৪০
“তোর পিরিয়ড ক্লিয়ার হয়েছে?”
ক্যান্টিনে সুকন্যাকে জিজ্ঞেস করল সাগ্নিক।
সুকন্যা বলল, “কেন? আবার যাবি?”
সাগ্নিক মাথা চুলকাল, “না, মানে তুই না যেতে চাইলে যাবো না। তুই কি চাস?”
সুকন্যা বলল, “এখন ইচ্ছে নেই। ইচ্ছে হলে বলব”।
সাগ্নিক কাঁধ ঝাঁকাল, “ঠিক আছে”।
সুকন্যা বলল, “তুই আমাকে একটা কথা বল, হোটেলে গিয়ে সেক্স করলেই আমরা বেশি ভালবাসব?”
সাগ্নিক বলল, “আমি কী জানি? ওই ডিসিশনটা দুজনেই নিয়েছিলাম”।
সুকন্যা বলল, “শোন ভাই, তোকে একটা কথা বলি। এই যে হোটেল হোটেল করছিস, ওই সব করার পর কী হয় জানিস? মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়। ছেলেটা না। এবার আমার কিছু হবার পর আমি নিজেও জানি না কী করতে হবে। তখন আমাকে কে দেখবে? তুই তো পালাবি”।
সাগ্নিক বলল, “কেন পালাবো? আমি পালাবো না। আমি যা করার করব। আমরা বিয়ে করে নেব”।
সুকন্যা সাগ্নিকের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল, “এগুলো এখন বলছিস। তখন বলবি না। তখন সব মাথা ব্যথা আমার হয়ে যাবে। দরকার নেই। এরকমই ভাল”।
সাগ্নিক বলল, “ঠিক আছে, আমি আর হোটেলে যাবার কথা বলব না। তবে তুই ভেবে দেখিস, সেদিন সিনেমা হলে কিস করতে করতে তুইই বলেছিলি এভাবে হয় না”।
সুকন্যা বলল, “ভাল তো। এখন আমিই বলছি এভাবে হয় না। ঠিক আছে?”
সাগ্নিক বলল, “ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাইই ঠিক। কোন অসুবিধে নেই”।
সুকন্যা বলল, “ক্লাস করবি না? পর পর তিনটে ক্লাস আছে এর পর”।
সাগ্নিক বলল, “ভাল লাগছে না”।
সুকন্যা বলল, “হোটেলে যাবো না বলায় ভাল লাগছে না, তাই তো?”
সাগ্নিক বলল, “সেসব কিছু না। তুই কেমন যেন হয়ে গেছিস সেদিন থেকে। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না”।
সুকন্যা বলল, “তা ঠিক। আমি অ্যাকচুয়ালি অনেক কিছু ভেবেছি”।
সাগ্নিক বলল, “কী ভেবেছিস?”
সুকন্যা বলল, “রিলেশনশিপে একটা এজ ডিফারেন্স হওয়া উচিত। তোর বয়সে তোর উচিত ক্লাস টুয়েলভ বা ইলেভেনের কোন মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা। সেম এজ রিলেশনশিপ ইজ নট কুল”।
সাগ্নিক হতভম্ব মুখে বলল, “মানে? তুই কি ব্রেক আপ করতে চাইছিস?”
সুকন্যা বলল, “ব্রেক আপটা তো চাপের শব্দ, তার আগে তুই কনফার্ম কর, আমরা কি রিলেশনে আছি?”
সাগ্নিক বলল, “অবভিয়াসলি। আমরা রিলেশনে আছি না নেই তুই জানিস না?”
সুকন্যা বলল, “তুই তো জানিস। তুই বল”।
সাগ্নিক বলল, “আমি তো বলছি আমরা রিলেশনশিপে আছি। আমি ক’দিন ধরেই দেখছি তুই আমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছিস। কিছু একটা কেস হয়েছে। তোর কি অন্য কাউকে পছন্দ? বেরোতে চাইছিস?”
সাগ্নিককে দেখে বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। তার কাঁদো কাঁদো অবস্থা হয়ে গেছে।
সুকন্যা বলল, “আমার একটু সময় চাই। ক’টা দিন তুই আমায় ফোন করিস না। আমরা একটু দূরে থাকি একে অপরের থেকে। যদি আমাদের মধ্যে রিলেশনশিপ বলে সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে আবার প্যাচ আপ করা যাবে?”
সাগ্নিক দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, “হয়ত এটাই হবার ছিল। আমারও মনে হচ্ছিল তুই বেরোতে চাইছিস”।
সুকন্যা বলল, “ঠিকই মনে হয়েছিল। আমি ক্লাসে যাচ্ছি। তুই গেলে চল। এন্ড বিহেভ লাইক এ ম্যাচিওর পারসন প্লিজ। একটা ব্রেক আপেই সব কিছু শেষ হয়ে যায় না”।
সাগ্নিক বলল, “ঠিক আছে, বাই”।
সুকন্যা বলল, “আর শোন না, আমাকে এখন মেসেজ করিস না। ফেসবুকে আপাতত ব্লক করব। পরে যদি বুঝি, অ্যাড করে নেব। ওকে?”
সাগ্নিক বলল, “ওকে”।
সুকন্যা চলে গেল। সাগ্নিক চুপ করে বসে রইল। দাশু এল, “কী বে, তোর মুখটা এরকম হয়ে গেছে কেন? কেউ পেছন মেরে দিয়ে গেছে নাকি?”
সাগ্নিক লাল চোখে দাশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “এখন যা”।
দাশুর স্বভাব মোটেও চুপ করে যাওয়ার না। সে সাগ্নিকের সামনে বসে পড়ে বলল, “বল না বল না। কী হয়েছে বল না”।
সাগ্নিক দাশুর মুখে ঘুষি মারল। দাশু মেঝেতে পড়ে গেল। পরক্ষণেই উঠে দাঁড়িয়ে সাগ্নিককে মারতে গেল। দুজনের মারপিট শুরু হয়ে গেল।
৪১
এন সি স্যারের ক্লাসে ঢুকে রায়া দেখল শিঞ্জিনী আবার আগের ডেস্কেই বসেছে। সে শিঞ্জিনীর পাশে গিয়ে বসল। শিঞ্জিনী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
রায়া বলল, “কিছু না। ঠিক আছে”।
শিঞ্জিনী বলল, “কী ঠিক আছে? ডেকে নিয়ে গেল কেন?”
রায়া বলল, “পরে বলছি”।
শিঞ্জিনী অঞ্জনার দিকে তাকাল। তার প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিল ক্লাসের মধ্যেই অঞ্জনার মুখে একটা চড় মেরে আসে। মাথায় আগুন জ্বলছে।
ক্লাস শেষ হলে শমীক ডেস্ক থেকে উঠে দাঁড়াল। অঞ্জনা বলল, “কোথায় যাচ্ছিস?”
শমীক বলল, “আমার কাজ আছে। আমি পিছনের ডেস্কে যাবো”।
অঞ্জনা বলল, “কী কাজ?”
শমীক উত্তর দিল না। পেছনে একটা ডেস্কে গিয়ে বসল। শিঞ্জিনী বলল, “তুই কি এখন শমীকের সিকিউরিটির কাজ করছিস? এমন পজেসিভনেস দেখাচ্ছিস যে গার্লফ্রেন্ডরাও এত দূর করে না।”
অঞ্জনা শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তো?”
শিঞ্জিনী বলল, “তো আর কী? যেটাই করিস, লাভ তো কিছু হচ্ছে না। তোকে কাটিয়ে দিচ্ছে দেখা যাচ্ছে তো”।
অঞ্জনা বলল, “কে দেখল? তোর সঙ্গে এত কথা বলছিই বা কেন? গো টু হেল”।
শিঞ্জিনী বলল, “নাকটা এত বড় রাখিস না। যেদিন কাটা যাবে, বুঝবি”।
অঞ্জনা বলল, “সেটা সেমের রেজাল্ট বেরোলেই বোঝা যাবে কার নাক কাটা যাবে”!
শিঞ্জিনী বলল, “তাই? রেজাল্টে নাকের শেপ থাকে বুঝি? তুই লোকজনের সঙ্গে যাচ্ছেতাই বিহেভ করবি, আর ভাববি রেজাল্ট ভাল হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে? ব্যাপারটা এতটাই সোজা?”
অঞ্জনা বলল, “আমার তোর সঙ্গে কথা বলতে ভাল লাগছে না”।
শিঞ্জিনী বলল, “আর আমার তো খুব ভাল লাগছে”।
দাশু ক্লাসে ঢুকল। তার চোখের তলায় কালশিটে পড়ে গেছে। শিঞ্জিনী অবাক হয়ে বলল, “তোর কী হল?”
দাশু বলল, “আরে সাগ্নিকের সঙ্গে একটা অ্যাকশান সিকোয়েন্স হয়ে গেল। ছোট খাটো ক্যালাকেলি। মালের মনে হয় ঝগড়া হয়েছে, পুরো ফালতু কেলিয়ে দিল”।
শিঞ্জিনী বলল, “ফার্স্ট এইডে যা। পরে ব্যথা করবে”।
দাশু বলল, “আরে এখনই ব্যাথা করছে”।
দাশুর চোখ পড়ল শমীক পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। সে শমীকের পাশে গিয়ে বসে পড়ল, “কিবে, তোর নাকি এখন প্রচুর ডিমান্ড? শিঞ্জিনী আর অঞ্জনা দুজনেই তোর জন্য প্রদীপ জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছে। যা তা ব্যাপার তো রে ভাই!”
শমীক বিরক্ত গলায় বলল, “চুপ কর না। সাগ্নিক তোকে মেরেছে ঠিকই করেছে। পারলে আমিও মারতাম। শুধু বাজে বকে যাস”।
দাশু গলা নামিয়ে বলল, “আরে সাগ্নিকের একদিন না একদিন ব্রেক আপ হতই। ওই সুকন্যাই তো একদিন কীসব কনফেস করেছিল ওর সেম এজ বয়ফ্রেন্ড ভাল লাগে না বলে”।
শমীক বলল, “তুই কী করে জানলি সুকন্যা কনফেস করেছিল? অ্যানোনিমাস কনফেশন হয় তো দেখেছি”।
দাশু বলল, “ও ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায়। তুই ওসব বুঝবি না। দেখার চোখ থাকতে হয় ডিটেকটিভদের মত। ওই দেখ, রায়া কেমন কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ঝাড় খেয়েছে। কেস কী জানিস?”
শমীক বলল, “না, তোর মত লোকের কেস খুঁজে বেড়ানো আমার কাজ না, তাই জানি না”।
দাশু বলল, “এটাও একটা কাজ। এই রায়া”।
দাশু চিৎকার করে রায়াকে ডাকল। রায়া ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “কী?”
দাশু বলল, “সব ঠিক আছে তো?”
রায়া বলল, “কেন? কী হবে”?
দাশু বলল, “এমনি। তোকে দেখে মনে হচ্ছে কোন প্রব্লেম হয়েছে। হলে জানাস”।
রায়া ডেস্ক থেকে উঠে দাশুর সামনে এসে বলল, “হলে কী করবি তুই? কী করার ক্ষমতা আছে তোর? নিজে তো মার খেয়ে এলি, এখন কার কী হয়েছে সেটা দেখে বেড়াচ্ছিস?”
শমীক হেসে বলল, “বেশ হয়েছে। এটাই হওয়া উচিত ছিল তোর”।
অঞ্জনা রাগী চোখে শমীকের দিকে তাকাল। শমীক পালটে গেছে। লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসেছে। শমীক অঞ্জনাকে পাত্তা দিল না। তাকালই না ওর দিকে।
৪২
“ক্লাস নেই এখন?”
সৌরভ ক্লাস টেস্টের জন্য প্রশ্নপত্র তৈরি করছিল, ল্যাবে অরুন্ধতী প্রবেশ করল। সৌরভ বলল, “হ্যাঁ, আছে তো। এখন নেই। একটা অফ আছে”।
অরুন্ধতী বলল, “একটা সুখবর আছে”।
সৌরভ বলল, “কী?”
অরুন্ধতী বলল, “আমার ল ইয়ার ফোন করেছিলেন। হয়ত তিন চারদিনের মধ্যে আমি মুক্ত হতে পারব”।
সৌরভ খুশি হল, “এটা দারুণ খবর তো। সেলিব্রেট করা উচিত”।
অরুন্ধতী বলল, “দাঁড়াও। এখনও না আঁচালে বিশ্বাস নেই”।
সৌরভ বলল, “সম্পর্ক কী অদ্ভুত জ্বালা তাই না? যেতে গেলে কী আনন্দ, এদিকে ছাড়তে চাইলে হাজার হাজার ঝামেলা চলে আসে”।
অরুন্ধতী বসল, “আর ঝামেলা। যা যা সমস্যার মধ্যে দিয়ে গেলাম, এখন আবার মনে করতে বসলে নিজেকে অসুস্থ মনে হয়”।
সৌরভ বলল, “এখন কী করবে?”
অরুন্ধতী হেসে মাথা নাড়ল, “জানি না। কিছু করার আছে নাকি সেটাই জানি না। এত কঠিন পৃথিবী, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় পালিয়ে যাই। সব কিছু কত কঠিন”।
সৌরভ বলল, “পালিয়ে কোথায় যাবে? পালিয়ে যাওয়া এত সোজা নাকি? ওভাবে কিছু হয় না। নিজেকে কিছুটা সময় দাও। পারলে কোথাও ঘুরে এসো”।
অরুন্ধতী ঠোঁট ওল্টাল, “একা একা কোথায় যাব আর? মাকে নিয়ে কি আর যাওয়া যায়? কোথাও যেতেও চায় না মা। একা জীবন কাটানো ইজ দ্য টাফেস্ট পার্ট অফ লাইফ। যেতে পারলে সত্যি ভাল হত। দেখি যদি কেসটা মিটে যায়, তাহলে চেষ্টা করব কোথাও যাওয়ার”।
সৌরভ বলল, “কোন ট্যুর কোম্পানির সঙ্গে যেতে পারো”।
অরুন্ধতী বলল, “পাগল? এদের সঙ্গে কোথাও যায়? কাকীমা পিসিমা লেভেলের লোক জন থাকে। প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে দেয়। এমনিতেই রবিবারগুলো বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। দেখা যাবে পাড়ার কেউ না কেউ চলে আসবে। দুঃখী মুখ করে জিজ্ঞেস করে, কিছুতেই কি মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়া গেল না? মেয়েদের তো একটু মানিয়ে গুছিয়ে নিতে হয়, কষ্ট সহ্য করতে হয়। অবশ্য বয়স্ক লোকেদেরই দোষ দিই কেন, মডার্ন সোসাইটিতেও অনেকে আছে যারা ডিভোর্সি দেখলে নাক কুঁচকায়। যেন কোন পাপ করে ফেলেছি। বেঁচে থাকাটা খুব কঠিন সৌরভ। তুমি বন্ধু বলে বলছি, বোর হচ্ছো না তো?”
সৌরভ বলল, “না না, তুমি বলতে পারো”।
অরুন্ধতী বলল, “এক্সের নিন্দা করাটা ঠিক না হয়ত, তবে কী জানো, একবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছিল। অনেক ছেলেই আছে, প্রগ্রেসিভ মাইন্ড দেখিয়ে এগিয়ে আসে, পরে দেখা যায় এরাই সব থেকে বেশি প্রাচীনপন্থী। একেক দিন একেক রকম শর্ত। একদিন শুনলাম, তুমি নাচতে? ছি ছি। নাচ কোন ভদ্র বাড়ির মেয়ে করে? এটা কোন কথা হল? ভদ্রবাড়ির মেয়ে নাচ করে না?”
অরুন্ধতী উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছিল। সৌরভ চুপ করে শুনে যাচ্ছিল। অরুন্ধতী জানে না, তার মা বউদিরাও এরকমই ভাবে। আশে পাশের সবাইও হয়ত। পোশাক কিংবা মানসিকতা, বেড়া ভাঙলে সবাই রে রে করে ওঠে। সে যদি কোন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করে, মা শয্যাশায়ী হয়ে যাবে হয়ত। মাঝে মাঝে এ জন্যই বিদ্যাসাগরের কথা ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অতো বছর আগে লোকটা বিধবা বিবাহের কথা মাথায় এনেছিলেন। অবশ্য অনেকেই মাথায় এনে থাকতে পারেন, সমাজের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই করেছিলেন। সমাজ বরাবরই প্রাচীনপন্থী, পিছনে টানার চেষ্টা করে যায়। সবাই সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
রায়া একরকম তাকে প্রপোজ করে গেল। এরকম অনেক প্রপোজালই সে পেয়েছে কলেজে পড়াতে গিয়ে। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের আবেগ বেশি থাকে। তারা অনেক বেশি সৎ থাকে। এই রায়াই একসময় বুঝবে সে ভুল করেছিল। কর্পোরেট জীবনে অনেক ভাল ভাল ছেলে তার জন্য থাকবে। অরুন্ধতী এখন যেমন তার এক্সকে নিয়ে বলছে, তখন হয়ত অরুন্ধতীর মত রায়াও তার অতীতের ভুল নিয়ে বলবে।
একবার করা ভুল বার বার ঠিক করে যাওয়ার চেষ্টাকেই বোধ হয় জীবন বলে।
৪৩
“তুই কিন্তু কেমন গুম মেরে গেছিস। আমাকে বলবি না কী হয়েছে?”
ব্রেকের সময় ক্যান্টিনের পথে যেতে যেতে শিঞ্জিনী রায়াকে জিজ্ঞেস করল। রায়া বলল, “কী আর হবে? আমি ডুমড। একবারে সব ফুটুর ডুম হয়ে গেছে আমার। সব জেনে গেছে”।
শিঞ্জিনী চমকে গিয়ে বলল, “সর্বনাশ, তারপর কী হল?”
রায়া বলল, “জ্ঞানের খাতা খুলে বসল। অনেক বড় জীবন, অনেক কিছু আছে, মানে পাতি কাটিয়ে দিল আর কী”।
শিঞ্জিনী বলল, “সেটাই তো স্বাভাবিক। কাটিয়ে না দিলেই আশ্চর্য হতাম। তবে চোর ধরেও ছেড়ে দেওয়াটাই তোর মরাল ভিক্ট্রি হয়ে থাকল”।
রায়া বলল, “বাদ দে। আমার কোন মরাল ভিক্ট্রির দরকার নেই। এই এপিসোডটা ভুলে গেলেই ভাল। দরকার নেই কাউকে”।
শিঞ্জিনী বলল, “কেন বল তো? তুই তো তোর মত একটা লড়াই চালাচ্ছিলি। তাহলে এখন আবার তোর গলায় মেলাঙ্কলি এল কোত্থেকে?”
রায়া বলল, “আমি বুঝে গেছি। ওর সঙ্গে অরুন্ধতী ম্যামের কিছু একটা চলছে”।
শিঞ্জিনী বলল, “কী করে বুঝেছিস? তোকে কিছু বলেছে?”
রায়া বলল, “কিছুই বলে নি। তবে আমার সিক্সথ সেন্স বলছে। আমাকে যেটা বোঝাল, সেটা হল তুমি পাতি কেটে পড়। এখানে বিশেষ লাভ নেই। যেরকম করে ওই কথাটা বলে, তুমি অনেক ভাল ডিজারভ কর এটসেট্রা”।
দুজনে ক্যান্টিনে এসে বসল। শিঞ্জিনী শমীককে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে বলল, “আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে তুই একটু বেশি নিরাশ হয়ে যাচ্ছিস। বরং এটা তোর যুদ্ধের ফার্স্ট ভিক্ট্রি হিসেবে দেখতে পারিস। উনি জেনে গেছেন তোর ক্রাশ আছে। এটাই তো আসল ব্যাপার। ক’টা লোক সেটা বলতে পারে? ক্রাশ আছে বা ভালবাসে, এটা বোঝাতেই তো পারা যায় না। যাকে ভালবাসবি দেখা যায় সেই কিছু জানে না। স্যার জেনে গেছেন। তোর ফার্স্ট ভিক্ট্রি। সেলিব্রেট করা উচিত। তুই ওর জায়গায় নিজেকে রেখে দেখ। একজন স্টুডেন্ট তাকে ভালোবাসে বলে পাগলামি করছে, তাতে উনি আর কী বলতেন? যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। বরং তুই তোর মত করে চলতে থাক। মাঝে মাঝে বাজিয়ে দেখ তোকে দেখলে কী রিয়্যাক্ট করছে। হয়ে যাবে। চান্স আছে”।
রায়া বলল, “আমি আর টেনশন নিতে পারছি না। যখন ডাকল, আমার মনে হচ্ছিল আমার বোধ হয় হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে। ফ্যাকাল্টি ব্যাপারটা খুবই চাপের। তোর মত শমীকের বা একই ক্লাসের কারো উপর চাপ থাকলে লড়াইটা দেওয়া যায়। স্যার আর এ বির মধ্যে যদি কিছু থাকে, সেখানে ঢুকলে আরো বাজে ব্যাপার হয়ে যাবে”।
শিঞ্জিনী গম্ভীর হয়ে বলল, “শমীকের সঙ্গে আমার কিছু নেই”।
রায়া বলল, “সে তো তোকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। এই অবস্থাতেও আমি লক্ষ্য করেছি শমীক অঞ্জনার সঙ্গে থাকলে তুই রেগে যাচ্ছিস”।
শিঞ্জিনী বলল, “ওহ এই ব্যাপার? এর মধ্যে প্রেম ট্রেমের কিছু নেই তো। শমীককে অঞ্জনা যেভাবে দখল করে রাখে, সবার সঙ্গে আমারও অস্বস্তি হয় বলে আমি বলেছি। ভাল দেখায় না তো”।
রায়া বলল, “তাতে তোর কী? শমীক কি আমাদের ক্লাসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর? ওকে যা খুশি লাগুক না, তুই কাটিয়ে দে। শোন ভাই, সেম এজ রিলেশনশিপে যাস না। পরে অনেক ঝামেলা হয়”।
শিঞ্জিনী বলল, “আর এজ ডিফারেন্সের রিলেশনশিপে গিয়ে কী হয়? প্রপোজ করতে গিয়ে কেস খেতে হয় নয়ত জ্ঞান শুনে আসতে হয়? কী লাভ তাতে। হেরোদের জন্য সব এক”।
রায়া বলল, “হেরোদের কথা জানি না বাপু, তবে তুই যে হেরো না, সেটা আমি খুব ভাল করে জানি। শোন, শমীক আর অঞ্জনার মধ্যে ঢুকতে যাস না, ওখানে কাঁঠালের আঠা আছে। ফালতু আঘাত খাবি”।
শিঞ্জিনী বলল, “আশ্চর্য, তোকে তো বলছি আমি ওদের মধ্যে ঢুকতে চাই না”।
রায়া বলল, “গুড। আশা করব তোর এটা মনে থাকবে। যাক গে, আমি আজ কিছু খাবো না। তুই খেলে খা। আমার খিদে নেই”।
শিঞ্জিনী বলল, “আমারও খিদে নেই”।
রায়া বলল, “ওহ, এরকম করিস না। আমি বিকেলে খাবো। আমার ভাল্লাগছে না বললাম তো”।
শিঞ্জিনী বলল, “তুই না খেলে আমিও খাবো না”।
রায়া বলল, “খুব বাজে জানিস তো এটা? আচ্ছা একটা চাউ নে, দুজনে ভাগ করে খাই”।
শিঞ্জিনী বলল, “নিয়ে আয়, আমার ল্যাদ লাগছে”।
রায়া বলল, “যা যা। এটুকু কর। আমি কত ব্যথা পেয়েছি সেটা বুঝে আমাকে দয়া কর”।
শিঞ্জিনী হেসে ফেলে বলল, “ঠিক আছে যাচ্ছি। জ্বালিয়ে খাস একবারে”।
৪৪
ক্লাস শেষে বেরোতে গিয়ে শমীক দেখল অঞ্জনা তার জন্য ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শমীক বলল, “তুই কি কিছু বলবি?”
অঞ্জনা বলল, “তোকে আমি বলেছিলাম শিঞ্জিনীর থেকে দূরে থাকবি। তুই ওর পাশে বসলি কেন?”
শমীক দাঁড়িয়ে গেল, “আমি বুঝতে পারছি না তোর সমস্যাটা কী? তোর সঙ্গে মিশতে পারব না, শিঞ্জিনীর সঙ্গে কথা বললে দোষ, তাহলে আমি কী করব?”
অঞ্জনা বলল, “তুই শিঞ্জিনীর সঙ্গে মিশবি না। তাহলেই হবে, ব্যাস”।
শমীক বলল, “ওভাবে হয় না। তুই দেখে নিয়েছিস আমার উপর তোর কোন ফিজিক্যাল অ্যাট্রাকশান নেই, তো ফাইন। এবার মুভ অন করে যা। তুই তোর মত থাক, আমি আমার মত থাকি। তাহলেই ব্যাপারটা মিটে যায়। দেখ, আমাকে অনেক ঝামেলা করে পড়াশুনা করতে হয়। এখন অযথা একটা ঝামেলা তৈরি করিস না”।
অঞ্জনা বলল, “তোর কী চাই? আমার সঙ্গে সেক্স করতে চাইছিস, সেদিনের রিভেঞ্জ নিতে চাইছিস, তাই তো?”
শমীক বলল, “আমি কোন রিভেঞ্জ নিতে চাইছি না। আমি আমার মত থাকতে চাইছি। তুই যেভাবে বললি, আমি তো সেভাবেই চললাম, এবার আমি কার সঙ্গে কথা বলব এগুলো কন্ট্রোল করতে চাইছিস তুই। নিজেই ভেবে বল, এটা কি ঠিক করছিস?”
অঞ্জনা ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি ভাল করে ভেবে দেখেছি, ওই বিচটার সঙ্গে তোকে দেখলেই আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না। তুই যদি ভাবিস ও তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায়, তাহলে তুই ভুল ভাবছিস। যেহেতু তুই আমার বন্ধু, তাই ও তোর সঙ্গে কথা বলে আমায় ইরিটেট করতে চায়”।
শমীক বলল, “তাহলে ইরিটেট হোস না। তুই ইরিটেটেড না হয়ে স্বাভাবিকভাবে ঘুরে বেড়া। তাহলেই ঝামেলা মিটে যায়। ও বুঝে যাবে তুই ইরিটেটেড হচ্ছিস না”।
অঞ্জনা বলল, “ওটাই তো সমস্যা হচ্ছে। আমি চেষ্টা করলেও পারছি না। ইরিটেটেড হয়ে যাচ্ছি”।
শমীক বলল, “চেষ্টা কর। তুই পারবি। তুই সবই তো খুব ভাল পারিস। যে প্রব্লেমগুলো কেউ সলভ করতে পারে না, তুই অনায়াসে সেগুলো সলভ করে ফেলিস”।
অঞ্জনা বলল, “ধুস, ওগুলো তো স্টাডি প্রব্লেম। লাইফ প্রব্লেম অতো সোজা না”।
শমীক বলল, “কঠিনও না। তুই চেষ্টা কর, আমি শিওর তুই পারবি”।
অঞ্জনা শমীকের দিকে স্থির চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “তার মানে তুই শিঞ্জিনীর সঙ্গে কথা বলবি, ওর পাশে যেমন বসছিলি তেমনই বসবি, তাই তো?”
শমীক বলল, “দেখ, তুই নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারিস। অন্যকে তো পারিস না। তুই কেন আমাকে কন্ট্রোল করবি, আর আমিই বা কেন তোকে কন্ট্রোল করতে দেব? ওভাবে কি কিছু হয়? হয় না। জাস্ট লিভ ইট”।
অঞ্জনা বলল, “তুই জানিস, আমার মাও বুঝতে পেরেছে তোর সঙ্গে আমার কোন একটা ঝামেলা হয়েছে। মা জিজ্ঞেস করছিল”।
শমীক বলল, “তাহলে আন্টিকে বলে দে কী প্রব্লেম। আমি শিওর উনি কোন না কোন একটা সলিউশন বলে দেবেন”।
অঞ্জনা জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “তুই খেপেছিস? মা সাঙ্ঘাতিক। একটু হিন্ট দিলে গোটা গল্প টেনে বের করে ফেলে। আমি কিছুতেই চাইছি না মা হোটেল যাওয়ার ব্যাপারটা বিন্দু বিসর্গও টের পাক। পেলে আমি মার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবো না। মা যদি তখন বলে তোকেই বিয়ে করতে হবে, তাহলে আমি কী করব?”
শমীক বলল, “উনি কখনই এসব আজব দাবি করতে যাবেন না। এত কিছুর পরেও যদি জোর করেন, আমি তো তোকে বিয়ে করব না। তুই নিশ্চিন্ত থাক”।
অঞ্জনা বলল, “কেন? তুই কাকে বিয়ে করবি তখন? শিঞ্জিনীকে?”
শমীক শ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি কাউকেই বিয়ে করব না। এটা আমার বিয়ে করার বয়সই না। কেন বিয়ে করতে যাব?”
অঞ্জনা বলল, “আমার মাথা কাজ করছে না। তুই কী চাইছিস, আমি কী চাইছি, আমি কিছু বুঝতে পারছি না”।
শমীক বলল, “আমি কী চাইছি তা তো ক্লিয়ার। আমাকে আমার মত থাকতে দে, আমি তাহলেই খুশি”।
অঞ্জনা শমীকের দিকে হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল।
৪৫
কলেজ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে ভাল লাগে সৌরভের। একা একা হাঁটার মানে নিজের সঙ্গে কথা বলার অনেকটা সুযোগ। সারাদিন কাজের পর দিনটা বিশ্লেষণের খুব দরকার হয়।
লকডাউনের পর সব জায়গার মানুষেরই আবেগের উত্তাপ অনেক খানি বেড়ে গেছে। অদ্ভুত সব খবর আসছে। ফোন খুললেই এমন সব খবর আসে, যেগুলো আগে ভাবাও যেত না। অবশ্য মিডিয়াগুলোও সেরকম হয়েছে। টি আর পির জন্য তিলকে তাল করে দেখানো মিডিয়ার প্রধান কাজ।
রায়ার জন্য খানিকটা মায়াই হচ্ছিল সৌরভের। এই বয়সটাই এরকম। কাউকে ভালবাসলে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে এই বয়স। কয়েকদিন পর এরাই ব্যাল্যান্স শিট নিয়ে বসে যাব। ঠিক ভুল হিসেব করবে। তখন ভুলটা বুঝতে পারবে। জীবন এমনই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিছন ফিরে দেখলে ভুলগুলোর জন্য কষ্ট হয়। ইদানীং মনে হয় শহরটা ছেড়ে দিতে পারলেই ভাল হত। এই শহরটাকে আজকাল ঠিক সহ্য হয় না তার। চারদিকে কেমন যেন হার মেনে নেওয়ার ভাব চলে এসেছে। মানুষ যদি শুরুতেই হার মেনে নেয়, তাহলে ভারি বিপদ। মানুষের লড়াইটাই তো হারিয়ে যেতে বসেছে।
নিজেও তো হেরেই যাচ্ছে সে। কেন এই প্রাইভেট কলেজে পড়াচ্ছে সে? হেরে যাওয়াটাকে কি স্বীকার করে নিয়েছে সে? তাহলে ভয়ের ব্যাপার। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখল অরুন্ধতী দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হেসে বলল, “আরে তুমি হেঁটে এলে? আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। একবার ভাবলাম ফোন করি, তারপর ভাবলাম এসো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। আজ ট্যাক্সিতে ফেরা যাক। ভাড়াটা হাফ করে নেওয়া যাবে। কী বল?”
সৌরভ বলল, “একদম। তার আগে আমার ভাগের চা-টা খেয়ে নিই”।
অরুন্ধতী হাসল, “একদম”।
সৌরভ চা নিল।
অরুন্ধতী বলল, “সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে বাঁচি’।
সৌরভ বলল, “তারপর কী করবে?”
অরুন্ধতী বলল, “বেঙ্গালুরুতে একটা ভাল ইউনিভার্সিটিতে ওপেনিং আছে। পি এইচ ডি প্লাস পড়ানো। চলে যাবো ভাবছি”।
সৌরভ বলল, “কলকাতাকে টা টা করে দেবে?”
অরুন্ধতী বলল, “অ্যাকচুয়ালি এই কাকীমা পিসিমাদের থেকে পালানোর চেষ্টা বলতে পারো। ওখানে আশা করি এত প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিতে হবে না”।
সৌরভ বলল, “পালিয়ে যাবে”?
অরুন্ধতী বলল, “পালিয়ে যাওয়া না। একবার উত্তর দেওয়া অবধি ব্যাপারটা ঠিক থাকে, রোজ রোজ উত্তর দিতে কি ভাল লাগে? আরেকটা ব্যাপার কী জানো তো, এখন সম্ভন্ধ আসা শুরু হয়েছে। ভয়ঙ্কর সব সম্বন্ধ। কোন লোক বিপত্নীক, কোন লোক ডিভোর্সি, মানে সিরিয়াসিলি? বিয়ে করতেই হবে? কে মাথার দিব্যি দিয়েছে?”
সৌরভের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি এল। সে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে আমার বাড়ি যাবে?”
অরুন্ধতী অবাক হয়ে বলল, “কেন বল তো”?
সৌরভ হেসে বলল, “আমার মা, বৌদি এরাও খুব প্রাচীনপন্থী। এদের ধারণা হয়েছে আমি কোন ডিভোর্সি মেয়ের সঙ্গে প্রেম করছি। চল দেখি। তোমাকে ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দি। আমি একটু ওদের প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাই”।
অরুন্ধতী কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী সর্বনাশ। এরকম কিছু হয়েছে নাকি?”
সৌরভ বলল, “হ্যাঁ, হয়েছে তো। তুমি চল। আমি একটু ওদের প্রতিক্রিয়াটা দেখতে চাই”।
অরুন্ধতী বলল, “তোমার মা বা বউদি খুব রিগ্রেসিভ নাকি?”
সৌরভ বলল, “হ্যাঁ। ওদের অনেক রকম ব্যাপার আছে। শুনলে মাথা ঠিক থাকে না। তুমি আমার সঙ্গে চল, আমি একটু ওদের প্রতিক্রিয়াটা দেখব”।
অরুন্ধতী বলল, “যেতে পারি, কিন্তু ব্যাপারটা কি ভাল হবে। মানে আবার তো সেই চর্বিত চর্বণ। তারপরে তোমার বাড়ির লোকজন আবার অশান্তি করবে। তুমিই বা কোন ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিচ্ছো না কেন বল তো?”
সৌরভ বলল, “ব্যাপারটা ভাল খারাপের না। ব্যাপারটা হল এরকম স্টিরিওটাইপ মানসিকতা এই সময়ে দাঁড়িয়ে মানুষের কেন থাকবে? আমরা কি উন্নতি করেছি তাহলে?”
অরুন্ধতী ম্লান হাসল, “কোন উন্নতি করি নি বুঝলে। আমরা আরো পিছিয়ে যাচ্ছি। যত পিছনে যাওয়া সম্ভব, তত পিছনে যাচ্ছি। ঠিক আছে, চল, তোমার বাড়ি যাওয়া যাক। জীবনে সব রকম অভিজ্ঞতাই হওয়া উচিত। পাড়ার এক কাকিমা আছে, আজকাল আমাকে অপয়া মনে করে। ডিভোর্স করে এসেছি মানে অপয়া। কালে কালে আর কী দেখতে হবে জানা নেই।“
সৌরভ চায়ের টাকা দিয়ে বলল, “চল। দেখে আসবে আমি কাদের সঙ্গে থাকি”।
৪৬
অটোতে রায়া গম্ভীর হয়ে বসে ছিল। বেশি কথা বলছিল না। পিজিতে পৌঁছে শিঞ্জিনীকে বলল, “আজ থেকে অল্ট, কন্ট্রোল আর ডিলিট। তোকে অনেক জ্বালিয়েছি, আর জ্বালাব না। নিশ্চিন্ত থাক। এবার জীবনটা রিস্টার্ট করব”।
শিঞ্জিনী বলল, “খুব ভালো। নতুন কাউকে দেখলি?” রায়া বলল, “না। দরকার নেই। আমি এখন ক’দিন একা থাকি। যতবার ভাবছি, তত কান্না পাচ্ছে। আমাকে জ্ঞান দেওয়ার কী আছে?” শিঞ্জিনী বলল, “বয়সে বড় হলে তো এটাই সমস্যা। ফ্রিতে জ্ঞান দিয়ে দেয়। যাক গে, আশা করা যাবে ভাইবাতে একটু হলেও স্পেশাল কনসিডারেশন দেবে”।
রায়া বলল, “দরকার নেই আমার কোন কনসিডারেশনের। ওসবের জন্য কি আমি এগিয়েছিলাম? তোর কী মনে হয়?”
শিঞ্জিনী বলল, “না। সেসব মনে হয় না। আমি জানি তুই ওসব ভাবিসও নি। তুই হলি ইমোশনাল ফুল”।
রায়া বলল, “ফুলই বটে। আসল ভিলেন হল ওই কনফেশন পেজের অ্যাডমিনটা। যদি পাই না, তাহলে বারোটা বাজিয়ে দেব ব্যাটার”।
শিঞ্জিনী বলল, “এই তো বললি সব ভুলে যেতে চাস। তাহলে আবার এসব কথা বলছিস কেন? কী দরকার?”
রায়া বলল, “তাও বটে। ঠিক আছে। তুই বরং শমীকের পিছনে লেগে থাক। যত লাগবি, অঞ্জনা তত রাগবে। তোর স্যাডিস্টিক প্লেজার হবে। ওটাই তো তুই চাস, তাই না?”
শিঞ্জিনী বলল, “তুই কি চাস? আমি শমীকের সঙ্গে কোন কথা বলব না?”
রায়া বলল, “আমি চাই, তুই ওসব উলটো পালটা আইডিয়া তোর মাথা থেকে ডিলিট করে দে। এক একজন একেক রকম রিলেশনে আছে। কারো ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট আছে। ওদের খামোখা বিরক্ত করবি কেন? অঞ্জনা একটু খরুস আছে। ও টপারগুলো সব ওরকমই হয়। ওরা ওদের মত থাকুক। তুই বরং নতুন কাউকে খোঁজ”।
শিঞ্জিনী রেগে গেল, “দরকার নেই কাউকে খোঁজার। এরকমই ঠিক আছে”।
রায়া বলল, “তাহলে তুই বরং নিজেকে বিয়ে করে নে”।
শিঞ্জিনী বলল, “তাই করব। তুই থামবি? এক সৌরভ বেরিয়েছে মাথা থেকে, এখন আমাকে নিয়ে পড়লি। তুই জ্বালাবি না তো একদম। খুন করে ফেলব নয়তো”।
রায়া হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “অরুন্ধতী ম্যাম আর সৌরভের রিলেশন কেমন হতে পারে?”
শিঞ্জিনী বলল, “বাওয়া। অরুন্ধতী ম্যাম আর এখনো সৌরভ? স্যার হল না?”
রায়া বলল, “অভ্যাস করে ফেলব। তুই বেশি চাপ নিস না। সব কিছু অভ্যাস হয়ে যায়”।
শিঞ্জিনী বলল, “হ্যাঁ তাই কর। সেম আসছে। আবার পড়তে হবে। ধুস, ভাল্লাগে না”।
রায়া বলল, “যা বলেছিস। এর থেকে কোন কোটিপতি বিয়ে করে তার বাড়িতে বউ হয়ে থাকতাম যদি। কোন কাজ করতে হত না। কবে হবে এরকম? আচ্ছা,আমাকে একটা কথা বল। এইসব পড়াশুনা করেই কী হবে? একটা লাইফ কাটাতে হবে। চাকরি করেই বা কী হবে? ইনফ্যাক্ট বেঁচে থেকেই বা কী হবে? একদিন তো মরেই যাব”।
শিঞ্জিনী বলল, “বেশি ফিলোজফিকাল হতে হবে না। ছাদে যাবি?”
রায়া বলল, “ওই সিনিয়রটার সঙ্গে গপাবি নাকি?”
শিঞ্জিনী বলল, “দূর। ওটা একটা গাম্বাট খোরাক। ওটার সঙ্গে আবার কী কথা বলব?”
রায়া বলল, “চাকরি পেয়েছে তো। তোকে চাকরি নিয়ে জ্ঞান দেবে। তুই ‘বল প্রাণনাথ’ বলে সে জ্ঞান শুনবি”।
শিঞ্জিনী বলল, “যত্তসব। থাম তো”।
পিজিতে সন্ধ্যের টিফিনে ঘরে তৈরী এগ রোল করেছিল। সেটা খেয়ে তারা ছাদে গেল। শুভ্র ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছিল। শিঞ্জিনী সেটা দেখে বলল, “তুমি না চাকরি পেয়েছো? লজ্জা লাগে না বিড়ি খেতে?”
শুভ্র বলল, “চাকরি পেয়েছি ঠিকই, মাইনে তো পাই নি। যত দিন মাইনে পাব না, ততদিন বিড়িই খাবো। কেন তোরা কি সিগারেট এনেছিস নাকি? থাকলে দে। কাউন্টার মারি”।
শিঞ্জিনী মুখ বাঁকাল, “আমরা ওসব সাব ষ্ট্যাণ্ডার্ড নেশা করি না”।
শুভ্র বলল, “তাহলে কি কোকেন নিস? যত্তসব”।
শিঞ্জিনী বলল, “চল তো রায়া। আজে বাজে লোকের সঙ্গে কথা বলতে নেই। আমরা অন্যদিকে গিয়ে দাঁড়াই”।
শুভ্র বলল, “হ্যাঁ, আমার যেন কথা বলার জন্য প্রাণ ফেটে যাচ্ছে। যত্তসব”।
শিঞ্জিনী শুভ্রর কথার উত্তর না দিয়ে ছাদের অন্যদিকে গেল। রায়া হাসতে হাসতে বলল, “ভালই জমছে কিন্তু। প্রেম করবি নাকি? বিড়ি খেকো মুখে চুমু খাবে, ঈশ”।
শিঞ্জিনী রায়াকে চিমটি কেটে দিল।
৪৭
সৌরভের বউদি স্বাতী আর সৌরভের মা টিভি দেখছিল। কলিং বেল শুনে দরজা খুলল স্বাতী।
সৌরভ অরুন্ধতীকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বাতীর মুখের হাঁ শুরুতেই অনেকটা বেড়ে গেল।
সৌরভ বলল, “এই যে বউদি, যার কথা বলছিলাম। ও অরুন্ধতী। আমাদের কলিগ”।
অরুন্ধতী হাত জোড় করল। স্বাতী বলল, “আসুন”।
ড্রইং রুমে অরুন্ধতীকে বসাল সৌরভ। সৌরভের মা অরুন্ধতীকে আপাদমস্তক দেখছিল। সৌরভ বলল, “উনি অরুন্ধতী। আমাদের কলেজেই পড়ান”।
স্বাতী আর সৌরভের মা আশা করে নি সৌরভ অরুন্ধতীকে সরাসরি বাড়ি নিয়ে আসবে। স্বাতী বলল, “চা খাবেন”?
অরুন্ধতী বলল, “না। ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি”।
মা সৌরভের দিকে ভীত চোখে তাকাল। সৌরভ বলল, “ওর সঙ্গেই কালকে কথা বলছিলাম। তুমি বার বার জিজ্ঞেস করছিলে না? অরুন্ধতীর ডিভোর্সটা হয়ত এই সপ্তাহেই হয়ে যাবে, তারপর আমরা বিয়ে করব”।
মা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। স্বাতী বলল, “নিজেরাই ঠিক করে নিলে? আমাদের বলতে পারতে”।
সৌরভ বলল, “সে তো বলতামই। না বলে কোথায় যেতাম? বলতে হবে না, একই বাড়িতে থাকব যখন। অরুন্ধতীর আগের বর খুব ঝামেলা করছিল, কিছুতেই ডিভোর্স দিচ্ছিল না। এতদিনে ঝামেলা মিটেছে। এবার শান্তি”।
মা জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, “সবই যখন ঠিকই করে ফেললি, এখন আর আমাকে বলছিস কেন? ঠিক যখন করেছিস, ভাল ভেবেই করেছিস”।
অরুন্ধতী সৌরভের দিকে ফিরল, “চল, তোমার ঘরটা দেখে আসি। ওই ঘরেই তো থাকতে হবে”।
সৌরভ উঠল, “এসো”।
অরুন্ধতীকে নিয়ে সৌরভ তার ঘরে গিয়ে হো হো করে হেসে উঠল। অরুন্ধতী খাটে বসে বলল, “ওরা কি সিরিয়াস হয়ে গেল! দেখলেও ভয় লাগছে। তুমি সামলে নাও। এখনই বলে দাও নয়ত সমস্যা হয়ে যাবে”।
সৌরভ বলল, “না। দেখি না এরা কতদূর যেতে পারে। আমাকে সেটাও দেখতে হবে”।
অরুন্ধতী বলল, “এসব এক্সপেরিমেন্ট করে কি মজা পাও সৌরভ? বাড়িতে অশান্তি হবে, মায়ের শরীর তো এমনিতেই ভাল থাকার কথা না। এরকম কোর না, উনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন”।
সৌরভ বলল, “কিছুই হবে না। বউদি মায়ের মাথা খাচ্ছে। আমাকে বল তো, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এরকম মানসিকতা কেন হবে মানুষের?”
অরুন্ধতী বলল, “কতজনকে পাল্টাতে পারবে তুমি? সবাই এরকম। আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে মানে আমার ক্যারেক্টারে দাগ পড়ে গেছে। সব দোষ আমার। মার ধোর খেয়ে, সব কিছু সহ্য করে কোন মতে শ্বশুরবাড়িতে টিকে থাকতে পারলে সে মেয়ে খুব ভাল হয়ে যায়। নয়ত তার থেকে খারাপ কেউ হয় না”।
সৌরভ বলল, “জানি তো। এই মানসিকতা আমাকে খুব শক দিয়েছে। ওরাও একটু শক পাক”।
অরুন্ধতী হাসল, “দেখো, শক দিতে গিয়ে কেউ অসুস্থ না হলেই হল। চল বেরনো যাক, নাকি? আমাকেও তো ফিরতে হবে”।
সৌরভ বলল, “চল”।
অরুন্ধতী সৌরভের ঘর থেকে বেরোল। স্বাতী আর সৌরভের মা পাংশু মুখে বসে ছিল। অরুন্ধতী বলল, “তাহলে আজ আসি? পরে আবার দেখা হবে না হয়”।
সৌরভ অরুন্ধতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার মা খুব আধুনিক। তুমি ডিভোর্সি কিনা আমার মায়ের তাতে কোন সমস্যা হবে না। তাই না মা?”
সৌরভের মা অন্যদিকে মুখ ঘুরাল। সৌরভ বলল, “আমি ওকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে আসছি”।
এবারও মা বা বউদি কোন রকম প্রতিক্রিয়া দিল না। বাড়ির বাইরে এসে সৌরভ বলল, “ওহ, আজ খুব ড্রামা হবে”।
অরুন্ধতী শান্ত গলায় বলল, “এসব কোর না সৌরভ। বাড়িতে খুব প্রেশার আসে। তুমি বিয়ে করে নাও”।
সৌরভ বলল, “করব তো। তোমাকেই করব। তুমি করবে আমায় বিয়ে?”
অরুন্ধতী দাঁড়িয়ে পড়ে সৌরভের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করল, “কাউকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এমন কিছু কোর না যাতে সারাজীবন পস্তাতে হয়। এসব ভাবতে যেও না। তোমার তো সব সিদ্ধান্তই হঠাৎ করে নেওয়া হয়, এটাও সেরকমই হল, তাই না?”
সৌরভ বলল, “হলে হবে। অসুবিধে নেই কোন।
অরুন্ধতী বলল, “তুমি এসব ভুলেও ভাবতে যেও না। কাউকে শাস্তি বা শিক্ষা দিতে যাওয়ার আগে একটা জিনিস ভেবে নিও, একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া মানে তোমাকে সারাজীবন সেই সিদ্ধান্তটার সঙ্গে থাকতে হবে। আগের সম্পর্ক আমায় অনেক কিছু শিখিয়ে গেছে। পাগলামি কোর না। হঠাৎ কী হল তোমার? কোন কিছু থেকে পালাতে চাইছ মনে হচ্ছে। কাউকে ভালবেসে ফেলেছ? এমন কোন ভালবাসা যেটার জন্য অস্থির হয়ে আছো বা স্বীকার করতে পারছ না সচেতনভাবে?”
সৌরভ চমকে অরুন্ধতীর দিকে তাকাল।
৪৮
মিতা চিন্তিত হয়ে বসেছিলেন। অরুন্ধতী ঢুকলে বললেন, “কী রে, আজ এত দেরী হল যে?”
অরুন্ধতী ব্যাগ রাখতে রাখতে বলল, “এক কলিগের বাড়ি গেছিলাম”।
মিতা বললেন, “কোন কলিগ? তুই তো কারো বাড়ি যাস না!”
অরুন্ধতী হাসল, “সে এক কাহিনি। সৌরভের কথা বলি না? ওদের বাড়ি”।
মিতা বললেন, “ও। খাওয়াল কিছু?”
অরুন্ধতী বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “এসে বলছি”।
বাথরুমে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে ফ্রেশ হতে। প্রায় কুড়ি মিনিট পরে চেঞ্জ করে বেরিয়ে সোফায় বসল, “সৌরভের মা আর বউদির ধারণা ওর সঙ্গে আমার কিছু আছে। ওরা সেটা নিয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। একটা যোগ্য ছেলে শেষে কিনা একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করবে?”
অরুন্ধতীর গলাটা শ্লেষাত্মক হতে গিয়েও তাতে শেষ মেশ বেদনা এসে মিশল। মিতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “তোকে ও নিয়ে গেল কেন? ওর কি তোর উপর কোন ফিলিংস আছে”?
অরুন্ধতী বলল, “নেই মনে হয়। আমার মনে হল, বাড়ির লোকের প্রতিক্রিয়া দেখে ও এই ঝামেলাটা ইচ্ছে করে করল”।
মিতা বললেন, “পাগলাটে আছে তোর মতই?”
অরুন্ধতী মাথা নাড়ল, “খানিকটা”।
মিতা বললেন, “এটা হয়। সারাক্ষণ পড়াশুনা নিয়ে থাকলে ছেলে মেয়েরা একটু পাগলাটে হয়ে যায়। ভালই করেছে ওদের বাড়ি নিয়ে গিয়ে। ওদের রি-অ্যাকশনটা দেখতে পারলে ভাল হত”।
মিতা হেসে ফেললেন।
অরুন্ধতী বলল, “সবাইই তো এরকম মা? ওরা আর আলাদা কি? সীমা মাসীও সেদিন আমাকে বলছিল ডিভোর্স করলে নাকি ধম্মে সইবে না। স্বামী মানে দেবতা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে এসব কথা শুনতে ভাল লাগে বল তো?”
মিতা বললেন, “না। ভাল লাগার কথাও না। একটা কাজ করবি, এখন থেকে আর চুপ করে শুনবি না। তুইও দু কথা শুনিয়ে দিবি। এদের কথা শুনে শুনেই এরা এত বাড় বেড়েছে এখন”।
অরুন্ধতী বলল, “তোমার বোন। বললে তোমার মাথা খারাপ করে দেবে তো”!
মিতা বললেন, “হোক আমার বোন। তুই বলবি। আমি তোকে পারমিশন দিলাম। প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেউ কোন কথা বললেই তুই তোর মত করে কথা শুনিয়ে দিবি। বাকিটা আমি বুঝব। অনেক সহ্য করা হল তো অনেকদিন”।
অরুন্ধতী মিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি ছিলে বলেই লড়াইটা একবারও হেরে যাব বলে মনে হয় নি মা। থ্যাংকস”।
মিতা অরুন্ধতীর গালে হালকা করে একটা চড় মেরে বললেন, “থাক। মাকে থ্যাংকস বলতে হবে না। একটা ভাল গল্পের বই কিনে দিস, তাহলেই হবে। অনেকদিন বই কেনা হচ্ছে না। আগের বইগুলো আর কাঁহাতক বার বার পড়া যায় বল তো? নতুন কেউই কি ভাল কিছু লিখছে না?”
অরুন্ধতী বলল, “ঠিক আছে। আমি দেখব কলেজ স্ট্রীটে গিয়ে। কিছু ভাল বই পেলে নিয়ে আসব”। অরুন্ধতী সোফার মধ্যেই মার কোলে শুয়ে পড়ল।
মিতা বললেন, “একী? শুয়ে পড়লি কেন? খাবার গরম করব না? তুই সেই কখন থেকে না খেয়ে আছিস বলতো?”
অরুন্ধতী বলল, “ও কিছু না মা। একটু থাকো। জানো, সৌরভ হুট করে প্রপোজ করে ফেলল। ঝোঁকের মাথাতেই করেছে বুঝতে পেরেছি। সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়েছি এসব করা ঠিক না। তোমার মাথায় অন্য কিছু আছে। সেসব থেকে পালাতে গিয়েই তুমি এসব করছো”।
মিতা বললেন, “ছেলেটা ভাল? এরকম প্রপোজাল দিল, একবারে না করে দেওয়ার আগে ভাবতে পারতিস। কয়েকদিন দেখতে পারতিস”।
অরুন্ধতী উঠে বসল, “এরকম বলছো কেন? হ্যাঁ, অবশ্যই সৌরভ ভাল, সেনসিটিভ ছেলে। এটা তো ঠিকই”।
মিতা বললেন, “তাহলে হুট করে বারণ করে দিলি কেন?”
অরুন্ধতী মাথা নেড়ে বলল, “না না, তুমি তো ওকে দেখো নি, সেসব কিছু নেই”।
মিতা বললেন, “কোন কিছুই হঠাৎ করে হয় না। তোকে কিছু বলেছিল মানে ভেবেছিল হয়ত। একবারে না করে দেওয়াটা ঠিক হয় নি”।
অরুন্ধতী ফ্যাকাসে মুখে বলল, “ঠিক আছে। ভেবে দেখি তবে”।
মিতা বললেন, “দেখ”।
অরুন্ধতী বলল, “ওদের বাড়ির লোক তো আবার মানবে না। খুব রক্ষণশীল”।
মিতা বললেন, “বাড়ির লোকের সঙ্গে তো সম্পর্কে যাবি না। দুজনে এক কলেজে পড়াস, একসঙ্গে কলেজ যেতিস”।
অরুন্ধতী বলল, “ওরে বাবা। ঠিক আছে একটু ভাবি?”
মিতা বললেন, “ঠিক আছে। ভাব”।
৪৯
বাড়িতে ফিরে সৌরভ দেখল চারদিক একবারে থম থম করছে। মা আর বউদি, দুজনেই কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে।
সে বলল, “চা কর। চা খাই। আর কিছু বানিয়ে থাকলে দাও”।
মা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাদের কিছু না বলে এতদূর এগিয়ে গেলি? মেয়েটা একবারে তোর ঘরে ঢুকে গেল?”
সৌরভ বলল, “দেখতে এসেছিল। কেন, কী হয়েছে?”
মা বলল, “ডিভোর্সি মেয়ে মানে বুঝিস তুই? হাতে পায়ে তো বড় হয়েছিস। সত্যিকারের বড় হবি কবে?”
সৌরভ বলল, “ডিভোর্সি মেয়ে মানে ডিভোর্সি মেয়ে। আগের সম্পর্ক টেকে নি। নতুন সম্পর্কে যাবে। ব্যস। আর তো কোন ঝামেলা নেই”।
মা বলল, “তোর জ্যেঠি, কাকী, পিসিরা কী বলবে? পাড়ার লোকই বা কী বলবে?”
সৌরভ বলল, “কে কী বলবে ভেবে থাকলে কী করে হবে? এই যে তোমরা মধ্যযুগের মানসিকতা নিয়ে চলছ, তাতে কি কেউ কিছু বলেছে?”
মা বলল, “আর তুই খুব আধুনিক মানসিকতা নিয়ে আছিস? আমি কিন্তু কিছুতেই তোর এই বিয়ে মেনে নেবো না, মনে রাখিস। এরকম কোন মেয়েকে আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না”।
সৌরভ বলল, “বিয়েটা তো আমি করব। তাই কাকে করব আমিই ঠিক করে দেবো। আমি ঘরে গেলাম”।
সৌরভ ঘরে যেতেই বউদি তার পেছন পেছন চলে এল।
স্বাতী বলল, “মেয়েটা তোমার সঙ্গে কাজ করে?”
সৌরভ বলল, “হ্যাঁ”।
স্বাতী বলল, “সারাক্ষণ নিশ্চয়ই নিজের দুঃখের কাঁদুনি গাইতো, তাই না? এদের কাজই হল নিজের দুঃখের কাঁদুনি গেয়ে লোকের সিমপ্যাথি আদায় করা”।
সৌরভ বলল, “আমার না এখন ঠিক ভাল লাগছে না বুঝলে। আজকের মত এসব কথা বন্ধ থাক”।
স্বাতী বলল, “কেন বন্ধ থাকবে? আমরা কি তোমার খারাপ চাই?”
সৌরভ বলল, “ভাল লাগছে না বললাম তো। ছাড়ো না”।
স্বাতী বলল, “পুতুল পিসির মেয়েটাকে একবার দেখে নাও। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে! তুমি একবার দেখে নাও, তারপর না হয় তোমার যাকে ইচ্ছে তাকে বিয়ে কর”।
সৌরভ বলল, “এ আবার কী? একজনের সঙ্গে সম্পর্কে আছি জেনেও তুমি অন্য কাউকে দেখতে বলছ?”
স্বাতী বলল, “বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। ওভাবে হুট হাট করে কাউকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসে তো বিয়ে হয় না। তুমি মেয়েটাকে দেখে নাও। তারপর না হয় যা সিদ্ধান্ত নেবার নিও। শোন, এই ধরণের মেয়েরা খুব কাঁদুনে হয়। সারাক্ষণ আগের সম্পর্কের ব্যাপারে নাকি কান্না কেঁদে যাবে। তুমি তো এক তরফা কথা শুনছো। খোঁজ নিয়ে দেখা যাবে আসল দোষ মেয়েটারই ছিল। ওর জন্যই সমস্যা তৈরি হচ্ছিল”।
সৌরভ চমৎকৃত হল, “তুমি দেখছি অন্তর্যামী বউদি”।
স্বাতী বলল, “কিছু হলেও তো পৃথিবী দেখেছি। এখন তুমি প্রেম করছো, মেয়েটার সব কিছুই তোমার খুব ভাল লাগছে। ওর সঙ্গে ঝামেলা লাগলে বুঝবে ও যখন তোমাকে দোষী করে সব জায়গায় বলে তোমার নামে আজেবাজে কথা বলে বেড়াবে। তখন তুমি কী করবে?”
সৌরভ বলল, “তুমি তো ফাটাফাটি বউদি। একবার দেখেই কত কিছু বলে দিলে! ভাবতে পারছি না”।
স্বাতী বলল, “তোমার দাদা ফিরুক। দেখো সবাই মিলে আলোচনা করে। আমি এখন কিছু বলেই খারাপ হয়ে যাবো সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছি”।
সৌরভ হাত জোড় করে বলল, “হ্যাঁ, আমাকে বাঁচাও। প্লিজ যাও। তোমরা গোল টেবিল বৈঠক কর, যা খুশি কর। কিন্তু নিজেরা নিজেরা কর। আমাকে এখানে টেনো না। আর দয়া করে কাউকে দেখতে যাওয়ার কথা বোল না। আমি কাউকে দেখতে যেতে পারবো না”।
স্বাতী থমথমে মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সৌরভের মনে হচ্ছিল অরুন্ধতীকে বাড়িতে আনাটা ঠিক হল না হয়ত। অরুন্ধতীর চরিত্র কাটা ছেঁড়া শুরু হয়ে গেল।
অথচ মেয়েটাকে তার মা বা বউদি চেনেই না।সময়টুকুই পাল্টেছে শুধু। মানুষ যা ছিল, তাই আছে।তবে অরুন্ধতীর একটা কথা তাকে ভাবাচ্ছে। সে কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে?
কাকে? রায়াকে? ধুস। কীসব অযৌক্তিক কথা ভাবছে সে।
এসব তো মাথায় আসতই না আগে!!!