২০
“শহরে একটা অ্যালিয়েন ইনভেশন হবার দরকার আছে। মানুষজন কেমন যেন দিন দিন অসহ্য হয়ে যাচ্ছে। মানুষের কমন সেন্স থেকে সিভিক সেন্স, সব কমে যাচ্ছে। আর পারা যাচ্ছে না”।
মিতা কথা বলে যাচ্ছেন। অরুন্ধতী চুপ করে টিভি দেখছিল। মা আজকাল অল্পেতেই ভীষণ বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। তাকে নিয়ে চিন্তার জন্যই হবে। বিয়ে ভাঙাটা এখনও অত্যন্ত অস্বাভাবিক চোখে দেখা হয়। যে করেই হোক সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হবে। সেখানে সে টেকে নি। বাড়ি চলে এসেছে।
মা একদিকে খুশিই হয়েছে, আবার তাকে নিয়ে চিন্তাতেও পড়ে যায় মাঝে মাঝে। একটা কোন ভবিষ্যৎ ঠিক হওয়া দরকার। একা যদি থাকতে হয়, তাহলে তার জন্যও অনেক কিছু ঠিক করে নেওয়া দরকার। মিতা বলেন, “শহরে একা থাকাই যায়, কিন্তু তাও যখন একটার পর একটা ধর্ষণের খবর দেখি, ভয় লাগে। বাচ্চা থেকে বয়স্কা, কেউই তো নিরাপদ না। সেখানে তুই একা কী করে থাকবি? এখনও ভাবতে হবে অনেক কিছু। ঠিক কর কী করবি। আমি কোন কিছুতেই না করব না। তবে সিকিউরিটিটা ভীষণ ইম্পরট্যান্ট।
কলেজ থেকে ফেরার সময় বাস স্ট্যান্ড থেকে বাড়ির রাস্তার খুব কম একটা অংশ সামান্য অন্ধকার। ওই টুকু জায়গা পেরোতেও আজকাল ভয় লাগে। ভয় লজিক মানে না। বুকে চেপে ধরে। মানুষ নির্মম এবং অসভ্য। এখনো ধর্ষিতারই চরিত্র কাটাছেড়া হয় আগে। পোশাক থেকে সাজ, আচরণ থেকে খাওয়া দাওয়া, সব কিছুকেউ তুলে এনে হঠাৎ করে কেউ বলে দিচ্ছে, ও তো এমন পোশাক পরে, ও এসব খায়, তাহলে ওর রেপ হওয়া জায়েজ। বমি উঠে আসে, ভয়ে শরীর কেঁপে ওঠে, তবু শক্ত হতেই হয়। দিনের শেষে যাকে একা থাকার পথ বেছে নিতে হয়, তার শক্ত হয়ে থাকাটা জরুরি।
মেসেঞ্জারে একটা স্ক্রিনশট এসেছে। কনফেশন গ্রুপে তার আর সৌরভের নাম জড়িয়ে একটা কনফেশন পোষ্ট হয়েছে। এর পরেই আবার একটা খাপ খোলা হয়েছে। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু দেখলেই সেটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আগে অরুন্ধতী এক ঘণ্টা ধৈর্য ধরে। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যাপারটা ক্ষতিকারক। তবে স্ক্রিনশটটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।
সে সৌরভকে ফোন করল। সৌরভ খাচ্ছিল। তার ফোন ধরে বলল, “হ্যাঁ,বল”।
অরুন্ধতী বলল, “ব্যস্ত”?
সৌরভ বলল, “খাচ্ছিলাম। কথা বলা যাবে। বল”।
অরুন্ধতী পুরো ব্যাপারটা বলল। সৌরভ বিরক্ত গলায় বলল, “এই কনফেশন গ্রুপ ব্যাপারটাই তো ফালতু। স্টুডেন্টদের নিয়ে এসব কনফেশন পোষ্ট করছে তাও ঠিক আছে, কিন্তু ফ্যাকাল্টিদেরও এরা জড়িয়ে ফেলছে। আমার মনে হয় কাল এই ব্যাপারটা নিয়ে ডিরেক্টরের কাছে কমপ্লেইন করা যায়”।
অরুন্ধতী বলল, “তাতে কোন লাভ হবে না। বরং দিনকাল পাল্টে যাচ্ছে সৌরভ। একটা শ্রেণীর কোন কিছু পছন্দ না হলেই তারা বিলো দ্য বেল্ট ট্রোল করতে শুরু করে দেয়। সবসময় ব্যাপারটা নেওয়া যায় না। আমার মনে হয় ব্যাপারটাকে অন্যভাবে ট্যাকল করা যায়”।
সৌরভ বলল, “সাইবার সেলে কমপ্লেইন করে?”
অরুন্ধতী বলল, “না না। সেটা বাজে ব্যাপার। এরা তো ছোট, এরা জানে না এরা কী করছে। মাঝখান দিয়ে কেস টেস খেয়ে গিয়ে বাজে ব্যাপার হবে। আমরা একটা জিনিস করতে পারি, সরাসরি ক্লাসগুলোতে গিয়ে একটা মেসেজ দিতে পারি যে দেখো বাপু, যে বা যারা এসব করছ, তারা যদি ভেবে থাকো এই ব্যাপারগুলো ভীষণ কুল, আদতে সেটা অতোটাও কুল নয়। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থাকে, সেগুলোকে আমাদের রেসপেক্ট করা উচিত। বড় হলে তোমরা সেটা বুঝতে পারবে। এখন কলেজে ঢুকেই তোমাদের যেভাবে পাখনা গজিয়েছে, সেটা একদিন তোমাদের খুব বড় কোন ক্ষতি করতে পারে যেটার ধারণা তোমরা করতেই পারো না। অ্যানোনিমাস পোস্টিং বা ফেক পোস্টিং আদতে ফ্রাস্ট্রেটেড জীবন থেকে দূরে থাকার জন্য করা হয়। তোমাদের কোন সমস্যা হলে আমাদের এসে বল, আমরা না হয় কোন মনোবিদের সঙ্গে তোমাদের কথা বলিয়ে দেব। আপাতত এই জিনিসগুলো কোর না”।
সৌরভ বলল, “ভাল আইডিয়া। এটাই করা হোক”।
অরুন্ধতী বলল, “আমার মা-ই ঠিক বলেন। কলকাতায় অ্যালিয়েন ইনভেশন দরকার। লোকজন ভীষণ ভুল ভাল হয়ে যাচ্ছে। স্টুডেন্টদের আর দোষ কি!”
সৌরভ হেসে ফেলল, “ঠিকই বলেন। কাকীমা খুব সায়েন্স ফিকশন পড়েন নাকি?”
অরুন্ধতী বলল, “মা বইয়ের পোকা। সব পড়ে”।
সৌরভ বলল, “ভাল করেন। আচ্ছা কাল তাহলে একবার জানিয়ে দিও কী করতে হবে”।
অরুন্ধতী বলল, “শিওর”।
২১
শমীক হেঁটে যাচ্ছিল। বাস স্ট্যান্ডে নেমে কলেজের রাস্তাটা সে হেঁটে যায়। রাস্তা অনেকটা। এই রাস্তাটা হাঁটতে হবে বলে সে আধঘণ্টা আগে চলে আসে। সে শুধু একাই হাঁটে না। অনেকেই হাঁটে। অটো বা ভ্যান ভাড়া যেটুকু বাঁচে, সেটুকুই মঙ্গল। খানিকটা রাস্তা হাঁটতে দাশুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তার। দাশু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাউকে ফোনে খুব গালাগালি করছে।
শমীক দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, “কী হয়েছে?”
দাশু তাকে হাত দেখিয়ে দাঁড়াতে বলে তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে গালাগালি কন্টিনিউ করে প্রায় মিনিট তিনেক পরে ফোন রেখে বলল, “বিরক্তিকর”।
শমীক বলল, “কী কেস?”
দাশু বলল, “আরে আমাকে ফোন করে বলছে আমি কি বডি ম্যাসাজ করাতে আগ্রহী নাকি?”
শমীক বলল, “তা তুই কী বললি?”
দাশু বলল, “আমি বললাম বডি ম্যাসাজ তোর পেছনে গুঁজে রাখ বাইচোত। সেটা শুনে ওই মালটা দেখি আমাকে খিস্তি মারতে শুরু করল। আমি কি ছাড়ি নাকি? আমিও ভরে দিলাম”।
শমীক হেসে ফেলল, “তুই এরকম কেন? ফোনটা তো ইন্টারেস্টেড না বলেও কেটে দিতে পারতিস”।
দাশু বলল, “কেন? তুই বুঝিস না? এগুলো শিওর হোস্টেলের মালগুলোর কাজ। আমার পেছনে লাগছে। আমিও ছাড়ব না”।
শমীক হাসতে হাসতে হাঁটতে লাগল। দাশু লাফাতে লাফাতে তার পেছন পেছন আসতে আসতে বলল, “শোন না, ওই করো হোটেলের সিস্টেমটা ঠিক কী জানিস?”
শমীক সামান্য চমকে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমি কী করে জানব?”
দাশু বলল, “আমি একটা সার্ভে করছি”।
শমীক বলল, “কী ব্যাপারে”?
দাশু বলল, “আমাদের ক্লাসের কে কে করো হোটেলে গিয়ে করেছে, তা নিয়ে। আমার সিক্সথ সেন্স কেন জানি না বলছে, তুই গেছিস”।
শমীক বলল, “আমি কার সঙ্গে যাব?”
দাশু অম্লানবদনে বলল, “ওই যে, অঞ্জনা আছে তো। তোরা দুই টপার সেদিন এলি না, ওখানেই গেছিলি শিওর। তারপর হোটেলের রুমে বসে প্রোগ্রাম লিখে বাড়ি চলে এসেছিস”।
শমীক বলল, “এসব বলিস না। অঞ্জনা শুনলে হেবি খচে যাবে”।
দাশু শমীকের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তুই তো খচবি না। তোকে বলাই যায়”।
শমীক বলল, “না, আমাকেও বলবি না। কেন অকারণ আজেবাজে বকিস তুই?”
দাশু বলল, “অ্যায়সে হি, সেক্সি লাগতা হ্যায়। আচ্ছা, আমাদের ক্লাসের আরেকটা কাপল আছে, সাগ্নিক আর সুকন্যা, ওরা শিওর গেছে, বল? যেভাবে ক্লাস শেষে ধরাধরি করে, ইয়ে মানে হাত, তাতে বোঝাই যায়, রাহা নেহি যাতা, বল?”
শমীক বলল, “তুই এসব নিয়ে এত ভাবতে শুরু করেছিস কেন?”
দাশু বলল, “আরে ভাই, আমার এক দাদা আছে। সে দাদার বক্তব্য হল, ওদের সময় শুধু একটা ঘর পেত না বলে কত সহি প্রেম হাওয়াসী হতে পারল না। আর আমাদের সময়টা নাকি সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া। গরম হলেই করো। ওই দাদা আমাকে উদমা খিস্তি মারল। বলে কী ছিঁড়লি তুই? করোতে যেতে পারলি না? করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে ফলো কেন করবে না যুবসমাজ! কী সব বলে দিল ভাই”।
শমীক বলল, “সারাক্ষণ আজেবাজে বকে যাচ্ছিস। এসব বকলে কি টাকা পাওয়া যায়?”
দাশু বলল, “টাকা পাওয়া গেলে আরো বকতাম। কিন্তু ভুল কি কিছু বললাম? আমার জি এফ থাকলে আমিও করোতে করতে যেতাম”।
শমীক বলল, “তোর একটা ভুল ধারণা আছে, আমি বুঝতে পারি। অঞ্জনা আমার জি এফ না। কোন মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলেই সে জি এফ হয় না”।
দাশু বিজ্ঞের মত মাথা নাড়িয়ে বলল, “কী জানি ভাই, পাবলিক কী করে মেয়ে বন্ধু মেন্টেন করে। ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হতে পারে না। শারুখ খান বলেছে”।
শমীক বলল, “সে যা বলার বল। আমি কিছু বলব না”।
দাশু বলল, “তবে আমি কিন্তু একটা জিনিস দেখেছি। তোকে শিঞ্জিনী পছন্দ করে। তুই বুঝিস সেটা?”
শমীক বিরক্ত হয়ে বলল, “তুই কি সারাদিন আমার উপর সিসিটিভিগিরি করিস?”
দাশু বলল, “আই অ্যাম লাইক টিরিয়ন ল্যানিস্টার। আই ড্রিংক এন্ড আই নো থিংস”।
শমীক বলল, “হ্যাঁ, লিভারটা খারাপ কর আর কী টিরিয়ন হবার চক্করে”।
দাশু বলল, “মাঝে শমীক। এদিকে শিঞ্জিনী আর অঞ্জনা। এক ফুল দো মালি। মেঘের কোলে শমীক ফুটেছে বাদল গেছে টুটি। আহা হা হা হা”।
শমীক দাশুকে ধরতে গেল। দাশু দৌড়ে পালাতে পালাতে চিৎকার করল, “ধরা যাবে না ভাই। আই অ্যাম আনটাচেবল”।
শমীক দাশুকে ধাওয়া না করে চুপ করে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “পাগলা একটা”।
২২
কলেজে ঢুকেই ক্লাসরুমের বাইরে অঞ্জনার মুখোমুখি হয়ে গেল শমীক। অঞ্জনা গম্ভীর গলায় বলল, “উই নিড টু টক”।
শমীক বলল, “এস ডির ক্লাস আছে তো। করবি না”?
অঞ্জনা বলল, “ক্যান্টিনে চল। কথা বলে ক্লাসের মাঝখানে ঢুকব। এস ডি আমাদের কিছু বলবে না হোপফুলি”।
শমীক বলল, “ঠিক আছে চল। কথাগুলো পরে বললেও হত। আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না”।
অঞ্জনা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “না। আমি অনেক ভেবে এসেছি কথাগুলো বলব বলে। বলে নি। তারপর আসব”।
শমীক মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে”।
ক্যান্টিন যাওয়ার পথেই তাদের সঙ্গে সৌরভের দেখা হয়ে গেল। সৌরভ তাদের দেখে অবাক হয়ে বলল, “কোথায় যাচ্ছ তোমরা? ক্লাস বাঙ্ক মারবে নাকি?”
অঞ্জনা বলল, “না স্যার। একটা নোটস জেরক্স করেই আসছি”।
সৌরভ বলল, “ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি এসো”।
ক্যান্টিনে একবারেই ভিড় নেই। অঞ্জনা সেটা দেখে খুশি হয়ে বলল, “গুড। ফাঁকা আছে। বস”।
শমীক বসে বলল, “জলদি বল। ক্লাস মিস হলে রোজ রোজ শিঞ্জিনী আমায় নোটস দেবে না”।
অঞ্জনা বলল, “ঠিক আছে। শোন, একটা কথাই বলার। আমাদের মধ্যে ব্রেক আপ হওয়ার প্রয়োজন আছে”।
শমীক অবাক হয়ে অঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বলল, “ব্রেক আপ? আমরা কি কোন রিলেশনশিপে ছিলাম যে ব্রেক আপ হবে?”
অঞ্জনা একটু দ্বিধান্বিত হয়ে বলল, “ছিলাম না?” পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বলল, “মানে হোয়াটেভার। যাই ছিল, সেটা আর না রাখাই ভাল”।
শমীক বলল, “একাডেমিক ডিসকাসনও করবি না?”
অঞ্জনা বলল, “না। আমার মনে হচ্ছে আমরা একসঙ্গে থাকলে সেক্সুয়ালি আমরা জড়িয়ে পড়তে পারি। এটা দুজনের জন্যই ভাল। মাও বলল তোর পড়াশুনায় কোন রকম বাধা আসা ঠিক না”।
শমীক শুকনো ডাঙায় হোঁচট খাবার মত মুখ করে বলল, “তুই আন্টিকে এসবও বলে দিয়েছিস? সে কী রে!”
অঞ্জনা বলল, “না, মানে বলি নি। তবে ফ্রিজিডনেস নিয়ে আমি কালকে খুব চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তারপর ভাল করে চিন্তা করে বুঝলাম, ব্যাপারটা ফ্রিজিডনেস না। আমি তোর প্রতি অ্যাট্রাকটেড না হয়েই ফিজিক্যাল রিলেশন করতে গেছিলাম বলে আমার মধ্যে কোন সমস্যা তৈরি হয়েছিল। হোপফুলি সেটা ঠিক হয়ে যাবে। বুঝলি?”
শমীক বলল, “ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাই হবে”।
অঞ্জনা বলল, “তোর মন খারাপ হলে আই অ্যাম সরি। তুই চাইলে কলেজ থেকে ফেরার পথে তোকে একটা ফেয়ারওয়েল কিস করতে পারি, তবে তার আগে তোকে ফেসওয়াস দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হবে”।
শমীক বলল, “না না। দরকার নেই। তুই যখন চাইছিস না, তখন কোন অসুবিধা নেই। যেভাবে বলছিস, সেভাবেই হবে”।
অঞ্জনা বলল, “ফ্রিজিডনেস ইস ডেঞ্জারাস। কখনো ভেবেছিস ব্যাপারটা নিয়ে? সেক্স করার সময় দেখা গেল কোন ফিলিংসই এলো না। মানে ব্যাপারটা টেরিবল। আমার মনে হয় কোন মনোবিদ দেখানো দরকার। বা কোন টেস্ট হওয়া দরকার। কীভাবে কী হবে জানি না, তবে হলে ভাল হত। মাকে সব কিছু বলা যায় না। বললে চিন্তা করবে। কিন্তু এটা তো সিরিয়াস ব্যাপার। আর আমাদেরও আমাদের ফিউচার পার্টনারের সঙ্গে লয়্যাল থাকা দরকার। সে জন্য আমরা দুজন দুজনের থেকে দূরে থাকব। সব জায়গা থেকে দুজন দুজনকে ব্লক করে দেব। দুজনেই দুজনের নাম্বার ডিলিট করে দেব। ওকে?”
শমীক বলল, “ঠিক আছে। এবার ক্লাসে যেতে পারি?”
অঞ্জনা বলল, “আমি আমার ফিউচার পার্টনারকে ঠকালাম, তাই না?”
শমীক বলল, “ভাই আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এবার এই ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করলে হয় না?”
অঞ্জনা বলল, “ইউ আর রাইট। লেবু বেশি কচলানো হয়ে যাচ্ছে। আমরা আর কোন কথা বলব না। চল”।
দুজনে আবার চুপ চাপ ক্লাসে ফিরে এল।
ফিরে অবাক হয়ে দেখল রায়া থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। পারলে কেঁদেই দেয়।
২৩
ঘটনাটা তেমন কিছু না। সৌরভ ক্লাস নিচ্ছিল। রায়া যথারীতি শিঞ্জিনীর সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে জোরে হেসে দিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে সৌরভ বোর্ড থেকে ক্লাসের দিকে ফিরে দেখল রায়া হাসি হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
সৌরভ ভীষণ রেগে গিয়ে বলল, “এই যে, রায়া, দাঁড়িয়ে পড়। কী হয়েছে? এত আনন্দ কেন?”
রায়া থতমত হয়ে বলল, “স্যার একটা ঘটনা মনে পড়ায় হাসি পেয়ে গেল”। উত্তর দিয়েই রায়া আবার হেসে ফেলল।
সৌরভ বলল, “এখানে কি আমি স্ট্যান্ড আপ কমেডি করছি?”
রায়া জোরে জোরে মাথা নাড়ল, “না স্যার। আমি সেটা বলি নি। আপনার কোন কথায় আমি হাসি নি স্যার”।
শমীক আর অঞ্জনা ক্লাসের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
“স্যার মে আই কাম ইন?”
দুজনেই বলে উঠল। সৌরভ বলল, “না, ইউ ক্যান নট কাম ইন। এটা ক্লাস হচ্ছে। যখন খুশি যাওয়া আসা করা যাবে না”।
অঞ্জনা বলল, “স্যার আপনাকে তো আমি বলে গেছিলাম”!
সৌরভ বললেন, “সেটার একটা টাইম লিমিট থাকা উচিত, তাই না? এখন ক্লাসে ঢোকা যাবে না। ট্রাই টু বি পাংচুয়াল ইন ফিউচার”।
অঞ্জনা আর শমীক কথা বাড়াল না। তারা বেরিয়ে চলে গেল। সৌরভ রায়াকে ঝাড়তে থাকল। বলল, “তোমাদের যত দেখছি, তত অবাক হয়ে যাচ্ছি। এতগুলো বছর ঘরে বসে রইলে, অনলাইন ক্লাসে নিজেরাও জানো কেমন ক্লাস হয়েছে, এখন কলেজে এসে তোমাদের মুখে হাসি আসছে? অদ্ভুত! কিছু বলার নেই, সত্যিই”।
রায়া বসতে যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সে কান্না সামলাচ্ছিল। সৌরভ বলল, “তুমি ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাও। ক্লাসটা ইয়ার্কি ফাজলামির জায়গা না। এটাই তোমার পানিশমেন্ট। বেরিয়ে যাও”।
রায়ার চোখে জল চলে এল। সে কোন কথা না বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেল।
সৌরভ ক্লাসকে উদ্দেশ্য করে বলল, “জানো তো, সব কিছুর একটা পরিবেশ থাকে। তোমাদের দেখলে আজকাল মনে হয় তোমরা প্লে স্কুলে এসেছো। বড় হও নি তোমরা? কেউ হাসছ, কেউ কনফেশন পেজ টাইপের ভুল ভাল জিনিসে যা খুশি লিখে দিচ্ছ, তোমরা ভেবেই নিচ্ছো ফ্যাকাল্টি আর তোমাদের মধ্যে কোন ডিফারেন্স হয় না। তোমাদের তো বেসিক শিক্ষাটাই হয় নি দেখছি। ক্লাসকে ইয়ার্কি ফাজলামির জায়গা ভেবে নিয়েছ। ঠিক আছে, চিন্তার কিছু নেই। তোমরা যখন আমাদের নিয়েও ইয়ার্কি মারার জায়গায় চলে গেছো, আমিও তোমাদের ছাড়ব না। কনফেশন পেজ চালাও আর যাই করে থাকো, প্রথমে ভেবেছিলাম তোমাদের বুঝিয়েই ছেড়ে দেব, সেটা করা হবে না। স্ট্রিক্ট অ্যাকশন নেওয়া হবে। যে বা যারা এই কনফেশন পেজ চালাও, আমার ল্যাবে এসে দেখা করবে আজকের মধ্যে। নইলে কাল সকালে এই পেজের নামে আমি কলকাতা পুলিশের পেজে কমপ্লেইন করব। বাবা বাছা বলার সময় পেরিয়েছে, এবার দেখে নেওয়ার পালা। আশা করি ব্যাপারটার কনসিকোয়েন্স কী হতে পারে জানো? আই পি অ্যাড্রেস ট্র্যাক করে পুলিশ ঠিকই জেনে যাবে কারা এসব করছ, তারপর বাকিটা কলেজ বুঝে নেবে। নিজেরা যা খুশি নোংরামি কর, তোমরা এর মধ্যে আমাদেরও জড়িয়ে দিচ্ছ? তোমরা জানো এ বি ম্যামের ফ্যামিলিতে কী কী প্রব্লেম চলছে? ম্যাম কতটা সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন? তোমরা কী করলে? আমাকে আর ম্যামকে নিয়ে একটা নোংরা কনফেশন পোষ্ট করে দিলে। মানেটা কী? যা ইচ্ছে, তাই করা যায়?”
ক্লাসের সবার মুখ পাংশু হয়ে গেল।
সাগ্নিক ফিসফিস করে করে বলল, “এ কি রে ভাই, এতো হুলিয়ে হুমকি দেওয়া শুরু করেছে? মাথা ফাথা গেছে নাকি?”
সুকন্যা সাগ্নিককে চিমটি কেটে ইশারা করল চুপ করতে। সাগ্নিক চুপ করে গেল।
সৌরভ বলল, “এখনো কিছু মিনিমাম রেস্পেক্ট করা উচিত ফ্যাকাল্টিদের। তোমাদের সঙ্গে ওই গুণ্ডাগুলোর তো কিছু তফাৎ আছে নাকি, যারা ভিসিকে গালাগালি দিয়ে আসে, তোমরা তাদের থেকে কিছু হলেও আলাদা তো?”
ক্লাস কোন কথা বলল না।
সৌরভ বলল, “যেটা বললাম, আজকের মধ্যে এই পেজের অ্যাডমিন যেন আমার সঙ্গে এসে দেখা করে। কলেজে যেই এই পেজটা চালাক, বলে দিও তাকে”।
সৌরভ ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
দাশু ক্লাসেই ছিল না। সে এই ক্লাসটা বাংক মেরেছিল।
২৪
প্রথম দুটো ক্লাস লালুদার দোকানেই কেটে যায় দাশুর। পুকুরের ধারে বেঞ্চে বসে একটার পর সিগারেট টেনে ঘুম কাটায় সে। কলেজ বুঝতে গেলে কি শুধু ক্লাস করলেই হয়? কলেজ বুঝতে গেলে বাংকও মারতে হয়। দাশু বাংক স্পেশালিষ্ট। কলেজে ঢোকার রাস্তাতেই সে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক করে নেয় কোন ক্লাস করবে আর কোনটা ডুব মারবে। মাঝে মাঝেই অ্যাটেন্ডেন্সের ঝামেলায় পড়ে যায়। তাতে অবশ্য তার কিছুই যায় আসে না। কী আর হবে? সে ঠিক করে নিয়েছে, কলেজ থেকে বের করে দিলে লালুদার পার্টনার হয়ে যাবে। লালুদা পেটাই পরোটা বানায়। সেও বানাবে। ময়দায় তেলটা যখন মাখায়, তখন একটা স্বর্গীয় দৃশ্য হয়। এরকম পরোটা সবাই বানাতে পারে না। যারা বানাতে পারে, তারা ঈশ্বরের দূত। লালুদা ঈশ্বরের দূত।
কোন কোন দিন দাশু ক্লাসও করে না। গোটা দিনই লালুদার দোকানে কাটিয়ে দেয়। একদিন বলেওছে লালুদাকে, “গুরু, আমাকে পেটাই পরোটা বানানো শিখিয়ে দেবে?”
লালুদা হেসে বলেছে, “কী যে বলো?”
দাশু বলেছে, “দেখো গুরু, দেশের যা অবস্থা, এমনিতেই চাকরি নেই, ওমনিতেই নেই, তার থেকে তুমি আমাকে পরোটা বানানো শিখিয়ে দিলে অন্তত করে কম্মে খেতে পারবো”।
অনেক ঝোলাঝুলি করার পর লালুদা কথা দিয়েছে শেখাবে একদিন। দাশু তাতেই খুশি।
রোদটা কম উঠেছে অন্যদিনের তুলনায়। পুকুর পাড়ে একটা প্রাণকাড়া হাওয়া দিচ্ছে। দাশু সিগারেট টানতে টানতে প্রকৃতির হাওয়া নিচ্ছিল, তার ক্লাসের চার পাঁচজন এসে মাচায় বসল। দাশু সাগ্নিককে দেখে বলল, “কীরে করো হোটেলের পার্টনার, ক্লাস করছিলি না? কী হল?”
সাগ্নিক বলল, “ভুল ভাল বকিস না দাশু। পুরো ঝাঁট জ্বলে আলুর দম হয়ে গেছে”।
দাশু সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “কেন? কী হয়েছে?”
সাগ্নিক বলল, “আরে ওই একটা কনফেশন পেজ আছে, তাতে কাল বিকেলে এবি আর এস ডিকে নিয়ে একটা কনফেশন পোষ্ট হয়েছিল। সেটা দেখে এস ডি হেবি খচে গেছে। ক্লাস না করিয়ে চলে গেছে। বলেছে ওই পেজের অ্যাডমিন যদি ওর সঙ্গে আজকের মধ্যে দেখা না করে, তবে উনি কলকাতা পুলিশের সাইবার সেলে নালিশ করে দেবেন। এ ভাই, সাইবার সেল কিন্তু হেবি এফিসিয়েন্ট, সেই স্পেসিফায়েড তারকাটার কেসটা মনে আছে?”
দাশু বিষম খেল। হৃদপিণ্ডে কেমন একটা সুনামি হচ্ছে, টেবিল টেনিস বল দুটোও কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল, “ধুস, ওতে কিছু হয় নাকি? ওর কি হবে? এসব আজে বাজে হুমকি”।
সাগ্নিক বলল, “শোন ভাই, আজে হুমকি, না বাজে হুমকি জানি না, তবে ব্যাপারগুলো মোটেও হালকা নেবার না। অনেক কেস দেখি আজকাল, এইসব আইনে পেছনে হুড়কো হয়ে যায়। কে কী করেছে জানি না, কে পেজ চালায়, তাও জানি না, তবে এস ডি যদি মনে করে ব্যাপারটা নিয়ে এগোবে, তাহলে যার পেজ, সে উদুম কেস খাবে”।
দাশু “ধুস, ওসব কিছু হবে না” বলে কাটিয়ে দিয়ে মাচা থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটল। সে যে “কুল” আছে, তার যে ফেটে চৌত্রিশ হয়ে যায় নি, সেটাই তাকে এখন প্রমাণ করতে হবে। তবু বুকের ধুকপুকুনি কি এত সহজে কমে? কেমন ঘাম টামও হতে শুরু করে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ভেবে টেবে সে এস ডির ল্যাবের সামনে দিয়ে পায়চারি করতে শুরু করল।
এসডি গম্ভীর হয়ে বসে আছে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব রেগে আছে।
দাশু একটু ভেবে নিয়ে এসডির দরজায় নক করে বলল, “স্যার, আসব?”
সৌরভ বলল, “তুই পেজটা চালাস”?
দাশু আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলল, “কোন পেজটা স্যার?”
সৌরভ বলল, “কনফেশন পেজটা?”
দাশু বলল, “কী যে বলেন স্যার। আমি এখনো ঠিক করে উইন্ডোজ শাট ডাউন করতে পারি না, ওসব পেজ কী করে চালাবো?”
সৌরভ বলল, “তাহলে কী করতে এসেছিস এখানে?”
দাশু বলল, “স্যার লাস্ট ক্লাসের নোটস নিতে এসেছিলাম”।
সৌরভ চুপ করে দাশুর দিকে তাকিয়ে রইল।
২৫
ক্যান্টিনে শমীক চুপ করে বসে ছিল। অঞ্জনা বলেছে তার পাশে না বসতে। অঞ্জনা দূরে একটা টেবিলে বসে আছে।
রায়াকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
শিঞ্জিনী ফোন করল। রায়া ধরল না। শিঞ্জিনী আবার ফোন করল। এবার ধরল। ধরা গলায় বলল, “বল”।
শিঞ্জিনী বলল, “তুই কোথায়?”
রায়া বলল, “পিজিতে যাচ্ছি। আজকে আর ক্লাস করব না”।
শিঞ্জিনী বলল, “এটুকু ঘটনার জন্য ক্লাস করবি না কেন? এসব নিয়ে চাপ নিস কেন?”
রায়া বলল, “চাপ নিই নি, চাপের তো কিছু নেই। আমার ভাল লাগছে না। একদিন বাঙ্ক করলে কিছু হবে না। আমি ঠিক আছি, ভাবিস না”।
শিঞ্জিনী কয়েক সেকেন্ড ফোনটা ধরে বলল, “ঠিক আছে, তুই কোথাও বেরোস না, আমি ফিরে কথা বলব”।
রায়া “হু” বলে ফোন রেখে দিল। শিঞ্জিনী শমীকের টেবিলে গিয়ে বসল, “কিরে, তুই একা বসে আছিস কেন?”
শমীক বলল, “এমনি”।
শিঞ্জিনী আড়চোখে অঞ্জনার দিকে তাকিয়ে শমীকের দিকে তাকাল, “ঝগড়া হয়েছে?”
শমীক বলল, “না। কিছুই হয় নি”।
শিঞ্জিনী বলল, “ভাল। বলবি না যখন, ঠিক আছে। শোন, রায়া খুব কষ্ট পেয়েছে দেখলি তো। এস ডি কেমন রেগে গেল”।
শমীক বলল, “রায়া ওভাবে হাসবেই বা কেন? ওর জন্যই তো এস ডি রেগে গেলেন। ঠিকই তো বলেছেন উনি। একজন ক্লাস নেবেন, আরেকজন দাঁত বের করে হাসবেই বা কেন? এমনিতেই আমাদের চাকরি বাকরির কোন ঠিক নেই এখন। সবাই হাত তুলে দিচ্ছে। ক্লাসটাও যদি ঠিক করে না করায়, তাহলে কী করে হবে?”
শিঞ্জিনী বলল, “উফ, তুই অনেক বেশি ভেবে ফেলছিস”।
শমীক বলল, “আমি ঠিকই ভেবেছি, আর যে ওই কনফেশন পেজের নামে এসব শুরু করেছে, সেও ঠিক করে নি। খুব বড় কেস খাবে”।
দাশু ক্যান্টিনে এসেছিল। শমীকের পাশে বসে বলল, “কী কেস খাবে?”
শমীক বলল, “কলেজ থেকে পুলিশে কমপ্লেইন করলে পুলিশ জানিয়ে দেবে কোন আই পি অ্যাড্রেস থেকে এসব চলে। ধরা পড়তে আর কতক্ষণ লাগে?”
দাশু বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ল। শিঞ্জিনী বলল, “যে যা পারে করুক, কনফেশন পেজ করুক আর যাই করুক, আমার সে নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। স্যার ওভার রিয়্যাক্ট করলেন। মনে হয় কোন ফ্যামিলি প্রব্লেম আছে, তার জন্য এতটা রেগে গেলেন”।
শমীক বললেন, “যদি আমার সঙ্গে এরকম হত, আমিও এভাবেই রিয়্যাক্ট করতাম। এতে ওভাররিয়্যাক্টের কিছু নেই। আর ওই পেজের এডমিন যদি নিজে থেকে এই পোষ্ট করে, তাহলে তো হয়েই গেল, সেই কেস খাবে”।
দাশু চোখ পিট পিট করে শমীকের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই বেশি বুঝিস না? পেজের অ্যাডমিন কেন পোষ্ট করতে যাবে? যা যা কনফেশন আসে, পেজ থেকে সেগুলোই পোষ্ট করা হয়। তুই দেখবি পেজে গিয়ে, যে কনফেশনটা পাঠিয়েছিল, সে আবার ফেক প্রোফাইল থেকে পোষ্টটা ডিলিট করার জন্য অনেক হেজিয়েছিল। যা জানিস না, সেই নিয়ে বেশি বকিস না তো”।
শিঞ্জিনী ঢোক গিলে বলল, “হ্যাঁ, দেখলাম তো। আমার তো মনে হয় অ্যাডমিনটারই দোষ। ফেক থেকে রিকোয়েস্ট এল যখন, কনফেশনটা ডিলিট করে দিলেই হত। ডিলিট না করে কেসটা হল”।
দাশু বলল, “অ্যাডমিনের দোষ কেন হবে? অ্যাডমিনকে হুমকি দিয়েছিল কেন?”
শিঞ্জিনী বলল, “বেশ করেছিল হুমকি দিয়েছিল। সেটাই করা উচিত ছিল”।
দাশু বলল, “বাওয়া, এমন করছিস তুই, যেন পোষ্টটা তুইই করেছিলিস”।
শিঞ্জিনী বলল, “আমি কেন করতে যাবো? আমিও পেজটা দেখেছি। কোথাকার কোন নিব্বা নিব্বি অ্যাডমিন হয়েছে কেন জানে, আরে ভাই, পেজ তো ফ্রিতে চলে। কেউ টাকা দেয়? এত হাব ভাব নেবার কী আছে? দু হাজার লাইকের পেজের অ্যাডমিনের এমন ভাব, যতসব”।
অঞ্জনা দূর থেকে দেখছিল শিঞ্জিনী শমীকের টেবিলে গিয়ে বসেছে। সে শমীককে মেসেজ করল, “শিঞ্জিনী কী করছে তোর টেবিলে?”
শমীক মেসেজটা দেখল, রিপ্লাই দিল না।
দাশু কিছুক্ষণ শিঞ্জিনীর সঙ্গে ঝগড়া করে আবার সৌরভের ল্যাবের সঙ্গে ঘুর ঘুর করতে শুরু করল।
২৬
ল্যাবের দরজার সামনে ঘুর ঘুর করছিল দাশু। মন দিয়ে সৌরভের নেমপ্লেটটা দেখছিল। সৌরভ ল্যাব থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “কী দেখছিস?”
দাশু বলল, “স্যার আপনি এম টেক করেছেন? তারপর পড়লেন না”?
সৌরভ দাশুকে বলল, “ভেতরে আয়”।
দাশু ল্যাবে ঢুকল। সৌরভ বলল, “বস”।
দাশু বসল।
সৌরভ বলল, “তুই পেজটা চালাস, তাই তো?”
দাশু বলল, “বিশ্বাস করুন স্যার, আপনার নামে কিছু করতে চাই নি। মালটা এসে গেছিল, পোষ্ট করে দিয়েছিলাম। তারপর দেখলাম যে কনফেশন পাঠিয়েছিল, সে ফেক থেকে হুমকি দিচ্ছে। আমি তো ঘাউড়া মাল, ডিলিট করি নি আর কী”।
সৌরভ বলল, “পেজটা বের কর। যে ফেকটা থেকে তোকে হুমকি দিয়েছিল, সেটার ইউ আর এল লেখ”। দাশু তাড়াতাড়ি তার ফোন বের করে ফেক প্রোফাইলের আইডি ডিটেলস দিল। সৌরভ বলল, “এটা প্রথমে বললে কী হত?”
দাশু বলল, “আপনি হেবি খচে গিয়েছেন শুনলাম। আমি তো স্যার আপনাকে গুরু মানি। একে আপনি, দুইয়ে আইনস্টাইন, তিনে জনি সিন্স। বিশ্বাস করুন”।
সৌরভ বলল, “একটা গাট্টা মারব না, ভাগ এখান থেকে”। দাশু বলল, “মাইরি স্যার, কেস খাওয়াবেন না। জাস্ট ফর ফান পেজ। আর কাউকে বলবেন না প্লিজ। আমি কোন দিন কোন ফ্যাকাল্টিকে নিয়ে কোন কনফেশন এলেও পোষ্ট করব না। এই কান মুলছি”।
সৌরভ বলল, “যে কোন ঘটনা নিয়েই ফান করা যায়। সমস্যা হল, ফান বা ট্রোল যাই বল, তার একটা সময় থাকা উচিত। যে কাউকে নিয়ে মজা কর, কিন্তু মাঝে মাঝে তার মধ্যেও একটা মনুষ্যত্ব থাকা উচিত। এখন কারো যদি প্রিয়জন মারা যায়, তুই তাকে নিয়ে ট্রোল করতে পারবি? একজন মানুষ সবে একটা মারাত্মক শক থেকে উঠেছেন, তাকে যে কোন ব্যাপারে জড়ানোটা কি দরকার ছিল?”
দাশু বলল, “বলছি তো স্যার, ম্যামকে নিয়ে কিছু লেখার কথা আমি ভাবতেও পারব না। কনফেশনটা হয়ত আমি ডিলিটও করে দিতাম। আমাকে হুমকি দিল বলে আমার মাথা ঠিক থাকল না। আপনি তো জানেন স্যার আমার দু চারটে স্ক্রু মিসিং আছে”।
সৌরভ বলল, “আমি জানি, বা না জানলেও হয়ত তুই এসেছিস বলে তোর কোন ক্ষতি আমি করব না। কারো কোন রকম ক্ষতি করার ইচ্ছেই আমার নেই। কিন্তু মনে রাখিস, পাস আউট করে যখন বাইরের দুনিয়াটার মুখোমুখি হবি, তখন কেউ মনে রাখবে না তোর মাথার দু চারটে স্ক্রু ঢিলে আছে বা মিসিং আছে। লোকজন কিন্তু আগে প্যাঁদাবে, তারপর কথা বলবে। থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে জন্মেছিস, ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির কমনসেন্স আর ব্ল্যাক কমেডি মারাতে যাস না। অনেক বেশি মাড়িয়ে বসে থাকবি। বুঝলি কী বললাম?”
দাশু বলল, “হ্যাঁ স্যার। যাব?”
সৌরভ বলল, “যা”।
দাশু লাফাতে লাফাতে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল। সৌরভ তার বন্ধু অবিনাশকে ফোন করল। অবিনাশ সাইবার সেলে আছে। অবিনাশ ফোন ধরল একবার রিং হতেই, “বল রে। কী খবর”।
সৌরভ বলল, “একটা প্রোফাইলের আইপি ডিটেলস বের করতে পারবি?”
অবিনাশ বলল, “কী হয়েছে? হুমকি টুমকি দিয়েছে নাকি?”
সৌরভ হাসল, “না না, সেসব না। জানার দরকার ছিল আর কি। পারবি?”
অবিনাশ বলল, “লিখিত কোন ডকুমেন্ট বা এফ আই আর টার না?”
সৌরভ বলল, “না। আমার শুধু প্রোফাইলের মালিকের খোঁজ লাগবে”।
অবিনাশ বলল, “পাঠিয়ে দে। দেখছি”।
সৌরভ বলল, “মেইল করছি তোকে। কখন পাওয়া যাবে?”
অবিনাশ বলল, “পাঠা। পেলে দেখছি। ব্যাপারগুলো একটু ঝামেলার আছে তো এখনো। তাও পারব আশা করছি। পাঠিয়ে দে”।
সৌরভ বলল, “ওকে”।
#
ক্যান্টিন থেকে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল শমীক, পাশে শিঞ্জিনী। একটু দূরে তাদের দিকে কড়া চোখে তাকাতে তাকাতে হাঁটছিল অঞ্জনা। দাশু শিঞ্জিনীর পাশে এসে বলল, “বুঝলি বুন্দু, আমি শুনলাম এস ডি নাকি ওই ফেকের ঠিকুজি কুষ্ঠী বের করার চেষ্টায় আছে। যে বা যারা এসব করুক, কপালে হেবি ঘাপলা আছে ভাই”।
শিঞ্জিনী রেগে মেগে বলল, “যা তো, কাজ নেই, সারাক্ষণ ভাট বকে যাচ্ছে। ভাগ!”
২৭
শিঞ্জিনী বিকেলে পিজিতে ফিরে দেখল রায়া উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সে রায়াকে ঠেলল, “কী হয়েছে তোর?”
রায়া বলল, “মেডিসিনের দোকানের ছেলেটা ভীষণ শয়তান”।
শিঞ্জিনী অবাক হয়ে বলল, “কী করেছে?”
রায়া বলল, “ঘুমের ওষুধ নাকি প্রেসক্রিপশন ছাড়া দেওয়া যায় না। এটা আবার কোথায় ঠিক হল?”
শিঞ্জিনী বলল, “ঘুমের ওষুধ কী করতে লাগবে তোর? ভালোই তো ঘুমোস। নাকও ডাকিস মাঝে মাঝে”।
রায়া বলল, “মোটেই আমি নাক ডাকি না। নাক তুই ডাকিস”।
শিঞ্জিনী বলল, “আমিও ডাকি না। কিন্তু তুই ঘুমের ওষুধ দিয়ে কী করবি?”
রায়া তার লম্বা লম্বা নখ দেখতে দেখতে বলল, “আর বেঁচে থেকে কী হবে? এভাবে অপমান করল”!
শিঞ্জিনী বলল, “একটা চেনা নেই জানা নেই লোকের জন্য তুই ঘুমের ওষুধ খেয়ে সুইসাইড করবি? ঘুমের ওষুধের দরকার নেই। আমিই তোকে মেরে ফেলছি গণ্ডমূর্খ কোথাকার”!
শিঞ্জিনী রায়ার কান মলে দিল।
রায়া আর্তনাদ করে উঠল, “উফ! তুই তো বহুত ফালতু! আমার লাগে না”?
শিঞ্জিনী বলল, “মরতে গেলে তো আরো লাগত। পড়াশুনো করে এই সব সুইসাইড কনসেপ্টটা আসে কোত্থেকে তোর? মরলে কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়?”
রায়া বলল, “বেঁচে থেকেই বা কী হবে? কীভাবে অপমান করল দেখলি? মেইনে তো উশে মেরা সব কুছ দে দিয়া, উনহে মুঝে বেগানা কর দিয়া”।
শিঞ্জিনী বলল, “ধুস! বেগানার ভাই হয়েছে। কত আসবে যাবে এরকম। তবে আজকে তো আমি এস ডির উপর ইম্প্রেসড হয়ে গেলাম। হি শোড হিস ক্যারেকটার। ক’টা লোক এভাবে প্রতিবাদ করতে পারে বল? বেশিরভাগ পাবলিক স্টুডেন্টদের ভয় পায়। উনি তো বলেই দিয়েছেন দেখে নেবেন কনফেশন পেজের অ্যাডমিনকে”।
রায়া জুল জুল চোখে শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে বলছিস তোর জামাইবাবু ঠিক আছে?”
শিঞ্জিনী হেসে ফেলল, “আবার জামাইবাবু হয়ে গেল?”
রায়া বলল, “তাহলে বলব তোমার উপর বিগত যা রাগ ছিল, আমি দমায় ফেলসি। ঠিকই তো। আচ্ছা, আমি একটা ফোন করি”।
শিঞ্জিনী বলল, “ফোন করবি কেন?”
রায়া বলল, “সরি বলে”।
শিঞ্জিনী বলল, “খুব চুলকাচ্ছে না তোর? মানে এত চুলকানি রাখিস কোথায়?”
রায়া বলল, “থাম তো। বরকে রাগিয়েছি যখন, আমাকেই তো রাগ কমাতে হবে, বল?”
শিঞ্জিনী শ্বাস ছেড়ে বলল, “যা খুশি কর”।
রায়া তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে সৌরভকে ফোন করল।
সৌরভ ফোন রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ, বল”।
রায়া গলায় যতটা সম্ভব কাঁদো কাঁদো ভাব এনে বলল, “স্যার, সরি। এক্সট্রিমলি সরি। আমার ওভাবে হেসে ফেলা ঠিক হয় নি। প্লিজ কিছু মনে করবেন না। ফিউচারে এরকম হবে না”।
সৌরভ বলল, “ঠিক আছে। তখন আমিও রেগে গেছিলাম। কনফেশনটার ব্যাপারে শোনার পর থেকে মাথা গরম হয়ে গেছে। আমি ওই কনফেশন পেজের অ্যাডমিনটাকে পেয়ে গেছি। এবার কে এই জঘন্য কনফেশনটা করেছে বের করি, তারপর তারই একদিন কি আমার একদিন”।
রায়া চোখ বড় বড় করে শিঞ্জিনীর দিকে তাকিয়ে কপাল চাপড়ে বলল, “আচ্ছা স্যার”। সে ফোন রাখতেই শিঞ্জিনী বলল, “কী হয়েছে?”
রায়া বলল, “বাঁশ হয়েছে। পুরো দশ হাত। ঢুকে গেছে। আমাকে বাঁচা। ওরে বাবারে, ভাই প্রেসক্রিপশন থাকুক আর না থাকুক, আমাকে ওই ঘুমের ওষুধই কিনে দে। যেখান থেকে হোক ব্যবস্থা কর”।
শিঞ্জিনী বলল, “ধুস। বলবি তো কী হয়েছে?”
রায়া বলল, “উনি নাকি কনফেশন পেজের অ্যাডমিনকে খুঁজে বের করেছেন। এবার কে কনফেশন করেছে সেটা বের করবেন। ওরে বাবারে, আমি এবার গেলাম”।
শিঞ্জিনী বলল, “এই কথাটাই তো দাশু বলেছিল। তার মানে কি দাশুই পেজটার অ্যাডমিন নাকি?”
রায়া অবাক হয়ে বলল, “দাশু কী বলেছিল?”
শিঞ্জিনী বলল, “দাশু বলেছিল এস ডি নাকি কে কনফেশন করেছে বের করবে। দাঁড়া, আরেকটু ভাবি”।
রায়া বলল, “আর চিন্তা ভাবনা। আমার হয়ে গেল। ওরে বাবারে!”
২৮
কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার সময় বাসস্ট্যান্ডে অরুন্ধতীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল সৌরভের। অরুন্ধতী তাকে দেখে হাসল, “কী খবর?”
সৌরভ বলল, “কী বলব আর? আজ এতটাই মাথা গরম হয়ে গেছিল ক্লাসে, খুব রাগারাগি করে ফেলেছি। এর ফলে একটা কাজের কাজ হয়েছে, কনফেশন গ্রুপটার অ্যাডমিনটার নাগাল পাওয়া গেছে”।
অরুন্ধতী অবাক হয়ে বলল, “সেকি? এতো বিরাট প্রোগ্রেস!”
সৌরভ বলল, “প্রোগ্রেস বলতে ছেলেটা ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। ও বলেছে ও নিজেও ঠিক করেছিল কনফেশনটা দিয়ে ডিলিট করে দেবে। সমস্যাটা হল যে কনফেশনটা করেছিল, সে ফেক প্রোফাইল থেকে ছেলেটাকে অহেতুক উত্তেজিত করে দেওয়ার ফলে ও খাপ খুলে ফেলে। এবার ওই ফেকটার আইপি ট্র্যাক করতে দিলাম। দেখা যাক কিছু হয় নাকি”।
অরুন্ধতী বলল, “এভাবে ট্র্যাক করা যায় নাকি?”
সৌরভ বলল, “সবই করা যায়। দেখি সাইবার সেল কিছু করে নাকি”।
অরুন্ধতী বলল, “আমাকেও তো কয়েকটা ফেক থেকে সম্ভবত আমার হাজবেন্ডই গালাগাল করে। সেটা দিলে সাইবার সেল কিছু করতে পারে?”
সৌরভ বলল, “কেন পারবে না? লিখিত কমপ্লেইন করে দেখো। ঠিক ঠাকই ব্যবস্থা নেয়”।
অরুন্ধতী বিষণ্ণ মুখে বলল, “আর ভাল লাগে না। এত কাদা ছোঁড়াছুড়ি অর্থহীন মনে হয় আজকাল”।
সৌরভ অপ্রস্তুত হল, “সরি”।
অরুন্ধতী বলল, “সরির কিছু নেই। এসব এত বিরক্তিকর যে এ নিয়ে কথা বলতেও ভাল লাগে না। এর মধ্যে কলেজে যদি এসব হয়। আমাদের সময় আমরা এসব ভাবতে পারতাম? ইদানীং যেন সব কিছুই বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। ফ্রাস্ট্রেশন থেকেই হচ্ছে হয়ত। ঘরে বসে ছিল এতদিন, কার্বাইড পাকা হয়ে গেছে সব”।
সৌরভ হেসে ফেলল, “এটা ভাল বললে, কার্বাইড পাকা। এটাই ঠিক টার্ম। এরা ঠিক ভুল জানে না, সব কিছুতেই এক্সপার্ট হয়ে গেছে”।
অরুন্ধতী বলল, “অবশ্য গোটা পরিবেশটাই যেখানে দিন দিন পচে যাচ্ছে, সেখানে এই জেনারেশন আর কী করবে? এভ্রিথিং ইজ কোরাপ্টেড, মাঝে মাঝে মনে হয় সব কিছু ছেড়ে পালাই। তোমার ভাল লাগে এখানে কাজ করতে, থাকতে?”
সৌরভ বলল, “দুর্ভাগ্যবশত এখানে জন্মেছি, বাড়ির টান আর হোমসিকনেসটা আছে। সবকিছু যে দিকে যাচ্ছে, আমিও পালাতেই পারি”।
অরুন্ধতী বলল, “কোথায় যাবে? পশ্চিমে? সে দেশে কিন্তু টিচার স্টুডেন্ট রিলেশনশিপ টক্সিকই। আলাদা কিছু না। তবে আমাদের দেশ অক্ষম অনুকরণ করে সব কিছুর। ধামাধরা আর অন্ধকার মানসিকতার সঙ্গে পশ্চিমী অনুকরণের কম্বিনেশন যা হয়, এখানে তাই হয়ে গেছে এখন। এসব বেশি বলতেও নিজেকে সিনিক্যাল বলে মনে হয় আজকাল”।
সৌরভ বলল, “চা খাবে? তোমাকে আজকাল খুব হতাশ লাগছে”।
অরুন্ধতী বলল, “চা খাওয়াই যায়। চল। বাসে এমনিতেও যা ভিড় আজকে, ট্যাক্সি নিতে হবে মনে হচ্ছে”।
দুজনে বাসস্ট্যান্ডের চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়াল। সৌরভ বলল, “তোমার ওদিকের সমস্যা মিটল?”
অরুন্ধতী বলল, “ডিভোর্স রিলেটেড?”
সৌরভ মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ”।
অরুন্ধতী বলল, “সমস্যা কি এত সহজে মেটে? আমি কিছু বললে মনে হতে পারে সারাক্ষণ অভিযোগ করে যাচ্ছি, ঘরের কথা বাইরে বলাও হয়ত উচিত না, কিন্তু পারা যায় না সব সময়। জীবনটারই বারোটা বেজে গেল”।
সৌরভ বলল, “তুমি বরং বাইরেই চলে যাও। এখানে যত থাকবে, তত বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবে”।
অরুন্ধতী বলল, “দেখছি, যদি যাওয়ার সুযোগ পাই, থাকব না। এখন তো নতুন পদ্ধতি এসে গেছে, সম্পর্ক ভেঙে গেলে খুন করে দাও, কত সমর্থক তার। একজন ঠাণ্ডা মাথার খুনি, যে কিনা রীতিমত প্ল্যান করে খুন করছে, সে শহিদ। আরেকটা কেস তো বরাবরই হয়ে চলেছে, ব্যর্থ প্রেমিক তার প্রেমিকার মুখে অ্যাসিড ছুঁড়ে মারছে। ক্রমাগত ভিক্টিমের ক্যারেক্টার অ্যাসাসিনেসন হয়ে যাচ্ছে। ভয় লাগছে আজকাল। আমার মত মেয়েরা এসব দেখে ভয় পেয়ে যাচ্ছে”।
চা এল। সৌরভ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “যদি এই কনফেশনটা কে করেছে জানতে পারি, কী করব?”
অরুন্ধতী বলল, “কী আর করবে? জ্ঞান দিয়ে ছেড়ে দেবে। আমাদের তো একটাই লক্ষ্য এখন, অপরাধী যেন আরো বেশি প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে যায়”।
সৌরভ মাথা নাড়ল, “ঠিকই। সবটাই এখন নিজেকে বাঁচিয়েই করতে হয়”।
অরুন্ধতী হাসল, “একটা সময় আসবে, ভিক্টিমও ছেড়ে কথা বলবে না দেখে নিও। কত আর মার খাবে সে? তখনই বোধহয় সব ব্যালান্সড হবে। অবশ্য মরে গেলে তো আর কিছু করার থাকবে না। মৃত মানুষের কীই বা প্রতিশোধ!”
সৌরভ বুঝতে পারছিল অরুন্ধতী ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে, এমন এক অন্ধকারে চলে যাচ্ছে যেখানে কারো কিছু করার নেই।
২৯
“আমি কী স্যারকে বলে দেব? সব কনফেস করে দেবো?” রায়া কাঁদো কাঁদো মুখে বলল।
শিঞ্জিনী বলল, “জানি না কী করবি। তবে এই আইপি থেকে ডিটেলস বের করা অতো সোজা হবে বলে মনে হয় না। তুই প্রোফাইলটা উড়িয়ে দিয়েছিস তো?”
রায়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, সেসব করে দিয়েছি। কিন্তু ধরা পড়লে হেবি কেলো হবে”।
শিঞ্জিনী বলল, “কিচ্ছু হবে না। তুই কিছুতেই স্বীকার করবি না। এমন স্টেটে থাকবি যেন তুই কিছুই জানিস না। আর যদি জেনে যায়, তাহলে সবার সামনে লাভ কনফেস করে ফেলবি”।
রায়া বড় বড় চোখ করে বলল, “বলিস কী?”
শিঞ্জিনী বলল, “হ্যাঁ। এছাড়া কোন উপায় নেই। বলবি তুই একটা ঘোরে ছিলিস। স্যারের সঙ্গে ম্যামকে কথা বলতে দেখে বুঝতে পারিস নি ঝামেলা হতে পারে। ক্ষমা চেয়ে নিবি”।
রায়া বলল, “তাতে আমার প্রেমের পুরো মার গাড়া যাবে”।
শিঞ্জিনী বলল, “গেলে যাবে। আপাতত বাঁচবি। কিছুতেই কোন ভয় নেই। যদি শুরু থেকেই অস্বীকার করে যেতে পারিস, সব থেকে ভাল হয়। দেখ পারিস নাকি”।
রায়া বলল, “আমি আজ আর ঘুমোতে পারব না। কী বাজে দিন গেল। তোর মুখ তো রোজই দেখি বুন্দু, তাহলে কী এমন হল যে আজকেই তুই এমন অপয়া হয়ে গেলি”?
শিঞ্জিনী বলল, “পয়া অপয়ার কিছু নেই। এসবই কর্মফল। স্যারকে দেখে হাসলে খিস্তি খেতেই হবে। এর একটা পজিটিভ দিক আছে। তোর মাথা থেকে স্যারের ভূত নেমে যাবে। তুই আবার পড়ায় মন দিতে পারবি। আজকাল যা হয়েছে তোর, পড়াশুনার নামই নেই”।
রায়া রেগে গিয়ে বলল, “আমার কথা বাদ দে, তোর কী হয়েছে বল তো? তুই আজকাল সব কিছুতেই খুব পজিটিভ ভাইবস দেখে বেড়াচ্ছিস। শমীক পাত্তা দিয়েছে নাকি? তোর তো আবার ওর উপর হেবি সফট কর্নার আছে। তুই যতই চেপে রাখিস, আমি ঠিকই বুঝি। কিন্তু মামা, একটা কথা বুঝতে হবে। সেম এজ রিলেশনশিপে যাস না। কোন লাভ নেই। এসব ছেলেদের না বাড়ে বুদ্ধি, না পাবি সেক্সে মজা। চার পাঁচ বছর বড় দেখ, সব দিক থেকেই ভাল”।
শিঞ্জিনী বলল, “তুই খুব সেক্স বুঝে গেছিস? কে বোঝাল তোকে?”
রায়া বলল, “কে আর বোঝাবে? এসব তো থাম্ব রুল। সেম এজ রিলেশনশিপ ভাল না। যারা জানে, তারা জানে। এমনি এমনি লোকে ফ্যাকাল্টির প্রেমে পড়ে? একটু কচি, একটু বড় ফ্যাকাল্টিই ভাল, বুঝলি না?”
শিঞ্জিনী বলল, “হিসেবে তো দেখছি তোর ধারে কাছে কেউ নেই, তাহলে এমন কাঁচা কাজ করলি কেন?”
রায়া বলল, “ভুল তো হবেই। ভুল থেকেই তো শিক্ষা নেব। যেদিন সৌরভের সোহাগে আদরে ঢাকা পড়ে যাব, সেদিন তুই বুঝবি আমি ঠিক ছিলাম”।
শিঞ্জিনী হাই তুলল, “ভাল, তাহলে এখন আর কলেজ বাঙ্ক মারিস না। তুই রেগুলার কলেজ বাঙ্ক মারলে তোর নাম বাইরে এলেও তোকেই দোষী ভাববে সবাই। একবারে বুক ফুলিয়ে ক্লাস কর রোজ”।
রায়া বলল, “তুইও কর। শমীককে দেখা। যদি শমীক অঞ্জনারটা ছেড়ে তোর ইয়েতে নজর দেয়”।
শিঞ্জিনী রেগে গিয়ে বলল, “আমি কিন্তু খুব রেগে যাচ্ছি। তুই বার বার শমীককে টানছিস কেন? তুই তো ঠিকই জানিস ওর আর অঞ্জনার কিছু একটা আছে?”
রায়া বলল, “আমি ঠিকই জানি যেমন, তুইও জানিস। তবু তুই শমীককে ঠিকই ঝাড়ি মারিস। তুই না বুঝলেও আমি বুঝতে পারি, সবাই বুঝতে পারে। অকারণ শমীকের কাছে গিয়ে বসিস, ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করিস তোকে পাত্তা না দিলেও, তুই কি ভাবিস আমরা কিছুই বুঝি না? সবাই সব বোঝে। মাঝখান দিয়ে তুই নিজেকে বেশি চালাক ভাবিস, লাভ নেই, তুইও বোকাই, আমিও ওই বোকাই, আমরা সবাই বোকা আমাদের এই বোকার জগতে”।
শিঞ্জিনী থমথমে মুখে বসে থেকে বলল, “আমি মোটেও শমীককে ওসব ভাবি না। তুই ভুল ভাবিস”।
রায়া ফিকফিক করে হাসতে লাগল, সেটা দেখে শিঞ্জিনী আরও রেগে গেল।