নৃত্যশালা

নৃত্যশালা

(এগারো) পাঠিকা

সিআইটি কলোনির সেই জনাকীর্ণ সান্ধ্য রাজপথ ছেড়ে কখন যেন অন্য এক অপরাহ্ণবেলার নির্জন সমুদ্রসৈকতে এসে বসেছি। কখন এলাম এখানে, কীভাবে-বা, সেসব ভাবনা এতক্ষণে ছেড়ে দিয়েছি আমি। সময় আমাকে যেমন দেখাবে, তেমনই দেখে চলতে হবে, মেনে নিয়েছি এবার।

এ বড়ো নির্জন সমুদ্রতীর। বালির ওপর বসে আছি একা। অদূরে সমুদ্রের ঢেউ বারবার আছড়ে পড়ে তার স্বচ্ছ ওড়না বালুরাশির বুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে, পরক্ষণেই গুটিয়ে নিচ্ছে। রেখে যাচ্ছে জলের পদচিহ্ন। সন্ধে হয়ে আসছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম, কোথাও কেউ কাছে নেই। এখান থেকে অনেক দূরে সমুদ্রতীর-বরাবর স্নানরত কিছু মানুষের অস্পষ্ট অবয়ব—অপরিচিত কোনো চিত্রীর কাঠপেনসিলে আঁকা হালকা ট্রেসিং। পেছন ফিরে চাইলাম; একটা অদ্ভুত গড়নের প্রাচীন মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে সময়ের সব আতুরতা নিয়ে। তারও পেছনে একটা নির্জন বাতিঘর আকাশপানে উঠে গেছে। বাতিঘরটিও বেশ প্রাচীন, তার অলংকৃত ঊর্ধ্বাঙ্গে পুরোনো আমলের বড়ো একটা ঘড়ি চোখে পড়ল। ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে কবেকার তিনটে পঁচিশে। জানি না, সেই তিনটে পঁচিশ বিকেল ছিল, নাকি ভোররাত। ক্ষয়ে আসা মিনারেটটার থেকে অনেক দূরে একটা অনতিস্পষ্ট পোড়ো ভিটের ওপর কতগুলো বিশাল ডানার শকুন নেমে এসেছে। জেলেরা ওখানে সামুদ্রিক মাছের শরীরের পরিত্যক্ত আঁত ফেলে যায় হয়তো প্রচুর পরিমাণে। তারই টানে আকাশের অগাধ নীল ডানায় মেখেও শকুনেরা নেমে আসে হয়তো নিতান্ত জৈবিক আহার্যেরই টানে।

সামনে সমুদ্র, তার অবিশ্রান্ত ঢেউ, বালির ওপর ছোটো ছোটো ঢেউয়ের শেষ পরিণাম মিলিয়ে আসতে আসতেই বহু দূরে আবার বড়ো ঢেউয়ের তোড়জোড় শুরু হচ্ছে। ফেনার পতাকা মাথায় করে সেই সব বিস্তীর্ণ ঢেউয়ের বাহু ছুটে আসছে এইদিকে। যেন অজগরের ফণার মতো ফুঁসে উঠছে বারবার। দূর দিগন্তের কাছে নীল জল আর নীলাকাশ কোনো শান্ত অধিবৃত্তে একাকার হয়ে গেছে। আকাশে ছিন্নভিন্ন মেঘে মেঘে অস্তরাগের বিনম্র আয়োজন। বহু দূরে মৎস্যজীবীদের দুয়েকটা নৌকো সাগরের টালমাটাল ঢেউ ভেঙে কোথায় যেন চলেছে।

মনে মনে ভেবে চলি কোভালনের কথা, কন্নকীর কথা। ভাবি আজকের মানুষ-মানুষীর কথাও। মানুষ স্বপ্ন দিয়ে মানসপ্রতিমা গড়ে। সেই মানসপ্রতিমার সঙ্গে কেমন করে কখন যেন খানিকটা মিলে যায় বাস্তবের কোনো মানুষীর মুখ। মানুষীও স্বপ্ন দিয়ে মানসপ্রতিমা গড়ে তোলে। তারপর কোনো এক তন্ময় মুহূর্তে সেই মানসপ্রতিমের সঙ্গে বুঝি মিলে যায় কোনো আকস্মিক মানুষের অবয়ব, স্বভাব, আচরণ। তখন কল্পনা আর বাস্তব দুই ঘনিষ্ঠ সখীর মতন এ ওর চুল বেঁধে দিতে বসে। তবু শতেক যতনের পরেও তাদের কবরী খুলে যায় কখনও-বা। বিস্রস্তকুন্তলা দুই নারীর মতন কল্পনা আর মেলাতে পারে না বাস্তবকে, বাস্তব চিনতে পারে না কল্পনাকে আর। তখন অন্ধকার সন্ধ্যায় দুই নারী অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে পরস্পর। কল্পনা অভিমান করে বাস্তবের দাবির কাছে বসে থাকে, বাস্তব মুখ ঘুরিয়ে রাখে কল্পনার দিক থেকে। প্রেম ধীরে ভেঙে যায়। একেবারে ভেঙে যায় কি? আবার কি কোনো আশ্রয় খোঁজে না সে? সেখানেও যদি নীড় পুড়ে যায়, তখন আকাশ আশ্রয় করে বাঁচে পাখি? অথবা, ফিরে আসে পূর্ব পরিত্যক্ত নীড়ের কাছে, আঘাতের অধ্যায়ের ভিতর দিয়ে পুনরায় ভালোবাসাকে চিনে নিতে, ফিরে পেতে? কী জানি এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর আছে কি না। পায়ের কাছে সমুদ্রের অবিশ্রান্ত কল্লোলগুলি বারবার অশান্ত প্রশ্ন তুলে নিভে যেতে থাকে।

ভাবতে ভাবতে একবার ঘাড় ফিরিয়ে হঠাৎ দেখি, কে একটি অল্পবয়েসি মেয়ে অদূরে একা বসে আছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। একটা মেরুন রঙের লেহেঙ্গা পরে আছে সে। চুলগুলো খানিকটা চুড়ো করে বাঁধা। খালি পা বেলাভূমির বালির মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে। ঈষৎ বাদামি রঙের চোখ দুটিতে কেমন একটা বিস্ময়ের বিহ্বলতা। এতক্ষণ তো দেখিনি তাকে, হঠাৎ কোথা থেকে এল এই মেয়ে?

আমি তার দিকে তাকিয়েছি দেখে, কেমন অপ্রস্তুতভাবে হাসল মেয়েটি। বালি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাগরার ধুলো ঝাড়ল হাত দিয়ে। তারপরে দেখি, আমার দিকেই আসছে। আমি বুঝতে পারছি না, কে সে। মনে পড়ে না, এর আগে কোথাও দেখেছি বলে। অপ্রস্তুতভাবে আমিও হাসলাম ।

আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনিই কি স্বয়ম?’

এ কীভাবে আমার নাম জানে ? দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে নমস্কার জানিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি…? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারছি না….’

‘চিনতে পারার কথাও নয়। আমাদের আগে কখনও দেখা হয়নি সরাসরি। আমার নাম কাঁকন দাশগুপ্ত,’ বলল মেয়েটি।

আমি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কাঁকন নামের মেয়েটি আঙুলের ইশারায় বলল, সে-ই বসবে।

     

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এর আগে দেখা হয়নি যদি, তাহলে আপনি আমার নাম জানলেন কীভাবে?’

বালির ওপর বসে সে আমাকে বলল, ‘যেভাবে কোনো পাঠক বা পাঠিকা তার প্রিয় লেখকের নাম জানে, সেভাবেই….’

আমি বললাম, ‘আমি তো তেমন কোনো লেখক নই যে, আপনার বয়েসি কোনো মেয়ে আমাকে জানবে… হয়তো আপনার ভুল হচ্ছে কোথাও…’

মেয়েটি নির্দ্বিধায় বলল, “নাহ্, কোনো ভুল হচ্ছে না। আমি আপনার লেখা বইগুলো পড়েছি। খুব বেশি তো লেখেননি। যা যতটুকু লিখেছেন, আমি পড়েছি। ভালো লেগেছে বেশ। আরও কী লেখেন, তার অপেক্ষায় আছি। … শুনুন, আপনি আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। বললে খুবই রাগ করব। ‘তুমি’ বলবেন, কিংবা ‘তুই’। আমি আপনার থেকে অনেক ছোটো। ওহো, আপনি তো আবার ঘরছাড়া ফকির। এসব বুঝবেন কি না, কে জানে! আচ্ছা, ধরে নিন, আমি আপনার কোনো অল্পবয়েসি বন্ধু…”

মেয়েটি, মানে এই কাঁকন, দেখা যাচ্ছে, কথা শুরু করলে এক সমুদ্র কথা বলে। বেশ সরল বকবকী বালিকা। কিন্তু মুশকিল এই, আমি অপরিচিত মানুষের সঙ্গে প্রথমেই চট করে বেশি কথা বলতে পারি না। ‘তুই’ সম্বোধন তো সম্ভবই নয়। তাও ভেবে-চিন্তে বললাম, ‘এখানে কি বেড়াতে এসেছ? তোমার অন্য বন্ধুরা কই? একাই এসেছ না কি?’

প্রশ্নটা শুনে কেমন হকচকিয়ে গেল কাঁকন। এতক্ষণ তার মধ্যে যে-প্রগল্ভতা দেখছিলাম, সেসব যেন এক লহমায় নিভে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল সে আত্মগত স্বরে, ‘আমি… আমি তো এখানে আসিনি…’

আমি তার কথা কিছু বুঝতে পারলাম না। কোনো কারণে এলোমেলো হয়ে আছে কি মেয়েটি? বললাম, ‘আসোনি মানে…?’

‘আসলে আজ মাঝদুপুরে ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফিরে আপনার একটা লেখা পড়ছিলাম। ওই যে কন্নকী-কোভালনের গল্প…’

আমি খুব অবাক হলাম তার কথায়। বললাম, ‘যে-লেখা আমি এখনও লিখিনি, তুমি তা পড়ছিলে কীভাবে?’

‘তাতে কী? হয়তো লিখবেন এর পর কোনোদিন ভবিষ্যতে। আমি হয়তো আপনার ভবিষ্যতের সেই পাঠিকা… সে যাই হোক…’

ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। আমি যা এখনও লিখিনি, কাঁকন তা কীভাবে পড়েছে? মেয়েটির কোনোরকম মস্তিষ্কবিকৃতি হয়নি তো? আবার এও অস্বীকার করতে পারছি না যে, আমিও তো কলকাতায় সেই ভাড়াবাড়ির অপরিসর ঘরের ভেতর বসে ভাবতে ভাবতে এই স্বপ্ন-না-কী-যেন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে মাদ্রাজে চলে এসে বাসবান্নার মুখে কন্নকী-কোভালনের আখ্যানই শুনছিলাম। এ রহস্য আপাতত মুলতুবি থাক, কী বলছে কাঁকন, তাই বরং শুনি ।

‘…সে যাই হোক… আপনার ওই লেখাটা পড়তে পড়তে কখন যেন দেখছি… মানে সত্যিই দেখছি কি না বুঝতে পারছি না… দেখছি, কলকাতায় বাড়িতে আমার ঘরে আমি যেন আর নেই… কখন এই সমুদ্রের তীরে এসে বসেছি… কীভাবে এলাম… মানে সত্যিই এলাম কি না বুঝতে পারছি না… অথচ এসেছি তো ঠিকই… এই তো সমুদ্রতীর…. পায়ের নীচে ভেজা বালি…. ওই তো নীল সমুদ্র ফুঁসছে… এই তো আপনি পাশে বসে আছেন,’ এই বলে সে আমার হাতের কবজিটা ধরল, আমার হাতের পাতা নিজের চোখের কাছে টেনে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল। এমনভাবে দেখছে, যেন আমি, আমার এই হাত—এসব সত্যি না কি স্বপ্ন, পরখ করে দেখতে চাইছে সে। আমি দেখলাম, তার বাদামি রঙের চোখ জলে ভরে এল এক অব্যাখ্যাত অসহায়তায়—যেন সে একটা বিষম সংকটে পড়েছে; পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে নিতান্ত অপরিচিত কোনো ঘটনার অরণ্যে হারিয়ে গিয়েছে, ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছে না আর ।

আমি বললাম, ‘তুমি একবার ভালো করে কলকাতার বাড়ির কথা ভাবো দেখি, যদি ফিরে যেতে পারো!’

কাঁকন আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চোখ মুছে নিতে নিতে বলল, ‘আমি ফিরতে চাইছি, কে আপনাকে বলল?’

‘তাহলে কাঁদছ যে! তোমার চোখে জল… কোন বাড়ির মেয়ে তুমি…কেমন সুন্দর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে পড়তে বসেছিলে… খামোখা কেন যে আমার লেখা টেনে পড়তে বসলে…তাও আবার সেই লেখা, যা আমি এখনও লিখিনি?… তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে যাও, কাঁকন, আমি চাই। তোমার বাড়ির লোকজন হয়তো এতক্ষণে তোমাকে কত খুঁজছেন না দেখতে পেয়ে। কী ভীষণ চিন্তা হচ্ছে তাঁদের বলো তো?’

‘হোক চিন্তা । আমি বড়ো হয়েছি…. আমি স্বাধীন… আমি তো আমার নিজের ইচ্ছেয় এসেছি।’

‘নিজের ইচ্ছেয়? তুমি ঠিক বলছ?’

কাঁকন আমার কথায় বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। খানিক ভুরু কুঁচকে কী সব আকাশপাতাল ভাবছে। তারপর আবার পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে ভেজা বালি খুঁড়তে খুঁড়তে আপন-মনে বলতে লাগল, ‘নিজের ইচ্ছে? তা হয়তো পুরোপুরি নয়, তবু এসেছি তো ঠিকই… আমাকে অত খোঁজারই-বা কী আছে আমার বাড়ির লোকের? আর আপনিই-বা কীভাবে ভাবলেন, আমি বাড়ি ফিরতে চাইছি বলে আমার চোখে জল আসছে? আমি কি ছোটো মেয়ে?’

আমি তার কথায় হেসে ফেললাম। ছোটোদের মতো জেদ, অথচ বলছে, সে ছোটো নয়। আমি সামাল দিতে বললাম, ‘না-না, আমি তো তা বলতে চাইনি। বলছিলাম, তুমি কাঁদছিলে কেন? মানে, তোমার চোখে জল এল কেন?’

হেসে ফেলল কাঁকন। তারপরে আবার হাসিটা লুকিয়ে ফেলল। তার মুখে যেন একটা স্থায়ী মনখারাপ আছে। বলল, ‘না, আমি ভাবছি, কোভালনের এবার কী হবে? কন্নকীর কী হবে? আপনি তো আর লিখছেন না!’

‘বিশ্বাস করো, কাঁকন, আমি এসব সত্যিই লিখিনি এখনও। আমিও তো স্বপ্ন-না-কী-যেন-র ঘোরে মাদ্রাজে এসে বাসবান্নার মুখে গল্প শুনছিলাম!’

‘তাহলে বাসবান্নার কাছেই ফিরে যাচ্ছেন না কেন? চলুন, আমরা দুজনেই সেখানে যাই। গিয়ে বলি, বাসবান্না, বাসবান্না, কোভালন-কন্নকীর তারপরে কী হল?’

আমি মনে মনে হাসলাম। এ মেয়েটি খুবই গল্পপ্রিয়। এবং এই রূপান্তরিত চেতনার মধ্যে এসে পড়ে সে আমার মতো অস্বস্তিতে ভুগছে না। হয়তো সে ছেলেমানুষ, তাই এমন। এ বয়েসে স্থায়িত্বের দিকে তেমন টান থাকে না ।

আমি বললাম, ‘বেশ, চলো তবে যাওয়া যাক।’এই বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে অনুসরণ করে কাঁকনও উঠে দাঁড়াল। এতক্ষণে তার মুখে যেন আনন্দের আভা দেখা দিয়েছে। যেন সে এখনই আমার সঙ্গে কোনো অভিযানে বেরিয়ে পড়তে চায়। যেন কোনো পিছুটান নেই তার।

আমরা হাঁটতে লাগলাম। আমাদের পেছনে সেই সমুদ্রতীর, সেই প্রাচীন মিনারেট, অদ্ভুত বাতিঘর—সমস্তই আচম্বিতে মিলিয়ে এল।

(বারো) কথাসূত্র

‘একে কোথায় পেলে তুমি, স্বয়ম? এ কে?’ বাসবান্না অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

আবার সেই ঘরটা। পুরোনো আর্মচেয়ারে বসে আছেন বাসবান্না। তাঁর উলটোদিকে একটা জীর্ণ সোফায় বসে আছি আমি। আমার পাশের সোফাটায় একটু আগে বসেছিল কাঁকন। কয়েক মুহূর্ত আগে উঠে গেছে। বাসবান্নার পৈতৃক বাড়িটি প্রাচীন; সামনের বারান্দাটা সাবেক দক্ষিণী কলারীতিতে অসাধারণ কারুকার্য করা—কাঁকন উঠে গেছে বারান্দার সেই কারুকৃতি দেখবে বলে। এ ঘরে মাথার ওপর মন্থর গতিতে ঘুরছে সেই পুরোনো সিলিং ফ্যান। কাঠের বুককেসগুলোর মধ্যবর্তী ব্যবধানে জানালাগুলো এখন খোলা, খসখসের আবরণ সরে গেছে একপাশে। ঘরের কোণে সেই ময়ূরমুখী আধমানুষ-সমান উঁচু প্রদীপদানে সন্ধেবেলা প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে কেউ। বাসবান্না আর আমার মাঝখানে জলপাইরঙের টেবিলক্লথে ঢাকা ছোটো টেবিলটার একপাশে কাঁসার পুষ্পপাত্রে কতগুলো রজনীগন্ধার পুষ্পিত বাহু, সেই ফুলের গন্ধের সঙ্গে মৃদু কর্পূরের ঘ্রাণ মিশে আছে এ ঘরে। কুলুঙ্গিতে সবুজ রঙের ঘোমটা দেওয়া একটা টেবিলল্যাম্প–তার সবজেটে আলোর সঙ্গে পিলসুজের ওপর পিত্তল প্রদীপের ম্লান আভা মিশে ঘরের মধ্যে যেন একটা মায়াবী রূপকথার পরিবেশ রচনা করেছে।

আমি বলে উঠলাম, ‘ওর নাম কাঁকন দাশগুপ্ত। আগে চিনতাম না, সমুদ্রতীরে দেখা হল। বলছে নাকি, আমার লেখাপত্তর পড়েছে সব। আমি ওকে আপনার কন্নকী-কোভালনের গল্পটা বলছিলাম। কিন্তু সবটা তো বলেননি এখনও আপনি আমাকে। তাই এর পরে কোভালনের কী হল, শুনতে এসেছে।’

বাসবান্নাকে কাঁকনের সমস্ত ব্যাপারটা ঠিক খুলে বলা গেল না। গল্পের বই (যা এখনও লেখাই হয়নি) পড়তে পড়তে মেয়েটি কীভাবে যেন স্বপ্নসদৃশ কোনো অভিজ্ঞতার ঘোরে মাদ্রাজে এসে পড়েছে—একথা বললে বাসবান্না কি বিশ্বাস করবেন? আমাকে পাগল বা মিথ্যুক, কী যে ভাববেন তিনি! এমনকি আমি নিজেও যে এই মায়া-অভিজ্ঞতার ঘোরের ভিতর দিয়েই এখানে এসেছি মনে হচ্ছে অথবা তাঁর সঙ্গে কথা বলছি মনে হচ্ছে—এসব যে কী উদ্ভট! বাসবান্না নিজেও যে আসলে কী—বাস্তব নাকি স্বপ্নরচিত, তাও তো আমি স্থির করতে পারিনি ।

‘বাব্বা! পাঠিকা ? এরই মধ্যে তুমি পাঠক-পাঠিকা জোগাড় করে ফেলেছ?’

‘বেশি না, বাসবান্না, কতিপয়!’

আমার কথায় বাসবেশ্বরণ জোরে হেসে উঠলেন। আর তখনই দরজার পর্দা সরিয়ে একজন মাঝবয়েসি লোক একটা ট্রে-তে করে আমাদের জন্য জলখাবার নিয়ে এল। খাস মাদ্রাজি রীতিতে কফিভর্তি অ্যালুমিনিয়ামের টাম্বলার ছোটো ছোটো কানা-উঁচু বাটির ওপর বসানো। সঙ্গে কিছু মুচমুচে স্বাদিষ্ট অনুপান। আমি কাঁকনকে বারান্দা থেকে ডেকে নিয়ে এলাম ।

বাসবান্না কাঁকনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি এখনও পড়াশোনা করছ?’

কফির পাত্রে মৃদু চুমুক দিয়ে কাঁকন ঘাড় কাত করে বলল, ‘হ্যাঁ। রবীন্দ্রভারতীতে মাস্টার্স করছি। ফাইনাল ইয়ার।’

‘কী বিষয় তোমার?’ মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন বাসুদা

‘ইংরেজি সাহিত্য।’

টাম্বলার থেকে ছোটো কানা-উঁচু পাত্রে কফি ঢালাঢালি করতে করতে বাসবান্না হাসিমুখে বলে উঠলেন, ‘চমৎকার! সাহিত্যের ছাত্রী! সাহিত্যের ছাত্র বা ছাত্রী হওয়ার ভীষণ একটা সুবিধে যে, অল্প বয়েসেই পৃথিবীর নানা দেশের সাহিত্যের সঙ্গে সহজেই পরিচয় হয়ে যায়।’

‘তাই কি?’ কাঁকন প্রশ্ন করল ফিরে।

‘তাই নয়?’

‘আমাদের সিলেবাসে তো অত কিছু পড়তে হয় না। সিলেবাস বদলায়ওনি তেমন। বহু বছর একই জিনিসপত্তর আছে।’

‘তা হয়তো ঠিক। তবু ইচ্ছে থাকলে, পড়তে পারো। তোমাদের সুযোগ অনেক বেশি অন্যান্য সব বিভাগের তুলনায়। শোনো, এমএ করার পরে আরও পড়াশোনা করতে চাও ?’

‘ইচ্ছে আছে,’কাঁকন মৃদু হেসে বলল ৷

‘তাহলে বলি শোনো, চেন্নাই চলে এসো। এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হও। আমার বাড়িতেই থাকতে পারো। কি, থাকবে না?’

বাসবান্নার সমস্যাই ওই। একটা প্রসঙ্গ পেলেই হল, আগুপিছুর সব কথা ভুলে তখনকার মতো সেই প্রসঙ্গ নিয়েই কথা চালাচালি করে যাবেন। এখন কাঁকনের পড়াশোনার কথা উঠেছে। তো এবারে কতক্ষণে যে এ বিষয়ে আলাপ শেষ হবে, কে জানে !

বাসবান্নার প্রশ্নের উত্তরে কাঁকন মিষ্টি হেসে বলল, ‘নিশ্চয়ই থাকব। যদি আপনি থাকতে দেন। আর যদি এরকম রোজ সন্ধেয় আমাকে বিস্মৃতপ্রায় প্রাচীন সাহিত্যের গল্প বলেন।’

বাসবান্না মহা উৎসাহে বললেন, ‘সে তোমাকে আমি বলব। অবশ্যই বলব। এসব এখন ক-জন শুনতে চায়, বলো তো? তুমি শুনতে চাইলে বলব বই-কী ! এই সুবিশাল তামিল সাহিত্যের কথাই ধরো না
! কত যে গল্প এর কত যুগের, তার কি ইয়ত্তা আছে ?… কোভালন-কন্নকীর গল্প তো সেই সুবিপুল কথাসাগরের একটা মাত্র ঢেউ।’

আমি বুঝলাম, এই তো সুযোগ এসেছে। এখন আর দেরি নয়। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘সেটুকুও তো আমরা পুরোপুরি জানতে পারিনি এখনও, বাসুদা। বলুন না, কী হল কোভালনের এর পর?’

বাসবান্না নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়ে বসলেন এবার। তারপর বললেন, ‘হ্যাঁ, বলছি। কিন্তু কোভালনের গল্পটা এর পরে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে মাধবীর গল্প বলতে হবে। আবার মাধবীর গল্পে যাওয়ার আগে বেশ কিছু বছর পিছিয়ে ইন্দুমুখীর কথা বলা দরকার । ইন্দুমুখীর কথার সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে মিশরীয় এক যুবক আমেনহোটেপ। বোঝো কেমন সব এটার সঙ্গে ওটা, ওটার সঙ্গে সেটা জড়িয়ে যাওয়া গোলকধাঁধার মতো ব্যাপার!’

কাঁকন বলল, ‘তা হোক। আপনি বলুন, আমরা শুনব।’

বাসবান্না নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে বলতে আরম্ভ করলেন, ‘ইলাঙ্গো আডিগলের লেখা শিলল্পদিকরম-এ অবশ্য ইন্দুমুখী-আমেনহোটেপের এ আখ্যান নেই। ওদের আখ্যান যেভাবে আমি লোকমুখে শুনেছি, যেভাবে আমার মনের মধ্যে এসেছে, সেভাবেই বলছি। আসলে ইন্দুমুখীকে না বুঝলে তার কন্যা মাধবীর চরিত্র বুঝতে পারবে না তোমরা।’

‘আমরা যে-সময়টার কথা বলছি, তার থেকে দুই দশক আগের কথা। সে সময় আমেনহোটেপ এ দেশে এসেছিল এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। এক বিশেষ জ্ঞান সে খুঁজছিল। আর তার সেই অন্বেষণের পথে তার দেখা হয়েছিল তামিল পণ্ডিত ধাতুধরণের সঙ্গে…’ বাসবান্না ধীরগতিতে প্রবেশ করলেন এবার আখ্যানে। এবং তাঁর কথা শুনতে শুনতে আগের বারের মতন এবারেও সেই অদ্ভুত ব্যাপারটা হতে লাগল আমার মধ্যে । এ ঘর, কাঁকন, বাসবান্না সব মুছে গিয়ে শুধু যেন জেগে উঠতে লাগল বাসবান্নার মন্ত্র কণ্ঠস্বর। আবার শুধু যে সেই কণ্ঠস্বর আমি শুনে চলছিলাম তাও নয়; শোনার সঙ্গে সঙ্গে এবারেও যেন দেখতে পাচ্ছিলাম কতশত বছর আগের সেই সব লুপ্তপ্রায় দৃশ্যাবলী । যেন আবছা কুয়াশার পর্দার ওপর এ মহাকাহিনির, এ কথনবিশ্বের পাত্র-পাত্রী, ঘটনাস্রোত ছবির মতন ফুটে উঠছে একের পরে আরেক।

(তেরো) সন্ধানী

‘আমি জানি ও বস্তু কোথায় আছে, কার কাছে আছে। কিন্তু সেকথা জেনে তোমার কোনো লাভ হবে না, যুবক!’ কথাটা বলেই পণ্ডিত ধাতুধরণ অপাঙ্গ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপের দিকে চাইলেন। তারপরই চকিতে কণ্ঠলগ্ন অঙ্গবস্ত্রটি দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডল মার্জনা করে নিলেন।

আমেনহোটেপ বিভ্রান্ত বোধ করছিল। রৌদ্র থেকে ছায়াবৃত্তের মধ্যে সরে এসে নিম্নস্বরে সে বলল, ‘কিন্তু কেন? আমি তো ও পুথির জন্য শত দ্রম্ম দিতেও প্রস্তুত। তাহলে…’

আমেনহোটেপের মুখের কথা মুখেই রইল, সুদীর্ঘ শিখাসমেত শিরোদেশ দুপাশে দুলিয়ে ধাতুধরণ অট্টহাস্যে ফেটে পড়লেন। খানিক পরে নিজেকে সামান্য সামলে নিয়ে বাজপাখির মতন সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করতে করতে বললেন, ‘ঐতিহ্য! ঐতিহ্য কী জিনিস, তা কি তুমি বোঝো, হে মিশরীয় ?’

ঐতিহ্য? আমেনহোটেপের হাসি পাচ্ছিল। বিগত সহস্র সহস্র বৎসর ধরে যে-পুরোহিতেরা প্রাচীন ফ্যারাওদের সেবা করে এসেছেন, তাঁদেরই রক্ত বইছে আমেনহোটেপের শিরায়, ধমনীতে। সেই মহান পুরোহিতবংশের উত্তরাধিকারী আমেনহোটেপকে আজ ঐতিহ্য বোঝাচ্ছে তামিল ব্রাহ্মণ ধাতুধরণ ? সময়ের কী বিচিত্র পরিহাস! দীর্ঘকালের ঘোলা জলে সুদূর অতীতের ঐতিহ্য কীভাবে ধুয়ে বেরিয়ে যায়, আমেনহোটেপ তা নির্ঘাত জানে। তা না হলে প্রাচীন যুগে একদিন যে-সোবেক দেবতার ভয়ে সারা মিশর থরথর করে কাঁপত, আজ সেই সোবেক দেবতার মূর্তি খোলা বাজারে রোমান সেঞ্চুরিয়নদের পুত্রকন্যার খেলনা হিসেবে সস্তা দামে বিক্রি হয় ? সোবেকের সেই ভয়ংকর কুম্ভীরাকৃতি মুখকেও কেউ আর ভয় পায় না আজকাল। অর্থ দিয়ে, ক্ষমতা দিয়ে ক্রয় করা যায় না, কী এমন আছে এই পৃথিবীতে? কিন্তু সেসব কথা এই বৃদ্ধ ধাতুধরণকে বোঝানো অসম্ভব। তাই মনের কথা মনেই গোপন রেখে মুখে একটা বিব্রত ভাব ফুটিয়ে তুলে আমেনহোটেপ বলল, ‘তবু আপনি বলুন, ব্রাহ্মণ! কোথায় গেলে ও পুথির দেখা মিলবে? কার কাছে আছে? কিনতে না পারি, চোখে দেখেও তো একবার সাধ মেটাতে পারব, নাকি?’

ধাতুধরণ গম্ভীর ভাব ধারণ করলেন। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘রাজনর্তকী ইন্দুমুখীর কাছে ও পুথি আছে। ওই পুথি ওদের পারিবারিক সম্পত্তি। ইন্দুমুখী, তার মা করুণৈ, করুণৈ-র মা সুধাবিন্দু, তারও পূর্বনারীরা সকলেই ছিল রাজনটী। ওই বারাঙ্গনাদের পরিবারটিই ওই পুথির অধিকারী। ও পুথির প্রতিদিন পূজা না করে তারা জলগ্রহণ পর্যন্ত করে না আজও অবধি।’

‘শুধু পূজা করে? পুথিটি কি তারা পড়েনি, বিপ্র?’ আমেনহোটেপের কৌতূহল বাঁধ মানতে চায় না।

‘পড়বে না কেন? ইন্দুমুখীর মতো-বিদুষী নারী—যার পাণ্ডিত্যের কাছে চোলরাজার সভাপণ্ডিতরা পর্যন্ত হার মেনে যায়—সে ওই পুথির চর্চা করেনি বলছ? সেই চৰ্চা সে করেছে, খুবই করেছে। চর্চা না করলে লোকের মুখ দেখামাত্রই ইন্দুমুখী মানুষের মনের ভাব বুঝে যায় কীভাবে? কিন্তু একথাও ঠিক যে, সে-পুথি তাদের পারিবারিক উপাসনালয়ে রক্ষিত অতি পবিত্র বস্তু। হাতে নিয়ে একবার তোমাকে দেখতে দিলেও দিতে পারে, তবে অর্থের মূল্যে বিক্রয় করবে—এমন দুরাশা তুমি স্বপ্নেও কোরো না,’ বলতে বলতে ধাতুধরণ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁকে অন্যত্র কোথাও যেতে হবে, অযথা বাক্যালাপে কালক্ষয় করার মতন অবসর নেই ।

অগত্যা ব্যর্থমনোরথ আমেনহোটেপ তামিল পণ্ডিত ধাতুধরণের কুটির পরিত্যাগ করে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হল। চারিদিকে প্রখর রৌদ্র। পন্থা অতিবাহন করতে ক্লান্ত লাগছিল। তবুও এত ব্যর্থতা সত্ত্বেও এক বিষয়ে কিন্তু কিছুটা স্বস্তি। আজ এতদিন পরে অন্তত ‘সামুদ্রচন্দ্রিকা’ পুথির খোঁজ পাওয়া গেছে। ওহ্, কম আয়াস সে করেছে আজ এই কটা বছর এর জন্যে ?

দেশে ঘরে থেকে দিন চালানো তাদের কঠিন হয়ে উঠেছে। প্রাচীন থেবাই নগরীতে আমেনহোটেপের পৈতৃক ভিটে। থেবাই নগরীর সে-জলুস যেমন আর নেই, রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হয়ে মিশরীয়দের একদা সমৃদ্ধ রাজধানীটি আজ যেমন প্রায় এক ধুলামাখা গ্রাম, ঠিক তেমনই থেবাইয়ের পুরোহিতকুলগুলিও দারিদ্র্যদুঃখে আজ বহু শতক ধরে নিপতিত। তাদের কুলোচিত বিদ্যা কিছু কিছু এখনও আমেনহোটেপের আয়ত্ত, কিন্তু বিদ্যা থাকলেই কি আর হয়? সেসব বিদ্যার চাহিদা সমাজে এখন ফুরিয়ে এসেছে। এখন মানুষের মনে আছে শুধু জ্যোতিষশাস্ত্রে আগ্রহ, ওই দিয়েই যা যতটুকু উপার্জন। থেবাইয়ের ছেলেবুড়ো ছাড়াও রোমান সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা, সেনাপ্রধান লেগেটরা আসে ভবিষ্যৎ জানতে। তাদের ভবিষ্যৎ বলে দেয় বটে আমেনহোটেপ, কিন্তু নিজের ভবিষ্যৎ কী, তা সে দেখতে পায় না ।

বরং অতীতের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে থাকে আমেনহোটেপ। বেশ বুঝতে পারে, হাজার পাঁচেক বছরের এত প্রাচীন একটা সমৃদ্ধ দেশ মিশর, শুধু পিরামিড গড়তে গড়তেই কীভাবে তার আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছে। মিশরের বিপুল ধনরত্ন-সম্পদ চিরকালই লুব্ধ করে এসেছে বৈদেশিকদের। মিশর জুড়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের অভ্যন্তরীণ কলহ, আর সেই কলহের সুযোগ নিয়ে একের পর এক আছড়ে পড়েছে বিদেশী শক্তি মিশরের মাটিতে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই বৈদেশিক আক্রমণের ঢেউ। প্রথমে আসিরীয়, তারপর পারসিক, তারপর গ্রিক, অবশেষে গত দুশো বছর ধরে চলছে রোমান সাম্রাজ্যের শাসন।

সে-মিশর আর নেই, অবলুপ্ত হয়ে গেছে ফ্যারাওদের নীলনদের দুই তীরবিস্তারী সাম্রাজ্য, থেবাই গিয়েছে, মেমফিস গিয়েছে, যেন একটা প্রকাণ্ড ধ্বংসস্তূপের উপর বসে আছে আমেনহোটেপ ও অন্যান্য প্রাচীন পরিবারের সন্ততিরা। নিজের নামটার দিকে তাকাতে পর্যন্ত লজ্জা লাগে আমেনহোটেপের। ওই নামে তিন-তিন জন প্রবল পরাক্রান্ত ফ্যারাও ছিলেন একদা মিশরে। পিতামাতা হয়তো সেসব অবসিত গৌরবের আগুনেই হাত-পা সেঁকতে চেয়েছিলেন পুত্রের নামকরণের সময়; কিন্তু একটু বড়ো হতেই এই নাম তার আত্মমর্যাদায় উত্তাপ ছড়িয়েছে যত, তার থেকে ছ্যাঁকা দিয়েছে বেশি। আ-মে-ন-হো-টে-প! কোথায় সেই সব পরাক্রান্ত সম্রাট, আর কোথায় এই দরিদ্র ধুলামলিন জ্যোতিষী।

তবু সে যুবক—আত্মগ্লানিতে ডুবে থাকা তার সাজে না। যুবাবয়সের ধর্মই হল অন্ধকারের মধ্যে নতুন কোনো পথ খোঁজা। সেই পথই খুঁজছিল আমেনহোটেপ থেবাইতে বসে। কিন্তু কিছুতেই আয়বৃদ্ধি আর করতে পারছিল না। অবশেষে….

অবশেষে সে একটা অদ্ভুত বিদ্যার খোঁজ পায় এক রোমান ব্যাপারীর কাছে। ব্যাপারীরা জলযানে চড়ে কত দূর দূর দেশে ভেসে যায়। সেসব দেশ থেকে শুধু মুনাফা আর বাণিজ্যদ্রব্য নিয়েই দেশে ফেরে না, নিয়ে আসে অজস্র সম্ভব, অসম্ভব গল্প। তো সেই রোমান ব্যাপারী ভারতবর্ষ বলে একটা দেশ থেকে ফিরেছে তখন সদ্য। সে-লোকটাই প্রথম আমেনহোটেপকে বলেছিল এক বিচিত্র বিদ্যার কথা।

এমন নাকি শাস্ত্র আছে, যার সাহায্যে মানুষের শারীরিক গঠন থেকে মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে বলে দেওয়া যায়। শরীরের কোথায় কোথায় তিল থাকলে মানুষটা কামুক প্রকৃতির হয়, হাত-পায়ের আঙুলের দৈর্ঘ্য থেকে স্থির করা যায় মানুষটা কোমল নাকি কঠোর, শৌচাদিগমনকালে মূত্রধারা বামদিকে হেলে গেলে লোকটা ভোগী, ডানদিকে হেলে গেলে ত্যাগী, নিদ্রাকালে কতটা নিঃশ্বাস পড়ছে তার থেকে বলা যায় মানুষটা কতদিন বাঁচবে…. এমনই আরও কত যে আজব সব নির্ণয়! আর এসব নির্ণয় নাকি অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত হয়েছে, এমনই বলছিল সেই রোমান বণিক।

শুনতে শুনতে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে যুবক আমেনহোটেপ। তা কী নাম এই শাস্ত্রের ? রোমান ব্যাপারী বলল, এর নাম হল সামুদ্রিক শাস্ত্র। ভারতে, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে, এই শাস্ত্র খুবই প্রচলিত। প্রচলিত রয়েছে বিশেষত রাজবংশাবলীর ভিতর। এই বিদ্যার সহায়তায় ভারতবর্ষের রাজারা নাকি নিজেদের ও অন্যদের চরিত্র নির্ণয় করে কর্তব্যকর্ম সম্পাদনা করে থাকেন ।

এসব শুনতে শুনতে মাথার ভেতর যেন একটা পর্দা খুলে যায় আমেনহোটেপের। একবার যদি সে এই বিদ্যা আয়ত্ত করতে পারে, তাহলে এ দিয়েই তো সে তার ভাগ্য-পরিবর্তন করে ফেলতে পারবে! কোনো মিশরীয়র কাছে এই বিদ্যা নেই। এই সামুদ্রিক শাস্ত্র শিখে নিতে পারলে জ্যোতিষী হিসেবে তার কদরও বেড়ে যাবে খুবই। তখন কি আর সে এই থেবাইতে বসে থাকবে? রোমান সেঞ্চুরিয়নের প্রাসাদে বসে সে ভাগ্য গণনা করবে, কে কতদিন বাঁচবে, কখন যুদ্ধ ঘোষণা করা ঠিক হবে, কার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করতে হবে, কাকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া যাবে না—সব সে অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করে দিতে পারবে। কী বিপুল খ্যাতি হবে তার, কত উপার্জন হবে—ভাবতে ভাবতে আমেনহোটেপের মন স্বপ্নরঙিন হয়ে ওঠে। কে বলতে পারে, হয়তো স্বয়ং সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস অ্যান্টোনিনাস-এর প্রাসাদেই তার ডাক পড়বে। এই রোমান সম্রাট অরেলিয়াস যে খুবই বিদ্যোৎসাহী, সেকথা তো সে শুনেছে। রাজানুগ্রহে নিজ পরিবারের হৃতগৌরব উদ্ধার করতে পারবে সে এই সামুদ্রিক শাস্ত্রের সাহায্যেই।

কিন্তু এ জিনিস শেখা যায় কোথা থেকে? ব্যাপারীদের মুখে সে শুনেছিল, ভারতের লোক সহজে কোনো বিদ্যা হস্তান্তর করতে চায় না। তার জন্যে নাকি ‘অধিকারী’হতে হয় । রোমান ব্যাপারীটি আরও বলেছিল, সামুদ্রিক শাস্ত্রের অনেক পুথিই নাকি ভারতে চালু আছে, যদিও সেসব পুথি আসলে একটি মূল পুঁথিরই বিকৃত অনুকরণ। আর বিকৃত অনুকরণ হলে যা হয়, ওসব পুথিতে ভেজাল মিশে গেছে অনেক। মূল পুথির নাম—’সামুদ্রচন্দ্রিকা’। তামিল ভাষায় লেখা। সে-পুথির নাম শোনা যায় বটে, কিন্তু তার দেখা পাওয়া দুষ্কর। কোথাও কোনো সম্পন্ন পরিবারে লুকোনো আছে হয়তো তার একটি দুটি অনুলিপি। তবে তামিল ভাষার পুথি যখন, তখন থাকলে ভারতের দক্ষিণদেশগত কোনো স্থানেই থাকবে ।

ধীরে ধীরে মনস্থির করে ফেলেছিল আমেনহোটেপ। এখনও সে বিয়ে-থা করেনি, মা-বাপ ছাড়া সংসারে অন্য পিছুটান নেই। অনেক ভেবে-চিন্তে ব্যাপারীদের বাণিজ্যপোতে চেপে বসেছিল সে। যে-সময়ের কথা বলছি, সেই খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকেরও বহু পূর্বকাল থেকেই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রপথে বাণিজ্য-সম্পর্ক রচিত হয়েছে কত ভিনদেশের। গ্রিস, রোম, আরব, ব্যাবিলন, আলেকজান্দ্রিয়া—কত দূর দেশ থেকে সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস গায়ে মেখে বণিকের দল ভারতে আসত বাণিজ্যের প্রয়োজনে। আমেনহোটেপও অমনই তিন মাস্তুল টাঙানো অর্ণবপোতে চেপে বসল একদিন। লক্ষ্য সেই সাগরপারের ভারতবর্ষ। সেই বাণিজ্যতরীর গঠন বড়ো অদ্ভুত, কাঠের তক্তাগুলো পেরেক বা আংটা দিয়ে জোড়া নয়, বরং অত্যন্ত মোটা ও শক্ত কাছি দিয়ে বাঁধা — সামুদ্রিক তুফান কিংবা ভারত মহাসমুদ্রের প্রবালদ্বীপের সংঘাত সেই সুদৃঢ় কাছির বাঁধনই একমাত্র সহ্য করতে পারে, পেরেক বা আংটা নয়। জাহাজে মাঝি-মাল্লা-ব্যাপারীরা ছাড়াও ক্রীতদাসদাসী, বাণিজ্যোপযোগী সুরা, সোনা, টিন, সিসা, প্রবাল, মুক্তা ও নানা দুর্মূল্য রত্নরাজি বোঝাই।

এসবের মধ্যেই একপাশে আমেনহোটেপ চলেছিল দীর্ঘ এক বর্ষব্যাপী ক্লেশকর সমুদ্রযাত্রায়। অর্ণবপোতেও সে নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকেনি। সৌভাগ্যক্রমে এ যাত্রায় সে পেয়ে গিয়েছিল এক তামিল বণিকের সাহচর্য। তার কাছ থেকে তামিল ভাষা বলতে, বুঝতে, লিখতে, পড়তে শিখেছিল সে। খুব বেশি যে শিখতে পেরেছিল, তা নয় । তবু যতটুকু তামিল ভাষা জানলে বাগ্‌বিনিময় করা সম্ভব হয়, ততটুকু অন্তত শিখেছিল আমেনহোটেপ। সমুদ্রপথে ভারতে পৌঁছে দক্ষিণদেশের প্রধান প্রধান বাণিজ্যবন্দর— নিরণম্, বিলীনম্, মুচিরি, টোন্ডি, মরণ্ডাই, নারাভু, বরকলাই, পোরকাড, কুমারী, মারুঙ্গুপট্টিনম্, কয়াল, সালিয়ুর, কোরকাই, আরিকামেডু, মারাক্কানম্, নাগপট্টিনম্ সর্বত্র ঘুরেছে সে ওই পুথির সন্ধানে। কিন্তু কোথাও কিচ্ছু পায়নি। অবশেষে কাবেরী নদীর স্রোত বেয়ে এসে পৌঁছেছে এই কাবেরীপট্টিনম্ পুষ্পহার নগরে। যতজন বিশেষজ্ঞের কাছেই সে গিয়েছে, শেষ পর্যন্তসকলেই এই পুষ্পহার বা পুহার নগরীর দিকেই অঙ্গুলীনির্দেশ করেছেন। থাকলে সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি ওই পুহারেই থাকবে, না থাকলে অন্যত্র কোথাও নয়—এই ছিল বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

কিন্তু আজ এ কী হরিষে বিষাদ হল? পুথির খোঁজ যদি-বা পাওয়া গেল, তারই সঙ্গে জানা গেল সে-পুথির অপ্রাপণীয়তা। পুষ্পহারের জনাকীর্ণ রৌদ্রদগ্ধ জনপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হতাশ ক্ষিন্ন মনে আমেনহোটেপ ভেবে চলেছিল এই প্রাণান্ত প্রয়াসের এমন প্রায়-অসফল পরিণতির ব্যাপার।

পুষ্পহারের রাজপথ বেয়ে চলেছে অগণ্য মানুষের স্রোত—ধনী-দরিদ্র নাগরিক, সুবেশ রাজপুরুষবৃন্দ, কলহাস্যমুখরিতা রমণীর দল, পুরোহিত, সৈনিক, দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ী, ভৃত্য, ভৃতিকা, গণিকা—কে নেই এই জনস্রোতে? পুষ্পহার এক বন্দর-নগরী; তাই নানা দিগ্‌দেশাগত বিচিত্রবেশ অতিথিদেরও এখানে কিছুমাত্র অভাব নেই। বিচিত্ৰদৰ্শন ভিনদেশীদের দেখে এখানকার মানুষ অবাক চোখে তাকায় না আর। আমেনহোটেপ মিশরীয় পুরোহিত, পশুচর্মনির্মিত কোনো আবরণ তখনও অবধি মিশরীয় পুরোহিতদের অঙ্গে শোভা পেত না । আমেনহোটেপের পায়ে প্যাপিরাসের ছাল থেকে তৈরি পাদত্রাণ, কটিদেশ থেকে পদপাত পর্যন্ত লম্বিত শনের আঁশে বোনা ধূসর বস্ত্র, বলিষ্ঠ তাম্রাভ শরীর, কণ্ঠে ও বাহুতে শুষ্ক পত্রাস্থিমালা, দুই আয়ত কালো চোখে গাঢ় কাজলের রেখা টানা, কর্ণে কুণ্ডলজাতীয় কর্ণাভরণ, মুণ্ডিত মস্তকের এক পার্শ্বে লম্বিত সুদীর্ঘ বেণী—এমন বিচিত্র আকার এই মিশরীয় যুবকের—তথাপি পুষ্পহার নগরপথের পথিকেরা, এমনকি অল্পবয়েসি মেয়েরা পর্যন্ত আমেনহোটেপের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে তাকাচ্ছিল না। কাবেরীর জলরেণুমাখা বাতাস মধ্যে মধ্যে পথশ্রান্ত আমেনহোটেপের কপালের স্বেদবিন্দু মুছিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল বটে, কিন্তু আকাশে মেঘ আছে—মোটের উপর আবহাওয়া গুমোট।

আমেনহোটেপ দেখেছে, যখনই সে দ্রুত পায়ে হাঁটে, তখনই ভাবনাগুলো বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। আবার চিন্তা নিয়ন্ত্রিত হলে, শ্বাসপ্রশ্বাস ধীর হয়, চলার বেগ কমে যায়। কিছুক্ষণ দ্রুত হাঁটার পরে সে এখন পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষছায়ার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। মনে হল তার, পণ্ডিত ধাতুধরণের কথায় এখনই এতদূর বিমর্ষ হওয়ার কোনো কারণ আছে কি? আমেনহোটেপ বরং ভাবছিল ইন্দুমুখীর কথা। ধাতুধরণের বয়ান অনুসারে ইন্দুমুখী রাজনর্তকী, বারাঙ্গনা; অথচ সে নাকি এতই বিদুষী যে বিদ্বান পণ্ডিতেরাও তার কাছে হার মেনে যায়। আলেকজান্দ্রিয়াতে এমন কয়েকজন বিদুষী নারীর কথা আমেনহোটেপ শুনেছে, কিন্তু তাঁরা সকলেই সম্ভ্রান্ত গৃহস্থ পরিবারের সন্তান। অথচ এখানে ভারতবর্ষে বারাঙ্গনারা বিদুষী, তাদের গৃহেই সংস্কৃতিমনস্ক বিদ্বান মানুষদের যাতায়াত। আমেনহোটেপ ভাবছিল, সে কি একবার এই ইন্দুমুখীকে দেখতে যাবে না? সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি ইন্দুমুখী বিক্রয় করে বা না-করে, হাতে নিয়ে অন্তত দেখতে একবার দেবে নিশ্চয়। রাজনটী যখন, তখন তার আবাস খুঁজে বের করা এমন শক্ত কী কাজ? ভাবতে ভাবতে আমেনহোটেপ মনস্থির করে ফেলল।

অতঃপর দ্রুত পায়ে অতিথিশালায় ফিরে মধ্যাহ্নভোজন সমাধা করে সে অধীর আগ্রহে সন্ধ্যাগমের অপেক্ষা করতে লাগল।

(চোদ্দো) বিয়োগভয়

বাইরের দিকের একটি আলো-আঁধারি কক্ষে আমেনহোটেপকে বসতে বলে গেছে পরিচারিকা। সম্ভবত এখানেই ইন্দুমুখীর প্রণয়প্রার্থীরা অপেক্ষা করে। ইন্দুমুখীর প্রাসাদটি প্রাচীন ও বৃহৎ, এর সাজসজ্জা দেখে বোঝা যায়, গৃহস্বামিনী বিত্তবতী। তা হওয়াই স্বাভাবিক, চোলরাজার নটী যখন। যেখানে আমেনহোটেপ বসে আছে একটি কাষ্ঠাসনের উপর, সেটি একটি নিম্নবর্তী কক্ষ, এখান থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি একটি দালানের দিকে উপরে উঠে গেছে। এই নিম্নবর্তী কক্ষ আর উপরের ওই দালানের মাঝখানে ঊর্ণাজালের মতন একটি অর্ধস্বচ্ছ পর্দা লম্বিত রয়েছে। এখানে বসে আমেনহোটেপ দালানে কী হচ্ছে না-হচ্ছে, তা আবছামতো দেখতে পাচ্ছিল। পর্দার ওদিকে একটি প্রকৃষ্ট দীপাধারে প্রদীপ জ্বলছে। সেখানে চার-পাঁচ জন মানুষের একটি জটলা। একজন নারী, সম্ভবত সে পর্যঙ্কের উপরে আসীন; অন্যরা সম্ভবত কক্ষের চারিপাশে উচ্চাসনে উপবিষ্ট। কী একটি বিষয় নিয়ে তাদের মধ্যে নিগূঢ় আলোচনা চলছে। আলোচনাকারী ব্যক্তিদের মুখ বা অবয়ব এখান থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না আমেনহোটেপ, কিন্তু একটু সন্তর্পণে কান পাতলে তাদের কথাবার্তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সাধারণ লৌকিক তামিল ভাষায় কথোপকথন চলছে, তাই বুঝতে তেমন সমস্যা নেই।

শ্বাসপীড়িত দুর্বল কণ্ঠে কে একজন পুরুষ বলে উঠল, ‘এখনই এত নিশ্চিত হচ্ছ কী প্রকারে? জ্বরজারি কি মানুষের হয় না? অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে। ঔষধ যা দিয়েছি, খলনুড়িতে মেড়ে যথাসময়ে যদি খাওয়াও আর পথ্যাদি যদি নিয়মিতভাবে চলে, তাহলে এ যাত্রায় কয়েকদিনের মধ্যেই করুণৈ সুস্থ হয়ে উঠবেন বলেই তো মনে হয় আমার। তা আমার উপর কি আর আস্থা রাখতে পারছ না তুমি ?’

সে কথার উত্তরে যেন একটি বীণানিন্দিত করুণ নারীকণ্ঠ বেজে উঠল, ‘না-না, বৈদ্যরাজ ! আপনার উপর ভরসা আমার যায়নি। কিন্তু মা এতদিন ধরে ভুগছেন। যেন বিছানার সঙ্গে তাঁর ক্ষীণতনু মিলিয়ে গিয়েছে। আপনারা তো জানেন, আমি পিতৃপরিচয়হীনা অনাথা । এ মহল্লার সকলেই প্রায় তাই। মায়ের পরিচয়েই আমাদের পরিচয়। আমার যা কিছু শিক্ষা—নৃত্যকলা, সঙ্গীত, প্রসাধন, শাস্ত্রবিদ্যা—সবই আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি। তাঁর অনুপস্থিতি আমি কল্পনাও করতে পারছি না। সেই জন্যেই এতটা ভয় আমার প্রাণে চেপে বসেছে। ঔষধ, পথ্যাদি নিয়মিত চলছে ঠিকই, তবু মায়ের একটা ব্যাপার আমি প্রায় নিশ্চিতভাবেই জেনে ফেলেছি, ভিষগ্‌!’

পূর্বের সেই শ্বাসাহত পুরুষকণ্ঠ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী জেনেছ, ইন্দুমুখী?’

‘মায়ের শরীরের স্ফীতি, গতি ও অন্যান্য শারীরিক চিহ্নাদি বলছে, মায়ের আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে এসেছে। খুব বেশি হলে আর এক পক্ষকাল। আপনারা জানেন, সামুদ্রিক শাস্ত্রের গণনা অভ্রান্ত!’

ঘরের ভিতর সুবিপুল নিস্তব্ধতা। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলছে না। এরই মধ্যে বোধহয় কোনো পরিচারিকা দালানে ঢুকল। কঙ্কণবলয়ের ঠিনঠিনি তুলে পরিচারিকাটি সম্ভবত গৃহস্বামিনী ও অতিথিবর্গকে সুরা পরিবেশন করল। আরও কিছুক্ষণ পরে জনৈক যুবাবয়স্ক কেউ বলল, ‘এখনই এত শোকার্ত হলে কি চলে, প্রিয় বান্ধবী? কতদিন হল তুমি ঠিকমতো স্নান-পান-আহারাদি করছ না। কেশসংস্কারও করনি। রাজপুরী থেকে এখনই যদি ডাক আসে, কী করবে তুমি? সেই তো প্রস্তুত হয়ে যেতে হবে।’

ভারী দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নারীকণ্ঠ ঈষৎ জড়িত স্বরে বলল, ‘সে তো আমার কর্তব্য, কুমারণ! কর্তব্যপালনে শৈথিল্য করব না আমি। কিন্তু এর মধ্যে মা চলে গেলে কী হবে আমার, ভেবে দেখেছ?’

এবার অন্য এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের কণ্ঠস্বর বেজে উঠল, ‘দ্যাখো, ইন্দুমুখী! অযথাই দুশ্চিন্তা করছ তুমি। মা-বাপ কারওই চিরকাল থাকে না।’

‘কিন্তু মা? মায়ের কী হবে? মা কোথায় যাবে? এভাবেই মায়ের শেষ?’ ইন্দুমুখীর উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর।

আবার সেই মধ্যবয়স্ক পুরুষ: ‘সকলেরই যা হয়, তোমার মায়েরও তাই হবে। তুমি তো মনস্বিনী ! শাস্ত্রবাক্য তোমার অবিদিত নয়। মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়—হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা সাধনা করে তাই-ই তো আবিষ্কার করেছেন। এসব তুমি জেনেও বালিকার মতন উদ্বিগ্ন হচ্ছ মিছিমিছি। সাপের খোলস তুমি দ্যাখোনি কি? খোলসের অন্য নাম কঞ্চুক। কঞ্চুক জীর্ণ হলে সাপ সেই কঞ্চুক ছেড়ে চলে যায়। আবার কালক্রমে সাপ নতুন কঞ্চুক নির্মাণ করে নেয় নিজের চারিদিকে। ঠিক তেমনই দেহেরই মৃত্যু হয়, দেহীর কখনও মৃত্যু হয় না। সাপ যেমন বিশীর্ণ কঞ্চুক ছেড়ে চলে যায়, দেহ জীর্ণ হলে দেহী জীবাত্মাও তেমনই সেই রোগজীর্ণ দেহ পরিত্যাগ করে চলে যায়। আবার নতুন দেহ নির্মাণ করে নেয় জন্মান্তরে। দেহটা তো তুচ্ছ একটা কঞ্চুকের মতন।’

নারীকণ্ঠ অধীর স্বরে বলে উঠল, ‘জানি, জানি, এসব কথা তো আমি জানি । মৃত্যুতে দেহেরই বিনাশ, আত্মা মৃত্যুহীন—এসবই তো অমোঘ শাস্ত্রবচন ! কিন্তু আমি অজ্ঞানাচ্ছন্ন সামান্য মানুষ । আমি তো মাকে এতদিন ওই দেহরূপেই দেখে এসেছি। মাকে ওই দেহ বলেই জানি। আমার মায়ের মৃত্যু হলে আপনারা তো তখন তাঁর মৃতদেহ চিতাগ্নিতেই অর্পণ করবেন, তাই না?’

শ্বাসাহত ভিষগের স্বর বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই তো প্রথা! সাধু হোক, চোর হোক, রাজা হোক, ভিক্ষুক হোক, নটী হোক বা সতী হোক—আগুন সবারই শরীর খায়। এতে অস্বাভাবিক কী আছে? এ নিয়ে প্রশ্ন করছ কেন?’

আবার কিছুক্ষণের স্তব্ধতা। তারপর নারীকণ্ঠে যেন মন্থর চিন্তা মিশ্রিত হল, ‘প্রশ্ন করছি… কেননা… তারপর থেকে আমি তো আর আমার মায়ের মুখ দেখতে পাব না… যে-মুখ দেখে রোজ ঘুম থেকে উঠতাম, সে-মুখখানি দেখব না আমি আর । যে-হাত বেদনার মুহূর্তে আমার পিঠের উপর সান্ত্বনার মতো নেমে আসত, সে-হাতের আদর পাব না আর কোনোদিন ! যে-চোখের তারায় ভরা মমতার মেঘ আমার বুকের জমিতে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসত শ্রাবণসন্ধ্যায়, সে-চোখ তখন আর নেই… যে-বুকে মুখ গুঁজে আমি দিনান্তে ভুলে যেতাম জগতের দেওয়া যত অপমান লাঞ্ছনা, সে-বুক তখন এক মুঠি ছাই হয়ে যাবে…ওহ্, মায়ের অদর্শনে কীভাবে যে আমি বাঁচব সেই অমোঘ শূন্যতা বুকে নিয়ে…?’

সকলেই চুপ করে গেল। সব কথা যেন নৈঃশব্দ্যের মধ্যে জমাট পাথর হয়ে গিয়েছে। সেই নীরবতা ইন্দুমুখীর শোক, তাপ, উদ্বেগের উপর নিরাময়ের সান্ত্বনা দিতে পারল না । অবশেষে এক এক করে নিঃশব্দে অতিথিরা গাত্রোত্থান করলেন। ঊর্ণাসদৃশ যবনিকা সরিয়ে দালান থেকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে আমেনহোটেপের পাশ দিয়ে তাঁরা একে একে প্রাসাদ হতে নিষ্ক্রমণ করতে লাগলেন । তাদের মধ্যে কেউ কেউ উপেক্ষাভরে আমেনহোটেপের দিকে একবার চেয়ে দেখলেন, কিন্তু কেউই কিছু বললেন না । এখন দালানে উর্ণার অন্তরালে পর্যঙ্কের উপরে কেবল ইন্দুমুখীর অস্পষ্ট উপস্থিতি আভাসিত হতে লাগল ।

প্রায় অর্ধদণ্ড পরে পূর্বদৃষ্ট পরিচারিকাটি এসে আমেনহোটেপকে ভিতরে যেতে বলল। আমেনহোটেপ সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে ঊর্ণা সরিয়ে দালানের মধ্যে উপস্থিত হল। স্বপ্নালোকিত দালানটির চারিদিকে ইতস্ততোবিক্ষিপ্ত কাষ্ঠাসনগুলির আবরণ মর্দিত, একখানা উৎপীঠিকার উপর কতগুলো অর্ধপূর্ণ পানপাত্র ও চষক পড়ে রয়েছে। কিন্তু সেদিকে ভালো করে দৃষ্টিক্ষেপের আগেই আমেনহোটেপের চোখ দালানের কেন্দ্রে পর্যঙ্কের উপর একটি কোমল উপাধান-আশ্রয়ী অর্ধশায়িত নারীমূর্তির প্রতি ধাবিত হল। যদি আকাশের বিদ্যুতকে কোনো মন্ত্রবলে স্তম্ভিত করা যায়, একমাত্র তবেই এ নারীরূপের তুলনা হতে পারে। অথবা শয্যার উপর অর্ধশায়িত একটি সুবঙ্কিম তরবারিই বুঝি এ সুন্দরীর সার্থক উপমা। যুবতী ঈষৎ শ্যামাঙ্গী, কিন্তু তার নির্মেদ শরীরের প্রতিটি বক্রতা অতি নিখুঁত, পরনে ঈষৎ স্বচ্ছ ঘাগরা জাতীয় একটি পরিধেয়, সুকোমল পদপল্লবে সুচারু নুপূর, উন্মুক্ত বাহুলতা দুটি তরুণ কদলীকাণ্ডের মতন কমনীয়, হাতের প্রতিটি আঙুল চম্পককলির মতন সুচারু, কেশপাশে উন্মুক্ত ঝটিকার মেঘ আর তার সেই কালো চোখদুটিতে যেন সুদূর সিন্ধুপারের কোনো নির্জন বিষাদমধুর দ্বীপভূমির আহ্বান।

নারীর ইঙ্গিতে আমেনহোটেপ আসন গ্রহণ করল। কিছু পরে জড়তা পরিহার করে সে মুখ খুলল, ‘অভিবাদন, ভদ্রে ইন্দুমুখী ! আমি মিশরদেশাগত পুরোহিত আমেনহোটেপ। একটি বিশেষ প্রয়োজনে আমি আপনার দর্শনপ্রার্থী।’

ইন্দুমুখী প্রত্যভিবাদন জানাল। তারপর বলল, ‘আমার সঙ্গে কী প্রয়োজন, যদি সংক্ষেপে বলেন, ভদ্র!’

আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘পেশায় আমি জ্যোতিষী। আমাদের মিশরদেশের জ্যোতিষশাস্ত্র ভারতের জ্যোতিষশাস্ত্রের থেকে নানাভাবে ভিন্ন। সম্প্রতি এক বিশেষ বিদ্যার সন্ধানে আমি এদেশে এসেছি। বস্তুত সে-বিদ্যার চর্চা আমার স্বদেশে মোটেই হয় না।’

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমেনহোটেপের মুখের দিকে খানিক নিরীক্ষণ সেরে নিয়েই ইন্দুমুখী তরল কণ্ঠে বলে উঠল, ‘আপনি কি সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথির জন্য আমার কাছে এসেছেন ? ও পুথি আমার কাছে আছে, একথা কে বলল আপনাকে—পণ্ডিত ধাতুধরণ?’

চমৎকৃত হওয়ারই কথা ! এই নারী মেধাবিনী, একথা আমেনহোটেপ আগেই শুনে এসেছে। কিন্তু এতটা বুদ্ধিমতী, ভাবতে পারেনি। তবু চমৎকৃত হয়ে বসে থাকার সময় এখন নয়, আমেনহোটেপ দ্রুত উত্তর দিল, ‘আপনি ঠিকই ধরেছেন, মনস্বিনী! কিন্তু আপনি কীভাবে—?’

ঈষৎ দর্পিত ভঙ্গীতে হেসে উঠে ইন্দুমুখী বলল, ‘সে-অনুমান করা কি খুব কঠিন, ভদ্র? জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পর্কিত কোনো বিদ্যার জন্যে মিশরদেশ থেকে একজন পুরোহিত কেনই-বা এক বারাঙ্গনার কাছে আসবেন? তার জন্য তিনি তো পুরোহিতদের কাছেই যাবেন, জ্যোতিষ যাঁদের ব্যবসা। এক্ষেত্রে আপনি আমার কাছে এসেছেন, নিশ্চয়ই সামুদ্রচন্দ্রিকা পুথি এ গৃহে আছে, একথা জানতে পেরেছেন বলেই। ধাতুধরণের মতন চার-পাঁচ জন স্থানীয় ব্রাহ্মণ, যাঁরা আমার ঘনিষ্ঠ, তাঁরাই ওকথা জানেন। একটু আগে যাঁরা এসেছিলেন, তাঁরাও ওকথা জানেন। কিন্তু তাঁরা আপনার পরিচিত হলে নিশ্চয়ই এ গৃহ থেকে নিষ্ক্রমণকালে তাঁরা আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ করতেন। তা যখন করেননি, তাহলে পরিশেষ-ন্যায় অনুসরণ করে বলতে হয়, ধাতুধরণ বা তাঁর মতন কেউ আপনাকে ওই পুথির কথা বলেছেন। এক্ষেত্রে ধাতুধরণের সম্ভাবনাই প্রবল, কেননা তাঁর গৃহেই ভিনদেশাগত অতিথিদের যাতায়াত অধিক।’

মুগ্ধ আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘আপনার তীক্ষ্ণ অনুমানশক্তির প্রশংসা না করে পারছি না। আমি এখানে এসে অনেক ঘুরেছি। সামুদ্রচন্দ্রিকার যেসব পুথি আমার নজরে পড়েছে, সে সবই মূল পুথির বিকৃতি, বন্যার জলের মতন ঘোলা। মূল পুথিটি আপনার কাছে আছে জেনে অত্যন্ত আশা নিয়ে এসেছি।’

‘আপনি কী চান?’

‘আ-আমি পুথিটি একবার দেখতে চাই। যদি আপনি আমার প্রতি বিশেষ কৃপাদৃষ্টি করে পুথিটি দান করেন…. অথবা যদি বিক্রয় করেন… আমি শত দ্রম্ম দিতেও প্রস্তুত…. জানি, আমার এ অনুরোধ অত্যন্ত অন্যায়…তবু যদি…’

ইন্দুমুখী এবার পর্যঙ্কের উপর সোজা হয়ে বসল। তারপর মাথার উপর দু-হাত তুলে উন্মুক্ত কেশপাশ আলগোছে বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘তা কীভাবে সম্ভব, ভদ্র ? পুথিটি আমাদের পরিবারের মাঙ্গলিক বস্তু। পুথি আমি দান বা বিক্রয় করব, একথা দূরতম স্বপ্নেও আমি কখনও ভাবিনি। সে হয় না। তবে দেখতে চাইলে দেখাতে পারি।’

‘যদি আমি অনুলিপি করে নিই?’

‘আপনি তামিল লিখতে, পড়তে পারেন?’

‘হ্যাঁ, তা কিছুটা পারি।’

‘আচ্ছা, সে দেখা যাবে এখন। কিন্তু ইদানীং আমি বড়ো বিব্রত অবস্থায় আছি। পক্ষকাল পরে যদি আসেন, তাহলে আমি আপনাকে পুথিটি দেখাতে পারি। এখন আমার মা অত্যন্ত অসুস্থ, মৃত্যুশয্যাশায়ী। এখন আমার মানসিক স্থিরতা নেই।’

আমেনহোটেপ কিছু একটা বলবে বলবে করছিল, কিন্তু বলে উঠতে পারছিল না। তার সেই সংকুচিত ভাব দেখে ইন্দুমুখী বলল, ‘আপনি কি আমাকে কিছু বলবেন আর?’

‘হ্যাঁ। আসলে আমি অজান্তেই আপনার প্রতি একটা অপরাধ করে ফেলেছি।’

এবার প্রশ্রয়ের হাসি হেসে ফেলল ইন্দুমুখী। বলল, ‘কী করেছেন? বলুন !’

‘আমি সম্মুখবর্তী কক্ষ থেকে আপনাদের আলোচনা শুনে ফেলেছি। তার থেকে আপনার মানসিক অবস্থা কিছুটা হলেও আমি বুঝতে পারছি!’

ইন্দুমুখীর মুখমণ্ডল পুনরায় বিষাদমেঘে ঢেকে গেল। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘হ্যাঁ, ভদ্র ! মা ছাড়া আমার আর কেউ নেই। মা চলে গেলে আমি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ হয়ে যাব ।। মাকে আর দেখতে পাব না, মাকে আর ছুঁতে পারব না, একথা ভাবতে গেলেই আমার হৃদয় যেন বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। জানি, মৃত্যু অবধারিত, এই অদর্শনই স্বাভাবিক, তবু…’

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে কী যেন আকাশপাতাল ভাবতে লাগল আমেনহোটেপ। তার মাথায় একটা বিশেষ চিন্তা খেলা করছে। অনেক ভেবে ভেবে একটা বুদ্ধি এল যেন। নরম স্বরে বলল, ‘আমি কি আপনাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করতে পারি?’

‘আপনি কী করবেন, ভদ্র? মৃত্যুকে কে রোধ করতে পারে ? আমরা যারা মানুষকে দেহ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারি না, আমাদের জন্যে শোক-পরিতাপই অন্তিমে অপেক্ষা করে থাকে!’ ভারী দীর্ঘশ্বাসে ইন্দুমুখীর সমুন্নত বুক দুটি সামান্য নমিত হল।

‘এক্ষেত্রে আমার কিছু করার আছে,’ আমেনহোটেপ চিন্তামগ্ন স্বরে বলল, আপনি আমাকে অনুমতি দেন… যদি আমার কথা-অনুযায়ী কাজ করেন…’

ইন্দুমুখীর মুখপদ্মে বিস্ময়ের ঘোর ফুটে উঠল, সে বলল, ‘কী করতে চাইছেন, বুঝতে পারছি না… এখন অবধি শুধু এইটুকুই জানি, আমার মায়ের মৃত্যু আসন্ন… এক পক্ষকালমাত্র সময়…’

আমেনহোটেপ দৃঢ়স্বরে বলল, ‘আমি চাই সামুদ্রচন্দ্রিকার গণনা মিথ্যা হোক, আপনার মা সুস্থ হয়ে উঠুন। কিন্তু যদি তা না হয়, যদি সত্যিই পক্ষকালের মধ্যে তাঁর মৃত্যুকাল ঘনিয়ে আসে, তাহলে…’

‘তাহলে?’

‘…তাহলে আপনি সেকথা এখানকার কাউকে জানাবেন না। মায়ের মৃত্যুসংবাদ গোপন রাখবেন। আর আমাকে একটু সংবাদ পাঠাবেন। আমি বর্তমানে কাবেরীতীরস্থ শিবমন্দিরের পার্শ্ববর্তী অতিথিশালাটিতেই বসবাস করছি।’

ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, আমেনহোটেপ কী করতে চাইছে, সেকথা ইন্দুমুখী এবার কিছুই বুঝতে পারছে না। বিস্ময়-বিমূঢ় অবস্থায় আচ্ছন্নস্বরে সে শুধু বলল, ‘আচ্ছা, বেশ। যদিও জানি না, আপনি ঠিক কী করতে পারবেন সেক্ষেত্রে। তবু আমি আপনার কথা মেনে চলব। মায়ের মৃত্যুসংবাদ কাউকে না-জানিয়ে আপনার কাছেই যত দ্রুত সম্ভব প্রেরণ করব।’

ইন্দুমুখীর কথা শুনে মৃদু হাসল আমেনহোটেপ মনে মনে। তারপর বিদায়-অভিবাদন জানিয়ে আসন থেকে উঠে দাঁড়াল।

(পনেরো) মৃত্যুনীল

সামুদ্রচন্দ্রিকার গণনা কিন্তু অভ্রান্ত। ঠিক চৌদ্দো দিনের মাথায় পরিচারক-মারফত আমেনহোটেপ খবর পেল, ইন্দুমুখীর মা করুণৈ আর নেই। আর এক মুহূর্ত দেরি না-করে প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি একটি সম্পূটকে নিয়ে আমেনহোটেপ ইন্দুমুখীর গৃহে উপস্থিত হল।

শোকার্ত ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, এ ইন্দু সে ইন্দু নয়। যেন কমলবনে মত্ত হস্তী সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। মেয়েটির চোখ দুটি জবাপুষ্পের মতো লাল, রাত্রিজাগরণের ফলে চোখের নীচে কালি পড়েছে, সমস্ত শরীরে যেন মৃত্যুশোক আর বিয়োগবিলাপ আঁধিয়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

আমেনহোটেপ উৎকণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘কে কে জানে এখনও অবধি করুণৈদেবীর মৃত্যুসংবাদ?’

ইন্দুমুখী ক্ষিপ্নস্বরে উত্তর দিল, ‘তেমন কেউই না। আমি আর আপনি ছাড়া দুয়েকজন বিশ্বস্ত দাসদাসী একথা জেনেছে। কিন্তু তারা সকলে এই প্রাসাদেই থাকে। আপনার পরামর্শমতো বাইরের কাউকেই এখন একথা না জানানোর কঠোর নির্দেশ দিয়েছি।’

আমেনহোটেপ বলল, ‘বেশ। এখনই আপনি আমাকে আপনার মায়ের কক্ষে নিয়ে চলুন।’

করুণৈ-র কক্ষে উপস্থিত হয়ে আমেনহোটেপ দেখল, করুণৈ-র মৃতদেহ পর্যঙ্কে শায়িত। একেবারে রোগজীর্ণ শরীর। যেন একটি ম্লান অতসীপুষ্পের মতো করুণৈ ব্যাধির সঙ্গে মহাসমরে পরাস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। কী করুণ সেই অন্তিম শয়ন!

ইন্দুমুখী চক্ষে অঞ্চল চাপা দিয়ে বালিকার মতো অঝোর ধারায় কেঁদে চলেছিল। আমেনহোটেপ বলল, ‘আপনি মাকে এভাবেই তো দেখতে চান, তাই না? তাঁকে ছেড়ে থাকতে চান না, তাঁকে নিজের কাছে ধরে রাখতে চান….’

আমেনহোটেপের কথায় ইন্দুমুখীর ক্রন্দনবেগ আরও বৃদ্ধি পেল। অশ্রুপরিপ্লুত স্বরে সে বলে উঠল, ‘তা আর সম্ভব নয় গো, ভদ্র! মা আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গেলেন…’

আমেনহোটেপ উত্তর দিল, ‘কোথাও যাননি। আপনি রোদন সংবরণ করুন।’

আমেনহোটেপের কণ্ঠস্বরে কী যেন ছিল। আঁচলে চোখ মুছে ইন্দুমুখী অবাক হয়ে আমেনহোটেপের দিকে চোখ তুলে তাকাল।

আমেনহোটেপ বলতে লাগল, ‘শুনুন, ভদ্রে ! আপনাদের ভারতীয়দের মতো আমরা মিশরীয়রা একথা বিশ্বাস করি না যে, শরীরের মৃত্যু হলেই আত্মা শরীর ছেড়ে চলে যায় । বরং আমরা মনে করি, শরীরটা যতদিন অবিকৃত থাকে আত্মাও ততদিনই জীবিত থাকে। শরীরটা পুড়িয়ে ফেললে বা কোনোভাবে শরীরটি নষ্ট হয়ে গেলে তখনই একমাত্র আত্মার মৃত্যু হয়। আপনার মা করুণৈদেবী কোথাও যাননি, তিনি এখানেই আছেন। শুধু দেখতে হবে, যাতে এই শরীরের কোনো পচন বা বিকার না ঘটে।’

এত শোকের মধ্যেও ইন্দুমুখী বিস্ময়াবিষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘অদ্ভুত বিশ্বাস !’

আমেনহোটেপ আত্মপ্রত্যয়ী স্বরে বলল, ‘অদ্ভুত, কিন্তু সত্য। যা বলছি, তা করুন । সমস্ত কিছু আমার কাছে নেই, কতগুলো দ্রব্য লাগবে। আমি এখনই একটি তালিকা তৈরি করে দিচ্ছি। যত শীঘ্র সম্ভব আমাকে সেগুলো এনে দিন। এসব মিশরীয় গুপ্ত বিদ্যা। পাঁচকান করবেন না। এ প্রাসাদে কোথাও কি কোনো গুপ্ত কক্ষ আছে ?’

ইন্দুমুখী বলল, ‘হ্যাঁ। পাণ্ড্যরাজাদের দ্বারা চোলরাজ্য দশ বৎসর পূর্বে আক্রান্ত হয় ৷ শত্রুসৈন্যের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে তখন এই প্রাসাদের নিম্নে একটি পাতালঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। আমরা ওই পাতালঘরকে নিগূঢ় কক্ষ বলে থাকি। সেখানে পাশাপাশি দুটি কক্ষ আছে। সেই কক্ষদুটি এখন অব্যবহৃত হয়েই পড়ে থাকে।’

আমেনহোটেপ বলল, ‘উত্তম। তবে এখনই করুণৈদেবীর দেহটি সেই নিগূঢ় কক্ষে স্থানান্তরিত করুন। আমাকে এখন থেকে আড়াই মাসকাল এ গৃহের নিগূঢ় কক্ষেই থাকতে হবে। এই সময়ের মধ্যে আপনারা কেউ আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করবেন না বা ওই নিগূঢ় কক্ষের ভিতরে যাবেন না। আমার আহারাদি পাতালের সোপানের উপর রাখলেই হবে।’

ইন্দুমুখী বিহ্বল স্বরে বলল, ‘কিন্তু কী করতে চাইছেন, তার যদি কিছুটা হলেও ইঙ্গিত দিতেন—?’

‘আপনি তো চান, আপনার মা আপনার কাছেই থাকুন? আমি এমন ব্যবস্থা করব, যাতে চিরকাল তিনি আপনার সঙ্গেই থাকেন। আপনি তাঁকে স্পর্শ করতে পারবেন। সেবা করতে পারবেন। কথা বলতে পারবেন। হ্যাঁ, তিনি আপনার সেবা নেবেন, কথাও শুনবেন। আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবেন না। আপনি শুধু আমার উপরে সামান্য বিশ্বাস রাখুন!’ আমেনহোটেপ অনুনয়-সহকারে বলল।

যেন আস্থার শেষ খড়কুটো চেপে ধরে শোকসাগরে ডুবন্ত ইন্দুমতী সেকথা শুনে বলে উঠল, ‘সত্যি? সত্যিই এমন হবে? সত্যিই যদি আপনি এমন পারেন, ভদ্র, তাহলে আমি আপনার চিরদাসী হয়ে থাকব। আর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আমাদের পারিবারিক উপাসনালয়ে রক্ষিত সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথিটি আমি আপনাকে উপহার দেব, কথা দিচ্ছি।’

আমেনহোটেপ হাসতে হাসতে বলল, ‘সে যখনকার কথা, তখন দেখা যাবে। এখন যা যা বললাম, তাই করুন তো দেখি!’

বিশ্বস্ত দাসদাসীর দ্বারা অতি সাবধানে মৃতদেহটি পাতালঘরে নিয়ে যাওয়া হতে লাগল । প্রায়ান্ধকার সোপানশ্রেণী, সংকীর্ণ সুড়ঙ্গপথ পার হয়ে শববাহকেরা সন্তর্পণে চলেছিল, তাদের সবার সামনে প্রদীপ হাতে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল ইন্দুমুখী। আর সকলের পেছনে সম্পূটক পিঠে ধীরে ধীরে নামছিল আমেনহোটেপ। মাটির অনেক নীচে সেই নিগূঢ় কক্ষ দুটির একটিতে মৃতদেহটিকে একটি সমুচ্চ পর্যঙ্কে শুইয়ে দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যে আমেনহোটেপের তালিকানিবদ্ধ দ্রব্যগুলিও সংগ্রহ করে আনা হল। তারপর ইন্দুমুখী ও তার দাসদাসীরা আমেনহোটেপকে পাতালঘরে রেখে উপরে চলে গেল।

আমেনহোটেপ এখন একা। পার্শ্ববর্তী নিগূঢ় কক্ষে সে তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিল। এখানেই তাকে আড়াই মাসকাল অতিবাহিত করতে হবে। শত শত বৎসর পূর্বে তার পূর্বপুরুষেরা যে-কাজ অনেকে মিলে করতেন, সেই কাজ তাকে একলা হাতে করতে হবে। কাজটি কঠিন, এক বিন্দু ভুলচুক হলেই সর্বনাশ।

এ বিদ্যা তার পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত বিদ্যা। মৃত ব্যক্তির মমি প্রস্তুত করার বিদ্যা । যদিও এর প্রয়োজন এখন এই দ্বিতীয় শতকে আর হয় না, তবু পারিবারিক সূত্রেই তাকে এসব হাতেকলমে শিখতে হয়েছিল কৈশোরে। তখন দুয়েকটি মৃত পশুপাখির উপরই এ বিদ্যা প্রয়োগ করতে পেরেছিল, এতদিন পরে মানুষের মৃতদেহের উপর প্রয়োগের সুযোগ এল।

সেই দিন থেকেই শুরু হল আমেনহোটেপের কঠিন পরীক্ষা। ঘৃতদীপের আলোতে পর্যঙ্কে শায়িত মৃতদেহটির মমি প্রস্তুত করতে হবে। প্রথমেই বিশেষ ধরনের কর্তরী দিয়ে তলপেট সামান্য চিরে মৃতার শরীর থেকে ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ ও অন্ত্রাদি বের করে আনল আমেনহোটেপ। তারপর একটি দীর্ঘ সূচীমুখ মৃতদেহের নাসাপথে প্রবেশ করিয়ে অতি সন্তর্পণে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে মৃতার মস্তিষ্ক সে টেনে বের করে আনতে লাগল। প্রতিটি অঙ্গ—মস্তিষ্ক, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃৎ, অস্ত্র—পৃথক পৃথক মৃন্ময় পাত্রে অতি যত্নে সংরক্ষিত হল। কিন্তু মৃতার হৃৎপিণ্ড আমেনহোটেপ বের করে আনল না। মিশরীয়দের বিশ্বাস, মৃত মানুষটির চিন্তা ও সমগ্র সত্তার উৎস হৃৎপিণ্ড—যা অবিকৃত রাখাই প্রয়োজন । এইরূপে পরিষ্কৃত দেহটি উত্তম সুরা দিয়ে প্রলিপ্ত করা হল। কেননা সুরা জীবাণুনাশক।

এর পরের কাজ, শরীরটিকে শুষ্ক করার কাজ। আমেনহোটেপের কাছে এক বিশেষ ধরনের রাসায়নিক ছিল, এক বিশেষ প্রকারের লবণ, যা উত্তর মিশরের নত্রন উপত্যকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সেই রাসায়নিক দ্রব্য কাপড়ের ছোটো ছোটো পুঁটুলিতে মৃতার শরীরের ভিতর ভরে দিল আমেনহোটেপ। মৃতদেহটিকে ওই লবণ দিয়ে সম্পূর্ণ ঢেকে দিল।

এবার চল্লিশ দিনের অপেক্ষা। করুণৈ-র শরীর সম্পূর্ণভাবে জলীয়তামুক্ত হবে। এই অবসরে আমেনহোটেপ পাতালের নিগূঢ় কক্ষ থেকে ইন্দুমুখীর কাছে একটি আবেদন পাঠাল। দাসদাসীরা সোপানের উপর প্রত্যহ আমেনহোটেপের খাবার রেখে যেত, উচ্ছিষ্ট পাত্রগুলি ফেরত দেওয়ার সঙ্গে একদিন একটি পত্র প্রেরণ করল আমেনহোটেপ। সেই পত্রে কাঠের তৈরি একটি পেটিকার চিত্রিত পরিকল্পনা ছিল। পেটিকাটির আয়তন মৃতদেহের সমান। ধাতু বা পাথরের শবাধারই যদিও বৈধ, তবু এক্ষেত্রে নীচে নামানোর সুবিধে হবে বলে কাঠের পেটিকারই আর্জি জানিয়েছিল আমেনহোটেপ। নানা ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপে নিরত আমেনহোটেপ অতি সংযত চিত্তে পেটিকাটির অপেক্ষা করতে লাগল। পুষ্পহারের দারুশিল্পীদের দ্বারা নির্মিত পেটিকাটিও এসে পড়ল দুই সপ্তাহের মধ্যেই।

এখানে দিনও নেই, রাত্রিও নেই—শুধুই অন্ধকার। এখানে ইতিও নেই, নেতিও নেই—শুধুই শূন্যতা। এখানে জীবনও নেই, মৃত্যুও নেই—শুধুই স্থবিরতা। নিগূঢ় কক্ষে দিনের পর দিন নিঃশব্দে বাস করছিল আমেনহোটেপ, পার্শ্ববর্তী কক্ষে শায়িত ছিল শুধু শুষ্কপ্রায় হিমশীতল একটি মৃতদেহ।

চল্লিশ দিন পরে আমেনহোটেপ সেই রাসায়নিকের প্রলেপ সরিয়ে দেখল, মৃতদেহটি শুকিয়ে কুঞ্চিত কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে। এর পরেই বেশ কঠিন কাজ। বহু দিন ধরে তৈল-সহযোগে মৃতদেহটির অঙ্গসংবাহন করতে লাগল আমেনহোটেপ। ধীরে ধীরে মরদেহের মাংসপেশীগুলি নরম হয়ে এল, যেন একটা প্রাণনার আভাস ফুটল। অক্ষিকোটরে নকল দুটি বেলেপাথরের চক্ষু স্থাপন করল আমেনহোটেপ, রংতুলি দিয়ে প্রস্ফুট করে তুলতে লাগল শরীরের বিভিন্ন সংস্থান। অতঃপর দেবদারু ও সরলবৃক্ষ হতে উৎপন্ন উষ্ণ রজন দিয়ে মরদেহটিকে প্রলিপ্ত করে পট্টবস্ত্র দ্বারা ভালোমতো বাঁধতে লাগল। এই সব কাজে কেটে গেল আরও কুড়ি দিন ।

অবশেষে এক বিশেষ ধর্মীয় ক্রিয়াকাণ্ডের অনুষ্ঠান করল সে, যাতে করুণৈ-র প্রতিটি অঙ্গদ্বার সামান্য উন্মুক্ত হয়। নাক, চোখ ও মুখের রন্ধ্রপথ বাদ দিয়ে অবশিষ্ট মুখমণ্ডলে অবিকল চর্মবর্ণের একটি মুখচ্ছদ পরিয়ে দিল। করুণৈ-র শরীরে তার পূর্বপরিহিত বস্ত্রগুলি একে একে পরাল আমেনহোটেপ। সারা শরীর সাজিয়ে দিল প্রসাধনে। চোখদুটির পাতা খুলে দিল। কাজল পরাল নীল চোখে। মমীকৃত শরীরটিকে এবার স্থাপন করল অলংকৃত কাঠের শবাধারে। তারপর উপরে সংবাদ পাঠাল—ক্রিয়া সমাপ্ত হয়েছে, গৃহকর্তী একাকী যেন নিগূঢ় কক্ষে এসে দেখা করেন।

ভয়ে, বিস্ময়ে, মায়াটানে বিহ্বল ইন্দুমুখী হাতে একটা ঘিয়ের প্রদীপ নিয়ে সোপান বেয়ে নেমে এসে নিগূঢ় কক্ষে উপস্থিত হল। সে দেখল, সেই বৃহদায়তন কাষ্ঠপেটিকার ভিতর মা করুণৈ জীবন্ত শুয়ে আছেন। তাঁর চোখ দুটি খোলা, মুখে সেই চিরপরিচিত হাসি। এই তো মা তার দিকে চেয়ে মধুর হাসছেন! আহা, কী এক অপার্থিব শান্তি মায়ের চোখে-মুখে, সমস্ত শরীরে!

আমেনহোটেপ মুগ্ধা ইন্দুমুখীর মুখপানে চেয়ে দেখল। ডানহাতে প্রদীপ তুলে ধরে নতমুখে বিস্ময়াবিষ্ট দৃষ্টিতে ইন্দুমুখী করুণৈ-র দিকে চেয়ে রয়েছে। প্রদীপের আভায় আভায়িত ইন্দুর সেই মুখে বিস্ময় আছে, মুগ্ধতা আছে, সম্ভ্রম আছে। কিন্তু কী যেন একটা নেই! কী নেই, তা আমেনহোটেপও বুঝে উঠতে পারছিল না। তন্নতন্ন করে দেখছিল, তবু ইন্দুমুখীর মুখে কী একটা ভাব আমেনহোটেপ কিছুতেই খুঁজে পেল না ।

যেন একটা সুচ্ছন্দিত সুনির্মিত কবিতা লিখেছে আমেনহোটেপ। লিখবার পরে ইন্দুমুখীকে পরিশীলিত উচ্চারণে পড়ে শোনাচ্ছে। ইন্দুমুখী শুনতে শুনতে কবিতার গঠনকাঠামোয় মুগ্ধ হয়ে গেছে, বিস্ময়-শিহরিত হয়েছে। তবু যেন শ্রোত্রী ইন্দুমুখী কিছুতেই সে-কবিতায় ভাবাবিষ্ট হচ্ছে না, সম্মোহিত হচ্ছে না।

আমেনহোটেপ ভাবল, আরও কিছু সময় যাক। নিশ্চয়ই হবে। এই তো সবে আরম্ভ। নৈঃশব্দ্য ভেঙে বলল আমেনহোটেপ, ‘আপনার মা আপনার কাছেই ফিরে এসেছেন, ইন্দুমুখী ! আপনার কাছেই এখন থেকে থাকবেন। আমি তাঁর শরীরকে অবিকৃত করে দিয়েছি। এখন থেকে তাঁর আর মরণ নেই। তিনি এখানেই আছেন। আমাদের সব কথা তিনি শুনতে পাচ্ছেন। আগে যেমন যা যা সেবা করতেন, অবিকল তাই-ই করে চলুন । তাঁর প্রিয় দ্রব্যাদি, অলংকার বস্ত্রাদি সব এ ঘরে এনে রাখুন। আজ থেকে নিয়মিতভাবে তাঁকে আহার্য, পানীয় দেবেন। কোনো অযত্ন করবেন না।’

ইন্দুমুখী ধীরে ধীরে মুখ তুলে বলল, ‘আমি সত্যিই আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ, ভদ্র। আপনি আমার মাকে চিরজীবন দিয়েছেন। আপনার এ ঋণ আমি কোনোদিন পরিশোধ করতে পারব না।’

আমেনহোটেপ ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘আমি এখন যাব, ইন্দুমুখী। দিন তিনেক পরে আবার আসব। বহুদিন এই নিগূঢ় কক্ষে রয়েছি। এবার আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। সুস্থতার প্রয়োজন। কয়েক দিনের মধ্যেই ফিরে এসে আপনার সঙ্গে দেখা করব আমি।’

সেই অর্ধদীপিত কক্ষে ইন্দুমুখীকে রেখে সোপান বেয়ে আলোকিত পৃথিবীতে উঠে এল আমেনহোটেপ।

(ষোলো) সূর্যাস্ত

তিনদিন নয়। প্রায় এক সপ্তাহ লাগল আমেনহোটেপের সুস্থ হতে। মানুষ পৃথিবীর উপরিভাগের জীব। পাতালের নিগূঢ় কক্ষের আবছা অন্ধকার ও বদ্ধ বাতাসে সে সুস্থ থাকতে পারে না। তার সুস্থ জীবনধারণের জন্য পৃথিবীর উপরিভাগের মুক্ত আলোহাওয়ারই প্রয়োজন হয়।

সাতদিন পরে এক অপরাহ্ণবেলায় আমেনহোটেপ ইন্দুমুখীর প্রাসাদে এসে উপস্থিত হল। দর্শনকক্ষ হতে পরিচারিকা তাকে একেবারে প্রাসাদের ছাদে নিয়ে গেল। এখানেই ইন্দুমুখী তার সঙ্গে দেখা করবে। ছাদের অলংকৃত মেঝেতে একটি কিলিঞ্জক অর্থাৎ মাদুর জাতীয় আসন বিছানো রয়েছে। কয়েকটি সুচিত্রিত উপাধানও কিলিঞ্জকের উপরে সাজানো রয়েছে। উপাধানে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে আমেনহোটেপ অধীর আগ্রহে ইন্দুমুখীর অপেক্ষা করতে লাগল ৷

কিছুক্ষণ পরে ইন্দুমুখী ছাদে এল। তার পরনে একটি বাসন্তী রঙের দুকূল ও কেশপাশ কবরীবদ্ধ। কবরীতে একটি যূথিকাপুষ্পের মালা সুরভি ছড়াচ্ছে। অনেকদিন পরে ইন্দুমুখীকে দেখে মনে হল, নিজেকে সে যেন অনেকখানি সামলে সুসংবৃত করে নিতে পেরেছে। হাতে তার লাল শালুতে বাঁধা একটি পুথি।

ইন্দুমুখী কিলিঞ্জকে এসে বসল। পরিচারিকা উভয়ের জন্য পানীয় পরিবেশন করে গেল। ইন্দুমুখী সেই পুথিটি আমেনহোটেপের হাতে দিয়ে বলল, ‘এই আপনার দীর্ঘবাঞ্ছিত সামুদ্রচন্দ্রিকার পুথি। এতদিন আমাদের পূজার ঘরে ছিল। আপনি আমার যে-উপকার করেছেন, তারই প্রত্যুপকারস্বরূপ আমি এ পুথি আপনাকে উপহার দিলাম।’

ইন্দুমুখীর হাত থেকে পুথিটি নিয়ে বাঁধন খুলে দেখতে লাগল আমেনহোটেপ। তামিল ভাষার অলংকৃত পুথি। স্পষ্টাক্ষরে লিখিত। পঠন-পাঠনে কোনো অসুবিধা হবে না। মানুষের শারীরিক আকার ও বিভিন্ন অঙ্গসংস্থান থেকে মানুষটির মানসিক ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ এ পুথিতে অনিবার্যভাবে লিখিত রয়েছে।

অতিথিশালায় ফিরে গিয়ে বিস্তারিতভাবে অধ্যয়ন করা যাবে, এই কথা ভেবে আমেনহোটেপ আপাতত পুথিতে বাঁধন দিয়ে লাল শালুতে বেঁধে নিল। তারপরে পানপাত্রে চুমুক দিয়ে ইন্দুমুখীকে প্রশ্ন করল, ‘তারপর? এখন কেমন বোধ করছেন? এখন মনে শান্তি পেয়েছেন তো?’

‘হ্যাঁ,’ ইন্দু সংক্ষেপে উত্তর দিল।

‘আপনার মাকে আপনি নিরন্তর কাছে কাছে পাচ্ছেন তো?’

‘না৷’

আমেনহোটেপ নিতান্ত বিস্ময়াহত হয়ে পানপাত্রটি কিলিঞ্জকের উপর নামিয়ে রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘পাচ্ছেন না? সেকী! কেন?’

ইন্দুমুখী বলল, ‘না, পাচ্ছি না। কারণ নিগূঢ় কক্ষে শায়িত ওই দেহটি আমার মা নন!’ ছাদের উপর সহসা বজ্রাঘাত হলেও আমেনহোটেপ বোধহয় এতখানি অবাক হত না। কিছুক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না। স্তব্ধবাক বসে থেকে থেকে অবশেষে নীরবতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করল আমেনহোটেপ, ‘কিন্তু কেন এমন কথা মনে হল আপনার? আমি তো সমস্ত ক্রিয়াকাণ্ডের বিধিবৎ অনুষ্ঠান করে করুণৈদেবীকে পুনর্জাগরিত করেছি। ওই দেহটি সহস্র সহস্র বৎসরেও নষ্ট হবে না। আর তাই ওরই সঙ্গে করুণৈদেবী দীর্ঘকাল লগ্ন হয়ে থাকবেন। এতে কি আপনার বিশ্বাস হয় না?’

অনেক দূরের আকাশের দিকে চেয়ে থেকে থেকে ইন্দুমুখী ধীরে ধীরে বলল, ‘না। এতে আমার বিশ্বাস হয় না, ভদ্র। আমি বুঝতে পেরেছি, প্রায়ান্ধকার কক্ষে শয়ান ওই দেহটি আমার মা নন। কোনোকালেও ছিলেন না। আপনি সুদীর্ঘ ও সযত্ন প্রয়াসে একটি মৃতদেহকে দীর্ঘস্থায়ী করেছেন মাত্র। আর কিছু নয়। ও দেহ নড়ে না, চড়ে না। বোবা চোখ মেলে শুধু চেয়ে থাকে। আমি আহার্য দিই, সে-আহার্য যেমনকার তেমনই অস্পৃষ্ট পড়ে থাকে। আমি কথা বলি, কিন্তু তিনি আমার কথা শুনতে পান বলে মনে হয় না। আমি তাঁকে দেখি, কিন্তু তিনি আমাকে কি দেখতে পান? আমি তো দূরস্থান, তিনি নিজেকেও কি অনুভব করতে পারেন? যা নিজেকে অনুভব করতে পারে না, তা প্ৰাণহীন জড়পদার্থ ছাড়া আর কিছু নয়। স্বানুভবই জীবিতের প্রথম লক্ষণ।’

আমেনহোটেপ নিজের বিশ্বাসের ভূমিকে অতিক্রম করে এই ভিনদেশী মেয়েটির মনোভূমিকে আত্মস্থ করবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল। খানিক ভেবে নিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা। কিন্তু মাকে আপনি যেভাবে তাঁর মৃত্যুর আগে দেখেছেন, এখনও তো ঠিক সেই আকারেই দেখছেন। নয় কি?’

ইন্দুমুখী উত্তর দিল, “মাকে কি আমি একপ্রকার আকারেই দেখেছি, ভদ্ৰ ? আমি যখন শিশু ছিলাম, আমার মা তখন যুবতী। ধীরে ধীরে আমি যুবতী হয়ে উঠলাম, আমার চোখের সামনেই মা ধীরে ধীরে প্রৌঢ়া হয়ে গেলেন। আমার যুবতী মায়ের সেই নীলোৎপল আঁখি, যৌবনের সেই থিরবিজুরি রূপ, সেই সুঠাম সুছাঁদ দেহগঠন সমস্তই একে একে চলে গেল। কৃষ্ণকেশ পলিত হল, বলিরেখায় আক্রান্ত হল মুখ, চর্ম শিথিল হল,  উন্নত
 স্তনদ্বয় লোল হল, কটিদেশ থেকে হারিয়ে গেল বিভঙ্গবিদ্যুৎ। যৌবন চলে গিয়ে জরা এল মায়ের সমস্ত শরীর জুড়ে। কই, আমি তো মায়ের সেই যুবতী-রূপ চলে যাওয়াতে শোক করিনি তখন? মায়ের বৃদ্ধাবস্থার রূপকেই শান্তমনে মেনে নিয়েছি। এই পরিবর্তনেরই অন্য নাম জীবন। কিন্তু আপনি আজ দুঃসাধ্য চেষ্টায় মায়ের যে-বার্ধক্যের রূপটিকে স্থায়িত্ব দিয়েছেন, তাতে তার আর কোনো পরিবর্তন হবে না। সে দীর্ঘ হবে না, হ্রস্ব হবে না, তার কেশপাশ বর্ধিত হবে না, ক্ষয়প্রাপ্তও হবে না। চোখের পাতাও তার বন্ধ হবে না আর। এরকমই নিষ্প্রাণ পুতুলের মতো সে শুধু অনন্তকাল চোখ খোলা রেখে হেসে চলবে অন্ধকারে। এই যে স্থায়িত্ব, এই যে গতিহীনতা, এই যে স্থবিরতা—এই-ই তো মৃত্যু। আপনি আমার মাকে মৃত্যু থেকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারেননি, ভদ্র। কেউই পারে না। আপনি শুধু আমার মায়ের মৃত্যুকেই চিরস্থায়িত্ব দিয়েছেন।’

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে আছে। দূরের আকাশ বেয়ে কোনো অজানা পাখির ডাক ভেসে আসছে। আমেনহোটেপ বলল, ‘তাহলে আমার এই প্রয়াস আপনার কোনো কাজেই লাগল না, ভদ্ৰে !’ তার গলায় নিতল নৈরাশ্যের সুর বেজে উঠছে।

ইন্দুমুখী বলল, ‘তা নয়। অবশ্যই আপনি আমার মহদুপকার করেছেন। আজ সাতদিন আমি নিগূঢ় কক্ষে ওই দেহটির সঙ্গে কাটিয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি, মৃত্যু কী। আর তার বিপরীতে জীবনই বা আসলে কী। ওই দেহটি আমার মা নন। ওটা একটা নিষ্ঠুর করুণরঙিল পুতুল মাত্র। আপনার বহুশ্রমে নির্মিত। এক রাত্রে স্বপ্ন দেখলাম, মা এসেছেন। তিনি আগের মতনই হাঁটছেন, অঙ্গসঞ্চালন করছেন, কথা বলছেন, আমাকে আদর করছেন। ঘুম ভেঙে মনে হল, স্বপ্নে দেখা আমার ওই মায়ের যতটুকু জীবন আছে, পর্যঙ্কে শায়িত এই মৃত পুত্তলিকাটার ততটুকু জীবনও নেই। আমাদের দেশের প্রাজ্ঞ মনীষীরা যে বলেন, মানুষ আসলে দেহনিরপেক্ষ আত্মা–সেকথা আমি আজও বুঝিনি। কিন্তু এই ক-দিনে আমার এটুকু বোধ অন্তত হয়েছে যে, মানুষ আর যাই হোক, সে এই মাংসল জড়পিণ্ড শরীর নয়। কোনোকালেও ছিল না। আপনার প্রচেষ্টার ফলেই আমি একথা বুঝতে পেরেছি। এখন আমার আর কোনো মোহ নেই। সেজন্যেই আমি আপনার কাছে সবিশেষ কৃতজ্ঞ!’

শুনতে শুনতে আমেনহোটেপের মনের অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে যেন একটা বাতায়ন অস্পষ্টভাবে খুলে যেতে লাগল। সে যেন একটু একটু করে ইন্দুমুখীর কথাগুলো এবার বুঝতে পারছে। যেন হাজার হাজার বছরের স্থবির বিশ্বাসের অজস্র পিরামিড ভেঙে পড়ছে আমেনহোটেপের মনের মধ্যে। সেসব বিভগ্ন মৃত্যু-উপত্যকা থেকে স্যাক্রোফেগাসের আবরণ সরিয়ে উঠে বসছে গণনাতীত মমীকৃত মানুষ। তারা বিলাপ করছে, হাহাকার করছে, জড়িয়ে জড়িয়ে কাকে যেন অভিশাপ দিচ্ছে আকাশে দু-হাত তুলে…

ধীরে ধীরে ইন্দুমুখীর করতলে লাল শালুতে মোড়া সেই পুথিখানি প্রত্যর্পণ করল আমেনহোটেপ। অশ্রুসজল দুই চোখ তুলে আমেনহোটেপ মন্থর স্বরে বলল, ‘প্রিয় বান্ধবী! তবে এ পুথিখানিরও আমার আর প্রয়োজন নেই। এর প্রতি লোভ নেই এখন আর আমার মনে। মানুষ যদি দেহই না হয়ে থাকে, মানুষ যদি দেহ ছাড়া অপর কিছুই হয়ে থাকে, তবে দেহের গঠনভঙ্গিমা থেকে মানুষের চরিত্র বা মনোগঠন নির্ণয়ের বিদ্যাও নিতান্তই অর্থহীন। ওই বাসনা আমি এখনই ত্যাগ করলাম।’

দিগন্তে তখন এক আশ্চর্য সূর্যাস্ত হচ্ছিল। দিনান্তের সেই আলো এসে খেলা করছিল ইন্দুমুখী ও আমেনহোটেপের মুখে। ওরা তাকিয়ে রইল দুজনে দুজনার দিকে সেই আলোর ভিতর। এ সেই আলো, যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে জীবন ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, আশা ও ভয়ের ঊর্ধ্বে, বিশীর্ণ কঞ্চুক এই দেহের সমস্ত দাবির ঊর্ধ্বে মানুষ মানুষকে চিরকাল নিৰ্ভয়ে বলেছে: ‘ভালোবাসি’।

(সতেরো) শিল্পীসত্তা

এ কি মায়া, নাকি স্বপ্ন, নাকি মতিভ্রম অথবা এই কি চিরন্তন প্রেমের সত্য—সেকথা কে বলতে পারে? মৃত্যুচিন্তা থেকে হয়তো অবিচল প্রেমেই উত্তীর্ণ হয়েছিল মিশরীয় যুবক আমেনহোটেপ। মিশরে সে ফিরে যায়নি আর। প্রেমাস্পদা ইন্দুমুখীকে ভালোবেসে সে এই পুষ্পহার নগরীতেই থাকতে শুরু করে। জ্যোতিষচর্চা ছিল আমেনহোটেপের জীবিকা নির্বাহের উপায়। ইন্দুমুখী অবশ্য ধীরে ধীরে বারাঙ্গনাবৃত্তি পরিহার করে। প্রতি দিনান্তে তারা দেখা করত পুষ্পহার নগরীর কোনো নির্জন স্থানে। কখনও কাবেরীতটে, কখনও কোনো পরিত্যক্ত মন্দিরে, কখনও বা কোনো নিস্তব্ধ বিপিনে। আবার অনেক সময় ইন্দুমুখীর প্রাসাদেও আমেনহোটেপ উপস্থিত হত সায়ংকালে। শোনা যায়, এর বেশ কিছু বছর পরে আমেনহোটেপ ও ইন্দুমুখী সিংহল দেশে অনুরাধাপুরে চলে যায় রাজা গজবাহুর আমন্ত্রণে। সেখানেই তারা জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি অতিবাহিত করেছিল।

মাতৃপিতৃহীনা কন্যা এক—নাম তার মাধবী। অপরূপা সুন্দরী সেই মেয়েটিকে ইন্দুমুখী মায়ের যত্নে ছোটো থেকে বড়ো করে তোলে পুষ্পহার ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে। নিজের মনের মতো করে গড়ে তোলে সে মাধবীকে। তাকে নৃত্যগীতবিদ্যা শিক্ষা দেয় কঠোর অনুশাসনে। করুণৈদেবীর মৃত্যুর পরে এই দুটি মাত্র অবলম্বন আশ্রয় করেই ইন্দুমুখী এই পুষ্পহার নগরীতে ছিল। এক—এই মেয়ে মাধবী। আর দুই—ইন্দুমুখীর প্রেমিক পুরুষ মিশরীয় আমেনহোটেপ ।

ধীরে ধীরে মাধবী ইন্দুমুখীর যোগ্য শিষ্যারূপে বড়ো হয়ে ওঠে। ইন্দুমুখীর কাছ থেকে মাধবী শুধু নৃত্যগীতবিদ্যাই আয়ত্ত করেনি, তদুপরি সে আয়ত্ত করেছিল এক বিশিষ্ট জীবনদর্শন। ইন্দুমুখী তাকে শিখিয়েছিল জীবনের অনিত্যতা। অনিত্যতার বিষাদ ও মাধুর্য। মৃত্যুকে নিয়ত মনে রাখার দুর্লভ পাঠ। মাধবী স্বভাব-কবিত্ব নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিল। মুখে মুখে পদরচনা করে সে হৃদয়ের বেদনাকে প্রকাশ করতে পারত। সুর দিতে পারত সে সেসব আশ্চর্য কবিতায়। মধুকণ্ঠে গাইতে পারত গান। ইন্দুমুখী আমেনহোটেপের হাত ধরে সিংহলদেশে চলে যাওয়ার পরে ইন্দুমুখীর রিক্ত স্থান পূর্ণ করে মাধবীই। ধীরে ধীরে মাধবী হয়ে ওঠে চোলনৃপতির সভায় প্রধানা নর্তকী। কিন্তু কেমন করে হল তার এই উত্থান, সেকথা বলছি পরে। তার আগে বলা দরকার, কীভাবে মাধবী এ পৃথিবীতে এল।

মাধবীর জন্মকথা নিয়ে পুষ্পহার নগরীতে অবশ্য একটি পুষ্পিত কিংবদন্তী প্রচলিত ছিল। ইলাঙ্গো আডিগল প্রচলিত সেই উপাখ্যানটিই তাঁর কাব্যে নিবেশিত করেছেন। এ প্রচলকথায় স্বর্গ আর মর্ত বাঁধা পড়েছে সুকোমল, সুনিবিড় বাহুবন্ধনে।

ইন্দ্রের স্বর্গসভায় একদিন সুন্দরী উর্বশী নৃত্যরতা ছিলেন। সভাতে উপস্থিত ছিলেন সকল দেবদেবীবৃন্দ। সভার একপাশে বসে ছিলেন ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্ত। নৃত্য চলছে, এমন সময় সেখানে মহাতেজা কোপনস্বভাব মুনি দুর্বাসা উপস্থিত হলেন। নৃত্যকালে সুরূপা উর্বশী ও অনিন্দ্যসুন্দর জয়ন্ত পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় করেছিলেন। তাঁদের দৃষ্টিতে ছিল অনুরাগের মুগ্ধ আবেশ। এই অন্যমনস্কতার ফলেই নৃত্য প্রদর্শনকালে উর্বশীর এক সময় তালভঙ্গ হয়। এতাদৃশ অপরাধে রুষ্ট দুর্বাসা উর্বশী ও জয়ন্তকে শাপ দেন। দুর্বাসার অভিশাপে তাঁরা দুজন স্বর্গ থেকে নির্বাসিত হন মর্তে।

বিন্ধ্য পর্বতের গহন অরণ্যে সামান্য এক বেণুদণ্ড রূপে জন্মগ্রহণ করেন জয়ন্ত । নির্জন সেই বনভূমে শীতল বাতাসের স্পর্শে দুলতে দুলতে কেটে যায় প্রেমিক জয়ন্তর সেই তৃণজাতীয় মতৰ্জন্ম।

আর উর্বশী জন্মগ্রহণ করেন কাঞ্চিতে এক অতুলনীয়া নর্তকী রূপে।

পুষ্পহার নগরীর মানুষেরা কানাকানি করত, মাধবী নাকি কাঞ্চিপুরের সেই নর্তকীরই মেয়ে।

কিন্তু এসব কথার সারবত্তা কতটুকু আর? আমাদের সাম্প্রতিক সংশয়ী মন কি মানতে চায় এসব অনুপম কাব্যের সত্য? সে বরং খোঁজে সম্ভাব্য যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা ।

অনুমান করি, এ কিংবদন্তী আসলে কোনো বস্তুনিষ্ঠ তথ্যকেই গোপন রাখার প্রয়াস । মনে হয়, এই মাধবী আসলে পুষ্পহারের রাজনটী ইন্দুমুখী ও মিশরীয় পুরোহিত আমেনহোটেপেরই কন্যা। আমেনহোটেপ ও ইন্দুমুখীর তো বিয়ে হয়নি সামাজিক বৈধ নিয়ম মেনে। আর সেজন্যেই হয়তো মাধবীর জন্মের সাথে সাথেই এমনতরো কিংবদন্তীরও জন্ম হয়েছিল।

মাধবীর রূপগুণের খ্যাতি পুষ্পহার নগরীতে দিনে দিনে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়েছিল। তার মধুস্রাবী কণ্ঠ, নৃত্যশিল্পে তার অপার্থিব পারঙ্গমতা, তার স্বভাব-কবিত্ব, পূর্ণিমার জ্যোৎস্নার মতো তার রূপ, প্রশস্ত স্কন্ধ, লোধরেণুমাখা কুন্তলভার—যেন স্বর্গ থেকে মর্তে নেমে এসেছেন আরেক উর্বশী। দীর্ঘ সাত বছর ধরে ইন্দুমুখীর শিক্ষায় নৃত্যবিদ্যা, গীতবিদ্যা ও রূপচর্চায় মাধবী অতুলনীয়া হয়ে ওঠে। সমস্ত প্রাণ ঢেলে ইন্দুমুখী তার মেয়েকে মনের মতো করে গড়ে তুলেছিল।

তবে ইন্দুমুখী একাই যে মাধবীকে নির্মাণ করেছিল, তা নয়। ইন্দুমুখীকে কেন্দ্র করে পুষ্পহার নগরীতে যেসব বিদ্বান শিল্পীদের সারস্বত সমাবেশ হয়েছিল, তাঁদের অনেকেই মাধবীর শিক্ষক ছিলেন। ইন্দুমুখী ছাড়াও মাধবীকে নৃত্যবিদ্যায় সুশিক্ষিত করে তোলেন গুরু কন্দর্পরত্নম। কন্দর্পরত্নম এত রূপবান ছিলেন যে তাঁর বয়স বাইরে থেকে দেখে বোঝা যেত না। তিনি ‘দেশী’ও ‘মার্গ’—অর্থাৎ লৌকিক ও ধ্রুপদী—উভয়বিধ নৃত্যকলাতেই সুপণ্ডিত ছিলেন। সঙ্গীতের সুরলহরীর সঙ্গে কেমন করে শরীরী ছন্দের মিতালি হবে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের একাদশ প্রকার চলন কীভাবে নিখুঁত উপস্থাপন করতে হবে, কীভাবে গীতবাদ্যশব্দে নিবিষ্টচিত্ত হতে হবে নৃত্যশিল্পীকে—এসব নখদর্পণে ছিল কন্দর্পরত্নমের। বিভঙ্গ, মুদ্রা, নৃত্য-সংরচনা, তাল—সমস্তই মাধবীকে অনুপুঙ্খভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। কোন মুদ্রা এক করপত্রে রচিত হয়, কোনটি-বা রচনা করতে হয় যুগপৎ দুই করপত্রেই; কোন চলন মূকাভিনয়ের জন্যই প্রযোজ্য, কোনটি-বা আবার শুধু নৃত্যেরই উপযোগী; কোথায় আলোর রেখার মতো সরল হতে হবে নর্তকীর গতি আর কোথায় হতে হবে বিদ্যুৎরেখার মতো দ্রুত, চকিত ও কুটিল; কীভাবে নৃত্যাভিনয়ের মধ্য দিয়ে কোনো পুরাণপ্রখ্যাত চরিত্রকে জীবন্ত করে তুলতে হবে দর্শকদের সামনে আর কীভাবে-বা মূর্ত করে তুলতে হবে বিশুদ্ধ ভাবরূপ; চরণসম্পাতে কেমন করে রূপ দিতে হবে তাল ও ছন্দকে পৃথক পৃথক মর্যাদায়—এসব নিগূঢ় বিদ্যা মাধবী অর্জন করেছিল গুরু কন্দর্পরত্নমের কাছ থেকে সুদীর্ঘ ও সশ্রম অভিনিবেশে।

কেবল নৃত্যগুরু কন্দর্পরত্নমই নন, মাধবীর সঙ্গীতগুরু মেঘবর্ণ, কবি কুমারণ, মৃদঙ্গবাদক পদ্মহাস, বংশীবাদক গোবিন্দ, বীণাবাদক মধুকরণ—এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর এঁদের সকলের কাছ থেকেই তালিম নিয়েছিল মাধবী।

মেঘবর্ণ প্রৌঢ়, অথচ তখনও তাঁর কণ্ঠসম্পদ নিটোল, বিদ্যাবৈভব ছিল অতুলনীয় । ধ্রুপদী সঙ্গীতশাস্ত্রে একান্ত নিষ্ঠা রেখেও কীভাবে নবতর বৈচিত্র্য উদ্ভাবন করা যায়—সেই করণকৌশল সঙ্গীতশাস্ত্রী মেঘবর্ণ তাঁর একান্ত অনুগতা শিষ্যা মাধবীকে বহু যত্নে শিক্ষা দিয়েছিলেন।

কবি কুমারণের কবিত্ব তখন এই সমুদ্রবেষ্টিত দ্রাবিড়দেশে অতি প্রসিদ্ধ ছিল। নাট্যগুণান্বিত, মনস্তাত্ত্বিক ও বিচ্ছেদব্যথাতুর কবিতার অপ্রতিম স্রষ্টা ছিলেন কুমারণ । মাধবীর কবিত্বশক্তিকে তিনিই জাগরিত করেছিলেন। মাধবী তার প্রিয় কবি কুমারণের কবিতাতে সুরারোপ করে তাকে নৃত্যোপযোগী করে তুলেছিল অপরিসীম দক্ষতায়।

মৃদঙ্গবাদক যুবক পদ্মহাস মাধবীর সমস্ত নৃত্যানুষ্ঠানেই উপস্থিত থাকতেন। নানা মাত্রার তাল কীভাবে বাজাতে হবে, কীভাবে বাঁশি ও বীণার সঙ্গে এবং কণ্ঠযন্ত্র থেকে নিঃসৃত সুরলহরীর সঙ্গে মৃদঙ্গ বাদনকে নির্ভুলভাবে মিলিয়ে নিয়ে সঙ্গত করতে হবে—পদ্মহাস তা সম্যক জানতেন। প্রয়োজনমতো মৃদঙ্গশব্দকে ঢিমে করে নিয়ে পদ্মহাস অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রকে শ্রুতিগোচর করে তুলতেন। আবার ঠিক সময় এলেই এতক্ষণ ধরে লুকিয়ে থাকা মৃদঙ্গধ্বনিকে প্রবল করে তুলে অন্য সব শ্রুতি, ধ্বনি, ধাতু, বাক-কে ধাবমান ধুন্ধুমার শব্দে ঢেকে দিতেন ঝটিতি। মনে হত, এতক্ষণ যেন একটা বাঘ গুহার মধ্যে ঘুমিয়ে ছিল, সময় আসতেই গুহা থেকে বেরিয়ে এসে সে বনের আর সব পশুদের ধরাশায়ী করে নিজ বিক্রম সগর্জনে ঘোষণা করছে।

দৃষ্টিহীন বংশীবাদক গোবিন্দের সুমিষ্ট সুরলহরীতে ভরে যেত মাধবীর তালিমঘর। কখনও চড়ায় উঠে বাঁশির সুর যেন কোনো কিশোরের সুমধুর আবদারের মতন শ্রোতার গলা জড়িয়ে ধরত, কখনও খাদে নেমে বিরহিণীর ব্যথাতুর অভিমানে গুমরে মরত। কণ্ঠসঙ্গীতের পেছনে নাছোড় প্রেমিকের মতো গোবিন্দের বাঁশির সুর ধেয়ে যেত, কত সকাতর অনুনয় করে বলত, ‘ফিরে এসো, ফিরে এসো !’

প্রবীণ বীণাবাদক মধুকরণের চতুর্দশতন্ত্রী বীণা–সেই বীণার ঝংকারে যেন শূন্যের মধ্যে ফুটে উঠত রাশি রাশি শ্বেতপদ্ম… সেসব কমলকর্ণিকায় চরণচিহ্ন আঁকতে আঁকতে নৃত্যের আসরে প্রবেশ করত অপরূপা মাধবী। মনে হত, নিরবয়ব সুর যেন অবয়ব পেয়েছে মাধবীর মধুছন্দা শরীরে। মধুকরণের বড়ো প্রিয় শিষ্যা ছিল মাধবী। একেবারে বালিকা বয়স থেকে মাধবী প্রবীণ শিল্পী মধুকরণের কাছে বীণাবাদন শিক্ষা করে আসছে। মধুকরণ বলেছিলেন ইন্দুমুখীর কাছে, মাধবীর মধ্যে সুরসরস্বতীর বিশেষ আশীৰ্বাদ আছে।

ধীরে ধীরে লোকপরম্পরা-বাহিত হয়ে মাধবীর রূপগুণের খ্যাতি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল। সেসব কথা অবশেষে একদিন চোলনৃপতি কারিক্কালের কানেও গিয়ে পৌঁছোল। ইন্দুমুখী চলে যাওয়ার পরে রাজা কারিক্কাল এমনিতেই তখন বিরহদশায় নিমজ্জিত। বিশেষত তাঁর রাজসভা ইন্দুমুখী-বিহনে যেন শূন্য হয়ে গিয়েছিল। তিনি তাঁর সভার জন্য উপযুক্ত নর্তকীর অনুসন্ধান করছিলেন। মাধবী ইন্দুমুখীরই শিষ্যা, নৃত্য-গীত-বাদ্যে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত—একথা জেনেও রাজা সরাসরি মাধবীকে রাজনটীপদে নিয়োগ করতে পারছিলেন না। কারণ, সেই সময় রাজসভার নর্তকী-নির্বাচনের বিশেষ প্রথা ছিল। সেই বংশানুক্রমিক প্রথাকে অতিক্রম করে নিজের ইচ্ছেমতো কাউকে রাজনর্তকী নির্বাচন করার সামর্থ্য রাজা কারিক্কালেরও ছিল না।

প্রথাটি এইরূপ। যে প্রতিভাময়ী নর্তকীকে রাজা রাজনটীরূপে সম্মানিত করতে চান, তাঁকে ওই পদে নিয়োগ করার আগে রাজা তাঁর কলানৈপুণ্যের পরীক্ষা নেবেন। এই উদ্দেশ্যে প্রথমেই রাজা নর্তকীর কাছে তাঁর নৃত্যানুষ্ঠান দেখবার জন্য অনুরোধ পাঠাবেন। রাজার অনুরোধ—সে অবশ্য প্রকারান্তরে রাজাদেশই বটে! এই অনুরোধ পাওয়ার পরে নর্তকী রাজপ্রাসাদে এসে তালাইক্কোলের পূজা করবেন। এখন প্রশ্ন ওঠে: তালাইক্কোল বস্তুটি আসলে কী?

তালাইকোল হল এমন একটি বংশদণ্ড, যা কখনও কোনো এক সময় চোল রাজারা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতিস্পর্ধী কোনো রাজার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন। দণ্ডটি অতএব রাজবংশের গরিমার সূচক। অন্যদিকে এই বংশদণ্ডই আবার সেই ইন্দ্রপুত্র জয়ন্তর প্রতীক, যাঁকে প্রণয়-অভিশপ্ত হয়ে বিন্ধ্যারণ্যে একবার বেণুদণ্ডরূপে জন্ম নিতে হয়েছিল। চোল-রাজপ্রাসাদে বংশদণ্ডটি একটি অলংকৃত ছত্রের দণ্ডরূপে সশ্রদ্ধায় স্থাপিত থাকত।

প্রথা ছিল এই, রাজার অনুরোধ পেয়ে নর্তকী রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে একটি সোনার ঘটিতে আনীত কাবেরীর সুপবিত্র জলে তালাইক্কোলের অভিষেক করবেন। তালাইক্কোলকে পুষ্পমাল্যে বিভূষিত করবেন। তারপর বহু রত্নমানিক্যভূষিত সেই তালাইক্কোল হাতে নিয়ে রাজা ও তাঁর পাঁচ অমাত্য অলংকৃত রাজহস্তীর চতুর্দিকে পরিক্রমা করতেন। পরিক্রমা শেষে রাজা অপর একটি রথে উপবিষ্ট সভাকবির হাতে তালাইক্কোলটি তুলে দিতেন। তখন সেই রথ ও হস্তী চলতে থাকবে। নগরের সমস্ত লোক হস্তী ও রথের সঙ্গে সঙ্গে গীতবাদ্যসহকারে নগর-পরিক্রমায় যোগ দিত। আনন্দিত জনতার সঙ্গে রাজাও নগর-ভ্রমণ সাঙ্গ করে নৃত্যানুষ্ঠানের স্থলে উপস্থিত হতেন। রথ থেকে তালাইক্কোলকে সশ্রদ্ধায় নামিয়ে এনে অনুষ্ঠান-মঞ্চের একপাশে স্থাপন করা হত। অর্থাৎ ভাবনাটা এই যে, তালাইক্কোলের মধ্য দিয়ে নৃত্যকুশল জয়ন্তই যেন এই অনুষ্ঠান উপভোগ করতে এসেছেন। অনুষ্ঠানস্থলে তালাইক্কোল স্থাপনের পরে শুরু হত নৃত্যগীত। অনুষ্ঠান শেষে রাজ্যের বিশিষ্ট গুণী শিল্পীরা যদি নর্তকীর কলাকৃতিতে মুগ্ধ হন, তাঁদের বিচারে যদি নর্তকী সসম্মানে উত্তীর্ণ হতে পারেন, একমাত্র তখনই রাজা ওই নর্তকীকে রাজনটীর পদে নিয়োগ করতে পারতেন, অন্যথায় নয়।

মাধবীর ক্ষেত্রেও এই প্রথার ব্যতিক্রম হল না। রাজার আদেশ পেয়ে মাধবী স্বর্ণকলসে করে কাবেরীর জল ভরে এনে রাজপ্রাসাদে তালাইক্কোলকে স্নান করালো। তারপর নগর-পরিক্রমা শেষ হলে তালাইক্কোল মঞ্চের একপাশে স্থাপন করা হল। সভাকক্ষ অগণিত জনতায় গমগম করছে। দর্শকমণ্ডলীর একেবারে সম্মুখভাগে বসেছেন রাজা কারিক্কাল তাঁর পাত্র-মিত্র-অমাত্য-সভাসদদের নিয়ে। বিচারকের আসনে বসেছেন বিশিষ্ট কলাবিদবৃন্দ। মাধবীর গুরুরা—কন্দর্পরত্নম, মেঘবর্ণ, কবি কুমারণ, পদ্মহাস, গোবিন্দ কিংবা মধুকরণ—কেউই কিন্তু বিচারকমণ্ডলীতে থাকতে পারবেন না। কেননা, মাধবী তাঁদের শিষ্যা, শিষ্যার প্রতি গুরুর পক্ষপাত যেন বিচারকে প্রভাবিত না করে।

যবনিকা অপসারিত হল। দেখা গেল, মঞ্চভাগ সুসজ্জিত। দুই দিকে তার দুটি প্রবেশপথ। মঞ্চের ওপরে দারুনির্মিত পাটাতন সুচিত্রিত, আলিম্পিত হয়ে রয়েছে। এটিই নৃত্যক্ষেত্র—এর ওপরেই নৃত্য পরিবেশিত হবে। পটভূমিকায় মাল্যচন্দনে বিভূষিত যত উপাসিত দেবতার আলেখ্যসমূহ। মঞ্চের নানা স্থানে পিতলের পিলসুজের ওপর জ্বলছে উজ্জ্বল দীপবর্তিকা; কিন্তু সেসব এমনভাবেই স্থাপিত, যাতে স্তম্ভসমূহের ছায়াসম্পাতে অনুষ্ঠান-উপভোগে বিঘ্ন না উপস্থিত হয়। মঞ্চের সম্মুখে ও দুই পাশের প্রবেশপথে লম্বিত যবনিকা, রজ্জুর আকর্ষণে যবনিকা উন্মীলিত ও নিমীলিত হয়ে থাকে। মঞ্চছাদের চিত্রিত চন্দ্ৰাতপ থেকে এখানে-ওখানে ঝুলছে শ্বেতশুভ্র মুক্তার মালা যত উজ্জ্বল। মৃদঙ্গবাদক পদ্মহাস, বংশীবাদক গোবিন্দ, বীণাবাদক মধুকরণ এবং অন্যান্য যন্ত্রীরা তাঁদের স্ব স্ব স্থানে বসেছেন।

দক্ষিণ প্রবেশপথ দিয়ে নাচের ছন্দে মাধবী মঞ্চে প্রবেশ করল। দ্বারসমীপবর্তী স্তম্ভের পাশে এসে দাঁড়াল সে। বাম দ্বারপথ দিয়ে এল আরও পাঁচজন নর্তকী; তারা দাঁড়াল বামদিকের স্তম্ভের কাছে। প্রথমে দুটি মাঙ্গলিক স্তব উদ্গীত হল। প্রতিটি স্তবপাঠের শেষে বাদ্যযন্ত্রগুলি বেজে উঠল একে একে। তারপর বীণার মূর্ছনার সঙ্গে আড়বাঁশির ললিত, মৃদঙ্গের অবঘাতের সঙ্গে বীণার ঝংকার এক সুরে বাঁধা হল। সমস্বরিত ঐকতানের মধ্যে নৃত্য আরম্ভ করল মাধবী ও অপরাপর নর্তকীবৃন্দ।

লৌকিক দেশজ ধারার নৃত্য এটি। সেই নিবেদনের মধ্যে মিশে গেল মাটির ঘ্রাণ, সমুদ্রের লবণাক্ত বাতাস, দিগন্তলীন নীলাকাশের স্বপ্ন আর পিতৃপরিচয়হীনা এক অনাথা বালিকার হৃদয়বেদনা। কখনও বেদনার মেঘ থেকে নেমে এল অশ্রুর পারিজাত, কখনও অশ্রুর সমুদ্র থেকে উঠে এলেন আনন্দলক্ষ্মী, উল্লাসের চলোর্মিমালা মাধবীর রূপ ধরে মঞ্চের উপর চকিতচঞ্চল হয়ে উঠল। মানবমনের যত স্বাভাবিক হর্ষবিষাদ, জীবনের যত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, উত্থানপতন—সমস্তই একে একে প্রকাশিত হতে লাগল মাধবীকৃত দেশজ নৃত্যের উপস্থাপনায়।

দেশজ এই নৃত্যের পরেই অন্ধ্রদেশের ধ্রুপদী ঘরানার নৃত্য উপস্থাপন করল মাধবী। নৃত্যশৈলীর ব্যাকরণ সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ রেখেও ঘটাল তাতে প্রাণের সঞ্চার। সেই মনোহরণ নৃত্য দেখতে দেখতে দর্শকদের মনে হচ্ছিল, যে-বস্তুকে এত কঠিন মনে হত এতদিন, তা যেন কত সহজ, কত সাবলীল হয়ে ধরা দিচ্ছে আজ মাধবীর নাচের ছন্দে। ধীরে ধীরে এই দুই ধারা—দেশজ আর ধ্রুপদী—মিশে যেতে লাগল তার সম্মোহক পরিবেশনায়। মনে হল, দ্রুতসঞ্চারী মাধবী যেন এক চিন্ময়ী প্রাণবন্ত স্বর্ণলতা—অমরার সভা থেকে বুঝি আজ ধরিত্রীর ধূলিকণায় নেমে এসেছে শাপভ্রষ্টা কোনো বিদ্যুন্মালা অপ্সরা।

নৃত্যানুষ্ঠান অবসিত হল দর্শকদের মুহুর্মুহু সাধুবাদে। বিচারকরা তাঁদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত জানালেন—মাধবী অনন্যা, নৃত্যে গীতে রূপে মাধবী অতুলনীয়া । তখন রাজা কারিক্কাল মাধবীকে সর্বসমক্ষে রাজনর্তকীরূপে ঘোষণা করলেন। সেকালের প্রথানুযায়ী রাজা স্বহস্তে একটি শ্যামপর্ণী মালা বিজয়িনী মাধবীর কণ্ঠে পরিয়ে দিলেন। তারই সঙ্গে তিনি মাধবীকে দিলেন তাঁর প্রথম উপহার—অষ্ট সহস্র কালাঞ্জু স্বর্ণমুদ্রা।*

সমবেত জনতা ও সমস্ত গুরুজনদের উদ্দেশে আনত অভিবাদন জানাল মাধবী। অনুষ্ঠানশেষে সব উপহার নিয়ে সখীপরিবৃত হয়ে মধ্যরাতে সে যখন ঘরে ফিরল, তখন সারাদিনের পরিশ্রমে সে নিতান্তই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সখীরা চলে গেল একে একে। পরিচারিকারা নৈশ আহার নিয়ে এল, কিন্তু তার থেকে সামান্য কিছু মুখে দিয়েই সে উঠে গেল। শরীর শ্রান্ত; উত্তেজনায় ও ক্লান্তিতে কখন যেন তার খিদে চলে গেছে। সবাইকে বিদায় দিয়ে শয়নকক্ষে চলে এল মাধবী। আর তার শরীর দিচ্ছিল না ।

এ কক্ষে প্রদীপের স্তিমিত আলোয় আলোকিত ইন্দুমুখীর একখানি আলেখ্য। সেই আলেখ্যের দিকে তাকিয়ে সারাদিনের শেষে বুক ভেঙে কান্না এল তার। আজ কতদিন হল, ইন্দুমুখী অনুরাধাপুর চলে গেছে আমেনহোটেপের সঙ্গে। আজকের এই সাফল্য সংবাদ সে তার প্রথম গুরু ইন্দুমুখীকে দিতে পারল না। ইন্দুমুখীর আলেখ্যের সম্মুখে কান্নায় ভেঙে পড়ল মাধবী।

আজ সে যা হয়েছে, যতটুকু হয়েছে, সবই তো মা ইন্দুমুখীর জন্যে। প্রাণান্ত পরিশ্রম করে তিলে তিলে মা তাকে গড়ে তুলেছিল। কিন্তু কী গড়ে তুলল মা, তা আর দেখতে পেল না কিছুই। এ দুঃখ যে সে কার সঙ্গে ভাগ করে নেবে ?

বিছানায় শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবছিল মাধবী। ঘুম আসছিল না। আজ রাত্রেই তাকে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে হবে। এর পরে সে কী করবে? এখন সে রাজনটী। রাজসভায় নিয়মিত নৃত্য প্রদর্শন করতে হবে রাজা কারিক্কাল ও তাঁর সভাসদদের সম্মুখে। সে অত্যন্ত সম্মানের বিষয়, সুখের বিষয়। কিন্তু অবশিষ্ট সময় ? অবশিষ্ট সময়ে সে কী করবে? কীভাবে সে দিনে দিনে আরও যত্নে তার শিল্পকে উন্নততর করে তুলতে পারবে? ভালোর তো কোনো শেষ নেই। সমাজের স্বীকৃতি তো অনেকেই পায়, সেও পেয়েছে। কিন্তু সরস্বতীর উপাসনা কি তাতে সাঙ্গ হয়? পরিতৃপ্ত সে হয়নি, পরিতৃপ্তিই শিল্পীর মরণ। সাধারণের চোখ থেকে, এমনকি বিশিষ্ট শিল্পীদের চোখ থেকেও উপস্থাপনার যে-ত্রুটিগুলি সে লুকিয়ে রাখতে শিখেছে, সেগুলো তার নিজের ক্ষমাহীন দৃষ্টির সম্মুখে তো প্রতিবারই ধরা পড়ে যায় ৷

তাকে আরও অভ্যাস করতে হবে, আরও সাধনা করতে হবে। কিন্তু তার অসুন্দর জীবন, চারিদিকে লোলুপ মানুষের কুশ্রী লোভ কি তাকে সেই সাধনা করতে দেবে? বৃত্তিতে সে বারাঙ্গনা, এ মহল্লার সব মেয়েই তাই। তাদের কারওই কোনো নির্দিষ্ট পিতৃপরিচয় নেই। বারাঙ্গনাকুলে জন্ম নিয়ে এই বৃত্তি পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যেতে দেবে না তাদের সমাজ; সে তারা বিত্তবতীই হোক আর হতদরিদ্রই হোক—জন্মসূত্রে সমাজের চোখে তারা বেশ্যা ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রতি রাত্রে তাদের উন্মুক্ত হতে হবে, উপভুক্ত হতে হবে, লোলুপ পুরুষের জান্তব ক্ষুধা মেটাতে হবে। মাধবী এখনও এ বৃত্তিতে আসেনি; মা-পাখি যেমন করে শাবককে তার ডানার নীচে আড়াল করে রাখে সব ঝড়-জল-বৃষ্টি থেকে, ইন্দুমুখীও তেমনই তাকে এতদিন সমাজের কলুষিত দৃষ্টি থেকে একপ্রকার আড়াল করেই রেখেছিল। কিন্তু আজকের পর থেকে সে সকলের সামনে উন্মুক্ত হয়ে গেল। বিত্তবান ধনী মানুষেরা আর তাকে রেহাই দেবে না। ওই সব মানুষের চোখে সুন্দর বলে কিছু নেই, শিল্প বলে কিছু নেই, শুধু শরীর, শরীর আর শরীর। ওদের তথাকথিত শিল্পানুরাগ সমস্তই নারীকে শয্যায় তুলে নিয়ে যাওয়ার পূর্বভূমিকা। দিনে দিনে সে এইবার ক্রমাগত ব্যবহৃত হবে, জীর্ণ হবে। সেসব জীর্ণতাকে প্রসাধনের নীচে ঢেকে ফেলে উদ্ভিন্নযৌবনা সেজে প্রতিদিন রাজসভায় তাকে উপস্থিত হতে হবে। সাধনার সামগ্রী দিয়ে তৃপ্ত করতে হবে বিলাসী সভাসদদের মন। ভাবতে ভাবতে গভীর বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল মাধবীর ভিতর থেকে ।

কিন্তু শুধু সমস্যার পর্যালোচনা করেই ক্ষান্ত হতে চাইল না মাধবী। অন্ধকারে চোখ জ্বেলে জ্বেলে সে এর একটা সমাধান খুঁজছিল। মাধবীর সমস্যা সম্ভবত যেকোনো যুগের যেকোনো শিল্পপ্রতিভাসম্পন্না বারাঙ্গনারই সমস্যা। আরও বড়ো করে দেখলে, এ সমস্যা যেকোনো শিল্পীরই সমস্যা। যেকোনো বিজ্ঞানীরই সমস্যা। যেকোনোরকম সৃজনশীল চিন্তকেরই সমস্যা। লঘুচিত্ত মানুষের বিনোদনের জন্য শিল্প-সাহিত্য-দর্শন কিছুই নয়। অথচ শিল্পীকে, বিজ্ঞানীকে, চিন্তককে বেঁচে থাকতে হলে পেটের ভাত, গায়ের কাপড়ের ব্যবস্থা করতে হবেই। আর তা করতে হলে বৃহত্তর সমাজের ওপর তাকে নির্ভর করতে হবেই। তখন শিল্প-সাহিত্য-বিজ্ঞান সবই নিছক পণ্য—লঘু মানুষের বাজারে বিক্রয়যোগ্য বস্তু। অন্যদিকে পণ্য হয়ে উঠলে তা আর তখন শিল্পের বা বিজ্ঞানের বা চিন্তার ধন হয়ে থাকতে পারে না । তখন তা কেবল উপভোগ্য বস্তু হয়ে ওঠে। সৃজনশীল মানুষের মনের মধ্যে এই যে নিরন্তর পরিত্রাণহীন স্ববিরোধ, যা তাকে দিনে দিনে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায়, এক দিক দিয়ে দেখলে এই স্ববিরোধের ইতিহাসই তো মানুষের সমাজের ইতিহাস, শিল্পের ইতিহাস, চিন্তার ইতিহাস। এই স্ববিরোধ থেকে আজ এই একুশ শতকে যেমন মুক্তি নেই কারও, সুদূর দ্বিতীয় শতকের নৃত্যশিল্পী মাধবীরও তেমন মুক্তি ছিল না ।

কেউ কেউ অবশ্য বলেন, দুটি ভাত-কাপড়ের আগে সংস্থান করে, তারপরে শিল্পচর্চা করতে যাওয়াই ভালো। তাতে শিল্পকে পণ্য হয়ে উঠতে হয় না। কিন্তু এতে মুশকিল হচ্ছে, যেকোনো শিল্পই চব্বিশ ঘণ্টার অতন্দ্র মনোযোগ দাবি করে। অন্নবস্ত্রসংস্থানের জন্য অন্য পেশায় জীবিকানির্বাহের কাজ সেরে বাড়ি ফিরে অবসরমতো শিল্প করা যায় না। অবসরমতো শিল্প করলে, দুয়েকটি শ্রদ্ধেয় ব্যতিক্রম বাদ দিলে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা শিল্পীর ব্যক্তিগত বিনোদনের ফলমাত্র হয়ে দাঁড়ায়। মাধবীর ক্ষেত্রে অবশ্য অবস্থা আরও করুণ। মাধবী যদি শুধু জীবিকানির্বাহের জন্য বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনো পেশা বেছে নিত, তা হলেও সেদিনের অর্থাৎ দ্বিতীয় শতকের সমাজ কিন্তু মাধবীর সেই বিকল্প বৃত্তিকে স্বীকার করত না ।

মাধবী বুঝতে পারছিল, কোনো-না-কোনোভাবে তার সামাজিক নিরাপত্তার প্রয়োজন এখন—যদি তার শিল্পীসত্তাকে কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখতে হয়। আগ্রাসী মানুষের থাবার নীচে প্রতি রাতে উপভুক্ত হওয়ার চেয়ে, সমাজে বহুবল্লভা হয়ে আমৃত্যু বেঁচে থাকার চেয়ে এমন কিছু তাকে বেছে নিতে হবে, যাতে সে নৃত্য-অনুশীলনের নির্বিঘ্ন, নিরাপদ অবসর পায়। কীভাবে তা সে পাবে? রাজসভা একটি প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান তাকে ব্যবহার করবেই। অবশ্য একই সঙ্গে মাধবীর শিল্পপ্রতিভাকে লালনও করবে সেই প্রতিষ্ঠান নিজেরই স্বার্থে। কিন্তু এর বাইরে যাতে তাকে আরও উপদ্রুত না হতে হয় বিত্তবান মানুষের হাতে, যাতে সে নিজের জন্যে, নৃত্যচর্চার জন্যে সময় পায় খানিকটা, তার উপায় কী ? সহসা মনে হল মাধবীর—বেশ্যা হওয়ার চেয়ে রক্ষিতা হওয়া ভালো। বেশ্যার কোনো সামাজিক নিরাপত্তা নেই, তার শিল্পের কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই, যেকোনো লোভাতুর মানুষের সাময়িক উত্তেজনার উপাদান সে। কিন্তু রক্ষিতার একজন রক্ষক আছে, পৃষ্ঠপোষক আছে—সেখানেও ব্যবহৃত হতে হবে, কিন্তু অপরিমিত, অনিয়মিত নয় সেই ব্যবহার। কোথাও একটু আপস করতেই হবে তাকে। ভাবতে ভাবতে মনে হল মাধবীর—অবশ্যই এ তার একান্ত ব্যক্তিগত মনে হওয়া—তথাকথিত স্বাধীনতার চেয়ে এই নিরাপত্তা শ্রেয়োতর।

যদি তাকে কেউ কিনে নেয় চিরতরে ! কে কিনে নেবে? সম্পত্তির প্রতি সম্পদশালীর মায়া জন্মায়। ‘সেই মায়া থেকেই হয়তো যে-লোক কিনে নেবে আমাকে, সে আমার প্রতি মায়াপরবশ হবে, আমাকে অপক্ষয়িত হতে দেবে না সে। হয়তো সেই মায়া কোনো আচম্বিত মুহূর্তে আমার প্রতি তার ভালোবাসার রূপ নেবে। হতে পারে না এমন কি অসম্ভব কিছু এ জীবনে ? আমি তো ইন্দুমুখীর জীবন দেখেছি, মা কারও রক্ষিতা হয়নি, দিনে দিনে ক্ষয়ে গেছিল। যদি অন্তিমে মিশরীয় পুরোহিত আমেনহোটেপকে মা না পেত, তাহলে একটি অপচয়িত জীবন ছাড়া মায়ের কাছে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না । কিন্তু আমার কী হবে? কেউ আছে, যে আমাকে ভালোবাসবে?’—ভাবতে ভাবতে কাঁদতে কাঁদতে শেষ রাতের নির্জন বাতাসের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ল মাধবী।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠে সকালবেলায় স্নান সেরে রক্তবর্ণের একটি দুকূল পরল সে। কবরী বন্ধন করে সাজসজ্জা সম্পূর্ণ করল দর্পণের সামনে বসে। তারপর ঊষসীকে ডাকল এ ঘরে। ঊষসী মাধবীর সখী ও ব্যক্তিগত পরিচারিকা। ইন্দুমুখী চলে যাওয়ার পরে এ গৃহই এখন মাধবীর আবাসস্থল।

ঊষসী এসে দাঁড়াল। গত রাত্রের সেই রাজার দেওয়া উপহার—সেই শ্যামপর্ণী মালাটি মাধবী সখী ঊষসীর হাতে দিয়ে বলল, ‘যা লো ঊষসী, চার রাস্তা যেখানে মিলেছে, যে-পথ দিয়ে বিত্তবান নাগরিকদের নিত্য যাতায়াত, সেখানে এই মালা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বল—যে ব্যক্তি এই মালা সহস্র কালাঞ্জু দিয়ে ক্রয় করতে পারবে, লতার চেয়েও কমনীয়া পুষ্পিতযৌবনা মাধবী একমাত্র তারই, কেবল তারই চির-আশ্রিতা হয়ে থাকবে!’

(আঠেরো) শ্যামপর্ণী

পুষ্পহারের জনাকীর্ণ রাজপথ ধরে প্রভাতবেলায় ঈষৎ বিষণ্ণ মনে হাঁটছিল কোভালন সে যাবে কাবেরীতীরস্থ তাদের পারিবারিক বিপণিতে। এই বিপণিকে কেন্দ্র করেই তার পিতা মাশাত্ত্ববান ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনা করতেন। পিতার মৃত্যুর পরে ব্যবসার গতিক বেশ সুবিধের নয়, এখন কোভালনই নিজের পৈতৃক ব্যবসাপাতির দেখাশোনা করছে । ইদানীং নিতান্ত যান্ত্রিকভাবে হলেও সে কাজে মন দিয়েছে। বলা ভালো, মন দিতে বাধ্য হয়েছে। এ মুহূর্তে তার বেশবাস, হাবভাব দেখে বোঝার উপায় নেই যে, সে কোনোদিন কবিতা লিখত। বাইরে থেকে দেখে তাকে এখন একজন মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী বলেই মনে হয়। কবিতার ঘোর সে জোর করেই কাটিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।

মনে যে পরিতাপ জন্মায়, তা প্রায়শই নিজের ওপর নিজেকেই প্রতিশোধ নিতে প্ররোচিত করে। বিবাহের পরে এই পরিতাপ জন্মেছে তার দিনে দিনে। কেন সে কবিতাকে ভালোবাসতে গেল? কেন সে আর পাঁচজনের মতো স্বাভাবিক মানুষ হল না ? যদি সে সুস্থ হত, স্বাভাবিক হত, তাহলে কল্পনার মৃগতৃষ্ণিকার পেছনে ছুটে নিজের জীবনকে ঊষর করে ফেলতে হত না। সুন্দরী, সতীলক্ষ্মী স্ত্রীকে নিয়ে সুখে সংসার করতে পারত সে। সেই সুখ যখন তার হল না, তখন অভিমানভরে আবাল্যপূজিত সরস্বতীকে ছেড়ে সে ধনলক্ষ্মীর উপাসনা করে নিজের আহত সত্তাকে নিজের হাতেই শেষ করে ফেলতে চেয়েছে।

কন্নকী বড়ো ভালো মেয়ে; কিন্তু এত ভালো কোভালনের জন্যে ভালো হল না । কন্নকীর জীবনে কবিতা নেই, সে বাস্তব পরিস্থিতিকে সর্বাধিক মূল্য দেয়। সমস্ত দিন ধরে সে গৃহকাজ করতে ভালোবাসে। গৃহে অগণিত পরিচারিকা থাকা সত্ত্বেও এই কাজপাগল মেয়েটি এক মুহূর্তের জন্যেও নিজের হাতদুটোকে বিশ্রাম দিয়ে সুস্থির হয়ে বসে না। সারাদিন একের পরে এক কাজ করে যায়। তারপর দিন শেষ হলে যতই রাত্রি ঘনাতে থাকে কন্নকী ততই ক্লান্ত থেকে ক্লান্ততর হতে থাকে। রাত্রির প্রথম প্রহরের মধ্যে কন্নকীর দু-চোখ জুড়ে ঘুমের পাপিয়ারা গান বন্ধ করে ডানা মুড়ে একে একে নেমে আসতে শুরু করে। কথা বলতে বলতে কথা জড়িয়ে যায় কন্নকীর, হাই উঠতে থাকে। কখনও সে

কোভালনকে বলে কবিতা পড়ে শোনাতে। কিন্তু কবিতা শুনতে শুনতে ক্লান্তির আবেশে সে কোভালনের কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে শোয়। আত্মমগ্ন হয়ে কবিতা পড়তে পড়তে হঠাৎ কোভালন দেখে, কন্নকী কখন ক্ষুদ্র বালিকার মতো কোভালনের উত্তরীয়টি বাম মুঠিতে চেপে ধরে কোলের উপর নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কোল থেকে লঘুভার কন্নকীকে দুই হাতে তুলে নিয়ে শয্যায় শুইয়ে দেয় কোভালন। অন্ধকারে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

কোভালনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসায়, তার খাওয়া-পরা, শরীরের যত্ন নেওয়ায় কন্নকীর যত্নের শেষ নেই। কোভালন যেন তার অলংকার-পেটিকার সর্বশ্রেষ্ঠ রত্ন। তাকে প্রত্যহ ঝেড়ে-মুছে সুন্দর করে সাজিয়ে পেটিকার মধ্যে তুলে রাখতে চায় সে। এরই মধ্যে কোভালনদের ব্যবসার প্রতিটি খুঁটিনাটি তার নখদর্পণে। বণিক মানাইক্কনের মেয়ে কন্নকী—ব্যবসা তো তার রক্তে। ব্যবসাঘটিত কঠিন সব সমস্যা, যার নিষ্পত্তি করতে কোভালন হিমশিম খায়, সেসব একবার কনকীর সঙ্গে আলোচনা করলেই অবধারিতভাবে সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসে। কোভালন ভাবে, এত বুদ্ধিমতী কন্নকী, শুধু যদি একটু কবিতা বুঝত !

কবিতা যে কন্নকী বোঝে না, তা একেবারেই সত্যি নয়। অনেক সময় তার মন সজাগ থাকলে কবিতা শুনতে শুনতে সে এমন একেকটা কথা বলে যে, সেসব কথা শুনে কোভালনও নিতান্ত অবাক হয়ে যায়। তখন সে ভাবে, এদিকটা তো সে চিন্তাও করেনি কস্মিনকালেও। কন্নকীর রুচি আছে, বুদ্ধি আছে, সংবেদনশীলতাও আছে। যদি মনোযোগ দিয়ে অনেকদিন ধরে সে কবিতা শুনত, তাহলে এ রাজ্যের কোনোকিছুই তার অনায়াত্ত থাকত না। কিন্তু কবিতার প্রতি ওই মনোযোগটিই দেয় না কন্নকী। তার কাছে কবিতার থেকে মূল্যবান তার স্বামী, তার সংসার। অনেকদিন কবিতা না লিখলে কোভালন, সে অনুযোগ করে। কিন্তু কোভালনের কবিতার একমাত্র মূর্তিমতী উপাদান যে কন্নকী নিজেই, একথা ভুলে যায়। সে যদি এত বাস্তবখচিত হয়, তবে তাকে নিয়ে কল্পলোক কীভাবে নির্মাণ করবে কোভালন ?

কন্নকীর ভালোবাসা কোভালনের প্রতি একরৈখিক। তাতে কোনো বর্ণবৈচিত্র্য নেই। ও কেমন সকালের আলোর মতন সরল, স্পষ্ট! তাতে কোনো আড়াল নেই, খেলা নেই, পেয়ে হারানোর ভয় নেই, হারিয়ে ফিরে পাওয়ার উত্তেজনা নেই, কোনো লুকোচুরি নেই, কোনো মধুর পীড়ন নেই। এই আড়াল, এই খেলা, এই ভয়, এই উত্তেজনা, এই লুকোচুরি, এই পীড়ন ছাড়া, হে সরলা নারী, বলো তুমি বলো, কবিতা কীভাবে সম্ভবে ?

কন্নকীর সরল বাস্তবতার কাছে তাই কোভালনের নিগূঢ় কল্পনা বারবার পরাস্ত হয়ে যায়, হতমান হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আর লিখতে পারে না কোভালন। কোভালন তো নির্লিপ্ত সন্ন্যাসী নয় যে, সম্পূর্ণ লোকবিবিক্ত হয়ে একান্ত নিজের কাছে এসে বসতে পারবে, নির্জন কোনো গুহাবাসে বসে শান্ত, নিতান্ত নিরুদ্বিগ্ন মনে সে লিখে চলতে পারবে। সেই কৌশল সে শেখেনি। হয়তো আরও বয়েস হলে জীবন তাকে এসব

এমনিতেই শিখিয়ে দিত। কিন্তু এখনও সে শুধু প্রেরণা-নির্ভর। উত্তেজনা-নির্ভর। এখনও তার জীবনে, পরিপার্শ্বে কিছু না ঘটলে সে লিখতে পারে না। কন্নকীকে প্রেমের মধ্য দিয়ে, সুন্দরের মধ্য দিয়ে, কবিতার মধ্য দিয়ে পেতে চেয়েছিল সে। পেল না । তাই লিখল না। কিন্তু যেভাবে পাচ্ছে, তাও যে কবিতার আশ্রয় হতে পারে, তরুণ কোভালন এখনও তা বুঝতে পারেনি। আর বুঝতে পারেনি বলেই, সে কবিতা থেকে সরে গিয়েছে। না, বরং সে এখন অভিমানভরে বন্ধুদের বলে, ‘কবিতা আমাকে ছেড়ে গিয়েছে।’ কবিতা কীভাবে ছেড়ে যাবে? কোথা থেকে কোথায় যাবে? কবিতা তো আকাশের মতন । আকাশ কোথা থেকে কোথায় যায়? সরে দাঁড়ানোর জায়গা কই আকাশের? কবিতার? সত্যের যে অনন্ত রূপ, অনন্ত আনন, সেই বোধ হয়নি এখনও তরুণ কোভালনের।

রাগে, অভিমানে সে নিজেকে ব্যবসার গাঁটরির নীচে চিরকালের মতো পিষ্ট করে মেরে ফেলতে চায়। নিজেকে মেরে ফেলা কি এতই সহজ? অবদমিত ‘আমি’অভিমান হয়ে বেঁচে থাকে। সেই আত্মপীড়নের ভার নিয়ে বিষণ্ন মনে কোভালন এখন প্রভাতবেলায় জনাকীর্ণ রাজপথ দিয়ে কাবেরীতীরস্থ পারিবারিক বিপণির দিকে অনুত্তেজিত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছে।

যেতে যেতে রাস্তার চৌমাথার কাছে পৌঁছোতেই একটা অস্পষ্ট হট্টগোল শুনে কোভালনের এতক্ষণের আত্মনিমগ্নতা ভেঙে গেল। চমকে উঠে তাকিয়ে সে দেখল, পথের ওধারে কতগুলো লোক কী নিয়ে যেন মহা উত্তেজিত হয়ে হইচই করছে। রাস্তা পার হয়ে কোনোমতে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে কোভালন দেখল, একটি সুশ্রী মেয়ে হাতে একটা শ্যামপর্ণী মালা উঁচু করে ধরে তারস্বরে বলে চলেছে, ‘মহাশয়গণ! শুনুন, শুনুন, শুনুন! এই যে শ্যামপর্ণী মালা—এটি আমার স্বামিনী শ্রীমতী মাধবীকে মহারাজ কারিকাল কাল রাত্রে সর্বজনসমক্ষে উপহার দিয়েছেন। রাজদত্ত এই মালা যে-ব্যক্তি কিনে নিতে পারবেন, লতার চেয়েও কমনীয়া, পুষ্পিতযৌবনা, শিরীষকুসুমের চেয়েও কোমলা, ভগবান পুষ্পধনুর প্রসাদধন্যা, নৃত্যগীতদক্ষা আমার স্বামিনী শ্রীমতী মাধবী এখন থেকে হবেন কেবল তাঁরই, তাঁরই, তাঁরই!’

মেয়েটির ঘোষণা শেষ হওয়া মাত্র সমবেত জনতা আরও জোরে উল্লাসে ফেটে পড়ছে। নানা লোকের নানা কথা, চিৎকারের চোটে কান পাতা দায়। একজন যুবক তারই মধ্যে গলা তুলে বলল, “মাধবী সমস্ত নগরীর। চিরতরে কোনো একজনের সে অঙ্কশায়িনী হবে কেন? ”

মেয়েটি যুবকের থেকেও উচ্চৈঃস্বরে গলা তুলে উত্তর দিল, ‘এই প্রশ্নের উত্তর একমাত্র আমার স্বামিনীই দিতে পারেন, মহাশয়। আমি দাসী মাত্র। আপনার দরকার পড়লে আপনি আমার স্বামিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এই প্রশ্ন করুন গে। কিন্তু সেই সাক্ষাৎ তখনই সম্ভব হবে, একমাত্র যদি আপনি আমার স্বামিনীকে ক্রয় করেন। শুনুন, শুনুন, শুনুন! রাজদত্ত এই মালা যে-ব্যক্তি কিনে নিতে পারবেন….’ আবার সেই চিৎকৃত ঘোষণা

একজন মধ্যবয়স্ক নাগরিক এরই মধ্যে সরস ভঙ্গীতে দাসীর দিকে তাকিয়ে ফুট কাটল, ‘তা তুমিও বিক্রীত হচ্ছ না কেন, বাপু? মাধবীকে না পারি, তোমাকে তো অন্তত কিনে নিতে পারতাম!’

প্রায় ষাটোর্ধ্ব এক পলিতকেশ বৃদ্ধ যষ্টিতে ভর দিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘মাধবীকে কিনতে কে না চায় ! সবারই তো সাধ-আহ্লাদ আছে। কিন্তু কিনব বললেই তো হল না, মূল্য দিতে হবে। তা কত মূল্য এই মালার? কত মূল্য তোমার স্বামিনীর? কত কালাঞ্জু ? কহো !

পূর্বের যুবকটি সরস ভঙ্গিতে চোখ গোল গোল করে বৃদ্ধের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘বাব্বা ! এখনও সাধ-আহ্লাদ আছে তাহলে—ও তাতা ?”

যুবকটির এই কথায় সহর্ষ জনতা তুমুল হাস্যরোলে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেই হই-হট্টগোলের আওয়াজ ছাপিয়ে মেয়েটি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘মালার মূল্য সহস্র কালাঞ্জু। আছে কেউ, যে মূল্য দেবে? মালা যে কিনবে, সে এখন থেকে আমার স্বামিনীকে চিরকালের জন্যে পাবে।’

তার এমন ঘোষণায় এক লহমায় সব হইচই থেমে গেল। একজন চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘কী বললে? এক সহস্র কালাঞ্জু ? এ বলে কী! কে দিতে পারবে এক সহস্র কালাঞ্জু একজন নটীর জন্যে?’

তখনই আরেকজন স্থূলবপু নাগরিক পূর্বের ব্যক্তিটিকে বাধা দিয়ে সজোরে বলে উঠল, ‘নটী? কেবল নটী কাকে বলছ, হে সুধাকরণ? এ যে সে নটী নয়, একেবারে রাজনটী! স্বয়ং রাজনটী ইন্দুমুখীর শিষ্যা। আর অমন সুন্দরী, অমন নৃত্যগীতপটিয়সী নর্তকী আছে নাকি হে ভূভারতে? মাধবীর মূল্য দিতে না পারো, সরে পড়ো না কেন? খামোখা দিক্ করছে, দ্যাখো! যত্তোসব!’

কোভালন দেখল, এত কথা হচ্ছে, মেয়েটিও সেই একই সুরে তার স্বামিনী মাধবীর রূপগুণের ব্যাখ্যান করে দর হাঁকছে, কিন্তু কেউই মালাটির মূল্য দিতে আর অগ্রসর হচ্ছে না। ভিড়ের মধ্যে নানা দিক দিয়ে ঠেলা খেতে খেতে কোভালন বাত্যাহত অর্ণবপোতের মতন ক্রমাগত কী যেন একটা ভাবনার সমুদ্রে ডুবে যেতে লাগল।

বারবার ‘মাধবী, মাধবী, মাধবী’ শুনতে শুনতে কোভালনের অবসাদ-আচ্ছন্ন মনের অতল থেকে বিদ্যুতের শিখার মতন অনেকদিন আগের একটা স্মৃতি সহসা জেগে উঠছিল। সে আজকের কথা নয়, কোভালনের বয়স তখন হবে আঠেরো বা উনিশ বছর। সবেমাত্র কবিতা লিখতে শুরু করেছে তখন, কবিতার সূত্র ধরেই ছোটোখাটো একটি তরুণ কবিদের দলও গড়ে উঠেছে তার চারপাশে। কাপিলর, পারানর প্রভৃতি পূর্বজ কবিদের অকাম* ও পূরম* —দুই প্রকার কবিতার পাশাপাশি কবি তিরুভাল্লুভারের সুভাষিত-সুবাসিত পদগুলিও আলোড়িত করছে তাদের। আবার একই সঙ্গে সমকালীন কবিদের কবিতা নিয়েও তারা চর্চা করছে। এমন সময় কতগুলো বিস্ময়কর কবিতা তাদের হাতে এসে পড়ল—ছিন্নভিন্ন কয়েকটি মাত্র পদ—কিন্তু কী তাদের অভিনবত্ব, চোখ-ধাঁধানো উপমার কী আশ্চর্য প্রয়োগ !

খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল, তাতে আরও বেশি অবাক হওয়ার কারণ ছিল। এই কবিতাগুলো নাকি এক অপ্রাপ্তবয়স্কা কিশোরীর রচনা, নাম তার মাধবী। রাজনটী ইন্দুমুখীর পালিতা কন্যা সে। অপরূপা সুন্দরী, সে শুধু কবিতাই লেখে না, নৃত্যগীতেও তার অপ্রতিম প্রতিভা। এমন একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করা যায় না? না, যায় না। কেননা সে নাকি থাকে ইন্দুমুখীর তত্ত্বাবধানে কড়া পাহারায়। কে যেন বলেছিল, কবিনী আব্বাইয়ার স্বয়ং হয়তো পুনর্জন্ম নিয়েছেন এই মেয়ের মধ্যে।

সেই মাধবী! কিন্তু সেই মাধবী যে এই মাধবী—সেকথা এখনও নিশ্চিত করতে পারছে না কোভালন। একটু আগে ভিড়ের মধ্যে মোটা গোছের লোকটা মাধবীকে ইন্দুমুখীর শিষ্যা বলে পরিচয় দিয়েছে ঠিকই, তবু সংশয় একেবারে যাচ্ছে না। গতকাল সন্ধ্যায় কাবেরী তটে কয়েকজন রোমক বণিকের আগমন হওয়ায় কোভালন খুবই ব্যস্ত ছিল সেখানে। নগরীর কেন্দ্রে নৃত্যানুষ্ঠানের শেষে কোনো এক তরুণী নর্তকীকে রাজা কারিকাল রাজনটী পদে নির্বাচন করেছেন, এমন একটা ভাসা ভাসা উড়ো খবর কোভালনের কানেও গিয়ে পৌঁছেছিল, তাও সত্যি। কিন্তু সেদিকে মন দেওয়ার মতো অবসর তখন তার ছিল না। বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোকে এখন সে মনে মনে জোড়া লাগাতে পারছে। কিন্তু কালকেই রাজনটী পদে নিযুক্ত হয়ে আজ সকালে উঠেই মাধবীর আত্মবিক্রয়ের এমন ইচ্ছা হল কেন? তবে কি সে বহুপভুক্তা হতে চাইছে না? কেন? কী উদ্দেশ্যে? বহু মানুষের থেকে আড়াল করে কী বাঁচাতে চাইছে সে নিজের? কবিতাকে?

সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ যৌবনের স্বপ্ন-কুহক মাখা রূপকথার প্রাসাদ… তার মায়াচ্ছন্ন খিলানের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা কবিতার মতো সেই রহস্যময়ী কিশোরী মাধবী… আর আজকের রৌদ্রাক্ত রাজপথে অতিবিজ্ঞাপিত নটী মাধবী—এরা একই ব্যক্তি কি না, সেকথা জানবার জন্যে কোভালনের মনের মধ্যে একটা অদম্য আগ্রহ জেগে উঠতে লাগল ক্রমাগত । একটু আগে তার অবসন্ন চেতনার তলদেশ থেকে কৌতূহলী বিদ্যুতের যে-শিখা জ্বলে উঠে চকিতে নিভে যাচ্ছিল, এখন তা আর কিছুতেই নিভতে চাইছে না । ধীরে ধীরে ক্ষণপ্রভার দীপ্তি বাসনার ইন্ধন পেয়ে সাকার মূর্তি ধরছে। যেন তার মুখের চারিপাশে হেমকান্তি প্রদীপ ধরে কে বৃত্তাকারে ঘোরাচ্ছে। জীবনের বিবর্ণ যাপনের ভিতর সে-দীপ আশায় প্রোজ্জ্বল, বাসনায় সংরক্ত। বুকের ভিতরে বসে কে এক প্রমত্তা নারী সতীত্বের শঙ্খকঙ্কণ অসংযমের আঘাটায় ঠুকে চূর্ণ করে দিয়ে লীলাখিলখিল হাসতে হাসতে বলছে, ‘আছে, আছে, এখনও এই ক্লান্তি আর অবসাদ থেকে মুক্তির উপায় আছে! এখনও প্রেম আছে, আশা আছে, উদ্দীপনা আছে, কল্পনা আছে! পঞ্জরাস্থির নীচে এখনও স্নায়ুবিজুরির চকিত চুম্বন আছে, শোণিতস্রোতে এখনও রক্তকণিকার উত্তপ্ত লাস্য আছে, শেষ হয়ে যায়নি কিছুই, কিছুই শেষ হয়ে যায় না…..

কী করতে যাচ্ছে, সেকথা ভালো করে না-বুঝেই কোভালন তার চিনাংশুকের প্রান্তে গ্রন্থিত বিত্তকোশটির বন্ধন খসিয়ে এনে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল, ‘আমি দেবো সহস্ৰ

কালাঞ্জু। এবং তা দেবো এখনই। আমাকে আপনার স্বামিনীর কাছে নিয়ে চলুন।’

কোভালনের এতাদৃশ ঘোষণার দাপটে রাজপথের সমস্ত জনতা এতক্ষণের উল্লাপন থামিয়ে একেবারে হতচকিত স্তব্ধ হয়ে গেল। এদের মধ্যে কোভালনকে কেউ কেউ চেনে, তাদের পৈতৃক ব্যবসার সাম্প্রতিক অবনমনের খবরও রাখে। মাশাবানপুত্ৰ কোভালন যে সেসব বিপর্যয় কাটিয়ে এরই মধ্যে এতখানি বিত্তবান হয়ে উঠেছে যে, সহস্র কালাঞ্জু দিয়ে নটী মাধবীকে সে কিনে নেওয়ার দুঃসাহস করবে, একথা চিন্তা করেও তাদের যেন শ্বাসরোধের অবস্থা হল। বণিক মাত্রেই বিলাসব্যসনে আসক্ত হয়, তার ফলও সর্বনাশা, কে জানে কোন দুর্গ্রহ আজ এই পথিমধ্যে মাশাত্তুবান-তনয়ের মাথায় চড়ে বসেছে!

এতক্ষণ পরে কোভালনের কথা শুনে মাল্যধারিণী মেয়েটির মুখ কিন্তু আশাপ্রোজ্জ্বল হয়ে উঠল। কোভালনের কাছ থেকে সহস্র কালাঞ্জু নিয়ে হাতের মালাটি সে কোভালনের গলায় পরিয়ে দিয়ে নম্র সুরে বলল, ‘আসুন, ভদ্রমুখ! আমার স্বামিনী আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছেন। ‘

এত সহজে তামাশা মিটে গেল দেখে আমোদপ্রিয় জনতা বেজার মুখে আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাজপথে এখন শুধু দুটি মানুষ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে—কোভালন আর সেই মেয়েটি। অভিবাদন জানিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আমার নাম ঊষসী। আমি রাজনটী মাধবীর প্রধানা পরিচারিকা। আপনি আমার সঙ্গে আসুন।’

ঊষসীর পেছনে পেছনে রাজপথ অতিক্রম করে শীর্ণ প্রায়ান্ধকার গলিপথ ধরে সম্মোহিতের মতন হাঁটছিল কোভালন। কিছুটা অগ্রসর হওয়ার পরে একটি নাতি-উচ্চ হর্ম্য চোখে পড়ল। আশেপাশের গৃহাবাসগুলির তুলনায় এ হর্ম্যটি তার স্থাপত্যের দিক দিয়ে বিশিষ্ট। দ্বার অতিক্রম করে ক্ষুদ্রায়তন একটি কক্ষে কোভালনকে নিয়ে গেল ঊষসী। এই কক্ষ থেকে কয়েক ধাপ সোপান উত্তরের একটি দালানের দিকে উঠে গেছে। একটি ঊর্ণাসদৃশ অর্ধস্বচ্ছ পর্দা ভিতরের দালানকে দৃষ্টিপথ থেকে সামান্য সম্বৃত করে রেখেছে। কোভালনকে সেই ঊর্ণা-আবরণ সরিয়ে ঊষসী দালানে উঠে যেতে ইশারা করল। সোপানসমূহ অতিক্রম করে আধেক-লীন যবনিকা অপসারিত করে বিমুগ্ধ কোভালন আড়ষ্ট পদক্ষেপে দালানে উত্তীর্ণ হল। সম্মুখে তাকিয়ে প্রথমে সে কিছুই দেখতে পেল না। এতক্ষণ রৌদ্রের তীব্রতার মধ্যে তার চোখের মণি বিস্ফারিত থাকায় সহসা প্রায়ান্ধকার দালানে চোখ সওয়াতে সময় লাগল। দৃষ্টি সহজ হতে সে বুঝতে পারল, সে একটা অলংকৃত বৃহৎ প্রকোষ্ঠের মতো দালানে মূঢ়বৎ দাঁড়িয়ে আছে। প্রকোষ্ঠের একপাশে একটি সুদীর্ঘ দীপদণ্ডের উপরে একটি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বলছে। দীপপ্রভায় স্বল্প-আভায়িত পর্যঙ্কের উপর উপাধানে ভর দিয়ে একজন সদ্যোযুবতী নারী অর্ধশায়িতা। যুবতীর অঙ্গে বিষণ্ণ সন্ধ্যাকাশের মতন একটি রক্তাভ দুকূল।

(উনিশ) কবিতা

মাধবী কিছুটা অন্যমনস্ক অবস্থায় পর্যঙ্কে শায়িত ছিল। প্রথমে সে দেখেও দেখছিল না। কিন্তু সম্মুখে দণ্ডায়মান ব্যক্তির গলদেশে শ্যামপর্ণী মালাটি চোখে পড়ামাত্রই ধড়মড় করে পর্যঙ্ক থেকে উঠে দাঁড়াল। তার কবরীপুঞ্জ অর্ধেক খুলে পড়ল। মালতিমালাটি স্বস্থানচ্যুত হল। কিন্তু সে সেদিকে মনোযোগ দিতে পারল না তখনই। সম্মুখে আনত হয়ে অভিবাদন জানিয়ে মাধবী বলল, ‘আমার অনবধানজনিত কৃতাপরাধ ক্ষমা করবেন, ভদ্রমুখ । কাল রাত্রের অনুষ্ঠানজনিত পরিশ্রমে আমি ক্লান্ত, অবসন্ন ছিলাম। তাই আপনার উপস্থিতি ক্ষণিকের জন্য টের পাইনি। এখন থেকে আমার সর্বস্ব আপনিই। দয়া করে আসন গ্রহণ করুন।’

কক্ষের এখানে-ওখানে কতগুলি সুসজ্জিত উচ্চাসন আছে। কোভালন তারই একটিতে যন্ত্রচালিতবৎ বসল। কিন্তু তার দৃষ্টি মাধবীর থেকে সহজে অপসৃত হল না। এই নারী এখনও পূর্ণগঠিতা যুবতী হয়ে ওঠেনি, তথাপি সে এখনই উদ্ভিন্নযৌবনা । মাধবীকে দেখে অধীত সাহিত্যের প্রথাগত উপমাগুলি কোভালনের মনে একে একে উদিত হচ্ছিল। বসন্তরাত্রির প্রিয় অন্ধকারের মতন আলুলায়িত কুন্তল, নিশীথ সমুদ্রের মতন রহস্যময় দুটি কৃষ্ণ নয়ন, কমনীয় শিরীষপুষ্পের মতন নাসা, নাগচম্পার মতন আরক্ত গণ্ডযুগ, প্রশস্ত মরালগ্রীবা, উদ্যতা ফণিনীর ন্যায় দুটি ভুজলতা, বিকচমান পদ্মকোরকের মতন উন্মেষশীল স্তনযুগ্ম, স্রোতের ন্যায় বিপদসংকুল ঘূর্ণমান নাভি, মন্দিরের ভাস্কর্যের ন্যায় ত্রিবলী ও রোমলতা, মাদুরার প্রস্তরকলসের মতন বিপুল গম্ভীর শ্রোণীদেশ—এ সবই মনে আসছিল কোভালনের। কিন্তু এ সমস্ত উপমার একটিকেও এই নারীর সৌন্দর্য বর্ণনায় উপযুক্ত বলে মনে হচ্ছিল না তার। এসব উপমা কেমন যেন বানানো, কৃত্রিম, অতিরিক্ত। পূর্বজ সমস্ত অলংকারপ্রিয় কবিদের এ মুহূর্তে কামাচ্ছন্ন জরাব বলে মনে হচ্ছিল। নারীশরীরের একটি একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে প্রকৃতির এক-একটি ভাবহীন বস্তুর সঙ্গে তুলনা করলে কি সুবিচার করা হবে এই চিন্ময়ীর সমগ্রতার? ও কি সৌন্দর্যের বর্ণনা, নাকি সৌন্দর্যের ব্যবচ্ছেদ? কোভালনের বরং মনে হচ্ছিল, এই অষ্টাদশী নারীর

চিৎচুম্বিত শরীরের মধ্য দিয়ে যেন অনেকটা নির্মুক্তির আকাশ ধরা পড়েছে। বর্ণনাসম্ভব রূপের অতীত কোনো প্রদেশ থেকে বোধ, বুদ্ধি, প্রতিভা ও মর্যাদার দীপ্তি যেন সদ্যোযুবতী মেয়েটির কপাল আলো করে রেখেছে। সাময়িক জড়তা কাটিয়ে সে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল প্রায়ান্ধকার ঘরে, ‘আমি কোভালন–বণিক মাশাত্তুবানের পুত্র। আপনিই কি সেই মাধবী, যে একদিন কবিতা লিখত ? ”

কোভালনের স্মৃতিনিবিষ্ট কণ্ঠস্বরে কী যেন ছিল! শব্দচয়নে ভুল হল কি তার? মাধবীকে ‘আপনি’বলে সম্বোধন করেও ক্রিয়াপদে ‘লিখত’বলল কেন সে? আসলে তার মন এ মুহূর্তে দ্বিধাগ্রস্ত, দোলাচলিত। সম্বোধন করার সময়ে সে বর্তমান কালের যুবতী নারীকে দেখছে, আর বাক্যের অবশিষ্ট অংশ বলতে বলতে সুদূর অতীতের এক হারিয়ে যাওয়া অনুজন্মা কিশোরীর কাছে ফিরে যাচ্ছে।

মাধবী সম্মুখবর্তী কোভালনের আত্মবিস্মৃত রূপ দেখছিল। মনে মনে পাগল হচ্ছিল সেও। সম্মুখে কোনো শালপ্রাংশু মহাভুজ পুরুষকেই শুধু সে দেখছিল না। আশঙ্কা করেছিল, রাজনটীকে ক্রয় করে বিত্তগর্বে স্ফীত কোনো স্থূলরুচির শ্রেষ্ঠী তার স্বত্বাধিকারীরূপে এ গৃহে প্রবেশ করবেন। কিন্তু এ যে বিষ্ণুর মতন লীলায়িত অথচ শিবের মতন অন্তৰ্নিবিষ্ট এক মানুষ! এর চোখদুটিতে যেন উদাসীন মেঘলোকের কল্পবাস্তবতা, ঈষৎ উন্মোচিত শিশুসুলভ ওষ্ঠাধরে যেন মূর্তিমান অনঙ্গ আবদার, করপুট ও অঙ্গুলিগুলি কেমন সুচারু সরল—যেন কেবল কবিতা লিখবার জন্যেই এরা নির্মিত হয়েছে। অস্পষ্ট দীপালোকে কোভালনের দেহরেখা আভাসিত হচ্ছিল মাত্র—মনে হচ্ছিল, এই মানুষ যেন পুরোপুরি বাস্তব নয়, সে যেন দূরকালের অনেকখানি কল্পনা—অথবা হয়তো সে শুধু সময়ের একটি নিরবয়ব আধার, আর কিছু নয় ।

মাধবী দ্বিধাজড়িত স্বরে উত্তর দিল, ‘কবিতা তো আমি লিখি এখনও । আপনি কি আমার কবিতা আগে কখনও পড়েছেন?

স্মৃতির ভিতর হারিয়ে যেতে যেতে আপনমনে বলতে লাগল কোভালন : ‘চোখের পাতার মতো নিমীলিত ওইখানে জেলেদের ঘর— সমুদ্রতীরের রোদে শুষ্ক যেথা হয় রোজ জালের পিঞ্জর। লবণাক্ত ঢেউ ভাঙে আলোড়িত বালুকাবেলায়, ওইখানে মৃত্যু এসে বসে আছে যুবতীর রূপে আজ দু-পহরে ভরা অবেলায় চাহনিতে শায়কের তীক্ষ্ণ সুচীমুখ—হাতে তবু বরণের স্নিগ্ধ ফুলমালা ? সাগরসন্তান যত মীনশিশু, তাহাদের মৃত শব পণ্য করে মীনাক্ষী এ বালা? চারিদিকে মৃত্যুঘ্রাণ, জানতাম যদি এই মৃত্যুজনিতাকে— বৈদেশী বণিক আমি কেন আসা এ বিভূমে? বেলাভূমি পদচিহ্ন কার ধরে রাখে?’

শুনতে শুনতে অনেক দুরের কোনো কালপর্বে যেন হারিয়ে যেতে লাগল মাধবী। কুয়াশা সরিয়ে উন্মুক্ত ক্ষেত্রের উপর ভোরের সূর্য উঠে এলে যেমন দূর দিগন্তের নিসর্গদৃশ্য ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই কবেকার কোন হারিয়ে যাওয়া কৈশোরের স্মৃতি এ মুহূর্তে মাধবীর মনে ভেসে উঠল। কবিতাটি তারই লেখা, কিন্তু সে কতকাল আগে লিখেছিল যে! কোভালনের দিকে চেয়ে থেকে থেকে আত্ম-আচ্ছন্ন স্বরে বলে উঠল মাধবী, ‘ওহ্, এ কবিতাটার কথা তো আমি ভুলেই গেছিলাম! কবেকার প্রণীত! আপনি যখন আবৃত্তি আরম্ভ করেছিলেন, তখন একে চিনতেও পারিনি। তারপরে শেষ চরণে এসে বুঝতে পারলাম—আমারই লেখা।’ বলতে বলতে মাধবীর মুখে-চোখে লজ্জার আভাস দেখা দিল। বলল, “কী অপরিণত ছিলাম তখন! কত অপরিণত কবিতা! এমনকি শব্দের বিজ্ঞান পর্যন্ত তখনও ভালোমতো আয়ত্ত হয়নি।’

কোভালন বলল, ‘কেন? কেন এমন মনে হচ্ছে আপনার? আমার তো এখনও বেশ পরিণতই মনে হচ্ছে একে। কেমন প্রাতিস্বিকতার আলো ছড়িয়ে আছে এ কবিতার শরীরে!’

‘মনে হচ্ছে একটি বিশেষ কারণেই। এ কবিতায় একটি চিত্রকল্প আছে। সমুদ্রতীরে কোনো মৎস্যজীবী কন্যার চিত্রকল্প। সেই মেয়েটি মাছ বিক্রয় করছে। মাছগুলি মৃত। মেয়েটির হাতে বরণমালা—সে যেন কাকে সপ্রেমে বরণ করে নেবে বলে অপেক্ষা করছে। এই মৎস্যজীবী মেয়েটিকে আমি মৃত্যুর রূপ বলে চিন্তা করেছি। সে এক অমোঘ অবধারিত পরিণাম, অথচ তীব্র তার আকর্ষণ। জীবন থেকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে যায় সে। ভালো কথা । কিন্তু একেবারে শেষের দিকে একটি শব্দ—’মৃত্যুজনিতা’। ‘জানতাম যদি এই মৃত্যুজনিতাকে’। “মৃত্যুজনিতা’ মানে যে মৃত্যুকে জন্ম দেয়। যার থেকে মৃত্যু আরম্ভ হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, ‘মৃত্যুজনিতা’ পুংলিঙ্গবাচক শব্দ, যার স্ত্রীলিঙ্গে হবে ‘মৃত্যুজনিত্রী’। অথচ এর আগে মৃত্যুকে এক যুবতী স্ত্রীলোক বলে কল্পনা করেছি। এই তো ভুল হয়েছে!”

কোভালন বলল, ‘এটা কিন্তু একান্তই ব্যাকরণের সমস্যা। মূল শব্দ—’জনিতৃ’। তার পুংলিঙ্গে ‘জনিতা’, স্ত্রীলিঙ্গে ‘জনিত্রী’। আপনি আগে একটি কন্যার কথা বলেছেন। পরে পুংলিঙ্গবাচক ‘জনিতা’ ব্যবহার করেছেন বলে একে ভুল বলছেন। কিন্তু কবিতায় ‘মৃত্যুজনিতাকে’শব্দটি এমন যথাযথভাবে বসেছে যে, তার জায়গায় অন্য কোনো শব্দ বসানোর কথা ভাবতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রকৃত কাব্যরসিক একে ভুল না বলে আর্যপ্রয়োগই বলবেন।’

মাধবী হেসে উঠে বলল, ‘আপনি উদারপ্রকৃতির পাঠক, তাই ক্ষমাসুন্দর চোখে একে দেখছেন।’

মাধবীর হাসিতে কোভালনও যোগ দিল। তারপর বলল, “না, আমি সত্যিই বলছি, মাধবী। বৃথা প্রশংসা করছি না। একে যদি ভুল বলাও হয়, তা হলেও ওই ভুলটুকুকে বাদ দিলে এ কবিতা কিন্তু নিটোল, ত্রুটিশূন্য। এতে এমন একটা দার্শনিক চিন্তা ধরা পড়েছে, যাকে প্রথাগত কোনো চিন্তার ছকে আঁটানো যাবে না। ভীষণ সমুদ্রতীরে এক মৎস্যজীবী

কন্যা রৌদ্রাক্ত দ্বিপ্রহরে মরা মাছ বিক্রয় করছে। তার উপস্থিতির মধ্যেই এক আকর্ষক বৈপরীত্য। দৃষ্টিতে তার তীক্ষ্ণ তিরের মতো ধার, অথচ তার হাতে স্নিগ্ধ বরণমালা । যেন জীবন আর মৃত্যুকে সে তার নিজ-অবয়বে একই সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছে। তাকে ভালোমতো না জেনেই মানুষ ভালোবেসে ফেলে। যেমন জীবনকে ভালোবাসি আমরা। জানি না, জীবন আসলে মৃত্যুরই অন্য রূপ। জীবন-মৃত্যু একই ধাতুমুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। যখন জানতে পারি এই কন্যার স্বরূপ, এই জীবনের রহস্য, তখন মনে আক্ষেপ আসে, কেন এলাম আমি জীবনের বালুকাবেলায়! এখানে আমি তো আমি, আমার পদচিহ্নটুকুও ধুয়ে মুছে যাবে সময়ের সাথে সাথে। কী অর্থহীন আমাদের অস্তিত্ব! আমি শুধু ভাবি, অত অল্প বয়সে কবিতার এই ভাব আপনি কোথা থেকে পেলেন ?”

কোভালনের ব্যাখ্যা শুনছিল মুগ্ধ চিত্তে মাধবী। ভাবছিল, কী গভীরে ডুব দিয়ে তার কবিতাকে বুঝতে চেয়েছে এই যুবক। কিন্তু কোভালনের শেষ প্রশ্নে মুগ্ধতার আবেশ ভেঙে সে জেগে উঠল। উত্তর দিল, ‘আসলে কীভাবে যে পেয়েছিলাম এই ভাব, তা এখন আর বলতে পারি না। হয়তো আমার মায়ের কাছ থেকে। যিনি আমাকে লালন-পালন করেছিলেন। নটী ইন্দুমুখী। তিনিই আমাকে বলতেন, জীবন আসলে মৃত্যুরই অপর রূপ। আমাদের এই শরীর—এ আসলে একটা বিশীর্ণ কঞ্চুক। একটা ক্ষয়িষ্ণু খোলস, যা অবশেষে পরিত্যাগ করতেই হয়। একে টিকিয়ে রাখা যায় না কোনোমতেই। মায়ের কাছ থেকে এসব শুনে শুনে হয়তো ওই ভাব মনে এসেছিল। আর অমন একটা দৃশ্য প্রায়ই তো দেখা যায় এখানে সমুদ্রতীরে। মৎস্যজীবী মেয়েদের মরা মাছ বিক্রি করতে দেখা যায় দ্বিপ্রহরে। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার বেশ তন্বী, সুন্দরী। ওই দৃশ্য, ওই ভাব…ওই সব মিলেমিশে হয়তো এই কবিতার রূপ নিয়েছিল আমার কিশোরী মনে। … কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা।’

‘কী? ‘

ভাবছি, আপনি কীভাবে এ কবিতাটি পেয়েছিলেন? আর কেনই-বা এতদিন ধরে একে মনে রাখলেন?’

‘কীভাবে হাতে এসে পৌঁছেছিল, তা এখন আর বলতে পারি না। আমরা কবিতাপাগল কয়েকজন তরুণ—আমাদের একটি দল ছিল। আমাদের মধ্যে এই কবিতা, আরও অনেক কবিতার সঙ্গে, এসে পড়েছিল হঠাৎই। হয়তো আপনার মায়ের কোনো অনুরাগী একে এই গৃহের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেভাবেই হয়তো হবে। কেন এতদিন পরে কবিতাটি আমার আজও মনে আছে, তারও নির্দিষ্ট কারণ বলতে পারব না। হয়তো কবিতাটির অনন্যতা আমার মনকে অধিকার করে রেখেছে এতদিন। হয়তো আপনার সঙ্গে একদিন আমার দেখা হবে, তাই…’ বলতে বলতে চোখ তুলে মাধবীর দিকে এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল কোভালন। মাধবী মুখ নামিয়ে নিল। তার মুখ লজ্জায় অরুণবর্ণ হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে বসে আছে। কোনো কথা নেই। যেন একটা ভালোলাগার

হাওয়া মৃদুলবেগে বইছে এ ঘরে। দুজনের মনের মধ্যেই সে-সুবাতাস ঢুকে পড়ছিল, দুজনের মনের মধ্যেই জমে থাকা অনেক দিন আগের অনেক সুকুমার অনুভূতি তার সুখস্পর্শ পেয়ে ধীরে ধীরে জেগে উঠছিল। কোভালনের মনে হচ্ছিল, কতদিন এমন সুন্দর সব কথা সে শোনেনি। বলেনি। কে এই মেয়েটি, আজ সকালবেলা কোথা থেকে এল! কতদিন এমন একটি মেধাবিনী মেয়েকে সে কবিতা পড়ে শোনায়নি। নিজের কণ্ঠস্বরই নিজের কাছে আজ ভালো লাগছিল কোভালনের। ভালো লাগছিল এই ঘর, গৃহসজ্জা, এর অলংকৃত দেওয়ালগুলি, দীপাধারে জ্বলমান ঘিয়ের প্রদীপ। মেয়েটি কেমন পর্যঙ্কের উপর তার পা দুটি পাহাড়চূড়ার মতো সম্মুখে গুটিয়ে এনে হাঁটুতে মুখ রেখে আলগোছে বসে আছে। তার দৃষ্টি দীপাধারের দিকে ফেরানো, কৃষ্ণপক্ষ্মসমন্বিত ডাগর ডাগর চোখ দুটিতে স্পন্দমান আলোর আভা এসে পড়ছে। কেশসজ্জার শৃঙ্খলা অমান্য করে চূর্ণ কুন্তলগুচ্ছ মেয়েটির অপরিসর কপালের উপর এসে পড়ে কাঁপছে । কী যেন ভাবছে সে গাঢ়ভাবে–হয়তো তার ফেলে আসা কিশোরীবেলার কথা, হয়তো তার মা ইন্দুমুখীর কথা, হয়তো তার স্বপ্ন, ভয়, সাধ, সুষমার কথা মেয়েটির অন্যমনস্কতার পরিসরের ভিতর বিচ্ছিন্ন ভ্রমরের মতো উড়ে আসছে, ফিরে যাচ্ছে ক্রমাগত৷

কোভালনের মনে হল, কী এক হা-ক্লান্ত গার্হস্থ্য আর বাণিজ্যকেন্দ্রিক দিনযাপনের মধ্যে যে সে পড়ে গিয়েছে কতদিন! কোথাও দুটো অন্য কথা কইবার মানুষ নেই, অন্যরকমভাবে চিন্তা করার, কল্পনা করার উপাদান নেই তার কোনোদিকে! কোথাও সহৃদয়তা, সমমর্মিতা নেই একটুও! সমস্তই একান্তনীরস, যান্ত্রিক, প্রয়োজনমাফিক। সেসব প্রয়োজনীয় কাজের পৃথিবীতে এ কোন অকাজের মুক্তি নিয়ে এল মাধবী আজ প্রভাতবেলায়?

এরই মধ্যে জনৈক পরিচারিকা পানপাত্রাদি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করল। কোভালন ও মাধবীকে পানীয় ও অনুপান পরিবেশন করল সে। এই পরিচারিকা অবশ্য পূর্বদৃষ্ট ঊষসী নয়। এ অন্য মেয়ে।

কোভালন আধোমনস্কভাবে সুরাপান করছিল। হঠাৎ চমক ভাঙল মাধবীর কথায়। ওইভাবে হাঁটুর উপর মুখ রেখে বসে থেকে থেকে নিজের মনেই মাধবী বলে উঠল, ‘আমাদের কেন আগে দেখা হল না যে? কেন এভাবে, এ অবস্থায় দেখা হতে হল? …

কথাটা বলেই সতর্ক হয়ে উঠল মাধবী। আগের সেই অগোছালো ভঙ্গিমা ছেড়ে পর্যঙ্কের উপর সংযত হয়ে উঠে বসল সে। হাসিমুখে কোভালনের দিকে চেয়ে বলল, “কী যে সব বলছি অর্থহীন কথা? আগে কী করে দেখা হবে আমাদের? এইভাবেই তো দেখা হওয়ার কথা। এভাবেই তো দেখা হওয়া বিধিনির্দিষ্ট!”

কোভালনের কিন্তু ভালো লাগল না মাধবীর সহসা এই সচেতন হয়ে-ওঠা। বরং একটু আগে সে যে অসতর্ক, অসচেতন হয়ে বসেছিল, সেটাই বেশি ভালো লাগছিল কোভালনের। আরও কিছুক্ষণ মেয়েটিকে অমন অসতর্ক অবস্থাতেই দেখতে চাইছিল কোভালনের মন। কিন্তু সেই মুহূর্তটি অতর্কিতে চলে গেল। আর কখনও আসবে না।

এখন চেষ্টা করেও মাধবীকে আর আগের সেই অসতর্ক মুহূর্তে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না কোনোমতেই। যে-মুহূর্ত চলে যায়, কোথায় যে যায়, কেন যে আর ফিরে আসে না, কে জানে!

কোভালন বলল, ‘বিধিনির্দিষ্ট কি না, তা জানি না। বিধির নির্দেশ কী, আমি তা বুঝিও না। এককালে সেসব নিয়ে ভাবতাম অনেক। এখন আর ভাবি না। তবু একটা কথা জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।’

‘কী?’

‘গতকাল রাজনটী পদে অভিষিক্ত হওয়ার পরে আজ সকালেই ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিক্রয় করতে ইচ্ছে হল কেন?’

মাধবীর মুখ বাস্তবতার স্পর্শে কঠিন হয়ে উঠল এক লহমায়। পরমুহূর্তেই আবার সহজ স্বাভাবিক হয়ে গেল সে। তবু গম্ভীর স্বরে বলল, ‘সেটা যে কোনো মানসিক চপলতা থেকে নয়, তা নিশ্চয়ই আপনি বোঝেন। সে এক কঠিন সমস্যার সহজ বাস্তবমুখী সমাধান মাত্র।’

‘সমস্যাটা কী আর তার সমাধানটাই-বা কী, সেটাই তো বুঝতে চাইছি,’ কোভালন আন্তরিক স্বরে জানতে চাইল।

মাধবীর ভ্রূলতা ঈষৎ কুঞ্চিত হল। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সম্বত করে নিল। নিরাবেগ সহজ স্বরে বলতে লাগল, ‘আপনি তো জানেন, এ বারাঙ্গনাপল্লী ৷ আমি এই পরিবেশেই জন্মেছি। আমার পিতৃমাতৃপরিচয় নেই। অলীক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে আমার জন্মকথা নিয়ে। এ পল্লীতে আমরা পালিকা মায়ের পরিচয়েই বড়ো হয়ে উঠি। যেমন আমি বড়ো হয়েছি আমার পালিকা মা ইন্দুমুখীর পরিচয়ে। বারাঙ্গনাবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনো বৃত্তি অবলম্বন করার উপায় নেই এ পল্লীর মেয়েদের। আমার জন্যেও এ নিয়মের কোনো ব্যতিক্রম হবে না। এতদিন আমাকে কেউ জানত না। কিন্তু কাল রাত্রে আমি রাজনর্তকী হওয়ার পরে সর্বসাধারণের চোখে আমি এখন উন্মুক্ত।’

এই পর্যন্ত বলে একটু থামল মাধবী। পানপাত্র তুলে নিল হাতে। সামান্য পান করে পাত্রটি নামিয়ে রাখল উপবৃত্তাকার আধারের উপর। কোভালন বুঝতে পারছিল, এখন কথা বলা সঙ্গত হবে না। মাধবী যতই স্বাভাবিক স্বরে কথা বলুক না কেন, ভিতরে ভিতরে সে এখন নিজেকে প্রাণপণে সংযত করারই চেষ্টা করছে।

খানিক বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় মাধবী বলতে লাগল, ‘রাজনটী হিসেবে রাজকো থেকে যে-পারিতোষিক আমি পাব, তা নিয়মিতও নয়, আর পর্যাপ্তও নয় । রাজনটী, সভাকবি, বিদূষক—এসব পদের তেমন স্থিরতাও থাকে না। সমস্তই রাজার ইচ্ছাধীন। আগামীকাল যদি আমার চেয়ে সুন্দরী, আমার থেকেও সুদক্ষা কোনো নর্তকীর সন্ধান পাওয়া যায়, তখন আমাকে সরিয়ে তাকেই রাজনটী পদে নিয়োগ করবেন রাজা কারিক্কাল। এমতাবস্থায় রাজনর্তকী হিসেবে রাজসভায় আনন্দদানের পাশাপাশি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে দুটি মাত্র স্থায়ী পথ আমার সামনে খোলা আছে। হয়—বারাঙ্গনাবৃত্তি গ্রহণ করা। নয়তো—কোনো ধনী ব্যক্তির রক্ষিতা হয়ে থাকা। দ্বিতীয়টিতে নিরাপত্তা আছে, শিল্পসাধনার যথার্থ সুযোগ ও অবসর আছে। যিনি আমার অধিকারী হবেন, তিনি আমার নিয়ন্ত্রকও হবেন অবশ্য। তা হলেও আমাকে দিনের পর দিন বহুপভুক্ত হয়ে অন্তত বেঁচে থাকতে হবে না। একজনকে সন্তুষ্ট করে অবশিষ্ট সময় আমি শিল্পসাধনায় দিতে পারব। তাই না ?’

মাধবীর কথাগুলি কোভালন নিবিষ্ট চিত্তে শুনছিল। শুনছিল আর ভাবছিল। একটু আগের সেই মাধবী এ নয়। আগের সেই ভাবাবগাহিতা সরে গিয়ে এ মুহূর্তে মাধবীর মধ্যে এক সংগ্রামী মেয়ের কণ্ঠস্বর বেজে উঠছে। বাস্তব পরিস্থিতি কী কঠিন এই মেয়েটির জীবনে! কিন্তু সেই কঠিন পরিস্থিতিতে বিচলিত না হয়ে স্থিরবুদ্ধিতে সে এর একটা কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করেছে। একই সঙ্গে শিল্পীর ভাবতন্ময়তা ও প্রয়োজনে কর্মীর বাস্তববোধ—এ দুয়ের সমন্বয়ে গঠিত এই নারী কেন যে বারাঙ্গনাপল্লীতে জন্ম নিল? মাধবী কেন সহজ পরিবেশে জন্ম নিল না? ওহ্! কেন মাধবী যে কন্নকী হল না, আহা, যদি হত—এই সব আকাশপাতাল ভাবছিল কোভালন।

হঠাৎ মাধবীর হাসির শব্দে কোভালনের সে-চিন্তাস্রোত বাধা পেল। মুখ তুলে দেখল, মাধবী আপনমনে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ছে পর্যঙ্কের ওপর। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে মুখ তুলে তাকাল কোভালন। মাধবী হাসি থামিয়ে তরল স্বরে বলল, ‘আমি অবশ্য ভাবিনি যে, আপনি… মানে আপনার মতো কেউ আমাকে ক্রয় করে নেবেন?’

মাধবীর হাসিতে যোগ দিয়ে কোভালন প্রশ্ন করল, ‘তাহলে কী ভেবেছিলে?’

হাস্য-পরিহাসের স্পর্শে মুগ্ধ কোভালন কখন যেন অজান্তেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’-তে নেমে এসেছে।

‘ভেবেছিলাম… চিনাংশুক আর গজমুক্তার মালা পরিহিত স্থূলাকার কোনো মধ্যবয়স্ক শ্রেষ্ঠী উদর দুলিয়ে এ কক্ষে প্রবেশ করবে…. বলবে, মাধবী! অয়ি সুন্দরী! আজ থেকে তুমি শুধু আমার, তুমি আমার…’ বলতে বলতে সেই কল্পিত স্থূলোদর শ্রেষ্ঠীর কণ্ঠস্বর ও ভঙ্গিমা নকল করতে করতে হা-হা করে হাসতে হাসতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল মাধবী।

তারপরে আবার পর্যঙ্কে উঠে বসে হাস্যবেগ সামান্য প্রশমিত করে বলল, ‘অথবা… অথবা কোনো মিশরীয় দস্যু… অথবা উদ্ধত ধনগর্বী কোনো রোমক বণিক… অথবা কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের মতন বিরাট আকৃতির কোনো এক মূর… হি হি হি ! কী যে হত তাহলে? কী ভাষায় যে তারা কথা বলত… ইয়নহো চিয়ানহো… সুবিশাস ফিবিশাস…দেদ্রোফেম উদদ্রোক্লিত… হা হা হা! কিছুই বুঝতাম না। ঊষসীকে সাজিয়ে-গুজিয়ে এনে বলতাম, ভদ্রমুখ ! এই হচ্ছে আপনার মাধবী নর্তকী। নিন, একে উপভোগ করুন । এসব অদ্ভুত লোকদের কীভাবে যে সামলাত ঊষসী তখন…

আবার সে হাসতে হাসতে পর্যঙ্কে গড়িয়ে পড়ছে। কোভালনও খুব হাসছিল মাধবীর রঙ্গব্যঙ্গ, হাস্যকৌতুক দেখে আর মিশরীয়, রোমক বা মূরদেশীয়দের ভাষার অর্থহীন

অনুকৃতি শুনে। এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্যা কোভালন কখনও কোনো নারীর মধ্যে দেখেনি । মাধবী কিন্তু চকিতেই নিজেকে সামলে নিল। বোধহয় বুঝল, এভাবে বলা তার ঠিক হয়নি প্রায়-অপরিচিত কোভালনের সম্মুখে। অনেক আগেই সে শালীনতার মাত্রা অতিক্রম করেছে। ছি-ছি! কোভালন কী জানি ভাবছে তার সম্পর্কে! হাসিতে রাশ টেনে গম্ভীর হয়ে বলল, ‘ক্ষমা করবেন, ভদ্রমুখ ! অধীনার এই অপরিশীলিত আচরণ মার্জনা করবেন। ইশ্, কত বেলা হয়ে গিয়েছে, আপনার মাধ্যাহ্নিক ভোজনের এখনও ব্যবস্থা করা হয়নি । আপনি অন্তঃপ্রকোষ্ঠে এসে খানিক বিশ্রাম করুন। আমি এক্ষুনি একবার….’

কোভালন দ্রুত উত্তর দিল, ‘না-না, তুমি ব্যস্ত হয়ো না। আমি তো আমাদের বিপণিতে ফিরে যাব। মধ্যাহ্নবেলায় আমার স্ত্রী পরিচারকের হাতে আহার্য পাঠাবেন। আমি আবার অন্য কোনোদিন আসব এখানে।’

মাধবী বলল, ‘তাও কি হয়, ভদ্রমুখ ? আজই তো আপনি প্রথম এলেন। এ হর্ম্য, এ গেহ—এই সবই তো এখন থেকে আপনার। আর আমিও তো…’ বলতে গিয়ে লজ্জাবশত কথা আটকাল মাধবীর। তাড়াতাড়ি কথা ঘুরিয়ে নিয়ে সে বলে উঠল, ‘বলছিলাম, পত্নীপ্রেরিত মধ্যাহ্নভোজ—সে তো রোজই আহার করেন। আজ না হয় এখানেই….আমার দ্বারা রন্ধিত আহার্যগ্রহণে যদি আপনার তেমন আপত্তি না থাকে—’

কোভালন ত্বরিতে বলল, ‘না না, আপত্তি কীসের? এভাবে বলছ কেন তুমি, মাধবী ?’

‘বেশ। তবে আপনি ভিতরের ঘরে বসে দুই দণ্ড বিশ্রাম করবেন চলুন। আমি আপনার মধ্যাহ্নভোজন নিয়ে এখনই আসছি। আপনার আহার সমাধা হলে আমরা আবার কবিতা পড়ব। দেখি, আপনার লেখা কোনো কবিতাকে সুরলগ্ন করা যায় কি না, তারই প্রচেষ্টা করব আমি ।

কোভালন হাসতে হাসতে উত্তর দিল, ‘আমি সম্মত আছি। কিন্তু এক শর্তে।’

মাধবী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী?’

‘তোমাকেও তাহলে আমারই সঙ্গে আহার করতে হবে।’

মাধবী স্মিত হেসে কোভালনের সে ইচ্ছায় সম্মতি জানিয়ে উঠে দাঁড়াল। আসন থেকে

উঠে দাঁড়াল কোভালনও। তাকে অন্তঃপুরের দিকে সযত্নে নিয়ে যেতে লাগল মাধবী। মাধবীর স্পর্শে কোভালন ভুলে গেল, তার বিপণিতে এখন ব্যাপারীরা তার অপেক্ষায় আছে। ভুলে গেল, এতক্ষণে হয়তো বিপণিতে তার জন্য গৃহপরিচারকটি মাধ্যাহ্নিক ভোজন নিয়ে এসে বসে আছে। ভুলে গেল, দিনান্তে তারই প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় দুটি ক্লান্ত চোখ মেলে বসে থাকবে তার স্ত্রী কন্নকী; যাকে নিয়ে সে একদিন কবিতা লিখত। আলো-ছায়ার সন্নিপাতের ভিতর কোভালন ও মাধবী দুজনে দুজনের হাতে হাত রেখে অন্তঃপুরের দিকে অগ্রসর হল।

তাদের বিলীয়মান ছায়াদুটির দিকে অপাঙ্গ-দৃষ্টিতে চেয়ে ইলাঙ্গো আডিগল শুধু একবার একটু মুচকি হাসলেন।

(কুড়ি) বিরহিণী

সেদিনের সেই ঘটনার পরে আরও কতিপয় প্রভাত-প্রদোষ, মধ্যদিন-মধ্যনিশীথ, দিবাভুক রাত্রি ও রাত্রিভুক দিবস অতীত হয়ে গেল। বহুস্রোতা কাবেরীর বিপুল জলরাশি উপনীত হল সমুদ্রে। তাপদগ্ধ নিদাঘ গেল, নদীনীরবিন্দুসিঞ্চিত প্রাবৃটের অতিবর্ষী মৌসুমী অম্বুবাহ এল তারই পাছে পাছে। প্রকৃতির নিয়ম স্বতোৎসারিত, স্বতশ্চল—তাই সে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় নেই। কিন্তু নিজের স্বভাব অতিক্রম করে স্বাভিমানী মানুষ সময়ে সময়ে যে-নিয়ম বানায়, যে-নিয়মের নিগড়ে সে নিজেকে জোর করে বাঁধতে চায়—তা কৃত্রিম, আরোপিতও স্বভাববিরোধী হওয়ায় সামান্য প্রলোভনের অবঘাতে অমন পলকা নিয়ম চৈনিক পুষ্পপাত্রের মতো এক লহমায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। কোভালনের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হল। কন্নকীর প্রখর বাস্তবতার সামনে তার কল্পভুবন বারবার পরাহত হওয়াতে অভিমানাহত কোভালন কবিতাকে বিদায় জানিয়ে, নিজের স্বভাবকে অতিক্রম করে আরোপিত নিয়মের নিগড়ে নিজেকে বেঁধে সুসামাজিক বাণিজ্যজীবী হয়ে উঠতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই চেষ্টামাত্রই সার—ঘষেমেজে রূপ আর ধরেবেঁধে সম্প্রীতি—যেমন সম্ভব নয়, তেমনই এবম্বিধ নিয়মের নিগড়ে কোভালনের প্রাণ দিনে দিনে ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। এবং সে-নিয়ম যখন ভাঙল, তখন তা এমনভাবে ভাঙল, যাতে আর জোড়া লাগানো যায় না। এখন কোভালন পূর্বাপেক্ষা আরও অধিক উচ্ছৃঙ্খল জীবনে ফিরে গেছে। ব্যবসাবাণিজ্যে তার মন একেবারেই নেই। সব দিন নিয়মিতভাবে সে বিপণিতে যায় না; প্রায়শই মাধবীগৃহে পড়ে থাকে। কোনো কোনোদিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার অনেক পরে সে নিজগৃহে ফেরে, কোনোদিন-বা রাত্রেও সে গৃহে ফেরে না, মাধবীসঙ্গেই সমস্ত রজনী অতিবাহিত করে। তারপরে প্রভাতে যখন গৃহে প্রত্যাবৃত হয়, তখন তার কেশপাশ উদ্ভ্রান্ত, বেশবাস অসম্ভৃত, উচ্চারণ স্খলিত, চক্ষুদ্বয় আরক্তিম… নেশাচ্ছন্ন। কোভালনের এই পরিণতির কারণ কনকীর অজ্ঞাত নয়, বিশেষত কোভালন যে নটী মাধবীকে সর্বসমক্ষে উন্মুক্ত রাজপথেই ক্রয় করেছিল—বিলম্বে হলেও সে-সংবাদ কন্নকী পেয়েছে।

যে-সময়ের কথা হচ্ছে, সেই খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের উপান্তে, বিত্তবান বণিকদের পক্ষে বারাঙ্গনাগমন, রক্ষিতাচয়ন ইত্যাদি অতি স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই পরিগণিত হত। কন্নকী বণিকের ঘরের মেয়ে, পণ্যজীবীদের এতাদৃশ আচরণ সে বাল্যাবধি জেনে আসছে। কিন্তু অপরাপর ব্যক্তির আচরণ-সম্পর্কিত তথ্য জেনে রাখা আর নিজ জীবনে সেই একই ঘটনা বাস্তবায়িত হওয়ার মধ্যে সুবিপুল সাংবেদনিক পার্থক্য আছে। অপরের গৃহস্থলী দস্যুর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, একথা জানা একরকম। আর নিজের গৃহাবাস দস্যু-আক্রান্ত হওয়া—সে অন্যরকম অভিজ্ঞতা। প্রথমটি পরোক্ষ, দ্বিতীয়টি প্রত্যক্ষ। পরোক্ষ জ্ঞানের দ্বারা প্রত্যক্ষ দুঃখ কিছুমাত্র কমে না, সামান্য সান্ত্বনা হয়তো-বা মিললে ও মিলতে পারে ।

বিশেষত, কন্নকী আশা করেনি যে, কোভালনের মতন বিষয়বুদ্ধিহীন ভাবুক যুবক সহসা নটী মাধবীকে ক্রয় করে বসবে। বিবাহের পরে কোভালনকে যতটুকু মাধবী জেনেছে, তাতে তাকে কবিস্বভাব, প্রেমিক, কল্পনাপ্রবণ ও চিন্তাশীল বলেই তো মনে হয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে বারবার অভাগিনী কন্নকী প্রশ্ন করে, তার নিজের ন্যূনতা কোথায় ছিল? কোভালনকে সে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছে, কোভালনের ভালোবাসাকেও কখনও সে অমর্যাদা করেনি। তার মধ্যে কোন অভাব কোভালনকে মাধবী-অভিমুখে চালিত করল, বারবার সেই কথা সে ভাবে আর নিজের মন্দভাগ্যকে অন্তিমে দোষ দেয় ৷ আসলে এ এমন একটা সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যা বুঝে উঠতে পারে না অল্পবয়েসি সরলা মেয়েটি। কোভালনকে তার সাম্প্রতিক অনিয়ম, ব্যবসাকর্মে ঔদাসীন্য, গৃহে ও বিপণিতে তার প্রায়শই অনুপস্থিতি প্রভৃতির কারণ কী—সেসব বিষয়ে কয়েকবার প্রশ্ন করেও দেখেছে কন্নকী। কিন্তু কন্নকীর প্রশ্নগুলোকে কোভালন নানাভাবে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এই যে কোভালন কন্নকীকে মাধবীর কথা বলছে না, এই যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট একটা ব্যাপারকে কোভালন গোপন করে যাচ্ছে, এটাই কন্নকীর কাছে সর্বাধিক অপমানজনক মনে হচ্ছে। প্রণয় কি তবে পালকের মতো লঘুভার, যা সামান্য ঘূর্ণি বাতাসে উড়ে চলে যায়? বিশ্বাস কি তবে তাপিত চৈত্রের বিবর্ণ পাতা, অপরাহ্ণের উদাসীন বাতাসে যা স্খলিত হয়ে যায় বৃক্ষশাখা থেকে? যৌবন কি তবে বসন্তের অন্তিম দীর্ঘশ্বাস, গ্রীষ্মের প্রখর তাপে শুষ্ক হওয়াই যার নিয়তি? কোথায় গেল বিবাহোত্তর সেই দিনগুলির অননুভূতপূর্ব মাধুর্য? সে নিজে কি তবে কোভালনের অসম্পূর্ণ একটি কবিতার পঙ্ক্তি, যা লিখিত হওয়ার আগেই হারিয়ে গেছে… অন্ত্যমিলের অপেক্ষা না করেই… হয়তো জলের দিকে গেল… হয়তো হাওয়ার সঙ্গে মিশে পৃথিবীর ধুলাকাদা মেখে বিবর্ণ মলিন হল… বর্ষার অশ্রুবর্ষণ যাকে শীতল করতে পারল না… শুধু পুথির পাতা থেকে ধুয়ে মুছে গেল যার অবলুপ্ত অক্ষর… ?

কন্নকীর হৃদয় বেদনাভারাতুর… তার সুন্দর চরণযুগ আর সেই দুটি শিল্পিত নূপুরে শোভিত হয় না। সেই যে সুদূর কিশোরীবেলায়, ভুলে যাওয়া কোনো এক জন্মতিথিতে পিতা মানাইক্কন কন্যা কন্নকীর জন্য বাদ্য মণিকণ্ডনের বিপণি থেকে দুটি আশ্চর্য সুন্দর চরণমঞ্জীর কিনে এনে উপহার দিয়েছিলেন। জগতের লীলানাট্য থেকে মানাইক্কনও বিদায় নিয়েছেন কয়েক মাস হল। পিতার স্মৃতি, পিতার আদর তবু যেন লেগে আছে ওই নূপুর দুটির গায়ে। সে-দুটি নূপুর প্রগল্ভা সখীর মতো সারা দিনরাত কন্নকীর পায়ে পায়ে কত কথা বলে চলত, কন্নকী এখন পদপল্লব থেকে তাদের অপ্রয়োজনীয়বোধে খুলে রেখেছে। এখন তার পদপাতে বেজে ওঠে না আর কোনো প্রণয়কোমল সুর। কমনীয় কটিদেশে ক্ষৌমবস্ত্রের কাঞ্চিবন্ধন রণিত হয় না আর কিঙ্কিণীশব্দে, ক্লান্ত কুচযুগ আর আলিম্পিত হয় না চন্দনলেখায়, কর্ণপুট আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না তাড়ঙ্ক-আভরণে, কালো কাজল আর দীর্ঘায়িত করে তোলে না তার আয়ত মীনাক্ষি। এখন আর মুক্তার মতো স্বচ্ছ শ্রমজ স্বেদবিন্দুতে শোভমান হয় না চন্দ্রাননার ললাটদেশ, সীমন্তে এখন সে আর পরে না এয়োতির সিন্দুর, কেশসংস্কার করে না সে এখন আর আলস্যভরে। শুধু তার অপার্থিব রূপ নিরলংকৃত, অনাদৃত হয়ে পড়ে থাকে—যেন শব্দহীন জনবিরল কোনো শীতরাত্রির অবিগীত জ্যোৎস্নার মতন। তার উৎফুল্ল মুখের সেই হাসি, একদিন যা কোভালনকে প্রণয়জ্বরে পীড়িত করে তুলত, আজ সে-হাসি তার ওষ্ঠপুট থেকে বুঝি চিরতরে হারিয়ে গিয়েছে!

কোনো কোনো মধ্যদিন যখন অপরাহ্ণে গলে যায়, অপরাহ্ণ প্রতীক্ষায় ফুরায়, সন্ধ্যা নামে—কোভালন তবু ঘরে আসে না। কন্নকী… রুক্ষকেশা, অসাজে অসাধে বিরহশীর্ণা কন্নকী—গৃহছাদে যায়… এই সেই ছাদ, যেখানে বিবাহোত্তর প্রণয়ের দিনগুলিতে কত মধুযামিনী কোভালনের সঙ্গে কত আদরে, সোহাগে কেটেছে। আজ এই ছাদ বিবর্ণ, ধুলামলিন। আলিশাতে ঘর বেঁধেছিল যেসব কপোত-কপোতীরা, তারা সব তাদের যাবতীয় প্রণয়কূজন নিয়ে কোথায় যেন উড়ে চলে গেছে। এখন তাদের সেই কুহরগুলি রিক্ত, বিগত বর্ষার শ্যাম শৈবালে আচ্ছন্ন, স্তব্ধগীত। ছাদের প্রাচীরে ভর দিয়ে কোনোমতে কন্নকী উঠে দাঁড়ায়, আকাশের দিকে তার নিরশ্রু শুষ্ক চোখ দুটি তুলে চায় ৷ মনে হয়, গোধূলিসন্ধি এসেছে, সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম দিগন্তে, কপালে করাঘাত করে তাই সদ্যোবিধবা সমুদ্রমেখলা ধরিত্রী বিলাপ করে চলেছেন, ‘হে নাথ ! হে অপ্রতিহতপ্রতাপ দিবাকর ! কোথায় তুমি অদৃশ্য হয়ে গেলে বলো তো? তোমার সেই তেজোময় রশ্মিচক্র যা সকল ভুবনকে দীপ্তদণ্ড ধরে শাসন করে, আমি কেন তা আর এখন দেখতে পাচ্ছি না ? কোথায় আমার সেই তেজস্বী সন্তান রাজকুমার সোমদেব, সেও তো অদৃশ্য হয়ে আছে, যার কিরণলাবণ্যে এই আয়ত নভোনীলিমা প্লাবিত হয়? হায়, আমি অনাথিনী, আমার পতি নাই, পুত্র নাই, একাকিনী আমি অরক্ষিতা !

ধরিত্রীর চারিদিকে প্রসারিত চতুরাস্য বিলাপোক্তিতে মলিন হয়ে আসে, তার পুষ্পিত নয়ন আর্দ্র হয়ে যায়, তার সমস্ত শরীর ঢেকে যায় শিশিরবাষ্পে। যেন কোনো প্রবলপ্রতাপান্বিত রাজার অনুপস্থিতির সুযোগে বিদ্রোহী প্রজাদের সহযোগিতায় রাজ্যের

শিষ্ট জনসাধারণের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের মূর্তি ধরে মাথা তুলেছে কোনো সামস্তনায়ক। আর অভ্যন্তরীণ এই উপপ্লবের সুযোগ নিয়ে প্রাচীন নগরী পুষ্পহারে জয়োল্লাস তুলে সসৈন্যে প্রবেশ করছে বহিঃশত্রুর মতো প্রদোষকাল। স্বামী-পরিত্যক্তা বিরহিণী এয়োতিরা কপালে কঙ্কণ ঠুকে হা-হা শব্দে বিলাপ করছে। আর অন্যদিকে শৃঙ্গারাঢ্যা বারবধুরা গোপন প্রেমিকের সঙ্গে রতিবিহারে মত্ত হয়ে প্রবল রভসসুখে শীৎকারে গোঙায়। কোথা থেকে যেন পরিতাপকাতর সুরে গোপালকেরা বাঁশি বাজায়, সে-সুরের সঙ্গে গুঞ্জন মিলিয়ে পরাক্রমী মধুমক্ষিকারা মুল্লাই-বনাঞ্চলের পুষ্পে পুষ্পে এসে বসে, আফোটা পুষ্পকোরকের মুখ জোর করে খুলে মধু খায়। তাদের চকিত মধুস্রাবের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে পুষ্পহার নগরীর পথে পথে। তখন সমুদ্রস্পর্শী দক্ষিণা বাতাস এসে উড়িয়ে দিয়ে যায় সেই বলধৃষ্ট ‘কুরুম্বু’ মধুকর-দস্যুদের বারংবার। সন্ধ্যা নামে পুষ্পহারের পথে পথে, ঘরে ঘরে কনকবলয়ের রণিত কিঙ্কিণীশব্দে কুমারীরা জ্বালায় সন্ধ্যাপ্রদীপ ।*

তারপর চাঁদ ওঠে। কন্নকীর মনে হয়, এই চাঁদ যেন পাণ্ড্য রাজবংশের কুলপ্রদীপ কোনো বীর রাজকুমার। অল্পবয়স্ক তরুণ হওয়া সত্ত্বেও যার স্নায়ুতে স্নায়ুতে প্রবাহিত রাজ-পরাক্রম। পিতার রাজ্য দস্যু প্রদোষের দ্বারা উপদ্রুত দেখে কুমার সোমদেব শত্রুর বিরুদ্ধে কিরণ-বল্লম হাতে ঘুরে দাঁড়ায়, তার তেজের সম্মুখে পরাভূত প্রদোষ পলায়ন করে, ডুব দেয় মধ্যনিশীথের অগাধ সমুদ্রজলে। ক্ষীরস্রাবী শুভ্র দীপ্তিসুধায় বিলসিত হয়ে ওঠে চন্দ্রাতপ—শর্বরীর নীলাভ অম্বরের আয়তাঞ্চল।

হয়তো এখন নটী মাধবীর মিলনশয্যা আকুল হয়ে উঠেছে বন্য মুল্লাইপুষ্পের সুঘ্রাণে, হয়তো তার নীবিবন্ধ খসে পড়ছে উত্তাল শ্রোণীদেশ থেকে, ওই হয়তো প্রবালরত্ন দিয়ে গাঁথা কটিবন্ধটিও স্খলিত হয়ে গেল, আলুথালু অর্ধবসনা মাধবী হয়তো এখন কুহকসংকেতে কোভালনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ছাদে, হয়তো সেখানে এই চাঁদের আলোর নীচে মিলন ও ছদ্মকলহের মধুর উত্তাপে রতি-উৎসব আয়োজিত হবে সঙ্গোপনে ।

রাত হচ্ছে। উত্তর-পর্বতের প্রস্তরপীঠে দক্ষিণশৈলদেশের চন্দনকাষ্ঠ ঘর্ষণ করে বিলাসিনী নারীরা বেটেছে শীতল সিতচন্দন; স্নান সেরে তারা রতিপ্রত্যাশী দেহে লেপন করবে সেই চন্দনের শৈত্য। তাদের কুসুমাস্তীর্ণ মিলনশয্যা কুঙ্কুমে, চন্দনে, কমনীয় কমলদলে, কণ্ঠচ্যুত মুক্তাহারে, শ্যামপর্ণিকা মালার ছিন্নপত্রে মুহুর্মুহু বিস্রস্ত হয়ে যাবে। শৃঙ্গার-কুতুহল সাঙ্গ করে প্রতীচীর আয়িরচূর্ণের সঙ্গে প্রাচী পর্বতমালার আগরচূর্ণ মিশিয়ে তারা ধুনো দেবে, সুঘ্রাণে ভরে যাবে তাদের মিলন-মন্দির। সেই গন্ধমধুর অন্ধকারের ভিতর প্রিয়তমর বক্ষে মুখ গুঁজে ধীরে ধীরে সুখস্বপ্নে ডুবে যাবে মাধবী-রমণীরা।*

কন্নকী এসব ভাবে। আরও কত কথা ভাবে…

কন্নকীর মতো পতিবিচ্ছিন্না নারীরা এভাবেই জেগে থাকবে সমস্ত রাত অন্ধকারে, বিরহতাপে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে ক্রমাগত, শয়নকক্ষ ছেড়ে উঠে আসবে ছাদে, চাঁদের আলো তাদের কাছে বিধুর বিদ্রূপ বলে মনে হবে, চন্দনপঙ্কে প্রলিপ্ত করবে না বক্ষোদেশ, ১২০ | মূর্ছিত নূপুর

মুক্তামালায় সজ্জিত করবে না তাদের পীন পয়োধর। প্রণয়কৌতুকে যাদের আয়ত চোখের চঞ্চল মণিকশা একদিন নয়নসরসীতে সাঁতার দিত এ প্রান্ত থেকেও প্রান্ত অবধি, সোহাগিনী সেই মেয়েদের চোখ আজ একাকিত্বের বেদনায় স্থির, অশ্রুপরিপ্লুত, আরক্ত । সমস্ত রাত বিনিদ্র থেকেও তারা এই ছাদ ছেড়ে নেমে যাবে না নীচে, শয়ন করবে না আর উপাধানে মাথা রেখে—কেননা সে-শয্যা আজ দমচাপা দীর্ঘশ্বাসে মথিত স্মৃতিমেদুর – সেই কুসুমশয়নেই তো একদিন প্রিয় মরাল তার প্রিয় মরালীকে মধুর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরেছিল।

এই সব ভাবতে ভাবতে অন্ধকার রাত্রিকে কন্নকীর মনে হবে যেন চন্দ্রালোকে কম্পিত কোনো কালো হ্রদের মতন—বিরহিণীর চোখের মতনই কালো তার জল। কৃষ্ণা অপ্সরার মতো সুন্দরী কন্যা যেন এই উজাগর রাত্রি, রাতজাগা পাখিদের মৃদু সঞ্চারের মতো মৃদুগতি, সুগন্ধি পুষ্পের মতো তার অঙ্গসৌরভ, বিকচমান পদ্মকোরকের মতো তার কুসুমিত ওষ্ঠাধর, তরঙ্গায়িত বালুরাশির মতো অন্ধকার তার আলুলায়িত কেশকলাপ । এই রাত্রি শেষ হয়ে আসবে ধীরে ধীরে অতি ধীরে, যখন চঞ্চল ভ্রমরকুল গুঞ্জনে গুঞ্জনে ঊষাকে জাগিয়ে তুলবে, নিদ্রিত কুবলয় আঁখি মেলে চাইবে, যখন আকাশ বেয়ে পূর্ব দিগন্তের আলো ডানায় মেখে ভোরের পাখিরা উড়ে যাবে প্রভাতী কলতানমুখর। মন্দ্রস্বরে স্পন্দিত সমুদ্রের মতো রাত্রির সুবিপুল অমারহস্যকে সরিয়ে পূর্বাচলের শিখরচূড়ায় দেখা দেবেন জ্যোতিষ্মান আদিত্যদেব ।

(একুশ) অন্তর্দ্বন্দ্ব

কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না। অসাধে, বিষাদে এইভাবে ক্ষয়িত হতে হতে কত কত দিন আর কাটাবে কন্নকী? জীবন কখনও কোনো স্থবিরতাকে প্রশ্রয় দেয় না। কাবেরীর বহমান স্রোতোধারার মতন জীবন সর্বদাই সম্মুখে বহে যায়। কন্নকীকেও স্থবির হতে দিল না জীবন। অন্যরকম অভিঘাত এনে বিষাদের নীড় থেকে তাকে বিচ্যুত করে আবার আশা-প্রত্যাশার চলিষ্ণু ভূমিতে এনে দাঁড় করালো জীবন, হিরণ্যচক্ষু কপোত-জননী যেভাবে শিশু-কপোতকে চঞ্চুর এক আঘাতে বাসা থেকে সবেগে ঠেলে ফেলে দিয়ে স্বপক্ষনির্ভর উড্ডয়নে অভ্যস্ত হতে শেখায়, এও ঠিক তেমনই ।

কিন্তু সেই অভিঘাত কোথা থেকে যে আসবে, কীভাবে যে আসবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না আগে থেকে। কখনও তা বাইরের কোনো ঘটনার থেকে আসতে পারে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়েই তা আসে মনের ভেতর থেকে। এত সূক্ষ্মভাবে তা আসে, এত অতর্কিতে আসে যে, সাধারণ মানুষ বুঝেই উঠতে পারে না, অভিঘাতটা ঠিক কোথা থেকে এল।

কোনো এক দ্বিপ্রহরে সহসা কী যেন কী হল কন্নকীর! ভূমিশয্যা থেকে সে উঠে দাঁড়াল, বহুকাল পরে যত্নভরে স্নান করল, দীর্ঘদিনের অযত্নে রুক্ষ চুলগুলিকে তৈলপ্রয়োগে মার্জিত করে তুলল। কেশসংস্কার সমাধা হলে আহার সেরে নিল পরিতৃপ্তিভরে। তারপর অলংকৃত পেটিকাটি খুলে এতদিন ধরে তুলে রাখা নূপুর দুটি বের করে আনল সে। বাদ্য মণিকগুনের দ্বারা নির্মিত সেই দুটি শিল্পিত নূপুর, পিতা মণিকণ্ডন কত সাধ করে কিনে এনে নূপুর দুটি কন্নকীকে উপহার দিয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া সে-কোন কিশোরীবেলায়।

কোভালনের রূপান্তরের পর থেকে এতদিন কন্নকী নূপুর দুটি পরেনি। তার চরণ রিক্ত ছিল এতদিন। আজ কী জানি কী ভেবে সে নূপুর দুটো পায়ে পরল। ভূমি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কন্নকী এ ঘর থেকে ও ঘরে নূপুরের শব্দ তুলে হেঁটে গেল। পুনরায় ও ঘর থেকে হেঁটে এল এ ঘরে কাশ্মীরদেশীয়া তুরঙ্গমার মতো। সোপান বেয়ে ঝমঝম শব্দ তুলে সে ছাদে উঠে গেল, নির্জন ছাদে ময়ূরীর মতো হঠাৎ নেচে নিল আনন্দে একপাক।

নিজের কাণ্ড দেখে নিজেই হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল ছাদে। তারপরে আবার সিঁড়ি বেয়ে শিঞ্জন-শব্দ তুলে নেমে এল ভূতলে; প্রাসাদসংলগ্ন উদ্যানের পথে সে চক্রবাকী পক্ষিণীর মতো চংক্রমণ করতে লাগল ক্রমাগত। যেদিকেই সে যাচ্ছে, নূপুর দুটো বেজেই চলেছে—ঝমঝম্, ঝমাঝম্ । কিছুতেই তাদের থামতে দিতে ইচ্ছে করছে না আজ কন্নকীর । তাই সে কোথাও বসতে চাইছে না কিংবা স্থির হয়ে দাঁড়াতেও চাইছে না। ক্রমাগত উদ্যানপথে সে হাঁটছে, কখনও চঞ্চলা বালিকার মতো উদ্যানপথ বেয়ে ছুটে যাচ্ছে, সাহ্লাদে নৃত্য করছে, উদ্যান সংলগ্ন হ্রদের সোপানের উপর বসে জলের মধ্যে দুই পা ডুবিয়ে অবিরত সম্মুখে পশ্চাতে চরণ আন্দোলিত করছে, জলের কল্লোলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে নূপুরের শিঞ্জন। কী জানি, কী যেন হয়েছে আজ তার। মনে হচ্ছে, এখন নূপুর দুটিকে শুধু অনর্গল কথা বলতে দিতে হবে। ওদের কথা তাকে কান পেতে শুনতে হবে আজ৷

ধীরে ধীরে সন্তর্পণে কান পেতে শুনতে লাগল কন্নকী, নূপুর দুটো কী কথা বলছে পরস্পর। হয়তো সে নূপুরে নূপুরে সংলাপ নয়, হয়তো সে কন্নকীরই দ্বিধাবিভক্ত চেতনার ভিতর কথোপকথন। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক সেসব বিশ্লেষণে এখন কিছুতেই রুচি হল না মেয়েটির। তার মনে হল, ওই তো নূপুর দুটোই তো এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়ে হাসতে হাসতে দুই প্রিয় সখীর মতো কলস্বরে কথা বলে চলেছে….

বামপায়ের নূপুর বলছে, ‘কী ব্যাপার হল, বল তো আজ, সখী? আজ হঠাৎ এতদিন পর আমাদের খোঁজ পড়ল যে? পেটিকার মধ্যে থাকতে থাকতে তো মনে হচ্ছিল, আমাদের বাকশক্তি পর্যন্ত চিরতরে চলে গেছে! বলি, আজ হলটা কী ?’

ডানপায়ের নূপুর অমনি মৃদু নিক্কণধ্বনি তুলে উত্তর দিল, ‘সেই কথাটাই আমিও তো ভাবছি। আমাদের হঠাৎ চরণ থেকে খুলে পেটিকায় তুলে রেখেছিল, রেখেছিল! তা আজ আবার পেটিকা থেকে বের করে এনে পায়ে পরে চপলা বালিকার মতো সারাক্ষণ হেঁটেই-বা চলেছে কেন?’

বামপায়ের নুপুর প্রগল্ভা রসিকার মতো তার পদ্মরাগমণির ঠোঁট চেপে চেপে ফিক করে হেসে উঠে বলল, ‘হ্যাঁ, যা বলেছিস, ভাই! বালিকা তো আর কন্নকী এখন নয়কো ! যৌবনের মধুস্বাদ তো এতদিনে ভালোমতোই পাওয়া হয়ে গিয়েছে!’

ডানপায়ের নূপুর ঝনৎ-শব্দে ছদ্মকোপ প্রকাশ করল, ‘তোর মুখে তো দেখছি কোনো আগল নেই রে মুখপুড়ি! বলি, খবর কিছু কি রাখিস? পদ্মমধু যে বৈদ্যের তিক্ত ঔষধ হতে চলল !’

‘বলিস কী রে?’

‘তবে আর বলছিটা কী ?’

‘বেশ করে একটু ভেঙে বল তো !’

ডানপায়ের নূপুর তখন ঝমঝম্ শব্দে বলতে লাগল, ‘প্রথমে তো কী প্ৰেম, কী প্রেম দুজনের! এমন পাগলপারা আদর যে, কখন কন্নকীর পা থেকে যে আদরের চোটে আমরা দুটি খসে পড়লাম, তার খেয়াল পর্যন্ত নেই। তারপরে দিন যতই যায়, ভালোবাসা ততই পুরোনো হতে থাকল। আরে বাপু, শরীরে শরীরে ঘষে ঘষে কি আর ভালোবাসা হয় ? ওসব শরীরী দলিল তামাদি হতে কতক্ষণ? কারও কিছুটা আগে, কারও খানিকটা পরে। তামাদি হবেই। মনে মনে ওদের যোগ বুঝি আর হল না ।’

বামপায়ের নূপুর বলল, ‘কেন মনে মনে যোগ হল না বল দেখি?’

‘সেইটেই তো ভাবছি। দুজনের মনে কেন এত অসাধ্য দূরত্ব রইল? তারপরে গৃহস্বামী কোভালন তো এখন … হুঁ হুঁ !’

‘কী, হুঁ হুঁ ?’

ডানপায়ের নূপুর মুক্তার চোখ টিপে উত্তর দিল, ‘আরে এখন নতুন রূপের ঠিকানা পেয়েছে যে! ভবের হাটে সবই বিকোয়। কোভালন এখন মাধবীসুন্দরীর কটিবন্ধে ঝুলছে।’

‘বলিস কী রে?’

“ঠিকই বলছি। সাঁঝবেলাতেই আঁধার হল, কাঁদব কত রাত! আর সেই অভিমানেই তো স্বামিনী কন্নকী আমাদের পেটিকায় তুলে রেখেছিল!’

‘রসিকতা রাখ, বাপু! এ যে বড়ো দুঃখের কথা! অমন লক্ষ্মীপ্রতিমার মতো রূপ আমাদের কন্নকীর, অত গুণ, তাকে ছেড়ে মাধবীতে কোভালন মজল কেন ?’

‘দুঃখ কি আমারই কম রে? তবে আমরা হলাম অলংকারজাতীয়। দুঃখের মধ্যেও আমরা উজ্জ্বল হয়ে হাসি, ঝনঝন করে বাজি। ওসব কথা থাক। স্বামিনী কন্নকীর দিকে সত্যিই আর তাকানো যায় না, কী হাল যে করেছে নিজের ! আরে বাপু, পুরুষ জাতটাই অমনধারা। ওদের কারুক্কে বিশ্বাস নেই। কখন যে চোখের কাজলটি পর্যন্ত চুরি করে নিয়ে চলে যাবে, টেরও পাবি না। এখন দ্যাখ, স্বামীর বিরহে ভুগে ভুগে নিজেকে শেষ করতে বসেছে লো !’

‘কিন্তু কিছু তো একটা অভাব ছিল কন্নকীর, নাকি? তা না হলে কোভালন কন্নকীকে ছেড়ে মাধবীর কাছে গেল কেন?’

চুপ কর, মুখপুড়ি! অভাব আর অভাব! অভাব কোথায় নেই লা? ভালোবাসা যার স্বভাব, সে অভাব দেখতেই পায় না। ভালোবাসার খোঁজই পায়নি কোভালন, তাই অমন কুরুম্বুর মতো এই ফুল থেকে উড়ে ওই ফুলে গিয়ে বসে মধু খাচ্ছে। ও ওড়াউড়ির শেষ হয় না, হ্যাঁ, এই বলে রাখলাম!’

‘তুই এখন যে একেবারে আডিগল পণ্ডিতের মতো কথা কইছিস রে, দক্ষিণী ! থাম বাপু, থাম ! আরেকটু হলেই এক্কেবারে তিরুকুরাল আউড়ে ফেলবি যে! ওরে বাবা, মানুষের ভালোবাসায় ওরকম একটু স্যাঁতসেঁতে ব্যাপার থাকেই। একটু অভাব, একটু ছাড়াছাড়ি, আবার একটু মিলমিশ ! খানিক নাকেকান্না, মান-অভিমান, তারপরে আবার এসো হে প্রাণনাথো, আধো-আঁচরে বোসো হে! তারপরে আবার যে-কে-সেই! কিন্তু কন্নকী তো তেমন মেয়ে নয় !’

‘তেমন নয় বলেই তো ঝামেলা বেধেছে রে, বামা! কোভালনকে মাধবীতে আসক্ত জেনে মুখে কুলুপটি এঁটেছে আমাদের কন্নকী। ভালো করে জিজ্ঞেস করছে না, কেন কোভালন কম্নকীকে ছেড়ে মাধবীতে উড়ে গেল? হয় স্পষ্ট করে এই প্রশ্ন করুক, নয় তো ভালো করে কোভালনকে রূপের দড়ি দিয়ে বাঁধুক। তা না, খালি কান্না আর কান্না !’

‘আমার কী মনে হয়, জানিস বোন? কন্নকী প্রথমটাই এবার করবে। জানার চেষ্টা করবে, কোন অভাব মেটাতে কোভালন মাধবীর কাছে গিয়েছে।’

‘ঠিকই তো, এটাই তো এখন কন্নকীর করা উচিত। কোভালনের কাউকে তো ভালো লাগতেই পারে। হ্যাঁ, ভালো লেগে যেতেই পারে। কিন্তু তার জন্যে একেবারে স্ত্রীর মর্যাদা, আস্থা—সবকিছুকে জলাঞ্জলি দিয়ে পাকাপাকি মাধবীর কাছে গিয়ে ওঠা—তার তো একটা সুষ্ঠু কারণ থাকবে!

নূপুর দুটির বার্তালাপ মগ্ন হয়ে শুনতে শুনতে নিজের ভিতরেই তলিয়ে যাচ্ছিল কন্নকী। মনে হল তার, ওরা ঠিক কথাই তো বলছে। এর একটা নিষ্পত্তি করা দরকার এবার। হ্রদের সোপানশ্রেণী থেকে কন্নকী উঠে দাঁড়াল। লঘু পায়ে হেঁটে দ্বিতলে নিজের ঘরে গেল সে। পা থেকে নূপুর দুটি খুলে সযত্নে পেটিকায় তুলে রাখল। তারপর কোভালনের গৃহে প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা করতে লাগল । কী জানি, কোভালন কতক্ষণে গৃহে ফেরে! কী অবস্থাতে ফেরে! তবু আশায় আশায় বুক বেঁধে সে একাগ্রচিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল ।

এবং কী আশ্চর্য, সেদিন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হওয়ার একটু পরেই কোভালন ঘরে ফিরল। অন্যদিনের মতো অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় নয়, বরং বেশ স্বাভাবিক অবস্থায়। তার চোখ দুটো আজ উৎসাহে জ্বলছে। যেন তাকে একটু আগে কেউ কোনো একটা উন্মুক্ত স্পর্ধায় আহ্বান করেছে, যার মীমাংসা তাকে এখনই করে ফেলতে হবে। স্নান ও আহারাদি সেরে সে ত্বরিতে উৎপীঠিকার সম্মুখে প্রসারিত আসনটিতে গিয়ে বসল। প্রদীপ উজ্জ্বল করে কাছে টেনে নিল। মস্যাধারে লেখনী ডুবিয়ে তালীপত্রে খস্থস্ শব্দ করে কী যেন রচনা করতে লাগল কোভালন আপনমনে । গৃহে প্রবেশ করা থেকে এ পর্যন্ত সে কন্নকীর সঙ্গে একটিও বাক্য বিনিময় করেনি। যেন সে তার নিজের ভাবে নিমগ্ন হয়ে আছে ।

কোভালনের এই আত্মবিস্মৃত রূপ দেখছিল কন্নকী কক্ষের এক পাশে দাঁড়িয়ে। লিখতে লিখতে একবার থামল কোভালন, তালীপত্রের থেকে মুখ তুলে সম্মুখে চিন্তামগ্ন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইল । তার চোখ দুটো কন্নকীর দিকেই খোলা রয়েছে, কিন্তু কন্নকীকে সে দেখতে পাচ্ছে না। বোধহয় কোনো কাঙ্ক্ষিত শব্দ খুঁজছে, চিন্তাস্রোত বারংবার বাধা পাচ্ছে তার। হঠাৎ কোভালন অনুভব করল, কন্নকী তার দিকেই শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে ।

চিন্তামগ্নতা থেকে সে সহসাই জেগে উঠল এবার। কন্নকী কি তাকে কিছু বলতে চায়? তাদের দুজনের চোখেই জিজ্ঞাসা ফুটে উঠেছে।

কন্নকীই মুখ খুলল প্রথমে। বলল, ‘কিছু কি লিখছ? কী লিখছ? দুরূহ কোনো কবিতা ?’

কোভালন বিস্মিত হল। অনেকদিন হল কন্নকীকে সে এত স্বাভাবিক প্রশ্ন করতে দেখেনি। অন্যদিনের মতো আজ কন্নকীর মুখ বর্ষাপীড়িত মেঘাচ্ছন্ন হয়ে নেই। উত্তর দিল, “হ্যাঁ, কবিতা। তবে সাধারণ কবিতা নয়। একে বলে চিত্রকাব্য। এর অঙ্গসংস্থান বেশ জটিল। রচনা করা অত্যন্ত কঠিন।’

‘তোমাকে কি কেউ চিত্রকাব্য রচনার স্পর্ধায় উন্মুক্ত আহ্বান জানিয়েছে?’

প্রশ্নটা শুনেই কোভালন অমনি সতর্ক হয়ে গেল। ত্বরিতে বলে উঠল, ‘কই, না তো !’

কন্নকী দেখল, এভাবে কার্যোদ্ধার হবে না। একটু থেমে থেকে এবার সে বলল, ‘অনেকদিন তো কবিতা রচনা করতে দেখিনি, তাই বললাম। আবার শুরু করলে যে!”

কোভালন উত্তর দিল, ‘আমি তো কবিতাকে ছাড়িনি। কবিতাই আমাকে ছেড়ে গিয়েছিল।’

‘তারপর আবার ফিরে এল?’ কন্নকী ঈষৎ তরল স্বরে প্রশ্ন করল।

অন্যমনস্কভাবে চিবুকের নীচে বামহাতের তালু ঘষতে ঘষতে কোভালন অতি সংক্ষেপে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘সেই কবিতার নাম বুঝি নটী মাধবী?’ কন্নকীর কণ্ঠস্বর এবার কঠিন নয়, কিন্তু বেশ সহজও নয়। শীতল।

কোভালন নিষ্পলক চেয়ে রইল। তার মুখমণ্ডলে অস্বস্তির ভাব ফুটে উঠল । কিন্তু সে কিছু বলল না ।

‘আমি তোমাকে কতদিন বলেছি, কবিতা লিখতে। কিন্তু তখন তাতে তুমি উৎসাহ পাওনি। তারপর মাধবীর সংসর্গে গিয়ে সেই উৎসাহ পেয়েছ, সে তো ভালোই! মাধবীই কি এখন তোমার কবিতার বিষয়বস্তু?’

কোভালন উত্তরে প্রশ্ন ফিরিয়ে দিল, ‘তুমি মাধবীকে নিয়ে এত কথা বলছ কেন, কন্নকী? কবিতার কি প্রকৃতই কোনো বিষয় হয় ?’

‘না, হয় না। তবে একদিন কবিতা লিখে তুমি আমাকে শোনাতে। বলতে, সেসব শ্লোক নাকি আমাকে নিয়েই লিখেছ। তাই বললাম। মাধবীকে নিয়ে এত কথা আমি বলতাম না কোভালন। বললাম, তার অনেক কারণ আছে।’

রাজা কারিক্কালের বিচারসভায় অভিযুক্ত ব্যক্তির মতো কোভালন উন্মুখ চোখে কী কী কারণ, শুনবার জন্য কন্নকীর মুখপানে তাকিয়ে রইল।

কন্নকী নিজেকে অল্প গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি মাধবীর কথা আমাকে কখনও সরাসরি বলোনি। কেন?’

একটা জোড়াতাড়া দিয়ে উত্তর বয়ন করল কোভালন, ‘আমি ভেবেছি, তুমি এমনিতেই ওর কথা জানতে পারবে।’

‘হ্যাঁ। পারব। কেননা মাধবীকে তুমি ক্রয় করেছ উন্মুক্ত রাজপথে। কিন্তু অন্যের মুখ থেকে সেটা জানলে যে আমি অপমানিত হব, সেকথা তুমি ভাবোনি? তুমি নিজে মুখ ফুটে আমাকে বললে না একবারও? ‘

‘না, বলা হয়নি।’

‘কেন ?’

‘তোমাকে ওকথা আমি নিজমুখে বললে তুমি খুব আঘাত পাবে… এই ভেবে….’ কোভালন ভেবে পাচ্ছিল না, কীভাবে তার কৈফিয়তকে সে সম্পূর্ণতা দেবে।

‘অন্যের কাছ থেকে শুনলে যে আমি আরও বেশি আহত হব, তুমি বোঝোনি ?’

কোভালন চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘আমি… আসলে খুব ভয় পেয়েছিলাম…’

‘ভয়? কাকে?’

‘তোমাকে।’

‘আমাকে?’ কথাটা উচ্চারণ করে এত দুঃখেও ঠা-ঠা করে হেসে উঠল কন্নকী, ‘আমাকে ভয় ? আমি একজন সাধারণ অবলা নারী। সাধারণ বধূ। আমাকে ভয় হল কেন তোমার ?’

এবার কোভালন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠতে চাইল নিজের কাছেই। উৎপীঠিকা ঠেলে সরিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। কক্ষের মধ্যে দ্রুতবেগে পদচারণা করতে করতে উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল আপনমনে, ‘হ্যাঁ, ভয়। তোমাকেই ভয়, কন্নকী। তোমার সরলতাকে ভয়। তোমার স্পষ্টতাকে ভয় । তোমার অসম্ভব জেদকে ভয়। কিছুতেই… কোনোমতেই তুমি বুঝতে চাও না, মানুষের জীবন রোদের আলোর মতো স্পষ্ট নয়। বর্শার ফলার মতো ঋজু নয়। মানুষের জীবনে অনেক আলো-অন্ধকার আছে। অনেক কুহেলিতিমির আছে। অনেক আশা-হতাশা আছে।’

তার সেই উদ্ভ্রান্ত পদচারণার মধ্যে এসে পড়ে তাকে থামাল কন্নকী। বলল, ‘তাই? কিন্তু এর মধ্যে অস্পষ্টতা কোথায়, কোভালন? আমি বণিক ব্যাপারীর সন্তান । তুমিও তাই। আমাদের সমাজে পুরুষদের রক্ষিতা-গ্রহণ কোনো ব্যতিক্রমী অস্পষ্ট ঘটনাই নয় । প্রায় প্রত্যেক বিত্তবান বণিকই এখন রক্ষিতা রাখে। তুমিও না হয় তাই-ই করেছ। যদিও আমি তোমাকে অন্যরকম ভেবেছিলাম। সে হয়তো আমারই ভুল। কিন্তু কথাটা গোপন থাকবে না জেনেও তুমি কথাটা আমাকে বলোনি কেন? কীসের প্রতিশোধ নিতে চাইলে তুমি? আমি কী অপরাধ করেছি?’ কন্নকীর কণ্ঠস্বর শেষ দিকে উগ্র হয়ে উঠল।

‘অপরাধ, প্রতিশোধ—ওসব কিছুই নয়। কিন্তু… তুমিই-বা আমাকে অন্য পাঁচজনের সঙ্গে এক করে বুঝছ কেন? অন্যরা যে-কারণে রক্ষিতা রাখে, সেই কারণে কি আমি মাধবীকে ক্রয় করেছি? না। কখনোই না। আর মাধবীকে আমি আমার রক্ষিতা বলে মনেই করি না। আমি মাধবীর কাছে গিয়েছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে।’

‘ও, অন্য কারণে? বেশ। পরে শুনব কী সেই কারণ। কিন্তু তুমি যে-কারণেই মাধবীর কাছে গিয়ে থাকো, একটা কথা আজ তোমাকে খুলে বলি, মাশাত্তুবানপুত্র কোভালন! সেই জন্যেই আমি মাধবীর কথাটা তুললাম। খুব স্পষ্ট করেই বলছি। যে-স্পষ্টতাকে তুমি ভয় পাও বললে, সেই স্পষ্টতা সহকারেই কথাটা আমাকে আজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলতে হবে। তোমার পিতা মৃত্যুর আগে তোমাদের ব্যবসা ও তোমার দায়িত্ব আমার হাতে দিয়ে গেছেন। আমি সেই অসহায় মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধকে কথা দিয়েছিলাম। আজ বহুদিন হল, তুমি বিপণিতে নিয়মিত যাও না। ব্যবসাপত্র দ্যাখো না। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, পারিবারিক ব্যবসার অবস্থা ভালো নয়। প্রচুর দেনা হয়েছে। তুমি প্রচুর অর্থ বিপণি থেকে নিয়ে মাধবীর জন্যে ব্যয় করছ। চারিদিকে অসংখ্য মানুষ আমাদের সঙ্গে তঞ্চকতা করছে। তোমার পিতা মাশাত্তুবান বহু শ্রম করে এই ব্যবসাকে দাঁড় করিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র হয়ে তোমার একবারও কি মনে হচ্ছে না যে, তুমি ভুল করছ?’

কোভালন অসহায় অবুঝ শিশুর মতো নিজের শিরোদেশের দীর্ঘ কুন্তলগুলিকে দু-হাতে টেনে ধরে সবলে পীড়ন করতে করতে হাহাকার করে উঠল, ‘জানি, জানি, জানি। এসব আমি জানি । সব জানি। কিন্তু আমার কিচ্ছু করার নেই। আমি ব্যবসা করতে পারব না । আমার ভালো লাগে না যে! এই সিসা, টিন, প্রবাল, মুক্তা, রত্ন, মশলা, সুগন্ধি, লাক্ষা—এসব নিয়ে থাকতে আমার একটুও ভালো লাগে না। একটুও না । বণিকের সন্তান হয়ে জন্মানোটাই আমার ভুল হয়েছে। এর থেকে যদি আমি বারাঙ্গনাপল্লীর বিট হয়েও জন্মাতাম…’

কন্নকী কোভালনের ওষ্ঠের উপর হাত চাপা দিয়ে বলল, ‘শান্ত হও। তুমি কী বলছ, তুমি তা জানো না। মাধবীকে তোমার ভালো লাগতেই পারে। মাধবীর কাছে তুমি যেতেই পারো। কিন্তু ব্যবসার এতদূর ক্ষতি করে নয়। এরপর সর্বস্বান্ত হয়ে যাবে যে ! এখনও বলছি, থামো!’

কন্নকীর করতল ওষ্ঠাধর থেকে হেলাভরে সরিয়ে উচ্চৈঃস্বরে বলে উঠল কোভালন, ‘আমার কিছু করার নেই। ব্যবসায় অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি আমি নিয়োগ করছি, যার সহায়তায় তুমি এ গৃহে বসেই ব্যবসা চালাতে পারবে। অথবা আমার পিতৃবন্ধু কলানিধি আছেন, তাঁরও সাহায্য নিতে পারো। কিন্তু এর বেশি আমি কিছু করতে পারব না। যে-খেলা আমি শুরু করেছি, সে-খেলা আমাকেই শেষ করতে হবে। গ্রিক তরবারির দুদিকেই ধার থাকে, আমার মন ওই গ্রিক তরবারির মতন। আমার মানসিক যন্ত্রণার সংবাদ কেউ রাখে না। তুমি তো এত কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলে, কই একবারও তো জিজ্ঞাসা করলে না, কেন আমি মাধবীর কাছে গিয়েছি?’

কন্নকী নিষ্পলক নেত্রে বলল, ‘এ প্রশ্নটা আমিই তোমাকে করতাম। ভালো হল, তুমি নিজেই কথা তুললে। বলো, কোন অভাব পূরাতে তুমি মাধবীর কাছে গেলে? শুনি!’

কোভালন অত্যন্ত উত্তেজিত স্বরে জবাব দিল, ‘শুনবে? শোনো তবে। তোমাকে আমি যেভাবে কল্পনা করে এসেছি, বাস্তবে তুমি তার থেকেও অনেক সুন্দর বলে। তুমি এত সুন্দর যে, তোমার কাছে এসে আমার কল্পনা বারবার অপমানিত হয়। তোমার বাস্তব সৌন্দর্যের কাছে এসে আমার কল্পনার, আমার কবিতার মাথা হেঁট হয়ে যায় প্রতিদিন। তাই…’

কোভালনের কথা শুনে কন্নকী বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। এমন একটা উত্তর সে শুনবে, ভাবতে পারেনি। অনেকক্ষণ সে কোনো কথা বলতে পারল না। অনেকক্ষণ সে নিজের ভিতরে তলিয়ে গিয়ে মাথা নীচু করে ভাবতে লাগল অনেক কথা । তারপর ধীরে ধীরে চিন্তা করতে করতে বলল, “আমি এত সুন্দর বলে তুমি মাধবীর কাছে গেছ ? ভাবছ, সে তোমার কল্পনার থেকে কম সুন্দর হবে? তাতে তোমার কবিত্বশক্তি, তোমার কল্পনা বাস্তবকে হারিয়ে বিজয়ী হবে? কে বলেছে তোমাকে এই কথা যে, আমার বাস্তব রূপ তোমার কল্পনার চেয়েও সুন্দর? তোমার কল্পনা আলাদা আর বাস্তব আলাদা—এই মাত্র। কেউ কারও থেকে বেশি বা কম সুন্দর হতে পারে না।… আমিই হই আর মাধবীই হোক—তুমি তো আমাদের কাউকেই চাওনি, কোভালন। তুমি তোমার কল্পনার মানসসুন্দরীকে চেয়েছ। আমাদের মধ্যে তুমি তোমার সেই কল্পিত মানসসুন্দরীকে খুঁজছ। এতে যে তুমি নিত্যদিন আমাদের অপমান করে চলেছ, বুঝতে পারছ না ?

কোভালন সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘কী? আ-আমি তোমাদের অপমান করছি? আমি ?’

কন্নকী উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি, তুমিই অপমান করছ। তোমার মতো পুরুষেরা কেন একথা বোঝে না যে, মেয়েরা সুন্দরও নয়, অসুন্দরও নয়। মেয়েরা তোমাদের মতোই মানুষ। রক্তমাংসের বাস্তব মানুষ। তাদের অসুখ-বিসুখ আছে, ব্যথা-বেদনা আছে, ক্লান্তি আছে, হতাশা আছে, মক্ষিকার মতো প্রতিদিন মরে যাওয়া আছে। তোমাদের কল্পনা পূরণের কোনো দায় নেই মেয়েদের। তোমার কবিতার ঘোরগ্রস্ত খেলার পুতুল নই কেউ আমরা।’

প্রচণ্ড আঘাতে সহসা আহত বিহ্বল হয়ে ঈষৎ স্খলিত স্বরে বলে উঠল কোভালন, ‘কেন একথা বলছ তুমি ? তুমি একথা বলতে পারলে? আমি—আমি কি ভালোবাসিনি তোমাকে, কন্নকী? ভালোবাসি না আমি মাধবীকে?”

‘না। কিছুমাত্র না। তুমি কখনও ভালোবাসোনি কাউকে। ভালোবাসার সঙ্গে সৌন্দর্যের—তুমি সুন্দর বলতে যা বোঝো—সেই সৌন্দর্যের কোনো সম্পর্ক নেই। সৌন্দর্যপ্রীতি তো একটা প্রাথমিক আকর্ষণ। সেই আবেগেই আটকে আছে তোমার কবিতা, তোমার কল্পনা। তার থেকে এগোতে পারেনি। যদি ভালোবাসতে আমাকে তুমি, তাহলে আমি সুন্দর না অসুন্দর, তোমার কল্পনা বেশি সুন্দর না বাস্তবে আমি বেশি সুন্দর—এসব শিশুসুলভ প্রশ্ন উঠতই না। ভালোবাসলে তো তুমি আমাকে বুঝতে চাইতে ! মাধবীর ক্ষতবিক্ষত জীবনটাকেও তুমি বুঝতে চাইতে। তোমার কল্পনা দিয়েই বুঝতে চাইতে না হয়…’ শেষ কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে মেঝেতে বসে পড়ল কন্নকী। কোভালন ক্রন্দনরতা কন্নকীকে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিতে চাইল। কিন্তু সফল হল না। আরও অধিক বিলাপে চূর্ণবিচূর্ণ হতে হতে কবিতা লেখার উৎপীঠিকার উপরে রাখা তালীপত্রের শুষ্ক পুথির উপর মাথা ঠুকতে ঠুকতে অশ্রুপরিপ্লুত স্বরে কন্নকী বলতে লাগল, ‘ওহ্, কেন, কেন, কেন আমি এত সুন্দর হলাম? কেন তোমার কবিতার চেয়ে কম সুন্দর হলাম না আমি? তাহলে তো তুমি আমাকে ভালোবাসতে। তাহলে তো তুমি আমাকে ছেড়ে আর মাধবীর কাছে যেতে না…’

মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল মেয়েটি। এতক্ষণের সুচিন্তিত যুক্তির পথ সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে বিলাপের কোন অসংজ্ঞায়িত অন্তহীন স্রোতে সে ভেসে যেতে লাগল যে…

বহু চেষ্টা করেও রোরুদ্যমানা কন্নকীকে শান্ত করতে না পেরে, কক্ষ পরিত্যাগ করে কোভালন অন্ধকার অলিন্দে এসে দাঁড়াল। সেখানে কিছুক্ষণ অশান্তভাবে পদচারণা করতে লাগল, তবু মস্তিষ্ক কোনোমতেই তার শান্ত হল না। কোভালন বুঝতে পারল, এখনই… এই মুহূর্তেই তার মাধবীর কাছে যাওয়া বড়ো প্রয়োজন। তা না হলে এই উত্তপ্ত মস্তিষ্ক যেন আরেকটু পরেই ফেটে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে ।

কাউকে কিছু না বলে উদ্যান অতিক্রম করে নৈশ অন্ধকারে আবৃত নগরীর পথে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল কোভালন ৷

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *