নির্ঝঞ্ঝাটপুরে ঝঞ্ঝাটে টিয়ে – হিমাদ্রিকিশোর দাশগুপ্ত
দারোগা, শঙ্কাহরণ সরখেল আইনের মোটা বইটা টেবিলে হতাশভাবে রেখে বললেন, ‘না, টিয়াপাখিকে অ্যারেস্ট করার কোনো আইন এ বইতে লেখা নেই। আর কাল যদি সে এসেই পড়ে, তাহলে আর পাখিটাকে ধরে কী হবে? কপালে কী আছে কে জানে! তোর গিন্নিমা, আর, কাতলা-পুঁটি দুই ভাই-বোনকে সকালবেলা ওদের মামাবাড়ির বাড়ির ট্রেনে তুলে দিয়েছি। পানুচোরও তার পরিবার, মালপত্র সব নিয়ে ওই একই গাড়িতে গেল। যাবার সময় আবার বলে গেল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না দারোগাবাবু, গিন্নিমা আর বাচ্চাদের আমি ঠিক জায়গায় ঠিকমতো গাড়ি থেকে নামিয়ে দেব। আমি আর এখানে ফিরব না। যে আসছে সে ভয়ংকর লোক। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।’
‘সেও চলে গেল স্যার? তার সঙ্গে আমাদের কত দিনের সম্পর্ক! ঠিক যেন আত্মীয়ের মতন। কতদিন লক-আপের এপাশে-ওপাশে বসে আমরা সুখ-দুঃখের গল্প করেছি। সেও শেষে আমাদের এভাবেই ছেড়ে চলে গেল! কী স্বার্থপর!’—কথাগুলো বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলল কনস্টেবল কাশীনাথ কয়াল।
শঙ্কাহরণ তার অবস্থা দেখে পকেট থেকে রুমাল বার করে নিজের চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘কেঁদো না কাশীনাথ কেঁদো না। অন্য কাউকে কাঁদতে দেখলে আমি আবার ইমোশনাল হয়ে পড়ি। পানুচোরতো আর আমাদের মতো সরকারি চাকুরি করে না যে তাকে নির্ঝঞ্ঝাটপুরের থানা আগলে বসে থাকতে হবে। ঝঞ্ঝাট দেখলে সে যেখানে খুশি সটকে পড়তে পারে। নিজের প্রাণ তো তা নিজেকেই সামলাতে হবে। আর চোরদের সোর্স আমাদের থেকে বেশি হয়। হয়তো দশাননের ব্যাপারে ভয়ংকর কোনো খবর ওর কাছে আছে। তাই আমাদের ছেড়েই ও…।’
শঙ্কাহরণ এরপর বললেন, ‘শুধু আমার-তোমার জীবনই নিজেদের হাতে নেই। সরকারের হাতে বাঁধা। ইস একটাও জীবনবিমা যদি করানো থাকত তবে এতটা নিজের কথা ভাবতাম না আমি। তবে হাল ছাড়লে চলবে না। নিজেদের নিরাপত্তার কথা নিজেদেরই আমায়-তোমায় ভাবতে হবে। আচ্ছা লক-আপের চাবিটা কোথায়?’ কাশীনাথ চাবির কথা শুনে পালটা প্রশ্ন করল, ‘লকআপের চাবি দিয়ে কী হবে স্যার? ঝঞ্ঝাটে টিয়া না দশানন, কাকে ধরে রাখবেন?’ প্রশ্ন শুনে শঙ্কাহরণ উদাসভাবে বললেন, ‘টিয়াপাখি ধরার আইন ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে নেই, কেউ ধরলে বরং আইনে ফেঁসে যাবে। আর দশানন সম্বন্ধে যেসব কথা শুনছি, তাতে আমাদের কি তাকে ধরার ক্ষমতা আছে? লকআপের কথাটা আমি ভাবছি আমাদের নিরাপত্তার কারণে। ভাবছি কাল সকালবেলা আমরা দুজন লকআপের ভিতর ঢুকে ভিতর থেকে তালা চাবি দিয়ে দেব। ব্রিটিশ আমলের মজবুত দেওয়াল, মজবুত গরাদ। ওই দশানন যতই শক্তিধর হোক-না-কেন, চট করে তার ভিতরে ঢুকতে পারবে বলে মনে হয় না। বাইরে থেকে ওর ভিতর আমরা অনেক বেশি নিরাপদ।’ তাঁর কথা শুনে কাশীনাথ বলল, ‘ব্যাপারটা আপনি মন্দ বলেননি স্যার। কিন্তু চাবি নেই। পানুচোরকে তো আর লকআপে পুরে চাবি দেবার দরকার হত না, দরজা ভেজিয়ে রাখলেই হত। এছাড়া এই নির্ঝঞ্ঝাটপুরে কাউকে তো আর ওর ভিতরে পোরার দরকার হয়নি। চাবিটা বেকারই পড়ে ছিল। এ ব্যাপারটা আমাদের এস. পি. সাহেবেরও জানা আছে। গত মাসে এস. পি. সাহেবের মা পরলোক গমন করলেন। গুরুদশায় তাঁর কোমরে বাঁধার জন্য একটা চাবির দরকার ছিল। বড়ো মানুষের কোমর বাঁধার জন্য বড়ো চাবির প্রয়োজন। নইলে আত্মীয়কুটুম্ব নানা কথা বলতে পারে। তাই তিনি সে-সময় জমাদার ফাগুলালকে পাঠিয়ে চাবিটা নিয়ে গেছিলেন। গত হপ্তায় সদরে গিয়ে ফাগুলালের সঙ্গে দেখা হতে সে বলল, ‘ও-চাবি আর পাওয়া যাবে না। গঙ্গার ঘাটে ঘুনসি থেকে খুলে পড়ে ও-চাবিরও গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়েছে।’ আশাহত শঙ্কাহরণ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘তাহলে শেষ অংশটাও গেল, একেই বলে কপাল!’
এরপর তিনি তাঁর বিরাট বড়ো ভুঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘চিন্তায় চিন্তায় আমি একদম অর্ধেক হয়ে গেলাম। কপালে যা আছে হবে। তুমি বরং ভ্যান রিকশাটা নিয়ে এসো। বিকাল হয়ে এল। বগলাচরণ বিদ্যামন্দিরে নির্ঝঞ্ঝাটপুরের বিশিষ্ট লোকেদের নিয়ে একাট মিটিং ডেকেছি। সেটা সেরে সন্ধ্যার আগে ফিরে আসতে হবে। কিছুই বলা যাবে না। সেই দশানন হয়তো অ্যাডভান্স আজই চলে এল।’
‘হ্যাঁ, তাহলে এখনই বেরিয়ে পড়া ভালো’—এই বলে দারোগাবাবুর কথা শুনে রিকশা আনতে চলে গেল কাশীনাথ। আর শঙ্কিত শঙ্কাবরণ গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল, ‘নির্ঝঞ্ঝাটপুরে হঠাৎ একী ঝঞ্ঝাট এসে উপস্থিত হল।’
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা ভাববার মতোই বটে। শঙ্গাহরণের কনফিডেন্সিয়াল পুলিশ রিপোর্ট যা বলছে, তাতে এই ঝঞ্ঝাটের আগমনবার্তা প্রথম শোনা যায় গত সোমবার ভোর চারটে, আটান্ন মিনিটে, উনষাট সেকেন্ডে। হারাণ প্রতিহারের ছিয়ানব্বই বছরের ঠাকুমা পান্ত ঠাকুরান সে-সময় বাগানে গেছিলেন কুমড়ো ফুল তোলার জন্য। হঠাৎ কুমড়ো মাচার ওপর থেকে কার যেন গলা শোনা গেল, ‘সাবধান, এই বেলা প্রাণ নিয়ে কেটে পড়ো।’ ঠাকুমা তাকিয়ে দেখলেন কুমড়ো মাচার ওপর বসে আছে একটা টিয়াপাখি। পাখিটা এরপর বলল, ‘দশানন শনিবার আসছে।’ এই বলে টিয়া উড়ে গেল। ঠাকুমা কানে কম শোনেন, পাখির প্রথম কথাটা তিনি ভালো শুনতে পারেননি। আর দ্বিতীয় বারের কথাটা তিনি শুনলেন একটু অন্য ভাবে,—’গজানন প্রতিহার আসছে।’ গজানন প্রতিহার হল হারাণের স্বর্গত ঠাকুরদার বড়ো ভাইয়ের নাম। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই পান্তা ঠাকুরান জিভ কেটে লম্বা ঘোমটা টেনে ঘরে দৌড়ে এসে হারাণের আশিবছর বয়সি বাবাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে বলল, ‘ওরে খোকা ওঠ ওঠ। একটা টিয়ে এসে বলল, ‘তোর বড়ো জ্যাঠা আসছে।’ গজানন প্রতিহার গত হয়েছেন গত শতাব্দীতে। তিনি কোত্থেকে আসবেন? হারাণের বাবা-ঠাকুমা বয়স জনিত কারণে মাঝে মাঝে বাজে বকেন। হারাণ ভাবল ব্যাপারটা তাই। কিন্তু ঘটনাটা যদি এই সামান্য ব্যাপারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত তাহলে কোনো ব্যাপারই ছিল না। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই পাখিটা দেখা দিতে লাগল নির্ঝঞ্ঝাটপুরের সর্বত্র। কখনও নিত্যানন্দর টালির ছাদে, কখনও হেডমাস্টার গঙ্গাপদবাবুর উঠানে, কখনও পোস্ট অফিসের কার্নিশে সে পায়চারি করতে করতে বলতে লাগল ওই কথা, ‘সাবধান, এই বেলা প্রাণ নিয়ে কেটে পড়ো। দশানন শনিবার আসছে।’ আর আজ নিয়ে গত দু-দিন ধরে সর্বত্র উড়ে ঝঞ্ঝাটে পাখিটা একই কথা প্রচার করছে। প্রথমদিন ব্যাপারটাকে মজা হিসেবেই সকলে নিয়েছিল, দ্বিতীয় দিন কেউ কেউ ব্যাপারটা নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করল। ওদের সেই ভাবনা তৃতীয় দিন ঘোঁটটাকে বেশ জমিয়ে তুলল। দশানন নামটার মধ্যে কেমন একটা অন্যরকম গন্ধ আছে। আর শনিবার দিনটাও অশুভ। তাই দশানন যে ভয়ংকর কেউ হবে—এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হল সবাই। একদল মানুষ দাবি তুলল, ‘দশাননের দূত আতঙ্কসৃষ্টিকারী টিয়াটাকে অ্যারেস্ট করতে হবে।’ আবার পক্ষীপ্রেমী সংগঠন দাবি তুলল, ‘বন্যপ্রাণীকে অ্যারেস্ট করা যাবে না।’ এ ব্যাপার নিয়ে নিজেদের দাবির সমর্থনে প্রথম পক্ষ হেরিকেন হাতে ও দ্বিতীয় পক্ষ মোমবাতি মিছিল করে প্রশাসন অর্থাৎ শঙ্কাহরণের কাছে ডেপুটেশন দিয়ে গেল। গতকাল অর্থাৎ বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই উত্তেজনায় বাজার দোকানপাটের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল। বগলাচরণ বিদ্যামন্দিরের হেডমাস্টার গঙ্গাপদবাবু স্কুলে হাফছুটি দিয়ে দিলেন, পোস্টমাস্টার পত্রবন্ধুবাবু নিজেই জমে থাকা চিঠিগুলো বাড়ি বাড়ি বিলি করলেন, আর বলে এলেন, ‘এই তো আপনাদের শেষ চিঠি তাই নিজেই দিতে এলাম’। কিপটে কাঙালি হালদার জীবনে প্রথম এবং সম্ভবত শেষবারের জন্য ছেলেকে চার আনা পয়সা দিলেন গুজিয়া খাবার জন্য। আর সন্ধ্যা হতেই সকলে নির্ঝঞ্ঝাটপুর ছাড়তে লাগল আতঙ্কে। সে ধারা আজও অব্যাহত। স্বয়ং শঙ্কাহরণই যখন তার পরিবারকে এখানে রাখতে সাহস পেলেন না, তখন অন্যরা সে-সাহস কোথা থেকে পাবে? আজ সকাল থেকেই থমথমে পরিবেশ। মোড়ে মোড়ে ছোটো ছোটো জটলা। ওই দশানন যে কত ভয়ংকর। আর সে এলে কী কী হতে পারে তা নিয়ে আগাম জল্পনা চলছে লোকেদের মুখে। সবাই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিত। আর সবচেয়ে বেশি ভাবনা শঙ্কাহরণের মাথায়। কারণ তিনি নির্ঝঞ্ঝাটপুরের দারোগা। আজকাল কাক মরলেও লোকে প্রশাসনের দিকে ঢিল ছোড়ে। আর এ-তো সাংঘাতিক ব্যাপার। তেমন কিছু ঘটলে কেউ তাঁকে ছেড়ে কথা বলবে না। ইতিমধ্যে ব্যাপারটা নিয়ে বহু ভেবেও কোনো কুলকিনারা করতে পারেননি তিনি। তাই এ ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করার জন্য নির্ঝঞ্ঝাটপুরের গণ্যমান্য লোকেদের নিয়ে একটা সভা ডেকেছেন। যদি তাতে কোনো উপায় বার হয়।
কাশীনাথ ভ্যান রিকশা নিয়ে এল। শঙ্কাহরণ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে চড়ে বসলেন তাতে। কাশীনাথ উঠে পড়ল চালকের আসনে। এ থানায় কোনো জিপ নেই। এই ভ্যান রিকশা সম্বল। তাও আবার এটাও থানার নিজস্ব নয়। থানার পাশেই এক কাঠগোলার। চেয়ে-চিন্তে আনতে হয়। শঙ্কাহরণকে নিয়ে থানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল কাশীনাথ। শঙ্কাহরণ পথের দু-পাশ দেখতে দেখতে চললেন। কী শুনশান পথঘাট! অর্ধেক লোক পালিয়েছে, বাকি অর্ধেক দরজা দিয়ে ঘরে বসে আছে। কে জানে দশানন যদি দিন ভুল করে আজই চলে আসে। স্কুলবাড়ি বেশি দূরে নয়, কিছুক্ষণের মধ্যেই বগলাচরণ বিদ্যামন্দিরের সামনে এসে নামলেন শঙ্কাহরণ।
2
হেডমাস্টারের ঘরেই মিটিং। সে-ঘরে শঙ্কাহরণ ঢুকতেই সমবেত ভদ্রমণ্ডলী উঠে দাঁড়ালেন। শঙ্কাহরণ হেডমাস্টার গঙ্গাপদবাবুর পাশের চেয়ারে বসে একবার চারপাশে তাকালেন। লোক-সমাগমও আশানুরূপ হয়নি। তবে যারা আছেন সকলেই গণ্যমান্য ব্যক্তি। সকলেরই মুখ গম্ভীর। পাশের চেয়ারেই বসে ছিলেন বিশিষ্ট সমাজসেবী জননেতা অনাথবন্ধু চাকলাদার। শঙ্কাহরণ চেয়ারে বসতে-না-বসতেই ঘড়ি দেখে অনাথবন্ধু শঙ্কাহরণের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘নিন শুরু করুন। আমাকে আবার কলকাতায় জরুরি মিটিং-এ যেতে হবে পাঁচটার ট্রেনে।’
তাঁর কথা শুনে এত গম্ভীর পরিবেশের মধ্যেও মনে মনে হাসলেন শঙ্কাহরণ। কলকাতায় জরুরি মিটিং করতে যাওয়ার মতো অতোবড়ো নেতা তিনি নন। ময়দানের বড়ো মিটিং-এ কোনো সময় শ্রোতা হিসেবে যান হয়তো। আজ সকালেই শঙ্কাহরণ তাঁকে প্ল্যাটফর্মের টিকিট কাউন্টারে বগুলার চারটে টিকিট কিনতে দেখেছেন। অনাথবন্ধু সে-সময় তাঁকে খেয়াল করেননি। বগুলাতে তাঁর শ্যালকের বাড়ি। অর্থাৎ, নির্ঝঞ্ঝাটপুরের জনগণকে অনাথ করে দিয়ে দশাননের ভয়ে সপরিবারে বগুলা সটকাচ্ছেন অনাথবন্ধু।
যাইহোক এরপর গঙ্গাপদবাবুকে সভাপতি করে সভার কাজ শুরু হল। প্রারম্ভে অতিসংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন শঙ্কাহরণ। তিনি বললেন, ‘মাননীয় ভদ্রমণ্ডলী, আপনারা জানেন কী কারণে এই সভা। টিয়ার ব্যাপারে যে আসছে তার নাম আমরা সকলেই জানি। একটা ভয়ংকর কিছু যে ঘটতে চলেছে তা সহজেই অনুমেয়। তবে পুলিশ প্রশাসন সর্বদা আপনাদের পাশে আছেন…।’ কথাটা শুনেই পিছন থেকে কে যেন ফুট কাটলেন, ‘আমাদের না অনাথবন্ধুর পাশে?’ কথাটা শুনলেও শঙ্কাহরণ তার কথা গায়ে মাখলেন না। তিনি এই বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন যে, ‘আমি চাই এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে এই সভায় এ সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় সংবাদ ও পরামর্শ দিয়ে পুলিশকে সাহায্য করুন।’
শঙ্কাহরণের এই সংক্ষিপ্ত আবেদন বক্তৃতায় সাড়া দিয়ে প্রথমে বলতে উঠলেন জননেতা অনাথবন্ধু। বক্তৃতা শুরু করার আগে মাইক্রোফোনে একবার টোকা দিয়ে দেখে নেবার অভ্যাস তার। বক্তৃতার প্রারম্ভে অভ্যাস মতো টোকা দিতে গিয়ে মাইক্রোফোন না-পেয়ে টোকা দিয়ে দিয়ে বসলেন তাঁর সামনে বসে থাকা ইতিহাসবিদ কনিষ্ক ধরের টাকে। কনিষ্কবাবু সজ্জন মানুষ। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে কিছু বললেন না। অনাথবন্ধু স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় বলতে শুরু করলেন, ‘বন্ধুগণ, আজ আমাদের বড়ো সংকটের দিন। নির্ঝঞ্ঝাটপুরের মতো শান্ত জায়গাতে এক টিয়াপাখি যে ঝঞ্ঝটবার্তা বহন করে এনে যে ঝঞ্ঝাটের সূচনা করেছে আমি মনে করি তা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ইঙ্গিত। ওই টিয়া পাখি হল দশানন নামে কোনো সন্ত্রাসবাদী নেতার এজেন্ট। সে এখানে সন্ত্রাস ছড়াতে এসেছে। এলাকার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। তবে সন্ত্রাসবাদ শুধু নির্ঝঞ্ঝাটপুরের সমস্যা নয়, জাতীয় আন্তর্জাতিক সমস্যা…।’
এরপর অনাথবন্ধু সন্ত্রাসবাদ নিয়ে আলোচনা শুরু করে নির্ঝঞ্ঝাটপুরের গণ্ডি অতিক্রম করে দেশ থেকে বিদেশে চলে গেলেন। মিনিট চল্লিশ পর তিনি যখন তাঁর বক্তৃতা শেষ করলেন, তখন অনেকেই হাই তুলতে শুরু করেছে। ঝানু নেতা অনাথবন্ধু, জনগণকে কীভাবে উজ্জীবিত করতে হয় তা তাঁর বিলক্ষণ জানা। বক্তৃতার শেষে তিনি চিৎকার করে শঙ্কাহরণের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘অবিলম্বে সন্ত্রাসবাদী টিয়াপাখিকে গ্রেপ্তার করতে হবে।’ ঘরের কোণে অনাথবন্ধুর কয়েকজন সাঙ্গোপাঙ্গ ছড়িয়ে ছিল। তারা অমনি চিৎকার করে উঠল, ‘করতে হবে, করতে হবে, জবাব চাই জবাব দাও।’
যাদের ঘুম পাচ্ছিল, তাদের চটকা ভেঙে গেল। হতচকিত শঙ্কাহরণ একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জবাব দিলেন, ‘মানে, টিয়াপাখিকে অ্যারেস্ট করার কোনো প্রভিশন আইনে নেই।’
‘নেই মানে?’ একটা হুংকার ছাড়লেন অনাথবন্ধু। তারপর বললেন, ‘টিয়াপাখিটা সন্ত্রাসবাদী, ওকে টাডা আইনে গ্রেপ্তার করতে হবে। আর ওই দশানন এলে তাকেও।’
টিয়াপাখিকে টাডা আইনে গ্রেপ্তারের দাবি শুনে আরো ঘাবড়ে গেলেন শঙ্কাহরণ। অনাথবন্ধু ঘড়ি দেখে বুঝে নিলেন তাঁর ট্রেনের সময় এগিয়ে আসছে। তাই তিনি এরপর জনগণের হিতার্থে 24 ঘন্টার মধ্যে টাডা আইনে টিয়াকে গ্রেপ্তারের দাবিতে পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি করার অজুহাতে মিটিং থেকে ওয়াক-আউট করলেন। তবে অনুগামীরাও স্লোগান দিতে দিতে কক্ষ ত্যাগ করল। সম্ভবত তারাও দশানন কাল আসার আগেই এ তল্লাট ছাড়তে চায়।
অনাথবন্ধু চলে যাবার পর পরিবেশ শান্ত হতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। তারপর বলতে উঠলেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ কনিষ্ক ধর। সম্প্রতি তিনি, ‘নির্ঝঞ্ঝাটপুরের ইতিহাস’ নামে একটা ইতিহাস বই লিখেছেন। তিনি বললেন, ‘ভদ্রমণ্ডলী, আমি কোনো দীর্ঘ বক্তব্যে যাব না। শুধু সামান্য কটা কথা বলি,—টিয়া আর দশাননের আগমনের ব্যাপারে পিছনে একটা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। সম্প্রতি আমি পূর্ব পাড়ার হারানিধি হালদারের রান্নাঘরে মশলা বাটার শিলে এক দুর্লভ শিলালিপির সন্ধান পেয়েছি। তাতে লেখা আছে, আড়াই হাজার বছর আগে নির্ঝঞ্ঝাটপুর ছিল পঞ্চানন বলে এক অত্যাচারী রাজার রাজধানী। তিনি তাঁর শততম উত্তরপুরুষের নামকরণ আগাম উৎকীর্ণ করে গেছিলেন তাঁর শিলালিপিতে। যে নাম হল—দশানন। এই দশানন হল সেই দশানন। সে আসছে তার পূর্বপুরুষের রাজধানী উদ্ধার করতে। আর ওই টিয়া হল তাদের রাজবংশের প্রতীক। ঠিক যেমন পারসীয় এক সম্রাটের প্রতীক ছিল শিকারি বাজ। কাল এই নির্ঝঞ্ঝাটপুরের মাটিতে দ্বিতীয় কলিঙ্গ যুদ্ধ হবে। ‘হিস্ট্রি রিপিটস’! এই বলে বসে পড়লেন কনিষ্ক ধর।
এরপর উঠে দাঁড়ালেন সংস্কৃত পণ্ডিত তারানাথ কর্মকার। একটিপ নস্য নিয়ে নাক ঝেড়ে তিনি বললেন, ‘কলি কলি, আসলে ঘোর কলি! অনাচারে ভরে গেছে চারপাশ। চোদ্দো পুরুষের প্রাচীন ভাষা না-পড়িয়ে বাপ-মারা আজকাল ছেলে-মেয়েদের গলায় কাপড়ের ল্যাজ ঝুলিয়ে টোলের বদলে স্কুলে পাঠাচ্ছেন ম্লেচ্ছ ভাষা পড়ানোর জন্য। বলি ধর্ম বলে তো একটা জিনিস আছে, এত পাপ ধর্মে সইবে কেন? ওই দশানন বলে যে কাল আসছে, সে আসলে স্বয়ং কল্কি অবতার। দশানন প্রতীকী নাম। রাবণের মতো কল্কিও ধবংসের প্রতীক। কলির বিনাশ ঘটাতে সে আসছে। সংস্কৃত বিনা পরিত্রাণ নেই।’
তর্কালঙ্কারের ঠিক পিছনেই বসে ছিল তেলকলের মালিক মুকুন্দদাস খটমল। সে অল্প অল্প বাংলা বোঝে। পণ্ডিতের কথায় সে কী বুঝল কে জানে? হঠাৎ সে কাঁদো কাঁদো গলায় পণ্ডিতের উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘উও সমস্কৃত কী আছে? আপনি উও সমস্কৃত পাঁচ কেজি হামাকে মেহেরবানি করে দিন। যোতো রূপিয়া লাগে হামি দিব। হামার বহত ডর লাগছে। দশানন বহুত খতরনাক আছে। সমস্কৃত নিয়ে আপনি হামাকে বাঁচান।’
খটমলের কথায় হাসির রোল উঠল ঘরে। পণ্ডিতমশায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘মর্কট, সংস্কৃত কী কেজি দরে বেচার জিনিস?’ হাসির শব্দ আরও বাড়ল। হঠাৎ সবার গলা ছাপিয়ে কার যেন গলা ভেসে এল, ‘ভুল … সব ভুল’। শঙ্কাহরণ তাকিয়ে দেখলেন পিছনের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, মহাকাশ গবেষক নীহারিকা গুপ্ত। তিনি তিরিশ ফুট লম্বা ফাঁপা মুলিবাঁশের দু-পাশে আতসকাচ লাগিয়ে এই দূরনিরীক্ষণ বা টেলিস্কোপ যন্ত্র তৈরি করেছেন। আর সেই যন্ত্র চিলেকোঠার ছাদে বসিয়ে সারারাত জেগে তা দিয়ে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করেন। নীহারিকা গুপ্তর গলা শুনে হাসি থেমে গেল। পণ্ডিতমশাইও বসে পড়লেন। নীহারিকা গুপ্ত বললেন, ‘ভুল’। ও সব ‘পঞ্চাননের বংশধর’ বা ‘কল্কি অবতার’-এ সব থিওরি সব ভুল। আসলে ওই দশানন হল মঙ্গলগ্রহের জীব। গত রোববার রাতে আমি মঙ্গলের দিক থেকে এক উজ্জ্বল আলোকপিণ্ডকে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসতে দেখেছি—মঙ্গলের স্পেসশিপ। আমার হিসাবমতো আজ রাতেই তা ল্যান্ড করবে নির্ঝঞ্ঝাটপুরের মাটিতে। কাল সকাল থেকেই শুরু হবে যাকে বলে, ‘মার্স অ্যাটাক!’—মঙ্গলের আক্রমণ! আর আপনারা যাকে টিয়াপাখি বলে মনে করছেন, তা আসলে হল গ্রহান্তরের প্রাণীদের পাঠানো একটা রোবট মাত্র। সে এখানকার যাবতীয় খবরাখবর পাঠাচ্ছে সেই স্পেসশিপে। ‘স্টার ওয়ার এবার শুরু হতে চলেছে।’—এই বলে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য নিয়ে তিনি বসে পড়লেন।
এতক্ষণ চুপচাপ বসে একটা চিরকুটে বক্তাদের বক্তব্য নোট করছিলেন স্থানীয় ‘চোখাচোখি’ কাগজের সাংবাদিক, ভূপাল সাহা। তিনি কবিতাও লেখেন। সম্প্রতি দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘হাতির গান’ আত্মপ্রকাশ করেছে। এবার তাঁর বলার পালা। চোখে চশমা একমুখ দাঁড়ি কাঁধে ব্যাগ নিয়ে উঠে তিনি বললেন, ‘আমি মুখে কিছু বলব না। আমার যা বক্তব্য তা আগামী সংখ্যায় ‘চোখাচোখি’তে দেখতে পাবেন। তবে আমি স্বভাব কবি। তাই সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে এখানে বসেই যে কবিতাটা লিখে ফেললাম সেটা আপনাদের শোনাচ্ছি,—’আতা গাছে টিয়াপাখি, ডালিম গাছে ভৌযটিয়াপাখিটা আসলে হল, দশাননের ফেউ’।
কবিতা শুনে একজন জানতে চাইল, ‘প্রথম লাইনের শেষ শব্দটা ‘মৌ’ না, ‘ভৌ’? ভৌ তো কুকুর। সে কী করে ডালিমগাছে উঠবে?’
ভূপাল সাহা তাকে ধমকে বলল, ‘আধুনিক কবিতা কিছু বোঝো? এটা আধুনিক কবিতা। সব শব্দের মানে খুঁজতে যেও না। সাহিত্য বুঝতে হলে আমার লেখা মন দিয়ে পড়ো।’
ধমক খেয়ে প্রশ্নকর্তা চুপ করে গেল ঠিকই, কিন্তু কাছেই বসে থাকা পত্রবন্ধু আধুনিক কবিকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘আপনি কি হজমের ওষুধ খান মশাই? আমি তো কত ওষুধ খাই, কিন্তু কিছুতেই হজম হয় না? ছোটোবেলা থেকে শুনে আসা কবিতা অদলবদল করে হজম করে দিলেন?’
তার কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেন আগুনে ঘৃতাহুতি হল! ভূপাল সাহা চিৎকার করে উঠলেন, ‘কী, এত বড়ো সাহস! আমার কবিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ? বাগনান থেকে বগুলা পর্যন্ত ছিয়াত্তরটা কাগজে আমার কবিতা ছাপা হয়। আমার লেখা নিয়ে প্রশ্ন? ‘চোখাচোখি’-র আগামী সংখ্যায় আপনার পোস্ট অফিস নিয়ে লিখে মজা বুঝিয়ে দেব।’
পত্রবন্ধু তো এবার খেপে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন, তুমি আবার কী মজা বোঝাবে? তোমার ঘাতঘোতও আমার জানা আছে। তোমার প্রথম কবিতার বইতো কানুলাল শতপথির বই-এর জেরক্স কপি। দ্বিতীয় বইটা কার কে জানে…?
সভাঘরে আবার একটা চিৎকার চেঁচামেচির সৃষ্টি হল। কে কী বলছে শঙ্কাহরণ কিছুই বুঝতে পারছেন না। কেউ কেউ বিড়ালের ডাক ডাকতে লাগল। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে শঙ্কাহরণ শেষপর্যন্ত বাজখাঁই গলা করে চিৎকার করে উঠলেন, ‘চো-ও-ও-প…।’
হাজার হোক পুলিশের ধমক, তা খেয়ে গোলযোগ থেমে গেল।
শঙ্কাহরণ এরপর বললেন, ‘অনেক হয়েছে আর নয়। ওই দশানন যে ভয়ংকর লোক তা আপনাদের সকলের কথায় বেরিয়ে এল। এখন তাকে কীভাবে রোখা যাবে বলুন?’ তাঁর কথা শুনে কনিষ্ক ধর বললেন, ‘এ তো আপনার দায়িত্ব আমরা কী বলব? তাকে সমর্থন করে পণ্ডিতমশাই বললেন, ‘ঠিক তাই।’ খটমল বললেন, ‘সহি বাত।’ নীহারিকা গুপ্ত বললেন, ‘ঠিকই তো।’ ভূপাল সাহা বললেন, ‘একদম ঠিক। তাকে রোখার দায়িত্ব পুলিশকে নিতে হবে।’
শুধু একজন ফিচেল গোছের ছোঁড়া বলল, ‘তাকে রোখার একটা পথ অবশ্য আছে। ওই দশানন এলে তাকে কনিষ্ক গুপ্তর লেখা ইতিহাস বা ভূপাল সাহার কবিতা শোনানো হোক। তাহলে সে কল্কি অবতারই হোক আর মঙ্গলগ্রহের লোকই হোক, পালাতে পথ পাবে না।’
এই কথা শেষ হবার পর এবার যে গোলযোগ শুরু হল তা যে আর থামোনো সম্ভব নয় বুঝতে পেরে এবার সভা ছেড়ে বেরিয়ে কাশীনাথের ভ্যান রিকশায় উঠে পড়লেন শঙ্কাহরণ। কাশীনাথ সিটে উঠে বসে প্যাডেলে চাপ দিয়ে বলল, ‘স্যার কিছু হল?’
শঙ্কাহরণ সোজা থানায় চলে এলেন। রাত দশটা অব্দি গালে হাত দিয়ে বসে দশাননের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে কোনো কূলকিনারা না-পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে কাশীনাথকে বললেন, ‘কাল সকাল সকাল এসো আমি আর তুমি মোকাবিলা করবো দশাননের। কপালে যা আছে হবে।’
3
পরের দিন ভোরবেলা যখন কাশীনাথ থানায় এসে উপস্থিত হল, তখন শঙ্কাহরণ থানায় লাগোয়া ‘পাত-কো’-তে চান করছেন।
সূর্য মাঝগগনে না-গেলে কোনোদিন স্নান করেন না তিনি। তাও আবার তিনদিন অন্তর গ্রীষ্মকালে, গরম জলে। আর শীতকালে এসবের কোনো ব্যাপারই নেই। শীত-গ্রীষ্মে শঙ্কাহরণের জলে ভীষণ ভয়। গায়ে জল পড়লেই তার মাথার চুল খাড়া হয়ে ওঠে। অতিষ্ঠ হয়ে গিন্নিমা বা তাঁর ছেলেপুলেরা তাঁর গায়ে জল ঢেলে দেন। ব্যাপারটা কাশীনাথেরও জানা। তাই শঙ্কাহরণকে এই ভাবে স্নান করতে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে কাশীনাথ তাকাল তার দিকে।
শঙ্কাহরণ কুয়োর ঠান্ডাজল গায়ে ঢালতে ঢালতে কাশীনাথের উদ্দেশ্যে হেসে বললেন, ‘বুঝলে কাশীনাথ, ভয়কে জয় করছি। যে দশাননের সঙ্গে লড়তে যাচ্ছে সামান্য ঠান্ডা জলে তার কী ভয়? তবে বুঝলে ভায়া ঠান্ডা জলে স্নান করতে এত আনন্দ আগে জানা ছিল না। যদি ফিরে আসি তবে এবার থেকে রোজ স্নান করব।’
স্নান সেরে থানায় এসে একটা পাটভাঙা ইউনিফর্ম বার করলেন তিনি, এটা তিনি যত্ন করে রেখেছিলেন, যদি কোনোদিন পুলিশ পদক পান তাহলে সেদিন পরে পদক আনতে যাবেন বলে। তা আর বোধহয় হল না। ইউনিফর্ম পরে কোমরে রিভলবার গুঁজে কাশীনাথকে নিয়ে থানা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। গন্তব্য চৌরাস্তার মোড়। ওই মোড়ই নির্ঝঞ্ঝাটপুরের প্রবেশপথ। ওখানে দশাননের মোকাবিলা করবেন শঙ্কাহরণ।
সুন্দর সকাল। অনেকদিন পর এমন সকালে পায়ে হেঁটে বেড়ালেন শঙ্কাহরণ। স্নান সেরে তাঁর মনটাও বেশ ফুরফুরে। তবে পথে-ঘাটে কোনো লোকজন চোখে পড়ল না শঙ্কাহরণের। সম্ভবত সকলেই দশাননের ভয়ে গা ঢাকা দিয়েছে। কিন্তু শঙ্কাহরণের সব শঙ্কা যেন কেটে যাচ্ছে। বুকের ভিতর কে যেন গান গাইছে, ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা, খুশিকী গীত গায়ে যা…।’ বেশ দৃপ্ত ভঙ্গিতে হাঁটতে লাগলেন শঙ্কাহরণ।
তাকে এভাবে হাঁটতে দেখে কাশীনাথও বেশ উৎসাহিত হয়। তাকে বলল, ‘স্যার, আপনাকে কিন্তু সত্যিই আজ পুলিশ পুলিশ লাগছে।’
শঙ্কাহরণ মৃদু হেসে বললেন, ‘কেন আগে কি পুলিশ ছিলাম না? আসলে এতদিন ঠিক কাজ করার সুযোগ পাইনি। জানো কাশীনাথ, আমাদের বংশে কিন্তু বেশ কয়েকজন সাহসী পুরুষ ছিলেন। আমার প্রপিতামহ শত্রুদমন সরখেল একবার ছেলেবেলায় ব্রিটিশ আমলে এক পুলিশ কনস্টেবলকে ছাদ থেকে গুলতি ছুড়েছিলেন। আর, আমার সেজো দাদু, তমসাহরণ একবার একলা ট্রেনে চেপে ছেলেবেলায় কলকাতা গেছিলেন। তাদেরই তো রক্ত বইছে আমার দেহে। সাহস আমারও কম নেই।’
শঙ্কাহরণ এরপর সম্ভবত তাঁর পিতৃপুরুষদের গৌরবগাথার আরো কয়েকটা নিদর্শন শোনাতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ কাশীনাথ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে চেঁচিয়ে উঠল,—’ওই যে স্যার, ওই ওই।’
শঙ্কাহরণ সঙ্গে সঙ্গে তাকালেন সেদিকে। কাছেই একটা ভাঙা পাঁচিলের উপর বসে আছে টিয়াটা। পা দিয়ে ধরে একটা লঙ্কা খাচ্ছিল সে। শঙ্কাহরণ তার দিকে তাকাতেই সে স্পষ্ট বলে উঠল, ‘সাবধান, এই বেলা প্রাণ নিয়ে কেটে পড়, শনিবার দশানান আসছে।’
শঙ্কাহরণ শুনে পাখিটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘আমি শঙ্কাহরণ সরখেল, আমাকে কাটতে বলছ! কোথায় সে দশানন না বিভীষণ? নির্ঝঞ্ঝাটপুরের কলঙ্ক আজি ভঞ্জিব আহবে।’
পাখিটা তার চিৎকারে না-ঘাবড়িয়ে ধমকের সুরে এবার বলে উঠল, ‘কাট, কাট।’
তাই শুনে শঙ্কাহরণ আরো উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘কী? আবার কাটতে বলা হচ্ছে? দেখাচ্ছি তোমার মজা!’
কোমর থেকে রিভলবার বার করলেন শঙ্কাহরণ। পুলিশ কোডে লেখা আছে, অপরাধীকে ভয় দেখাবার জন্য আগে শূন্যে গুলি ছুড়তে হয়, তাতে কাজ না-হলে পায়ে গুলি, তারপর দেহে। আইনমাফিক প্রচণ্ড শব্দে শূন্যে গুলি ছুড়লেন তিনি। এতে কাজ হল। পাখিটা ভয়ে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ল আকাশে।
শঙ্কাহরণ কোমরে রিভলবার গুঁজে কাশীনাথকে বললেন, ‘বেটা মনে হয় আমাকে লাস্ট ওয়ার্নিং দিতে এসেছিল। দেখলি শেষপর্যন্ত আমার সামনে দাঁড়াতেই পারল না।’ এই বলে শঙ্কাহরণ দৃপ্ত পায়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
চৌরাস্তার মোড়ে পৌঁছে একটা গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসলেন শঙ্কাহরণ। অর্থাৎ পুলিশি ভাষায় যাকে বলে পজিশন নেওয়া। ফাঁকা রাস্তার মোড়। দশাননের ভয়ে সব শুনশান। তার আগমনের প্রতীক্ষা করতে লাগল শঙ্কাহরণ। বেলা ক্রমে বাড়তে লাগল। বসে বসে ঘামতে লাগলেন দুজনে।
বেলা তখন ঠিক বারোটা। হঠাৎ একটা কালো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়াল রাস্তার মোড়ে। শঙ্কাহরণ চাপা স্বরে বললেন, ওই মনে হয় এসে গেছে নামলেই অতর্কিতে ঘিরে ধরতে হবে। যা হয় হবে। করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে।’
গাড়ি থেকে নামল দুজন লোক। একজন মধ্যবয়সি টেকো একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি, চোখে চশমা, পরনে কালো সুট, অপরজন চিমশে চেহারার বছর ছাব্বিশের যুবক। তারা গাড়ি থেকে চারপাশে তাকাতে লাগল।
কাশীনাথ বলল, ‘এদের কাউকে দেখতে ঠিক দশানন বলে মনে হচ্ছে না?’
শঙ্কাহরণ চাপাস্বরে কাশীনাথকে বললেন, ‘সম্ভবত ওই টেকো লোকটাই দশানন। ক্যামুফ্লেজ করেছে। একটা সঙ্গীও এনেছে দেখছি। ভয়ের কোনো কারণ নেই। সময় দেওয়া যাবে না, এখনই ওদের ঘিরে ফেলতে হবে। অ্যাকশান।’ এই বলে রিভলবার উঁচিয়ে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে একলাফে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন শঙ্কাহরণ। আর তার সঙ্গে কাশীনাথ। আকস্মিক পুলিশের উর্দিধারী দুজন লোককে এভাবে সামনে আবির্ভূত হতে দেখে আগন্তুকগুলো কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। টেকো লোকটার বুকে রিভলবার ঠেকিয়ে শঙ্কাহরণ হুংকার ছেড়ে বললেন, ‘আপনি কি দশানন?’
লোকটা বলল, ‘না, মানে, তবে…’
আর একটা হুংকার ছেড়ে শঙ্কাহরণ বললেন, ‘তবে? কি? পঞ্চাননের বংশধর? কল্কি অবতার, নাকি মঙ্গলগ্রহের জীব? যেই হোন না-কেন আজ নিস্তার নেই। আপনাদের থানায় যেতে হবে।’
টেকো লোকটা এবার মেয়েলি স্বরে মিন মিন করে জবাব দিল, ‘না, না, আমি ওসব কেউ নই। আমি হলাম বিখ্যাত ফিল্ম ডিরেক্টর আলোছায়া সাঁপুই। আর এ হল আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট বদনা বাড়ই। আমরা তো থানাতেই যাচ্ছিলাম, অফিসারের সঙ্গে দেখা করার জন্য। নির্ঝঞ্ঝাটপুর থানাটা কোনদিকে তা কাউকে জিজ্ঞেস করার জন্য গাড়িটা এখানে থামিয়েছি।’
‘আলোছায়া সাঁপুই’ নামটা কোথায় যেন শুনেছেন বলে মনে হল শঙ্কাহরণের। তিনি তাঁর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কেন থানায় যাচ্ছিলেন কেন? আমিই থানার ইনচার্জ শঙ্কাহরণ সরখেল।’
আলোছায়াবাবু শঙ্কাহরণের পরিচয় পেয়ে যেন ধাতস্থ হলেন। বেশ উৎফুল্ল হয়ে তিনি রিনি রিনি স্বরে বললেন, ‘তাই নাকি মশাই, তাই নাকি! এস. পি. সাহেব তো আমাকে আপনার কাছেই চিঠি দিয়ে পাঠালেন। ব্যাপারটা এখানেই তাহলে বলি আপনাকে। আমি চোরেদের জীবন নিয়ে একটা ফিলম করছি। আর্ট ফিলম তো, তাই রিয়েল এক্সপিরিয়েন্স জানার জন্য আপনাদের নির্ঝঞ্ঝাটপুরের পানুচোরকে আমাদের শুটিং স্টুডিয়োতে কাজে নিয়েছিলাম। সে আমাদের চুরির অভিজ্ঞতা শোনাবার সঙ্গে সঙ্গে ফাইফরমাশও খাটত। দিনসাতেক হল সে স্টুডিয়োর বেশ কিছু মালপত্র নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে আর তার সঙ্গে আমার ফিলমের চোরের ভূমিকায় অভিনয় করা নায়ক, সুদর্শন চাকলাদারের পোষা টিয়াপাখিটাও নিয়ে এসেছে। পাখির শোকে আমার নায়ক পাগল হয়ে গেছে। শুটিং বন্ধ। এস. পি. সাহেবের চিঠি এনেছি। যদি পানুচোরকে ধরে মালপত্র আর বিশেষত পাখিটাকে উদ্ধার করে দেন…’
আলোছায়াবাবুর কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ রাস্তার পাশের গাছের মাথা থেকে ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর, ‘সাবধান, এই বেলা প্রাণ নিয়ে কেটে পড়। দশানন শনিবার আসছে।’
চমকে উঠে সবাই তাকাল গাছটার দিকে। বদনা বাড়ই উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল, ‘স্যার, ওই তো আমাদের পাখি। আই মিঠু, আয় আয়—’
পরিচিত লোককে দেখে টিয়াটা গাছ থেকে উড়ে এসে বদনার কাঁধে বসল।
হতভম্ব শঙ্কাহরণ পাখিটার দিকে তাকিয়ে আলোছায়া বাবুর উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কিন্তু পাখিটা ও কথা বলে বেড়াচ্ছে কেন?’
আলোছায়াবাবু হেসে বললেন, ‘আমাদের শুটিং স্পটের পাশেই একটা খাঁচায় ঝোলানো থাকত পাখিটা। ও যা বলছে তা আমার ফিলমেরই একটা ডায়ালগ। আর্ট ফিলম তো, তাই সাতাশ বার ডায়ালগ থ্রোর পর সিনটা টেক করেছি। দশানন বলে ফিলমে একটা ক্যারেকটার আছে। বারবার শুনে পাখিটা ডায়ালগটা শিখে ফেলেছে। ওটা ও বলে। আলোছায়াবাবুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পাখিটা এবার ধমকের সুরে বলে উঠল—’কাট, কাট—’,
এ ‘কাট’-এর অর্থ যে কেটে পড়া নয়, এবারে তা বুঝতে পারলেন শঙ্কাহরণ। তবে পানুচোর যে অনেক দূর কেটে পড়েছে তা বুঝতে অসুবিধা হল না তাঁর।