পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ— ছড়ার অর্থ

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ— ছড়ার অর্থ

২০ জুন, ২০১৮, চন্দননগর

কেন জানি না, আচমকা আমার এতক্ষণের ভয় ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছিল। এক লম্বা অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে আলো দেখতে পাবার মতো আমিও একটা সূত্র দেখতে পেলাম। বারবার করে দেবাশিসদার লেখাটা পড়ছিলাম…

“প্রিয়নাথের শেষ হাড়
মুরের কাব্যগাথা
গণপতির ভূতের বাক্সে
তারিণীর ছেঁড়া খাতা”

চার লাইনের কবিতায় চারজনের কথা, যার তিনজন আমার কাছে পরিচিত, দ্বিতীয়জন ছাড়া। কিন্তু মুশকিল হল, এদের নিয়ে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন দেবাশিসদা? আর তাঁকে এমনভাবে মরতেই বা হল কেন? খুব সম্ভব দেবাশিসদা এমন কিছুর খোঁজ পেয়েছিলেন, যাতে কারও অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। সে বা তারা সেটার খোঁজেই এসেছিল। দেবাশিসদাকে অত্যাচার করে জানতে চেয়েছিল তার হদিশ। দেবাশিসদা সহজে বলেননি, আমি নিশ্চিত। তাহলে লিং-চির প্রয়োজন হত না। কিন্তু কী সেই জিনিস?

“কী ব্যাপার, মুখে যে কথা ফুটছে না… কিছু বুঝলেন?” চমক ভাঙল পুলিশ অফিসার মুখার্জির কথায়। “এদের চেনেন? এই প্রিয়নাথ, মুর, গণপতি, তারিণী…?”

“মুরকে চিনি না। বাকিদের চিনি।”

“অ্যাঁ? বাহ, চমৎকার। তাহলে চাঁদমুখ করে ঠিকানাগুলো দিয়ে দিন তো। ধরে নিয়ে আসি।”

মশকরা করার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে ইচ্ছে হল না। বললাম, “আগের ঠিকানা কিছু জানা আছে। কিন্তু এখন কোথায় আছেন তা জানতে গেলে একটু পরিশ্রম করতে হবে।”

“কীরকম?”

“একটা উইজা বোর্ড লাগবে।”

“কী বোর্ড? বাংলায় বলুন”, অফিসারের চোখ মুখ দিয়ে প্রচুর বিস্ময় ফেটে বেরোচ্ছে।

“বাংলায় বলতে গেলে বলতে হয় ভৌতিক স্বতঃলিখন যন্ত্র। একটা বড়ো কাঠের বোর্ডের ওপর বিভিন্ন অক্ষর A থেকে Z, সংখ্যা ১ থেকে ৯, ০ লেখা থাকে। তার ওপর তিনকোনা এক বোর্ড ক্যাস্টর দানার ওপরে এমনভাবে বসানো থাকে যাতে বড়ো বোর্ডটা নির্বিঘ্নে ঘুরতে পারে। হাতের আঙুলের চাপে ছোটো বোর্ড বড়ো বোর্ডে লেখা অক্ষরের ওপর ঘুরে ঘুরে এক-একটা শব্দকে নির্দেশ করে। বিদেহী আত্মাই নাকি মিডিয়ামের আঙুলের ওপর ভর করে উত্তরের শব্দগুলো বলে দেয়।”

“মানে?”

“ধরুন, কয়েকজন একসঙ্গে বসেছেন। চোখ খুলে ধ্যান করছেন আর বলছেন, এই ঘরে কোনও শুভ শক্তি থাকলে সাড়া দিন। সবার হাত বোর্ডের লাভ সাইনের উপর। বোর্ডের লাভ চিহ্ন গিয়ে নিজে নিজে বসবে YES ঘরের উপর। মনে করুন, আপনি জিজ্ঞেস করলেন, প্রিয়নাথ তুমি ঘরে আছ? দেখবেন আবার সেই লাভ চিহ্ন YES ঘরে বসবে। তারপর আপনার যা যা জিজ্ঞেস করার করে নেবেন। তবে হ্যাঁ, উত্তর যেন হ্যাঁ, না-তে হয়। বেশি বড়ো উত্তর তেনারা দিতে পারেন না…”

“শুনুন মশাই, আমার সঙ্গে ফাজলামি করতে আসবেন না, হ্যাঁ… এমন জায়গায় ভরে দেব যে সাতদিন সোজা হয়ে বসতে পারবেন না। সোজা কথায় বলুন। এদের ঠিকানা জানেন, না জানেন না?” বুঝলাম বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি। তবু কনফিডেন্স হারালাম না, “কী করে জানব? তিনজনই মরেছেন বহুকাল হল। এখনকার ঠিকানা জানা নেই।”

“কারা এঁরা?”

“প্রিয়নাথকে অন্তত আপনার চেনা উচিত ছিল। যাই হোক, বলেই দিই। দেবাশিসদার থেকেই এঁর কথা শোনা। প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৫৫ সালে, নদিয়ার চুয়াডাঙায়। পেশায় পুলিশ কর্মচারী। বাংলায় প্রথম গোয়েন্দা গল্পের লেখক। প্রধানত নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘দারোগার দপ্তর’ নামে একটা সিরিজ ১২৯৭ বঙ্গাব্দ থেকে টানা বারো বছর চালিয়েছিলেন তিনি। তখনকার দিনে হটকেকের মতো বিক্রি হত। প্রিয়নাথ ১৮৭৮ থেকে ১৯১১ সালের ১৫ মে অবধি কলকাতা ডিটেকটিভ পুলিশে কাজ করেন। দারোগার দপ্তর প্রতি মাসে বেরোত। তখনকার দিনে সব শিক্ষিত বাঙালির ঘরে অন্তত দুই-এক কপি এই বই দেখা যেতই। যেসব কেস প্রিয়নাথ সলভ করেছিলেন তাদের বিস্তারিত বিবরণ লেখা থাকত এর পাতায় পাতায়। অবশ্য পরে পাঠকের চাহিদার চাপে কিছু বিদেশি গল্পও সত্যি বলে চালিয়েছিলেন…”

“অ… তা এই ভদ্রলোকের হাড়ের কেসটা কী?”

“সেটাই তো মাথায় ঢুকছে না… হার হলে নাহয় বুঝতাম কোনও কেসে হার জিতের হারের কথা হচ্ছে। আবার গলায় পরার অলংকার যে হার, তাও হতে পারত। কিন্তু এ হাড় তো হাড্ডি। যা মানুষের ২০৬ খানা থাকে…” বলেই চমকে উঠলাম। জটায়ুর ভাষায় হাই ভোল্টেজ স্পার্ক।

“বুঝেছি। প্রিয়নাথের শেষ হাড় কী বুঝেছি… শোনা যায় জীবৎকালে মোট ২০৬টা কাহিনি লিখেছিলেন প্রিয়নাথ, যার মধ্যে ২০৫টার সন্ধান পাওয়া যায়। আর-একটা কাহিনি কবে লিখেছিলেন, কী ছিল তাতে, কেউ জানে না। হয়তো এমন কিছু ছিল, যা তখন প্রকাশের অযোগ্য মনে করে পাণ্ডুলিপি ধবংস করে দিয়েছিলেন প্রিয়নাথ নিজেই। হয়তো সেই কেসে তাঁর হার হয়েছিল। অন্তত এমনটাই এতদিন ভাবা হত। কিন্তু দেবাশিসদার এই লেখা পেয়ে কেন জানি মনে হচ্ছে প্রিয়নাথের এই হারিয়ে যাওয়া পাণ্ডুলিপির খোঁজ তিনি পেয়েছিলেন…”

“সে পাণ্ডুলিপির খুব দাম বুঝি?” অফিসারের গলা এবার বেশ নরম।

“দাম তো বটেই। হাতে পেয়ে গেলে কলকাতার ইতিহাস আবার নতুন করে লিখতে হবে কি না কে জানে।”

বুঝতে পারছিলাম ইনস্পেক্টর গভীর চিন্তায় পড়েছেন। খানিকক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “আর বাকি দুজন?”

“গণপতি মানে জাদুকর গণপতি। গণপতি চক্রবর্তী। জন্ম শ্রীরামপুরের কাছে ছাতরা গ্রামে একটি জমিদার পরিবারে। ছেলেবেলায় লেখাপড়ায় উৎসাহী ছিলেন না। বরং গানবাজনায় বেশি উৎসাহ ছিল তাঁর। সতেরো-আঠারো বছর বয়েসে তিনি গৃহত্যাগ করেন, হিন্দু সাধুদের থেকে গুপ্ত মন্ত্রতন্ত্র, ভবিষ্যৎ ও অদৃষ্ট গণনা, ঝাড়ফুঁক এবং নানা রোগের অলৌকিক চিকিৎসাবিদ্যা শেখার জন্য। তিনি দু-একজন জাদুকরের সংস্পর্শেও এসেছিলেন। সেই সময় নানা জাদু শিখে পরে গুরুর কথাতেই আবার সংসারে ফিরে আসেন। শুরুতে উইজার্ডস ক্লাবে মামুলি হাতসাফাই ইত্যাদির খেলা দেখাতেন। কেউ বেশি পাত্তা দিত না। তারপর কিছু একটা হয়। রাতারাতি ক্লাবে গণপতি একজন কেউকেটা হয়ে ওঠেন। প্রায় একই সময়ে কলকাতায় কার্টার সাহেব ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলেন। সাহেবের শেষ শো-তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে। কার্টার এবং সহকারী স্টেজেই মারা যান। কিন্তু কীভাবে, তার বিস্তারিত বিবরণ কোত্থাও নেই। সেসময়ের সব পত্রিকা এই ব্যাপারে অদ্ভুতভাবে নীরব।

এই ঘটনার কিছুদিন পরেই গণপতি প্রিয়নাথ বসুর গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে যোগ দেন এবং কৌতুক অভিনয়, মজাদার খেলা দেখিয়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁর পলায়নী বিদ্যা ছিল দেখার মতো। বিদেশে হুডিনির মতো তিনিও যে-কোনো বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারতেন। তিনি ভৌতিক ক্ষমতাসিদ্ধ, দর্শকদের মনে এই ধারণা দৃঢ়মূল হয়েছিল। বেশ কিছুদিন তাঁকে একটা ভারী সিসার বাক্স বয়ে নিয়ে যেতে দেখা যেত। বলতেন এতে নাকি ভূত পোষা আছে। সে বাক্সে কোনও তালাচাবি ছিল না, তবু অনেকে চেষ্টা করেও সেই বাক্স খুলতে পারেনি। বাক্স কীভাবে তাঁর কাছে এল, আর কীভাবেই বা একদিন আচমকা দেখা গেল আর নেই, সে রহস্য আজও কেউ ভেদ করতে পারেনি। আমি শিওর, সেই বাক্সের কথাই দেবাশিসদা বলেছেন।”

“কী করে বুঝলেন? “

“উনিই আমাকে এই বাক্সের কথা বলেছিলেন। বাকি গল্পটাও। এটাও বলেছিলেন, ‘আমরা বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, ইস্টার আইল্যান্ডের রহস্য নিয়ে মাথা ঘামিয়ে চলছি, এদিকে ঘরের পাশেই এত বড়ো সব রহস্য লুকিয়ে আছে, তার খোঁজ কেউ রাখি না।’ তবে আমার বিশ্বাস, চুপিচুপি উনি এই সন্ধানটা চালাচ্ছিলেন। প্রায়ই বলতেন, ‘ভাবতাম আমি একাই এসব জানি। এখন দেখি পিছনে লোক লেগেছে।’ তারা কারা, বা উনি কী খুঁজছেন কোনও দিন বলেননি।”

“আর তারিণী?” স্পষ্টই অফিসার এবার বেশ কৌতূহলী।

“ইনি এমন একজন, যাঁর সঙ্গে আমার রক্তের সম্পর্ক রয়েছে। আমার বড়দাদু, স্বর্গীয় তারিণীচরণ রায়। কলকাতার প্রথম বাঙালি প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তারিণীচরণ ১৮৯০-এর শেষ থেকে কলকাতায় ডিটেকটিভগিরি শুরু করেন। প্রায় সেসময় থেকেই তাঁর ডায়রি লেখার স্বভাব। মৃত্যুর আগে অবধি প্রায় সব ডায়রি আমার কাছে আছে। শুধু ১৮৯২-৯৩-এর শেষের দিকের কিছু অংশের পাতা ছেঁড়া। ১৮৯৫-৯৬ ডায়রিটাই নেই।”

“এও তো এক রহস্য…” অফিসার বললেন।

“তা তো বটেই। দেবাশিসদা এই ডায়রির ব্যাপারে জানতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন। জানতে চাইতেন তারিণী সম্পর্কে। একবার বলেছিলেন ওই ছেঁড়া পাতাগুলো নাকি এক গ্র্যান্ড ডিজাইনের, এক বিরাট জিগস পাজলের শেষ কটা টুকরো। কীসের ডিজাইন, কী পাজল… কিচ্ছু খুলে বলেননি।”

“তাহলে আপনার কী মনে হয়? এই লিস্টটা মরার আগে আপনাকে লিখে পাঠানোর মানে কী?”

আমি আবার ভালো করে লিস্টটা দেখলাম। আর এবার দুটো নতুন ব্যাপার চোখে পড়ল। এক, কবিতাটা জেল পেনে লেখা ধরে ধরে, আর তুর্বসু জানে-টা ডট পেনে দ্রুত হাতে। যার একটাই মানে। কবিতাটা আগে কোথাও লেখা ছিল। তাড়াহুড়ো করে সেই প্যাডের পাতা ছিঁড়ে নিচে আমার নাম লেখা হয়েছে। দ্বিতীয়, যে প্যাডে কবিতা লেখা ছিল, তার বাঁদিকে পারফোরেশান। তাড়াতাড়ি ছিঁড়তে গিয়ে কাগজ অসমানভাবে ছেঁড়া হয়েছে। ফলে পারফোরেশান বরাবর কাগজ না ছিঁড়ে মাঝে কিছুটা ঢুকে গেছে। আর তাতেই হয়েছে বিপত্তি। “মুরের কাব্যগাথা” শব্দে মুরের আগে আর একটি বা একাধিক শব্দ লেখা ছিল। আভাস পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু বোঝা যাচ্ছে না।

অফিসারকে দেখালাম। খানিক নাক চুলকে তিনি বললেন, “তাহলে উপায়?”

“একটু ঝামেলা আছে। একটা মোটা প্যাড, লম্বায় ৫ ইঞ্চি চওড়ায় ৩ ইঞ্চি, একধারে নীল কালির ছাপ… এই বইয়ের গাদা থেকে খুঁজে বার করতে হবে। আর আমি যদি ঠিক ভাবি, তাহলে এই প্যাডটা দেবাশিসদার পাশের টেবিলে দেখেছি। কিছু লিখতে গেলে, সে ফোন নম্বর হোক বা কারও নাম, উনি এতেই লিখতেন। প্যাডের উপরে লাল কভারে Oxford লেখা।”

প্যাড খুঁজে পেতে পনেরো মিনিটের বেশি লাগল না। পাতায় পাতায় ফোন নম্বর, নাম, হিজিবিজি কাটা। আমার নাম আর নম্বরের পাশে লাল কালিতে লেখা ‘তারিণীর প্রপৌত্র’। মাঝামাঝি গিয়ে ছেঁড়া পাতাটা পাওয়া গেল। ত্রিভুজের মতো ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো তাতে আটকানো। খুদে অক্ষরে কী যেন লেখা। ভালো করে দেখতে দেখা গেল, লেখা আছে ‘তৈ’। মানে ‘তৈমুরের কাব্যগাথা’। এতে লাভের লাভ কী হল বুঝলাম না। কে এই তৈমুর? তাঁর কাব্যগাথার সঙ্গে তারিণী বা প্রিয়নাথের কী সম্পর্ক? কিছুটা জট খুলতে না খুলতে আবার পাকিয়ে গেল।

অফিসার পাশেই ছিলেন। “কিছু বুঝতে পারছেন?”

“এটা বুঝছি না। তবে বাকি তিনটে থেকে একটা ভাসা ভাসা ধারণা যেন আকার নিচ্ছে।”

“কীরকম?”

“১৮৯২-৯৩ সালে, যে সময়ে তারিণীর ডায়রির পাতা গায়েব হয়ে গেছে, ঠিক সেই সময়ই প্রিয়নাথ দারোগাগিরি করছেন, গণপতি তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করবেন বলে ভাবছেন… একই সময় এই তিনজন একসঙ্গে কলকাতা শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। আর ঠিক সেই সময় কার্টারের শেষ ম্যাজিক শো-তে স্টেজেই মৃত্যু হচ্ছে। সে মৃত্যু এমন মৃত্যু যে কোনও পত্রিকা খোলসা করে বলছে না ঠিক কী হয়েছিল। না স্যার… আমি নিশ্চিত ভয়ানক কিছু একটা ঘটেছিল সেসময়।”

“সে নাহয় হল, কিন্তু সে তো একশো বছরের আগের ঘটনা। আর এই খুন তো টাটকা। আজকের। এত পুরোনো ঘটনা, যদি কিছু ঘটেও থাকে, তার জন্য এতদিন পরে দেবাশিসবাবুকে মরতে হবে কেন?”

“দেবাশিসদা নিশ্চয়ই কিছুর সন্ধান পেয়েছিলেন। কিছু বিপদ চিরকালীন। ধরে নিন এটাও সেইরকম কিছু একটা। গত একশো বছর ধরে কেউ বা কারা একটা দৈত্যকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চাইছে। আমার স্থির বিশ্বাস, দেবাশিস গুহ জেনে হোক বা না জেনে সেই দৈত্যের গায়ে ঢিল ছুড়ে তার ঘুম ভাঙাতে চেয়েছিলেন।”

ষষ্ঠদশ পরিচ্ছেদ— তৈমুর

১৭ ডিসেম্বর, ১৮৯২, কলিকাতা, রাত ৯টা

খুব অস্থির লাগছিল গণপতির। কিছুতেই যেন নিশ্চিন্ত হয়ে বসতে পারছে না। দুই-একবার মাথায় হাত দিয়ে চুল ঠিক করে নিল। করিন্থিয়ান থিয়েটার আজ কানায় কানায় ভরা। কার্টার সাহেবের ম্যাজিকের আজ শেষ দিন। নবীন মান্না বলেছেন আজ নাকি কী সব স্পেশাল হবে। গণপতি আর তারিণী যেখানে বসে আছে সেখানে বসার সামর্থ্য তাদের নেই। বারো টাকা তাদের দুজনের সারা মাসের আয়ের বেশি। সেদিন সকালে নবীনবাবু গণপতির পলায়নী বিদ্যা দেখে চমৎকৃত হয়ে নিজেই ওদের দুজনের জন্য বক্সের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। দুজনেই আজ সাহেবি পোশাক পরে এসেছে। নিজেদের না। থিয়েটার কোম্পানি থেকে এক বেলার জন্য চেয়েচিন্তে আনা। এই বাবদ দেড় আনা কড়ায়গন্ডায় ম্যানেজারবাবু আগেই বুঝে নিয়েছেন। তারিণী উত্তেজিত, জীবনে প্রথমবার এই থিয়েটারে ঢুকতে পেরে। গণপতির উত্তেজনা সেরকম না একবারেই। যেন কোনও এক অনাগত বিপদের আশঙ্কা করছে সে। তারিণী বুঝবে না। হিমালয়ে গুরুর কাছে নানা বিদ্যা শেখার মধ্যে এটাও আয়ত্ত করেছিল গণপতি। বাতাস যেন ফিসফিসিয়ে তার কানে এসে কু ডেকে যায়। এমনটা এর আগে দুই-একবার হয়েছিল। প্রতিবার শেষটা খুব দুঃখজনক হয়েছে। কলকাতায় এসে গুরু হিসেবে পেয়েছিল বলরাম দে স্ট্রিটের জওহরলাল ধরকে। পামিং-এর রাজা। বাংলায় যাকে বলে হাতসাফাইয়ের খেলা। তাঁর কাছেই নাড়া বেঁধে হাতসাফাই শিখতে শুরু করে গণপতি। প্রথমে সরষে, তারপর মটর, তারপর মটর কড়াই হাতের ভাঁজে লুকানোর অভ্যাস করাতেন তিনি। গণপতি বিরক্ত হত। চাইত একেবারে টাকা হাপিসের খেলা শিখতে। জওহরলাল হাসতেন। বলতেন, “ধীরে অভ্যাস করো। এর ফল পরে বুঝতে পারবে।” যেদিন টাকা হাপিসের পদ্ধতি শেখাবেন, সেদিনও সকাল থেকে গণপতির এমন উচাটন ভাব। জওহরলাল জিজ্ঞাসাও করলেন, “কী ব্যাপার? আজ এত অস্থির দেখছি! মন শান্ত করো। তা না হলে এই খেলা শেখা যাবে না।” নিজেকেই ধমকে, শান্ত করে টাকা হাপিসের গোপন পদ্ধতি শিখেছিল গণপতি। তারপর তার হাতে জওহরলাল তুলে দিয়েছিলেন পঞ্চাশ টাকার বড়ো একটা নোট, “দেখি এটাকে হাপিস করে দেখাও…।” মা ভবতারিণী আর গুরুর নাম স্মরণ করে হাতের দুই ঝটকায় গণপতি যখন নোটটা তালুর ভাঁজে লুকিয়ে ফেলল, জওহরলাল অবাক না হয়ে পারেননি। খুশি হয়ে তিনি ওই টাকা গণপতিকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। তাঁকে প্রণাম করে গণপতি উইজার্ডস ক্লাবে আসতে না আসতে খবরটা পায়। জওহরলাল ধর আর নেই। তাকে ম্যাজিক শিখিয়েই জওহরলাল রাস্তায় বেরিয়েছিলেন কোনও কাজে। এমন সময় এক চেরেট গাড়ি কোথা থেকে তাঁকে চাপা দিয়ে চলে যায়। সে গাড়ির ঘোড়া নাকি পাগলা হয়ে গেছিল। ঘটনাস্থলেই জওহরলাল মারা গেছেন।

অনেকদিন বাদে আজকে আবার গণপতি বাতাসে সেই গন্ধটা পাচ্ছে। দম বন্ধ করা। অস্বস্তিদায়ক। শ্মশানের স্মৃতির মতো। তারিণীর মহা ফুর্তি। কিন্তু গণপতি খুশি হতে পারছে না। কোথাও একটা বাচ্চা কেঁদে উঠল যেন, হাসি, চিৎকার, কথাবার্তা সবকিছু যেন হাজার গুণ জোরে তার কানে এসে বাজছে। অবশেষে খুব জোরে বেজে উঠল ড্রাম। বারবার শুধু একটা কথা ভাবছিল গণপতি। খুব ভুল জায়গায় বসেছে সে। তার স্থান মঞ্চের এদিকে না, ওদিকে। মঞ্চের ওপরে। ফুটলাইটের চুনজ্বলা আলো কাঁপতে লাগল। পর্দার অন্যদিকে আর-এক লম্বা যুবক একটু অস্থিরভাবে পায়চারি করছিল। হাতে পাতলা একটা চটি বই। সেটার কান ধরেই মোচড়াচ্ছিল সে। আজ এই শেষ শো-টা শেষ হলে বাঁচে। যেমনটা সে ভয় পেয়েছিল ঠিক সেটাই হয়েছে। তার এখন থাকার কথা মেডিক্যাল কলেজে, সেই লাশটার পাশে। কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে ভেবে তার দাদা তাকে পাঠিয়েছেন অন্য এক কাজে। এই দেশে। অন্য নাম আর পরিচয় দিয়ে। দাদা ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের হোমরাচোমরা। এতটাই, যে তাঁকেই স্বয়ং ব্রিটিশ সরকার বলা যায়। ভাইয়ের চেয়ে সবদিকে এগিয়ে, কিন্তু অলস। পরিশ্রম করতে রাজি নন। অগত্যা ভাইকেই গোপনে আসতে হয়েছে এই দেশে। তার আসল পরিচয় কেউ জানে না। কার্টারও না। জানেন কেবল তার দাদার বন্ধু চিফ ম্যাজিস্ট্রেট টমসন সাহেব আর ডাক্তার মার্টিন।

প্রথমে ভাবনা ছিল কী পরিচয়ে সে আসবে? অভিনয়। এর আগে উইলিয়াম এস্কট নাম নিয়ে হ্যামলেট নাটকে, কিংবা জুলিয়াস সিজারে ক্যাসিয়াসের ভূমিকায় অভিনয় করেছিল সে। নাটকের সূত্রেই ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় যাওয়া। গোটা আমেরিকা জুড়ে প্রায় একশো আটাশটি অভিনয় করে তার দল। মঞ্চ তার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা নয়। তবে কার্টারের খেলায় অভিনয়ের সুযোগ নেই। কার্টারই তার হাতে এই বইটা ধরিয়ে বলেছেন এটা থেকে আবৃত্তি করতে। সেই থেকে তার কাছেই বইটা থাকে।

১৮২৭ সালে প্রকাশিত বইটার লেখকের নাম নেই। মুদ্রক কেলভিন এফ এস থমাস। কোন এক বোস্টনবাসী নিজের খরচায় বইটা ছাপিয়েছিল। বেশ কটা কবিতা। দীর্ঘ কবিতা একটাই। পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেছিল সে। বারবার পড়েছিল, প্রায় সারারাত। বইটা সে কাছছাড়া করে না। বইয়ের প্রথম পাতায় কালো কালিতে এক কোনায় ছোটো ছোটো করে লেখা ওঁর খুব চেনা এক লেখকের নাম। কে জানে হয়তো বেনামে বইটা তাঁরই লেখা।

আবার বেজে উঠল ড্রাম। প্রথমে কার্টার ঢুকবেন, তারপর কিউ পেলেই তাকে ঢুকতে হবে মঞ্চে। স্টেজ ম্যানেজার হাতের ইশারা করল। চারজন সহকারী মঞ্চের পিছনে থেকে ঠেলে নিয়ে এল পাগড়ি পরা, লাঠি হাতে এক পুতুলকে। তার সামনে একটা দাবার বোর্ড। পুতুলের ডান হাত দাবার ছকের ওপরে। দুই সহকারী পুতুলের নিচের কাবার্ডের দরজা খুলে দেখিয়ে দিল সেখানে একগাদা গিয়ার আর কগ চাকা, কোনও মানুষ লুকিয়ে নেই। ড্রামের আওয়াজ বাড়তে বাড়তে প্রায় কানের পর্দা ফাটিয়ে দেবে, এমন সময় যেন অন্ধকার ফুঁড়ে উদয় হলেন ম্যাজিশিয়ান কার্টার। প্রায় ছ-ফুট লম্বা, খাড়া নাক, ওলটানো চুল, হাসিমুখ। কার্টারের পরনে লম্বা ফ্রক কোট, বো টাই আর পায়ে চকচকে পালিশ করা জুতো। ঢুকেই দুই পকেট থেকে বার করলেন দুটো রুমাল আর সে দুটো মুঠো করে ছুড়ে দিতেই দুটো পায়রা ঝটপট করে উড়ে গেল হলের মধ্যে। দর্শকদের হাততালির আওয়াজে হলেও যেন একশো পায়রা উড়ে গেল।

“লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান, বয়েজ অ্যান্ড গার্লস… আজ থেকে এক দশক আগে আমি ভারতে এসেছিলাম। তবে কলকাতায় না। এসেছিলাম হিমালয়ে। সেখানে এক গুরুর কাছে দীর্ঘদিন জাদু শিক্ষা করেছি আমি। শিখেছি গোপন সব জাদুবিদ্যার কথা। গুরু আমার ওপর খুশি হয়ে এই পুতুলটি উপহার দিয়েছিলেন আমায়…”

সব মিথ্যে কথা, গণপতি ভাবছিল, এই লোক আর যাই হোক কোনও দিন হিমালয়ে গিয়ে জাদু শেখেনি। ভারতীয় জাদুতে এই দেখনদারি নেই একেবারেই।

“এই পুতুলের নাম তৈমুর। সেই অত্যাচারী দস্যু, যিনি এককালে গোটা এশিয়ার ত্রাস ছিলেন। সমরখন্দে তাঁর সমাধিতে লেখা আছে, ‘আমি যেদিন ফের জেগে উঠব, সেদিন সমস্ত পৃথিবী আমার ভয়ে কাঁপবে!’ এই পুতুলে তৈমুরের আত্মা লুকানো আছে। এখন শুধু দরকার তাঁকে জাগিয়ে তোলা।”

দর্শকদের মধ্যে চাপা ভয়ের একটা নিঃশ্বাস টানার শব্দ হল। বাকি সব চুপচাপ। থমথমে।

“কেউ একটাও কথা বলবেন না। কেউ কারও দিকে তাকাবেন না। আমি এবার এই আত্মাকে জাগিয়ে তুলব”, বলে যেন হাওয়া থেকেই কার্টার হাজির করলেন এক ম্যাজিক ওয়ান্ড। আর এটাই কিউ।

সেই যুবক ধীরে ধীরে এসে দাঁড়াল ফুটলাইটের সামনে। অদ্ভুত গমগমে গলায় আবৃত্তি করতে থাকল…

“Kind solace in a dying hour
Such, father, is not (now) my theme—
I will not madly deem that power
Of Earth may shrive me of the sin
Unearthly pride hath revell’d in—
I have no time to dote or dream:
You call it hope— that fire of fire!”

স্তবকের ঠিক মাঝামাঝি ক্যাঁচ করে একটা শব্দ হল। তৈমুরের মাথাটা অল্প নড়ে উঠল যেন! কার্টার চোখ বুজে বিড়বিড় করছেন। যুবক বলে চলেছে—

“It is but agony of desire:
If I can hope— Oh God! I can—
Its fount is holier— more divine—
I would not call thee fool, old man,
But such is not a gift of thine.”

কার্টার ম্যাজিক ওয়ান্ডটা একবার ঘড়ির কাঁটার দিকে, একবার বিপরীত দিকে ঘোরাচ্ছেন। ঘোরানোর গতি বাড়ছে। কার্টারের হাত প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। এদিকে আবৃত্তির লয় বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। হঠাৎ সব স্তব্ধ। কার্টার হাঁফাচ্ছেন। সেই যুবক চুপ। শুধু একটাই ক্যাঁচকোঁচ শব্দ শোনা যাচ্ছে গোটা হলে। তা যেন বেড়ে উঠছে ক্রমাগত। তৈমুরের হাত সেই দাবার বোর্ডে নড়ছে। পাশাপাশি। ঠিক জ্যান্ত মানুষের মতো। গণপতি জীবনে এমন অদ্ভুত জিনিস দেখেনি।

কার্টার এবার দর্শকদের থেকে কোনও একজনকে উঠে আসতে বললেন। এমন একজন, যিনি ভালো দাবা খেলতে জানেন। কেউ ওঠে না। শেষে মৃদু হেসে কার্টার বললেন, “আমি জানি বড়োলাট দাবায় পারদর্শী। আমাদের অসীম সৌভাগ্য, তিনি নিজে আমাদের এই শো দেখতে এসেছেন। আর তাঁর জন্যেই আজ এক স্পেশাল খেলা দেখাব আমি, যা গোটা সফরে দেখাবার সাহস করতে পারিনি। সে কথা পরে। আমি মাননীয় বড়োলাটকে অনুরোধ করব তিনি যেন দয়া করে একবারটি মঞ্চে আসেন।” চমকে গেল গণপতি। তারিণীও। সব কাজ ফেলে ল্যান্সডাউন এসেছেন ম্যাজিক খেলা দেখতে!

একটু আপত্তি করে হাসিমুখে মঞ্চে উঠলেন বড়োলাট। তাঁকে প্রায় হাত ধরে তৈমুরের কাছে নিয়ে গেলেন কার্টার। আবার নিচের ক্যাবিনেট খুলে বড়োলাটকে দেখিয়ে দেওয়া হল কিছু চাকা ছাড়া ভিতরে কেউ লুকিয়ে নেই। ডালা বন্ধ করা হল। তৈমুরের সামনে সাদা গুটি। বড়োলাটের সামনে কালো। তিনি সামনে দাঁড়াতেই তৈমুর রাজার সামনের বোড়ে দুই ঘর এগিয়ে দিল। প্রায় কিছু না ভেবেই বড়োলাট তাঁর রাজার সামনের বোড়েও দুই ঘর এগোলেন। এক ঝটকায় তৈমুর রাজার ডান পাশের হাতিকে টেনে নিয়ে এল সাদা বোড়ের পাশে। বড়োলাট এটা আশা করেননি। তিনি একটু ভেবে মন্ত্রীর পাশের কালো ঘোড়াকে আড়াই চাল দিয়ে এগিয়ে আনলেন সামনে। তৈমুর নিজের মন্ত্রীকে বাড়িয়ে দিল কোনাকুনি, চার ঘর। এবার বড়োলাট একটু বিভ্রান্ত। অন্য ঘোড়াটাও আড়াই চালে এগিয়ে দিলেন সামনে। ব্যস! তৈমুর যেন এটার অপেক্ষাই করছিল। কালো হাতির সামনের বোড়েকে খেয়ে মন্ত্রী চলে গেল সোজা রাজার সামনে। কিস্তিমাত। আর মাত্র একটা বোড়ে খেয়ে। চার চালে এমনভাবে কিস্তিমাত হবেন, তা বুঝি বড়োলাট নিজেও ভাবেননি। আর তাও একটা পুতুলের কাছে। লজ্জায় তাঁর ফর্সা মুখ লাল। কার্টার বুঝি বুঝলেন ব্যাপারটা। বললেন, “হিজ হাইনেস! একটা কথা বলি। আমরা সাধারণ মরমানুষ। আমাদের কি ক্ষমতা আছে বিদেহী আত্মার সঙ্গে লড়ার? আর তাও যে-কোনো আত্মা না। স্বয়ং তৈমুরের আত্মা। রণকৌশলে যাঁর জুড়ি একদা পৃথিবীতে ছিল না, তাঁর সঙ্গে দাবার ময়দানে আপনি বলে তাও চার চাল অবধি টিকতে পেরেছেন। আমি আপনাকে বলছি, এর আগে বেশিরভাগ মানুষ খেলার সাহসই দেখায়নি। যারা দেখিয়েছে, কেউই দুই চালের বেশি টেকেনি। বড়োলাটের জন্য সবাইকে একটা অভিনন্দন জানাতে অনুরোধ করছি।” বড়োলাট না হলেও তৈমুরের জন্য গোটা হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। কার্টার বড়োলাটকে তাঁর বসার জায়গা অবধি পৌঁছে দিলেন। এবার কার্টার সরাসরি ফিরলেন সেই যুবকের দিকে। “আর-একটা হাততালি লন্ডনের বিখ্যাত অভিনেতা সাইগারসনের জন্য, যিনি আজ কবিতাটি আপনাদের সামনে পাঠ করলেন।”

সামান্য কিছু হাততালির শব্দ শোনা গেল। যুবক মাথা নিচু করে কী যেন ভাবতে ভাবতে উইংসে ঢুকে গেল। কার্টারের সঙ্গে হাত মেলানোর সময় বড়োলাট কার্টারের হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দিলেন। কী লেখা আছে তাতে?

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ— গণপতির ভেলকি

১৭ ডিসেম্বর, ১৮৯২, কলিকাতা, রাত সাড়ে নটা থেকে দশটা

বড়োলাট মঞ্চ থেকে নেমে যেতেই কার্টার আবার ফিরে গেলেন তাঁর বুকনিতে। যাকে বলে প্যাটার। “অন্য খেলা দেখানোর আগে আমি আপনাদের জানিয়ে দিতে চাই ম্যাজিশিয়ান হিসেবে আমার কাজ আপনাদের আনন্দ দেওয়া। আর ঠিক সেটাই আজ আমি করব। আমি আজ এই মঞ্চে যাই করি না কেন, দয়া করে মনে রাখবেন, আমি আপনাদের বোকা বানাব না। কিছুতেই না।”

“ঠিক সেটাই তুমি করতে যাচ্ছ”, মনে মনে বিড়বিড় করে বলল গণপতি।

তারপর আধঘণ্টা ধরে নানা ভেলকি দেখিয়ে গেলেন কার্টার। কাচের বয়াম থেকে রুমাল বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই। হাওয়া থেকে গুচ্ছ গুচ্ছ তাস এনে টিপ করে ছুড়ে দিতে লাগলেন দর্শকদের দিকে। “এটা আপনার জন্য” বলে ছুড়ছেন, আর তাস যেন পোষমানা পাখির মতো উড়ে গিয়ে যাঁর নাম তাঁর কোলে পড়ছে। প্রথম তাস পড়ল বড়োলাটের কোলে। তিনি সবাইকে দেখালেন। ইস্কাবনের সাহেব। হাতে উদ্যত তলোয়ার। একে একে দূরের আসনেও ছিটকে যেতে থাকল তাস। শেষে যখন একেবারে পিছনে বসা দর্শকদের কাছেও তাস উড়ে গিয়ে পড়তে লাগল, গোটা হল ফেটে পড়ল হাততালিতে। হঠাৎ কার্টার সাহেব থেমে গেলেন। পিছনের অর্কেস্ট্রার আওয়াজ মৃদু আর গমগমে হয়ে গেল। কার্টার এগিয়ে এলেন সামনে। গম্ভীর ব্যারিটোন গলায় বললেন, “আমি আপনাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনাদের আগেই বলেছি, আমি আজ একটা স্পেশাল খেলা দেখাব। যে খেলা হাজার হাজার বছর আগে ভারতের কোনও এক নাম না জানা ফকির আবিষ্কার করেছিলেন, যে খেলা একদল বেদে দেখিয়েছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীরের দরবারে, সারা বিশ্বে যে জাদু দেখানোর সাহস আজ অবধি কোনও ইউরোপিয়ান করেননি, আজ সেই খেলাই আমি আপনাদের দেখাব। কারণ দুটো। এক— আজ আমার শো-র শেষ দিন, আর দুই, স্বয়ং বড়োলাট আজ এখানে উপস্থিত আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, ক্ষমা কেন? কারণ এই দুরূহ খেলাটি দেখাতে কিছু প্রস্তুতি দরকার, আর ঠিক সেইজন্য আজ আমি আমার চিরপরিচিত পলায়নী বিদ্যা বা এসকেপ আর্ট দেখাতে পারব না। আমি দুঃখিত, আপনারা যাঁরা আমার শো আগে দেখেননি, তাঁরা এই খেলা থেকে বঞ্চিত হবেন।”

“এক্সকিউজ মি”, নিচে দ্বিতীয় রো থেকে ভেসে এল কার গলা। এ কণ্ঠ গণপতির চেনা। কার্টারেরও।

উঠে দাঁড়িয়ে এইমাত্র যিনি কথাটা বললেন, তিনি কলকাতার পরিচিত মুখ। উইজার্ড ক্লাবের প্রেসিডেন্ট নবীনচন্দ্র মান্না।

কার্টার ঠিক এই ধরনের বাধার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কেউই না। তবু তিনি সামলে উঠে বললেন, “বলুন কী বলবেন?”

“আসলে আমরা যারা জাদুর খেলা দেখাই, তারা একটা মন্ত্রকে বীজমন্ত্রের মতো জপ করি। দ্য শো মাস্ট গো অন। যা হয় হোক। খেলা বন্ধ করা যাবে না। সাহেব, এখানে বেশিরভাগ দর্শক আপনার পলায়নী বিদ্যা দেখতেই এসেছেন। আপনি তাঁদের বঞ্চিত করবেন না। আপনি স্পেশাল দেখাতে চান দেখান, কিন্তু তা বলে যে খেলা বিজ্ঞাপিত হয়ে গেছে তাকে বাদ দিয়ে নয়।”

অন্য কেউ হলে হয়তো কার্টার গুরুত্বই দিতেন না। কিন্তু নবীন মান্না বেশ কেউকেটা লোক। বড়ো বড়ো জায়গা অবধি তাঁর হাত আছে। তাঁকে চটানো ঠিক সমীচীন মনে করলেন না কার্টার।

“বুঝলাম মিস্টার মান্না, কিন্তু আমি যে খেলাটি দেখাতে চলেছি, তা ঠিকভাবে পারফর্ম করতে গেলে অন্তত আধ ঘণ্টা আমাকে নিবিড়ভাবে মনঃসংযোগ করতে হবে। একটু ভুল হলে কারও মৃত্যু অবধি হতে পারে। এসকেপ আর্ট খুবই কঠিন এক বিদ্যা। তারপরে অন্য কোনও জাদু দেখানো সম্ভব হয় না। আপনারা বরং ততক্ষণ আমার সহকারী বিখ্যাত চিনা জাদুকর চিন-সু-লিনের চৈনিক জাদু দেখুন।”

নবীন মান্না তবু আসনে বসলেন না, বরং সবাইকে অবাক করে মঞ্চে উঠে এলেন। কার্টারের দিকে সোজা তাকিয়ে বললেন, “আমার একটা প্রস্তাব আছে। দেখুন আপনি রাজি কি না। আমার এক শিষ্য আছে। নেটিভ। সে পলায়নী বিদ্যায় যে দক্ষতা অর্জন করেছে, তা যে-কোনো ইউরোপিয়ান জাদুকরের সমকক্ষ। আমার ইচ্ছা, আজ আপনার পরিবর্তে সে এই পলায়নী বিদ্যা সবার সামনে প্রদর্শন করুক।”

“অসম্ভব! এই বিদ্যা কোনও শিক্ষানবিশের খেলা বা তাসের জাদু না। একটু এদিক-ওদিক হলে আপনার শিষ্য নির্ঘাত মারা যাবে। আমি তা হতে দিতে পারি না। আপনি এই খেয়াল ত্যাগ করুন।”

এদিকে উত্তেজিত তারিণী ক্রমাগত গণপতিকে খোঁচাচ্ছিল; “তোমার কথাই তো বলছে মনে হচ্চে হে! তুমি তৈরি তো?” গণপতি নিজে কেমন বোকা হয়ে গেছিল। সাহেবি ইংরাজি উচ্চারণ ভালো না বুঝলেও হাবেভাবে ব্যাপারটা অল্প বুঝতে পারছিল। কিছুটা তারিণীও অনুবাদ করে বলছিল। এভাবে এইরকম সুযোগ আসবে, সে ভাবেওনি। কিন্তু যখন এল, একদিকে তার বুক উত্তেজনায় দুরুদুরু করছে, মন বলছে সাহেব যেন রাজি হন। করিন্থিয়ান থিয়েটারে ম্যাজিক দেখানোর সুযোগ কজনের ভাগ্যে জোটে? আর যদি জুটে যায়, তবে গণপতিই হবে প্রথম ভারতীয়, যার ভাগ্য এই শিকে ছিঁড়ল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা ভয় তাকে চেপে ধরছে। এত বড়ো মঞ্চে ম্যাজিক সে কোনও দিন দেখায়নি। আর-একটা ব্যাপার আছে। গঙ্গায় পলায়নী বিদ্যা দেখানোর সময় যন্ত্রপাতি সব তার নিজের, এখানে সাহেবের যন্ত্রে কাজ করতে হবে। অবশ্য অন্যদিকে দেখতে গেলে সব ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিকের যন্ত্রে আগে বাঁচার উপায়টা করে রাখে। ফলে গঙ্গায় মারা যাবার যে ঝুঁকি ছিল, এখানে তা নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রশ্নটা অন্য জায়গায়, সাহেব কি রাজি হবেন? মুখের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে একবার সে দেখে নিল টর্ক রেঞ্চটা ঠিকঠাক আছে কি না।

এদিকে মঞ্চে নবীন মান্না আর কার্টারে বেশ তর্কই বেধে গেছে। নবীন মান্না গঙ্গাবক্ষে গণপতির পলায়নের কথা বললেন। জানালেন, তিনি অনেকদিন ধরে এই যুবককে নিজে ম্যাজিক শিক্ষা দিচ্ছেন (যদিও তা সত্যি নয়)। কিন্তু কিছুতেই সাহেব রাজি হচ্ছেন না দেখে শেষে তিনি তুরুপের তাসটি ফেললেন, “আপনি কি ভয় পাচ্ছেন মি. কার্টার? একজন নেটিভের কাছে হেরে যাবার ভয়?”

এই চ্যালেঞ্জ উপেক্ষা করা কার্টারের পক্ষে মুশকিল। গণপতি পরিষ্কার দেখতে পেল কার্টার একবার সামনের সারিতে বসে থাকা বড়োলাটের দিকে তাকালেন। বড়োলাট কোটের পকেট থেকে ঘড়ি বার করে বারবার দেখছিলেন, তিনি কার্টারের দিকে চেয়ে দুবার উপরে নিচে ঘাড় নাড়লেন। যার মানে হ্যাঁ। কার্টার অবশেষে নবীন মান্নাকে বললেন, “ওয়েল, আপনার কথাই থাক। ডাকুন আপনার শিষ্যকে, কিন্তু পরে কিছু হলে দোষ দিতে পারবেন না এই বলে রাখলাম।”

নবীন মান্না মৃদু হেসে উত্তর না দিয়ে সোজা তাকালেন গণপতি আর তারিণীর বক্সের দিকে। একটু গলা কাঁপিয়ে ঘোষণা করলেন, “দর্শকরা, যাঁরা পলায়নী বিদ্যা দেখতে এসেছেন, তাঁদের আজ নিরাশ হয়ে ফিরে যেতে হবে না। জাদু দেখাবেন আমাদেরই এক নেটিভ বাঙালি জাদুকর, যিনি আমাদের উইজার্ডস ক্লাবের তারকাও বটে, যাঁর গঙ্গাবক্ষে পলায়নী বিদ্যার কথা নিশ্চয়ই আপনারা শুনেছেন (মজার ব্যাপার এখানে অনেককে মাথা নাড়াতে দেখে গণপতি আর তারিণী দুজনেই যুগপৎ অবাক হল। দশ মিনিট আগেও নবীন মান্না ছাড়া কেউ তাদের গঙ্গা অভিযানের কথা জানত না। এখন লোকে এমন মাথা নাড়াচ্ছে, যেন সবাই সেখানে উপস্থিত ছিল)… আমি ডেকে নিচ্ছি বিখ্যাত জাদুকর, ইজ হি আ ম্যান অর আ ডেভিল? ইজ কন্টিনিউয়াসলি আস্কড, এভরি ম্যান, উওম্যান, অ্যান্ড চাইল্ড শুড সি দিস ওয়ান্ডারফুল ম্যান, দ্য গ্রে-এ-এ-এ-ট গণপতি…” হলের বেশিরভাগ দর্শকই দেশীয়। নতুন কিছু দেখার আশায় তারা করতালিতে হল ফাটিয়ে দিল। গণপতি অতি ধীরে বক্স থেকে নেমে মঞ্চের দিকে এগিয়ে এল। সামান্য হলেও ঘাবড়ে গেছে সে। সবার দৃষ্টি তার দিকে। মঞ্চে ওঠার সময়ই একবার হোঁচট খেয়ে গেল। হেসে উঠলেন দর্শকদের কেউ কেউ। কার্টারকে দেখলে মনে হয় কে যেন তাঁর মুখে চিরতাগোলা জল ঢেলে দিয়েছে। কোনওক্রমে হাত মিলিয়ে গণপতিকে ইংরাজিতে বললেন, “তুমি আমার যন্ত্রপাতি দেখে নাও। চিন-সু-লিন আধ ঘণ্টা ম্যাজিক দেখাবে। তারপরেই তোমার পালা। দেখো, প্রাণটা যেন বাঁচে।” নবীন মান্না হাসিমুখে গোটাটার অনুবাদ করে শেষে যোগ করে দিলেন, “দাও তো বাছা, সাহেবের মুখে নুড়ো জ্বেলে… এ এক তুমিই পারবে…”

গোটা মঞ্চে আবার আওয়াজ শুরু হল। এবার চৈনিক সুর। মঞ্চে পায়ে পায়ে এসে ঢুকলেন চৈনিক জাদুকর চিন-সু-লিন। গণপতি কার্টারের সহকারীর সঙ্গে মঞ্চের পাশে যেতে যেতে হঠাৎ চমকে দেখল চৈনিক জাদুকরের চোখের মণির রং গাঢ় নীল। কোনও চিনা লোকের চোখের রং নীল হয়, তা গণপতির জানা ছিল না।

চিন-সু-লিনের ছোটোখাটো চেহারা। ম্যাজিক যে দারুণ কিছু দেখাচ্ছেন, তা-ও নয়। তবে তাঁর ম্যাজিকে বেশ চটক আছে। আর কার্টারের ম্যাজিকের থেকে এঁর তফাত হল, ইনি একটিও শব্দ উচ্চারণ করেন না। খাঁটি চিনা জাদু বলে ‘ড্রিম অফ ওয়েলথ’ নামে এক ম্যাজিক দেখালেন লিন। ছোটো এক ধাতুর খালি পাত্রে কিছুটা দুধ ঢেলে গরম করলেন তেলের বাতির খোলা আগুনে। দুধ ফুটতে না ফুটতে ভিতর থেকে ফোয়ারার মতো বেরিয়ে এল অসংখ্য ধাতব মুদ্রা। তাঁর সহকারীর গোটা ট্রে ভরে গেল, তবু মুদ্রা বেরোচ্ছে তো বেরোচ্ছেই। শেষে জাদুকর সেই পাত্র থেকে টেনে বার করলেন বিরাট বড়ো একটা চৌকো সিল্কের কাপড়, যাতে একশো টাকার নোটের ছবি আঁকা। আবার দুইজন সহকারী সেই কাপড়ের দুই দিক ধরে একবার ঝাঁকুনি দিতেই কাপড় অদৃশ্য। মঞ্চের ঠিক মাঝবরাবর ভেসে আছে বিশাল এক মুদ্রা।

কার্টারের এক সহকারী এবার গণপতিকে নিয়ে গেল ভিতরের দিকে। লিনের জাদু শেষ হলেই তাকে স্টেজে নামতে হবে। এদিক-ওদিক চেয়ে কার্টারকে দেখতে পেল না সে। কার্টার যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছেন। হলের পিছনে অন্ধকার গলিতে টিমটিমে কেরোসিন তেলের আলো। বাইরের দর্শকদের উল্লাস, হাততালির আওয়াজ অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে এখানে। সহকারী বিরাট এক বাক্সের সামনে উপস্থিত করলেন গণপতিকে। এক মানুষ সমান। ডালা খুলতেই গণপতির চক্ষু চড়কগাছ। ভিতরে ক্রুশকাঠের মতো বড়ো একটা পাটাতন, তার সঙ্গে আটকানো অন্তত গোটা দশেক শিকল, হাতকড়া, দড়িদড়া। সহকারী বুঝিয়ে বললেন, এতে দর্শকদের মধ্যে থেকে কেউ একজন এসে জাদুকরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দিয়ে বাক্সে ভরে দেবেন। তারপর পাঁচ মিনিটের মধ্যে জাদুকর সেই বন্ধন মুক্ত হয়ে বেরোবেন।

এতসব বোঝানোর ফাঁকেই সহকারী বিড়বিড় করে বলছিলেন কী যেন। গণপতি হাত উঠিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিল। বারবার পরীক্ষা করতে থাকল দড়িদড়া, হাতকড়া আর লোহার মোটা মোটা ক্লাম্পগুলো। নিজের মনেই অস্ফুটে একবার যেন বলে উঠল, “এ যে কংসের কারাগার…।” তিন-চারবার ভিতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খুটখাট কী যেন করল সে। তারপর সব নিস্তব্ধ। সহকারী বাইরে দাঁড়িয়ে। ওদিকে চিন-সু-লিনের খেলা প্রায় শেষ। গণপতি ভিতরে ঢুকে কী করছে? আর কেউ জানুক না জানুক, সহকারী জানে ভিতরে বাতাসের চলাচল কম। আনাড়ি লোকের জ্ঞান হারানো অসম্ভব না। একটু ঘাবড়ে গিয়েই দরজা খোলার চেষ্টা করে দেখল, কোন অদ্ভুত উপায়ে গণপতি নিজেকে ভিতরে আটকে ফেলেছে। বাইরে থেকে দরজা খোলা যাচ্ছে না। এখন উপায়? কার্টার সাহেবকে ডাকা যায়। কিন্তু তিনি তো দলের সবাইকে বলেই দিয়েছেন আজকের স্পেশাল ম্যাজিকের আগে তাঁকে কিছুতেই যেন বিরক্ত না করা হয়। তাঁর হাতে বাছাই কিছু সহকারী নিয়ে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে কী করছেন কে জানে। এদিকে সময় এগিয়ে যাচ্ছে, গণপতির কোনও সাড়াশব্দ নেই। বাইরে থেকে বেশ কয়েকবার টোকা দিয়েও লাভ হয়নি কিছুই। আচ্ছা ফ্যাসাদ! ওপরচালাকি করতে গিয়ে মরল নাকি লোকটা? তাহলে তো কেলেঙ্কারির একশেষ।

খানিক ভেবেচিন্তে কার্টারকে জানাবে বলেই ঠিক করল সে। রওনা দিল কার্টারের ঘরের দিকে। ঘরের দরজা বন্ধ, সামনে দরজায় প্রায় কান পেতে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। সহকারী কাছে যেতেই একটু চমকে তাঁর দিকে যে ফিরল, তাকে তিনি চেনেন। এ সেই লন্ডনের সাহেব, যে শুরুতে কবিতা পাঠ করে, আর মাঝেমধ্যেই কোথায় যেন হাপিস হয়ে যায়। কার্টারের এই দলটা অদ্ভুত। সবাই মিলে একসঙ্গে ম্যাজিক দেখায়, তবু কার্টার শো-র পরে বিশেষ কিছু লোক বাদে বাকিদের খবর রাখেন না, কথা বলা তো দূরস্থান। শো শেষে প্রত্যেকের ভাগের টাকা বুঝিয়ে পরের শো কবে তা বলে দেওয়া হয়। আগের দিন এসে একটা রিহার্সাল হয়, মাঝে কে কী করল, কোথায় গেল, কেউ তার খোঁজ রাখে না। বেশিরভাগ গিয়ে ভিড় জমায় সোনাগাছির বেশ্যাপট্টিতে। বিশেষ করে সাহেবরা। কালো মেয়েদের গা নাকি ঠান্ডা হয়। শরীরের জ্বালা জুড়াতে তাদের জুড়ি নেই। তিনি নিশ্চিত, এই সাইগারসন সাহেবও সেখানেই যায়। শুধু সেখানেই না, সাহেবকে চাংওয়ার পাশে চন্ডুখোরদের আস্তানাতেও একদিন দেখেছেন তিনি… অনেক গুণই আছে এই সাহেবের। কিন্তু এখন দরজায় কান লাগিয়ে এ কী করছে?

সাইগারসন চমকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার?”

“আসলে একটা সমস্যা হয়েছে। সেই নেটিভ ছোকরা নিজেকে আটকে ফেলেছে বাক্সে। মরে-টরে গেল কি না কে জানে।”

“চলো তো দেখি”, বলে সাইগারসন সেই সহকারীর পিছু নিল।

ইলিউশন বক্স তখনও বন্ধ। সাইগারসন দু-একবার খোলার চেষ্টা করলেন। ধাক্কা দিলেন। কোনও শব্দ নেই ভিতর থেকে। এদিকে চিন-সু-লিনের খেলা শেষ। গোটা হল ভেসে যাচ্ছে করতালির আওয়াজে। সাইগারসন পকেট থেকে বার করল পাতলা একটা লোহার পাত। দরজার ফাঁকে ঢুকিয়ে আস্তে করে চাড় দিয়ে খুলে ফেলল দরজার পাল্লা।

ভিতরে দেহের উপরের অংশ প্রায় অনাবৃত করে দাঁড়িয়ে আছে গণপতি। সারা দেহ ঘর্মাক্ত। মুখে অদ্ভুত একটা হাসি। যে হাসি দেখবে বলে দুজনের কেউ আশা করেনি।

ম্যাজিক দেখিয়ে বাও করেই চিন-সু-লিন দ্রুত ঢুকে গেলেন উইংসে। যেন খুব তাড়া। সোজা হাঁটা দিলেন কার্টারের ঘরের দিকে। যাবার পথে চিনা টুপিটা খুলতে টুপির সঙ্গেই খুলে হাতে চলে এল দুইদিকে দুই ঝোলানো বেণিওয়ালা পরচুলা। একঝলকে গণপতি দেখল ভিতরে ছোটো করে ছাঁটা সোনালি চুল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গণপতি শুনল মঞ্চে তার নাম ঘোষণা করা হচ্ছে।

পোশাক পরে নিল গণপতি। সে জানে তাকে ঠিক কী করতে হবে। ছয়জন মিলে সেই ইলিউশন বক্স নিয়ে উপস্থিত হল মঞ্চে। গোটা মঞ্চ থমথমে। কেউ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না একজন নেটিভ আজ করিন্থিয়ান থিয়েটারে ম্যাজিক দেখাবে। আদৌ সে পারবে কি না সেই সন্দেহটাই সবার কাছে প্রবল। এক কোনায় নবীন মান্না নিজে দাঁড়িয়ে। গণপতির কাছে এসে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সব দেখেশুনে নিয়েছ তো ভায়া? কোনও অসুবিধা থাকলে বলো, এখনও সময় আছে।”

প্রশ্নই নেই। কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ল গণপতি।

এবার ঘোষণার দায়িত্ব নিলেন নবীন মান্না নিজে। দর্শকদের বুঝিয়ে দিলেন এই খেলার কৌশল। এই বাক্সের মধ্যে শিকল, আর দড়াদড়ি দিয়ে গণপতিকে বেঁধে রাখা হবে বাক্সের মাঝের ক্রুশকাঠের সঙ্গে। বাঁধবেন দর্শকদেরই এক বা একাধিক জন। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। গণপতি বাঁধন খুলে বেরিয়ে আসবেন, যেমন কার্টার সাহেব আসেন। এখানে নবীন মান্না একটা প্যাঁচ কষলেন। কার্টার সাহেব পাঁচ মিনিটে বেরিয়ে আসেন। গণপতির বেলায় আরও দুই মিনিট বাড়িয়ে সাত মিনিট করে দিলেন। একটু হ্যান্ডিক্যাপ পাক ছোকরা।

ডেকে নেওয়া হল তিনজনকে। তিন সাহেব। তিনজনই প্রথমে পরীক্ষা করে নিলেন হাতকড়া আর দড়ি। সব ঠিকঠাক আছে কি না। গণপতি তৈরি। ঢুকে পড়ল বাক্সে। তিন সাহেব মিলে প্রায় দশ মিনিট ধরে তাকে বেঁধে ফেললেন ভিতরের ক্রুশকাঠে। হাতকড়ার চাবি রইল এক সাহেবের হাতে। দরজা বন্ধ করে দেওয়া হল।

এদিকে আসনে বসে তারিণী আবার পেটের ভিতর গুড়গুড়ানি টের পেল। সেই সেদিনকার মতো একটা ভয় তাকে চেপে ধরছে, যেদিন সে আর গণপতি সকালে গঙ্গার ঘাটে গেছিল। এখন অবশ্য মরার ভয় নেই তেমন, তবে ভয় অন্য। যদি গণপতি বেরোতে না পারে! সাহেবি কল। কী বানিয়ে রেখেছে বলা মুশকিল। কেমন একটা বমি বমি পাচ্ছে যেন।

মঞ্চে বেজে উঠল গম্ভীর ড্রাম। সবাই চুপ। কী হয় কী হয় ভাব। নবীন মান্না রুমাল বের করে ঘাম মুছলেন। ল্যান্সডাউন আবার পকেট থেকে ঘড়ি বার করে দেখলেন। মঞ্চের ঠিক মাঝে সেই বাক্স রাখা। আশেপাশে কেউ নেই।

ঠিক সাড়ে তিন মিনিটের মাথায় দড়াম করে দরজা খুলে গেল। দুই পাল্লায় দুই হাত দিয়ে দরজা খুলে দিয়েছে গণপতি। তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। তলায় শুধু একখানা ইজের পরা। এই ম্যাজিক কার্টারের কৌশলের অনুকরণ নয়, সম্পূর্ণ নতুন এক জাদুবিদ্যা। একে তো কার্টারের চেয়েও কম সময়ে গণপতি বেরিয়ে এসেছে আর ওই বাক্সের মধ্যে এত কম সময়ে পোশাক পরিবর্তন সে করল কীভাবে, তা কারও মাথায় ঢুকছিল না। গণপতি দুই হাত ওঠাল দর্শকদের দিকে। খানিকক্ষণ সবাই চুপ। তারপর হলে শুধু তালির আওয়াজ… কিন্তু এ কী? গণপতি কী করছে? সবাইকে চমকে দিয়ে গণপতি আবার ঢুকে গেল সেই বাক্সে। আর ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল।

এটা কেউ আশাও করেনি। বুঝে উঠতেই খানিক সময় গেল। নবীন মান্না দৌড়ে গেলেন বাক্সের কাছে। ডাকতে লাগলেন “গণপতি, গণপতি” বলে। কোনও সাড়া নেই। সবাই অবাক। বুঝতেই পারছে না কী করবে। সময় বয়ে যাচ্ছে। বাজনদারেরা বাজনা বাজাতে ভুলে গেছে। গোটা হল জুড়ে এবার হইচই শুরু হল। তারিণীর মনে হল এবার সে নিশ্চিত বমি করে ফেলবে। ঠিক এই সময় উইংসের পর্দা সরিয়ে প্রায় দৌড়ে ঢুকলেন কার্টার সাহেব। নবীনের দিকে চেয়ে শুধু বললেন, “আগেই বলেছিলাম আপনাকে।” সোজা বাক্সের সামনে গিয়ে কী এক অদ্ভুত কায়দায় খুলে ফেললেন ডালা।

সবাই, এমনকি কার্টারও অবাক বিস্ময়ে দেখলেন, ভিতরে ক্রুশকাঠে শিকল, হাতকড়া আর দড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা অবস্থায় গণপতি দাঁড়িয়ে আছে। মুখে অপার্থিব এক হাসি। সম্পূর্ণ পোশাক পরা। না বললে কেউ বিশ্বাসই করবে না একটু আগেই সে সব শিকল আর পোশাকের বন্ধনমুক্ত হয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল ফুটলাইটে। এ কি সত্য? না স্বপ্ন? গোটা করিন্থিয়ান হলকে যেন কোনও জাদুকর অদ্ভুত ম্যাজিকে স্ট্যাচু বানিয়ে দিয়েছে। শুধু নবীন মান্না ঘড়ি দেখলেন। এই পাঁচ মিনিট শেষ হল।

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ— সপ্তম সূর্য

২০ জুন, ২০১৮, চন্দননগর

চন্দননগর স্ট্র্যান্ডে গঙ্গার ঘাটে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া সিঁড়িতে বসে আছি আমি আর পুলিশ অফিসার অমিতাভ মুখার্জি। নামটা একটু আগে নিজেই বলেছেন। ভদ্রলোক মানুষ হিসেবে খারাপ না। আচমকা এত বড়ো কেস মাথায় এসে যাওয়ায় একটু চাপে পড়ে গেছেন এই যা। দেবাশিসদার কবিতাটার কিছুটা উদ্ধার করাতে আমার ওপরে একটু ভরসা এসেছে মনে হল। একটা সিগারেট সাধলেন আমায়। আমি না বলাতে নিজেই একখানা ধরিয়ে উদাস মুখে গঙ্গায় লঞ্চের আসা যাওয়া দেখতে লাগলেন। রাত হয়ে গেছে। পাড়ের দুই দিকেই জ্বলে উঠছে একের পর এক আলো। সেই আলোর প্রতিবিম্ব জলে পড়ে কাঁপা কাঁপা রেখায় যেন ভ্যান গঘের আঁকা ছবি। অফিসারের কপালে তিন-চারটে ভাঁজ। বোঝা যাচ্ছে ভেবেও কিছু করতে পারছেন না বলে হতাশ।

হাতের এক টোকায় সিগারেটটা সোজা জলে ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে একবার হাসার চেষ্টা করলেন। তারপর মাস্টারমশাইয়ের মতো জিজ্ঞেস করলেন, “বলুন দেখি, চন্দননগরের নাম চন্দননগর কেন?”

এটা জানতাম। হরিহর শেঠের লেখা আমার পড়া ছিল। ক্যুইজের উত্তর দেবার মতো করে বললাম, “এ নিয়ে অনেকরকম মত আছে। ত্রিবেণীতে এসে গঙ্গা তিনটে ধারায় ভাগ হয়ে গেছিল। যমুনা, সরস্বতী আর ভাগীরথী। এই যমুনা পরে কল্যাণীর বাগেরখালের দিকে গিয়ে চারঘাটে এসে হারিয়ে যায়। বাকি রইল ভাগীরথী আর সরস্বতী। সরস্বতী ছিল মূল নদী। তার তীরেই সপ্তগ্রাম বন্দর। বাণিজ্য জাহাজ আসত চিন, আরব, পারস্য থেকে। তারপর ষোড়শ শতকে ভয়াবহ কিছু একটা হয়, যার ফলে সরস্বতীর বুকের জলধারা কমে যেতে যেতে প্রায় শুকিয়ে যায়। ওদিকে বাড়তে থাকে ভাগীরথীর নাব্যতা। ফলে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল বেড়ে যায় এখানে। হিজলি থেকে নুন বোঝাই করে পর্তুগিজরা নদীর ধারে গোলা বা গুদাম করে রাখতে থাকে। তারা গুদামকে বলত ওগোলি, আর সেই থেকেই হুগলি এসেছে। হুগলি আর সরস্বতীর মাঝে ধনুক বা চাঁদের কলার মতো জায়গায় ছিল তিনটে গ্রাম। বোড়ো, খলিসানী আর গোন্দলপাড়া। ভাগীরথীর দিকের এই তিন গ্রাম নিয়েই চন্দননগরের উত্থান। মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর হুগলি নদীর ধারে বোড়াইচণ্ডীর মন্দির স্থাপন করেন। কেউ বলেন এই চণ্ডী থেকেই প্রথমে চণ্ডীনগর আর পরে চন্দননগর নাম হয়। আবার হরিহর শেঠ নিজে লিখেছেন শহর দেখতে অনেকটা চাঁদের কলার মতো হওয়ায় চন্দ্রনগর থেকে নাকি চন্দননগর হয়েছে।”

অফিসার নিজেও এতটা জানতেন বলে মনে হয় না। অবাক হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কি গোয়েন্দাগিরির সঙ্গে ইতিহাস নিয়েও চর্চা করেন নাকি!”

“আগে করতাম না। দেবাশিসদার পাল্লায় পড়ে কিছুদিন হল আগ্রহ হয়েছে। পসার তো জানেন, প্রায় কিছুই নেই। তাই অঢেল সময়।”

“না, না। ভালো তো। আমরা কলুর বলদ। চাকরি করে আর অন্য পড়াশোনার সময় পাই না। জানেন তো, এককালে আমারও ইতিহাস সাবজেক্ট ছিল। ভালোই লাগত পড়তে… ইচ্ছে ছিল ইতিহাস নিয়েই গবেষণা করব। সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠোদ্ধার করব। কিন্তু ওই যে ম্যান প্রোপোজেস আর উপরওয়ালা ডিসপোজেস… বাবা মারা গেলেন। চাকরির তাড়নায় পুলিশে যোগ দিলাম। এখন এইসব করে বেড়াচ্ছি। আপনি একদিকে ভালোই করেছেন। এসব লাফড়ায় ঢোকেননি। আমাদের মশাই জান কয়লা হয়ে গেল। ভাবুন তো, ধোন কেটে, বিচি কেটে ফেলে রেখে গেছে… কী অদ্ভুত কেস রে বাবা…”

“কেটে কোথায় ফেলল?”

“মানে?”

“এই যে কাটল, কেটে ফেলল কোথায়? ওটাও তো এভিডেন্স!”

“আরেহ, তাই তো…” অফিসারের এতক্ষণে মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। “আপনি এখানেই বসুন। আমি এক্ষুনি আসছি”, বলেই মোবাইলে কাকে যেন চেষ্টা করতে করতে ছুটে গেলেন পাশেই পার্কিং করা গাড়ির দিকে। আমি পাশ দিয়ে একটা ঘটিগরমওয়ালাকে ডেকে পাঁচ টাকার ঘটিগরম কিনলাম। খিদে পেয়েছে।

সারাদিনে সেই সকালের পর এতক্ষণে একেবারে একা। সেই আমি, যার জীবনে তেমন কিছু ঘটে না, মাত্র কয়েক ঘণ্টায় যা যা ঘটে গেল, তাতে বদহজম না হয়ে যায়! পুলিশে ধরে নিয়ে যাওয়া, দেবাশিসদার খুন, হেঁয়ালি ভরা মেসেজ, লিং-চি, প্রিয়নাথ, গণপতি, সব মিলেমিশে যা ঘোঁট পাকিয়েছে, সহজে এ থেকে ছাড়া পাব বলে মনে হয় না। ভাবতেই নিজেকে নিজে ধমক দিলাম। আমি না গোয়েন্দা? রহস্য যত জটিল, গোয়েন্দাদের তত ফুর্তি হওয়া উচিত। হোমস, পোয়ারো থেকে ফেলু মিত্তির, ব্যোমকেশ সবাইকে তো তেমনই দেখেছি। মুশকিল হল বইতে খুনের গল্প পড়া আর নিজে তার সাক্ষী থাকায় বিস্তর তফাত, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, সাহস জিনিসটা আমার বরাবর বেশ কম। মুখে কিছুটা স্মার্টনেস দেখালেও পেটে এখনও প্রজাপতি উড়ছে। পা কাঁপছে। যুক্তি বুদ্ধি সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

গঙ্গার হাওয়া বইছে বেশ জোরে। একটু জোলো। হয়তো বৃষ্টি নামবে। যা গরম পড়েছে! দেবাশিসদা বলতেন, “খুব গরম লাগলে শুধু ভাববে তুমিই এই গরমের জন্যে দায়ী। তুমিই তুর্বসু, সূর্য, সপ্তম সূর্য।” আমি অবাক হয়েছিলাম। সূর্যের আবার প্রথম দ্বিতীয় কী? সূর্য তো একটাই… আদি অনন্তকাল ধরে আমাদের জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

“ধুসস…” হেসে ফেলেছিলেন দেবাশিসদা। “বৌদ্ধদের পবিত্র গ্রন্থ ‘বিশুদ্ধি মগগ’-এ বিশ্বচক্র নিয়ে গোটা একটা অধ্যায় আছে। তাতে লেখা, বিনাশ তিনরকম। জলে, আগুনে আর বায়ুতে। মহাপ্লাবনের পরে অবিরাম বৃষ্টি শেষ হবার পরে আকাশে দ্বিতীয় সূর্য উদিত হয়। খেয়াল করো, এই মহাপ্লাবনের কথা কিন্তু বাইবেলের নোয়া আর আমাদের মনুর কাহিনিতেও আছে। খুব সম্ভব ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছিল। দ্বিতীয় সূর্য উঠলে দিন রাতের প্রভাব মুছে গেল। এইভাবে তৃতীয়, চতুর্থ আর পঞ্চম সূর্য উদিত হয় আর অস্ত যায়। শেষ হয় এক-একটি পর্ব। পঞ্চম সূর্যের সময় সমুদ্র জলহীন হয়ে যায়। ষষ্ঠ সূর্য এলে পৃথিবী ঢেকে যায় ধোঁয়ায়। এখন সেই পর্ব। এর পরেই আসবে তুর্বসু। সপ্তম সূর্য। তার বিপুল তেজে জ্বলে উঠবে সারা বিশ্বসংসার।”

“এ বই আপনি পেলেন কোথায়?”

“পাব আর কোথায়? এসব কি আর কেউ কিনতে পারে? প্রাচীন পুথি। পেয়েছি এক জায়গায়…”

“আরে কোথায় বলবেন তো!”

“হরিহরের বাপের বাড়ি।”

“এই শুরু হল আপনার হেঁয়ালি মার্কা কথা। কে হরিহর? কে-ই বা তাঁর বাবা? কিছুই তো জানি না।”

“হরিহর মানে হরিহর শেঠ। সত্যজিৎ রায়ের অনেক আগে ‘লেজিয়ঁ দনার’ পাওয়া মানুষ। মহামানবই বলা চলে। এই চন্দননগরের প্রাণপুরুষ। হরিহর শেঠ-কে ‘লেজিয়ঁ দনার’ দেওয়া হয় ১৯৩৪ সালে৷ একাধারে ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সংগ্রাহক৷ জেলায় প্রথম নারীশিক্ষার জন্য স্কুল ‘কৃষ্ণভাবিনী নারী শিক্ষা মন্দির’ তাঁর হাতে তৈরি৷

হরিহর শেঠ-এর সঙ্গে চিঠিতে বেশ যোগাযোগ ছিল গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের৷ ১৯৩৭ সালে বিংশতি বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চন্দননগরের জাহ্নবী আবাসে, যেটা বর্তমানে রবীন্দ্র ভবন। রবীন্দ্রনাথ এই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন আর একটি নাতিদীর্ঘ বক্তৃতাও দেন৷ চন্দননগর মিউজিয়ামে একদিন যেয়ো। এই অনুষ্ঠানের ছবি-সহ বিস্তারিত বিবরণী, প্রেস রিলিজ ইত্যাদি সযত্নে রক্ষিত আছে৷ এই অনুষ্ঠানের প্রধান আহ্বায়ক ছিলেন হরিহর শেঠ৷ মিউজিয়ামের প্রায় ৮০ শতাংশ সংগ্রহ হরিহর শেঠ মারফত এসেছে৷ তাদের মধ্যে অষ্টম শতকের বুদ্ধমূর্তি এক অমূল্য সংগ্রহ৷ ১৯৪৭ সালে ফরাসি চন্দননগরকে ‘Ville Libre’ বা মুক্ত নগরী ঘোষণা করা হলে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ভবনে ভারতের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তোলন করা হয়৷ নবগঠিত পৌরসভার সভাপতি নির্বাচিত হন হরিহর শেঠ৷ তাঁর লেখা ‘সংক্ষিপ্ত চন্দননগর পরিচয়’ চন্দননগরের ইতিহাস সম্পর্কে একটি আকর গ্রন্থ৷ পাওয়া যায়। অবশ্যই কিনে পড়বে। বুঝলে?”

“বুঝলাম। কিন্তু এঁর সঙ্গে তাঁর বাবার কী সম্পর্ক?”

“নৃত্যগোপাল শেঠ ছিলেন হরিহর শেঠের বাবা। নিজের বাবার স্মৃতিতে তিনি স্থাপন করেন নৃত্যগোপাল স্মৃতিমন্দির। ১৯২০ সালের ২৩ মে তাঁরই বদান্যতায় চন্দননগর পুস্তকাগার ঠাঁই পেল এই স্মৃতিমন্দিরে। ভবনের দ্বার উদ্ঘাটন করেছিলেন স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি আর পুস্তকাগারে গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশাই। শুধু লাইব্রেরি না। লাইব্রেরি কাম অডিটোরিয়াম।”

“এর আগে চন্দননগরে লাইব্রেরি ছিল না?”

“ছিল তো। ১৮৭৩ সালে উর্দিবাজারে এক ভাড়াটে বাড়ির দোতলায় যদুনাথ পালিত আর মতিলাল শেঠ মিলে চন্দননগর পুস্তকাগার স্থাপন করেন। তারপর বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করে শেষে এখানে ঠাঁই পায়।”

“আচ্ছা, আর এখানেই আপনি সব উদ্ভট বই আর পুথি খুঁজে পান, তাই তো?”

“শুধু কি খুঁজে পাই? ও বাড়ি বড়ো অদ্ভুত জায়গা। কিছু খুঁজে পেলে লুকিয়েও রাখি।”

“মানে?”

“মানে একটা বালির কণাকে লুকাতে গেলে কোথায় লুকানো ভালো?”

“আরও বালির মধ্যে।”

“তাহলে একটা রেয়ার বই বা নথি লুকানোর সেরা জায়গা কোনটা?”

“ওহহ… বুঝেছি। লাইব্রেরি। তাই তো?”

“সাবাস তোপসে! তাহলে? এতক্ষণ বলছিলে না তুমি কিছু জানো না, এবার তো জানলে? তাই তো?”

“হ্যাঁ, তা বলতে পারেন।”

“এখন তাহলে আমি আইনস্টাইন হয়ে যাব।”

“উফফ, আবার হেঁয়ালি। কী বলছেন খোলসা করে বলুন না।”

“একটা বাজে গল্প আইনস্টাইনের নামে চলে। ডাহা মিথ্যে, তবে গল্পটা খাসা। একবার তাঁর ড্রাইভারের শখ হয়েছে পিছনের সিটে বসার। মানে আইনস্টাইন সাজার। আইনস্টাইন এক কথায় রাজি। তিনিই ড্রাইভ করছেন। ড্রাইভার পিছনে বসে। এক সেমিনারে গিয়ে ড্রাইভারকে সবাই আইনস্টাইন ভেবে ঘিরে ধরেছে। “একটু বুঝিয়ে বলবেন, থিয়োরি অফ রিলেটিভিটি-টা ঠিক কী?” ড্রাইভার পড়েছে মহা ফাঁপরে। কিন্তু হাজার হোক আইনস্টাইনের ড্রাইভার। হাজির জবাবে ওস্তাদ। বলে কিনা, এ আর এমন কী কঠিন? এ তো আমার ড্রাইভারও জানে। বলে দাও হে ব্যাপারটা কী…”

খুব হেসেছিলাম দুজনে। তারপর দেবাশিসদা বলেছিলেন, “আমিও এখন থেকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে বলব ‘তুর্বসু জানে’, কেমন?”

কারেন্টের শক লাগার মতো চমকে উঠলাম। ‘তুর্বসু জানে’, এটাই ছিল না সেই কাগজে?

পকেট থেকে মোবাইল বের করেই অফিসারের নম্বরে ফোন করলাম আমি। পেটে আবার বুড়বুড়ি কাটা শুরু হয়েছে। অফিসারের অনেক আগে করা একটা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। আমি এখন জানি যে আমি ঠিক কী জানি।

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ— মঞ্চে মৃত্যু

১৭ ডিসেম্বর, ১৮৯২, কলিকাতা, রাত দশটা

গোটা করিন্থিয়ান হল যেন কাঁপছে। হাততালির আওয়াজে। সাহেবদের ‘ব্রাভো, ব্রাভো’, কিছু দেশীয় মানুষ তো দাঁড়িয়েই পড়লেন তালি দিতে দিতে। গণপতির মনে হল সে স্বপ্ন দেখছে। এ সত্যি হতে পারে না। চারিদিক যেন টলে গেল তার। নবীন মান্না ঠিক সময়ে ধরে না ফেললে হয়তো মঞ্চেই উলটে পড়ত। প্রায় ধরে ধরে তাকে নিজের জায়গায় বসিয়ে দিলেন নবীন মান্না। তারিণী তখন উত্তেজনায় দুই রোগা রোগা হাতে গণপতিকে জাপটে ধরেছে। তারিণীর দুচোখে জল। মুখে শুধু “কী দেখালে ভাই, কী দেখালে…” বলেই চলছে ক্রমাগত। ওদিকে মঞ্চে আবার পর্দা নেমে এসেছে। শুরু হয়েছে গম্ভীর বাজনা। একটু পরেই হবে কার্টারের স্পেশাল। হল আবার চুপচাপ, থমথমে। গণপতির উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কোনও এক অজানা বিপদের আশঙ্কা, যেটা প্রায় চলেই গেছিল, ফিরে এসেছে আবার। দ্রিম দ্রিম করে আওয়াজ কানে তালা লাগিয়ে দিল প্রায়। পর্দা খুলে গেল। খুলতেই দেখা গেল মঞ্চের ঠিক মাঝখানে গাঢ় লাল কাপড়ে ঢাকা একটা ঘরের মতো। বাইরে কার্টার দাঁড়িয়ে। কার্টারের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন ‘চৈনিক’ জাদুকর চিন-সু-লিন, আর তাঁর পাশে মাথায় পাগড়ি, চকচকে পোশাক, গালে দাড়ি এক ভারতীয় দাঁড়িয়ে। এই লোকটাকে কেমন চেনা চেনা মনে হল তারিণীর। কোথায় যেন দেখেছে। অনেকদিন আগে না। খুব সম্প্রতি। কিন্তু কোথায়, তা কিছুতেই মনে পড়ছিল না। কার্টার এদিকে তাঁর প্যাটার শুরু করে দিয়েছেন, “আজ, মাননীয় বড়োলাট বাহাদুরের সামনে আমি সেই জাদুর খেলা দেখাব, যা হিমালয়ে আমার গুরু আমাকেই একমাত্র শিখিয়েছিলেন আর বলেছিলেন বিশেষ মানুষদের ছাড়া কাউকে না দেখাতে। কোনও ইউরোপীয় আজ অবধি সফলভাবে এই খেলা দেখাতে সক্ষম হননি। শুধুমাত্র হাতের কারসাজি নয়, এই ম্যাজিকে লাগে সত্যিকারের মন্ত্র, যা ছাড়া এই জাদু অসম্ভব। তাই আমি যখন এই খেলা দেখাব, আমার এই ভারতীয় সঙ্গী রাখহরি মন্ত্র উচ্চারণ করবে, যাতে গোটা জাদুতে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। আমি আজ, এই মঞ্চে দেখাব এক অসম্ভব জাদুর খেলা”, বলে টেনে টেনে উচ্চারণ করলেন “ই- ন্ডি-য়া-ন- রো-প- ট্রি-ক”… শোনা মাত্র ম্যাজিক সার্কেলের যে সদস্যরা খেলা দেখতে এসেছিলেন, সবাই তালি দিয়ে উঠলেন। গণপতি অবাক। তার ধারণা ছিল এই ম্যাজিকের অস্তিত্ব শুধুমাত্র লোককথাতেই আছে। হিমালয়ে থাকাকালীন অনেক সিদ্ধাই পাওয়া সাধুদের সে এই জাদুর কথা জিজ্ঞাসা করেছে, কেউ সঠিক বলতে পারেননি। বেশিরভাগই বলেছেন পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো এও এক রূপকথা। আর সেই ম্যাজিক দেখাবেন এই সাহেব!

গণপতির ভ্যাবলা ভাব দেখে তারিণীও অবাক হল। কী এমন ম্যাজিক যে তার বন্ধুও হতবাক হয়ে গেছে! কার্টার এবার ব্যাখ্যা শুরু করলেন। শূন্য থেকে হাত ঘুরিয়ে নিয়ে এলেন লম্বা, মোটা একটা রশি। গোটানো। বললেন, প্রথমে রাখহরি মন্ত্র পড়ে দেবতাকে জাগাবে। তারপর কার্টার শূন্যে ছুড়ে দেবেন দড়ি। দড়ি মাটিতে নেমে আসবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে স্তম্ভের মতো। সেই দড়ি বেয়ে উঠে যাবেন চিন-সু-লিন। কার্টার তাঁকে ভ্যানিশ করে দেবেন। এই ম্যাজিকের জন্য একজনকে মঞ্চে ডাকলেন কার্টার। মঞ্চে এলেন এক ইংরেজ সাহেব। কার্টার এবার বললেন, তাঁর ইশারা পেলেই চিন-সু-লিন আর রাখহরি ঢুকে যাবেন সেই পর্দাঘেরা স্থানে। রাখহরি শুদ্ধ করবেন লিনকে। তারপর সেই মন্ত্রবলে বলীয়ান লিন উঠে যাবেন দড়ি বেয়ে। তাঁর দেহ বায়ুভূত হয়ে যাবে। এরপর তিনিই আবার দেহ ধারণ করবেন হলের বাইরে গিয়ে। হেঁটে আসবেন সামনের দরজা দিয়ে।

“এক্সকিউজ মি!” এক সন্ধ্যায় এই নিয়ে দুইবার এই কথা শুনতে হল কার্টারকে। তবে এবার বক্তা অন্য। বক্তা সেই রোগা, লম্বা ইংরেজ সাহেব, যিনি এইমাত্র উঠে এসেছেন মঞ্চে। “একটা কথা ছিল মি. কার্টার। মি. লিনের কোনও যমজ বা দেখতে একরকম কোনও মানুষকে যে আপনি বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখেননি, তার প্রমাণ কী? কীভাবে জানব যিনি অদৃশ্য হচ্ছেন আর যিনি ফিরে আসছেন, দুজন একই লোক?

কার্টার থমকে গেলেন একটু। তারপর বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার পরিচয়?”

সাহেব একটু হেসে বললেন, “আমার নাম এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি। আমি সম্প্রতি বাংলায় পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেল পদে আসীন হয়েছি।”

“আপনার তবে কী মত? কীভাবে জানা যাবে, দুজনেই এক মানুষ?”

“আমি বেশ কয়েকবছর এক গবেষণায় রত আছি। অপরাধবিজ্ঞানে মূল সমস্যা অপরাধীকে একেবারে নিশ্চিত করে চিহ্নিত করা। শুধু চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বলেই প্রতি বছর হাজার হাজার অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে আর স্বাধীনভাবে সমাজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন ফ্রান্সিস গ্যালটন। আমার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত পত্রে যোগাযোগ আছে। তবে তাঁর শনাক্ত পদ্ধতি বেশ জটিল। বার্তিলোঁর পদ্ধতিও তাই। তাই অনেক গবেষণা করে আমি এই সিদ্ধান্তে এসেছি যে, দুটো মানুষের হাতের ছাপ কখনোই একরকম হবে না। তারা যমজ ভাই হলেও নয়।”

গোটা হলে একটা গুনগুন শুরু হল। এও আবার হয় নাকি? অনেকে নিজের হাতের পাঞ্জার দিকে চাইতে লাগল। কার্টার এবার বললেন, “তবে এই হাতের ছাপ নেব কীভাবে?”

“সে আপনি ভাববেন না। হাতের ছাপ আমার একটা বাতিক হয়ে গেছে। সময় পেলেই পরিচিত অপরিচিত সবার হাতের ছাপ নিয়ে পরীক্ষা করি। ছাপ নেওয়ার যন্ত্রপাতি সব আমার পকেটেই থাকে”, বলে পকেট থেকে ভুষোকালি মাখা একটা প্যাড আর কাগজ বের করলেন হেনরি। চিন-সু-লিন-কে ডেকে তাঁর ডান হাতের পাঞ্জায় কালি মাখিয়ে পরিষ্কার একটা ছাপ নিলেন কাগজে। কার্টার এবার হেনরিকে দাঁড় করালেন উইংসের ঠিক পাশে। এই খেলা নাকি এত বিপজ্জনক যে একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে দেখলে দর্শকেরও ক্ষতি হতে পারে। কার্টার আচমকা “ওম-ম-ম” বলে উঠলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুজন ঢুকে গেলেন পর্দাঘেরা কক্ষে। ভিতরে শুরু হল গম্ভীর মন্ত্র উচ্চারণ।

নীলোৎপলদলশ্যামা চতুর্বাহুসমন্বিতা ।
খট্বাঙ্গ চন্দ্রহাসঞ্চ বিভ্রতী দক্ষিণে করে ।।
বামে চর্ম্ম চ পাশঞ্চ ঊর্ধ্বাধোভাগতঃ পুনঃ ।
দধতী মুণ্ডমালাঞ্চ ব্যাঘ্রচর্মধরাম্বরা ।।
কৃশোদরী দীর্ঘদংষ্ট্রা অতিদীর্ঘাতিভীষণা ।
লোলজিহ্বা নিমগ্নারক্তনয়নারাবভীষণা ।।
কবন্ধবাহনাসীনা বিস্তারা শ্রবণাননা ।
এষা কালী সমাখ্যাতা চামুণ্ডা ইতি কথ্যতে ।।

চামুণ্ডা কালীর মন্ত্র। কিন্তু এখানে কেন? ভাবল গণপতি। যাক গে যাক… সাহেব কী করেন দেখি। মন্ত্র বন্ধ হল। সাহেব এবার দড়ি ছুড়ে দেবেন শূন্যে। কিন্তু আবার বিপত্তি। দড়িতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। সাহেব পর্দার ভিতরে মুখ ঢুকিয়ে রাখহরিকে কিছু বললেন। তিনি দ্রুত পায়ে দড়ি নিয়ে উইংসে মিলিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন খানিক পরেই। সাহেবকে দড়িটা প্রায় ছুড়ে দিয়েই ঢুকে গেলেন ভিতরে। কার্টার এবার দড়ি ছুড়ে দিলেন শূন্যে। গণপতি, শুধু গণপতি কেন, হলের সবাই চমকে দেখল সাপের ফণার মতো দুলছে দড়ির ডগাটা। যেন এইমাত্র ছোবল মারবে। তারপর হঠাৎ যেন কীসের এক অমোঘ টানে একেবারে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেন দড়ি না, একটা বাঁশের দণ্ড। দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না, একটু আগে একেই হাতে গুটিয়ে রেখেছিলেন কার্টার। দর্শকদের মধ্যে একটা শ্বাস টানার শব্দ শোনা গেল। কার্টার সাহেব পকেট থেকে একটা ডুয়েলের ফ্লিন্টলক পিস্তল বার করলেন। হাতির দাঁতের বাঁট। বিখ্যাত বন্দুক প্রস্তুতকারক জন হারম্যানের নিজের হাতে তৈরি। দুটো করে গুলি ভরার ব্যবস্থা আছে এতে। সেটা উপরের দিকে তাগ করে গুলি ছুড়তেই মঞ্চ ঢেকে গেল সাদা ধোঁয়ায়। আর সেই ধোঁয়াতেই দেখা গেল চিন-সু-লিন-কে। অদ্ভুত দক্ষতায় যেন টিকটিকির মতো সরসর করে সোজা দড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছেন তিনি। মাথার দুই বেণি ঝুলছে দুই পাশ থেকে। দেখতে দেখতে দড়ির মাথায় উঠে গেলেন। কার্টার সাহেব অন্য পকেট থেকে বার করলেন আর-একটা ফ্লিন্টলক পিস্তল। আবার উপরের দিকে লক্ষ্য করে ছুড়লেন গুলি। ঝপ করে একটা শব্দ হল। ঠিক একইসঙ্গে মঞ্চের মাঝের সেই পর্দাঘেরা স্থানের পর্দা খসে পড়ে গেল। সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল ভিতরে কেউ নেই। রাখহরি না। চিন-সু-লিন না। তবে চিন-সু-লিনের স্মৃতি হিসেবে পড়ে আছে তাঁর কাপড়চোপড়। একটা পুঁটুলির মতো। আর-একজন আছে। এতক্ষণে তারিণী বুঝল কেন রাখহরিকে তার চেনা চেনা ঠেকছিল। অবিকল রাখহরির মতো, তাঁরই পোশাকে একজন বসে আছে মঞ্চের মাঝখানে। তাকে একটু আগেই মঞ্চ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবু কোন অজানা মন্ত্রবলে সে আবার ফিরে এসেছে স্পটলাইটের একদম মাঝখানটাতে… তৈমুর, আর তার হাত অদ্ভুতভাবে নড়ে চলেছে, একেবারে আসল মানুষের মতো।

হাততালি শুরু হতেই কার্টার সবাইকে হাত তুলে থামালেন। ম্যাজিক এখনও বাকি আছে। লিনের পোশাকের সামনে নিয়ে গেলেন হেনরিকে। হেনরি হাতে একটা লাঠি নিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন, ভিতরে কোনও মানুষ লুকিয়ে নেই। এবার ম্যাজিকের দ্বিতীয় অংশ। লিনের ফিরে আসা। কার্টার নিজে এবার অদ্ভুত মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। একবার করে মন্ত্র উচ্চারণ করেন আর হাতের লাঠি দিয়ে তৈমুরকে স্পর্শ করেন। এ মন্ত্র কোনও চেনা ভাষার নয়। তাঁর দৃষ্টি স্থির দরজার দিকে। সবাই সেদিকেই তাকিয়ে আছে। এই বুঝি দরজা খুলে ঢুকলেন লিন। সময় কেটে যাচ্ছে। এক মিনিট। দুই মিনিট। কেউ ঢুকছে না। দর্শকরা এবার উশখুশ করতে শুরু করল। কার্টারের মন্ত্র গেল থেমে। মঞ্চের ওপরে খুব দূর থেকে একটা মৃদু কাঠের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ শোনা গেল যেন। কার্টার উপরের দিকে তাকালেন। বোঝার আগেই মঞ্চের উপরের কাঠের পাটাতন ভেঙে হুড়মুড়িয়ে নিচে এসে পড়ল ভারী কিছু একটা। একটা দেহ। মৃতদেহ। মানুষের। মানুষটার সারা দেহে একটা সুতোও নেই। ঘাড়টা মটকে গেছে মাটিতে পড়ামাত্র। ইনস্পেক্টর জেনারেল একলাফে কার্টারকে সরিয়ে সোজা চলে এলেন মৃতদেহের সামনে। দর্শকদের তখন বিহ্বল অবস্থা। স্বয়ং বড়োলাট উঠে দাঁড়িয়েছেন। চিৎকার করে উঠলেন এডওয়ার্ড রিচার্ড হেনরি, “কেউ জায়গা থেকে নড়বেন না। কেউ হল ছেড়ে বেরোবেন না। বাইরে তালা লাগিয়ে দাও।”

ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়লেন মৃতদেহের পাশে। ছোটো ছোটো করে কাটা সোনালি চুল। চোখ খোলা। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা উঠছে। গলায় লাল হয়ে বসে গেছে আঙুলের ছাপ। চোখের তারা নীল। মুখটা বড্ড চেনা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন কার্টারের দিকে। “চেনেন এঁকে?”

মঞ্চে কথায় বাজিমাত করা কার্টারের মুখে বাক্যি ফুটছে না। যেন বজ্রপাত এক নিমেষে তাঁকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কোনওরকমে অস্ফুটে বললেন, “ডিক… ডিক…”

“কে ডিক?”

“রিচার্ড হ্যালিডে… চিন-সু-লিন…”

“কী বলছেন আপনি? চিন-সু-লিন? এ তো ইউরোপিয়ান…”

“হ্যাঁ। ও-ই। ও ছদ্মনামে ম্যাজিক দেখাত।”

“কিন্তু এটা কী হল? কী মনে হয় আপনার?”

“নিশ্চয়ই ম্যাজিক দেখানোতে কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। আমার জাদুতে ওর দেহ বায়ুভূত হয়েছে, কিন্তু আবার ঠিকঠাক দেহধারণ করতে পারেনি। মন্ত্রে কোনও গণ্ডগোল ছিল। আমার ভুল… আমার ভুল…”

“সে কী করে হয়? এ তো গলা টিপে খুন!” হেনরি বললেন।

“আমি জানি না। বিশ্বাস করুন কিচ্ছু জানি না।”

কার্টারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। দেখেই মনে হচ্ছে এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাবেন। হেনরি কিছু বোঝার আগেই লম্বাপানা এক তরুণ কার্টারকে ধরে নিল। একে হেনরি চেনেন। এ সেই লোকটা, যে শুরুতে কবিতা আবৃত্তি করে। সাইগারসন নাম। কার্টারকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়ার আগে প্রায় ফিসফিস করে সে হেনরিকে বলল, “মড়ার হাতের ছাপটা একবার নিয়ে দেখুন না স্যার…”

এটা হেনরির মাথায় আসেনি। সত্যি সত্যি এ-ই সেই লোক কি না জানার এর থেকে ভালো উপায় নেই। আবার পকেট থেকে প্যাড কাগজ বার করে ছাপ নিতে গিয়েই বুঝে গেলেন নিশ্চিতভাবে এই সেই লোক। বাঁ হাতে এখনও ভুষো কালির দাগ লেগে আছে। তবু নিয়েই নিলেন একটা ছাপ। যদি আদালতে প্রশ্ন তোলে।

এদিকে অস্থির দর্শকদের সামলাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট টমসন আর তাঁর দলবল। হেনরি সাহেব ইশারায় টমসনকে ডাকলেন। মঞ্চে ডেকে ফিসফিস করে বললেন, “বডি হাসপাতালে পাঠাতে হবে। তবে তুমি যেয়ো না। বিশ্বস্ত কেউ আছে?”

“আছে স্যার। তবে নেটিভ। কাজ ভালোই জানে। ডাকব?”

হেনরি সাহেব সম্মতি জানাতেই টমসন এক দেশি পুলিশকে ডাকলেন। ছেলেটি বেশ চটপটে। উঠে এল দ্রুত।

“তোমার নাম কী, মাই বয়?”

“প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ইওর অনার স্যার”, স্যালুট ঠুকে বলল সে।

টমসন মনে মনে হাসলেন। স্বয়ং ইনস্পেক্টর জেনারেলকে দেখে ঘাবড়ে গেছে বেচারা।

“তুমি এক কাজ করো। এই বডিটাকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যাও। ওখানে মার্টিন আছেন। ওঁকে আমার কথা বলবে, আর যতক্ষণ না যাই, তুমি থাকবে…” বলে উইংসের দিকে তাকিয়ে বললেন হেনরি, “টমসন, এবার দর্শকদের ধীরে ধীরে ছেড়ে দাও। কিন্তু ম্যাজিকের দলের সবাই যেন মঞ্চের পিছনে উপস্থিত থাকে। তুমি মঞ্চের পিছনে গিয়ে সবাইকে জড়ো করো। আমার কিছু জানার আছে।”

টমসন চলে গেলে হেনরি উপরের দিকে তাকালেন। কাঠের দুর্বল পাটাতন ভেঙে নিচে পড়েছে দেহটা। কিন্তু এখানে এই পাটাতন কেন? মাটিতে পড়ে থাকা কাঠের টুকরোগুলো তুলে নিলেন হেনরি। পাতলা কাঠের চেরা তক্তা। তবে… তাহলে…

“একটা কথা ছিল স্যার”, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সাইগারসন। “আপনি আমায় চেনেন না। আমি আপনাকে চিনি। সেন্ট এডমুন্ড কলেজে আমার দাদা আপনার সহপাঠী ছিল। তারপর আপনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলেন আর দাদা ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সে।”

“কী নাম তোমার দাদার?”

তাঁর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে নামটা বলল সাইগারসন। আক্ষরিক অর্থেই চমকে উঠলেন হেনরি। “কিন্তু আমি তো শুনেছিলাম তুমি…”

“যা শুনেছিলেন ভুলে যান স্যার। এসব ভাবার সময় নেই। পরে সব খুলে বলব। এদিকে খেলা শুরু হয়ে গেছে”, বলতে না বলতে গ্রিনরুম থেকে শোনা গেল গুলির শব্দ।

“কার্টার”, বলেই সাইগারসন দৌড়োল সেদিকে। পিছন পিছন হেনরি।

গ্রিনরুমের দরজা আধা ভেজানো। ভিতরে টিমটিমে কেরোসিনের বাতি প্রায় নিভু নিভু। তবু যা দেখতে পেলেন, হেনরির পক্ষে সেটাই যথেষ্ট। একটা হাই ব্যাক চেয়ারে অদ্ভুতভাবে এলিয়ে রয়েছেন কার্টার। মাথার ঠিক মাঝে একটা ফুটো, সেখান থেকে দরদরিয়ে রক্তের ধারা নেমে আসছে। আর তাঁর ডান হাতের তর্জনীতে তখনও ধরা আছে যে যন্ত্রটা, সেটা একটু আগেই হেনরি দেখেছেন। জন হারম্যানের তৈরি ফ্লিন্টলক ডুয়েল পিস্তলজোড়ার একটা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *