১০
এইভাবেই চলছিল। জীবনের এক বিচিত্র নকশা এইভাবেই নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির দেড়শ বিঘার আঙিনাতে আঁকা হচ্ছিল। সেদিন নির্জন দুপুরে ল্যাবরেটরির ঘরে বসে একমনে টাইপ করছিল অমিতাভ। নিস্তব্ধ অপরাহ্ণ অমিতাভকে মধ্যে মধ্যে বিষণ্ণ করে তোলে। মনে হয় পৃথিবীর গতি স্তব্ধ হতে চলেছে। দুষ্টুমি শেষ করে ক্ষুধার্ত পতঙ্গের দলও বিশ্রাম নিচ্ছে, মাঠের চাষীরাও মাঠ ছেড়ে হয়তো কোনো গাছের তলায় একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। বাতাসও ছুটি নিয়েছে, ভাই পাতা নড়ে না! শহরে এমন হয় না; কারখানার ঘড়ি কাউকে ছুটি দেয় না, শিল্পের মানুষদের জীবনবীণার তারগুলো বোধহয় অন্যভাবে বাঁধা। অমিতাভ ভাবছিল।
এই বিষণ্ণ মুহূর্তে মনে হয় মানুষের যাত্রাপথ অন্তহীন। জীবনের রেলগাড়ি লক্ষ্যহীনভাবে এমন এক অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলেছে, যেখানে রেলের ইঞ্জিনীয়াররা স্টেশন তৈরি করতে ভুলে গিয়েছে। এইসব মুহূর্তে জটিল কোনো কাজ করতে ইচ্ছে করে না—গায়ে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে মাথার জানালাটা দিয়ে ফিকে নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। গগনের কোনো গৃহবধূ যেন ছুটির দিনে সাবান কাচতে বসেছেন। শাদা মেঘের ফেনাগুলো সেখান থেকেই অলস গতিতে ভেসে আসছে। এমনিভাবে তাকিয়ে থাকলে ঘুম এসে যায়—কিন্তু দুপুরে ঘুমনোটা ভাল অভ্যেস নয়। তাই টাইপ-রাইটারটা নিয়ে বসে পড়েছে অমিতাভ।
কিন্তু মাঝে মাঝে টাইপরাইটারে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে অমিতাভ। ভাবে, ভাগ্যের কোন্ লিখনে জীমূতবাহনের সঙ্গে তার জীবনের গাঁটছড়া বাঁধা হলো। কোথায় ছিলেন জীমূতবাহন, কোথায় ছিল অমিতাভ, দু‘জনে কেমনভাবে দেখা হয়ে গেল। বিজ্ঞানকে জীবনের বৈষয়িক উন্নতির মাধ্যম বলে ভাবতে শিখেছিল অমিতাভ। বড় বৈজ্ঞানিক হয়ে অন্য অনেকের মতো লক্ষ্মীর স্নেহধন্য হবে এই ছিল কল্পনা। বড় চাকরি করবে, তার সঙ্গে খ্যাতি ও স্বাচ্ছন্দ্য, এই ছিল লক্ষ্য। কিন্তু জীমূতবাহনকে না দেখসে জীবনের এক বৃহৎ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হতো অমিতাভ।
জ্ঞানের দীপটি সযত্নে ধারণ করে সংসারের বিচিত্র ঝঞ্ঝার মধ্য দিয়ে নিরাসক্ত নির্ভীক জীমূতবাহন যেভাবে আপন উদ্দেশ্যের দিকে আপন মনে এগিয়ে চলেছেন, তাতে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।
না, টাকাই সব নয়। বৈজ্ঞানিক অমিতাভ মিত্ৰ ধনবান ঐশ্বর্যশালী অমিতাভ মিত্রের কাছে নিজেকে বন্ধক রাখতে চায় না। জীবনের অপরাহু বেলায় সংসারী জীমূতবাহন নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার যদি সত্যের সাধনা শুরু করতে পারেন, তবে একলা অমিতাভ এখনই তা পারবে না কেন? ডারহামের সেই সান্ধ্যভোজের আসরে জীমূতবাহনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল বলে অমিতাভ নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেয়।
চিন্তার রেশ ছিন্ন করে অমিতাভ আবার টাইপরাইটারের চাবি টিপতে শুরু করলে।
একাদিক্রমে টাইপের খটাখট চলেছিল। এমন সময় গুরুকন্যা যে ঘরে ঢুকতে পারে, তার জন্য অমিতাভ প্রস্তুত ছিল না।
একটা সিল্কের শাড়ির ওপর টকটকে লাল রঙের কার্ডিগান চাপিয়েছে মদালসা। হাতঘড়িট৷ আকারে বৃহৎ, অন্য হাতে স্টেনলেস স্টিলের চুড়ি পরেছে সে। কানের দুল দুটো যে বেশ মূল্যবান পাথরে তৈরি, তা বুঝতে দেরি হয় না।
একটা জয়পুরী নাগরা পরেছে মদালসা, আর হাতের ছুঁচলো নখগুলো করেছে লাল।
ঘরে ঢুকে সহজভাবেই জিগ্যেস করলো মদালসা, “কী ঠকঠক করে টাইপ করছেন?”
“একটা প্রবন্ধ,” টাইপরাইটারটা সরাতে সরাতে অমিতাভ বলে।
“আসুন। বসুন এখানে। ”
“এত কী প্রবন্ধ লেখেন আপনারা?” মদালসা প্রশ্ন করে।
“বিজ্ঞানের জগতে পেপার তৈরি করা এবং সেগুলো জার্নালে প্রকাশ করাটা খুব প্রয়োজনীয় কাজ। এইসব জার্নাল পড়েই তো বিদেশের বৈজ্ঞানিকরা জানতে পারবেন, আমরা এখানে কী কাজ করছি ; এবং আমরা জানতে পারবে। বিদেশে কী কাজ হচ্ছে?”
“বাবাও বোধহয় আজ এই ধরনের কী একটা পেপার পড়তে শহরে গিয়েছেন,” মদালসা জানায়।
“এখানকার বিজ্ঞান কলেজে এগ্রিকালচারাল অফিসারদের এক সম্মেলন হচ্ছে। সেখানে বক্তৃতা করবেন আপনারা বাবা।”
মদালসা বললে, “শুনুন, যে জন্যে আসা। মা বলে দিয়েছেন, একটু পরেই আপনি আমাদের বাড়িতে যাবেন।”
“কেন বলুন তো।” অমিতাভ প্রশ্ন করলে।
“কোন কেন নেই, মানুষ মানুষের বাড়িতে যায় না?”
“আমি তো বলতে গেলে একরকম আপনাদের বাড়িতেই আছি,” অমিতাভ হেসে উত্তর দেয়।
“মা বলেছেন, আপনার যদি আপত্তি না থাকে, বিকেলের চা-টা আমাদের ওখানেই খাবেন।”
অমিতাভ বললে, “বেশ, যাবো।”
কিন্তু মদালসা জিগ্যেস করলে, “আপনিও কী বাপির মতো ভুলো নাকি?”
“আপনার বাবাকে ভুলো বলছেন? হাজার দশেক পোকামাকড়ের নাম এখনই মুখস্থ বলে যেতে পারেন। কাগজে-কলমে আপনার বাবা এখানে যে কাজ করছেন, হলাণ্ডের প্রফেসর কুনিন ঠিক সেই একই কাজের জন্যে কমপিউটর ব্যবহার করছেন।”
হাতের চাবির রিঙটা ঘোরাতে ঘোরাতে মদালসা বললে, “ওই পর্যন্ত। বাবার ভুলো স্বভাবের জন্যে আমাদের যে কত ভুগতে হয়েছে।
“পৃথিবীতে যাঁরা বড় কাজে ব্যস্ত থাকেন, ছোট ছোট জিনিস অনেক সময় তাঁদের ভুলে থাকতে হয়,” অমিতাভ উত্তর দেয়।
“আপনি যে সুপ্রিয়দার মতো হয়ে উঠলেন। মেজদির সঙ্গে তখন ও বিয়ে হয়নি সুপ্রিয়দার। বাবার ল্যাবরেটরিতে আপনারই মতো পাগল হয়ে কাজ করতেন সুপ্রিয়দা, আর বাবার বিরুদ্ধে কোনো কথা সহ্য করতে পারতেন না।”
“তাই বুঝি? ঠিকই করেছিলেন সুপ্রিয়বাবু। গুরুনিন্দা সহ্য করবেন কেন তিনি?”
অমিতাভ বোধ হয় এবার মদালসার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিল। কিন্তু মদালসা ভাবলো, তার অবিন্যস্ত চুলগুলোর দিকে অমিতাভ নজর পড়ে গিয়েছে। অনেক ‘অ্যাপলজি’ ভিক্ষা করলো সে এবং বললে, “কী করবো বলুন—এখানে একটাও হেয়ার-ড্রেসার নেই।”
অমিতাভ উত্তর দিলে, “আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। যদি রাগ না করেন তো বলি।”
“রাগ করবো না, কথা দিচ্ছি।”
“এই রকম মাথায় মৌমাছিরা হঠাৎ চাক শুরু করে না দেয়।”
“এ্যাঁ, কী রলছেন আপনি! এখানে মৌমাছি আছে বুঝি?” মদালসা বেশ ভয় পেয়েই জিগ্যেস করে।
“পোকা-মাকড়ের আড়ত এটা, বুঝতেই পারছেন। ওরা একবার আকৃষ্ট হলে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতে আরম্ভ করবে।” অমিতাভ গম্ভীর ভাবে জানাল।
“সর্বনাশ! তাহলে কী হবে?” মদালসা কাঁদ-কাঁদ কণ্ঠে জিগ্যেস করে।
“ডি-ডি-টি ছড়ালে চলে যেতে পারে। কিন্তু এখানে আমরা আবার ডি-ডি-টি ছড়াই না। আপনার বাবার কাছ থেকে কোনো প্যারাসাইটের নাম জেনে মৌমাছিদের পিছনে লেলিয়ে দিতে হবে।”
এবার রসিকতা বুঝতে পেরেছে মদালসা। চোখ দুটো বড় বড় করে আহত কণ্ঠে জিগ্যেস করলে, “আপনার বুঝি এই রকম হেয়ার স্টাইল পছন্দ হয় না?”
“কে বলেছে?” অমিতাভ ক্ষমা চায়। হাজার হোক গুরুকন্যা—
প্রথম নিভৃত আলাপেই এতটা রসিকতা করা ঠিক হচ্ছে না।
আর একটুখানি টাইপ করবার অনুমতি চেয়ে নেয় অমিতাভ। কিন্তু কাজে মন বসানো শক্ত বোধ হয়। মদালসা হাঁ করেই মেশিনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
“আপনার খুব খারাপ লাগছে নিশ্চয়!” অমিতাভ জানতে চায় “এই তো ক’দিন হলো এসেছি, এর মধ্যেই হাপিয়ে উঠেছি। এখানে কোনো সোসাইটি নেই, ক্লাব নেই, ভাল সিনেমা হল নেই।” মদালসা নিজের ছোট্ট ছোট্ট ফুলো ফুলো আঙুলগুলো নাচাতে নাচাতে অমিতাভকে বলে।
“কেন? এখানকার কিছু পছন্দ হচ্ছে না আপনার?” অমিতাভ টাইপ করতে করতেই জানতে চায়।
“সে-সব পরে বলবো। এখন চলুন—মা হয়তো তৈরি হয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন।”
“এসো বাবা।” সাদর আহ্বান জানালেন ঈশিতা সেন।
“ক’দিন থেকেই আমি আর খুকুমণি ফন্দি আঁটছি, তোমার সঙ্গে একটু ভাবটাব করবো।”
মদালসা রেগে গিয়ে বললে, “মা-মণি, তুমি আমার ডাকনাম ফাঁস করে দিলে কেন? বিশ্রী নাম একটা। ধাড়ি হয়ে মরতে চললাম, এখনও খুকুমণি।”
“ধাড়ি ধাড়ি করবি না। একুশ বছর বয়সে আজকাল কেউ ধাড়ি হয় না। তাই না বাবা অমিতাভ, তুমি কী বলো?” মিষ্টি হেসে অমিতাভর মতামত জানতে চাইলেন ঈশিতা সেন।
“সে তো বটেই,” অমিতাভ সায় দেয়।
“তা বাবা, তোমারও তো বয়স কম। সাতাশ-আটাশের বেশী কিছুতেই নয়!” ঈশিতা প্রশ্ন নিক্ষেপ করেন।
“প্রায় তিরিশ হতে চললাম। অমিতাভ উত্তর দিলে।
সযত্নে প্রসাধন করেছেন ঈশিতা। একটা শাদা খোলের টাঙাইল শাড়ি পরেছেন তিনি। সঙ্গে হাতা কাটা ব্লাউজ। এই বয়সেও মেদাধিক্য নেই কোথাৎ, থোড়ের মতে৷ সুডৌল হাত ছুটি নেমে এসেছে।
সেই হাত বাড়িয়েই অমিতাভর কাপে চা ঢেলে দিলেন ঈশিতা। দিতে দিতে জিগ্যেস করলেন, “কোথায় দেশ তোমাদের?”
“কলকাতাই বলতে পারেন।” অমিতাভ উত্তর দেয়।
“তাই নাকি? আমাদেরও তাই।” মেপে মেপে মিষ্টিভাবে উত্তর দিচ্ছেন ঈশিতা।
মদালসা বললে, “কই, খাচ্ছেন না তো কিছু?”
অমিতাভ বললে, “আমি বেশ তো খাচ্ছি। আপনিই বরং…”
“ওর কথা বোলো না বাবা, সব হিসেব করে খাওয়া।
এক ফোটা এদিক ওদিক হলে নাকি ওজন বেড়ে যাবে। আমরাও তো বাপু একদিন ওদের বয়সী ছিলাম। কিন্তু যা পেতুম খেতুম পায়ের সোনালী নাগরা জুতোটা নাচাতে নাচাতে মদালসা বললে, “ও সব বাজে কথা বোলো না মা-মণি। তুমি এখনও একবেলা কিছুই খাও না বলতে গেলে।”
মা-মণি বললেন, “তোদের বয়েস আর আমাদের বয়েস? আমাদের এখন বেশী খেলেই যাতে ধরবে।”
অমিতাভর ডিশে আর একটা মিষ্টি তুলে দিয়ে ঈশিতা বললেন, “ওর বাবা তোমাকে খুব ভালবাসেন। তোমার মতো ভাল ছাত্র নাকি উনি দেখেননি।”
“ভালবাসেন বলেই মাস্টারমশাই একটু বাড়িয়ে বলেন,” অমিতাভ চায়ে চুমুক দিয়ে বলে।
“আমার এই মেয়েটিও বড় গুণের মেয়ে। আমার সব মেয়েই অ্যাকমপ্লিসড –বড় প্রিয়ংবদা ভাল আঁকতে পারে। বাবা বেঁচে ছিলেন তখন, আমরাও বিলেতে ছিলাম, জোর করে প্যারিতে পাঠিয়ে দিলেন। মেজ মেয়ে সুস্মিতা ইংরিজীতে এম-এ। সেজ মেয়ে ‘চিত্রাও আর্ট কলেজ থেকে ডিপ্লোমা নিয়েছে। আর আমার এই মেয়ে লোরেটো থেকে ইংলিশ অনার্স পেয়েছে। কিন্তু সেটা কিছুই নয়। ওর অন্য যেসব গুণ আছে “আঃ মা, মেয়ের গুণকীর্তন আরম্ভ করলে এবার।” মদালসা সলজ্জ মৃদু প্রতিবাদ জানায়।
আদর করে মেয়ের কপাল থেকে একটা চুল সরিয়ে দিতে দিতে ঈশিতা বললেন, “গুণকীর্তন কেন, যা সত্যি তাই বলছি। আর অমিতাভ তো আমাদের ঘরের ছেলে, মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে সম্বন্ধে ওর জানতে ইচ্ছে করে না? ইংরিজী বাজনায় খুব ঝোঁক মেয়ের—ক্যালকাটা স্কুল অফ মিউজিকে প্রাইজও পেয়েছে। তুমি যখন কলতাতায় আসবে, চেম্বার কনসার্টের ব্যবস্থা করবো। শুধু বাজনা নয়, টেবিল টেনিস খেলে খুব ভাল। সাঁতারেও এক্সপার্ট। ওর মাথাটা এমন, যা ধরে তাতেই ভাল করে।”
“মাস্টারমশাইয়ের লাইনে এলেন না কেন?” অমিতাভ এবার মদালসার চঞ্চল চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে।
“পোকামাকড়? রক্ষে করুন! আরশোলা দেখলে আমার যা অবস্থা হয়।” মদালসা বলে।
“তোমার মাস্টারমশাইয়ের লাইন? রক্ষে করো বাবা। আমি তো সারাজীবন দেখছি,” ঈশিতা গম্ভীরভাবে বলেন! “বরং ও যদি ব্যারিস্টার হতে চায়, এখনও চেষ্টা করে দেখতে পারে। জগদানন্দ বোসের নাতনী শুনলে অনেক এটর্নি এখনও ব্রীফ নিয়ে ছুটে আসবে।”
মাস্টারমশাইয়ের কথা উঠতেই ঈশিতা কায়দা করে দু‘একটা খবর জানতে চাইলেন। “বিলেতে থাকতে থাকতেই ওঁর মাথায় কী যে আইডিয়া এল।”
“আপনি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের কথা বলছেন?”
“হ্যা বাবা। আমরা মেয়েমানুষ, চালের কণ্ঠে াল, ডালের কন্ট্রোল, তেলের কন্ট্রোলের কথাই জানতাম, এখন আবার এই সব নতুন কন্ট্রোলের কথা শিখছি।”
“এ লাইনে সম্ভাবনা আছে প্রচুর,” অমিতাভ গুরুপত্নীকে জানায়।
“কী সম্ভাবনা বাবা? বার বছর তো হতে চললো ওঁর এই কাজে। ঘরসংসারের সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে বার বছর তো পোকা ঘাঁটছেন। কই কী হলো?”
“কখন কোথা থেকে কী হয়, কেউ বলতে পারে না মিসেস সেন।”
“তা সত্যি। উনি যেভাবে পর পর দুটো ইনসেকটিসাইডের পেটেণ্ট পেয়ে গিয়েছিলেন।”
অমিতাভ বললে, “এ লাইনে অবশ্য পেটেণ্ট হয় না। উনি তো নতুন পোকার সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছেন মাত্র। তার কোনো পেটেণ্ট নেবার নিয়ম আছে বলে শুনিনি তো! তা ছাড়া ওঁর পেটেন্ট নেবার ইচ্ছেও নেই।”
“তাই বুঝি?” ঈশিতা দুঃখের সঙ্গে জিগ্যেস করলেন। “প্রথমতঃ আবিষ্কারের আশা নেই বললেও চলে এবং দ্বিতীয়তঃ আবিষ্কার হলেও কোনো লাভ নেই।” ঈশিতা সংবাদের শেষ অংশটুকুতে সম্পূর্ণ হতাশ হয়েছেন।
“পেনিসিলিন যিনি আবিষ্কার করেছিলেন, তিনি পেটেণ্ট নেননি। টলস্টয় তাঁর বইয়ের কপিরাইট ছেড়ে দিয়েছিলেন শুনেছি,” অমিতাভ বলল।
“হ্যাঁ বাবা, নামের মোহটা সংসারে সবচেয়ে কঠিন মোহ,” ঈশিতা গম্ভীরভাবে বললেন। পুরুষ মানুষরা সংসারে সুখ দুঃখটা সবসময়ে মাথায় রাখতে চায় না। যাক বাবা, যা বলছিলাম, খুকুর বাবাকে তো জানোই—উদাসী মানুষ, তোমাকে বাড়িতে আসতে বলার কথাও ওঁর মনে থাকে না। তুমি বাবা এসো, অন্ততঃ আমরা যতদিন আছি প্রায়ই চলে আসবে। এখানে খুকুমণির একমাত্র বন্ধু তুমি। তোমাদের দু‘জনের যখন ভাব হয়ে গেল তখন আর সঙ্কোচের কারণ নেই। ”
জীমূতবাহন এই সময় উপস্থিত থাকলে মদালসার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতেন, এই প্রস্তাবে তাঁর মেয়েরও কোনো আপত্তি নেই। অমিতাভ অবশ্য স্বাভাবিক সঙ্কোচবশতঃ মদালসার দিকে তাকায়নি।
“এখনই উঠছো কেন বাবা, এই তো এলে।” অমিতাভকে উঠতে দেখে ঈশিতা বাধা দিলেন।
“আরও এক কাপ চা খাও। গরম করে দিচ্ছি।”
মেয়েকে ঈশিতা বললেন, “তুই অমিতের সঙ্গে কথা বল, আমি জল নিয়ে আসি।”
অমিতাভ এবার মদালসাকে বললে, “সেদিন আপনাকে যেভাবে হুকুম করেছিলুম, তার জন্যে ক্ষমা চাইছি। খুব রেগে গিয়েছিলেন আপনি।”
“খুব নয়, একটু রেগেছিলুম। পরে যখন দেখলাম আপনার উপায় নেই, তখন রাগ পড়ে গেল।”
চায়ের জল নিয়ে ঈশিতা ঘরে ঢুকলেন। হাসতে হাসতে বললেন, “শুনলাম, পোকার বাচ্চাদের তুমি খুব যত্ন করতে পারো।”
“মাস্টারমশাইয়ের তুলনায় আমি কিছুই পারি না। উনি যেভাবে লাভিদের ফিড করান, দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।”
চা ঢালতে চালতে ঈশিতা বললেন, “কী জানি বাবা, সংসারে কোনোদিন তো কুটোটি নেড়ে ছটো করেননি। খুকুমণি তখন দু‘মাসের বাচ্চা। এমনভাবে ফিডিং বোতল ধরেছিলেন যে, খুকুমণি বিষম খেয়ে যায় আর কী!”
“আপনি চা খাবেন না?” মদালসাকে জিগ্যেস করলে অমিতাভ।
“ওকে এই সময় আর চা দিই না—এক গ্লাস করে হরলিক্স খায়। তাও খাওয়ানো যা কষ্টকর, সারাক্ষণ সামনে বসে থাকতে হবে, বকতে হবে তবে খাবেন।” ঈশিতা নিজের দিকেও এক কাপ চা টেনে নিলেন।
চা মুখে দিয়েই মুখ কুঁচকোলেন ঈশিতা। “এই চা তোমার খুব খারাপ লাগবে। এমন বিশ্রী জায়গা, ভদ্রলোককে দেবার মতো একটু চা-ও মেলে না। এ-জানলে কলকাতা থেকে একটু চা আনতাম।”
“কিছু দরকার নেই,” অমিতাভ বললে।
“আমার বাবা খুব চা খেতে ভালবাসতেন। আমার তিনটি জামাই ও চায়ের ভক্ত।”
“আর ‘আসল ব্যাপারটা তো বলছো না মা,” মদালসা অভিযোগ করলে।
একটু লজ্জিতভাবেই ঈশিতা বললেন, “ও কিছু নয়।”
মদালসা ব্যাপারটা ফাঁস করে দিল, “রবীন্দ্রনাথ মায়ের হাতের তৈরি চা খেতে ভালবাসতেন। দাদুর বাড়িতে এলেই বলতেন, ঈশিতা কই, সে যেন চা তৈরি করে!”
“তাই বুঝি?” অমিতাভ বিস্ময়ের সঙ্গে জিগ্যেস করলে।
“ওই জন্যেই তো মাকে অত ঘন ঘন চিঠি লিখতেন রবীন্দ্রনাথ।
অস্তুতঃ দু‘শো চিঠি আছে মা‘র কাছে।” মদালসা জানায়।
“এগুলো বার করেন না কেন?” অমিতাভ ঈশিতাকে জিগ্যেস করে। মা‘র হয়ে মদালসাই বললে, “ব্যক্তিগত চিঠি কাগজে ছাপানো মা‘র ইচ্ছে নয়।”
সলজ্জ হেসে ঈশিতা বললেন, “এখন যত্ন করে রেখে দিয়েছি, মদালসার বিয়ে হয়ে গেলে ওকেই দিয়ে দেবো।”
লজ্জায় মুখ লাল করে খুব রাগের সঙ্গে মদালসা বলেছিল, “তুমি যা অসভ্য, মা।”