ন্যাদোশের গল্প
”সন্দেশ” কাগজে না লিখলে মন খুঁৎখুঁৎ—অথচ গল্পরা সব কোথায় যেন পালিয়েছে, তাদের খোঁজ পাচ্ছি না মোটে। এসব কথাই ভাবছিলাম, এমন সময়ে চলে এল ন্যাদোশ।
ন্যাদোশাকে তোমরা হয়তো জানো না। জানবে বা কী করে? ন্যাদোশ হোল গে ভারতের, হয়তো দুনিয়ারই প্রথম গোরু, যে মাছ—মাংস খেত। না, ধাপ্পা দিচ্ছি না। কেন না ন্যাদোশ ছিল আমাদের বাড়ির গোরু। কবে কোন আদ্যিযুগে, সত্যজিৎ রায় যখন ”সন্দেশ” সম্পাদনা করছেন, একটা গল্প লিখতে বললেন।
তখন আমি বেকার, যাকে বলে কেজোকর্মা ছিলাম। অর্থাৎ চটপট লিখতে পারতাম। ভাবলাম, ছোটদের জন্যে যখন লিখব, সত্যি ঘটনাই লিখি। তাই ন্যাদোশের গল্প লিখে ফেললাম।
বলছি, ”সত্যি ঘটনা,”—লিখলাম ”গল্প”। তোমরা জিগ্যেস করতেই পারো, গল্প কি সত্যি হয়?
হয়। হয়। যত গল্প পড়ো, স—ব সত্যি।
যাক গে,—”ন্যাদোশ পুরাণ” নামে যদি কোনো বই বেরোয়, তাতে ন্যাদোশের গল্প স—ব থাকবে। সত্যজিৎ রায় নেই। তাই ন্যাদোশের ছবি কে আঁকবে তা জানি না। আঁকলে আঁকবে। না—আঁকলে না—আঁকবে। যাক গে, ব্যাপারটা হোল এই। প্রতি বছর পুজোর আগে ন্যাদোশ চলে আসে।
কোথা দিয়ে যে ঢোকে, তাও জানি না। দিব্যি চলে আসে। সেই ল্যাগবেগে পা, খ্যাটখেটে ল্যাজ আর ট্যারা চোখ। আমি কখন লেখার টেবিলে বসি, ও তা জানে। যথারীতি ঢুকল জানলা দিয়ে। চার ঠ্যাং ছেতরে বসে পড়ল। আমার বাড়ি যে দোতলায়, তাতে ওর কোনো অসুবিধে হোল না। কবেই বা হয়েছে! যখন ইচ্ছে, তখনি চলে আসে।
এসেই বলল, ক্যাট আনড টাইগার আর দি সেম।
বললাম, ন্যাদোশ! সেই কবে তুমি গো—লোকে, অর্থাৎ গোরুদের স্বর্গে গেছ। আসই বা কেন? বকই বা কেন?
—বাঃ! তোমার ভাইবোনদের বইখানা খেয়েই তো শিক্ষিত হয়ে গেলাম। জানো, কচ্ছপের ইংরিজি কী?
—ওঃ! ন্যাদোশ! জ্বালিও না।
ন্যাদোশ বলল, তোমার লেখা বই পড়েই তো গোলোকের, মানে গোরুদের স্বর্গের, মানে হেভনের সবাই ক্ষেপে গেছে। আমাকে এখন ওই অশিক্ষিত গোরুদের ইংরিজি পড়াতে হচ্ছে।
—সত্যি?
—নিশ্চয়!
—কেন ওরা ইংরিজি শিখে কী করবে?
—প্রোমোশান চায়, প্রোমোশান!
—এ কথার মানে কী?
—ওরা অকসফোর্ড যাবে, কেমব্রিজ যাবে, হারভার্ড যাবে। যাবেই তো! ও সব জায়গার গোরুদের মেজাজ কী! হবে না? বেটারা ক্রিকেট খেলে, টি. ভি. দেখে!
—বলছ কী?
—যাও, দেখ, বোমকে যাবে! যা তোমরা করবে, তাই ওদের করা চাই। চ্যাংড়া চ্যাংড়া বাছুর সব, প্রত্যেকের কানে আটা মোবাইল। ভাবতে পারো?
—না ন্যাদোশ!
ন্যাদোশ হঠাৎ সামনের ঠ্যাং তুলে কানে ঢোকাল। ন্যাদোশ তো জানো, আমার খাটে বসে, মেঝেতে বসে। ঘরে যারা ঢোকে, তারা ওর ভেতর দিয়েই চলাফেরা করে। এমনটা তো হয়ই। যে ন্যাদোশ চলে গিয়েছিল, সে তো গোরুদের স্বর্গ গোলোকে গেছে।
গোলোক চমৎকার জায়গা! সেখানে খাওয়াদাওয়া বেজায় ভালো। এনতার ফল খায় ন্যাদোশরা। ন্যাদোশের ভেতর দিয়ে শৈলী ঘর ঝাঁট দিল। বেরিয়ে গেল। আমার নিজের মোবাইল নেই, ন্যদোশ তার কান থেকে মোবাইল বের করল। বলল, মোবাইল ছাড়া কাজ চলে?
—কী কাজ, ন্যাদোশ?
—আর বোল না? দিব্যি ছিলাম গোলোকে, ঘাস বলো, জল বলো, সব ফাসক্লাস! কোথা থেকে এসেছে সতোরোটা চ্যাংড়া বজ্জাত গোরু। তাদের মোবাইল চাই! গোলোকের কিছু তাদের পছন্দ নয়। কী চায় জানো?
—কী চায়?
বলতে বলতেই দেখতে পেলাম, আদি ঢুকছে বাড়িতে। আদিকে তোমরা চেনো না। ওর বয়স তিন, থাকে হায়দ্রাবাদে, কলকাতা এলেই বলে, হ্যারি পটারের গল্প বলো!
ঘরে ন্যাদোশ, ঢুকছে আদি। তবু ন্যাদোশ বলে কথা! বললাম, ওই গোরুরা কী চায়?
—হ্যারি পটারের বই খেতে চায়।
—কেন?
—তা কি আমি জানি? আমি যে সব বই খেয়েছি, সেগুলোই জানি। সে সব বই বাংলায় লেখা!
—তা হলে তো মুশকিল! হ্যারি পটার ইংরিজিতে লেখা।
—এ যে কী মুশকিল! আমাকে সবাই শিক্ষিত গোরু বলে জানে! আজ ইংরিজিতে হ্যারি পটার পাব কোথায়? খাব কী করে? দেখছ, কী ঝামেলায় ফেললে?
সঙ্গে সঙ্গে আদি ঢুকে পড়ল ওর দাদীর সঙ্গে। আর ঢুকেই আদি চেঁচাল, বড়দিদা! আমি হ্যারি পটার! এসে গেছি!
শুনেই ন্যাদোশ ছিটকে উঠল। আমার টেলিফোন, কলমদানী, সবকিছুর মধ্যে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। বলতে বলতে গেল, এখানেও হ্যারি পটার? যাই! ওই ডেঁপো গোরুদের জানিয়ে দিই।
ব্যস! এ বছরের মতো ন্যাদোশ হাওয়া! বলতে বলতে গেল, লাইফটা হেল করে দিল। কোথাও শান্তি নেই?
দেখলাম, ন্যাদোশ এখনো ছোটবেলার মতোই লাফ মারতে পারে। পারবেই তো! গল্পের গোরু তো।