৭
চায়ের পেয়ালার আওয়াজেই বোধ হয় ঈশিতার ঘুম ভেঙে গেল। উঠে পড়ে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, “ঘুমোওনি?”
“ঘুম এলো না কিছুতেই,” জীমূতবাহন উত্তর দিলেন।
“তার ওপর চা খাচ্ছ। ঘুমের কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।” জীমূতবাহন বললেন, “ভোর হয়ে এসেছে।”
বিছানা থেকে উঠে পড়ে ঈশিতা বললেন, “দেখি তোমার জ্বরটর হয়নি তো?”
জীমূতবাহনের গায়ে হাত দিলেন ঈশিতা। অনেকদিন পরে একটা উষ্ণ স্পর্শ পেলেন জীমূতবাহন। ঈশিতা বললেন, “না, গা তো বরফের মতো ঠাণ্ডা।”
জীমূতবাহন কিছুতেই উত্তর দিলেন না। ঈশিতা তাঁকে সরিয়ে দিয়ে নিজেই চা করতে লাগলেন। বললেন, “নিজে না করে আমাকে ডাকলে পারতে!”
“তুমি ঘুমচ্ছিলে, তোমার ঘুমটা আমার জন্যে ভেঙে গেল।”
“আর ভদ্রতা করতে হবে না,” এই বলে ঈশিতা নিজের কাজে মন দিলেন।
ঈশিতা নিজেও একটু চা নিয়েছে। “বাইরে গিয়ে বসবে? জীমূতবাহনের প্রস্তাব মতো ঈশিতা দরজা খুলে বাইরে বেরোতে গিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। অন্ধকারে একটা শামুকের ওপর পা দিয়ে ফেলেছেন তিনি।
দ্রুত বেরিয়ে এসে জীমূতবাহন মাড়িয়ে-ফেলা শামুকটাকে হাতে তুলে নিলেন। “আহা একটু দেখে পা ফেললে না–বেচারা রোমিওকে শেষ করে দিলে?”
“আমাকে যদি কামড়ে দিত?” ঈশিতা বিরক্তভাবে বললেন। “তোমার কাছে শামুকটাই বড় হলো?”
“শামুকরা কামড়ায় না, ঈশিতা। ও-যে আসবে আমি জানতাম। ওর জুলিয়েটকে এখানে এনে রেখেছি। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিক আসতে পারে কিনা, তাই পরীক্ষা করে দেখছিলাম।”
ঈশিতা বিরক্তকণ্ঠে বললেন, “ধন্য তোমাদের গবেষণা। তবে শামুকরা পর্যন্ত শম্বুকগতিতে যা করে, তোমার মত ব্যস্তবাগীশ মানুষরা তাও করে না। কতকাল কলকাতায় যাওনি বলো তো?”
জীমূতবাহন বললেন, “কী করে যাই? কার হাতে এতোগুলো প্রাণের দায়িত্ব ছেড়ে যেতে পারি বলো তো?”
ঈশিতা বললেন, “কার হাতে তোমার সন্তানের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে এখানে নিশ্চিন্তে বসে আছো?”
এই ভোরবেলাতেই বোধ হয় অশান্তি আরম্ভ হলো। জীমূতবাহন বললেন, “তোমার ভরসায় ঈশিতা। তুমি তো আমার সহধর্মিণী। স্ত্রীর সহায়তা ছাড়া আজকের দিনে পৃথিবীতে কোনো বড় কাজ করা কি সম্ভব?”
“তোমাকে একটা কথা বলবো?” ঈশিতা প্রশ্ন করেন।
“নিশ্চয়।”
“সেই বিয়ের দিন থেকেই তো সহযোগিতার কথা চলছে। মরতে আর ক’টা দিন বাকি বলো তো? কোনোদিন কি এর শেষ হবে?”
বিব্রত বোধ করেন জীমূতবাহন। আস্তে আস্তে বললেন, “ঈশিতা, তুমি হয়তো ভয় পাচ্ছো, ভাবছো আমাদের এই নতুন রিসার্চ কোনোদিন সফল হবে না। জোর করে কেউ কোনোদিন কিছু বলতে পারে না। তবে এইটুকু জেনো, কখনও কখনও অল্পেই ফল পাওয়া যায়, আবার কখনও বহু সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর আগে অল্পে ফল পেয়েছি, পেটেণ্ট রয়ালটির টাকা আজও আসছে। এবার অপেক্ষা করতে হচ্ছে।”
ঈশিতা জানালেন, “সুপ্রিয় বলছিল, যেভাবে আমেরিকায় গবেষণা হচ্ছে, তাতে তোমার পেটেন্ট আর কতদিন টাকা আনবে বলা শক্ত।”
জীমূতবাহন গম্ভীর হয়ে বললেন, “হু”।”
ঈশিতা বললেন, “তখন কী হবে ভেবে দেখেছো? দু‘খানা ঘরের জন্যেই আমাদের তিন শ’ টাকা ভাড়া দিতে হচ্ছে। আমার মোটর গাড়িটার অবস্থা কী হয়েছে দেখেছো? পড়াশোনার জন্যে আজকাল কত খরচ হয় খবর রাখো? যেসব মেয়ে ছোটবেলায় কষ্টের মধ্যে মানুষ হয়, তাদের মন কখনও হেলদি হয় না।”
জীমূতবাহনের ইচ্ছে হলো জিগ্যেস করেন, এই মূল্যবান তথ্য ঈশিতা কোথা থেকে সংগ্রহ করলো। কিন্তু পারলেন না।
ঈশিতা বললেন, “জগদীশদার সঙ্গে দেখা হলো সেদিন। উনি বলছিলেন, এখনও ফিরে যাবার সময় আছে। ইণ্ডিয়াতে বড় বড় কেমিক্যাল কোম্পানিরা আসতে শুরু করেছে। তোমার মতো লোক পেলে তারা লুফে নেবে। বরং অবসর সময়ে ছোটখাট গবেষণা কোরো কিছু।”
জীমূতবাহন চায়ের কাপটা শেষ করে ফেলেছেন। বললেন, “এবার কতদিন থাকবে?”
“কিছুই ঠিক করিনি। তবে কয়েকদিন থাকবার ইচ্ছে আছে।”
“মদালসাকে নিয়ে এলে না কেন?” জীমূতবাহন জিগ্যেস করেন। “ইয়ুথ প্রোগ্রামে আমেরিকায় যাবার কথা হচ্ছে। একটু ধরাধরির ব্যাপার আছে। তুমি মুখ খুললে এখনই হয়ে যায়।”
“সেটা কি ভাল ঈশিতা? আমার মেয়েকে বিনা পয়সায় বিদেশ ঘুরিয়ে আনবার জন্যে আমি অন্য লোককে বলবো?”
“তবে কি পাড়ার লোকে বলবে? তুমিও যখন প্রথম বিলেত গিয়েছিলে, নিজের পয়সায় যাওনি।” ঈশিতা উত্তর দিতে দ্বিধা করলেন না!
জীমূতবাহন বললেন, “এবার আমি উঠি। যদি ফিরতে দেরি হয়, আমার জন্যে অপেক্ষা কোরো না। খেয়ে নিও।”
ঈশিতা বললেন, “কাউকে দিয়ে মদালসাকে টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে দিও—ম্যাক্সফ্যাক্টর র্যাচেল কালারের হবে।”
“আচ্ছা।” জীমূতবাহন উত্তর দেন।
“যাচ্ছো কোথায়? আরও কথা আছে। সুস্মিতা চাইল্ড এক্সপেক্ট করছে,” ঈশিতা স্বামীকে জানালেন।
“তাই নাকি! কবে?”
“স্টর্ক আসতে আরও মাস চারেক দেরি।’
“তাহলে এখানে চলে আসতে বলো না। শহরে ডাক্তার গোড়বলে রয়েছেন। মিডওয়াইফরিতে খুব ভাল হাত, আমার বন্ধুও বটে।”
“ওদের তো এখনও ভীমরতি ধরেনি। দেবকুমার উডল্যাণ্ড নার্সিং হোমে এয়ারকণ্ডিশনড, সুইট বুক করে রেখেছে। অফিস থেকে সব খরচ দেবে।”
দেবকুমার সরকার, জীমূতবাহনের আর একটি কৃতী ছাত্র। কৃতী নয়, কৃতী হতে পারতো। কাজ শিখতে এসেছিল, কিন্তু নজর পড়ে গেল ঈশিতার। অতএব সুস্মিতা সেন সুস্মিতা সরকারে রূপান্তরিত হলো। ভাল জামাই পেলেন জীমূতবাহন ; কিন্তু হারালেন একটি ভাল ছাত্রকে।
ঈশিতাকে কে বোঝাবে, একটা ভাল বৈজ্ঞানিক মন পেতে অনেক খোঁজাখুঁজি করতে হয়। ভাল ছাত্রের বদলে টেরিলিনের শুট পরা আর একটি অফিসার জামাই পেয়েছেন জীমূতবাহন। নাকের বদলে নরুন পেয়েছেন নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির জীমূতবাহন সেন।
ঈশিতা ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। “কই, কিছু বললে না তো?”
“আমাদের এখানে এয়ারকণ্ডিশনড্ ঘর নেই।” জীমূতবাহন দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করলেন।
“অসুস্থ মানুষের জন্যে নেই, কিন্তু সুস্থ পোকাদের জন্যে আছে,” ফোড়ন দিলেন ঈশিতা।