নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক – ৫০

৫০

শিঞ্জিনী ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝরাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বালিয়ে দেখল রায়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সে বলল, “কী রে? ঘুমোবি না?”

রায়া বলল, “তুই ঘুমো। আমি পরে ঘুমোচ্ছি”।

শিঞ্জিনী বলল, “কেঁদে কি কিছু হবে? কেন সময় নষ্ট করছিস? অকারণ চোখের জল নষ্ট করিস না। ঘুমিয়ে পড়”।

রায়া বলল, “তুই ঘুমো না। আমার চোখের জল আমাকে নষ্ট করতে দে। ঘুমো তো!”

শিঞ্জিনী বলল, “ঠিক আছে। আমি ঘুমোব। কিন্তু কনফেশন পেজে আবার কোন পোষ্ট করে দিস না”।

রায়া বলল, “আমার কি কনফেশন পেজ ছাড়া কোন লাইফ নেই। কেন বাজে কথা বলছিস? তুই ঘুমো না”।

শিঞ্জিনী বলল, “আমি তো ঘুমোব। শুধু তোকে দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। একটা পুরো ফালতু জিনিস নিয়ে পড়ে আছিস। একটা ক্রাশ ছিল, কেটে গেছে, ঠিক আছে। সেটা নিয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদার কী হল?”

রায়া বলল, “আমার কাঁদতে ভাল্লাগে। আমি নিজের আনন্দে কাঁদছি। তোর ঘুমোতে ভাল লাগে। তুই নিজের আনন্দে ঘুমিয়ে পড়। সকালে কথা হবে। গুড নাইট”।

শিঞ্জিনী রায়ার পেটে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করল। রায়া কাঁদতে কাঁদতে হাসতে লাগল। বলল, “ভাল হচ্ছে না কিন্তু”।

শিঞ্জিনী বলল, “সব ভাল হচ্ছে। তোকে দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। তুই যদি এখনই না ঘুমোস, তাহলে তোর গায়ে আমি এক বালতি জল ঢেলে দেবো”।

রায়া উঠে বসল। চোখ মুছে বলল, “তুই ঘুমনোর পর আমি কাঁদতে শুরু করলাম যাতে তুই না জ্বালাতন করিস। সেই শুরু করলি”।

শিঞ্জিনী ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে বলল, “এই নে। ফ্রুটস এন্ড নাটস খা। ঠিক হয়ে যাবি”।

রায়া বলল, “একা খাবো?”

শিঞ্জিনী বলল, “একা কেন খাবি? হাফ আমাকেও দে”।

রায়া চকলেটটার মোড়ক খুলে অর্ধেক শিঞ্জিনীকে দিয়ে বাকি অর্ধেক খেতে শুরু করল। শিঞ্জিনী বলল, “এবার ঠিক লাগছে?”

রায়া বলল, “আমার সব সময়েই ঠিক লাগছিল। এতে চাপের কিছু নেই। আমার কাঁদতে ভাল লাগে। প্রেমে পড়ার সময়েও কেঁদেছি। এখনও কাঁদছি”।

শিঞ্জিনী বলল, “শোন। সৌরভ স্যার নিজের জায়গায় একদম ঠিক আছে। তোদের রিলেশন যদি হয়েও যেত, তাতেও অনেক লোক অনেক কথা বলত”।

রায়া বলল, “আমি এতক্ষণ কাঁদছিলাম কেন? এটা ফ্ল্যাশ করছিলাম। সৌরভকে ফ্ল্যাশ করে বের করে দিয়েছি। সৌরভ এখন আমার মনে আর নেই। আমার মন আর মাথা এখন ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। একবারে সাদা পাতার মত ক্লিয়ার। আমি কাল থেকে এই নিয়ে কোন কথাই বলব না। ক্লাসে যাবো। ক্লাস করে চলে আসব”।

শিঞ্জিনী বলল, “তাই? এটা নিয়ে কাল আর কোন কথা বলবি না? আমাকে আর জ্বালাতন করবি না?”

রায়া বলল, “না। করব না”।

শিঞ্জিনী কাঁধ ঝাঁকাল, “ঠিক আছে। দেখা যাক”।

রায়া বলল, “দেখে নিস। এবার ঘুমো। আমাকে মেমোরি ফরম্যাট করতে হলে আরো কাঁদতে হবে”।

শিঞ্জিনী হাত জোড় করে বলল, “জীবনে প্রথম কাউকে দেখলাম মেমোরি ফরম্যাট করতে কাঁদতে হয়। তুইই সেরা মা”।

রায়া বলল, “জীবনে ক’টা লোককে দেখেছিস তুই? পৃথিবীতে সবাই কি তোর মত শক্ত মন নিয়ে এসেছে? কেউ কেউ আমার মত দুর্বল মন নিয়েও এসেছে”।

শিঞ্জিনী বলল, “ঠিক আছে মা। তুই ঘুমো। তুইই সেরা। কিন্তু কালকে থেকে যদি দেখেছি আবার সৌরভ সৌরভ করেছিস, তাহলে তোর খবর আছে মনে রাখিস”।

রায়া বলল, “ঠিক আছে। খবর করে দিস। লাইট অফ করলাম”।

রায়া আলো নিভিয়ে দিল। শিঞ্জিনী শুয়ে পড়ে বলল, “খামোখা কষ্ট পেলি। শুরু থেকেই যদি নিজেকে প্রিভেন্ট করে ফেলতিস তাহলে এত কষ্ট হত না। তা না, কনফেশন পেজে একটা কেচ্ছা দাঁড় করিয়ে দিলি। স্যার অনেক ভাল বলে কোথাও গেলেন না। কাউকে কিছু বলেন ও নি। দেখ গে, তোর উপর সত্যিই ফিলিংস আছে নাকি। হয়ত ভাবছেন তুই পরে এই ডিসিশনটা রিগ্রেট করবি। তাই আর এগোলেন না”।

রায়া ঝাঁপিয়ে পড়ে শিঞ্জিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “বলিস কি বুন্দু? তাহলে তো ব্যাপারটা কাল্টিভেট করতে হচ্ছে। এখন তাহলে কান্না বন্ধ”।

শিঞ্জিনী কপাল চাপড়ে বলল, “হায় রে, কেন যে বলতে গেলাম!”

৫১

 কলেজ কনফেশন

এম/২০/নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

আজ আমাদের ব্রেক আপ হল। অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল। আমি ভেবেছিলাম আমাদের সম্পর্কটা খুব সুন্দর এগোচ্ছে। ভুল ভেবেছিলাম। হয়ত আমারই দোষ ছিল। হয়ত উলটোটা। ও আগে থেকেই অন্য কাউকে পছন্দ করে বসে আছে। আমাকে কাটাতে চাইছিল।

সব শেষ হয়ে গেল। ভাল লাগছে না কিছু। কালকেও আমি খুব ভাল ছিলাম। একবারও মনে হয় নি সম্পর্কটা হঠাৎ করে শেষ হয়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতের কত স্বপ্ন দেখেছিলাম আমরা একসঙ্গে? একদিনেই ডিসকোয়ালিফাই হয়ে গেলাম? ব্লক করে রেখেছে আমাকে। ব্লক করার মত তো কিছু করি নি? কী ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব কিছু। এবার কী করব? খুব ফ্রাস্ট্রেটেড লাগছে।

কমেন্ট ১- ভাই, ফ্রাস্ট্রেটেড লাগলে লাগুক, ভুল করেও সুইসাইডের কথা ভাবিস না কিন্তু। আমরা আছি। যদি মনে করিস কথা বললে ভাল লাগবে, তাহলে কন্ট্যাক্ট কর।

দাশু পা নাচাচ্ছিল। এই কনফেশনটা তার কাছে গুগল ফর্মে এসেছে। অ্যানোনিমাস কনফেশন। কে করেছে বোঝা যাচ্ছে না। কনফেশনের সুরটা খুব একটা ভাল লাগছে না তার। অনেক মানুষই আজকাল হঠাৎ করে হতাশ হয়ে গিয়ে সুইসাইড অ্যাটেম্পট নিয়ে নিচ্ছে। এ আবার সেরকম করবে না তো?

তার সিক্সথ সেন্স বলছে এটা সাগ্নিকের কাজ। সাগ্নিক মারপিট করার ছেলে না। যখন হঠাৎ মারতে এল, দাশু অবাক হয়ে গেছিল। এখন তার মনে হচ্ছে, সাগ্নিকের ব্রেক আপ হয়েছিল বলেই হতাশা থেকে ওরকম করছিল। তখন সাগ্নিকের চোখ মুখ গুলিও ঠিক ঠাক লাগছিল না।

সে সাগ্নিককে ফোন করল।

একটা রিং হতেই সাগ্নিক ধরল, “কী হল?”

দাশু বলল, “ভাই, সরি বলতে ফোন করেছিলাম”।

সাগ্নিক স্তিমিত গলায় বলল, “ইটস ওকে। আমিও সরি। এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে। এত রাতে তোর মনে হল, আমাকে সরি বলা দরকার?”

দাশু বলল, “ওই রাতেই ইভ্যালুয়েট করি তো দিনের কথা। এমনিই মনে হল তোকে ফোন করি। তুই আশিক আদমি আছিস। নিশ্চয়ই এত রাত অবধি জেগে থাকবি”।

সাগ্নিক বলল, “হু”।

দাশু বলল, “কী হু? কী হয়েছে তোর? সব ঠিক আছে?”

সাগ্নিক বলল, “ব্রেক আপ হয়ে গেছে”।

দাশু নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিল। ঠিকই ভেবেছিল সে। মুখে বলল, “সে কী রে? এ আবার কী? দেখ, কালকেই দেখবি ঠিক হয়ে গেছে। ঝগড়া তো হয়ই”।

সাগ্নিক বলল, “ব্যাপারটা সেরকম না। পার্মানেন্ট ব্রেক আপই হয়েছে। নরমাল ঝগড়ার ব্যাপার হলে আমি সামলে দিতাম। ঝগড়া হলে ও ফেসবুকে ব্লক করত। হোয়াটস অ্যাপে করত না। এখন হোয়াটস অ্যাপেই শুধু না, ফোনেও ব্লক করে দিয়েছে। যা হবার হয়ে গেছে। রিলেশনশিপটা শেষ হয়ে গেছে”।

দাশু বলল, “কী কারণে হয়েছে? কোন কারণ আছে কি?”

সাগ্নিক বলল, “আমি নিজেই তো সেটা জানতে চাইছি যে এর পিছনে কোন কনক্রিট কারণ আছে নাকি। ও আমাকে সেভাবে কিছুই খোলসা করে বলল না। জাস্ট চলে গেল”।

দাশু বলল, “ভাল তো। গেছে গেছে। আরো কতজন আসবে। এত চাপ নেওয়ার কী আছে? তোদের যদি আজ ব্রেক আপ হয়, তুই কাল আরেকটা মেয়েকে প্রপোজ করে দে”।

সাগ্নিক বলল, “এই জন্য না তোকে কিছু বলতে চাই না। সব কিছুকে খুব ইজি ভেবে বসে থাকিস”।

দাশু বলল, “কোন কিছুকেই ইজি ভাবছি না। আমি ঠিক পথেই ভাবছি। কোন মেয়ে যদি তোর সঙ্গে রিলেশনে থাকে, তার মানে তোর মধ্যে রিলেশনশিপ মেটিরিয়াল ছিল। এখন একটা গেছে, তাতে তো কিছু হয় নি। তুই চলার পথে এগিয়ে যা। জুনিয়রদের দিকে দেখ। কাউকে না কাউকে ঠিক পেয়ে যাবি”।

সাগ্নিক বলল, “ঠিক আছে। ফোন রাখছি। থ্যাংকস ফর চিয়ারিং মি”।

দাশু বলল, “ব্রেক আপ মানে বেঁচে গেলি ভাই। ক জনের ব্রেক আপ হয়? একটা রিলেশনেই সারাজীবন ঝুলে থাকতে হয়। চল কাল পার্টি দিবি। বিয়ার খাওয়াবি। ঠিক আছে?”

সাগ্নিক বলল, “খাস। থ্যাংকস ফর কলিং”।

দাশু বলল, “আচ্ছা শোন, আমি হলাম প্যাঁচা। সারারাত জেগেই থাকি। কথা বলতে ইচ্ছে হলে ফোন করবি। ওকে?”

সাগ্নিক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “ওকে। থ্যাংকস রে”।

দাশু বলল, “ওকে ওকে। অতো থ্যাংকস দিতে হবে না। কয়েকটা চরম গল্প পাঠাচ্ছি। দেখে নে। গোটা পৃথিবী ভুলে যাবি”।

সাগ্নিক এবার হেসে ফেলল, “ভাগ বিসি”।

৫২

সে কোন একটা অন্ধ গলিতে আটকে পড়েছে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছে। চারদিকে কেউ নেই। শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।

হঠাৎই একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “এখানে কী করছেন? চলুন চলুন। হাতটা এগিয়ে দিন”।

রায়া! কী সুন্দর করে সেজেছে। শাড়ি পরেছে। হাত এগিয়ে দিয়ে বলছে ওর সঙ্গে যেতে। সে হাত বাড়াল। রায়ার সঙ্গে হেঁটে চলেছে সে।

ঘুম ভাঙতেই স্বপ্নটা মনে পড়ল সৌরভের।

কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। তার অবচেতনে কি রায়ার কথা ঘুরে ফিরে আসছে? না না, এটা একদম ঠিক হচ্ছে না। অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে তাকে, নইলে সমস্যা বেড়ে যাবে। তাকে ঠিক থাকতে হবে।

বাড়িতে কিছুই বলল না সে। অবশ্য কেউ কথাও বলল না। তৈরি হয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কলেজে পৌঁছে ল্যাবে গিয়ে বসল। কলেজ শুরুর এক ঘণ্টা আগে কলেজে এলে অদ্ভুত লাগে। ছাত্রহীন কলেজ দেখলে মন খারাপ হয়।

কলেজ বিল্ডিং যত ভালই হোক, ছাত্রছাত্রীরা হল সে কলেজের প্রাণ। তারা না থাকলে কলেজকে জড় বস্তু বলে মনে হয়। চোখ বুজে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল সে।

জীবন জটিল হয়ে যাচ্ছে। বিয়েটা কি সত্যিই সব কিছু থেকে মুক্তির পথ হতে পারে? কাকে বিয়ে করবে সে? মা বা বউদি কোন একটা মেয়েকে নিয়ে আসবে, হয়ত শেষ মেশ তাকেই বিয়ে করবে সে। তারপরে কী হবে? ক’দিন পর যদি আর ভাল না লাগে? এরকমও তো হতে পারে। সব সময় ভালই লাগতে হবে, এরকম হয় না। আরো সমস্যা থাকতে পারে। কম্প্যাটিবিলিটি ইস্যু হতে পারে।

লকডাউন না এলে হয়ত এত কিছু মাথায় আসত না। মাথার মধ্যে ইনসিকিউরিটি বাসা বাঁধছে। কাউন্সেলিং করতে হবে হয়ত।

কাগজের মধ্যে হিজিবিজি লিখতে লিখতে চোখে পড়ল শিঞ্জিনীকে নিয়ে রায়া যাচ্ছে। রায়া মাঝে মাঝেই আড়চোখে ল্যাবের জানলা দিয়ে দেখছে।

নিজের মনে হাসল সৌরভ। কম বয়সে এরকম কত ক্রাশ আসবে। রায়ার ভালর জন্যই সৌরভকে শক্ত হতে হবে।

ফেসবুকের যুগ, টিন্ডারের যুগ। মুহূর্তে সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, মুহূর্তে সে সম্পর্ক শেষ হয়ে যাচ্ছে। সে ফ্যাকাল্টি। ছাত্রীকে বিয়ে করা কেরিয়ারে কালো দাগ ফেলে দিতে পারে। বিবাহ বিচ্ছেদ আরো বড় কালো দাগ ফেলবে। লজ্জায় হয়ত চাকরিটাই করতে পারবে না। কী হবে তখন?

“স্যার আসব?”

কী আশ্চর্য! রায়া চলে এসেছে! তাকে শক্ত হতে হবে। স্বাভাবিক গলায় সে বলল, “এসো”।

রায়া ল্যাবের ভিতর প্রবেশ করল।

সৌরভ কম্পিউটারে চোখ রাখল। রায়ার দিকে তাকানো যাবে না। যদি মেয়েটা বোঝে যে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে, তাহলে বিপদ।

সে বলল, “বস”।

রায়া চেয়ারে বসে বলল, “স্যার, আমি কাল অনেক রাত অবধি খুব ভেবেছি”।

সৌরভ বলল, “তুমি কি এখানে কোন পার্সোনাল কথা বলতে এসেছ?”

রায়া থতমত খেয়ে বলল, “না মানে একটা কথা বলার ছিল। সেটা বলতে এসেছি”।

সৌরভ বলল, “সেটা কি পার্সোনাল?”

রায়া বলল, “স্যার, আমি একটা সমস্যায় আছি। আপনি হেল্প না করলে সমস্যাটা থেকে বেরোতে পারবো না। আমি সারাক্ষণ আপনার কথা ভেবে যাচ্ছি। যাচ্ছেতাই ভুল ভাল কাজ করে যাচ্ছি। যাই করি, আপনাকে ইগনোর করতে পারি না। আমার মাথায় আসে আপনি আমাকে বলেছেন ফিউচারে এই ডিসিশনের জন্য আমারই কষ্ট হবে। কিন্তু ফিউচার দিয়ে কী হবে বলুন। আমরা তো এইসময়ে বাঁচি। আমি কী করব বলবেন”?

সৌরভ রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি যদি কোন রিলেশনে থাকি, তাহলে তোমার মাথা থেকে আমার ভূত নামবে, তাই তো?”

রায়া বলল, “আপনি কি রিলেশনে আছেন”?

সৌরভ বলল, “ধরে নাও আছি”।

রায়া বলল, “অরুন্ধতী ম্যামের সঙ্গে?”

সৌরভ একটু থমকে বলল, “হ্যাঁ। ম্যামের সঙ্গে”।

রায়ার চোখে জল চলে এল। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে। আসি স্যার। আপনারা ভাল থাকবেন”।

ল্যাব থেকে হন হন করে বেরিয়ে গেল রায়া।

৫৩

ফার্স্ট ক্লাস। এন সি ক্লাসে চলে এসেছেন। ডেস্কে মাথা নিচু করে রায়াকে ফোন করল শিঞ্জিনী। রায়ার ফোন বেজে গেল। ফোন ধরল না।

সে বিরক্ত হল। রায়া বলে গেল সৌরভকে একটা কথা বলে চলে আসবে। এল না তো! ওকে যেতে দেওয়াটাই ভুল হয়েছে।

অদ্ভুতভাবে অঞ্জনা শমীকের পাশে বসে নি। অন্য ডেস্কে বসেছে। শিঞ্জিনীও শমীকের পাশে বসে নি। সে ঠিক করেছে রায়া এলে ওর পাশে বসবে। রায়ার কাজকর্ম ঠিক লাগছে না তার। ঘুমনোর আগে অবধি ঠিক ছিল, কান্নাটা মনে পড়তেই অস্বস্তি হচ্ছে।

অঞ্জনা তার দিকে সরাসরি তাকাল। শিঞ্জিনীও অঞ্জনার দিকে তাকাল। অঞ্জনা তাকে ইশারা করল শমীকের পাশে বসতে। শিঞ্জিনী অঞ্জনাকে মধ্যমা দেখাল। অঞ্জনা রাগল না। তাকে অবাক করে হেসে উঠল। শিঞ্জিনীরও হাসি এল। কেন এল সে জানে না।

এন সি পড়াচ্ছেন। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে শিঞ্জিনী ক্লাসে ডুবে যাচ্ছিল, সম্বিত ফিরল শুভ্রর গলায়। শুভ্র ছুটতে ছুটতে তাদের ক্লাসে ঢুকে গিয়ে তার কাছে এসে বলল, “তোর সঙ্গে যে মেয়েটা থাকে, পুকুরে ডুবে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি চল”।

শিঞ্জিনীই শুধু না, গোটা ক্লাস অবাক হয়ে শুভ্রর দিকে তাকাল। শুভ্র প্রায় স্নান করে ফেলেছে।

এন সি বিরক্ত হয়ে বললেন, “একী, কার পারমিশন নিয়ে তুমি ক্লাসে ঢুকলে? বৃষ্টি পড়ছে না তো, ভিজলে কী করে?”

শুভ্র বলল, “স্যার, এই ক্লাসের একটা মেয়ে কলেজের পাশের পুকুরটায় ডুবে যাচ্ছিল”।

শিঞ্জিনী এন সির থেকে কোন পারমিশন না নিয়েই ছুটল। তার সঙ্গে ক্লাসের বাকিরাও। পুকুরের পাশের দোকানে রায়াকে বসানো হয়েছে। কোত্থেকে আবার একটা গামছা জোগাড় করে ওকে দেওয়া হয়েছে। দোকানের ভিতর ভিড় জমে গেছে।

রায়ার গোটা শরীর ভেজা। কেমন ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছে।

শিঞ্জিনী হাঁফ ধরা গলায় রায়াকে বলল, “কী হয়েছে? ডুবে যাচ্ছিলি মানে কী?”

রায়ার চোখ লাল হয়ে আছে। শুভ্র বলল, “আমি না থাকলে ডুবেই যেত। পাগল নাকি মেয়েটা? দেখি সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে নেমে যাচ্ছে। আমিই তো টেনে তুললাম। কী হয়েছে? কোন প্রব্লেম? পিজিতে নিয়ে যাবি না কলেজে কাউকে কোন রিপোর্ট করবি?”

বিভিন্ন লোক বিভিন্ন কথা বলছিল। অঞ্জনা সেটা দেখে শিঞ্জিনীকে বলল, “ওকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ভাল হয়। এখানে থাকলেই একেকজন একেক রকম কথা বলবে”।

অঞ্জনা অস্থির মুখে দোকান থেকে একটা জলের বোতল নিয়ে রায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এ নে। জলটা খা। চা খাবি?”

শিঞ্জিনী অঞ্জনার হাত থেকে বোতলের মুখ খুলে রায়ার মুখে জলের ছিটে দিল। রায়া শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিজে গেলাম তো। কী হবে এবার”?

অঞ্জনা শিঞ্জিনীকে বলল, “তোরা একই সঙ্গে থাকিস না? চল, আমিও যাব”।

শিঞ্জিনী বলল, “চল”।

শমীক অটো ডেকে আনল। চারজন মিলে রায়াকে নিয়ে অটোয় উঠল। শুভ্র বলল, “একী, আমিও তো ভিজে গেছি। আমি না গেলে কী করে হবে?”

শিঞ্জিনী বলল, “অটোকাকুর পাশে বসে যাও”।

শুভ্র বলল, “ঠিক আছে। ভাই আমি বাঁচালাম, তোরা আমাকে না নিয়ে চলে যাচ্ছিলি?”

শিঞ্জিনী বলল, “ঠিক আছে, তোমাকে একটা বিড়ির প্যাকেট কিনে দেব। চুপ করবে?”

অটো চলতে শুরু করল। শুভ্র বলল, “আমাদের পাড়ায় একটা ছেলে আছে, ওর নাম হল ঝিম। মাঝে মাঝেই ও ঝিম মেরে যায়। এ মেয়েটার সেরকম ঝিম রোগ আছে নাকি? কেমন ঝিমোতে ঝিমোতে পুকুরে নেমে যাচ্ছিল। ভাগ্যিস আমি বিড়ি টানছিলাম। তোরা আমার বিড়িকে আন্ডার এস্টিমেট করিস তো, আজ বিড়ি না টেনে ক্লাস করলে তোদের বন্ধু খবর হয়ে যেত”।

রায়া শক্ত করে শিঞ্জিনীর হাত ধরে আছে। হাউজিং কমপ্লেক্সে ঢুকে অটো ছাড়ার পর শুভ্র বলল, “আমি চেঞ্জ করতে গেলাম। যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাস কিন্তু। তোরা কলেজে ফিরবি তো?”

শমীক বলল, “হ্যাঁ। ফিরব। তোমার নাম্বারটা দিয়ে দাও”।

শুভ্র শমীককে তার ফোন নাম্বার দিল। রায়াকে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে গেল শিঞ্জিনী। পিজির কাকীমা অবাক হয়ে সবাইকে দেখে বলল, “কিছু হয়েছে নাকি?”

শিঞ্জিনী বলল, “না কাকীমা, সেরকম কিছু না। রায়া আমাদের কলেজের পুকুরে পা পিছলে পড়ে গেছিল, এখন ঠিক আছে”।

কাকীমা অবাক হয়ে বলল, “এ বাবা। ডাক্তার দেখাবে কি?”

শিঞ্জিনী বলল, “না না। সেসব দরকার নেই। ও চেঞ্জ করে নিক, আমরা আবার কলেজ যাবো তারপরে”।

কাকীমা বলল, “একটা দুর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছিল। ওকে আবার নিয়ে যাবে? আজ থাকলে হয় না?”

অঞ্জনা বলল, “না না। ক্লাস মিস করবে কেন? কিরে রায়া পারবি না?”

রায়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ। ক্লাস করব তো”।

অঞ্জনা বলল, “আপনি একদম ভাববেন না। আমরা ওকে নিয়ে যাবো”।

কাকীমা মাথা নেড়ে বললেন, “ঠিক আছে, আমি এক গ্লাস গরম দুধ এনে দি। ওকে খাইয়ে দাও”।

শিঞ্জিনী রায়াকে খাটে বসাল। বলল, “কী হয়েছে? তোর কি মাথাটা গেছে?”

শমীক অবাক হয়ে শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন মাথা যাওয়ার কী আছে? কী হয়েছে?”

শিঞ্জিনী রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মাথা হয়েছে। এই মেয়েটা আমাকে পাগল করে দেবে”।

শমীক বলল, “আমাকে কি বলা যায়?”

শিঞ্জিনী বলল, “ও সৌরভ স্যারকে প্রপোজ করেছিল। স্যার নিশ্চয়ই না করে দিয়েছেন। তারপর থেকে এসব করছে”।

শমীক কপালে হাত দিল, “মাই গড”।

অঞ্জনা রায়ার হাত ধরে বলল, “কোন ছেলের জন্য এসব করে? তুই কী রে? এসব কী করছিলি?”

রায়া শিঞ্জিনীকে বলল, “সবাইকে বলে দিলি? এবার কী হবে?”

অঞ্জনা বলল, “কিছু হবে না। আমরা এ ক’জনই জানব। তুই ভাবিস না। কলেজে বলে দেব তুই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিলি। ওই সিনিয়রকেও তাই শিখিয়ে দেবো, ঠিক আছে”?

রায়া কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শিঞ্জিনী দেখল তার ফোন বাজছে। সৌরভ ফোন করছে। সে রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোর সৌরভ ফোন করেছে বোধ হয় খবর নিতে। কী বলব?”

রায়া শূন্য চোখে বলল, “যেটা বাকি সবাইকে বলবি, তাই বলে দে”।

শিঞ্জিনী ফোন নিয়ে বাইরে চলে গেল।

শমীক বলল, “স্যারকে ভালবাসার কী আছে? তুই কি আর কাউকে পেলি না?”

রায়া বলল, “তুই থাম। সারাদিন পড়ে যাস, ভালবাসার কিছু বুঝিস?”

অঞ্জনা হেসে দিল।

শমীক বলল, “বুঝে টুঝে তো মরতে যাচ্ছিলি গাধা”।

রায়া বলল, “এই যে ডুবতে গেলাম, এবার ঠিক হয়ে যাবে। ভূত নেমে যাবে। চিন্তা করিস না”।

শমীক বলল, “কী যে করিস। এসব প্রেম ট্রেম কোন কাজের কথা নাকি?”

রায়া বলল, “সেই। ঠিকই বলেছিস”।

৫৪ 

“কী হয়েছে রায়ার? আমি এই মাত্র শুনলাম”। সৌরভ জানতে চাইল।

শিঞ্জিনী বলল, “স্যার, আমাদের কলেজের বাইরের পুকুরে পা পিছলে পড়ে গেছিল। আমরা ওকে আমাদের পিজিতে নিয়ে এসেছি”।

সৌরভ অবাক গলায় বলল, “পড়ে গেছিল মানে? ওখানে কী করতে গেছিল?”

শিঞ্জিনী বলল, “চা খেতে গেছিল হয়ত”।

সৌরভ বলল, “ও, ঠিক আছে। দেখে রেখো। কী যে কর তোমরা। বাই”।

শিঞ্জিনী ফোন রেখে একটু থমকাল। স্যারের কণ্ঠে বেশ খানিকটা উদ্বেগ ছিল। এটা রায়াকে বলা ঠিক হবে না। বললেই হয়ত আবার নাচতে শুরু করবে।

সে ঘরে ঢুকে দেখল অঞ্জনা তাদের খাটে বসে আছে। শমীক চেয়ারে বসে মোবাইল ঘাঁটছে। শিঞ্জিনীর একটু লজ্জাও লাগছিল। ঘরটার অবস্থা খুব খারাপ। চারদিকে বই ছিটিয়ে রয়েছে। ওরা আসবে জানলে পরিষ্কার করে রাখা যেত। তাকে দেখে রায়া বলল, “কী হল?”

শিঞ্জিনী বলল, “কিছু না। তোকে নিয়ে সবাই চিন্তিত হয়ে গেছে আর কী”।

শমীক বলল, “চিন্তিত তো হবেই। গাধার মত কাজ করলে চিন্তিত হবে না। ফ্যাকাল্টির প্রেমে পড়ে কেউ?”

অঞ্জনা বলল, “এক কথা বার বার বলে লাভ নেই। মানুষ সবার প্রেমে পড়তে পারে। ফ্যাকাল্টি এখানে কোন দোষ করল। সৌরভ স্যার তো খুব হ্যান্ডু, যে কেউ প্রেমে পড়তে পারে”।

শিঞ্জিনী রায়ার দিকে তাকাল। রায়া রাগতে গিয়েও রাগল না। ও সক্রিয়ভাবে মাথা থেকে স্যারকে বের করতে চাইছে হয়ত। স্যারের কাছে মেয়েটা কী বলতে গেছিল পরে জিজ্ঞেস করে নিতে হবে।

ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজল। শুভ্র এসেছে। সরাসরি ঘরে ঢুকে বলল, “কী রে, তোদের কি কলেজে যাবার ইচ্ছা নেই?”

অঞ্জনা বলল, “ওদের পিজির আন্টি দুধ আনতে গেছেন। ওটা খেয়ে বেরনো যাবে”। শুভ্র শিস দিয়ে উঠল, “বাপরে, কী ভাল পিজি তোদের। আর আমার পিজি, একবারের বেলায় দুবার ভাত চাইলে এমন করে তাকায় যেন কিডনি চাইছি। বাই দ্য ওয়ে, তুই কি ইংলিশ চ্যানেল পার ফার হবার কথা ভাবছিলি নাকি বল তো?”

শিঞ্জিনী হেসে ফেলল। রায়া বলল, “তুমি এরকম কেন? সব সময় অদ্ভুত সব কথা বল!”

শুভ্র বলল, “আমি আবার কী রকম? তুই নিজের দিকে তাকা। আমরা না হয় ছেলে পিলে, ক্লাস ফাস বাংক মেরে বাইরে বিড়ি খেয়ে বেড়াই, তোরা তো পড়ুয়া পাবলিক, সারাক্ষণ বইতে মুখ গুঁজে থাকিস, তোদের আবার এরকম ভীমরতি হল কী করে”?

রায়া বলল, “ও কিছু না। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি বস”।

শুভ্র টুল টেনে বসল। শমীক বলল, “তুমি লাস্ট ইয়ারে আছো। তোমরা খুব ফরচুনেট, তোমাদের ক্যাম্পাসিং হয়েছে। জানি না আমাদের হবে নাকি”।

শুভ্র বলল, “হবে না কেন? না হবার তো কোন কারণ নেই”।

শমীক বলল, “এই যে ইনফ্লেশন হচ্ছে, কত জনের চাকরি চলে যাচ্ছে”।

শুভ্র বলল, “শোন ভাই, মেন্টাল প্রিপারেশন নিয়ে নে, চাকরি হোক আর না হোক, তোকে বাইরে যেতে হবে। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে”।

শমীক বলল, “আমি তো সেটাই চাই। আমি বাইরেই যেতে চাই”।

শুভ্র বলল, “তাহলে তো ঠিকই আছে। কোন সমস্যা নেই। ঘরকুনোদের কিছু হবে না। এখানে থাকলে একদমই কিছু হবে না”।

পিজির কাকিমা রায়ার জন্য দুধ দিয়ে গেলেন। রায়া সভয়ে বলল, “ওরে বাবা, এতটা দুধ আমি খেতে পারবো না”।

শিঞ্জিনী বলল, “খেতে তোকে হবেই। জলে পড়ে গিয়েছিলি। আয় তো অঞ্জনা”।

অঞ্জনা আর শিঞ্জিনী দুজনে মিলে জোর করে রায়াকে গোটা গ্লাসের দুধ খাইয়ে দিল। রায়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “কী করতে যে জলে পড়তে গেলাম। এতটা দুধ খেতে হবে জানলে জীবনেও জলে পড়তাম না”।

শুভ্র তাড়া দিয়ে বলল, “ওঠ ওঠ। আর বসে থাকিস না। ক্লাস না করলেও আমাকে ল্যাব অ্যাটেন্ড করতে হবে। তারপরে আবার সল্টলেকে যেতে হবে জাভার একটা ট্রেনিঙের ব্যাপারে খোঁজ নিতে। চল”।

সবাই হই হই করে বেরোল। কিছুক্ষণ আগের টেনশন কোথায় যেন ফুসমন্তর হয়ে গেল…

৫৫

অরুন্ধতী সৌরভের ল্যাবে এসে বলল, “কী হয়েছে? একটা মেয়ে নাকি জলে পড়ে গেছে? কী হয়েছিল জানো কিছু?”

সৌরভ বলল, “হ্যাঁ। বলছিল পা পিছলে পড়ে গেছে নাকি”।

অরুন্ধতী ভ্রু কুঁচকে বলল, “নেশা করে নাকি?”

সৌরভ হেসে ফেলল, “আরে না। ভাল মেয়ে। ওসব করে না। অন্য কিছু হবে”।

অরুন্ধতী বলল, “সুইসাইড অ্যাটেম্পট? জলে মরতে টরতে যায় নি তো?”

সৌরভ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল, “না না। এত দূর যেও না”।

অরুন্ধতী শ্বাস ছেড়ে বলল, “যাচ্ছি না। তবে ভয় হয়। এক একটা নিউজ দেখলে ভয় লাগে না? একটা খবর দেখলাম, কোন একটা মেয়ে তার বাবার কাছে ফোন চেয়েছিল। বাবা বলেছিল দশ দিন অপেক্ষা করতে। মেয়েটা সুইসাইড করল। এই প্রজন্ম খুব গোলমেলে”।

সৌরভ বলল, “তা ঠিক। তবে এখানে ভয়ের কিছু নেই। চাপ নিও না”।

অরুন্ধতী বলল, “ওকে। চাপ নেবো না। তুমি বল, তোমার বাড়িতে সব ঠিক আছে তো?”

সৌরভ বলল, “বাড়ি পুরো গরম হয়ে আছে। কেউ কথা বলছে না”।

অরুন্ধতী বলল, “সেটাই স্বাভাবিক। কথা বলবে না এখন। তোমার মাথায় কী হয় বল তো? সবাইকে খ্যাপাতে গেলে? তুমি কি কোন সমস্যায় আছো? আমাকে বন্ধু ভেবে বলতে পারো কিন্তু।”

সৌরভ একটু থমকে গিয়ে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না না। ভেবো না। আমি ঠিক আছি। মা আর বউদির ওসব কনজারভেটিভ কথা বার্তা শুনে মাথা গরম হয়ে গেছিল। বাকি সব ঠিক আছে”।

অরুন্ধতী বলল, “ঠিক আছে। দেখো, মাথা ঠাণ্ডা রেখো। আমার মনে হল তুমি খুব হুইমজিকাল। কী করছো নিজেও জানো না। আমিও ছিলাম। একই রকম। একটা বয়স থাকে, যখন আমরা অল্পে মুগ্ধ হয়ে যাই। ঠিক ভুল ভাবি না। জেদের বশে কাজ করে ফেলি। তোমার মা বা বউদিকে শাস্তি দিতে হলে আমাকে বা কোন ডিভোর্সিকেই বিয়ে করতে হবে, এই মানসিকতাটাই ভুলে যাও সৌরভ। এই দেখো, আমি তোমার সঙ্গে এত কথা টথা বলি, তোমার ল্যাবে আসি, হয়ত এটা নিয়েও আজে বাজে কথা রটতে পারে। সেটা আটকাতে গিয়ে আমরা কি এমন কিছু করব, যেটা হওয়া আদৌ ঠিক না? আমার মনে হয় তুমি এমন কিছুতে আটকে গেছো, যেটা তোমার মধ্যে কোন অপরাধবোধ তৈরি করছে। আছে কিছু এরকম?”

সৌরভ থতমত খেয়ে বলল, “না না। সেসব কিছু নেই। সব ঠিক আছে”।

অরুন্ধতী বলল, “তুমি শিওর তো?”

সৌরভ বলল, “হান্ড্রেড পারসেন্ট”।

অরুন্ধতী চলে যাচ্ছিল। দরজা থেকে ফিরে এসে বলল, “টেল মি ওয়ান থিং। কলেজের কনফেশন গ্রুপে তোমায় নিয়ে অনেক স্টুডেন্টই কনফেস করে। তুমি এরকম কোন সম্পর্কে কারো সঙ্গে জড়িয়ে পড় নি তো?”

সৌরভ বলল, “ধুস। এসব ভাবছ কেন”?

অরুন্ধতী বলল, “আমার কেন জানি না মনে হল। আমার গেসিং পাওয়ার খুব বেশি। কেন জানি না সেসব কেমন করে যেন মিলেও যায়। তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার যদি কোন স্টুডেন্টের সঙ্গে অ্যাফেয়ার হয়েও যায়, অপরাধবোধে ভুগো না। এটা এমন কিছু আউট অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ব্যাপার না। এরকম হতেই পারে। কত হয়। লোকে কী বলবে সেসব ভেবে মাথা খারাপ করার কোন মানে হয় না”।

সৌরভ বলল, “তুমি এসব বলছো কেন? সেসব কোন ব্যাপার না। অপরাধবোধের কোন গল্প নেই”।

অরুন্ধতী বলল, “না থাকলেই ভাল। তুমি আমার ভাল বন্ধু। একজন ব্যালান্সড মানুষও বটে। এরকম কেউ যখন হঠাৎ করে আউট অফ দ্য ট্রাক বিহেভ করে, তখন খটকা লাগে”।

সৌরভ হাসল, “না না। ভেবো না। ইটস ওকে”।

অরুন্ধতী কাঁধ ঝাঁকাল, “বেশ। ওকে হলে ভাল। আমি আসি। বিকেলে চায়ের ঠেকে দেখা হবে”।

সৌরভ বলল, “ঠিক আছে”।

অরুন্ধতী বেরিয়ে যেতে সৌরভ জোরে শ্বাস ছাড়ল।

অরুন্ধতী অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। ওর আই কিউ পাওয়ার অত্যন্ত বেশি। এত আই কিউ পাওয়ার থাকা কারো কাছে সত্যিটা লুকিয়ে রাখা সত্যিই কঠিন।

রায়ার জন্য অপরাধবোধ হচ্ছিল। তার থেকে কথাটা শুনেই মেয়েটা বোকার মত কাজটা করেছে। অতটা কঠোর না হলেই ভাল হত।

কী করবে সে? কিছু কি করার আছে? অসহায়ের মত বসে রইল সৌরভ।

৫৬

“তোর কিন্তু আমাকে ট্রিট দেওয়া উচিত”।

অটো থেকে নেমে শুভ্র কলেজের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে রায়াকে বলল।রায়া বলল, “কেন? কী আনন্দে ট্রিট দেবো?”

শুভ্র হাঁ করে রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “আজব পাবলিক তো তুই? তোকে বাঁচালাম, আর তুই এসব বলছিস?”

রায়া বলল, “বাঁচানোর কী আছে, আমি সাঁতার জানি তো”।

শিঞ্জিনী শুভ্রকে বলল, “সব সময় ছকের চেষ্টায় আছো না তুমি? ভাল্লাগে?”

শুভ্র বলল, “তোরা তো ডেঞ্জারাস পাবলিক সব। এখানে ছকের কী আছে? তুই বল, আমি না থাকলে কী হত? এই জন্য তোদের সবারই উচিত আমায় ট্রিট দেওয়া। ঠিক ঠাক লোক থাকলে আমায় রাষ্ট্রীয় সম্মান দিত, বুঝলি?”শিঞ্জিনী বলল, “রায়ার সঙ্গে ছক করে লাভ নেই। তুমি অন্য কোন দিকে দেখো। এটা কি সিনেমা পেয়েছো, নায়িকাকে বাঁচাবে আর নায়িকা তোমার কোলে বসে পড়বে?”

শুভ্র পকেট থেকে বিড়ির প্যাকেট বের করে বিমর্ষ গলায় বলল, “দূর দূর, দেশটাই নিমকহারাম হয়ে গেছে। কাউকে আর কিছু বলাই যাবে না। কী হত একটা ছোট ট্রিট দিলে? একটা ছোট বিরিয়ানির প্যাকেট, একটা চকলেট, কত আর খরচা হত, তিনশো টাকা?”

অঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে। আমরা সবাই না হয় কলেজের পর কোথাও মিট করব। তোমার টাকাটা আমরা সবাই মিলে ভাগাভাগি করে দিয়ে দেব”।শিঞ্জিনী বলল, “যদিও তুমি সিনিয়র, তোমারই উচিত ছিল আমাদের খাওয়ানো”।শুভ্র বিড়ি ধরিয়ে বলল, “এই তোরা যা। তোদের কাউকে খাওয়াতে হবে না। অনেক হয়েছে”।

শিঞ্জিনী বলল, “ঠিক আছে। অনেক হয়েছে। এক কাজ কর, তুমি শমীককে তোমার নাম্বারটা দিয়ে দাও। আমরা কলেজ থেকে বেরিয়ে তোমার সঙ্গে মিট করে নেবো”।

শুভ্র বলল, “কেন? তোর নাম্বার দিতে কী হয়? তুই কে রে? আলিয়া ভাট?”শিঞ্জিনী বলল, “আমি কে তা জানি না, তবে তুমি যে মস্ত বড় ভাট সে নিয়ে কি কোন ডাউট আছে? শমীক, দাদাইয়ের নাম্বারটা নিয়ে নে”।শুভ্র বিড়ি টানতে টানতে শমীককে বলল, “আমার নাম্বার আছে তোর কাছে। ঠিক আছে। মিসড কল মেরে দে একটা। বিড়িটা শেষ করে লাইব্রেরী যাবো। আর তোদের বন্ধুকে বলে দে, আর জলে ডোবার প্ল্যান থাকলে আগে থেকে বলে দিতে। আমি এক্সট্রা জামা প্যান্ট নিয়ে আসবো”।আর বি ম্যামের ক্লাস চলছিল। তাদের ঢুকতে দেখে বাকিরা কৌতূহলী চোখে তাকাল। দাশু শমীকের ঘাড়ের কাছে এসে বলল, “এ কী রে? এতো পুরো রামধনু জোট। কী কেস?”

ম্যাম দাশুকে বললেন, “কী হল? তোমার কী হয়েছে? লাফ ঝাঁপ দিচ্ছো কেন? এমনিতে তো ক্লাসেও দেখি না। বল তো কী পড়াচ্ছিলাম”।দাশু বসে ছিল।

ম্যাম বললেন, “উঠে দাঁড়াও”।

দাশু দাঁড়াল। ম্যাম বললেন, “কী পড়াচ্ছিলাম”?

দাশু আমতা আমতা করে বলল, “ম্যাম, অ্যাকচুয়ালি একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল তো, সেটা নিয়েই জিজ্ঞেস করছিলাম। আফটার অল, সি ইজ আওয়ার ক্লাস মেট”।

ম্যাম বললেন, “হ্যাঁ। রাইট। রায়া, ঠিক আছো তো? কী হয়েছিল?”

রায়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ম্যাম, পুকুরে পড়ে গেছিলাম। এখন ঠিক আছি”।ম্যাম বললেন, “ক্লাস না করে পুকুর পাড়ে কী করছিলে? তুমি তো ভাল মেয়ে। তোমার আবার কী হল? বাংক মেরেছিলে?”

রায়া বলল, “না ম্যাম, আমি পিজিতে যাচ্ছিলাম। পার্স আনতে ভুলে গেছিলাম। ওই তাড়াহুড়োতেই অ্যাক্সিডেন্টটা হয়ে গেছে”।

ম্যাম উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল বল তো, দেখে শুনে চলবে সবাই। কলেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন খুব শিগগিরি পুকুরের দিকটা ঘিরে দিচ্ছে। তার আগে অবধি ওদিকটা সবাই সাবধানে যেও। আজই আমি ডিরেক্টর স্যারকে জানাচ্ছি। বস। আর তুমি দাঁড়িয়ে থাকো”।

দাশু গোটা ক্লাস দাঁড়িয়ে রইল। ম্যাম বেরিয়ে যেতে দাশু রায়াকে বলল, “কী রে, তুই কি আজকাল গাঁজা টাজা টানছিস নাকি? অতো বড় রাস্তা ছিল আর তোকে পুকুরের ধার দিয়েই হাঁটতে হল?”

শিঞ্জিনী বলল, “তাতে তোর কী? নিজের চরকায় তেল দে তুই”।

দাশু বলল, “ওকে ওকে। আমি জাস্ট খোঁজ নিচ্ছিলাম আর কী”।

শিঞ্জিনী বলল, “তোকে অতো খোঁজ নিতে হবে না। কোত্থেকে মার খেয়ে নাক মুখ ফাটিয়ে এসেছিস, তুই নিজের খোঁজ নে আগে”।

দাশু কাঁধ টাধ ঝাঁকিয়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে গেল।

৫৭

সাগ্নিক লালুদার দোকানে বসে ছিল। দাশু সাগ্নিককে দেখে বলল, “কী বে, এখনও মন খারাপ নাকি?”

সাগ্নিক বলল, “ব্রেক আপ করিস নি তো কোনদিন, তুই কী করে বুঝবি?”

দাশু বলল, “বোঝাবুঝির কী আছে? গরু গাধায় প্রেম করে। তুই সেই গরু গাধা”।

সাগ্নিক রাগল না। বলল, “গরুই বটে। কী আর করব। জীবনটাই শেষ হয়ে গেল”।

দাশু শুভ্রকে আগে থেকে চেনে। লালুদার দোকানের বিড়িখোরেদের অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি টাইপ এখন শুভ্র। পুকুরে পা ডুবিয়ে বিড়ি খাচ্ছিল। দাশু গলা ছাড়ল, “তুমি তো এখন হিরো গুরু। তোমারই বাজার”।

শুভ্র বলল, “ভাগ শালা। তোদের ক্লাসের মেয়ে না? কী কেস? ব্যথা ট্যাথা আছে নাকি?”

দাশু বলল, “কে জানে। আমি কিছু জানি না”। সাগ্নিক বলল, “শালা, তুই জানিস না? তুই হলি আমাদের ক্লাসের বিবিসি, তুই জানবি না হয় নাকি”।

দাশু জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “মাইরি বলছি। আমি কিছু জানি না”। শুভ্র বলল, “একেকটা পাবলিক একেক রকম। এই জন্য মেয়েদের বিড়ি টানা দরকার। ওই মেয়েটাকে লালুদার দোকানে নিয়ে আসিস। বিড়ি টানলে ঠিক হয়ে যাবে”।

দাশু বলল, “গুরু খুব ইচ্ছা মনে হচ্ছে? পছন্দ হয়েছে?”

শুভ্র বলল, “পছন্দর কী আছে? মেয়ে হোক বা ছেলেই হোক, ব্রেক আপের পরে বেশি ফ্রাস্ট্রু খেতে নেই। বিড়ি খেতে হয়। বিড়িতেই সব ঠিক হয়ে যায়”। দাশু জুতো খুলে শুভ্রর পাশে বসে জলে পা ডুবিয়ে দিয়ে বলল, “বলছি তখন রায়া কি খুব বেশি ফ্রাস্ট্রু খেয়ে ছিল?” শুভ্র দাশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “কেন? কী কেস? তুই জানিস?”

দাশু বলল, “না মানে এমনি জানতে চাইছি”। শুভ্র বলল, “তুই কিছু না বললে আমিও কিছু বলব না। বললে বল, নাহলে ফুটে যা। ঝাঁট জ্বালাস না”।

দাশু এদিক ওদিক তাকাল। তারপর বলল, “রায়ার ব্যথা ছিল। তারপর কেটে গেছে মনে হয়”।

সাগ্নিক দেখছিল দাশু শুভ্রর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলছে। সে বলল, “কিরে, কী বলছিস তুই?”

শুভ্র হাত তুলে সাগ্নিককে বলল চুপ করতে। সাগ্নিক চুপ করে গেল। শুভ্র দাশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “কার উপর চাপ ছিল?”

দাশু বলল, “সৌরভ স্যার”।

শুভ্র কাশতে শুরু করল। কাশতে কাশতে বলল, “সৌরভ স্যার? তা হতেই পারে। এরকম কত কিছুই তো হয়। স্যার ব্যাথা দিয়েছে বলছিস?”

দাশু বলল, “আমি কিছু বলছি না। আমার মনে হল, সেটাই বললাম। ওয়াইল্ড গেস”।

শুভ্র বলল, “ঠিক আছে। আচ্ছা শোন, ওর সঙ্গে যে মেয়েটা থাকে না, খুব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে… কী যেন নাম…”

দাশু বলল, “শিঞ্জিনী?”

শুভ্র উদাস গলায় বলল, “হ্যাঁ, ওই শিঞ্জিনী না কী একটা হবে। ওর বয়ফ্রেন্ড আছে?”

দাশু বলল, “না। তবে আমাদের ক্লাসের শমীকের ওপর ওর চাপ আছে। শমীক আবার অঞ্জনার বন্ধু। ওই নিয়ে হেবি ক্যাচাল লাগে”।

শুভ্র চোখ মুখ কুঁচকে বলল, “এই জন্য বাঙালির কিছু হল না। কত এলিজিবল ব্যাচেলর ঘুরে বেড়ায়, আর এরা একটা ছেলেকে নিয়ে দুটো মেয়ে গুঁতোগুঁতি করে। গাধা কোথাকার”।

দাশু বলল, “সেই তো। কোথায় তোমার মত একটা হ্যান্ডু বিড়িখেকো দাদা ছিল, তোমার কাছে এসে ডাইভ দেবে, তা না…”

শুভ্র কড়া চোখে দাশুর দিকে তাকাল। দাশু তড়িঘড়ি করে জল থেকে পা তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা, আসি হ্যাঁ। ভাল থাকো”।

শুভ্র বলল, “ভাগ পাগলা। যতসব জোটেও”। দাশু পালাল।

এর কিছুক্ষণ পরেই কলেজ কনফেশন গ্রুপে একটা কনফেশন পোষ্ট হল।

#কলেজ কনফেশন

#এম/২১/নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

প্রিয় শিন, তোকে আমি হেবি ভালোবাসি। তুমি আমার জন্যই পৃথিবীতে এসেছ। তুমি জানো না তোমাকে আমি কত ভালোবাসি। আমাকে এক প্যাকেট বিড়ি কিনে দেবে গো?

ইতি তোমার যিনি”।

পোস্টটা পেজ থেকে করে ফিক ফিক করে হাসতে লাগল দাশু। এবার খেলা জমবে।

৫৮

কলেজ শেষের পর কলেজ থেকে বেরিয়ে সৌরভ দেখল শমীক, অঞ্জনা, রায়া, শিঞ্জিনীরা হাঁটছে। তার থেকে খানিকটা এগিয়ে হাঁটছে তারা। জোরে জোরে হাসছে, এক জন আরেকজনের পেছনে লাগছে।

দূর থেকে দেখতে ভাল লাগছিল তার। এটাই তো কলেজ জীবন। বেশি চিন্তা নেই, হেরে যাওয়ার মালিন্য নেই, একজন আঘাত পেয়ে পড়ে গেলে আরেকজন হাত বাড়িয়ে ডেকে নেয়… জীবনের সোনার সময় এখন। একটু ঠিক ঠাক গাইডেন্স পেলে এরা অনেক দূর যাবে।

হাঁটতে হাঁটতে নিজেকেও দেখতে পায় সে। ভাল লাগছে ওদের দেখে। ফোন বেজে উঠল তার। ধরল সে, “হ্যালো”।

-গুড ইভনিং স্যার।

-গুড ইভনিং।

– আমি রিচা বলছি স্যার উইলসন এন্ড সন্স থেকে বলছি।

-বলুন রিচা।

– স্যার, লাস্ট উইক আপনি ভিডিও কনফারেন্সিং এ ইন্টারভিউ দিয়েছিলেন আমাদের কোম্পানিতে।

-হ্যাঁ।

-স্যার, আপনাকে এটা জানানোর জন্য আমি ফোন করছি যে আপনি সিলেক্টেড হয়েছেন। আপনি কি এই উইকের মধ্যে আমাদের মুম্বই অফিসে আসতে পারবেন? কিছু অফিসিয়াল পেপার ওয়ার্কস আছে। আপনি যদি চান আপনাকে আপনার এয়ার টিকেট পাঠিয়ে দেব। স্যার আপনি কি আসবেন?

থমকে দাঁড়িয়ে গেল সৌরভ। তার পা-টা হঠাৎ করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। কলেজ লাইফে এরকম হত। উত্তেজনা হোলেই পা কাঁপতে শুরু করে দিত।

চাকরিটা হয়ে গেল? তার স্বপ্নের চাকরি! সে বলল, “রিচা, আপনি কি আমাকে কাল সকাল দশটায় ফোন করতে পারবেন? আমি যদি তখন বলি? আমি এখন যেখানে চাকরি করি সেখান থেকে ছুটি নেওয়ার ব্যাপার থাকবে, তাই এখানে কথা বলে আপনাকে জানাই?”

রিচা বলল, “শিওর স্যার। হ্যাভ এ গ্রেট ডে”।

“থ্যাঙ্ক ইউ” বলে ফোন রাখল সৌরভ।

কলেজ শিক্ষকতার জীবন শেষ হবে এবার? উইলসনের ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য কতদিনের প্রস্তুতি ছিল তার! পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। এ শহর ছেড়ে যাওয়া হবে তাহলে শেষ মেশ!

এ শহরে আর কিছু নেই। কিচ্ছু নেই। পালানো হবে তাহলে! সৌরভ দাঁড়িয়ে পড়ল। শিক্ষকতায় ঢোকার সময় অনেক স্বপ্ন ছিল। ভাল শিক্ষক হবে। নতুন প্রজন্মকে তৈরি করবে। মোহভঙ্গ হয়েছিল কি? হবে হয়তো।

কিংবা শহর ছাড়ার জন্যই বেশি তাড়া ছিল। ইদানীং কিছুই সহ্য হয় না তার। বড় তাড়াতাড়ি মোহভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল। সবাই কেমন আপোষের স্রোতে ভাসছে। পালিয়ে যাওয়ার জন্য এর থেকে ভাল সুযোগ আর কিছু হতে পারত না।

বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখল অরুন্ধতী তার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দল থেকে রায়াও দেখল সেটা। সৌরভ অরুন্ধতীর কাছে গিয়ে বলল, “চা খেয়ে নিয়েছো?”

অরুন্ধতী বলল, “তোমার জন্যই দাঁড়িয়ে আছি। এই আড্ডাটারও তো দরকার আছে”।

সৌরভ হাসল, “ঠিক, ঠিক”।

অরুন্ধতী বলল, “অনলাইন ক্লাস করে করে স্টুডেন্টগুলোর হাল খুব খারাপ হয়ে গেছে। দুপুরবেলা কতজন যে হাই তুলছে। কী অবস্থা ভাবো”।

সৌরভ বলল, “আমিও যখন কলেজে পড়তাম, দুপুরে হাই উঠত। হাই তো উঠবেই। এখন বলতে পারো ফ্রিকোয়েন্সিটা বেড়েছে”।

অরুন্ধতী বলল, “বেড়েছে মানে সাংঘাতিকভাবে বেড়েছে। ভয়াবহভাবে বেড়েছে। লকডাউনের পর অন্তত পাঁচ বছর লাগবে সব স্বাভাবিক হতে। আচ্ছা, একটা ভাল খবর আছে। আমার প্রাক্তনবাবু ফোন করেছিলেন। আমায় মুক্তি দেওয়ার কথা অফিশিয়ালি আমাকে ফোন করে ঘোষণা করলেন। আমি মারাত্মক খুশি আজ। কী খাবে বল”।

সৌরভ বলল, “যা খাওয়াবে। তাহলে কি চা খাবে না?”

অরুন্ধতী বলল, “না। স্যুপ খাবো। ওই যে একটা চাইনিজ রেস্তোরাঁ হয়েছে না, ওটায় চল”।

সৌরভ বলল, “চল”।

দুজনে হাঁটতে হাঁটতে রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখল রায়ারাও সেটায় ঢুকেছে। সৌরভ দেখল রায়ার মুখটা ছাইবর্ণ হয়ে গেল। সে অন্যদিকে তাকাল। অরুন্ধতী ওদের দেখে বলল, “আমরা ফার্স্ট ফ্লোরে যাই চল। ওরা কাছে থাকলে অকওয়ারড লাগবে”।

সৌরভ বলল, “চল। আমার মনে আছে আমাদের স্যারেরা একবার আমাদের সরস্বতী পুজোর চাঁদা কেটে আসার পর রসগোল্লা খাইয়েছিলেন”।

অরুন্ধতী থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “তুমি কি বল? আমার কি ওদের খাওয়ানো উচিত?”

সৌরভ হাসল, “এই ব্যাপারে আমিও কনফিউজড”।

অরুন্ধতী বলল, “আচ্ছা, ব্যাপারটাকে প্রফেশনাল দিক থেকেই দেখি। ওরা ওদের মত থাকুক। আমরা ফার্স্ট ফ্লোরে যাই”।

সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় গেল তারা। সৌরভ বলল, “আচ্ছা আমি একবার নিচ থেকে আসি। ওদের সঙ্গে কথা বলে এলাম না, ঠিক হল না বোধ হয়”।

অরুন্ধতী অবাক হল, “হঠাৎ”?

সৌরভ ইতস্তত করে বলল, “আচ্ছা থাক”।

অরুন্ধতী তার চোখের দিকে তাকাল, “কী হয়েছে সৌরভ? এদের মধ্যে একটা মেয়েই আজকে জলে পড়ে গেছিল না”?

সৌরভ হাসার চেষ্টা করল, “হ্যাঁ। তবে আমি সে জন্য যাচ্ছি না। আফটার অল ওরা আমাদের স্টুডেন্টস। এভাবে ইগনোর করে চলে এলাম…”

অরুন্ধতী বলল, “বস। চলে যখন এসেছো, ঠিক আছে। এখন গেলেই বরং ব্যাপারটা খারাপ দেখায়। টিচার স্টুডেন্ট রিলেশনশিপের বাইরেও আমাদের একটা লাইফ আছে। বল কী খাবে? স্যুপ বলি?”

সৌরভ বলল, “বল”।

অরুন্ধতী বলল, “আজ কেন জানি না, হঠাৎ করে মনে হল তোমার প্রপোজালটা নিয়ে ভাবা যেতেই পারে। জীবনকে এখনই এক্সপ্লোর করা বন্ধ করাটা ঠিক হবে না। পরক্ষণে মনে হল, ধুস, কীসব ভাবছি। তোমার বাড়িতে আবার একটা ঝামেলা… কিছু মনে কোর না হ্যাঁ, বন্ধু মনে করি বলেই এই কথাটা বলে ফেললাম”।

সৌরভ বলল, “আমি এই চাকরিটা ছাড়ছি অরুন্ধতী। শহরটাও”।

অরুন্ধতী চমকে তাকাল সৌরভের দিকে।

৫৯

সৌরভ আর অরুন্ধতীকে রেস্তোরাঁয় ঢুকতে দেখে রায়ার ছাইবর্ণ মুখটা দেখতে পেল অঞ্জনা। রায়ার হাত ধরে বলল, “ওই, তুই কাদের সঙ্গে এসেছিস? আমাদের দিকে তাকা”।

রায়া হেসে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল, “ও হ্যাঁ হ্যাঁ। সরি রে। হঠাৎ করে এসব দেখলে চাপ হয়ে যায় আর কী”!

শমীক বলল, “তুই একটা মাইন্ডসেটে চলে আয়। এরকম দেখবি, স্যারের ক্লাসও করবি স্বাভাবিকভাবে। ব্যাপারটাকে পুরো ফরম্যাট করে ফেল, দেখবি কোন অসুবিধে হবে না”।

শিঞ্জিনী বলল, “তোরা তো জানিস না রায়া কতটা ইনভল্ভ হয়ে গেছিল। কিছুটা সময় তো দিতে হবে”।

শমীক বলল, “আমার মনে হয় শুরু থেকেই প্র্যাকটিস করতে হবে। এটা তো ব্রেক আপের মত, ব্রেক আপ হ্যান্ডেল করতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না”।

অঞ্জনা বলল, “অ্যাজ ইফ তোর প্রচুর এক্সপেরিয়েন্স আছে”।

শমীক থতমত খেয়ে গেল।

শিঞ্জিনী বলল, “লাভ বার্ডস দোতলায় চলে গেল দেখলি? আমাদের দেখে লজ্জা পেল মনে হয়”।

রায়া বলল, “এসব কথা এখন থাক। বাদ দে”।

শিঞ্জিনী বলল, “ওকে ওকে। আচ্ছা ওই বিড়িখোরটা কোথায় গেল রে? আসব বলে এল না তো”।

শমীক বলল, “ওই তো। আমি ফোন করেছিলাম, বলছিল একটু দেরী হবে। এসে গেছে দেখ”।

শুভ্র একটা লাল সবুজ রঙের টি শার্ট পরে এসেছে। শিঞ্জিনী সেটা দেখেই হেসে দিল, “একী? এতো পুরো টিয়া পাখি”।

শুভ্র চেয়ার টেনে বসে বলল, “হয়েছে হয়েছে। এসব তোরা বুঝবি না। এটাই এখন মডার্ন স্টাইল”।

শিঞ্জিনী বলল, “তুমি কি এখানে আসবে বলে আবার পিজিতে ফিরে চেঞ্জ করে এলে?”

শুভ্র বলল, “না। সেটা কেন হবে? আমি এমনিই পিজিতে গেছিলাম”।

শিঞ্জিনী বলল, “তুমি যে বলছিলে কলেজের পরে কোথায় জাভার ব্যাপারে খোঁজ নিতে যাবে। গেলে না?”

শুভ্র বলল, “হায় হায়, মামণি আমার সব কথা মনে রেখেছে। ভাবতেই দিল খুশ হয়ে গেল”।

শিঞ্জিনী বলল, “মনে না রাখলে ঢপ ধরা পড়বে কী করে?”

শুভ্র বলল, “কীসের ঢপ? আমি ঢপ মারতে যাবো কেন? আচ্ছা শোন না, এস ডি কেমন পড়াচ্ছে তোদের?”

শমীক শুভ্রকে ইশারা করল গলা নামিয়ে কথা বলতে। শুভ্র অবাক হয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছে”?

শমীক বলল, “উনি এখানেই আছেন। উপরে। অরুন্ধতী ম্যামের সঙ্গে এসেছেন”।

শুভ্র রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “অ। ওরাই এখন ইস্মার্ট জোড়ি নাকি রে?”

শিঞ্জিনী বলল, “হ্যাঁ। এসডির কথা তোমাকে কে বলেছে? এসব বলছো, জানতে পারলে ইন্টারনাল ঝুলিয়ে দেবে তো”।

শুভ্র কথাটা উড়িয়ে দেওয়ার ভাব করে বলল, “ছাড় তো। কত দেখলাম। ইন্টারনাল দিয়ে কী হবে?”

শমীক হতভম্ব গলায় বলল, “মানে? ইন্টারনাল দিয়ে কী হয় মানে? কী বলছ এসব?”

রায়া বলল, “এস ডি কখনো ক্ষতি করবেন না কারো। উনি সেরকম লোকই নন। এসব বলার কোন মানে হয় না”।

শুভ্র বলল, “স্যার কিন্তু চরম পড়ায়। আমি অন্যদের ক্লাস বাঙ্ক মারলেও কখনো স্যারের ক্লাস বাঙ্ক মারি নি। অরুন্ধতী ম্যাম একটু খরুস টাইপ। কেমন যেন”।

শমীক বলল, “এই কথাগুলো এখানে না বলাই ভাল। ওরা শুনতে পাবে। ছাড়ো না”।

শুভ্র বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। এটাও ঠিক। ওরা এখন হট টপিক নাকি কলেজে?”

অঞ্জনা বলল, “কে কী করল সেটা কেউ পাত্তা দেয় না। এরকম তো কতই হয়, হট টপিকের কিছু নেই”।

শুভ্র হাত নেড়ে বলল, “ধুস তুই কিছু জানিস না। সবাই সব কিছু বোঝে। শুধু চেপে থাকে”।

ওয়েটার এল। শুভ্র বলল, “পাঁচটা ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন”।

শিঞ্জিনী বলল, “আরে এ পাগল নাকি? অতো নেয় কেউ? তিনটে দিন, পাঁচটা করে নেওয়া যাবে”।

শুভ্র বলল, “বাহ, তোর মধ্যে একটা গিন্নি গিন্নি ব্যাপার আছে তো”।

সবাই হেসে ফেলল। শিঞ্জিনী রেগে গেল, “ভাট বকা বন্ধ কর বিড়ি খোর। এখানে বললে না বিড়ি দিতে, বিড়ি নিতে পারতে তো”।

শুভ্র বলল, “রাইট। ওয়েটারকে ডাকি?”

শুভ্র ডাকতে যাচ্ছিল শিঞ্জিনী নুনের কৌটো ছুঁড়ে মারল ওর দিকে।

অঞ্জনার ভাল লাগছিল। এতদিন তারা একসঙ্গে পড়ছে, কোন দিন এরকম কোথাও খেতে যায় নি তো! শুধু কলেজ আর বাড়ি করে গেছে।

কেন যায় নি? এগুলোরও কি দরকার ছিল না?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *