১৩
এরপরের কয়েকটা সপ্তাহ যেন স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে গিয়েছিল।
নিজে অসুরের মতো পরিশ্রম করেছিলেন জীমূতবাহন। কিন্তু তিনিও অবাক হয়েছিলেন অমিতাভর নিষ্ঠায়। এই ক’সপ্তাহে সে একবারও চোখ বুজেছিল কিনা সন্দেহ।
মাংসের টুকরোর মধ্যে মাছিদের বংশ বৃদ্ধি করতে উৎসাহ দিতে হয়েছিল। এক একটা ভ্যাটের মধ্যে হাজার হাজার নবজাত মাছিকে রাখতে হতো। এক-আধটা নয়, ত্রিশ লক্ষ মাছির জন্ম দিতে হয়েছে ল্যাবরেটরিতে।
তারপর শুরু হতো রোনজেন রশ্মি প্রয়োগের কাজ। রশ্মি প্রয়োগের পদ্ম মিহি তারের জালের খাঁচায় পুরে মাছিদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো ভেটারিনারি কলেজে—সেখান থেকে তারা চলে যেতো বিভিন্ন জায়গায়।
অমিতাভর ওপর বিশ্বাস বেড়ে গিয়েছে জীমূতবাহনের। সত্যি যোগ্য সহকারীর সন্ধান পেয়েছেন তিনি। অমিতাভরও কাজ ভাল লাগছে বোধ হয়। নতুন নতুন বিষয়ে কাজ করবার অসীম আগ্রহ তার। ভেটারিনারি কলেজের ছাত্ররা গ্রামে গ্রামে গিয়ে যে খবর নিয়ে এসেছে, তাতে গরুর দেহে ম্যাগটের আক্রমণ এবার অনেক কম।
“আরও কম হতো যদি আরও কিছু মাছি ছাড়া যেতো,” অমিতাভ বলে। “তা সত্যি। কারণ আমরা যত মাছি ছেড়েছি তার সব তো পুরুষ নয়—অন্ততঃ অর্ধেক স্ত্রী,” জীমূতবাহন বলেছিলেন।
অমিতাভ বললে, “যদি এমন কোনো সহজ উপায় থাকতে৷ যাতে পুরুষ মাছির অনুপাত ল্যাবরেটরিতে বাড়িয়ে দেওয়া যায়, তা হলে মন্দ হতো না।”
জীমূতবাহন বললেন, “আশা ছাড়িনি অমিত। একদিন আমাদের এই ল্যাবরেটরি আরও অনেক বড় হবে। ভারতের সেরা ছেলেদের এখানে এসে গবেষণায় আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহ দেবো আমরা। তখন প্রজনন রহস্যের ওপরেও কাজ হবে।”
জীমূতবাহন পরম উৎসাহে বলে চললেন, “ফিজিক্স, বায়োফিজিক্স এবং মাইক্রোমিটিরিয়োলজির সমন্বয়েও আমি কিছু অনুসন্ধান চালাতে চাই। যেমন আমি জানতে চাই, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পোকা-মাকড়দের মেজাজের এবং স্বভাবের কী পরিবর্তন হয়। যেসব পাখী পোকা খায়, তাদের সম্বন্ধেও অনেক কিছু জানতে চাই আমি। লীডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক বন্ধু যন্ত্র বসিয়ে গুণে দেখেছেন, টিটমিস পাখী বাচ্চা হবার ঠিক দু‘সপ্তাহ পরে পেটুক সন্তানদের খাওয়াবার জন্যে দিনে অন্ততঃ এক হাজার বার পোকা ধরতে বেরোয়। আমাদেরও অনেক কিছু জানবার আছে।”
কিন্তু একি স্বপ্ন, না সত্যিই একদিন সম্ভব হবে!
বড় কষ্ট হয় জীমূতবাহনের। যে দেশ একদিন পৃথিবীর শস্যভাণ্ডার ছিল, সেখানে আজ চাষীর পেট ভরাবার মতো ফসলও হয় না। ভাল বীজ নিয়ে জমিতে সার দিয়ে এবং জল ঢেলে চাষ করলেই তো হলো না—চারাদের মোটা অংশ নষ্ট হচ্ছে পোকাদের অত্যাচারে। যা চাষ এখন হয় সেইটুকু রক্ষা করতে পারলেই বিদেশে ভারতের ভিক্ষাবৃত্তির অবসান ঘটানো যেতো।
আর শুধু ভারতবর্ষ কেন? জীমূতবাহন পৃথিবীর সমস্ত মানুষের কথা ভাবেন। কী বিশাল সমস্যা! তার তুলনায় জীমূতবাহনের মতো সামান্য মানুষের সামর্থ্য কতটুকু? কিন্তু জীমূতবাহন হতাশ হতে রাজী নন। ছোট ছোট মানুষরাই তো পৃথিবীর অনেক বৃহৎ বৃহৎ সমস্যার সমাধান করেছে।
এর জন্যে পরিশ্রম করতে হবে। তাঁর এবং অমিতাভ মিত্রর এখন নষ্ট করবার মতো এক ফোঁটা সময়ও নেই। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির আলো বহু রাত এখন জ্বালা থাকবে।
ইন্দুমতীও অনেক সাহায্য করছে তাঁদের। বড় শাস্ত মেয়েটি। চোখ দুটো দেখলেই হৃদয়ের গভীরতা বোঝা যায়। কথা বলে না বেশী। নিজের মনেই কাজ করে যায়। রিসার্চের থিসিস জমা দিয়ে এসেছে মেয়েটা, এবার কী করবে কে জানে। ইন্দুমতীকে খুব ভালবাসেন জীমূতবাহন—ইন্দুমতী দেশাই-এর মতো মেয়ে লাখে একটা হয় না। কিন্তু বড় শান্ত। অত শান্ত হলে তো কাজ চলে না পৃথিবীতে।
,ইন্দুর খোঁজ করলেন জীমূতবাহন। “কেমন আছ ইন্দু? ক’সপ্তাহ যেভাবে কাটলো তাতে কিছু খোঁজই নিতে পারিনি। তোমার খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়। ওরা তোমাদের কী খেতে দেয় দেখাও হয় না আমার।”
মাস্টারমশাইয়ের এই দিকটার সঙ্গে পরিচয় আছে ইন্দুর। লোকটা যে কতখানি স্নেহপ্রবণ তাও জানে ইন্দুমতী দেশাই। তাই তো এত শ্রদ্ধা করে তাঁকে।
ইন্দু হেসে বললে, “আমি কি আর সেই, ছোট্ট মেয়েটি আছি মাস্টারমশাই? অসুবিধে হলে ঠিক বলতাম আপনাকে।”
“উঁহু, অত সহজে ছাড়ছি না। আজ সকালে কী খেয়েছ বলো।”
ইন্দুমতীর হাসিতে এক অপরূপ স্নিগ্ধতা আবিষ্কার করলেন জীমূতবাহন তাঁর মেয়ে মদালসার হাসিও তো লক্ষ্য করেছেন জীমূতবাহন। কিন্তু সে হাসিতে বড় বেশী জ্বালা দেবার চেষ্টা আছে।
ইন্দুমতী বললে, “সকালে খেয়েছি টোস্ট, মাখন আর কলা।”
ইন্দুমতী যে আবার মাছ মাংস ডিম খায় না। জীমূতবাহন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। “না, এ খাওয়া চলবে না। সকালে একটু দুধ অন্ততঃ চাই, আমি হরিমোহনকে বলে দেবো।”
“না মাস্টারমশাই, এইসব ছোটখাট ব্যাপারে আপনার সময় ব্যয় করবার মানে হয় না,” ইন্দুমতী বলে।
“ছোটখাট? দুধের ব্যাপারটা মোটেই ছোটখাট নয়,” জীমূতবাহন হুঙ্কার দিলেন। মনে মনে দুঃখও হলো—ঈশিতা রয়েছে, সে একটু দেখতে পারে না? আগেকার দিনে গুরুগৃহে ছেলেরা যখন শিক্ষা গ্রহণ করতো তখন গুরুপত্নীরাই তো এসবের তদারক করতেন।
ইন্দুমতী বললে, “মাস্টারমশাই, আপনি একেবারে ব্যস্ত হবেন না। খাওয়ার জন্যে কেউ আপনার এখানে আসে না!”
“তবে কিসের জন্যে আসে?” জীমূতবাহন সস্নেহে প্রশ্ন করেন।
“কাজ করতে। কাজ শিখতে।” ইন্দুমতীর উত্তরটা বেশ ভাল লাগল জীমূতবাহনের। বেশ তো কথা বলতে পারে মেয়েটা; কিন্তু তাহলে অন্যের সামনে অমন চুপ করে থাকে কেন?
ইন্দুমতী হঠাৎ মাস্টারমশাইকে নমস্কার করলে। “আপনি না ডাকলেও আপনার কাছে আসছিলাম মাস্টারমশাই। সুখবর আছে। বাবার টেলিগ্রাম পেলাম এই মাত্র—আমি ডক্টরেট পেয়েছি।”
“তাই নাকি!” প্রচণ্ড আনন্দে ইন্দুমতীর পিঠে কিল মারলেন জীমূতবাহন। তাহলে তুমি আজ ভাল করে পায়ের ধুলো নাও, আমি আপত্তি করবো না।”
ইন্দুমতী বাধ্য মেয়ের মতো আবার পায়ের ধুলো নিল। মাস্টারমশাই আনন্দে কী করবেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না। বললেন, “শুধু নমস্কারে ভো হবে না ডক্টর ইন্দুমতী দেশাই! গুরুদক্ষিণা চাই।”
“নিশ্চয়ই, গুরুদক্ষিণা না দিলে গুরুঋণ শোধ হয় না। কীভাবে শোধ করবো বলুন মাস্টারমশাই?”
জীমূতবাহন হাসতে হাসতে বললেন, “আজকালকার ছাত্র-ছাত্রীরা দক্ষিণা দিতে চায় না। বড় জোর একবাক্স মিষ্টি! এই ডামাডোলের যুগে যখন একটি অনুগতা ছাত্রী পাওয়া গিয়েছে, তখন ভেবেচিন্তে চাইতে হবে। জান তো আগেকার দিনে গুরুঋণ শোধ করতে গিয়ে কত জন কত বিপদে পড়েছে।”
“আপনি এখনই বলুন মাস্টারমশাই,” জেদ করতে লাগলো ইন্দুমতী। মাস্টারমশাই বললেন, “সময় দাও ভাবতে।”
“আপনি কথা দিচ্ছেন, ভেবে দক্ষিণা চাইবেন।”
“দিচ্ছি। দক্ষিণা আদায় না করে কিছুতেই ছাড়ছি না তোমায়।” জীমূতবাহন আর একটা স্নেহের কিল মারলেন ইন্দুমতীর পিঠে। তারপর জিগ্যেস করলেন, “এবার কী কাজ করবে?”
ইন্দুমতী সমস্যাটা মাস্টারমশাইয়ের উপর ছেড়ে দিলে। “বলুন, কীসের ওপর কাজ করবো?”
“যার ওপর কিছু কাজ করেছো তুমি সেটাই চালিয়ে যাও। কেমিক্যাল অ্যাট্রাকটান্ট। কৃত্রিম গন্ধে কেমন করে পোকাদের ছলনা করা যায়। এ বিষয়ে বলতে গেলে কোনো কাজই হয়নি।”
ইন্দুমতী বললে, “জানেন মাস্টারমশাই, আমাদের হরিমোহনটা কী করে? খাঁচার মধ্যে একটা স্ত্রী ফড়িং রেখে দেয়। তারই গন্ধে গন্ধে বিকেলে অনেক ফড়িং দূর থেকে আসতে আরম্ভ করে। আর হরিমোহনের হাঁসগুলো তখন পরম সুখে ফড়িং খেতে আরম্ভ করে।
“তাই বুঝি?” জীমূতবাহন বললেন, “হরিমোহনটাও দেখছি পতঙ্গবিদ্ হয়ে উঠছে।”
জীমূতবাহনের মনে পড়লো, গন্ধে পাগল একটা জিপসি মথ প্রেয়সীর সন্ধানে দু’ মাইল উড়ে এসেছিল। কুমারী পতঙ্গ বয়ঃপ্রাপ্ত হলেই দেহ থেকে গন্ধ ছড়াতে থাকে—পুরুষের অ্যানটেনায় গন্ধ প্রবেশ করলেই সে লক্ষ্যের দিকে ছুটতে থাকে। প্রেমের ফাঁদ ভুবনে ভুবনে সত্যিই পাতা রয়েছে, কে কোথায় ধরা পড়বে কে জানে।
“ইন্দু, পোকাদের কী কী লোভ দেখানো যায়?” জীমূতবাহন প্রশ্ন করলেন।
ইন্দু বললে, “তিন রকমের লোভ—ফুড, সেক্স অ্যাও ওভিপোজিসন!”
জীমূতবাহন বললেন, “খাবারের লোভ আদিমতম। আমাদেরও আছে—পেটের দায়ে কত মানুষ পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে চলে আসে। যৌন লোভের ফাঁদ পাততে তো আমাদের হরিমোহনও শিখে গিয়েছে। গর্ভবতী পতঙ্গরা একটা ভাল জায়গায় ডিমপাড়ার জন্যে উদ্বিগ্ন থাকে। এ বিষয়ে বিদেশে এখনও তেমন কাজ হয়নি! তুমি এই ওভিপোজিসন লিওর সম্বন্ধে কাজ করতে পারো।
ইন্দুমতী রাজী। মাস্টারমশাইয়ের ওপর অগাধ বিশ্বাস তার—আর উৎসাহেরও অভাব নেই।
জীমূতবাহন বললেন, “অমিতাভ কোথায়? তার সঙ্গে এ-বিষয়ে একটু পরামর্শ করা যাক না!”
কিন্তু কোথায় অমিতাভ?
“উনি এখন নেই,” ইন্দুমতী জানায়।
“সে কী! একটু আগেই তো তোমরা দু‘জনে এক্স-রে চেম্বারে কাজ করছিলে।”
“মদালসা এসেছিল। মিসেস সেন, মদালসা এবং অমিতবাবুর সিনেমায় যাবার কথা আছে।”
জীমূতবাহন বোকার মতো প্রশ্ন করলেন, “তিনঙ্গমে যখন গেল, তুমিও গেলে না কেন?”
ইন্দুমতী বুদ্ধিমতীর মতো বললে, “ওঁদের টিকিট কাটা ছিল। তাছাড়া বললেও যাওয়া যেতো না—আমার অনেক কাজ রয়েছে।”
চেয়ার থেকে উঠে বাড়ি যাবার পথে জীমূতবাহন আবার বোকার মতো বললেন, “কাজ কাজ আর কাজ। সারাজীবন তো মা তোমাকে কাজ করতে হবে। আমার মতো কাঠখোট্টা হয়ে কষ্ট পাবে মা। বিশ বছর সিনেমা দেখা হয়নি। মাঝে মাঝে হৈচৈ করবে। ”
ইন্দুমতী কিছু বললে না, দুষ্টু মেয়ের হাসিতে তার মুখটা ভরে গেল।
আর পথে যেতে যেতে জীমূতবাহনের খেয়াল হলো, ইন্দুমতীকে যাওয়ার কথাটা বলা তার ঠিক হয়নি। তাঁর, স্ত্রী, তাঁর মেয়েকে তিনি তো জানেন—ওকে সঙ্গে নেবার ভদ্রতাটুকুও হয়নি তাদের। জীমূতবাহন ছাড়বেন না, ফিরে এলেই আজ প্রশ্ন করবেন, ঝগড়া করবেন প্রয়োজন হলে।
বাড়ি ফিরেই আশ্চর্য হলেন জীমূতবাহন। চেয়ারে বসে বড় জামাই-এর চিঠি পড়ছেন ঈশিতা।
“এ কি তোমরা যাওনি সিনেমায়?” উৎকণ্ঠিত জীমূতবাহন প্রশ্ন করেন। “আমি যাইনি, ওরা গিয়েছে,” ঈশিতা উত্তর দিলেন।
“কেন, তোমার কি অসুখবিসুখ করলো নাকি?”
“অমিতকে তাই বললাম—গা ৰমি বমি করছে,” ঈশিতা উত্তর দিলেন। “আমাকে খবর দাওনি কেন, ডাক্তারকে টেলিফোন করে দিতাম।”
ঈশিতা ঠোঁট বেঁকিয়ে বললেন, “তোমার কী বুদ্ধিসুদ্ধি কোনো দিন হবে না! আমি ইচ্ছে করেই শেষ মুহূর্তে ড্রপ করেছি।”
“ও!” জীমূতবাহনের হঠাৎ মনে পড়লো গত বারোবছরে এমন ঘটনা আরও হয়েছে। চিত্রলেখা আর সুপ্রিয়কে নিয়ে সিনেমায় যাবার সময় ঈশিতার এই রকম শরীর খারাপ হয়ে পড়েছিল। সুস্মিতা-দেবকুমার, প্রিয়ংবদা-অজয়ের বেলাতেও একই ঘটনা ঘটেছিল।
ঈশিতা বললেন, “একটা টিকিট নষ্ট হয় বটে, কিন্তু লাভ হয় অনেক। ওদেরও সঙ্কোচের কোনো কারণ থাকে না।”
এসব মোটেই ভাল লাগছে না জীমূতবাহনের। মদালসার জন্যে পৃথিবীতে অমিতাভ ছাড়া অনেক ছেলে আছে, এ-কথাটা ঈশিতাকে মনে করিয়ে দিতেই হবে। আর নয়, অনেক সহ্য করেছেন তিনি।
দেবকুমার, সুপ্রিয়, অজয় এরা সবাই ঈশিতাকে লম্বা লম্বা চিঠি দেয়। ঘর-সংসারের প্রতিটি কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেখে, ঈশিতার উপদেশ চায়।
জীমূতবাহনের কাছে ভুলেও চিঠি লেখে না তারা। অথচ বিয়ের আগে একদিন কত পত্রালাপ হতো তাঁর সঙ্গে। যখনই ট্যুরে যেতেন লম্বা লম্বা চিঠি পেতেন জীমূতবাহন, ফাইল ঘাঁটলে সেসব এখনও পাওয়া যাবে।
সে যাক, দেবকুমার, সুপ্রিয়, অজয় যাকে খুশি চিঠি লিখুক তাঁর কোনো আপত্তি নেই। তারা সুখে থাকুক। কিন্তু অমিতাভকে আবার সিনেমায় পাঠানো কেন? এ অন্যায়, খুব অন্যায়।
জামাকাপড় ছেড়ে ড্রইংরুমে এসে বসলেন জীমূতবাহন। ড্রইংরুমটা ঢেলে সাজিয়ে ফেলেছেন ঈশিতা। নিজের বাবার ছবি টাঙিয়েছেন দেওয়ালে। পাশে বোর্ন-সেফার্ডের তোলা নিজেদের বিয়ের ছবিটাও ঝুলিয়েছেন। আর এদিকে মেয়ে-জামাইদের ছবি। প্রিয়ংবদার পাশে অজয়, সুস্মিতার পাশে দেবকুমার, চিত্রলেখার পাশে সুপ্রিয়। মদালসার ছবিও টাঙিয়ে ফেলেছেন ঈশিতা। তার পাশে আর একখানা ছবি টাঙানোর খালি জায়গা রয়েছে। আর সেই খালি জায়গাটার দিকেই যেন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ঈশিতা।
চা এগিয়ে দিয়ে ঈশিতা বললেন, “মেয়ে তো তোমার ডগমগ।”
জীমূতবাহন ফ্যাল ফ্যাল করে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটার ঈশিতা বললেন, “আমার গর্ব, মেয়েদের এমনভাবে শিক্ষা দিয়েছি যে মায়ের কাছে তারা কোনো কিছু ঢাকে না। মনের কথা নিঃসঙ্কোচে বলতে তারা মোটেই ভয় পায় না।”
জীমূতবাহন চায়ে চুমুক দিলেন। ঈশিতা বললেন, “তুমি কিন্তু কুটোটি ভেঙে দুটো করছো না। জামাই তো আমার একার হবে না। তোমাকে যে বললাম, অমিতের সঙ্গে কথা বল।”
“কথা তো রোজই বলি।”
“ওর মনটা জানতে হবে না? আজকালকার ভদ্রছেলে, পেটে খিদে থাকলেও মুখে প্রকাশ করে না।”
“পেটের খবর বার করা বেশ শক্ত কাজ, ঈশিতা,” জীমূতবাহন গম্ভীরভাবে বলেন।
“মোটেই শক্ত নয়। তাছাড়া মাঝে মাঝে চারা গাছের গোড়ায় জল দিতে হয়। অজয়ের বেলাতেও তো তোমার সন্দেহ ছিল। তারপর একদিন ওদের দুজনকে ঘরে পুরে শিকল দিয়ে দিলাম। শিক্ষিত ছেলে, শিক্ষিত মেয়ে—নিজেদের মধ্যে ফয়সালা করে নিল।”
ঈশিতার উৎসাহের অন্ত নেই। শুনিয়ে দিলেন, “অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। খুকুমণিকে দেখলেই ওর চোখ দুটো কেমন খুশী খুশী হয়ে ওঠে। খুকুমণি তো ক’দিন ওর কোয়ার্টারে গিয়েছে—গল্প করে এসেছে। খুব ফিট্ফাট্ ছেলে কিন্তু। ঘরদোর এমনভাবে রেখেছে যে মেয়েরা লজ্জা পেয়ে যাবে। ভালই হবে, খুকুমণি একটু অগোছাল আছে। জিনিসপত্তর ঠিক করে রাখতে পারে না। কতগুলো যে ব্লাউজ হারাল।”
জীমূতবাহন চুপ করে থাকলেও ঈশিতা আজ ছাড়বেন না। “তুমি একটু কথা বোলো। অন্ততঃ মদালসার গুণের কথাগুলো গুছিয়ে বলো—হাজার হোক তোমাকে ভক্তিশ্রদ্ধা করে, সহজে বিশ্বাস করবে।”
জীমূতবাহনের শঙ্কা বাড়ছে। ঈশিতা বললেন, “থুকুমণি তো অমিতদা বলতে অজ্ঞান। বেঁটে কালো ছেলে ও দেখতে পারে না। ভালই হয়েছে। লম্বা, ফর্সা, ধারাল গড়ন অথচ ভাল ছেলে পাওয়া বেশ শক্ত। চিত্রাকে ও নিজেই কিছু লিখেছে বোধহয়। কারণ, এই দেখো-না চিত্রা লিখেছে—
‘অমিতাভ ছেলেটি কে? বাবার ল্যাবরেটরিতে কবে জয়েন করলো? সম্ভব হলে একটা ছবি পাঠিও।’ অমিতের একটি ছবি আমাকে দিও তো।”
“আমার কাছে ছবি নেই,” জীমূতবাহন এক মুহূর্ত দেরি না করেই উত্তর দিলেন।
রেগে গিয়ে ঈশিতা বললেন, “দরকার নেই। ছবি সেদিন খুকুমণি নিজের ক্যামেরায় তুলেছে। খুকুমণির ছবিটা অমিত শাটার টিপে দিয়েছে। আজ সিনেমা থেকে ফেরবার পথে দোকান থেকে প্রিন্ট আনতে বলেছি।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। মাঠে যাবার জন্যে উঠেছিলেন জীমূতবাহন। পাঁচ নম্বর প্লটে ধানের স্টেম বোরার ছাড়া আছে, তাদের দেখতে হবে। বাংলাদেশে বলে মাজরা পোকা, ধানের ডাঁটা ফুটো করে ভেতরে ঢোকে, ডাঁটার কচি অংশ খেয়ে ফেলে। ফুল আসার পর গাছগুলো আক্রান্ত হয়েছে—এতে ধানের শীষ বেরোবে না, আর বার হলেও চিট হয়ে যাবে। ছ’ নম্বরে আছে রাইস বাগ্, বা গান্ধী পোকা। বসিরহাট থেকে তিড়িং পোকাও আনিয়েছেন কিছু, অন্য জায়গায় পাটচাষীরা যাকে বলে ঘোড়া পোকা। আর এসেছে লাল মাকড়সা ও আঁকি পোকা—জুট উইভিল। এদেরও তদারক করা প্রয়োজন।
উঠতে যাচ্ছিলেন জীমূতবাহন। কিন্তু ঈশিতা ছাড়লেন না। বললেন, “ওরা এখনই এসে পড়বে। অমিতাভকে খেতে বলেছি এখানে। ”
বাংলোর বাইরে একটা চেয়ার নিয়ে এসে বসলেন জীমূতবাহন। রাতের অন্ধকারে ঝাঁকে ঝাঁকে পুরুষ জোনাকি প্রিয়াদের উদ্দেশে আলোর সঙ্কেত প্রেরণ করছে। ওদিকে একটা বাদামী রঙের ধামসা পোকা ফড়িং ধরেছে। ধামসা পোকার শক্ত দুটো ডানার ওপর ফোঁটা ফোঁটা দাগ—যেমন গোল গোল দাগ থাকে বাঘের গায়ে। ফড়িংটা এখনও প্রতিরোধ করছে। কিন্তু পারবে কি ছাড়াতে? ধামসা পোকাকে সাপের মাসী-পিসীও বলে। মাসী-পিসী! মেসো খুড়ো নয় কেন, জীমূতবাহনের জানতে ইচ্ছে করে। মেসো খুড়োরা বোধহয় অতটা নির্মম হতে পারে না! না, ফড়িংটার ভাগ্য ভাল—ধামসা পোকার একমুহূর্তের অনবধানতায় সে গালিয়েছে। রাগে গরগর করতে করতে সাপের মাসী-পিসী দেওয়ালে মাথা ঠুকছে।
জোনাকিরা আবার জীমূতবাহনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। দলবদ্ধ মদমত্ত পুরুষ জোনাকিরা রাত্রের এই অন্ধকারে তাদের নারীদের সন্ধানে বেরিয়েছে। গাছের ডালে ডালে আলোর টর্চ ফেলে হতাশ পুরুষ জোনাকি এবার মাটির কাছাকাছি উড়ে বেড়াচ্ছে। সোঁ করে নিচে নামবার সময় তীব্র আলো জ্বালিয়ে আবার উপরে উঠতে উঠতে আলো নিভিয়ে দিচ্ছে। প্রতি পাঁচ সেকেণ্ড অন্তর পুরুষ জোনাকি তার কামনার বার্তা প্রেরণ করছে দিকে দিকে। জীমূতবাহন দেখলেন ফুলগাছের পাতা থেকে আলোর সঙ্কেতে প্রত্যুত্তর এল ঠিক দু’সেকেণ্ড পরে। পুলকিত পুরুষ জোনাকি ওদিকে লক্ষ্য করে আবার আলো জ্বালাল-ঠিক দু‘সেকেণ্ড পরে এদিক থেকে আবার আলোর সম্মতি গেল। দশ পনেরো বার আলোক বিনিময়ের পর পুরুষ জোনাকি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে তীরবেগে যেভাবে পাতার বাসর-শয্যায় নেমে এল, তা বিশ্বের আধুনিকতম বিমানের পক্ষে সম্ভব নয়।
দূরদূরান্তে ঝিঁঝিরাও ডাক শুরু করেছে। ওদের ডাকের অর্থ বুঝতে পারেন জীমূতবাহন। পুরুষ ঝিঁঝিরা যা চাইছে, ঘাসের মধ্যে ওই লজ্জাহীন! জোনাকি মহিলাটিও তাই চান। ল্যামপিসিস নটিলুকা পাখা নেই ওর, তাই ঘাসের ডগায় নিজের আলোটি জ্বালিয়ে কলকাতার হাড়কাটা গলির রূপোপজীবিনীর মতো অপেক্ষা করছে। বিগতযৌবনা রূপসী ক্লান্ত হয়ে পড়ছে বোধ হয় এবার, তাই নিভিয়ে দিল নিজের প্ৰদীপ।
প্রকৃতির রাজ্যে দুর্দমনীয় কামনার বা এসেছে যেন। আকাশে, বাতাসে, গাছের পাতায়, ঝোপের আড়ালে, ঘাসের মাথায় পতঙ্গদের অভিসার শুরু হয়েছে। মাটির তলাতেও। উইঢিপির তলায় যে কুৎসিত মধ্যবয়সিনী উইরানী রয়েছে, সেও এই মুহূর্তে নিশ্চয় সহস্র সন্তানের জন্ম দিতে ব্যস্ত। জীমূতবাহন যে বৈজ্ঞানিক তা ভুলেই গেলেন কিছুক্ষণের জন্য। ঘৃণায় হঠাৎ গা রি রি করে উঠলো।
কিন্তু পরমুহূর্তে কে যেন চাবুক মারল জীমূতবাহনকে। তাঁর দিকে তাকিয়েই যেন লক্ষ লক্ষ পতঙ্গ মিট মিট করে হাসছে। জীমূতবাহন নিজেকে আবিষ্কার করছেন। কামনার শৃঙ্খলে ঈশিতার বন্দীশালায় তিনিও তো অনেকদিন আবদ্ধ ছিলেন। এই এতোদিন ধরে ঈশিতার অব্যক্ত আকর্ষণ থেকে নিজেকে সম্পুর্ণ মুক্ত করতে পারেননি।
অনেকদিন আগে প্রিয়ংবদার গতি করবার জন্যে যখন অজয়কে চেয়েছিলেন ঈশিতা, তখনই তো সব বুঝেছিলেন জীমূতবাহন। বিজ্ঞানের ক্ষতি হবে জেনেও তিনি তো না বলতে পারেননি। ঈশিতার সেই মোহিনী চাহনির সামনে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন জীমূতবাহন। জ্ঞানবান হৃদয়বান নিষ্ঠাবান জীমূতবাহন সেন আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হয়েছিলেন অজয়ের আদর্শচ্যুতিতে—তবু দেবকুমারকেও সুস্মিতা সেনের হাতে সমর্পণ করতে বাধলো না জীমূতবাহন সেনের। সুস্মিতা সেনের মা—তাঁর শয্যা-সঙ্গিনী ঈশিতা, তাঁর চোখগুলোকে সেবার আরও মোহময় করে তুলেছিলেন। সম্মোহিত জীমূতবাহন সেই একইভাবে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির আর এক ভবিষ্যৎকে চিত্রলেখা সেনের পোষকে রূপান্তরিত করেছিলেন। জীমূতবাহন যদি মনে করেন তাঁর কোনো দোষ ছিল না, তবে অন্যায় হবে।
গাড়ির আওয়াজে হঠাৎ জীমূতবাহনের চিন্তার জাল ছিন্ন হলো। দূরে হেডলাইটের আলো দেখা যাচ্ছে। অমিত ও মদালসা ফিরছে। ওদের অভ্যর্থনার জন্যে ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলেন ঈশিতা।
“এসো ‘অমিত, এসো। কেমন সিনেমা দেখলে,” ঈশিতার কণ্ঠে যেন মধু ঝরে পড়ছে।
“ভাল। আপনার শরীর এখন কেমন?” অমিত জিগ্যেস করলে।
“এখন বেশ ভালই আছি বাবা,” ঈশিতা উত্তর দিলেন। জীমূতবাহনের মনে হলো অভিনয়ের জন্য ঈশিতাকে গোল্ড মেডেল দেওয়া উচিত।
“আপনি সঙ্গে গেলে বেশ হতো,” অমিতাভ খেতে খেতে বললে। ঈশিতা খাবার এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আর একদিন যাবো তোমাদের সঙ্গে।”
স্বামীর দিকে মুখ ফিরিয়ে ঈশিতা বললেন, “তুমি চুপচাপ রয়েছ কেন? কিছু বলো?”
জীমূতবাহন নিজের নার্ভগুলো শক্ত করে বললেন, “ব্যাড নিউজ অমিত, কাটুই পোকাগুলো সব মারা গেল।”
“কখন?” অমিতাভ জিগ্যেস করে।
“তুমি যাবার একটু পরেই।”
ঈশিতা স্বামীকে এবার প্রচণ্ড কুনি লাগালেন, “তোমার কী আর কোনো কথা নেই? বেচারা খেটে খেটে রোগা হয়ে গেল। একটুখানি রিল্যাক্স করছে, সেই সময় আবার মৃত্যুসংবাদ।”
খাওয়ার পরও খানিকটা হৈ হুল্লোড় করবার চেষ্টা করলেন ঈশিতা। অমিতের সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে লাগলেন। মদালসার গুণাবলীর সুদীর্ঘ বিবরণ দিলেন। তারপর শুভরাত্রি জানিয়ে অমিতাভ যখন বিদায় নিল, তখন মেয়েকে শোয়ার ঘরে নিয়ে ফিস ফিস করে কথা বলতে লাগলেন ঈশিতা। মদালসাকে নিয়ে তিনি একটা ঘরে শোন। জীমূতবাহন একা পাশের ছোট ঘরটায় রাত্রি কাটান।
নিশীথশয়নে একলা জেগে রয়েছেন জীমূতবাহন সেন। অমিতাভকে একটা কথা বলা উচিত ছিল। তারই অবহেলায় পোকাগুলো মারা গিয়েছে। তাড়াতাড়িতে হিটিং চেম্বারের হিট রেগুলেট করেনি। জীমূতবাহনের নজর সেদিকে যখন পড়লো, তখন চেম্বারটা উনুনের মতো গরম হয়ে গিয়েছে। খাওয়ার টেবিলে সকলের সামনেই অমিতাভকে খবরটা দেওয়া উচিত ছিল। মদালসার মুখের দিকে তাকিয়েই তা পারেননি তিনি।
পাশ ফিরে ঘুমোবার কথা ভাবছিলেন জীমূতবাহন। বুকে একটা উষ্ণ হাত এসে পড়লো। ফিস ফিস করে ঈশিতা বললেন, “একটু সরে যাও। ”
সিঙ্গল বেডের এক কোণে সরে গিয়ে ঈশিতার জন্য জায়গা করে দিতে হলো। স্বামীর বালিশের এক কোণে মাথা রেখে ঈশিতা পায়ের গোড়ার চাদরটা বুক পর্যন্ত টেনে আনলেন।
জীমূতবাহন বিব্রতভাবে বললেন, “মধ্যিখানের দরজাটা কিন্তু খোলা রয়েছে।”
ঈশিতা কানের কাছে মুখ এনে বললেন, “খুকুমণিকে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি।”
জীমূতবাহন তবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন। ঈশিতা এবার ফিস ফিস করে বললেন, “শোন, এবার তুমি একটু চেষ্টা করলেই ফলাফলটা বোঝা যায়৷ তুমি অমিতের সঙ্গে কালকেই’ কথা বলবে। ওর মনটা বুঝে নিতেই হবে। এমনিতে গম্ভীর হয়ে থাকে, কথা বলে না। কিন্তু খুকুমণিকে আজ জিগ্যেস করেছে রবীন্দ্র-সঙ্গীত জানে কিনা।”
“আচ্ছা, দেখি,” জীমূতবাহন বললেন। কিন্তু গলাটা যেন একটু কেঁপে উঠলো জীমূতবাহনের এইতো কেমন মিথ্যে কথা বললেন জীমূতবাহন। জীমূতবাহন ভাবলেন, কই কোনো অসুবিধে হলো না তো তাঁর।
“উঠছো?” ঈশিতা প্রশ্ন করলেন।
“একবার ল্যাবরেটরিতে যাবো। ওখানে অনেক কাজ আছে যা রাত্রি ছাড়া করা যায় না।”
ঈশিতা বললেন, “আর একটু বিশ্রাম করে যাও। আমিও খুকুমণির কাছে ফিরে যাই। ওর যা পাতলা ঘুম।”
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা প্রবল উত্তেজনা বোধ করছেন জীমূতবাহন। হাতের টর্চটা জ্বালাতেই কয়েকটা পোকা ঘাস থেকে উড়ে গেল। ঝিঁঝিদের কামনার নিবৃত্তি হয়নি এখনও সমানে শব্দের আহ্বান পাঠিয়ে চলেছে তারা।
জীমূতবাহনের কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। বুকের ভিতরের যন্ত্রগুলো যেন বুঝতে পেরেছে, ভয়ংকর কিছু একটা হতে চলেছে। তারা কি জীমূতবাহনকে বাধা দিচ্ছে, না কেবল জীমূতবাহনের সঙ্গে তারাও উত্তেজিত বোধ করছে? অনেক ভেবেছেন জীমূতবাহন। তাঁর সমগ্র জীবনের সাধনার ভবিষ্যৎ জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। কোনো উপায় নেই। তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেছেন।
মাঠের মধ্য দিয়ে দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছেন জীমূতবাহন। যেন কোনো কিছু চুরি করে গৃহস্থের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাচ্ছেন জীমূতবাহন। কিন্তু উপায় নেই। দাঁতে দাঁত দিয়ে জোর করে মাড়িটা চেপে ধরেছেন জীমূতবাহন। এতে মনোবল পান তিনি। জীমূতবাহন দেখেছেন চরম বিপদের সময় কোথা থেকে হঠাৎ মনোবল এসে যায়।
পাঁচ নম্বর প্লটের মাজরা পোকাগুলো ধানগাছের হাড় ফুটো ফুটো করে দিচ্ছে। স্টেম বোরারগুলো যেন জীমূতবাহনের মনের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাঁর স্বপ্নের সর্বনাশ হতে চলেছে। ইন্দুমতীকে তাঁর প্রয়োজন।
রাত অনেক। কিন্তু ইন্দুমতীর ঘরে আলো জ্বলছে। ইন্দুমতী এখনও পড়ছে। কিংবা হয়তো বাবাকে চিঠি লিখছে।
জীমূতবাহনের মনে হচ্ছে প্রচুর মদ খেয়েছেন তিনি। তাঁর পা দুটো টলমল করছে। নিজের হাতটার ওপরও কর্তৃত্ব নেই তেমন।
ইন্দুমতীর দরজায় টোকা পড়ল। পায়ে একটা চটি জড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছিল সে।
অবাক হয়ে গিয়েছে ইন্দুমতী। “মাস্টারমশাই! এত রাত্রে!” মাস্টারমশাই প্রথমে কোনো উত্তরই দিতে পারলেন না। ইন্দুমতীর মুখের দিকে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
ইন্দুমতী তার বড় বড় চোখ দুটো জীমূতবাহনের মুখের ওপর নিবদ্ধ করে আবার বললে, “মাস্টারমশাই!”
অবশেষে মাস্টারমশাইয়ের ঠোঁট দুটো নড়ে উঠলো। আমতা আমতা করে বললেন, “ইন্দু, আর দেরি করতে পারলাম না।”
“মাস্টারমশাই, আপনি ভিতরে আসুন,” ইন্দুমতী বললে।
কিন্তু মাস্টারমশাই যেন ভিতরে ঢোকবার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছেন। জোর করেই তাঁকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে আনলেন ইন্দুমতী। হাত ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে দিল তাঁকে। “আপনার শরীর এমনভাবে কাঁপছে কেন?” ইন্দুমতী চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো।
ইন্দুমতীর দিকে করুণভাবে তাকিয়ে আছেন জীমূতবাহন। “ইন্দু, মা আমার, বড় বিপদে পড়ে এসেছি তোমার কাছে। অমিতাভ সম্বন্ধে তোমার মত কী?”
“কেন মাস্টারমশাই? অমিতাভবাবুকে আপনি এতো ভালবাসেন। আপনার মনে কোনো আঘাত দিয়েছেন নাকি তিনি? ওঁর ব্যবহার তো খুবই ভদ্র বলে জানি।” ইন্দুমতী যে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে তা তার মুখ দেখেই বুঝতে পারছেন জীমূতবাহন।
জীমূতবাহন বললেন, “ইন্দু, আমি গুরুদক্ষিণা চাইতে এসেছি। তুমি না বলেছিলে, আমি যা চাইব তাই দেবে তুমি।”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়।”
“পারবে তুমি? তুমি ছাড়া আর কেউ তো পারবে না, আমার এই সাধের ল্যাবরেটরিকে বাঁচাতে।”
তারপর আশ্চর্য সেই গুরুদক্ষিণা চেয়েছিলেন জীমূতবাহন। “কঠিন সে কাজ, কিন্তু আমি চাই অমিতাভকে তুমি জয় করো।”
টলতে টলতে বেরিয়ে এসেছিলেন জীমূতবাহন সেন। যেন শাস্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আকাশে জোনাকিরা পোকাগুলোও ক্লাস্তি আর অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্বেলেই এগিয়ে যেতে লাগলেন জীমূতবাহন।
পৃথিবী এতক্ষণে নেই। ঝিঝি ।
টর্চের আলো না সত্যের জন্যে, সাধনার জন্যে যুগে যুগে মানুষ যা করেছে তার সবটাই কি ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছে? মনে তো হয় না!
জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধ আলোয় নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির লম্বা বাড়িটা পরম আদরে দেখতে লাগলেন জীমূতবাহন। আর ভাবতে লাগলেন, ঠিক করেছেন তিনি। চমকে উঠে ইন্দুমতী তাঁর হাত দুটো জড়িয়ে ধরেছিল। চোখ দুটো বন্ধ করে অস্ফুট কণ্ঠে বলেছিল, “একি বলছেন মাস্টারমশাই!” ইন্দুমতী কি বলতে চায় তা বুঝতে পেরেছিলেন জীমূতবাহন। কিন্তু মদালসা ও ঈশিতার যদি সাধ-আহ্লাদ থাকে, ইন্দুমতীরও থাকবে না কেন? কি অপরাধ করেছে ইন্দমতী? সেও তো তাঁর মেয়েরই মতো।
ইন্দুমতীর মুখের ভাব থেকেই অমিতাভ সম্বন্ধে তার মনোভাব বুঝে নিতে জীমূতবাহনের কষ্ট হয়নি। মাস্টারমশাইয়ের ঘরের কথা ভেবেই ইন্দুমতী যে এতোদিন তার বাসনাকে বন্দী করে রেখেছিল, একথা জোর করেই বলতে পারেন জীমূতবাহন। পরম স্নেহে ইন্দুর মাথাটা নিজের বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে জীমূতবাহন বলেছিলেন, “গুরুদক্ষিণা দিতেই হবে।”