নেকড়ের নিমন্ত্রণ
বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো সার্জারি বিভাগের সদ্য পাশ করা তরুণ চিকিৎসকদের সামনে বক্তৃতা করছিলেন বিখ্যাত নিউরো সার্জেন প্রফেসর হ্যারল্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ। মাত্র কয়েকদিন আগেই নিউরো সার্জারি বিভাগে সর্বোচ্চ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা দেশে ফিরে যাবার আগে মিলিত হবার জন্য আয়োজন করেছিল এই সভার।
প্রফেসর তার বক্তৃতা শেষ করলেন এইভাবে—’আমি আমার সাধ্যমতো তোমাদের শিক্ষাদানের চেষ্টা করেছি। তবে আমি তো আর প্রফেসর উলফ নই, কিছু সীমাবদ্ধতা নিশ্চয়ই আমারও আছে। তবে এটুকু বলতে পারি, তোমরা যা শিখেছ তা এই পেশার পক্ষে যথেষ্টই বলা যায়। আশা করি দেশে ফিরে তোমরা প্রত্যেকেই স্নায়ু শল্যচিকিৎসক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হবে ও মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করবে।’ তুমুল করতালির মধ্যে বক্তৃতা শেষ করলেন প্রফেসর হ্যারল্ড।
দর্শকাসনে প্রথম সারিতেই বসেছিল সুজয়। সে এবার নিউরো সার্জারি বিভাগে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়েছে। প্রফেসর হ্যারল্ডের প্রিয় ছাত্র সে। কিন্তু লন্ডন তথা পৃথিবীর অন্যতম স্নায়ু শল্যচিকিৎসক হ্যারল্ড তার বক্তৃতা শেষে বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে ‘প্রফেসর উলফ বলে যে ব্যক্তির নাম উচ্চারণ করলেন, তিনি কে? বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অধ্যাপকরাও তো কোনোদিন বলেননি এই নাম! সবাই তো বলেন নিউরো সার্জারি সংক্রান্ত ব্যাপারে লন্ডন শহরে শেষ মন্তব্য করার লোক হ্যারল্ডই। সুজয় ভেবে নিল হ্যারল্ডের কাছ থেকে তার কৌতূহলের নিরসন করতে হবে।
হ্যারল্ডের বক্তৃতার সঙ্গে সঙ্গেই সভাও শেষ হয়ে গেল। মঞ্চ থেকে নামার সময় সুজয়কে ইশারা করলেন প্রফেসর। সে ইঙ্গিত বুঝতে পারল। প্রিয় ছাত্রকে তাঁর বাড়িতে ডিনারে আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখছেন তিনি। তাঁর গাড়িতেই সুজয়কে এখন আমন্ত্রণ রক্ষা করতে যেতে হবে। সঙ্গীদের থেকে বিদায় নিয়ে রাতে হোস্টেলে ফিরবে বলে কনফারেন্স রুমের বাইরে বেরিয়ে সুজয় কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে বসল প্রফেসর হ্যারল্ডের গাড়িতে। ঝাঁ চকচকে আলোকোজ্জ্বল নগরীর রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল লন্ডনের এক অভিজাত অঞ্চলে হ্যারল্ডের বাড়ির উদ্দেশে।
প্রফেসরের বাড়িতে আগেও বেশ কয়েক বার এসেছে সুজয়। কম্পাউন্ড ঘেরা ভিক্টোরিয়া আমলের বাড়িটাতে স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন প্রফেসর। সুজয়ের সমবয়সি তাদের একমাত্র ছেলে গ্লাসগোতে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পাঠ নিচ্ছে। মিসেস হ্যারল্ড হাসিখুশি স্নেহশীল মহিলা। সুজয় তার ছেলের সমবয়সি বলেই তিনি হয়তো কিছুটা বাড়তি স্নেহ করেন সুজয়কে। সে প্রফেসরের বাড়িতে পৌঁছবার পর মিসেস হ্যারল্ড বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে খাতিরযত্ন করে খাওয়ালেন সুজয়কে। ডিনার পর্ব সাঙ্গ হলে প্রফেসরের স্টাডিতে মোমের আলোতে গল্প করতে বসল তিনজন।
প্রশ্নটা সুজয়ের মনে ঘুরঘুর করছিল অনেক্ষণ ধরে। কিছু হালকা আলাপ আলোচনার পর সুযোগ বুঝে প্রফেসরকে প্রশ্নটা করে ফেলল, ‘আপনি যে আজ বক্তৃতায় প্রফেসর উলফের নাম বললেন, তিনি কে? তার নাম কোনোদিন শুনিনি তো!’
সুজয় প্রশ্নটা করতেই মিসেস হ্যারল্ড যেন একটু চমকে উঠে বললেন, ‘ও গড!’ প্রফেসর হ্যারল্ড মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বললেন, ‘বক্তৃতা করতে গিয়ে অনেকদিন পর ও নাম আচমকাই মুখে চলে এসেছিল আমার। অসম্ভব প্রতিভাধর মানুষ সে। আমার মতে নিউরো সার্জারিতে ওর মতো জ্ঞান আর দক্ষতা ইংল্যান্ডে আর কারও নেই। চিকিৎসাশাস্ত্র বাদ দিয়েও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা, যেমন, পদার্থবিদ্যা-রসায়ন-ইঞ্জিনিয়ারিং-এ সবেতেই ওর পাণ্ডিত্য অসীম। তুমি যদি ওর সংস্পর্শে আসতে তাহলে আরও বেশি শিখতে। একটা চুলের মতো নার্ভকেও আশ্চর্যভাবে ও লম্বালম্বি চিরে ফিলতে পারে। এমনই দক্ষতা ওর! তবে লোকটা একটু অদ্ভুত ধরনের। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সঙ্গেই অধ্যাপনার কাজে ঢুকেছিল। তার সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতাও ছিল। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিল। বার্মিংহামে পূর্বপুরুষদের বিশাল দুর্গবাড়িতে নানারকম গবেষণা করে দীর্ঘদিন সময় কাটাচ্ছে সে।’
মিসেস হ্যারল্ড এবার স্বামীর কথা শুনে বললেন, ‘গবেষণা না ছাই, লোকে তো বলে কবরখানা ঘেরা ওই প্রাচীন বাড়িতে বসে প্রেতচর্চা করে লোকটা। কেউ কেউ তো বলে উলফ আসলে মানুষ নয়। দিনেরবেলাতে তাকে কোনোদিন দেখা যায় না। রাতে যে ওই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় সে আসলে উলফের প্রেতাত্মা।’
প্রফেসর স্ত্রীর কথায় মৃদু প্রতিবাদ করে বললেন,’ব্যাপারটা আসলে ঠিক নয়। উলফ প্রতিবেশীদের কারওর সঙ্গে মেশে না। পল্লি অঞ্চলে একাকী কেউ বাস করলে গ্রাম্য মানুষরা ওরকম নানা গল্প ছড়ায়।’
সুজয় লোকটার পরিচয় শুনে কৌতূহলী হয়ে বলল, ‘তাঁর সঙ্গে আপনার যোগাযোগ আছে? তাঁর কাছে কিছু শিখতে পারলে ভাগ্যবান মনে করতাম নিজেকে।’
প্রফেসর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, ‘সে অর্থে প্রায় কুড়ি বছর তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ তেমন নেই। লন্ডন শহরের কোলাহল থেকে ও নিজেকে দূরে রাখে। বছর পাঁচেক আগে ও আমাকে শেষ একটা চিঠি পাঠিয়েছিল নিউরো সার্জারি সংক্রান্ত কাজকর্মের বিষয়ে। পাছে কেউ ওর কাজে ব্যাঘাত ঘটায় তাই ওর বাড়িতে টেলিফোন লাইন নেই। আমি ওর নামে তোমাকে একটা চিঠি লিখে দিতে পারি। তার সঙ্গে তোমার সার্টিফিকেটের একটা প্রতিলিপি যুক্ত করে তুমি একটা চিঠি লেখো ওকে। দ্যাখো যদি ওর সাড়া মেলে।’
সুজয় বলল, ‘তাহলে লিখে দিন। দেখি যদি ওঁর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।’
মিসেস হ্যারল্ড আঁতকে উঠে সুজয়কে বললেন, ‘তুমি সত্যিই সেখানে যাবে নাকি? আমার এক বোনপো থাকে ওদিকে। সে বলছিল উলফ ক্যাসেলের ত্রিসীমানায় কেউ যায় না। রাতে নাকি ওই কবরখানা থেকে নানারকম শব্দ ভেসে আসে। দপ করে জ্বলে ওঠে নীলাভ আলো! একবার গ্রামেরই এক চোর রাতের বেলায় গিয়েছিল ওদিকে। পরদিন মৃত অবস্থায় কবরখানার বাইরের রাস্তায় পাওয়া যায় তাকে। লোকটার দেহে কোনো ক্ষতচিহ্ন না থাকলেও চোখে-মুখে ছিল স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ!’
প্রফেসর হ্যারল্ড স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বললেন, ‘কেন বাজে গল্প ওকে শোনাচ্ছ? ও যদি সত্যিই উলফের সংস্পর্শে আসতে পারে তবে ও আরও নতুন কিছু শিখতে পারবে।”
প্রফেসরের ধমক খেয়ে মিসেস হ্যারল্ড রাগ করে অন্য ঘরে চলে গেলেন। তবে যাবার আগে স্নেহশীল মায়ের মতো সুজয়কে বলে গেলেন, ”তুমি কিন্তু ওখানে যেয়ো না। উলফ নাকি ‘উলফ’—মানে ‘নেকড়েও’ পোষে।’
।। ২।।
মিসেস হ্যারল্ড যাই বলুন না কেন, প্রফেসর কিন্তু সত্যিই একটা চিঠি লিখে দিলেন প্রফেসর উলফের নামে। তারপর সেলফ থেকে পুরোনো একটা ফটোগ্রাফ বার করে সুজয়ের সামনে ধরে বললেন, ‘এই হল কুড়ি বছর আগে উলফের ছবি। অনেক বছর তাকে না দেখলেও অনুমান করতে পারি তার চুলগুলো এখন আমারই মতো সাদা হয়ে গেছে। তোমার তাকে চেনার সুবিধার জন্য ছবিটা দেখালাম।’ সুজয় মোমের আলোতে ছবিটা দেখল। একজন মধ্যবয়সি মানুষের ছবি। মাথার পেছনে টেনে বাঁধা ঘন কালো চুল। ছুঁচলো চিবুক। প্রশস্ত কপাল আর তিক্ষ্ন নাসা যেন পরিচয় দিচ্ছে তাঁর মেধাশক্তির। সবচেয়ে উজ্জ্বল তাঁর চোখ দুটো। বুদ্ধিদীপ্ত সেই চোখ যেন ছবির ভিতর থেকে সুজয়ের দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটা রহস্যময় দৃষ্টি আছে সেই চোখে। সুজয় বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা দেখে সেটা ফেরত দিল। প্রফেসরকে। তাঁর বাড়ি ছেড়ে বেরোবার সময় প্রফেসর এরপর শুধু বললেন, ‘তবে লোকটা তো একটু পাগলাটে ধরনের। কাজেই আশাহত হলে দুঃখ পেয়ো না।”
প্রফেসরের বাড়ি থেকে হোস্টেলে ফিরে এসে বেশ উত্তেজনা অনুভব করল সুজয়। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পাচ্ছে ছবির সেই লোকটা, প্রফেসর উলফ তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
পরদিন সকালে উঠেই প্রফেসর উলফের উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে ফেলল সে। প্রফেসর হ্যারল্ডের চিঠিতে উলফের ঠিকানা লেখা ছিল। সেই ঠিকানাতে হ্যারল্ডের কথামতো দুটো চিঠি আর প্রথম বিভাগে প্রথম হবার সার্টিফিকেটের প্রতিলিপি সেদিনের ডাকেই পাঠিয়ে দিল সে।
দিন তিনেকের মধ্যেই অপ্রত্যাশিতভাবে চিঠির জবাব এসে গেল। নোংরা একটা কাগজে কালচে লাল কালির আঁকাবাঁকা হরফে লেখা চিঠি। তার ভাষা সংক্ষিপ্ত ও কর্কশ।
‘আপনার আবেদন ও সার্টিফিকেট দেখলাম। তবে ওই সার্টিফিকেট আমার কাছে নিতান্ত কাগজের টুকরো মাত্র। আমার কাছে শিক্ষানবিশ থাকতে হলে পরীক্ষা দিতে হবে। তাতে কৃতকার্য না হলে আমার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য গলাধাক্কা খাবেন। যেমন এর আগে কয়েকজন খেয়েছেন। আপনার কোনো ক্ষতির দায়িত্ব আমার নয়। পরীক্ষা দিতে রাজি থাকলে আগামী ৩১ অক্টোবর রাত দশটায় বার্মিংহাম ক্রসিংয়ে অপেক্ষা করবেন। অবশ্যই একলা আসবেন। আমার গাড়ি সেখানে আপনাকে নিতে আসবে।
স্বাক্ষর
মার্টিমার উলফ
উলফ ক্যাসেল, বার্মিংহাম।”
চিঠির ভাষাটা বেশ আশ্চর্য লাগল সুজয়ের। তারপর চিঠিটা খুঁটিয়ে দেখে চমকে উঠল সে। মৃদু আঁশটে গন্ধ আছে কাগজটাতে। সম্ভবত চিঠির লাল কালিটা হল রক্ত। মুহূর্তের জন্য মিসেস হ্যারল্ডের কথাগুলো মনে হল তার। বেশ অদ্ভুত লোক তো মিস্টার উলফ। রক্ত দিয়ে চিঠি লেখেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে সুজয় সিদ্ধান্ত নিল এরকম অদ্ভুত লোককে অন্তত একবার চাক্ষুস করতে হবে। প্রফেসর হ্যারল্ডের মতে যিনি লন্ডনের শ্রেষ্ঠ স্নায়ু শল্যচিকিৎসক।
।। ৩।।
নির্ধারিত দিনে লন্ডন থেকে রাত ন-টা নাগাদ বার্মিংহামে পৌঁছে গেল সুজয়। তারপর ট্যাক্সি নিয়ে রওনা হল বার্মিংহাম ক্রসিংয়ের দিকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা হাইওয়ে ধরল গাড়ি। বেশ ঠান্ডা এদিকটাতে। এ অঞ্চলে আগে কোনোদিন আসেনি সুজয়। গাইড বুকে শুধু লেখা, বার্মিংহোম ক্রসিংয়ের মাইল পাঁচেক দূরে নর্মান আমলের প্রাচীন এক কবরখানা আছে, আর আছে এক প্রাচীন জমিদারবাড়ি। সম্ভবত ওটাই উলফ ক্যাসেল।
নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই ক্রসিংয়ে এসে পৌঁছল সুজয়। জনমানবহীন জায়গা। ফাঁকা হাইওয়ে চলে গেছে আরও উত্তরে। পশ্চিমে ফাঁকা মাঠ আর পূর্ব দিকে উইলোর জঙ্গলের ভিতর থেকে একটা মেঠো রাস্তা এসে মিলেছে হাইওয়ের সঙ্গে। তারপর সেটা হাইওয়ে ছেদ করে এগিয়েছে মাঠের মধ্যে দিয়ে। এজন্যই জায়গাটার নাম মনে হয় ক্রসিং। গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে ভাড়া মেটাবার সময় ড্রাইভার হঠাৎ কৌতূহলি হয়ে বলল, ”কোথায় যাবেন আপনি? এত রাতে এখানে কিন্তু কোনো গাড়ি পাবেন না। আশেপাশে জনবসতি নেই।” সুজয় জবাব দিল, ‘উলফ ক্যাসেল যাব। গাড়ি আসবে আমাকে নিতে।’
লোকটা চমকে উঠে বলল, ‘উলফ ক্যাসেল। এত রাতে। ওটা তো কবরখানা। আজ কী দিন খেয়াল আছে তো? ৩১ অক্টোবর ‘হ্যালোউইন ডে’। মৃত আত্মারা কবর ছেড়ে এ রাতে উঠে আসে। ওখানে যাবেন?’ সুজয় বলল, ‘হ্যাঁ, বিশেষ কাজ আছে।’
লোকটা জবাব শুনে কয়েক মুহূর্ত বিস্মিতভাবে তাকিয়ে থেকে নিজের বুকে ক্রুশ চিহ্ন এঁকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেল ফেরার জন্য। চাঁদের আলোতে নির্জন রাস্তায় একলা দাঁড়িয়ে সুজয়।
ঠিক রাত দশটায় সুজয় দেখতে পেল একটা গাড়ির বিন্দুর মতো দুটো হেড লাইটের আলো। উইলো বনের কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে আসছে হাইওয়ের দিকে।
গাড়ি এসে দাঁড়াল সুজয়ের ঠিক সামনেই। লড়ঝড়ে, পুরোনো মডেলের কালো রঙের ফোর্ড গাড়ি। হলদে ম্যাটম্যাটে আলো ছড়াচ্ছে হেডলাইট দুটো। সামনের কালো কাঁচটা সামান্য নামল। চালকের আসন থেকে একজন বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই উলফ ক্যাসেলে যাবেন? তাহলে উঠে বসুন।’
সুজয় গাড়িতে উঠে পড়ল। হাইওয়ে থেকে নেমে উইলো বনের ভেতর দিয়ে দুলতে দুলতে এগোল গাড়ি। গাড়ির ভিতর অন্ধকার। কেমন যেন একটা পুরোনো গন্ধ ভেতরটাতে। চালকের আসন আর সুজয়ের বসার জায়গার মধ্যে বেশ অনেকটা ফাঁক। ড্রাইভারের উঁচু কলারের ওভারকোটের ওপরে সাদা চুল সমেত মাথার কিছু অংশ শুধু দেখা যাচ্ছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। আলাপ জমাবার জন্য সুজয় তার উদ্দেশে বলল, ‘শহরতলিতে রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে! আশেপাশে কোনো লোকজন থাকে না?’
লোকটা কোনো জবাব দিল না। সুজয় এবার জানতে চাইল উলফ ক্যাসেল পৌঁছতে কত সময় লাগবে?”
লোকটা যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে অদ্ভুত জবাব দিল, ‘না পৌঁছলে বলতে পারব না।”
সুজয় বুঝতে পারল তার সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা তার নেই। লোকটা মনে হয় তার মালিকের মতোই অদ্ভুত। একথা ভেবে বাইরে চোখ রাখল সূজয়। আধো অন্ধকারে রাস্তার দু-পাশে গাছগুলো ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তা যেন এগিয়েছে কোনো ভৌতিক জগতের দিকে।
একসময় জঙ্গল শেষ হল। চাঁদের আলোতে দেখা দিল এক বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তার মধ্যে জেগে আছে অসংখ্য বেদি আর তার মাথায় সার সার ক্রুশ চিহ্ন। চাঁদের আলোতে ধবধব করছে সেগুলো। মাঠের অপর প্রান্তে অনেক দূরে প্রাচীন এক স্থাপত্য যেন দেখা যাচ্ছে, সম্ভবত ওটাই উলফ ক্যাসেল। একটা ভাঙা তোরণ অতিক্রম করে প্রাচীন কবরখানায় প্রবেশ করল গাড়ি। তারপর খুব ধীর গতিতে কবরের সারির পাশ কাটিয়ে চলতে লাগল। চারপাশে শুধু কবর আর কবর। প্রাচীন কবরগুলোর মাথায় ক্রুশ কোথাও হেলে পড়েছে, কোথাও আবার শ্বেতপাথর ফুঁড়ে মাথা তুলেছে ঝোপঝাড়।
বাইরের দিকে চোখ রেখে চলেছিল সুজয়। হঠাৎ কিছু দূরে একটা কবরের বুক ফুঁড়ে একটা নীল আলো দপ করে জ্বলে উঠে নিভে গেল। এরপর কিছু দূরে আর একটা, তারপর আরও একটা।
সুজয়ের মনে পড়ে গেল মিসেস হ্যারল্ডের কথা। তিনি বলেছিলেন এই ভৌতিক আলোর ব্যাপারে। সুজয় একটু বিস্মিত হয়ে ড্রাইভারকে বলল, ‘ও কীসের আলো?’
সুজয় তার উত্তর না পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, চালকের আসন শূন্য। সেখানে কেউ নেই। অথচ গাড়িটা চলছে। ড্রাইভার কি অসুস্থ হয়ে সামনে ঢলে পড়ল? সামনে ঝুঁকে দেখতে গিয়ে সুজয় কপালে ঠোক্কর খেল। ড্রাইভারের সিটের ঠিক পিছনেই স্বচ্ছ কাচের পার্টিশন আছে। সেটা আগে আধো অন্ধকারে সে বুঝতে পারেনি। তবে তার ভিতর দিয়ে ওপাশটা দেখা যাচ্ছে, চালকের আসনে কেউ নেই। তবুও স্টিয়ারিংটা ঘুরছে। কবরগুলোকে কাটিয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে গাড়ি। সুজয়ের মাথার ভিতরটা কেমন যেন গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। সে বলে উঠল— ‘আপনি কোথায়?’ ঠিক সেই সময় ঝাঁকুনি খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। আর গাড়ির চারপাশের কবরগুলোতে জ্বলে উঠতে লাগল নীল আলো। আর এরপরই জানলার পাশে একটা বিরাট কবরের মাথার ক্রুশটা সশব্দে ভেঙে পড়ল, ধীরে ধীরে ফাঁক হয়ে গেল কবরের উপরিভাগ। তার ভিতর থেকে উঠে বসল একটা অবয়ব। ঠিক সেই সময় একটা নীল আলো ঝলসে উঠল। সেই আলোতে সুজয় দেখল কবর থেকে উঠে বসেছে একটা কঙ্কাল। সে তার রক্তমাংসহীন হাত দিয়ে টেনে ধরতে চাইছে গাড়ির চাকা। সুজয়ের মনে হল— সে কি ঠিক দেখছে। তাহলে কি মিসেস হ্যারল্ডের শোনা গল্প ঠিক? হ্যালোউইন ডে-তে কি সত্যিই জেগে ওঠে প্রেতাত্মারা! তা কী করে সম্ভব। কিন্তু চোখকে সে অবিশ্বাস করবে কীভাবে?
গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে তার যাত্রাপথের দু-পাশে ঘটতে লাগল অবিশ্বাস্য সব ঘটনা। কোথাও কবর ফুঁড়ে উঠে আসছে কঙ্কাল! কোথাও রাস্তা আগলে দাঁড়িয়ে আছে কবন্ধ! কোথাও আবার শোনা যাচ্ছে পৈশাচিক হাসি। গাড়িটা লক্ষ্য করে ছুটে আসছে এসব কিছু। মনটাকে শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সুজয়। নিজের মনকে সে বার বার বলার চেষ্টা করতে লাগল, এ হতে পারে না! এ হতে পারে না! তার এতদিনের শেখা বিজ্ঞান কিছুতেই মিথ্যা হতে পারে না। দুটো পরস্পরবিরোধী চিন্তার লড়াই হতে লাগল মনের মধ্যে। একসময় কোথা থেকে যেন ছুটে এল একপাল নেকড়ে। তাদের দেহগুলো যেন অন্ধকারে জ্বলছে। চাঁদের আলোতেই ঝিলিক দিচ্ছে তাদের ধবধবে হিংস্র দাঁতের পাটি। গাড়িটার সঙ্গে তারা ছুটতে লাগল। ভিতরে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল সুজয়। দমবন্ধ করা আতঙ্কে তার মনে হতে লাগল এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা ঘণ্টা।
এগিয়ে চলল গাড়ি। কতক্ষণ এভাবে সে গাড়িতে বসে রইল খেয়াল নেই তার। একসময় সে খেয়াল করল বিশাল এক তোরণের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করছে গাড়ি। নেকড়েগুলো সেই তোরণে পৌঁছে থেমে গেল। একটা অন্ধকার টানেল অতিক্রম করে বিরাট একটা আলোকোজ্জ্বল কক্ষে পৌঁছে থেমে গেল গাড়ি। তার দরজাও খুলে গেল।
আলো দেখে একটু ইতস্তত করে গাড়ি ছেড়ে নামল সুজয়। প্রাচীন কক্ষ, ছাদ অনেক উঁচুতে। দেওয়ালের গায়ে টাঙানো আছে বিভিন্ন তৈলচিত্র, প্রাচীন ঢাল-বর্শা অস্ত্র। সম্ভবত এটাই নর্মান আমলের প্রাচীন উলফ ক্যাসেল। সে দেখল একজন লোক এগিয়ে আসছে তার দিকে। তাঁর তীক্ষ্ম নাসা, উঁচু কপাল, আর তার নীচে হ্যারল্ডের দেখানো ফটোগ্রাফের সেই উজ্জ্বল চোখ। মাথার চুল শনের মতো সাদা। পরনে কলার উঁচু ওভারকোট। প্রফেসর উলফ।
লোকটা সুজয়ের সামনে এসে করমর্দনের জন্য হাত বাড়াল। সুজয় স্পর্শ করল সেই হাত। সেই হাত যেন বরফের মত ঠান্ডা। এরপর নিঃশব্দে হাসল লোকটা। সুজয় স্পষ্ট দেখতে পেল প্রফেসরের ঠোঁটের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে ক্যানাইন। ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর চুল আর কোট দেখে সুজয়ের মনে হল এই যেন তার গাড়ির অদৃশ্য হয়ে যাওয়া চালক। হয়তো এরপর সে সত্যি সংজ্ঞা হারাত। কিন্তু তার আগে মনের সব শক্তি একত্রিত করে লোকটার চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, ‘আপনি নিশ্চয় প্রফেসর উলফ? আমি আপনার কাছে পরীক্ষা দিতে এসেছি।”
ভদ্রলোক তার কথা শোনা মাত্রই তাঁর নকল শ্বদন্ত দুটো খুলে ছুড়ে ফেলে সুজয়ের পিঠ চাপড়ে বলে উঠলেন, ‘আরে পরীক্ষা তো তুমি দিয়েই ফেলেছ। আর শেষ পরীক্ষাতেও এত ভালোভাবে পাশ করবে ভাবতে পারিনি। ভেবেছিলাম তুমি সংজ্ঞাহীন অবস্থায় এখানে আসবে। আর কাল সকালেই তোমায় বিদায় করব। যেমন এর আগে কয়েকজনকে করেছি। তোমাকে আমার সহকারী করতেই হবে।”
মুহূর্তের মধ্যেই হাসি ফুটে উঠল সুজয়ের মুখে। সে বলল, ‘আপনি কাণ্ডগুলো ঘটালেন কীভাবে?’
প্রফেসর উলফ বলেলেন, ‘গাড়িটা আসলে দূর নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। রিমোটে চালাচ্ছিলাম। আমার ঘরে স্ক্রিন আছে। ড্রাইভার ছিল না ওতে। ড্রাইভার আর তোমার মাঝে কাচের পর্দাটা আসলে থ্রিডি স্ক্রিন। গাড়ির জানালার কাচগুলো ক্ষেত্র বিশেষে ওই কাজ করেছে। পর্দায় ছবি ফুটে উঠেছে। ড্রাইভারের কথাগুলো আমি ঘরে বসে বলছিলাম। কবরখানার কঙ্কালগুলো আসলে সাজানো ইলেকট্রিক পুতুল। যেমন হরর হাউসে সাজানো থাকে।’
‘কিন্তু ওই নেকড়েগুলো তো পুতুল নয়।’
‘ওগুলো আমার ট্রেইনড ওয়াচ ডগ। গায়ে ফসফরাস মাখিয়েছি বলে অন্ধকারে ওরা জ্বলছিল। একা এত বড় বাড়িতে থাকি তো, ওদের ভুতুড়ে কুকুর ভেবে চোরডাকাত এ বাড়ির কাছে ঘেঁষে না।”
‘কিন্তু আমাকে ভয় দেখাবার জন্য এতসব আয়োজন কেন?’ শেষ প্রশ্ন করল সুজয়।
সুজয়ের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে প্রফেসর উলফ বললেন, ”ভবিষ্যতে যে নিউরো সার্জেন হতে যাচ্ছে তার নিজের নার্ভ কতটা শক্ত তা পরখ করতে হবে তো? নইলে অপারেশন টেবিলে কোনো দুর্ঘটনায় ভয়ংকর ক্ষতবিক্ষত রোগীকে সে কীভাবে ছিনিয়ে আনবে মৃত্যুর মুখ থেকে? ওইসব ক্ষেত্রে ডাক্তারের নার্ভ কতটা শক্ত তার ওপরেই তো রোগীর জীবন নির্ভর করে।’
এরপর তিনি সুজয়ের পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বললেন, ‘চলো এবার ভেতরে যাওয়া যাক। তোমাকে ভয় দেখাবার জন্য হাতটা বরফ জলে চুবিয়ে রেখে কনকন করছে। ফায়ারপ্লেসে হাত সেঁকতে হবে। তারপর আজ রাতেই তোমাকে একটা হাতের ডিসেকশন দেখাব। মানুষের হাত। ভয় পাবে না তো?’
তারা দু-জনেই হেসে উঠল তারপর।
—