৩
জীমূতবাহনের বাংলোটা ষাট-সত্তর গজ দূরে। মধ্যে লাল সুরকি দিয়ে রাস্তা—এমন কিছু চওড়া নয়, একটা ছোট গাড়ি কোনোরকমে চলে যেত পারে। বাংলোটা আকারে একটু যা বড়ো, কয়েকটা বেশি ঘর আছে।
বাড়িতে আর কেউ আছে বলে মনে হলো না, কারণ জীমূতবাহন সেন নিজেই দরজার তালা খুললেন। ড্রইং রুমটা নিতান্ত ছোট নয়—দেওয়ালে অসংখ্য বই-এর সারি।
জীমূতবাহন বললেন, “আমি চাই আমার সাধের এই নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সঙ্গে তোমার পরিচয় হোক। কত দূর থেকে আমার কথার ওপর ভরসা করে তুমি এসেছো।”
অমিতাভ প্রতিবাদ করল, “আপনার কথা ছাড়াও প্রফেসর ব্ল্যাকারের মুখে নিবেদিতা ল্যাবরেটরির অনেক খবর শুনেছি আর সায়েন্টিফিক জার্নালগুলোও কিছু কিছু উল্টে দেখার অভ্যাস আছে আমার। ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অফ এগ্রিকালচারের জার্নালে আপনার একটা লেখার অনুবাদ ছেপেছে দেখলাম।”
“তুমি ফরাসী জানো?”
“কাজ চালানো গোছের।”
বেজায় খুশী হয়ে জীমূতবাহন বললেন, “খুব ভালো হলো—ফরাসী না জানার জন্যে মাঝে মাঝে বড্ড অসুবিধে হয়। ফরাসী এনটমোলজিস্ট জাঁ হেনরি ফেবারের লেখাগুলো আমার খুব ভাল লাগে। ইংরিজী অনুবাদ পড়েছি কিছু কিছু—কিন্তু অবসর সময়ে তোমার সাহায্যে অরিজিন্যালগুলো পড়া যাবে।”
“নিশ্চয়। ফেবারের কিছু কিছু লেখা আমিও মূল ফরাসীতে পড়েছি—সত্যি খুব ভাল লাগে!” অমিতাভ উৎসাহের সঙ্গে বললে।
জীমূতবাহনের এই পরিবেশ অমিতাভর বেশ ভাল লাগছে। জীমূতবাহনের মধ্যে বোধ হয় সেই গুণ কিছু আছে, যা গান্ধীজীর মধ্যে ছিল—মানুষ দেখলেই, খপ করে মোহিত করে টপ করে নিজের কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন। বিলাসী ব্যবসায়ী, বিখ্যাত ব্যারিস্টার, ডাকসাইটে ডাক্তার, উদীয়মান উকিল, কত প্রতিভাধর কেমন সুখে স্বচ্ছন্দে সচ্ছল দিন কাটাচ্ছিলেন। গান্ধীজীর সঙ্গে একবার সাক্ষাতেই মাথায় ভূত চেপে গেল। পসার প্র্যাকটিশ পিছনে ফেলে রেখে জেলখানায় ঢুকতে হলো।
অমিতাভর চিন্তাস্রোতে বাধা দিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “তোমার খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধে হবে। আমার হরিমোহন যা রাঁধে, তা বোধ হয় তোমার ভাল লাগবে না।”
“মোটেই খারাপ লাগবে না,” অমিতাভ জানায়।
জীমূতবাহন বললেন, “হরিমোহনের পূর্বপুরুষ শিবাজীর সৈন্যবাহিনীতে ছিলেন। যুদ্ধ করার চেয়েও রান্না করাটা যে অনেক শক্ত, তা হরিমোহনের কাজকর্ম দেখলে বুঝতে পারবে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন ডাক দিলেন, “হরিমোহন, হরিমোহন।”
অমিতাভকে বললেন, “মেক ইওরসেলফ ইজি—জুতোটুতো খুলে ফেলে নিজের বাড়ির মতো করে বোসো।”
ডাইনিং টেবিলে হরিমোহন একবার আবির্ভূত হয়ে খাবার জিনিসপত্র গুছিয়ে দিলেও, জীমূতবাহনই অমিতাভর দিকে সব এগিয়ে দিতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “এটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস। ছাত্রাবস্থায় হোস্টেল থেকে এই মেয়েলী স্বভাবটা আয়ত্ত করি। সবাই টেবিলে বসতো। আমিই ভাত-ডালগুলো এগিয়ে দিতাম। ”
অমিতাভ এবারও হাসলো। জীমূতবাহন বললেন, “এফ এ ও-র ডাইরেক্টর জেনারেল বি আর সেন মশাই একবার রোমে খেতে নেমন্তন্ন করেছিলেন। সেখানেও ভুলে আর একটু হলে আমি নিজেই সার্ভ করতে যাচ্ছিলাম। শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছিলাম, বিনয়রঞ্জনবাবু জানতে পারেননি। জানলে হয়তো সব জিনিসটাই লঘু করে দিতেন। বলতেন, পৃথিবীর কোটি কোটি লোকের খাবারের থালায় অন্ন তুলে দেওয়ার সুযোগটা একটা মস্ত প্রিভিলেজ।”
‘অমিতাভ উত্তর দিলে, “তা সত্যি। পৃথিবীর খাদ্যসমস্যা ক্রমশ যেরকম গুরুতর আকার ধারণ করছে তা খুবই চিন্তার বিষয়। এবং এটা খুবই গর্বের কথা, এই সমস্যা সমাধানের নেতৃত্বটি যাঁকে দেওয়া হয়েছে তিনি একজন ভারতীয়।”
জীমূতবাহন বললেন, “এবার খাওয়া শুরু করো। কোটি কোটি মানুষ যে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অনাহারে অর্ধাহারে রাত্রি যাপন করছে এসব কথা খাবার সময় মনে না আনাই ভাল।”
খাওয়ার টেবিলেই কত আলোচন৷ হচ্ছিল। জীমূতবাহনকে খুঁটিয়ে লক্ষ্য করছিল অমিতাভ। চোখদুটো দেখলেই মনে হয় বড় স্নেহপ্রবণ। ভারি সরল মানুষটি।
জীমূতবাহনের চশমাটা যা পুরু, কত পাওয়ার কে জানে! তাকানোর কায়দাতেই বোঝা যায় মাইওপিক। অথচ জীমূতবাহন নিজের সাধনায় পৃথিবীর কত দূরের জিনিস দেখতে পাচ্ছেন। শুধু ভূগোলের দূরত্ব নয়—কালের দূরত্ব। লক্ষ কোটি বছর আগে এই প্রাণহীন পৃথিবীতে যেদিন প্রথম প্রাণের স্পন্দন অনুভূত হয়েছিল, কিংবা সাড়ে সাঁইত্রিশ কোটি বছর আগের সেই প্যালিওজিক যুগেও জীমূতবাহন যে অনায়াসে বিচরণ করেন, তা তাঁর কথা শুনেই বুঝতে পারছে অমিতাভ। মাছেদের বয়স তখন অতি সামান্য ( এই কয়েক লক্ষ বছর মাত্র! ) সিলুরিয়ান পিরিয়ডে প্রথম পতঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেল। হেমিপটেরাদের এই নিকট আত্মীয়কে শিলীভূত অবস্থায় লীমূতবাহন সুইডেনে দেখে এসেছেন। কিংবা পঁচিশ কোটি বছর আগে কার্বনিফেরাস যুগে ড্রাগনাকৃতি পতঙ্গরা যখন আড়াই ফুট লম্বা পাখা মেলে উড়ে বেড়াতো, জীমূতবাহন সে সম্বন্ধেও খবর রাখেন!
কথাপ্রসঙ্গে জীমূতবাহন বললেন, “মানুষের বড়াই করবার মতো কিছুই নেই। যদি কারও তা থাকে, সে এই আরশোলার—যা দেখে আমার মেয়ে মদালসা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়, ঘেন্নায় বমি করে ফেলে। কিন্তু জীবিত পাগীদের মধ্যে একমাত্র আরশোলাই ২৫ কোটি বছরের ঐতিহ্য দাবি করতে পারে।”
অমিতাভ জীমৃতবাহনের মোটা কাচের চশমার দিকে অবাক হয়েই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু জীমূতবাহন তা লক্ষ্য করলেন না, আরশোলাদের সম্বন্ধে তাঁর তখন বেশী চিন্তা।
জীমূতবাহন বললেন, “ভেরি প্রিমিটিভ টাইপ অফ ইনসেক্ট! ওদের কাছে আমাদের অনেক কিছু শেখবার আছে। নিজেদের গায়ের রঙ, খাবার জিনিস, সামাজিক ব্যবহার কোনো বিষয়েই আরশোলারা খুঁতখুঁতে হয়নি, তাই আজও তারা টিকে রয়েছে। এবং বহু যুগ পরে অস্তগামী সূর্যের কিরণ বরফে আবৃত এই পৃথিবীর শেষ যে প্রাণীটির ওপর এসে পড়বে, সেও নিশ্চয় একটা আরশোলা।”
জীমূতবাহন সেন কিংবা অমিতাভ মিত্র শেষের সেই ভয়ঙ্কর দিনে নিশ্চয় উপস্থিত থাকবেন না। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর নায়কের মতো জীমূতবাহন কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না, অনাগত কালে মানুষের আধিপত্যের একদিন শেষ হবে। প্রকৃতির সংগ্রামে পরাজিত মানুষকে একদিন রণদর্পী পতঙ্গের হাতে পৃথিবীর আধিপত্য সমর্পণ করে চিরবিদায় নিতে হবে।
অমিতাভর চোখদুটো জীমূতবাহনের খুব ভাল লাগছে। চোখ থেকে মানুষের গভীরতা মাপবার একটা সহজাত শক্তি আছে জীমূতবাহনের ওকে পাঁচ জনের থেকে আলাদা মনে হয়েছে জীমূতবাহনের। সেই আশাতেই তো অমিতাভকে তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন। একজন, অন্তত একজন বিশ্বস্ত তরুণ বন্ধুর প্রয়োজন তাঁর, বিজ্ঞানের পদযাত্রায় যে হবে তাঁর সহযাত্রী।
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জীমূতবাহন। অমিতাভকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি বলো, পতঙ্গের হাতে আমাদের এই পরাজয় আমরা বিনাযুদ্ধে মেনে নেবো? এখন থেকেই আমাদের কি কিছু স্টেপ নেওয়া উচিত নয়?”
মুখ খুলে এ-প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়নি অমিতাভকে। জীমূতবাহন ওর মুখের দিকে তাকিয়েই যেন সব বুঝে ফেলেছেন। অমিতাভ এখনও তাঁর পরিকল্পনার কিছু জানে না। কানে না শুনে, নিজের চোখে সব কিছু দেখুক অমিতাভ।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে অমিতাভ ও জীমূতবাহন বাইরের বারান্দায় এসে বসলেন। চাঁদ ওঠেনি। কিন্তু তারায় তারায় ছেয়ে রয়েছে আকাশের উঠোন।
তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে অমিতাভ। ওর মনটা যে একটু কাব্যিক তা জীমূতবাহন সহজে বুঝতে পারেন। তারাদের দিকে তাকিয়ে অমিতাভর কী মনে হয় কে জানে। হয়তো মনে হয় কোনো শাড়ির আঁচলের সোনালী চুমকি, কিংবা স্বৰ্গ দেওয়ালীতে লক্ষ প্রদীপের সমারোহ। কিন্তু জীমূতবাহনের মনে হয়, পৃথিবীর মতো স্বর্গেও নিশ্চয় পতঙ্গের পরাক্রম আছে। তারাগুলো যেন সুদূরের পতঙ্গ।
আজ না হয় বয়স হয়েছে জীমূতবাহনের; সংসারের আগুনে জ্বলেপুড়ে তাঁর সমবয়সী অনেকেই হয়তো কুসুমে কেবল কীট দেখেন। কিন্তু যখন তাঁর বয়স কম ছিল, যখন সবে তিনি বিবাহ করেছেন, সবুজ সম্ভাবনার দিনগুলো যখন সামনে নরম কার্পেটের মতো পেতে দেওয়া হয়েছে, তখনও তারকাতে পতঙ্গ দেখেছেন জীমূতবাহন।
ঈশিতা, তাঁর স্ত্রী, নববিবাহিতার সলজ্জ আভায় তখনও রঙীন হয়ে ছিল। কলকাতার প্রিটোরিয়া স্ট্রীটে ওদের বাড়ির পিছনে সবুজ ঘাসভরা যে বিরাট লন ছিল সেখানে জীমূতবাহনকে নিয়ে গিয়েছিল ঈশিতা। খোপায় ফুল পরেছিল ঈশিতা—আর দুটো বেতের চেয়ারে মুখোমুখি বসে গুনগুন করে গান গেয়েছিল, “আজ তারায় তারায় দীপ্ত শিখার অগ্নি জ্বলে নিদ্রাবিহীন গগনতলে।”
বোধ হয় ঈশিতা বুঝেছিল, স্বামীর মরমে সে গান ঢুকছে না। তাই বোধহয় বলেছিল, “কী হাঁদা-গঙ্গারামের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে আছো?”
মনে যে একটু আঘাত লাগেনি এমন নয়। কিন্তু জীমূতবাহন এসব সহ্য করবার মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই জগদানন্দ বস্তুর মেয়েকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিলেন। ঈশিতা বলেছিল, “জান, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তোমার খবরাখবর চেয়েছেন।”
“আমার খবর! পৃথিবীতে এতো লোক থাকতে গ্রাম্য স্কুলের পাশ করা জীমূতবাহনের খবর নিতে চেয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
ঈশিতা একটু বিরক্ত হয়ে বলেছিল, “তার কারণ তুমি ঈশিতার স্বামী আমাকে কবিগুরু খুব স্নেহ করেন। জন্মদিনে কবিতা লিখে দিয়েছেন। অসুস্থ হয়ে না পড়লে বিয়েতে ঠিক আসতেন, হয়তো একটা বড় কবিতাই লিখে ফেলতেন। এখন সুস্থ হয়েই তোমার খবরাখবর জানতে চেয়েছেন। একবার জোড়ে শান্তিনিকেতন যেতেও বার বার অনুরোধ করেছেন।”
ঈশিতা বলেছিল, “তুমি নিজেই ওঁকে চিঠি লেখো না—একটা খামের মধ্যে দু‘জনের চিঠি পাঠিয়ে দিই। খুব খুশী হবেন, নিশ্চয় উত্তর দেবেন।”
“রবীন্দ্রনাথকে? ওরে বাবা, মরে গেলেও নয়!”
“কেন, তোমার বাংলা বানান ভুল হয় নাকি? সায়েন্সের ছাত্র, হলেও হতে পারে, কিন্তু আমি তো রয়েছি, দেখে দেবো।”
“পাঠশালায় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণপরিচয় দ্বিতীয় ভাগটা যত্ন করে পড়তে হয়েছিল, তাই বানান ভুল হয় না—কিন্তু একেবারে কাঠখোট্টা মানুষ। একটুও রসকষ নেই,” জীমূতবাহন বলেছিলেন।
“রস না থাকুক, কষ যে আছে সেটা বেশ বুঝিয়ে দিচ্ছো।” অভিমানিনী ঈশিতা উত্তর দিয়েছিল।
রোমান্সের সেই অবমাননা ঈশিতা ৰোধহয় আজও ভুলতে পারেনি। কিন্তু কী করবেন জীমূতবাহন? কোটি কোটি কীটপতঙ্গের জীবনে’ আদিম রোমান্সের যে পুনরাবৃত্তি হচ্ছে তার গহনে একবার প্রবেশ করলে অন্য কিছুতেই আর রস পাওয়া যায় না।
ঈশিতা যদি তার মধ্যে প্রবেশ করতো, সেও নিশ্চয় সমান আনন্দ পেতো। মানুষের সমাজে যে উত্থান-পতন চলেছে, পিঁপড়ের সামাজিক কাহিনী কি তার থেকে কম রোমাঞ্চকর? ধরিত্রীর বক্ষ খনন করে পুরাতত্ত্ববিদ্ল মহেঞ্জোদারোর যে ইতিহাস অতীতের আলিঙ্গন থেকে উদ্ধার করেছেন, তা অবশ্যই আকর্ষণীয়; কিন্তু মাটির গর্ভে উই পোকার নগরে যে রমণী প্রতিদিন সাত হাজার সন্তানের জন্ম দিচ্ছে এবং অলিখিত সংবিধানের বলে ত্রিশ লক্ষ নাগরিকের উপর কর্তৃত্ব করছে, সেও কি কম আকর্ষণীয়?
ঈশিতাকে জীমূতবাহন কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, “জানো, উইদের রানীকে পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকতে দেখা গেছে। প্রতিদিন সাত হাজার ডিম পাড়লে অর্ধ-শতাব্দীতে কত হয় ভেবে দেখো তো!”
ঈশিতা কোনো বিস্ময় বোধ করেনি, বরং ঘেন্নায় তার গা ঘিন ঘিন করতে শুরু করেছিল। বলেছিল, “সবে মাত্র খেয়ে এসেছি—এখন এই সব বলতে আরম্ভ করলে বমি হয়ে যাবে আমার।”
কিন্তু ঈশিতার অতীত রোমন্থনের অনেক সময় পাওয়া যাবে; এখন বরং অমিতাভর মনে যে-সব প্রশ্ন জাগতে পারে তার উত্তর দেওয়া যাক।
জীমূতবাহন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আচমকা ঝাঁকানি খেয়ে উঠে পড়ে অমিতাভকে ‘বললেন, “তুমি সিগারেট ধরাচ্ছো না কেন অমিতাভ? নিজে সিগারেট খাই না, কিন্তু তাই বলে ‘নাদার মধ্যে কুকুরের’ পলিসি “অনুসরণ করি না আমি।”
অমিতাভ তখনও ইতস্তত করছিল দেখে জীমূতবাহন নিজেই ভিতর থেকে সিগারেট নিয়ে এলেন। বললেন, “জাপানী অধ্যাপক মিচিকানা কিছুদিন এখানে আতিথ্য নিয়েছিলেন। তিনি চুরুটের ভক্ত নন। সিগারেট না হলে তাঁর চলতো না—সেই সময় কিনে রেখেছিলাম।” জীমূতবাহন সিগারেট এগিয়ে দিয়ে দেশলাই জ্বেলে দিলেন। নিজেও এবার একটা চুরুট পরালেন তিনি।
সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে অমিতাভ। ধোঁয়ার কুণ্ডলীগুলো প্রশ্নচিহ্নের ‘আকার ধারণ করে জীমূতবাহনকে সেই সব প্রশ্ন জিগ্যেস করছে যা অমিতাভ সোজাসুজি বলতে পারছে না।
অন্তত জীমূতবাহনের তাই মনে হলো। একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে তিনি ‘পাই অমিতাভকে বললেন, “তোমার যা-যা জানতে ইচ্ছে করছে আমাকে নিঃসঙ্কোচে বলো ”
অমিতাভ কোনো উত্তর দিলে না।
“চুপ করে রইলে কেন, অমিতাভ? আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র আমাদের বলতেন—ইউ মাস্ট আস্ক কোয়েশ্চেনস্।”
“প্রফেসর ব্ল্যাকারের কাছে শুনেছি, আপনি নতুন অনেক কিছু করার স্বপ্ন দেখেছেন,” অমিতাভ ধীরে ধীরে বললে।
“স্বপ্ন অনেকেই দেখে, অমিত। আসলে সারাজীবন ধরে যা দেখে এলাম সে কি শুধু স্বপ্ন, না তার কোনো বাস্তব সম্ভাবনা আছে? সেইটাই আজকে আমার কাছে, শুধু আমার কাছে কেন, সমাজের কাছে, এমনকি আমার বাড়ির লোকের কাছেও মস্ত বড় একটা প্রশ্ন।”
“মানে?” অমিতাভ প্রশ্ন করে।
“মানে, মনে করো পরীক্ষার হলে বহুক্ষণ ধরে একটা জটিল অঙ্ক কষে যাচ্ছো। অঙ্কটা শেষ পর্যন্ত মিলবে কিনা তুমি নিজেই বুঝতে পারছো না, অথচ সময় ফুরিয়ে আসছে। এই অবস্থায় তুমি কি সেই অঙ্কটাই কষে যাবে, না অন্য কোনে৷ সহজ অঙ্ক ধরবার চেষ্টা করবে?’
সিগারেট টানা বন্ধ করে অমিতাভ যে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে তাঁর কথা শুনছে, জীমূতবাহন এবার তা বুঝতে পারলেন। নিজের উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন, “একদিনে তোমার ঘাড়ে সব ডেটা চাপিয়ে দিতে চাই না। আস্তে আস্তে তুমি নিজেই সব বুঝতে পারবে। এখন মোটামুটি দরকারী কথাগুলো বলে দিই।”
“বলুন স্যার।”
“তুমি জানো, আমি পেস্টিসাইডের ওপর কাজ করে প্রথম বৈজ্ঞানিক জগতে নাম করেছিলাম। পৃথিবীতে আমাদের অনেক ফসল দরকার। যদি এতগুলো মানুষকে দু’ বেলা খাওয়াতে হয়, তাহলে পোকামাকড়ের হাত থেকে কৃষিপণ্যকে রক্ষা করতেই হবে। ধানের মাজরা পোকা, স্টেম বোরার অর্থাৎ কিনা Schoenobius bipunctifera এবং পামরী পোকা—রাইস হিস্পা ( Hispa armigera )-এর উপর প্রথম কাজ আরম্ভ করি।”
অমিতাভ বললে, “আপনার গোড়ার যুগের সেই রিপোর্ট ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এখনও পড়ে থাকে। হাইমেনোপটেরা, নিউরোপটেরা ও কোলিওপটেরার ওপর আপনার কয়েকটা কাজ তো ক্লাসিক স্বীকৃতি পেয়েছে।”
অমিতাভর দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “সেসব কাজের পর বিজ্ঞানের বহু অগ্রগতি হয়েছে—জাপান এবং স্টেটসের বৈজ্ঞানিকরা অনেক নতুন আলোকসম্পাত করেছেন। ঐতিহাসিক মূল্য ছাড়া সেনস্ রিপোর্টের আর কোনো মূল্য নেই আজ। আর কবে মান্ধাতার আমলে একটা কিছু করে, সেই নাম ভাঙিয়ে বাকি জীবনটা কুড়েমি করে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেওয়াটাও আমি ঘূর্ণা করি।”
“ভারতীয়দের এ-রকম একটা বদনাম আছে বটে—খুব ভাল স্টার্ট এবং ব্যাড ফিনিস।” অমিতাভ তার নিজের মত জানাল।
“অথচ সব ভাল যার শেষ ভাল।” জীমূতবাহন এবার অমিতাভর কথার সূত্র ধরলেন। “আমার স্থির বিশ্বাস ছিল, কেমিক্যাল কন্ট্রোল ছাড়া পতঙ্গের এই পরাক্রম থেকে কৃষির মুক্তি নেই। আমেরিকায় সেই সময় পাগলের মতো পরিশ্রম করেছিলাম এবং ভাগ্যের দেবতা স্মিতহাস্থে আমার দিকে কৃপাদৃষ্টিপাতও করেছিলেন।”
অমিতাভ বিস্মিতভাবে জীমূতবাহনের কথা শুনে যাচ্ছিল। “আপনি কেমিক্যাল পেস্টিসাইডে দুটো পেটেন্ট পেয়েছিলেন, তাই না?”
“অত অল্প সময়ের মধ্যে দুটো পেটেন্ট পাওয়া নিতান্ত ঈশ্বরের আশীর্বাদ তাড়া কি বলবো? অনেকে তখন বলেছিল, নিজের ফার্ম চালু করো—ক্রমশ কোম্পানী হয়ে উঠবে। নিজের আবিষ্কারকে মূলধন করে যাঁরা কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাঁদের বিশ্বজোড়া নাম হয়েছে—আলফ্রেড নোবেল, হেনরি ফোর্ড, আলেকজাণ্ডার গ্রাহাম বেল, মার্সিজ মার্কনি ও গানেস্ট ফন সীমেন্স—আরও কত নাম বলতে পারি।”
“করলেন না কেন? পৃথিবীর রসায়ন শিল্পে একজন ভারতীয়ের নাম অন্তত পরিচিত হয়ে যেতো,” অমিতাভ প্রশ্ন করে।
জীমূতবাহন বললেন, “অনেকে যেমন বিশ্বজোড়া কোম্পানী ফেঁদেছেন, মেন আবার অনেকে দেউলিয়াও হয়ে গিয়েছিলেন।”
“সেটা তো অ্যাডভেঞ্চারের প্রশ্ন। চেষ্টা করে হেরে যাওয়ার মধ্যে কোনো লজ্জা আছে?” অমিতাভ জানতে চায়।
“না অমিতাভ, ব্যবসা আমাদের কাজ নয়! আমাদের কাজ গবেষণা।
তা ছাড়া, আমার এক এক সময় কীটনাশক ইনসেকটিসাইড-এর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সন্দেহ হয়।”
“মানে, আপনি কী বলতে চান? রাসায়নিক কীটনাশক আবিষ্কৃত না হলে পৃথিবীতে এতোদিন দুর্ভিক্ষ লেগে যেতো। পোকামাকড় পৃথিবীময় চাষের যে সর্বনাশ করছিল—ইনসেকটিসাইড তার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করেছে।”
জীমূতবাহন চুরুটে আর একটা টান দিয়ে বললেন, “কীটনাশক ছাড়া এগ্রিকালচারের কথা ভাবা পর্যন্ত যায় না—স্বীকার করি। আমাদের দেশেই প্রতি বছর অন্তত এক হাজার কোটি টাকা দামের খাদ্যশস্য পোকামাকড় এবং জন্তুজানোয়াররা নষ্ট করছে। কোটি কোটি টাকার কীটনাশক ক্ষেতে ক্ষেতে বিভিন্ন সময় স্প্রে করা দরকার। পৃথিবীর অন্য দেশেও তাই হচ্ছে—এরোপ্লেন এবং হেলিকপ্টার পর্যন্ত এই কাজে লাগানো হচ্ছে! কিন্তু যে জিনিসটা আমাকে ক্রমশই চিন্তিত করে তুলছে তা হলো পতঙ্গরাও বাঁচবার নতুন পথ খুঁজে বার করছে।”
একটু থেমে জীমূতবাহন বললেন, “কীটনাশকে প্রথম দিকে যে-রকম কাজ হতো ইতিমধ্যেই আর ততটা হচ্ছে না। এমন একদিন আসতে পারে, যেদিন পতঙ্গের সহ্যশক্তি এমন বেড়ে যাবে যে, মানুষের তৈরি এই ইনসেকটিসাইডে আর কোনো কাজই হবে না। মশা, মাছি, বীল, মথ এরা মহানন্দে রসায়নকে অবজ্ঞা করে নিজেদের বংশবৃদ্ধি করে যাবে।”
অমিতাভ বললে, “সেদিন এখনও অনেক দূরে।”
জীমূতবাহন বললেন, “দূরে, কিন্তু হয়তো খুব দূরে নয়। আগে যেখানে ফাইভ পারসেন্টে কাজ হতো, এখন সেখানে দশ পারসেন্ট দিতে হচ্ছে, তাতেও সব সময় মনের মতো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। পোকারা নীলকণ্ঠ হবার সাধনা করছে।”
অমিতাভ উত্তর দেয়, “কয়েকটা বড় বড় কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি দেখেছি আমি। নতুন নতুন বিষ বার করবার জন্যে নিরন্তর গবেষণা চলছে। সেই সব ছড়িয়ে কৃষিবিজ্ঞানীয় শিশু চারাদের সর্বভুক্ পোকাদের হাত থেকে রক্ষা করবে।”
জীমূতবাহন বললেন, “রাসায়নিক যুদ্ধ যারা করছে, করুক। কিন্তু এর বিপদের দিকটাও যে ক্রমশ আরও প্রকট হয়ে উঠবে, এ সম্বন্ধে আমার মনে একটুও সন্দেহ নেই। নির্বিচারে বিষ ছড়িয়ে, প্রকৃতির রাজ্যে, আমরা ইতিমধ্যে বহু সর্বনাশ করেছি। শত্রু পোকার সঙ্গে যে-সব পোকা মানুষের বন্ধু, আমরা তাদের নির্বংশ করে ফেলে, নতুন বিপদ ডেকে আনছি।”
“নিখাদ আশীর্বাদ বলে কোনো জিনিস তো পৃথিবীতে নেই। একদিন বাষ্পীয় রেল-ইঞ্জিন আমাদের জঙ্গে নতুন আশীর্বাদ বহন করে এনেছিল, কিন্তু তার সঙ্গে এসেছিল ম্যালেরিয়া। ম্যালেরিয়ার ভয়ে রেলপথ বিস্তার বন্ধ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে ভাল হতো কি?” অমিতাভ নিজের মত জানায়।
কিন্তু জীমূতবাহন এই বিষয়ে চিন্তা করেছেন। তিনি বললেন, “মোটর গাড়ি না থাকলে মোটর অ্যাক্সিডেন্টে লোক মারা যেতো না—সুতরাং মোটর গাড়ি না হওয়াই ভাল ছিল, এমন মতে নিশ্চয় আমি বিশ্বাস করি না অমিতাভ। কিন্তু নির্বিচারে ইনসেকটিসাইড ব্যবহার করে আমরা ভবিষ্যৎ মানব জাতির দৈহিক ক্ষতি করছি, একথা পশ্চিমের অনেক বৈজ্ঞানিক এখন গেছেন। বৈজ্ঞানিক জার্নালের সীমা পেরিয়ে, মাঝে মাঝে খবরের কাগজেও ‘এ-সম্বন্ধে কথা উঠছে। আমরা বোধহয় ধীরে ধীরে অনেক শস্যকেও বিষাক্ত করে ফেলছি। গোরুবাছুররা এই সব খড় এবং ঘাস খাচ্ছে। তাদের দুধ থেকে এইসব বিষ তোমার আমার ঘরে ফিরে আসছে। কোটি কোটি অনাগত শিশুর ওপর একদিন এই বিষের কী ক্রিয়া হবে, তা এখনও খামাদের জানা নেই।”
অমিতাভ বললে, “তা হলে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে চাষা? দেখবে তার সোনার ক্ষেত ঝাকে ঝাঁকে পতঙ্গ এসে লুট করছে?”
“না, তা বলছি না।”
“তবে?”
“কেমিক্যাল কন্ট্রোল আমি ছেড়ে দিতে বলছি না—আরও অনেকদিন পারে এই সব বিষ আমাদের চাষ-আবাদ রক্ষা করতে সাহায্য করবে। কিন্তু অন্য যেসব পথ রয়েছে, সেসব সম্বন্ধে আরও বেশী করে চিন্তা করবার সময় এসে গিয়েছে। আমার এই ছোট্ট ল্যাবরেটরিতে সেই নিয়েই তো কাজ চালাবার চেষ্টা করছি।”
“আপনি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের কথা বলছেন?”
জীমূতবাহন বললেন, “ক্যালিফোর্নিয়ায় একবার কটনি কুশন স্কেল পোকার অত্যাচার শুরু হলো। অস্ট্রেলিয়া কিংবা নিউজিল্যাণ্ড থেকে কীভাবে তারা আমেরিকা পাড়ি দিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার তাদের বংশ তেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায় না, কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ায় তারা এতো বেড়ে যাচ্ছে কেন? এ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করবার জন্যে আলফ্রেড কীবিল নামে এক ভদ্রলোককে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানো হলো। তিনি সেখানে ওই পোকার জন্মগত শত্রু আর এক পোকাকে আবিষ্কার করলেন। লেডি বার্ড বীট্ল এনে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছেড়ে দিতেই মন্ত্রের মতো ফল পাওয়া গেল।”
একটু কেশে জীমূতবাহন বললেন, “আমার বন্ধু ডাক্তার মায়ার পোকা দিয়ে পোকা তাড়ানোর যে আশ্চর্য ফল হাওয়াই দ্বীপে পেয়েছেন, তা তো গল্পের মতো শোনায়। ফিজিতে লেভুয়ানা মথকে কিছুতেই বাগে আনা যাচ্ছিল না। সেখানে ট্যাকিনিড প্যারাসাইট ছেড়ে দিতেই কাজ পাওয়া গিয়েছে।”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জীমূতবাহন এবার চমকে উঠলেন, বললেন, “প্রায় বারটা বাজতে চলেছে। এখন আর আলোচনা নয়। আলোচনা করবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। দু‘দিন ট্রেন জার্নি করে তোমার এখন ঘুমের প্রয়োজন। যতক্ষণ খুশী ঘুমিয়ে থেকো!”
জীমূতবাহন নিজে অমিতাভকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন। অমিতাভর ঘরে খাবার জল দেওয়া হয়েছে কিনা নিজে দেখলেন। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন।