পঞ্চতন্ত্র মিত্রভেদ

পঞ্চতন্ত্র মিত্রভেদ

দমনক ও পিঙ্গলক

দক্ষিণ ভারতের এক প্রাচীন নগর-মহিলারোপ্য। সেখানে বাস করত এক বণিক-নাম বর্ধমান। তার অনেক টাকা। কিন্তু আরও টাকা চাই। কারণ টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। টাকা থাকলে সবই হয়। আত্মীয় হয়। বন্ধু হয়। বিদ্যা হয়। যশ হয়। মান হয়। পর আপন হয়। বৃদ্ধ যুবক হয়। কি-না হয়? তাই ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ’—একথা ভেবে সে স্থির করল—বাণিজ্যে যাবে।

কিন্তু কিসের বাণিজ্য করবে? অনেক ভাবল। তারপর স্থির হলো-গন্ধদ্রব্যের, কারণ মথুরায় তখন এর খুব চাহিদা। তাই বাড়ির দুটি ষাঁড় সঞ্জীবক ও নন্দনককে জোয়ালে জুড়ে রওনা দিল। সঙ্গে বণিকদল।

যমুনার তীর ধরে যাচ্ছে। রাধা-কৃষ্ণের লীলাভূমি এই যমুনার কূল। এর স্নিগ্ধ বাতাসে সকলের মন ভরে গেল।

হঠাৎ যমুনার জলাভূমিতে কাদায় পড়ে গেল সঞ্জীবক। পা মচকে জোয়াল ভেঙ্গে বসে পড়ল। বর্ধমানের খুব কষ্ট হলো! কারণ সঞ্জীবককে সে খুব ভালোবাসে। সঞ্জীবক সেরে উঠবে এই আশায় যাত্রা তিনদিন বন্ধ রাখা হলো। কিন্তু সঞ্জীবক সারছে না। দলের লোকেরা বলল—শেঠজি, এ বনে বাঘ আছে, সিংহ আছে। তুচ্ছ একটা ষাঁড়ের জন্য গোটা দলকেই বিপদে ফেলবেন! তাছাড়া অনেক পাওয়ার আশায় যে একটু ছাড়ে, কিংবা একটু ছেড়ে যে অনেক রাখে, সে-ইতো বুদ্ধিমান।

সত্য কথা! কিন্তু সে এখন কি করবে? একদিকে জীবনের মায়া, অন্যদিকে ভালোবাসা। শেষমেশ সঞ্জীবকের জন্য কয়েকজন পাহারাদার রেখে বর্ধমান চলে গেল।

কিন্তু চাচা, আপন প্রাণ বাঁচা। একটা ষাঁড়ের জন্য তারা বেঘোরে প্রাণ দেবে কেন? তাই পরের দিন দলে ফিরে গিয়ে বর্ধমানকে বলল—শেঠজি, সঞ্জীবক মারা গেছে; আমরা তার সৎকার করে এসেছি।

শুনে বর্ধমান খুব কষ্ট পেল।

এদিকে যমুনার ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়ায় ক্লান্তি দূর হলে সঞ্জীবক উঠে তীরের দিকে গেল। সেখানে পান্নার মতো কচিকচি ঘাস খেয়ে অল্পদিনেই সে শিবের বাহনের মতো নাদুস-নুদুস হয়ে উঠল। গায়ে এখন তার দ্বিগুণ বল। শিং দিয়ে উইয়ের ঢিবি ভাঙ্গে আর বিকট গর্জন করে।

এমন সময় যমুনায় জল খেতে আসছিল পিঙ্গলক নামে এক সিংহ—বনের রাজা। সঙ্গে তার দলবল। যমুনার পাড়ে এক অজানা জন্তুর গর্জন শুনে রাজার পিলে গেল চমকে কিসের জল খাওয়া! তেষ্টার চেয়ে জানটাই যে বড়! তাই সদলবলে ফিরে গেল বনের মধ্যে।

দূর থেকে এ ঘটনা দেখতে পেল করটক ও দমনক নামে দুই শেয়াল। ওরা দু-ভাই। পিঙ্গলকেরই মন্ত্রীর ছেলে। রাজার চাকরি করত। এখন বেকার।

দমনক বলল: চল ভাই, দেখে আসি ঘটনা কি? মহারাজ যে জল না খেয়েই ফিরে এল।

করটক বলল: রাজা-বাদশাদের ব্যাপার! কি দরকার এতে নাক গলানো? যার যা কাজ নয় তা করতে গেলে মরণ অনিবার্য—যেমন হয়েছিল ঐ গোঁজ-ওপড়ানো বানরের। দমনক: কি হয়েছিল?

করটক: শোন, বলছি…

গোঁজ-ওপড়ানো বানর

কোনও এক শহরে বাস করত এক বণিক। সে একটি মন্দির তৈরি করছিল নিকটবর্তী গাছ-পালার মধ্যে। কারিগররা সেখানে করাত দিয়ে গাছ ফাঁড়ছিল। তখন দুপুর বেলা। কারিগররা গেছে খেতে। এই সুযোগে একদল বানর এল। ওরা প্রায়ই আসে ছোটাছুটি করে, কিচির-মিচির করে, আবার চলে যায়। ঐদিন এক বানর লাফ দিয়ে উঠল আধচেরা একটি অঞ্জন কাঠের ওপর। তার মধ্যে ছিল একটি গোঁজ ঢোকানো। বানরটি খেলতে খেলতে গোঁজটি উপরে ফেলল। যেই না উপরে ফেলা, অমনি তাতে পিষ্ট হয়ে সে অক্কা পেল। তাই বলছিলাম:

যার যা কাজ নয় করতে গেলে তা।
মরতে হবে, যেমন ম’লো বোকা বানরের ছা ॥

আমরা তো যা হোক খেয়ে-পড়ে ভালই আছি। কি দরকার এসব ঝামেলায় যাওয়ার? দমনক বলল: তুমি দেখছি কেবল খাওয়ার কাঙাল। চাকরি নেই বাকরি নেই, মরার মতো বেঁচে আছি। একে কি বাঁচা বলে? এভাবে তো কাক-বক, কুকুর-বেড়ালও বাঁচে। আমি এভাবে বাঁচতে চাই না। যে-বাঁচা লোকসমাজে প্রশংসা পায়, আমি তেমন বাঁচা বাঁচতে চাই। ছোট মন নিয়ে তা সম্ভব নয়।

দেখ, ছোট নদী অল্পতেই ভরে যায়, ইঁদুরের অঞ্জলি সামান্যতেই পূর্ণ হয়, আর যারা কাপুরুষ তারা অল্পতেই তুষ্ট হয়। আরও দেখ, পতাকার স্থান যেমন বাঁশের আগায়, তেমনি যার অবস্থান সমাজের উঁচুতে না হয়, তার জন্ম কেবল মায়ের যৌবনই হরণ করে।

করটক বলল: কিন্তু আমরা এমন কি, যে রাজা আমাদের কথা শুনবে? কথা সেখানেই বলা উচিত যেখানে সাদা কাপড়ে রঙের মতো লাগে।

উত্তরে দমনক বলল: দেখ, রাজার সঙ্গে যার সম্পর্ক থাকে, লোকে তাকে ভয় পায়, শ্রদ্ধা করে। তা না হলে কে কাকে ঠেঙায়? যারা বিদ্বান, বীর, শিল্পী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং সেবক রাজা ছাড়া তাদের গতি নেই। যারা আত্মাভিমানে রাজার কাছ থেকে দূরে থাকে, তাদের প্রায়শ্চিত্ত আমরণ ভিক্ষা। ও আমার দ্বারা হবে না। তাই আমি ওর নিকট যাবই।

করটক বলল: দেখ দমনক, রাজাদের মর্জি ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। এই ভালো তো এই মন্দ, ক্ষণে রুষ্ট ক্ষণে তুষ্ট। তাই তুমি গিয়ে কি বলবে? কিভাবে তাকে বশ করবে? দমনক বলল: দেখ, যারা বুদ্ধিমান তারা যার যে ভাব তা সঠিক বুঝে নিয়ে চট করে বশ করে ফেলে। রাজা ক্রুদ্ধ হলে প্রশংসা, তার প্রিয়জনকে ভালোবাসা, অপ্রিয়জনকে নিন্দা করা, তার দানের প্রশংসা করা এগুলি হলো তন্ত্র-মন্ত্র ছাড়াই বশীকরণের উপায়। এভাবে সব সময় মন জুগিয়ে চললে রাক্ষসকেও বশ করা যায়। এই বলে করটকের নিকট বিদায় নিয়ে দমনক পিঙ্গলকের নিকট গেল।

এদিকে ভয়ার্ত পিঙ্গলক পুরনো চাকরকে আসতে দেখে মনে জোর পেল। তাকে কাছে ডেকে বলল: এতদিন কোথায় ছিলে, বন্ধু?

করটক মনে মনে বলল: বেটা হারামজাদা! তাড়িয়ে দেয়ার সময় কুকুর-বেড়ালের মতো ব্যবহার করেছে। আর এখন বিপদে পড়ে এমন গদগদভাবে কথা বলছে যেন আমি ওর চোদ্দ পুরুষের পরমাত্মীয়! কিন্তু প্রকাশ্যে জোরহাতে বলল: প্রভু, অভয় দিলে বলি। পিঙ্গলক: নির্ভয়ে বল।

দমনক: মহারাজ, মালিক যদি সব ভৃত্যের সঙ্গে সমান ব্যবহার করেন, গুণের কোনো তারতম্য না করেন, তাহলে গুণবান ভৃত্যেরা সেখানে থাকে কি করে? তাইতো এতদিন দূরে দূরে ছিলাম। কিন্তু আমরা হলাম বংশানুক্রমে আপনাদের গোলাম। তাই বিপদের সময় দূরে থাকি কি করে? দেখুন, না ডাকতেই যে প্রভুর বিপদে পাশে দাঁড়ায়, কিংবা প্রভুর ক্ষতিকর কিছু দেখলে আদেশের অপেক্ষা না করেই যে প্রতিবিধান করে, সে-ইতো প্রকৃত ভৃত্য।

পিঙ্গলক দমনকের মনের কথা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল: ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকেতো চিনিই। তা কি বলবে নির্ভয়ে বলে ফেল।

দমনক বলল: মহারাজ, গোপন কথা শুধু চার কানেই হতে হয়, ছয় কান হলে তা ফাঁস হয়ে যায়।

পিঙ্গলক দমনকের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে সভাসদদের দিকে তাকাল এবং তারা সবাই চলে গেল। তখন দমনক বলল: মহারাজ, জল না খেয়েই ফিরে এলেন যে? ভৃত্যের নিকট ধরা পড়ে যাওয়ায় পিঙ্গলক লজ্জা পেল। প্রথমে কিছু বলতে পারল না। তারপর মুচকি হেসে বলল: ও কিছু না, এমনি।

দমনক বলল: মহারাজ, যদি আমাকে বলার মতো না হয় তাহলে থাক, কারণ মানুষের কিছু কথা গোপন রাখতে হয় স্ত্রীর কাছে, কিছু আত্মীয়-স্বজনের কাছে, কিছু বন্ধু—বান্ধবদের কাছে, কিছু ছেলে-মেয়েদের কাছে। আর কিছু কথা আছে যা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বলা ঠিক-কি-ঠিক-না ভালোভাবে বিবেচনা করে তবে বলেন।

পিঙ্গলক ভাবল: এ যথার্থই যোগ্য লোক। একে বলা যায়। তাই সে বলল: এ-বনে অদ্ভুত এক জন্তু এসেছে! বিকট তার আওয়াজ! যেমন আওয়াজ, তেমনই তার শক্তি! আমি আর এ বনে থাকব না!

দমনক বলল: মহারাজ, ডাক শুনেই ভয় পেলেন? জন্তুটা কি তা না জেনেই বাপ—পিতামো’র এই রাজত্ব ছেড়ে চলে যাবেন? কথায় বলে না ভয়ঙ্কর শত্রুর আক্রমণেও যে-রাজার ধৈর্য টলে না, তার পরাজয় নেই। দেখুন, ঘোর গ্রীষ্মে পুকুর শুকায়, কিন্তু সমুদ্র? সে আরও উত্তাল হয়। তাই বলছিলাম—ধৈর্য ধরুন, ভাল করে না জেনে কেবল শব্দ শুনেই পালাবেন না যেমন পালাতে চেয়েছিল দামামার শব্দে শেয়াল।

পিঙ্গলক: খুলে বলতো ব্যাপারটা!

দমনক: বলছি…

শেয়াল ও দামামা

এক বনে ছিল এক শেয়াল। খিদায় তার পিত্তি যাচ্ছিল জ্বলে। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এক বিকট শব্দ শুনতে পেল। তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। ভাবল এই শব্দ যে করছে, তার সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই। চুলোয় যাক খাবার! জানটা আগে বাঁচাই। এই ভেবে কয়েক পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। ভাবল কে শব্দ করছে তা না জেনে চোদ্দ পুরুষের ভিটে ছেড়ে পালাব! কিছুতেই নয়! মরতে হয় মরব, তার আগে জানব ও কে, এমন শব্দ করছে?

এই ভেবে সে পায়ে পায়ে ঐ শব্দের দিকে এগিয়ে গেল। দৃষ্টিসীমায় পৌঁছে তার ধড়ে প্রাণ ফিরে এল। আনন্দে মনটাও ভরে উঠল। দেখল, একটি দামামা পড়ে আছে। কিছুদিন আগে এখানে এক যুদ্ধ হয়েছিল। সৈন্যরা ফেলে গেছে। তার উপর বাতাসের ধাক্কায় গাছের ডাল পড়ে শব্দ হচ্ছিল। দুমাদুম। শেয়ালটি কাছে গিয়ে মনের আনন্দে দামামার ছাউনি চামড়া খেয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করল। ক্ষুধায় যখন প্রাণ যায়-যায়, তখন অখাদ্যও অমৃত মনে হয়।

দমনক বলল: প্রভু! তাই বলছিলাম—শুধু শব্দ শুনেই ভয় পাওয়া উচিত নয়। কথায় বলে না—

কারণ না জেনে পালায় যে।
মরার আগে মরে সে।।

পিঙ্গলক দ্বিধান্বিত চিত্তে বলল: বলছতো ভালো, কিন্তু দেখছ না, আমার লোকজন সব পালাই-পালাই করছে! আমি কি করে ধৈর্য ধরি!

দমনক: প্রভু, এদের আর দোষ কি? ভৃত্যরা প্রভুকেই অনুসরণ করে। শাস্ত্রে আছে না অস্ত্র শাস্ত্র নারী আর বীণা এরা যেমন লোকের হাতে পড়ে তেমন বাজে। তাই বলছি আপনি সাহসে ভর করে একটু অপেক্ষা করুন, আমি গিয়ে বৃত্তান্তটা জেনে আসি। পিঙ্গলক কম্পিত কণ্ঠে বলল: তুমি যাবে ঐ যমের কাছে?

দমনক সাহসের সঙ্গে দৃঢ় কণ্ঠে বলল: মহারাজ! ভৃত্য প্রভুর আদেশে সাপের মুখে পা দেবে, সমুদ্রে কিংবা আগুনে ঝাঁপ দেবে। তা না হলে কিসের ভৃত্য? এর অন্যথা হলে তাকে ছাড়িয়ে দিতে বিলম্ব করবেন কেন?

দমনকের কথায় পিঙ্গলক আশ্বস্ত হয়ে বলল, তবে যাও।

দমনক ‘তথাস্তু’ বলে পিঙ্গলককে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।

এদিকে পিঙ্গলক ভাবল, একে বিশ্বাস করে মনের কথা খুলে বলা উচিত হয়নি। কারণ, ওর আমি চাকরি খেয়েছি, সুযোগ পেয়ে ও হয়তো এখন আমার অনিষ্ট করতে চাইছে। একবার যারা রাজার কাছে সম্মান পেয়ে পরে অবমানিত হয়, তারা অভিজাত হলেও রাজাকে শেষ করতে চায়। তাছাড়া, যারা যাকে-তাকে বিশ্বাস করে, তারা সবল হলেও দুর্বলেরা তাদের সহজেই অনিষ্ট করতে পারে। আর যারা যাকে-তাকে বিশ্বাস করেনা, তারা দুর্বল হলেও সবলেরা তাদের অনিষ্ট করতে পারেনা। বিশ্বাস ছাড়া দেবতারা পর্যন্ত শত্রুকে ধ্বংস করতে পারেনা। তাই বিচক্ষণ ব্যক্তি সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় দেবগুরু বৃহস্পতিকেও বিশ্বাস করেনা। এসব ভেবে পিঙ্গলক আত্মগোপন করে দমনকের আগমন প্রতীক্ষা করতে লাগল।

এদিকে দমনক যমুনার তীরে সঞ্জীবককে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। মনে মনে বলল ওঃ, ষাঁড়! ভালই হলো, এক ঢিলে দুই পাখি মারব। প্রথমে দুজনের মধ্যে সন্ধি করিয়ে পরে বিচ্ছেদ ঘটাব। তবেই পিঙ্গলক সুড়সুড় করে আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। রাজা কি সহজেই মন্ত্রীর কথা শুনতে চায়? শোনে বিপদে পড়লে। কথায় বলেনা—

রোগ নাই যার কি প্রয়োজন ডাক্তার।
নিরাপদ রাজার মন্ত্রীর কি দরকার।।

তাই এই সুযোগে অপমানের প্রতিশোধ নেব। এই ভেবে দমনক সঞ্জীবকের কাছে আর না গিয়ে পিঙ্গলকের দিকে ফিরে চলল।

এদিকে পিঙ্গলক গভীর আগ্রহের সঙ্গে দমনকের প্রতীক্ষায় ছিল। দমনক কাছে গিয়ে প্রণাম করে পাশে বসল। পিঙ্গলক বলল: জন্তুটাকে দেখলে?

দমনক: মহারাজের অনুগ্রহে কি না সম্ভব?

পিঙ্গলক: সত্যি বলছতো?

দমনক: মহারাজ! আপনার সামনে মিথ্যে বলব সে সাধ্য কোথায়? মনু বলেছেন না রাজা আর দেবতা সমান হলেও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। দেবতা ভালোমন্দ কাজের ফল দেন পরজন্মে, আর রাজা দেন হাতে-হাতে।

দমনকের যুক্তিকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে পিঙ্গলক বলল: মানছি, তুমি গিয়েছিলে, তবে ফিরে যে এসেছ, সে তারই উদারতায়, কারণ বড়োরা সামান্য লোকের উপর রাগ করেন না। দেখনা, প্রচণ্ড ঝড় মাটিতে নুয়ে পড়া তৃণকে ছোঁয়না, কিন্তু বৃক্ষকে ভূপাতিত করে।

পিঙ্গলকের কথায় দমনক ভীষণভাবে আহত হয় এবং তার প্রতিশোধস্পৃহাও বেড়ে যায়। কিন্তু সে-ভাব গোপন রেখে সে বলে: মহারাজের কথাই সই। তার কাছে আমি কিছুই না। তবে আপনি চাইলে আমি তাকে আপনার চাকর করে দিতে পারি। পিঙ্গলক সাগ্রহে বলল: পারবে?

দমনক: মহারাজ! বুদ্ধিবলে কি না হয়? দেখুন না

বড়ো বড়ো হাতি-ঘোড়া কত শক্তিমান।
বুদ্ধিবলে বশে তাকে মানব সন্তান।।

পিঙ্গলক সাদরে দমনকের হাত চেপে ধরে বলল: তবে তাই হোক! আজই তোমার চাকরি ফিরিয়ে দিলাম। এখন থেকে আমার ভালোমন্দ সব তোমার হাতে। এর অন্যথা হবেনা।

দমনক ‘যথাজ্ঞা’ বলে কাঙ্ক্ষিত সিদ্ধি লাভের আশায় মহানন্দে পুনরায় ছুটে চলল যমুনার তীরে। সঞ্জীবককে ধমক দিয়ে বলল: এই বেটা! কচি-কচি ঘাস খেয়ে গায়ে চর্বি হয়েছে! খামোখা গাঁক্ গাঁক্ শব্দ করছিস! তোর কি প্রাণের মায়া নেই? জানিস এটা কার রাজত্ব?

সঞ্জীবক সভয়ে বলল: কার?

দমনক: রাজা পিঙ্গলকের। পশুরাজ সিংহ। ঐতো মহারাজ বসে আছেন সিংহাসনে। তাকে ঘিরে আছে সব সাঙ্গোপাঙ্গ। অজানা শব্দ শুনে আমায় পাঠিয়েছেন তোকে ধরে নিয়ে যেতে। চল।

দমনকের কথা শুনে সঞ্জীবকের পিলে গেল চমকে। এমন নিশ্চিন্ত জীবনে একি উৎপাত এসে জুটল! কম্পিত কণ্ঠে সে দমনককে বলল: ভাই! তোমাকে দেখেতো সজ্জনই মনে হচ্ছে। একটা ব্যবস্থা করে দাওনা যাতে প্রভু আমার প্রতি সদয় হন।

দমনক ভাবল: ওষুধ গিলেছে। আমার বাসনা পূরণ হতে যাচ্ছে। প্রকাশ্যে বলল: তা তুমি এখানেই থাক। প্রভুর সঙ্গে কথা বলে সময়মতো আমি তোমায় নিয়ে যাব।

এই বলে দমনক পিঙ্গলকের কাছে গিয়ে সভয়ে বলল: মহারাজ! এ স্বয়ং শিবের বাহন নন্দী। বলে কি-না—মহাদেব তাকে বলেছেন, এই বন তোর খেলার মাঠ, যথেচ্ছ ঘুরে বেড়া আর যমুনার তীরে চরে বেড়া।

পিঙ্গলক মাথা নেড়ে বলল: তা-ই হবে। তা নাহলে এক সামান্য ঘাসখেকো দেবতার অনুগ্রহ ছাড়া এই গভীর অরণ্যে একাকী ঘুরে বেড়াতে পারে? তা তুমি কি বললে? দমনক: মহারাজ! আপনিই বা কম কিসে? আমি বললাম: এ বন হচ্ছে চণ্ডীদেবীর বাহন পিঙ্গলকের, যার কথায় ঝরা পাতা বোঁটায় জোড়া লাগে। আপনি আমাদের অতিথি। তাই চলুন, মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভাইয়ের মতো যদ্দিন ইচ্ছা থাকবেন; পানাহার করবেন।

পিঙ্গলক সাগ্রহে জানতে চাইল: কি বললে?

দমনক: কি আর বলবে? বলল, মহারাজ যাতে প্রসন্ন হন, তার ব্যবস্থা তোমায় করে দিতে হবে, ভাই!

আমি তাকে আশ্বস্ত করে আপনার কাছে ফিরে এলাম। এখন আপনার মর্জি।

পিঙ্গলক দমনকের হাত চেপে ধরে বলল: তুমি আমায় বাঁচালে! তেষ্টায় আমার প্রাণ যায়! তোমার মতো বিশ্বস্ত লোককে তাড়িয়ে দিয়ে আমি বড্ড ভুল করেছিলাম। আজ তার মাশুল দিচ্ছি। আমি তাকে অভয় দিলাম। তুমিও আমার জন্য তার অভয় চেয়ে নিয়ে তাকে শিগগির এখানে নিয়ে এস। আজ আমি বুঝলাম—শক্ত-সমর্থ-সরল স্তম্ভ যেমন বাড়ির ছাদটাকে ধরে রাখে, তেমনি সৎ, অকুটিল এবং রাজভক্ত কর্মচারীও গোটা রাজ্যের ভার বহন করে।

পিঙ্গলকের কথায় দমনক তো মহাখুশি! তাকে আর পায় কে? মহারাজ এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছেন। তার পরামর্শ শুনতেও প্রস্তুত। তার মতো ভাগ্যবান আর কে? তাই মনের আনন্দে সে সঞ্জীবকের দিকে যাচ্ছে আর ভাবছে—

শীতে আগুন অমৃত আর অমৃত রাজসম্মান।
সুন্দর চেহারা অমৃত আর অমৃত দুগ্ধপান।।

একথা ভাবতে ভাবতে সে সঞ্জীবকের কাছে গিয়ে খুব বিনম্রভাবে বলল: বন্ধু! অনেক কষ্টে মহারাজকে রাজি করিয়েছি। তুমি এবার নিশ্চিন্তে তার কাছে যাও। তবে মনে রেখ, আরাম পেয়ে যেন আবার আমায় ভুলে যেও না। ওরা রাজার জাত। মতিগতির ঠিক নেই। যা করি দুজনে পরামর্শ করে করব। আমি মন্ত্রী হয়ে তোমার পরামর্শ নিয়ে রাজ্য চালাব। তাহলে নিশ্চিন্তে আমরা রাজ্যশ্রী ভোগ করতে পারব। শিকারে গিয়ে যেমন একজন পশুদের তাড়া করে, অন্যজন শিকার করে, আমরাও তেমনি একজন প্রজাদের তাড়া দেব, অন্যজন মারব। তাহলে আমাদের আর বিপদ থাকবে না। আর একটি কথা মনে রেখ। রাজার কাছে ছোট-বড় অনেকেই থাকে, ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও স্বার্থোদ্ধারের জন্য তাদের সম্মান করতে হয়; অভিমানবশত যে তা না করে সে হোমরাচোমরা হওয়া সত্ত্বেও অধিকার হারায়, যেমন হারিয়েছিল দন্তিল।

সঞ্জীবক: কি হয়েছিল দন্তিলের?

দমনক: শুনবে? তবে শোন…

দন্তিল ও গোরম্ভ

পুরাকালে বর্ধমান নামে এক নগর ছিল। সেখানে বাস করত এক কারবারি—দন্তিল। নানা পণ্যের কারবার ছিল তার। চতুর কারবারি শ্যামও রাখত, কুলও রাখত; অর্থাৎ সুকৌশলে সে রাজা এবং নগরবাসী উভয়কেই খুশি রাখত। তাই সকলেই তাকে পছন্দ করত। সে জানত যে কেবল রাজার মঙ্গল করে, লোকে তাকে কুনজরে দেখে; আবার যে কেবল দেশের মঙ্গল করে, রাজা তাকে ত্যাগ করে; আর সে-ই বুদ্ধিমান যে উভয়কে খুশি করে।

এভাবে সুখেই কাটছিল তার দিন। একদিন এল সেই অলক্ষুণে কাল। সেদিন ছিল দন্তিলের বিয়ে। বাড়ি-ভরা আত্মীয়-স্বজন। রাজা-রানিসহ গোটা রাজবাড়িটাই যেন তার বাড়িতে। খাচ্ছে-দাচ্ছে আর তারই দেয়া পোশাক-পরিচ্ছদ পরে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাজার বাড়ির এক ঝাড়ুদার, গোরম্ভ, সেও এসেছে। আসবেইতো, মানাতো নেই। কিন্তু সে গিয়ে বসল একেবারে এমন জায়গায় যেখানে তার বসার কথা নয়। দেখে দন্তিলের পিত্তি গেল জ্বলে। ধৈর্য ধরা আর সম্ভব হলো না। সামান্য ঝাড়ুদারের এত সাহস! দিল গলা ধাক্কা একেবারে বাড়ির বাইরে। আর যায় কোথা? দন্তিলের ভাগ্যতরী ডুবল!

এদিকে হাজার লোকের সামনে গলা ধাক্কা খেয়ে প্রতিশোধ স্পৃহায় ফুঁসতে লাগল গোরম্ভ। আঁতে ঘা লাগলে গোখরো থাক দূরের কথা, ঢেঁাড়াও ঘুরে দাঁড়ায়। তাই ফন্দি আঁটছে গোরম্ভ—কিভাবে এই অপমান শতগুণে ফিরিয়ে দেয়া যায়। আহার-নিদ্রা প্রায় বর্জিত। শরীর শুকিয়ে কাঠ। এক সময় হতাশ হয়ে ভাবল—স্বয়ং রাজার যে প্রিয়জন, তার অনিষ্ট করা কি সহজ কাজ? কারো অনিষ্ট করার ক্ষমতা যার নেই, তার রাগ করা শোভা পায়না; ছোলার দানা যতই লাফালাফি করুক, তাওয়া ভাঙা কি তার পক্ষে সম্ভব?

কিন্তু দেহের ক্ষত যেমন শুকায় না, তেমনি মনের ক্ষতও যায় না। তাই গোরম্ভ হাল না ছেড়ে সুযোগ খুঁজতে লাগল। একদিন এসে যায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন ভোরবেলা রাজার ঘুমটা পাতলা হয়ে এসেছে। পালঙ্কের পাশ দিয়ে সে ঝাড়ু দিচ্ছিল। হঠাৎ বলে উঠল—ইস! কি আস্পর্ধা ঐ দন্তিলের! রানিকে ধরে আলিঙ্গন!

রাজা ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন: কি বললে, গোরম্ভ? সত্যি?

গোরম্ভ চমকে ওঠার মতো ভাব করে বলল: ‘মাফ করবেন, হুজুর! সারারাত জেগে জুয়ো খেলেছিতো, তাই ঘুমের ঘোরে কি বলেছি খেয়াল নেই।’ এই বলে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

কিন্তু রাজার মনে সাপ ঢুকে অনবরত দংশন করতে লাগল। তিনি ভাবলেন গোরম্ভ আর দন্তিল উভয়েরই অন্তঃপুরে অবাধ যাতায়াত। গোরম্ভ নিশ্চয়ই দিনের বেলা কখনো দেখেছে দন্তিল রানিকে আলিঙ্গন করছে, তাই রাতের বেলা ঘুমের ঘোরে তা কেবলই ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। আর মানুষের গোপন কথা জানা যায় ঘুমের ঘোরে কিংবা নেশার ঘোরে তার কথা থেকে। আর স্ত্রীচরিত্র! সেতো অকূল দরিয়া! তারা কথা বলে একজনের সঙ্গে, তাকায় আর একজনের দিকে এবং ভাবে আর একজনের কথা। তারাতো আগুন কিংবা সাগরের মতো—যতই কাঠ দাও ততই জ্বলে কিংবা হাজার নদী মিশলেও উদর পূর্তি হয়না। তাদের সতীত্ব নির্ভর করে গোপন স্থান, সুযোগ আর প্রার্থীর অভাবের উপর।

এমনি সব ভাবতে ভাবতে রাজার মেজাজ গেল বিগড়ে। তিনি দন্তিলের উপর বেজায় ক্ষেপে রাজবাড়িতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেন। দন্তিল শুনেতো মাথায় হাত! হঠাৎ কি হলো যে রাজা তার উপর এমন ক্ষেপে গেলেন! অনেক ভেবেও কোনো কারণ খুঁজে পেলনা। পরে আক্ষেপ করে বলল: সাদা কাক, সত্যবাদী জুয়াড়ি, সাপের ক্ষমা, কামনার প্রশান্তি, ক্লীবের ধৈর্য, মাতালের তত্ত্বচিন্তা আর রাজার বন্ধুত্ব—এ-কি কেউ কখনো দেখেছে না শুনেছে? রাজার কোনো প্রিয় পাত্র নেই। আমিতো জ্ঞানত রাজার কোনো অমঙ্গল করিনি; তার ভালো বৈ মন্দ করিনি। তাহলে কেন তিনি আমার উপর এমন বেজার হলেন?

এরূপ ভাবতে ভাবতে দন্তিল অসুস্থ হয়ে পড়ল। তার শরীর ভেঙ্গে গেল। ব্যবসা—বাণিজ্য লাটে উঠল। অবশেষে একদিন সাহসে ভর করে সে রাজবাড়িতে গেল কারণটা জানার জন্য। কিন্তু দারোয়ান তাকে সিংহদ্বারে আটকে দিল। সেখানে উপস্থিত ছিল গোরম্ভ। সে মুচকি হেসে দারোয়ানকে বলল: করছ কি! রাজার প্রিয়পাত্র যে! অমান্য করলে চাকরি যাবে।

গোরম্ভের কথা শুনে দন্তিল বুঝতে পারল—সেদিনের অপমানের শোধ নিয়েছে দন্তিল। এ তারই কাজ। এখন একে শান্ত করা ছাড়া আর উপায় নেই। তাই তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল: ‘আমার ভুল হয়েছে, ভাই! রাতের বেলা তুমি বাড়ি এস।’ বাড়ি গেলে দন্তিল তাকে উত্তম ভোজে আপ্যায়িত করে নববস্ত্র ও দক্ষিণা দিয়ে তুষ্ট করল। যাওয়ার সময় গোরম্ভ বলে গেল: ‘যে সাপ তোমায় দংশন করেছে, এবার দেখ, আমার বুদ্ধির জোরে সেই সাপই তোমার বিষ তুলে নেবে।’ গোরম্ভ চলে যাওয়ার পর দন্তিল মনে মনে বলল:

দাঁড়িপাল্লার দাঁড়ি আর দুষ্ট লোকের ব্যবহার।
দুইই সমান—অল্পে ওঠে অল্পে নামে আবার।।

এদিকে দন্তিলের নিকট থেকে উপঢৌকন পেয়ে গোরম্ভ তার প্রতিশ্রুত কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ খুঁজতে লাগল। একদিন এসেও যায় সে সুযোগ। ভোরবেলা রাজা চোখ বুজে বিছানায় শুয়ে আছেন। গোরম্ভ ঘর ঝাড়ু দিচ্ছে। হঠাৎ সে বিড়বিড় করে বলে উঠল: ‘ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! রাজা হয়ে কি-না চাকরানির কাপড় ধরে টানাটানি করে! এরকম হলে রাজবাড়িতে আর পরস্ত্রীর নিরাপত্তা কোথায়?’

রাজা শুনে লাফ দিয়ে উঠে কান ধরে টেনে তুললেন। ‘হারামজাদা! কি বললি?’

গোরম্ভ করজোড়ে বলল: পায়ে পড়ি, হুজুর! রাতে নেশাটা একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল; তাই মাথার ঠিক নেই। এবারকার মতো মাফ করে দিন।

রাজা বললেন: ‘আর এরকম হলে শুধু চাকরি নয়, জানটাও যাবে।’ গোরম্ভ ‘যে আজ্ঞে’ বলে বেরিয়ে গেল। রাজা তখন ভাবলেন: ‘সেদিন এই নেশাখোর জুয়াড়ির কথায় বিশ্বাস করে দন্তিলের প্রতি আমি অন্যায় করেছি। এর প্রতিকার করা উচিত।’ এই বলে সেদিনই তিনি দন্তিলকে ডেকে পাঠান।

এরপর দমনক সঞ্জীবককে উদ্দেশ করে বলল: তাই বলছিলাম— রাজার লোককে কক্‌খনো অবহেলা করতে নেই, হোক সে মুখ্য কিংবা গৌণ।

সঞ্জীবকও তার কথায় সায় দিয়ে বলল: ‘যথার্থই বলেছ, বন্ধু। আমি তোমার কথামতোই চলব; এর অন্যথা হবেনা।’ অতঃপর দুজনে পিঙ্গলকের কাছ গেল। পিঙ্গলক ও সঞ্জীবক উভয়ের কুশল বিনিময়ের পর পিঙ্গলক বলল: ‘তোমার কোনো ভয় নেই, বন্ধু। তুমি নিশ্চিন্তে এখানে থাকতে পার। তবে মনে রেখ, এখানে সব মাংসভোজী পশুদের বাস, তার মধ্যে একা তুমি তৃণভোজী। তাই সব সময় আমার কাছাকাছি থাকবে, নইলে বিপদ হতে পারে।’ এই বলে পিঙ্গলক দলবল নিয়ে যমুনার শীতল জলে প্রাণ জুড়িয়ে বনের মধ্যে ঢুকে গেল।

যতই দিন যেতে লাগল পিঙ্গলক ও সঞ্জীবকের বন্ধুত্ব ততই ঘনিষ্ঠতর হতে লাগল। এক সময় দমনককে প্রধানমন্ত্রীর পদে উন্নীত করা হলো। সুযোগ বুঝে দমনক ভাই করটককেও চাকরি দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে এল। পিঙ্গলক সঞ্জীবকের ব্যবহারে এতই মুগ্ধ হয়ে পড়ল যে, দুজনের কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারছেনা। এক পর্যায়ে পিঙ্গলক সঞ্জীবককে বয়স্যের চাকরি দিয়ে একেবারে নিজের কাছেই রেখে দিল। রাজকার্যের প্রতি পিঙ্গলকের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এক সময় দমনক ও করটকের উপর রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে তারা দুজনে একান্ত আলাপে মশগুল হয়ে পড়ল। অন্য পশুদেরতো কথাই নেই, স্বয়ং দমনকেরও তাদের কাছে যাওয়ার অনুমতি ছিলনা। এতে তারা ক্ষুব্ধ হলো। শুধু তারাই নয়, ক্ষুব্ধ হলো সকলে, কারণ কারো খাবার জুটছিলনা মহারাজের অনুমতি ছাড়া কেউ কিছু করতেও পারে না। তাই তারা না খেয়ে মারা যাচ্ছিল। অনেকেই পিঙ্গলকের চাকরি ছেড়ে চলে গেছে। যাবেই বা না কেন? বিনা বেতনে আর কে কতদিন চাকরি করে? তাছাড়া মড়া গাছে যেমন পাখি থাকেনা, তেমনি যে রাজার কাছে কিছু পাওয়ার নেই, তার কাছেও কেউ থাকেনা।

এমতাবস্থায় করটর একদিন দমনককে বলল: ভাই, তুমি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী, সেহেতু রাজাকে তোমার কিছু বলা উচিত, তা নাহলে তুমি দোষের ভাগী হবে। শাস্ত্রে বলে না

রাজা কর্ণপাত না করলেও মন্ত্রীদের বলতে হয়, যাতে নিজের উপর দোষ না চাপে, যেমন বিদুর বলতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। তাছাড়া মদমত্ত রাজা আর হাতি যখন বিপথে হাটে, তখন দোষ হয় মন্ত্রী আর মাহুতের। আর এই ঘাসখেকোটাকেতো তুমিই এনেছ! নিজের জ্বালানো আগুনে এবার নিজের ঘরই পুড়ছে!

দমনকের নিজের উপর ভীষণ রাগ হলো। সে বলল: ষাঁড়টাকে এত করে বোঝালাম, কিন্তু কাজ হলোনা; রাজার ছায়া পেয়ে আমার কাছ থেকে সরে পড়ল! আর প্রভু ও তাতে মজে গেল! যার ভয়ে তেষ্টা নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল, আমায় ভুলে এখন তাকে নিয়ে মেতে আছে! আসলে দোষটা আমারই, প্রভুর নয়! কথায় বলে :

শেয়াল মরল রক্তলোভে গুরু শিষ্যবেশে।
দূতী মরল পরের কাজে সবই নিজের দোষে।।

করটক: কি সে ঘটনা? খুলে বল।

দমনক: বলছি, শোন…

শেয়াল গুরু ও দূতী

এক নির্জন জায়গায় ছিল এক পোড়ো মন্দির। সেখানে বাস করতেন এক গুরু-ঠাকুর। তিনকুলে তাঁর কেউ ছিলনা—কিছু শিষ্য আর যজমান ছাড়া। মন্দিরে আগত পুণ্যার্থীরা যা প্রণামী দিত, তা তিনি গোপনে জমাতেন। দেখতে দেখতে তার পরিমাণটা হয়ে উঠল লোভনীয়। গুরুর মতি-গতিরও পরিবর্তন ঘটল। মানুষের প্রতি তাঁর অবিশ্বাস জন্মিল। তাই টাকার পুঁটলিটা তিনি কখনোই বগলচ্যুত করতেন না। একি যন্ত্রণা! সাধে কি আর বলে—টাকা আয় করা কষ্ট, রক্ষা করা কষ্ট, ব্যয় করা কষ্ট কেবল কষ্ট, কষ্ট আর কষ্ট! তারপরও মানুষ এর পেছনেই ছোটে অন্ধের মতো! সংসার বিবাগী গুরুও ছুটছেন।

কিন্তু চোরের উপরেও যে বাটপার আছে, সে-কথা গুরু-ঠাকুর বুঝতে পারেন নি! তাই একদিন আষাঢ়ভূতি নামে এক জোচ্চোর টাকাটা দেখে ফেলল। কিন্তু সমস্যা হলো গুরুতো ওটা কিছুতেই বগলছাড়া করছেন না। মন্দিরের দেয়ালও পাশ্, তাই সিঁধ কাটারও উপায় নেই। কিন্তু ওটা যে তার চাই-ই।

আষাঢ়ভূতি উপায় খুঁজতে থাকে। শেষে একদিন ঠিক করে যেভাবেই হোক, গুরুর বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তাঁকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাঁর শিষ্য হতে হবে। পণ্ডিতেরাইতো বলেন—নির্লোভ হলে উচ্চপদ পাওয়া যায়না, চতুর না হলে কারো প্রিয় হওয়া যায়না, আর সত্যি কথা বলে কখনো ঠগ-জোচ্চোর হওয়া যায়না।

এরূপ চিন্তা করে আষাঢ়ভূতি একদিন ‘ওঁ নমঃ শিবায়’ বলে গুরুকে সাষ্টাঙ্গে প্ৰণাম করল। গুরুও ‘আয়ুষ্মান্ ভব’ বলে তাকে আশীর্বাদ করলেন। এই প্রশ্রয়টুকু পেয়েই আষাঢ়ভূতি গদগদভাবে বলল: গুরুদেব, অসার এ সংসার! যৌবন যেন পাহাড়ী নদীর বেগ, খানিক পরেই শান্ত! জীবনটা যেন খড়ের আগুন, নিমেষেই ছাই! আনন্দ-ফূর্তি যেন শরৎকালের মেঘ, দেখতে দেখতে ফুরিয়ে যায়! দারা-পুত্র-পরিবার—সবই যেন নিশার স্বপন, চেতন ফিরলে আর নেই! আমি সব বুঝতে পেরেছি! আমার আর ভালো লাগেনা! আপনি আমার মুক্তির পথ দেখান!

শেয়ালের মিষ্টি কথায় যেমন কাক ভুলেছিল, তেমনি আষাঢ়ভূতির কথায় গুরুও মজে গেলেন। বিস্ময়াবেশে তিনি বললেন: চমৎকার! যৌবনেই যার এমন বৈরাগ্য, সে-ইতো ধন্য! শাস্ত্র বলছে :

যৌবনে যে এমন শান্ত সে-ই শান্ত সুনিশ্চয়।
ধাতু ক্ষীণ হইলে বলো কে-ই বা না শান্ত হয়।।

তাছাড়া সজ্জন প্রথমে মনেই বৃদ্ধ হন, পরে দেহে; কিন্তু দুর্জন কেবল দেহেই বৃদ্ধ হয়, মনে কখনোই নয়। তুমি সজ্জন। মহাদেবের কৃপা তুমি পাবেই।

গুরুর কথা শুনে আষাঢ়ভূতি ছুটে গিয়ে তাঁর পা জড়িয়ে ধরে। বলে: আপনি আমায় দীক্ষা দিন।

গুরু আর না করতে পারলেন না। রাজি হয়ে গেলেন। তবে অন্তরের কোণে সন্দেহের দানাটুকু রয়েই গেল। তাই আষাঢ়ভূতিকে বললেন: একটি শর্ত—রাতের বেলা তুমি আমার ঘরে ঢুকতে পারবে না। বাইরের ঐ কুঁড়েঘরে থাকবে। কারণ সন্ন্যাসীদের একা থাকাই ভালো—তোমারও, আমারও। দেখ, শাস্ত্র বলছে:

রাজা নষ্ট কুমন্ত্রণায়, সাধু নষ্ট মেলামেশায়।
ব্রাহ্মণ নষ্ট বেদ ছাড়লে, ছেলে আদিখ্যেতায় ॥
বংশ নষ্ট কুলাঙ্গারে, স্বভাব নষ্ট দুষ্ট-সেবায়।
অভদ্রতায় ভাব নষ্ট, বিষয় নষ্ট অবহেলায় ॥
স্নেহ নষ্ট দূরবাসে, অহঙ্কারে মেয়ে নষ্ট।
টাকা নষ্ট অতিব্যয়ে, অযতনে কৃষি নষ্ট ॥

আষাঢ়ভূতি আরো জোরে পা জড়িয়ে ধরে সোৎসাহে বলল: গুরুদেব! আপনি আমায় দীক্ষা দেবেন এটাই আমার পরম পাওয়া! আহার-নিদ্রা কোনো ব্যাপার নয়!

অতঃপর গুরু প্রীত হয়ে যথাশাস্ত্র তাকে শিষ্য করে নিলেন।

এভাবে দিন যায়, মাস যায়। আষাঢ়ভূতি পরম যত্নে গুরুর হাত-পা টিপে দেয়। এতে গুরু মহাসন্তুষ্ট হন। কিন্তু টাকার পুঁটলিটা বগলছাড়া করেন না। তাই মনে মনে আষাঢ়ভূতি ভীষণ অধৈর্য হয়ে পড়ে। তার কি এভাবেই জীবন কাটবে! এতো তার কাম্য নয়! একবার ভাবে—বেটাকে শেষ করে দিয়ে পুঁটলিটা নিয়ে নিলেইতো হয়! এমন সময় একটি সুবর্ণ সুযোগ আসে। ভিন গাঁয়ের এক শিষ্য আসে নিমন্ত্রণ নিয়ে। তার ছেলের অন্নপ্রাশনে গুরুকে যেতেই হবে। ভুরিভোজ এবং উপরি পাওনার আশায় গুরুও সানন্দে রাজি হয়ে যান। যথাসময়ে আষাঢ়ভূতিকে সঙ্গে নিয়ে তিনি শিষ্যবাড়ি যাত্রা করেন। পথে পড়ে একটি নদী। গুরু বললেন: বৎস, স্রোতস্বিনীতে স্নানটা সেরে নেই। ততক্ষণে তুমি মহেশ্বরের এই কন্থাটি সযত্নে রক্ষা কর। এর কোনো ক্ষতি হলে তিনি রুষ্ট হবেন। তাতে উভয়েরই অমঙ্গল!

এই বলে গুরুদেব টাকার পুঁটলিসহ যাবতীয় জিনিসপত্র একটি কাঁথায় মুড়ে আষাঢ়ভূতিকে দিয়ে নদীর দিকে যাত্রা করলেন। আষাঢ়ভূতিও ‘যথাজ্ঞা’ বলে দুহাত বাড়িয়ে সেটি নিয়ে পথের পাশে একটি গাছের নীচে বসে পড়ল। নদীর পথে একটি ছোট ঝোঁপ-ঝাড় পড়ে। গুরু এক সময় তাতে অদৃশ্য হয়ে যান। স্নান সেরে তীরে উঠে দেখেন একদল মেষ চরে বেড়াচ্ছে এবং দুটি শিংওয়ালা মেষ সজোরে পরস্পরের কপালে ঢুঁ মারছে। তাতে কপাল ফেটে রক্ত ঝরছে। পাশেই ছিল এক ক্ষুধার্ত শৃগাল। সে আর লোভ সামলাতে পারলা না। চুঁসাটুসির মধ্যেই চেটে চেটে গরম তাজা রক্ত খেতে লাগল। হঠাৎ দুদিক থেকে মেষদুটি এসে আঘাত করায় শেয়ালটা অক্কা পেল। গুরু মনে মনে বললেন: লোভের তরী ওকে ভবনদী পার করে দিল!

শেয়ালটার জন্য দুঃখ করতে করতে গুরু ফিরে এসে দেখেন—আর সবই আছে, নেই কেবল আষাঢ়ভূতি আর তাঁর টাকার পুঁটলিটা। তিনি বিলাপ করতে করতে বললেন: আষাঢ়ভূতি! আমার এত কষ্টের সঞ্চয় শেষ পর্যন্ত নিয়ে পালালে! এই তোমার গুরুসেবা!

আর কি করার আছে? বেলাও পড়ে আসছে। অগত্যা আষাঢ়ভূতির পায়ের চিহ্ন লক্ষ্য করে তিনি এগুতে লাগলেন। কিছুদূর যেতেই সন্ধ্যে হয়ে এল। অজানা জায়গা! কোথায় যাবেন তিনি? কোথায়ই বা রাত কাটাবেন? এমন সময় দেখতে পেলেন— এক তাঁতি সস্ত্রীক যাচ্ছে মদের ভাঁটিতে। গুরু তার উদ্দেশে বললেন: আমি পরদেশী। তোমার অতিথি হতে চাই। অতিথি সৎকার পরম ধর্ম। শাস্ত্রে আছে—সূর্যাস্তের অতিথির সেবা করলে গৃহস্থের শতযজ্ঞের ফললাভ হয়।

তাঁতি গুরুর দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করে স্ত্রীকে বলল: ইনি আমাদের অতিথি। অতিথি নারায়ণ। তুই এঁকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আদর-যত্ন কর। আমি তোর জন্য বারুণি নিয়ে আসব।

তাঁতিবৌ এ-কথায় মহা খুশি হয়ে গুরুকে নিয়ে বাড়ি গেল। তার খুশির কারণ তাঁতি আজ রাতে আর ঘরে ফিরবে না। মদের নেশায় বুঁদ হয়ে ভাঁটিখানায়ই পড়ে থাকবে। তাই প্রেমিক দেবদত্তের সঙ্গে রাতটা তার ভালোই কাটবে। কথায় বলে:

বাদল দিন, ঘন আঁধার
রাজপথে চলা ভার।
পতি যাচ্ছে দূরদেশে
মন্দ মেয়ে সুখে ভাসে ॥

কিংবা—

কুল-হারানো লোকনিন্দা বন্দীদশা জীবন ক্ষয়।
সব সইতে রাজি যার পরপুরুষে প্রণয় রয় ॥

তাই তাঁতিবৌ কোনোরকমে গুরুর জন্য আহার-নিদ্রার ব্যবস্থা করে সেজে-গুজে অভিসারে যাত্রা করল। কিন্তু বিধি বাম! টলতে টলতে তাঁতি আজ তাড়াতাড়িই ফিরে এল। তাকে দেখামাত্র বিদ্যুৎ-বেগে তাঁতিবৌ ঘরে এসে সাজ-গোজ খুলে ফেলল। কিন্তু তাঁতির চোখ এড়াতে পারল না। সে চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করল: পাপিষ্ঠা! কোথায় যাচ্ছিলি? এতদিন লোকের কানাঘুষোয় বিশ্বাস করিনি। আজ নিজের চোখে দেখলাম। বল! কার কাছে যাচ্ছিলি? কে তোর নাগর?

তাঁতিবৌ ঝামটা মেরে বলল: কি সব আবোল-তাবোল বকছ? মদে তোমার মাথা ঠিক নেই। আমি আবার যাব কোথায়? তোমার পথ চেয়েইতো বসে ছিলাম।

স্ত্রীর মিথ্যা কথা শুনে তাঁতির মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে অগ্নিকণ্ঠে বলল: হারামজাদি! পাপিষ্ঠা! অনাচার করে আবার মিথ্যে বলছিস! তোর পাপের ফল ষোলআনা পেকেছে! আজ তোকে খাওয়াবই!

এই বলে লাঠিপেটা করে তার সর্বাঙ্গ ফুলিয়ে দিল। অতঃপর ঘরের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে সে আবার টলতে টলতে পড়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে নাপিতবৌ এসে বলল: সই, সেই কখন থেকে দেবদত্ত অপেক্ষা করছে! তাঁতিবৌ: আমি কি করব, সই? দেখনা, মিনসে আমায় মেরে কি করেছে! তারপর আবার বেঁধে রেখেছে! আমার বোধ হয় আর তার দেখা হলো না-রে!

নাপিতবৌ: এই নে, আমি তোর বাঁধন খুলে দিচ্ছি, তুই যা।

তাঁতিবৌ: কি করে যাব? দেখছিস না, মিনসে পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে! জেগে উঠে আমায় না দেখলেতো মেরে ফেলবে!

নাপিতবৌ: আচ্ছা, তোর জায়গায় আমি আছি। তুই আমায় বেঁধে রেখে যা। তাড়াতাড়ি চলে আসবি।

কথামতো কাজ হলো। তাঁতিবৌয়ের জায়গায় নাপিতবৌ নিজেকে বেঁধে রেখে সইকে নাগরের কাছে পাঠালো। এদিকে তাঁতির মদের নেশা কিছুটা হালকা হলে সে স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে লাগল: ওরে মুখপুড়ি! প্রতিজ্ঞা কর আজ থেকে আর বাড়ির বাইরে যাবি না। আর আমার সঙ্গে খর্খর্ করে কথা বলবি না। তাহলে ছেড়ে দেব। নাপিতবৌ ভয়ে চমকে উঠল। সর্বনাশ! এই মরার পো যদি সত্যিই জেগে ওঠে তো রক্ষে নেই! মান আর জান উভয়ই যাবে। আবার কথা বললেও বিপদ! গলার আওয়াজে ধরা পড়ে যাব! তাই চুপ থাকাই ভালো। দেখি কি হয়!

তাঁতি কিন্তু কথার উত্তর না পেয়ে খেপে গেল। সে অপমানিত বোধ করে বলল: অন্যায় করে আবার চুপ করে আছিস! তোর সাহসতো কম নয়, হতচ্ছাড়ি! দেখাচ্ছি মজা! এই বলে অন্ধকারে হাতড়াতে হাতড়াতে এসে ছুরির এক হ্যাচকা টানে দিল নাপিতবৌর নাক কেটে। ঝরঝর করে রক্ত পড়ে ভিজে গেল মাটি। তাঁতি আবার গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল এদিকে তাঁতিবৌ মনের ক্ষুধা মিটিয়ে হাসতে-হাসতে, নাচতে-নাচতে বাড়ি ফিরল । সইকে জিজ্ঞেস করল: সব ঠিকঠাক আছে তো? মিনসে আবার কিছু করেনি তো? নাপিতবৌ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল: নাক বাদে আর সবই ঠিক আছে!

তাঁতিবৌ কাছে এসে সইয়ের নাক কাটা দেখে ভীষণ কষ্ট পেল। বলল: পরজনমে আমি তোর বাঁদি হয়ে এ ঋণ শোধ করব, সই!

নাপিতবৌ: সে হবে, এখন আমার বাঁধন খুলে দে দিকিনি। আমি বাড়ি যাই। নইলে নাক তো গেছেই, জানটাও যাবে! অতঃপর তাঁতিবৌ দ্রুত তার বাঁধন খুলে দিল এবং নাপিতবৌ তাঁতিবৌকে আবার আগের মতো বেঁধে রেখে নিজের বাড়ি চলে গেল।

এদিকে তাঁতির মদের নেশা কেটে গেলে স্ত্রীর কাছে এসে চড়া গলায় বলল: কি রে, হারামজাদি! এখনও চুপ করে আছিস! বললি না, কোথায় গিয়েছিলি? নাক তো গেছেই, এবার কানটাও খোয়াতে চাস?

এবার তাঁতিবৌ ঝামটা মেরে বলল: ওরে হতভাগা! আমার মতো সতীর গায়ে হাত তোলে এমন সাধ্যি কার? তেত্রিশ কোটি দেবতা জানে আমি কেমন সতী! তিন লোকের দেবগণ শোনো: আমি যদি সতী হই, মনে মনেও যদি অন্য পুরুষ কামনা না করে থাকি, তাহলে এই মুহূর্তে আমার কাটা নাক যেন জোড়া লেগে যায়। আর যদি অসতী হই তাহলে যেন আমার মরণ হয়!

মুহূর্তকাল পরে চিৎকার করে বলল: ওরে ড্যাকরা! চেয়ে দেখ, আমার সতীত্বের জোরে কাটা নাক জোড়া লেগে গেছে!

স্ত্রীর কথা শুনে তাঁতির মনে ধন্দ লাগল। সে প্রদীপ জ্বালিয়ে স্ত্রীর মুখের কাছে ধরে তো হতবাক! এ কি করে সম্ভব! কিন্তু সে তো নিজের হাতেই নাক কেটেছে, আবার নিজের চোখেই দেখছে। তাই অবিশ্বাস করবে কি করে? নীচের দিকে তাকিয়ে দেখে রক্তে মাটি এখনও ভিজা! অগত্যা দ্রুত বাঁধন খুলে দিয়ে স্ত্রীকে বিছানায় নিয়ে সে কি সোহাগ! সোহাগে সোহাগে সর্বাঙ্গ ভরে দিয়ে তার মান ভাঙাতে লাগল।

এদিকে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গুরু নির্বাক দর্শকের মতো এই দুই রমণীর কাণ্ড-কারখানা অবলোকন করেছেন আর ভাবছেন: হায়রে স্ত্রীলোক! তোমার দ্বারা কি না সম্ভব হয়! বুদ্ধিতে তোমার কাছে বৃহস্পতিও হার মানে! শাস্ত্র কি আর এমনি বলেছে: মেয়েদের মুখে মধু, হৃদয়ে বিষ! তাইতো পুরুষরা সেই মধুর লোভে তার অধর পান করে, কিন্তু বেরিয়ে আসে হলাহল! স্ত্রীলোক প্রথমে প্রেমের অভিনয় করে পুরুষকে আকৃষ্ট করে এবং যতক্ষণ না পুরুষটি মজে যায় ততক্ষণ অভিনয় চলতে থাকে। যখনই বুঝতে পারে সে মজেছে, অমনি টোপগেলা মাছের মতো হ্যাঁচকা টানে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এরূপ ভেবে ভেবে কোনোরকমে গুরু সে রাতটা কাটিয়ে দিলেন। এদিকে নাপিতবৌ দূতীয়ালি করতে গিয়ে নাক হারিয়ে এখন চিন্তায় পড়ে গেছে—স্বামী ফিরে এলে কি জবাব দেবে এই ভেবে। তার স্বামী কাজের চাপে সেদিন রাজবাড়ি থেকে ফিরতে পারেনি। সকাল বেলা এসে বাইরে থেকেই হাঁক দিয়ে বলল: কৈ গো, আমার ক্ষুরের বাক্সটা দে তো, আজ অনেককে কামাতে হবে।

কিন্তু নাপিতবৌ কাটা নাক নিয়ে সামনে আসবে কি করে? ধরা পড়ে যাবে যে! তাই ঘরের কাজে যেন খুবই ব্যস্ত এমন ভাব করে সে বাক্স থেকে ক্ষুরটা বের করে বাইরে ছুঁড়ে মারল। স্ত্রী কাছে তো এলই না, উপরন্তু শুধু ক্ষুরটা ছুঁড়ে মারল। এতে নাপিতের মাথায় রক্ত উঠে গেল। সে চিৎকার দিয়ে ক্ষুরটা আবার স্ত্রীর দিকে ছুঁড়ে মারল। নাপিতবৌ তো এমন একটি সুযোগই খুঁজছিল। সঙ্গে সঙ্গে সে চিৎকার দিয়ে বাইরে এল এবং পাড়ার লোককে ডেকে বলল: তোমরা দেখ! মিনসে আমার নাক কেটে দিয়েছে! তোমরা এর বিচার কর!

লোকজন ছুটে এসে দেখে সত্যিই নাপিতবৌর নাক কাটা। তারা রাজার লোককে খবর দিল। এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় নাপিত তো হতবিহ্বল! রাজার লোক এসে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেও কোনো উত্তর পেল না। তারা তাকে ইচ্ছেমতো উত্তম-মধ্যম দিল। তারপর তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দুজনকেই নিয়ে গেল রাজ দরবারে।

বিচারকরা নাপিতকে জিজ্ঞেস করলেন: কেন তুমি স্ত্রীর অঙ্গহানি করেছ? সে কি পরপুরুষগামিনী? না-কি তোমায় মারতে গিয়েছিল? বল?

নাপিত নিরুত্তর এবং নতমুখী। বিচারকরা বললেন: নিরপরাধের মুখ থাকে প্রসন্ন, কথা হয় স্পষ্ট, চোখের দৃষ্টিতে থাকে ক্রোধের ভাব; সে কথা বলে সোজা হয়ে বুক ফুলিয়ে। কিন্তু এ দেখছি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ স্খলিত পদে সভায় প্রবেশ করল। এর মুখ ফ্যাকাশে। কপালে ঘাম ছুটছে। গলার স্বর ও মুখের রং বদলে গেছে। ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। এ-সবই অপরাধীর লক্ষণ। স্ত্রীলোকের গায়ে হাত! গুরুতর অপরাধ! তাই এর দণ্ডও হবে গুরুতর। শূলে চড়িয়ে মৃত্যু।

বিচারকদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক জল্লাদ নাপিতকে বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে। লোকজন বলাবলি করছে। তা শুনে গুরু ছুটে এসে বলেন: তোমরা থাম! এর কোনো দোষ নেই। সমস্ত দোষ ঐ নষ্টা মেয়েলোকের। একজন ভালো লোককে তোমরা মৃত্যুদণ্ড দিওনা। গুরুর কথায় জল্লাদেরা থমকে দাঁড়াল। তারা গুরুকে বলল: আপনার যা বলার বিচারকদের বলবেন, চলুন। এই বলে তারা গুরু এবং নাপিত উভয়কে বিচারালয়ে নিয়ে গেল। গুরু তখন বিচারকদের উদ্দেশে বললেন:

শেয়াল মরল রক্তলোভে গুরু শিষ্যবেশে।
দূতী মরল পরের কাজে সবই নিজের দোষে ॥

বিচারকরা বললেন: গুরুদেব, খুলে বলুন! গুরু তখন সমস্ত ঘটনা খুলে বললে নাপিত ছাড়া পায়। কিন্তু বিচারকরা সিদ্ধান্ত দেন: নারী, শিশু, ব্রাহ্মণ, তপস্বী এবং রোগী এই পাঁচজনের অপরাধ গুরুতর হলেও মৃত্যুদণ্ড হয়না, হয় অঙ্গহানি। তাই নাপিতবৌ নিজের দোষে নাক হারিয়েছে, এবার বিচারে তার কান কাটা যাবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জল্লাদ তার দু-কান কেটে দেয়। এসব দেখে গুরু তাঁর টাকার শোক ভুলে শান্ত মনে আবার মন্দিরে ফিরে যান।

দমনক এসব বলে নীরব হলে করটক বলল: তা-তো বুঝলাম। কিন্তু গুরু নিজেও তো কম চালাক নন। তবে আষাঢ়ভূতি তাঁর টাকা চুরি করল কি করে?

দমনক বলল: তাঁরও বুদ্ধির ঘাটতি ছিল। দেখ:

ভালো করে আঁটলে ফন্দি অন্ত পায় না ব্ৰহ্মা।
বিষ্ণুরূপ ধরে তাঁতি ভুঞ্জে রাজকন্যা ॥

করটক: মানে?

দমনক: বলছি, শোন…

বিষ্ণুরূপী তাঁতি

এক নগরে থাকত দুই বন্ধু

এক তাঁতি আর এক ছুতার। দুজনে খুব ভাব

সেই ছোটবেলা থেকেই। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। যেখানে যায় এক সঙ্গে। যা করে তা-ও এক সঙ্গে। এমনি জোড়মানিক। হরিহর আত্মা।

সেই নগরে ছিল এক বারোয়ারি মন্দির। লক্ষ লোকের সমাগম হয় পালা-পার্বণে। বসে বিরাট মেলা। হাতি-ঘোড়া, বাঘ-ভাল্লুক কত কি আসে! সার্কাস, নাচ-গান, কবির লড়াই নানা রকম বিনোদনের ব্যবস্থা থাকে সেখানে। তাই দুজনে একদিন গেল সেই মেলায়। মেলার এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ দেখে চন্দ্রমা যেন আকাশ ছেড়ে হাতির পিঠে চড়ে মেলায় ঢুকছে! না, চন্দ্ৰমা নয় রাজকন্যা! লোকে তা-ই বলছে। তাঁতি তাকিয়েই আছে! অপলক! কিছুক্ষণের মধ্যে সে ধপাস করে মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। ছুতার তো হতবাক! বিমূঢ়! কি হলো ওর? কালক্ষেপণ না করে ধরাধরি করে তাকে নিয়ে গেল নিজের বাড়ি। বদ্যি-কবিরাজ ডেকে চিকিৎসা করায় অল্পতেই জ্ঞান ফিরল। তারপর নিভৃতে জিজ্ঞেস করলে তাঁতি বন্ধুকে যা বলল, তা শুনে তো তার আক্কেল গুড়ুম! তাঁতি বলল: রাজকন্যাকে দেখার পর থেকেই কামশরে আমি বিদ্ধ হয়েছি। মরণ আমার নিশ্চিত, কারণ এর কোনো প্রতিকার নেই, একমাত্র মরণ ছাড়া। তাই তুমি আমার চিতা সাজাও। আর যদি তোমাকে কখনও কষ্ট দিয়ে থাকি, বন্ধু হিসেবে মাফ করে দিও!

এই বলে তাঁতি নীরবে কাঁদতে লাগল। বন্ধু ছুতারও কিংকর্তব্যবিমূঢ়! কিছুক্ষণ ভেবে সে বলল: বন্ধু, ধৈর্য ধর! তুমি যেখানে যাবে, আমারও গন্তব্য তা-ই। দুচোখ কি দুদিকে তাকাতে পারে? তাই চিতা সাজাতে হলে দুটোই সাজাব। কিন্তু ভাবছি—যে আগুনে তোমার হৃদয় পুড়ছে, তা থেকে তোমার দেহটাকে বাঁচাই কি করে? তবে এটাও ঠিক—সব রোগেরই ওষুধ আছে। শাস্ত্র বলছে না—সর্বস্যৌষধমস্তি। তুমি আমার ওপর ভরসা রাখ। যা হোক ব্যবস্থা একটা হবেই।

এই বলে ছুতার কিছুক্ষণ চিন্তা করে সোৎসাহে বলল: বন্ধু, হয়ে গেছে! সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে! আজ রাতেই তুমি রাজকন্যার সঙ্গে মিলিত হতে পারবে।

তাঁতি উদাস কণ্ঠে বলল: এত রক্ষী পাহারা দিচ্ছে! একমাত্র বায়ু ছাড়া আর কেউ যেখানে ঢুকতে পারে না, সেখানে এটা কি করে সম্ভব? মিছেমিছি তুমি আমায় নাচাচ্ছ! এ তোমার বন্ধুবাৎসল্য! আর কিছু নয়!

ছুতার দৃঢ়তার সঙ্গে বলল: তুমি শুধু আমার কথামতো কাজ করবে, তারপর দেখবে আমার বুদ্ধির জোর কতখানি!

এই বলে ছুতার তার পরিকল্পনা খুলে বলল। তাঁতিকে সে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম-ধারী বিষ্ণুরূপে সাজিয়ে দিয়ে রাতের বেলা অন্তঃপুরে পাঠাবে। যন্ত্রচালিত গরুড়ে চড়ে সে যাবে। ছুতার দ্রুততার সঙ্গে সব ব্যবস্থা করে ফেলল এবং বিষ্ণুরূপী তাঁতি যথাসময়ে রাজকন্যার সামনে গিয়ে হাজির হলো। হতভম্ব রাজকন্যা কিছু বলার আগেই তাঁতি বলল: তুমি আমার লক্ষ্মী। আগের জন্মে রাধা ছিলে। তোমায় ছাড়া আমি থাকি কি করে, বল তো!

স্বয়ং বিষ্ণুকে দেখে রাজকুমারী বিমোহিত, বিস্মিত! ‘না’ বলার সাহস নেই। তাই বলে নারীর ভূষণ ত্যাগ করাও সহজ নয়। অতঃপর বিষ্ণুরূপী তাঁতির সর্বৈব সান্ত্বনায় রাজকুমারী নিজেকে তার হাতে তুলে দিল। ভোর হওয়ার আগেই ‘আবার দেখা হবে’ বলে তাঁতি চলে গেল।

এভাবে চলতে লাগল বিষ্ণুরূপী তাঁতি আর রাজকন্যার গোপন অভিসার। কিন্তু গোপন বিষয় আর কতদিন গোপন থাকে? বীজের অঙ্কুরের মতো তা একদিন প্রকাশ পায়ই। রাজকন্যাও ধরা পড়ে গেল। রক্ষীরা একদিন রাজাকে গিয়ে জানাল: মহারাজ! আমাদের দায়িত্ব পালনে এতটুকু ফাঁক নেই যে রাজকুমারীর মইলে মাছিও ঢুকতে পারে! কিন্তু তারপরেও বলছি রাজকন্যার মহলে কেউ একজন গোপন অভিসারে আসে!

রাজার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! তিনি ব্যাকুল চিত্তে ভাবতে লাগলেন: মেয়ের বাবার চিন্তার আর শেষ নেই! কখন কি কেলেঙ্কারি ঘটে বসে! মেয়েকে কার হাতে দেব

এ এক বিরাট সমস্যা! আবার দিলেও সুখী হবে কি-না সে-ও এক সমস্যা! মেয়ে জন্মালেই বাপ-মায়ের মন উড়ে যায়!

এসব ভাবতে ভাবতে রাজা গেলেন অন্তঃপুরে। রানিকে গিয়ে বললেন: এতকাল দুধ—কলা দিয়ে যাকে পুষেছ, এবার সে ছোবল মারার জন্য তৈরি। রানি বিস্ময়াবিষ্টের ন্যায় তাকিয়ে আছেন। রাজা তখন সব কথা খুলে বলে রানিকে বললেন: জেনে এস রাতের বেলা মেয়ের ঘরে কে আসে! রানির বুকটা যেন কে চেপে ধরল! দুরু দুরু বক্ষে কম্পিত পদে তিনি গেলেন রাজকন্যার প্রাসাদে। বললেন: পাপিষ্ঠা! বল, তোর কাছে কে আসে? কার যমের বাড়ি যাওয়ার সাধ হয়েছে?

রাজকন্যা সলজ্জভাবে সব খুলে বললে রানির বুক থেকে পাথরটা সরে গেল। তাঁর শরীরটা যেন পালকের ন্যায় হালকা হয়ে গেল। তিনি যেন উড়ে গিয়ে রাজাকে বললেন: মহারাজ! আমাদের ভাগ্যদেবতা সুপ্রসন্ন! স্বয়ং বিষ্ণু আমাদের জামাতা! গরুড়বাহন আমাদের মেয়েকে গান্ধর্বমতে বিবাহ করেছেন! রাতের বেলা তিনিই আসেন!

আনন্দে রাজা যেন রানিকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলেন। নিজেকে সংবরণ করে বললেন: তাহলে আমাদের চেয়ে সুখী আর কে আছে? এবার জামাইয়ের আশীর্বাদে আমি পৃথিবী জয় করব।

উচ্ছ্বাস স্তিমিত হলে রাজা-রানি রাতের অপেক্ষা করতে লাগলেন। কখন তাঁদের জামাতা অভিসারে আসবে। অপেক্ষার সময় যে আর কাটে না। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। রাজা-রানি সাগ্রহে তাকিয়ে আছেন আকাশের দিকে। হঠাৎ দেখেন গরুড়ে চড়ে স্বয়ং নারায়ণ আসছেন তাঁদের মেয়ের ঘরে! তাঁদের আনন্দ আর দেখে কে? রাজা পরের দিনই শুরু করেন পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহ জয় করতে। তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে একদা সমস্ত রাজা জোটবদ্ধ হয়ে তাঁকেই আক্রমণ করেন। রাজা কিছুতেই পেরে উঠছেন না। দিনে দিনে তাঁর রাজ্য সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। বাকি আছে শুধু দেয়ালঘেরা প্রাসাদটুকু। রাজা তখন মেয়েকে ডেকে বললেন: মা, তুমি জামাইকে একটু বল, নাহলে তো আর রক্ষে নেই। স্বয়ং বিষ্ণু যার জামাতা তার কি-না এই দশা! রাজকুমারী পিতাকে আশ্বস্ত করে তাঁতিকে গিয়ে বলল: আপনি স্বয়ং নারায়ণ যাঁর জামাতা, তাঁর রাজ্য এভাবে ধ্বংস হলে আপনারই যে অপযশ হবে, প্রভু! সে তো আমি সইতে পারব না! এটা তো আমার কাম্য হতে পারে না!

তাঁতি বীরত্বের সঙ্গে বলল: অবশ্যই নয়। আজই আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি। তুমি শ্বশুর মহাশায়কে বল—তিনি যেন নিজে যুদ্ধে যান। আমি আগে থেকেই শত্রুসৈন্যদের দুর্বল করে রাখব, তিনি মারবেন। আমি নিজের হাতে মারলে ওরা যে স্বর্গে যাবে!

রাজকন্যা মহাখুশি হয়ে পিতাকে গিয়ে সব বলল। রাজাও পরের দিন সাড়ম্বরে যুদ্ধে গেলেন। এদিকে তাঁতির কপালে চিন্তার রেখা দেখা দিল। সে ভাবল: সুখের জীবন শেষ! আজ ধরা পড়তেই হবে! ফলে রাজকন্যার সঙ্গে চিরতরে বিচ্ছেদ ঘটবে। এমনকি জীবনটাও যেতে পারে! তার চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়েই মরা ভালো। তাতে অন্ততঃপক্ষে দেশের কাজে প্রাণ যাবে। এরূপ ভেবে তাঁতি গরুড়ে চড়ে আকাশে উঠে গেল।

এদিকে বৈকুণ্ঠে স্বয়ং বিষ্ণু চিন্তাগ্রস্ত হলেন। তিনি গরুড়কে ডেকে বললেন: বৈনতেয়, তাঁতির পো’র কাণ্ড দেখেছ?

গরুড় বলল: প্রভুর কৃপায় সবই জানি!

বিষ্ণু: ও-বেটা যুদ্ধে মারা গেলে সবাই ভাববে মানুষের হাতে বিষ্ণু তাঁর বাহনসহ মারা গেছে। তাতে সর্বনাশ তো আমাদেরই! কেউ আর আমাদের পুজো দেবে না।

গরুড়: তা এখন কি কর্তব্য, প্ৰভু?

বিষ্ণু: তুমি গিয়ে ঐ কাঠের গরুড়ে ভর কর, আর আমি তাঁতির মধ্যে ঢুকি। এছাড়া আর উপায় কি?

কথামতো কাজ হলো। বিষ্ণু যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে শত্রুসৈন্যদের মায়াবশে দুর্বল করে দিলেন। আর রাজা তাদের হত্যা করলেন। যুদ্ধশেষে তাঁতি যখন মাটিতে নেমে এল, তখন সবাই তাকে চিনে ফেলল: এ-যে আমাদেরই তাঁতির পো! তাঁতি তখন সব ঘটনা খুলে বলল। রাজা তার বুদ্ধি ও সাহস দেখে এবং সর্বোপরি তার সাহায্যে নিজ প্রভাব ফিরে পেয়ে অত্যন্ত খুশি হলেন। শুধু তা-ই নয়, সাড়ম্বরে তিনি রাজ্যসহ রাজকন্যাকে তার হতে তুলে দিলেন।

তাঁতির কাহিনী শুনে করটক বলল: তাতো বুঝলুম, কিন্তু সঞ্জীবক আর পিঙ্গলকের ক্ষেত্রে আমাদের আর কি করার আছে?

দমনক বিজ্ঞের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল: আছে, আছে! দেখ

ধনুকধারী তীর ছুঁড়লে কেউ মরে কেউ মরে না।
বুদ্ধিমানে বুদ্ধি ছাড়লে তার সামনে কেউ বাঁচে না ॥

করটক: বুদ্ধিতে তুমি সেয়ানা এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পিঙ্গলকের সঙ্গে সঞ্জীবকের ছাড়াছাড়ি ঘটানোর শক্তি তোমার কোথায়?

দমনক: শোন, শাস্ত্রে আছে না—

কৌশলেতে পারবে যা গায়ের জোরে হয় না।
কাক মারল কেউটে সাপ দিয়ে সোনার গয়না ॥

করটক: কি রকম?

দমনক: শোন তাহলে…

কাক ও কেউটে

এক বনের ধারে ছিল এক বিশাল বটগাছ। সেখানে বাস করত এক কাক-দম্পতি। গাছের কোটরে থাকত এক কেউটে সাপ। প্রতিবারই কাকী ডিম পাড়ত আর বাচ্চা ফুটত। কিন্তু ঐ কেউটে এসে বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলত।

ঐ গাছের তলায় থাকত এক শেয়াল। তার সঙ্গে আবার কাক-দম্পতির ছিল গভীর বন্ধুত্ব। একদিন কাক-দম্পতি শেয়ালকে বলল: বন্ধু, তোমার সান্নিধ্যে ভালই ছিলাম! কিন্তু আর বুঝি এ-বনে আমাদের থাকা হলো না!

শেয়াল উদ্বেগের সঙ্গে বলল: কেন, বন্ধু! কি হয়েছে?

কাক বিমর্ষভাবে বলল: প্রতিবারই আমাদের বাচ্চা হয়, আর ঐ কেউটে বেটা কোটর থেকে এসে খেয়ে ফেলে! কাজেই এ অবস্থায় আর এখানে থাকি কি করে? কথায় বলে না:

নদীর ধারে ধানক্ষেত পরাসক্ত পরিবার।
সাপের সঙ্গে বসবাস কিসে হবে শান্তি তারা ॥

শেয়াল একটু ভেবে বলল: কিচ্ছু চিন্তা করো না, বন্ধু। কৌশলে সব করতে হবে। দেখ, অনেক সময় অস্ত্র-শস্ত্রে যা না হয়, কৌশলে তা সম্ভব হয়। কৌশল জানলে ক্ষুদ্র হয়েও বীরের সঙ্গে লড়া যায়, তাকে কুপোকাৎ করা যায়।

কাক-দম্পতি বলল: তা উপায়টা কি, শুনি! যদি কোনো উপায় করতে পার তাহলে আর তোমায় ছেড়ে যাব কোথায়?

শেয়াল: তোমরা নগরে যাও। দেখ, কোনো বড়লোকের স্ত্রী বা মেয়ের একটি দামি হার পাওয়া কি-না। পেলে সেটা নিয়ে আস্তে আস্তে উড়ে আসবে, যাতে তারা দেখতে পায় তোমরা কোন দিকে আসছ। হারটা এনে কেউটের কোটরের মুখে রাখবে। তারপর দেখ কি হয়।

শেয়ালের কথামতো বায়স-দম্পতি ছুটে চলল নগরের দিকে। উড়তে উড়তে এক জায়গায় দেখে এক রাজার দুলালি মুক্তো-বসানো একটি সোনার হার খুলে রেখে স্নান করছে। কাল বিলম্ব না করে শাঁ করে নেমে কাকটি হারটি নিয়ে উড়ে এল। রাজার লোকেরা তার পেছনে পেছনে ছুটল। কাকটি হারটি এনে সাপের কোটরে রাখল। তা দেখে রাজার লোকেরা গাছে উঠে হারটি নামিয়ে নিল, আর কোটরে সাপটাকে দেখে মেরে ফেলল। এরপর থেকে কাক-দম্পতি সুখে বসবাস করতে লাগল।

দমনক খুব দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল: তাই বলছিলুম, গায়ের জোরে যা না হয়, কৌশলে তা সম্ভব।

করটক বলল: কিন্তু পিঙ্গলক বনের রাজা। অসীম তার শক্তি! সঞ্জীবকেরও বিশাল দেহ। এদের সঙ্গে তুমি পারবে কি করে?

দমনক: দেখ, শুধু শক্তি আর দেহ থাকলেই হয় না, বুদ্ধিই প্রধান। তা নাহলে হাতি কারো বশ হতো? কারো হাতে তার মৃত্যু হতো? কথায় বলে না—

বুদ্ধি যার বল তার নির্বুদ্ধির কোথা বল।
শশক হাতে পশুরাজ গেল তাই রসাতল ॥

করটক: কিভাবে?

দমনক: বলছি, শোন…

শশক ও সিংহ

এক বনে ছিল এক সিংহ। নাম তার ভাসুরক। গায়ের জোর অসীম। থাবায় দশটা—পাঁচটা পশু মারে। দুইটা খায়, তিনটা ফেলে। এতে বনের পশুকুল প্রায় নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। তাই সকলে মিলে একদিন গিয়ে বলল: প্রভু, আপনি আমাদের মা-বাপ! আপনি রক্ষা না করলে আমরা বাঁচব কি করে?

ভাসুরক অর্ধনিমীলিত চোখে তাকিয়ে বলল: কি হয়েছে?

পশুরা: প্রভু, আপনি রোজ যেভাবে মারছেন, তাতে আমাদের বংশ রক্ষা করাই যে দায় হয়ে পড়েছে! এভাবে চললে একদিন আপনার আহারের সঙ্কট হবে যে!

ভাসুরক বিস্ফারিত চোখে বলল: তাহলে তোরা কি করতে চাস?

পশুরা: আমরা ভাবছি, প্রতিদিন একটি করে পশু আপনার নিকট পাঠাব। আপনি নিশ্চিন্তে বসে খাবেন। তাতে দুটি লাভ। খাবারের জন্য আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আর আমাদেরও বংশবৃদ্ধি ঘটবে। শাস্ত্র বলে না—গোয়ালা যেমন দুধের জন্য গাভী ও তার বাছুরের যত্ন নেয়, তেমনি রাজাকেও খাজনা পেতে হলে রাজ্য ও প্রজার দেখ—ভাল করতে হয়। তা নাহলে অচিরেই রাজ্য সম্পদশূন্য হয়ে পড়ে। মালী যেমন জল দিয়ে অঙ্কুরগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে, রাজাকেও তেমনি প্রজাদের বাঁচিয়ে রাখতে হয়। এতে রাজ্যের যেমন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে, রাজারও তেমনি সুনাম ছড়িয়ে পড়ে

পশুরা এসব বলে ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে ভাসুরকের দিকে। কি বলে তা-ই ভাবছে। ভাসুরক ভাবল: প্রস্তাবটা মন্দ নয়। বিনা প্ররিশ্রমে যদি আহার জোটে তো ভালই। এখন না হয় গায়ে জোর আছে। ধরে-মেরে খাচ্ছি। কিন্তু বয়স হলে? তাই এদের প্রস্তাবে রাজি হওয়াই উত্তম। প্রকাশ্যে বলল: তা-ই হবে, তবে এর ব্যতিক্রম হলে কিন্তু সবকটাকেই মেরে ফেলব। মনে থাকে যেন।

পশুরা ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল। পরদিন থেকে পালা করে একটি করে পশু ভাসুরকের কাছে যায় এবং সে নিশ্চিন্তে বসে খায়। কেউ যায় ইচ্ছায়, কেউ যায় অনিচ্ছায়। যুবা—বৃদ্ধ এবং জাত নির্বিশেষে এভাবে চলতে থাকে। অবশেষে একদিন আসে এক খরগোসের পালা। সে কিছুতেই রাজি নয়। কিন্তু নিয়ম ভাঙলে সকলের বিপদ! তাই সবাই মিলে জোর করে তাকে পাঠিয়ে দিল।

যেতে যেতে খরগোস ভাবছে—কিভাবে সিংহটাকে জব্দ করা যায়। দুই পা আগায় তো এক পা পিছোয়। এভাবে অর্ধেক পথ যেতে যেতেই দুপুর হয়ে গেল। ভাসুরকের খাবার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। সেদিকে খরগোসের ভ্রূক্ষেপ নেই। হঠাৎ পথে পড়ল এক পাতকুয়া। খরগোস আনমনে নিচের দিকে তাকাতেই জলের উপর তার ছায়া ভেসে উঠল। বিদ্যুৎ গতিতে তার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। মনে মনে বলল: হারামজাদাকে শায়েস্তা করার উপায় পেয়ে গেছি! এই বলে সে ভাসুরকের পথে চলতে লাগল।

খরগোস যখন ভাসুরকের কাছে পৌঁছল তখন বিকেল হয়ে গেছে। তাকে দেখে ভাসুরক দাঁত কটমট করে ছুটে এল। খরগোস হাত জোড় করে বলল: প্রভু, আমার কোনো দোষ নেই! আমি ঠিক সময়েই আসছিলাম। আমি ছোট বলে আমার সঙ্গে আরো চারটি খরগোসও আপনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু, পথে আরেকটি সিংহ আমার পথ আটকে বলল: কোথায় যাচ্ছিস, আমাকে বাদ দিয়ে?

আমি বললাম: আমরা প্রভুর কাছে যাচ্ছি। আমরা গেলে তার আহার হবে।

সে রেগে বলল: কে আবার প্রভু? আমিই এ বনের রাজা। তোরা আমার আহার হবি।

আমি বললাম: সে হয় না। এক বনে রাজা তো একজনই হয়।

সে বলল: ঠিক আছে। ঐ চারটাকে এখানে রেখে তোর প্রভুকে ডেকে নিয়ে আয়। যুদ্ধে যে জিতবে সে-ই হবে এ বনের রাজা।

আমিও ‘আচ্ছা’ বলে আপনার কাছে চলে এলাম। এখন প্রভু যা করেন।

খরগোসের কথা শুনে ভাসুরক তো রেগে আগুন! তার রাজ্যে আবার কে এল ভাগ বসাতে? সে বলল: রাজ্য, বন্ধু, সম্পদ আর সম্মান যুদ্ধ করেই অর্জন করতে হয়। তাই চল, দেখি সেই পাষণ্ড কোথায় লুকিয়ে আছে!

খরগোস বলল: প্রভু যথার্থই বলেছেন। কিন্তু সে তো দুর্গের মধ্যে আছে। সেখানে আপনি ঢুকবেন কি করে?

ভাসুরক: হোক দুর্গ, শত্রুকে ছাড়তে নেই। শাস্ত্রে আছে না—শত্রু, ব্যাধি আর আগুন ছোট হোক বড় হোক—এদের সমূলে বিনাশ করতে হয়। যে নিজের ভাল চায় সে উঠতি শত্রুকেও উপেক্ষা করেনা। উঠতি শত্রু আর নতুন ব্যাধি উভয়ই সমান পরে ভয়ানক হয়।

খরগোস: তা ঠিকই বলেছেন, প্রভু। কিন্তু যাওয়ার আগে আরেকবার ভাবুন। ঐ সিংহটা কিন্তু জোয়ান। নিজের এবং শত্রুর শক্তি সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে যুদ্ধে যাওয়া আর জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেয়া একই কথা।

ভাসুরক: তুই পথ দেখা। সে ভাবনা আমার। খিদেয় আমার পেট জ্বলছে!

এরপর খরগোসটি আগে-আগে পথ দেখিয়ে ভাসুরককে নিয়ে গেল সেই কুয়োর কাছে। বলল: প্রভু, ঐ হচ্ছে তার দুর্গ। নিচের দিকে তাকিয়ে দেখুন। ভাসুরক নিচের দিকে তাকিয়ে জলের উপর নিজের ছায়া দেখতে পেল। যেই গর্জন করে উঠল, অমনি তার প্রতিধ্বনি উপরে উঠে এল। ভাসুরক ঘার নাড়ালে তার ছায়াটাও ঘার নাড়ায়। ভাসুরক সত্যিই তার ছায়াকে শত্রু মনে করে যেই ঝাঁপিয়ে পড়ল, অমনি কুয়োর জলে ডুবে অক্কা পেল। খরগোসটি তখন মনের আনন্দে বনে গিয়ে সবাইকে ঘটনাটা বলল। সেই থেকে তারা নিশ্চিন্তে বসবাস করতে লাগল।

তাই বলছিলুম—বুদ্ধির কাছে গায়ের জোর কিছুই নয়। বুদ্ধি দিয়ে আমি ঐ পিঙ্গলক আর সঞ্জীবকের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবই।

করটক এবার আশ্বস্ত হয়ে বলল: তবে তা-ই হোক। তোমার পথ নিষ্কণ্টক হোক।

এই বলে করটক দমনককে আশীর্বাদ করলে দমনকও অগ্রজকে প্রণাম করে রাজসমীপে যাত্রা করল। দমনক দূর থেকে তাকিয়ে দেখল পিঙ্গলক একাই বসে আছে। এই সুযোগে কাছে গিয়ে বলল: পেন্নাম হই, প্ৰভু।

পিঙ্গলক অনেক দিন পরে দমনককে দেখে কিছুটা অনুযোগের সুরে বলল: তুমি এতদিন কোথায় ছিলে, বন্ধু?

দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: হুজুরের তো আর আমাকে প্রয়োজন নেই, তাই আসি না। তবে …!

পিঙ্গলক উদ্বেগের সঙ্গে বলল: তবে কি? থামলে কেন?

দমনক: আপনার বিপদ দেখে আর দূরে থাকতে পারলাম না। কথায় বলে না—যার মঙ্গল চাও, সে না বললেও তার বিপদ দেখে দূরে থেকনা; তার ভালো-মন্দ সম্পর্কে তাকে জানাও।

পিঙ্গলক অতীতের কথা স্মরণ করে সাগ্রহে বলল: তুমি তো আমার বন্ধু, শুধু মন্ত্রীই নও। তা কি বিপদের আশঙ্কা করছ, বল না!

দমনক চারদিকে তাকিয়ে চুপি চুপি বলল: প্রভু, ঐ বেটা সঞ্জীবকের মতি-গতি ভালো ঠেকছে না! বলে কি-না—তোমাদের রাজা পিঙ্গলকের নাড়ি-নক্ষত্র আমার জানা হয়ে গেছে। ও বেটা মনেও দুর্বল, দেহেও দুর্বল। তাই ওকে মেরে আমি নিজেই রাজা হব। তোমাকে বানাব মুখ্যমন্ত্ৰী।

দমনকের কথা শুনে পিঙ্গলকের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। সে বিশ্বাস করতে পারল না যে, সঞ্জীবক এতটা বিশ্বাসঘাতক হতে পারে। সে বলল: আমার বিশ্বাস হয় না যে, সে আমার এতটা অনিষ্ট করতে পারে! আমি যে তাকে ভীষণ ভালোবাসি! সে আমার প্রাণসম, দমনক!

দমনক আরো একটু কাছে গিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল: প্রভু, ভৃত্য হোক আর বন্ধু হোক, রাজলক্ষ্মী কে না চায়? যারা অপারগ কেবল তারাই রাজাকে ঘিরে থাকে।

পিঙ্গলক: তবুও তার প্রতি আমার মন বিরূপ হচ্ছে না। কারণ, দেখ:

কত খুঁত তবু দেহ কার না প্রিয়।
শত দোষ তবু প্রিয় হয় যে প্ৰিয়।।

দমনক: প্রভু, সমস্যা তো এখানেই! রাজার যে সবচেয়ে প্রিয়, রাজত্বে তো ভাগ বসাতে সে-ই সাহস পায়। রাজার স্নেহ পেয়ে প্রথমে সে বিশ্বাস অর্জন করে। এতে রাজা তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে।

এরপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: তাছাড়া প্রভু যে সঞ্জীবকের মধ্যে আহামরি কি দেখেছেন জানিনা। ওর কি গুণ আছে? ও একটা তৃণভোজী। কিন্তু আপনার শত্রুরা সব মাংসভোজী। বিপদে পড়লে ও কি আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে? মাংসভোজীদের হঠানো ওর কাজ নয়। তাই বলছি—যেকোন একটা দোষ খাঁড়া করে ওকে মেরে ফেলুন, নিজের পথ নিষ্কণ্টক করুন।

পিঙ্গলক দ্বিধান্বিত চিত্তে বলল: কিন্তু কাউকে একবার সভায় গুণবান ঘোষণা করে পরে তাকে আসামি নির্ধারণ করে দণ্ড দিলে নিজেরই অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। দেখ, দেবতারা পর্যন্ত তপস্যায় তুষ্ট হয়ে দৈত্যদেরও বর দেয়। আর বিষবৃক্ষ হলেও নিজের হাতে বড় করে তাকে নিজের হাতেই ছেদন করা যায় না। কাউকে একবার অনুগ্রহ করে চিরদিন তা বজায় রাখাই সজ্জনের ধর্ম। তাছাড়া যে তোমার উপকার করে তার নিকট ভালো থাকায় কোনো কৃতিত্ব নেই, বরং যে তোমার অপকার করে, তার নিকট ভালো থাকাই উত্তমের ধর্ম। কজেই সঞ্জীবক যদি আমার ক্ষতিও করে তথাপি আমি তাকে মারতে পারব না।

পিঙ্গলকের কথায় দমনক একটু হতাশ হলেও দমবার পাত্র সে নয়। সে আরো একটু জোর গলায় বলল: প্রভু, এটা কিন্তু রাজধর্ম নয়। বিদ্রোহীকে ক্ষমা করা রাজনীতি—বিরোধী। শাস্ত্র বলে মারি অরি পারি যে কৌশলে। দেখুন, অর্থে সমান, সামর্থ্যে সমান, উদ্যোগী, গোপন খবর জানে এবং রাজত্বে ভাগ বসাতে পারে– এমন ভৃত্যকে যে না মারে, তার হাতে সেই রাজার নিজেরই মৃত্যু হয়। তাছাড়া লক্ষ্য করছি যে, সঞ্জীবকের সঙ্গে মেশার পর থেকেই আপনার স্বভাবেরও পরিবর্তন ঘটেছে। আপনি রাজকার্যে মন দিচ্ছেন না। আমিষ ছেড়ে দিয়েছেন। এতে রাজকর্মচারীরাও অসন্তুষ্ট। তারা সবাই চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ফলে বিপদ আরো বাড়ছে। কারণ ঘনিষ্ঠজনেরা সংসর্গজা আয়ত্তের বাইরে চলে গেলে শত্রুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়। শাস্ত্র বলে দোষগুণা ভবন্তি সঙ্গগুণে দোষ-গুণ দেখা দেয়। যেমন, এক ফোঁটা জল গরম লোহায় পড়লে মুহূর্তে উড়ে যায়, পদ্মপাতায় পড়লে মুক্তোর মতো দেখায়, আর ঝিনুকের মধ্যে পড়লে একেবারেই মুক্তো হয়ে যায়। মহারাজকে আর কি বলব। অসৎসঙ্গে পড়লে মানুষ কি-না করতে পারে? মহামতি ভীষ্মও দুষ্ট দুর্যোধনের পাল্লায় পড়ে গরু চুরি করেছিলেন। তাই পণ্ডিতেরা বলেন:

ঠাঁই দিয়োনা না জেনে স্বভাব আর গুণ।
ছারপোকার দোষে তাই মরল যে উকুন।।

উকুন ও ছারপোকা

এক রাজার ছিল এক চমৎকার বিছানা। সাদা ধবধবে দুটি চাদর বিছানো। তার ফাঁকে থাকত এক উকুন। নাম তার মন্দবিসর্পিণী। ধীরে ধীরে চলে বলে এই নাম। রাজা ঘুমিয়ে পড়লে সে তার রক্ত খেত। সুস্বাদু রাজরক্ত। এভাবে চলছিল তার দিন। মহাসুখে।

একদিন সেখানে এল এক ছারপোকা। নাম তার অগ্নিমুখ। কামড়ে বিষ তো! তাই এই নাম। তাকে দেখে উকুনের মেজাজ গেল বিগড়ে। সে দূর-দূর করতে লাগল। ছারপোকা বলল: বন্ধু, এভাবে তাড়িয়ে দিচ্ছ কেন? বাড়িতে চোর-ডাকাত এলেও তো মানুষ এমন করেনা। তাছাড়া শাস্ত্র বলছে না—অতিথি নারায়ণ! অতিথির সেবা করলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়! আর দেখ, জীবনে রক্ত তো কম খাইনি। কিন্তু কি বলব? সেগুলোর কোনটা টক, কোনটা ঝাল, কোনটা তেতো। হবেনা কেন? খায় তো আজেবাজে খাবার। রাজরক্ত কোনদিন ভাগ্যে জোটেনি! রাজারা কতকিছু খায়! মাছ-মাংস, দধি—মিষ্টি, ছানা-রসগোল্লা! কত কি! তাই তাদের রক্ত না-জানি কত মিষ্টি! একবার যদি খেতে পেতুম, তাহলে জীবনের সাধ মিটে যেত! এ কারণেই তোমার কাছে এলাম। আর দেখ, জিভের স্বাদ কাঙাল আর রাজা—উভয়েরই সমান। এই স্বাদ মেটানোর জন্যই সবাই কাজ করে, দেশ-বিদেশে যায়। তা নাহলে কে আর কাজ করত? কে কার ভৃত্য কিংবা বশীভূত হতো? তাই এই শেষ বয়সে তোমার বাড়ি এসেছি এই শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করতে।

অগ্নিমুখের কথায় উকুনের দয়া হলো। সে সবকিছু ভুলে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করল। তবে সতর্ক করে দিয়ে বলল: বন্ধু, মনে রেখ, রাজামশায় ঘুমিয়ে পড়লে তখন আমি তার রক্ত খাই। তোমার তো আবার ত্বর সয়না। জেগে থাকা অবস্থায় যেন কামড়-টামড় দিওনা। তাহলে দুজনেরই মরণ নিশ্চিত। একবার খেয়ে দেখ রাজরক্ত কি সুস্বাদু!

অগ্নিমুখ মহাখুশি! অবেগ-জড়িত কণ্ঠে বলল: তুমি কিচ্ছু ভেবনা, বন্ধু! আমি বাপ—মায়ের দিব্যি দিয়ে বলছি, তুমি না বলা পর্যন্ত আমি মুখই খুলব না। দেখ।

এভাবে দুজনের কথা হতে-হতে রাজামশায় এসে শুয়ে পড়লেন। ভৃত্য প্রদীপ নিভিয়ে চলে গেল। কিন্তু অগ্নিমুখের তো আর ত্বর সইছে না! দীর্ঘদিন না-খাওয়া। তাই রাজার ঘুমানোর অপেক্ষা করা তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না। এসেই দিল কামড়। রাজা লাফ দিয়ে উঠে ভৃত্যকে ডাকলেন। ভৃত্য আলো জ্বেলে চাদর সরিয়ে দেখে উকুনটি গুটি গুটি হাটছে। অগ্নিমুখ ততক্ষণে খাটের ফাঁকে ঢুকে পড়েছে। ভৃত্য তাই উকুনটাকেই মেরে ফেলল।

দমনক এবার পিঙ্গলকের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল: মহারাজ! তাই বলছিলুম, ভাল করে স্বভাব-চরিত্র না জেনে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। তাতে মহা বিপদের আশঙ্কা থাকে। তাছাড়া স্বজনদের তাড়িয়ে দিয়ে পরজনদের আপন করলে মরণ নিশ্চিত। তাই তো বলা হয়:

পরকে আপন আপনকে পর করে যেই জন।
চণ্ডরব শেয়ালের মতো মরে সেই জন।।

চণ্ডরব শৃগাল

এক বনে বাস করত এক শৃগাল। নাম তার চণ্ডরব। একদিন খিদের জ্বালায় তার মাথা ঘুরছিল। এদিক যায়, ওদিক যায়। কোথাও কিছু মিলছে না! তারপর একসময় ছুটতে ছুটতে চলে যায় শহরে। আর যায় কোথা? শহরের কুকুরগুলো ধেয়ে এল। কামড়ে কামড়ে তার দেহ দিল ছিঁড়েফুঁড়ে। খিদের জ্বালা ভুলে সে এখন প্রাণভয়ে পালাচ্ছে। পথে পড়ল এক ধোপাবাড়ি। ঢুকে পড়ল সেখানে। কিন্তু কুকুরগুলো যে পিছু ছাড়ছে না। তাড়াচ্ছে তো তাড়াচ্ছেই। আর চণ্ডরবও ছুটছে। পথের পাশে ছিল এক প্রকাণ্ড নীলের গামলা। পড়ল গিয়ে তার মধ্যে। সেখান থেকে যখন উঠে এল, তখন নিজেই নিজেকে আর চিনতে পারল না। তার সারা শরীর হয়ে গেছে নীলবর্ণ। কুকুরগুলোও আর তাকে চিনতে পারল না। তাই যে-যার মতো চলে গেল। চণ্ডরবও সুযোগ বুঝে বনে ফিরে গেল।

এদিকে বনের পশু বাঘ-ভাল্লুক, চিতা-নেকড়ে, মায় সিংহ পর্যন্ত, এই অদ্ভুত জন্তু দেখে ভয় পেল। সবাই দিক-বিদিক পালাতে লাগল। ওরা বলতে লাগল:

ধরন-ধারণ বংশ কিংবা মনের কথা গায়ের জোর।
জানি না যার সামনে তার পড়ার কি-বা প্রয়োজন।।

এই বলে সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল। ধূর্ত চণ্ডরব মুহূর্তে ঘটনা আঁচ করতে পারল। বুঝল, তাকে চিনতে না পেরে সবাই ভয়ে পালাচ্ছে। তাই গলার স্বর পরিবর্তন করে সবাইকে ডেকে বলল: তোমরা পালাচ্ছ কেন? স্বয়ং ব্রহ্মা আমায় সৃষ্টি করে পাঠিয়ে দিলেন এই বনে। বললেন—‘এই বনে কোনো রাজা নেই। তুমি গিয়ে ওদের রক্ষা কর।’ তাই আজ থেকে তোমরা সবাই আমার প্রজা। আমার ছত্রছায়ায় তোমরা নিরাপদে থাকবে। তোমাদের সব দায়িত্ব আমার।

চণ্ডরবের কথা শুনে সবাই আশ্বস্ত হলো। তারা ফিরে এসে সেলাম দিয়ে তার চারদিকে ঘিরে দাঁড়াল। কয়েকজন তার জন্য একটি সিংহাসনও বানিয়ে ফেলল। চণ্ডরব সবাইকে দায়িত্ব ভাগ করে দিল। সিংহকে দিল মন্ত্রীর পদ। বাঘকে করল শয্যাপাল। চিতাকে দিল পানের দপ্তর। নেকড়েকে করল দ্বারপাল। কিন্তু তার যে স্বজাতি—শেয়ালের দল

তাদের সঙ্গে বাক্যালাপ পর্যন্ত করল না। বরং গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। এভাবে চণ্ডরবের দিন মহাসুখেই কাটছিল। বাঘ-সিংহ পশু-পাখি মেরে তার কাছে নিয়ে আসে। সে সবাইকে ভাগ করে দেয়। এ ব্যবস্থায় সবাই খুশি। তাই তাকে সবাই খুব সমীহ করে।

একদিন চণ্ডরব পারিষদবর্গ নিয়ে সিংহাসনে বসে আছে। এমনি সময় দূরবনে শেয়াল ডেকে উঠল। আজন্ম অভ্যাসবশত সেও ‘হুক্কা হুয়া’ করে ডেকে উঠল। আর যায় কোথা! সবাই বুঝতে পারল, এ যে শেয়াল! তখন নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে বাঘ—সিংহ সবাই কিছুক্ষণ লজ্জায় মাথা নত করে রইল। তারপর সিংহ হুঙ্কার দিয়ে বলল: ধর ওকে! ও আমাদের ঠকিয়েছে!

অবস্থা বেগতিক দেখে চণ্ডরব পালাতে লাগল। কিন্তু যাবে কোথায়? চারদিক থেকে সবাই এসে তাকে ধরে ফেলল। কামড়ে-আঁচড়ে তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে ফেলল। তাই বলছিলুম, মহারাজ! নিজের লোককে অবহেলা করা ভালো নয়।

দমনকের মুখে চণ্ডরবের কাহিনী শুনে পিঙ্গলক কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর বলল : দমনক, সঞ্জীবক যে আমার অনিষ্ট করতে চায় তার প্রমাণ কি?

দমনক: প্রভু, সে প্রতিজ্ঞা করেছে কাল সকালে আপনাকে মারবে। এটা যদি তার মনের কথা হয় তাহলে তার লক্ষণ তার শরীরে দেখা যাবে। দেখবেন তার চোখ লাল। ঠোঁট কাঁপছে। নির্ধারিত আসনে না বসে সুবিধামতো জায়গায় বসেছে। আপনার দিকে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এসব দেখে যা ভালো মনে হয় করবেন।

এই বলে দমনক বিদায় নিল এবং অন্যপথে সঞ্জীবকের বাড়ি গেল। মুখ তার বিষণ্ণ। চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্ন। তাকে দেখেই সঞ্জীবক এগিয়ে এসে সোদ্বেগে বলল: কি হয়েছে, বন্ধু? তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? অনেক দিন এদিকে আস না! ব্যাপার কি, বলত? আমার বাড়িতে তুমি এসেছ—এ যে আমার কত সৌভাগ্য! কথায় বলে না:

পৃথিবীতে সে-ই ধন্য তারই হয় জয়।
যার বাড়িতে সজ্জনেরা আপনি হাজির হয়।।

দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: চাকর আবার সজ্জন হয় না-কি? তাও আবার রাজার চাকর! সর্বদা আতঙ্কে থাকতে হয়—কখন প্ৰাণটা যায়!

সঞ্জীবক: তুমি ত মন্ত্রী, চাকর নও। তবে?

দমনক: ওই হলো! রাজার কাছে সবাই সমান। দেখ— চাকরের কি দেহ-মন কোথাও স্বাধীনতা আছে? তার ইচ্ছায় কিছু হয়? মহাভারত বলেছে না রোগী, গরিব, মূর্খ, প্রবাসী আর সেবক এই পাঁচজন হচ্ছে জীয়ন্তে মরা! এরা কুকুরের চেয়েও অধম। কুকুর তবু স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ায়। চাকর তাও পারে না। দেখ, মুনি আর চাকর উভয়ের মধ্যে বহু বিষয়ে মিল আছে মাটিতে শোওয়া, রোগা, ব্রহ্মচর্য, কম খাওয়া ইত্যাদি, কিন্তু অমিল হলো—প্রথমজন ধার্মিক আর দ্বিতীয়জন হতভাগা-পাপী। পেটের দায়ে চাকর শীত-গ্রীষ্ম আরো কত কি যে সহ্য করে, এর কণাভাগও যদি ধর্মের জন্য সইতো, তাহলে নিশ্চয় তার স্বর্গলাভ হতো।

এসব বলে দমনক বিষণ্ণ বদনে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। সঞ্জীবক কাছে এসে তার গায়ে হাত দিয়ে সাদরে বলল: বন্ধু, আর ভনিতা না করে বলো কি হয়েছে।

দমনক সঞ্জীবকের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল: বন্ধু, মন্ত্রী হয়ে রাজার মন্ত্রণা ফাঁস করি কি করে? তাতে যে রাজারও ক্ষতি আর আমারও নরক প্রাপ্তি হবে! কিছুক্ষণ নীরব থেকে দৃঢ়কণ্ঠে আবার বলল: তা হোক, আমি বলবই। কারণ তুমি আমারই কথায় বিশ্বাস করে রাজবাড়িতে ঢুকেছিলে। এখন সেই কারণে যদি তোমার প্রাণ যায়, তাহলে আমি যে মহাপাতকে নিমজ্জিত হব! এ কথা আমার নয়, স্বয়ং মনুর সঞ্জীবকের আর ধৈর্য থাকছে না। সে দমনককে ধাক্কা মেরে বলল: আসল কথাটা কি তুমি বলবে?

দমনক গম্ভীর কণ্ঠে বলল: তোমার সম্পর্কে পিঙ্গলকের মতলব ভালো নয়। সে বলল কাল সকালে তোমাকে হত্যা করে সবাইকে ভোজ দেবে! আমি বললাম, কি সাংঘাতিক কথা, মহারাজ! ব্রহ্মহত্যা করলে তার প্রায়শ্চিত্ত আছে, কিন্তু মিত্রদ্রোহ! শাস্ত্রেওতো এর বিধান নেই!

বিস্ময় আর উদ্বেগের সঙ্গে সঞ্জীবক বলল: তা সে কি বলল?

দমনক: সে বলল রাখ তোমার মিত্র! ও হচ্ছে ঘাসখেকো, আর আমরা মাংসখেকো! সম্পূর্ণ বিপরীত। ও আর আমরা হলাম পরস্পর জন্মশত্রু। শত্রুকে কখনও বুদ্দিমানেরা উপেক্ষা করে না। দেখ, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি কন্যা দিয়ে হলেও শত্রুকে অর্থাৎ জামাইকে হত্যা করে। অন্য উপায় না থাকলে এমন হত্যায় দোষ নেই। তাছাড়া—

যুদ্ধে নেমে ক্ষত্রিয় কি বাছে কৃত্যাকৃত্য।
ঘুমের ঘোরে ধৃষ্টদ্যুম্ন মারল দ্রোণপুত্র।।

তাই সাম, দান, ভেদ, দণ্ড–যেকোন উপায়েই হোক ওকে মারতে হবে।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: বন্ধু, এই সাংঘাতিক পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে আমি আর থাকতে পারলাম না। ছুটে এলাম তোমার কাছে। এখন তুমি যা ভালো মনে কর, কর। পিঙ্গলকের মতো এমন ভয়ঙ্কর রাজার কাছে আমার বোধ হয় থাকা হবে না!

দমনকের কথা শুনে সঞ্জীবকের মাথায় যেন বিনামেঘে বজ্রপাত হলো। সে বিশ্বাসই করতে পারল না যে, পিঙ্গলক তার সম্পর্কে এমন সাংঘাতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। ক্রোধে তার চোখ দুটি জ্বলতে লাগল! ক্ষুব্ধকণ্ঠে সে বলল: কি ভুলই না আমি করেছি এর সঙ্গে ভাব করে! পণ্ডিতেরা ঠিকই বলেছেন:

দুর্জনের হাতে পড়ে নারী
কৃপণের হাতে টাকা-কড়ি।
মরুতে মেঘ ঢালে জল
রাজার আপন কে হয় বল॥

ওর পাল্লায় পড়ে আমি শাস্ত্রের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম যে, সমান অর্থ আর বংশ হলে তবেই বন্ধুত্ব হয়, সবলে-দুর্বলে কখনও নয়। তাছাড়া স্বজাতির সঙ্গেই স্বজাতির বন্ধুত্ব হয়, বিজাতীয়ের সঙ্গে নয়। তাইতো হরিণের সঙ্গে হরিণের, গরুর সঙ্গে গরুর, ঘোড়ার সঙ্গে ঘোড়ার, মূর্খের সঙ্গে মূর্খের এবং সজ্জনের সঙ্গে সজ্জনেরই বন্ধুত্ব হয়। যাদের স্বভাব-চরিত্র আর নেশা এক—কেবল তাদের বন্ধুত্বই স্থায়ী হয়।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে সঞ্জীবক আবার বলল: এখন আমি গিয়ে তাকে প্রসন্ন করার চেষ্টা করলেও সে প্রসন্ন হবে না। কারণ যার রাগের কারণ থাকে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করা যায়, কিন্তু অকারণে যে রাগ করে তাকে শান্ত করার উপায় কি? দেখ ভাই, রাজা আর সমুদ্র উভয়ই সমান। এদের মতিগতি বোঝা ভার। তুমি জান দিয়ে রাজার উপকার করবে, অথচ কেউ তোমার বিরুদ্ধে লাগালে রাজা আগের কথা ভুলে যায়। তাই রাজার চাকরি করা খুবই কঠিন ব্যাপার! তাছাড়া, আমি একটা ব্যাপার বুঝেছি যে, রাজসভায় কেউ কেউ আমাকে সহ্য করতে পারছে না। সতীন যেমন সতীনের ওপর স্বামীর অতিরিক্ত ভালোবাসা সইতে পারে না, তেমনি আমার প্রতি রাজার অতিরিক্ত স্নেহও কেউ কেউ সহ্য করতে পারছে না। আবার এও সত্যি যে, গুণীরা কাছে থাকলে নির্গুণরা সমাদর পায় না, যেমন সূর্যোদয়ে প্রদীপ ম্লান হয়ে যায়। তাই নির্দোষ হয়েও আজ আমার এই দশা!

দমনক: ঠিক বলেছ, বন্ধু! আমারও তাই ধারণা। তা তুমি রাজাকে গিয়ে সব বল। দুর্জনরা যতই বলুক, তোমার সুবচনে নিশ্চয়ই সে প্রসন্ন হবে।

সঞ্জীবক: তোমার কথা ঠিক নয়। দুর্জনরা যতই ক্ষুদ্র হোক তাদের মধ্যে বাস করা যায় না। তারা যেকোন উপায়ে আমাকে মারবেই। দেখ—

দুর্জনেরা করে—যাহা ভাবে মনে মন
না পারিলে একা, করে মিলে বহুজন।
সরল প্রাণী উষ্ট্র—তাহার দোষ না-ই বা থাক
মারল তারে মিলে চিতা শেয়াল আর কাক।।

দমনক: কিভাবে?

সঞ্জীবক: বলছি, শোন…

উট শেয়াল চিতা কাক

এক বনে ছিল এক সিংহ। নাম মদোকট। তার অনুচরেরা হলো শেয়াল, চিতা আর কাক। একদিন বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তারা এক অদ্ভুত জন্তু দেখতে পেল। সিংহ বলল: বাঃ! এমন জন্তু তো কখনো দেখিনি। খোঁজ নাও তো ও কে? কোথা থেকেই বা এল।

কাক উড়ে গিয়ে সব জেনে এসে বলল: হুজুর, ও হচ্ছে উট। নাম ক্ৰথনক। বণিকদল থেকে ছিটকে পড়ে এখন পথভ্রষ্ট। তবে খুব শান্ত। আপনি চাইলে ভোজে লাগানো যায়।

সিংহ ধমক দিয়ে বলল: খবরদার! ও এখন আমাদের অতিথি। যেভাবেই হোক আমাদের বাড়িতে এসে পড়েছে। তাই ওকে বধ করা অন্যায়। শাস্ত্র বলছে না—শত্রুও যদি নির্ভয়ে বাড়িতে আসে তাহলে তাকে হত্যা করলে শত ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ হয়। তাই ওকে অভয় দিয়ে আমার কাছে নিয়ে এস।

সিংহের কথামতো সবাই মিলে এথনককে নিয়ে এল। সেও সিংহকে প্রণাম করে বসল। তারপর সিংহ জানতে চাইলে সে সব ঘটনা খুলে বলল। বণিকদলের সঙ্গে কোথায় যাচ্ছিল। কিভাবে সে ছিটকে পড়ল। ইত্যাদি। সব শুনে সিংহের মায়া হলো। সে বলল: আজ থেকে তুমি আমাদের বন্ধু। তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি নির্ভয়ে এই বনে চরবে, আর পান্নার মতো কচি ঘাস খাবে। কি হবে গ্রামে গিয়ে আবার ভার বয়ে?

ক্রথনক রাজি হয়ে গেল। সেই থেকে তাদের সঙ্গে থাকে, খায়। এভাবে ছাড়াঘাস খেয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সে নাদুস-নুদুস হয়ে ওঠে।

একদিন এক প্রকাণ্ড বুনো হাতির সঙ্গে মদোৎকটের লড়াই বাঁধে। হাতির মুষলের মতো দাঁতের আঘাতে মদোৎকটের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। প্রাণটা কোনোরকমে বেঁচে যায়। কিন্তু শিকার ধরার ক্ষমতা আর থাকে না। তাই সবাই এক প্রকার উপোস করে দিন কাটাতে থাকে। শেষে একদিন মদোৎকট বলল: আমার সঙ্গে-সঙ্গে তোরাও যে না খেয়ে মরতে বসেছিস। যা-না, একটা জানোয়ার-টানোয়ার ধরে নিয়ে আয়। ওটাকে মেরে তোদের খাওয়ার ব্যবস্থা করি।

সিংহের কথায় সবাই বেরিয়ে পড়ে শিকারের সন্ধানে। কিন্তু কোথাও কিছু পায় না। তখন শেয়াল বলে: দেখ, অযথা ঘুরে লাভ কি? শিকার তো আমাদের সঙ্গেই আছে।

কাক বলল: কে?

শেয়াল: কেন, ক্ৰথনক।

চিতা: কিন্তু সে তো হুজুরের প্রিয়ভাজন। তার গায়ে হাত তুলবে কে?

শেয়াল: আরে, সে ব্যবস্থা আমি করছি।

কাক ও চিতা: তবে তাই হোক।

এরপর শেয়াল গেল সিংহের কাছে। বলল: মহারাজ, বনে কিছুই পাওয়া গেল না। এদিকে খিদেয় যে সবার প্রাণ যায়। আপনারও তো পথ্য দরকার। তাই বলছিলুম, আজকের ভোজটা ক্ৰথনককে দিয়ে হয় না?

মদোকট গর্জে উঠল। রক্তচক্ষু হয়ে বলল: ধিক পাপিষ্ঠ! আর একবার একথা বললে তোকেই মেরে ফেলব। বলেছি না, কাউকে অভয় দিয়ে তাকে আর মারা যায় না। শাস্ত্রে আছে না:

অন্নদান গোদান কিংবা ভূদান।
সবার সেরা দান হলো অভয়দান।।

কিন্তু ধূর্ত শেয়াল দমবার পাত্র নয়। সে জোড়হাতে বলল: হুজুর, মানলুম আপনার কথা। কিন্তু কেউ যদি হুজুরকে ভক্তি করে স্বেচ্ছায় আত্মদান করে, তাহলে তো দোষ নেই। তাই ও যদি নিজে থেকে ওকে মারতে বলে, তাহলে আর ওকে মারতে পাপ কেথায়? তাছাড়া আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। কিন্তু আপনাকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আপনার কিছু হলে আমরা যাব কোথায়? কথায় বলে না—বংশের যিনি প্রধান, তাঁকে যে-করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে হবে, কারণ তিনি গেলে তো সবই গেল। দেখুন, ঢাকার নাভিটি (কেন্দ্র) ভাঙলে শলাগুলি কি আর ভার বইতে পারে?

শেয়ালের যুক্তির কাছে এবার মদোৎকট হেরে গেল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল: তা তোরা যা ভালো বুঝিস কর! আমি আর কি বলব।

প্রভুর সম্মতি পেয়ে ধূর্ত শেয়াল এক শ্বাসে ছুটে গেল কাক আর চিতার কাছে। বলল: অনেক কষ্টে প্রভুর মন পেয়েছি। এবার খুব সাবধানে এথনককে ফাঁসাতে হবে। এই বলে সমস্ত পরিকল্পনা খুলে বলে তিনজন গেল ক্রথনকের কাছে। শেয়াল বলল: প্রভুর অবস্থা খুব খারাপ। এক্ষুণি আমাদের তাঁর কাছে যাওয়া উচিত।

শেয়ালের কথা শুনে তারা চারজনই সিংহের কাছে গেল। শেয়াল কাঁদ-কাঁদ স্বরে বলল: কদিন যাবৎ প্রভুর উপবাস যাচ্ছে। তার ওপর শরীর অসুস্থ। আজও কোথাও কিছু পাওয়া গেল না। এতদিন হুজুরের নিমক খেয়েছি। আজ যেভাবেই হোক তাঁর প্রাণ রক্ষা করতে হবে। নিজের জীবন দিয়ে হলেও।

একথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে কাক সিংহকে প্রণাম করে জোড়হাতে বলল: প্রভু, আপনার অনেক অন্ন খেয়েছি। আজ তার কিছুটা হলেও শোধ করার সুযোগ দিন। আমাকে দিয়েই আপনার আজকের আহার হোক। তাতে হুজুরের খিদে মিটবে। আমারও স্বর্গলাভ হবে। শাস্ত্রে আছে না—

প্রভুর জন্য নিজেরে দান করে যেই ভৃত্য।
পুণ্যবলে স্বর্গলাভ হবে যে তার নিত্য।।

একথা শোনার সঙ্গে-সঙ্গে শেয়াল লাফ দিয়ে সামনে এসে বলল: অনেক হয়েছে হুজুরের ঋণ শোধ করা। এবার সরতো। তোমার মতো দশ-বিশটা কাক খেলে হুজুরের কি হবে? কথায় বলে না—কাকের মাংস আর কুকুরের এঁটো এ খাওয়াও যা, না খাওয়াও তা। আর ইহলোকে পরলোকে সবাই তোমাকে চেনে। তাই আজকের সুযোগটা, ভাই, আমাকেই দাও।

শেয়ালের কথা শুনে কাক সরে গেল এবং শেয়াল কাছে এসে সিংহের কাছে হাত জোড় করে নিজেকে সমর্পণ করল। এমন সময় চিতা কাছে এগিয়ে এসে শেয়ালকে বলল: ভালোই বলেছ, ভাই। কাকের চেয়ে তুমিই বা আর কত বড়? তোমায় খেলে হুজুরের পেট আর কতটা ভরবে? তাছাড়া কথায় বলে না—কুলীনকুলে জন্ম যার, প্রাণ গেলেও সে অখাদ্য খায় না। তাই আজকের সুযোগটা আমায় দাও। তুমি অনেক বুদ্ধিমান। তুমি হুজুরের অনেক উপকার করেছ। সেই পুণ্যে তুমি এমনিতেই স্বর্গে যাবে। হুজুরের সেবার দ্বারা আমায় একটু পুণ্য অর্জন করতে দাও, ভাই।

কাক, শেয়াল আর চিতার এসব আচরণ দেখে সরলপ্রাণ ক্রথনক ভাবল—এদের কি প্রভুভক্তি! নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য কি আকুলতা! ধন্য এদের জীবন! আর প্রভুও এদের মারছেন না। তাই আমি-ই বা পিছিয়ে থাকব কেন? এই ভেবে সবাইকে সরিয়ে দিয়ে সে বলল: তোমরা হুজুরের স্বজাতি। কারো আছে নখ, কারো বা ঠোঁট। শাস্ত্রে আছে—স্বজাতিবধে মহাপাপ! তাছাড়া তোমাদের তিনজনকে খেলেও তো হুজুরের খিদে মিটবে না। আর আমিও তার হাছে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ। দলভ্রষ্ট হয়ে একা একা এই বনে ঘুরছিলাম। হুজুর আশ্রয় দিয়েছেন। সুতরাং এই সুযোগে তার ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করি। শাস্ত্র বলছে:

প্রভুর তরে জীবন দিয়ে সেবক যাহা লভে।
যোগী কিংবা যাজ্ঞিক তা পায় না কভু ভবে।।

তাই এই সুযোগটা আমি হাতছাড়া করছি না।

এই বলে ক্রথনক যেই সিংহের কাছে নিজেকে উৎসর্গ করল, অমনি শেয়াল আর চিতা মিলে তার পেট চিরে নাড়ি-ভুঁড়ি বের করে ফেলল। তারপর সবাই মিলে পরম তৃপ্তি ভরে আহার করল।

সঞ্জীবক কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল: তাই, ভাই দমনক, আমি আর ওখানে যাচ্ছি না। কারণ আমি বুঝে ফেলেছি—তার চারপাশে এখন অসৎ লোকের ভিড়। আর অমাত্যরা অসৎ হলে জনগণ সেই রাজার অনুরক্ত হয় না, কিংবা রাজাও জনগণের মঙ্গল চিন্তা করে না। দেখ—

শকুন হলেও সেব্য রাজা, হংস যদি হয় সভাজন। হংস হলেও ত্যাজ্য রাজা, শকুন যদি হয় সভাজন। তাই আমি নিশ্চিত যে, প্রভুর পাশে কেউ একজন দুর্জন আছে, যে আমার বিরুদ্ধে তার কানে লাগিয়েছে। সাপের সঙ্গে বরং বাস করা যায়, কিন্তু দুর্জনের সঙ্গে নয়। কারণ সাপ শুধু তাকেই ছোবল মারে, যে তাকে আঘাত করে। কিন্তু দুর্জন কান ধরে একজনের, মারে আরেক জনকে। তারপরেও যেহেতু তুমি আমার বন্ধু, তাই তুমিই বলো এখন আমার কি করা উচিত।

দমনক একটু ভেবে বলল: আমারও মনে হয় এমন কু-প্রভুর সেবা না করাই ভালো। কথায় বলে না—গুরুর যদি দেমাকে ঠিক পথে পা না পড়ে, তিনি যদি কর্তব্যাকর্তব্য ভুলে যান, তাহলে তাঁকেও বর্জন করতে হবে।

সঞ্জীবক: তা বটে, কিন্তু পিঙ্গলককে না বলে যাই কি করে? তাতেও তো বিপদ! দেখ, শক্তিমান শত্রুর হাত অনেক লম্বা। তার কাছ থেকে দূরে গেলেই বিপদ যায় না। দূর থেকেও সে শত্রুকে টেনে আনে। তাই তার মোকাবেলা না করে আমার উপায় নেই। তাছাড়া বীরের পরিচয় যুদ্ধক্ষেত্রে। এতে মরলেও যশ, বাঁচলেও যশ। আর হাজার তীর্থসেবা, তপস্যা কিংবা যাগ-যজ্ঞ করায় যে ফল লাভ হয় পরকালে, যুদ্ধে জয়ী কিংবা নিহত বীরের সে ফল লাভ হয় তৎক্ষণাৎ। তাই পিঙ্গলকের সঙ্গে না যুঝে আমি যাব না।

সঞ্জীবকের এরূপ মনোভাব দেখে দমনক একটু ভয়ই পেয়ে গেল। সে ভাবল, কি জানি, চোখা-চোখা শিং দিয়ে এ আবার প্রভুকে মেরেই ফেলে কি-না! তাই একে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে দমনক বলল: তাতো বুঝলুম, বন্ধু! কিন্তু চাকরে—মনিবে কি লড়াই শোভনীয়? তাছাড়া শত্রু বলবান হলে দুর্বলের উচিত লুকিয়ে আত্মরক্ষা করা। শত্রুর বল না জেনে যুদ্ধে গেলে মরণ নিশ্চিত, যেমন মরেছিল বোকা টিট্টিভ—সমুদ্রের হাতে।

সঞ্জীবক: কি রকম?

দমনক: শোন, বলছি…

সমুদ্র ও টিটিভ

সমুদ্রের ধারে থাকত এক টিট্টিভ দম্পতি। এক বসন্তে টিট্টিভী গর্ভধারণ করল। ডিম পাড়ার সময় হলে স্বামীকে বলল: একটা নিরাপদ জায়গার সন্ধান কর।

টিট্টিভ বলল: কেন, এ জায়গাটা তো চমৎকার! এখানেই ডিম পাড়ো না।

টিট্টিভী: মোটেই না। পূর্ণিমায় সমুদ্রের মাতাল ঢেউ হাতি-ঘোরা পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যায়; আমরা তো কোন ছাড়!

টিট্টিভ সদম্ভে বলল: সে কি গো! সমুদ্রের এত স্পর্ধা যে আমার বাচ্চাদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! তুমি নিশ্চিন্তে ডিম পাড়ো তো। আমি দেখব সমুদ্রের কত সাহস! তাছাড়া—

মরিবার ভয়ে যে ছাড়ে নিজ ঠাঁই।
এ জগতে বাঁচিবার তার আশা নাই।।

টিট্টিভের এই আস্ফালন দেখে সমুদ্রের যেমন হাসি পেল, তেমনি আবার ক্ষোভও হলো। সে মনে মনে বলল: ক্ষুদে পাখিটার সাহস কত! আমাকে অবজ্ঞা! সময় হোক, দেখাব মজা!

এই ভেবে সে সময়ের অপেক্ষা করতে লাগল।

.এদিকে টিট্টিভী এক জোড়া ডিম পাড়ল। দিনের পর দিন তা দেয়ায় ডিম কেবল ফুটি ফুটি করছে। এমন সময় একদিন পূর্ণিমায় হাত বাড়িয়ে সমুদ্র দুটি ডিমই নিয়ে নিল। টিট্টিভী বিলাপ করতে করতে টিট্টিভকে বলল: মুখ্যু কোথাকার! এত করে বললুম সমুদ্রের সঙ্গে আড়ি দিয়ো না, পারবে না; তার চেয়ে চলো দূরে কোথাও চলে যাই! তা শুনলে না আমার কথা! হলো তো এখন! শত্রুর ক্ষমতা না যেনে যে লড়াই করে, তার এমনই দশা হয়! বন্ধুর পরামর্শ তার কোনো কাজে লাগে না। কথায় বলে না:

হিতৈষী জনের কথা নাহি শোনে যে।
বোকা কচ্ছপের মতো সত্য মরে সে।।

টিট্টিভ: কি রকম?

টিট্টিভী: শোনো …

হাঁস ও কচ্ছপ

এক জলাশয়ে থাকত এক কচ্ছপ। নাম তার কম্বুগ্রীব। শাঁখের মতো গলা বলে এই নাম।

সেখানে আরও থাকত দুটি হাঁস—সঙ্কট আর বিকট। তিনজনে ভীষণ ভাব। কত গল্প করে তারা—রাজা-রানি-রাজপুত্র-রাজকন্যা, আরও কত কি। সন্ধ্যা হলে আবার যার—যার ঘরে ফিরে যায়। এভাবেই সুখে কাটছিল তাদের দিন।

একবার ভীষণ অনাবৃষ্টি দেখা দিল। মাঠ-ঘাট ফেটে চৌচির! চারদিক খাঁ-খাঁ করছে! পশু-পাখির জিহ্বা ভেতরে যাচ্ছে না! জলাশয়ের জলও গেছে শুকিয়ে। সঙ্কট আর বিকট কচ্ছপকে বলল: বন্ধু, তোমার কথা ভেবে তো আমরা অস্থির! এখন কি করি, বল তো?

কচ্ছপ কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল: জল বিনে তো আমার গতি নেই, তাই উপায় একটা ভাব। কথায় বলে না:

সঙ্কটে যে ধৈর্য ধরে বুদ্ধি দিয়ে ভাবে।
বিপদে সে বাঁচার মতো উপায় খুঁজে পাবে।।

দেখ— সমুদ্রে জাহাজ ডুবলে সাহসীরা বাঁচার চেষ্টা করে, কিন্তু ভীতরা? সঙ্গেই সঙ্গেই ডুবে যায়। আর চাণক্য বলেছেন না:

সে-ই বন্ধু যে পাশে থাকে সুদিনে দুর্দিনে।
দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে কিংবা রাজদ্বারে শ্মশানে।।

তোমরা তো আমার পরম বন্ধু। তাই উপায় একটা নিশ্চয়ই ভাববে।

কচ্ছপের কথা শুনে হংসদ্বয় কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল: বন্ধু, ঠিক বলেছ। উপায় একটা হবেই।

একথা বলে তারা বাসায় ফিরে গেল এবং পরের দিন এসে বলল: আর চিন্তা নেই। ঐ দূরে বিশাল এক জলাশয় দেখে এসেছি। হাজার বছরও বৃষ্টি না হলে তলা জাগবে না। ভাবছি, তোমাকে ওখানেই নিয়ে যাব। ওটাই হবে আমাদের নতুন আবাস। কথামতো কাজ এগিয়ে চলল। হাঁসদুটি একটি শক্ত কাঠ এনে কচ্ছপকে বলল: বন্ধু, তুমি এর মাঝখানটা শক্ত করে কামড়ে ধরবে, আর আমরা দু-দিক ধরে তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাব। তবে সাবধান! কথা বললে কিন্তু মহাবিপদ! পড়ে গিয়ে মারা যাবে! কচ্ছপ বলল: তা-ই হবে।

এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন বন্ধু উড়ে চলল। অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছে। নতুন ঠিকানার প্রায় কাছাকাছি। তারা তখন এক নগরের উপর দিয়ে যাচ্ছিল। নগরবাসীরা এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে হৈ-চৈ করে উঠল। তা শুনে কচ্ছপ যেই বলতে যাচ্ছিল—কিসের গোলমাল অমনি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে নগরবাসীরা দৌড়ে এসে ধরে নিয়ে কেটে খেয়ে ফেলল।

টিট্টিভী বলল: তাই বলছিলুম— হিতৈষীর কথা না শুনলে এভাবেই মরতে হয়। তাছাড়া:

স্ববুদ্ধি ক্ষণবুদ্ধি দৈববুদ্ধি আর।
আদি দুই বাঁচে, মরে শেষে নাম যার।।

টিট্টিভ বলল: সে আবার কি?

টিট্টিভী বলল: শোনো তাহলে…

স্ববুদ্ধি ক্ষণবুদ্ধি আর দৈববুদ্ধি

এক জলাশয়ে থাকত তিনটি মাছ স্ববুদ্ধি, ক্ষণবুদ্ধি আর দৈবুদ্ধি। এরা তিন দলপতি। প্রথমজন খুব বুদ্ধিমান। সব সময় নিজের বুদ্ধিতে চলে। দ্বিতীয়জন মুহূর্তের মধ্যে কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারে। আর তৃতীয়জন দৈবে বিশ্বাসী। অদৃষ্টে যা আছে তা-ই হবে—এই ছিল তার ধারণা।

একদিন তিন জেলে যাচ্ছিল জলাশয়ের পার দিয়ে। তারা বলাবলি করছিল এখানে প্রচুর মাছ আছে। অনেকদিন ধরা হয়না। কাল সকালে আসব। বজ্রপাতের মতো একথা শুনে স্ববুদ্ধি সকলকে ডেকে বলল: ভাইসব, তোমরা শুনলে তো! আমাদের যে মহাবিপদ উপস্থিত! এখন করণীয় ভাবতে হবে। আমার মতে আজ রাতেই আমাদের অন্য কোথাও চলে যাওয়া উচিত। কথায় বলে না—শত্রু প্রবল হলে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া দুর্বলের আর উপায় থাকে না। তাছাড়া—অন্য আশ্রয় থাকলে বুদ্ধিমান ব্যক্তি দেশ কিংবা কুলের কথা না ভেবে দ্রুত সরে পড়ে।

ক্ষণবুদ্ধি তৎক্ষণাৎ বলল: যথার্থ কথা। আমারও তা-ই মত। চলো সবাই অন্য কোথাও চলে যাই। দেখ— ফন্দিবাজ, নপুংসক, কাক, হরিণ আর কাপুরুষ—এরাই দেশে বসে মরে, অথচ ভয়ে বিদেশে যাবে না। কিন্তু সর্বত্র যার যাওয়ার যোগ্যতা আছে, সে কখনও ‘দেশ দেশ’ করে মরে না।

একথা শুনে দৈববুদ্ধি অট্ট হেসে বলল: কি বলছ তোমরা? শুধু ওদের মুখের কথায় বাপ-পিতামো’র এই আবাস ছেড়ে পালাব? যদি আয়ু শেষ হয় তো অন্য কোথাও গেলেও মরণ হবে। তাছাড়া— রাখে কেষ্ট মারে কে? মারে কেষ্ট রাখে কে? তাই, তোমরা গেলে যাও, আমি যাচ্ছি না।

অগত্যা স্ববুদ্ধি আর ক্ষণবুদ্ধি তাদের দলবল নিয়ে সেই রাতেই অন্য জলাশয়ে চলে গেল। আর পরের দিন সকালে জেলেদের হাতে দৈববুদ্ধিসহ তার দলবল সব মারা পড়ল। তাই বলছিলুম— বুদ্ধি খাটিয়ে চললে তার বিপদ হয় না।

টিট্টিভীর কথা শুনে টিট্টিভ উদ্ধত স্বরে বলল: তুমি আমাকে দৈববুদ্ধি ভাবছ? তবে দেখ আমার বুদ্ধির জোর। ঐ পাজি সমুদ্রটাকে আমি এক চুমুকে শুষে ফেলছি।

টিট্টিভী তাচ্ছিল্যের সুরে বলল: তুমি সমুদ্রের সঙ্গে লড়বে? তাহলেই হয়েছে! কেন শুধু—শুধু ওর সঙ্গে লাগতে যাচ্ছ? শোনো নি—যার মুরোদ নেই তার নিজের রাগে নিজেরই ক্ষতি হয়? মাটির তাওয়া যতই গরম হয় ততই তার নিজের গা পোড়ে। আরও শোনো:

বল না জেনে শত্রুকে যে মারতে যায়।
মরে—যেমন অগ্নিপানে পতঙ্গ ধায়।।

টিট্টিভ গর্বের সঙ্গে বলল: তুমি আমাকে এত তুচ্ছ জ্ঞান করছ কেন? দেখ— যাদের মধ্যে উৎসাহ আর তেজ আছে, তারা ছোট হলেও বড়কে আক্রমণ করতে ভয় পায় না। শুধু বয়স আর দেহ হলেই হয় না—বুদ্ধি, কৌশল আর সাহস থাকা চাই। আকৃতিতে হাতি অনেক বড়, কিন্তু সিংহ ছোট হয়েও তাকে কুপোকাত করে। আর পুরুষ যতক্ষণ শত্রুর সম্মুখীন না হয়, ততক্ষণ তার পৌরুষের পরিচয় পাওয়া যায় না। অতএব, তুমি দেখো—আমি আমার এই ক্ষুদ্র ঠোঁট দিয়ে তোমার ঐ সমুদ্রকে কিভাবে শুষে ফেলি। টিট্টিভী দেখল—স্বামী তার সমুদ্রের সঙ্গে লড়তে যাবেই। তাই সাবধান করে দিয়ে বলল: যাবেই যখন, টোনা-টুনি সবাইকে সঙ্গে নাও। কেননা—

তুচ্ছরা সব এক হলে শক্তি হয় দুর্জয়।
দড়িতে তাই অতবড় হাতি-ঘোড়া বদ্ধ হয়।।

তাই তো—

চড়ুই পাখি কাঠঠোকরা মাছি আর ব্যাঙ।
জোট বেঁধে নিল ঐ গজরাজের প্রাণ॥

টিট্টিভ: সে কি আবার?

টিট্টিভী: বলছি, শোনো…

চড়ুই কাঠঠোকরা মাছি ব্যাঙ ও হাতি

এক বনে এক গাছের ডালে বাস করত এক চড়ুই দম্পতি। চড়ুইনী সম্প্রতি ডিম পেড়েছে। একদিন দুপুর বেলা প্রখর রোদে অতিষ্ঠ হয়ে ঐ গাছের নিচে আশ্রয় নিল এক মস্ত হাতি। গরমে সে পাগল প্রায়। হঠাৎ শুঁড় দিয়ে মটাৎ করে ভেঙ্গে ফেলল সেই ডালটি, যে ডালে ছিল চড়ুইর বাসা। আর যায় কোথা? ডিমগুলো ফেটে চৌচির! শোকে চড়ুইনী বিলাপ করতে লাগল।

কাছেই থাকত তাদের বন্ধু কাঠঠোকরা। বন্ধুর বিলাপ শুনে ছুটে এল। সব শুনে সে বলল: দেখ, যা হারিয়ে গেছে, মরে গেছে কিংবা ছেড়ে গেছে—তার জন্য শোক করে মূর্খরা। সংসারে কারও জন্য শোক করা মানে দ্বিতীয়বার কষ্ট পাওয়া। তাই পণ্ডিতেরা কখনও শোক করেন না।

চড়ুইনী বলল: তা তো বুঝলুম, কিন্তু ঐ বজ্জাত হাতিটার কি হবে? ও যে আমার সব্বনাশ করল! এর কোনো শাস্তি হবে না? তুমি যদি আমার প্রকৃত বন্ধু হও, তাহলে এর একটা বিহিত কর। তবে আমার শান্তি হবে।

কাঠঠোকরা: ঠিকই বলেছ, ভাই। কথায় বলে না—

বিপদে যে পাশে থাকে বন্ধু বটে সে।
সুসময়ে বন্ধু বলে কে না পাশে বসে।।

তাই আমি কথা দিচ্ছি, ঐ নচ্ছার হাতিটাকে মেরে আমি তোমার সন্তান-শোক দূর করব। তবে এর জন্য আমার এক মাছি বন্ধু আছে, বীণারব—ওর সাহায্য দরকার। চলো আমরা ওর কাছে যাই।

কথামতো কাঠঠোকরা আর চড়ুইনী গেল মাছির কাছে। কাঠঠোকরা সব খুলে বলল। মাছি শুনে বলল: বন্ধু, তোমার কাজে লাগতে পারলে আমি তো ধন্য। তাছাড়া—

বন্ধুর কাজ বন্ধু করে সে তো জানে সবে।
বন্ধুর বন্ধুর কাজ সে তো বড় ভবে।।

তবে আমার এক ব্যাঙ বন্ধু আছে—মেঘনাদ। ওর সাহায্য প্রয়োজন। চলো আমরা ওর কাছে যাই।

এই বলে তিনজন গেল মেঘনাদের কাছে। মেঘনাদ সব শুনে বলল: কোনো চিন্তা করো না। ধরে নাও, বেটা হাতির বাচ্চা মরেছে।

এই বলে ব্যাঙ সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল এবং চারজন চলল হাতির উদ্দেশে। এদিকে হাতিটা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে গাছের নিচে বসে ঝিমোচ্ছে। এই সুযোগে মাছি তার কানের কাছে গিয়ে মধুর বীণারবে গান শুরু করে দিয়েছে। হাতিটা শুনতে শুনতে মধুর আবেশে বুঁদ হয়ে আছে। এই সুযোগে কাঠঠোকরা দ্রুত তার চোখদুটো খুবলে নেয়। মুহূর্তে হাতিটা মাতালের ন্যায় ছুটতে থাকে। ছুটতে ছুটতে তৃষ্ণায় তার ছাতি ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। তখন বিশাল এক গর্তে বসে ব্যাঙ জোরে জোরে ডাকতে থাকে। হাতিটা জলের আশায় সেদিকে ছুটতে গিয়ে পড়ে সেই গর্তে। আর পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়।

তুচ্ছ চড়ুইদের হাতে হাতির এই করুণ মৃত্যুর ঘটনা শুনে টিট্টিভ বলল: তুমি যথার্থই বলেছ। আমি তাহলে সবাইকে নিয়েই যাব সমুদ্রকে শুষতে।

এই বলে টিট্টিভ কাক, বক, সারস, ময়ূর সবাইকে ডেকে বলল—সমুদ্র তাদের ডিম চুরি করেছে সে কথা। তাই সমুদ্রকে শুষে ফেলে তার প্রতিশোধ নিতে হবে। পাখিরা শুনে বলল: এ কাজে আমরা কেন? এর জন্য তো আমাদের রাজা গরুড়ই রয়েছেন। চলো না, তাঁর কাছে যাই।

টিট্টিভসহ পাখিরা তখন সবাই গেল গরুড়ের কাছে। তারা জোড়হাতে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল: প্রভু! আপনি আমাদের মা-বাপ! আপনি না দেখলে আমরা বাঁচব কি করে? গরুড়: কি হয়েছে, বলো?

পাখিরা: প্রভু! ঐ সমুদ্র টিট্টিভের ডিম চুরি করেছে। এর উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত, কারণ—

একের গর্হিত কাজ অপরেতে করে।
রাজা যদি প্রথমের বিচার না করে।।

আর এভাবে চলতে থাকলে আমাদের বংশই যে লোপ পাবে! তাছাড়া, মনুর মতে রাজার কর্তব্য হলো ঠগ, জোচ্চোর, দুর্বৃত্ত, ডাকাত, খুনি—এদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করা। তা নাহলে প্রজাপীড়নের সন্তাপ থেকে যে আগুন জন্মে তা রাজা, রাজ্যশ্রী সব পুড়ে ছাই করে দেয়। জগতে যার কেউ নেই, রাজাই তার সব। অন্ধ প্রজার চোখের মণি রাজা। রাজার যে ঐশ্বর্য, তার সবই প্রজার দান। তাই রাজা যদি ঐশ্বর্য চান তাহলে সর্বপ্রকারে প্রজার পালন করতে হবে, যেমন করে গোয়ালা— দুধের জন্য—গাভী আর বাছুরকে, কিংবা মালী—অঙ্কুরের জন্য—বীজকে। মনু আরও বলেছেন, রাজা উত্তমরূপে প্রজাপালন করলে প্রজার পুণ্যের ছয় ভাগের একভাগ তিনি পান। আর তা না করলে প্রজার পাপের ছয় ভাগের এক ভাগ তাঁর উপর বর্তায়।

পাখিদের কথা শুনে গরুড় ক্রুদ্ধ হয়ে বলল: তোমরা ঠিকই বলেছ! প্রজাপালনের একমাত্র দায়িত্ব রাজার! তা নাহলে সে কিসের রাজা? দাঁড়াও, এক্ষুণি আমি দুরাত্মা সমুদ্রকে উচিত শিক্ষা দিচ্ছি!

ঠিক এই সময় বিষ্ণুদূত এসে হাজির। গরুড়কে বলল: ভগবান বিষ্ণু দেবকাজে অমরাবতী যাবেন। শিগগির চলো।

গরুড় অভিমানভরে বলল: প্রভুকে প্রণাম জানিয়ে বলো, অমি আর তাঁর কাজ করব না। ঊষর জমিতে লাঙ্গল দিয়ে যেমন কোনো লাভ হয় না, তেমনি ভৃত্যের প্রতি উদাস প্রভুর সেবা করেও কোনো লাভ নেই।

বিষ্ণুদূত বিস্মিত হয়ে বলল: ভাই গরুড়! তোমার কি হয়েছে আজ? কস্মিন কালেও তো তুমি প্রভুর প্রতি এমন আচরণ করো নি! আমায় খুলে বলো।

গরুড়: প্রভুর অপর ভৃত্য সমুদ্র আমার প্রজার ডিম চুরি করেছে। তুমি প্রভুকে গিয়ে বলো, এর বিচার না করা পর্যন্ত আমি আর তাঁর কাজ করব না। দরকার হলে তিনি তাঁকে বহন করার জন্য অন্য ভৃত্য রাখতে পারেন।

দূতমুখে সব শুনে বিষ্ণু বললেন: গরুড়ের রাগ যথার্থ, কারণ প্রজারক্ষায় ব্যর্থ রাজার সম্মান কোথায়? তাই যাই, নিজেই গিয়ে খাতির করে তাকে নিয়ে আসি। কথায় বলে না— নিজের ভাল চাইলে সৎকুলজাত অনুরক্ত ভৃত্যকে সন্তানের ন্যায় যত্ন করা উচিত। তাছাড়া, রাজা ভৃত্যের কাজে খুশি হয়ে কেবল অর্থই দেয়, আর ভৃত্য? সে সম্মান পেলে রাজার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে।

এসব চিন্তা করে বিষ্ণু স্বয়ং চলে এলেন গরুড়ের আস্তানায়। তাঁকে দেখে সলজ্জ গরুড় বিনয়ের সঙ্গে বলল: প্রভু! সমুদ্র আপনাকে আশ্রয় দেয় বলে সেই অহঙ্কারে সে আমার প্রজার ডিম চুরি করে আমায় অপমান করেছে। কেবল আপনার মুখ চেয়ে আমি ওকে এতক্ষণ শুকিয়ে ফেলিনি, কারণ মনিবের খাতিরে লোকে তার কুকুরকে পর্যন্ত প্রহার করেনা। সেবাশাস্ত্রেই তো আছে—

প্রভুর যাতে মানের হানি কিংবা চিত্তে পীড়া হয়।
জীবন গেলেও সে-কাজ কুল-ভৃত্য দ্বারা হবার নয়।।

গরুড়ের যুক্তিপূর্ণ কথায় খুশি হয়ে বিষ্ণু বললেন: তুমি যথার্থই বলেছ। ভৃত্যের অপরাধে কেউ তাকে সাজা দিলে তা যেমন মনিবের গায়েও লাগে, তেমনি ভৃত্যের লজ্জাজনক কাজের দায়ভারও মনিবেরই, ভূত্যের নয়। তাই চলো, সমুদ্রের কাছে গিয়ে ডিম ফিরিয়ে এনে টিট্টিভকে খুশি করি।

তা-ই হলো। সমুদ্রের কাছে গিয়ে বিষ্ণু অগ্নিবাণ ধনুকে জুড়ে সমুদ্রকে ভর্ৎসনা করে বললেন: এক্ষুণি টিট্টিভের ডিম ফিরিয়ে দাও, নইলে তোমাকে স্থলে পরিণত করব। অমনি সমুদ্র যেমন হাত বাড়িয়ে ডিম নিয়েছিল, তেমনি হাত বাড়িয়ে আবার তা ফিরিয়ে দিল। টিট্টিভ ডিমগুলো স্ত্রীর হাতে দিয়ে তাকে শান্ত করল।

দমনক এবার সঞ্জীবককে বলল: তাই বলছিলুম, বন্ধু! শত্রুর বল না জেনে লড়তে যাওয়া ঠিক নয়। তবে নীতিশাস্ত্র বলে পুরুষকে কখনও উদ্যম ছাড়তে নেই। সঞ্জীবক: কিন্তু আমি কি করে বুঝব যে পিঙ্গলক আমাকে মারতে চায়?

দমনক: প্রমাণ চাচ্ছ? তবে শোনো—রাজসভায় গিয়ে যদি দেখ সে তোমার সঙ্গে আগের মতো ব্যবহার করছে না, কিংবা তার চোখ দুটো লাল, ভুরু কুচকে তাকাচ্ছে এবং জিহ্বা দিয়ে নাক চাটছে—তাহলে বুঝবে মতলব ভালো নয়। আর এর বিপরীত হলে বুঝবে সুপ্রসন্ন।

কিছুক্ষণ নীরব থেকে দমনক আবার বলল: এবার তাহলে আজ্ঞা করো, নিজের বাসায় যাই। তবে দেখ, গোপন মন্ত্রণাটা যেন আবার ফাঁস না হয়ে যায়! তাহলে তোমারও শেষ, আমারও শেষ! আর যদি সাহসে না কুলোয় তাহলে রাতের অন্ধকারেই কেটে পড়, কারণ বুদ্ধিমানের সিদ্ধান্ত হলো— বংশের জন্য ব্যক্তি ছাড়বে, গ্রামের জন্য ছাড়বে বংশ, প্রয়োজনে দেশের জন্য গ্রাম ছাড়বে, কিন্তু জগৎ ছাড়বে নিজের জন্য। আর টাকা বাঁচাবে বিপদের জন্য, টাকা দিয়ে বাঁচাবে স্ত্রী, কিন্তু নিজেকে বাঁচাবে টাকা অথবা স্ত্রী কিংবা উভয়কে দিয়েই। আর ধর্মের কথা বলছ? সে তো নিজেকে সব দিক থেকে গুছিয়ে তার পরে।

এই বলে দমনক বিদায় নিয়ে চলে গেল করটকের কাছে। করটক বলল: কি করে এলে, ভাই?

দমনক: বীজ পুঁতে এলুম, ফল ধরল বলে।

করটক: কি করেছ, খুলে বলো।

দমনক: দুজনের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে দিয়েছি। দেখো, কেউ কারও সঙ্গে আর কথাটি পর্যন্ত বলবে না। এমনও হতে পারে যে, একজন আরেক জনকে মেরেই ফেলল।

করটক: কাজটা কি ভালো হলো? দুজনে কেমন সুখে ছিল—যেন আত্মার আত্মীয়। অথচ ফেলে দিলে একেবারে রেষারেষির মাঝ দরিয়ায়! শাস্ত্র বলছে না—অকারণে কেউ কারও সুখ নষ্ট করলে, জন্মজন্মান্তরে সে কষ্ট পায়। তাছাড়া, নীচ ব্যক্তি শুধু অপরের ক্ষতিই করতে পারে, উপকার নয় যেমন ইঁদুর কেবল ঘরের বাঁধই কাটে, বাঁধ দিতে পারে না।

করটকের কথায় দমনক একটু উত্তেজিত হয়ে বলল: তুমি রাজনীতির অ-আ-ক-খ ও বোঝনা, তাই এসব নীতির কথা বলছ! উন্নয়নকামী ব্যক্তি শুরুতেই শত্রু, অগ্নি কিংবা ব্যাধি নির্মূল করে ফেলে। দেখ, ঐ বেটা সঞ্জীবককে আমরাই এনেছিলাম, অথচ সে-ই কি-না আমাদের পদ কেড়ে নিল! রাজা এখন আর আমাদের চেনেই না! তুমি যা-ই বলো, এ আমি সহ্য করতে পরব না। আর মনে রেখো—উদ্যমী পুরুষরাই কেবল সুন্দরী গৃহলক্ষ্মী, স্থায়ী রাজ্যলক্ষ্মী আর অফুরন্ত ধন-সম্পদ ভোগ করতে পারে, অলসের পক্ষে এ সম্ভব নয়। রাজনীতির মূল কথাই হলো মুখে মিষ্টি, অন্তরে বিষ, আর অনিষ্টকারী হত্যায় অকুণ্ঠা। তাছাড়া, সঞ্জীবক মরলে আমাদের তিনটি লাভ—প্রতিশোধ গ্রহণ, মন্ত্রীত্ব পুনঃপ্রাপ্তি এবং ভুরিভোজ। আর পিঙ্গলক মরলেও ক্ষতি নেই; রাজত্ব তখন আমাদেরই হবে। কাজেই তুমি চুপ করে থাক। যা করার আমিই করব। দেখ—

পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে বুদ্ধিমানের জীবন চলে।
সিংহ পালায় শিকার ফেলে চতুরকের বুদ্ধিবলে।।

করটক: সে আবার কি?

দমনক: শোনো তাহলে…

সিংহ শেয়াল নেকড়ে

এক বনে থাকত এক সিংহ। নাম তার বজ্রদন্ত। বজ্রের ন্যায় ভয়ানক দাঁত তো! তাই এই নাম। তার ছিল দুই সহচর—চতুরক নামে এক শেয়াল, আর ক্রব্যমুখ নামে এক নেকড়ে। অতিশয় চালাক বলে শেয়ালের নাম চতুরক। আর মুখে সব সময় কাঁচা মাংস থাকত বলে নেকড়ের নাম ক্রব্যমুখ।

সুখেই তাদের দিন কাটছিল। একবার দাবানল লেগে বন গেল পুড়ে। তাই খাদ্যাভাব দেখা দিল। পরপর বেশ কয়েকদিন তাদের অনাহারে থাকতে হলো। একদিন এক বণিকদল উটের সারি নিয়ে যাচ্ছিল বাণিজ্যে। হঠাৎ এক বাচ্চা উট ছুটতে ছুটতে দলছাড়া হয়ে পড়ল। শেয়াল বলল: প্রভু! খাবার মিলেছে; ঐ দেখুন! এই বলে সে উটশাবককে দেখিয়ে দিল। সিংহ একটু ভেবে বলল: এ নিতান্তই বাচ্চা; একে মারা ঠিক হবে না; অন্য কিছুর সন্ধান কর।

দুষ্টু শেয়ালের আবার মায়া-দয়া! সে ঠিক করল— একেই মারতে হবে; খিদের সময় আবার মায়া-দয়া? প্রকাশ্যে বলল: প্রভু! শাস্ত্রে আছে ‘শরীরম্ আদ্যং খলু ধর্মসাধনম্’ শরীর রক্ষাই হলো বড় ধর্ম। না খেয়ে খেয়ে আপনার শরীর আধখানা হয়ে গেছে। এভাবে চললে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি অনিবার্য। তখন আমাদের কি হবে? আর ও যদি স্বেচ্ছায় আত্মোৎসর্গ করে তাহলে আর দোষ কোথায়?

চতুরকের কথায় সিংহ মৌনী থাকল। ‘মৌনং সম্মতিলক্ষণম্’—এই প্রবাদবাক্য স্মরণ করে তাই চতুরক গেল উটের কাছে। বলল: বাছা! বুঝতে পেরেছি তুমি মাকে হারিয়েছ। তা, এটাতো প্রভু বজ্রদন্তের রাজ্য। এখানে তার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাটিও পড়ে না, বাতাসটিও নড়েনা। তাই তুমি যদি মায়ের কাছে যেতে চাও তাহলে তার সাহায্য লাগবে।

উটশাবক কাতরভাবে বলল: আমাকে কি করতে হবে?

চতুরক: তুমি প্রভুর সেবায় নিজেকে উৎসর্গ কর। তিনি দৈববলে তোমায় মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।

উটশাবক রাজি হয়ে সিংহের কাছে গেল এবং তার আবেদনে সাড়া দিয়ে সিংহ তাকে মেরে ফেলল। কিন্তু কয়েকদিনের অনাহারী, তদুপরি শিকারটি বাচ্চা। তাই চতুরক মনে মনে ভাবল, যেভাবেই হোক এটাকে সে একাই খাবে। কিন্তু কিভাবে? মুহূর্তকাল চিন্তা করে সে সিংহকে বলল: প্রভু! আজ পূর্ণিমা। গঙ্গায় নতুন জল। তাই স্নানটা সেরে নিলে ভালো হতো না?

সিংহ: কথাটা মন্দ বলোনি। আমি ডুব দিয়ে আসি। তোমরা ততক্ষণ চুপ করে বসে থাক। এই বলে সে চলে গেল।

এদিকে চতুরক ভাবতে লাগল কিভাবে ক্রব্যমুখকে ফাঁসানো যায়। কিন্তু উপায় বের করতে সময় লাগল না। এমনিতে কি আর শেয়ালকে বলে পণ্ডিত! সে ক্রব্যমুখকে বলল: দীর্ঘদিন না খাওয়া! তোমার মুখটা এবারে শুকিয়ে গেছে! তুমি এক কাজ কর। এক পাশ দিয়ে একটু খেয়ে নাও। প্রভুকে আমি সামলাব।

ক্রব্যমুখের আসলেই আর তর সইছিল না। তাই সে দু-এক কামড় দিতেই অদূরে সিংহকে দেখে চতুরক বলল: বন্ধু! সরে দাঁড়াও, প্রভু আসছে! ক্রব্যমুখ তৎক্ষণাৎ সরে দাঁড়াল। সিংহ আসামাত্রই চতুরক ক্রব্যমুখের উদ্দেশে অভিযোগের সুরে বলল: এতদিন বাদে প্রভুর জন্য আহারের ব্যবস্থা হলো, আর তুই সেটাকে এঁটো করে দিলি!

সিংহ তাকিয়ে দেখে ক্রব্যমুখের মুখে রক্ত। তাই হুঙ্কার দিয়ে বলল: ধর ওকে, ওকেই আগে খাব। আর যায় কোথা! এক ছুটে ক্রব্যমুখ দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। এদিকে বজ্রদন্ত আসনে বসে যেই আহার শুরু করবে, ঠিক তখনই অদূরে বিকট ঘণ্টাধ্বনি শোনা গেল। বজ্রদন্ত চতুরককে বলল: দেখতো কিসের শব্দ!

বনের অদূর দিয়ে এক বণিকদল যাচ্ছিল উটের সারি নিয়ে। প্রথমটির গলায় ঝোলানো এক বিশাল ঘণ্টা থেকে এমন শব্দ বেরুচ্ছিল। চতুরক সুযোগ বুঝে ফিরে এসে বলল: প্রভু, সর্বনাশ! সেই উটের দল বাচ্চার খোঁজে এদিকেই আসছে! বলছে: যে আমাদের বাচ্চা ধরেছে তার বাপ-ঠাকুরদা পর্যন্ত ধরে নিযে যাব। এ-কথা শুনে বজ্রদন্ত মরা উটটির দিকে একবার তাকিয়ে ভোঁ-দৌড়ে পালিয়ে গেল। আর চতুরক তৃপ্তিভরে একাই সেটা ভক্ষণ করল।

দমনক করটকের উদ্দেশে বলল: তাই বলছিলাম—বুদ্ধিমানের বুদ্ধির কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। প্যাঁচটা কেবল ঠিকমতো কসতে হবে। তাহলে আর ফসকানোর জো থাকবেনা। এই বলে করটক ও দমনক গেল রাজসভায়।

এদিকে দমনককে বিদায় দিয়ে সঞ্জীবক ভাবছিল—কি ভুলটাই না সে করেছে! নিজে তৃণভোজী হয়ে মাংসখেকো ঐ পিঙ্গলকের দলে ভিড়ে নিজের বিপদ সে নিজেই ডেকে এনেছে। এখন উপায় কি? পালিয়ে যাবে? কিন্তু এই বনে কে তাকে অশ্রয় দেবে? মাংসখেকোরতো অভাব নেই। কারো-না-কারো হাতে তার প্রাণ যাবেই। তার চেয়ে বরং পিঙ্গলকের কাছেই ফিরে যাওয়া ভালো। তার শরণাগত হলে সে হয়তো পূর্বমিত্রতা স্মরণ করে ক্ষমাও করতে পারে। তাছাড়া কথায় বলে না—

আগুনেতে পুড়লে পা শুকাইতে ঘা।
আগুন দিয়েই তৈরি ঐ মলম লাগা।

এসব চিন্তা করে সঞ্জীবক ভয়ে ভয়ে রাজসভায় গেল। কিন্তু পিঙ্গলকের চোখে চোখ পড়তেই তার পিলে গেল চমকে! চোখ লাল! কটমট করে তাকাচ্ছে তার দিকে! তখন তার দমনকের কথা মনে পড়ল। দমনক যেমনটি বলেছিল, ঠিক তেমনটিই সে দেখছে। তাই সঞ্জীবক অন্য দিনের মতো পিঙ্গলকের কাছে না গিয়ে দূর থেকে প্রণাম করে অন্যত্র সরে বসল। তা দেখে পিঙ্গলকেরও দমনকের কথা মনে পড়ল। দমনক যেমন বলেছিল, সঞ্জীবকের আচরণে তা-ই সে দেখতে পেল। তাই পিঙ্গলকের আর ধৈর্য মানল না। সে হুঙ্কার দিয়ে পড়ল গিয়ে সঞ্জীবকের উপর। তীক্ষ্ণ নখের আচরে সঞ্জীবকের দেহ হলো ক্ষত-বিক্ষত। সঞ্জীবকও তার বজ্রের ন্যায় শৃঙ্গ দিয়ে মারল গুঁতো। পিঙ্গলকের পেটের চামড়া ছিঁড়ে ফেলে কোন রকমে সে রক্ষা পেল। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে গর্জন করতে লাগল। এই ভয়ঙ্কর কাণ্ড দেখে করটক তখন দমনককে তিরস্কার করে বলল: মূর্খ! এই বুদ্ধি নিয়ে তুই মন্ত্রী হতে চাস? এই কি মন্ত্রীর কাজ? অহিংস পথে যে রাজার সমস্যার সমাধান করতে পারে, সে-ইতো প্রকৃত মন্ত্রী। দেখ, বৈদ্যের পরীক্ষা হয় রোগের চিকিৎসায়, আর মন্ত্রীর পরীক্ষা হয় দ্বন্দ্ব নিরসনে। কিন্তু তুই এর বিপরীত। তুইতো রাজনীতির ‘র’-ও জানিস না। ব্রহ্মা বলেছেন না—শত্রুজয়ে প্রথমে প্রয়োগ করতে হয় সাম। তারপর দান। তাতেও কাজ না হলে ভেদ এবং সবশেষে দণ্ড। কিন্তু তোর মধ্যে শুধু যুদ্ধ-যুদ্ধ ভাব। দেখ, এই দ্বন্দ্বে রাজা মারা গেলে তোর মন্ত্রী হওয়া শেষ, কারণ তৃণভোজী সঞ্জীবক আজ-না-হোক কাল মারা পড়বেই। আর পিঙ্গলক বাঁচলেও তোর লাভ হবে না। সে তোকে আর বিশ্বাস করবে না, কারণ সঞ্জীবককে তুই-ই তার নিকট নিয়ে এসেছিলি।

মুহূর্তকাল নীরব থেকে আবার বলল: অবশ্য তোকে আর দোষ দিচ্ছি কেন? দোষ তো আসলে রাজার। তোকে প্রশ্রয় দিয়েই আজ তার এই দশা। তোর যেকোন কথাই তিনি বিশ্বাস করতেন। তোর মতো মন্ত্রীরা যার পাশে থাকে, সেই রাজার মৃত্যু অবধারিত। সেই রাজা গুণের আধার হলেও সজ্জনেরা তার কাছে যায় না, যেমন পরিষ্কার ও সুস্বাদু জল হলেও কুমির থাকলে সেই হ্রদে কেউ নামে না। অবশ্য তোর মতো মূর্খকে উপদেশ দেয়াও বিপদ! তাতে সে শান্ত না হয়ে বরং উপদেশদাতারই ক্ষতি করে, যেমন করেছিল বানর—বাবুইর বাসা ভেঙ্গে।

দমনক: কি রকম?

করটক: শোন তাহলে…

বানর ও বাবুই

এক বনে ছিল এক তালগাছ। তাতে বাসা বেঁধে থাকত এক বাবুই দম্পতি। বেশ সুখেই ছিল তারা। হঠাৎ হেমন্তের এক সকালে এল মুষলধারে বৃষ্টি। যেমন হাওয়া, তেমন বৃষ্টি। তাই ছুটতে ছুটতে এক বানর এসে আশ্রয় নিল সেই গাছের নীচে। ঠঠক করে কাঁপছে তার দন্তপাটি। দেখে বাবুই বলল: তোমারতো হাত আছে, পা-ও আছে। একটা লম্বা লেজও আছে। দেখতে অনেকটা মানুষেরই মতো। কিন্তু ঘর বাঁধ না কেন? বৃষ্টিতে ভিজে কেন এমন কাঁপছ! আমাদের কেবল ঠোঁট আছে। তা দিয়েই কেমন সুন্দর বাসা বানিয়ে আমরা কত আরামে আছি। তোমরা আসলে অলস ও মূর্খ। তাই কষ্ট পাচ্ছ।

একেতো বৃষ্টিভেজা, তায় আবার তুচ্ছ এক বাবুইর উপদেশ। শুনে বানরের গেল মাথা গরম হয়ে। সে দাঁত খিচিয়ে বলল: আমি শীতে কাঁপছি তাতে তোর কি? তোর এত স্পর্ধা যে আমায় উপদেশ দিচ্ছিস! চুপ থাক, নইলে উচিত শিক্ষা দেব!

বাবুই: সাপকে দুধ খাওয়ালে তাতে যেমন তার বিষই বাড়ে, তেমনি মূর্খকে উপদেশ দিলে তাতে তার ক্রোধই বাড়ে।

বানর: তবে রে পাজি! দেখাচ্ছি মজা! এই বলে গাছে উঠে বাবুইর বাসা ভেঙ্গে ফেলল এবং বাসার ভেতরে যে ডিম ছিল, তা নীচে পড়ে খানখান হয়ে গেল।

করটক: তাই বলছিলুম, মূর্খকে উদেশ দিয়ে কোনো লাভ নেই। তোকে প্রথম থেকেই এত করে বললুম যে, রাজার সঙ্গে লড়তে যাসনে। তাতে পদে পদে বিপদ। তা আমার কথা শুনলি না। অবশ্য শুনবিই বা কেন? মরাগাছে জল দিলে তাতে কি আর ফল ধরে? দেখ যারা অন্যের বিপদ দেখে নাচে, তারা নেচেনেচে নিজের বিপদকেই স্বাগত জানায়। আর মনে রাখিস—ধর্মের কাছে অধর্ম একদিন পরাস্ত হবেই। তাইতো—

ধর্মবুদ্ধি পাপবুদ্ধি ছিল দুই সখা।
মিলেমিশে আয় করে ভুরি ভুরি টাকা।।
লোভে পড়ে পাপবুদ্ধি করে মস্ত পাপ।
তার ফলে পুড়ে মরে আপনার বাপ।।

দমনক: খুলে বলো।

করটক: শোন …

ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধি

এক গ্রামে ছিল দুই বন্ধু—ধর্মবুদ্ধি ও পাপবুদ্ধি। দুজনে খুব ভাব। একদিন পাপবুদ্ধি ভাবল আমার যা বিদ্যে, তা দিয়ে অর্থোপার্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ভবিষ্যৎটা কাটবে কি করে? তাই ব্যবস্থা একটা করতেই হয়।

এই ভেবে সে একদিন ধর্মবুদ্ধিকে গিয়ে বলল: বন্ধু, বয়সতো দু-কুড়ি হলো, আর ক—দিনই বা বাঁচব? বৃদ্ধ বয়সের সম্বল কিছু টাকাকড়িতো জোগার করতে হয়। তাছাড়া দেশ-বিদেশ না ঘুরলে জ্ঞানার্জনও সম্পূর্ণ হয়না। কথায় বলে না—

কত দেশ কত ভাষা কত বেশ কত ভূষা
আরও কত কি।
ঘুরিয়া যে দেখিল না জীবন তার কিছুই না
ছি! ছি! ছি! ছি! ছি!!

ধর্মবুদ্ধি শুনে বলল: তাইতো! বিদেশ না গেলে কুনো ব্যাঙ আর মানুষে তফাত কি? বিদেশ ভ্রমণে বিদ্যা, ধন, যশ, খ্যাতি সবই হয়। তাই আমাকেও যেতে হবে।

এই বলে সে গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে পাপবুদ্ধির সঙ্গে বিদেশ গেল। সেখানে তার বুদ্ধি ও জ্ঞানবলে দুজনে প্রচুর অর্থোপার্জন করল। তারপর একদিন পাপবুদ্ধি বলল: বন্ধু, আর কত? এবার চল ফিরে যাই। কথায় বলেনা—

প্রবাসীর লাভ হলে বিদ্যা শিল্প ধন।
স্বজনের লাগি মন হয় উচাটন।

পাপবুদ্ধির কথায় সায় দিয়ে দুজনে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। সারা পথ পাপবুদ্ধি ভাবছিল—কিভাবে ধর্মবুদ্ধিকে ঠকিয়ে পুরো টাকাটাই হাতিয়ে নেয়া যায়। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে ধর্মবুদ্ধিকে বলল: বন্ধু, শাস্ত্র বলে—টাকা দেখলে সন্ন্যাসীরও মন টলে, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরতো কথাই নেই। এত টাকা দেখলে সবাই ভাগ চাইবে। তাই সব টাকা বাড়ি নেয়া ঠিক হবেনা। অল্প কিছু নিয়ে বাকিটা বনের মধ্যে কোথাও পুঁতে রেখে যাই। প্রয়োজনমতো দুজনে এসে নিয়ে যাব।

কৌশলটা ধর্মবুদ্ধির ভালই লাগে। তাই সে পাপবুদ্ধির প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। তারপর তারা বাড়ির অদূরে বনের মধ্যে এক শমীবৃক্ষের নীচে গর্ত খুড়ে টাকাগুলো রেখে দেয়। এবং অল্প কিছু টাকা নিয়ে যার যার বাড়ি যায়।

দু-একদিন পরে পাপবুদ্ধি গভীর রাতে এসে টাকাগুলো নিয়ে যায় এবং ভোরবেলা ধর্মবুদ্ধির কাছে গিয়ে বলে: বন্ধু, জানইতো, আমার হচ্ছে রাবণের গুষ্টি। টাকা যা এনেছিলাম, শেষ। তাই চল, কিছু টাকা নিয়ে আসি।

ধর্মবুদ্ধি সরল মনে বলল: চল।

কিন্তু গিয়ে দেখে, টাকা নেই। গর্ত খুড়ে কে যেন আবার তা বন্ধ করে রেখেছে। ধর্মবুদ্ধি কিছু বলার আগেই পাপবুদ্ধি জোর গলায় বলে উঠল: বেটা চোর! টাকা তুই নিয়েছিস! এক্ষুণি আমার অর্ধেক ফিরিয়ে দে! নইলে রাজার কাছে নালিশ করব!

ধর্মবুদ্ধি: খবরদার বদমাস! আমি হচ্ছি ধর্মবুদ্ধি। এসব জোচ্চুরি আমার কাজ নয়। ধর্মবুদ্ধি সব সময় পরস্ত্রীকে মায়ের মতো, টাকাকে মাটির ঢেলার মতো এবং সবাইকে নিজের মতো দেখে। এ তোর কাজ। এক্ষুণি আমার প্রাপ্য ফিরিয়ে দে। নইলে আমিও রাজার কাছে নালিশ করব।

এমনিভাবে কিছুক্ষণ বাদানুবাদের পর অবশেষে উভয়ই রাজার কাছে যায় এবং পরস্পরের নামে নালিশ করে। রাজার আদেশে বিচার কাজ শুরু হয়। বিচারক বলেন, শাস্ত্রে আছে—

বিচার-কাজে দেখবে দলিল,
তার অভাবে সাক্ষী-সাবুদ।
তার অভাবে দৈববাণী
বলেন এসব মনস্বী-বুধা

তা তোমরা যে টাকা ভাগাভাগি করেছ, তার কি কোনো দলিল আছে?

উভয়: আজ্ঞে, না।

বিচারক: তাহলে কোনো সাক্ষী?

ধর্মবুদ্ধি বলল: ধর্মাবতার, আমরা যখন টাকাগুলো মাটির নীচে রাখি, তখন সেখানে আর কেউ ছিলনা।

পাপবুদ্ধি সঙ্গে সঙ্গে বলল: ধর্মাবতার, আমার সাক্ষী বনদেবতা। তিনিই বলে দেবেন কে চোর, কে সাধু।

বিচারক: তবে তা-ই হোক। কাল সকালে আমরা সবাই একসঙ্গে সেখানে যাব। তোমরা কেউ একা সেখানে যাবেনা। সম্মত হয়ে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি বাড়ি ফিরে গেল।

ধর্মবুদ্ধি বুঝতে পারছে না কি করবে। সে কেবল ধর্মে আত্মসমর্পণ করে সকালের অপেক্ষা করছে। এদিকে পাপবুদ্ধি বাড়ি গিয়ে বৃদ্ধ বাবাকে সব খুলে বলে। বলে: কঠিন সমস্যা, বাবা! বিচারে হারলে এতগুলো টাকাও যাবে, সঙ্গে জীবনটাও! একমাত্র উপায় আছে, যদি তুমি রাজি হও।

বাবা বললেন: কি করতে হবে?

পাপবুদ্ধি: বনের মধ্যে এক বিশাল শমীবৃক্ষ আছে। তাতে আছে এক বিরাট গর্ত। তুমি আজ রাতেই গিয়ে সেই গর্তে লুকিয়ে থাকবে। কাল সকালে বিচারক যখন জানতে চাইবেন কে চোর, তখন তুমি বলবে ধর্মবুদ্ধিই চোর। ব্যাস! তারপর আজীবন সুখে কাল কাটাব!

পরের দিন সকালে ধর্মবুদ্ধি আর পাপবুদ্ধি বিচারকের সঙ্গে গেল সেই শমীবৃক্ষের তলায়। সঙ্গে রাজার লোকেরা। বিচারক জোড়হাতে শমীবৃক্ষের দিকে তাকিয়ে বললেন: হে বনদেবতা! নিজের বুদ্ধিতে যখন কুলোয় না, মানুষ তখন দেবতার সাহায্য কামনা করে। আমরাও তোমার সাহায্যপ্রার্থী। বলে দাও, গচ্ছিত অর্থ কে চুরি করেছে—ধর্মবুদ্ধি না পাপবুদ্ধি?

অমনি বৃক্ষকোটর থেকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় উত্তর এলো: ধর্মবুদ্ধি চুরি করেছে, সে-ই চোর।

সবাই বিস্মিত হয়ে গেল! জাগ্ৰত বনদেবতা! ধন্য পাপবুদ্ধি!

বিচারক বললেন: বিচার শেষ। এবার দণ্ডদানের পালা।

ধর্মবুদ্ধিকে কি দণ্ড দেয়া যায় এ নিয়ে যখন পরামর্শ চলছে, তখন ধর্মবুদ্ধি শমীবৃক্ষের কোটরের চারপাশে দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিল। আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল। এক সময় ঢুকে পড়ল কোটরের মধ্যে। অমনি আর্তনাদ করে বেরিয়ে এলো পাপবুদ্ধির পিতা। দেহের অর্ধেকখানা পুড়ে ছাই। সেই অবস্থায়ই সে খুলে বলল পাপবুদ্ধির কীর্তি-কাহিনী এবং বলল: পাপবুদ্ধিই চোর।

এই বলে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করল জীবন দিয়ে। তখন রাজপুরুষেরা পাপবুদ্ধিকে ধরে শূলে চড়াল। আর ধর্মবুদ্ধির প্রশংসা করতে করতে বলল: পণ্ডিতেরা কোনো উপায় চিন্তা করলে সঙ্গে সঙ্গে তার খারাপ দিকটাও ভাবেন, নইলে বিপদ আরও বাড়ে, যেমন সাপের হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে বেজির হাতে মারা পড়ে বোকা বকেরা।

ধর্মবুদ্ধিঃ তাই না-কি? শুনি তাহলে ঘটনাটা!

রাজপুরুষরা: শোনো তাহলে…

বক ও বেঁজি

এক বনে ছিল এক বিশাল বটগাছ। তাতে বাস করত একদল বক। তার কোটরে থাকত এক কালকেউটে। রকদের বাচ্চা হলে সে সাবার করে দিত। এ নিয়ে বকদের ভীষণ কষ্ট! কিন্তু কি করবে? সাপের সঙ্গে তারা পারবে কি করে?

গাছের নিচে ছিল একটা পুকুর। একদিন এক বঁক পুকুরপাড়ে বসে চোখের জলে ভাসছে! তা দেখে এক কাঁকড়া এসে বলল: কি মামা! এমন করে কাঁদছ যে!

বক: কি আর করি! কিছুই ভাল লাগছে না!

কাঁকড়া: কেন, কি হয়েছে?

বক: আর বলো না! কোটরস্থ ঐ কেউটে আমাদের সর্বনাশ করে দিচ্ছে! কাঁকড়া: কি হয়েছে খুলে বলো।

বক: আমাদের বাচ্চা হলে ঐ দুর্বৃত্তটা সব খেয়ে ফেলে। এই দেখনা গেলদিন আমাদের তিনটে বাচ্চা ফুটলো, আজ একটিও নেই! কাজেই এখানে আর থাকি কি করে!

কাঁকড়া মনে মনে ভাবল: বক আমাদের জাতশত্রু। এতদিন আমাদের ধরে ধরে গিলেছে। আজ তার প্রতিশোধ নেব। এমন পরামর্শ দেব যাতে বকের বংশ ধ্বংস হয়। কথায় বলেনা—

মুখে মিষ্টি অন্তরে বিষ      এমনিভাবে বুদ্ধি দিস
শত্রু যাতে টের না পায়।
কৌশলেতে করবি কাজ      হয়তো কাল কিংবা আজ
সমূলে সব মারা যায়।

এই ভেবে সে প্রকাশ্যে বলল: মামা, এ আর এমন কি? তুমিতো জান—সাপে আর বেঁজিতে চিরশত্রুতা। তাই বেঁজির গর্ত থেকে সাপের গর্ত পর্যন্ত ছোটছোট মাছ ছড়িয়ে দাও। ঐ মাছ খেতে গিয়ে বেঁজি সাপটাকে মেরে ফেলবে। ব্যাস! তোমরাও বেঁচে যাবে।

কাঁকড়ার পরামর্শ বকের পছন্দ হলো। সে সবাইকে ডেকে তা-ই করল। বেঁজিও ঠিকই সাপটাকে মারল। কিন্তু বকদের বাসায় বাকি যে শাবকগুলো ছিল, একে একে সেগুলোও সাবাড় করল। তাই বলছিলুম—পাপবুদ্ধি অন্যায়ভাবে অর্থ আত্মসাতের উপায় খুঁজতে গিয়ে তার অপায় অর্থাৎ খারাপ দিকটি চিন্তা করেনি।

এসব উপদেশের পরে করটক দমনককে বলল: ওরে মূর্খ! তোর মাথাও ঐ পাপবুদ্ধির মতোই। উপায় খুঁজতে গিয়ে তার অপায় চিন্তা করিস না। পাপকাজেই কেবল বুদ্ধি খেলে, ভালকাজে নয়। তোকে আমি ভাল করে চিনেছি। হুজুর তোকে বিশ্বাস করে চাকরিতে পুনর্বহাল করেছিলেন। কিন্তু তুই তাঁর জীবন বিপন্ন করে নিজেই দেখিয়ে দিলি তুই কতবড় কুটিল, শয়তান, বিশ্বাসঘাতক এবং বোকা! দেখ—ময়ূর দেখতে কত সুন্দর! তার সর্বাঙ্গে কি মনোহর রূপ! কিন্তু সেই বোকা যদি মেঘের ডাকে মহানন্দে পেখম তুলে না নাচত, তাহলে তার খারাপ দিকটা (মলদ্বার) কি কেউ দেখতে পেত? ঐ বোকা ময়ূরের মতো তুইও নিজের স্বরূপ প্রকাশ করে দিলি। তুই হুজুরেরই যখন এতবড় সর্বনাশ করতে পারলি, তখন আমাদের আর কথা কি? কাজেই তোর সঙ্গে বাস করা নিরাপদ নয়। তুই চলে যা এখান থেকে। আমার ধারে-কাছে আর আসবি না। দেখ, বিশ্বাসঘাতক আর মিথ্যেবাদী এদের কখনো উন্নতি হয়না। তাইতো বলেছে ভাল—

লোহার তৈরি তুলা যদি ইঁদুরে সব খেতে পারে।
শ্রেষ্ঠিপুত্র বাজে নেবে তাহাতে আর সন্দ কি-রে।।

দমনক বলল: সে আবার কি?

করটক: শোন তাহলে…

জীর্ণধন ও শ্রেষ্ঠী

দক্ষিণ ভারতের এক নগরে বাস করত এক বণিক। নাম জীর্ণধন। এক সময় প্রচুর ধন-সম্পদ ছিল। এখন সব শেষ, তাই এই নাম।

জীর্ণধন একদিন স্থির করল—বিদেশ যাবে। কারণ, এক সময় সে দাপটে চলেছে। বুক ফুলিয়ে ফূর্তি করেছে। এখন বৈভব হারিয়ে কাপুরুষের ন্যায় চললে, শত্রু থাক দূরের কথা, সাধারণ মানুষও ছিঃ ছিঃ করবে। কেউ মান্য করবে না। তাই বিদেশ গমন জরুরি।

তার ছিল একটি লোহার তুলাদণ্ড। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। যাওয়ার আগে সেটি প্রতিবেশী এক শ্রেষ্ঠীর নিকট গচ্ছিত রেখে গেল। বছর খানেক পরে ফিরে এসে শ্রেষ্ঠীকে বলল: মহাশয়, আমার তুলাটা ফিরিয়ে দিন।

শ্রেষ্ঠী: সেতো সম্ভব নয়!

জীর্ণধন: কেন?

শ্রেষ্ঠী: আপনি যাওয়ার পরপরই ইঁদুরে খেয়ে ফেলেছে!

শ্রেষ্ঠীর মুখে এই অসম্ভব কথা শুনে জীর্ণধন বুঝল, তুলাটি এ মেরে দিতে চাইছে। কিন্তু, মুখে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পরে বলল: তাহলে আর আপনার কি দোষ! সংসারটা এমনই! এখানে কিছুই কারো চিরকাল থাকেনা। যাহোক, বেলা হয়ে এল। যাই, নদীদে স্নানটা সেরে আসি। তা, আপনার শিশু পুত্রটিকে যদি বলেন স্নানের জিনিসগুলো নিয়ে আমার সঙ্গে যেতে, তাহলে ভালো হয়।

শ্রেষ্ঠী অতি আগ্রহে বলল: আজ্ঞে, অবশ্যই যাবে। ছেলেকে ডেকে বলল: বাবা, তোমার কাকামণি স্নানে যাচ্ছেন, তুমি কাপড়-চোপড় নিয়ে সঙ্গে যাওতো।

অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। শ্রেষ্ঠীর আচরণেও তা প্রকাশ পাচ্ছে। জীর্ণধন তাই মনে মনে বলল: ভয়ে কিংবা লোভে পড়েই মানুষ অন্যের পছন্দমতো কাজ করে, নিছক ভক্তির কারণে নয়। তাইতো পণ্ডিতেরা বলেছেন:

কারণ ছাড়া অতিভক্তি যদি দেখতে পাও।
সন্দ করো, হে বুদ্ধিমান, যদি বাঁচতে চাও।।

এরূপ ভাবতে ভাবতে জীর্ণধন স্নানে চলল। শ্রেষ্ঠীর শিশুপুত্রও আহ্লাদে আটখানা নদীতে যেতে পেরে। কিন্তু জগৎটাকে সে এখনো চেনেনি। তাই তার এ সরল আনন্দ। জীর্ণধন স্নান সেরে শিশুটিকে এক গুহায় ঢুকিয়ে মস্ত এক পাথর দিয়ে মুখটা দিল বন্ধ করে। তারপর ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে ফিরে গেল শ্রেষ্ঠীর বাড়ি। শ্রেষ্ঠী অস্থির কণ্ঠে বলল : আমার ছেলে কোথায়?

জীর্ণধন: নদীর পাড় থেকে বাজে নিয়ে গেছে।

শ্রেষ্ঠী: মিথ্যেবাদী! বাজ কখনো একটা মানুষ নিতে পারে? দিব্যি করে বলছি, আমার ছেলে ফিরিয়ে দাও, নইলে রাজার কাছে বিচার দেব!

জীর্ণধন: তবে তা-ই হোক! রাজাই বিচার করবেন কে মিথ্যেবাদী, আর কে সত্যবাদী! এভাবে দুজন বিবাদ করতে করতে রাজদরবারে গেল। শ্রেষ্ঠী চিৎকার করে বলছে: তোমরা শোন! কি সাংঘাতিক কথা! এই জীর্ণধন আমার ছেলেকে চুরি করেছে!

শুনে বিচারকরা বললেন: ওহে জীর্ণধন, তুমি ওর ছেলেকে চুরি করেছ কেন?

জীর্ণধন: আমি চুরি করিনি; বাজে নিয়ে গেছে।

বিচারক: সেটা কি করে সম্ভব? বাজপাখি একটা মানুষ ছোঁ মেরে নিতে পারে?

জীর্ণধন: ধর্মাবতার! বাজপাখি যদি মানুষ না নিতে পারে, তাহলে ইঁদুরে কি করে লোহার তুলা খায়?

অতঃপর বিচারকরা জানতে চাইলে জীর্ণধন পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা খুলে বলে এবং বিচারের রায় অনুযায়ী জীর্ণধন তার তুলাদণ্ড এবং শ্রেষ্ঠী তার পুত্র ফিরে পায়।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর করটক দমনককে পুনরায় বলল: আরে নির্বোধ! তুইও ঐ লোভী শ্রেষ্ঠীর মতো সঞ্জীবকের সম্মান দেখে সহ্য করতে পারছিলি না। তাই এ কাণ্ড করেছিস। আর তোকেইবা কি বলব? দুনিয়ার নিয়মই হচ্ছে, নীচকুলে যার জন্ম সে কুলীনকে হিংসা করে। ভাগ্যবানকে হিংসা করে দুর্ভাগা। দাতাকে হিংসা করে কৃপণ। ধনীকে হিংসা করে দরিদ্র। সুজনকে হিংসা করে দুর্জন। সুপুরুষকে হিংসা করে কুপুরুষ। ধার্মিককে হিংসা করে অধার্মিক। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতকে হিংসা করে নির্বোধ। আর সতীকে হিংসা করে অসতী। অবশ্য মূর্খের সঙ্গে যার বন্ধুত্ব হয়, তার এরূপ দশাই হয়। তাইতো কথায় বলে:

মূর্খ বন্ধুর চেয়ে পণ্ডিত শত্রুও ভাল।
বানরের হাতে রাজা দ্বিখণ্ডিত হলো।

দমনক: কি করে হলো?

করটক: এভাবে…

রাজা ও বানর

এক রাজার নিত্যসঙ্গী ছিল এক বানর। অত্যন্ত ভক্তিমান ও সেবাপরায়ণ। বিশ্বস্তও। সব সময় রাজার পাশে-পাশে থাকত। রাজা ঘুমোলে সে তাঁর অঙ্গসেবা করত।

একদিন রাজা দিবানিদ্রা যাচ্ছেন। বানরটি তাঁর পাহাড়ায়। হঠাৎ এক মাছি এসে বসল রাজার গালে। বানরটি তাড়িয়ে দিল। আবার এসে বসল। আবার তাড়িয়ে দিল। কিন্তু মাছিটি যাচ্ছে না। কখনো রাজার মাথায়, কখনো বুকে, কখনো পায়ে—এভাবে বসছে, আর বানরটি তাড়াচ্ছে। কখনো হাত দিয়ে। কখনো লেজ দিয়ে। কখনো ফুঁ দিয়ে কিন্তু মাছি রাজাকে ছাড়ছে না। বানরটি রাগে গজগজ করছে! লাফ দিয়ে রাজার ওপাশে যাচ্ছে। আবার এপাশে আসছে। মাছিটাকে ধরার জন্য দুহাত উঁচিয়ে থাপ্পর মারছে। কিন্তু মাছি ফাঁক দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। বানরের আর ধৈর্য ধরছে না। সে মাছিটাকে মারার জন্য দেয়াল থেকে শাণিত এক তরবারি এনে উঁচিয়ে ধরল। মাছিটা তখন রাজার গলায় বসেছে। আর যায় কোথা? মাছিটাকে মারতে গিয়ে দিল এক কোপ। কিন্তু মাছি গেল উড়ে। আর রাজা হলেন দ্বিখণ্ডিত।

তাই বলছিলাম—তোর মতো লোককে মন্ত্রী করে রাজা পিঙ্গলকের জীবনও আজ বিপন্ন। আর যে তোকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত, সেই সঞ্জীবকও আজ মৃত্যুর দ্বারে। দেখ—

লোভী আর বিশ্বাসঘাতক—জগতে এ দুজনে।
শাস্তি পায়—যেমন পেল শিক্ষিত ঐ বামুনে।।

দমনক: সে আবার কি?

করটক: শুনতে চাস? তবে শোন…

ব্রাহ্মণ ও বণিক

এক নগরে থাকত এক ব্রাহ্মণ। সে ছিল খুব বিদ্বান, কিন্তু লোভী। একবার ঐ নগরে এল তিন ভিনদেশী বণিক। তারা সওদা বিক্রি করে প্রচুর অর্থোপার্জন করল। তা দেখে ব্রাহ্মণের ভীষণ লোভ হলো। কি করে অর্থ হাতানো যায়, ভাবতে লাগল।

এদিকে বণিকরা ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছে। তা দেখে ব্রাহ্মণ অস্থির হয়ে উঠল। ওঃ! এত টাকা! আর সে কিছুই পাবে না! এটা কি করে হয়? তাই অনেক ভেবে-চিন্তে স্থির করল—বণিকদের সঙ্গে যাবে। পথে বিষ দিয়ে হত্যা করে টাকা-পয়সা নিয়ে ভাগবে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী বণিকদের কাছে গিয়ে বিগলিত কণ্ঠে বলল: বন্ধুরা! তোমাদের স্নেহপাশে আমি আবদ্ধ হয়ে পড়েছি! তোমাদের ছাড়া আমি বাঁচব না! দয়া করে আমাকে তোমাদের সঙ্গে নাও!

তার করুণ বিলাপে বণিকদের মন গলে গেল। তাই সেও তাদের সঙ্গে চলল।

পথে চারজন এক গভীর বন দিয়ে যাচ্ছে। জায়গাটি কিরাতদের দখলে। কিরাতরা কাকচরিত্র জানে। তাদের ভাষা বোঝে। বণিকদের দেখে কাকগুলো বলতে লাগল—

কিরাত, কিরাত, দৌড়ে আয়।
টাকা নিয়ে বণিক যায়।।

কাকদের কথা শুনে কিরাতরা দৌড়ে এল। চারজনকে বেঁধে ফেলল। লাঠিপেটা করে সকলের কাপড় খুলে ফেলল। কিন্তু কিছুই পেল না। কারণ বণিকরা টাকা রেখেছিল পায়ের নীচে জুতার মধ্যে। একথা ব্রাহ্মণও বুঝতে পারেনি। তখন ক্রুদ্ধ হয়ে কিরাতরা বলল: দেখো, তোমাদের কাছে নিশ্চয় টাকা আছে। কাকদের কথা মিথ্যে হয়না। তাই, ভালোয় ভালোয় দিয়ে দাও। নইলে সবকটাকে মেরে চামড়া খুলে টাকা নেব।

সবাই নীরব। তখন কিরাতরা ঐ ব্রাহ্মণকেই আগে মারল। তার চামড়া খুলে দেখল কিছুই নেই। তখন বাকিদের ছেড়ে দিল। তাই বলছিলুম—বেশি লোভ করা ভালো নয়।

দমনক আর করটকের এরূপ বাক্যালাপের এক পর্যায়ে পিঙ্গলকের প্রচণ্ড থাবায় সঞ্জীবক মারা গেল। তার বিশাল দেহ সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল। তার নিথর দেহের প্রতি তাকিয়ে পিঙ্গলক করুণ কণ্ঠে বলতে লাগল: আমি কি পাপিষ্ঠ! সঞ্জীবক আমাকে কত বিশ্বাস করত! অথচ আমি তাকে মেরে ফেললাম! এমন বিশ্বাসঘাতকতার চেয়ে বড়ো পাপ আর কি হতে পারে! শাস্ত্র ঠিকই বলেছে: যারা বন্ধুর ক্ষতি করে, যারা অন্যের উপকার ভুলে যায়, আর যারা বিশ্বাসঘাতক—তারা সবাই নরকে যায়। লোকে বলে: রাজার রাজ্য যাওয়া, আর বিশ্বস্ত বন্ধু মরা একই কথা। কিন্তু, আমি বলি—এ দুটি এক নয়। রাজ্য গেলে রাজ্য পাওয়া যায়, কিন্তু বিশ্বস্ত বন্ধু পাওয়া যায়না।

পিঙ্গলক সঞ্জীবকের জন্য এভাবে বিলাপ করতে থাকলে দমনক এগিয়ে এসে সোল্লাসে বলল: প্রভু, একটা তৃণভোজীর জন্য এভাবে বিলাপ করা রাজার শোভা পায়না। শাস্ত্রে আছে না—

পিতা কিংবা পুত্র কিংবা বন্ধু-ভাৰ্যা-ভাই।
শত্রু হলে তাকে বধে দোষের কিছু নাই।।

আরো দেখুন—দয়ালু রাজা, স্বাধীন স্ত্রী, অবাধ্য ভৃত্য, দায়িত্বহীন সচিব, দুষ্ট সহায়ক, সর্বভুক ব্রাহ্মণ এবং অকৃতজ্ঞ―এ ক’জন সর্বদা পরিত্যাজ্য। বুদ্ধিমান এবং উন্নতিকামী ব্যক্তিরা কখনো এদের ঠাঁই দেয়না।

তাছাড়া, রাজনীতির ধর্মই হলো—কখনো সে সত্য বলে, কখনো মিথ্যা বলে; কখনো রূঢ়কথা বলে, কখনো প্রিয়কথা বলে; কখনো সে নৃশংস, কখনো দয়ালু; কখনো প্রচুর খরচ করে, কখনো অজস্র অর্জন করে; আসলে রাজনীতি হচ্ছে পতিতার ন্যায় বহুরূপিণী।

দমনক এভাবে বোঝালে পিঙ্গলকের মন থেকে সঞ্জীবকের মৃত্যুজনিত শোক কেটে যায়। সে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে এবং দমনককে প্রধানমন্ত্রীর পদ ফিরিয়ে দেয়। ঐদিন সঞ্জীবকের টাটকা মাংসে সবার ভুরিভোজ হয় এবং তারপর থেকে দমনকের বুদ্ধিতে পিঙ্গলক সুখে রাজত্ব করতে থাকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *