৩০
বাড়ি ফিরে সৌরভ অরুন্ধতীকে মেসেজ করল, “ঠিক ঠাক পৌঁছেছ?”
অরুন্ধতী রিপ্লাই করল, “হ্যাঁ। থ্যাঙ্ক ইউ”।
সৌরভ আর কিছু লিখল না। বেশি কনসার্ন দেখানোর আবার অন্য মানে হতে পারে।
সৌরভের বৌদি স্বাতী মাঝে মাঝেই তাকে টিজ করে বিয়ে করার জন্য। তার মেসেজ করাটা দেখে নিয়েছিল। বলল, “কী ব্যাপার, পড়তে পড়তে কি এবার প্রেমটা সত্যিই শুরু করলে নাকি”?
সৌরভ মাথা নাড়ল, “না না, সেসব কিছু না। আমার এক কলিগ, ওর হাজবেন্ডের সঙ্গে খুব ঝামেলা চলছে। একসাথেই ফিরি, খবর নিলাম ঠিক ঠাক পৌঁছেছে নাকি”।
স্বাতী সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক তো? আর কিছু না তো? দেখো বাপু এই সব সহানুভূতি থেকেই কিন্তু প্রেম শুরু হয়ে যায়। তুমি এমনিতেই সারা বেলা পড়াশুনা করা পাবলিক, সম্পর্কের ব্যাপারে তোমার অতো বোধবুদ্ধি নেই। ঝোঁকের মাথায় কাউকে জল থেকে তুলতে গিয়ে নিজেই জলে পড়ে যেও না যেন”।
সৌরভ বলল, “ধুস, তোমাকে বলাই বিপদ হয়েছে। ওসব না বললাম তো। আমি কেন এসব ভাবতে যাব? উনিই বা ভাববেন কেন?”
স্বাতী বলল, “কেউই ভাববে না, তারপর ভাবতে ভাবতে হয়ে যাবে। দেখো বাপু যা করবে বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলে করবে”।
সৌরভ বলল, “আমি কিছুই করব না। আমার কোন প্ল্যানও নেই এখন কোন কিছু করার। দয়া করে এসব না ভেবে আমাকে চা খাওয়াও। তোমাদের দেখে তো বুঝতে পারি দাদা কত বড় ভুল করেছে। তুমি ভাবলে কী করে আমি আবার একই ভুল করব?”
স্বাতী বলল, “ফের তুমি এসব কথা বলছ? আমি ছিলাম বলে তোমরা বেঁচে গেলে বুঝলে? না থাকলে বুঝতে। মা তো বলে, দুটো ভাইই একবারে অখাদ্য তৈরি হয়েছ। কেউ কোন কাজের না। যাক গে, মেয়েটার নাম কী?”
সৌরভ বলল, “আবার তুমি ওসব টানছ? বলছি তো জাস্ট কলিগ”।
স্বাতী বলল, “বটে? ক’টা কলিগকে বাড়ি ফিরে মেসেজ করে খবর নাও শুনি?”
সৌরভ বলল, “এটাই তোমাদের সমস্যা জানো তো? যদি কোন ছেলে কলিগ হত, তাহলে তো এসব বলতে না? মেয়ে বলেই কী অনেক দূর অবধি ভেবে নাও?”
স্বাতী বলল, “খানিকটা তাই আবার খানিকটা না। সব সময় তা ভাবি না। তবে আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিয়ে তুমি খানিকটা ভাবো। কি, ভাবো না?”
সৌরভ স্বাতীর দিকে তাকিয়ে বলল, “না ভাবি না কারণ এখানে ভাবাভাবির কিছু নেই। দয়া করে থামো”।
সৌরভের মা ঠাকুরঘর থেকে এলেন। সৌরভ আর স্বাতীকে প্রসাদ দিয়ে বললেন, “কী নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে তোদের? কী হয়েছে?”
স্বাতী বলল, “আমি বলব না, কিছু বলেই ভাই রেগে যাচ্ছে। দেখো তুমি কিছু বের করতে পারো নাকি?”
মা বললেন, “কী হয়েছে? ছেলের কি কাউকে মনে ধরেছে? তা হলেও তো বাঁচি”।
স্বাতী বলল, “জিজ্ঞেস কর”।
সৌরভ থমথমে মুখে বসে থেকে বলল, “বউদি তুমি মাকে এসব কেন বলছ বল তো”।
স্বাতী বলল, “আমি কিছু বলছি না। আমরা একটা কথা শুরু করেছিলাম, আমি খানিকটা জ্ঞান দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম যে ডিভোর্স করা বা ব্রেক আপ হওয়া মেয়েদের সঙ্গে না জড়ানোই ভাল”।
সৌরভ বলল, “ব্রেক আপ হওয়া মেয়েদের সঙ্গে?” জোরে হেসে উঠল সৌরভ, “কোন দুনিয়ায় থাকো তুমি? পৃথিবীতে সবাই কোন না কোন রিলেশনে আছে। আজব মানসিকতা তো?”
স্বাতী বলল, “দেখেছো, তোমাকে এটা নিয়ে কিছু বললেই তুমি কেমন রেগে যাচ্ছো? এর মানে হল আমার সন্দেহ অনেকটাই সত্যি। ঠিক আছে, আমি কিছু বলব না, আমি তো এ বাড়িতেই থাকব, দেখব তুমি কী কর”।
স্বাতী রেগে মেগে ঘরে চলে গেল।
মা অবাক হয়ে বললেন, “কী হয়েছে? ও কী বলছে ডিভোর্সি না কী?”
সৌরভ হাত জোড় করল, “কিচ্ছু না, আমার কথা বলাই ভুল হয়েছে। যাই বলব, সেটা ভুল হোক ঠিক হোক, ব্রেকিং নিউজ করে দেওয়া হয়। আমি আর কিচ্ছু বলব না”।
৩১
বাবা কোথাও একটা বেরিয়েছে। শমীক সবে বই খুলে বসেছিল, অঞ্জনা ফোন করল। প্রথমে ধরল না শমীক। অঞ্জনা আবার ফোন করল। এবার ধরল সে। অঞ্জনা বিরক্ত গলায় বলল, “ফোন ধরছিস না কেন?”
শমীক বলল, “তোকে ইগনোর করা প্র্যাকটিস করছিলাম”।
অঞ্জনা বলল, “ইগনোর করার কী আছে? তোকে কি বলেছি আমায় ইগনোর করতে?”
শমীক বলল, “তুই বলেছিস আমরা যদি কথা বলি, তাহলে আমরা আবার কোন সেক্সুয়াল রিলেশনশিপে জড়িয়ে পড়তে পারি যেটা তুই চাস না। এর একটাই উপায় হল আমরা আর কথা বলব না। কথা বলেই সমস্যা তৈরি হবে”।
অঞ্জনা বলল, “তা বলে তুই ওই শিঞ্জিনী না কী বিচ আছে একটা, ওর সঙ্গে কথা বলবি? ও তো জাস্ট সুযোগ খুঁজছিল তোর কাছে আসার জন্য। সুযোগ পেয়ে গেছে, এখন ও একবারে তোর গা ঘেঁষে বসে পড়েছে। দিস ইজ নট ডান”!
শমীক বলল, “বিচ মানে? বিচের কী আছে? কেউ কারো সঙ্গে কথা বলতে গেলে সে বিচ হয়ে যায়? তুই এটা কী বললি? ঠিক বললি না। হোপফুলি আন্টি নিশ্চয়ই শোনে নি তুই এই ওয়ার্ডটা ইউজ করলি”।
অঞ্জনা বলল, “মা যা ইচ্ছে শুনুক আমার জানার দরকার নেই। আমি তোকে বলছি, তুই ওই শিঞ্জিনীর থেকে দূরে থাকবি”।
শমীক বলল, “কেন বল তো? আমাকে সব সময় তোর কথা শুনে চলতে হবে কেন? প্রথমে তুই বললি আমার সঙ্গে হোটেলে যাবি। ফাইন, আমি তোর সঙ্গে গেলাম। ওখানে গিয়ে বললি আমার সঙ্গে কোন সেক্সুয়াল অ্যাটাচমেন্ট তোর পছন্দ না, চলে এলি। আমি সেটাও মেনে নিলাম। এরপর বললি তোর থেকে দূরে থাকতে। আমি তাও মেনে নিলাম। এখন আমি কার সঙ্গে মিশব, কার সঙ্গে কথা বলব, সেটাও তুই ঠিক করে দিবি? আমি কেন তোর কথা শুনব?”
অঞ্জনা রেগে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে। শুনতে হবে না। গো টু হেল”।
ফোন কেটে গেল। শমীক কিছু করল না। শান্তভাবে ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকল। অঞ্জনা পরমুহূর্তেই ফোন করল। ও এটাই করে। রেগেমেগে ফোন কেটে দিয়ে আবার ফোন করে। শমীক ধরে বলল, “বল”।
অঞ্জনা বলল, “আই অ্যাম সরি। আমার মনে হয় তোকে আমার থেকে দূরে থাকতে বলাটা আমার ঠিক কাজ হয় নি”।
শমীক বলল, “তুই ভেবে বলছিস তো? তোর তো কোন ঠিক নেই। আবার কাল দেখা যাবে তোর ডিসিশন চেঞ্জ হয়ে গেছে। এত বার ডিসিশন চেঞ্জ করিস না, তুই বরং সময় নে। আরো বেশি করে ভাব। দেখ আউট অফ জেলাসি কোন ডিসিশন নিচ্ছিস কি না”।
অঞ্জনা বলল, “আউট অফ জেলাসি, ওই বিচটার সঙ্গে আমি নিজেকে তুলনা করি নাকি? তুই ভাবলি কী করে? এখানে আউট অফ জেলাসির কিছু নেই। তোর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছি, তাই তোকে সরি বলছি। এখানে আর কারো থাকার কারণ নেই”।
শমীক বলল, “আমি তাহলে কী হব? তোর বন্ধু?”
অঞ্জনা বলল, “অবভিয়াসলি। আমি এখন জানি না আদৌ আমি সেক্সুয়ালি অ্যাকটিভ নাকি। হতেই পারে আমি ফ্রিজিড। কার সঙ্গে কথা বলব? কথা বলার কেউই নেই। তার কোন ডিসিশনও নেওয়া যাবে না এখন। আমি আর তুই যেরকম কথা বলতাম, সেরকমই বলব। এর বাইরে কিছু না। কোন রকম হোটেল এটসেট্রায় যাওয়ার ব্যাপারে আর ফারদার কিছু ভাব না। ঠিক আছে?”
শমীক বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তুই একটা কথা জেনে রাখ। আমি কার সঙ্গে মিশব, কার সঙ্গে কথা বলব, সেটা তুই ঠিক করে দিবি না। এভাবে কাউকে কন্ট্রোল করা যায় না, তুই জানিস বোধ হয় সেটা, তাই না?”
অঞ্জনা বলল, “মানে? তুই শিঞ্জিনীর সঙ্গে মিশবি তার মানে?”
শমীক বলল, “হ্যাঁ”।
অঞ্জনা ফোন কেটে দিল। শমীক জানে এরপরে অঞ্জনা আর ফোন করবে না।
করলোও না।
৩২
সৌরভ ঘরে শুয়ে শুয়ে মোবাইল ঘাঁটছিল। মা ঘরে ঢুকে তার খাটে বসে বলল, “কত দূর এগিয়েছে?”
সৌরভ অবাক হয়ে বলল, “কী কত দূর এগিয়েছে?”
মা বলল, “ওই যে স্বাতী যেটা বলছিল সেটা। ওই ডিভোর্সি মেয়েটার সঙ্গে সম্পর্কটা কতদূর এগিয়েছে?”
সৌরভ উঠে বসে বলল, “কী শুরু করেছো বল তো তোমরা? একটা স্বাভাবিক ব্যাপারকে নিয়ে কত দূর কত দূর শুরু করে দিলে? মানেটা কী? আমার কোন মেয়ে কলিগ থাকতে পারে না?”
মা বলল, “শোন, ব্যাপারটা বোঝ। স্বাতী ঠিকই বলেছে। একটা ডিভোর্সি মেয়ে মানে অনেক সমস্যা নিয়ে ঘোরা মেয়ে। তার আগের রিলেশন, সেটা নিয়ে সব সময় কমপ্যারিজন চলতে থাকবে। সুখ থাকে না, বুঝলি? আবার যে মেয়ে একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে, তাকে বিয়ে করলেও অনেক সমস্যা তৈরি হতে পারে। বিয়ের আগে এগুলো বুঝতে হয়।”
সৌরভ বলল, “তোমাদের সমস্যাটা কী জানো তো? প্রথমত, তোমরা ‘ক’ দেখলে ভাবো গোটা উপন্যাস পড়ে ফেলেছ। দ্বিতীয়ত, তোমরা দু আড়াইশো বছর পিছিয়ে আছো। ডিভোর্সি মেয়ে মানে এত সমস্যা হয় কে বলেছে তোমাদের?”
মা তার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছিস? এর মধ্যেই ডিফেন্ড করতে শুরু করে দিয়েছিস?”
সৌরভ মাথায় হাত দিল, “ডিফেন্ড করছি? এটাকে ডিফেন্ড করা বলে? ডিভোর্সি মেয়ে মানে সে আর কোন দিন বিয়ে করতে পারবে না? এ কোন যুগে পড়ে আছো বল তো?”
মা কঠিন গলায় বলল, “আমি ওসব জানি না। তুই কোন ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করবি না, ব্যস”।
সৌরভের মাথায় রক্ত চড়ে গেল, “এটাই যদি হয়, তাহলে আমি ডিভোর্সি মেয়েই বিয়ে করব। যাকে পাবো তাকে বিয়ে করব। সবার আগে তোমাদের এসব মধ্যযুগীয় মানসিকতা পাল্টানো দরকার”।
মা বলল, “সে যে মানসিকতাই হোক, আমি যা বলছি, সেটা শুনলে ভাল থাকবি”।
সৌরভ বলল, “ভাল থাকাথাকির কিছু নেই। তুমি বা তোমরা যে কথাগুলো বলছো, সে কথাগুলো আজকের দিনে এসে কেউ বলে না। লজ্জা লাগা দরকার, পড়াশুনা করা লোকজন এসব কথা বলে”।
মা বলল, “ডাইনিটা এর মধ্যে তোকে এভাবে বশ করে ফেলেছে”?
সৌরভ রেগে মেগে ছাদে চলে গেল। মাথা কাজ করছে না। সামান্য জিনিস থেকে যে কত দূর কত কিছু হতে পারে, তাদের বাড়িতে না থাকলে কেউ জানতে পারবে না। এদের জন্য ওই ডিভোর্সি মেয়েই দরকার। কোন যুগে পড়ে আছে কে জানে।
ফোন বাজছিল। সৌরভ দেখল রায়া ফোন করছে। এত রাতে? সে ফোন ধরতে না ধরতেই ফোনটা কেটে গেল। ভ্রূ কুঁচকে সে কল ব্যাক করল।
রিং হয়ে গেল, রায়া ফোন ধরল না। সৌরভ রেগে গেল। এ আবার কী? সে আবার ফোন করল। এবার রায়া ফোন ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “হ্যালো স্যার”।
সৌরভ বিরক্ত গলায় বলল, “কী হল? মিসড কল মারছ কেন?”
রায়া বলল, “স্যার ভুল করে হাত পড়ে গেছে। সরি স্যার”।
সৌরভ বলল, “হাত পড়ে গেলে যখন কল ব্যাক করছি, ধরবে তো। ঠিক আছে, গুড নাইট”।
ফোন কেটে সৌরভ পায়চারি করতে লাগল। মা ছাদে চলে এসেছে। বলল, “ঠিক আছে, ওই মেয়েটার ফোন নাম্বার দে। আমরা কথা বলি”।
সৌরভ ঠাণ্ডা হবার চেষ্টা করল, “তুমি কি চাও আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই?”
মা বলল, “আজে বাজে মেয়ে বিয়ে করে আনিস না। আমি বলছি শোন। আমাকে কথা বলতে দে। আমি একবার কথা বলতেই বুঝে যাবো”।
রায়া আবার ফোন করছে। সৌরভের ফোন বাজছে দেখে সৌরভ ফোন কেটে দিল। মা বলল, “এই তো, ওই মেয়েটাই ফোন করেছে তো? আমাকে দে। আমি কথা বলছি”।
সৌরভ বলল, “কোন মেয়ে ফোন করছে না। আমাদের কলেজের স্টুডেন্ট, পড়ার ব্যাপারে ফোন করছে। আমাকে একটু একা থাকতে দাও মা, ফালতু ঝামেলা কোর না”।
মা বলল, “এই স্টুডেন্ট ডিভোর্সি?”
সৌরভ মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এই স্টুডেন্ট ডিভোর্সি হবে কেন?”
মা বলল, “তাহলে এত রাতে ফোন করছে কে? আমি তোর এসব ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করি নি কোন দিন। এখন দেখছি করতে হবে। তুই কী করছিস কে জানে। কাল থেকেই তোর জন্য মেয়ে দেখব। কী শুরু করেছিস তুই!”
মার গলা কাঁদো কাঁদো শোনাল। সৌরভ আবার ছাদ থেকে নেমে তার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এ বাড়িতে থাকলে খুব শিগগিরি সে পাগল হয়ে যাবে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল।
৩৩
“একটা ভুল হয়ে গেছে”।
শিঞ্জিনী ঘুমিয়ে পড়েছিল। রায়া শিঞ্জিনীর ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বলল।
শিঞ্জিনী ঘুম জড়ানো বিরক্তি মাখা গলায় বলল, “কী হয়েছে? তুই কি ঘুমোতেও দিবি না?”
রায়া গড়গড় করে বলে চলল, “আমি এস ডিকে ফোন করে ফেলেছিলাম। রাত এগারোটা নাগাদ। বললাম স্যার ভুল করে হাত চলে গেছে। তারপর আবার ভাবলাম একটু কথা বলি। এখন ফোন করে হেবি ঝাড় দিল। বলল এত রাতে কেন ফোন করছি”।
শিঞ্জিনী বলল, “ঠিক হয়েছে। ফোনের ওপার থেকে হাত বাড়িয়ে তোর কান মুলে দিলে আরো ভাল হত। তুই একটা লাইন ক্রস করছিস। বুঝতে পারছিস সেটা”?
রায়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “আমি তো ওর কাছে কনফেস করে নিতে চাইছিলাম। ফোন ধরতেই মনে হচ্ছে বোবায় ধরছে। কিছু বলতেই পারছি না”।
শিঞ্জিনী বলল, “এত রাতে ফোন করতে নেই, সেটা বুঝছিস না”?
রায়া বলল, “আমার যা টেনশন হচ্ছে, রাত দিন কি মাথায় থাকে বল। শোন না, ডিলিট করা ফেক প্রোফাইল ট্র্যাক করা যায়?”
শিঞ্জিনী বলল, “সব করা যায়। না করার কিছু নেই। যারা করে, সবসুদ্ধ বের করে দেবে। তুই চিন্তা করিস না। ঘুমিয়ে পড়। যা হবে দেখা যাবে”।
রায়া বলল, “কী দেখা যাবে ভাই? আমার মা বাবা আমার এস ভেঙে দেবে”।
শিঞ্জিনী বলল, “এস ভাঙুক, জি ভাঙুক, যা খুশি ভাঙুক, তুই আমাকে এখন ঘুমোতে না দিলে তোকেই ভেঙে দেব আমি। ঘুমোবি?”
রায়া বলল, “কী বাজে চাপ হয়ে গেল। আচ্ছা, তুই ঘুমা, আমি ম্যানেজ করতে পারি নাকি দেখি”।
শিঞ্জিনী বলল, “কী ম্যানেজ করবি তুই? বেশি বুদ্ধি খাটাতে যাস না, আরো বড় কেস খেয়ে যাবি”।
রায়া বলল, “আমি আরেকটা কনফেশন করে দি ক্ষমা চেয়ে? যে খুব বড় ভুল হয়ে গেছে, আমার কিছু পোস্ট করা উচিত হয় নি, এসব লিখে দেব?”
শিঞ্জিনী হতাশ গলায় বলল, “অনেক তো ছড়িয়েছিস, আর ছড়াস না মা। তুই ঘুমো। আমাকে বাঁচা। প্লিজ”।
রায়া ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগল। শিঞ্জিনী ঘুমিয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণ পরে রায়া দেখল হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ এসেছে আননোন নাম্বার থেকে, “hi, frandship korba?”
রায়া বলল, “কে বে তুই? জানিস আমার বয়ফ্রেন্ড সাইবার সেলে কাজ করে? ধরে একবারে বারোটা বাজিয়ে দেবে। ভাগ”।
মেসেজটা সিন হতেই তাকে ব্লক করে দিল নাম্বারটা। রায়া হোয়াটস অ্যাপে সৌরভের ডিপি বের করে সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “এবারের মত ক্ষমা করে দাও। আমি আর করব না। বিরাট কেস খেয়ে যাব। প্লিজ এবারের মত ছেড়ে দাও”। সে কনফেশন পেজ খুলল। দেখল একটা কনফেশন পোষ্ট হয়েছে,
#এফ, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।
খুব খারাপ লাগল যে আমাদের স্টুডেন্টদের মধ্যে কেউ এস ডি আর এ বিকে টিজ করে একটা কনফেস করেছে। এস ডি ক্লাসে এসে আজ যেভাবে রেগে গেছিলেন, সেটা দেখে আমার খুব খারাপ লেগেছে। এত ডিসেন্ট একজন স্যার, এত ভাল, আমি ওকে খুব সম্মান করি। ভাললাগে। যারা কাজটা করেছে, ঠিক করে নি।
কমেন্ট ১- ওরে মামণি, এর মধ্যে এস ডিকে প্রপোজ করে দিলি? জিও, বিয়ে করে ফেল, আমরা খেতে যাবো।
কমেন্ট ২ – এটা কালকের মামণিটাই, আবার ফুটেজ খেতে চলে এসেছে।
…
রায়ার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। সে শিঞ্জিনীকে আবার ঠেলে তুলে দিল। শিঞ্জিনী বলল, “কী হল? এবার কিন্তু আমি চিৎকার করব”!
রায়া বলল, “কোন একটা মেয়ে কনফেশন পোষ্ট করেছে এস ডিকে নাকি পছন্দ করে। আমি মেরে ফেলব। এত বড় সাহস! আমি থাকতে আমার সৌরভের দিকে নজর”।
রায়া প্রায় চিৎকার করে উঠছিল। শিঞ্জিনী রায়ার মুখে হাত দিয়ে বলল, “ওরে গলা নামিয়ে কথা বল। পিজি থেকে বের করে দেবে”।
রায়া বলল, “আমি গলা টিপে মেরে ফেলব। এত সাহস হয় কী করে?”
শিঞ্জিনী রায়ার অবস্থা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে রইল।
৩৪
সুমনার ঘুম আসছিল না। টিভি দেখছিলেন। অঞ্জনা ড্রইং রুমে এসে রিমোটটা নিয়ে একটার পর একটা চ্যানেল চেঞ্জ করতে শুরু করল।
সুমনা কয়েক সেকেন্ড মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “কী হয়েছে তোর?”
অঞ্জনা বলল, “কিছু হয় নি”।
সুমনা বললেন, “ঠিক আছে। বলিস না। কিন্তু রিমোটটার বারোটা বাজাস না। খারাপ হলে আমি এখন রিমোট কিনতে বেরোতে পারব না”।
অঞ্জনা বলল, “কী হবে রিমোট ঠিক থাকলে? সারাদিন তো সিরিয়ালগুলো গেলো। কার বরের দুটো বউ, কার বউ জেলে চলে গেল, সারাদিন ধরে এসব গিলে যাচ্ছো। রিমোট খারাপ হলে হবে”।
সুমনা বললেন, “ঠিক আছে, সে তো বুঝলাম। তুই মাথা ঠাণ্ডা কর। এত রাতে তো তুই কখনো টিভির চ্যানেল পাল্টাতে আসিস না, তাই ভাবছিলাম আর কী। শমীকের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে”?
অঞ্জনা মার দিকে রাগী একটা দৃষ্টি হেনে বলল, “শমীক? শমীকের সঙ্গে ঝগড়া হলে আমি কেন রাগতে যাবো? ও যেখানে ইচ্ছে যাক, যা ইচ্ছে করুক, আমার কী”?
সুমনা হাসলেন, “বুঝেছি। ব্যাপারটা তাহলে শমীককে নিয়েই হয়েছে, তাই তো? ভাল। আবার কী নিয়ে লাগলো?”
অঞ্জনা বলল, “কিছু নিয়ে লাগে নি। সব ঠিক আছে। ইউ টেক রেস্ট”।
সুমনা বললেন, “তোর মনে হচ্ছে আমি রেস্ট করছি মাঝরাতে?”
অঞ্জনা বলল, “আবার কী করছ? টিভি দেখাটা তো রেস্টের মধ্যেই পড়ে জানতাম”।
সুমনা বললেন, “ঠিক আছে তবে। রেস্টই করছি। তুই মাথা ঠাণ্ডা কর। এত মাথা গরম থাকলে তো সমস্যা”।
অঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে। আমার মাথায় কোন সমস্যা নেই। যথেষ্ট ঠাণ্ডা আছি আমি। কিছু হয় নি”।
সুমনা বললেন, “সে তো বুঝতেই পারছি”।
অঞ্জনা বলল, “এই শিঞ্জিনীটা ভীষণ ন্যাকা একটা মেয়ে”।
সুমনা বললেন, “এভাবে বলতে নেই”।
অঞ্জনা বলল, “এভাবেই বলতে হয়। ন্যাকা আর ওই যে কী যেন বলে না, হ্যাঁ, ঢলানি”।
সুমনা অঞ্জনার দিকে চোখ বড় করলেন।
অঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে। মানে ব্যাপারটা ওরকমই। শুধু শমীকের গায়ে ঢলে পড়ে”।
সুমনা বললেন, “এভাবে কথা বলতে নেই কারো সম্পর্কে। কথা ঠিক কর”।
অঞ্জনা বলল, “পারলাম না। এত ডিপ্লোম্যাটিক হতে পারব না। কেন ভালভাবে কথা বলব কারো সম্পর্কে যখন দেখি সে একবারেই ঠিক নেই? যে যেরকম, তার সম্পর্কে সেরকম কথাই তো বলব নাকি? আর শমীকও তো কম যায় না। ওর সঙ্গে কথা বলেই যায়। কেন বলবে?”
সুমনা বললেন, “তোর সমস্যাটা কী বল তো? তোর মন মত কিছু না হলেই তুই রেগে যাস, চিৎকার করতে শুরু করে দিস। এত বড় জীবন পড়ে আছে, এখনও তুই নিজেকে কন্ট্রোল না করলে ফিউচারে সমস্যায় পড়ে যাবি। তুই কী করে ভাবলি শমীক বা শিঞ্জিনীকে তোর কথা মত চলতে হবে? ওরা প্রত্যেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইন্ডিভিজুয়াল এন্টিটি। ওরা যে তোকে দলছুট করে দেয় নি, তোর ভাগ্য ভাল। তুই ভুলেও ভাবিস না তুই ক্লাস টপার বলে সবাই তোকে আলাদা করে সম্মান করবে। সম্মান ওভাবে পাওয়া যায় না। কন্ট্রোল করতে যাস না কাউকে। সমস্যায় পড়ে যাবি”।
সুমনার সব কথা অঞ্জনা শুনে গুম হয়ে গেল। কোন কথা বলল না। টিভির দিকে ফিরে আবার অস্থিরভাবে চ্যানেল চেঞ্জ করতে শুরু করে দিল।
সুমনা বললেন, “আমার মনে হচ্ছে তোর আর শমীকের মধ্যে কোন ইমোশনাল রিলেশনশিপ তৈরি হয়েছে। এরকম কিছু হয়েছে কি?”
অঞ্জনা সুমনার দিকে ফিরে হাত জোড় করে বলল, “দয়া করে ওই সব বাংলা সিরিয়াল দেখা বন্ধ করবে? সব কিছুকেই রিলেশনশিপে কনভার্ট করে ফেলাটা বন্ধ কর দয়া করে। এখানে রিলেশনের কী আছে?”
সুমনা বললেন, “নেই? তাহলে ভাল। তবে যেটাই করবি, ভেবে টেবে করিস বাপু। দিনকাল ভাল না। শমীকের উপর রাগ করে আবার এমন কোন ফালতু ছেলের সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়ে পড়িস না যাতে জীবন নষ্ট হয়ে যায়। এটাই হয় রে। একজনের উপর রাগে নিজের জীবনের বারোটা বেজে যায়”।
সুমনা শ্বাস ছাড়লেন।
অঞ্জনা রেগে মেগে নিজের ঘরে চলে গেল।
৩৫
কোন কোন রাত এমন আসে, মাথা গরম হয়ে থাকে। অন্য কোন কাজে মন দেওয়া যায় না। মা আর বৌদির ব্যবহার সৌরভের মাথা গরম করে দিয়েছিল। সে ঘুমোতে পারছিল না। যে মানুষগুলোর সঙ্গে সে থাকে, তাদের মানসিকতা নিয়েই যদি তার মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে, তাহলে সব কিছু মেনে নেওয়া বড় কঠিন হয়।
কী মনে হতে হোয়াটস অ্যাপ খুলে অরুন্ধতীর কন্ট্যাক্টটা খুলে দেখল অনলাইন দেখাচ্ছে। সে লিখল “সব ঠিক আছে তো?”
অরুন্ধতী অবাক হবার স্মাইলি দিয়ে লিখল, “হ্যাঁ, ঠিক আছে। কেন বল তো?”
সৌরভ লিখল, “এত রাতে অনলাইন দেখে লিখলাম আর কী”।
অরুন্ধতী হাসির স্মাইলি দিয়ে লিখল, “তুমিও তো অনলাইন। পড়ছিলে নাকি?”
সৌরভ লিখল, “নাহ। পড়ায় মন বসে নাকি? আচ্ছা তোমার সমস্যাটা কী ছিল? যদি না বলতে চাও চাপ নেই”।
অরুন্ধতী লিখল, “হঠাৎ? এত রাতে?”
সৌরভ লিখল, “এমনিই মনে হল। অ্যাকচুয়ালি আমরা কলিগ। আমি তো বেশি কথা বলি না কারো সঙ্গে। হঠাৎই মনে হল তোমার অনেক সমস্যা আছে, আমিই জানতে চেষ্টা করি নি। এটা ঠিক করি নি”।
অরুন্ধতী লিখল, “ধুস। অতো চাপ নিও না। ইটস ওকে। অন্যের সমস্যা জেনে কীই বা করবে? কেউ কেউ আবার ভাবে আমি সিম্প্যাথি নেওয়ার চেষ্টা করছি। কিছু না জানাই ভাল”।
সৌরভ লিখল, “না, ঠিক আছে। তুমি চাইলে আমাকে ভেন্ট করতে পারো। আমি কাউকে কিছু বলার লোক নই”।
অরুন্ধতী লিখল, “বলব। ভেবো না। ভালো লাগে না অ্যাকচুয়ালি। মনে হয় সারাক্ষণ নিজের কাঁদুনি গেয়ে যাচ্ছি। কোনকালেই এরকম ছিলাম না জানো তো”।
সৌরভ হাসির স্মাইলি দিল, “পরিস্থিতি মানুষকে পাল্টায় জানি। ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে”।
অরুন্ধতী লিখল, “বাই দ্য ওয়ে, কলেজে তোমার বেশ ক্রেজ আছে ছাত্রীমহলে। কে আবার কনফেস করেছে তোমাকে পছন্দ করে”।
সৌরভ হেসে ফেলল, “কলেজ লাইফ ক্রাশ ম্যাম। ও সব কেটে যায়। ও নিয়ে ভাবলে হয় নাকি?”
অরুন্ধতী লিখল, “তা ঠিক। সত্যি কেটে যায়। আমারও একজন কলেজ লাইফ ক্রাশ ছিল। পরে সে-ই আমার হাজব্যান্ড হয়। ভাবা যায় না একজন মানুষ কি করে ক্রাশ থেকে বাঁশ হয়ে যায়”।
সৌরভ লিখল, “সরি টু হিয়ার দ্যাট”।
অরুন্ধতী লিখল, “মাঝে মাঝে মনে হয় আমি পাগল হয়ে গেছি। অনেকেই বলে আমি সারাক্ষণ ওকে নিয়ে ভেবে যাচ্ছি। এটা ঠিক না। আচ্ছা কেন ভাবব না বল? একটা লোক, যাকে আমি ঈশ্বরের মত ভেবেছি বরাবর, তার কুৎসিত কদাকার রূপ দেখলে যে শকটা লাগে, সেটাকে কী করে সহ্য করা যায়? আচ্ছা আমি কল করি? এত কথা লিখে বলতে প্রব্লেম হয়”।
লেখাটা পড়ে সৌরভই ফোন করল। অরুন্ধতী ফোন ধরে বলল, “তুমি হঠাৎ করে আমায় এসব জিজ্ঞেস করছো কেন?”
সৌরভ বলল, “আমার কেন জানি না বিকেলে মনে হল তুমি কোন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছ। তোমার বন্ধুর অভাব হচ্ছে। সেটা ভেবেই তোমাকে বললাম। তোমার যদি কিছু বলার ইচ্ছে হয়, আমাকে বলতে পারো”।
অরুন্ধতী ম্লান হাসল, “কী আর বলি বল তো। কিছুই বলার নেই। আমার আর পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে ইচ্ছেও করে না। বাই দ্য ওয়ে, মিস্টার কলেজ ক্রাশ, তুমি কি ধরতে পেরেছো কে বা কারা তোমায় এত ভালোবাসে বা পছন্দ করে?”
সৌরভ বলল, “নাহ, পারি নি। পারলে ধমক চমক দেবো আর কী। ব্যাপারটা ক্রাশ অবধি ঠিক ছিল, কনফেশন পেজের আড়ালে ব্যাপারগুলো নোংরামো হয়ে যাচ্ছে”।
অরুন্ধতী বলল, “ঠিক আছে। এত রাতে এসব নিয়ে ভেবো না। ঘুমিয়ে পড়। কালকে তো সেই কলেজ”।
সৌরভ বলল, “ওহ, তুমি ঘুমোবে? ঠিক আছে”।
অরুন্ধতী বলল, “আমি? ঘুম? এই কম্বিনেশনটা বহুদিন নষ্ট হয়ে গেছে হে! বহুদিন ঘুমাই না। সারারাত জেগে থাকি। কিন্তু তোমাকে জাগতে হবে না। ঘুমোও”।
সৌরভ দুঃখিত গলায় বলল, “ডাক্তার দেখাতে পারো তো”।
অরুন্ধতী বলল, “কী লাভ? ট্রিটমেন্ট চলতে চলতে তেনার যদি আবার আমাকে জ্বালানোর ইচ্ছে চলে এল তো আবার সব চলে গেল! কী দরকার! এভাবেই চলুক”।
সৌরভ চুপ করে রইল।
মানুষকে কত কষ্ট সামলে টিকে থাকতে হয় এই পৃথিবীতে!
৩৬
রায়া সারারাত ঠিক করে ঘুমোতেই পারল না। শেষ রাতে ঘুমোল। শিঞ্জিনীর ঘুম ভাঙল সকাল আটটায়। ব্রেকফাস্ট করার আগে রায়াকে ডেকে তুলল। রায়া চোখ মুছে বলল, “আমি ভাবছি আজ বাঙ্ক মারব”।
শিঞ্জিনী রাগী গলায় বলল, “ঠিক কী আনন্দে? কাল কলেজ থেকে চলে এলি, আজকেও যাবি না? এন্ড অফ দ্য ডে তোকে পড়াশুনাটা করতে হবে, সেটা মাথায় আছে তো রে? অ্যাটেনডেন্স না থাকলে সেমিস্টারে বসতে দেবে না তখন বুঝবি”।
রায়া কাতর চোখে তাকিয়ে বলল, “রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো একবারেই বাঙ্ক মারি না। কলেজে গেলেই তো সবাই আমার দিকে কেমন কেমন চোখে তাকাবে কালকের জন্য। আমার ওইরকম চোখ ভাল লাগে না”।
শিঞ্জিনী বলল, “ফেস কর। একটা গোটা দিন চলে গেছে। কেউ কিচ্ছু মনে রাখে না। লোকের খেয়ে দেয়ে অতো কাজ নেই যে সব কিছু মনে রেখে দেবে। নরমালি ক্লাস কর। বরং তুই কলেজে না গেলে সবার স্ট্রাইক করবে, রায়া কোথায়? কোথায় গেল?”
রায়া বলল, “ভাল্লাগে না। ধুস। কবে শনিবার আসবে বলতো? ধুস ধুস”।
শিঞ্জিনী বলল, “উঠে পড়। রেডি হয়ে নে। তোকে না নিয়ে আমি নড়ছি না”।
রায়া ব্যাজার মুখে বাথরুমে ঢুকল। তৈরি হয়ে দুজনে বেরিয়ে বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখল শুভ্র গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। শিঞ্জিনীদের দেখেই শুভ্র খুব ডাঁটের মাথায় বলল, “কোথায় যাবি?”
শিঞ্জিনী বলল, “দিল্লি যাবো দাদা। এখান থেকেই দিল্লির বাস ছাড়ে না?”
শুভ্র রেগে গিয়ে বলল, “আমার সঙ্গে কি ইয়ার্কি করছিস?”
শিঞ্জিনী বলল, “না। এমনিই বললাম। কোথায় আর যাবো বল? কলেজের সময় তো লোকজন কলেজেই যায়, তাই না?”
শুভ্র বলল, “সেটা বলতেই পারতিস। ট্যারা ব্যাকা রিপ্লাই দেওয়ার তো কিছু ছিল না। এই জন্যই ঠিক করে র্যাগিং হবার দরকার ছিল তোদের। কোভিডের জন্য বেঁচে গেছিস। ঠিক ঠাক র্যাগিং হলে একদম শিখে যেতিস সিনিয়রদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়”।
শিঞ্জিনী বলল, “এটা ঠিক। তুমি চাইলে র্যাগিং করতেই পারো। তবে কী সব অ্যান্টি র্যাগিং কমিটি আছে শুনেছিলাম কলেজে? তুমি তো চাকরি পেয়ে গেছো? র্যাগিং করতে গিয়ে যদি চাকরিটা চলে যায়, তাহলে কি ভাল হবে দাদা?”
শুভ্র বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে। তোদের সঙ্গে কথা বলাই বিপদ। যা পারিস কর”।
অন্যসময় হলে রায়া প্রচুর হাসত, এখন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। শিঞ্জিনী সেটা বুঝে বেশি কথা বাড়াল না। বাসের রাস্তাটাও রায়া গম্ভীর হয়েছিল। বাস থেকে নামতেই তাদের চোখে পড়ল, একটা ভ্যানে সৌরভ আর অরুন্ধতী হাসতে হাসতে গল্প করতে করতে যাচ্ছে। রায়া সেটা দেখেই শিঞ্জিনীকে বলল, “দেখ, দেখ। কী খুশি দেখ। এর পরেও তুই বিশ্বাস করতে বলছিস ওদের মধ্যে কিছু নেই?”
শিঞ্জিনী বলল, “বিশ্বাস না করলে করিস না। তুই এটা নিয়ে অকারণ আপসেট হচ্ছিস কেন?”
রায়া বলল, “জানি না। যদি জানতে পারতাম ওরা সত্যিই রিলেশনে আছে, তাহলে আমি আর বেশি ভাবতাম না। আমি মনে হয় বেশি ভেবে ফেলছি”।
শিঞ্জিনী বলল, “তা তো ফেলছিসই। এটা নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? ব্যাপারটা নিয়ে ভেবে ভেবে এমন জায়গায় চলে গেছিস, এখন উলটো পাল্টা কাজ করে যাচ্ছিস। ছড়িয়ে লাট করে দিচ্ছিস। মাথা ঠাণ্ডা কর। গোটা ব্যাপারটা আবার নতুন করে ভাব”।
রায়া অনেকটাই নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছিল। বলল, “আমি সরে যাই বরং। এসব নিয়ে আর ভাবব না”।
শিঞ্জিনী শ্বাস ছেড়ে বলল, “এই ডিসিশনটা মনে হয় তুই চার হাজার বার নিয়ে নিলি, তাই না?”
রায়া বলল, “কী করব বল? আমি চাইলেও তো কাটিয়ে দিতে পারি না। বুকটা কেমন হু হু করে”।
শিঞ্জিনী বলল, “পুরো ভরপেট কেস যতক্ষণ না খাচ্ছিস, ততক্ষণ এরকমভাবেই হু হু করবে। তারপর কেস খেলে বুঝবি কেমন লাগে। ওরা কীভাবে গেল দেখলি না? এখন তো তোর গান করা উচিত ছিল ‘দেখেছিলাম আলোর নিচে, অপূর্ব সেই আলো, স্বীকার করি দুজনকেই মানিয়েছিল ভাল’”।
রায়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলল, “এরকম করলে কিন্তু আমি পিজিতে ফিরে যাবো”।
শিঞ্জিনী বলল, “যা না। তারপর আমি কাকিমাকে ফোন করে বলব তুই কী করছিস”। রায়া দুঃখিত হয়ে বলল, “তুই পারবি?”
শিঞ্জিনী বলল, “কেন পারবো না। তোর নউটঙ্কি আর সহ্য হচ্ছে না। এবার নতুন একটা কাউকে ধরে ঝুলে পড়”।
শুভ্র সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। শিঞ্জিনী ফিসফিস করে রায়াকে বলল, “আমাদের বিল্ডিং এ এই দাদাটা থাকে। চাকরিও পেয়েছে। ঝুলে পড়”।
রায়া রেগে মেগে শিঞ্জিনীকে জোরে চিমটি কেটে দিল।
৩৭
সৌরভ ল্যাবে ঢুকতে গিয়ে দাশু ল্যাবের বাইরে বসে আছে। সে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”
দাশু গম্ভীর গলায় বলল, “স্যার সিক্রেট কথা”।
সৌরভ ল্যাবের দরজা খুলে বলল, “ভেতরে এসো”।
দাশু ল্যাবে ঢুকল।
সৌরভ চেয়ারে বসে বলল, “বল তোমার কী সিক্রেট কথা আছে”।
দাশু বলল, “স্যার, আপনি হেবি পপুলার। কত মেয়ে ফ্যান আপনার। একটার পর একটা কনফেশন এসেছে কাল থেকে আপনার হয়ে। আমি পোষ্ট করার আগে ভাবলাম আপনার পারমিশন নিয়ে নি। কী করব স্যার? ওগুলো পোস্ট করব?”
সৌরভ বলল, “একবারেই না। সব কিছুর একটা লিমিট থাকা উচিত। সেটা রাখো”।
দাশু বলল, “ঠিক আছে স্যার। আমি কেস খেতে চাই না। আমি তো মজা করতে পেজটা খুলেছিলাম, কেস খাবো কেন বলুন?”
হাসি পেলেও সেটা চেপে রেখে সৌরভ বলল, “হ্যাঁ, ঠিক করেছো। এবার ক্লাস কর”।
দাশু হাই তুলে বলল, “স্যার ক্লাস করতে ইচ্ছে করে না। এখন একটু মাচায় বসে থাকব”।
সৌরভ বলল, “ক্লাস না করলে আমি স্টেপ নেব তোমার এগেইন্সটে”।
দাশু ব্যাজার মুখে করে বলল, “স্যার এটা ব্ল্যাকমেইল হয়ে গেল। এটা আপনার থেকে আশা করি নি”।
সৌরভ বলল, “অ্যাটেনডেন্স কম থাকলে সেমিস্টারে বসতে পারবে না, সেটা ভাল লাগবে?”
দাশু বলল, “এটা ঠিক না স্যার। অ্যাটেনডেন্সের ঝামেলা না রেখে সেমিস্টার করা উচিত। ওসব কেন থাকবে?”
সৌরভ বলল, “এখানে থ্রি ইডিয়টস চলছে না। কলেজের কিছু নিয়ম আছে, সেগুলো মেনে চলো, তাছাড়া আমি তো বললামই, ক্লাস না করলে আমি কী করব”।
দাশু বলল, “স্যার এটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ”।
সৌরভ এবার হেসে ফেলে বলল, “ক্লাসে যাও। অনেক হয়েছে”।
দাশু বলল, “স্যার, আমাদের ক্লাসের রায়ার মনে হয় আপনার উপর হেবি চাপ আছে। আমি বুঝতে পারি”।
সৌরভ অবাক হয়ে দাশুর দিয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “ঠিক আছে যাও”।
দাশু বেরিয়ে গেলে সৌরভ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে গত রাতের কল রেকর্ড দেখল। ঠিকই। অদ্ভুত টাইমে মেয়েটা ফোন করেছে। ক্লাসে তার বকাঝকা শুনে কেমন অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে গেছিল। এদিকে মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে তার ল্যাবে চলে আসে। যেন ল্যাবে আসার কোন ছুতোর দরকার ছিল।
সব কিছুই কেমন অদ্ভুতভাবে অঙ্ক মিলিয়ে দিচ্ছে। হয়ত কনফেশনটাও রায়াই করেছিল। এদের বয়সটা ভাল না। লকডাউনের জন্য এমনিতেই কারো মনের অবস্থাই ভাল ছিল না, সুইসাইডের ঘটনা আকছার ঘটছে। এই মুহূর্তে রায়াকে অনেক সাবধানে সামলাতে হবে। কী অদ্ভুত ব্যাপার! কলেজে পড়ানো শুরু করার সময় তো এসব ভেবে কখনো পড়ানো শুরু করে নি সে! আজকাল কী সব সমস্যা দেখা দিচ্ছে! তাদের অনেক বেশি করে ছাত্র ছাত্রীদের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে পড়াশুনা করা উচিত ছিল। শুধু বিষয় নয়, বিষয়ের বাইরে গিয়েও অনেক বিষয় আছে যেগুলো অনেক বেশি করে জানতে হত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সৌরভ। জীবনটা বড় জটিল হয়ে যাচ্ছে। না চাইতেই সব কিছু কেমন যেন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠেছে। এরকমটা হবার কথা ছিল না হয়ত। সে তো চায় নি। সে পড়তে চেয়েছিল, পড়াতে চেয়েছিল, একটা সহজ সরল অ্যাকাডেমিক জীবন চেয়েছিল। হঠাৎ করে সব কিছু এরকম বেসুরো হয়ে গেল কেন? তার জায়গাটাও তো ভারি কঠিন। ছাত্রীকে বিন্দুমাত্র প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, আবার বকাবকিও করা যাবে না। কী করবে সে এই সময়ে? অরুন্ধতীর সঙ্গে কথা বলবে? না থাক। কারো সঙ্গেই কথা বলার দরকার নেই। সে যেমন স্বাভাবিক থাকে, তেমনই থাকবে। বেশি কিছু ভাবতে গেলে সমস্যা বাড়বে। কনফেশন পেজ আছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট আছে, দিনে দিনে সব কিছুর বাড় বাড়ন্তই এই সমস্যাগুলো বাড়িয়ে দিচ্ছে।
একটা কথা মনে পড়ায় সৌরভ নড়ে চড়ে বসল। সেদিন যখন অরুন্ধতী এখানে এসেছিল রায়াই ছিল বাইরে। তার মানে ওই কনফেশনটাও রায়ারই করা ছিল?
৩৮
অভ্যাস একটা কঠিন ব্যাপার। এতদিন সে শমীকের সঙ্গে বসত। আজ শমীকের পাশে ব্যাগ রেখেও মনে পড়ল সে শমীকের সঙ্গে ঝগড়া করেছে। অঞ্জনা পাশের বেঞ্চে বসল। এবং অবাক হয়ে দেখল শিঞ্জিনী কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাবেই শমীকের পাশে বসে পড়ল এবং তখন ক্লাসও শুরু হয়ে গেল।শমীক জানত অঞ্জনা তার পাশে বসবে না। শিঞ্জিনী বসায় সামান্য অবাক হলেও কিছু বলল না। রায়া একবারে লাস্ট বেঞ্চে গিয়ে বসে আছে শুরু থেকেই। তার চোখ মুখ থমথমে। ক্লাস শুরু হবার মিনিট পাঁচেক পর দাশু ক্লাসে ঢুকে রায়ার পাশে গিয়ে বসল। স্যার বোর্ডের দিকে ফিরতেই দাশু ফিসফিস করে রায়াকে বলল, “তোর কি সৌরভ স্যারের উপর চাপ আছে?”রায়া বলল, “এসব কে বলেছে তোকে?”
দাশু ভালমানুষের মত মুখ করে বলল, “একটা ওয়াইল্ড গেস মারলাম আর কী। থাকলে কী আছে? এ কলেজের সবারই তো দেখি ওর উপর চাপ”।রায়া রেগে গেলে তার নাক লাল হয়ে যায়।
দাশুর দিকে না তাকিয়ে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজে বাজে কথা না বলে ক্লাস করতে দে, নইলে স্যারকে বলে দেব”।
দাশু বলল, “বললে বলবি। কী আর হবে?”
রায়া গোটা ক্লাস কোন কথা বলল না।
অন্যদিকে অঞ্জনা পাশের বেঞ্চ থেকে আড়চোখে দেখল শিঞ্জিনী কেমন যেন শমীকের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তার রাগ হচ্ছিল। শিঞ্জিনী আবার শমীকের সঙ্গে ফিসফিস করে কী সব কথা বলতে শুরু করল কিছুক্ষণ পরে। অঞ্জনা জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগল। তাকে মা শিখিয়েছে খুব বেশি রাগ হলে জোরে জোরে শ্বাস নিতে, ছাড়তে হয়। সে তাই করতে লাগল।ক্লাস শেষ হতেই দাশু পিছনের বেঞ্চ থেকে সামনে এসে বলল, “কী ব্যাপার, আমাদের কাজল শারুক জুটি ভেঙে গেল নাকি?”
শমীক রাগী চোখে দাশুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বাজে বকিস না”।দাশু শিঞ্জিনীর দিকে তাকাল, “কীরে, তুই রায়াকে ছাড়াই বসেছিস কেন? কী হয়েছে?”
শিঞ্জিনী বলল, “সব কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে”?
দাশু বলল, “এমনিই জিজ্ঞেস করলাম আর কী”!
অঞ্জনা গম্ভীর হয়ে বসে ছিল। মাঝে মাঝেই শ্বাস নেওয়া ছাড়া প্র্যাক্টিস করছিল। এখন সৌরভের ক্লাস ছিল না। সৌরভ হঠাৎ করেই ক্লাসে ঢুকতে সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। সৌরভ ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, “রায়া এসেছে? একবার ল্যাবে এসো তো, কথা আছে”।
শিঞ্জিনী দেখল রায়া ফ্যাকাসে মুখে উঠে দাঁড়িয়েছে। সৌরভ বেরোতে সেও বেরিয়ে গেল। শিঞ্জিনী কিছু বলতে গেছিল রায়ার কানেই গেল না।
শিঞ্জিনী বেরিয়ে যেতে দাশু বলল, “কী চাপের ব্যাপার বল তো। এভাবে আলাদা করে ডেকে নিয়ে গেল কেন?”
শিঞ্জিনী বলল, “ডাকতেই পারে। তোর কী সমস্যা হচ্ছে?”
দাশু বলল, “আমার আর কী সমস্যা? আমার কোন সমস্যা নেই। এমনিই মনে হল আর কী”।
শিঞ্জিনী বলল, “একটু বেশিই মনে হয় তোর সব কিছুতে। এত মনে হওয়া ভাল না”।
দাশু চুপ চাপ তার ডেস্কে গিয়ে বসল। শিঞ্জিনী বাথরুমে গেল। ফিরে এসে দেখল অঞ্জনা তার জায়গায় বসে পড়েছে।
সে বলল, “কী হল? আমি তো এখানে বসে ছিলাম। কী রে শমীক? তুই দেখিস নি আমি এখানে বসেছিলাম?”
শমীক কিছুই বলল না।
অঞ্জনা বলল, “আমার জায়গা এটা। আমি বসলাম। তুই যেখানে রোজ বসিস, সেখানে বস”।
শিঞ্জিনী বলল, “অদ্ভুত ব্যাপার তো। আমার ব্যাগটা তুই সরিয়ে দিলি কেন? এত সাহস কী করে হল তোর?”
অঞ্জনা বলল, “সাহসের তো কিছু নেই এখানে। এটা আমার জায়গা, এখানে আমি বসেছি, ব্যাস!”
শিঞ্জিনী শমীককে বলল, “আমি এক্সপেক্ট করেছিলাম তুই অন্তত কিছু বলবি। তোরা না অদ্ভুত টাইপের পাবলিক সব”।
এন সি স্যার ঢুকলেন ক্লাসে। শিঞ্জিনী রেগে মেগে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
৩৯
“বসো”। ল্যাবে ঢুকে তার সামনের চেয়ারে রায়াকে বসালো সৌরভ।
রায়ার বুক ঢিবঢিব করছিল। ভীষণ ভয় লাগছিল তার। সে বলল, “কী হয়েছে স্যার? এনি প্রবলেম?”
সৌরভ রায়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার বাড়িতে কে কে আছে রায়া?”
রায়া অবাক হয়ে বলল, “কেন স্যার?”
সৌরভ বলল, “এমনি। কৌতূহল। কে কে আছে?”
রায়া বলল, “বাবা, মা। দাদা, বৌদি”।
সৌরভ বলল, “তুমি কলকাতার নও?”
রায়া বলল, “না স্যার। এখানে পিজিতে থাকি”।
সৌরভ বলল, “বাবা মাকে রোজ ফোন কর?”
রায়া বলল, “হ্যাঁ স্যার”।
সৌরভ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “তুমি পড়াশুনায় ভাল। বি টেক করে গেট বা ক্যাট যে কোন একটাতে বসবে। হায়ার স্টাডি করলেও ভাল প্রসপেক্ট আছে, ভাল চাকরিও পেতে পারো। সেটা নিয়ে ভেবেছো কখনো?”
রায়া বলল, “হ্যাঁ স্যার। আমি চেষ্টা করব। বাকিটা ভাগ্য”।
সৌরভ বলল, “ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছো। ভাগ্যের কী দেখলে তুমি? পড়তে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি নিজেও মাধ্যমিক দিয়ে ক্লাস ইলেভেনে উঠে ভেবেছিলাম খুব বড় হয়ে গেলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং এ আরো বেশি মনে হয় সেটা। আসলে কিন্তু কেউ বড় হয় না। এই না বেড়ে ওঠার সময়টায় নিজেদের বড় ভাবাটাই সমস্যাটা তৈরী করে দেয়। ভাবতে পারো জ্ঞান দিচ্ছি, কিন্তু এটা বুঝতে হবে। এই যে ইন্সটিটুউশনটা দেখছো, এখানে আমাদের সবার আলাদা আলাদা একটা ফাংশান আছে। কেউ পড়াতে এসেছি, কেউ পড়তে এসেছি। এর বাইরেও আমরা মজা করছি, খেলছি, সব কিছু করছি। আমাদের সবার মধ্যে একটা বাউন্ডারি আছে। আমরা অনেকেই সেটা পেরিয়ে ফেলি, বুঝতে পারি না কী করি। সেটা ঠিক না রায়া”।
রায়া বলল, “এগুলো আমাকে কেন বলছেন স্যার”?
সৌরভ বলল, “কলেজের কনফেশন পেজে ওই কনফেশনটা তুমি করেছিলে, তাই না”?
রায়া মাথা নিচু করে বসে রইল।
সৌরভ বলল, “ভয়ের কিছু নেই রায়া। তুমি নির্ভয়ে বল। আমি শুধু জানতে চাইছি”।
রায়া বলল, “স্যার, আপনার উপরে আমার একটা ক্রাশ আছে। আমি আপনাকে পছন্দ করি। সেদিন এ বিকে এই রুমে দেখে রাগের মাথায় ওই কনফেশনটা পাঠিয়েছিলাম। তারপরে আমি বুঝেছিলাম আমার ওটা পাঠানো ঠিক হয় নি। আমি মেসেজ করি অ্যাডমিনকে। ও কনফেশনটা ডিলিট করে নি। আমাকে প্লিজ ক্ষমা করে দিন স্যার। বাড়িতেও যদি কিছু বলা হয়, তাহলে খুব ঝামেলা হয়ে যাবে”।
সৌরভ বলল, “আমি কাউকেই কিছু বলব না। তোমাদের বয়সটা কম। এসব এই বয়সে হয়। স্টুডেন্ট হিসেবে তুমি খুবই ভাল। আমি চাই না কোন তুচ্ছ কারণে আমার কোন স্টুডেন্টের বিন্দুমাত্র কোন ক্ষতি হয়। তবে কী জানো তো, তোমাদের একটা জিনিস বুঝতে হবে। শুধু কলেজ বলে না, তোমাদের সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে। এই জীবনে প্রেমিক প্রেমিকা ছাড়াও ছেলে মেয়েরা কাজের কথা বলতে পারে। তারা বন্ধু হতে পারে। অফিস রিলেশন থাকতে পারে। তারা কথা বললেই ব্যাপারটার সরলীকরণ করে নিতে নেই। যারা এগুলো সরলীকরণ করে, তারা কি ঠিক করে? তোমার কী মনে হয়?”
রায়ার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল। কোন মতে বলল, “সরি স্যার। আর হবে না”।
সৌরভ বলল, “গোটা জীবন পড়ে আছে রায়া। এসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে বেশি ভাবতে যেও না। সামনের সেমিস্টারগুলো খুব কঠিন হতে চলেছে। এতদিন বাড়িতে বসে ছিলে। এসব ক্রাশ ট্র্যাশ ছেড়ে পড়ায় মন দাও। গেটের কথাটাও ভুলো না”।
রায়া বলল, “কিন্তু স্যার কাউকে ভালবাসলে তো সেটা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না, তাই না?”
সৌরভ বলল, “না। যায় না। কিন্তু এরকম ভালোবাসা কত আসে, কত যায়। জীবনে সব কিছুর জন্য এত সময় নষ্ট করবে তুমি?”
রায়া বলল, “সরি স্যার। আমার ভুল হয়ে গেছে”।
সৌরভ বলল, “তোমাদের বয়সটাই এরকম। ভুলচুক হবেই। আমি বলি শোন, ফোকাসটা ঠিক রাখো। আমি প্রথমে খুব রেগে গেছিলাম। পরে যখন বুঝি এসব তোমার কাজ, আমার মনে হল বোঝানোটা বেশি দরকার। তুমি কি বুঝেছো আমি কী বলতে চাইছি?”
রায়া সৌরভের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বলল, “স্যার আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট পোস্ট, নট সরি ফর মাই ফিলিংস টুয়ারডস ইও। আমি কী করব স্যার, ওখানে আমার কোন হাত নেই”।
সৌরভ চুপ করে কয়েক সেকেন্ড বসে থেকে বলল, “এসব কেটে যাবে রায়া। এগুলোকে ইনফ্যাচুয়েশন বলে। ক্লাস কর। আর বাংক টাংক কোর না। যাও”।
রায়া সৌরভের দিকে একবার তাকিয়ে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল।
সৌরভ চুপ করে বসে রইল। রায়ার কথাটা তাকে যেন হঠাৎ করে একটা ধাক্কা মারল!