নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি – ৯

না চাইলে পৃথিবীতে কিছু পাওয়া যায় কি?

দাবি না করলে কেউ কিছু ছাড়তে চায় না। জগদানন্দ বোসের মত মানুষ দিয়ে সংসারটা তৈরি নয়। তিনি না চাইতে দিতেন। সাতটি সন্তানের সবরকম সম্ভাব্য প্রয়োজনের দিকে তাঁর কী সজাগ দৃষ্টি ছিল। বাবার কথা ভাবতে ভাবতে ঈশিতার চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। কতদিন আগে বাবা মারা গিয়েছেন ; কিন্তু এখনও তাঁর স্নেহের কথা মনে পড়লে ঈশিতার ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করে।

জীমূতবাহনের বাংলোয় বসে স্মৃতি রোমন্থন করলেও ঈশিতার হাত দুটো বেকার বসে ছিল না। দুটো উলের কাঁটা দ্রুতবেগে টানাপোড়েন করতে করতে সোয়েটার বুনে চলেছিল। বড় নাতনী ঐন্দ্রিলার জন্মদিন দ্রুত এগিয়ে আসছে, আর সময় নষ্ট করলে চলবে না।

ঐন্দ্রিলাকে সামান্য একটা সোয়েটার দিচ্ছেন তার দিদিমা। আর তার মা‘র জন্মদিনে জগদানন্দ কী না করতেন। এতো কাজের মধ্যেও প্রিয়ংবদার জন্মতারিখটা তিনি ঠিক মনে রেখে দিতেন। ড্রাইভারকে ডেকে চুপিচুপি নাতনীর হাত ধরে বেরিয়ে পড়তেন। হোয়াইটওয়ে লেডলো, আমি নেভি স্টোর কিংবা হল অ্যাণ্ডারসন উজাড় করে বাড়ি ফিরতেন।

ঈশিতা নিজেই বাবাকে বকেছেন। কিন্তু বাবা শোনেননি। হেসে বলতেন, “ওরা যখন বড় হবে, তখন তো আর বেঁচে থাকবো না। ছোটবেলার উপহারের একটু-আধটু স্মৃতি আবছা ভেসে উঠে ওদের দাদুর কথা মনে করিয়ে দেবে।”

অতবড় ব্যারিস্টার ছিলেন, সবার মনের কথা কত সহজে বুঝতে পারতেন। সত্যি, প্রিয়ংবদা দাদুর উপহারের কথা মনে রেখেছে। আর প্রিয়ংবদার মেয়ে তার দাদু সম্বন্ধে কী মনে রাখবে? নিজের মেয়েরই খবরা-খবর রাখেন না জীমূতবাহন, তার নাতনী!

রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে ঈশিভা ডাক দিলেন, “বেয়ারা।”

হরিমোহন বেয়ারা কথাটা মোটেই পছন্দ করে না। সবাই জানে ল্যাবরেটরিতেই সে কাজ করে। ওইভাবে ডাকলে একটু দুঃখ হয়। কিন্তু মেমসায়েবকে সে একটু ভয়ও পায়, কিছু বলতে সাহস করে না।

মেমসায়েবের সামনে এসে হরিমোহন সেলাম করলে। “সেন সায়েবকে খবর দিয়েছো?” ঈশিতা জিগ্যেস করেন। এই এক কাজ হয়েছে তাঁর। কোথাও কোনো ডিসিপ্লিন নেই, প্রতিবার খাবার সময় ডেকে পাঠাতে হবে।

প্রায় আধঘণ্টা আগে বিকেলের চায়ের নোটিশ পাঠিয়েছেন ঈশিতা। কিন্তু কোথায় জীমূতবাহন?

বিরক্ত ঈশিতা বললেন, “ঠিকভাবে বলেছো তো?”

“হ্যাঁ, মেমসায়েব।

উল বোনা বন্ধ রেখে ঈশিতা বাঁ হাতের মণিবন্ধটা একটু চুলকে নিলেন। তারপর গম্ভীরভাবে বললেন, “চায়ের জল চাপানো হয়েছে তো?”

হরিমোহন জানালে, “উনুনে এখন অন্য জিনিস রয়েছে।”

“খাবার কিছু চাপিয়েছ বুঝি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ মেমসায়েব, স্পেশাল খাবার।”

“স্পেশাল খাবার! আমাকে না জিগ্যেস করেই ..

“আপনাকে কী জিগ্যেস করবো? সায়েব নিজে হুকুম দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি করতে।”

অপমানে ফেটে পড়বার ইচ্ছে হলো ঈশিতার। কলকাতার বাড়ি হলে এতোক্ষণে দূর করে তাড়িয়ে দিতেন হতচ্ছাড়া চাকরটাকে। সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়লো জীমূতবাহনের ওপর। ইচ্ছে করেই লোকটা তাঁকে সারাজীবন ধরে বার বার অপমান করে চলেছে।

“শোনো হরিমোহন, ওই স্পেশাল খাবার তুমি তোমার সায়েবকেই শুধু খাইয়ে আসবে। আমাকে শুধু চা দেবে।”

হরিমোহন ভ্যাবাচাকা খেয়ে বললে, “সে কি মেমসায়েব! সায়েবকে খাওয়াবো কি?”

চিৎকার করে উঠলেন ঈশিতা, “চাকর-বাকরকে একবারের বেশী হুকুম দিই না আমি। আমাকে শুধু চা দেবে।”

জীমূতবাহন সেই সময়ে হাজির হয়ে ব্যাপারটা আরও সঙ্গীন করে তুললেন। “তোমার না গ্যাসটিকের গোলমাল রয়েছে। শুধু চা খাবে কি?” জীমুতবাহন চেয়ারে বসতে বসতে বললেন।

হরিমোহনকে ওখান থেকে চলে যেতে বললেন ঈশিতা। তারপর উলের কাঁটা দুটো সরিয়ে দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। “তুমি আমাকে এইভাবে চাকর-বাকরের কাছেও অপমান করছো কেন?”

বিস্ময়ে স্তম্ভিত জীমূতবাহন কী করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। “কী বলছো ঈশিতা? তোমাকে আমি অপমান করবো?”

“হরিমোহন স্পেশাল খাবারের হুকুম ল্যাবরেটরি থেকে নিয়ে আসবে, অথচ আমি বাড়িতে বসে আছি।”

জীমূতবাহন এবার হেসে ফেললেন। হরিমোহনকে হাঁক দিয়ে ডাকলেন। হরিমোহন আসতেই বললেন, “কী স্পেশাল খাবার তৈরি করছো?”

“সাবু চিংড়ি।” হরিমোহন উত্তর দিলে।

“শুকনো চিংড়িমাছের সঙ্গে সাবু সেদ্ধ করা।”

ঈশিতা শিউরে উঠে বললেন, “এ্যা এখানে এসবও খাচ্ছ তুমি?”

“আমি নয়। কয়েকটা পোকার জন্যে স্পেশাল তৈরি করতে বলেছিলাম হরিমোহনকে।”

শাস্তভাবে বললেও, ঈশিতার আচরণে গভীর দুঃখ পেলেন জীমূতবাহন। কিন্তু ঈশিতা নিজের ভুল বুঝতে পারলেও দোষ স্বীকার করলেন না।

কেন করবেন? জীবনে কোনোদিন ঈশিতা নিজের ভুল স্বীকার করেননি।

বিকেলের একফালি পড়ন্ত রোদ ঈশিতার ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। ঈশিতা গম্ভীরভাবে স্বামীর কাপে চা ঢেলে দিয়ে আবার উলের কাঁটা নিয়ে বসলেন। কাঁটা দিয়ে মনের মধ্যে জীমূতবাহনও লক্ষ্যহীনভাবে বুনতে আরম্ভ করলেন। দ্রুতবেগে বুনেই চলেছেন, কিন্তু কোনো প্যাটার্ন নেই। কিংবা থাকলেও খুবই সাধারণ—একটা সোজা, একটা উল্টো। একবার উল্টো পথে অতীতে ফিরে চলেছেন, পরমুহূর্তেই ফিরে আসছেন বর্তমানে।

আজও ঈশিতা উল বুনছেন, আর বিয়ের পরই স্বামীকে তিনি যে সোয়েটারটা বুনে দিয়েছিলেন, সেটার কথা মনে পড়ছে জীমূতবাহনের বাড়ির কাউকে না বলে নিজেই দোকান থেকে পশম কিনে এনেছিলেন ঈশিতা। আর সুতো দিয়ে কতবার যে স্বামীর বুকের, গলার এবং হাতের মাপ নিয়েছিলেন। আধা তৈরি সোয়েটারটা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রায়ই স্বামীর বুকের কাছে ধরে ঈশিতা যখন মাপ নিতেন, তখন কপট বিরক্তি প্রকাশ করতেন জীমূতবাহন। কিন্তু কি সুন্দরই যে লাগতো!

বিজ্ঞানের নেশায় পাগল জীমুক্তবাহন এতোদিন পরেও দাম্পত্যজীবনের সেই ছোট ছোট মধুর ছবিগুলো বিস্মৃত হননি।

ঈশিতাকে আজও কত টাটকা মনে হয়। এতোদিনের সংসারযাত্রা তাঁর দেহের ওপর তেমন ছায়া ফেলতে পারলো না–অথচ কত সহজে বুড়িয়ে গেলেন জীমূতবাহন।

কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীরা আরও কাছে চলে আসে, না দূরে সরে যায়? জীমূতবাহন বুঝতে পারছেন, তাঁদের কক্ষপথের দূরত্ব ক্রমশই যেন বেড়ে চলেছে। নিজের কর্মজীবন ছাড়া আর সব বিষয়েই তো ঈশিতার আধিপত্য তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তবু ঈশিতার হৃদয় জয় করতে পারলেন না তিনি। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির পাগলামোতে মত্ত হয়ে যে লোক সন্তানদের কষ্টে ফেলে, তার প্রতি ঈশিতার যে কোনো দুর্বলতা নেই, একথা তিনি প্রায়ই বুঝিয়ে দেন।

বিয়ের রজত-জয়ন্তীর পরও দাম্পত্য জীবনের এই সব সন্দেহ ও দুশ্চিন্তা সত্যি হাস্যকর। এসব নিয়ে অযথা সময় ব্যয় করার কোনো মানে হয় না। মনকে এবার একটা প্রচণ্ড বকুনি লাগালেন জীমূতবাহন। ঈশিতার জন্যে কম ভালবাসা তাঁর হৃদয়ে জড়ো হয়ে নেই। এই এতোদিন ধরে বেচারা ঈশিতা স্বামীর জন্যে কম কষ্ট স্বীকার করেননি। জগদানন্দ বোসের মেয়ে নিজেকে অনেকটা নামিয়ে এনেছেন, এর থেকে বেশী পরিবর্তন করা বোধ হয় সম্ভবও নয়।

রোদের সোনালী রেখাটা এবার ঘাড় থেকে সরে গিয়ে ঈশিতার গালের ওপর এসে পড়েছে। যেন নতুন স্টাইলে সোনালী লিপস্টিক লাগাবার সরঞ্জাম করছেন ঈশিতা।

জীমূতবাহন বললেন, “ঈশিতা, এখানে একলা একলা তোমার বোধ হয় খুব খারাপ লাগছে।”

উলের মধ্য থেকে চোখ না তুলেই ঈশিতা বললেন, “বোধ হয় উল একটু কম পড়বে। ভগবানের আশীর্বাদে ঐন্দ্রিলার স্বাস্থ্য ভাল, আর প্রিয়ংবদা লিখেছে, চড় চড় করে বড় হয়ে যাচ্ছে।”

সত্যি আশ্চর্য লাগে ঈশিতার। এই তো সেদিন যেন তাঁর বিয়ে হলো। মাথায় টোপর দিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে তাকাতে জীমূতবাহন বিয়ে করতে এলেন। তখনও ঈশিতা আশা করেছেন, জীবনটা কত সহজভাবে কেটে যাবে। আসলে জীবনসংগ্রাম জিনিসটা যে কী, তা বাবার জন্যে কোনোদিন জানতেই হয়নি। কত স্বপ্ন ছিল ঈশিতার। কবিগুরু হাসতে হাসতে জগদানন্দ বোসকে বলতেন, “তোমার ছোটমেয়ের মধ্যে সথী-ভাবটাই প্রবল।”

সবাই তাই ভাবতো। সখী ঈশিতা নিজেও, কিন্তু কি জানি কোথায় কী হলো, বিধাতা কোথাকার কোন্ গুপ্ত সুইচ টিপে দিলেন, সব পাল্টে গেল। প্রিয়ংবদার জন্ম থেকেই সখীটা কোথায় হারিয়ে গেল। ‘তুমি মা, তুমি মা–মা হওয়া অত সহজ নয়’—এই কথাগুলো কে যেন ঈশিতার কানের কাছে নিরন্তর বলে চলেছে।

এই তো সেদিন ঈশিতা কোলে করে প্রিয়ংবদাকে দুধ খাওয়াতেন, পেরমবুলেটর ঠেলে মেয়েকে নিয়ে বেড়াতে বেরোতেন। আর সেই প্রিয়ংবদারই মেয়ের জন্যে সোয়েটার বুনছেন তিনি এখন।

যাকে সবাই ভেবেছিল পাল্টাতে পারবে না, সে কেমন সহজে খুকী থেকে মা হয়ে গেল, আর যাকে সবাই প্রাপ্তবয়স্ক ভেবেছিল, সে তার দায়িত্ব নিতে পারলে না।

জীমূতবাহন এবার কথা বললেন। “এখানে কি এসব উল পাবে?”

“তাহলে মদালসাকে আর একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দাও—উলটাও যেন ডাকে পাঠিয়ে দেয়।”

“ডাকে পাঠাবে কেন? পরীক্ষা যখন হয়ে গিয়েছে তখন…”

ঈশিতা বেশ অবাক হয়েই জীমূতবাহনের মুখের দিকে তাকালেন। জীমূতবাহন নিজে থেকে মেয়েদের কথা ভাবছেন!

উলের কাঁটা নাড়তে নাড়তে ঈশিতা বললেন, “সামনের শনিবার টেবিল টেনিস খেলতে মদালসা বোম্বাই আসছে। ওদের কলেজটীমের ক্যাপ্টেন হয়েছে। ভাবছি বোম্বাইতে গিয়ে খুকুমণির খেলাটাও দেখে আসি, আর তারপর ওকে এখানে নিয়ে চলে আসবো।”

জীমূতবাহন বললেন, “বেশ ভাল কথা। ওখানে তোমার থাকবারও অসুবিধে হবে না। ইন্দুমতীদের বাড়ি রয়েছে, আমি লিখে দিতে পারি।”

“দরকার হবে না,” গম্ভীরভাবে উত্তর দিলেন ঈশিতা। “আমার নিজের বোনপোই রয়েছে অল্টামাউন্ট রোডে। হিন্দুস্থান লিভারে খুব টপ পজিশন পেয়েছে। স্যার নগেন সরকারের একমাত্র মেয়ে তিলোত্তমার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।”

কোনো প্রতিবাদ করলেন না জীমূতবাহন। ছোট মেয়ের সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হবে ভেবে একটু খুশীই হলেন। মদালসা ছোটবেলায় মোটেই মায়ের কাছে থাকতে চাইতো না। বাবার সঙ্গেই ছিল তার যত ভাব। বাড়িতে যতটুকু সময় থাকতেন জীমূতবাহনের ছোট মেয়ে এসে ঘুর ঘুর করতো।

জীমূতবাহন ঘড়ির দিকে তাকাতেই ঈশিতা বললেন, “আবার বেরোবে নাকি?”

“বেরোতেই হবে। অমিতাভ অপেক্ষা করছে।”

এত সময় ধরে জীমূতবাহন ল্যাবরেটরিতে কী যে করেন, ঈশিতার মাথায় আসে না। এবং এত করেও কোনো ফলের আভাস দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না কেন, তাও বুঝতে পারেন না।

ঈশিতা গম্ভীরভাবে বললেন, “সব কাজই কি তোমাকে করতে হয়? তাহলে এতগুলো লোককে মাইনে দিয়ে পুষছো কেন?”

জীমূতবাহন গম্ভীরভাবে বললেন, “আমার এখানে লোকরা যা পরিশ্রম করে, তা আশ্চর্যই বলতে পারো।”

ঈশিতা বললেন, “তোমার না হয় কোনো সাধ-আহ্লাদ নেই, কিন্তু ওই ছেলেটাকে দিনরাত বদ্ধ ঘরে রেখে দিচ্ছ কেন?”

“কার কথা বলছো? অমিতাভর?” জীমূতবাহন সগর্বে বললেন, “ওর কাজের উৎসাহ আমার থেকেও বেশী। দু‘জনে সমান পাল্লা দিয়ে যাবো – দেখি কে কাকে হারাতে পারে।”

“ওর খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হচ্ছে বোধ হয়। একটু রোগা হয়ে গেছে মনে হলো। রঙটাও পুড়ে যাচ্ছে।”

এবার উঠে পড়লেন জীমূতবাহন। ঈশিতার কথাগুলো মোটেই ভাল লাগল না তাঁর। অমিতাভর দিকে তাঁর নিজের যথেষ্ট নজর আছে, আর কারুর সেখানে নাক গলানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

.

আলোটা কাছে এনে একটা কাঁচের ওপর ঝুঁকে পড়ে অমিতাভ কিছু একটা লক্ষ্য করছিল।

পিছনে এসে পরম স্নেহে পিঠে হাত দিলেন জীমূতবাহন। “কী দেখছো অমিতাভ?”

ঘাড় ফিরিয়ে অমিতাভ বললে, “আপনি এত তাড়াতাড়ি এসে গেলেন স্যার?”

জীমূতবাহন হাসতে হাসতে বললেন, “আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলতেন, বুড়ো হলেই যে স্লো হতে হবে এমন কোনো আইন নেই।”

জীমূতবাহনের হাসিতে অমিতাভও যোগ দিল! আচার্যদেবের কথা বলতে গেলে জীমূতবাহনের আর জ্ঞান থাকে না। জীমূতবাহন বললেন, “মাস্টারমশাই দিব্যজ্ঞানী ছিলেন বোধ হয়। না হলে কোথায় তখন আমার রিসার্চের পরিকল্পনা, কোথায় তখন ল্যাবরেটরি। কিন্তু উনি প্রায়ই বলতেন, যদি কোনোদিন গবেষণাগার করিস, নিবেদিতার নাম রাখিস। মনের মধ্যে একটা পবিত্রভাব আসবে। নিষ্ঠার ভাব না এলে বিজ্ঞানের সাধক হওয়া যায় না।”

জীমূতবাহন বললেন, “ভাল কথা অমিতাভ, সারাক্ষণ এই ল্যাবরেটরিতে বসে থাক। তোমার ভাল নয়। একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসবে।”

“বেড়ানো যথেষ্টই হচ্ছে মাস্টারমশাই। কতবার তো ক্ষেতে যাচ্ছি।” অমিতাভ কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চাইছে।

জীমূতবাহন অগত্যা কাঁচের বাক্সটার দিকে সরে এলেন। “মিরিয়াপোডটা নিয়ে এখনো পড়ে রয়েছো?”

“তেঁতুলে বিছেও যে সুন্দর, প্রকৃতির কী অদ্ভুত কারুকার্য যে এর পিছনে রয়েছে, তা আজ প্রথম বুঝতে পারলাম স্যার।”

“এই রকমই হয়,” জীমূতবাহন উত্তর দিলেন। “অসুন্দরের মধ্যে অকস্মাৎ সুন্দরকে আবিষ্কার করে কতবার নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছি—আজি এ প্রভাতে ভানুর কর, কেমনে পশিল প্রাণের ‘পর।”

অমিতাভ বললে, “সহস্রপদীর সামনের চারটে আর পিছনের চারটে পা বেঁধে দিয়েছি। তাতে মুভমেন্ট বেশ অ্যাফেকটেড্ হয়েছে।”

“খাওয়া-দাওয়া করছে?” জীমূতবাহন জিগ্যেস করলেন। “ভালই করছে।”

জীমূতবাহন বললেন, “এতগুলো পা নিয়ে কেন্নো এবং বিছেদের হাঁটাটা একটা ছোটখাট বিস্ময় বৈকি। একটা মজার ছড়া মুখস্থ করেছিলাম আমরা :

A centipede was happy quite,

Until a toad in fun

Said, “Pray, which leg moves after which,?”

Which raised her doubts to such a pitch,

She fell exhausted in the ditch,

Not knowing how to run.”

অমিতাভ বললে, “মাস্টারমশাই, আপনার পেপারটা কিন্তু আজকে শেষ করতে হবে। আমেরিকান সোসাইটি অফ এগ্রিকালচার থেকে আবার চিঠি এসে পড়বে।”

জীমূতবাহন বললেন, “বাড়িতে যদি সময় পাই, আজকেই রেডি করে ফেলবো। তবে পেপারটা আমাদের দু‘জনের নামে যাবে। কারণ ল্যাবরেটরিতে তৈরি এবং লালিত-পালিত যে পোকাগুলোর কথা লিখছি, সেগুলো তোমারই পরিচর্যায় ছিল।”

অমিতাভ বললে, “মাস্টারমশাই, আমার নাম দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি শুধু আপনার কথামতো কাজ করে গিয়েছি।”

মাস্টারমশাই বললেন, “সবকথাই যখন মেনে চলেছে৷ তখন এটাও মানবে।”

.

“শুনুন।”

“শুনছি।” মাথা নিচু করে নবজাত স্পটেড বোলওয়ার্মের নার্সিং করছিল অমিতাভ। তারের জালের মধ্যে রাখা ছিল বোলওয়ার্মগুলো। শুককীট জন্মাবার পরে তলায় বালির বিছানা পেতে দিয়েছিল অমিতাভ। কীটদের গা থেকে জলীয় পদার্থ বেরোয়, শুকনো বালি সেগুলো শুষে নেয়। গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থেকেছে অমিতাভ কয়েকদিন। অপেক্ষা সার্থক করে অবশেষে মথ বেরিয়ে এসেছে। মথকেও প্রজাপতি বলে ছেলেরা। কেমন ডানা গুটিয়ে বসে আছে। একটা চার ইঞ্চি ফাঁদের এবং আট ইঞ্চি উঁচু জারের মধ্যে সাবালক মথদের তুলে রাখছিল অমিতাভ এবং রাখতে রাখতেই উত্তর দিয়েছিল, “শুনছি।”

“ক্ষমা করবেন”–আবার মহিলা-কণ্ঠ শোনা গেল।

ব্যস্ত অমিতাভ ততক্ষণে ঝুঁকে পড়ে একটা পাতলা ফর্সা কাপড়ের টুকরো জারের মধ্যে রাখছিল। সেই অবস্থায় অমিতাভ বললে, “ক্ষমা করছি।”

প্রশ্নকারিণী যে রীতিমত বিরক্ত হয়েছেন, তা পরবর্তী প্রশ্নেই বোঝা গেল। “আমার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।”

“আমারও বিশেষ প্রয়োজন।” অমিতাভ ঝুঁকে পড়েই উত্তর দেয়। সত্যিই তার প্রয়োজন রয়েছে।

কিন্তু ততক্ষণে মহিলা আগন্তুক বেশ রাগতস্বরে বললেন, “কী বললেন?” বিরক্ত হয়ে পিছনে তাকালো অমিতাভ। এবং জলজ্যান্ত এক যুবতীকে দেখে আরও চমকে উঠলো। লজ্জিত অমিতাভ ক্ষমা ভিক্ষা করলো, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত। আমি ঠিক খেয়াল করে উঠতে পারিনি। তবে সত্যিই আমার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। আমার একটুখানি চিনি দরকার।”

“চায়ের জন্যে?” বিস্মিত আগন্তুকের প্রশ্ন।

“না না, এই মথদের জন্যে। চিনির জল খাওয়াতে হবে এখনই। সলতেও চাই। আমার কাছে পাতলা কাপড় রয়েছে, এখনই সলতে পাকিয়ে নিচ্ছি।”

“আমি কে বোধহয় বুঝতে পেরেছেন। আমি মদালসা সেন। জীমূতবাহন সেন আমার বাবা। গতরাত্রে আমি এখানে এসেছি।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনেছি আপনি আসছেন। আপনার মা নিজেই তো বোম্বাই গিয়েছিলেন আপনাকে আনতে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন, একটু চিনি নিয়ে আসবেন মিসেস সেনের কাছ থেকে? বড় বিপদে পড়ে গিয়েছি। মথগুলোর খুব খিদে পেয়েছে,” অমিতাভ বললে।

মদালসার মাথার চুলগুলো তপস্বিনীর মতো উঁচু করে বাঁধা। এই ধরনের কেশবিন্যাসের কী একটা নামও আছে যেন, অমিতাভ কাগজে পড়েছে। মেয়েটির স্বাস্থ্য ভাল। সমৃদ্ধ কুমারীতনু আঁটসাট জামার তীক্ষ্ণ শাসনে রয়েছে। রঙটা একটু চাপা—ঈশিতা সেনের মতই। তবে বয়সের মসৃণতা আছে। চোখ দুটো অমনই টানাটানা, না বিলিতি পেনসিল দিয়ে ভ্রূ আঁকা হয়েছে, তা বোঝা গেল না।

প্রতিবাদ করবার সুযোগই পায়নি মদালসা। এমনভাবে মুখের ওপর চিনি আনবার হুকুম করেছিল অমিতাভ যে, আঁচলটা ব্লাউজের গলায় গুঁজে সোজা হুকুম তামিল করতে ছুটতে হলো তাকে।

চিনি নিয়ে মদালসা যখন ফিরে এল তখন অমিতার্ভ সলতে পাকাচ্ছে। “এই নিন আপনার চিনি।”

“আমি অত্যন্ত লজ্জিত মিস্ সেন। ঠিক ওইভাবে আপনাকে চিনি আনতে বলাটা উচিত হয়নি আমার।”

‘অপমানটা হজম করেই গেল মদালসা। কিন্তু বেশ বিরক্ত হয়ে উঠেছে সে। “আপনার কাছে একটা খবর নিতে এসেছিলাম, আমার বাবা কোথায় বলতে পারেন? বাপি এখনও স্নান করেননি।”

“স্নান করতে ওঁর দেরি হবে। অন্যদের স্নান করাচ্ছেন এখন,”

তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে অমিতাভ উত্তর দিলে।

“মানে, আমার বাবা কি চাকর যে অন্য লোককে স্নান করিয়ে দেবেন?” যৌবনবতী মদালসা বেশ অভিমানের সঙ্গে বললেন।

“লোক নয়, পোকাদের স্নান করাচ্ছেন। বিশ্বাস না হয় দেখবেন আসুন।” এই বলে অমিতাভ একটা চেম্বারের দিকে এগোতে লাগল।

ওরা দু‘জনেই যখন ঘরে ঢুকে পড়েছে তখন জীমূতবাহন একটা কাঁচের টেবিলে কয়েকটা পোকা নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন।

আলুগাছের জাব পোকা যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই পোকাদের চিনতে পারবেন। ওই এক জাতের—তুলোর অ্যাফিড। তুলো ছাড়াও বেগুন, ঢেঁড়স এবং লঙ্কাগাছের শত্রু। বেগুনের কয়েকটা পাতায় শূককীট ছিল, সকালে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে অমিতাভ। একটা ট্রেতে গোটা-কুড়ি পোকাকে রেখে ওপর থেকে স্নানের ঝাঁঝরি খুলে দিলেন জীমূতবাহন স্নান সেরেই ফ্যানের তলায় শুকোতে দিলেন পোকাগুলোকে।

“আপনাকে বাড়ি থেকে ডাকতে এসেছে স্নানের জন্যে”, অমিতাভ এবার জীমূতবাহনকে জানাল।

“এখানকার স্নানযাত্রার এই তো সবে শুরু। এখনও শ’ ভিনেক পোকা আছে—বিভিন্ন কেমিক্যালে স্নান করিয়ে ফলাফল দেখতে হবে। অমিতাভ, তুমি এবার পোকাগুলোকে বেগুনপাতা খেতে দাও—দেখো খেতে পারে কিনা, বেগুনে বোধহয় অরুচি হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে।”

“কীসের বাথ দিলেন?”

“ফোড্রেন।” জীমূতবাহন উত্তর দিলেন।

অমিতাভ বললে, “আপনি স্যর বাড়ি গিয়ে স্নান সেরে খেয়ে নিন, আমি এই কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি।”

“না না, নিজের খাওয়াটাই কি আগে হলো?” জীমূতবাহন প্রতিবাদ করেন।

কোনো কথা শুনলে না অমিতাভ, জোর করে ওঁকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল।

জীমূতবাহন বললেন, “তাহলে ডিটেলগুলো লিখে নাও। হেট্রোজিনিটি—X2 (3) =1-631। রিগ্রেসন, ফিডিউসিয়াল লিমিট এবং রিলেটিভ টক্সিসিটিও লিখে নাও।”

জীমূতবাহন যখন হাত ধুতে গিয়েছেন, তখন মদালসা সেন জিগ্যেস করলে, “স্নান করিয়ে কী লাভ হচ্ছে আপনাদের?”

গম্ভীরভাবে অমিতাভ উত্তর দিলে, “সাবান দিয়ে এদের রঙ ফর্সা করবার চেষ্টা হচ্ছে।”

অমিতাভর উত্তরে মদালসা বেশ বিরক্ত হলো। “সোজা করে আপনারা কিছু বলতে শেখেন না?”

অমিতাভ হেসে বললে, “কীটনাশক কেমিক্যালের শক্তি দেখছি আমরা। এর পরে প্যারাসাইটরা কতটা কী করতে পারে দেখা হবে। আমাদের পদ্ধতিতে সময় একটু বেশী লাগে। ধৈর্য চাই। অনেকে বলেন খরচও বেশী। এখন হয়তো তাই—কিন্তু ঠিকমতো কাজ হলে খরচ অনেক কমই হবে।”

হাত ধুয়ে বেরিয়ে এসে জীমূতবাহন মদালসাকে এগোতে বললেন। “তুমি যাও মা, আমি যাচ্ছি।”

মদালসা যেমনি হল থেকে বেরিয়ে গেল, জীমূতবাহন বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। “ল্যাবরেটরির মধ্যে বাইরের কারুর ঢুকে পড়া ভাল নয়। তুমি কী বলো?” অমিতাভর মতামত জানতে চাইছেন জীমূতবাহন।

কিছুই বললো না অমিতাভ, কিন্তু মদালসা ভিতরে চলে আসায় জীমূতবাহনের বিরক্তির কী কারণ হতে পারে তা বুঝতে পারলো না।

যেতে যেতে জীমূতবাহন একটা তারের খাঁচার দিকে তাকালেন—একটা গর্ভিনী প্যারাসাইট উড়ে উড়ে হোস্টকে বাগাবার চেষ্টা করছে। জীমূতবাহন দেখলেন হোস্ট এখনও বিপদের ইঙ্গিত পায়নি—কিন্তু তার অসাবধানতার সুযোগ নিয়ে এক মহাসর্বনাশ হতে চলেছে।

গতকাল রাত্রে মেয়ের সঙ্গে তেমন গল্প হয়নি। ট্রেন জার্নির ক্লান্তিতে বেচারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আজও লাঞ্চ টেবিলে গল্প হবে না। ল্যাবরেটরিতে তাড়াতাড়ি ফিরে গেলে তবে অমিতাভ খাবার সময় পাবে।

লাঞ্চটা গোগ্রাসেই গিলছিলেন জীমূতবাহন। ঈশিতা যে ক’দিন বোম্বাইতে ছিলেন, সে ক’দিন তো বাড়িতেই ফিরতেন না। ল্যাবরেটরিতে হরিমোহন কয়েকটা স্যাণ্ডউইচ দিয়ে আসতো। দুপুরবেলায় বেশী খেলে বিকেলের কাজকর্মে ঢিলে পড়ে যায়।

“তুমি সবসময় এতো গোমড়া মুখ করে থাকে৷ কেন?” ঈশিতা বেশ গম্ভীর ভাবেই অভিযোগ করলেন।

ঈশিতা চেষ্টা করে জীমূতবাহনের ভুল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মোটেই গম্ভীর হয়ে নেই জীমূতবাহন, বরং অনেকদিন পরে আদরের ছোটমেয়েকে দেখে বেশ খুশী হয়েছেন। ঈশিতাকে আড়ালে ডেকে একসময় বলে দিতে হবে, ঝগড়াঝাঁটিটা মেয়ের সামনে না করলেই ভাল। মেয়ের বয়স হয়েছে, সে এখন সব বুঝতে পারবে।

মেয়ের সামনে প্রতিবাদ করতে পারলেন না জীমূতবাহন। রসিকতা করে বললেন, “কোথায় গম্ভীর? প্রচুর হাসি পেটের মধ্যে জমা হয়ে রয়েছে।”

মেয়ে বললে, “তোমরা দু‘জনেই খুব হাসবে কিন্তু। না হলে আমি রেগে যাবো।”

জীমূতবাহন খেলার খোঁজ নিলেন। “তারপর মা, তোমাদের কম্পিটিশনে কী হলো?”

ঈশিতা বললেন, “খুকুর কোনো দোষ নেই। মিক্‌সড ডাব লসে ওর পার্টনার এমন ডোবাল যে হেরে গেল। খুকু, ওই রকম বাজে পার্টনার আর নিও না।”

জীমূতবাহন বললেন, “পার্টনারের উপর অনেক কিছু নির্ভর করে—একা কিছুই করা যায় না।”

“বাপি, তোমাদের এখানকার ক্রকারি দেখছি খুব খারাপ। কিছুদিন আগে, বৃষ্টির সময় শেয়ালদার কাছে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে ঠিক এই রকম বিশ্রী ডিশ প্লেট,” মদালসা দাঁত দিয়ে ভাত কাটতে কাটতে বললে।

মনে বেশ আঘাত পেলেন জীমূতবাহন। মেয়েকে কী শিক্ষা দিচ্ছে ঈশিতা? ভাত খেতে খেতে বললেন, “আমরা জঙ্গলের মধ্যে পড়ে আছি মা, কোথায় ভাল জিনিস পাবো।”

“বাপি, তুমি হাত দিয়ে ভাত খাও কী করে? চামচ দিয়ে খেতে পারো না আমাদের মতো?”

সুখ না তুলেই জীমূতবাহন বললেন, “ছোটবেলা থেকে এই রকম অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, মা।”

“তুমি না কি বৈজ্ঞানিক? বাপি, হাতে কত ময়লা থাকে জানো?”

“জানি মা—সেই জন্যেই তো হাত ধুয়ে খেতে হয়।”

মেয়ের পক্ষে এবার মা বললেন, “তোর বাবার এই বিশ্রী অভ্যেস কিছুতে ছাড়াতে পারলাম না—বিয়ের পর কত চেষ্টা করেছি। আমার বাবা অবশ্য বলতেন, যার যেভাবে খেতে ভাল লাগে তাকে সেইভাবে খেতে দেওয়া উচিত।”

দাদুর কথাতেই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো মদালসা। “জানো বাপি, সামনের বছরে দাদুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপিত হবে। সেইজন্যে শতবার্ষিকী কমিটি হচ্ছে। মাকে তো কমিটিতে নিয়েছে, কাগজে নাম বেরিয়েছে মা‘র।”

“সাধারণ কমিটিতে নয়, উপদেষ্টা কমিটিতে,” ঈশিতা সগর্বে সংশোধন করে দেন। “তোমার কাছেও চাঁদার চিঠি আসবে।”

“দিয়ে দিও,” জীমূতবাহন উত্তর দেন।

“এমনভাবে বলছো যেন সরস্বতীপূজার চাঁদা চাওয়া হচ্ছে তোমার কাছ থেকে। তিন বছর তিনি তোমাকে বিলেতে রেখে পড়াশোনা করিয়েছিলেন,” মুখঝামটা দিলেন ঈশিতা।

অসহায় জীমূতবাহন কিছুই বললেন না। মদালসাও বিপদ বুঝে অন্য কথা তুললো, “বাপি, এই জায়গাটা যদি কলকাতার কাছে হতো, ফাইন হতো।”

“ওসব কথা বোলো না, তোমার বাবা রেগে যান। কলকাতা থেকে যত দূরে থাকতে পারেন ততই তোমার বাবার আনন্দ,” ঈশিতা এমন সুযোগটা ছাড়তে পারলেন না।

“কলকাতার কাছে এতোখানি জমি মাত্র একশ টাকায় একশ বছরের লিজে কে আমাকে দিত, ঈশিতা?” জীমূতবাহন বেশ দুঃখের সঙ্গে জিগ্যেস করলেন।

“চেষ্টা করে দেখেছিলে? জগদানন্দ বোসের জামাই জমির জন্যে আবেদন করছে জানলে অনেকেই এগিয়ে আসতো।” সরকারী মহলে তাঁর বাবার ভক্ত সংখ্যা এখনও যে কর্ণ নয়, তা ঈশিতা জানিয়ে দিতে ভুললেন না।

জীমূতবাহন গম্ভীরভাবে বললেন, “কম বয়সে অনেকবার বাধ্য হয়ে হাত পেতেছি, কিন্তু এই বয়সে আর ছোট হতে ইচ্ছে করে না। অম্বালাল দেশাই নিজে থেকে জমিটার ব্যবস্থা করে দিলেন তাই।”

অম্বালালই তোমার শনি, ঈশিতা মনে মনে বললেন। এই অম্বালাল লোকটাকে মোটেই দেখতে পারেন না ঈশিতা। জীমূতবাহন যা বলবেন তাতেই হাঁ৷ বলে তাঁকে ক্ষেপিয়ে দেয়। জীমূতবাহন সেন ছাড়া ইণ্ডিয়াতে যেন বৈজ্ঞানিক নেই। যত ‘মায়ে খেদানো বাপে তাড়ানো বৈজ্ঞানিক প্রবলেমকে লালন-পালনের জন্যেই যেন জীমূতবাহন বেঁচে রয়েছেন। তাঁর ঘর নেই, সংসার নেই, ছেলেপুলের চিন্তা নেই, শুধু বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ালেই তাঁর চলবে। অথচ অম্বালালের কথা জীমূতবাহন শোনেন। জীমূতবাহনকে বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের পাগলামিতে যেতে বারণ করবার জন্যে অম্বালালকে নিজে অনুরোধ করেছিলেন ঈশিতা। অম্বালাল সোজা না বলে দিয়েছিলেন : “ওঁর মতো একজন বৈজ্ঞানিকের স্বাধীনতায় আমি হাত দেবার কে?”

মেয়ের প্লেটে খাবার দিতে দিতে ঈশিতা স্বামীকে বললেন, “তুমি ভালভাবেই জানো, তোমার স্ত্রীর, তোমার মেয়েদের স্বাস্থ্য এখানে কোনোদিন ভাল থাকে না। কিন্তু তার জন্যে কণামাত্র আগ্রহ তুমি দেখাশুনি ”

স্বাস্থ্য খারাপ হয়, না মন টেকে না? জীমূতবাহনের জানতে ইচ্ছে করে। জীমূতবাহনের আর একবার মনে হলো, ঝিঁঝিপোকারা ভাগ্যবান—তাদের বউবা শব্দ করতে পারে না!

কলকাতার কাছে হলে কী সুবিধে হতো মদালসা এবার বলেই ফেললো। “বান্ধবীদের নিয়ে মাঝে মাঝে পিকনিকে আসা যেতো।”

জীমূতবাহনের ইচ্ছে হলো মেয়েকে মনে করিয়ে দেন, এই জায়গাটা তার বাবার সাধনার স্থান। মন্দিরের ভিতর কেউ পিকনিক করে না। কিন্তু সামনে ঈশিতা বাঘিনীর মতো মেয়েকে যেভাবে আগলে বসে রয়েছেন, ভাতে কিছুই বলা গেল না। গম্ভীরভাবে জীমূতবাহন মেয়েকে বললেন, “পিকনিকের মতো একটুকরো খালি জায়গাও নেই। প্রতিটি ইঞ্চি জমিতে আমার কিছু না কিছু কাজ করছি।”

কিন্তু এতেও নিষ্কৃতি পেলেন না জীমূতবাহন। তাঁরই প্লেটে আরও এক চামচ ভাত ঢালতে গিয়ে ঠক করে আওয়াজ করে ফেললেন ঈশিতা। তাঁর হাতের চুড়িগুলো কিন কিন করে বেজে উঠলো। সেই সুরেই ঈশিতা বললেন, “শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনেও অনেক গাছ-গাছড়া আছে, তবুও লোকে পিকনিক করে। ভয় নেই, খুকুমণির কোনো বন্ধুই এখানে পিকনিক করতে আসছে না।”

জীমূতবাহন তাঁর মোটা কাচের চশমার মধ্য দিয়ে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

মেয়ে এবার বললে, “মা, বাবাকে ওই ব্যাপারটা বলো।”

ঈশিতা বললেন, “হ্যাঁ জরুরী কথা, ৰিকেলে খুকুমণিকে শহরে কোনো হেয়ারড্রেসারের কাছে নিয়ে যেও তো।”

পায়ের স্লিপার নাচাতে নাচাতে মদালসা বললে, “হ্যা বাবা, স্নান করবার সময় হেডক্যাপটা পরতে ভুলে গিয়েছিলাম, কী অবস্থা হয়েছে দেখো না।”

বেশ খুঁটিয়েই মেয়ের চুলগুলো দেখলেন জীমূতবাহন। কিন্তু চুলের অবস্থা এমন কিছু বিপর্যস্ত হয়েছে বলে তিনি বুঝতে পারলেন না। নিশ্চয়ই হয়েছে, তাঁদের মোটা দৃষ্টিতে ওসব সূক্ষ্ম দোষ ধরা পড়ে না। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে তাঁকে জানাতে হলো এখানকার শহরে মেয়েদের কোনো হেয়ার-ড্রেসার নেই।

“তা হলে কী হবে মা-মণি?” উদ্বেগে মদালসার মুখ কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠলো।

মেয়ের চিন্তা যে মাকেও স্পর্শ করেছে তা বোঝা গেল। তিনি বললেন, “দেখি আমি নিজে তোমাকে কিছু হেল্‌প করতে পারি কিনা। তেমন হলে কলকাতায় ফিরে যাবে, উপায় কী?”

ঈশিতা সেন স্বামীকে নীরবে বুঝিয়ে দিলেন, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত। কিন্তু কিছুতেই লজ্জা হচ্ছে না জীমূতবাহনের। কী করেন তিনি?

লজ্জা জিনিসটা কী? কেন লজ্জা হয়? লজ্জা না হলে কী করা উচিত? এইসব অসংলগ্ন চিন্তা জীমূতবাহনের মনের মধ্যে কৈ মাছের মতো ছটফট করতে আরম্ভ করেছিল। ল্যাবরেটরিতে নিজের ঘরে বসেও এলোমেলো চিন্তার হাত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না।

ল্যাবরেটরিতে ঢুকে পড়লে কিছুদিন আগেও জীমূতবাহন বাইরের সব চিন্তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারতেন। এতো কাজ থাকতো, এতো দিকে নজর দেবার প্রয়োজন হতো যে, অন্য চিন্তাগুলো পালাবার পথ পেতো না। কিন্তু অমিতাভ এসে অনেক দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নিয়েছে। প্রতিদিনের অনেক দুশ্চিন্তার হাত থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছে অমিতাভ।

শুধু ভার লাঘব নয়, জীমূতবাহন এখন অমিতাভর মধ্য দিয়ে যৌবনের সেই প্রাণময় উদ্দীপন৷ আবার অনুভব করেন। জীমূতবাহন ভুলে যান, জীবনের উইকেটে সেই ভোরবেলা থেকে তাঁর ব্যাটিং চলেছে—লাঞ্চ তো দূরের কথা, চা-পানের বিরতিও শেষ হয়ে গিয়েছে। যৌবনের ছোঁয়াচে রোগটা অমিতাভ তাঁর মনে আবার ঢুকিয়ে দেবার চেষ্টা করছে।

যৌবন কাউকেই তোয়াক্কা করে না। জীমূতবাহনও করবেন কেন? সংসারের তুচ্ছ ঘটনাগুলোকে মাইক্রোসকোপে বড় করে দেখে নিজে সময় নষ্ট করবেন কেন?

“মাস্টারমশাই!”

অমিতাভর কণ্ঠস্বর না? জীমূতবাহন বললেন, “ইয়েস মাই ডিয়ার বয়।”

“আপনি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন কেন? একটু বিশ্রাম নিলে পারতেন।”

“তুমি খেয়ে এস অমিতাভ। বিশ্রাম এ-জীবনে অনেক নিয়েছি। বিশ্রামের দোহাই দিয়ে জীবনের কত অমূল্য সময় অযথা নষ্ট করেছি, ভাবলে এখন দুঃখ হয়। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গিয়েছে।”

মোটা কাচের মধ্য দিয়ে জীমূতবাহনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। জীমূতবাহন হাসছেন। মাস্টারমশাইয়ের এই হাসিটা ভারি ভাল লাগে অমিতাভর।

এই হাসি শুধু ভালই লাগে না, কেমন এক আকর্ষণী শক্তি আছে এই সহঙ্গ নিষ্পাপ হাসিতে। জীমূতবাহনের দেহে অকস্মাৎ যেন বিদ্যুৎপ্রবাহ চালিত হয়—একটা বিচিত্র চুম্বকে পরিণত হন জীমূতবাহন সেন, যা অমিতাভকে আকর্ষণ করে। শুধু অমিতাভ মিত্র কেন—ইন্দুমতী দেশাই, অম্বালাল দেশাই, প্রফেসর ব্ল্যাকার, অধ্যাপক মিচিকানা আরও কতজন তাতে আত্কৃষ্ট হন।

চেয়ার থেকে উঠে পড়ে জীমূতবাহন বললেন, “আমাকে এখন কী কী করতে হবে বলো।”

“রুটিন কাজ কিছুই করতে হবে না। সব হয়ে গিয়েছে। কেমিক্যাল বাথ-এর সমস্ত ডিটেল নোট করে নিয়েছি। পিঁয়াজের পোকা ওনিয়ন ম্যাগটগুলো ভালই আছে। র‍্যবডিপাইসিন কিয়েটারগুলো মেপেছি, আর বড় হবে বলে মনে হয় না।”

“কত বড় হয়েছে মাদিগুলো?”

“২৬০ মিলিমিটার। চোখের রঙ ব্রাউনিস ব্ল্যাক। সুতরাং আপনার চিন্তার কিছু নেই।”

অমিতাভর পিঠে হাত রেখে জীমূতবাহন বললেন, “আমার জন্যে কোনো কাজই রাখনি তাহলে।”

অমিতাভ হেসে বললে, “কাজ আছে—আপনার পেপারটা শেষ করা। আর চিঠি-পত্তরের উত্তর দেওয়া, অনেক চিঠি জমে রয়েছে।”

চিঠি লিখতে বসলেন জীমূতবাহন। দু‘একটা ছোটখাট চিঠি শেষও করলেন। কিন্তু ঈশিতার বিরক্ত মুখটা আবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। ঈশিতা কী চায়, বুঝতে পারেন না জীমূতবাহন। তাঁর ব্যক্তিগত যা রোজগার সবই তো ঈশিতার হাতে তুলে দেন। পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে তার কোনোদিন কোনো বিষয়েই প্রশ্ন করেন না তিনি। শুধু একটু শাস্তি চান জীমূতবাহন, যে শাস্তিটুকু না হলে দিনের পর দিন বছরের পর বছর ল্যাবরেটরিতে মত্ত থাকা যায় না। কিন্তু ওরা সন্তুষ্ট নয় কেন? তাঁর মেয়েরা, যাদের তিনি সত্যিই ভালবাসেন, তারাও সব মায়ের দলে। কেন? কী ভুল করেছেন তিনি?

“বাবা!” মদালসা নিঃশব্দে কখন ল্যাবরেটরিতে ঢুকে পড়েছে। “আয় না।”

“বাবা, তোমার ঘুম পাচ্ছে বুঝি?”

“না মা, চোখ বুজে বসে আছি।” জীমূতবাহন চোখ দুটো খুলে কাচের চশমার মধ্য দিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ভারি মিষ্টি দেখতে হয়েছে তাঁর মেয়ে মদালসা। প্রথম যৌবনে ঈশিতা হুবহু এমনই দেখতে ছিল। শুধু ঈশিতা এতো টাইট জামা পরতো না। ঈশিতার চুলও ছিল অনেক, কিন্তু সেগুলো খোঁপা বেঁধে জড়িয়ে রাখতো ঈশিতা।

বাবার খুব কাছে এসে বসলো মদালসা। “চোখ বুজে তুমি ভাবো, তাই না বাবা? কী এতো ভাবো তুমি?”

জীমূতবাহন হাসলেন। এই মেয়েটি সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ দুর্বলতা আছে! দূরত্বের বাধা সরিয়ে দিয়ে ছোটবেলায় সে-ই তাঁর কাছে চলে আসতো। জীমূতবাহন বললেন, “ভাবার কী আর শেষ আছে মা? কত কি রয়েছে—কত রহস্য, কত সমস্যা, কত মিথ্যার আবরণ।”

“আচ্ছা বাবামণি, পৃথিবীতে এতো লোক রয়েছে, সবাই একটু একটু করে ভাবলে পারে। তুমি একা কেন সবার জন্যে ভেবে ভেবে কষ্ট পাবে!

মেয়েটা সত্যি এখনও বোকা—না হলে এমন প্রশ্ন কেউ করে? জীমূতবাহন সস্নেহে বললেন, “আমি একা কেন মা, পৃথিবীর আরও কত লোক সারাজীবন ধরে এমনি ভেবেই চলেছে। তবেই তো পৃথিবী চলছে।”

“আচ্ছা বাবা, তুমি নিজেদের সম্বন্ধে ভাব না কেন?”

মেয়ের প্রশ্নে জীমূতবাহন চমকে উঠলেন। “কে বলেছে মা?” জীমূতবাহন সোজা হয়ে বসলেন। “না মা, সে অত সহজ নয়—নিজের সম্বন্ধে ভুলে গিয়ে শুধু সত্যের জন্যে ভাবা খুব শক্ত কথা।”

“বাবা, তোমাকে হেয়ারড্রেসারের খোঁজ করতে হবে না। এখনকার মতো মা-ই ঠিক করে দিয়েছে।”

বাবা বললেন, “হ্যাঁ, বেশ ভালই দেখাচ্ছে।”

মদালসা বললে, “জানো বাবা, আমাদের কলেজের একটা মেয়ে তার বাবার সঙ্গে বিলেতে গিয়েছিল। প্যারি থেকে যা হেয়ার-ডু করিয়ে এনেছে, এখানে স্বপ্নেও ভাবা যায় না।”

বাবা বললেন, “তাই বুঝি?”

“আচ্ছা বাবা, আমরাও তো ইউ কে-তে ছিলাম, তাই না?”

“তোর জন্ম ওখানে, ওখানেই ছোটবেলা কেটেছে।”

“শুধু শুধু বোকার মতো চলে এলাম কেন আমরা?” মদালসা প্রশ্ন করে। “তুমি খুব বড় চাকরি করতে, তাই না? অনেক টাকা মাইনে পেতে। মা‘র একটা আলাদা গাড়ি ছিল। জান বাপি, ন’মাসিমার মেয়ের বিয়েতে আমরা ট্যাক্সি করে গেলাম। কী লজ্জা করছিল মা‘র!”

নিরুত্তর জীমূতবাহন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

“আমি চাকরি ছেড়ে না দিলে তোদের খুব মজা হতো তাই না?” জীমূতবাহন জিগ্যেস করলেন।

“প্যারিতে প্রতি সপ্তাহে হেয়ার-ডু করানো যেতো। জান বাবা, ফ্রেঞ্চ পারফিউমের কী দাম এখানে! চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা শিশি চায়। দিশি সেণ্ট গায়ে দিলে পচা গন্ধ বেরোয়।”

জীমূতবাহন স্তব্ধ হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতের পুতুলের মতো মেয়েকে তৈরি করছে ঈশিতা। মদালসা বললে, “শুভ্রা বিলেত থেকে ইলাস্টিক কাপড় এনেছে—টাইট ফিটিং শালোয়ার কামিজ যা হয়েছে না, তোমাকে কী বলবো।”

জীমূতবাহন বললেন, “তোর মা যখন বিলেতে ছিলেন, তখন কলকাতা থেকে শাড়ি পাঠাতেন তোর দাদু।”

মদালসা বললে, “বিলেতের অফিস কেন ছাড়লে বাবা? তোমার সঙ্গে সায়েবের ঝগড়া হয়েছিল বুঝি?”

জীমূতবাহন আমতা আমতা করতে লাগলেন। “না মা, আমার ভাল লাগল না। মনে হলো আমার জন্যে দেশে আরও অনেক বড় কাজ অপেক্ষা করছে।”

উত্তরটা মেয়ের যে পছন্দ হলো না, তা তার মুখের দিকে তাকিয়েই জীমূতবাহন বুঝতে পারলেন।

টেবিলের দিকে ঝুঁকে পড়ে জীমূতবাহন বললেন, “তুই একটু বোস, আমার কাজগুলো সেরে ফেলি।”

“তুমি এখানে এতো কাজ করো অথচ মাইনে পাও না!” মদালসা বিস্ময় প্রকাশ করলে।

“কে এখানে মাইনে দেবে আমাকে? গ্র্যান্টের টাকায় কোনো রকমে এতগুলো লোকের চলে যায়।”

“না বাবা, এ ভাল নয়। তুমি আবার বিলেতে ফিরে চলো, খুব মজা হবে।”

জীমূতবাহন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মেয়ে বললে, “তুমি তাহলে কাজ করো, আমি মা‘র কাছে যাই। মা একলা বসে আছে।”

মদালসা চলে যাবার পর জীমূতবাহনও চেয়ারে বসে থাকতে পারলেন না। অসহনীয় অন্তর্দাহে ছটফট করতে লাগলেন।

খাওয়া শেষ করে অমিতাভ নিজের ঘরে এসে বসেছে। সেখানে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসলেন জীমূতবাহন। বললেন, “লিখতে ইচ্ছে করছে না। আমি বরং প্রবন্ধটা মুখে মুখে বলে যাই, তুমি লিখে নাও।”  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *