১১
মদালসা। মদালসা। নামটার মধ্যে সত্যিই মাদকতা আছে। এতো মেয়ের কথাই তো শুনেছে অমিতাভ—কিন্তু মদালসা নামটা একবারও কানে আসেনি। শুধু নামে নয়, মদালসার দেহে এবং ব্যবহারেও কি কোনো মাদকতা আছে?
মদ্যপানে অলস যে সে মদালসা। ভাল বাংলা না জেনেও অমিতাভ সেটা বোঝে। কিন্তু মদালসা সম্পূর্ণ অন্য।
মদালসা নিজেই একদিন অমিতাভকে পুরাকালের সেই প্রখ্যাত গন্ধৰ রাজকন্যা মদালসার কাহিনী বলেছিল। ঋতধ্বজ নামক এক সাহসী রাজ-কুমারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। স্বামী মৃত এই মিথ্যা সংবাদ পেয়ে যুবতী মদালসা শোকে অভিভূত হয়ে মৃত্যু বরণ করেছিল। স্বামীর বহু সাধ্যসাধনায় তার পুনর্জীবন হয়েছিল। তারপর মায়াময় এই সংসারের মায়া মদালসাকে আর মোহিত করতে পারেনি। মদালসার একটি সস্তান জন্মাল, মদালসা তাকে এমন শিক্ষা দিল যে, রাজপুত্রের সংসারে প্রবৃত্তি হলো না। আবার সস্তান হলো মদালসার, আবার তাকে সেই শিক্ষা দিল মদালসা—মায়ামুক্তির শিক্ষা। স্বামী ঋতধ্বজ তৃতীয় সস্তানের বেলাতেও কিছু বলেননি। কিন্তু শঙ্কিত অবস্থায় চতুর্থবারে অনুরোধ করলেন, এবার সন্তানটিকে অন্ততঃ সাংসারিক শিক্ষা দাও-না হলে এই রাজত্বের ভার কার ওপর রেখে যাবো?
খুব হেসেছিল এই গল্প শুনে—অমিতাভ ও মদালসা। অমিতাভ লক্ষ্য করছে, মদালসার মধ্যে প্রজাপতির মতো একটা হাল্কা স্বাচ্ছন্দ্য আছে—
আর তার থেকেও বড় কথা, পৃথিবীর সুখ, সৌন্দর্য ও আনন্দ উপভোগের প্রচণ্ড ক্ষুধা আছে। স্বাস্থ্যকর ক্ষুধা এবং সেই ক্ষুধা চেপে রাখবার চেষ্টা করে না মদালসা।
মধ্যিখানে ইন্দুমতী এসেছিল। ইন্দুমতী গম্ভীর গোবেচারি মানুষ। মাস্টারমশাই ছাড়া আর কারুর সঙ্গে তেমন মন খুলে জোর দিয়ে কথা বলে না। ইন্দুমতীও এবার একটু ইন্ধন জুগিয়ে গেল।
ইন্দুমতীকে স্টেশন থেকে আনবার জন্যে জীপ বার করছিল অমিতাভ। সেই সময় মদালসা এসে জিগ্যেস করলো, “কোথায় চললেন?”
“স্টেশনে—মিস্ দেশাইকে আনতে।”
মদালসা বললে, “মা সেদিন বাবাকে বকছিলেন—একটা ড্রাইভারের কতই বা মাইনে। শুধু শুধু আপনার ঘাড়ে বাজে কাজ চাপিয়ে দেওয়া।”
হেসে ফেললে অমিতাভ। “উল্টোদিক দিয়ে দেখুন, মাঝে মাঝে ড্রাইভ না করলে যদি ড্রাইভিং ভুলে যাই।”
“আহা, একদম বাজে কথা—সাঁতার, সাইকেল চালানো, মোটর ড্রাইভিং, বর্ণপরিচয় এগুলো লোকে একবার শিখলে আর ভোলে না।”
অমিতাভ বললে, “ও-সব পণ্ডিতদের কথা—আমি সামান্য ড্রাইভার, ওসব ঝুঁকি নিতে পারবো না।”
মদালসা বললে, “আপনারা কিছুই খবর রাখেন না। ক্যানটনমেন্টে মিলিটারি অফিসারদের বৌদের জন্যে একটা হেয়ার ড্রেসিং সেলুন খোলা হয়েছে।”
“তাই নাকি?” অমিতাভ লজ্জিতভাবে বলে।
“একবার আপনার গড়িতে যেতে পারলে হতো, অবশ্য যদি না আপনার কোনো আপত্তি থাকে।” মদালসা কথাটা বলে মুখ ফিরিয়ে নিলেও, আড়চোখে অমিতাভর দিকে তাকাতে লাগল।
“আমার কোনো আপত্তিই নেই। স্টেশন ওয়াগনে আপনাকে এবং ইন্দুমতী দেশাইকে বসিয়েও অনেক জায়গা থেকে যাবে।”
মদালসাকে চুলের দোকানে বসিয়ে দিয়ে, অমিতাভ বললে, “ড্রেস হয়ে গেলে আপনি এখানেই অপেক্ষা করবেন। স্টেশন থেকে সোজা চলে আসবো এখানে। ”
কুলি ডাকবার জন্যে গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বার করেই ইন্দুমতী অমিতাভকে দেখতে পেল। “আরে আপনি?”
অমিতাভ জিগ্যেস করলে, “ক’টা কুলি লাগবে?”
ইন্দুমতী বললে, “লটবহর অনেক—তিনটে তো বটেই।”
স্টেশন ওয়াগনে মাল বোঝাই করতে করতে অমিতাভ বললে, “রেল কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, যথাসম্ভব কম মালপত্র নিয়ে ভ্রমণ করুন।
ইন্দুমতী বললে, “আমার নিজের একটা ব্যাগ। কিন্তু বাবা এক কাঁড়ি জিনিস ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন-মাস্টায়মশাইয়ের জন্যে গাছগাছড়া, পোকা-মাকড়, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি জড়ো করেছেন।”
গাড়িতে স্টার্ট দিলে অমিতাভ। ইন্দুমতী জিগ্যেস করলে, “মাস্টারমশাই কেমন আছেন?”
“ ভালই। মিসেস সেন এখানে রয়েছেন।”
“হ্যাঁ, ওঁর আসার খবর মাস্টারমশাই লিখেছিলেন—খুব ভাল হয়েছে। আমার বাবা তো এক মুহূত মাকে ছাড়া থাকতে পারেন না।
“মাস্টারমশাই আপনাকে খুব চিঠি লেখেন বুঝি?” অমিতাভ গাড়ি চালাতে চালাতে জিগ্যেস করলে।
“মাস্টারমশাইয়ের সব চিঠি আমি যত্ন করে রেখে দিই। একদিন এর দাম হবে। তবে আজকালকার চিঠিতে মাস্টারমশাই শুধু আপনার কথা লেখেন।”
“আমার কথা?”
“হ্যাঁ, মাস্টারমশাই তো সোজাসুজি লিখেই দিয়েছেন, আমার জীবনে এমন ছাত্র ও সহকারী কোনোদিন পাইনি।”
“তাই নাকি?”
ইন্দুমতী বললে, “মাস্টারমশাইকে আপনি একেবারে বশ করে ফেলেছেন। নিবেদিতা ল্যাবরেটরিতে আমার নিজের একটা ভবিষ্যৎ ছিল, সেটা গেল।”
ক্যানটনমেন্টের কাছে গাড়ি এসে গিয়েছে। মার্কেটের সামনে গাড়িটা দাড় করিয়ে অমিতাভ হেয়ারড্রেসারের দোকানে ঢুকে পড়ল। মদালসা তার জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
ইন্দুমতীও গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এসেছিল।
অমিতাভ বললে, “এঁকে চিনতে পারছেন মিস্ দেশাই? মাস্টার-মশাইয়ের সবচেয়ে ছোট মেয়ে মদালসা।”
হাত জোড় করে নমস্কার করলে ইন্দুমতী। “আপনাকে দেখিনি কোনোদিন। তবে আপনার কথা শুনেছি অনেক। মাস্টারমশাইয়ের প্রিয় মেয়ে আপনি।”
মদালসা গাড়িতে উঠতে উঠতে গম্ভীরভাবে বললে, “বাপি আমাকে ই বেশী ভালবাসেন।”
অমিতাভ বললে, “আপনাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি তো?”
“একবার আলোটা জ্বালুন তো। দেখুন না, চুলটা কেমন করেছে। একেবারে জোচ্চোর দোকান। কিচ্ছু জানে না—আমাকেই দেখিয়ে দিতে হলো। লেটেস্ট স্টাইলগুলোর নামও শোনেনি।”
গাড়িতে স্টার্ট দিতেই মদালসা বললে, “আগে কাঁচগুলো বন্ধ করে দিন—না হলে কালকেই আবার দোকানে আসতে হবে।”
“আসতে হয় আসা যাবে।” অমিতাভ রসিকতা করলে।
“তাতে আপনার অমূল্য সময় নষ্ট হবে। আপনার কাজের ক্ষতি হবে।” মদালসা এক মুহূর্ত দেরি না করেই উত্তর দিল।
ইন্দুমতী এবার মদালসাকে বললে, “আমি যে ক’দিন আছি কোনো চিন্তা নেই। অমিতাভ বাবুর কয়েকঘণ্টার ডিউটি আমি চালিয়ে নিতে পারবো।”
মদালসা গম্ভীরভাবে বললে, “ওঁর দর বাবা যথেষ্টই বাড়িয়ে দিচ্ছেন—আর বাড়াবার দরকার নেই। ওঁকে বাদ দিয়ে—মিস্ দেশাই আর আমি দু‘জনে চলে আসতে পারবো।”
ইন্দুমতী এবার বেশীদিন থাকেনি। কিন্তু যে ক’দিন ছিল মাস্টারমশাইকে যতটা পারে সাহায্য করেছে।
মদালসাকে নিয়েও মজা করতো সে। মদালসা অনেক সময় সাহস করে ল্যাবরেটরির ভিতর যেখানে জীমূতবাহন ও অমিতাভ কাজে ব্যস্ত, সেখানে ঢুকতো না।
ইন্দুমতী তাকে দেখলেই বলতো, “এই যে আসুন মিস্ সেন। এই শাড়িটাতে আপনাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে।”
মদালসা বলতো, “চটির সঙ্গে ঠিক ম্যাচিং হলো না। এখানে মাত্র পাঁচটা চটি এনেছি আমি। মা‘র চটি আছে অনেকগুলো, কিন্তু আমার পায়ে ঢোকে না। ”
ইন্দুমতী বলে, “আমি তো বোম্বাই ফিরছি। যদি মাপ দিয়ে দেন, রঙ বলে দেন, এনে দিতে পারি।”
“আপনি শীঘ্র আসবেন?”
“হ্যাঁ, তাড়াতাড়িই আসতে হবে—মাস্টারমশাইয়ের হুকুম—মতুন একটা এক্সপেরিমেন্ট হবে, যা ভারতে কখনও হয়নি।”
মদালসা বলে, “ডক্টর মিত্র কোথায়?”
ইন্দুমতী বলে, “আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। দিনরাত কাজের মধ্যে ডুবে রয়েছেন ভদ্রলোক ; দেখুন না যদি বার করে নিয়ে একটু টাটকা হাওয়া খাওয়াতে পারেন।”
.
মাস্টারমশাই, ঈশিতা সেন, মদালসা—এদের সবার কথা সেদিন ল্যাবরেটরিতে বসে বসে ভাবছিল অমিতাভ মিত্ৰ।
কাজ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে মাস্টারমশাইয়ের আগ্রহ নেই। বাড়ির মেয়ে এবং স্ত্রী সম্বন্ধে অমিতাভর কাছে কোনো কথাই বলেন না। অবশ্য গম্ভীর মানুষ তিনি, কী বলবেন?
মিসেস সেন কিন্তু অনেক কথা বলেন। তাঁদের প্রথম জীবনের কথা—জীমূতবাহনের ‘স্বর্ণযুগ’ যাকে বলেন ঈশিতা। তাঁর মেয়েদের কথা, তাদের কৃতী স্বামীদের কথা—কেমন মোটা টাকার চাকরি করছে তারা, তার গল্প। উলের সোয়েটার বুনতে বুনতে ঈশিতা বলেন, “স্বামীর কাছে মেয়েরা কী আশা করে জান বাবা?”
অমিতাভ চুপ করে থাকে। ঈশিতা নিজেই বলেন, “তোমরা হয়তো ভাবছো প্রেম এবং অর্থ। মেয়েদের মনের ভেতরে যখন ঢুকবে, তখন দেখবে এ দুটো দরকারি কথা, কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা নয়। প্রিয় সখী থেকে মেয়েরা যখন মা হয়, তখন তারা স্বামীর কাছ থেকে দায়িত্ববোধ আশা করে।”
অমিতাভর কাপে চা ঢালতে ঢালতে ঈশিতা আবার বললেন, “ভগবানের আশীর্বাদে আমার মেয়েদের স্বামীভাগ্য ভাল। অজয়, সুপ্রিয়, দেবকুমার—এরা চমৎকার ছেলে, এদের দায়িত্ববোধ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। কিছু মনে কোরো না বাবা, আমি বড় ফ্র্যাংক। আমার বাবা বলতেন, কখনও গুজগুজে ফুসফুসে হবি না। আমার মেয়েদেরও সেই শিক্ষা দিয়েছি। তারা আমার কাছে এসে সব কথা বলে।”
উলের কাঁটাটা আবার তুলে নিয়ে ঈশিতা বললেন, “হ্যাঁ, যা বলছিলাম—সন্তানের ওপর দায়িত্ব শুধু মায়ের একার নয়। বাবারও সমান দায়িত্ব—কিন্তু সংসারে কেউ কেউ সে কথা মনে রাখে না। বাইরের নেশায়—সে টাকারই হোক, নামেরই হোক, বা অন্য মেয়েরই হোক—অনেকে নিজেদের প্রধান দায়িত্ব, যে দায়িত্ব ঈশ্বর তাঁর ওপর দিয়েছেন, তার কথা ভুলে যায়।”
তারপরেই হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ঈশিতার মুখ। “কী সব বাজে বকছি! আর বল কেন; এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় তোমার মতো বুদ্ধিমান ছেলে পেলে বক বক করতে ইচ্ছে হয়।”
“সে তো বটেই,” অমিতাভ বলে।
ঈশিত৷ হাসতে হাসতে বলেন, “আমি বাপু বয়সে ছোটবড় মানি না। প্রাপ্তবয়স্ক হলে সবাই সমান। আমার মেয়েরা আমার বন্ধু। আমার জামাইরাও আমার কাছে খুব ফ্র্যাংক—আমার বন্ধুরই মতো!”
“তাই তো হওয়া উচিত,” অমিতাভ বলে।
ঈশিতা বলেন, “উনি কিন্তু তা পারেন না। সবসময় কোথায় যেন একটু দূরত্ব থেকে যায়!”
আজকাল অমিতাভ সময় পেলে সেন পরিবারের কথা মাঝে মাঝে চিন্তা করে। কাজ যথেষ্ট আছে—কিন্তু রোমন্থন মন্দ লাগে না।
সেদিন কতকগুলো ফড়িং-এর সামনে একটা উঁচু টুলে বসে অমিতাভ নোট লিখছিল। লেখা থামিয়ে মাঝে ঐসব চিন্তাও করছিল। এমন সময়ে মদালসার আবির্ভাব।
পেন্সিলের মতো ছুঁ চলো সালোয়ার পড়েছে মদালসা। দেহের বন্ধুরতা উচ্চৈঃস্বরে বিজ্ঞাপিত হয়েছে।
“এই কিম্ভূতকিমাকার ফড়িংগুলো নিয়ে কি করছেন?” মদালসা প্রশ্ন করে।
গম্ভীরভাবে অমিতাভ বললে, “ফড়িং বলতে আমাদের কাছে হাজার রকমের ফড়িং বোঝাতে পারে। যাঁদের দেখছেন এঁদের বৈজ্ঞানিক নাম হিরোগ্লাইফাস নাইগ্রোরেপ্লিটাস। ১৯৩৭ সালে এঁরা নেলোরে আখের ক্ষতি করেন। ১৯৪৫ সালে বেনারস এবং আজমগড়ের চাষীরা এঁদের অত্যাচারে চোখের জল ফেলেছিল। এঁদের পরিবারের সদস্যরা ১৯৪৯ সালে আজমীরে ষাট লক্ষ টাকার জওয়ার খেয়ে ফেলেছিলেন।”
“এখন তো দেখছি আপনিই এদের খেতে বসেছেন,” মদালসা হাসতে হাসতে বলে।
“আপনার বাবার কড়া হুকুম-বিশটি ফড়িং দম্পতির প্রেমোপাখ্যান রচনা করতে হবে। ”
“মানে?”
“মানে, জন্মের কতদিনের মধ্যে এঁরা সাবালক হন, কীভাবে এঁদের বিয়ে হয়, বিয়ের কতদিনের মধ্যে বাচ্চা হয়, এইসব লক্ষ্য রাখতে হচ্ছে। এক নম্বর শিশিতে যে দম্পতিকে দেখছেন, এঁদের দুজনের বয়েস বারোদিন। পাঁচদিন আগে বিয়ে হয়েছে—আর আজই দুটি ডিমের পুঁটলি উপহার দিয়েছেন।”
“এবারে কলকাতায় ফিরে আমরা একটা ব্যালে করবো—ফড়িং-এর সংসার!” মদালসা বললে।
কাজ পড়ে রয়েছে অনেক। কিন্তু মদালসা প্রায় জোর করেই অমিতাভকে বাইরে টেনে আনল ব্যাডমিন্টন খেলার জন্যে।
মদালসা আব্দার করে বললে, “খেলাধুলো না করে শরীরে জং ধরে যাচ্ছে আমার। এইভাবে চললে শিগগির আমার ওজন এক টন হয়ে যাবে। গতকাল মাকে খেলতে নামিয়েছিলাম। আজ মা‘র শরীরে খুব ব্যথা হয়েছে। পার্টনার পাচ্ছি না—মা বললেন আপনাকে পাকড়াও করতে।”
অগত্যা খেলায় নামতে হলো অমিতাভকে।
কিন্তু জীমূতবাহনও যে ঠিক সেই সময় অমিতের খোঁজ করবেন তা কেমন করে জানা যাবে? ল্যাবরেটরিতে ঢুকে জীমূতবাহন দেখলেন ঘর খালি। অমিতাভর নোটবইটা খোলা পড়ে রয়েছে। একটু অপেক্ষা করলেন তার জন্যে। কিন্তু কোথায় অমিতাভ?
বাড়ি যাবার দরকার ছিল জীমূতবাহনের—বিকেলে স্নান করলে সন্ধ্যাবেলায় অনেকক্ষণ কঠিন কাজগুলো করা যায়। বিকেলের সোনার রোদ মাঠের মধ্যে সোনালী আলপনা কাটছে। বাড়ি ফেরার পথে ব্যাডমিন্টন খেলার দৃশ্য দেখতে পেলেন জীমূতবাহন।
একটা নেটের দু‘দিকে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রিয় শিষ্য অমিতাভ এবং তাঁরই মেয়ে মদালসা খেলায় মেতেছে। অমিতাভ উঁচু করে সার্ভ করল, মদালসা সজোরে বলটা ফিরিয়ে দিলে। কিন্তু অমিতাভ সহজভাবেই বলটা আবার তুলে দিল। মদালস৷ নিপুণভাবে চাপ মারলে, অমিতাভ টুক করে ব্যাটটা সামান্য ঠেকিয়ে দিয়ে মদালসাকে ঠকাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু তীরের মতো এগিয়ে এসে বলটা আবার অমিতাভর কোর্টে পাঠিয়ে দিল মদালসা। উত্তেজনায় মদালসা হাপাচ্ছে, তার বুকটা দ্রুত ওঠা-নামা করছে, কিন্তু সে কিছুতেই অমিতাভর কাছে হেরে না যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মদালসা মাঠময় ছোটাছুটি করছে, তার লাল রঙের দোপাট্টা সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে রয়েছে। আর একটা বল মারতে মারতে মদালসা বললে, “আপনাকে হারিয়ে ছাড়বো।”
“দেখা যাক,” বলে হাসতে হাসতে আর একটা বল মারলে অমিতাভ। হঠাৎ চমকে উঠলেন জীমূতবাহন। তাঁর মাথাটা যেন সামান্য ঘুরছে। নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সবুজ আঙিনায় এই খেলা আগেও দেখেছেন জীমূতবাহন। কিন্তু সে তো বহুদিন আগে—অনেকদিন এ-খেলা বন্ধ ছিল।
সব মনে পড়ছে জীমূতবাহনের। সুপ্রিয়র সঙ্গে তাঁর সমর্থ মেয়ে চিত্রলেখাকে এই মাঠেই তো খেলতে দেখেছেন তিনি। একান্ত প্রিয় সহকারী দেবকুমারকে তাঁর স্পোর্টসম্যান মেয়ে সুস্মিতা এই মাঠেই তো গেম দিয়েছে। তাঁর আর এক ছাত্র অজয়ও এই মাঠেই আর এক মেয়ে প্রিয়ংবদার কাছে হেরে গিয়েছে। ঈশিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েদের খেলা দেখেছেন।
জীমূতবাহনের বেশ মনে পড়ে যাচ্ছে, একবার জোর করে তাঁকেও মাঠে নামিয়ে দিয়েছিল সুস্মিতা। ঈশিতা ভারসাস জীমূতবাহন। অনভ্যস্ত জীমূতবাহন গোহারাম হেরে গিয়েছিলেন। র্যাকেট হাতে তাঁর ব্যর্থতা দেখে সবাই হেসেছিল সেদিন।
স্বামীকে নিল-গেম দিয়েছিলেন সেদিন ঈশিতা। তারপরও তো বার বার নিল-গেমই দিয়ে চলেছেন ঈশিতা। বার বার জীমূতবাহন শিষ্য সংগ্ৰহ করেছেন, নিজের হাতে শিক্ষা দেওয়া শুরু করেছেন, আর ছিনিয়ে নিয়েছেন ঈশিতা। প্রিয়ংবদা, চিত্রলেখা, সুস্মিতা এরা যে তাঁরও মেয়ে, ঈশিতা সে কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন জীমূতবাহনকে।
জীমূতবাহন স্বীকার করছেন এরা তাঁরই মেয়ে। তাঁরই রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে এদের ধমনীতে, কিন্তু এদের শাড়ির দাম যে অনেক। ব্যারিস্টার জগদানন্দ বোসের মেয়ে ঈশিতা যে তাদের সেইভাবে মানুষ করেছেন। ঈশিতা এদের যে-জগতে স্থাপন করেছেন সেখানে বাড়ি হলেই হয় না, গাড়িও দরকার হয়। গাড়ি হলেই চলে না—ঘরে রঙ মেলানো কার্টেন দরকার হয়, দামি ফার্নিচার প্রয়োজন হয়। আয়া, বেয়ারা, কুক, ড্রাইভার, মালী, হেয়ারড্রেসার ইত্যাদি কত কি প্রয়োজন হয় তাদের। অনুগত অজয় বসু, দেবকুমার সরকার, সুপ্রিয় চৌধুরী কেমন স্ত্রীদের হুকুম তামিল করছে, তাদের প্রয়োজন মেটাবার জন্যে মন দিয়ে চাকরি করছে। তাদের এই অধঃপতন দেখে নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির অর্ধপাগল জীমূতবাহন সেন ছাড়া আর কারও মনে দুঃখ হয়নি।
দুঃখ! বরং আনন্দ হয়েছে। বিজয়গর্বে ফেটে পড়েছেন ঈশিতা।
বলেছেন, “দেখো, ওদের দিকে তাকিয়ে দেখো—আহা চোখ জুড়িয়ে যায়। একটা নয়, ভগবান চার চারটে মেয়ে দিয়েছেন। তোমার ওপর নির্ভর করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে এমন সব সোনার চাঁদ জামাই কোনোদিন হতো না। ”
জীমূতবাহন কোনো কথা বলেননি। ‘ঈশিতা শুনিয়ে দিয়েছেন, “আমার মায়েরও সাতটা মেয়ে ছিল, কিন্তু কোনোদিন তাঁকে চিন্তা করতে হয়নি, আমার বাবা সব করেছেন।”
যথাসময়ে চিত্রলেখা, সুস্মিতা, প্রিয়ংবদার কাছ থেকে সস্তান-সম্ভাবনার চিঠি এসেছে—শুভ সংবাদ পেয়েই ঈশিতা কলকাতায় ছুটে গিয়েছেন। তাদের সন্তান হওয়ার সময়ও উপস্থিত থেকেছেন। সেন তনয়াদের প্রয়োজনের তালিক! ক্রমশঃ আরও দীর্ঘ হয়েছে—বেবিফুড, দুধ, টনিক, খেলনা, ফ্রক, শার্ট, বাবা সুট, আয়া, গানের মাস্টার, নাচের মাস্টার, পড়ার মাস্টার, আরও কত কি তালিকায় যোগ হয়েছে। কিন্তু কই, কিছুই তো বলতে পারেননি জীমূতবাহন? একবারও তো মুখ ফুটে প্রতিবাদ করেননি জীমূতবাহন।
মনের এই অবস্থা নিয়ে জীমূতবাহন যখন ঘরে ঢুকলেন, তখন তাঁর চোখদুটো বোধ হয় ঘোলাটে হয়ে উঠেছিল। ঈশিতা জিগ্যেস করলেন, “তোমার শরীর খারাপ নাকি?”
“না, মোটেই না। বেশ ভাল আছি,” প্রবল প্রতিবাদ জানালেন জীমূতবাহন।
বেশ হাসি হাসি মুখ যেন ঈশিতার। স্বামীর কাছাকাছি বসে ঈশিতা বললেন, “জানো, অজয় এবার প্রিয়ংবদাকে নিয়ে কোম্পানির খরচে বিলেত যাচ্ছে। যোধপুর পার্কে জমি কিনছে দেবকুমার। আমি লিখে দিয়েছি সুস্মিতার নামে জমি কিনতে।”
জোর করে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সিনথেটিক আনন্দ প্রকাশ করলেন জীমূতবাহন।
ঈশিতার আজ খুব আনন্দ। বুক থেকে আঁচলটা খসে পড়েছে। সেদিকে খেয়ালই নেই। কাঁধের কাছটা একটু চুলকে নিলেন ঈশিতা। তারপর খুব মিষ্টিভাবে আদুরে গলায় স্বামীকে বললেন, “তোমার সঙ্গে কথা আছে। তোমার সঙ্গে পরামর্শ আছে।”
“আমার সঙ্গে পরামর্শ?” জীবনে কোনো বিষয়ে কোনোদিন পরামর্শ নেয়নি তো ‘ঈশিতা। একদম মিথ্যে। নিশ্চয় অন্য কোনো মতলব এসেছে জগদানন্দ বোসের মেয়ের মাথায়।
খুব কাছে সরে এলেন ঈশিতা। ফিস ফিস করে বললেন, “বেশ ছেলেটি এই অমিতাভ। যেমন সুপুরুষ, তেমনি বিদ্বান। বাড়ির অবস্থাও বেশ ভাল। কেয়াতলায় ওর বাবা নতুন বাড়ি করেছেন।”
জীমূতবাহন মাথায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করছেন। মোটা কাচের চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলেন তিনি। এতে একটা সুবিধে, ঈশিতা ঝাপসা হয়ে যায়। জীমূতবাহন বললেন, “দেখতে সুপুরুষ নিয়ে আমি কী করবো ঈশিতা। আমার চাই কাজের মানুষ, যে মন প্রাণ দিয়ে আমার সঙ্গে কাজে ডুবে থাকতে পারবে।”
“তোমার কাজের কথা বলছি না। তোমার কী মাথা খারাপ হলো! তোমার ল্যাবরেটরি নিয়ে তুমি যা খুশি করো।” বিরক্ত ভাবেই উত্তর দেন ঈশিতা।
“তবে?”
“আমি ভাবছি পালটি ঘর।”
“মানে?” জীমূতবাহনের দেহে কে যেন পেট্রোল ধরিয়ে দিল।
জীমূতবাহন যেন হতভাগ্য হোস্ট। ঈশিতা একটা বিশাল প্যারাসাইটের আকার ধারণ করে তাঁর দেহে ডিম ছেড়ে দিতে এসেছেন। প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করছেন জীমূতবাহন, কিন্তু পারছেন না।
“খুকু পাঁচফুট পাচ, অমিত পাঁচফুট আট,” ঈশিতা ঘোষণা করলেন। “তাতে কী এসে যায়?
ঈশিতা কোমর থেকে রুমাল বার করে নাকটা আলতোভাবে মুছতে মুছতে উত্তর দিলেন, “ঠিকই। দু-এক ইঞ্চির এদিক ওদিকে কী এসে যায়?”
“আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না ঈশিতা।” জীমূতবাহন গম্ভীরভাবে সওয়াল শুরু করলেন।
কিন্তু ঈশিতা তার মোহমায়া বিস্তার করে স্বামীকে আদর করে বললেন, “পোকাদের বেলায় এত বোঝ, আর নিজের মেয়েদের বেলায় বুঝতে পার না? আমি যদি মরে যেতাম, মেয়েদের মানুষ করতে কী করে?”
জীমূতবাহনের মনের ভিতর থেকে কে যেন নিঃশব্দে বলল, ‘তাহলে মেয়েদের আমি অন্যভাবে মানুষ করতাম।’ কিন্তু সংসারে থেকে নিজের স্ত্রীকে সে কথা বলা যায় না। তাই নীরব হয়ে রইলেন জীমূতবাহন।
ঈশিতাও আজ কিছুতে রাগ করে হেরে যাবেন না। স্বামীর আরও কাছে এগিয়ে এসে সোহাগ করে বললেন, “আসল কথা তোমার মেয়ের খুব পছন্দ। সেই যে প্রথম যেদিন চিনি আনতে পাঠিয়েছিল, সেদিন থেকেই খুকুমণি ফাঁদে পড়ে গিয়েছে!”
“একজনে বিয়ে হয় না, ঈশিতা। অন্ততঃ আর একজনের মত লাগে।” নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে জীমূতবাহন উত্তর দিলেন।
ঈশিতা অত বোকা নন। এর আগে তিনটে মেয়েকে তিনি পার করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করলেন, “তা বলে তো হাল ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে পারি না। আমি না থাকলে, অমন হীরের টুকরো জামাই একটাও জোগাড় হতো না—তোমার মেয়েরা কেউ ডানাকাটা পরী নয়।”
পরী না হয়েই তো বিপদ হয়েছে। স্বর্গের অ্যাঞ্জেলদের লগা দিয়ে মাটিতে টেনে নামিয়ে এনেছে তারা। সুপ্রিয়, অজয়, দেবকুমারের মতো প্রতিভাবান বৈজ্ঞানিকদের চিরদিনের মতো হারিয়েছেন জীমূতবাহন সেন। আর একবার তাই হবে নাকি? জীমূতবাহন অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলেন।
ঈশিতা বললেন, “যত দায় কী আমার? তোমার কোনো কর্তব্য নেই? তুমি অমিতের মনটা জানবার চেষ্টা করো। তোমাকে খুব শ্রদ্ধা করে ও। তাছাড়া মেলামেশার সুযোগ নিক ভরা আরও কিছুদিন।”
“কিন্তু তোমাকে কলকাতায় যেতে হবে না?” জীমূতবাহন স্ত্রীকে নিবৃত্ত করতে চেষ্টা করলেন।
“একটা কিছু ফয়সালা না করে আমি যাচ্ছি না। বিলেতের পি এইচ ডি ছেলে আমি হাতছাড়া করতে পারবো না।” ঈশিতা খোলাখুলি নিজের মনোভাব প্রকাশ করলেন।