ন্যাদোশের জন্মদিন
সকালবেলা উঠে (আমার সকাল আটটায় হয়) তিনটে বাংলা আর দুটো ইংরিজি কাগজ ওল্টাই। সেইসঙ্গেই কম করে চার কাপ চা খাই। আর সেটাই হল শ্রীমতী ন্যাদোশের অ্যানুয়েল ভিজিটের সময়।
এ—কথা তো ‘সন্দেশ’—পড়ুয়ারা জানোই। কখন ন্যাদোশ আসে! ‘সন্দেশ’—এর পড়ুয়া মানে ১০ থেকে ৬০—সব বয়সের পড়ুয়া!
কী? আজকালকার বাচ্চারা বাংলা পড়ে না? শুনছি না—শুনব না। মানছি না—মানব না। কেন জানো? শান্তনু ত্রিপাঠী একজন বেজায় ভালো ডাক্তার। তাঁর ১৪—১৫ বছরের মেয়ে দেবলীনা, ছোট্ট বয়স থেকে আমার বই পড়ছে আর পড়ছে। তার সঙ্গে সেদিনও ফোনেও কথা হল।
গোদা কথা এই—বাঙালি ছেলেমেয়ে বাংলা বই পড়ছে, এর চেয়ে ভালো খবর কী দিতে পারতাম? খবরটা তোমাদের পুজোর উপহার।
যাক গে! পুজোর ‘সন্দেশ’ কাগজে ন্যাদোশের গল্প লিখতেই হবে। এ একটা জঘন্য অভ্যেস! লিখতেই হয়, কেন—না সে—সময়েই তিনি এসে উদয় হন।
ন্যাদোশ ওইরকমই। হ্যাঁ, মানছি তুমি ভারতের, বা এশিয়ার, হয়তো গোটা দুনিয়ার প্রথম মাছ—মাংসখেকো গোরু! কিন্তু এটাও তো মনে রাখবে—৫০ বছর আগে পৃথিবীকে টা—টা জানিয়ে তুমি গো—লোকে, অর্থাৎ গোরুদের স্বর্গে চলে গেছ!
সে—সব ভুলে প্রতিবছর আসছ তো আসছই। বাড়ি বদল করছি। মোটে নিস্তার নেই। ঘোরানো সিঁড়ির সেই বাড়িতে ২৭ বছর থাকলাম! তারপর এলাম ছায়াঢাকা ঠাণ্ডা একটা একতলা বাড়িতে। সেখানেও তুমি। এখন কী সুন্দর একটা দোতলা বাড়িতে এসেছি। সেখানেও তুমি!
আছ ভালো। চলতে—ফিরতে পয়সা লাগে না। হাওয়ায় ভেসে চলে আসো! এই—তো আজই…
আমার শোবার খাট আর লেখার টেবিলের মাঝখানের জায়গাটা খুবই ছোট, খুব! সেখানে ন্যাদোশ ল্যাগবেগে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে পড়ল। বলল, ‘ঘন ঘন বাড়ি পাল্টাচ্ছ কেন, বলতে পারো? তিন বছরে দুটো বাড়ি বদল? এর মানে কী?’
‘তোমার তাতে কী? তুমি তো আসছই।’
‘সে তো আসতেই হবে। বুঝলে না? হাজার হলেও তোমাদের গোরুই ছিলাম। মাছ বলো, মাংস বলো—কী খাইনি?’
‘গো—লোকে তো নিরামিষ!’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, মাছ—মাংসের পাট নেই। যে—সব ফল তরিতরকারি খাই, সে—যে কী…’
‘ভালোই হয়েছে।’
‘সে তো বটেই। এখন তো সর্বত্র লিখছে—নিরামিষ খাও। আর ধরাধামে যত মাছ—মাংস, তার তেমন সোয়াদ নেই। তা… তোমার নাতির একটা খোকা হয়েছে!’
‘সে—খবরও রাখো?’
‘কোন খবরটা রাখি না? তাকে দেখেই এলাম। দিব্যি ছেলে! আশা করছি, তোমার নাতির মতোই বিচ্ছু হবে। ঘুমোচ্ছিল বটে! দারুণ তেজি তেজি ভাব। দ্যাখো, তোমাদের পরিবারে কে কোথায় কেমন আছে, সে—খবর রাখাটা আমার কর্তব্য।’
‘তোমার উচ্চারণও বদলে যাচ্ছে।’
‘ভালো হচ্ছে, না মন্দ?’
‘ভালো হচ্ছে।’
‘আমি গো—লোকে ‘যে—যার মাতৃভাষা পড়ো’—এ—নিয়ে খুব বলছি। বাংলার বাছুর, বাংলা পড়ো—’
‘হ্যাঁ, বাঙালি শিশুরা তো ভুলে যাচ্ছে সব!’
‘যাক, ভুলে যাক। আবার বাপ—বাপ বলে বাংলা পড়বে সবাই। গো—লোকে সব বাঙালি বাছুর সকালবেলা ‘ভোর হল দোর খোলো, খুকুমণি ওঠ রে—’ গড়গড়িয়ে বলে।’
‘সে কী?’
‘শুধু কী বাংলা? হিন্দি উর্দু মারাঠি তামিল—স—ব ভাষায় ওরা বলে। তোমাদের মতো নয়। ওখানে সব বাছুরকে আটটা ভারতীয় ভাষা জানতে হয়।’
‘বাঃ!’
‘বললাম, ওদের শিশুপাঠ্য বই খেতে দাও। আমার কথা মানল কোথায়?’
‘তুমি সমাজসেবী হয়ে গেলে?’
‘বলতে পারো, বলতে পারো। সেইজন্যেই তোমার কাছে এলাম।’
‘অর্থাৎ, মতলব নিয়ে এসেছ তো?’
‘মতলব শব্দটা সন্দেহজনক। বলতে পারো, কাজ নিয়ে এসেছি।’
‘কাজটা কী?’
‘যাদের কাজ, তারাই বলুক। পাখাটা বাড়িয়ে দাও। একে তো তোমাদের দুনিয়ায় বাতাসে দূষণ, তায় নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। পাখাটা বাড়িয়ে দাও। ওই যে, দ্যাখো কে এলেন!’
ন্যাদোশের মুখের কথা ফুরোয়নি। অমনি লাফ মেরে চলে এলো একটা পেল্লায় বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
আর ন্যাদোশ বলল, ‘এই যে! ইনি হলেন দ্য গ্রেট আলবার্ট অব দ্য গ্রেট জুবিলি সার্কাস!’
আমার মুখে বাক্যি নেই। ন্যাদোশ আসে গো—লোক থেকে, সে তো জানি। ইনি এলেন কোথা থেকে? বাঘরাও কি স্বর্গে যায়?
আমার মনের কথা বুঝে নিয়ে ন্যাদোশ বলল, ‘যায় বইকী। জগদ্ধাত্রী বাঘে চাপেন না? তাঁর বাহন তো স্বর্গেই যাবে। সত্যি, কী—যে লেখাপড়া শিখেছিলে!’
‘স্যরি।’
বাঘটা বলল, ‘একটু পরিচয় দিই?’
‘দিন।’
‘দেখুন, আমি উচ্চবংশের বাঘ। জিম করবেটের বই নাকি পড়েছেন?’
‘পড়েছি।’
‘ওই—যে ‘কানহার মানুষখেকো বাঘ’—এর গল্প পড়েছেন? আমি তেনারই বংশধর বটে!’
‘ও! নমস্কার, নমস্কার।’
‘তিনি যে কে হতেন, সে বলতে পারব না। যা—হোক, আমি হলাম আলবার্ট। জুবিলি সার্কাসের আলবার্ট। সার্কাসের বাঘ হলেই সাহেবি নাম হবে, বুঝলেন? পান্না সার্কাসে ছিল এডওয়ার্ড। গ্রেট ন্যাশনালে ছিল মাইকেল—’
‘বুঝলাম, বুঝলাম। তা আমার কাছে কেন? আমি…মানে…কী করব?’
আলবার্ট বলল, ‘উনিই বলবেন।’
‘ন্যাদোশ?’
‘উনি আমাদের মন্ত্রণা দেন, কাউনসেলিং করেন। ওঁর পরামর্শ নিয়েই চলি।’
‘বাঘকে উপদেশ দেয় গোরু?’
ন্যাদোশ মুচকি হাসল।
আর আলবার্ট বলল, ‘উনি শিক্ষিত গোরু। হাই কোয়ালিটির মাছ—মাংস খেতেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়তেন। সে—কথা আমরা আপনার বই পড়ে জেনেছি।’
‘বুঝলাম, বুঝলাম! কিন্তু আমি…কেন?’
‘আমাদের…মানে বাঘেদের অনেক অভিযোগ আছে। তা তিনি আপনাকে লিখতে হবে।’
‘মানে…মরা বাঘদের নিয়ে?’
‘আজ্ঞে না। মেরে তো শেষ করে এনেছেন। যে—ক’টা জ্যান্ত আছে, তাদের কথাই লিখবেন। ন্যাদোশ, তুমিও বলো না গো।’
‘শুরু করো, আমি আছি।’
‘বেশ।’
ন্যাদোশ একটা চেয়ারে দু’—ঠ্যাঙে দাঁড়ায়। আলবার্টকে বলে, ‘তুমিও দাঁড়াও হে! আমি একলাইন বলব, তুমি একলাইন বলবে। বুঝলে? এবার শোনো—আজ আমরা বাঘদের অভিযোগ জানাতে চাই। তাদের কথাই বলব—যারা আজও বেঁচে আছে…এবার তুমি।’
‘জঙ্গলে যে—ক’জন ছিল, তারাও মারা পড়ছে। বাঘ মারছে। তার নখ, দাঁত, চামড়া বিক্রি করছে। আর সার্কাসে বাঘের খেলা…’
‘বন্ধ করে দিল? তাহলে আর…’
‘রইল কী? সার্কাসে বাঘ নেই, মানুষ কি মানুষ দেখতে যাবে?’
আমি কানে হাত—চাপা দিলাম। কিন্তু ন্যাদোশ আর আলবার্টকে থামাবে কে?
ন্যাদোশ বলল, ‘সার্কাসে যে বাঘগুলো ছিল তাদের রেখেছে…’
‘ছোট ছোট খাঁচায়! নড়াচড়ার জায়গা নেই।’
‘পেট ভরে খেতেও দেয় না। তাই আমরা বলব—
বাঘের খেলা খতম কিনা
সে—সব কথা মানব না।
বাঘের চাই বিশাল খাঁচা
বাঘের চাই জবর খানা।’
‘বুঝলাম। বুঝলাম। বলবে কার কাছে?’
‘আন্তর্জাতিক ব্যাঘ্রাধিকার কমিশনের কাছে। তাই করাই তো নিয়ম।’
‘ইয়ে…’বাঘ বাঁচাও’ নাম কোনও কমিশন কি হয়েছে?’
আলবার্ট বলল, ‘নিশ্চয়ই হয়েছে। ন্যাদোশ বলছে, তুমি তা লিখেছ যেন কোথায়!’
‘বাজে কথা।’
ন্যাদোশ বলল, ‘আলবার্ট, আমি—চারঠেঙোরা তো লিখতে জানে না। তুমিই লিখতে বসে যাও।’
‘হ্যাঁ, বসে যাও।’ বলেই আলবার্ট এক হুঙ্কার ছাড়ল।
আমি—কী আশ্চর্য—বেজায় ভয় পেলাম। বললাম, ‘কমিশনটা হল কোথায়?’
আলবার্ট বলল, ‘কেন? পরলোকে?’
ন্যাদোশ বলল, ‘তোমাকে জানানো যায়নি। তোমার কি ই—মেল আছে? যা হাড়কিপটে! দ্যাখো, লেখালেখি তোমাকেই করতে হবে। নইলে—’
‘লিখব।’
‘এই তো, পথে এসেছ। কথা রেখো কিন্তু…নইলে যত বাঘের গল্প পড়েছ, সব্বাইকে পাঠাব।’
‘বাঘে আর গোরুতে এতই বন্ধুত্ব?’
‘আমরা কি মানুষ নাকি? হিংসে নেই, ঝগড়া নেই, যে—যার জিগরি দোস্ত! মানুষ তা পারবে?’
তারপরই ন্যাদোশ বলল, ‘কেমন ঘাবড়ে দিলাম? এটা আমার জন্মদিনের সারপ্রাইজ।’
তারপর?
ন্যাদোশ নেই! আলবার্ট নেই!
ভাবছি, বাড়ি বদলে গো—লোকে যাব নাকি!
তোমরা কী বলো?