৬
আজ বড়ো আনন্দের দিন। জীমূতবাহন সেন এখন খুশিতে ভরপুর। অমিতাভ নিজেই বলে গিয়েছে, নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে থাকতে চায় সে। সুযোগ-সুবিধা, লোকবল, অর্থবল, যন্ত্রবল না থাকা, সত্ত্বেও এই সামান্য গবেষণাগারে যে কাজ হচ্ছে, অমিতাভ তাতে বিস্মিত। কে জানে, সাফল্যের দেবতা বিজ্ঞানের জয়মাল্য নিয়ে একদিন হয়তো এই অখ্যাত নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির দ্বারেই উপস্থিত হবেন।’
“আর যদি না-ই বা আসেন, কী এসে যায়?” অমিতাভ ধীরকণ্ঠে জীমূতবাহনকে বলেছে।
পৃথীবীর কত বৈজ্ঞানিকই তো সমস্ত জীবন ধরে আলেয়ার পিছনে ঘুরেছেন। জীবনের কোনো ধনই ফেলা যায় না। তাঁদের ব্যর্থতার ভস্মরাশির ওপ্রই অনাগত যুগের কোনো নিবেদিতপ্রাণ ভারতসন্তান সাফল্যের জয়স্তম্ভ গড়ে তুলবেন।
অমিতাভর কথাগুলো চিন্তা করতে জীমূতবাহন খুব আনন্দ অনুভব করছেন। অমিতাভ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছে। জীমূতবাহন মনে প্রাণে চান তাঁরা দু‘জনে অনেক কাজ করবেন। তারপর শিষ্যের কীর্তি একদিন যেন গুরুর কীর্তিকে পিছনে ফেলে রেখে বহুদূর এগিয়ে যায়। গুরু শিষ্যের নিকট পরাজয় ইচ্ছা করেন।
নিজেকে এবার একটু শাসন করবার চেষ্টা করলেন জীমূতবাহন। আনন্দটা তাঁর যেন একটু বেশী হচ্ছে।
আনন্দকে মুহূর্তে নিরানন্দে পরিবর্তন করবার এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে জীমূতবাহনের। তা তিনি নিজেও জানেন। জীমূতবাহন ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলেন। চোখের সামনে রাশি রাশি পতঙ্গ দেখতে পাচ্ছেন। তিনি নিজেও যেন একটা পতঙ্গ। এবং তাঁর উল্লাসের কারণও এতক্ষণে খুঁজে পেয়েছেন। পূর্ণগর্ভা প্যারাসাইট পতঙ্গ এতক্ষণে একটা পোষকের সন্ধান পেয়েছে। তাঁর স্বপ্ন, যে-স্বপ্নের সর্বভুক শূককীটগুলো তাঁকে উত্ত্যক্ত করে সংসারের সব সুখ থেকে বঞ্চিত করছিল, তাদের লালন-পালনের জন্যে মনের মতো পোষকের সন্ধান পেয়েছেন শেষ পর্যন্ত।
চমকে উঠলেন জীমূতবাহন সেন। বোধ হয় একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলেন তিনি। ঘরের আলোটা জ্বালা। দাঁড়িয়ে রয়েছে ঈশিতা। জীমূতবাহন সেনের স্ত্রীর আজ যে কলকাতা থেকে আসবার কথা ছিল, তা মুহূর্তে মনে পড়ে গেল!
যে-ঈশিতাকে তিনি বিয়ে করেছিলেন আর আজকের প্রৌঢ়া ঈশিতা এক নয়। ঈশিতাকে প্রৌঢ়া বলছেন কেন জীমূতবাহন? ঈশিতাও তো পঞ্চাশের সীমারেখা অতিক্রম করে গিয়েছে। কিন্তু ঈশিতাকে দেখলে তো তা মনে হয় না। ঈশিতাকে এখনও অনেক কচি কচি দেখায়। স্বাস্থ্য ও শ্রীকে ঈশিতা অন্য অনেক জিনিসের মতো নিজের শাসনে রেখে দিয়েছে। এত চুপি চুপি ঈশিতা প্রৌঢ়ত্বের অক্ষরেখা অতিক্রম করেছে যে, পোষ মানানো অনুগত যৌবন চাকরি ছাড়া তো দূরের কথা, এখনও নোটিশ পর্যন্ত দেয়নি।
আজ বড় ভুল করে ফেলেছেন জীমূতবাহন। ঈশিতা এতদূর থেকে আসছে, তাঁর নিজেরই স্টেশনে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু ইস্টার্ন লেডি বার্ড বীট্লগুলো ক’দিন আগেই সহবাস করেছে, আজই তাদের ডিমপাড়ার কথা। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বীলগুলোর স্বভাবের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন ছিল। প্রসবের সময়ে ওদের হাবভাব থেকে কিছু কিছু নতুন সংবাদ জানবার আশা আছে। মানুষের পরম বন্ধু এই লেডি বার্ড বাঁল। শূককীট অবস্থা থেকেই বহুরকমের পতঙ্গ এবং তার ডিন খেতে আরম্ভ করে।
ইস্টার্ন লেডি বার্ড বীল-অ্যাডালিয়া বাইপাংটাটা—আমেরিকান লেডি বার্ড বীটুলের মাসতুতো বোন। প্রসবের আগে বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল—খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আবার পাতার ওপর আছড়ে পড়ছিল। ভয় পেলে ওরা ওইরকমই করে। জীমূতবাহনের মনে পড়ে গিয়েছিল তাঁর প্রথম যৌবনের কথা। ঈশিতাও প্রথমবার মা হবার সময় খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল। জীমূতবাহন নিজেও সেই দুশ্চিন্তার দিনগুলো আজও ভুলতে পারেননি। কিন্তু ভাবী পতঙ্গমাতাদের স্বামীরা কেমন খোশমেজাজে পাশের খাঁচায় নিজেদের পেটের খিদে মেটাতে ব্যস্ত।
জীমূতবাহন এখনও দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারলেন না ; পতঙ্গদের লেবার রুমের পাশেই পাহারায় রইলেন। স্টেশনে যাওয়া হলো না, জীপটা পাঠিয়ে দিলেন।
খাঁচার মধ্যে সবুজ গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহনকে আরও অনেকক্ষণ হয়তো বসে থাকতে হতো। কিন্তু একটু পরেই প্রসব করলো গর্ভিণী—হলদে, অনেকটা কমলালেবু রঙের এক ডজন ডিম। নবজাতকদের প্রয়োজনীয় যত্নের ব্যবস্থা করে হাতটাত ধুয়ে নিজের ঘরে ফিরে, আনন্দের রোমন্থন শুরু করেছিলেন জীমূতবাহন। ঘরের আলোটা জ্বলতেই সংবিৎ ফিরে পেলেন।
ঈশিতা কেমন টাটকা তাজা রয়েছে। কে বলবে লম্বা ট্রেনজার্নি করে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে এইমাত্র এসেছে সে? ঈশিতাকে দেখে কে বলবে, চারটে সন্তানের জন্ম দিয়েছে সে!
“ঈশিতা, কেমন আছ তুমি?” জীমূতবাহন জিগ্যেস করলেন। “ভালই।” একটু গম্ভীর হয়েই ঈশিতা উত্তর দিলেন।
“ট্রেনে কোনো অসুবিধে হয়নি তো?” জীমূতবাহন আবার প্রশ্ন করলেন।
“দুদিন ট্রেন-জার্নিতে যত না অসুবিধে হয়েছে, তার ডবল অসুবিধে হয়েছে স্টেশনে। আমি তোমার অপেক্ষায় হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি, কুলিদের গালাগালি খাচ্ছি, কিন্তু কোথায় তুমি?”
“হঠাৎ এমন আটকে গেলাম যে, কিছুতেই যাওয়া হলো না।”
“আমি এলে স্টেশনে যাবে কেন? কোনো অচেনা প্রফেসর হলে আড়াই ঘণ্টা আগে গিয়ে বসে থাকতে।” ঈশিতা বেশ অভিমানের সঙ্গেই উত্তর দিলেন।
“না না, ঈশিতা, ইনসেক্টগুলোর ডেলিভারির মুহূর্তে আমার থাকার বিশেষ প্রয়োজন ছিল।” জীমূতবাহন উত্তর দিলেন।
“এতই যখন হচ্ছে, একটা ড্রাইভার রাখো না কেন? স্টেশনে যে গিয়েছিল ছেলেটি কে? কিছুই বলতে পারে না। বড্ড লাজুক মনে হলো। ভিড়ের মধ্যে আমার খোঁজখবর না করে, গেটের ধারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ভাগ্যে গাড়ির নম্বর জানতাম ; তাই নিজেই এসে খোঁজ করলাম।”
জীমূতবাহনের ইচ্ছে হলো স্ত্রীকে বলেন, গাড়িটা প্রাইভেট ব্যবহারের জন্যে নয়। যে-সব মধ্যবিত্ত জাপানীরা চাঁদা করে এ গাড়িটা উপহার দিয়েছে, তারা আশা করে এইটা চড়ে দূর-দূরান্তে, গ্রামের মধ্যে কিংবা অরণ্যের ধারে আমরা কীটপতঙ্গ সংগ্রহ করবো। কিন্তু বললেন না কিছুই। মনে হলো, ঈশিতা এ-সবের মূল্য দেবে না।
জীমূতবাহন বললেন, “যে-ছেলেটি তোমাকে নিয়ে আসতে গিয়েছিল সে সম্প্রতি আমার এখানে যোগ দিয়েছে।”
“একটু গোবেচারি এই যা, কিন্তু খুব বিদ্বান নিশ্চয়।”
“ডারহাম ইউনিভার্সিটিতে ডক্টরেট করেছে।”
ঈশিতা ভাবলেন, ছেলেটা তাহলে বেঁচেছে। ডক্টরেট ডিগ্রিটা মুঠোর মধ্যে ধরতে পেরেছে যখন, তখন গবেষণার হাত থেকে মুক্তি পাবে। একবার তাঁর ইচ্ছে হলো জীমূতবাহনকে সে কথা বলেন, কিন্তু জীমূতবাহন প্রচণ্ড দুঃখ পাবেন। সঙ্গে সঙ্গে বলে বসবেন, পরীক্ষার পর যেমন আসল পড়াশোনার শুরু, তেমনি পি-এইচ-ডি বা ডি-এস-সির শেষেই প্রকৃত গবেষণার আরম্ভ। কত সময় যে জীমূতবাহন বৃথা নষ্ট করেন, সে কথা কে ওঁকে বোঝাবে!
ঈশিতা জিগ্যেস করলেন, “ছেলেটির বয়েস কত?”
এবার বেশ শঙ্কিত হয়ে উঠলেন জীমূতবাহন। ঈশিতা আবার এইসব প্রশ্ন করছে কেন? না না, এইসব কৌতূহলের প্রশ্রয় কিছুতেই আর দেবেন না তিনি। ভাবলেন, কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকলেই প্রসঙ্গের পরিবর্তন হবে। কিন্তু ঈশিতা যা জেদী। আদর দিয়ে দিয়ে ব্যারিস্টার জগদানন্দ বসু মেয়েগুলোর কিছুই রাখেননি।
ঈশিতা বললেন, “কী গো, কথার উত্তর দিচ্ছ না কেন?”
জীমূতবাহন বললেন, “তা সাঁইত্রিশ আটত্রিশ হবে নিশ্চয়।” জীমূতবাহন ইচ্ছে করেই বয়েসটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে দিলেন।
কিন্তু ঈশিতা অত সহজে বোকা বনতে চাইলেন না। “কী যে বল তুমি। ওই রকম কচি কচি মুখ, আটত্রিশ হবে কি করে?”
জীমূতবাহনের বলতে ইচ্ছে হলো, কচি কচি মুখ তো তোমারও আছে, কিন্তু তাই বলে কি তোমার বয়েস সাতাশ? কিন্তু সামান্যক্ষণ এসেছে ঈশিতা। এরই মধ্যে বিস্ফোরণের ইন্ধন যোগাতে চান না জীমূতবাহন।
“তুমি নিজে ওর সার্টিফিকেট দেখেছো?” ঈশিতা প্রশ্ন করলেন।
“এটা কিছু সরকারী চাকরি নয় যে, গেজেটেড অফিসারের আশীর্বাদপুত পরীক্ষার সার্টিফিকেটের নকল আমার কাছে নিবেদন করতে হবে। বয়েসটা তোমাকে আন্দাজেই বললাম।”
ঈশিতা অবজ্ঞাভরে বললেন, “এই জ্ঞান নিয়ে পোকামাকড়ের বয়েস ঠিক করো তোমরা?”
জীমূতবাহন এবার পরিবেশটা হাল্কা করার সুযোগ পেয়ে গিয়েছেন। বললেন, “ঈশিতা, পতঙ্গদের জগতে একটা বছর যেন একটা শতাব্দী। তারই মধ্যে চতুর্দশ পুরুষের জন্মমৃত্যু ঘটতে পারে। কোনো মে-ফ্লাইকে আটচল্লিশ ঘণ্টার বেশী বেঁচে থাকতে দেখা যায়নি। দীর্ঘজীবী সেভেনটিন-ইয়ার-সিকাডা পতঙ্গ জগতের ব্যতিক্রম। এরা জন্মের পর সতেরো বছর ঘুমিয়ে থাকে, তারপর কিন্তু বেঁচে থাকে মাত্র কয়েক দিন।”
ঈশিতাও ছাড়লেন না। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “সতেরো বছরের বেশী তোমরা তাই বোধহয় গুনতে পারো না!”
“ঈশিতা, তুমি স্নান করবে নাকি? ঠাণ্ডা আছে। গরম জল করে দিতে বল হরিমোহনকে।” জীমূতবাহন এবার আলোচনার মোড় ফেরাতে চেষ্টা করলেন।
ঈশিতা কিন্তু অন্য প্রশ্ন করলেন, “ছেলেটি পড়াশোনায় কেমন ছিল?”
“ব্রিলিয়ান্ট।” উত্তরটা না দিতে পারলেই খুশী হতেন জীমূতবাহন কিন্তু কিছুতেই মিথ্যে বলতে পারলেন না। কেমন ভয় ভয় করছে জীমূতবাহনের ঈশিতা যদি এখন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে, কিংবা সোজা স্নানঘরে চলে যায়, তাহলে স্বস্তি পেতেন জীমূতবাহন। ঈশিতাকে তিনি যে ভয় পান, এটা অস্বীকার করেন না জীমূতবাহন।
স্নান সেরে এসে ঈশিতা প্রসাধনে বসলেন! জীবনের কত সময় ঈশিতা প্রসাধনে ব্যয় করেছে, সেটা কষে দেখতে ইচ্ছে করে জীমূতবাহনের। সেটা অন্তত কয়েক বছর হবে, একথা জোর করে বলতে পারেন জীমূতবাহন।
নরম তোয়ালে দিয়ে ততোধিক নরম গাল দুটো আলতোভাবে মুছতে মুছতে ঈশিতা বললেন, “তাড়াতাড়ির মাথায় যা ভুল করে ফেলেছি! এখন ভদ্রসমাজে মুখ দেখাবো কী করে?”
উদ্বিগ্ন জীমূতবাহন ব্যস্তভাবে বললেন, “কী হয়েছে?”
“মেক-আপের কৌটোটা ফেলে এসেছি। কাল সকালেই খুকুমণিকে একটা টেলিগ্রাম করে দেবে? যেন একটা ম্যাক্সফ্যাক্টর কিনে এয়ারমেলে পাঠিয়ে দেয়।”
“ম্যাক্সফ্যাক্টর এখানকার শহরেও পেতে পারো।” জীমূতবাহন বললেন।
“সেগুলো মেড-ইন-ইণ্ডিয়া! নিউ মার্কেটে একটা লোক আমাদের বিলিতী জিনিস দেয়।”
জীমূতবাহন বললেন, “আমাদের দেশে ভাল ভাল কসমেটিক তৈরি হচ্ছে, কাগজে পড়লাম।”
“দিশী কসমেটিক ব্যবহার করা থেকে মুখে চুনকালি মাখা ভাল।” প্রসাধনরতা ঈশিতা তাঁর সুচিন্তিত অভিমত জানালেন। “খুকুটুকুর জন্যে দুঃখ হয়। ওদের বয়েসে আমরা যখন কলেজে পড়তাম, তখন বাবা কত রকমের কসমেটিকস্ প্যারি থেকে আনিয়ে দিতেন। সন্তানদের জন্যে আমার বাবা যা আগ্রহ নিতেন…” ঈশিতা ইচ্ছে করেই কথাটা ‘অসমাপ্ত রেখে দিলেন।
জীমূতবাহনের মনে হলো ঈশিতা কৌশলে তাঁর গায়ে হুল ফোটাচ্ছে, তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, পিতৃত্বের পরীক্ষায় তিনি পাস নম্বরও জোগাড় করতে পারেননি এখন পর্যন্ত।
ঈশিতা বললেন, “আমার একখানা শাড়ি বাবা সত্যিই একবার ফ্রান্স থেকে কাচিয়ে এনে দিয়েছিলেন। এটা গল্পের কথা নয়।”
সপ্তকন্যার এক কন্যা ঈশিতা। কিন্তু সপ্তকন্যাকেই কী প্রচণ্ড দাপটে মানুষ করেছিলেন ব্যারিস্টার জগদানন্দ বসু। টাকাকে কোনোদিন টাকাই মনে করেননি তিনি।
ঈশিতা মনে করিয়ে দিলেন, “বাবা বলতেন, টাকা পয়সা হাতে পেলে ছেলেরা বকে যায়, কিন্তু মেয়েরা তা হয় না। মেয়েরা যে লক্ষ্মী—লক্ষ্মীর যত্ন করতে হয়।”
“আর একটা কী যেন বলতেন?” জীমূতবাহন প্রশ্ন করলেন।
“বলতেন, মেয়েরা বাড়িতেও এমনভাবে সব সময় সাজগোজ করে থাকবে যে, মনে হবে এখনই কোথাও বেরোচ্ছে। তোমাদের সমুদ্র সেন এখন তো এতো নামকরা ডাক্তার হয়েছে। তখন মোটেই প্র্যাকটিশ ছিল না। অর্ডিনারি এম-বি। মেজদির প্রেমে পাগল। বাবার কাছে প্রপোজ করেছিল পর্যন্ত। বাবা সোজা বলেছিলেন, তোমার একমাসের রোজগারে আমার মেয়ের শাড়ির খরচ উঠবে না।”
খিল খিল করে হেসে উঠলেন ঈশিতা। “ধনেখালির রাজাবাহাদুরদের বাড়িতে শেষ পর্যন্ত মেজদির বিয়ে হলো। ওদের জমিদারিটারি এখন গিয়েছে। কিন্তু কলকাতাতে এখনও যা খাস জমি আছে, তাতে তোমার মতো পোকামাকড় না ঘেঁটেই পাঁচপুরুষ চলে যাবে।”
ঈশিতা সূক্ষ্মভাবে তাঁকে ব্যঙ্গ করছে কিনা জীমূতবাহন ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কিন্তু এরকম হুল অনেকবার দেহে ফুটেছে জীমূতবাহনের! তেমন কষ্ট হয় না, বেশ সহ্য হয়ে গিয়েছে। প্রতিবাদ না করে শুনে যাওয়াই ভাল।
“তোমাকে একেবারে বলতে ভুলে গিয়েছি। মেজদির বড় ছেলে অনিরুদ্ধ এবার ক্রফোর্ড অ্যাণ্ড ক্রফোর্ডের ডিরেক্টর হলো। স্টার্লিং কোম্পানী ছিল এতোদিন। এবার ইণ্ডিয়া লিমিটেড হচ্ছে।” ঈশিতা স্বামীকে জানালেন।
বড় বড় কোম্পানীর খবরাখবর ঈশিতা তাঁর থেকে অনেক বেশী রাখে।
বড় বড় অফিসের বড় বড় পোস্টে ওঁর অনেক আত্মীয়স্বজন অথবা দিদিদের কেউ-না-কেউ কাজ করে। বোধ হয় কোনো মন্তব্য না করাটা অশোভন হবে, এই মনে করে জীমূতবাহন বললেন, “তাই নাকি! খুবই সুখবর। তোমার দিদিকে যখন লিখবে, তখন আমার অভিনন্দনটা জানিয়ে দিও।”
“আমি কেন লিখতে যাবে৷? তোমার হাত পা আছে, গণ্ডা গণ্ডা বাজে চিঠি লিখছ দুনিয়ার সর্বত্র, ইচ্ছে করলে আমার দিদিকেও একটা চিঠি ছাড়তে পারো।”
জীমূতবাহন চুপ করে রইলেন।
জীমূতবাহনের নীরবতা যে ঈশিতাকে বিরক্ত করেছে, তা তাঁর পরবর্তী কথা থেকেই বোঝা গেল। “দিদি তো বলে—সপ্তম লাইনে ছন্দপতন। এই শেষ লাইনে এসেই বাবা কবিতা মেলাতে পারলেন না।”
“মানে?” হাসতে হাসতে জীমূতবাহন জিগ্যেস করলেন। ল্যাবরেটরিতে কাজ আছে কিছু, কিন্তু সেগুলো আজ করা যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
“মানে তুমি অত্যন্ত অসামাজিক।”
“অসামাজিক?”
“তোমার থেকে অসামাজিক আমাদের সাতগুষ্টিতে কেউ নেই।” কোনো প্রতিবাদ করলেন না জীমূতবাহন। কারণে অকারণে প্রতিবাদ জানানোর জন্যেই পৃথিবীতে এতো অশান্তি।
যাদের স্ত্রীরা মুখরা, তারা যদি স্বল্পবাক্ হয় তবেই তো ভারসাম্য বজায় থাকবে। পৃথিবীর সব পুরুষই যে ঝিঁঝি পোকার মতো ভাগ্যবান নয়, তা অ্যারিস্টটলেরও দুশো বছর আগে এক গ্রীক ভদ্রলোক লিখে গিয়েছিলেন :
Happy the Cicadas’ lives
For they have only voiceless wives.
সিকাডার প্রেমপর্ব এই ক’দিন আগেই জীমূতবাহন ল্যাবরেটরিতে বিশ্লেষণ করছিলেন। একটা পাখার সঙ্গে আর একটা পাখা ঘষে পুরুষরা আকাশে বাতাসে আহ্বান ছড়িয়ে দেয়। শ্রীমতী সিকাডা নির্বাক হলেও বধিরা নন। তাই সঙ্গে সঙ্গে চঞ্চল হয়ে ওঠেন এবং তীরবেগে প্রিয়তমের কাছে উড়ে আসেন!
প্রসাধন শেষ করে ঈশিতা এবার স্বামীর সামনে এসে বসলেন। “তোমার খিদে পেয়েছে নিশ্চয়”, জীমূতবাহন প্রশ্ন করলেন। “তুমি আজকাল খাও কখন?” ঈশিতা জানতে চাইলেন। “ঠক নেই কিছু”, জীমূতবাহন উত্তর দেন।
ঈশিতা বিরক্ত হয়ে বলেন, “আমার বাবারও নিশ্বাস ফেলবার সময় থাকতো না, তবু রাত্রের খাওয়াটা ঠিক আটটায় সেরে নিতেন। ”
“সব সময় হয়ে ওঠে না, ঈশিতা।”
“এইটা তোমার বাড়াবাড়ি। বাবার জন্যে বড় বড় মক্কেলরা বসে থাকতেন। ডজনখানেক পোকা যদি তোমার জন্যে আধঘণ্টা বেশী অপেক্ষা করে, তাহলে নিশ্চয় তাদের জমিদারি লাটে উঠবে না।”
এত বলেও ঈশিতার মন ভরলো না। আবার আরম্ভ করলেন, “নাম কেনার চেষ্টা করা ভাল, আমার ছেলে থাকলে তাকেও তাই বলতাম, কিন্তু কোনো জিনিসের বাড়াবাড়ি ঠিক নয়।”
সুযোগ পেলেই ঈশিতা যে তাঁকে ব্যঙ্গ করেন, তাঁর এই সাধনাকে নাম কেনার একটা চেষ্টা মনে করেন, তা জীমূতবাহন লক্ষ্য করেছেন। বাবার বিরাট সাফল্য দেখেছেন ঈশিতা। দিদিদের বড় বড় ঘর থেকে বর এসেছে। তাদের ধনগৌরবও ঈশিতাকে প্রভাবান্বিত করেছে। ছোটখাট সার্থকতা, ছোটখাট স্বপ্নকে তাই বোধহয় জগদানন্দ বস্তুর কনিষ্ঠা কন্যা আমল দিতে পারেন না।
এক একবার জীমূতবাহনের মনে হয়, ঈশিতাকে বিয়ে করে মস্ত ভুল করেছিলেন। ঈশিতাকে বিয়ে করে নিজের ওপর এবং তার থেকেও বেশী ঈশিতার ওপর অন্যায় করেছিলেন জীমূতবাহন। কতদিন আগেকার কথা, এসব নিয়ে এই বৃদ্ধ বয়সে চিন্তা করে কোনো লাভ নেই। তবু জীমূতবাহন এই ধরনের ভাবনাকে মন থেকে দূর সরিয়ে রাখতে পারছেন না। তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই চিন্তার প্যারাসাইটগুলো তাঁর দেহে ঘর-সংসার পেতে বসছে এবং তিলে তিলে তাঁকে কুরে কুরে খাবার চেষ্টা করছে।
ঈশিতাকে বিয়ে না করলে জীমূতবাহনের জীবনধারা কোনদিকে প্রবাহিত হতো কে জানে? কিন্তু ঈশিতা বিরক্ত হলেই যে কথাটা মনে করিয়ে দেন সেটা মিথ্যা নয়—“আমার বাবাই তোমাকে সমস্ত খরচ দিয়ে বিলেত পাঠিয়েছিলেন। তিন বছর তোমাকে শুধু রাজার হালে রাখেননি, তোমার মাকেও টাকা পাঠিয়েছেন। বল, এসব মিথ্যে? বল, আমার বাবা না থাকলেও তোমার নামের পিছনে ওই বিলেতের ডক্টরেট ডিগ্রিটা জুড়তে পারতে ”
অস্বীকার করে লাভ নেই—সত্যিই জীমূতবাহন কিছুই পারতেন না, যদি না ঈশিতাকে বিয়ে করতেন। মাস্টারমশাই স্যার পি সি রায় ব্যারিস্টার জগদানন্দ বসুকে চিনতেন। দু‘জনে ভাবও ছিল খুব।
জগদানন্দই বোধ হয় বলেছিলেন, “বিত্তবানদের ঘরে ছ’টা মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। এবার ভাবছি মুখ পাল্টাবো। এটা বেশ বুঝতে পারছি, প্রফুল্লবাবু আপনাদের ইউনিভার্সিটির ছেলেরাই দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে। আমার খুব ইচ্ছে ছোট মেয়ে ঈশিতাকে জ্ঞানবানের হাতে দান করি।”
স্যর পি সি রায় তখন জীমূতবাহনের কথা বলেছিলেন—“বিশ্ববিদ্যালয়ের রত্ন। তাছাড়া পরীক্ষায় ফার্স্ট সেকেণ্ড হওয়াটাই বড় কথা নয়। ইংরিজীর ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্টরাই যেমন ইংরিজী সাহিত্যের কর্ণধার হয়নি, তেমনি সায়েন্সের ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট রাই বিজ্ঞানের বৃহৎ আবিষ্কার করেনি।”
জগদানন্দ বসুকে তিনি বলেছিলেন, “এদের বাড়ির অবস্থা ভাল নয়, কিন্তু ছেলেটার মধ্যে প্রতিভার চমক দেখতে পাই। সুযোগমতো যদি আমাদের কলকাতার কুয়ো ছেড়ে একবার বিদেশটা দেখে আসতে পারে এবং যদি গবেষণার সুযোগ পায়, তাহলে জীমূতবাহন বড় কিছু করে ফেলতে পারে।”
জীমূতবাহনকেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র অনেক কথা বলেছিলেন। বড়লোকদের সম্বন্ধে চিরকালই জীমূতবাহনের ভীতি ছিল। বড়লোকের জামাই, সে তো আরও ভয়ের কারণ!
মাস্টারমশাইকে জীমূতবাহন বলেছিলেন, “কলেজের সামান্য মাস্টারি করে ক’টা টাকা পাবো মাস্টারমশাই? বড়লোকের মেয়ের শাড়ি কেনবার টাকাই থাকবে না।”
প্রচণ্ড বকুনি লাগিয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। “সংসার সম্বন্ধে কিছুই বুঝিস না তুই। গরীবের মেয়েরাই অনেক সময় শাড়ি বেশী চায়। অনেক শাড়ি পরে পরে বড়লোকের মেয়ের প্রায়ই দামী শাড়িতে লোভ থাকে না।”
“কিন্তু স্যর, ওদের স্ট্যাণ্ডার্ড আর আমার স্ট্যাণ্ডার্ড!” জীমূতবাহন আবার আবেদন জানিয়েছিলেন।
“তুই বড্ড বকিস আজকাল,” স্যর পি সি রায় বকুনি লাগিয়েছিলেন। “সুযোগের সদ্ব্যবহার যারা করতে পারে না, তাবা বড় বৈজ্ঞানিক হবে কী করে? তোকেও তো স্ট্যাণ্ডার্ড উঁচু করতে হবে। তোকে বড় হতে হবে না? আমি তো দেখতে পাচ্ছি, জগদানন্দ বোসের মেয়েকে বিয়ে করে তুই বিদেশে লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছিস। তারপর সংসারের তেল-নুন-ডালের হিসেবে সময় নষ্ট না করে নিজের জগতে তন্ময় হয়ে তুই গবেষণা করছিস।”
জীমূতবাহন মাস্টারমশাইয়ের একটা কথা আজও ভুলতে পারেননি। “থিওরিটিক্যাল গবেষণা দরকার, কিন্তু আমাদের এই গরীব দেশে তার থেকেও বেশী দরকার কি জানিস—অ্যাপ্লিকেশন। প্ৰয়োগ বিদ্যা। অ্যাডিসনের মতো আবিষ্কারক প্রয়োজন আমাদের, বুঝলি?”
“ইচ্ছে করলেই কেউ কি অ্যাডিসন বা ওয়েস্টিংহাউস হতে পারে মাস্টারমশাই!”
“তা সত্যি।” পি সি রায় স্বীকার করেছিলেন। কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলেছিলেন, “আমাদের এই দেশের অবস্থা দেখছিস তো! ভাত-কাপড়ের দুর্গতি দেখলে মাথার ঠিক থাকে না। এমন সব বিষয় নিয়ে কাজ করবি, যাতে দেশের এই মানুষগুলোর একটু সুরাহা হয়।”
তাঁর কথা ভাবলে জীমূতবাহনের চোখ দুটো সজল হয়ে ওঠে। ছেলেদের কথা অমনভাবে কেউ চিন্তা করে কী? মাস্টারমশাই বলেছিলেন, “দেখিস, একদিন তোর মনে হবে বিয়েটা দিয়ে আমি ভালই করেছিলাম।”
জীমূতবাহন তখন যেন কেমন ছেলেমানুষ হয়ে গিয়েছিলেন। মাস্টার-মশাইকে বলেছিলেন, “অমন শিক্ষিতা মেয়ে বিয়ে করে অসুবিধেয় পড়ে যাবো না তো!”
হেসে ফেলেছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। “তার মানে তুই কি শিক্ষিত না?”
“তা নয়, তবে সায়েন্সের মধ্যেই তো পড়ে রয়েছি। আর্ট লিটারেচার অস্পৃশ্য হয়ে আছে, অথচ ঈশিতা কবিতা লেখে শুনেছি।”
মাস্টারমশাই জোরে হেসে উঠেছিলেন। “বিয়ে-থা করিনি বটে, কিন্তু তোকে একটা সাংসারিক উপদেশ দিয়ে রাখি, শোন্। বিয়ের সময় মেয়েরা থাকে একতাল নরম মাটির মতো। নতুন স্বামীটি হচ্ছে পটো। যেমনভাবে গড়ে নিবি মেয়েটা ঠিক তাই হবে। তুই কেষ্টনগরের কারিগর হবার চেষ্টা করিস।”
কারিগর, কেষ্টনগরের কারিগর তো দূরের কথা, ইস্কুলের ড্রয়িং মাস্টারও হতে পারেননি জীমূতবাহন। ঈশিতাকে গড়ে তুলবেন তিনি! মাটির নয়, ঢালাই লোহার পুতুল বলে মনে হয়েছে ঈশিতাকে।
ঈশিতা এখন কী করছে? চমকে উঠলেন জীমূতবাহন। ঈশিতা বেডরুম থেকে উঠে গিয়েছেন। বোধ হয় তিনি একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন, সেই সুযোগেই চলে গিয়েছেন ঈশিতা।
“কোথায় গেলে ঈশিতা?” জীমূতবাহন ডাক দিলেন। ঈশিতা ডাইনিং টেবিলে বসে চিঠি লিখছেন।
“চিঠি লিখছো? কাকে?” জীমূতবাহন প্রশ্ন করেন।
“যাদের তুমি কোনোদিন চিঠি লেখো না,” ঈশিতা কর্কশভাবে উত্তর দিলেন।
“মানে?”
“মানে, সন্তানরা বাবা-মায়ের সংবাদ আশা করে। মদালসা এসেছিল আমাকে স্টেশনে তুলে দিতে। সে-বেচারা এতক্ষণ মুখ শুকনো করে মায়ের কথা ভাবছে নিশ্চয়।”
ক্ষমা প্রার্থনা করলেন জীমূতবাহন। “চিঠি লেখা শেষ করো।”
চিঠি লেখা শেষ করলেন না ঈশিতা। কলমটা নামিয়ে রেখে বললেন, “পরের জন্মে পুরুষ হবার প্রার্থনা করবো।”
“কেন?”
“মা হওয়ার দুঃখ অনেক। বাবা হওয়ার কোনো দায়িত্ব নেই।” একটা বোলতা যেন জীমূতবাহনের দেহে হুল ফুটিয়ে দিয়ে গেল। জীমূতবাহন তবুও রেগে উঠলেন না। উত্ত্যক্ত হলে কেঁচোরাও ফোঁস করে ওঠে। জীমূতবাহন নিজেকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না।
.
দু‘জনের এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া শুরু হলো। খাওয়া শেষ করে বিছানায় এসে বসলেন জীমূতবাহন। লুঙিটা পরলেন তিনি।
বাথরুম থেকে শাড়ি পাল্টে স্লিপিং গাউন পরে এলেন ঈশিতা। এই স্লিপিং গাউনটা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারেন না জীমূতবাহন। কোনো কারণ নেই ; তবু অচেতন মনে একটা বিরাগ আছে। বিয়ের পর ঈশিতাও তাঁকে স্লিপিং সুট পরাবার কত চেষ্টা করেছেন। কিছুতেই রাজী হননি জীমূতবাহন। দেশ-বিদেশ যেখানেই যান, রাত্রে লুঙি পরেই শুয়েছেন তিনি।
ঈশিতাও রেগে গিয়েছিলেন, “পররুচি পরনা যখন নয়, তখন আমিও স্লিপিং গাউন ছাড়বো না।”
খাট দুটো পাশাপাশি জোড়া রয়েছে। “এখনই ঘুমোবে?” জীমূতবাহন জানতে চাইলেন।
ঈশিতা চুলের বেণী থেকে কাটা খুলছিলেন। বললেন, “তুমি?”
“আমি একটু শুতে পারি।”
“পারি মানে?”
“কিছুক্ষণ শুয়ে আমি উঠে পড়ি। ওই সময় ঘণ্টাখানেক কাজ করলে খুব ভাল ফল পাই।”
ঈশিতা ঘাড় বেঁকিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে রইলেন। ঈশিতার এই ক্রুদ্ধ বিস্ময়ের ভঙ্গী জীমূতবাহনের খুব ভাল লাগে। সব বিভেদ কিছুক্ষণের জন্যে মিটিয়ে ফেলে শান্তি স্থাপনের লোভ হয়।
ঈশিতা ব্যাগ থেকে ক্লিনসিং মিল্কের শিশি এবং তুলো বার করে মুখে, গলায়, ঘাড়ে, হাতে এমন কি পায়ে ঘষতে লাগলেন।
জীমূতবাহন দেখতে লাগলেন সাদা তুলো একটু পরেই কেমন ময়লা হয়ে উঠছে। ঈশিতার পরিচ্ছন্ন দেহে যে এত ময়লা থাকতে পারে, খালি চোখে কে বলবে। দুধ দিয়ে এমনিভাবে আস্তে আস্তে সমস্ত দেহটা মুছে ফেলতে নিশ্চয় অনেক সময় লাগবে।
জীমূতবাহন বললেন, “তুমি ক্লান্ত হয়ে আছ, এখন ঘুমোও।”
ঈশিতা বালিশের ওপর কসুই রেখে, আধশোয়া অবস্থায় বললেন, “তোমার বন্ধু জনার্দন মিত্র পড়াশোনায় কেমন ছিল?”
“বাজে বলতে পারো। থার্ড ক্লাশ পেয়েছিল।” জীমূতবাহন চশমাটা খুলে রাখতে রাখতে উত্তর দেন।
“তোমার কাছে ছ’একটা ফরমুলা দেখিয়ে নিতে এসেছিল না?” ড্রেসিং গাউনটা একটু আলগা করতে করতে ঈশিতা প্রশ্ন করলেন।
“মাঝে মাঝে আসতো। বেচারার খুব অভাব ছিল।”
লিপস্টিক মাখা ঠোঁট উলটিয়ে ঈশিতা বললেন, “তোমার সেই অভাবের জনার্দন লেক প্লেসে চারতলা বাড়ি করেছে। দোতলাটা পুরো এয়ার-কণ্ডিশন।”
“তাই নাকি? খুবই আনন্দের কথা।” পুরনো বন্ধুর সাফল্যের সংবাদে জীমূতবাহন সত্যিই খুব খুশী হয়ে উঠলেন।
“তোমার ক’কাঠা জমি আছে?” ঈশিতা এবার গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করলেন। জেরা করবার এই কঠিন ভঙ্গীটা ঈশিতা বোধ হয় বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন।
জীমূতবাহন প্রথমে একটু বিব্রত বোধ করলেন। তারপর সহজভাবেই উত্তর দিলেন, “জমি আমি কোথায় পাবো? কলকাতা শহরের জমি কেনা কি সহজ কথা?”
ঈশিতা বললেন, “প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে বাবা আমাদের কিভাবে রেখেছিলেন তা তো তোমার দেখা। আর আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কসবাতে দু‘খানা ঘরে কীভাবে থাকি? ”
জীমূতবাহন অস্বস্তিতে কাশতে লাগলেন।
ঈশিতা আবার বললেন, “যখন তুমি প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে আসতে, শুধু শোয়ার ঘর নয়, একটা সুইট পুরো পেতে। চিত্রাকে নিয়ে সুপ্রিয় এসেছিল সেদিন। মেয়ে-জামাইকে শোয়ার ঘর ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। ওরা রাজী হলো না—বাইরের ঘরে সোফা সরিয়ে ওরা শুলো।”
“আমার শ্বশুর বিখ্যাত ব্যারিস্টার ছিলেন।” গম্ভীর হয়ে জীমূতবাহন উত্তর দেন।
ঈশিতার পক্ষে বিরক্তি চেপে রাখা আর সম্ভব হলো না। গালটা ঠিকমতো তৈলাক্ত হয়েছে কিনা ডান হাতে অনুভব করতে করতে চোখটা ছোট করে বললেন, “সুপ্রিয়র শ্বশুরও শুনেছি জগদ্বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক।”
আর পারলেন না জীমূতবাহন। ঈশিতার দুটি হাত ধরে বললেন, “ঈশিতা, অনেকদিন পরে আমাদের দেখা হচ্ছে। কতদিন পরে তুমি আবার এখানে এলে। অন্তত আজকের রাতটা বিনা কলহে কাটলে কেমন হতো? প্লিজ, আজকের রাতটা।”
ঈশিতা এবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। ঈশিতার পিঠের দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহনের মনে হলো জেলখানার দুর্লঙ্ঘ্য পাঁচিলের মধ্যে বন্দী হয়ে রয়েছেন তিনি। দেওয়ালটা যেভাবে ফুলে ফুলে উঠছে তাতে মনে হয়, বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে, স্পর্শ করলেই দুর্ঘটনা ঘটবে। ঘরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন প্রশ্ন করলেন, “সুপ্রিয়র খবর কী?”
“প্রমোশন হয়েছে ওর। সমস্ত পূর্বাঞ্চলের সেলস্ ম্যানেজার। গাড়ি তো ছিলই, অফিস থেকে এবার ড্রাইভার দিল। এয়ারকণ্ডিশন ক্লাশের ভাড়া পায়। বছরে একবার বৌকে নিয়ে যেখানে খুশি ঘুরে আসতে পারে।”
ঈশিতা এবার সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছেন। আলোটা নিভিয়ে দিলেন জীমূতবাহন। কিন্তু তাঁর ঘুম আসছে না। ঈশিতা তাঁর রক্তচাপ বাড়িয়ে দিয়েছেন।
নানা উদ্ভট চিন্তা মাথায় জড়ো হচ্ছে। চিন্তার পোকাগুলোকে কোনো ওষুধে অবশ করে দিয়ে একটু ঘুমোতে পারলে মন্দ হতো না। চোখ বুজে ঘুমোবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন জীমূতবাহন।
কিন্তু কোথায় ঘুম? চিন্তার প্যারাসাইটগুলো নররক্তের আস্বাদ পেয়েছে, তারা অসহায় জীমূতবাহনের মাথায় তীক্ষ্ণ শুঁড় ফুটিয়ে ছোট ছোট গর্ত করছে।
তাঁর সেজ মেয়ে চিত্রলেখার মুখটা দেখতে পাচ্ছেন জীমূতবাহন। সুপ্রিয়র মুখটা আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন। জামাই বলে নয়, তারও আগের আর এক সুপ্রিয়কে দেখতে পাচ্ছেন অধ্যাপক জীমূতবাহন সুপ্রিয়র উন্নতি হয়েছে! আড়াই হাজার টাকা মাইনে পাচ্ছে সুপ্রিয়। কিন্তু সুপ্রিয় সেলসম্যান হয়েছে। বিজ্ঞানের গবেষণা ছেড়ে দিয়ে প্রিয় ছাত্র সুপ্রিয় চৌধুরী ইনসেকটিসাইডের ফেরিওয়ালা হয়েছে।
একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছে হচ্ছে জীমূতবাহনের। ফেরিওয়ালার চাকরিতে যদি সবচেয়ে বেশী মাইনে পাওয়া যায়, তাহলে মাইক্রোসকোপ পাশে সরিয়ে রেখে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার ছেড়ে দেশের সেরা ছাত্ররা কোটপ্যান্ট পরে, এয়ারকণ্ডিশন ক্লাশে বিভিন্ন শহরে ঘুরে ঘুরে মাল বিক্রি করে বেড়াবে? প্রাইস ক্যাটালগ, সেলস্ ট্যাক্স আর একচুয়াল ইউজার্স লাইসেন্সের তলায় চাপা পড়ে বিজ্ঞানের দীপশিখা অক্সিজেনের অভাবে নিভে যাবে?
এ সব কী ভাবছেন জীমূতবাহন? নিউ আলিপুরে তাঁর মেয়ে স্বামীর সঙ্গে কোম্পানির-দেওয়া ফ্ল্যাটে রয়েছে। সব সময় কোম্পানির ড্রাইভার থাকায় চিত্রার মার্কেটিঙের কোনো অসুবিধে হয় না। শ্বশুর জীমূতবাহনের এতে আনন্দিত হবারই কথা। কিন্তু অধ্যাপক জীমূতবাহন, বৈজ্ঞানিক জীমূতবাহন, যে-জীমূতবাহন প্রতিভাবান ছাত্র সুপ্রিয় চৌধুরীকে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্যে নিয়ে এসেছিলেন, তিনি কী করে আনন্দিত হবেন? সামান্য সাড়ে তিন শ’ টাকার একটা স্কলারশিপ ছিল সুপ্রিয়র। কিন্তু সঙ্গে স্বপ্নও তো ছিল। সম্ভাবনা? বিজ্ঞানের কী বিরাট সম্ভাবনা সুপ্রিয়র মধ্যে ছিল!
অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল জীমূতবাহনের। কিন্তু বুঝেই বা কী করতেন? জগদানন্দ বোসের নাতনী সাড়ে তিন শ’ টাকা রোজগারের স্বামী নিয়ে কী করতো?
ঈশিতা নিজেই তো বলেছিলেন, “ভাল অফিসের বেয়ারাও আজকাল সাড়ে তিন শ’ টাকা মাইনে পায়!”
বাধা দিতে পারতেন জীমূতবাহন। কিন্তু কী করে পারেন! ঈশিতা ছেলে পছন্দ করেছেন। চিত্রার সঙ্গে জীমূতবাহন কথা বলেননি, কিন্তু সুপ্রিয়র সঙ্গে তাঁকে নিবেদিতা ল্যাবরেটরির বাইরেও ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে।
ঈশিতা বলেছেন, “ছেলেটি বেশ। সংসারেও ঝামেলা নেই। বড় সংসার আমার দু-চোখের বিষ। তোমার মেয়ের একটু হ্যাণ্ডসাম পছন্দ! আর অতি বড় শত্রুও স্বীকার করবে সুপ্রিয় সুন্দর।”
“কন্যা বরয়তে রূপম্” ঈশিতাই তাঁকে বলেছিলেন। খুব দুঃখ পেয়েছিলেন জীমূতবাহন। তিনি আশা করেছিলেন তাঁর মেয়ে অন্তত অত সাধারণ হবে না। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন সুপ্রিয়র গুণেই আকৃষ্ট হয়েছে তাঁর মেয়ে।
না, এ সব চিন্তায় এই রাতদুপুরে নিজেকে বিব্রত করে কী লাভ হচ্ছে? কিছুই না। তবু জীমূতবাহন নিজেকে ঘুমের কোলে সঁপে দিতে পারছেন না। তাঁর চোখে ঘুম নেই ; অথচ এই দুর্ঘটনার জন্যে যে দায়ী, সুপ্রিয়র মতো গবেষককে যে ফেরিওয়ালা হতে বাধ্য করলে, সে পাশের বিছানায় কেমন নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে।
জীমূতবাহন কি তাঁর স্বপ্ন সফল করতে পারবেন? সেই ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞানের যে সাধনা তিনি করে আসছেন, তা কী সার্থক হবে না? প্রশংসা কি মনের ওপর উত্তেজকের কাজ করে? সাফল্য, হাততালি এগুলো কি লক্ষ্যে পৌঁছনর জন্যে ম্যারাথন দৌড়বীরের পক্ষে একান্তই প্রয়োজন?
প্রশংসা, ভালবাসা, উৎসাহ এক সময়ে তিনিও তো পেয়েছেন যথেষ্ট। আচার্য প্রফুল্লচন্দের স্নেহধন্য তিনি। প্রফুল্লচন্দ্র বিশ্বাস করতেন, সস্তা হাততালির মোহে বিভ্রান্ত না হয়ে জীমূতবাহন মানুষের সংসারে বড় কোনো কাজ করে যাবেন। ব্যারিস্টার জগদানন্দ বসু কন্যা স্নেহে অন্ধ হলেও এইটুকু বুঝেছিলেন যে, এই ছাত্রের পিছনে অর্থ বিনিয়োগ করাটা খুব ভুল হবে না।
আর ঈশিতা? যে-ঈশিতাকে জীমূতবাহন সেন বিবাহ করেছিলেন, যে-ঈশিতা তাঁর দীর্ঘপ্রবাসে একদিন ছাড়া একটা দীর্ঘ চিঠি লিখেছেন, যে-ঈশিতা বিছানায় শুয়ে বলেছেন, “আমি চাই তুমি খুব বড় হ, অন্য জামাইবাবুদের থেকে তোমার খ্যাতি যেন সমস্ত দেশে ছড়িয়ে পড়ে か
ঈশিতা লিখতেন, “আমাকে চিঠি লেখার জন্যে তোমার যদি পড়ার সময় নষ্ট হয়, তাহলে বড় চিঠি লিখো না। মাঝে মাঝে শুধু কুশল সংবাদ দিও৷ আমি অবশ্য তোমাকে চিঠি লিখে যাবো।”
ঈশিতাকে নিয়েই ওর বাবা একবার বিলেত বেড়াতে এসেছিলেন। কী রোমাঞ্চকর উত্তেজনার দিন সে-সব! কী কাজ করছ, কেমন ভাবে করছ, গবেষণার লক্ষ্যে পৌঁছতে আর কতদিন লাগবে সব খুঁটিয়ে জিগ্যেস করেছেন ঈশিতা।
ঈশিতা বলেছেন, “জাহাজে ওঠবার আগে স্যর পি সি রায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। উনি কী বললেন জানো?”
“কী বললেন?” জীমূতবাহন ঈশিতার কাঁধে একটা হাত রেখে জিগ্যেস করেছিলেন।
লজ্জায় মুখ রাঙা করে ঈশিতা বলেছিলেন, “এখন বলা যায় না। রাত্রে বলবো।”
দেরি সয়নি জীমূতবাহনের। বলেছিলেন, “এখনই তাহলে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে রাত্রি করে দিচ্ছি।”
চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে ঈশিতা বলেছিলো, “উনি বললেন, বরের খবর নিতে যাচ্ছ যাও, কিন্তু বরের থিসিস দেবার সময় ঘনিয়ে এসেছে—তার মাথা গরম করে দিও না!”
দু‘জনে খুব হেসেছিলেন। ঈশিতা বলেছিলেন, “আসতাম না। প্ৰিভি-কাউন্সিলে বাবার একটা কেস এসে গেল। ভাবলাম বরকে দেখে আসবার এই সুযোগটা ছাড়া যায় না।”
জগদানন্দ বোস কেস শেষ করেই জাহাজে চেপে বসেছিলেন। ঈশিতা স্বামীর অনুরোধ রাখেননি, বাবার সঙ্গেই ফিরে এসেছেন। যাবার আগে বলেছেন, “যন্ত্রপাতি সব পাচ্ছো তো? দরকার হয় তো বলো আমায়!
বাবাকে জানাবো না, আমার গয়না আছে সঙ্গে।”
দু‘একটা যন্ত্রপাতির দরকার ছিল। ঈশিতা কিছুতেই শোনেননি। হীরের দুল বিক্রি করে স্বামীর যন্ত্র কিনে দিয়েছিলেন।
বিশ্বাস হয়? জীমূতবাহন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেন না, সেই ঈশিতাই আজকের ঈশিতার রূপ নিয়ে তাঁর পাশে ঘুমিয়ে রয়েছে।
বিদেশে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের কথা মনে পড়ে যেতো, আর গর্ব হতো যে, মাটির তাল দিয়ে সুন্দরী সুশ্রী স্বপ্নময়ী এক নারী তৈরি করেছেন জীমূতবাহন।
এখন মাঝে মাঝে অন্য কথা মনে হয়। মনে হয় মূর্তি গড়া প্রায় শেষ করে একটু অন্যমনস্ক হয়েছিলেন জীমূতবাহন আর সেই সুযোগে নরম পুতুলটাকে কে চেপ্টে দিয়েছে—একটা বীভৎস সৃষ্টির মালিক হয়েছেন জীমূতবাহন সেন।
দেশে ফিরে এসেছেন জীমূতবাহন। অধ্যাপনার পদ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু ঈশিতা বলেছেন, “তুমি শুধু ছেলে পড়াও তা চাই না আমি। আমি চাই তুমি কিছু আবিষ্কার কর।”
ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে অধ্যাপনার নিমন্ত্রণ এসেছে। জগদানন্দ বসু ততদিনে দেশের কাজে ঝুঁকেছেন। ব্যারিস্টারি করা থেকে দেশের কোটি কোটি মানুষের মুক্তির চিন্তা যে অনেক বড় কাজ, তা বুঝতে আরম্ভ করেছেন। প্র্যাকটিশ ছেড়ে দেবেন ভেবেছেন, কিন্তু মেয়েদের জন্যে প্রচুর টাকা লাগে তাঁর। সংসারের খরচ যে অনেক।
জগদানন্দ বলেছেন, “বিদেশে গিয়ে বিদেশীর সেবা করে টাকা হয়তো পাবে। কিন্তু টাকাটাই কী সব? তুমি আমাদের দেশের কথা ভাবো।”
ঈশিতা বলেছেন, “বাবার কথা তোমাকে যে শুনতেই হবে, এমন কোনো দিব্যি নেই।”
জীমূতবাহন বলেছেন, “আজকে আমি যা, তার পিছনে রয়েছে তোমার বাবার আর্থিক সাহায্য।”
“কিন্তু সে সাহায্য তো তিনি বিনা স্বার্থে দেননি।” বলেছেন ঈশিতা।
“র্ধেক রাজত্বের সঙ্গে যদি রাজকন্যা দিয়ে থাকেন, সেটা তো বাড়তি লাভ।”
“বাড়তি কমতি বুঝি না। তোমার খ্যাতির বাড়তি দেখতে চাই আমরা। তুমি চাকরি নাও।”
চাকরি নিয়েছিলেন, জীমূতবাহন। সঙ্গে ঈশিতাকেও নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু যে কথাটা আজ বার বার মনে হচ্ছে, বিজ্ঞানের সাধনা কি শুধু খ্যাতির বাড়তির জন্যে? সাফল্য দিয়েই শুধু সাধনার বিচার হবে? এ কেমন করে সত্য হয়?
ইনসেকটিসাইডের জগতে জীমূতবাহনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা আন্তর্জাতিক মহলে সমাদর লাভ করেছে। ধীরে ধীরে রসায়নের জগৎ থেকে পতঙ্গের বিস্ময়কর জগতের প্রতি অধিকতর আকর্ষণ অনুভব করেছেন জীমূতবাহন। এটা স্থির বুঝেছেন, রাসায়নিক কীটনাশকের সন্ধান করতে হলে পতঙ্গের রহস্যময় পৃথিবীতেই তাঁকে বিচরণ করতে হবে।
বাধা দেননি ঈশিতা। বরং তাঁকে অনুপ্রেরণাই দিয়েছেন। ওই বয়সে নতুন করে ছাত্র হতে হয়েছে তাঁকে।
এনটমোলজির নতুন ডিগ্রি সংগ্রহ করেছেন জীমূতবাহন। কত কষ্ট করে সংসার চালিয়েছেন ঈশিতা। কারণ সমুদ্রের ওপারে স্বদেশে জগদানন্দ বোস তখন প্র্যাকটিশ ছেড়ে জেলে না ঢুকলেও স্বদেশীদের অর্থসাহায্য করতে ব্যস্ত। জগদানন্দ মেয়েকে লিখেছেন, “আশা করি, তোমরা জীমূতের রোজগারেই চালিয়ে নিতে পারবে।”
তারপর সাফল্য এসেছিল! সাফল্যের জোয়ার যেন জীমূতবাহনের জীবনকে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছিল। কীটনাশকের গবেষণায় একদিন গভীর রাত্রে জীমূতবাহন যে সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন, তার থেকেই একটা পেটেণ্ট জোগাড় হয়েছিল। সেই পেটেন্টের খবর পেয়ে ইউরোপ আমেরিকার বাঘা বাঘা কেমিক্যাল ফার্ম তাঁর পেছনে ঘোরাঘুরি শুরু করেছিল।
জীমূতবাহন বলতেন, “এইসব টাকা পয়সার ব্যাপারে ঈশিতা তুমিই আমার সেক্রেটারির কাজ কর। হাজার হোক ব্যারিস্টারের মেয়ে তুমি।”
“ঠিক বলেছো।” প্রবল উৎসাহে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন ঈশিতা।
আর ল্যাবরেটরির নির্জন কক্ষে আরও বেশী সময় কাটিয়েছেন জীমূতবাহন। এই পৃথিবীতে মানবশিশুর জন্মসংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই তো মাত্র সেদিন পৃথিবীর লোকসংখ্যা যা ছিল, এখন তার দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ পৃথিবীতে বিচরণ করছে। এই কোটি কোটি মানুষের ক্রমবর্ধমান ক্ষুধার অন্ন কেমন করে জুটবে, যদি না পতঙ্গের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়? পতঙ্গদের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ই তো রাসায়নিক সংগ্রাম—কেমিক্যাল ওয়ারফেয়ার।
সেই সংগ্রামে যে প্রচণ্ড অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন জীমূতবাহন, তা কীসের জন্যে? নিজেকেই মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় জীমূতবাহনের। বিজ্ঞানের নির্মল সাধনাই কি ছিল একমাত্র লক্ষ্য, না অর্থের লোভ?
প্রচুর অর্থ পেয়েছিলেন জীমূতবাহন। দূর-দূরান্তে পৃথিবীর শস্যক্ষেত্রে পতঙ্গের অত্যাচার যত বেড়েছে, কেমিক্যালের বিক্রি ততই ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে, আর ততই মোটা অঙ্কের চেক পেয়েছেন জীমূতবাহন। ঈশিতাও সেই সঙ্গে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছেন।
জীমূতবাহনের সংসারে নতুন অতিথিদের আগমন শুরু হয়েছে। একে একে চারটি মেয়ের মা হয়েছেন ঈশিতা। ঈশিতার মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা লক্ষ্য করেছেন জীমূতবাহন। যে-ঈশিতা হীরের দুল বিক্রি করে তাঁর যন্ত্র কিনে দিয়েছিলেন, আর মেয়েদের নিয়ে সদাব্যস্ত এই ঈশিতা এক নয়। ঈশিতা বড়বেশী সংসারী হয়ে উঠছেন। পাউণ্ড শিলিং পেন্স আর দুশ্চিন্তামুক্ত ভবিষ্যৎ এই দুটোর মধ্যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আবিষ্কার করছেন তিনি।
প্রতিটি মেয়ের মধ্য দিয়ে রঙীন সব স্বপ্ন দেখেন ঈশিতা সেন। ঈশিতার মধ্যে এতো অ্যামবিশন যে এইভাবে ঘুমিয়ে ছিল তা জীমূতবাহন কোনোদিন বুঝতে পারেননি।
চাকরির সুযোগ এসেছে। লোভনীয় চাকরি। কিন্তু জীমূতবাহন মনস্থির করে উঠতে পারেননি।
ঈশিতা বলেছেন, “কোম্পানিতে বসেও তো তুমি নিজের বিষয়ে কাজ করার সুযোগ পাবে—বরং বেশী সুবিধে হবে।”
“তাই কি?” প্রশ্ন করেছেন জীমূতবাহন।
“কেন নয়?” ঈশিতা বলেছেন, “স্বীকার করি বিশ্ববিদ্যালয়ই এখনও গবেষণার কেন্দ্র, কিন্তু পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানিগুলোর ল্যাবরেটরিতে কম কাজ হয় না। ডু পণ্ট, আই-সি-আই, ইউনিয়ন কারবাইড, বেল টেলিফোন, ডুফার ও ফিলিপস্ ল্যাবরেটরিতে কত আশ্চর্য জিনিসের অনুন্ধান চলেছে। আমেরিকান সাইনামাইড, ফাইজার, পার্ক ডেভিস, লেডারলি, স্কুইব, গ্ল্যাক্সো এবং বেয়ারের গবেষণাগারে মানুষের মঙ্গলের এবং ব্যাধিমুক্তির কম প্রচেষ্টা চলছে না।”
অবাক হয়ে যেতেন জীমূতবাহন। বিদেশী পরিবেশে ঈশিতা নিজেকে সব সময় আপটুডেট রেখেছে। “ঈশিতা, তুমি যদি ব্যারিস্টার হতে, তোমার বাবার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারতে।”
ঈশিতা হাসতে হাসতে উত্তর দিয়েছেন, “তার থেকে যদি নার্স হতাম, তা হলে মেয়েগুলোর বেশী যত্ন করতে পারতাম।”
জীমূতবাহন উপলব্ধি করেছেন, ঈশিতার যুক্তিতে কোনো ভুল নেই। “গবেষণাই যদি লক্ষ্য হয়, কোন্ গবেষণাগারে কাজ করলাম সেটা বড় কথা নয়। যেখানে সুযোগ সুবিধা বেশী, সেইটাই আদর্শ জায়গা। ”
মোটা মাইনের সেই চাকরির দিনগুলোর কথা জীমূতবাহন আজও মনে করে রেখেছেন। জীমূতবাহন এখন বিশ্বাস করেন, মানুষের ভাগ্যের নদীতেও জোয়ারভাটা খেলে। একদিন তাঁর জীবনেও ভরা কোটালের জোয়ার এসেছিল। সম্মান প্রতিপত্তির সঙ্গে সঙ্গে সাফল্যও এসেছিল।
সামান্য কয়েক বছরের মধ্যে ইনসেকটিসাইডের ক্ষেত্রে জীমূতবাহন যা নতুন আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন, তা বহু প্রতিভাবান গবেষক সমস্ত জীবনেও পারেননি। অবশ্য তখন কাজের সুযোগও ছিল যথেষ্ট। কত রকমের কীট-পতঙ্গ কত বিচিত্র রকমের ফসলের সর্বনাশ করছে। কেউ চারা অবস্থায়, কেউ ফলন্ত অবস্থায়, কেউ বীজ অবস্থায়, আবার কেউ গুদামে ক্ষুধার্ত কীটের লক্ষ্যস্থল হয়ে উঠছে। একটা ওষুধে তাদের সবাইকে দমন করা যায় না। আবার পতঙ্গ দমন করতে গিয়ে ফসল অজান্তে বিষময় হয়ে উঠলো, এমন উদাহরণেরও অভাব নেই। তাই প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়।
বিশাল খামারে নতুন নতুন ওষুধের ব্যবহার করে জীমূতবাহন ফলাফল লক্ষ্য করতেন। শুধু এইভাবে লক্ষ্য করেই যদি তিনি আরও নতুন আবিষ্কারের পথ খুঁজে পেতেন, তাহলে আজকের পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হতো না জীমূতবাহনকে। এই পরীক্ষা জীমূতবাহন এক জায়গায় দিচ্ছেন না। কত আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। কোথাও বিচারক ঈশিতা। সন্তানদের নিয়ে অভিযোগকারিণীও সে।
আবার কোথাও বৈজ্ঞানিক সমাজের সামনে জবানবন্দী দিচ্ছেন জীমূতবাহন। তাঁরা হাসছেন, তাঁরা বলছেন, “ডক্টর সেন, তুমি ভুল করেছো। যে-লাইনে তোমার নাম হয়েছিল, তাতেই লেগে থাকলে পারতে। কোথায় রাসায়নিক ইনসেটিসাইড, আর কোথায় তোমার পোকা দিয়ে পোকা মারার আজব পরিকল্পনা!”
কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে যেতেই হবে জীমূতবাহনকে। কালের বিচারশালায় একদিন প্রমাণিত হবে জীমূতবাহন ঠিক করেছিলেন, না ভুল করেছিলেন।
কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে করতেই মনের আকাশে নতুন চিন্তার মেঘ জমা হতে শুরু হয়েছিল। ডি ডি টি, এনড্রিন, লিনডেন, প্যারাথিওন, ডায়াজিনন, কেলথেন, ম্যালাথিয়ন, ক্লোরোডেন, টক্সাফিন, হেপ্টাক্লোর, গামা বি এইচ সি ইত্যাদি কেমিক্যালের প্রয়োজন আছে এবং থাকবে। কিন্তু প্রকৃতির রাজ্যেও ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল নিয়মের প্রয়োগ করে আরও আশ্চর্য ফল পাওয়া যেতে পারে। অনন্তকাল ধরে হাতে, মেশিনে এবং উড়োজাহাজ থেকে ওষুধ ছড়িয়ে পতঙ্গের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোনো অর্থ হয় না।
কেমিক্যাল ল্যাবরেটরিতে পতঙ্গের মৃতদেহের মধ্যে দাঁড়িয়ে জীমূতবাহন ভেবেছেন, এই সর্বনাশা বিষে মানুষের কত বন্ধু পোকাকেও আমরা হত্যা করছি। যেসব সবুজ ফসলে আমরা ফলের জন্মের অনেক আগে এই বিষ ছড়াচ্ছি, গরুবাছুররা সেই পাতা খাচ্ছে। আজ তাদের দুধের মধ্যেও বিষের লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
রসায়নবিদদের যুক্তি তিনি জানেন। তাঁরা বলেন, ‘এর থেকে এইটুকু প্রমাণ হয়—খুব সাবধানে এই সব বিষ প্রয়োগ করতে হবে।’
জীমূতবাহন তাঁদের সঙ্গে একমত। কিন্তু তাঁর ধারণা, আরও অনেক সহজে, অনেক কম খরচে এবং অনেক নিশ্চিন্তভাবে আমরা ফল পেতে পারি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলে।
কত পোকা রয়েছে যারা অন্য পোকা খেতে পেলে আর কিছুই চায় না। আর প্রকৃতির রাজ্যে যে কোটি কোটি স্ত্রী-পতঙ্গ রোজ গর্ভবতী হচ্ছে, তাদের অনেকেই সন্ধান করছে পোষক পতঙ্গকে, যার দেহে প্রসব করে দিয়ে তারা পালাতে পারে। যদি জীমূতবাহনের ক্ষমতা থাকতো তাহলে এইসব প্যারাসাইটদের জীবন নিয়ে এক মহাকাব্য রচনা করতেন।
জীমূতবাহন যখন চাকরি ছেড়ে দেবার প্রস্তাব করলেন তখন ঈশিতা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। “কী বলছো তুমি?”
একটু বিরক্ত হয়েছিলেন জীমূতবাহন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে তিনি কিসের চর্চা করবেন, সেটা নির্বাচনের স্বাধীনতা নিশ্চয় তাঁর আছে। যে-পথে দুটো পয়সা আছে, যে-পথে সহজে সাফল্য আসতে পারে, সবাই সে-পথের যাত্রী হলে চলবে কেন? বেশ তো কেটেছে এতোদিন। যে ক’টা পেটেণ্ট আছে, সেগুলো ভাঙিয়ে এখনও কয়েকটা বছর ডাল-ভাতের ব্যবস্থা হবে।
ঈশিতা বলেছিলেন, “তুমি ভুলে যাচ্ছ—একটা নয়, চারটে মেয়ের বাবা তুমি।”
“আমি তো সে দায়িত্ব অস্বীকার করছি না।”
“মুখে করছো না, কিন্তু কাজে করছো। এই চাকরি ছেড়ে তুমি অর্ডিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যেতে চাইছো। তাও সামান্য এক শিক্ষকের পদে।”
জীমূতবাহন বলেছিলেন, “আমার কাজের সুবিধেও তো দেখতে হবে।”
“মানুষ কাজ করে কেন? ছেলেপুলে সংসারের জন্যেই তো?” ঈশিতার সেই প্রশ্নটা আজও জীমূতবাহনের কানে বাজে।
আজ রাত্রে জীমূতবাহন নিজেকে আবার জিগ্যেস করলেন, মানুষ কাজ করে কেন? কেন মানুষ কাজ করে? ছেলে বউকে খাওয়াবার জন্যে, নিজের পেট ভরাবার জন্যে শুধু? শুধু মাইনের লোভে? বেশী টাকার লোভেই কি লোকে আরও পরিশ্রম করে?
ঈশিতা একদিন রাত্রে রেগে গিয়ে বলেছিলেন, “কিছু কিছু লোক আছে যারা নামের লোভে ঘুরে মরে।”
নাম? খ্যাতি? জীবনে এইটাই কি সবচেয়ে বড় কথা? শুধু কি নামের লোভে অমন সুখের মার্কিনী চাকরি ছেড়ে জীমূতবাহন বিলিতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গিয়েছিলেন?
কিন্তু সেখানেও তো টিকতে পারলেন না তিনি। এতোদিন ঘুরে ঘুরে আবার ভারতবর্ষে ফিরে আসতে হলো তাঁকে।
“কোনো চাকরি না নিয়ে তুমি ইণ্ডিয়ায় যাচ্ছ—এমন সোনার সুযোগ লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছ তুমি,” ঈশিতা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন। “তুমি কি আমাদের ভালবাস না?” ঈশিতা জানতে চেয়েছিলেন।
কেন ভালবাসবেন না, নিশ্চয় ভালবাসেন—ঈশিতাকে, তাঁর প্রত্যেকটি মেয়েকে তিনি প্রাণের থেকেও ভালবাসেন। কিন্তু তা বলে, সিকিউরিটি প্রেসে ছাপা গভর্নমেন্টের কয়েকখানা কারেন্সি নোটের জন্যে তাঁর মন যা চাইছে না, তাই আজন্ম করতে হবে?
ঈশিতা ভাবছেন স্বামীর ঘাড়ে ভূত চেপেছে। গবেষণার ভূত। এমন গবেষণা যা কোনোদিন সফল হবে না। বন্ধুরাও দু‘একজন বলেছে, এর নামই বুনো হাঁসের পিছনে ছোটা।
যদি তাই হয়, যদি কোনোদিন হাঁস ধরা না পড়ে, কিছু তথ্য তো পাওয়া যাবে। বুনো হাঁসেরা কেমন দেখতে, তাদের গতি কত এগুলোও তো ভাবীকালের হাঁসধরার। জীমূতবাহনের কাছ থেকে জানতে পারবে। তার কি কোনো দাম নেই?
ঈশিতার কান্নাতেও জীমূতবাহন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেননি। সরকারী গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ হয়তো পাওয়া যেতো। কিন্তু জীমূতবাহন স্বাধীনতা চান।
সেই সময় একটা সুযোগ জুটে গিয়েছিল। বন্ধুবর অম্বালাল দেশাই এই জমির ব্যবস্থা করে দিয়ে সাহায্য করেছিলেন। আর দু‘একটা ট্রাস্ট এবং ফাউণ্ডেশন থেকে কিছু চাঁদার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গিয়েছিল।
এই নিয়েই শুরু হয়েছিল নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি। এর সবটাই কি তাঁর বোকামির ফল?
পাশের খাটটা নড়ে উঠলো। ঈশিতা বোধ হয় ঘুমের ঘোরেই পাশ ফিরলেন।
জীমূতবাহনের আজ কি ঘুম আসবে না? রাত তো অনেক হলো।
জীমূতবাহন রাত্রি জাগতে অভ্যস্ত—কিন্তু সে রিসার্চের কাজে। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজলী বাতিগুলো তাঁর সুদীর্ঘ রাত্রি জাগরণের সাক্ষ্য দেবে। কাজের নেশা চাপলে খেয়াল থাকে না। তাছাড়া সব পোকাই তো রাত্রে ঘুমোয় না। রাত্রিই অনেক পোকার দিন। তাদের সকলের সেবাযত্ন করা ল্যাবরেটরির এই বারো-তেরোটা লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেক কাজই তাই নিজে করতে হয় এবং নিজে করতেও ভালবাসেন জীমূতবাহন।
এবার হয়তো একটু হাল্কা হতে পারবেন তিনি। অমিতাভ ছেলেটির দায়িত্বজ্ঞান আছে। শেখবার এবং জানবার আগ্রহ তার অসীম। তাঁর নিজের তুলনায় ওর মনটা এখনও অনেক সবুজ আছে। তাই অনেক সমস্যার সহজ সমাধান দেখতে পায় সে, যা জীমূতবাহন নিজে খুঁজে বার করতে পারেননি। অমিতাভকে তিনি মনের মতন করে গড়ে তুলবেন। অতি সামান্য থেকেই পৃথিবীর অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের শুরু হয়েছে। একদিন এই নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিও বড় হয়ে উঠবে—একদা শস্যশ্যামলা এই জন্মভূমির ঋণ কিছুটা শোধ করে যাবেন জীমূতবাহন। অমিতাভকে তিনি এমনভাবে গড়ে তুলবেন যে, যেদিন তিনি থাকবেন না, সেদিনও নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির কোনো অসুবিধা হবে না।
লোভ। জীমূতবাহন সেন বেশ বুঝতে পারছেন, লোভেই সর্বনাশ হচ্ছে আমাদের। আজ যদি নাপিতের চাকরিতে বেশী পয়সা পাওয়া যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের সেরা ছাত্ররাও সেই চাকরির পিছনে ছুটবে। অমিতাভর লোভ নেই, এটা খুব আশার কথা। লোভ না করলেই যে শেষ পর্যন্ত লাভ হবার আশা থাকে, এটা মানুষরা বুঝতে চায় না। তাঁর স্ত্রী অন্ততঃ কিছুতেই তা বুঝবেন না। তবে একটা বিশ্বাস আছে জীমূতবাহনের, টাকার অভাবে কোনো বড় কাজ আটকে যায় না। আজ পর্যন্ত তাঁর টাকার অভাব হয়নি! নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির কাজ কোনোদিন আটকে যায়নি, যাবে বলেও মনে হয় না।
ঈশিতা আবার পাশ ফিরলেন। ওঁকে কোনো পোকা কামড়াচ্ছে না তো? ঈশিতার দিকে শঙ্কিতভাবে তাকিয়ে রইলেন জীমূতবাহন। ঈশিতার একটা প্রশ্ন জীমূতবাহনের মোটেই ভালো লাগেনি। অমিতাভর বয়স জিজ্ঞাসা না করলেই জীমূতবাহন খুশী হতেন।
রাত্রি বোধ হয় শেষ হতে চললো। ঘুমের পোকারা আজ ধর্মঘট করেছে। কিংবা ঈশিতাকে দেখেই তারা পালিয়েছে। ঈশিতা তো বেশীদিন থাকেন না।
ল্যাবরেটরির নতুন জমি দেখেই ঈশিতা বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন। “পোকা-মাকড়ের পক্ষে এটা আদর্শ স্থান হতে পারে, কিন্তু মানুষের পক্ষে নয়।”
“এখানে অনেক লোক থাকেন—তাঁদের ছেলেপুলেও আছে,” জীমূতবাহন উত্তর দিয়েছিলেন।
“ওসব শুনিয়ে লাভ নেই। আমি মা, চোখের সামনে মেয়েদের গোল্লায় যেতে দিতে পারবো না। একটু বড় শহরে থেকে বিজ্ঞানের কি কোনো উন্নতি করা যায় না? তোমার সন্তানদের ওপর তোমার কি কোনোরকম দায়িত্ব নেই?” শ্লেষের সঙ্গে জিগ্যেস করেছিলেন ঈশিতা।
জীমূতবাহনের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে, ঈশিতা শেষ পর্যন্ত বলেছিলেন, “বেশ, তুমি এখানে পতঙ্গ প্রতিপালন করো, আর আমি কলকাতায় গিয়ে তোমার সন্তান পালন করি!”
দুটো সংসার না চালাতে পারলেই ভাল হতো। কিন্তু ঈশিতাকে সে কথা মুখ ফুটে বলা যায় না। “আমার বাবা বেঁচে থাকলে, তোমার কাছে পয়সার কথাও তুলতাম না। মেয়ের পড়ার খরচ দিয়েছেন, জামাই-এর খরচ জুগিয়েছেন, নাতনীদের খরচও দিতেন খুশী হয়ে,” ঈশিতা বলেছিলেন।
একটু চা খেতে পারলে মন্দ হতো না। ভোর হতেও দেরি নেই। তারপর একবার ল্যাবরেটরির দিকে যেতে হবে। কতকগুলো বীলকে কনস্ট্যান্ট টেম্পারেচারে রাখার দরকার ছিল, চেম্বারের এয়ারকণ্ডিশন মেশিনটা ঠিক রেগুলেট করে এসেছিলেন কিনা মনে পড়ছে না।