নির্বাসন – ১২

নির্বাসন – ১২

এ বাড়ির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি যখন বউ হয়ে আসেন, তখন দোতলায় একটিমাত্র ঘর ছিল, সেখানে বড়ো ভাসুর থাকতেন। পুকুরপাড়েও কোনো আলাদা ঘর ছিল না। বাড়ির কোনো নামও ছিল না। লোকে বলত ‘উকিলবাড়ি’। রিকশা থেকে নেমেই পিতলের নেমপ্লেটে বাড়ির নাম দেখলেন ‘কারা কানন’। কে রেখেছে এ নাম কে জানে। বোধহয় বড়ো ভাসুর। এ বাড়ি এখন আর চেনা যায় না। অনেক সুন্দর হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ফুলের বাগানটি নষ্ট হয়ে গেছে। গোলাপঝাড়ে মাত্র অল্প ক’টি ফুল দেখছেন। অথচ একসময় অগণিত গোলাপ ফুটত।

এই গোলাপ নিয়েই কত কাণ্ড। আনিসের বাবার শখ হল গোলাপ দিয়ে খাঁটি আতর বানাবেন। রাশি রাশি ফুল কুচিকুচি করে পানিতে চোবান হল। সেই পানি জ্বাল দেয়া হল সারা দিন। সন্ধ্যাবেলা আতর তৈরি হল, বোটকা গন্ধে তার কাছে যাওয়া যায় না। বাড়িতে মহা হাসাহাসি। আনিসের বাবার মনমরা ভাব কাটাবার জন্যে তিনি সে-আতর মাখলেন। সেই থেকে তার নাম হয়ে গেল ‘আতর বৌ’! কী লজ্জা কী লজ্জা! বড়ো ভাসুর পর্যন্ত আতর বৌ বলে ডাকতেন। পরী তখন সবে কথাবলা শিখেছে। ‘র’ বলতে পারে না, সে ডাকত ‘আতল, আতল’। আজ কি সেই পুরনো স্মৃতিময় নাম কারো মনে আছে? জরীর মা যখন নাম জানতে চাইলেন, তখন তিনি কেন সহজ সুরে বললেন না, আমি আতর বৌ?

না, আজ তা সম্ভব নয়। এ বাড়িতে আতর বৌ বলে কেউ নেই। পুরনো দিনের সব কথা মনে রাখতে নেই। কিছু কিছু কথা ভুলে যেতে হয়। তিনি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পিছনের খোলা জায়গাটায় এসে পড়লেন। এখানে একটি প্রকাণ্ড পেয়ারাগাছ ছিল, ‘সৈয়দী পেয়ারা’ বলত সবাই। ভেতরটা লাল টুকটুক। গাছটি আর নেই। আতর বৌ হাঁটতে হাঁটতে পুকুরপাড়ে চলে গেলেন। কী পরিষ্কার পানি, আয়নার মতো ঝকঝক করছে। পুকুরপাড়ের ঘাটটি বাঁধান। তাঁর সময় বাঁধান ছিল না। সে-সময় কাঠের তক্তা দিয়ে ঘাট বাঁধা ছিল। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে থাকত সে-ঘাট। পা টিপে টিপে পানিতে নামতে হ’ত। এক বার তো পিছলে পড়ে হাত কেটে গেল অনেকখানি। রক্ত বন্ধ হয় না কিছুতেই, শাড়ি দিয়ে হাত চেপে ধরে ঘরে উঠে এসেছেন। সারা শাড়ি রক্তে লাল। দেখতে পেয়ে আনিসের বাবা সঙ্গে সঙ্গে ফিট। এমন জোয়ান মানুষ, অথচ একটু-আধটু রক্ত দেখলেই হয়েছে কাজ। আতর বৌ ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন।

তাঁর ক্ষণিকের জন্য মনে হল এ বাড়ি থেকে চলে গিয়ে তিনি ভুল করেছেন। এখানে থাকলে জীবন এমন কিছু মন্দ কাটত না। পরমুহূর্তেই এ-চিন্তা ছেটে ফেললেন। পুরনো জায়গায় ফিরে আসবার জন্যই এ-রকম লাগছে হয়তো। তিনি আসলে মোটেই অসুখী নন। তাঁর স্বামী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে কোনো গোপন দুঃখ নেই। নিজের চারদিকে নতুন জীবনের সৃষ্টি করেছেন। সেখানে দুঃখ, হতাশা ও গ্লানির সঙ্গে সঙ্গে ভালোবাসাও আছে। শুধু যদি আনিস তাঁর সঙ্গে থাকত! ছেলেমেয়েদের সঙ্গে হেসেখেলে বড়ো হ’ত।

কিন্তু এ-বাড়ির সবাই অহংকারী ও নিষ্ঠুর। আনিসকে তারা কিছুতেই ছাড়ল না। অবিমিশ্র সুখী কখনো বোধহয় হতে নেই।

‘আতর বৌ এসেছ?’

আতর বৌ চমকে দেখলেন–বড়ো ভাসুর, নিঃশব্দে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘তুমি বড়ো রোগা হয়ে গেছ আতর বৌ।’

তাঁর মুখে পুরনো দিনের ডাক শুনে আতর বৌ-এর চোখে পানি এল। বড়ো ভাসুর বললেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েরা সবাই ভালো?’

‘জ্বি, ভালো।’

‘তাদের নিয়ে আসলে না কেন, দেখত তাদের আনিস ভাইকে।’

‘আপনি তো চিঠিতে তাদের আনবার কথা লেখেন নি।’

আতর বৌ আঁচলে চোখ মুছলেন। বড়ো ভাসুর বললেন, ‘কাঁদছ কেন?’

‘না, কাঁদছি না।’

‘আনিসের সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার?’

‘না।’

‘তাহলে তার পাশে গিয়ে একটু বস। তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আজ আনিসের বড়ো দুঃখের দিন।’

আতর বৌ বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘কেন? আজ দুঃখের দিন কেন?’

বড়ো ভাসুর চুপ করে রইলেন। অনেক দিন পর আতর বৌকে দেখে তাঁর বড়ো ভালো লাগছে। তিনি হঠাৎ কী মনে করে বললেন, ‘আতর বৌ, আনিসের বাবাকে কখনো স্বপ্নে দেখ?’

আতর বৌ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে শান্ত গলায় বললেন, ‘দেখি।’

‘তুমি কিছু মনে করলে না তো?’

‘না, কিছু মনে করি নি। স্বপ্নের কথা কেন জিজ্ঞেস করলেন?’

‘এম্নি করেছি। কোনো কারণ নেই।’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *