৫
“নমস্কার”, কটেজের ড্রইং রুমে একটা ইজিচেয়ারে আধ-শোয়া অবস্থায় দূর থেকে ইন্দুমতীকে দেখেই অমিতাভ প্রভাতের শুভেচ্ছাটা ছুঁড়ে দিল।
গায়ে একটা হাল্কা চাদর জড়িয়ে ইন্দুমতী অমিতাভর ঘরে ঢুকে পড়ল। নমস্কার জানিয়ে বলল, “রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো!”
“ঘুম ভালই হয়েছিল। দু‘দিন রেলযাত্রার শোধ এক রাতেই তুলে নিয়েছি।” অমিতাভ হাসতে হাসতে বললে।
ইন্দুমতী একটু আশ্বস্ত হলো। “তাও ভাল। আমার ভয় হচ্ছিল মাস্টারমশাই হয়তো বহুরাত পর্যন্ত আপনাকে জাগিয়ে রাখবেন। ল্যাবরেটরি এবং গবেষণা সম্বন্ধে কথা বলতে আরম্ভ করলে ওঁর কোনো খেয়ালই থাকে না। ”
“তাই নাকি?” অমিতাভ জিগ্যেস করলে।
একটা চেয়ারে বসে পড়ে ইন্দুমতী বললে, “সেবার টোকিও থেকে প্রফেসর মিচিকানা যখন এলেন, দুই বন্ধুতে খাওয়া-দাওয়ার পর একদিন আলোচনা করতে বসলেন। তারপর কখন যে রাত কেটে গেছে দু‘জনের কেউ খেয়াল করেননি। সকালবেলায় প্রফেসর মিচিকানার খবর নিতে এসে দেখি খুব ঘুমোচ্ছেন—শুনলাম সাড়ে পাঁচটার সময় শুতে এসেছেন, তাও মাস্টারমশাই পৌঁছে দিয়ে গিয়েছেন।”
অমিতাভ হাসতে হাসতে বললে, “না, আমার সমস্ত রাত জাগবার সৌভাগ্য হয়নি।”
ইন্দুমতী বললে, “সেদিন মাস্টারমশাইকে খুব বকেছিলাম। মাস্টারমশাই স্বীকার করলেন, দুই বন্ধু মিলে সারারাত ধানের পোকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। হিস্পা আর্মিজেরা, প্যাডি বাগ, চুঙ্গী পোকা, ভেঁপু পোকা আরও কত কী! ধানের শিষ কাটা লেদা পোকা অর্থাৎ সার্ফিস ইউনিপাংটাটা নিয়ে তর্ক করতে করতে দু‘জনের মধ্যে কথা বন্ধ না হলে হয়তো আরও চলতো। আমরা তো রেগে গিয়ে শেষপর্যন্ত মিচিকানাকে প্যাডিকানা বলে ডাকতাম।”
“ধানকানা বলেননি এই যথেষ্ট,” বলে অমিতাভ হাসতে লাগল।
ইন্দুমতী বললে, “সকালে আর একবার খোঁজ নিয়েছিলাম, তখনও আপনি দরজা খোলেননি। মাস্টারমশাইয়ের কড়া হুকুম কেউ যেন আপনার ঘুমের ব্যাঘাত না করে। এখানকার লোকদের বদনাম আছে, মোরগ ডাকার আগেই তারা উঠে পড়ে।”
“তাই নাকি? তাহলে তো বিপদের কথা! আমি একটি লেট লতিফ!” ইন্দুমতীর দিকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে অমিতাভ বলে।
ইন্দুমতী হেসে বললে, “আপনার সঙ্গদোষে মাস্টারমশাইয়ের যদি কিছু অধঃপতন হয়, তাহলে আমরা অনেকেই খুশী হই। উনি ভোর চারটের সময় উঠে পড়ে ল্যাবরেটরিতে ঢোকেন। ল্যাবরেটরি ইনসেক্টদের স্টাডি করবার ওইটাই নাকি প্রশস্ত সময়!”
অমিতাভর যে চা খেতে ইচ্ছে করছিল, তা ইন্দুমতী তার মুখের ভাব দেখেই বুঝে নিল। ইন্দুমতী জানালে, “হরিমোহনকে বলে এসেছি, আপনার এবং আমার চা সে এখানে নিয়ে আসছে।”
হরিমোহন চা এনে হাজির করলো। ইন্দুমতী নিজেই চা তৈরি করতে শুরু করলে। চা ঢালতে ঢালতে বললে, “একটা জিনিস বলা হয়নি আপনাকে, মশারি টাঙাতে ভুলবেন না। পোকামাকড়ের আড়তে বসে আছেন। মাস্টারমশাইয়ের ল্যাবরেটরিতেও কয়েক হাজার মশা বংশবৃদ্ধি করছে। দু-চারটে যে সেখান থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢুকবে না, এ-কথা গ্যারান্টি দেওয়া যায় না।”
ইন্দুমতী নামটা অমিতাভর একটু সেকেলে সেকেলে ঠেকেছিল। পরিচয়টাও জানবার আগ্রহ হচ্ছিল না এমন নয়। কিন্তু ইন্দুমতী নিজেই এবার যা প্রকাশ করলে তার জন্যে অমিতাভ প্রস্তুত ছিল না।
ইন্দুমতী বললে, “আমার পুরো নামটা আপনাকে বলে রাখা ভাল– ইন্দুমতী দেশাই, আমার দেশ গুজরাটে।”
বিস্মিত অমিতাভ বললে, “আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। এমন সুন্দর বাংলা শিখলেন কেমন করে?”
হেসে উঠলো ইন্দুমতী। “আমার বাংলার একটা সার্টিফিকেট পাওয়া গেল। বাবা বলেন, আমার বাংলায় যথেষ্ট দোষ আছে। ছোটবেলায় তিনি শান্তিনিকেতনে পড়েছিলেন ; ওঁর কথা শুনলে বোঝা মুশকিল যে তিনি বাঙালী নন।”
অমিতাভ বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলো। ইন্দুমতী বললে, “আমার বাবা অম্বালাল দেশাই মাস্টারমশাইয়ের বিশেষ বন্ধু। ভক্তও বটেন। সংসারের চাপে পারিবারিক ব্যবসা নিয়েই তিনি ব্যস্ত থাকেন। ইটালিয়ান কোলাবরেশনে একটা ওষুধের কারখানা খুলেছেন আমেদাবাদে। কিন্তু রিসার্চে খুব ঝোঁক।”
অমিতাভ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইন্দুমতীর কথা শুনতে লাগল। “আমেরিকায় মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে আমার বাবার প্রথম আলাপ। তখন আমার পাঁচ বছর বয়েস। তারপর এই এতোদিন ধরে দু‘জনের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়েছে। এই যে বিদেশী সহযোগিতায় নতুন কারখানা হয়েছে, যোগাযোগটা মাস্টারমশাই করিয়ে দিয়েছিলেন। ওঁর দুটো পেটেন্ট থাকায় কেমিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল মহলে বেশ জানাশোনা।”
অমিতাভ অভিযোগ করল, “আপনি কিন্তু চা খাচ্ছেন না, মিস দেশাই।” ইন্দুমতী বললে, “বাড়িতে আমরা চা খাই না। যা বলছিলাম, বাবা মাস্টারমশাইকে ডিরেক্টর বোর্ডে যোগ দিতে বলেছিলেন। মাস্টারমশাই রাজী হলেন না। বড় খেয়ালি লোক। যখনই দরকার হয়, বাবা অবশ্য চলে আসেন। উপদেশ নিয়ে যান।”
অবাক হয়ে অমিতাভ শুনছিল। ইন্দুমতী বললে, “আমি যে বিজ্ঞান পড়ছি, তাও মাস্টারমশাইয়ের আগ্রহে। বোম্বাই ইউনিভার্সিটি থেকে এম এস-সি পাস করেছি। তারপর ডি-ফিল-এর জন্যে তৈরি হচ্ছি। ওখানে নামটা রেজেস্ট্রি করা আছে—আমার আসল রিসার্চ গাইড মাস্টারমশাই। যখন খুশি চলে আসি। কোনো প্রবলেম হলেই মাস্টারমশাইকে জ্বালাতন করি।”
“তার মানে আপনি এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা নন?” অমিতাভ প্রশ্ন করে।
“অস্থায়ী বাসিন্দা বলতে পারেন। বাবার মতে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি তো শুধু একটা গবেষণাগার নয়—এটা একটা আশ্রমের মতো। একদিন এই ল্যাবরেটরিকে কেন্দ্র করেই হয়তো বিশ্বভারতীর মতো আর একটা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে, যেখানে ন্যাচারাল সায়েন্সের চর্চা হবে। দেশবিদেশের ছাত্রছাত্রীরা উচ্চতর গবেষণার জন্যে নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন।”
“নিবেদিতা কে আপনি জানেন?”
“জানি না মানে? বাবা এবং মাস্টারমশাই এরা দু‘জনেই নিবেদিতার বিশেষ ভক্ত। মাস্টারমশাই তো বলেন, আমরা এই বিদেশিনীকে বুঝে উঠতে পারিনি ; তার দানের কণামাত্র পরিশোধের চেষ্টা করেনি ভারতবর্ষ। আমাদের বাড়িতে ওঁর লেখা সব বই আছে। আর ওঁর বাগবাজারের বাসায় এবং নিবেদিতা গার্লস স্কুলেও গিয়েছি আমি। মাস্টারমশাই বলেন, ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার ইতিহাস যেদিন লেখা হবে সেদিন নিবেদিতা সম্বন্ধে আরও অনেক কিছু প্রকাশিত হবে। আচার্য জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-সাধনার সাফল্যের পিছনেও নিবেদিতার দান কম নয়। এক সময় তাঁর প্রতিটি ইংরেজি লেখা নিবেদিতা দেখে দিয়েছেন ; বিলেতের বৈজ্ঞানিক মহলে তাঁর প্রাথমিক পরিচিতির ব্যবস্থা সিস্টার নিবেদিতাই করেছিলেন।
;
ঘড়ির দিকে তাকালে ইন্দুমতী। “মাস্টারমশাই কয়েকটা কাজ দিয়েছেন, সেগুলো যাবার আগে করে দিয়ে যাবো।”
“কবে যাচ্ছেন?” অমিতাভ প্রশ্ন করে।
“এক সপ্তাহের মধ্যেই। আমার বড় কষ্ট হয় মাস্টারমশাইয়ের জন্যে। কত বাজে কাজ যে ওঁকে নিজে হাতে করতে হয়। যে ক’দিন থাকি ওঁকে সাহায্য করি।”
“নিজে হাতে করতে হয়?” আমিতাভ প্রশ্ন করে।
অমিতাভর কাপে আর একটু চা ঢেলে দিয়ে ইন্দুমতী বললে, “কী করবেন বলুন? লোকজন নেই। বেশী লোকজন রাখতে হলে অনেক টাকা দরকার। সে-টাকা মাস্টারমশাই পাবেন কোথায়? কয়েকজন ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট না রাখলেই নয়—তাদের মাইনে আছে। টাকা বাঁচাবার জন্যে চিঠিপত্তর টাইপ করার কাজ উনি নিজেই করেন। আমি এলে যতটা পারি সাহায্য করি। ওঁর রিসার্চের পেপারগুলো টাইপ করতে আমার খুব ভাল লাগে। টাইপও হয়, আমার পড়াও হয়ে যায়। জীপ আছে, কিন্তু আলাদা ড্রাইভার নেই। আবার একটা এক্স-রে মেশিন আসছে। সেটা কে চালাবে জানি না।”
ইন্দুমতী মেয়েটি বেশ সরল ; কিন্তু অনেক খবর রাখে সে। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির ভিতরের সব খবর তার মুখস্থ। অসুবিধা অনেক আছে, কিন্তু এই ল্যাবরেটরির খ্যাতি একদিন যে দেশের সীমানা পেরিয়ে সমস্ত পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, সে-সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহ নেই।
“যেখানে ইনসেক্ট নিয়ে কাজ হচ্ছে, সেখানে এক্স-রে মেশিন কী হবে?” অমিতাভ জানতে চায়।
“নিশ্চয় দরকার আছে। মাস্টারমশাই আপনাকে নিশ্চয়ই সব বলবেন সময়মতো। আপনার ওপর অনেক ভরসা করে বসে আছেন।”
“আমার ওপর?”
“বিলেত থেকে ফিরে এসে পর্যন্ত আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ তিনি। আপনাকে টেলিগ্রাম পাঠাবার পর মাস্টারমশাইয়ের কী উত্তেজনা! আমাকে পর্যন্ত রোজ জিগ্যেস করতেন, তোমার কী মনে হয় ইন্দুমতী? অমিতাভ কি এখানে আসবে?”
“আমাকে কতটুকু দেখেছেন মাস্টারমশাই?” লজ্জা পেয়ে অমিতাভ প্রতিবাদ করে।
“তা জানি না, যাঁরা দেখতে জানেন, অল্প দেখাতেই কাজ হয়ে যায় তাঁদের।” ইন্দুমতী হাসতে হাসতে উত্তর দেয়।
আবার গম্ভীর হয়ে যায় ইন্দুমতী। “যখন দেখি মাস্টারমশাই বেলা দুটোর সময় নিজের খাবার কথা ভুলে পোকামাকড়দের খাওয়াচ্ছেন, যখন দেখি গভীর রাতে আরশোলাদের খাঁচাগুলোর টেমপারেচার কন্ট্রোল করছেন, কিংবা উইপোকাদের ঢিবিটা ঢাকা দেবার জন্যে বৃষ্টির মধ্যে ওয়াটারপ্রুফ নিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তখন বেশ দুঃখ হয়।”
“ডঃ সেন কি উইপোকাও পুষছেন?”
“শুধু উইপোকা? চলুন আজই দেখাবো আপনাকে। এ এক আজব চিড়িয়াখানা। এখানে কত রকমের জীবন্ত কীটপতঙ্গ আছে দেখলে সাধারণ লোক ভয় পেয়ে যাবে।”
ইন্দুমতীকে একটু অপেক্ষা করতে বলে অমিতাভ ভিতর থেকে জামা পাল্টে এল। ইন্দুমতী বললে, “চটি নয়, বুট পরে নিন। অমানান হলেও আমি বুট পরেছি। না হলে মাস্টারমশাই বকবেন।”
ল্যাবরেটরিটা বিরাট মনে হচ্ছে। দুনিয়ার অজস্র কীটপতঙ্গ সংগ্রহ করে সত্যিই এক আজব চিড়িয়াখানা তৈরি করেছেন জীমূতবাহন সেন!
সূর্য ওঠার আগেই ডক্টর সেন নিশ্চয় কাজে লেগে গিয়েছেন। কিন্তু তাঁকে কাছাকাছি কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে একটা কাঁচের জারের সামনে এসে ইন্দুমতী দাঁড়িয়ে পড়ল। জারের মধ্যে গোটাকয়েক পোকা রয়েছে। তাদের দেখতে দেখতে ইন্দুমতী বললে, “যদি কিছু মনে না করেন, একটু অপেক্ষা করবেন?”
অমিতাভ বললে, “নিশ্চয়। ভিজিটরের জন্যে কাজ আটকে থাকতে পারে না।”
ইন্দুমতী বললে, “এদের দায়িত্ব আমার ওপর আছে—একটু খোঁজখবর নিয়ে নিই। এক ধরনের গুবরে পোকা, এখানে নতুন এসেছে। নাগপুরে এদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।”
অমিতাভ সরে গিয়ে পোকাগুলোর দিকে ভাল করে তাকাল। ইন্দুমতী বললে, “লেবুগাছের উইভিল পেস্ট।”
“সাইট্রাস প্ল্যান্টে এদেশে তেমন উইভিল হয় না শুনেছিলাম।”
অমিতাভ প্রশ্ন করে।
ইন্দুমতী বললে, “বেশী হতে কতক্ষণ, মাস্টারমশাই বলছিলেন।”
ভাল করে লক্ষ্য করে অমিতাভ বললে, “এরা কি মিলোসেরাস?”
খাতার দিকে নজর দিয়ে ইন্দুমতী বিস্ময়ের সঙ্গে জিগ্যেস করলে, “ধরলেন কী করে? ভারতবর্ষে খুবই দুষ্প্রাপ্য স্পেসিমেন।”
অমিতাভ বললে, “এনটমোলজি জার্নালে এদের সম্বন্ধে লেখা পড়েছি। কী খাওয়াচ্ছেন এদের?”
“মাস্টারমশাই আঙুরপাতা ছাড়া আর কিছু দিচ্ছেন না। কী পেটুক দেখুন না, একটা পোকা একখানা গোটা পাতা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খেয়ে ফেলেছে। ”
“ল্যাবরেটরিতেই যখন এত খিদে রয়েছে, গাছে এরা কী ভয়াবহ ক্ষতি করতে পারে বুঝুন।” অমিতাভ বললে।
“আপেল গাছে, আঙুরলতায়, লেবু গাছে বিষাক্ত কীটনাশক বেশী ছড়ানোর পক্ষপাতী নন মাস্টারমশাই। অজ্ঞাতে এই সব ফল দিনের পর দিন খেয়ে মানুষ হয়তো তার সমূহ ক্ষতি করছে।” ইন্দুমতী বললে।
“উনি কি মিলোসেরাসের প্রাকৃতিক শত্রুর সন্ধান করছেন?”
“রীতিমতো। ওঁর ধারণা এখন থেকে প্যারাসাইট খুঁজে রাখা ভাল। হঠাৎ হয়তো উইভিলদের এমন বংশবৃদ্ধি শুরু হবে যে, সাইট্রাস গাছগুলোকে বাঁচানো কঠিন হবে।”
ইন্দুমতী এবার অমিতাভর অনুমতি নিয়ে তার ল্যাবরেটরি রিপোর্ট লিখতে শুরু করলো। আর অমিতাভ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগলো মাস্টারমশাইয়ের প্যারাসাইট সন্ধানের কথা।
প্যারাসাইট—পরজীবী। প্রকৃতির রাজ্যে এই পরাশ্রিত কীট-পতঙ্গরা না থাকলে মানুষের কী সর্বনাশই হতো! আত্মীয়-নিধনকারী এই বিভীষণদের জন্যেই আজও পৃথিবীতে পতঙ্গের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কত পতঙ্গ তো অন্য পতঙ্গ, তাদের শূককীট এবং ডিম খেয়ে ক্ষুধা নিৰ্ব্বত্তি করছে। কিন্তু আশ্চর্য এই পরজীবীরা, যারা বিনা অনুমতিতেই অন্য জীবের দেহে বাসা বাঁধে। গর্ভিণী পতঙ্গ পোষকের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়, তারপর প্রথম সুযোগেই তার দেহে প্রনবকার্য সম্পন্ন করে পালিয়ে যায়। ক্ষুধার্ত কীটের দল পোষকের রক্ত-মাংসে বড় হয়ে ওঠে এবং তার মৃত্যুর কারণ হয়।
পরজীবীদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে দেশ-বিদেশের গবেষণাগারে কত অনুসন্ধান চলেছে—ডঃ সেনের কত প্রবন্ধই তো অমিতাভ গভীর আগ্রহের সঙ্গে পড়েছে। এমন পরজীবী পতঙ্গ আছে যা কেবল একটি পোষক ছাড়া অন্য কোথাও আশ্রয় নেবে না। আবার এমন পতঙ্গ আছে যে পোষক সম্বন্ধে তত খুঁতখুঁতে নয়—দশ বার রকম পোষকের যে কোনো একটি হলেই হলো। এই পলিফেগাস প্যারাসাইটদের সম্বন্ধে ডঃ সেনের একটি প্রবন্ধ কিছুদিন আগে বৈজ্ঞানিক মহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিল।
টেকিনিড মাছি সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ ছিল সেখানে। মথ এবং প্রজাপতির শূককীটের ওপর এরা ডিম পেড়ে দেয়—ডিমগুলো আঠার মতো গায়ে লেগে থাকে। তারপর ডিম ফুটে টেকিনিড মাছির শুককীট পোষকের মাংস খেতে শুরু করে।
এই মাছিরই জ্ঞাতিভাই লাইডেলা স্টেবুলা, ইউরোপীয়ান কর্ণবোরার নামে এক সর্বনাশা পোকার যম। গর্ভবতী এই মাছি হাজারখানেক শূককীট কর্ণবোরারের গর্তের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আসে। ক্ষুধার্ত ম্যাগটগুলো এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে কর্ণবোরারের দেহে আশ্রয় নেয়। মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে আসতে তখন বিলম্ব হয় না—বড় জোর পনেরো-ষোলো দিন। পোষকের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগটও সাবালক হয়ে ওঠে এবং লাইডে লা স্টেবুলায় রূপান্তরিত হয়ে আকাশে উড়তে আরম্ভ করে।
পোকার পিছনে এইরকম প্যারাসাইট লেলিয়ে দিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা চলেছে দেশে দেশে। বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের এই সাধনায় জীমূতবাহন আত্মনিয়োগ করেছেন।
ইন্দুমতীর কাজ শেষ হয়েছে। অমিতাভকে সে বললে, “অবাক হয়ে দেখছেন কী? এখন থেকে প্রতিদিন এই সব কীটপতঙ্গের সঙ্গে পরিচয় হবে আপনার।”
অমিতাভ প্রতিবাদ করবে ভেবেছিল। ইন্দুমতীর জানা উচিত, ডারহামের ডি-ফিল অমিতাভ মিত্র কেবল জীমূতবাহন সেনের নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি দেখতে এসেছে। এখানে সে যোগ দেবে কিনা সে-সম্বন্ধে এখনও কিছুই ঠিক হয়নি। অথচ কেমন দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে ইন্দুমতী বললে, অমিতাভর সঙ্গে জীমূতবাহনের আশ্রিত ও লালিতপালিত পতঙ্গদের প্রতিদিনের পরিচয় হবে। তবু অমিতাভ কিছুই বলতে পারলে না। ইন্দুমতীর কথাই সাময়িকভাবে বিনা প্রতিবাদে তাকে স্বীকার করে নিতে হলো।
অগত্যা পতঙ্গ প্রসঙ্গ আবার উত্থাপিত হলো। অমিতাভ বললে, “আমি অন্য কথা ভাবছি। কত ধরনের পোকা এখন নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে বসবাস করছে?”
খোপার ভারে বিব্রত ইন্দুমতী ফুলের মালা থেকে একটা বোলতা তাড়াতে তাড়াতে বললে, “তা কয়েক হাজার রকম তো বটেই। কখন কোন্টা দরকার হবে তার ঠিক নেই। মাস্টারমশাইয়ের মিউজিয়ামে যাদের মৃতদেহ সংগ্রহ করা আছে তার সংখ্যা অন্তত পঞ্চাশ হাজার।”
“আর এদের তত্ত্বাবধান উনি একা করে চলেছেন? আশ্চর্যই বটে!” অমিতাভ তার বিস্ময় চেপে রাখতে পারলে না।
“মাস্টারমশাই কোথায়?”
ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট গঙ্গাধর লোলেকার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। সে বললে—তিনি কাজ শেষ করে পুকুরধারে গিয়েছেন।
ওরা দু‘জনে ল্যাবরেটরি থেকে বেরিয়ে খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল। দেড়শো বিঘে জমি যে কতটা তা রাত্রে বোঝা যায়নি। একটু লম্বাটে হওয়ায় জমির যেন শেষ নেই। ‘আর কত রকমের চাষই যে সেখানে হয়েছে।
কিন্তু এক ধরনের চারা কোথায়ও বেশী নেই। ইন্দুমতী বললে, “ছোট ছোট প্লটে চাষ করায় বিশ্বাস করেন মাস্টারমশাই—এঁরা তো খুব বড় হতে পারবে না। এখানে পতঙ্গদের ছেড়ে দেওয়া হবে। নিবেদিতা ল্যাবরেটরির গিনিপিগ তো এরাই। প্রত্যেকটা প্লটের নম্বর আছে, নম্বর অনুযায়ী খাতায় সব বিবরণ লেখা থাকে।”
দূরে একটা পুকুর রয়েছে। অবশেষে সেইখানেই জীমূতবাহনকে আবিষ্কার করা গেল। পুকুরধারে একটা ইটের ওপর থুতনিতে হাত দিয়ে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে রয়েছেন। কাছাকাছি গিয়ে অমিতাভ ফিরে যেতে চাইল। বলা যায় না, হয়তো কোনো গভীর চিন্তায় ডুবে রয়েছেন জীমূতবাহন। শুধু শুধু তাঁকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না।
ইন্দুমতী বললে, “না না, উনি মোটেই বিরক্ত বোধ করবেন না। বরং আপনাকে দেখলে খুশীই হবেন। তাছাড়া আমার নিজেরও দরকার রয়েছে ওঁর সঙ্গে।”
মাস্টারমশাই এবার তাজ্জব কাণ্ড করে বসলেন। জামাকাপড় পরা অবস্থায় জলে নেমে পড়লেন। হঠাৎ কী হলো? কিছু পড়ে গেল নাকি? জলের মধ্যে মাস্টারমশাই কী যেন খুঁজছেন? আরও খানিকটা এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা লতার পাতা পটাপট ছিঁড়ে নিলেন। সাঁতার কেটে এবার পাড়ে উঠে এলেন জীমূতবাহন। ভিজে ছপ ছপ করছে সমস্ত জামাকাপড় ইন্দুমতী ব্যস্ত হয়ে বললে, “তোয়ালে আনেননি?” জীমূতবাহন লজ্জায় পড়ে গেলেন। “না, আনা হয়নি। তবে জলের দেশের ছেলে আমি—ভেজা অভ্যাস আছে।”
ইন্দুমতী বললে, “না স্যার, এটা আপনার খুব অন্যায়। আমি এখনই তোয়ালে নিয়ে আসছি।” সময় নষ্ট না করে সে এবার দ্রুত তোয়ালে আনতে ছুটলো।
অমিতাভ অবাক হয়ে একলা দাঁড়িয়ে রইল। জীমূতবাহন ততক্ষণে পরম যত্নে কয়েকটা কাঁচের জারের মধ্যে পাতাগুলো আলাদা আলাদা পুরতে লাগলেন।
“পানিফলের পাতা নয়?” অমিতাভ প্রশ্ন করে।
“হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছো তুমি। জলের পোকামাকড়ও আমাদের কম ক্ষতি করে না। পানিফল অনেক চাষীর লাভের ব্যবসা। কিন্তু সেখানেও পোকারা ডাঁটাগুলো ছিড়ে ফেলছে। পুসা ইনস্টিটিউটে জলের কয়েকটা পোকা ওরা আবিষ্কার করেছে। অনেক কষ্টে কয়েকটা নমুনা আনিয়েছি। কয়েকদিন আগে ওদের এখানে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই খবর নিতে এসেছিলাম।”
অমিতাভ বললে, “জামাটা ছেড়ে ফেললে পারতেন।”
জীমূতবাহন বললেন, “দেখবে? এই উইভিলগুলোর নাম বেগাস ট্রেপি।” আমতাভ বললে, “আপনি অন্ততঃ জলটা নিংড়ে ফেলে দিন।”
জীমূতবাহন বললেন, “পোকাগুলোর কোনো প্যারাসাইট আছে। যদি খোঁজখবর নিয়ে তাদের আবিষ্কার করা যায় এবং এই পোকাগুলোর পিছনে লাগিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে পানিফলগুলো বেঁচে যাবে।”
“জলের ধারের পোকা। সুতরাং প্যারাসাইট খুঁজে পাওয়া সম্ভব হলেও হতে পারে।” অমিতাভ তার মতামত দিল।
জীমূতবাহন বললেন, “তা হলে পানিফলের দাম কমে যাবে। লোকে খেয়ে বাঁচবে। ছোটবেলায় পানিফলের গুঁড়ো দিয়ে মা একরকম জিলিপি করে দিতেন, এখনও যেন মুখে লেগে রয়েছে।”
ইন্দুমতীকে দূর থেকে তোয়ালে নিয়ে আসতে দেখা গেল। জীমূতৰাহন বললেন, “ওহো, ইন্দু কবে যাবে জিগ্যেস করা হয়নি।”
ইন্দুর হাত থেকে তোয়ালে নিয়ে গা মুছতে মুছতে জীমূতবাহন বললেন, “তুমি যে এখানকার লোক নও, এটা কিছুতেই মনে থাকে না। তুমি কবে যাচ্ছো ইন্দু?”
ইন্দু বললে, “আপনাকে তো বলেছিলাম। সাতদিন আরও আছি।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। তোমার টিকিট কাটার কী ব্যবস্থা হলো?”
“আমি তো মাস্টারমশাই আগেই রিজার্ভেশান করে রেখেছি।”
“বেশ ভাল, ইন্দু। আবার কবে আসবে?”
“থিসিসটা জমা দিয়ে এবার আসবো। হাতে লম্বা সময় থাকবে, আপনার সঙ্গে নতুন কিছু নিয়ে আলোচনা চালানো যাবে।”
“নিশ্চয়। তবে আমরা তো সেকেলে হতে চলেছি।” অমিতাভকে দেখিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “এরা নতুন যুগের বৈজ্ঞানিক। আনকোরা বিদেশ থেকে নতুন জ্ঞান নিয়ে এসেছে।”
প্রতিবাদ না করে পারলো না অমিতাভ। “বিদেশে কি এর থেকে বেশী কিছু শেখা যায়?”
ইন্দুমতী বললে, “আমি ডক্টর মিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত।”
.
ঘুরে ঘুরে দেখতে কখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর নেমেছে তা তিন জনের কারুর খেয়াল হয়নি। ল্যাবরেটরির পোকাদের সঙ্গে অমিতাভর পরিচয়পর্ব শেষ করিয়ে জীমূতবাহন এবার ক্ষেতের দিকে যাবার প্রস্তাব করলেন।
একটা চুরুট ধরিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “কী বলো ইন্দু, টমাটো বাগানের দিকে যাওয়া যাক একবার। অমিতাভর নিশ্চয় খুব ভাল লাগবে। টমাটোর ওই বিশ্রী পোকাগুলো—হেলিওথিস অবসোলিটা—কেমন জব্দ হয়ে গিয়েছে।”
অমিতাভর দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “ইন্দু অবশ্য এর পিছনে খুব খেটেছে। তুমি হয়তো বলবে, হেলিওথিস অবসোলিটা আর ক’টা টমাটোর ক্ষতি করবে? কিন্তু যে কথা ইন্দুকে আমি বার বার বলি, ছোলার কথাটা ভুলে যেও না। আমাদের দেশের কত লোক ছোলা খেয়ে-বাঁচে! কলেজে পড়বার সময় আমরা মোহনবাগানের খেলা দেখতে যেতাম, পথে ছোলাভাজা কেনা হতো। অর্ধেক ছোলায় পোকা। ভুনাওয়ালাকে বকাবকি করতাম—কিন্তু এখন বুঝি সে বেচারা কী করবে? পোকা জব্দ করা তো তার কাজ নয়।”
টমাটো গাছ দেখিয়ে, জীমূতবাহন বললেন, “বিলিতী বেগুন যখন দেখলে তখন দেশী বেগুন কী দোষ করলে। বেগুনের স্টেমবোরার—ইউসোফেরা পার্টিসেলাও রয়েছে পাশেই। প্রফেসর মিচিকানাকে কয়েকটা উপহার দিতে চেয়েছিলাম—কিন্তু যা লোক, ধান নিয়েই পাগল হয়ে আছেন। অন্য কোনোদিকে নজর নেই।”
বেগুন-বাগানে একবার হাজির হলে কত সময় লাগতো ঠিক নেই। কিন্তু অমিতাভর ‘কথা চিন্তা করেই ইন্দুমতী বাধা দিলে। বললে, “মাস্টার-মশাই, পৌনে দুটো বাজে।”
জীমূতবাহন বললেন, “তাইতো, খেয়াল হয়নি! তোমাদের বোধহয় আমার সঙ্গে খেতে বলেছি, তাই না?”
হেসে ফেললে ইন্দুমতী। “বোধ হয় কি মাস্টারমশাই? বার বার করে বললেন, ইন্দু দুপুরে আজ আমার ওখানে খাবে। ”
মাস্টারমশাই একটু বিব্রত হয়ে পড়লেন। “অমিতাভ আমার সঙ্গে খাবে, সে হরিমোহন জানে। তোমারটা বলেছি কিনা মনে করতে পারছি না। চলো সঙ্গে, যা হয় একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
মাস্টারমশাইয়ের অসহায় অবস্থা দেখে ইন্দুমতী ব্যাপারটা এবার প্রকাশ করে ফেললে। “আপনি মাস্টারমশাই হরিমোহনকে বলেননি। সকালে আমি নিজে গিয়ে তাকে বলে এলাম।”
“তাই তো করবে মা। হরিমোহনটা কোনো কাজের নয়। কী আবার রেঁধেছে কে জানে, অমিতাভর কষ্ট হবে।” মাস্টারমশাই বিড়বিড় করতে লাগলেন। “ওকে রোজ বলি, আমার সঙ্গে সকালবেলায় রান্নার বিষয়টা আলোচনা করে নিবি।”
ইন্দুমতী বললে, “আপনি ভাববেন না, আজকের মেনু আমি নিজেই ঠিক করে দিয়ে এসেছি।”
জীমূতবাহন বললেন, “আই অ্যাম ভেরি স্যরি, অমিতাভ। তোমাকে স্নান করতে যাবার সময় পর্যন্ত দিইনি। আমি ভোরে স্নান করি, ইন্দুও তো দেখছি ভোরবেলায় কাজ গুছিয়ে ফেলেছে।”
অমিতাভ বললে, “আপনারা বাড়িতে গিয়ে বসুন। আমি দশ মিনিটে আপনাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছি।”
.
ইন্দুমতীকে নিয়ে জীমূতবাহন নিজের বাংলোয় এলেন। ইন্দুমতীর দুঃখ হলো মাস্টারমশাইকে দেখবার কেউ নেই। সকালে নিজে রান্নাঘরে এসে দেখে বেগুন এবং আলু ছাড়া আর কিছুই নেই হরিমোহনের ভাঁড়ারে।
ইন্দুমতী বললে, “অমিতাভবাবু যতদিন থাকবেন, একটু মাছ বা মাংসের ব্যবস্থা করা দরকার। আজকে আমি হরিমোহনকে দিয়ে আনিয়ে নিয়েছি।”
জীমূতবাহন বললেন, “তুমি তো নিরামিষাশী।”
“আমি নিরামিষাশী বলে অমিতাভবাবু বা আপনার তো চলবে না।” ইন্দুমতী জানায়।
জীমূতবাহন অসহায়ভাবে বললেন, “শাকসব্জী খেতে আমার খুব ভাল লাগে, অমিতকেও বলে দেবো‘খন আমি, তুমি ভেবো না।”
জীমূতবাহনের জন্যে ইন্দুমতীর মনটা করুণার্দ্র হয়ে উঠলো। ভদ্রলোক নিজের সাধনায় মগ্ন থাকবেন, না মাছমাংসের খবর নেবেন?
ইন্দুমতী বললে, “মাস্টারমশাই, খাবার ব্যাপারে অমিতবাবুকে আপনি এখন কিছু বলবেন না। খাবার কষ্ট হলে মানুষের কাজে মন বসে না।”
জীমূতবাহন বললেন, “বেশ, তুমি যখন বলছো, ও সম্বন্ধে কোনো কথাই তুলবো না। সত্যিই তো, খাওয়ার কষ্টের জন্যে অমিতাভ যদি আমার ল্যাবরেটরি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে দুঃখের শেষ থাকবে না। ”
জীমূতবাহন এবার কী যেন ভাবতে শুরু করলেন। পাশেই যে ইন্দুমতী বসে রয়েছে খেয়াল নেই। ইন্দুমতী একটু পরে ডাকলো, “মাস্টারমশাই।”
জীমূতবাহন নড়েচড়ে বসলেন। “এ্যা। কিছু বলছো আমায়?” সস্নেহে ইন্দুমতী জিগ্যেস করলে, “কী ভাবছেন মাস্টারমশাই?”
“নাথিং পার্টিকুলার। তেমন কিছু নয়। কে বড়? ব্ৰহ্মা না বিষ্ণু?”
“মানে?” ইন্দুমতী জিগ্যেস করলে।
মোটা চশমাটা খুলে জামার খুঁট দিয়ে মাস্টারমশাই চোখের কোণ দুটো মুছে নিলেন। বললেন, তৈরি করাটা শক্ত হতে পারে, কিন্তু তার থেকে হাজারগুণ শক্ত তাকে রক্ষা করা। এই তো কত সহজে নিবেদিতা ল্যাবরেটরির সৃষ্টি হলো। কিন্তু এর স্থিতি হবে কি?”
“কেন হবে না মাস্টারমশাই? নিশ্চয় হবে। আপনার এত পরিশ্রম কি ব্যর্থ হতে পারে?” ইন্দুমতী আশ্বাস দেয়।
“তোমার বাবাও সেই কথা বলেন আমাকে। কিন্তু পৃথিবীতে কত লোক আমার থেকে বেশী পরিশ্রম করেছেন, কিন্তু স্থিতি হয়নি।”
মাস্টারমশাই জামার খুঁট দিয়ে আবার চোখ মুছতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ইন্দুমতীর বকুনি খেলেন। “আপনার রুমাল নেই মাস্টারমশাই?”
“আছে বৈকি, নিশ্চয় আছে—চারটে পাঁচটা আছে। কিন্তু আমি তো নস্যি নিই না, তাই রুমাল ছাড়াই চলে যায়।”
“নস্যি আমিও নিই না মাস্টারমশাই, কিন্তু রুমালের দরকার হয়। আপনাকে অনেকদিন বলেছি, ওইভাবে চোখ মুছবেন না, সব সময় পোকা-মাকড় ঘাঁটছেন, কোনসময় ইনফেকশন হয়ে যাবে।”
মাস্টারমশাই বিনা প্রতিবাদে ইন্দুর কথা মেনে নিলেন। “জানো ইন্দু, একদিন আমাদের ল্যাবরেটরিতে ভাইরাস সম্বন্ধেও কাজ হবে। বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলে ভাইরাস অসাধ্যসাধন করতে পারে। কানাডাতে অমিতাভ এই কাজ করবার সুযোগ পেয়েছিল। ভাইরাস এলে আমাকে অবশ্যই রুমাল রাখতে হবে!”
ইন্দুমতী আর কিছুই বললে না। মনে মনে ভাবলে, এই লোকের মাথায় বিজ্ঞানের এতো জটিল সমস্যার সমাধান হয় কী করে?
জীমূতবাহন বললেন, “ছেলেটির প্রতিভা আছে। ওর কথাবার্তা দেখে বুঝলাম, বিদেশে সময়টা নষ্ট করেনি, জানে অনেক কিছু। বোধহয় মনটাও সবুজ। কাজ করতে চায়। অমিতাভ যদি থেকে যায়, আমি আরও বাড়িয়ে ফেলবো রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে।”
পায়ের শব্দ পাওয়া গেল এবার—অমিতাভ আসছে। জীমূতবাহন বললেন, “অমিতাভ, আজকে তোমার খাওয়ার অসুবিধে হবে। তবে আমি নিজে একদিন রেঁধে তোমাদের খাওয়াব।”
“আপনি রাঁধতে পারেন?” অমিতাভ জিগ্যেস করলে।
“পারি মানে? স্যর পি সি রায়কে প্রায়ই রেঁধে খাওয়াতাম। উনি আমার খিচুড়ির খুব প্রশংসা করতেন। প্রায়ই বলতেন, জীমূতের কোনো ভাবনা নেই। লেখাপড়ায় ভাল না করলে রান্না লাইনে উন্নতি করবে!”
খেতে খেতে জীমূতবাহন বললেন, “ভাগ্যে ইনসেক্ট ওয়ার্লডে রান্নার হাঙ্গামা নেই—তাহলে এতগুলো পোকামাকড়ের রান্নার ব্যবস্থা করতে করতেই পাগল হয়ে যেতাম।”
ইন্দুমতী বললে, “আমাদের মিউজিয়ামটা কেমন দেখলেন?”
অমিতাভ উত্তর দিলে, “ইন্টারেস্টিং। তবে সাজানোটা আরও বৈজ্ঞানিকভাবে করা যায়—এবং একটা কার্ড ইনডেক্স করতে পারি যদি, ভাল হয়।”
জীমূতবাহন উৎসাহিত হয়ে উঠলেন। “ঠিক বলেছো, · একটা ইনডেক্স দরকার। তুমি করো, আমি তোমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবো।”
ইন্দুমতী বললে, “ফিরে এসে আমিও আপনাদের দলে যোগ দেবো।” জীৎ সাহন ইন্দুর হয়ে ওকালতি করলেন, “ওকে তুমি নিতে পারো অমিত, ওর হাতের লেখাটা মুক্তোর মতো।”
এবার তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো। অমিতাভ অবাক হয়ে গেল, গতকালও এমন সময় যারা পরস্পরের কাছে অপরিচিত ছিল, তারা এর মধ্যে এত কাছাকাছি আসতে পেরেছে। জীমূতবাহনের হাবভাব এবং সরল কথাবার্তা দেখে কে বলবে, ইনিই সেই বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জে বি সেন, যিনি বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিরাট চাকরি হেলাভরে প্রত্যাখ্যান করে এসেছেন!
খেতে খেতে জীমূতবাহন বললেন, “আর একটা দিকের কথাও অমিত ভেবে দেখো। ইনসেক্টর! আমাদের খাদ্যও হতে পারে—সেক্ষেত্রে এই দরিদ্র দেশের সাধারণ মানুষের খাবারে প্রোটিনের অভাব থাকবে না।”
অমিতাভ বললে, “ব্যাপারটা একেবারে উড়িয়ে দেবার মতো নয়—কারণ অতি সহজেই আমরা অসংখ্য ইনসেক্ট সৃষ্টি করতে পারি। ”
জীমূতবাহন হাসতে হাসতে বললেন, “এ-ব্যাপারে আমরা অবশ্য ইন্দুমতীর কোনো সাহায্য পাবো না। ও মাছ মাংস ছোঁয় না।”
“ছুঁই, খাই না।” ইন্দুমতী প্রতিবাদ করলে।
“আমার মাও তাই করতেন। বিধবা মানুষ, আমার জন্যে মাছ ঝুঁধিতেন, কিন্তু খেতেন না”, জীমূতবাহন বললেন। তিনি যে আজ বেজায় খুশী তা তাঁর মুখের ভাব থেকেই ইন্দুমতী বুঝতে পারছে।
.
একটা সপ্তাহ যে কোথা দিয়ে কেটে গেল অমিতাভ নিজেই বুঝতে পারেনি। খেয়াল হলো, জীমূতবাহন যখন ইন্দুমতীকে জিগ্যেস করলেন, “আজ তাহলে তুমি যাচ্ছো!”
মাইক্রোস্কোপ থেকে মুখ তুলে ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে ইন্দুমতী বললে, “হ্যা মাস্টারমশাই।”
অমিতাভর মনে পড়লো, অন্ততঃ সাত-আটদিনের জন্যে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির আতিথ্য গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন জীমূতবাহন।
এই ক’দিন তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সে প্রায়ই মনে মনে নিজের সঙ্গে তর্ক করেছে। বাকযুদ্ধ অনেক হয়েছে, এবার ভোটে তুলে সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন। কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন ইন্দুমতীকে স্টেশনে তুলে দিয়ে আসা। এই দায়িত্বটা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন মাস্টারমশাই।
ইন্দুমতী নিজেই স্টিয়ারিং ধরতে চেয়েছিল। “আমাকে দিন। এই গাড়িটা চালাতে আমি বেশ অভ্যস্ত।”
অমিতাভ বললে, “আমারও তো অভ্যস্ত হয়ে ওঠা প্রয়োজন। আপনি না হয় ড্রাইভ করে স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে ট্রেনে উঠে বসলেন। ফেরার পথে আমার এবং গাড়িটার কী হবে?”
ইন্দুমতী বললে, “আত্মরক্ষার উৎকণ্ঠায় তখন ঠিক চলে আসতে পারবেন!” গাড়িতে যেতে যেতেই ইন্দু বলেছিল, “আপনার নিজের সম্বন্ধে কিছু ঠিক করলেন নাকি?”
“না, এখনও শুধু দেখে যাচ্ছি, ঠিক করা হয়ে ওঠেনি কিছু।”
ইন্দু বললে, “শেষ পর্যন্ত যদি আপনি থেকে যান, নিবেদিতা ল্যাবরেটরির পক্ষে ভাল হবে। মাস্টারমশাই অনেক কিছু করতে চান। অনেক কিছু করবার মতো শক্তিও ওঁর আছে।”
“বিজ্ঞানের নতুন দিক নিয়ে তিনি যে সাধনা করছেন, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই।”
“আপনি বলছেন?”
“জোর করেই বলছি—কারণ শুধু ইনসেকটিসাইড দিয়ে পোকা-মাকড়দের চিরদিন দাবিয়ে রাখা না-ও চলতে পারে। তাছাড়া আমাদের মতো গরীব দেশের পক্ষে পোকা দিয়ে পোকা ধ্বংস করতে পারলে অনেক অর্থের সাশ্রয় হবে। কেমিক্যাল কীটনাশক আপনাকে বার বার স্প্রে করতে হবে এবং প্রতি বছর তা চালিয়ে যেতে হবে। প্যারাসাইটরা একবার ছাড়া পেলে তারাও প্রকৃতির অংশ হয়ে যাবে এবং বহু বছর ধরে, হয়তো চিরদিনের জন্য, ফসলখেকো কীট-পতঙ্গদের পিছনে তারা রাহুর মতো লেগে থাকবে।”
ট্রেনে উঠে পড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দুমতী। তারপর একটু ইতস্ততঃ করে বললে, “আপনি ক’দিনের জন্যে এসেছেন। বলতে সঙ্কোচ বোধ করছি।”
“সঙ্কোচের কী আছে? বলুন।”
“মাস্টারমশাইকে একটু দেখবেন। ওঁকে বড় অসহায় মনে হয়। নিজের কাজে পাগল হয়ে থাকেন, পোকামাকড়ের জগতের অনেক খবর রাখেন, কিন্তু মানুষের জটিলতার সঙ্গে ঠিক খাপ খাইয়ে উঠতে পারেন না।”
লোকটার ওপর অমিতাভর বেশ মায়া পড়ে যাচ্ছে। এই তো ক’দিন সে এখানে এসেছে। এরই মধ্যে সে যেন নিবেদিতা আশ্রমের একজন হয়ে উঠেছে।
অমিতাভ জানতে চাইলে, “ওর স্ত্রী এখানে থাকেন না কেন?” ইন্দু বললে, “কী জানি!”
অমিতাভ বললে, “স্যরি, এরকম ব্যক্তিগত প্রশ্ন করাটা হয়তো আমার ঠিক হচ্ছে না!”
“কেন জিগ্যেস করবেন না? বেশ করবেন, জিগ্যেস করবেন। আমার মন বলে, আমাদের সবার উচিত মাস্টারমশাইকে সাহায্য করা। ঈশ্বর ওঁকে অনেক বড় কাজ করবার জন্যে তৈরি করেছেন। একদিন সমস্ত ভারতবর্ষ তাঁর জন্যে গর্ববোধ করবে।”
অমিতাভ বললে, “বিজ্ঞানের আবিষ্কারের কথা কেউ বলতে পারে না মিস্ দেশাই—আজ যেটা অসম্ভব মনে হচ্ছে, কাল দেখা যাবে সেইটাই সবচেয়ে সোজা কাজ!”
ইন্দুমতী বললে, “এখানে থাকলে টাকা আনা পাইয়ের মাপে আপনার কী হবে জানি না, কিন্তু এমন কাজের সুযোগ, এমনভাবে জানবার এবং শিখবার সুযোগ আর কোথাও পাবেন কিনা সন্দেহ।”