নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি – ২

ট্রেন থেকে নেমে কোনো অসুবিধাই হলো না। স্টেশনের পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে তখন ঘোষণা হচ্ছে : কলকাতার প্যাসেঞ্জার মিস্টার অমিতাভ মিত্র, গেটের কাছে আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে।

গাড়ি মানে স্টেশন ওয়াগন। সচরাচর এখানে যেমন দেখা যায় তার থেকে অনেক হাল্কা। গাড়ির ড্রাইভারটি কিন্তু জনৈক মহিলা। অমিতাভ হাত তুলে নমস্কার করলে।

“আপনিই অমিতাভ মিত্র? নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।” মেয়েটি চমৎকার বাংলায় বললে।

ফোর-হুইলারটা কোন্ মেকের দেখবার জন্যে অমিতাভ ঝুঁকে পড়েছিল। মেয়েটি বললে, “এ-দেশী নয়—জাপানী। খুব হাল্কা। জাপান এগ্রিকালচার অ্যাসোসিয়েশনের প্রফেসর মিচিকানা মাস্টারমশাইকে উপহার পাঠিয়েছেন। উনি কিছুদিন আগে এখানে এসেছিলেন।—মাস্টার-মশাইয়ের গেস্ট হয়েছিলেন।”

এ-দেশী মেয়েকে জীপ চালাতে দেখে অমিতাভ যে একটু অবাক হয়নি এমন নয়। গাড়িতে উঠে মেয়েটির দিকে অমিতাভ এমনভাবে তাকিয়েছিল, যার অর্থ—প্রয়োজন হলে আমি ড্রাইভ করতে পারি। কিন্তু পথ-প্ৰদর্শিকা ধন্যবাদ দিয়ে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলো।

অতিথিকে অভ্যর্থনা জানিয়ে মহিলাটি বললে, “মাস্টারমশাই নিজে এলে আমাকে ড্রাইভ করতে হতো না। কিন্তু উনি ল্যাবরেটরিতে আটকে পড়লেন। ল্যাবরেটরির কোলোরাডা বীলগুলো হঠাৎ কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। কতকগুলো ইতিমধ্যেই মারা গেল। মাস্টারমশাই ওদের অবজার্ভ করছেন। দু-একটা ওষুধ দিয়ে দেখছেন। হয়তো খাওয়ার দোষ হয়েছে।”

“ফুড পয়জন!” অমিতাভ হেসে উঠলো।

সামনের হেড লাইটটা জ্বেলে দিয়ে মেয়েটি বললে, “মাস্টারমশাইয়ের ছোট প্রতিষ্ঠান—ড্রাইভার রাখবার মতো সামর্থ্য নেই। সেই পয়সায় একটা ল্যাবরেটরি অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখতে পারলে খুশী হন তিনি।”

অমিতাভ ভাবছিল, মহিলা সারথির নাম জিগ্যেস করবে—পরিচয়ের পর্বটা যেন অর্ধসমাপ্ত রয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেটা নিজে থেকে উত্থাপন করাটা বোধ হয় শোভন হবে না।

কম কথা বলে মেয়েটি। কপালে নেমে আসা গুঁড়ো চুলগুলো বাঁ হাতে ঠিক করে নিয়ে সে বেশ অভ্যস্তভাবেই ডানদিকে গাড়িটা ঘুরিয়ে নিল। তারপর আধা-আলোকিত পথে আবার যাত্রা শুরু হলো। হেড লাইটটা গায়ের জোরে খানিকটা জমি ছিনিয়ে নিয়ে অন্ধকারের বুকের ওপর নিজের ছোট্ট জমিদারি ফেঁদে বসেছে। সেই আলোর অংশটুকুতে কয়েকটা পতঙ্গ ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। তারা যেন নতুন আগন্তুককে নিবেদিতা ল্যাবরেটরির পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে।

মেয়েটি এবার গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিল, সামনে একটা ঘোড়ার টানা গাড়ি চলেছে। দক্ষ হাতে তাকে পাশ কাটিয়ে পিছনে ফেলে রেখে আবার এগিয়ে চললো সে। যেতে যেতে বললে, “মাস্টারমশাই হলে গাড়ি থামিয়ে ঘোড়াটার পিছনে কিছুটা সময় কাটাতেন—পরীক্ষা করে দেখতেন কোথাও ঘা আছে কিনা।”

“কেন?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে অমিতাভ।

“এইসব ঘায়ে একরকম সর্বনাশা মাছি ডিম পাড়ে—স্ক্রু ফ্লাই। মাস্টারমশাই কিছু ম্যাগট জোগাড় করবার চেষ্টা করছেন।”

মাস্টারমশাই সম্বন্ধে সারথিনীর যে অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে, তা তার কথার ভঙ্গিতেই ধরা যায়।

সে এবার বললে, “আপনাকে একটু কষ্ট দেবো। গাড়িটা একবার থামিয়ে সামনের ওই দোকান থেকে কিছু খাবার নিয়ে নেবো। ”

অমিতাভ সারথিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখবার চেষ্টা করছিল। রঙটা প্রচণ্ড ফর্সা বলা চলে না নিশ্চয়। কিন্তু কোথাও বেশ খানিকটা স্নিগ্ধ লালিত্য রয়েছে। একটা নরম লাজুক ভঙ্গি সাড়ে পাঁচ ফুট দেহটার চারিদিকে লতার মতো জড়িয়ে রয়েছে। অথচ লজ্জায় জড়সড় নয়। মাথায় চুল অনেক—পিছনে বিরাট খোঁপা, দেহের তুলনার যেন একটু বড়ই, অন্তত বাংলা দেশের মাপে। সাদা ফুলের মালা জড়ানো রয়েছে খোঁপায়।

তাড়াতাড়িই ফিরে এসেছিল সারথিনী। হাতে খাবারের বদলে বিরাট ঝুড়ি। অমিতাভ সাহায্য করতে এগিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই অবলীলাক্রমে মোটটা পিছনে রেখে দিল সে।

অভিযোগের সুরেই অমিতাভ বললে, “একি কথা। আমরা থাকতে মেয়েরা মোট বইবে!”

হাসির মুক্তো ঝরিয়ে গাড়িতে আবার স্টার্ট দিতে দিতে মেয়েটি বললে, “মাস্টারমশাইয়ের কিন্তু ওসব খেয়াল থাকে না। তিনি বলেন, আদিম যুগে মোট বহন করবার প্রিভিলেজটা মেয়েদের একচেটিয়া ছিল।”

অমিতাভ বললে, “এ-যুগে সেটা বাতিল। হেভি ওয়েট লিফটিং চ্যাম্পিয়নশিপে মেয়েদের প্রতিযোগিতা করতেই দেওয়া হয় না।”

সারথিনী লজ্জাও পেল না, আবার প্রগল্ভা হয়েও উঠল না। সহজভাবেই বললে, “প্যাকেটটা এমন কিছু ভারি নয়। অর্ডার দেওয়া ছিল। আজকে না নিয়ে গেলে ক্যাবেজ অ্যাফিডগুলো উপোস করে থাকতো। মাস্টারমশাই খুব একসাইটেড-ল্যাবরেটরিতে ওরা বাচ্চা পাড়তে শুরু করেছে। তবে ছ’ মাসে ষোলোটা জেনারেশন হবে কিনা সন্দেহ! মাস্টার-মশাই বলছেন চোদ্দটা হলেও মন্দ কী!”

“চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার হয় তা হলে!” অমিতাভ রসিকতা করলে।

মেয়েটি মৃদু হেসে গাড়ি চালনায় মন দিল। অন্ধকারের বুক ভেদ করে কোন এক অজানা গ্রহের উদ্দেশে যেন জীপটা রকেটের মতো ছুটে চলেছে। অমিতাভ আড়চোখে মহিলার নিপুণ হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকলেও কোনো কথা বললে না।

এবার বোধ হয় লক্ষ্যস্থলের কাছাকাছি আসা গিয়েছে। ডায়াল ল্যাম্পের আলোয় হাতের ঘড়িটা দেখে নিল সারথিনী। তারপর গাড়িটা থামিয়ে লাফিয়ে নেমে পড়ে সামনের গেটের পাল্লাটা খুলে দিয়ে আবার গাড়িতে চেপে বসলো। গাড়িটা ভিতরে ঢুকিয়ে আবার গেটটা বন্ধ করে এল। অমিতাভ নিজেই গেট বন্ধ করতে চেয়েছিল, কিন্তু মেয়েটি বাধা দিয়েছিল : “আপনি অতিথি। যদি এখানে থাকেন, তখন আপনি নিজেই করবেন, আমরা কেউ বাধা দেবো না।”

“মানে আপনিও বাধা দেবেন না?”

“মোটেই না!”

আরও কথা হতো, কিন্তু রাত্রের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে পথ-প্ৰদর্শিকা বেশ জোরেই হর্ন টিপলো। গাড়িটা কাঁচা রাস্তার মধ্যে দিয়ে চলেছে। দু‘পাশে ক্ষেত।

পথ-প্রদর্শিকা বললে, “নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির মধ্যেই চলে এসেছি আমরা।”

সামনের ছোট্ট একটা কটেজে এবার আলো জ্বলে উঠলো। জীমূতবাহন সেন যে সেখান থেকে বেরিয়ে আসছেন, তা বুঝতে অমিতাভর দেরি হলো না। একটা ফতুয়া আর পাজামা পরেছেন ডঃ সেন। তিনি যে জীপের আওয়াজ শোনবার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন তা তাঁর কথাতেই বোঝা গেল। জীমূতবাহন বললেন, “ইন্দুমতী, তোমরা তা হলে এলে? আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল।”

“গাড়ি দেড় ঘণ্টা লেট ছিল স্যর।” ইন্দুমতী বললে।

“তাই বুঝি? তা হলে তো তোমার খুব কষ্ট হয়েছে ইন্দু।” জীমূতবাহন বেশ বিব্রতভাবেই বললেন।

“না মাস্টারমশাই, কষ্ট কী?” ইন্দুমতীর মিষ্টি উত্তর অমিতাভর দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারল না।

“এসো এসো অমিতাভ। তোমারও নিশ্চয় খুব কষ্ট হয়েছে।” জীমূতবাহন অমিতাভকে স্বাগত জানালেন। তারপর ইন্দুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “একটা দুঃসংবাদ আছে।”

চমকে উঠেছিল অমিতাভ, “কী দুঃসংবাদ!”

“কোলোরাডা বীলগুলোকে বাঁচানো গেল না। মড়ক লেগেছে, ইন্দু। তুমি যাবার পরে আরও দু’ হাজার আমার চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল।” মাস্টারমশাই যে গভীর দুঃখ পেয়েছেন তা তাঁর কথাবলার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে। হতাশ হয়েই যেন প্রশ্ন করলেন, “এখন কী হবে বলো তো, ইন্দু?”

“কী হবে, মাস্টারমশাই। আপনি চিন্তা করবেন না, বাবা তো এখনও ইউ এস এ-তে রয়েছেন। আমি কালই চিঠি লিখে দিচ্ছি-আর এক লট পাঠিয়ে দিতে।”

“তা হলে খুবই ভাল হয়। ডাকের চিঠ কবে গিয়ে পৌঁছবে কিছুই ঠিক নেই। তার থেকে একটা কেব্‌ল পাঠিয়ে দাও। বীলগুলোর তো এভাবে মরবার কথা নয়। নিশ্চয় ফিডিং-এর দোষ হয়েছিল।”

ঘড়ির দিকে তাকালেন জীমূতবাহন। যেন ঘড়িটার কাছে বকুনি খেয়েই তাঁর সংবিৎ ফিরে এলো। ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আই অ্যাম ভেরি স্যরি ইন্দু, রাত অনেক হয়েছে, তুমি তোমার ঘরে চলে যাও।”

শুভরাত্রি জানিয়ে ইন্দুমতী বিদায় নিচ্ছিল। কিন্তু জীমূতবাহন ডাকলেন, “ইন্দু, তোমার টর্চ কোথায়?”

“আনিনি স্যার—কিছু অসুবিধে হবে না।”

“না, না, এটা খুব অন্যায়—কত রকমের পোকামাকড় ঘুরে বেড়ায় এখানে—কয়েকটা কাঁকড়াবিছে সেদিন খাঁচা থেকে পালিয়েছে। কোথায় ঘর-সংসার পেতে তারা বংশ বৃদ্ধি করছে ঠিক নেই।”

ইন্দুমতী হাসতে হাসতে বলল, “আমার বৃশ্চিক রাশি মাস্টারমশাই।” মাস্টারমশাই এবার ইন্দুমতীর পায়ের দিকে তাকিয়ে আরও রেগে উঠলেন। “আমার নিজের কাজের অন্ত নেই—এতোগুলো পোকামাকড়ের তদারক করতে করতেই পাগল হয়ে যাচ্ছি, এরপর যদি আমাকে তোমাদের জুতোর খবরও রাখতে হয়!”

“কী হলো মাস্টারমশাই?” ইন্দুমতী সলজ্জ হেসে জানতে চাইল।

“তুমি আবার চটি পরেছো! বলেছি না, এটা স্লিপারের জায়গা নয়—এখানে তোমাকে মোজার সঙ্গে চামড়ার ঢাকা-জুতো পরতে হবে। কেন যে তোমরা আমার কথার অবাধ্য হও, বুঝি না।”

ইন্দুমতী হাসিমুখে বকুনিটা হজম করলে, তারপর মাস্টারমশাইকে শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিল।

জীমূতবাহন স্নেহভরা কণ্ঠে অমিতাভকে বললেন, “বড় ভালো মেয়ে আমাদের ইন্দুমতী।”

এবার অমিতাভর দিকে মনোযোগ করলেন জীমূতবাহন। “কাল সকালেই তোমাকে একটা বড় টর্চ দিতে হবে। পোকামাকড়দের কোনো নীতিজ্ঞান নেই!”

অমিতাভ একটু হাসলো। জীমূতবাহন বললেন, “আর সময় নষ্ট না করে চলে! তোমার বাংলোয়। আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।”

“আপনি শুধু শুধু কষ্ট করবেন কেন?”

“আরে চলো চলো। কষ্ট কিসের? তোমার জন্যে আলাদা একটা কটেজ ব্যবস্থা করেছি।”

ছোট্ট কটেজ। জীমূতবাহন নিজেই দরজার চাবি খুললেন। দুটো ঘর। একটায় শোবার ব্যবস্থা, আর একটায় বসবার এবং লেখাপড়া করবার। বেশ ছিমছাম। বিছানা ইতিমধ্যেই পরিপাটি করে সাজানো। একটা কাঠের ওয়ারড্রোবও রয়েছে। লাগোয়া বাথরুম।

জীমূতবাহন বললেন, “ভাল করে দেখে নাও। জল সব সময় পাবে। কিন্তু সারি—কোনো বাথটাব নেই। দোষটা আমারই। ইন্দু বলেছিল, তুমি বিলেত থেকে আসছো—বাথটাব ছাড়া তোমার খুব অসুবিধে হবে। কিন্তু আমার সেই ছোটবেলা থেকে ঘটি ঢেলে স্নান করার এমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছে যে, বড় হোটেলে গিয়েও বাথটাব ব্যবহার করতে পারি না। তবে তোমার বাথটাবের ব্যবস্থা করে দেবো।”

“না না, আমার মোটেই অসুবিধে হবে না। ক’দিন আর বিলেতে ছিলাম?” অমিতাভ উত্তর দেয়।

“স্নান সেরে জামাকাপড় পাল্টে নাও, আমি তোমার জন্যে বসছি।” জীমূতবাহন একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

“না না, আপনি কেন অপেক্ষা করবেন?” অমিতাভ আপত্তি জানায়। জীমূতবাহন পকেট থেকে এক টুকরো এলাচ বার করে মুখে পুরতে পুরতে বললেন, “আজ প্রথম দিন, আমার ওখানেই তোমার খাবার ব্যবস্থা করেছি। কাল থেকে তুমি স্বাধীন।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *