নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি – ১৪

১৪

তারপর পৃথিবীতে সূর্য উঠেছে। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে অন্ধকারে রেখে সূর্য আবার বিদায়ও নিয়েছে। চন্দ্র সূর্যের পালাবদল বার বার হয়েছে, আর নিজের কাজের ফাঁকে ফাঁকে জীমূতবাহন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছেন কবে বিস্ফোরণ হবে। টাইম বোমাটা হঠাৎ কখন ফেটে পড়বে।

অবশেষে সত্যিই একদিন বিস্ফোরণ হলো। সেদিন ভোরবেলাতে বিদ্যুৎ-গতিতেই খবরটা দিকে দিকে প্রচারিত হলো। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির বেয়ারা, ঠাকুর, চাকর, দারোয়ান, মালী, অ্যাসিসটেন্ট সবাই জানতে পারলে, ইন্দুমতী দেশাই আর অমিতাভ মিত্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। চুপি চুপি তারা আলোচনা করতে লাগলো—কাউকে না বলেই ওরা আমেদাবাদ পালিয়েছে, সেখানেই বিয়ে করবে ওরা।

কেউ বললে, “এমন যে হবে মনে হয়নি তো।” আবার কেউ বললে, “দেশাই দিদিমনি আগে খুব নিরীহ সাদাসিধে ছিলেন। কিন্তু ইদানীং দেশাই দিদিমনিও রঙচঙে শাড়ি পরছিলেন, চোখে কাজল দিচ্ছিলেন। বেণীতে রজনীগন্ধার মালা জড়িয়ে প্রায়ই ফট ফট করে কথা বলছিলেন মিটার সায়েবের সঙ্গে। মিটার সায়েবের ঘরে অনেক রাত পর্যন্ত দু‘জনকে গল্প করতে দেখা গিয়েছে।”

কিন্তু এ কি হলো জীমূতবাহনের? ভেবেছিলেন দূর থেকে তিনি বিস্ফোরণের একজন দর্শকমাত্র হবেন। কিন্তু বোমার একটা টুকরো আচমকা ছুটে এসে তাঁর বুকেই বিদ্ধ হয়েছে। মনে হচ্ছে এখনই তিনি মূর্ছিত হয়ে পড়বেন।

ওযুধের বোতল থেকে ট্র্যাংকুইলাইজার বার করে খেলেন জীমূতবাহন। ঈশিতার একটা মন্তব্য শুধু শুনতে পেয়েছিলেন জীমূতবাহন—“স্কাউনড্রেল।”

শহরে জরুরী কনফারেন্স ছিল জীমূতবাহনের। ভেটারিনারি কলেজে সব প্রদেশের পশুচিকিৎসকরা এসেছেন জীমূতবাহনের প্রজননশক্তিহীন মাছির বিবরণ শুনতে। জীমূতবাহন ভাবলেন, ভালই হয়েছে। কিছুক্ষণের জন্যে নিবেদিতা ল্যাবরেটরির যক্ষপুরী থেকে পালিয়ে গিয়ে বাঁচবেন তিনি।

সারাদিন মানুষের ভিড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলবার চেষ্টা করলেন জীমূতবাহন। যন্ত্রণায় মাথার শিরাগুলো যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। মদালসার মুখটা দেখতে পাচ্ছেন বার বার। একটা নয়, অনেকগুলো মদালসা যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আর কানে বাজছে ঈশিতার শেষ কথা—স্কাউনড্রেল।

অনেকগুলো বড়ি খেয়েছেন জীমূতবাহন। কিন্তু মাথাটা যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ঠিক বুঝতে পারছেন না, ঈশিতা কাকে স্কাউনড্রেল বললে। স্কাউনড্রেল মানে তো দুরাত্মা, বদমায়েস, পামর। কে স্কাউনড্রেল? অমিতাভ? ইন্দুমতী? না জীমূতবাহনকেই স্কাউনড্রেল বলেছেন ঈশিতা!

ডিনারের ব্যবস্থা ওখানেই ছিল। কিন্তু শেষের দিকে জীমূতবাহন আর দাড়িয়ে থাকতে পারলেন না। প্রথমে বসে পড়লেন। মনে হলো শুয়ে পড়তে পারলেই ভাল হতো। ডাঃ গোড়বলে ছিলেন কাছাকাছি। পরীক্ষা করে বললেন,নাড়িটা বেশ দ্রুত চলেছে, হয়তো রক্তের চাপ বেড়েছে একটু।

ওরা তাঁকে ল্যাবরেটরির গেট পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে জীমূতবাহনের। তাঁর নিজের সন্তানের মহা সর্বনাশ করেছেন একথা ভাবতেই অকস্মাৎ বুকের মধ্যে দুঃসহ যন্ত্রণা অনুভব করছেন! একবার মনে হচ্ছে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম অপরাধে তাঁর দুটি হাতকে কলুষিত করেছেন তিনি, আবার মনে হচ্ছে তিনি নিমিত্তমাত্র। যা হয়েছে তাছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।

বৈজ্ঞানিক জীমূতবাহন কি উন্মাদে পরিণত হচ্ছেন?

স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের ফয়সালা করতে না পেরে মত্ত জীমূতবাহন তাঁর নিষ্পাপ নেয়ের সর্বনাশ করেছেন।

বেশ রাত হয়েছে। কিন্তু বাড়িতে ঢুকতে সাহস করছেন না জীমূতবাহন। মদালসার মুখটা দেখবার জন্যেই হঠাৎ মনটা ছটফট করতে লাগল জীমূতবাহনের।

ঈশিতা গম্ভীর মুখেই জেগে বসে ছিলেন। এই একদিনেই দশ বছর বয়স বেড়ে গিয়েছে ঈশিতার। চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গিয়েছে। কে যেন ঈশিতাকে ব্ল্যাক-আউটের ঠুলি পরিয়ে দিয়েছে।

“খুকুমণি কোথায়?” ক্ষীণকণ্ঠে জিগ্যেস করলেন জীমূতবাহন।

“পাশের ঘরে,” কাঠের মতো শুকনো উত্তর দিলেন ঈশিতা।

খুকুমণির সঙ্গে কথা বলবার প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছে জীমূতবাহনের। তাঁর নিজের মেয়ে, কিন্তু তার ঘরে ঢোকবার অধিকার হারিয়ে ফেলেছেন জীমূতবাহন। তিনি যেন বাইরের কেউ। তাই ঈশিতার অনুমতি প্রার্থনা করলেন, “ওকে দেখবো একবার?”

“ওকে ইঞ্জেকশনে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে।” আবার কাঠের মতো উত্তর দিলেন ঈশিতা।

“এ্যা! ইঞ্জেকশন কেন?”

“সকালবেলায় নিজের চোখে অমিতাভর ঘরটা দেখে এসেছিল খুকুমণি। তারপর কয়েকবার বমি করলো। ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ট্যাবলেট খেয়েও ঘুম হলো না। গুম্ হয়ে পড়েছিল সারাদিন। তারপর…

“তারপর?” বিছানায় বসে পড়লেন জীমূতবাহন।

“বিকেলেই ফিট হলো। হাত পায়ে সব খিল ধরেছিল। ঠোঁটটা কামড়ে ফেলেছে। তখন ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিয়ে গিয়েছে।”

জীমূতবাহন বুকের মধ্যে আবার প্রচণ্ড উত্তেজনা বোধ করছেন। তাঁরও কি ফিট হবে নাকি? হাত কাঁপছে তাঁর। বড় ভাল মেয়ে খুকুমণি। ছোটবেলায় মেয়েটা কত আদর করতো তাঁকে। গলা জড়িয়ে ধরতো। চুম্ খেতো।

“খুকুর কেন এমন হলো!” কাতর আর্তনাদ করে উঠলেন জীমূতবাহন।

“হয়েছে! আর সীন ক্রিয়ট করো না। অনেক কষ্টে খুকুমণি ঘুমিয়েছে,” ঈশিতা চাপা গলায় বললেন।

ঈশিতা অমনভাবে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে কেন? ঈশিতার চোখ দুটো এমনিই বড়, কিন্তু এখন যেন ক্রমশ আরও বড় হয়ে উঠছে। কাতর কণ্ঠে অপরাধীর মতো জীমূতবাহন বললেন, “ঈশিতা, আমি মেয়ের আরও ভাল বিয়ে দেবো।”

“আচ্ছা!” ঈশিতার কণ্ঠে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছে।

“ঈশিতা, তুমি অমনভাবে তাকাচ্ছ কেন?” জীমূতবাহন কম্পিত কণ্ঠে প্রশ্ন করেন।

অক্টোপাশের পা দিয়ে ঈশিতা তাঁকে বেঁধে ফেলেছেন। “কেন তাকাচ্ছি তুমি সেটা ভালভাবেই জানো।”

কী বলতে চায় ঈশিতা? ঈশিতা কী ব্যাপারটা জানে? “ঈশিতা,” আবার কাতরভাবে ডাকলেন জীমূতবাহন।

মুখ ফিরিয়ে ঈশিতা বললেন, “আমি এখন খুকুর কাছে শুতে যাচ্ছি। একটু আস্তে কথা বলে কৃতার্থ করো।”

“ঈশিতা,” আবার ডাকলেন জীমূতবাহন।

“সাপেরাই শুনেছি নিজেদের বাচ্চা খায়,” এই কথা বলে জীমূতবাহনের মুখের ওপরই ঈশিতা দরজা বন্ধ করে দিলেন।

জীমূতবাহনের খুব ইচ্ছা হয়েছিল ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে ঘুমন্ত মদালসাকে একটু আদর করেন; বলেন, “তোমার খুব ভাল বর এনে দেবো।” কিন্তু দরজা বন্ধ।

এখন রাত অনেক। নিশীথের বিরাম সাগরে শ্রান্ত প্রাণের সমস্ত বেদনা অর্পণ করবার সব রকম চেষ্টা করেও সফল হলেন না জীমূতবাহন।

চটি এবং ফতুয়া পরেই বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন জীমূতবাহন। এইমাত্র কুশ্রী একটা স্বপ্ন দেখেছেন জীমূতবাহন। নিজেদের রিসার্চের জন্যে সন্তানের ক্ষতে ম্যাগট ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। রক্তবীজের বংশধররা তাঁর সন্তানের সর্বদেহে ছড়িয়ে পড়েছে। তাঁর মেয়ে কাদতে পারছে না, আওয়াজ করতে পারছে না, কিন্তু ম্যাগটের দংশনে অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

বাইরে পালিয়ে এসেছেন জীমূতবাহন। অমিতাভর শূন্য ফ্ল্যাটটা অন্ধকারে একপাটি পরিত্যক্ত জুতোর মতো পড়ে রয়েছে। আর ওধারে ইন্দুমতীর বাড়িখানাও যেন আর এক পার্টি স্যাণ্ডেল। কালও এরা সবাই ছিল, এখন কোথায় গেল?

ল্যাবরেটরির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন জীমূতবাহন যেন দানবপুরীর অভিশপ্ত প্রহরী তিনি। কিন্তু কেমন প্রহরী? তিনিও কি দানব, না মানুষ? না ঈশিতা যা বললে তাই?

ওধারে এক কোণে মাকড়সার জালটা নড়ছে। লূতা! ব্ল্যাক উইডো স্পাইডার। কালো বিধবা মাকড়সা! তারের জালের পিছনে জাল বিছিয়েছে লূতা। গতকাল লূতার স্বামীকেও পাশে রেখে দেওয়া হয়েছিল। মাকড়সার স্বামীরা উপহার দিয়ে পত্নীর মনোরঞ্জনের চেষ্টা করে মানুষের মতো। লূতার স্বামীও করছিল। কিন্তু কোথায় গেল সে? ওইতো, বেচারা স্বামীর মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছেন জীমূতবাহন। স্বামীকেই খেয়ে ফেলেছে লূতা। আলোটা যেন হঠাৎ প্রচণ্ড উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। লূতা নয়। ঈশিতাই যেন সেখানে বসে আছে। জীমূতবাহন নিজেকে বার বার বোঝাতে লাগলেন, ঈশিতা নয়, লূতাই বসে আছে সেখানে। কিন্তু মাথা ঠিক থাকছে না।

“ঈশিতা, ঈণিতা!’ ডাক দিলেন জীমূতবাহন। ঈশিতা সাড়া দিচ্ছে না কেন? বোধ হয় আলোতে লজ্জা পাচ্ছে ঈশিতা, জীমূতবাহনের মনে হলো।

আলো নিভিয়ে দিলেন জীমূতবাহন। অন্ধকারেই ঈশিতার আলিঙ্গনে ধরা দেবেন তিনি। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? সাপের নঙ্গে তো মাকড়সার বিয়ে হয় না। হয় কি? কেউটে সাপের সঙ্গে ব্ল্যাক উইডো স্পাইডারের শুভবিবাহ!

কে জানে! প্রকৃতির রাজ্যে কি হয়, আর কি না হয় বলা কঠিন।

এগিয়ে যাচ্ছেন জীমূতবাহন। মাকড়সার সঙ্গে সাপের বিয়ে হয় কিনা! এই প্রশ্ন কাকে করবেন? অমিতাভ থাকলে তাকে করা যেতো। মস্ত বড় বৈজ্ঞানিক সে। আরও বড় হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের উত্তর নিবোদ ল্যাবরেটার দিতে পারতো সে।

এদের জিগ্যেস করলে কেমন হয়? জীমূতবাহন আর একটা মস্ত খাচার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। এরা সাপও নয়, মাকড়সাও নয়। এরা কাঁকড়া বিছে। অনেক যত্ন করে ল্যাবরেটরিতে এদের জন্ম দেওয়া হয়েছে। ব্ল্যাক স্করপিয়ন। সংখ্যায় অনেক আছে এরা—রোনজেন্ রশ্মিতে এদেরও প্রজনন শক্তি নষ্ট করে দেওয়ার কথা আছে। এদেরই প্রশ্ন করা যাক। জীমূতবাহন নিজের হাতে খাঁচার দরজাটা খুলে দিলেন।

পরের দিন ভোরবেলায় নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সিমেন্ট করা মেঝের ওপর জীমূতবাহনের প্রাণহীন দেহ পাওয়া গিয়েছিল। প্রেস ট্রাস্ট অব ইণ্ডিয়ার স্থানীয় প্রতিনিধি প্রেরিত সংবাদটা টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে দিকে দিকে পরিবেশিতও হয়েছিল: ‘প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর জীমূতবাহন সেন গতকাল গভীর রাত্রে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে একাকী গবেষণাকালে এক মর্মন্তুদ দুর্ঘটনায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। ল্যাবরেটরিতে প্রতিপালিত শতাধিক বৃশ্চিকের দংশনই এই প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানীর মৃত্যুর কারণ বলিয়া অনুমিত হয়। পরলোকগত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রিয় ছাত্রগণের অন্যতম জীমূতবাহন খ্যাতনামা আইনজীবী ও দেশসেবক জগদানন্দ বসুর সপ্তম কন্যা ঈশিতাকে বিবাহ করেন…’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *