নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটরি – ১

ট্রেনের কামরায় বসে ইঞ্জিনের দোল খেতে খেতেই আবার সূর্য অস্ত গিয়েছিল। কতগুলো টানেলের মধ্য দিয়ে ইতিমধ্যে যে গাড়িখানা ঢুকলো আর বেরিয়ে এল তার হিসেব নেই। টানেলের মধ্যে যখন ট্রেনটা ঢুকে পড়ে তখন হঠাৎ নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে—ট্রেনটা যেন একটা সুতো, কোন বিশাল দৈত্য তাকে ছুঁচের ফুটোর মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেই আবার ভাল লাগে—প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়।

অমিতাভ দেখল, দূরের পর্বত-শিখরগুলো সেকেলে মেয়েদের মতো স্বামীর মঙ্গলকামনায় সীমন্তে প্রচুর সিঁদুর লাগিয়েছে। ক্ষয়ীভূত এই শিলা নাকি হিমালয়ের থেকেও বয়োজ্যেষ্ঠা। ট্রেন থেকে পাহাড়ের গাছগুলো হঠাৎ দেখলে মনে হয় চলমান অশ্বারোহীর সারি—অন্ধকার নামার আগেই তারা ব্যস্তভাবে নিকটতম সরাইখানার দিকে ছুটে চলেছে।

অমিতাভ মিত্র সামনের জানলার পর্দাটা ভাল করে সরিয়ে দিল—এই ট্রেনটা ভারতবর্ষের অন্যসব ট্রেনের মতো নয়। চলমান ট্রেন থেকে অপরূপা প্রকৃতিকে দু‘চোখ ভরে দেখবার জন্যে যাত্রীরা যে ব্যাকুল হতে পারেন তা স্থানীয় রেল কোম্পানীর দূরদর্শী কর্মকর্তারা এই লাইনের পত্তনের সময়ই বুঝতে পেরেছিলেন। তাই ট্রেনের কামরায় বড় বড় কাচের জানলা বসাতে কার্পণ্য করেননি তাঁরা। বসার জায়গাগুলোও সুন্দর।

একটা ছোট্ট স্টেশনকে অবজ্ঞা করে ট্রেনটা ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল। প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে একটা বাচ্চা ছেলে ফ্যাল ফ্যাল করে চলমান যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে রইল।

ভারতবর্ষ দেশটা যে কত বড় তা ট্রেনে না চড়লে বোঝা যায় না। রবিবার সন্ধেবেলায় অমিতাভ গাড়িতে চেপে বসেছিল। তারপর রবিবার গেল, সোমবার গেল—গাড়ি চলার বিরাম নেই। ভারতবর্ষটা যেন একটা রীলে জড়ানো ছিল—কে বোধ হয় মেশিন ঘুরিয়ে অমিতাভর চোখের সামনে সেটাকে আর একটা কাঠিমে জড়িয়ে নিচ্ছে। কত মাঠ, কত নদী, কত অরণ্য, কত পর্বত, কত স্টেশন, কত মানুষ চোখের সামনে এসে আবার বন বন করে কাঠিমে জড়িয়ে গেল। এর যেন শেষ নেই।

মঙ্গলবারে গাড়ি পালটিয়েছে অমিতাভ। স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ঘণ্টাকয়েক কাটিয়ে আবার এই নতুন ট্রেনটায় উঠে বসেছে। বিদ্যুতে টানছে গাড়িটাকে। গাড়িটা ভেস্টিবিউল্ড।

আগেকার গাড়িটাতে কুপে পেয়েছিল অমিতাভ। ঠিক যেন সেলের বন্দী হয়ে ছিল সে। একটা স্টেশন ছেড়ে আর একটা স্টেশনের পথে মনে হয় পৃথিবীর সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে—একটা ক্যাপসুলের ভিতর অবরুদ্ধ অমিতাভ পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

পৃথিবী থেকে না হোক চেনা-জানা সবাইকার কাছ থেকে এবার সত্যিই দূরে সরে যাচ্ছে অমিতাভ। বাবা বলেছিলেন, “এতো দূরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।”

মা বলেছিলেন অমিতাভকে, “তাহলে তোকে পেটে ধরে কী লাভ হলো? ইস্কুল থেকেই হোস্টেলে রইলি। কলেজেও হোস্টেল ছাড়লি না। তারপর বেশী বিদ্যের লোভে বিদেশে একা একা পালালি। ফিরে এসেও যদি তোর পড়াশোনার শেষ না হয় তাহলে কবে হবে?”

মায়ের দিকে তাকিয়ে অপরাধী অথচ আদুরে ছেলের মতো অমিতাভ হেসেছিল। মা বলে চললেন “তারপর একদিন বিয়ে করে বসবি—একেবারে পর হয়ে যাবি। মরে গেলে নিশ্চয় কষ্ট করে কাছা পরবি, হবিষ্যি করবি, পিণ্ডি দিবি, কিন্তু বেঁচে থাকতে মায়ের কাছে থাকলি না।”

তখন কিছুই বলেনি অমিতাভ। এখন ট্রেনের কামরায় বসে টাইম-টেবলের ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে জায়গাটা সত্যি অনেক দূরে। এই এতোদূর থেকে দুর্ধর্ষ বিরাট সৈন্যবাহিনী একদিন বাংলা দেশ আক্রমণ করতে যেতো! তখন তো ট্রেনও ছিল না।

এই গাড়িতে অমিতাভ একলা নয়—আরও তিনজন আছে। তিনজন নয়—আড়াই জন। তাই বা কেন, রেলের হিসেবে দু‘জন বলা উচিত। কারণ তৃতীয় প্রাণীটির অস্তিত্ব তিন মাস আগেও ছিল না। মিলিটারি ভদ্রলোক-আর্মি ভেটারিনারি কোরের ক্যাপ্টেন দেশপাণ্ডে আর মিসেস দেশপাণ্ডে।

সারা রাস্তা দেশপাণ্ডে শুধু ঘোড়ার গল্প বললেন। তাঁর দুঃখ স্ত্রী ঘোড়ায় চড়তে চায় না। ছেলেটা কী হবে কে জানে—মায়ের দোষটা না সংক্রামিত হয়! ঘোড়ায় চড়তে চাক না-চাক ছেলেটা সর্বদা মায়ের কোলে চড়তে চায় এবং সম্প্রতি আর একটি বস্তুর প্রতি তার দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছে। লাজুক মা তাকে ফিডিং বোতলের দুধ দিয়ে শান্ত করবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পুত্রটি বেয়াড়া, সে মায়ের দুধ চায়।

মাকে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে অমিতাভ বললে, “আমি একটু বেড়িয়ে আসি।”

করিডর দিয়ে সামনের দিকে যাবার চেষ্টা করলে অমিতাভ। কিন্তু গাড়িটা বেজায় দুলছে, এগোবার উপায় নেই। পা বাড়াবার চেষ্টা করলেই হুমড়ি খেয়ে পড়বার ভয়। অমিতাভ মিত্রের মনে হলো আরও অনেক শক্তি অদৃশ্য রজ্জু দিয়ে তাকে পিছনে টানবার চেষ্টা করছে।

এখান থেকে দাড়িয়ে দাড়িয়েই অমিতাভ দূর দিগন্তের পর্বতশ্রেণী দেখতে পাচ্ছে। আর একটা স্টেশনের ওপর দিয়ে গাড়িটা বেরিয়ে গেল। পাশের ছোট ছোট পাথুরে ঢিবির ওপর কয়েক জোড়া সলজ্জ যুবক-যুবতী নিশ্চল বসে রয়েছে। এদেশের গভীরেও কি আজকাল রোমান্স ঢুকে গেল? এটা যদি সত্যি হয় মন্দ কী?

এবার বেশ অন্ধকার হয়ে উঠেছে। রেস্তোরাঁ-কারে বসে কফির অর্ডার দিলে অমিতাভ।

বাইরে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু জায়গাটায় বোধ হয় অনেক নতুন কলকারখানা হচ্ছে! কারখানার শান্ত আলোগুলো আপন মনেই প্রবীণ ও বিশ্বস্ত কর্মচারীদের মতো স্থিরভাবে ডিউটি করে যাচ্ছে। মাঝে একটা জায়গায় ট্রেনের যাত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে একটা ছটফটে নিন সাইন জ্বলছে আর নিভছে। জানিয়ে দিচ্ছে এখানে এক্স-রে মেশিন তৈরি হয়। পাশেই একটা নামকরা রঙের কারখানা। তারই পাশে নাইলন মিল। ‘মানুষের তৈরি ফাইবার ব্যবহার করুন’—আর একটা নিওন আলো নীরব আবেদন জানাচ্ছে।

আর কিছুটা এগিয়ে গিয়েই বিরাট এক কারখানা—মানুষ বাঁচাবার সবচেয়ে নামকরা কয়েকটা অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ এখানেই শিশিতে ভর্তি হয়। তার পরেই মানুষ নিধনের কল—অর্ডনাল কারখানা।

অমিতাভর এখন আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না। এই ক’দিন একলা অনেক ভেবেছে—কোথায় চলেছে, কিসের সন্ধানে চলেছে, কী লাভ হবে? এ-সব চিন্তার সময় যে লোকটি মনের মধ্যে নিত্য আনাগোনা করেছেন তাঁর নাম অবশ্যই জীমূতবাহন সেন।

সুদুর বিদেশে জীমূতবাহন সেনের সঙ্গে অমিতাভর পরিচয়টা প্রায় গল্পের মতো।

ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে এসেছিলেন ডক্টর জে বি সেন। সেই উপলক্ষে প্রফেসর ব্ল্যাকার ডিনার পার্টি দিয়েছিলেন। অধ্যাপকদের ভোজসভায় কোনো ছাত্রের থাকবার কথা নয়। কিন্তু দলে একজন ইণ্ডিয়ান বাড়াবার কথা ভেবেই প্রফেসর ব্ল্যাকার অমিতাভকে আসতে বলেছিলেন।

আলাপ করিয়ে দেবার সময় অধ্যাপক ব্ল্যাকার বললেন, “হিয়ার ইজ এ বয় ফ্রম ঢাকা।”

“না না, ঢাকা নয়—সেটা ওয়ান্স আপন এ টাইম। বাবা ওখানে চাকরি করতেন। আসলে ক্যালকাটা,” অমিতাভকে বলতে হলো।

ডক্টর জে বি সেন গলাবন্ধ কোটের একটা বোতাম সামলাতে সামলাতে শুদ্ধ বাংলায় বললেন, “কলকাতার ছেলে? কোথাকার?”

“নর্থ ক্যালকাটা।”

“মানে শ্যামবাজার?”

“না, দর্জিপাড়া।”

“দর্জিপাড়ার মিত্তির নাকি তোমরা? তোমরা তো ভেরি ফেমাস। এক সময়—সে অবশ্য অনেকদিন আগেকার কথা—ওখানে আমি টিউশানি করতাম।”

জিনিসটা ভাল দেখাচ্ছে না বলে, বাংলায় কথাবার্তা বন্ধ রেখে অমিতাভ একটু দূরে সরে গিয়েছিল।

প্রফেসর ব্ল্যাকার হাসতে হাসতে জীমূতবাহনকে বললেন, “মিট্রাকে আমরা ডি-ইণ্ডিয়ানাইজ করবার চেষ্টা করছি! আমি জোর করে বলতে পারি এই ইউনিভার্সিটির প্রতিভাময়ী এবং আকর্ষণীয়া বালিকাদের মনের খাতার প্রথম পাতায় ওর নাম লেখা আছে। মিট্রার মতো প্ৰতিশ্ৰুতি-সম্পন্ন ছোকরাকে আমরা ডারহামেই রাখতে চাই—মিট্রাকে এখানে শিকড় গেঁড়ে বসতে হবে।”

প্রফেসরের রসিকতায় উপস্থিত সবাই সেখানে গলা কাঁপিয়ে হেসে উঠেছিলেন—জীমূতবাহন সেনের হেঁড়ে গলা সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।

এক সুযোগে জীমূতবাহন আবার অমিতাভর কাছে সরে এসে বলেছিলেন, “চলে যাবেন না, ডিনারের পর দু‘জনে একটু গল্প করা যাবে।”

ডিনারের শেষে দু‘জনকেই একসঙ্গে রাস্তায় হাঁটতে দেখা গিয়েছিল। জীমূতবাহন সেন ধুতি পরেই পার্টিতে এসেছিলেন। অমিতাভ বলেছিল, “আপনার ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।”

জীমূতবাহন হাসতে হাসতে বললেন, “দেশের মধ্যে তবু প্যান্ট পরি কিন্তু দেশ ছাড়লেই ধুতি ছাড়া কিছুই পরতে ইচ্ছে হয় না।”

“কেন? হারিয়ে যাবার ভয়?”

“ঠিক তা নয়—কেমন একটা গোঁ বলতে পারেন”, জীমূতবাহন উত্তর দিয়েছিলেন।

নিজের ঘরেই অমিতাভকে নিয়ে এসেছিলেন জীমূতবাহন। কাঠিতে দাত খুঁটতে খুঁটতে জীমূতবাহন বললেন, “খাওয়াদাওয়া মন্দ হলো না—কিন্তু ঠিক পরিতৃপ্তি হচ্ছে না।”

“কেন বলুন তো?” অমিতাভ প্রশ্ন করেছিল।

“সে আপনারা বুঝবেন না। আমরা সেকেলে প্রেসিডেন্সির গ্রুপ। ইডেন হিন্দু হোস্টেলের রুমমেট বদ নেশা ধরিয়ে দিয়েছিল। খাবার পর পান আর তার সঙ্গে জর্দা না খেলে মনটা কেমন খুঁত খুঁত করে। কিন্তু সে আর কোথায় পাওয়া যাবে বলুন?”

“এই জন্যেই কি আপনি আজকাল ইণ্ডিয়ার বাইরে বিশেষ আসতে চান না ডক্টর সেন?” অমিতাভ হাসতে হাসতে বলেছিল।

“সে কি? এ কথা কে বললে আপনাদের? দেশে কাজ পড়ে আছে অনেক। কিন্তু ঘর মজিয়ে কেমন মনের সুখে পর ভুলিয়ে বেড়াচ্ছি। বিশ্ব কৃষি-সংস্থার ডিরেক্টর জেনারেল বি আর সেন মশাই ছাড়লেন না। দেশ-বিদেশে অনেকগুলো সেমিনার করে গেলাম এবার।”

অমিতাভর দিকে একটা চুরুট এগিয়ে দিয়ে জীমূতবাহন বললেন, “চুরুট খান তো? এটাও আমরা হোস্টেলে অভ্যেস করেছিলাম। আমাদের সঙ্গে পড়তো হরিহর মহান্তি—ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল, কিন্তু বদমায়েসির গাছ। সে বলতো সিগারেটটা মেয়েলি নেশা—যদি বেটাছেলে হোস্ তো চুরুট টানবি।”

নিজের চুরুটটা ধরিয়ে নিয়ে জীমূতবাহন এবার বেশ জাঁকিয়ে বসলেন। অনেকদিন পরে যেন সমবয়সী এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা মারার সুযোগ পেয়েছেন। চুরুটটা হাতে নিয়ে ঠোঁটটা মুছে ফেলে বললেন, “মেয়েমানুষ বলা থেকে খারাপ গালাগালি তখন ছিল না—আমরা ভয়ে ভয়ে তাই চুরুট চর্চা আরম্ভ করেছিলুম। নিতান্ত পয়সা না থাকলে বিড়ি খেতাম।”

অমিতাভ হাসলো। বললে, “চুরুট খেতে পারি না। বড় কাশি আসে।”

জীমূতবাহন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না তো? ঠিক সময়ের মধ্যে হোস্টেলে ফেরবার আইন আছে নিশ্চয়।”

“আমার কোনো অসুবিধে নেই। আমি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি, কারুর সঙ্গে কারুর সম্পর্ক নেই।”

জীমূতবাহন ওয়ারড্রোব থেকে একটা আলোয়ান বার করে নিজের পা দুটো জড়িয়ে নিলেন।

অমিতাভ একটু অবাক হয়েই বললে, “এখানেও আলোয়ান এনেছেন?”

জীমূতবাহন পা দুটো মুড়ে বসতে বসতে বললেন, “আর বলেন কেন, কত রকমের বদ অভ্যেস যে করেছি। আলোয়ান না গায়ে জড়ালে আমার শীত ভাঙে না। ওভারকোট থাকলেও তার ওপর একটা আলোয়ান চড়াতে ইচ্ছে হয়। শাড়ি আর আলোয়ান—এরকম ভার্সেটাইল ড্রেস পৃথিবীতে আর আছে বলে আমার জানা নেই।”

অমিতাভ মৃদু হাসলো। জীমূতবাহনকে তার বেশ লাগছে। দেখতে টিপিক্যাল মফঃস্বল ইস্কুলের হেডমাস্টার, কিন্তু আজ দুপুরেই বৈজ্ঞানিক মহলে ভদ্রলোক কীভাবে সমাদৃত হয়েছেন, তাঁর আধুনিকতম চিন্তা কীভাবে আলোড়ন তুলেছে তা অমিতাভ নিজের চোখেই দেখেছে।

ধুতির সঙ্গে বুট-জুতোপরা পা-টা নাড়তে নাড়তে জীমূতবাহন বললেন, “বিনয় সেন মশাই অনেক ভাল কাজ করবার চেষ্টা করছেন। কে জানে, হয়তো ‘ফ্রিডম ফ্রম হাঙ্গার’ সত্যিই সম্ভব হবে—ক্ষুধা থেকে মুক্তি পাবে মানুষ। কিন্তু সমস্যাটা তো শুধু পৃথিবীর তিনশ কোটি মানুষের নয়—এদের সঙ্গে কীটপতঙ্গদের যোগ দিন। তারাও খেতে চায়, খেতে ভালবাসে—আর তাদের কোনো ফ্যামিলি প্ল্যানিং নেই।”

চুরুটের ধোয়া ছেড়ে, ঠোঁটটা আর একবার মুছে নিয়ে জীমূতবাহন জানালেন, “গ্লেন হেরিকের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল। ছ’মাসের জন্যে সেবার স্টেটসে গিয়েছিলাম। হেরিক বললেন, সেন, ৩১শে মার্চ থেকে ২রা অক্টোবর এই যে ক’মাস তুমি এখানে থাকবে তার মধ্যে একটা স্ত্রী ক্যাবেজ অ্যাফিড থেকে ১,৫৬০,০০০,০০০,০০,০০০,০০০,০০০,০০০ অ্যাফিডের জন্ম হতে পারে। মানুষের খাবারে ভাগ বসিয়েই তো এইসব পোকাদের বেঁচে থাকতে হবে।”

অমিতাভ বললে, “গতকাল আপনি যে পেপারটা পড়লেন—সেটার এখানকার অনেকেই খুব প্রশংসা করছিলেন।”

এবার পকেট থেকে সুপুরি বার করলেন জীমূতবাহন, এক টুকরো অমিতাভকে দিয়ে আর এক টুকরো নিজের মুখে পুরলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, “প্রশংসায় কী হবে? এখনও প্রচুর গবেষণা প্রয়োজন।”

অমিতাভ সেই সামান্য কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ডক্টর সেনের কত আপনজন হয়ে উঠেছিল। বিদেশেই বোধ হয় এটা হওয়া সম্ভব। জীমূতবাহন যেমন অমিতাভর ব্যক্তিগত খবরাখবর জানতে চাইলেন, তেমনি নিজের কোনো কথাও গোপন করলেন না।

বললেন, “কেন আমি বিদেশে এসেছি আপনাকে বলতে বাধা নেই। ফরেন এক্সচেঞ্জের অবস্থা জানেন তো? পঁয়তাল্লিশ কোটি লোকের খাবার আমদানি করতে গিয়ে ভারতবর্ষ দেউলিয়া হতে বসেছে। অথচ আমার এখন অনেক যন্ত্রপাতি চাই। একবার লেকচার ট্যুরে বেরোলেই কিছু পয়সা পাওয়া যায়, অনেকে টাকার বদলে কিছু যন্ত্রপাতিও দেয়।”

একটু থেমে জীমূতবাহন বললেন, “মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছি এবার। ইউ এস এ-তে খুব ভাল সাড়া পেয়েছি—ইংলণ্ডে তো বটেই। এবার পথে একবার রোমে ঢু মেরে যাবো।”

“আপনি এখন কী করছেন ডক্টর সেন?” অমিতাভ জানতে চায়।

জীমূতবাহন একটু হাসলেন। আপনিকে তুমিতে নামিয়ে এনে বললেন, “তুমি কী করছো বলো? বিদেশেই থেকে যাবে নাকি? এরা অবশ্য মাইনে দেয় ভাল, জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যও অনেক পাওয়া যায়, স্বাধীনতাও আছে, সম্মানও আছে এবং আছে গবেষণার অবাধ সুযোগ।”

অমিতাভর স্বভাব উত্তর না দিয়ে শুধু শুনে যাওয়া। উত্তরের অপেক্ষা না করেই জীমূতবাহন বললেন, “এমন একদিন ছিল যখন আমিও ভাবতাম বৈজ্ঞানিকের কোনো দেশ নেই। সমস্ত পৃথিবীই তার কর্মভূমি। তার কোনো ধর্মও নেই—একমাত্র সত্য। এই সত্যের সন্ধানে নিজের দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকবার কোনো প্রয়োজন নেই।”

পড়ে চুরুটের ধোয়া ছেড়ে জীমূতবাহন বললেন, “কতকগুলো ব্যাপারে আমি এখনও সেই এক মত পোষণ করি। কিন্তু অমিতাভ, যদি আমরা দেশকে না দেখি, দেশের সমস্যার বৈজ্ঞানিক সমাধানের চেষ্টা না করি, তাহলেই বা চলবে কী করে?”

সেই অল্পক্ষণের মধ্যেই ডক্টর সেনকে কেমন যেন ভালবেসে ফেলেছিল অমিতাভ। ডক্টর সেন বললেন, “তোমার ডক্টরেটের থিসিস তো সাবমিট করবার সময় হলো। তারপর?”

“এখনও ভেবে দেখিনি। কানাডাতে একটা গবেষণার সুযোগ আছে—এখানকার রয়েল কলেজ অফ এগ্রিকালচারেও কাজ করতে পারি। প্রফেসর ব্ল্যাকার বলছেন, কোনো বড় কেমিক্যাল কোম্পানীতেও বলে দিতে পারেন—শেল, আই-সি-আই বা ডুফার।”

সেই রাত্রে জীমূতবাহন আর কিছু বলেননি। গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন অমিতাভকে।

পরের দিনও জীমূতবাহনের লেকচার ছিল, অমিতাভ শুনতে গিয়েছিল। ডায়াসে উঠবার সময় একবার চোখাচোখি হয়েছিল, ডঃ সেন হেসেছিলেন। বক্তৃতার পর আলোচনার সময় দু-একটা প্রশ্ন করেছিল অমিতাভ।

তারপর ডক্টর সেন লণ্ডন চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে কি খেয়াল হলো, ট্রাঙ্ককল করেছিলেন অমিতাভকে।

রাত্রি তখন অনেক, শুয়ে পড়েছিল অমিতাভ। ঘরের টেলিফোনটা তুলে নিয়ে বলেছিল, “হ্যালো।”

ট্রাঙ্ককল শুনে আরও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল অমিতাভ। ওদিক থেকে চীৎকার করে জীমূতবাহন বললেন, “স্যরি টু ডিসটার্ব ইউ। হোটেলে বসে বসে ভাবছিলাম। বেশ বুঝছি আপনার দেশে ফেরা দরকার। চলে আসুন ইণ্ডিয়ায়।”

অবাক হয়ে গিয়েছিল অমিতাভ। লোকটা পাগল নাকি? ওদিক থেকে জীমূতবাহন চীৎকার করে বললেন, “তাহলে কবে আসছেন বলুন?”

অমিতাভ বিব্রতভাবে বললে, “ভেবে দেখি।”

“আমার কথা শুনুন—বেশী ভাববেন না। ভাবতে ভাবতেই দেখবেন সময় চলে গিয়েছে। শুনুন, দেশে একটা ছোটখাট ল্যাবরেটরি করেছি। ‘অনেক ফাণ্ডামেন্টাল কাজ করা যাবে। টাকা দিতে পারবো না বেশী—কিন্তু অনেক ‘লাইভলি’ প্রবলেম পাবেন। দরিদ্র দেশমাতা আপনাদের মতো ছেলেদের সাহায্য চায়।”

এ রকম আহ্বানের জন্যে অমিতাভ সত্যি প্রস্তুত ছিল না। মন্দ কী? উৎসাহিত হয়ে অমিতাভ বললে, “আপনাকে চিঠি লিখবো।”

জীমূতবাহন বললেন, “আজ ভোরে রোম যাচ্ছি। সেখান থেকে লিবিয়া। ত্রিপোলিতে কিছু কাজ আছে। দেশে ফিরে গিয়েই যেন চিঠি পাই।”

এর আগে বাড়ির লোকরা কতবার দেশে আসবার জন্যে করুণ আবেদন করেছেন, অমিতাভ বিশেষ পাত্তা দেয়নি। এই রাত্রে অমিতাভর হঠাৎ ভারতবর্ষে ফেরবার লোভ হচ্ছে। জীমূতবাহন তাকে টেলিফোনেই সম্মোহিত করে ফেলেছেন।

প্রফেসর ব্ল্যাকার হেসে ফেলেছিলেন। অমিতাভকে বলেছিলেন, “মনে হচ্ছে ডঃ সেন তোমাকে স্পেল-বাউণ্ড করেছেন।”

অমিতাভ বলেছিল, “কিছুই বুঝতে পারছি না স্যার।”

প্রফেসর ব্ল্যাকার অমিতাভর দিকে কফির কাপ এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি তোমাকে কোনোদিন বাধা দেবো না। ডঃ সেন বহু চেষ্টায় একটা কিছু গড়ে তোলবার চেষ্টা করছেন। দু-একজন কমপিটেণ্ট সহকারী প্রত্যাশা করবার অধিকার নিশ্চয়ই তাঁর আছে। আর তা ছাড়া যদিও সায়ানটিস্টের কোনো সংঙ্কীর্ণ ন্যাশন্যাল সেন্টিমেন্ট না থাকা ভাল, তবু তার দেশ যদি কিছু প্রত্যাশা করে তা হলে তা পূরণ করার চেষ্টা অবশ্য‍ই করা উচিত।”

একটু থেমে অধ্যাপক ব্ল্যাকার অমিতাভকে বলেছিলেন, “তুমি তো জানো প্রতি বছর ইংলণ্ডের কত সেরা বৈজ্ঞানিক বেটার মাইনে এবং বেটার সুযোগের লোভে ইউ এস এ এবং কানাডায় পালাচ্ছে। আমিও যেতে পারতাম, সুযোগ এসেছিল বার বার—কিন্তু ওল্ড সেন্টিমেন্ট আঁকড়ে পড়ে আছি। এখন ইণ্ডিয়া, তোমার মাদারল্যাণ্ড, যদি তোমায় ডাকে কেমন করে আমি না বলতে পারি?”

চুপ করেই বসেছিল অমিতাভ। প্রফেসর ব্ল্যাকার বলেছিলেন, “যারা পিছনের ব্রীজ পুড়িয়ে ফেলে এগিয়ে যেতে বলে, আমি তাদের দলে নই ; ইউ ক্যান অলওয়েজ কাম ব্যাক। আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন অস্ততঃ ডারহামের দরজা তোমার জন্যে খোলা থাকবে।”

সোজা কলকাতায় ফিরে এসেছিল অমিতাভ।

ছেলেকে হঠাৎ চলে আসতে দেখে বাড়ির সবাই যে একটু অবাক হয়ে যাননি এমন নয়। তাঁরা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। বাবা দুঃখ করে বলতেন, “সে বোধ হয় আর ফিরবে না। ওই জন্যে অনেকে খুব বেশী দিন বিদেশে থাকতে বারণ করে। ডি-ন্যাশনালাইজড হয়ে যাবার বিপদটা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে।”

“চাকরি নিয়েই এসেছো নাকি? বিলেতে জোগাড় করা চাকরি আর এখানকার চাকরির অনেক তফাত। অন্তত গভর্নমেন্টের সায়েনটিস্ট পুল-এ নাম রেজিস্ট্রি করে এসেছো নিশ্চয় বিলেত থেকে।” আত্মীয়রা প্রশ্ন করেছিলেন।

অমিতাভ কোনো উত্তর দেয়নি।

অমিতাভ একটা জিনিস শিখে ফেলেছে—কথার উত্তর দিলেই কথা বাড়ে। অনেক দিন আগেই পণ্ডিতরা এই সার সত্যটি আবিষ্কার করে উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন—সবায়ের দিকে তোমার কান এগিয়ে দেবে, কিন্তু খুব অল্পজনের কাছেই মুখ খুলবে!

নীরবেই অমিতাভ একটা চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিল জীমূতবাহন সেনের কাছে। “হঠাৎ ভারতবর্ষে এসেছি—পাকাপাকি ভাবে নয়। কিছুদিনের জন্মে বেড়াতে এসেছি বলতে পারেন।”

কিন্তু উত্তরটা যে টেলিগ্রামে আসবে তা অমিতাভ ভাবেনি। প্রিপেড টেলিগ্রাম। সঙ্গে টেলিগ্রাফিক মনি-অর্ডারে ট্রেনভাড়া। এখনই চলে এসো।

অন্তত গিয়ে নিজের চোখে সব কিছু দেখতে দোষ কী? ডঃ সেনের কত লেখাই তো বৈজ্ঞানিক জার্নালে পড়েছে অমিতাভ। লোকটা বোধ হয় পাগল—না হলে কেউ বলে ‘আমার এক ট্রাঙ্ক ভর্তি অপ্রকাশিত সায়েন্টিফিক লেখা আছে। কিন্তু জানো, আমার তেমন সাহস হয় না। তোমার মতো কাউকে যদি দেখাতে পারতাম।’ শোনো কথা! বিশ্বজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক জীমূতবাহন সেন একজন কাল-কা-ছোকরাকে আপনার লেখা শোনাতে চান!

কিছুই ঠিক করা ছিল না। কিন্তু টি-এম-ও ও টেলিগ্রামটাই যেন অমিতাভকে টানতে টানতে এসপ্ল্যানেড বুকিং অফিসে নিয়ে গিয়েছিল, টিকিট কাটাতে বাধ্য করেছিল এবং নির্দিষ্ট দিনে ট্রেনেও তুলে দিয়েছিল।

রবিবারের সন্ধেবেলায় যে রেলযাত্রা শুরু হয়েছিল, মঙ্গলের এই রাত্রেও তার শেষ হলো না!

না, এবার বোধ হয় শেষ হবে। গাড়িটা ইয়ার্ডের মধ্য দিয়ে যেতে শুরু করেছে। কেবিনটা দেখা যাচ্ছে, স্টেশনটা দূরে নয়। কিন্তু স্টেশন থেকে জায়গাটা কতদূরে কে জানে!  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *