নিবভাঙা কলম
।। ১।।
ভবতোষবাবু অফিস-ফেরতা যখন পার্ক স্ট্রিটের কলমের দোকানটাতে গিয়ে পোঁছলেন তখন সন্ধ্যা নামব নামব করছে। দোকানের মালিক সুধাময়বাবু হেসে বললেন, ‘আরে মশাই, আপনার এত দেরি হল কেন আসতে? আজ আবার আমার একটা নিমন্ত্রণ আছে। এখনই দোকান বন্ধ করতে যাচ্ছিলাম।’ রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে ভবতোষবাবু বললেন, ‘আর বলবেন না মশাই। আমার অফিসে এখন কাজের যা চাপ তাতে বেরোবার ফুরসত নেই। সকাল আটটায় অফিসে ঢুকে সেই যে কলম নিয়ে বসলাম তারপর মাথা তুললাম বেলা পাঁচটায়। তারপর ছুটতে ছুটতে এখানে এলাম।’
সুধাময়বাবু রসিকতা করে বললেন, ‘আপনার তো কলমের ওপর বরাবরই প্রবল টান। আপনি তাই কিছুতেই কলম ছাড়তে চান না।’
মজা করে বললেও কথাটা মিথ্যা বলেননি তিনি। ভবতোষবাবুর এই একটাই শখ কলম সংগ্রহ করা। নানা দেশের নানা ধরনের নামী কোম্পানির কলম আছে তাঁর সংগ্রহে। কলম কেনার জন্য তিনি কখনও অর্থের কার্পণ্য করেন না। এই তো মাসখানেক আগে এই দোকান থেকেই পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ডের কলম কিনে নিয়ে গেছেন তিনি। নতুন কোনো কলম এলেই সুধাময়বাবু টেলিফোন করেন তাঁকে। ভবতোষ দোকানে এসে কলম পছন্দ হলে কিনে নিয়ে যান। দু’দিন আগে সুধাময়বাবু টেলিফোন করেছিলেন তাঁকে। যে জন্যই ভবতোষবাবুর আজ এখানে আসা।
ভবতোষবাবু এরপর জানতে চাইলেন, ‘দেখান নতুন কী এল?’
সুধাময়বাবু হেসে বললেন, ‘নতুন নয়, পুরোনো, দেখাচ্ছি।’
দোকান সংলগ্ন পিছনে একটা ঘর আছে। যেটা দোকানের স্টোররুম। সেখানে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা কলমের বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এলেন সুধাময়বাবু। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাক্সটা অনেক পুরোনো। ভবতোষবাবুর সামনে বাক্সটা খুললেন সুধাময়বাবু। তার মধ্যে রাখা আছে একটা লাল রঙের পেটমোটা ফাউন্টেন পেন। কলমটা ভবতোষবাবুর হাতে তুলে দিয়ে সুধাময়বাবু বললেন, ‘গায়ের লেখাটা পড়ুন।’ লেখাটা পড়ে অবাক হয়ে গেলেন ভবতোষবাবু। পেনটার গায়ে ক্ষুদে হরফে লেখা বিখ্যাত এক কলম কোম্পানির নাম। তার সঙ্গে লেখা আছে ‘লন্ডন। ম্যানুফ্যাকচারিং ইয়ার নাইন্টিন হান্ড্রেড।’ অর্থাৎ কলমটার বয়স একশো বছরেরও বেশি!
ভবতোষবাবু বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘এ কলম আপনি কোথায় পেলেন?’
সুধাময়বাবু বললেন, ‘আমার গোডাউনটা পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা পুরোনো বাক্সর মধ্যে এই কলমের বাক্সটা ছিল। আমাদের এই তিন পুরুষের কলমের দোকান একশো বছরের পুরোনো। একসময় সাহেব-সুবোরাও এখানে আসতেন কলম কিনতে, কলম সারাতে। আমার ধারণা তেমনই কারো কলম এটা।’
ভবতোষবাবু বললেন, ‘এ তো এখন অ্যান্টিক জিনিস মশাই! ক্লিপটা তো রুপোর মনে হচ্ছে!’
সুধাময়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, অ্যান্টিক। কিন্তু কলমটা খুলে দেখুন।’
কলমের ক্যাপটা খুলেই ভবতোষবাবু দেখতে পেলেন কলমের নিবটা ভাঙা! তিনি বলে উঠলেন, ‘এমা, নিব যে ভাঙা!’
সুধাময়বাবু বললেন, ‘হ্যাঁ, ভাঙা। আমার ধারণা কেউ সে সময় কলমের নিবটা পাল্টাবার জন্য দোকানে কলমটা দিয়ে গেছিল। তারপর আর নিতে আসেনি।
একথা বলার পর সুধাময়বাবু বললেন, ‘কলমটা ভাঙা হলেও এটার এখন অন্য মূল্য আছে। এটা আপনাকে উপহার দিতে চাই। আমি একবার চেষ্টা করে দেখব বিদেশে এই নিব পাওয়া যায় কিনা? যদি পাওয়া যায় তবে তো আর কথাই নেই।’
ভবতোষবাবু তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘কিন্তু আমাকে কেন?’ যদিও মনে মনে বেশ খুশি হলেন তিনি।
সুধাময় বাবু বললেন, ‘আপনি আমার পুরোনো কাস্টমার। কত দামি দামি পেন কেনেন এখান থেকে। তাছাড়া এ জিনিসের মর্ম সবাই বুঝবে না। তাই এটা আপনাকে উপহার দিলাম।’
ভবতোষবাবু বললেন, ‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার উপহার আমি গ্রহণ করলাম।’
সুধাময়বাবুর দোকান বন্ধ করার তাড়া আছে। তাই আর তাঁর সময় নষ্ট না করে উপহারটা কাঁধের ব্যাগে পুরে ভবতোষবাবু রাস্তায় নামলেন।
।।২।।
কলমের দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে রাস্তা পেরোলেন ভবতোষবাবু। পাশেই গড়ের মাঠ। সূর্যর শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে পড়েছে বিশাল মাঠটায়। একসময় ছাত্রাবস্থায় যখন তিনি ইউনিভার্সিটিতে পড়তেন তখন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি পালিয়ে এই গড়ের মাঠে এসে আড্ডা দিতেন। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই সব সোনালি দিন। মাঠের দু-এক জায়গাতে ছেলের দল খেলা করছে, কিন্তু বিশাল মাঠটাকে ফাঁকাই বলা যায়। মাঠটা যেন ডাকছিল ভবতোষবাবুকে। তিনি একলা মানুষ। তাছাড়া আজ বাড়ি ফেরার তেমন তাড়াও নেই। পরদিন কালীপুজো। অফিস ছুটি। তাঁর বাড়িও বেশি দূরে নয়। এই কলকাতা শহরেই ঝামাপুকুর লেনে। ভবতোষবাবু ভাবলেন মাঠে গিয়ে কোথাও একটু বসা যাক। বহুদিন এমন কোনো খোলামেলা জায়গাতে গিয়ে বসেননি তিনি। কথাটা ভেবে রাস্তার পাশের এক বাদামওলার থেকে একঠোঙা বাদাম কিনলেন তিনি। তারপর মাঠের ভিতর প্রবেশ করলেন।
ভবতোষবাবু হাঁটতে হাঁটতে এগোলেন মাঠের ভিতর দিয়ে। রাস্তার কোলাহল আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে লাগল। মাঝমাঠের একপাশে যেখানে একটা বিরাট গাছ একলা দাঁড়িয়ে আছে, তার নীচে গিয়ে বসলেন তিনি। দু-পাশের রাস্তার গাড়ি বা লোকজনের শব্দ কিছুই এ জায়গা পর্যন্ত পৌঁছয় না। গাছের তলায় বসে প্রথমে বাদাম খেতে লাগলেন ভবতোষবাবু। সন্ধ্যা নামবে, তিনি দেখলেন মাঠে যারা খেলছিল সেই ছেলের দল ব্যাট-উইকেট গুটিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পথ ধরল। ভবতোষবাবুর মনে হল কলমটা আবার একবার দেখা যাক। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে কলমের বাক্সটা বের করলেন তিনি। তারপর বাক্স খুলে কলমটা নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। তার ক্যাপটা খুলে ভাঙা নিবটা ভালো করে দেখতে দেখতে তিনি ভাবতে লাগলেন যে সুধাময় যদি এর নিবটা জোগাড় করতে পারেন তবে বেশ হয়। আর যদি নাও পারেন তবুও জিনিসটা অমূল্য।
দ্রুত অন্ধকার নামতে শুরু করেছে চারপাশে। রাস্তার দিকে বাতিস্তম্ভগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করেছে। কালীপুজোর আগের দিন আজ আবার ভূত-চতুর্দশীর রাত। চাঁদ উঠবে না। বাড়ি ফিরে আজ আবার চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাতে হবে। দূরে রাস্তার গায়ে আলোগুলো জ্বলে উঠতে দেখে কথাটা মনে পড়ল ভবতোষবাবুর। এবার তবে তাঁকে উঠতে হবে। হঠাৎ কিছুটা তফাত থেকে একটা কণ্ঠস্বর কানে এল তাঁর, ‘খাঁটি বিলাতি কলম।’
ভবতোষবাবু তাকিয়ে দেখলেন কোথা থেকে যেন একজন এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁর কয়েক হাত দূরে। লোকটার পরনে ধুতির ওপর হাফশার্ট। পায়ে চপ্পল। লোক না বলে তাকে যুবক বা ছেলেই বলা যায়। সম্ভবত কৈশোর পেরিয়ে সদ্য যৌবনে পদার্পণ করেছে সে। ছেলেটা একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ভবতোষবাবুর হাতের কলমের দিকে। তার ঠোঁটের কোণে যেন আবছা হাসির রেশ। তাকে দেখে ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হল। তবে আজকাল এ বয়সের ছেলেরা কেউ ধুতি পরে না। ভবতোষবাবু নিজে বরাবর ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন তাই ছেলেটার পোশাক দেখে ভালো লাগল তাঁর।
ভবতোষবাবুর বয়স ষাটের কাছে। ছেলেটা যেহেতু তাঁর থেকে অনেক ছোট, তাই তাকে তিনি ‘তুমি’ সম্বোধন করেই মৃদু বিস্মিত ভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘কীভাবে বুঝলে এটা বিলাতি কলম? তুমি কলম চেনো?’
ছেলেটা জবাব দিল, ‘না, সব কলম চিনি না। তবে এ কলম আমি দেখেছি।’
ভবতোষবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি করো? কোথায় থাক? এমন কলম কোথায় দেখেছ?’
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।’
কথাটা শুনেই ভবতোষবাবু বললেন, ‘বেশ, বেশ, কলকাতায় বেড়াতে এসেছ বুঝি? একসময় আমার পূর্বপুরুষরাও ঢাকায় থাকতেন। আমার জন্ম অবশ্য এই কলকাতা শহরে।’
এরপর ছেলেটা জবাব দিল, ‘এ কলম হজসন সাহেবের ছিল।’
ভবতোষবাবু জানতে চাইলেন, ‘হজসন সাহেব কে?’
ছেলেটা জবাব দিল, ‘কুমিল্লার সাব জজসাহেব। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। তাঁর ওই কলম নিয়ে একটা গল্প আছে।’
‘কী গল্প?’ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন ভবতোষবাবু।
ছেলেটা বলল, ‘শুনবেন? তবে একটু বসেই বলি। আমাকে এখানে থাকতে হবে। একজন আসবে এখানে।’ দ্রুত অন্ধকার ঘিরে ধরছে চারদিকে। ছেলেটার মুখ যেন ঝাপসা হয়ে আসছে। ভবতোষবাবুর কয়েক হাত তফাতে বসল ছেলেটা। তারপর শুরু করল তার কাহিনি—
।। ৩।।
‘আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের ঘটনা। ১৯২০ সন। ব্রিটিশ রাজশক্তি তখন নিপীড়ন চালাচ্ছে ভারতবর্ষের বুকে। আর ব্রিটিশ শাসনকে উৎখাত করার জন্য শুরু হয়েছে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন। আর তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে অবিভক্ত বাংলার যুবসমাজ। স্কুল-কলেজ থেকে বেরিয়ে দেশমাতৃকাকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে ছাত্ররা। তারা মারছে এবং মরছেও। ১৯০৮ সনে ফাঁসির দড়ি গলায় পরেছেন ক্ষুদিরাম বসু। শহিদ হয়েছেন প্রফুল্ল চাকী-প্রফুল্ল চক্রবর্তী সহ চেনা-অচেনা অনেকে। ব্রিটিশ পুলিশের ফাঁসির দড়ি বা বন্দুকের গুলি কিছুই দমাতে পারছে না বাংলার দামাল ছেলেদের। যেন দেশের জন্য শহিদ হবার জন্যই জন্মেছে তারা।
কলকাতার অনুশীলন সমিতির শাখা হিসাবে ১৯০৫ সালে ঢাকাতেও বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রও যোগ দেয় তাতে। তেমনই এক ছাত্র ছিল মৃগাঙ্ক চাকলাদার। ষোল বছর বয়স। বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ছেলেবেলায় বাবা-মা মারা গেছিল তার। নিকটাত্মীয় বলতে তার কেউ ছিল না। দূরসম্পর্কের এক মামার বাড়িতে কাজকর্ম করে দেবার বিনিময়ে থাকত সে। তারপর সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে উঠে এসেছিল। মেধাবী ছাত্র বলে কিছু জলপানি পেত। আর দুটো দোকানে খাতা লেখার কাজ করত। তাতেই চলত তার…’
ভবতোষবাবু বললেন, ‘কিন্তু তার সঙ্গে হজসন সাহেবের কলমের সম্পর্ক কী? তুমি তো বললে হজসন সাহেবের কলমের গল্প বলবে?’
ছেলেটা বলল, ‘সম্পর্ক আছে। একটু ধৈর্য ধরে শুনুন।’
অন্ধকারে পুরো ঢেকে গেছে ছেলেটার মুখ। সে আবার বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ ওই মৃগাঙ্ক চাকলাদার। সে যুক্ত হল গুপ্ত সমিতির সঙ্গে। কিছুদিনের মধ্যেই তার কাঁধে একটা দায়িত্ব বর্তাল। বিপ্লবীদের এখন অস্ত্রের দরকার। ঠিক হল কুমিল্লার এক পুলিশ চৌকিতে হানা দিয়ে রাইফেল, পিস্তল লুঠ করতে হবে। সেই মতো আরও কয়েকজন সঙ্গীর সঙ্গে কুমিল্লায় পৌঁছোল সে। স্থানীয় গুপ্ত সমিতির সাহায্যে বেশ কয়েক মাস কুমিল্লায় থাকার পর অবশেষে এল সেই নির্দিষ্ট দিন। সেদিনও ছিল এমন ভূতচতুর্দশীর রাত। চারপাশ অন্ধকার থাকবে বলে সে রাতটাকেই বেছে নিয়েছিল তারা। মাঝরাতে তারা অতর্কিত হানা দিল পুলিশ ফাঁড়িতে। জনা সাতেক বাঙালি যুবকের দল। শুরু হল দু-পক্ষের গুলির লড়াই। মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আর বন্দেমাতরম ধ্বনিতে বিলীন হয়ে যেতে লাগল রাত্রির নিস্তব্ধতা।’—এ কথা বলে রাস্তার দিকে কী যেন দেখার চেষ্টা করে থামল ছেলেটা।
গল্পটা এবার আকর্ষণ করতে শুরু করেছে ভবতোষবাবুকে। তিনি বললেন, ‘থামলে কেন বলো?’
আবার বলতে শুরু করল ছেলেটা, ‘বিপ্লবীদের গুলিতে মারা পড়ল এক গোরা পুলিশ অফিসার। ঘায়েল হল বেশ কয়েজন দেশি সেপাই। চারটে রাইফেল আর তিনটে পিস্তল ছিনতাই করে পালাবার পথ ধরল বিপ্লবীরা। কিন্তু কিছুটা পথ এগোবার পরই একটা পুলিশের গাড়ি পিছু ধাওয়া করল। অন্যরা পালাতে পারলেও মৃগাঙ্ক আর দলনেতা কানাই গুপ্ত ঢুকে পড়লেন একটা বাড়িতে। বাড়ির মালিক নিরঞ্জন মল্লিক তাঁদের আশ্বস্ত করলেন কিছু হবে না বলে। ঘটনার পরদিনই পুলিশ বিজ্ঞাপন দিল যে যদি কেউ বিপ্লবীদের কোনো খবর দিতে পারে তবে তাকে ‘একশো’ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। আর মাত্র সেই একশো টাকার লোভে বাড়ির মালিকের শ্যালক পুলিশকে খবরটা জানিয়ে দিল। ধরা পড়ে গেল দুই বিপ্লবী।’ এ পর্যন্ত বলে আবারও মাঠের একপাশের রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল ছেলেটা।
ভবতোষবাবু বলে উঠলেন, ‘তারপর? তারপর?’
এবার যেন মৃদু হাসল ছেলেটা। সে বলল, ‘হ্যাঁ, এখান থেকেই আসল গল্পের শুরু। প্রথমে জেলে নিয়ে যাওয়া হল এই দুই বিপ্লবীকে। অন্য সঙ্গীদের নাম বার করার জন্য তাদের ওপর শুরু হল অকথ্য অত্যাচার। কিন্তু একটাও নাম বা খবর বার করতে পারল না তারা। অবশেষে মামলা উঠল হজসন সাহেবের কোর্টে। খুন, লুন্ঠন, রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা।
হজসন সাহেবের কোর্টে মামলা ওঠা মানেই ফাঁসি অথবা দ্বীপান্তর। নিদেনপক্ষে যাবজ্জীবন সাজা। বিপ্লবীদের সাজা দিয়ে ইতিমধ্যেই নাম কামিয়েছেন কুখ্যাত হজসন সাহেব। বিচারের নামে কিছুদিন ধরে প্রহসন চলার পর এল সাজা ঘোষণার দিন। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে দুই দেশপ্রেমিক বাঙালি যুবক, আর বিচারকের আসনে লালমুখো হজসন সাহেব। সাহেব কী রায় দিতে যাচ্ছেন তা বুঝতে অসুবিধা হল না দুই বিপ্লবীর। কারণ বিচারক তাঁর চেয়ারে বসার আগেই একজন আর্দালি প্লেটের মতো দেখতে একটা পাথর এনে রেখে গেছিল তাঁর টেবিলে। বিচারক তাঁর টেবিলে এসে বসলেন। তারপর আদেশনামা পাঠ করলেন। কানাইয়ের ফাঁসি, আর মৃগাঙ্কর তখনও আঠারো বছর হয়নি বলে সাজা কিছুটা কম—যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
রায়দানের পর হজসন আসামীদের কাছে জানতে চাইলেন, ‘তোমাদের কিছু বলার আছে?’
তাঁর কথা শুনে মৃগাঙ্ক চিৎকার করে বলে উঠল, ‘তুমিও বাঁচবে না সাহেব। দরকার হলে প্রতিজন্মে তোমাকে মারব আমি। ইহলোক বা পরলোক, কোনো লোকেই আমার হাত থেকে বাঁচবে না তুমি।’
সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলেন। তারপর আপনার ওই কলম দিয়ে ফাঁসির আদেশ সই করে পাথরের চাকতিতে চাপ দিয়ে নিব ভেঙে ফেললেন। ফাঁসির সাজা যে কলম দিয়ে স্বাক্ষর করা হয় তার নিব ভেঙে ফেলাই রীতি।’
ভবতোষবাবু কথাটা শুনে মনে মনে বলে উঠলেন, ‘আরে! আমার কলমের নিবটাও যে ভাঙা!’
ছেলেটা বলে চলল, ‘দুই বিপ্লবীকে দুই জেলে স্থানান্তর করা হল। ফাঁসি হয়ে গেল একজনের। কিন্তু মৃগাঙ্ককে দ্বীপান্তরে পাঠাবার আগেই একদিন সন্ধ্যায় জেল থেকে পাঁচিল টপকে পালাল সে। পুলিশ তার খোঁজ চালাতে লাগল ঠিকই, কিন্তু তাকে ধরতে পারল না। মৃগাঙ্ক পালিয়ে চলে এল কলকাতায়। কিন্তু সে তার শপথের কথা ভুলল না। যেভাবেই হোক শাস্তি দিতে হবে হজসনকে।
এদিকে অন্য একটা ঘটনা ঘটেছিল। সাহেব তো কলমের নিব ভেঙে ফেললেন ঠিকই, কিন্তু তারপরই তাঁর খেয়াল হল এই কলম সরকারি কলম নয়। এটা তাঁর স্ত্রীর দেওয়া উপহার। সে যদি কলমটা সাহেবের কাছে দেখতে চায় তবে তিনি বিপদে পড়বেন। বিড়ম্বনার থেকে বাঁচার জন্য তিনি তাঁর এক আর্দালির হাত দিয়ে কলমটার নিব বদলাবার জন্য পাঠিয়ে দিলেন কলকাতার এক কলমের দোকানে। কিন্তু নিব না থাকায় দোকানদার কলমটা তাঁকে দোকানে রেখে যেতে বললেন বিলেত থেকে নিব আনানোর অপেক্ষায়।
মাসতিনেক বাদে সাহেব কলকাতা আসবেন বলে ঠিক করলেন দুটো কাজে। একটা তাঁর সরকারি কাজ, আর দ্বিতীয় কাজটা হল কলমের নিবটা যদি ঠিক হয়ে থাকে তবে তা ফেরত নিয়ে যাবেন তিনি। খবরটা তাঁর এক আর্দালির মারফত পৌঁছে গেল বিপ্লবীদের কানে। তাঁরা ব্যাপারটা জানিয়ে দিলেন মৃগাঙ্ককে। সাহেব কোন ট্রেনে আসছেন, কোথায় কোথায় যাবেন এসব ব্যাপার। সাহেব ট্রেন থেকে নামতেই মৃগাঙ্ক অনুসরণ করলে তাঁকে। সাহেব প্রথমে লাটভবনে ঢুকলেন, তারপর সেখানের কাজ সেরে রাস্তা পেরিয়ে গড়ের মাঠে ঢুকলেন কোনাকুনি মাঠ পেরিয়ে পার্ক স্ট্রিটের কলমের দোকানে যাবার জন্য। আর ঠিক এ জায়গাতেই হজসন সাহেব আর মৃগাঙ্কর দেখা হল। সাহেব মৃগাঙ্ককে দেখতে পেয়েই বলে উঠলেন, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। মৃগাঙ্ক তুমি ধরা দাও।’ সাহেবের সঙ্গে একজন দেহরক্ষী ছিল। সে ধরতে গেল তাকে। কিন্তু মৃগাঙ্ক তৈরি হয়েই ছিল। সে পিস্তল বার করে গুলি চালিয়ে দিল হজসন সাহেবের হৃৎপিণ্ড লক্ষ্য করে। তাঁর নিবভাঙা কলমটাই তাঁর মৃত্যু ডেকে আনল। কিন্তু দেহরক্ষীকে লক্ষ্য করে মৃগাঙ্ক বেশ কয়েকটা গুলি চালাল ঠিকই কিন্তু তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। সেই দেহরক্ষীর পাল্টা গুলিতে নিহত হল মৃগাঙ্ক চাকলাদার। তার দেহটা পরবর্তীকালে কাউকে না জানিয়ে এই গড়ের মাঠেই পুঁতে দেওয়া হয়েছিল। ঠিক যেমন প্রফুল্ল চাকীর ছিন্নমুণ্ড পুঁতে ফেলা হয়েছিল কলকাতার এক পার্কে।’—এই বলে থেমে গেল ছেলেটা।
ভবতোষবাবু বিস্মিতভাবে বলে উঠলেন, ‘এত কথা তুমি জানলে কী ভাবে? তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমার কলমটা….’
ভবতোষবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই একটু তফাতে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠল ছেলেটা। তারপর দ্রুত গিয়ে আশ্রয় নিল গাছের গুঁড়ির আড়ালে। ভবতোষবাবু দেখতে পেলেন রাস্তার দিক থেকে মাঠ পেরিয়ে দুটো ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে।
।। ৪।।
লোক দুজন ভবতোষবাবুর সামনে এসে দাঁড়াল। অন্ধকারের মধ্যে ভবতোষবাবুর যা মনে হল তাতে তাদের একজনের পরনে সাহেবি পোশাক, কোট, হ্যাট। আর তার সঙ্গীর পরনে পুলিশের পোশাক।
সাহেবের পোশাক পরা লোকটা ভবতোষবাবুর উদ্দেশে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, ‘বাবু স্ট্যান্ড-আপ। উহা আমার কলম। উহা আমাকে ফিরাইয়া দাও।’
তার কথা শুনে ভবতোষবাবু বুঝতে পারলেন লোকটা সত্যি সাহেব। বিস্মিতভাবে তিনি উঠে দাঁড়াতে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ছেলেটা। তাকে দেখেই সাহেব বলে উঠলেন, ‘টুমি?’
ছেলেটা বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, আমি। তোমাকে কলমটা এখানে আবার টেনে আনবে জানতাম। ভাঙা নিবের কলমটার প্রতি তোমার টান পরকালেও গেল না। যেমন যায়নি আমার আক্রোশ।’
সাহেব বলে উঠলেন, ‘ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট। তুমি ধরা দাও মৃগাঙ্ক।’
ছেলেটা বলে উঠল, ‘না, তোমাকে পরকালেও ছাড়ব না আমি।’ পিস্তল বার করল মৃগাঙ্ক। সাহেবের অনুচর তাকে ধরতে যেতেই মৃগাঙ্ক গুলি চালিয়ে দিল সাহেবের বুক লক্ষ্য করে। বুলেটের খোলটা ভবতোষবাবুর গায়ে এসে পড়ল। আর তার মধ্যেই বুলেটটা ফুঁড়ে দিল সাহেবের বুক। মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গেলেন সাহেব। এরপর শুরু হল মৃগাঙ্ক আর সাহেবের দেহরক্ষীর মধ্যে গুলির লড়াই। হাত-পা কাঁপছে ভবতোষবাবুর। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও পারছেন না তিনি। আর এরপরই হঠাৎ গুলির আঘাতে ভবতোষবাবুর গায়ের ওপর ছিটকে পড়ল ছেলেটা। পুলিশটা এবার বন্দুক তাগ করে এগিয়ে এল ভবতোষবাবুর দিকে। হয়তো সে ভবতোষবাবুকে ছেলেটার সঙ্গী মনে করেছে। আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললেন ভবতোষবাবু। লোকটা এসে তাঁর একটা কাঁধ চেপে ধরল। কাঁধ ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে এরপর যেন সে বলতে লাগল, ‘উঠে পড়ুন, উঠে পড়ুন।’
তাহলে লোকটা গুলি চালাবে না। ভয়ে ভয়ে চোখ খুললেন ভবতোষবাবু। তিনি চোখ মেলে দেখলেন তাঁর সামনে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই কিন্তু একটু আগে দেখা সাহেবের সঙ্গী সেই পুলিশ নয়। সাদা ইউনিফর্ম পরা কলকাতা পুলিশের একজন অফিসার। আর তাঁর সঙ্গে একজন কনস্টেবল। অফিসার ভদ্রলোকই তাঁর কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিলেন। একটু থতমত খেয়ে কলম-বাক্স আর ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন ভবতোষবাবু। তাঁর কানে এখনও বাজছে গুলির শব্দ। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অবশ্য তার কারণ বুঝতে পারলেন তিনি। কালীপুজোর আগের রাতেই মাঠের পাশে কিছু লোক এসে পটকা ফাটাচ্ছে। এ তারই শব্দ।
ভবতোষবাবুকে পুলিশ অফিসার প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কী করেন? কোথায় থাকেন?’
তিনি জবাব দিলেন, ‘ঝামাপুকুর লেনে থাকি। ডালহৌসির এক সরকারি অফিসে অফিসারের চাকরি করি। পরিচয়পত্র দেখাব?’
পুলিশ অফিসার সম্ভবত অনুমান করলেন যে সত্যি বলছেন ভবতোষবাবু। তিনি বললেন, ‘থাক দরকার নেই। মাঠে হাওয়া খেতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বুঝি? অনেকক্ষণ অন্ধকার নেমেছে। দিনকাল ভালো না। একলা মাঠে বসা ঠিক না। যান বাড়ি যান।’
পুলিশ অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে পেনের বাক্সটা ব্যাগে পুরে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় উঠলেন ভবতোষবাবু। তারপর বাড়ি ফেরার জন্য একটা ট্যাক্সিতে চেপে বসলেন। উজ্জ্বল আলোকময় কলকাতার রাস্তা। চারপাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে তিনি ভাবলেন তাঁর দেখাটা নিশ্চয়ই স্বপ্ন ছিল। কোনো একটা বইতে যেন তিনি পড়েছিলেন যে ফাঁসির সাজা ঘোষণার পর বিচারকরা আদেশে স্বাক্ষর করে কলমের নিব ভেঙে দেন। কলমের ভাঙা নিব দেখে তাঁর অবচেতনে সে কথাটাই মনে এসেছিল। অফিসে ক’দিন কাজের খুব চাপ। মাঠে বসে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তিনি। তারপর ভাঙা নিবের কলম নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। পটকা ফাটানোর শব্দ তাঁর স্বপ্নে গুলির শব্দ হয়ে ধরা দিয়েছিল। ট্যাক্সিটা ভবতোষবাবুকে তাঁর বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে গেল।
ঘরে ঢুকে আলো জ্বালালেন ভবতোষবাবু। ব্যাগ থেকে কলমের বাক্সটা তিনি টেবিলে রাখতে যাচ্ছেন, হঠাৎ ব্যাগ থেকে ঠক করে মেঝের ওপর কী যেন একটা গড়িয়ে পড়ল। ভবতোষবাবু অবাক হয়ে গেলেন জিনিসটা দেখে। ঘরের উজ্জ্বল বাতির নীচে মেঝেতে পড়ে আছে একটা বুলেটের ফাঁপা ধাতব খোল। দেখে মনে হয় বেশ পুরোনো সেটা। এটা তাঁর ব্যাগে এল কী ভাবে। স্বপ্নর কথাটা মনে পড়ে গেল তাঁর। মৃগাঙ্ক যখন হজসন সাহেবকে গুলি চালাল তখন বুলেটের খোলটা ছিটকে তাঁর গায়ে পড়েছিল। তখনই কি সেটা মুখখোলা ব্যাগে ঢুকে গেছিল? তবুও তিনি মনকে প্রবোধ দেবার চেষ্টা করলেন এই বলে যে অনেক সময় পুলিশের লোকরা তাদের অনুষ্ঠানে বন্দুকবাজির খেলা দেখায় গড়ের মাঠে। মাঠে বসার পর হয়তো তেমনই খোল কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তিনি। এখন ব্যাপারটা মনে করতে পারছেন না। কিন্তু এরপর তিনি নিচু হয়ে মেঝে থেকে খোলটা কুড়িয়ে নিতে গিয়ে হঠাৎ আর একটা জিনিস দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। তাঁর ধুতির কোঁচায় লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ। মৃগাঙ্ক যখন গুলি খেয়ে তাঁর দেহের ওপর গড়িয়ে পড়েছিল সেই রক্তের দাগ।
খোলটা তুলে নিয়ে কোঁচাটা তুলে ধরে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। মনে মনে তিনি প্রণাম জানালেন সেই অমর শহিদের উদ্দেশে। এই রক্তমাখা ধুতি আর বুলেটের খোলটা যত্ন করে তুলে রাখবেন ভবতোষবাবু। আর ভাঙা নিবের এই কলমটা তিনি ফেরত দিয়ে আসবেন কলমের দোকানে।
—