নীল চিতার হিম আগুন

নীল চিতার হিম আগুন

এক

”আপনিই কি ঘাটবাবু?”

কাউন্টারের ওপাশে মড়ার নাম—ঠিকানা লেখার মোটা খাতাটার ওপর মাথা রেখে ঝিমোচ্ছিলেন শিবাইকালী শ্মশানের ঘাটবাবু নিতাই নস্কর। ঝিমুনির মধ্যেই হেঁড়ে গলার প্রশ্নটা তার কানে এল। তিনি বিশেষ পাত্তা দিলেন না। মাথা না তুলেই জবাব দিলেন, ”মড়া পোড়ানো বন্ধ। বাইরে নোটিশ দ্যাখেননি? ইলেকট্রিক চুল্লি খারাপ হয়ে গেছে।”

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। হালকা ঘুমের মধ্যেই নিতাইবাবু ভাবলেন, আপদ বিদায় হয়েছে। কিন্তু তখনই আবার বাজখাঁই গলায় দ্বিতীয় প্রশ্ন ভেসে এল—”চুল্লিটা কোথায়? একটু দেখতে হবে যে।”

এবার ধড়মড় করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন নিতাই নস্কর। দেখলেন কাউন্টারের গ্রিলের সঙ্গে নাকটাকে প্রায় ঠেকিয়ে প্রশ্নকর্তা দাঁড়িয়ে রয়েছেন। প্রথম দর্শনেই নিতাইবাবুর মনে হল ভদ্রলোক একদম ঠিক জায়গায় চলে এসেছেন। শ্মশানই এঁনার বসবাসের পক্ষে আদর্শ জায়গা। একেবারে যমদূতের জেরক্স—কপি। মুশকো চেহারা, উস্কো খুস্কো চুল, গায়ে একটা তেলচিটে নোংরা ফুলহাতা জ্যাকেট আর মাথায় টুপি। শুধু ভদ্রলোকের চশমার পুরু কাচে ঢাকা বড় বড় চোখদুটো কোনো যমদূতের চেহারার সঙ্গে একেবারেই বেমানান। একেবারে হীরের কুচির মতন ঝকমকে দুটো চোখ।

নিতাইবাবু অফিসঘরের দরজা খুলে বাইরে এসে লোকটার মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তার মাথা ছাড়িয়ে প্রায় হাতখানেক উঁচুতে লোকটার মাথা। কত হাইট হবে ওর? সাড়ে ছয়? ছয় আট? যাই হোক, সেই উচ্চতা থেকেই লোকটা আবার গুরু গম্ভীর স্বরে বলল, ”হাতে বেশি সময় নেই। চলুন।”

নিতাইবাবুর মাথাটা ভালো কাজ করছিল না, তাই চুল্লি—সারাই কোম্পানির লোককে যে তিনি নিজেই ফোন করে ডেকেছিলেন সে কথাটা মনে পড়তে একটু সময় লাগল। মাথাকে দোষ দেওয়া যায় না অবশ্য। কাল রাত থেকে যে ঝামেলা চলছে, তাতে যে কারুরই মাথা খারাপ হয়ে যাবে। সে কথা মনে পড়তেই দাঁত কিড়মিড় করলেন নিতাইবাবু। মনে মনে বললেন, টেকনোলজির নিকুচি করেছে। নিকুচি করেছে ইলেক্ট্রিক চুল্লির। ভেতরে একটা মড়া নিয়ে সেই যে রাত দেড়টার সময় ঘটাং করে দরজা বন্ধ হয়ে গেল, ব্যস। তারপর থেকে না জ্বলছে চুল্লির ভেতরের ফারনেস, না খুলছে সামনের শাটার। যেন আলিবাবার গুহার মধ্যে ঢুকে পড়েছে কাশেম আর তারপর পাস—ওয়ার্ড ভুলে গিয়ে আলু ফাঁক, বেগুন ফাঁক করে বৃথাই চিল্লিয়ে যাচ্ছে।

ভেতরে যে মড়াটা এখনও রয়ে গেছে, সেটাকে কালো ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে এসেছিল লোকাল থানার চারজন জমাদার। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নিতাইবাবু বুঝেছিলেন, লোকটা ছিল বিন্নাগাছি রেল—ইয়ার্ডের এক কালের বড় মাফিয়া। নাম কানকাটা মধু। ইদানিং বয়েস বাড়ার ফলে ওর প্রতিপত্তি কমে যাচ্ছিল। মধুর ওয়াগন—ব্রেকিং—এর দলের লোকেরা সব ট্যারা খগেনের সঙ্গে যোগ দিয়ে মধুকেই পেটাচ্ছিল। দিনের পর দিন ট্যারা খগেনের দলের কাছে এইভাবে ঝাড় খেতে খেতে গতকাল কানকাটা মধু মনের দুঃখে সুইসাইড করেছে। ওটা তারই লাশ। মধুর তিনকূলে কেউ নেই বলে পুলিশের ওপরেই দাহ করায় দায়িত্ব চেপে গেছে।

কুড়ি বছর ধরে শিবাইকালী শ্মশানের ‘কেয়ার—টেকার’, মানে ‘ঘাটবাবু’—র চাকরি করতে করতে নিতাই নস্করের মনটা দড়কচা মেরে গেছে। সুইসাইড হোক কি অ্যাকসিডেন্ট, বাচ্চা হোক কি বুড়ো— লাশ হচ্ছে লাশ। ডেথ—সার্টিফিকেট মিলিয়ে ওই মোটা খাতাটায় নম্বর ফেলো। তারপর চুল্লিতে ঢুকিয়ে দাও। ব্যস, নিতাইবাবুর কাজ শেষ।

গতকালও তাই হয়েছিল। লাশের লাইনে কানকাটা মধুর টার্ন আসার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চু আর ময়না দুই ডোম বডিটাকে চুল্লির সামনে কনভেয়রের ওপর শুইয়ে দিয়েছিল। এরপর মেঝেয় আটকানো বড় লিভারটা ধরে টানার সঙ্গে সঙ্গে কনভেয়রে চড়ে মধুর লাশ ঢুকে গিয়েছিল চুল্লির ভেতরে। ঘটাং করে লোহার শাটার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এই অবধি সব ঠিকঠাকই ছিল। নিতাইবাবু নিজের অফিসঘরে ফিরবার জন্যে পা বাড়িয়েছিলেন। এমন সময় পেছন থেকে বাচ্চু ডোমের অবাক আওয়াজ ভেসে এল— ”ও স্যার, ফারনেস তো নিভে গেল।”

”বলিস কী? বার কর! বার করে আবার ঢোকা!”—নির্দেশ দিয়েছিলেন নিতাইবাবু এবং সেই নির্দেশ মেনে পরপর যা করার করেও গিয়েছিল বাচ্চু আর ময়না। কিন্তু চুল্লির মধ্যে কোনো তাপ উত্তাপ দেখা যায়নি। অন্যান্যবার সুইচ টেপা মাত্র যে চুল্লির ভেতরটা প্রচণ্ড তাপে টকটকে লাল হয়ে ওঠে সেই চুল্লির গা আজ একদম ঠান্ডা। সবচেয়ে মুশকিলের কথা, শাটারটা অবধি খুলছে না। ভেতর থেকে মধুর বডিটা বার করে এনে যে অন্য শ্মশানে পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন, তারও উপায় নেই।

মধুর পেছনে, লাইনে যে আরও তিনটে মড়া ছিল, তাদের শ্মশানসঙ্গীরা বেগতিক দেখে পাশের শহরে দাহ করতে চলে গেল। অনেকক্ষণ ধরে হাই তুলে আর খৈনি ডলে, শেষমেশ বিরক্ত হয়ে পুলিশের জমাদার চারজনও ফিরে গেল থানায়। যাওয়ার আগে বলে গেল— ”মেশিন সারাই হলে আমাদের ডেকে নেবেন।” যে কোম্পানি চুল্লি বসিয়েছিল নিতাইবাবু তাদের ফোন করলেন। যে লোকটা ফোন ধরেছিল, সে বলল, ”এত রাতে তো কিছু করা যাবে না স্যার। সকাল হলেই লোক পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

নিতাইবাবু এখন ঘড়ি দেখলেন— সকাল সাতটা। চুল্লি—কোম্পানির লোকের কর্মতৎপরতায় খুশি না হয়ে পারলেন না নিতাইবাবু। আজকালকার দিনে কটা লোক এরকম কথা রাখে? সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিস্ত্রি পাঠিয়ে দিয়েছে। তিনি প্রসন্নমুখে যমদূতকে জিজ্ঞেস করলেন, ”আপনার নামটা কী ভাই?”

”ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র।” হেঁড়ে গলায় চটপট জবাব এল।

নিতাইবাবু মুহূর্তের মধ্যে সতর্ক হয়ে গেলেন। এ লোকটা পাগল, কিন্তু বলশালী। পরন্তু ময়না, বাচ্চু, পুলিশের জমাদার, কাছেপিঠে কেউ নেই। উপরন্তু এই শীতকালে চারিদিক অন্ধকার করে অসময়ের বৃষ্টি নেমেছে, ডাকলে কেউ শুনতে পাবে না। অধিকন্তু লোকটার হাতে একটা অন্তত পাঁচ কিলো ওজনের লোহার স্প্যানার, যেটা নিয়ে লোফালুফি করতে করতে সে কুটিল দৃষ্টিতে নিতাইবাবুর মাথার খুলির দিকে চেয়ে আছে। কাজেই কথা না বাড়িয়ে নিতাই নস্কর অত্যন্ত বিনয়ী গলায় বললেন, ”আসুন, আসুন, ডক্টর মিত্র। আমিই আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।”

দুই

চুল্লির সামনেটায় শ্মশানযাত্রীদের বসার জায়গা আছে। মাথায় ছাদ, চারিদিকে দেয়াল। বেশ চমৎকার ব্যবস্থা। তবে একটু অন্ধকার বলে দিনের বেলাতেও একটা বাল্ব জ্বলছিল। ওটা সব সময়েই জ্বলে। আলোটার নিচে বসে সেই উন্মাদ চুল্লি—সারাইওয়ালা তাঁর পিঠের বিশাল ব্যাক—প্যাকটা খুলে সামনে নিয়ে এলেন। তারপর তার মধ্যে থেকে এটা ওটা পার্টস, তাতাল, মিটার, ডায়োড, এইসব বার করে একটা প্লাস্টিক শিটের ওপর সাজাতে সাজাতে নিজের মনেই কথা বলে যেতে লাগলেন। গলাটা তাঁর যেহেতু বেশ চড়া আর ভরাট, কাজেই পাশে দাঁড়িয়ে নিতাইবাবু প্রত্যেকটা শব্দই বেশ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলেন। ভদ্রলোক বলছিলেন—

”প্রতিভা আর পয়সা এই দুটো জিনিস কদাচিৎ একসঙ্গে মেলে, বুঝলেন? আমার যেমন প্রতিভা আছে, কিন্তু পয়সা নেই। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে ডুসেলডর্ফ ইউনিভার্সিটি থেকে বায়ো—টেকনোলজিতে ডক্টরেট করেছি। কাজেই প্রতিভার ব্যাপারটা নিশ্চয় আপনি অস্বীকার করবেন না?” সিদ্ধকাম আড়চোখে নিতাই নস্করের দিকে তাকালেন। নিতাই নস্কর সবেগে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন, অস্বীকার করার কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবছেন না।

ভদ্রলোক মনে হয় খুশি হলেন। বললেন, ”হুঁ। কিন্তু ওই যে বললাম, আমার পয়সা নেই। চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, আর পরের গোলামি করবও না। এদিকে আমি যে ব্যাপারটা নিয়ে কাজ করছি সেটা প্রচণ্ড ব্যয়সাপেক্ষ এবং ঝুঁকিবহুল। ধরুন, এই রিসার্চ করতে গেলে নিয়মিত ডেড—বডির সাপ্লাই চাই। কে দেবে আমাকে ডেড বডি? এটা তো আর মেরি শেলীর আমলের বিলেত নয়, যে কবর খুঁড়ে বডি নিয়ে চলে এলাম, আর একটা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বানিয়ে ফেললাম।”

নিতাইবাবু শুকনো মুখে ঘাড় নেড়ে বোঝাতে চাইলেন যে, সত্যিই, কবর খুঁড়ে মৃতদেহ তুলে আনার সুবন্দোবস্ত না থাকায় তিনিও খুবই মর্মাহত।

সিদ্ধকাম মিত্র দুটো ডায়োডের মধ্যে তার জড়াতে জড়াতে বললেন, ”তবে প্রতিভাধরদের কাছে কোনো সমস্যাই সমস্যা নয়। আমি ভেবে দেখলাম, শ্মশানে যে মড়া পোড়ানোর চুল্লিগুলো থাকে, সেগুলোর মধ্যে সার্কিট, চেম্বার সবই একেবারে যেমনটি চাই তেমনই রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, ভেতরে মৃতদেহ অবধি রেডি। দরকার শুধু সার্কিটগুলো একটু ওলট পালট করে নেওয়া আর দু চারটে কেমিক্যাল ডেড বডির গায়ে মাখিয়ে দেওয়া। ব্যস, আমার কাজের বারো আনা তো ওতেই হয়ে গেল। সব মিলিয়ে হয় তো দেড় দুশো টাকা খরচ। আর তাতেই মৃতদেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনবার মতন যুগান্তকারী আবিষ্কার হয়ে যেতে পারে। আইডিয়াটা কেমন? ব্রিলিয়ান্ট না?”

আরেকটু হলে নিতাই নস্করের মুখ ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ”ঘোড়ার ডিম আর হাতির শিং।” কোনো রকমে সামলে নিয়ে বলেন, ”হেঁ, হেঁ। তা তো বটেই, তা তো বটেই।”

”প্রবলেম হল, আপনার মতন মূর্খ ঘাটবাবুরা ইলেক্ট্রিক চুল্লির দিকে আমাকে ঘেঁসতে দেয় না। তার ওপরে সারাক্ষণ শ্মশানঘাটগুলোতে মাছির মতন লোক কিলবিল করছে। এক্সপেরিমেন্টের জন্যে যে নির্জনতা দরকার সেটা পাওয়াই অসম্ভব। এর আগে মাত্র তিনবার খারাপ চুল্লির দখল নিতে পেরেছিলাম। তাতে কিছুটা শিখেছি। ভুল ত্রুটিগুলো অনেকটাই শুধরে নিয়েছি। দেখা যাক এবারে কী হয়।”— এই বলে ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র তাঁর হাতের সেই মুগুরের মতন দেখতে স্প্যানারটা দিয়ে এক ঝটকায় লোহার শাটারটা খুলে চুল্লির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

বাইরে দাঁড়িয়ে নিতাইবাবু ভাবতে থাকলেন, কত রকমেরই যে পাগল হয়। বেশিরভাগ পাগলেরই অবশ্য এই দোষটা থাকে। তারা যা নয়, নিজেদের তাই ভাবে। যেমন তাদের পাড়ার হাপু পাগলা নিজেকে ভাবত উত্তম কুমার। দু হাতে দুটো ডাবের খোলা নিয়ে হাপু রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গান গাইত আর ডায়ালগ মারত। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, কখনো গাড়ি চাপা পড়েনি। বোঝাই যাচ্ছে, চুল্লি সারাই কোম্পানির এই ভদ্রলোকও সেইরকমই নিজেকে বিজ্ঞানী ভাবছেন। তা ভাবুন। মূল ব্যাপারটা হচ্ছে মেশিনটাকে সারানো। ভদ্রলোক যেভাবে এক ঝটকায় শাটারটাকে খুলে ফেললেন, তাতে তো মনে হচ্ছে কাজটা ভালোই বোঝেন। তাহলে কিছুক্ষণ ওর তালে তাল দিয়ে গেলে ক্ষতি কী?

নিতাইবাবু চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন, এই পৌষ মাসেও আকাশ কালো করে অসময়ের বৃষ্টি নেমেছে। মানুষ তো মানুষ কুকুরগুলো অবধি ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে তল্লাট ছেড়ে পালিয়েছে। একবার পকেটের মোবাইল ফোনটায় হাত ঠেকিয়েও আবার কি মনে করে তিনি হাতটা সরিয়ে নিলেন। এখন কাউকে ফোন করাও রিস্কি। লাশ নিয়ে তার নিত্যদিনের কাজ ঠিকই, কিন্তু নিজে লাশ হয়ে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।

মিনিট দশেক বাদেই ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র আবার হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। হাতের যন্ত্রপাতি আর বোতলগুলো ব্যাক—প্যাকের মধ্যে ঢুকিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ব্যস, কাজ শেষ। এবার লিভারটা টানুন দেখি।”

নিতাইবাবু ভালো ছেলের মতন লিভারটায় হ্যাঁচকা টান দিলেন। ঘড়ঘড় শব্দ করে শাটার বন্ধ হয়ে গেল। তার আগে নিতাইবাবু একপলক দেখতে পেলেন, কানকাটা মধুর বডিটা একইভাবে কাঠ হয়ে চুল্লির ভেতরে পড়ে আছে।

ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র নিজেই দেয়ালের গায়ে বসানো ফার্নেসের সুইচটায় চাপ দিলেন। নিতাই নস্কর অবাক হয়ে দেখলেন, আগুনের লাল নয়, অন্যরকম একটা ঘোর নীল রঙের আলো চুল্লির ফাঁক ফোকর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এল। আগুনের গনগনে আঁচ নয়, বরং একটা হাড় কাঁপানো শীতল তরঙ্গ চুল্লির দেয়াল থেকে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে।

এই প্রথম নিতাই নস্করের মনে একটা অন্যরকমের সন্দেহ উঁকি মারল। তিনি আরেকবার ভালো করে সিদ্ধকামের চোখদুটো দেখলেন। ওরকম জ্বলজ্বলে চোখ পাগলদের হয়, আবার প্রতিভাবানদেরও হয়। ইনি যা বলছেন তা কি সত্যি? ইনি কি সত্যিই ডুসেলডর্ফের ডক্টরেট। সত্যিই কি উনি এইমাত্র কোনো যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা শেষ করলেন?

কান ফাটানো আওয়াজ করে কাছাকাছি কোথাও একটা বাজ পড়ল। শীতে কিংবা ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপে উঠলেন নিতাইবাবু। আর তখনই মসৃণভাবে চুল্লির দরজাটা আবার খুলে গেল।

তিন

”আমাকে বাঁচালে কেন?”— তীক্ষ্ন চিৎকারে শুধু নিতাইবাবু নন, ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র অবধি দু’পা পেছনে ছিটকে গেলেন।

”কেন বাঁচালে আমাকে?”— নীল আলোয় ভরা চুল্লির ভেতর থেকে আবার চিৎকার করে উঠল মধু মাফিয়া। চুল্লির মেঝেতে পাতা বাঁশের চালির ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছে সে। খালি গা। কোমরে একটা সাদা কাপড় জড়ানো। তার বুকে পেটে, এখানে ওখানে, মর্গের ডাক্তারবাবুর হাতে দেওয়া গুন চটের বস্তার মতন মোটা সেলাইয়ের দাগ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।

মধু মাস্তান টলতে টলতে বাইরে বেরিয়ে এসে সিদ্ধকামের মুখোমুখি দাঁড়াল। সিদ্ধকাম হাত তুলে তাকে শান্ত করার ভঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করলেন— ”আহা চটছেন কেন? লোকে তো বাঁচতেই চায়। আপনার নবজন্ম হল। এতে তো আপনার খুশিই হওয়া উচিত।”

”নিকুচি করেছে তোমার নবজন্মের। কোনোদিন নিজের চ্যালাচামুন্ডার হাতে মার খেয়েছ? একদিন যেখানে রাজার মতন বেঁচে ছিলে, সেখানে কোনো দিন ভিক্ষের ঝুলি পেতেছ? তাহলে বুঝতে, ওভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।”

হঠাৎ এক হেঁচকা টানে সিদ্ধকামের হাত থেকে স্প্যানারটা কেড়ে নিয়ে দুমদাম এদিক ওদিক চালাতে শুরু করল কানকাটা মধু। মাথা বাঁচাবার জন্যে দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন নিতাইবাবু আর ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র। সেখান থেকেই তারা ঝাড়া পাঁচ মিনিট ধরে ভাঙচুরের আওয়াজ শুনলেন। একটু বাদেই ঝড়ের মতন তাদের সামনে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল মধু মাস্তান। নদীর বুকে একটা শব্দ হল, ‘ঝপাং। নিতাইবাবু মুখের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির জল মুছতে মুছতে মন্তব্য করলেন, ”মধু তাহলে দ্বিতীয়বার সুইসাইড করল?”

ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র কোনো কথা না বলে আবার চুল্লির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পেছনে পেছনে নিতাই নস্কর। এখন আর সেটাকে চুল্লি না বলে চুল্লির ধ্বংসস্তূপ বলাই ভালো। চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সিদ্ধকামের লাগানো ডায়োড, ট্রায়োড, সার্কিট, কেমিকেলের বোতল। প্রচণ্ড হতাশ স্বরে সিদ্ধকাম বললেন, ”সব জলে গেল। এই প্রথমবার সাকসেস পেলাম, কিন্তু সাকসেসের ফর্মুলাটা টুকে রাখতে পারলাম না। কোথায় যে কী লাগিয়েছিলাম, কোন কেমিকেল কতটা অ্যাপ্লাই করেছিলাম, কত ভোল্টেজ দিয়েছিলাম— কিছুই মনে করতে পারছি না। জানি না, কবে আবার এরকম পরীক্ষার সুযোগ পাব।”

নিতাইবাবু দেখলেন, ওই বিশাল চেহারার লোকটাও কেমন যেন গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গেছে। মেঝে থেকে ব্যাকপ্যাকটা তুলে নিয়ে, ক্লান্ত পায়ে, বৃষ্টিধারায় ঝাপসা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলেন কোথাকার কে ডক্টর সিদ্ধকাম মিত্র। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিশ্চয় কিছুক্ষণের জন্যে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছিলেন নিতাইবাবু। তাঁর সম্বিৎ ফিরল পেছন থেকে মানুষের গলার আওয়াজে।— ”দাদা, আমরা চুল্লি—কোম্পানি থেকে এসেছি। যা বৃষ্টি, এক ঘণ্টার রাস্তা আসতে তিন ঘণ্টা লেগে গেল। কই দেখি কী হয়েছে।”

তিনটে ছেলে নিজেরাই স্মার্টলি চুল্লির সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর তাদের গলা থেকে সমবেত আর্তনাদ ভেসে এল— ”একি! আপনি তো বলেছিলেন চুল্লি খারাপ হয়ে গিয়েছে। এ তো দেখছি ভাঙচুর চালানো হয়েছে। মেশিনটার এরকম হাল হল কী করে?”

ওদের মধ্যে একজন একটু এগিয়ে গিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে বলল, ”আপনি যে বলেছিলেন ভেতরে বডি আটকে রয়েছে। কোথায় বডি? কী ব্যাপার বলুন তো।”

মেঝেয় শুয়ে থাকা নিতাই নস্করের কাছ থেকে এ সব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া গেল না, কারণ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাওয়ার ফলে এতক্ষণে তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন, আর অজ্ঞান মানুষ কথা বলে না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *