যায়। কিছু চীনা এসে ওদের উদ্ধার করতে অপারগ হওয়ায় আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। মেঝের উপর নিহতদের এমন পুরু রক্ত যে আমাদের জুতোর কিছু অংশ তাতে ডুবে যায়। চীনারা মিশ্র ভাষায় আমাদের কাছে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলে, “উনলোক ইনলোককো এইচে এইচে কাট তা। অউর তুম পুলিশলোক কুচো দেখতো না।’

মাঝখানে একবার আমরা দাঙ্গার মধ্যে পড়ে যাই। রাজপথে উভয় দিক হতে ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে। কিন্তু আমাদের গুলিবর্ষণে ওরা পিছিয়ে যায়। এ রকম জমাট-বাঁধা গুণ্ডা বাহিনী আগে কখনও দেখিনি। বোঝা গেল উল্টো বোঝানো হয়েছে। মধ্যে-মধ্যে ওদের তাড়া করে আমরা বহুদূর এগোই। তারপর বহু নরনারী ও শিশুকে উদ্ধার করে আনি।

আশ্চর্য এই যে উদ্ধারের সময় মহিলাগণ প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সহিত আচারের হাড়িগুলি পর্যন্ত সঙ্গে নিতে ভুলতেন না।

এক বাড়িতে এক প্রৌঢ় ব্যক্তি টবের পেয়ারা গাছটি ফেলে কিছুতেই এলেন না। তাঁর বক্তব্য হ’ল ওই পেয়ারা গাছটি প্রত্যহ আট বালতি জলে খেয়ে থাকে। টব নিয়ে তবে তিনি আমাদের সঙ্গে এসেছিলেন।

এতদসত্ত্বেও আমরা কিন্তু মুশ্লিম ও হিন্দু পল্লীর বাড়িগুলি সাময়িক একচেঞ্জের ব্যবস্থা করেছিলাম। মুশ্লিম পাড়ায় হিন্দুরা এবং হিন্দু পাড়ায় মুশ্লিমরা বাড়ির বারান্দা থেকে আমাদের দেখে উদ্ধারের জন্য চেঁচাচ্ছিলেন। আমরা তাঁদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। রাজপথে তখন আমরা ছাড়া কোনো পুলিশ নেই। যত্র তত্র এই কাজে যাওয়া-আসার ফলে আমি বার-কতক ইটের দ্বারা জখম হই। কিন্তু হাসপাতালে না-গিয়ে ক্ষতস্থান রুমাল দিয়ে বেঁধে নিয়েছি। একজন অবসরভোগী পুলিশ অফিসারকে রক্ষার জন্য একবালপুরে যেতে হয়। সামান্য বিলম্ব হওয়ায় ওই বাড়ির সকল বয়স্ক পুরুষদের হত্যাকাণ্ড শেষ। বাড়ির মহিলাদের উদ্দেশ্যে আততায়ীরা অবশ্য বলে, ‘আপলোককো ডর নেহী। আপলোক যাইয়ে।’ একটি মহিলা শিশুপুত্রকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে আনছিলেন। ওরা তা বুঝতে পেরে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে মাটিতে আছড়ে মেরে ফেলে। স্বামীপুত্র-হারা মহিলারা ওই শিশুর উপর উপুড় হয়ে পড়েছিল। ঠিক এই সময় আমরা সেখানে উপস্থিত হই ও বাকি পরিবারগুলিকে উদ্ধার করে আনি। ওই মহিলারা প্রতিদিন দুপুরে টালিগঞ্জের বাড়ি-বাড়ি ঘুরতো আর সব-হারানো কাহিনী শোনাতো।

বিঃ দ্রঃ—এজন্য দাঙ্গার পরে পুনর্বাসন কালে পূর্বস্থানে অন্য হিন্দুরা ফিরলেও, স্বামী পুত্র অথবা স্ত্রী-হারাদের স্বস্থানে কোনও দিন ফেরানো সম্ভব হয় নি।

[ভূ-কৈলাসের রাজবাড়ির গড়টি এই সময় বিশেষভাবে কাজে লেগেছিল। ওই গড়ে মুশ্লিম-পল্লীর বহু হিন্দু-পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল।]

জনৈক মুশ্লিম-অফিসারদের স্ত্রীকে সিঁদুর পরিয়ে উত্তর-কলিকাতার এক হিন্দু-অফিসারের স্ত্রী আশ্রয় দিয়েছিলেন। হিন্দু-গুণ্ডারা তা জানতে পেরে বাড়ি ঢুকে গৃহকর্ত্রী হিন্দু-বধূটিকেই বার করে আনছিল। আমরা হঠাৎ ভিড় দেখে গুলি করে গুণ্ডাদের তাড়িয়ে সেই বধূকে উদ্ধার করি।

এক মুশ্লিম-গুণ্ডাকে এইখানে খুন করে টাঙিয়ে রাখা হয়। সেই গুণ্ডা এক হিন্দু-বালিকাকে ওভাবে টাঙিয়েছিল বলে এটি ছিল হিন্দু-গুণ্ডাদের পক্ষে চরম প্রতিশোধ।

জ্যাকেরিয়া স্ট্রীট হতে এই সময় বহু হিন্দু নারী উদ্ধার করা হয়েছিল। কজন শুভবুদ্ধি-সম্পন্ন মুশ্লিমের সংবাদে ও সাহায্যে এই উদ্ধার-কার্য সম্ভব হয়। নিজেদের পল্লী টালিগঞ্জে ফিরে এসে দেখি, উন্মুক্ত কৃপাণ-হাতে শিখরা কোথা হতে একদল অর্ধ-উলঙ্গ দেহাতী নারী উদ্ধার করে লরী করে সেখানে এনেছে। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলি থেকে বন্ধুরা তাদের লজ্জা নিবারণের জন্যে শাড়ি ও ব্লাউজ ছুঁড়ে দিচ্ছিল। তাই দেখে স্থানীয় তরুণেরা উত্তেজিত হয়ে কাছেই নবাবদের ঘড়িঘর ও জাহাজ-বাড়ি আক্রমণ করলো। কিন্তু ওই সুরক্ষিত বাড়ি থেকে একসঙ্গে রাইফেল গর্জন করে উঠলো। বহু তরুণ তার ফলে হতাহত হলে কিছু লোক তাদের প্রাইভেট বন্দুক-সহ যুদ্ধে অবতীর্ণ হ’ল। চতুর্দিকে মুহুর্মুহু রণধ্বনি: ‘বন্দে মাতরম।’ অ্যামবুলেন্স-গাড়ি করে একদল আজাদ হিন্দ ফৌজ এসে তাদের থামাতে চাইল: ‘ক্ষান্ত হোন। আপনারা ক্ষান্ত হোন। শেষে নবাব পরিবারের কারো প্রেরিত সংবাদে মিলিটারী ও পুলিশ এসে উভয়পক্ষকে শান্ত করে।

আমাদের বাড়ির গায়ে একটি মসজিদের সিঁড়ির দুপাশে হিন্দুনারীরা জলপাত্র-হাতে অপেক্ষা করতো। নমাজীরা নমাজ পড়ে বেরিয়ে সেই পাত্রগুলিতে ফুঁ দিতো। এরূপ জল-পড়া ওষুধ নিতে সেদিনও বহু নারী সেখানে এসেছে। হঠাৎ তাদের চিৎকারে ছুটে গিয়ে একদল আক্রমণোদ্যত গুণ্ডার কবল থেকে মসজিদটি আমি রক্ষা করেছিলাম।

এক হিন্দু-ভদ্রলোক বিচলিত-ভাবে দৌড়ে এসে অভিযোগ করলো যে তাঁদের প্রিয় মাংসওয়ালা রহিম বিপদাপন্ন, তাকে রক্ষা করতে হবে। আমি তাকে সপরিবারে বাড়িতে এনে তুললুম, পরে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দিয়েছিলাম। এরিয়ান-বেকারীর মুশ্লিম-কর্মীদের আশ্রয় দিয়েছিলেন বলে আমার শ্বশুরালয় বিপন্ন। সংবাদ পেয়ে আমি তাড়াতাড়ি সেখানে গিয়ে একটা গাড়ি যোগাড় করে ওদের সবাইকে থানায় এনে তুলি।

এক মুশ্লিম-ভদ্রলোক আমাকে ডেকে সক্ষোভে বললেন, ‘দেখুন ব্যাপার, আমার পিতামহ একদা দুর্গাপূজা করেছিলেন আর আজ হিন্দু-গুণ্ডারা আমার বাড়ি চড়াও হতে চাইছেন।’ তাই শুনে মুশ্লিম-পল্লী হতে বিতাড়িত এক ভদ্রলোক আক্ষেপ করে বলে উঠলেন, ‘তবে শুনুন, আমি নিজে গ্রামে ওদের কবর স্থান ও বাজারের জন্য এই সেদিন দুবিঘা জমি দান করেছি। আর আপনি তো জানেন ওরা আজ আমার বাড়ির কি দুর্দশা করেছে।’

কিন্তু এতসত্ত্বেও বহুহিন্দু মুশ্লিমকে এবং বহু মুশ্লিম হিন্দুকে রক্ষা করতে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন করতে কুণ্ঠিত হন নি। আশ্চর্য এই-যে সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষ এসবের মধ্যে ছিল না। তারা শহরের ব্যবসা-বাণিজ্য অদ্ভুত উপায়ে চালু রেখেছিল। হিন্দু রিকশা ও ঠেলাওয়ালারা মুশ্লিম-পাড়ার সীমানা পর্যন্ত মাল বহন করে নিয়ে যেতো আর সেখান হতে মুশ্লিম রিকশা ও ঠেলাওয়ালারা সেই-সব মাল মুশ্লিম পল্লীর নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দিতো।

হরেন্দ্রনাথ ঘোষ

ঘুরতে ঘুরতে আমরা মধ্য-কলিকাতার এক মিশ্র পল্লীতে হরেন্দ্রনাথ ঘোষ মহাশয়ের অফিসে এলাম। ইনিই ইম্প্রেসারিও হিসাবে উদয়শংকরকে ভারতে নৃত্যশিল্পীরূপে পরিচিত করান। অনুষ্ঠান-সংগঠকরূপে তাঁর তখন বিশেষ খ্যাতি। তিনি আমাদের চা-পানে আপ্যায়িত করে ড্রয়ার খুলে একগুচ্ছ ঘুঙুর বার করে বলেছিলেন, ‘দেখ, একটা মিষ্টি জিনিস দেখ।’ আমরা তাঁকে এ-অঞ্চলে আর না-আসতে অনুরোধ করলে তিনি সম্মুখে উপবিষ্ট কয়েক ব্যক্তির দিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করে বলেছিলেন, ‘আমার এই মুশ্লিম-বন্ধুরা থাকতে ভয় কি।’ পরে, ওর গলিত মৃতদেহ এক বাসের মধ্যে পাওয়ায় আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি ওর আততায়ীকে খুঁজে বার করব। আমরা তাকে খুঁজে পাই এবং গ্রেপ্তার করি। তার কাছ থেকেই জানতে পারি কিছু খাওয়ানোর অজুহাতে তাঁকে অফিস থেকে বার করে নিরালা স্থানে এনে হত্যা করা হয়। সেদিন আঙুল দেখানো বন্ধুদের একজনই তাঁকে প্রথম ছুরিকাঘাত করেছিল।

বিঃ দ্রঃ-কোনো এক ইংরেজ-মিলিটারী অফিসার একদা আমাকে বলেছিলেন যে এ দাঙ্গার মতো নিষ্ঠুরতা তিনি কোনো যুদ্ধক্ষেত্রেও দেখেন নি। বস্তুত, ভাইয়ে-ভাইয়ে বিবাদের মধ্যেই এরূপ নিষ্ঠুরতা সম্ভব হয়ে থাকে। আমি একবার আহত হয়ে বাড়ি ফিরলে আমার মা-পূজার আসন ছেড়ে উঠে বলেছিলেন, ‘ভগবান, পৃথিবী থেকে দাঙ্গা যুদ্ধ কি শেষ হবে না?’

মহাদাঙ্গা কিছুটা প্রশমিত হলে কলিকাতা-পুলিশকে কয়েক সহস্ৰ মৃতদেহ শহর হতে সরাতে হয়েছিল। কোনো হত্যা মামলা রুজু করা অবান্তর। পোস্টমর্টম না-করে নামধাম না-জেনে তাদের সৎকার করা হ’ল। পরিবারবর্গের কাছে তারা চিরতরে নিখোঁজ। একদিন ওদের কেউ ফিরবে এই আশায় তাঁরা হয়তো আজও প্রতীক্ষারত।

মুশ্লিম-অফিসাররা মৃত ব্যক্তিদের মুশ্লিম আর হিন্দু-অফিসাররা হিন্দু উল্লেখ করে নিজেদের খাতা ভর্তি করেছেন। উদ্দেশ্য— নিজ-নিজ সম্প্রদায়ের লোক যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তা প্রমাণ করা। তখন কিছু পুলিশ কর্মী হঠাৎ সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছিল। কারণ তাদের বহু আত্মীয়-পরিজনও এই দাঙ্গায় নিহত বা ক্ষতিগ্রস্ত। কর্তাদের কেউ-কেউ বোধহয় এরূপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। কোনো হিন্দু পুলিশ-কর্মীর উক্তি: ‘স্যার,…মিয়া সাহেব এতোগুলি হিন্দুকে গুলি করে মেরেছে। আমরাও বেরিয়ে কিছু মুশ্লিম মেরে আসি।’ শুনে আমি তার বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেছিলাম।

শোণিত-স্পৃহা একবার জাগলে শনৈঃ শনৈঃ তা বেড়ে যায়। এক ব্যক্তিকে জানি সে কজন ভিন্ন-সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে কেটে হত্যা করলো। আরও হত্যার উদ্দেশ্যে সে নৌকা চড়াও হ’ল ভিন্ন-ধর্মী মাঝিদের কাটবে বলে। তাদের কাউকে না পেয়ে সে একটা ছাগ হত্যা করলো, তারপর জখম করলো গরু। ইতিমধ্যে তার মাথায় খুন চড়ে যাওয়ায় সে নিজের সম্প্রদায়ের লোকদেরই খাঁড়া নিয়ে তাড়া করলো। তাকে নিরস্ত্র করবার জন্য স্থানীয় লোকেরা লাঠির ঘায়ে জখম করে তার হাত থেকে খাড়া কেড়ে নিতে পেরেছিল।

সেই সময় অলিতে-গলিতে লুকিয়ে থাকা মনুষ্য-শিকারীদের অপেক্ষা করতে দেখেছিলাম।

প্রথম-প্রথম বয়স্ক ব্যক্তিরা তরুণদের দ্বারা সম্প্রদায় বিশেষকে মারধোর করতে দেখলে সক্রিয়ভাবে বাধা দিতেন। পরে শুধু ভৎসনা করেই কর্তব্য শেষ করছিলেন। অন্য জায়গা থেকে করুণ সংবাদ এলে সক্রিয়তা বিসর্জন দিয়ে নিষ্ক্রিয় হলেন। তারপর কিছুদিন পরে দেখা গেল তাঁরাও তরুণের দলে ভিড়ে গিয়েছেন। আদিম শোণিত-স্পৃহা শনৈঃ শনৈঃ চরিতার্থ হওয়ায় এটি অন্যতম প্রমাণ। উভয় সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে কম-বেশি এটা ঘটেছিল।

অন্তত একটি ক্ষেত্রে অভিযোগ এই-যে পাঞ্জাবি-কনস্টেবলরা হিন্দু-বালক ও শিশুকে গ্রেপ্তার করে লরীতে তুলে মুশ্লিম-পল্লীর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। পরে ওই বস্তির মাটি খুঁড়ে কিছু নর-কংকাল পাওয়া গিয়েছিল। জনৈক ঘুমন্ত হিন্দু-সিপাই স্বপ্নের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি সত্য হিসাবে গ্রহণ করে রাইফেল-সহ দ্বিতল হতে লাফিয়ে পড়েছিল।

হ্যারিসন রোডের এক বাড়িতে পাঞ্জাবি-সিপাইদের দ্বারা ভদ্রনারীর উপর বলাৎকারের সংবাদটির পর বাঙালীরা দেশ-বিভাগে প্রথম মত দেয়। এই সংবাদটি আমরাই শেষরাত্রে খবরের কাগজে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

বিঃ দ্রঃ-আশ্চর্য এই-যে বহু বাড়িতে একাধিক বন্দুক থাকা সত্ত্বেও সেগুলি ব্যবহারের রীতি তাদের জানা ছিল না। শুধু ভ্যানিটি অফ পজিসনের জন্য তাঁরা অস্ত্রগুলির লাইসেন্স নিয়েছিলেন। বন্দুক থাকতেও তাঁদের সর্বস্ব লুণ্ঠিত হয়। সেই-সব বাড়ির মহিলারা জীবন-রক্ষার পর আমাকে বলেছিলেন, ‘দৌলতহীন হয়ে আমাদের বেঁচে থেকে কী লাভ।’

এই দাঙ্গায় প্রমাণিত হয় যে বুলেট অপেক্ষা সটগান বেশি উপযোগী। বুলেটে একজন পড়লে অন্যেরা ছুটে আসে। কিন্তু সটগানের ছররা অনেকখানি স্থান ঘিরে ছড়ায় ও অনেক লোককে একসঙ্গে আহত করে। তার ফলে লোকেরা একত্রে আহত হয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় অথচ কারো জীবনহানি হয় না।

এই মহাদাঙ্গা আর উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ রইল না। ওরা নিজেদের ভুল বুঝে সংবিত ফিরে পেয়ে আত্মস্থ হয়েছে। এবার উভয় সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের মধ্যেই শুধু তা সীমাবদ্ধ হ’ল। এরা পরস্পর-বিরোধী সম্প্রদায়ের দ্রব্যাদি লুঠ করে, কিন্তু স্ব-সম্প্রদায়ের গৃহ লুঠ করতেও তাদের বাধে না। এই গুণ্ডাদের ভরণপোষণের অর্থ না-যোগানের ফলে ওরা অনর্থ বাধায়।

মিলিটারী নামানোর পরও দাঙ্গা না থামায় মুখ্যমন্ত্রী রাত্রে রেডিও-যোগে জনগণকে এবার ক্ষান্ত হতে বলেন, ‘কার দোষ তা পরে বিচার করা যাবে, এখন দয়া করে এই সভ্যতা-বিধ্বংসী দাঙ্গা বন্ধ করুন।’ পরদিন প্রত্যুষে এক জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রে এই শিরোনামায় সম্পাদকীয় বেরোয়: ‘ফাঁসির আসামী কথা বলিতেছে।’ একালে মুশ্লিম পত্রিকা ‘আজাদ’ এবং অন্য পত্রিকাগুলি পরস্পর সম্প্রদায়কে দায়ী করে লোমহর্ষক ঘটনাসমূহ প্রকাশ করছিল। পরে আবার তাঁরাই পারস্পরিক বন্দোবস্ত মতো সংবাদ বাছাই করে প্রকাশ করলে উত্তেজনার উপশম হয়।

তবে এই হিন্দু-মুশ্লিম দাঙ্গা উভয় পল্লীর এলাকায় সীমাবদ্ধ থেকেছে। ফলে, যা-কিছু লড়াই রাস্তার এপারে-ওপারে। এ পল্লীর তরুণ অন্য পল্লীতে গেলে তার নিশ্চিত মৃত্যু। ওরা সকলেই বাঙালী ও ধর্মে হিন্দু হলেও শুধু রাজনৈতিক মতবাদে পৃথক।

পূর্বে যে হিন্দুরা মুশ্লিম-পল্লী ভয়ে এড়িয়ে যেতো তারাই আবার নিরাপত্তার কারণে ওই পল্লীতেই বাড়ি খুঁজেছে। হিন্দুপল্লী অপেক্ষা মুশ্লিম ও খ্রীশ্চান এবং অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান পল্লীতে তারা নিরাপত্তা পেয়েছে। হিন্দু-মহিলারা এই-সব স্থানে বরং নিরাপদে চলাফেরা করেছে।

এই কালে জীবনের মূল্য আরও কমে গিয়েছিল। খুনের নেশায় বহু তরুণ হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। গভর্নমেন্ট বদলের পর পুলিশেরও মরাল বলে কোন বস্তু ছিল না। তারা নিজেরাই তখন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত। থানায় ফোন করলে উত্তর পেয়েছিলাম: ‘স্যার, জায়গাটা বড্ড খারাপ।’ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সৈনিকদের কর্তব্য-ভীতি দেখে আমরা অবাক হয়ে গিয়েছি।

ততোদিনে কলকাতা মহানগরী তিন ভাগে বিভক্ত: হিন্দু পল্লী, মশ্লিম পল্লী ও মিশ্র পল্লী। প্রথমোক্ত দুটি পল্লীতে দাঙ্গা থামলেও মিশ্র পল্লীগুলিতে তা অব্যাহত ছিল। হিন্দু ও মুশ্লিম পল্লীর অধিবাসীরা মিলেমিশে বহিরাগতের আক্রমণ একসঙ্গে রুখেছে। অন্যপক্ষে, মিশ্রপল্লীতে মুশ্লিমরা তখনও চুরি শানাচ্ছে জার হিন্দুরা পাইপগান ও বোমা তৈরি করছে। সারারাত্রি সেখানে পটপট আওয়াজ আর চোরাগোপ্তার আঘাত-জনিত আর্তনাদ। পুলিশ বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ইটের সন্ধানে ছাদ তল্লাসী করতো। এজন্য বাড়ির ছাদগুলিতে ইট দিয়ে ঘিরে তুলসী-মঞ্চ তৈরি করা হয়। বাড়ি আক্রান্ত হলে মেয়েরা ওই মঞ্চ ভেঙে ইট ছুঁড়তো। স্ত্রী-পুরুষ-নির্বিশেষে পরিবারের সবাই তখন একটি যুদ্ধবিদ জাতিতে পরিণত। মিশ্র-পল্লীগুলিতে তখন জাতি-বর্ণ ও ধনী-নির্ধনী ভেদ নেই। বিপদ-কালে বস্তি-সুদ্ধ সবাই স্বধর্মী ধনীর গৃহে সাদরে স্থান পেয়েছে। সকলেই এক হিন্দু জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে এ বাড়ির মেয়েরা বিপদের দিনে অন্য বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এইভাবে একটি নতুন সমাজ-ব্যবস্থা তখন গড়ে উঠেছিল।

[পুলিশ তার করণীয় কর্তব্য-কাজ না-করলেও পল্লীগুলিতে প্রাইভেট-পুলিশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তাদের ভরণপোষণের জন্য চাঁদা উঠতে থাকে। পল্লীর বাতিল-তরুণেরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়। পুলিশের খাতায় তারা প্রতিরোধী দল বা রেজিসটেন্স গ্রুপ রূপে চিহ্নিত হ’ল।]

বিঃ দ্রঃ—দাঙ্গার অবসানে স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের আর প্রয়োজন থাকে নি। পূর্বের মতো তাদের আর-কেউ আদর করে না। এই-সব লোকেদের দাঙ্গা-পরবর্তীকালে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। প্রকৃতপক্ষে গুণ্ডা ও পুলিশের কোনো জাত থাকে না। কিছু পুলিশ-কর্মী স্ব-স্ব সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের আস্কারা দিয়ে এমনকি তৈরি করেছিল। কিন্তু পরে তাদের দমন করতে তারা বিব্রত হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর এরা দারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে।

গোপালবাবু ও রামবাবু তখন জনগণের রক্ষাকর্তারূপে বিবেচিত ছিলেন। পরে অভিযোগ হয় যে আমি ও সত্যেনবাবু তাদের দুজনকে তৈরি করেছি। এ অভিযোগ আমরা স্বভাবতই অস্বীকার করি। এই বিশিষ্ট ভদ্রলোকদ্বয় জনগণের স্বার্থে ই তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন।

তৎকালে নিয়ম ছিল এই-যে কোনো জায়গায় বোমাবাজী বা অনুরূপ ঘটনা ঘটলে সেখানকার কিছু ব্যক্তিকে দোষী না হলেও নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে ওপর-মহলকে খুশি করতে হ’ত। এই কারণে গৃহস্থরা অর্থদান না করলে কিছু দলছুট উপগুণ্ডা বাড়ির সামনে বোমা ফাটিয়ে তাদের বিপদে ফেলতো।

বিঃ দ্রঃ—আমি নির্বিচারে লোক-দেখানো গ্রেপ্তারের পক্ষপাতী ছিলাম না। অথচ কর্তৃপক্ষকে পরিসংখ্যা দেখাতে হয় বলে তার প্রয়োজন। তাই ঘটনার পর স্থানীয় নেতাদের বলতাম কিছু তরুণকে নিজেরাই বাছাই করে গ্রেপ্তারের জন্য পাঠিয়ে দিতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কারো মা কান্নাকাটি করছে বলে তারাই আসামী বদল করে অন্যকে পাঠিয়েছে।

কিছু নিম্নপদের পুলিশ-কর্মী এই সুযোগে দুষ্টুমী শুরু করে দিলো। উচ্চপদস্থ বিহারী মুশ্লিমগণ স্থানীয় বাঙালী-মুশ্লিমদের চেহারা দেখে চিনতে পারতেন না। একবার কিছু মারমুখী মুশ্লিম-জনতাকে অগ্রসর হতে দেখে নিম্নপদের এক হিন্দু-কর্মী উচ্চপদস্থ বেহারী মুশ্লিম-অফিসারকে বললেন, ‘স্যার, টেরিবল হিন্দু-গুণ্ডার দল। মুশ্লিম-বস্তিগুলো এখনই ওরা জ্বালিয়ে দেবে।’ ‘অফিসারটি তাই শুনে ‘থ্যাংকস’ জানিয়ে সশস্ত্র পাঠান-সিপাহীদের হুকুম দিলেন, ‘ফায়ার।’ পরে অফিসার-ভদ্রলোক স্বজাতি নিধন দেখে হতবাক হয়ে যান।

আমার ভগিনী শ্রীমতী প্রণতি ব্যানার্জি, এম-ডি, এম-বি-বি-এস তখন মেডিকেল কলেজে ছাত্রী ও শিক্ষানবীশ। হঠাৎ দাঙ্গা বেধে যাওয়ায় হিন্দু ডাক্তররা বাড়িতে নিজ-নিজ এলাকায় আটকা পড়ে যান। কিন্তু মুশ্লিম-চিকিৎসকেরা কাছাকাছি থাকায় হাসপাতালে আসতে পেরেছিলেন। তখন রটে যায় যে তাঁদের চিকিৎসার দোষে হাসপাতালে হিন্দু-আহতদের মৃত্যু ঘটেছে। আমার ভগিনী তাই শুনে অন্যদের মতো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিল। সে রাত্রিবেলা শুধু ‘এইচ’ অর্থাৎ ‘হিন্দু’ টিকিট দেখে রোগীদের প্রতি যথাকর্তব্য সম্পাদন করে উপরে ঘুমতে গেল। কিন্তু ঘুমতে না পেরে বিবেকের দংশনে জর্জরিত হয়ে আবার নিচে নেমে ‘এম’ অর্থাৎ মুশ্লিম-রোগীদের প্রতিও যথাকর্তব্য সম্পাদন করে নিশ্চিন্ত হ’ল।

এই মহাবিষ তখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছিল। ফায়ার-ব্রিগেডের মুশ্লিম-কর্মীরা এই ব্যাধিকে প্রশ্রয় দেয়। রাইটার্স বিলডিং-এও কর্মীদের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের একাংশও এর দ্বারা আক্রান্ত হয়। কিন্তু কলিকাতা-পুলিশের অধিকাংশ কর্মী তখনও অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। কোনও এক মুশ্লিম-অফিসারকে মুশ্লিম-জনতা ‘মারো শালা হিন্দু লোককো’ বললে তিনি বন্দুক নিয়ে তেড়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি হিন্দু নই। আমি মুশ্লিম। কিন্তু এ কাজ করলে আমি তোমাদের জান নিয়ে নেব।’

[সিনেমা-শিল্পী কেষ্টবাবুর এক পুত্র আমার সুমুখেই মিলিটারীর গুলিতে নিহত হন। তখনও তাঁর বাম হাতে কেরোসিনের টিন ও ডানহাতে মশাল। মশালের আলোয় সে বিরাট মুশ্লিম-গুণ্ডাবাহিনী বিতাড়িত করে ফিরে আসছিল।

এঁদের জন্য তো নয়ই, এমন কি ধারা ভিন্ন-সম্প্রদায়ের লোকেদের রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কথা স্মরণ করেও কোনোখানে শহীদ-বেদী নির্মিত হয়নি। সেদিনের বহু তরুণকে আজ প্রৌঢ় অবস্থায় খণ্ডিত হাত নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি! তাঁদের কারোর জন্য সরকারী পেনসনের ব্যবস্থা নেই। অথচ ওরাই একদিন মা-বোনেদের ইজ্জত রক্ষা করেছিল।]

জনৈক উচ্চপদস্থ ইংরাজ-সেক্রেটারি সংবাদপত্রে বিবৃতি দেন: ‘সৌভাগ্য এই-যে এখনও পুলিশ দেখে ওরা পালায়। ওরা পুলিশকে এখনও পর্যন্ত আক্রমণের চিন্তাও করে নি।’ এই বিবৃতির ফলে সেদিন থেকেই এক সম্প্রদায়ের অফিসারদের উপর অন্য সম্প্রদায়ের আক্রমণ শুরু হ’ল। প্রথমে একজন হিন্দু-অফিসার ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারালেন। আমার উপরেও চারবার আক্রমণ করে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। মধ্যে মধ্যে শহরে আমার মৃত্যু-সংবাদ ছড়িয়ে পড়তো। জনৈক ব্যক্তি আমাকেই ফোন করে জিজ্ঞাসা করেছিল: ‘হ্যাঁ মশাই, একথা সত্যি মিঃ ঘোষাল নাকি মারা গেছেন?’ ওই সময়ে আমাকে রক্ষাকর্তা বুঝে পল্লীতে গেলে শাঁখ বাজানো হ’ত।

আমার জুনিয়র হক সাহেব গাড়ির মধ্যে স্টেনগানের গুলিতে প্রাণ হারালেন। অথচ এ ব্যক্তিটি অসাম্প্রদায়িক তো ছিলেনই এমন-কি মসজিদের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের বাড়িতে রেডিও-র গান বন্ধ করেন নি। তাঁরই শবদেহ বহন করে মুশ্লিমরা। নতুন করে হত্যাকাণ্ড শুরু করলো। প্রতিবাদে একদল জীপ-আরোহী হিন্দু কিছু পাঠান-কনস্টেবলকে স্টেনগান স্প্রে করে রাজপথে হত্যা করে শোধ নিলো। পরবর্তীকালে মন্ত্রী হয়েছেন এমন কজন ব্যক্তি আমাকে বলেছিলেন, ‘পঞ্চাননবাবু দেখবেন, আমাদের ওপর যেন হামলা না হয়।’ প্রকৃতপক্ষে আমরাই তখন হিন্দুদের একমাত্র ভরসাস্থল।

[স্বাধীনতার পর মন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্কর ও মন্ত্রী কালীপদ মুখোপাধ্যায় নবীন ডেপুটিদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তোমরা নবাগত ও বয়সে তরুণ। তোমরা জানো না যে সেদিন সত্যেন মুখার্জি ও পঞ্চানন ঘোষাল জীবন ও চাকুরি বিপন্ন করে কিভাবে নাগরিকদের রক্ষা করেছিলেন।’ দৈনিক বসুমতী-সম্পাদক বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তৎকালীন মন্ত্রী কিরণশংকরবাবু ও অন্য বহুজনকে বলেছিলেন, ‘ওহে, এই একটি লোকের কর্মতৎপরতার জন্য সেবার আমরা বেঁচে গিয়েছিলাম।’ —আজকের কলকাতা সেদিনকার কলকাতাকে ভুলে গিয়েছে। তাই আজ আমরাও শহরবাসীর স্মৃতিপথে সহজে আসি না।]

একদিন কিছু মুশ্লিম-অফিসার হিন্দু আসামীদের গ্রেপ্তার করে থানায় আনছিলেন। পথে কজন হিন্দু-ছোকরা বোমা ফাটালে তাঁরা বিহ্বল হয়ে গুলি ছুড়ে আসামীদের একজনের মাথাই উড়িয়ে দিলেন।

আর-একদিন অ্যাংলো-সার্জেন্টরা বোমা ও পিস্তল সমেত এক গাড়ি লোককে গ্রেপ্তার করলেন। হঠাৎ জীপে করে কজন য়ুনিফর্ম-পরা বাঙালী ইনস্পেক্টর এসে সার্জেন্টদের ডিউটিতে থাকতে বলে আসামী-সমেত ওই গাড়ি নিয়ে থানার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। কিছু পরে সার্জেন্টরা থানায় এসে বুঝলো যে ওরা অলীক তথা ভূয়া-পুলিশ। অত্যন্ত আপত্তিজনক বিষয় এই-যে আমাকে ও অন্য কয়েকজন অফিসারকে সন্দেহ করে সনাক্তির জন্য লালবাজারে আসতে বলা হয়। কিন্তু সার্জেন্টরা কেউই আমাদের সনাক্ত করতে পারে নি।

উভয়-সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে কিন্তু সৌহার্দ্য ও খানাপিনা এবং আলোচনায় তখনও ছেদ পড়ে নি। এবার ইংরাজ-প্রভুরা বুঝলেন যে তাঁদের নিজেদের ঘরেই আগুন লেগেছে। তাঁরা পূর্ব প্রশাসন-ব্যবস্থা পুনরায় প্রবর্তন করতে বদ্ধ পরিকর হলেন। লীগ-মন্ত্রীরা পথেই রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্র মুখার্জিকে নর্থ-ডিসট্রিক্ট ত্যাগ করে এনফোর্সমেন্ট-এর ডেপুটি পদে ফিরে যেতে হুকুম দিলেন। ইংরাজ পুলিশ-কমিশনার ফোনে গভর্নরকে তা জানালে তিনি বলেন, ‘এ হুকুম আমি বাতিল করে দিলাম।’

হীরেন্দ্র সরকার এবং সত্যেন্দ্র মুখার্জির নেতৃত্বে এবার আমরা সন্দেহজনক গুণ্ডাদের বস্তিগুলি খানা-তল্লাসী শুরু করে দিলাম। বস্তির লোক তাতে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘আরে এ ক্যা বাত? ইয়ে তো হুকুম নেহী থে।’ দশ কোটীর উপর মূল্যের অপহৃত দ্রব্য সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। বড়ো-বড়ো সিন্দুক ও আলমারী ভর্তি হীরা জহরত ও সোনা। পরিত্যক্ত বাড়ির বহু দরজা ও জানলা। সেই সাথে উঠান খুঁড়ে পাওয়া গেল মানুষের হাড়গোড় ও মাথার খুলি। সনাক্তির সুবিধার জন্য সেগুলি ইণ্ডিয়ান মিউজিয়ামে সাজানো হয়েছিল।

গুণ্ডাদের মূল ঘাঁটি কলাবাগান তখনও বিভীষিকা স্বরূপ। জনৈক চিত্রশিল্পী অন্যমনস্কবশত কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট হতে সর্টকাট কলাবাগানের মধ্য দিয়ে সেন্টাল এভিনিউ-তে এসেছিলেন। গুণ্ডারা তাঁর লম্বা চুল ও ঝলমলে পাজামা দেখে জাতি-নির্ণয়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবারে এলে তাঁকে দেখে আমি বলেছিলাম, ‘আরে করেছো কি? তুমি কলাবাগানের মধ্য দিয়ে দিব্যি চলে এলে!’ চিত্রশিল্পীটি ওটা কলাবাগান শুনে আঁতকে উঠে অজ্ঞান হয়ে যান আর-কি।

এই কলাবাগানের মোড়ে সত্যেন্দ্র মুখার্জির গাড়ি দুই শতাধিক ব্যক্তি আক্রমণ করে তাঁর মাথা ফাটায়। সৌভাগ্যক্রমে সেই সময় আমি টহলে এসে পড়ায় ও প্রতি-আক্রমণ করায় তারা পালিয়ে যায়। রায়বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ অপারেশনের পর বহুদিন ভুগে আরোগ্যলাভ করেন।

মুশ্লিম-সম্প্রদায় হতে সদ্য-ধর্মান্তরিত দুজন হিন্দুর দৌরাত্ম্যে চিৎপুরের মুশ্লিম-সমাজ বিপন্ন হয়। শুধু হিন্দু নয় হিন্দু-ব্রাহ্মণ হয়ে এরা অতি নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ড ও অগ্নিদাহ ঘটাতো। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা কিরূপ ধর্মবিদ্বেষী হয় তা এদের ব্যবহারে বুঝতে পেরেছিলাম। আমি বাধ্য হয়ে এদের গুলি করে জখম করি দুষ্কর্মের সময়। কোনও এক উগ্র হিন্দু উদর-স্ফীতিরোগে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে বিকারগ্রস্ত হয়ে বলেছিল, ‘আমি দশটি মুশ্লিম ভক্ষণ করেছি। ডাক্তারবাবুকে চারটে বার করে দিতে বলো।’

সাম্প্রদায়িকতা যে কিরূপ ভীষণ মনোরোগ সৃষ্টি করতে পারে আমি তার ওই কথা থেকে বুঝতে পেরেছিলাম।

মহাদাঙ্গার কারণ নিরূপণের জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এনকোয়ারি-কমিশন বসালেন। আমি ওখানে আমার বক্তব্যে প্রমাণ করেছিলাম যে দাঙ্গার প্রথম দিনে ধর্মতলা স্ট্রীটের মুশ্লিম দোকানগুলিতে এক বিশেষ চিহ্ন আঁকা থাকাতে দুয়ার ভেঙে লুণ্ঠন করা হয় নি। প্রতিরোধের জন্য কিছু তদারকি ব্যবস্থা ওই রাস্তায় মোতায়েন করা হয়। সাক্ষ্যদানকালে জনৈক ব্রিটিশ অফিসারও দেবজ্যোতি বর্মনের জেরায় ওই চিহ্ন দেখেছেন বলে স্বীকার করেন। আমার উপর গভর্নমেন্টের অভিযোগ: অথবা ট্রানস্‌ফারেন্স অফ পপুলেশন এবং দেবজ্যোতি বর্মনকে জেরার জন্য তথ্য সরবরাহ। অন্যদিকে ওঁরা হীরেন্দ্র সরকার ও সত্যেন্দ্র মুখার্জির উপরও বিরক্ত। এনকোয়ারি-কমিশনের সাক্ষ্যে সত্যেনবাবু বলেছিলেন যে অ্যাংলো-কর্মীরা দাঙ্গাকালে ইন্ধন যুগিয়েছে। সরকার-সাহেবের কিছু অপ্রিয় সাক্ষ্যও তাঁদের মনোমত হয় নি।—সরকার-সাহেব দীর্ঘ ছুটিতে ইংলণ্ড চলে গেলেন। সত্যেন্দ্র মুখার্জি আঠারো মাস ছুটির জন্য আবেদন পাঠালেন। আমাকে ময়ূরভঞ্জ রাজপ্রাসাদে মিলিটারীদের লিয়াঁসো অফিসাররূপে সেখানে আটকানো হ’ল। ময়ূরভঞ্জে গুর্খা-রেজিমেন্টের কর্তা ইংরাজ-কর্নেল আমাকে বলেছিলেন যে একমাত্র গুর্খা সৈন্যদের বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু সেখান থেকে হঠাৎ আমাকে ডেকে কাশীপুরের ও চিৎপুরের যুগ্ম ইনচার্জ করায় আমি সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি।

দেশ-বিভাগ ও স্বাধীনতা দুটি ঘটনাই যে অত্যাসন্ন তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। হঠাৎ কড়েয়ার য়ুরোপীয় ব্রথেলগুলির নারীদের জাহাজ ভর্তি করে বিলাতে পাঠাচ্ছে দেখে আমি বুঝেছিলাম যে ওদের কোনও কালিমা ওরা এদেশে রেখে যেতে চায় না। ওদিকে ওয়াকিবহাল মুশ্লিম সিভিলিয়ান ও রাজনীতিবিদরা পরিবারবর্গকে ঢাকায় পাঠাতে শুরু করেছেন। ব্রিটিশ রাজত্বের কলিকাতা-পুলিশের শেষ প্যারেড ট্রেনিং ইস্কুলের বদলে লালবাজারে অনুষ্ঠিত হয় গভর্নরের উপস্থিতিতে। কিন্তু ওই প্যারেড কম্যাণ্ড করার জন্য কোনও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তাঁদের অবর্তমানে ওই প্যারেড আমি কম্যাণ্ড করি। হীরেন্দ্র সরকারের স্থলে প্রণব সেন গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি হয়ে আসেন। দোহা সাহেবের স্থলে হরিসাধন ঘোষচৌধুরীকে হেড-কোয়ার্টারের ডেপুটি-কমিশনার করা হয়েছিল।

[হরিসাধন ঘোষচৌধুরী পরবর্তীকালে পুলিশ-কমিশনার হয়েছিলেন। ইনি অধীনস্থ কর্মীদের এলাকায় বসবাসকারী রিটায়ার্ড অফিসারদের খোঁজ-খবর নিতে বলতেন, যাতে তাঁরা ভাবেন যে তখনও তাঁরা পুলিশেরই একজন। তাঁদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা কার্যে প্রযুক্ত করতে বলতেন। তিনি পুলিশ মেডিকেল ইউনিট ও সংযোগ-ব্যবস্থা প্রভৃতি চালু করা সত্ত্বেও সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। প্রণবকুমার সেনও পরবর্তীকালে পুলিশ কমিশনার হয়েছিলেন। রাজপথের বর্তমান ট্রাফিক-লাইটগুলির তিনিই প্রবর্তক। লালবাজার কণ্ট্রোল-রুম ও ওয়্যারলেসেরও তিনি উন্নতি-বিধান করেন। বর্তমান স্পেশাল কনস্টেবল-প্রথা তিনিই তৈরি করে গেছেন। কিছু সুন্দর ইংরাজি ফ্রেজ তাঁর সৃষ্টি, যথা: লাইফ অফ ভালগারিটি, সেন্স অফ ইনসিকিউরিটি ইত্যাদি।]

চিৎপুর থানার যিনি ইনচার্জ তিনি দুটি বস্তি পুড়িয়ে এবং বহুজনকে হত্যা করে পূর্ববঙ্গে পলাতক। আমি ওখানে ঘাঁটি করে যুগ্ম-ইনচার্জ হলাম। সমগ্র থানা-এলাকা গরম। থানায় আমি একা হিন্দু অফিসার। প্রত্যেক জুনিয়র-অফিসার ও শতকরা আশিজন কনস্টেবল মুশ্লিম। অ্যাসিসটেন্ট ও ডেপুটি কমিশনারও মুশ্লিম, তাঁরা ছুটিতে পূর্ববঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব।

মিশ্রপল্লী হতে কোনও হিন্দু ভয়ে অন্যত্র চলে গেলে অন্য হিন্দুদ্বারা ওই বাড়িটি দখল হ’ত। এমনি একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে এক উপনেতা সপরিবারে অধিষ্ঠান করেন। তাঁর দুই পুত্র প্রতিরোধ-দলের শ্রেষ্ঠ ওয়ার্কার ছিল।

পুরুষদের অনুপস্থিতিতে ওদের বাড়ি চড়াও হয়ে গুণ্ডাদল এক চতুর্দশী বালিকাকে টেনে রাস্তায় আনে। সংবাদ পাওয়ামাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হই এবং একজনকে পদাঘাতে ও অন্যজনকে ঘুষি মেরে মেয়েটিকে বুকের মধ্যে টেনে নিই। গুণ্ডারা আমাকে দেখে পলায়নোাত হলেও শিকার-ত্যাগের বাসনাও ছাড়তে পারে না। আমি অস্ত্র বার করে ফাঁকা আওয়াজ করায় ওরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে।—মেয়েটি স্বভাবতই কৃতজ্ঞতাবশত পরবর্তীকালে রাত্রে ও-অঞ্চলে রাউণ্ডে গেলে চা তৈরি করে খেতে অনুরোধ করতো।

এটা লক্ষ্য করে গুণ্ডাদের কেউ বা অন্য কেউ আমার নামে বেনামী পোস্টকার্ড পাঠায়। তাতে লেখা: ‘মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ একাধিক চিঠি আসে। আমি সেগুলি লালবাজারে পাঠিয়ে দিলে কমিশনার নর্টনজন মন্তব্য লেখেন: ‘হু ইজ দিজ ফ্রেণ্ড?’—একরাত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর রায়বাহাদুর রমণী ব্যানার্জির সংবাদে ছুটে গিয়ে দেখি, ওদের টিনের বাড়িটি জ্বলছে আর দুই ব্যক্তি সাংঘাতিকভাবে আহত। কিন্তু ওই মেয়েটিকে জীবিত বা মৃত বহু বস্তি তল্লাসী করে ও খুঁজে পাই নি। এখনও বক্ষে তার সেই দিনের নিশ্চিন্ত-নির্ভর কোমল স্পর্শ টুকু আমি অনুভব করি।

[ঠিক ও-রকম আমি একদা একটি মুশ্লিম-বালিকাকে মেছুয়া এলাকায় হিন্দু-গুণ্ডাদের কবল হতে রক্ষা করি। তাকে কিন্তু নিরাপদে তার আত্মীয়দের বাড়ি পৌঁছে দিতে পেরেছিলাম।]

দুষ্টলোক রটাতে থাকে যে উক্ত ঘটনাবলীর জন্য প্রতিশোধ নিতে অসম্প্রদায়িক হয়েও কিছু গুলিবর্ষণ করি। কিন্তু তার মধ্যে এতটুকু সত্য ছিল না। অন্যায় প্রতিশোধ বা উৎপীড়নের আমি আদৌ পক্ষপাতী নই।

কিছু লীগ-নেতার মুশ্লিম-প্রধান পূর্ব-কলিকাতাকে একটি নগর-রাষ্ট্রে পরিণত করার অভিলাষ। মহাদাঙ্গার সময় পূর্ব-কলিকাতার বহুস্থান হতে হিন্দুরা অন্যত্র চলে গিয়েছে। গঙ্গাকূলবর্তী ফ্রেঞ্চ-চন্দননগরের মতো একটা আউটলেট পেতে ওদের চিৎপুর-এলাকাটি প্রয়োজন। এজন্য পরে একটি প্লেবিসাইট করলে সুবিধা হবে। কিন্তু ওদের এই ষড়যন্ত্র আমি ব্যর্থ করে দিই।

আমি সংবাদ পেলাম একটি বিশেষ তারিখে রাত্রি দুটোর সময় ওরা পাইকপাড়া ও রানী রোড অঞ্চল আক্রমণ করে হিন্দু-বাসিন্দাদের বিতাড়িত করবে। রানী রোডের ওপারে বস্তি এলাকায় লীগের গাড়ি করে বহু বহিরাগত গুণ্ডাদের আমদানি করা হয়েছে। অস্ত্র হিসাবে স্টেনগান ও ব্রেনগান তুলে দেওয়া হয়েছে ওদের হাতে। এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠানো সত্ত্বেও তার কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নি। আমি স্থানীয় হিন্দু ও কিছু মুশ্লিমণের সাহায্যে প্রতিরোধে প্রস্তুত হয়েছিলাম।

নির্ধারিত দিন ক্ষণে প্রায় চার হাজার বহিরাগত গুণ্ডাদের আক্রমণ শুরু হ’ল। আমার দেহরক্ষীর উদর ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল গুলি। তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলাম। উভয় মহল্লার মধ্যস্থলে রানী রোড। আমি সকলকে সীমানা হতে পিছিয়ে আনলাম। এই উদ্দেশ্যে যে আমাদের কেউ যাতে আক্রমণকারী বলতে না পারে। উপরক্ত দ্রুতগতিতে ইট গেঁথে একটা রক্ষা-পাঁচিলও তৈরি করা হ’ল। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে এই যুদ্ধ চলে। প্রথমে দুজন স্থানীয় তরুণ আহত হয়, একজনের পুরো ডানহাত উড়ে গিয়েছিল। দুজনকেই হাসপাতালে পাঠালাম তৎক্ষণাৎ। ওদের মধ্যে একজন বর্তমানে এ্যাডভোকেট মদন চক্রবর্তী। একজন গুর্খা সিপাই ঘটনাস্থলেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। শুরু হ’ল আমাদের প্রতি-আক্রমণ। ওরা বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে। ওরা হত বা আহত সঙ্গীদের ঘটনাস্থলে ফেলে রেখেই পলায়ন শুরু করলো। ওদের পশ্চাদ্ধাবন করে আমি আর মৃতের সংখ্যা বাড়াই নি।

কিন্তু কিছু বহিরাগত তরুণ মানা সত্ত্বেও সীমানা পেরিয়ে বস্তিতে অগ্নিসংযোগ করেছিল। আমি গুলিবর্ষণ করে ওদের বিতাড়িত করে ফায়ার-ব্রিগেড ডেকে আগুন নেবাই। আমি ডানপায়ে আঘাত পাওয়ায় ওদের রুখতে পারি নি। উভয় সম্প্রদায়ের কিছু লোকক গ্রেপ্তারও করা হয়। ওই এক রাত্রির ব্যবস্থায় কলকাতার দাঙ্গা সম্পূর্ণ থেমে গেল।

থানায় ফিরে দেখি সেখানে ইংরাজ পুলিশ কমিশনার ও ইংরাজ গভর্নর স্বয়ং উপস্থিত। কলিকাতা-পুলিশের কোনও থানায় সেই প্রথম ও সেই শেষ বাংলার লাট সাহেবের আগমন। ওঁরা ঘটনাস্থলও পরিদর্শন করেছিলেন। স্থানীয় মুশ্লিম-অধিবাসীরা তাঁদের বলেছিলেন যে আমিই তাদের রক্ষা করেছি। তবু তাঁরা আমাকে ওই স্থানেই সাসপেণ্ড করেছিলেন। আমিই একমাত্র অফিসার যে ওই মহাদাঙ্গার সময় ওঁদের শিকার হয়েছিলাম। আমার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তের আদেশ হয়। হিন্দু-মুশ্লিম উভয়-সম্প্রদায় এবং অ্যাংলো দমকল কর্মীরা আমার পক্ষে সাক্ষী দেয়। আমি অনারেব্‌ লি এবং রি-ইনস্টেটিভ হয়েছিলাম। প্রণব সেন, আই-পি সক্রিয়ভাবে আমার পক্ষ না নিলে আমার খুব অসুবিধা হ’ত।

তাছাড়া বসুমতী আনন্দবাজার অমৃতবাজার প্রভৃতি বহু পত্র-পত্রিকায় আমার পক্ষে সম্পাদকীয় লেখা হয়। নাগরিকগণ ও মান্যগণ্য ব্যক্তিগণ ইংরাজ-সরকার বরাবর গণ-দরখাস্তও পাঠিয়েছিলেন। আমার পক্ষে শ্লোগান-সহ কয়েকটি মিছিল ও ডেপুটেশনের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে আমার অব্যাহতি-লাভ ত্বরান্বিত হয়। এই সময়ে বহুবাজারের নিকট সেন্টাল এভেনিউ-এ এক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে। একটি জীপ-গাড়ির মধ্যে দুটি স্টেনগান ও বহু বোমা-সহ দুই ব্যক্তিকে কজন অ্যাংলো সার্জেন্ট ধরে ফেলে। কিন্তু পথেই দুজন য়ুনিফর্ম-পরা ব্যক্তি থানার ইনচার্জ-অফিসার ও সেকেণ্ড অফিসার রূপে পরিচয় দেয় এবং বামাল-সমেত আসামীদ্বয়কে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে তাঁদের ডিউটিতে ফিরে যেতে বলে। এই সার্জেন্টরা পরে থানায় এসে জানতে পারে যে ও-রকম কোনো আসামী বা অস্ত্রশস্ত্র কেউ থানায় আনে নি।

পরদিন ইংরাজ-কর্তৃপক্ষ কজন হিন্দু-অফিসারকে লালবাজারে ডেকে পাঠান। আমাকে বিশেষ করে সেখানে আসতে বলা হয়। আমাদের সকলকে সনাক্তকরণের জন্য একে-একে ওই সার্জেন্টদের সম্মুখে আনা হ’ল। কিন্তু ওরা আমাদের কাউকেই সনাক্ত করতে পারে নি। এই অপমানজনক ব্যবহারে আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম।

মহাত্মা গান্ধী

গান্ধীজী বেলেঘাটায় এক মুশ্লিমের বাগান-বাড়িতে এলেন। তাঁর উপস্থিতির ফলে শহরের পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন ঘটে। গতকাল যারা হানাহানি করেছে আজ তারা গলাগলি করে শাস্তি-মিছিলে সামিল। হিন্দু-মুশ্লিম আবার ভাই-ভাই হয়ে যায়। (তাহলে বাংলা দেশ-বিভাগের প্রয়োজন কী ছিল?)

[বিঃ দ্রঃ-গান্ধীজী শীতের রাত্রে এক বারান্দায় নগ্নগাত্রে বসেছিলেন। এক পুলিশকর্মী, যার সর্বাঙ্গ মোটা বনাতের ওভারকোট দ্বারা আবৃত, সলজ্জভাবে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে, ‘বাপুজি, আপনার শীত করছে না।’

গান্ধীজী তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তারপর মৃদু হেসে পাল্‌টা প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা তোমার নাকটা তো ঢাকা নেই, ওখানে ঠাণ্ডা লাগে না।’

পুলিশ অফিসার উত্তরে ‘অভ্যাস’ বলায় তিনিও জানান যে খালি গায়ে থাকা তাঁর অভ্যাস।]

আমাকে গান্ধীজীর নিকট উপস্থিত করা হয়েছিল। জনাব সুরাওয়ার্দি সাহেব তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গান্ধীজীকে বলেন যে আমার চিৎপুরের এপিসোডে খুব একটা দোষ নেই। গান্ধীজী আমাকে মুশ্লিমদের সেবা করার উপদেশ দিয়েছিলেন।

[গান্ধীজীর নিহত হওয়ার সংবাদে মুশ্লিম দোকানীরা কাঁদতে-কাঁদতে আমাকে বলেছিল, ‘বাবুজি, আপলোক-কো তো বহুত নেতা আছে, লেকেন হামলোককো ওহী এক-ই নেতা হ্যায়।’]

আমি এই সময় কংগ্রেসী-বন্ধুদের ডিপ্লোম্যাটিক হতে বলি। পাকিস্তান হিন্দুস্থান-বহির্ভূত স্বাধীন পশ্চিমবাংলা চাইলে স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য বাংলার অর্ধেকের উপর পাওয়া যেতো। তারপর ভারত-রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যরূপে যুক্ত হ’ত। তাহলে বাস্তুহারা-রূপ কোনো সমস্যা বাঙালীদের থাকতো না। কিন্তু ওঁরা কেউই বাঙালীরূপে ভাবতে অভ্যস্ত ছিলেন না।

সৌভাগ্য এই-যে ঠিক সময়ে গান্ধীজী কলকাতায় এসেছিলেন। নইলে, পশ্চিম ও পূর্ববঙ্গ হয়তো উভয়-পাঞ্জাবের মতো যথাক্রমে মুশ্লিম ও হিন্দুশূন্য হ’ত। এতে বাস্তহারা সমস্যা পাঞ্জাবের মতো অতি সহজে মীমাংসা করা যেত। বাঙালীদের ভিটামাটির প্রতি অনন্য মমতা, তবু তাঁরা অন্য বাঙালীদের মতো স্বাধীন বাংলা দেশের অভ্যুদয় পর্যন্ত কোনরূপে টিকে থাকলে ভালো হ’ত। প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ অফিসারদের অদল-বদল ব্যবস্থা গ্রহণ না-করলে বাংলার হিন্দু মুশ্লিমরা স্ব-স্ব স্থানে হয়তো টিকে থাকতেন। হঠাৎ পশ্চিম বাংলা হতে মুশ্লিম-পুলিশ এবং পূর্ববাংলা হতে হিন্দু-পুলিশ চলে আসার ফলে জনগণের মনোবল ভেঙে পড়ে। নচেৎ বাঙালী মুশ্লিম ও হিন্দু ভিটাত্যাগের এতটুকু চিন্তাও করতো না। তা না-হওয়ায় পশ্চিম বাংলায় একমুখী বাস্তুহারার আগমনে মহাসমস্যার সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশরা দেশ-বিভাগের পরও কিছুকাল থাকলে ভালো হ’ত। তাড়াহুড়া করে জীবদ্দশাতেই স্বাধীনতা ও ক্ষমতা-ভোগে লিপ্স নেতারা এ বিষয়ে এতটুকু দেরি করতে রাজী নন। তাঁরা সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার বিষয় একটুও চিন্তা করলেন না।

দেশবিভাগজনিত পাঞ্জাবের রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামার পর দ্বিমুখী বাস্তুত্যাগ ও নির্বিচার গণহত্যা এবং বাংলার একমুখী উৎপীড়িত বাস্তুহারাদের সম্পর্কে কলকাতার এক জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রে সম্পাদকীয় প্রবন্ধে লেখা হয়: ‘ঈশ্বর ওদেরকে ক্ষমা করো। ওরা জানে না ওরা কি করেছে।’

[আশ্চর্য এই-যে মুশ্লিম-নেতারা পাকিস্তানে পাড়ি দেবার কালে মুশ্লিম-জনগণের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না। বাস্তুত্যাগে অক্ষম মুশ্লিম-সমাজ নেতাদের ধোঁকাবাজি বুঝে অবাক হয়ে ভাবে যে এ-সবের প্রয়োজন কি ছিল। নিরাপত্তার অভাব না-থাকায় তারা বাস্তুত্যাগ করে নি।

কিন্তু বিহারী নিম্নপদস্থ মুশ্লিম-সিপাহী পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গিয়ে পরে মোহভঙ্গ হওয়ায় আবার ফিরে আসে। আমাদের চেষ্টায় তারা কলিকাতা-পুলিশে পুনর্বহাল হয়।

অন্যদিকে যে-সব সিডিউল কাস্ট মেম্বাররা লীগ-গভর্নমেন্টের বিশিষ্ট সহায়ক-রূপে পার্টিশনের বিকল্প ব্যবস্থার পরিপন্থী হন তারাও শেষ অবধি পাকিস্তান হতে বিতাড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।]

ওই সময় কলিকাতা-পুলিশের এক মহা-দুঃখবহ দিবস। বহুদিনের বন্ধু মুশ্লিম-সহকর্মীরা পূর্ব-পাকিস্তানে চলে গেলেন। সহকর্মীদের নিকট হতে বিদায় নেবার সময়টুকুও তাঁরা পান না। য়ুরোপীয় ও মুশ্লিম ঊর্ধ্বতন অফিসাররা তখন পোটলা-বেঁধে তৈরি। লালবাজারে আমার কম্যাণ্ডে শেষ পুলিশ-প্যারেড অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় লীগ-মন্ত্রীরা শেষবারের মতো বিষোদ্গার করলেন। গভর্নর কয়েকজন কর্মীকে পদক দিলেন এবং বিগত দিনের স্মৃতি ভুলে যেতে বললেন।

পুলিশ-কমিশনার হার্ডিক সাহেব নর্টনজনকে চার্জ বুঝিয়ে ঘুরোপে পাড়ি দিলেন। নর্টনজনই কলিকাতা-পুলিশের শেষ কমিশনার। প্রথম ভারতীয় পুলিশ-কমিশনার সুরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে চার্জ বুঝিয়ে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানে প্রস্থান করেন। তখনও পশ্চিম বাংলায় ছায়ামন্ত্রী তথা আণ্ডার-ট্রেনিং মন্ত্রী ও প্রকৃত মন্ত্রীর দ্বৈত-শাসন অব্যাহত।

লালবাজারে ড্রিলের দিন পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ বক্তৃতা দিতে আসেন। সেইদিনই ভারত পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী সেদিন উপস্থিত অফিসারদের বলেন যে পুলিশ হ’ল দৌবারিক, তারা যেন কারো কাছে হাতজোড় না করে। দুয়ার রক্ষার্থে তাকে উচিত-মতো কঠোর হতেই হবে। তাঁর এই বক্তৃতা আমাদের সকলেরই ভালো লাগে। তিনি আরও বলেন যে আনুগত্যহীন অফিসারদের সহ্য করা হবে না।

সদ্যোস্বাধীন দেশের মুখ্যমন্ত্রী অতঃপর ড্রিল হল-এ প্রবেশ করলে অফিসাররা তাঁকে সম্মান দিতে দাঁড়াবে কি-দাঁড়াবে না তা ঠিক করতে পারেন না। তাঁরা উঠি-উঠি করেও বসে পড়েন। বহুদিনের পুরানো অভ্যাস ত্যাগ করা কঠিন। ইংরাজ পুলিশ-কমিশনার নর্টনজন তখনও সুরেন্দ্র চ্যাটার্জিকে চার্জ বুঝিয়ে দেন নি। মিঃ নর্টনজন অফিসারদের দোদুল-মনোভাব দেখে নিজেই হাতের ইশারায় মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, ‘আপ, (up)।’ পরাধীনতা ও স্বাধীনতার সন্ধি-সীমায় দাঁড়িয়ে অফিসাররা কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

[সুরেন্দ্র চ্যাটার্জি কলিকাতা-পুলিশের প্রথম ভারতীয় কমিশনার। তিনি পল্লীতে-পল্লীতে হিন্দু-মুশ্লিমের যুক্ত মিটিং করে প্রতি জায়গায় নিজে বক্তৃতা দিতেন। আমি এরূপ বহু সভা, সংগঠন করে তাঁর কাজে সাহায্য করেছিলাম। সুবক্তা কমিশনার-সাহেব এভাবে হিন্দু-মুশ্লিম সম্প্রতি ফিরিয়ে এনেছিলেন। এই তেজস্বী ভদ্রলোক ব্যক্তিত্বে ও কর্ম-দক্ষতায় অনন্য ছিলেন।]

বাংলার প্রশাসন ও পুলিশের ইতিহাস এক ও অবিভাজ্য ছিল। এবার তা দুভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এপার বাংলা এপারের এবং ওপার বাংলা ওপারের ইতিহাস পড়বে। তবু পিছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে মূল-ইতিহাস একটাই। আমার মাত্র পনেরো বছরের চাকুরি-জীবনের মধ্যে এক মহা-অঘটন ঘটে গেল সেদিন। সেই কলকাতাকে আজও আমি স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পাই।

বাংলা-বিভাগের পরই বোঝা গেল যে এর জন্য বাঙালী-মাত্রই অনুতপ্ত। সেই মুহূর্তে কোনও নেতা সংযুক্ত বাংলার কথা বললে জনগণ তাঁকে স্বাগত জানাতো। কিন্তু সেইরূপ ব্যক্তিত্বপূর্ণ সাহসী নেতা একমাত্র সুভাষচন্দ্র ছাড়া আর কারই-বা নাম করা যায়। সুভাষচন্দ্র এই সময় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে প্রতিটি সমস্যার পূর্ণ মীমাংসা হ’ত। তাঁর প্রত্যাবর্তন যতই বিলম্বিত হবে এই-সব সমস্যা ততই সুদূরপরাহত হতে বাধ্য। নতুন বংশধরদের পুরনো ঐতিহ্যের প্রতি মমতা বিশেষ থাকবে না। সমগ্র প্রদেশ কেবল কাজী নজরুল এবং নদীর জল-মাছ ও পাখি ছাড়া বিলকুল সব ভাগ হয়ে গেল।

প্রথম প্রথম জনগণ পূর্বের মতো কিছুকাল বিনা পাশপোর্ট ও ভিসায় উভয়বঙ্গে যাতায়াত করছিল। দেশ যে বিভক্ত তা অন্তত সাধারণ বাঙালী কিছুতে বুঝতেই চায় নি। উভয় বঙ্গের পুলিশও পরস্পরকে মদত দিতো এবং পরস্পরের এনকোয়ারিশিপের উত্তর আদান-প্রদান করতো। এমন-কি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ওপার বাংলার স্কুল-কলেজের পরীক্ষাও গ্রহণ করেছে। এদিক থেকে ওদিকে নোট ও টাকা-পয়সা পাঠানোও হয়। এই ব্যবস্থা আরও কিছুকাল স্থায়ী করা যেতো। কিন্তু শীঘ্রই উভয়-দেশের সরকারী ব্যবস্থাপনায় এই সহজ সংযোগ-সূত্রগুলি বিচ্ছিন্ন করা হ’ল।

হিন্দু-মুশ্লিমের মিলিত শহর কলকাতা আজ অতীতের বস্তু। সিটি অফ প্যালেসের বদলে কলকাতা আজ সিটি অফ হকার্স। শহর কলকাতাকে যদি আজ জিজ্ঞাসা করা যায়, তুমি কার? তাহলে সে ওপার বাংলার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বলবে, অন্তত তোমাদের নই।

অঙ্গচ্ছেদের ফলে আমরা যা হারিয়েছি তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু উত্তরাধিকার-সূত্রে আমরা যে মহান ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক তা রক্ষা করা প্রত্যেক বাঙালীর পবিত্র কর্তব্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *