নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি – ৪

অমিতাভর কটেজ থেকে নিজের বাংলোয় ফিরে আসছেন জীমূতবাহন। তিনি ছাড়া নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সব মানুষ এতোক্ষণে নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু একনম্বর শেডে পতঙ্গদের কনসার্ট শুরু হয়েছে। কত রকমের অদ্ভুত আওয়াজ তাদের—কিন্তু সব মিলে সুন্দর ঐকতানের সৃষ্টি হয়েছে। ওদিকে বাইরের পতঙ্গ শিল্পীরাও অনাহূত হয়েই আসরে যোগ দিয়েছে। ল্যাবরেটরির ক্ষেতে অনেক ঝিঁ ঝিঁ জমা হয়েছে নিশ্চয়—তারাও সঙ্গীত সম্মেলনে মনের সুখে সুর ধরেছে।

টর্চের আলোটা ক্ষেতের ওপর ফেললেন জীমূতবাহন। আলোটা অনেক দূর পর্যন্ত দৌড়ে গেল—কিন্তু ল্যাবরেটরির সীমানার বাইরে নয়। পঞ্চাশ একর জমি নিয়ে এই ল্যাবরেটরি।

একবার শেডে যাবেন নাকি? কাটুই পোকা Agrotis ipsilon-গুলোর খবর নিয়ে এলে হয়। নতুন অতিথি। মাদ্রাজ থেকে আনিয়েছেন তিনি।

কাটুই পোকার জীবনটা আরও ভাল করে অনুসন্ধান করে দেখবেন জীমূতবাহন। ডিডিটি আর টক্সোফিন দিয়ে এদের এখনও নিধন করা হচ্ছে। কিন্তু আর কতদিন? রাতের অন্ধকারে এরা সক্রিয় হয়ে উঠে আলু, ছোলা, তামাক, তুলো এবং মটর গাছের চারার গোড়া কেটে দেয়। সেবার এক বছরে এক লক্ষ একর জমির চাষ নষ্ট করে দিয়েছিল কাটুই পোকারা।

না, কাল সকালে এদের খোঁজ খবর নিলে চলবে। সেই সঙ্গে আর একজন অতিথি অমিতাভ মিত্রর খবরও নেওয়া যাবে‘খন। টর্চটা হাতে নাচাতে নাচাতে জীমূতবাহন ডান দিকে মোড় ফিরলেন। কাঁচা রাস্তার উপর দিয়ে একবার খামারের পশ্চিম কোণের দিকে চলতে আরম্ভ করলেন। মাঝে মাঝে টর্চের আলোটা জ্বলছেন আর নেভাচ্ছেন। যেন অন্ধকারে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে উঠছে।

সাত নম্বর প্লটের কাছাকাছি এসে জীমূতবাহন টর্চ জ্বালানো বন্ধ করে দিলেন। যাদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে এসেছেন তারা আলো পছন্দ করে না। ধানের চাষ হয়ে রয়েছে কয়েক কাঠা জমিতে। গাছগুলো ছ’দিন আগেও নীরোগ ছিল। হাওয়ায় দুলে দুলে সুস্থ সবুজ শিশুরা তখন জীমূতবাহনকে অভিবাদন জানিয়েছিল। সঙ্গে ছিল ইন্দুমতী।

ইন্দুমতী বোধ হয় মাস্টারমশাইয়ের হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। “কী ভাবছেন মাস্টারমশাই?” ইন্দুমতী প্রশ্ন করেছিল।

“ভাবছি, উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে তা এই চারাদের দিকে তাকিয়ে যে কেউ বলে দিতে পারে। এর জন্যে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। তোমার কি মনে হচ্ছে না এরা জীবন্ত? আমাদের দেখে এই সব শিশুরা উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।”

ইন্দুমতী বলেছিল, “মাস্টারমশাই, আপনি বোধ হয় আমাদের থেকে অনেক বেশী দেখতে পান। ওরাও বোধ হয় বুঝতে পারে, আপনি ওদের বন্ধু।”

খুব খারাপ লেগেছিল, এই সুস্থ সবল নীরোগ শিশুদের মধ্যে রাক্ষসদের ছেড়ে দিতে। কিন্তু ওরা যে গিনিপিগ “এদের মধ্যে কী ছাড়ছেন মাস্টারমশাই?” ইন্দুমতী প্রশ্ন করেছিল। জীমূতবাহন বলেছিলেন, “সোয়ারমিং কেটারপিলার—বৈজ্ঞানিক নাম স্পোডোপটেরা মরিসিয়া। শিশু ধান চারার চরম শত্রু। বাংলা দেশের চাষীরা বলে লেদা পোকা। জমিতে এদের দেখলে চাষীদের ঘরে কান্না শুরু হয়ে যায়।”

ধান ক্ষেতের খুব কাছে এসে পড়েছেন জীমূতবাহন। আলো না জ্বালিয়েই খপ করে একটা চারায় হাত দিলেন তিনি। যা ভেবেছেন তাই—তাঁর হাতেই গোটা পাঁচেক লেদা পোকা ছটফট করছে। রাতের অন্ধকারে তারা নির্মম হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। দিনের বেলায় মাটির তলায় খুনেগুলো লুকিয়ে থাকে। নিরীহ চাষী বুঝতে পারে না। তারপর রাতের অন্ধকারে ওরা ঝাঁকে ঝাঁকে বেরিয়ে আসে। পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে কত চাষীর ঘরে ঘরে কান্না ওঠে—সোনার ধানে তাদের মাঠ আর ভরে উঠবে না।

লেদা পোকাগুলো হাতের মধ্যে থেকে পালাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে—জীমূতবাহনের হাতে ছুঁচ ফুটিয়ে দেবার চেষ্টা করছে। এখন‍ই টিপে মেরে ফেলে একটা চারাগাছকে অন্তত তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু মাত্র দুটো হাতে ভারতের লক্ষ লক্ষ কৃষিজীবীর ক’জনকে তিনি উদ্ধার করবেন? ভারতবর্ষের বিশাল মানচিত্রটা জীমূতবাহনের মানসচক্ষে ভেসে উঠলো। তিনি দেখলেন, ধানের চারা দিয়েই যেন তাঁর প্রিয় জন্মভূমির সুবিশাল মানচিত্রটা তৈরী হয়েছে। পতঙ্গের আক্রমণ থেকে ত্রাণ পাবার জন্যে কোটি কোটি শিশু হঠাৎ ক্রন্দন শুরু করেছে।

এবার আলো জ্বলালেন জীমূতবাহন। সমস্ত গাছগুলোর রঙ রাতারাতি পালটিয়ে গিয়েছে। সোয়ারমিং কেটারপিলারের দল মরণ আলিঙ্গনে চারাদের আবদ্ধ করেছে। কিন্তু একা তিনি কী করবেন? ভারতবর্ষের কৃষকরা জানে না, একটা ঋতুতেই এরা পাঁচটা বংশধারা বিস্তার করতে পারে।

কেমন যেন মায়া হলো জীমূতবাহনের। তাঁর গবেষণার জন্যে চারাগাছগুলো মৃত্যুবরণ করছে—না হলে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির চতুঃসীমানায় লেদা পোকাদের ঢোকার সাধ্য থাকত না। কাল সকাল বেলায় সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কীটদের আর দর্শন মিলবে না—তখন মেপে দেখতে হবে একদিনে কত ক্ষতি করতে পেরেছে এরা।

সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতে চারাগুলোকে সঁপে দিয়ে জীমূতবাহন এবার নিজের বাংলোর দিকে চলতে লাগলেন। ঝিঁঝিরা তাদের বাজনা বাজিয়ে চলেছে—এদের কোনো ক্লান্তি নেই।

বাড়িতে ফিরে এসেই যদি জীমূতবাহন ঘুমোতে পারতেন, কেমন সুন্দর হতো!

কিন্তু জীমূতবাহনের এক এক দিন কী হয়, কিছুতেই ঘুম আসে না। একদিক দিয়ে তিনি ভাগ্যরান, সাধারণত ঘুমকে ডাক দিলেই এসে হাজির হয়। ঘুমকে ডেকে কতবার জীমূতবাহন কত সর্বনাশা দুশ্চিন্তার হাত থেকে সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়েছেন। কিন্তু মাঝে মাঝে কী যে হয়—ঘুমদের বাড়ি ফেরার কথাই মনে থাকে না।

শেষ যেবার কলকাতায় ঈশিতার সঙ্গে দেখা হলো, বোনের বাড়ির কী একটা বিয়ে নিয়েই সে দিন-রাত ব্যস্ত থাকতো। কতদিন পরে কলকাতায় এসেছেন জীমূতবাহন! কিন্তু ঈশিতা বাপের বাড়ির আত্মীয়দের নিয়েই মশগুল।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন দেখেছেন দশটা বাজলো, এগারোটা বাজলো, রাত সাড়ে এগারোটার সময়েও ঈশিতার দেখা নেই। বারোটায় গাড়ি গ্যারেজে তোলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

কিন্তু ঈশিতাকে তিনি কিছুই বলেননি। শুধু একবার তার দিকে তাকিয়েছিলেন। ঈশিতা তাও সহ্য করতে পারে না। বিরক্তভাবে বলেছিল, “তোমাকে দেখলে সত্যি হিংসে হয়। সমাজ, সংসার, আত্মীয়-স্বজনের কথা না ভেবে কেমন নিজেকে নিয়েই খুশী হয়ে রয়েছো।”

“মানে?” জীমূতবাহন প্রশ্ন করেছিলেন।

“মানে, আমার বারাও হাইকোর্টের একজন নামজাদা ব্যারিস্টার ছিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত তাঁকেও কাজ করতে হতো। কিন্তু তবুও তিনি সামাজিকতার সমস্ত দায়িত্ব আমার মায়ের ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দিতেন না। মাঝে মাঝে নিজেও যেতেন পার্টিতে। সবার সঙ্গে দেখাশোনা করে ফিরে আসতেন। বৈজ্ঞানিককে নিশ্চয় হাইকোর্টের টপ ব্যারিস্টারের থেকে বেশী ব্যস্ত থাকতে হয় না!”

বিরক্তভাবে জীমূতবাহনের বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, “আজকের পৃথিবীতে বৈজ্ঞানিকের অনেক বেশী ব্যস্ত থাকা প্রয়োজন।” কিন্তু কী হবে ঈশিতার সঙ্গে তর্ক করে? ব্যারিস্টারের মেয়ের সঙ্গে তর্ক করে কোনোদিন পেরে উঠবেন না।

তর্ক চানও না জীমূতবাহন। শুধু একটু শান্তি চান—অখণ্ড শান্তিতে তিনি নিজের সাধনায় মগ্ন থাকতে চান!

যে ঈশিতার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল আর এই ঈশিতা কি এক? বিয়ের পর সেই মধুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে জীমূতবাহনের স্বামীকে নিয়ে হৈ হৈ করবার, নিজের দলে টানবার জন্যে ঈশিতার কী উৎসাহ!

স্বামীর কোলে মাথা রেখে মুখ ভার করে ঈশিতা বলেছে, “গুরুদেবের কাছে আমার মুখ দেখাবার উপায় রইল না। আমাকে দেখেই বললেন, একা কেন? বরকে নিয়ে আসতে পারলি না?”

“তুমি কী উত্তর দিলে?” জীমূতবাহন জিগ্যেস করলেন।

“তোমার জন্যে এক কাঁড়ি মিথ্যে কথা বলতে হলো।”

প্রিটোরিয়া স্ট্রীটের জগদানন্দ বসুর বাড়িতে তিনি যে জামাই হয়ে প্রবেশ করতে পারবেন, জীমূতবাহনের কাছে এটাই একটা আশ্চর্য ঘটনা।

ব্যারিস্টার জগদানন্দ বসুর কন্যারা তখন কলকাতার সম্ভ্রান্ত মহলে আলোচনার বস্তু। বেথুনের বস্তু-বালিকারা তখন সর্বগুণান্বিতা বলে স্বীকৃত। এরা গান গায়, আসরে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করতে এদের সঙ্কোচ নেই। এরা ঝুড়ি ঝুড়ি গয়না আর জমকালে৷ কাজ-করা শাড়ি পরে লোকের চোখ ধাঁধায় না; অথচ এদের কথাবার্তা, চালচলন, বেশভূষায় রুচির পরিচয় পাওয়া যায়। সত্যি কথা বলতে কি, বহু-বালিকারা যা পরেন, সেইটাই আধুনিক ফ্যাশান হয়ে যায়।

কী করে এই পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হবার সৌভাগ্য অর্জন করলেন জীমূতবাহন? সেইসব স্মৃতি রোমন্থনের সময় পাওয়া যাবে অনেক। এখন কেবল ঈশিতার সেই অভিমানের দিনটির কথা মনে পড়ছে। তখনও বোধ হয় সম্পূর্ণ আশা ছেড়ে দেয়নি ঈশিতা। ভেবেছিল, স্বামীর জড়তা কাটিয়ে তাকে সামাজিক জীব করে তুলতে পারবে সে।

তাই আনন্দে বিগলিত হয়ে ঈশিতা বলেছিল, “তোমার সাবজেক্টেও আমাকে একটু পড়িয়ে-শুনিয়ে নিও তো।”

বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিলেন জীমূতবাহন। প্রশ্ন করেছিলেন, “কেন বলো তো?”

“গুরুদেবের কাছে বেশ লজ্জা পেয়ে গেলাম। উনি গান গাইতে বললেন। গান গাইলাম। একথা সেকথার পর বললেন, ‘তোর বর কী করে?’ বললাম, কেমেস্ট্রি এবং পোকামাকড়ের জীবন-বৃত্তান্ত দুটো নিয়েই মত্ত হয়ে থাকে।

“কবিগুরু শুনে বেজায় খুশী। বললেন, ‘এটা একটা অদ্ভুত বিষয়। এ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক কাজ করবার আছে।’ তারপর বললেন, “তোর তাহলে খুব মজা। কত পোকামাকড়ের ঘরের কথা জানতে পারছিস।’

“ আমি বললাম, ‘পৃথিবীতে এতো সুন্দর জিনিস থাকতে পোকামাকড় নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবো কেন?

“কবিগুরু রসিকতা করে বললেন, ‘তোর সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা করে দেখি। আমার বন্ধু রায়মশাইয়ের বই পড়ে এই সব শিখেছি। বল দেখি ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ বলতে কাদের বোঝায়?

“চুপ করে ছিলাম আমি। কবিগুরু বললেন, ‘পারলি না তো—বোলতা, ভীমরুল, কুমার-পোকা এগুলো হলো ঝিল্লীপক্ষ পতঙ্গ। আর গোবরে পোকা, উকুন, ঘুণ এরা হলো কঠিনপক্ষ পতঙ্গ। এদের চারটে ডানা থাকে—উপরকার ডানা দু‘খানা হাড়ের মতো শক্ত।

“গুরুদেবের কাছে হেরে চলে এসেছি। ভাবছি পতঙ্গবিদের পত্নী যখন হয়েছি তখন এ-সব জেনে রাখবো।” ঈশিতার কথাগুলো জীমূতবাহনের বেশ মনে আছে।

আর মনে আছে সহপাঠীদের কথা। বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে এসে তারা বলেছিল, “এতোদিন জে বি সেন ছিলিস, এবার আই বি সেন হবি।”

জীয়তবাহন ঠিক বুঝতে না পেরে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। তারা বলেছিল, “জীমূতবাহন এবার ঈশিতাবাহন হবে!”

ইঙ্গিতটা মোটেই ভাল লাগেনি জীমূতবাহনের। তিনি যদি কারও সেবক হন সে বিজ্ঞানের। বড় জোর বি বি সেন অর্থাৎ বিজ্ঞানবাহন সেন হবেন, কোনোদিন আই বি সেন হচ্ছেন না তিনি।

এ-সব পুরনো কথা জীমূতবাহন আজ রাত্রে শুধু শুধু কেন ভাবছেন, তিনি নিজেই বুঝতে পারছেন না। এখন একটু ঘুমোলে শরীরটা হাল্কা হতো। কিন্তু বোধ হয় ঘুম আসবে না। কারণ অমিতাভর কথাও আবার মনে পড়ছে। সে-বেচারা নিশ্চয় এতক্ষণে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ছেলেটিকে বেশ পছন্দ হয়েছে তাঁর। এখন প্রশ্ন, রাখতে পারবেন তো?

জীমূতবাহনের বয়স হচ্ছে। যে প্রতিষ্ঠান তিনি নিজের রক্ত দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুলছেন, সেখানকার সাধনার ধারা অব্যাহত রাখার জন্যে মানুষ চাই। অমিতাভর কাছে তাঁর অনেক প্রত্যাশা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *