ন সো রমণ ন হাম রমণী
এখনকার দিনের পরিশীলিত ভাবনায় এ-কথা শুনলে অবাক লাগতে পারে বটে, কিন্তু এ-কথা মানতেই হবে যে, প্রাচীন ভারতীয় নৃত্যকলা এবং অভিনয়-শিল্পের বিবর্তনে সবচেয়ে যাঁদের অবদান বেশি ছিল—তাঁরা ছিলেন গণিকা এবং দেবদাসী। প্রাচীনকালে গণিকাদের প্রচুর সম্মান ছিল এবং তা ছিল প্রধানত তাঁদের নৃত্য-গীত-কুশলতার জন্যই। সত্যি কথা বলতে কি, গণিকারা সেকালে শুধু রূপেরই আধার ছিলেন না, বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বিচিত্র কলা-কৌশলের যে আভিজাত্য থাকে, সে আভিজাত্য প্রধানত গণিকাদের মধ্যে ছিল বলেই রাজবাড়িতে গণিকাদের অন্য সম্মান ছিল। হয়তো এই আভিজাত্য ছিল বলেই মৃচ্ছকটিকের মতো অসাধারণ নাটকে বসন্তসেনার মতো গণিকার সঙ্গে ব্রাহ্মণ চারুদত্তের মিলন ঘটেছে। আরও একটা সাংঘাতিক খবর আছে প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থ ললিতবিস্তরের মধ্যে। সেখানে দেখা যাচ্ছে—রাজা শুদ্ধোদন তাঁর পুত্র সিদ্ধার্থের বিয়ের জন্য এমন একটা মেয়ের খোঁজ করছেন, যাঁর শাস্ত্রজ্ঞান এবং কলাকুশলতা হবে একটি গণিকার মতো—শাস্ত্রে বিধিজ্ঞকুশলা গণিকা যথৈব।
‘গণিকার মতো’। শুদ্ধোধন অবশ্যই গণিকা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন না। ‘গণিকার মতো’—উপমার এই সামান্য অঙ্গুলি-সংকেত থেকেই কিন্তু গণিকার জীবন সম্বন্ধে দুটি পরস্পরবিরোধী মাত্রা জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। একটি মাত্রা হল—নৃত্য-গীত-কলার দক্ষতায় গণিকার সামাজিক প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে গণিকা হওয়ার কারণে তার সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এখানে যে দেবদাসীর কথা বলব, সেই দেবদাসীদের মধ্যেও এই গণিকা-জীবনের এই দুটি সূত্র লুকোনো আছে। একদিকে দেবদাসীরা মান্য, অন্যদিকে নিন্দিত। একদিকে মন্দির তথা গৃহস্থঘরের সমস্ত মঙ্গলকার্যে দেবদাসীদের উপস্থিতি মঙ্গলদায়িনী ছিল বলে তাঁরা ‘নিত্যসুমঙ্গলী’, অন্যদিকে সমাজের বিধিবহির্ভূত মিলন সাধারণ্যে তাঁদের নিন্দিত করে রেখেছে চিরকাল।
ভারতবর্ষে দেবদাসীদের নৃত্যগীত প্রচলিত হয়েছে বহুকাল। পণ্ডিতেরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন—ভারতবর্ষের নৃত্যকলার অন্যতম প্রধান আঙ্গিক—যাকে আমরা ‘ভরতনাট্যম’ বলে থাকি—সেই বিশিষ্ট নৃত্যকলার জন্ম হয়েছে দেবদাসীদের নৃত্য থেকে। দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন মন্দিরে দেবদাসীরা নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য মেনে যে নৃত্য করতেন, সেই নৃত্যই ভরতনাট্যমের প্রধান অঙ্গ। বিংশ শতাব্দীর চতুর্থ দশকেও মাদ্রাজ অথবা কলকাতায় যেসব নৃত্যাঙ্গনা ভরতনাট্যম শিক্ষা দিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই এগারো/বারো বছর বয়সে মন্দিরের দেবতার সামনে নৃত্যগীত পরিবেশন করেছেন; পরে কালবদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের জীবনপটেও পরিবর্তন এসেছে এবং তাঁরা ‘ভরতনাট্যম’-এর আচার্যা হয়ে গেছেন বিভিন্ন শহরের প্রাণকেন্দ্রে।
দেবদাসীদের জীবনে তিন ধরনের বিবর্তন আছে—একটি ইতিহাসগত, দ্বিতীয় প্রথাগত এবং তৃতীয়টি সামাজিক বিবর্তন। দেবদাসীপ্রথা শুধু ভারতবর্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতাতেও। ব্যাবিলনেও একভাবে দেবদাসী প্রথা দেখতে পাই—এনতু, নতিতু, জিক্রু—এই রকম কত শ্রেণির সব নাম—যাঁরা কেউ বিবাহ না করে, কেউ বা বিবাহিত হলেও সন্তান ধারণ না করে দেবতার স্ত্রীত্ব বরণ করতেন। ইশতার-দেবীর মন্দিরে মহিলা পুরোহিতদের সহায় হিসেবে যাঁদের উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের গণিকা বললে কোনো অত্যুক্তি হয় না, এবং দেশীয় ভাষায় তাঁদের গণিকা (কিজেরেতি) বলেই ডাকা হয়েছে অথবা বলা হয়েছে ‘শঙখতি’ অর্থাৎ ফূর্তিবাজ রমণী। ব্যাবিলনের মহাকাব্য গিলগামেশের কাহিনিতে ইশতার-দেবীর মন্দিরের এক ফূর্তিবাজ রমণীর সহায়তাতেই নায়ক গিলগামেশকে নিজের অধিকারে আনতে চেয়েছিলেন দেবী ইশতার।
আমাদের দেশে অবশ্য দেবদাসীর ইতিহাস খুঁজতে গেলেই আগে সুতনুকার নাম করা হয়। দেবদাসী সুতনুকার প্রাচীনত্ব কম নয় এবং তাঁর কাহিনির মধ্যে ‘রোমান্সে’র সমস্ত বীজ নিহিত, যদিও সেই রোমান্স ব্যক্ত হয়েছে প্রাকৃত-ভাষায় দুই-পঙক্তির পদ্যে-গদ্যে। ব্লক সাহেব (J. Bloch) কোথায় সেই বারাণসীর কাছে বিন্ধ্যপাদমূলে রামগড়ের জোগীমারা গুহায় সম্রাট অশোকের আমলের এক লিপি আবিষ্কার করেছেন। সেই লিপির মধ্যে নাম পাওয়া যাচ্ছে সুতনুকা নামে এক দেবদাসীর। এর পরের যুগে ঠিক ‘দেবদাসী’ শব্দটা ব্যবহৃত না হলেও কালিদাসের মেঘদূতে কিন্তু ‘মহাকাল মন্দিরের মাঝে/যখন গম্ভীর মন্দ্রে সন্ধ্যারতি’ আরম্ভ হয়েছিল, তখন চরণক্ষেপে ক্ষীণকটিতে চন্দ্রহার নাচিয়ে দেবতার সামনে নৃত্য করেছে বারাঙ্গনারা, ত্রিপুরবিজয়ের গান করেছে কিন্নরীরা। কালিদাসের সময়কালে মন্দিরচত্বরে দাঁড়িয়ে যে বারাঙ্গনারা নৃত্য করেছেন, তাঁরা দেবদাসী নয়তো কী?
দেবদাসী শব্দের ধ্বনিতেই বোঝা যায় এঁদের প্রথম প্রণয়ী ছিলেন মন্দিরের দেবতা—সেই দেবতার কাছে তাঁরা উৎসর্গীকৃত হতেন আট থেকে বারো বছর বয়সের মধ্যে। দেবতাদের সঙ্গেই তাঁদের বিয়ে হত এবং মর্ত্য জীবনে কোনো মানুষকে আর বিবাহ করা সম্ভব হত না তাঁদের পক্ষে। মন্দির-দেবতার নৃত্যসেবিকা হওয়ার সুবাদে মন্দিরের পুরোহিত, মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা রাজা এবং অন্য বড় মানুষেরাও দেবতার এই রমণীয় প্রসাদ থেকে বঞ্চিত হতেন না। সে প্রমাণ অনেক আছে এবং হয়তো সেই কারণেই একদিন যে রমণী মুকুলিকা বালিকা বয়সে দেবতার প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আত্মবলিদান করত, সেই একসময় দেববেশ্যায় পরিণত হত। লক্ষণীয়, মহানির্বাণতন্ত্রের মতো উচ্চমার্গীয় তন্ত্রশাস্ত্রের মধ্যে গুপ্তবেশ্যা, রাজবেশ্যা ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে ‘দেববেশ্যা’ বলে একটি শব্দ পাচ্ছি এবং আমাদের ধারণা এই শব্দের সংকেত দেবদাসীদের দিকেই।
মন্দির দেবতার উদ্দেশে একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি রমণীকে উৎসর্গ করার ব্যাপারটা খুব প্রাচীনকালে ছিল না বোধহয়। পণ্ডিতেরা লক্ষ করে দেখেছেন যে সম্পূর্ণ জাতক গ্রন্থগুলির মধ্যে দেবদাসী বা ওই জাতীয় দেবগণিকার কোনো উল্লেখ নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা বাৎস্যায়নের কামশাস্ত্রের গণিকাদের সম্মান প্রতিপত্তি এবং তাঁদের ক্রিয়াকর্ম নিয়ে বহুল আলোচনা থাকলেও দেবোদ্দেশে কোনো রমণীর বিধিসম্মত উৎসর্গীকরণের কথা লিখিত হয়নি। তবে হ্যাঁ, মন্দির চত্বরে নৃত্যশীলা রমণীর যে উদাহরণ আমরা পেয়েছি, তার উদ্দেশ্য শুধুই নৃত্যগীত পরিবেশন হয়তো। কেননা সেকালের দিনে রাজকীয় ক্রিয়াকর্মে রমণীদের নিযুক্তি লক্ষ করেছি আমরা। রাজার তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী থেকে আরম্ভ করে ছত্রধারিণী, চামরধারিণী, এমনকী রাজার ব্যক্তিগত সুরক্ষাতেও যবনী রমণীদের দেখেছি আমরা। একইভাবে বিনোদনের জন্য নৃত্যপরা যুবতীর ব্যবহারও ছিল, তাঁরা নাচতেন এবং অভিনয়ও করতেন। বসন্তোৎসবে বা মদনমহোৎসবে রাজার উদ্যানবাটিকায় অনঙ্গদেবতার সামনে নৃত্য করতেন রাজার অন্তঃপুরবাসিনীরাও। ওই একই বসন্তোৎসবে কালিদাসের মালবিকা নৃত্য-অভিনয় সম্পন্ন করেছেন রীতিমতো ‘স্টেজ-পারফরম্যান্স’ দিয়ে। কিন্তু এই ধরনের বিভিন্ন ক্রিয়াকর্ম এবং নৃত্যাভিনয় মেয়েদের মধ্যে বহুল প্রচলিত থাকলেও দেবতার উদ্দেশে নৃত্যপরা যুবতীদের উৎসর্গ তখনও পর্যন্ত চালু ছিল না বলেই মনে হয়।
বস্তুত এই উৎসর্গীকরণ আরম্ভ হয়েছে বৈদিক এবং একব্রহ্মবাদী উপনিষদ রচনার উত্তরযুগে। এই যুগে শিব অথবা বিষ্ণু-কৃষ্ণের মতো ব্যক্তিদেবতার উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে বৈধী ভক্তির মধ্যে সরসতা এবং ভক্তপ্রাণের অনুরাগ সঞ্চার হয়। কৃষ্ণ এবং শিবের মতো দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে পুরাণগুলি দেবতার উদ্দেশে পূজার্চনার উপচার হিসেবে গন্ধ, পুষ্প, ধূপ-দীপ, নৈবেদ্যের সঙ্গে নৃত্যগীতেরও বিধান দিতে থাকে। পৌরাণিক এই নির্দেশ বেদ-উপনিষদের শব্দপ্রমাণের মর্যাদা ধারণ না করলেও, এগুলি রাজা-রাজড়াদের বেশ পছন্দ হয়ে যায় নিশ্চয়। আত্মকীর্তি প্রচারের জন্য বড় বড় মন্দির তৈরির ব্যাপারে তাঁরাই প্রধানত আগ্রহী ছিলেন এবং দেবমন্দিরের আড়ম্বরের ক্ষেত্রটিও তাঁদেরই পৃষ্ঠপোষণে সমৃদ্ধ হত। পৌরাণিক নির্দেশ এবং নিজের অন্তরগত আড়ম্বর প্রেরণায় রাজারাই মন্দিরে সন্ধ্যারতির অমন্দ শঙ্খঘণ্টা ধ্বনির সঙ্গে যুবতীর নৃত্য-গীতের ব্যবস্থা করে দেন।
দেবদাসী-প্রথার অন্যতম প্রধান পীঠস্থান যে পুরুষোত্তমক্ষেত্র, সেই পুরীর মন্দিরের প্রতিষ্ঠার পৌরাণিক বর্ণনা আমাদের বক্তব্যপ্রমাণে সহায়তা করবে। ব্রহ্মপুরাণে দেখবেন—অবন্তীরাজ ইন্দ্রদ্যুম্নের রাজ্যে বারমুখ্যরা সকলেই নৃত্যগীতে নিপুণ। আবার তিনি যে মন্দির নির্মাণের জন্য শ্রীক্ষেত্রকেই বেছে নিলেন, তার অনেক কারণের মধ্যে এও আছে যে, তিনি শ্রীক্ষেত্রের বিলাসিনী রমণীদের দেখে মোহিত হয়েছিলেন এবং সেই মোহিত হওয়ার কারণ সেই বিলাসিনীরা বিচিত্র প্রকার নৃত্যগীতে কুশল ছিলেন—’অনেক গীতবাদ্যবিশারদাঃ’। শ্রীক্ষেত্রের এই বিলাসিনীরা শুধু নৃত্যগীতপটীয়সীই ছিলেন না, ব্রহ্মপুরাণের অন্য একটি বিশেষণে তাঁরা অপূর্ব সুন্দরী এবং তাঁরা নিজেরা স্বয়ং অন্যর কামনায় সাড়া দিতে জানে—কামোন্মত্তা বরাঙ্গানাঃ।
পুরীর মন্দির প্রতিষ্ঠার আগেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন নৃত্যগীত বিশারদ যেসব বারাঙ্গনাদের দেখে খুশি হয়েছিলেন, তাঁরা মন্দিরের কাজেই দেবদাসীতে পরিণত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। রাজাদের মন্দির নির্মাণের এই আড়ম্বরের সঙ্গে যদি পদ্মপুরাণের নির্দেশ মিলিয়ে নেওয়া যায়, তা হলে দেখব এই পুরাণ নির্দেশ দিচ্ছে যে, দেবতাদের আরতি ইত্যাদি সময়ে মন্দির-চত্বরে নৃত্যগীত পরিবেশন করার জন্য বিলাসিনী রমণীদের নিয়োগের ব্যবস্থা থাকা উচিত এবং এ ব্যাপারে সোজাসুজি ব্যবস্থা না হলে—সেই রকম সুন্দরী রমণীদের ক্রয় করেও দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গ করা উচিত—ক্রীতা দেবায় দাতব্যা ধীরেণাক্লিষ্টকর্মণা। এখানে অবশ্য ‘ক্রয়’ অর্থে রমণীদের নৃত্যগীতকলা-ক্রয়ের কথাই বোঝানো হচ্ছে মনে হয়। অর্থাৎ দেবারাধনার বিশেষ বিশেষ সময়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করে তার বিনিময়ে নৃত্যপরা যুবতীরা অর্থ পেতেন অথবা সম্পদ পেতেন। অন্যদিকে মনে রাখতে হবে, এই সব নৃত্যগীত-জানা রমণীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণিকা কিংবা বেশ্যার পর্যায়ভুক্ত ছিলেন, ফলে দেবমন্দিরে হয়তো এঁদেরই উৎসর্গ করার বিধি ছিল। সেটাও কিন্তু পুরাণ-বচন থেকে প্রমাণ করা যায়। ভবিষ্যপুরাণে দেখতে পাচ্ছি—ভক্তিসহকারে যিনি সূর্যমন্দিরে সূর্যের উদ্দেশে অনেক বেশ্যা-রমণীকে প্রদান করেন, তিনি নাকি মরণের পরে সূর্যলোকে পরম গতি লাভ করেন—বেশ্যাকদম্বকং যস্তু দদ্যাৎ সূর্যায় ভক্তিতঃ।
এ এক অদ্ভুত পরিতুষ্টি! নিজের ঘরের কোনো ক্ষতি হল না। মন্দিরে বেশ্যাদানের পুণ্যলাভও করা গেল অর্থের বিনিময়ে অন্যের ওপর দিয়ে, মন্দিরের দেবতার উদ্দেশে নৃত্যগীতও পরিবেশন করা গেল ভক্তির আড়ম্বরে। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যপুরাণে যতই এ গল্প থাক, সবসময়ে যে বেশ্যা-গণিকা দান করেই এই নৃত্যগীত পরিবেশন চলত তা নয়, বরঞ্চ নৃত্যপরা যুবতীরা দেবতার কাছে উৎসর্গীকৃত হয়ে মন্দিরের পুরোহিত, রাজা এবং অন্যান্য কামুক ব্যক্তির কল্যাণে বেশ্যা-গণিকায় পরিণত হতেন। তবে সব কিছুর ওপরেও আমাদের ধারণা—ব্রাহ্মণ্যপ্রধান পুরাণগুলির দু-চারখানি বচনে এই প্রথা তৈরি হয়নি, এই প্রথা প্রিয়তর করার পিছনে প্রধান উদ্যোক্তা হলেন রাজারাই। নবম/দশম খ্রিস্টাব্দে লিখিত দক্ষিণ ভারতের বহু শিলালিপিতে দেখা যাচ্ছে যে, মন্দিরের পূজা-আরতির সময়ে নৃত্যপরা যুবতীদের ব্যবহার প্রথাসিদ্ধ হয়ে গেছে। চোলরাজা রাজরাজ যখন তাঞ্জোরে মন্দির বানিয়েছিলেন, তখন অন্তত চারশো নর্তকী যুবতীর নাচের ব্যবস্থা করেছিলেন মন্দিরে। তবে শুধু দক্ষিণ ভারত নয়, বিখ্যাত সোমনাথের মন্দিরেও খুব কম করে পাঁচশো নর্তকীর ব্যবস্থা ছিল—যাঁরা দিন-রাত পালা করে নৃত্যগীত প্রদর্শন করত দেবতার সামনে।
এক-একটি মন্দিরে এতগুলি নর্তকীর ব্যবস্থা এবং তার পিছনে রাজাদের পোষণ—এই দুটিই আস্তে আস্তে নর্তকীদের স্বভাব খারাপ করে ফেলেছে এবং পণ্ডিত-সজ্জনেরা মন্তব্য করেছেন যে, মন্দিরসন্নিধিতে থাকা পুরুষেরা যতখানি না ভক্তিভরে দেবদর্শন করতে আসত, তার থেকে বেশি আসত মন্দির-নর্তকীদের হৃদয় আকর্ষণ করার জন্য। দামোদরগুপ্ত সেই অষ্টম খ্রিস্টাব্দে ‘মঞ্জরী’ নামের এক দেবগৃহনর্তকীর কথা লিখেছেন। তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে ভারী সুন্দর করে তিনি লিখেছেন—কাশ্মীরের আচার্যস্থানীয়, এক ব্রাহ্মণের মেয়ে মঞ্জরী ছিল কলশেশ্বর (কমলেশ্বর) শিবের ‘পাদমূলমঞ্জরী’। মন্দিরে নর্তকী হবার সুবাদে সে স্বভাবসিদ্ধ কলাবিলাসে এক রাজপুত্রের মাথা চিবিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছিল—প্রবরাচার্যদুহিত্রা রাজসুতশ্চর্বিতাশ্চ মুক্তশ্চ। দামোদরগুপ্ত সোজাসুজি দেবদাসী শব্দটি ব্যবহার না করে একেবারে মন্দিরদেবতার নাম উল্লেখ করে কোন মন্দিরের নর্তকী তিনি, সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এইরকমই একটি নাম গম্ভীরেশ্বরদাসী অর্থাৎ গম্ভীরেশ্বর শিবমন্দিরের নর্তকী। এই মন্দিরেও সমরভট নামক এক রাজপুত্রের আগমন ঘটেছে, অবশ্য তাঁর মস্তক পূর্ববৎ চর্বিত হয়নি, এই যা ভাগ্য।
যে কথা আগে বলেছিলাম—রাজারা যত যত মন্দির তৈরি করে দিচ্ছিলেন, মন্দিরে নর্তকীর আড়ম্বর তত বাড়ছিল এবং মন্দিরের পবিত্র শুদ্ধ পরিবেশও তত ব্যাহত হচ্ছিল। সমাজের অনেক জায়গায় সংরক্ষণশীল ব্রাহ্মণেরা দু-চারটি পৌরাণিক শব্দপ্রমাণে অভিভূত না হয়ে মন্দিরে এই নর্তকী-প্রবেশের বিরোধিতা করেছেন। ইতিহাসের সূত্র-দাতা আল বেরুনি সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের এই বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেছেন এবং তাঁর এই বীক্ষণ যে সত্য ছিল তা বোঝা যায় এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকায় উদ্ধৃত একটি লিপির প্রমাণে। দশম খ্রিস্টাব্দের এই লিপিতে দেখা যাচ্ছে—রাজপুতানার মুলতানে অধিষ্ঠিত সামন্তগোছের এক রাজা তাঁর বংশধরদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন যে, তিনি মন্দিরে মন্দিরে যেসব নর্তকীদের নৃত্যপ্রদর্শনের জন্য বহাল করেছেন, সেই নৃত্য বন্ধ করার জন্য যদি ব্রাহ্মণ এবং সাধুরা বাধা দেন, তাহলে তাঁর বংশধরেরা যেন সে বাধা না মানেন এবং পূর্বকৃত ব্যবস্থা জারি রাখেন।
এই শাসন থেকে বোঝা যায় যে, অন্তত বেশ কিছু মন্দিরে ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা দেবদাসী-নিযুক্তির ব্যাপারে বাধা দেন, কিন্তু রাজারাজড়ার শাসনযন্ত্রের জোর যেহেতু ব্রাহ্মণ-সজ্জনদের নৈতিক বাণীর চেয়ে বেশি এবং সমাজের বহু ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা যেহেতু রাজারাজড়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়েই চলতেন, তাই মন্দির-চত্বরে দেবদাসীদের নৃত্যগীত সাড়ম্বরে চালু হয়ে যায়। কলহন ‘রাজতরঙ্গিণী’তে যে-সময়ে দেবদাসীর কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে মনে হয় অন্তত সপ্তম খ্রিস্টাব্দ থেকেই কাশ্মীরে দেবদাসীপ্রথা বংশানুক্রমে চলে আসছিল। কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্যের সময়কাল সপ্তম খ্রিস্টাব্দেই পড়বে। ললিতাদিত্য একটি অশিক্ষিত অশ্বকে শিক্ষিত করার জন্য একা এক বনের মধ্যে এসে পড়েছিলেন। সেখানে অন্তরাল থেকে তিনি দেখলেন এক জায়গায় একটি অসাধারণ সুন্দরী মেয়ে এসে গান গাইল এবং ততোধিক সুন্দরী একজন নাচতে লাগল—একাং দদর্শ গায়ন্তীং নৃত্যন্তীমপরামপি।
তিনি অবাক হলেন—এঁদের গীতনৃত্যের কোনো শ্রোতাই সামনে নেই, দর্শকও সামনে নেই এবং নৃত্যগীত সাঙ্গ হবার পর সেই দুই সুন্দরী বিশেষ স্থানটিতে কার উদ্দেশে যেন প্রণাম করে গেল। কৌতূহলী ললিতাদিত্য প্রতিদিনই ওই জায়গাটায় আসতে লাগলেন এবং একদিন শেষপর্যন্ত নিজের পরিচয় দিয়ে কন্যা দুটিরও পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। মেয়ে দুটি যা বলল—সেটাই হল দেবদাসীবৃত্তির প্রথাগত সংবাদ। তারা বলল—আমরা দুজনেই দেবালয়ের নর্তকী। এই সামনেই আমাদের গ্রাম। গ্রামের নাম বর্ধমান। আমরা কেন যে এখানে নাচগান করি তা আমরা নিজেরাও জানি না। এর কারণ শুধু পরম্পরা। আমাদের মায়েরা এবং তাঁদের মায়েরাও এইখানে নাচগান করে জীবিকানির্বাহ করেছেন, আমরা সেই মায়েদের নির্দেশ মেনে তাঁদের বংশজাত মেয়েরা সবাই এখানে প্রতিদিন নৃত্যগীত প্রদর্শন করি। বংশ-পরম্পরায় আসা সেই রীতিই আমরা চালিয়ে যাচ্ছি—রূঢ়িঃ পরম্পরায়াতা সেয়মস্মদগৃহে স্থিতা। কিন্তু আমরা বা অন্য কেউই আমাদের নৃত্যগীত প্রদর্শনের অন্য কোনো কারণ সম্বন্ধে কিছুই বলতে পারব না।
ললিতাদিত্য বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি খনক ডাকিয়ে সেই নাচবার জায়গাটা খোঁড়ালেন এবং সবিস্ময়ে দেখলেন—খননকার্যের ফলে সেখান থেকে দুটি মন্দির বেরিয়ে এল এবং সেই মন্দির দুটির অধিষ্ঠাতৃ দেবতা দুজন হলেন রাম এবং লক্ষ্মণ। তার মানে, একটি প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দিরে নর্তকীর শিল্পসাধনা আরম্ভ হয়েছিল ললিতাদিত্যের সমন্বয়ের অনেক আগে থেকে এবং পূর্বোক্ত নর্তকীদের স্বীকারোক্তিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ঘটনাটা, সেটা হল—নর্তকীরা বলেছে যে, তাদের মায়েরা বংশ বংশ ধরে মন্দিরে নাচতেন এবং তাদের জীবিকানির্বাহও হত ওই নৃত্যগীতের সুবাদেই, অপিচ সে মায়েদের নির্দেশেই তারাও লুপ্ত-ধ্বস্ত মন্দির ক্ষেত্রে নাচতে এসেছে—ইহত্যজীবনভুজাং মাতৃণামুপদেশতঃ।
এখানেই দেবদাসী হয়ে যাবার প্রথাগত বীজগুলি নিহিত আছে। দক্ষিণ ভারত এবং জগন্নাথক্ষেত্রে যেখানে দেবদাসীবৃত্তির মর্যাদা এবং সার্বত্রিকতা এই সেদিনও বর্তমান ছিল, সেই দক্ষিণ ভারত এবং পুরীর দেবদাসীদের জীবনপঞ্জী বিচার করে দেখা গেছে যে, মন্দির-অধিষ্ঠিত দেবতার সঙ্গে অথবা মন্দিরের কোনও পবিত্র দেবার্চনার বস্তুর সঙ্গে অথবা দেবতার অস্ত্রাদির সঙ্গেও দেবদাসীর বিয়ে হয়ে যেত। এই বিবাহ সমাধা হয়ে যেত কন্যা অবস্থায় কৈশোরগন্ধী বয়সেই—তখনও হয়তো সেই বালিকার নৃত্যগীতশিক্ষা সম্পূর্ণই হয়নি। দেবতার সঙ্গে এই বিবাহের মধ্যে সামান্য আড়ম্বরও কিছু ছিল এবং ছিল কতকগুলি অনুষ্ঠানও। দক্ষিণ ভারতে এই অনুষ্ঠানের অঙ্গ অন্তত ছটি—প্রথম হল দেবতা বা দেবাঙ্গীয় বস্তুর সঙ্গে বিবাহ যাকে ওঁরা বলতেন—’কল্যাণম’। দ্বিতীয় কন্যার উৎসর্গীকরণ বা ‘মুত্তিরাই’। তৃতীয় হচ্ছে দেবতার সামনে প্রথম নৃত্যশিক্ষার পাঠগ্রহণ। চতুর্থ, পায়ের নূপুর বা ঘুঙুরের পূজা, যাকে ওঁরা বলেন গেজ্জাইপূজা। পঞ্চম, নৃত্যশিক্ষার শেষে দেবতার সামনে প্রথম নৃত্যানুষ্ঠান—ওঁদের ভাষায় অরঙ্গেত্রম। ষষ্ঠ এবং শেষ অঙ্গটি হল একটি উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকের তত্ত্বাবধানে থাকা—এই পৃষ্ঠপোষক কোনো রাজাও হতে পারেন অথবা কোনো ধনী ব্যক্তি, যিনি দেবতার থানে নৃত্যগীতের বিনিময়ে সেই নৃত্যপটীয়সী সুন্দরীর ভোজন, শয়ন, বাসগৃহ এবং বিলাসের ব্যবস্থা করবেন।
দেবতার সঙ্গে বিবাহিত হওয়ার এই যে অনুষ্ঠান, এই অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন রীতি দেশ এবং সমাজভেদে বিভিন্ন রকম। এমনকী দেবদাসী মানেই সে শুধু নর্তকীই হবে, তারও কোনো অর্থ নেই। দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন শিলালিপি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়—অন্তত চার থেকে ছ রকমের দেবকার্যে দেবদাসীরা নিযুক্ত হতেন। তাঁর দেবতার অন্তরঙ্গ প্রিয়কার্য সাধন করতেন, কারও উপাধি ‘নর্তকী’, কারও বা ‘গায়কী’, কেউ শ্রীমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে চামর দুলাতেন—কোপ্পরম জেলায় কোদণ্ড-রামস্বামীর মন্দিরে এঁদের উপাধি ছিল চমরীকায়। আর একেবারে সাধারণ পর্যায়ের দেবদাসীকে বলা হত—সেবাবিলাসিনী দেওদাসা—এঁরা মন্দিরের সাধারণ অঙ্গকার্যে নিযুক্ত হতেন।
এমনকি কৈশোরগন্ধী বয়সে দেবদাসীর সঙ্গে মন্দিরাধিষ্ঠিত দেবপুরুষের বিবাহের পদ্ধতিও বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন রকম। যেমন দক্ষিণ ভারতের ‘ইসাই বেল্লাল’ নামে যে বিশিষ্ট সমাজ ছিল—যে সমাজ থেকে এককালে বহু সংখ্যায় দেবদাসীও সৃষ্টি হয়েছে এবং পরবর্তীকালে যে সমাজ থেকে বহু বহু বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীরও সৃষ্টি হয়েছে—সেই তাঁদের মধ্যে দেবতা এবং দেবদাসীর বিবাহটা ছিল অনেকটা আমাদের ‘রাইকমল’ সিনেমার ‘মালা-চন্দন’ করার মতো। কৈশোরগন্ধী যে যুবতী দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত হতেন, তাঁর গলায় পরিয়ে দেওয়া হত একটি গোলাপফুলের মালা যার ভিতরে থাকত ‘পোট্টু’—যা নাকি বিবাহের প্রতীক। কলকাতায় থাকতেন এবং ভরতনাট্যম শেখাতেন টি. রাজলক্ষ্মী—তিনিও তাঁর পূর্বগ্রাম তিরুভিদাইমরুদুর গ্রামে মহালিঙ্গেশ্বর শিবের সঙ্গে নিজের ‘রোজাপুমাল্লাই’ (সেই গোলাপের মালা গলায় দিয়ে বিয়ে) অথবা মালাচন্দনের কথা স্মরণ করে ইন্টারভিউ দিয়ে বলেছেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, ১৯২৮-২৯ সালে আমার জীবনেও এই ঘটনা ঘটেছিল। এই উৎসর্গের ঘটনাকে এরা বলত ‘পোট্টুকট্টু’।
দক্ষিণ ভারতে ‘পোট্টুকট্টু’ যেভাবে হয়, জগন্নাথ ক্ষেত্রেই তা একটু অন্যরকম। এখানে কিশোরী অবস্থায় একটি কন্যা জগন্নাথের কাছে উৎসর্গীকৃত হয়, তারপর সেই কন্যা যখন পুষ্পবতী হয়, তখন জগন্নাথস্বামীর সঙ্গে আসল বিবাহটি হয়। পাণ্ডারা একে বলেন ‘পুনঃ বিবাহ’। জগন্নাথের সেবার কাজে নিযুক্ত হতে গেলে প্রথম অঙ্গটি হল ‘শাঢ়ি-বন্ধন’। ‘শাঢ়ি’ মানে ‘শাড়ি’, জগন্নাথের গায়ের এক টুকরো কাপড়। এই কাপড়টুকু পাবার জন্য দেবদাসীর জননী গজপতি রাজার কাছে আগে থেকে দরখাস্ত করেন। রাজার অনুমতি পেলে রাজকর্মচারীরা মন্দিরের উচ্চকার্যে নিযুক্ত বড় বড় পূজা-পাণ্ডা বা দেউল্যা-করণদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তাঁরা উৎসর্গে কল্পিত কন্যাটির নৃত্যগীতের জ্ঞান পরীক্ষা করবেন এবং পরীক্ষা করবেন তার জাতি। সে যদি দেবদাসীরই গর্ভজাতা অথবা তার পালিতা কন্যা হয় তবে অসুবিধে নেই কোনো, কিন্তু তা না হলে কন্যাটি যাতে অন্তত জল-চল জাতের হয়—ওড়িয়া ভাষায় পাণিস্পৃশ্য বা পাণিছুয়া হয়—সে ব্যাপারে মতামত দেবেন পূজা-পাণ্ডারা। লিখিত মতামত যাবে রাজার কাছে। রাজা মত দিলে শুভ দিন দেখে উৎসর্গে কল্পিতা কন্যা সকালে উঠে স্নান করে গায়ে হলুদ মেখে উপবাস করে থাকবে। তারপর নতুন শাড়ি-গয়না, হাতে কাঁকন পরে সে বসবে গুরুদীক্ষার জন্য। দেবদাসীর গুরু কিশোরী কন্যাটির কাছে বসবেন—গুরু এবং শিষ্যার মাথার ওপর দিয়ে একটি কাপড় ঢেকে দিলে গুরু কন্যাটির কানে কানে মন্ত্র বলবেন। গুরুদীক্ষার পরে মেয়ের কপালে এবং নাকের ওপর চন্দনের ‘ছিট্টা’ দেওয়া হবে। অর্থাৎ এবার সে ‘শাঢ়ি-বন্ধন’-এর জন্য প্রস্তুত।
এবারে দেবদাসীর মা এবং দেবদাসীর পরিবারবর্গ সকলে মিলে মেয়েটিকে জগন্নাথের মন্দিরে নিয়ে যাবে পুবের দরজা দিয়ে, যাতে একেবারে নাটমণ্ডপের সামনে জগন্নাথের গর্ভগৃহের কাছে দাঁড়ানো যায়। অকুস্থলের মন্দিরী নাম ‘জয়-বিজয় দৌরা’ যেটাকে জগন্নাথের বাহার-পোখারিয়া’ বা ‘অ্যান্টিচেম্বার’ বলা যায়। এখানেই ‘শাড়ি-বন্ধন হবে। মন্দিরের প্রধান পাণ্ডা, যিনি জগন্নাথের ছত্রিশ রকম সেবা-নিয়োগের প্রধান, সেই পাট জোশী মহাপাত্র জগন্নাথের অঙ্গবস্ত্র এনে দেবেন। ব্রাহ্মণ-সেবক হলে তিনি নিজেই এই শাড়িবন্ধন করতেন, কিন্তু জাতি অন্য হলে অথবা স্ত্রীলোক হলে তাঁর হয়ে এই শাড়িবন্ধন করেন ‘করণ’ জাতির জগন্নাথসেবক চরচেইতা’। এই ব্যক্তি উৎসর্গে কল্পিতা বালিকাটির মাথায় জগন্নাথের অঙ্গবস্ত্র জড়িয়ে দেয় ফেট্টিবাঁধার মতো করে এবং গলায় পরিয়ে দেয় জগন্নাথের প্রসাদী মালা, নাকে-কপালে লাগায় চন্দনের ছিটে। তারপর বালিকার হাতে খানিকটা আতপ চাল (আরুয়া চাউল) দিয়ে তার ওপরে গোটা পান দিয়ে তাকে শ্রীমন্দির প্রদক্ষিণ করানো হবে। আতপ চাল আর পান আঁচলে (অন্টি) বেঁধে জগন্নাথের বধূকল্পা কিশোরী এবার বাড়ি ফিরবে। সঙ্গে দেবদাসী-মা, তার পরিবার পরিজন রীতিমতো শোভাযাত্রা করে আসবে। ‘মর্দলী’ বাজাবে দেবদাসীর ভাই, বাজনাদারেরা (বজনতারি) বাজনা বাজাতে বাজাতে পিছনে পিছনে আসবে। মেয়েরা উলু দেবে, ঘোষণা করবে জগন্নাথের নববধূর জয়কার।
এরপর ঠিক আমাদের বিয়ে বাড়ির মতো সব ঘটনা। বাড়ি ফিরে কিশোরী বধূ তুলসীতলায় আলপনা কাটা পিঁড়ির ওপর বসবে, পূর্ণ কুম্ভ দর্শন করবে, পুরোহিত মন্ত্র পড়ে পুজো করবে, মেয়েরা-বড়রা আশীর্বাদ করবে। আঁচলে বাঁধা মন্দির থেকে আনা সেই আতপচালের পায়েস রান্না হবে। জগন্নাথের মহাপ্রসাদ বিতরণ হবে সকলের মধ্যে। ভোজ চলবে সারা দিন ধরে। সন্ধ্যাবেলায় নববধূর নতুন অভিসার শুরু হবে। তবে এবার জগন্নাথ মন্দিরে নয়। একেবারে রাজার বাড়িতে। দেবদাসী-মা এবং তার পরিবার-পরিজনেরা মিলে মেয়েটিকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পুরীর রাজা কোনো গজপতি বংশধরের বাড়িতে উপস্থিত হবে। মেয়েটি রাজার কাছে বসবে এবং কোনো এক সময়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হবে রাজার শয্যাগৃহে এবং প্রতীকীভাবে সে রাজার শয্যা স্পর্শ করবে। দেবদাসীর ভাষায় এটা ‘সেজ মোরাইবা’। ফিরে আসবার আগে রাজা বালিকার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাবেন এবং বালিকাও তাঁর দিকে তাকাবে পূর্ণ দৃষ্টিতে। যেন মিলন সম্পূর্ণ হল।
দেবদাসী যদিও বলে—আমার বিয়ে হয়েছে জগন্নাথের সঙ্গে—আমে বিবাহ জগন্নাথঙ্ক সহিত—তাঁর সঙ্গেই আমার স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ, তবু রাজবাড়িতে যে চারিচক্ষুর মিলন, তাতে বোঝা যায় রাজাই হলেন দেবদাসীর জাগতিক স্বামী। পুরীতে রাজাকে বলা হয় জগন্নাথের প্রথম সেবক—আদ্য সেবক; সেইজন্য দেবদাসীর ওপরেও রাজারই প্রথম অধিকার। এই অধিকার প্রমাণ হয়ে যায় জগন্নাথের সামনে উৎসর্গীকৃত সেই কিশোরী দেবদাসীর প্রথম রজোদর্শনের পর। পণ্ডিতেরা গবেষণা এবং ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার থেকে প্রমাণ করেছেন যে, রাজা যদি ইচ্ছা করেন তবে দেবদাসীর প্রথম যৌন উপভোগটুকু তিনিই গ্রহণ করবেন। কারও মতে এই উপভোগ পুরীর মন্দিরের কোনো ব্রাহ্মণ পাণ্ডারও জুটতে পারে যদি তিনি পুষ্পবতী রমণীটির রজোদর্শনোত্তর উৎসবের ব্যয়ভার গ্রহণ করে থাকেন।
ঘটনা হল, রাজার থেকেও মন্দিরস্থ ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেবদাসীদের পরিচয় এবং যোগাযোগ বেশি থাকার বাস্তব কারণেই অনেক সময়েই তাঁরা জগন্নাথের স্থানাভিষিক্ত হয়ে দেবদাসীদের শারীরিক উপভোগ লাভ করতেন। কিন্তু উৎসর্গের দিনে যেভাবে একটি দেবদাসীকে সান্ধ্যসজ্জায় রাজার কাছে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর সঙ্গে শুভদৃষ্টি করতে হয় এবং প্রতীকীভাবে তাঁর শয্যা স্পর্শ করতে হয়, তাতে প্রথাগতভাবে জগন্নাথের আদ্য সেবক রাজারই প্রথম অধিকার থাকত দেবদাসীদের ওপর। তবে রাজা অনেক সময়েই বহু-বল্লভতার কারণে এমনিই এই সুযোগ নিতেন না, সেটা তাঁর ইচ্ছা। কিন্তু তাঁর অনিচ্ছা থাকলেও সমাজের তথা মন্দিরের পাণ্ডাঠাকুরদের সদিচ্ছা বা অসদিচ্ছা বাড়ত। কখনও বা অন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও মহাপ্রসাদ থেকে বঞ্চিত হতেন না। দেবদাসীরা আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে বিয়ে করত না, কারণ জগন্নাথের সঙ্গেই তাঁদের স্বামী-স্ত্রী সম্বন্ধ। আবার আনুষ্ঠানিকভাবে তারা সন্তান ধারণ করতেও চাইত না। অবৈধ এবং বৈধ সন্তান যা হত—সকলকে তারা দত্তক বলে চালাতে চাইত। অবশ্য দেবদাসীদের মধ্যে দত্তক নেওয়ার চলও খুব বেশি—যদিও সে একেবারেই অন্য প্রশ্ন।
আর একটা সংবাদ খেয়াল করার মতো, সেটা হল—যেদিন জগন্নাথের নৃত্যমণ্ডপে তাঁদের নৃত্যসেবার পালা থাকত, তার আগের দিন থেকে হবিষ্য-উপবাসাদি করে দেবদাসীরা দেহ পবিত্র করার চেষ্টা করত। কিন্তু নৃত্যগীতের পালা মিটে গেলে অন্যের সঙ্গে দেহসম্ভোগকার্যটি সামাজিকভাবেই প্রায় অনুমোদিত ছিল—যদিও রাজার অফিসার—দোসন্দি পরিচ্ছা—সবসময় খেয়াল রাখত—কার সঙ্গে দেবদাসীর অন্তর বিনিময় ঘটছে। মন্দিরের বাইরে এই যে উপজীবন—সেখানেও জল-চল বা ‘পাণি-ছুয়া’ ব্যক্তি ভিন্ন অন্য কোনো নিম্নবর্গীয় ব্যক্তির সঙ্গে তাদের যৌনসম্বন্ধ ঘটছে কি না, সে বিষয়ে খেয়াল রাখাটাও ‘দোসন্ধি-পরিচ্ছা’র কর্তব্য ছিল। তবে হ্যাঁ, দেবদাসীর সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করত প্রধানত এই বহিঃসম্বন্ধের ওপরেই। মন্দিরের বড় বড় পাণ্ডা ঠাকুর, রাজা বা রাজপুরুষ যে দেবদাসীর সম্ভোক্তা হতেন, তার সামাজিক মর্যাদা সবচেয়ে বেশি।
প্রথাগতভাবে দেবদাসীরা কখনও আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করতে পারত না। কী দক্ষিণদেশে, কী শ্রীক্ষেত্রে সর্বত্রই মন্দিরদেবতার সঙ্গেই যেহেতু তাদের বিবাহসম্বন্ধ ঘটে যেত, তাই তারা কখনও বিধবাও হত না। দেবদাসীরা শুভ এবং মঙ্গলের প্রতীক, তাদের বলা হয় ‘নিত্যসুমঙ্গলা’। বিবাহ এবং অন্যান্য শুভকার্যে তথা বিভিন্ন উৎসবেও তাদের ডাক পড়ত নৃত্যগীত পরিবেশনের জন্য। লক্ষণীয় ব্যাপার হল—বহির্মন্দিরে দেবদাসীর উপজীবন গণিকাতুল্য বলে গণ্য হলেও একদিকে মন্দিরদেবতার সঙ্গে তার সংযোগ এবং অন্যদিকে নৃত্যগীতের মতো অসাধারণ শিল্পাঙ্গের সঙ্গে তাদের আন্তরিক সম্বন্ধ থাকায় দেবদাসীদের জীবনে ভিন্ন ধরনের এক মর্যাদাও যেমন প্রতিষ্ঠিত ছিল, তেমনই তাদের সম্বন্ধে কাজ করত এক বিপ্রতীপ সামাজিক বোধ।
বস্তুত জগন্নাথক্ষেত্র এবং দক্ষিণ ভারতের দেবদাসী বৃত্তি পর্যালোচনা করলে যে পার্থক্যটা বোঝা যায় সেটা হল—জগন্নাথের দেবদাসীদের মধ্যে মন্দির-নৃত্যের যে ভূমিকাটুকু তার মধ্যে ধর্মীয় প্রভাব বেশি। জগন্নাথের বিভিন্ন যে সেবা-অঙ্গীয় কর্ম আছে—ভোগ রান্না করা, বেশ-প্রসাধন, মাল্যদান অথবা চামর দুলানোর মতো নৃত্যগীতও সেখানে একটি সেবার আঙ্গিক। ওড়িশি নৃত্যের ক্ষেত্রে জগন্নাথের দেবদাসী-নৃত্যের প্রভাব যথেষ্টই আছে, কিন্তু সে নৃত্যেও ওড়িশার নিজস্ব সংস্কৃতি এবং স্বয়ং জগন্নাথও নায়কোচিতভাবে যতখানি গুরুত্বপূর্ণ, দেবদাসীরা ততটা নন। গজপতি রাজারাও বিশিষ্টভাবে এখানে নৃত্যকে যতখানি শৈল্পিক দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছেন, তার থেকে বেশি জগন্নাথের নৃত্য-সেবার মর্যাদা দিয়েছেন।
কিন্তু দক্ষিণ ভারতের দেবদাসীদের দেবতার উদ্দেশে নৃত্যগীত প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ধর্মদৃষ্টি যতখানি জাগ্রত, তার থেকে এখানে বড় হয়ে উঠেছে দেবতার উদ্দেশে শিল্পের নিবেদন। তার মধ্যে রাজা-রাজড়াও এখানে নৃত্যকলার অত্যন্ত রসিক হওয়ায় মন্দিরে নিযুক্ত দেবদাসীকে বিভিন্ন সময়ে ডেকে আনতেন নৃত্যগীত আস্বাদনের জন্যই। দক্ষিণ ভারতে দেবদাসীরা যেভাবে আঙ্গিকের মাধ্যমে দেবতার উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত হতেন, সেখানেও ধর্মভাবনার চেয়ে অতিরিক্তভাবে আছে নৃত্যের আঙ্গিকগুলি। উৎসর্গের দিনে ঘুঙুরপূজা (গেজ্জাইপূজা) এবং নৃত্যের প্রথম পাঠ নিয়ে যে দেবদাসীর জীবন আরম্ভ হচ্ছে, সে যেদিন প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রথম নাচটি ঠাকুরের সামনে নাচবে, সেই ‘অরঙ্গেম’-এর দিনেই কিন্তু দেবদাসী তার একজন অনুগত পৃষ্ঠপোষক বেছে নেবে। এই পৃষ্ঠপোষক যেমন দেবদাসীর দেহসম্ভোগের অধিকার পেতেন, তেমনই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁর নৃত্যকলার রসজ্ঞ হতেন। পণ্ডিতেরা উল্লেখ করেছেন যে, বিবাহিত গণ্যমান্য ধনী পুরুষেরাও একটি দেবদাসীর পৃষ্ঠপোষক এবং একই সঙ্গে সম্ভোক্তা হতে গর্ব বোধ করতেন, এমনকী সেই ব্যক্তির স্ত্রী কিংবা পরিবারবর্গও স্বামীর এই পৃষ্ঠপোষণা মেনে নিতেন—কখনও ভালো মনে, কখনও অনাদরে।
১৮০৭ সালে হ্যামিলটন বুকানন তাঁর দক্ষিণযাত্রার বিবরণ দিয়ে লিখেছেন—এখানকার ব্রাহ্মণদের বউরা যথেষ্টই সুন্দরী। কিন্তু তাঁদের স্বভাবচরিত্র এমনই জরদগব ধরনের যে তাঁদের স্বামী নৃত্যশিল্পী যুবতীদের সঙ্গ পছন্দ করেন। ঘটনা হল—তাঁরা স্বভাবেই জরদগব ছিলেন নাকি তাঁদের জরদগব করে রাখা হত। ভদ্রঘরের কোনো মেয়েকে সেকালে লেখাপড়া শেখানো হয় না, নৃত্যগীতের প্রশিক্ষণ তো চরিত্র হননের শামিল। অন্যদিকে দেবদাসীরাই ছিলেন সেখানে সবচেয়ে প্রগলভ ব্যক্তিত্ব। যৎসামান্য পড়াশুনো থেকে নৃত্যগীতের কলাক্ষেত্রটি তাঁদেরই দখলে ছিল। অন্যদিকে রাজারাজড়া থেকে আরম্ভ করে বহু বহু ধনী-গুণী মানুষ দেবদাসীদের পৃষ্ঠপোষক হওয়ায় দেবদাসীদের নৃত্যকলার মর্যাদা দক্ষিণভারতে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কলহনের ‘রাজতরঙ্গিনী’র প্রথম তরঙ্গে দেখুন—কাশ্মীরের রাজা জলৌক যখন ভগবান জ্যেষ্ঠরুদ্রের সামনে নর্তকীদের পরিবেশিত নৃত্যগীত দেখতেন, তখন তাঁর এত আনন্দ হত যে, তিনি তাঁর অন্তঃপুরবাসিনী রমণীদেরও তাঁদের সঙ্গে নাচতে উঠিয়ে দিতেন—প্রদদৌ জ্যেষ্ঠরুদ্রায় সো’ বরোধবধূশতম।
ঠিক এতটা না হলেও, দক্ষিণ ভারতীয় রাজারাজড়াদের মধ্যে নৃত্যকলার এই উন্মাদনাটা কাজ করেছে এবং তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতার দরুন দক্ষিণ ভারতীয় দেবদাসী নর্তকীদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এবং সামাজিক মর্যাদা শ্রীক্ষেত্রের দেবদাসীদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। এখানে সামাজিক মর্যাদা মানে অবশ্যই এই নয় যে, সংরক্ষণশীল সমাজের চোখে তাঁরা খুব উন্নত পর্যায়ে গণ্য হতেন, বরঞ্চ এই মর্যাদাকে সামাজিক না বলে সাংস্কৃতিক বলাই ভালো। কেননা দক্ষিণভারতীয় দেবদাসীদের নৃত্যপ্রশিক্ষণের মধ্যে এমনই এক চটক ছিল, যা মন্দিরদেবতাকে যতখানি তুষ্ট করত, ঠিক ততখানিই তৃপ্ত করত নৃত্যকলারসিকের মন। পণ্ডিতেরা গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে, আজকে ভরতনাট্যম বলে যে বিশেষ নৃত্যকলা সসম্মানে বিস্তার লাভ করেছে, তার মৌল রসভাবগুলি দেবদাসীদের নৃত্যকলারই অন্তর্ভুক্ত ছিল। দেবদাসীনৃত্যের মধ্যে শৃঙ্গারের রসায়ন একটু বেশিই ছিল এবং পরবর্তীকালের ভরতনাট্যম-এর নৃত্যশিল্পীরা শৃঙ্গারের ওই অতিরেকটুকু ছেঁটে দিয়ে সেই নৃত্যের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছেন মূল রসভাব অবিকৃত রেখে। ১৯২০ সাল থেকে সরকারি বিধান অনুযায়ী দেবদাসীদের চিরাচরিত বৃত্তিতে কিছু সমস্যা আসে এবং পর পর এই সমস্যাগুলি বাড়তেই থাকে। মন্দিরে কিশোরী কন্যার উৎসর্গীকরণ বন্ধ হয়ে যায় বরং মন্দিরের মধ্যে দেবদাসী-পুরোহিতদের ভ্রষ্টাচারের নিরিখে সমাজ এবং সরকারও দেবদাসীবৃত্তির সংস্কারসূচি গ্রহণ করে।
দেবদাসীবৃত্তির সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে লক্ষণীয় ঘটনা যেটা ঘটেছিল, সেটা হল দেবদাসী-নৃত্যকলারও সংস্কার। অতিরিক্ত শৃঙ্গাররসাশ্রিত যে নৃত্যকৌশল দেবদাসীদের প্রধান অবলম্বন ছিল সেই নৃত্য পরিশীলিত হয়ে প্রায় নতুন এবং নিরপেক্ষ এক নৃত্যশিল্পের সৃষ্টি হল—যার পরিণতি ঘটল ভরতনাট্যমের মধ্যে। দেবদাসীরা যে ভরতনাট্যমের মৌলরূপটুকু তাঁদের নৃত্যকলায় ফুটিয়ে তুলতেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ আছে কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’তে দেওয়া ঐতিহাসিক উপাদানে। সেখানে দেখা যাচ্ছে—কাশ্মীররাজ জয়াপীড় তাঁর শ্যালকের অত্যাচারে বিভ্রান্ত হয়ে একসময়ে গৌড়দেশে এসেছিলেন। আজকাল অনেকে যাঁরা বিভিন্ন নৃত্যের মধ্যে গৌড়ীয় রীতি দেখতে পান, তাঁরা ‘রাজতরঙ্গিণী’র এই অংশটুকু খেয়াল করবেন। গৌড়দেশে ঘুরতে ঘুরতে জয়াপীড় হঠাৎ একসময় এক কার্ত্তিকেয়র মন্দিরের সোপানে বসে পড়েন। সেখানে কমলা নামে এক দেবদাসী নৃত্য করছিল। সেই নৃত্যভঙ্গির মধ্যে ভরতানুমোদিত নৃত্যকলার প্রয়োগ দেখেই জয়াপীড় কমলার নৃত্য দেখতে কৌতূহলী হন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় গৌড়দেশেও যে-নৃত্যকলার প্রচলন ছিল তাও ভরতানুমোদিত নৃত্যকলা। অবশ্য পরবর্তীকালে যেটাকে আমরা ভরতনাট্যম বলেছি, তার মধ্যেও সম্পূর্ণ ‘ভরত’ নেই, বরঞ্চ দেবদাসীদের নিজস্ব রীতি সেখানে ‘ভরত’কে সমৃদ্ধ করেছে। সামাজিক সংস্কারের ফলে বিধিবদ্ধ দেবদাসীনৃত্য যেমন অনেক ক্ষেত্রে ভরতনাট্যমে রূপান্তরিত হয়েছে, তেমনই দেবদাসীরাও অনেকে মন্দিরের প্রাঙ্গণ থেকে বেরিয়ে এসে বিভিন্ন দেশে নৃত্য প্রদর্শনী করতে আরম্ভ করলেন এবং তাঁদের শিল্পের ব্যক্তিগত ধারা এবং কৌশলও তৈরি হয়ে গেল। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অনেক নৃত্যশিল্পীরই নাম করা যায় যাঁরা প্রথম জীবনে দেবদাসী ছিলেন এবং পরবর্তীকালে প্রত্যেকে ভরতনাট্যমের এক-একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। কয়েকটা এমন নাম হল—পি. কল্যাণী, পি. কে. রাজলক্ষ্মী, এম. ডি. গৌরী, কে. ভানুমতী, টি. বালাসরস্বতী, স্বর্ণসরস্বতী প্রমুখ। পরবর্তীকালে নিজেদের জীবনবৃত্তি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এঁরা অনেকে বিয়ে-থা করে সংসারীও হয়েছেন এবং আপন সন্তান প্রতিপালন করে বাৎসল্যেরও তুষ্টি ঘটিয়েছেন।
রামগড়ের গুহালিপিতে দেবদাসী সুতনুকার উদ্দেশে দেবদীন্ন (দেবদীর্ণ) যে ভালোবাসাটুকু খোদাই করেছিল, তাতে বোঝা যায় যে, দেবদীন্ন সুতনুকার সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পারেনি এই কারণেই যে, সুতনুকা নিশ্চয়ই নৃত্যের কারণে দেবতার কাছে আত্মপ্রদত্ত ছিল। এই আত্মদান এতটাই যে, যখনই কোনো কবি-রসিক তাঁর নিজস্ব কবিকর্মের নৃত্যরূপ দিতে চেয়েছেন, সেখানেও প্রধান সহায় ছিলেন এই দেবদাসীরাই। এই পাঁচশো বছর আগেও দক্ষিণ-দেশ থেকে পুরীতে আসা রামানন্দ রায় যখন তাঁর স্বকৃত জগন্নাথবল্লভ নাটকের অভিনয় করাতে চাইলেন, তখন কিন্তু তিনি স্মরণ করেছেন জগন্নাথক্ষেত্রের দুই দেবদাসীকে। যিনি পুরুষোত্তম চৈতন্যদেবকে ‘ন সো রমণ ন হাম রমণী’-র গান শুনিয়েছিলেন, সেই অন্তরবৈরাগীর পক্ষেই হয়তো সম্ভব ছিল নির্বিঘ্নচিত্তে দেবদাসীদের অঙ্গ সংস্কার করা অথবা স্বহস্তে তাদের কেশসংস্কার করে অভিনয়োচিত বেশবাস পরানো। চৈতন্যচরিতামৃতের কবি কী সুন্দর করে বর্ণনা করেছেন সেই নাটকের নেপথ্যে সেই দৃশ্য। রামানন্দ রায় স্বহস্তে দেবদাসীর কপালে, অঙ্গে অলকা-তিলকার চিহ্ন এঁকে দেবদাসীদের অভিনয় নৃত্য করতে নামিয়েছেন প্রভু জগন্নাথের সামনে—উদ্দেশ্য—জগন্নাথকেই নন্দিত করা।
জোগীমারার গুহায় হতভাগ্য দেবদীন্ন বুঝি এইজন্যই কবিদের ওপর রাগ করেছিল। দেবদীন্নের একটি প্রেমদীর্ণ হৃদয় থাকা সত্ত্বেও সে তার প্রণয়িনীকে শুধু দেবতাকেই নন্দিত করতে দেখেছে, কিন্তু দেবদীন্নের সঙ্গে মিলিত হতে চাইলেই সুতনুকার নামে লাগে কলঙ্ক। মর্ত্য ভাস্কর চিত্রকর তাই সদম্ভে প্রচার করে গেছে—সুতনুকা যতই তার দেবতাকে নন্দিত করুক, দেবতা তার প্রতিদান দেননি নিশ্চয়ই। কিন্তু দেবদীন্ন সুতনুকাকে ভালোবাসে।