নান্দী
পুরোনো সময়ে এদেশের উত্তরে দক্ষিণে যেসব নাটক বা কাব্যকবিতা লেখা হত একদিন, সেসবের প্রারম্ভে মঙ্গলবাচক কয়েকটি শ্লোকের মাধ্যমে রচনাটির অতি সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হত। একে বলা হত ‘নান্দী’। পুরোনো দিনের সেই বিধি এখন আর নেই। নতুন সময়ে এসে আমরা মনে করি, একটি লেখা নিজেই তার নিজের কথা বলবে, আলাদা করে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। মঙ্গলের ধারণাও আজ পালটে গেছে আমাদের। সে-হিসেবে এই উপন্যাসের ভূমিকা-রচনা প্রয়োজনীয় নয় তত। তবু ‘নান্দী’-র মতো করে দুটো কথা প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, যেহেতু যে-আধারশিলায় এ উপন্যাস গড়ে উঠেছে, অর্থাৎ ইলাঙ্গো আডিগলের লেখা তামিল মহাকাব্য ‘শিলপ্পদিকরম’, বাংলাভাষাভাষী পাঠকের কাছে তা অনেকটাই অপরিচিত এখনও। তা ছাড়া কী ছিল এ উপন্যাসে আমার অন্বেষা, তার জন্য কেনই-বা আমি হাত পাতলাম তামিল মহাকাব্যের কাছে, কতটুকু নিলাম, কোথায় সরে গেলাম, কী পেলাম সেখান থেকে অর্থাৎ অন্বেষার ফলাফল কী হল—এসব কথা প্রথমে না বলে নিলেই নয়।
মানুষের সঙ্গে মানুষের মিথস্ক্রিয়া থেকে গড়ে ওঠে সমাজদেহ। পারস্পরিক সম্বন্ধহীন মনুষ্যযূথকে ‘সমাজ’ বলে না। কিন্তু যখনই এক মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষ সম্পর্ক স্থাপন করতে যায়, যখনই সেই সম্পর্কের আলোছায়া তার নিজের কাছে প্রকাশ পেতে শুরু করে, তখনই সে দেখে, বাইরের সেসব সম্পর্ক আসলে ব্যক্তিমানুষের নিজ মনের নানামুখী ভাব ও আবেগের ভিতর সমীকরণ ও অসমীকরণের ফলাফল। মানুষের নিজ মনের অন্তঃপুরে যুক্তি ও আবেগ, কল্পনা ও বাস্তববোধ, স্বপ্ন ও জাগরণ, চেতন ও অবচেতনের মধ্যে যে নিয়ত দ্বন্দ্ব ও মিলন ঘটে চলেছে, বাইরের পৃথিবী তারই প্রতিফলন মাত্র। মানুষ বড়ো অসহায়, বড়ো দুঃখী; কেননা নিজ মনের সেসব বিপরীত মেরুবিন্দুগুলোকে সে প্রায়শই ধারণা করতে পারে না, ধারণা করতে পারলেও তাদের মেলাতে পারে না, ক্রমশই এক অন্ধকার থেকে অন্য অন্ধকারের দিকে যেতে যেতে অসহায়ভাবে মুখ তুলে আশ্বাসের অস্ফুট আলোক সে অবলোকন করে মাত্র, তারপর মুখ নামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুনরায় জীবনের ক্লেশকর পন্থার অনুবর্তন করতে থাকে।
এই যে সংকট মানুষের, এ কি নিতান্তই সাম্প্রতিক? নাকি আবহমান কাল ধরেই মানুষ এই অন্তর্গত সংকটের শিকার? শুধু কি আমাদের পরিচিত পৃথিবীতেই এ সমস্যা ক্রিয়মাণ? নাকি ভিন্ন কালে, ভিন্ন দেশে, ভিন্ন ভাষিক সংস্কৃতির মধ্যেও একই যন্ত্রণার অনুরণন? এই প্রেম, অপ্রেম, আশাশীলতা, পুনর্মিলন, বৈবাহিক, অতিবৈবাহিক বন্ধন, প্রব্রজ্যা, প্রতারণা, অন্তর্ঘাত—এসব নিয়েই কি মানুষ সৃষ্টির প্রাগূষা থেকে অন্তহীন এক অভিযাত্রায় বাহির হয়েছে? কোথায় চলেছে সে? কোনদিকে? এই প্রশ্নগুলোই ছিল আমার এ উপন্যাসের প্রাথমিক অন্বেষা।
উত্তর পাব না আমি এসব প্রশ্নের, যদি সাম্প্রতিক কালের মধ্যেই আটকে থাকি, যদি জন্মলব্ধ সংস্কৃতির ভিতরেই ঘুরে মরি আমি। আমাকে যেতে হবে দূরে, অতীতের ঘন তমিস্রা ভেদ করে ভিন্ন সংস্কৃতিবলয়ের, ভিন্ন ভাষার কোনো অপরিচিত এপিকধর্মী রচনার কাছে। যদি দেখি, সেখানেও এই একই সংকটের জাল বুনে চলেছে মানুষের মাথার ভিতর কোনো চাতুর্যময় ঊর্ণনাভ, তাহলে প্রাপ্ত উপাত্তের আলোকে আমি বলতে পারব, মানুষের এই আত্মসংকট দেশনিরপেক্ষ, কালনিরপেক্ষ, আবহমান। আর যদি এ সংকটকে আবহমান বলে একবার চিনে নিতে পারি, তাহলে একে বহন করার, সহ্য করার সামর্থ্যও আসবে। এত যুগ ধরে এত মানুষ যদি দেশকালনিরপেক্ষভাবে এই সংকটের ক্রুশকাঠ বহন করে থাকেন, তাহলে আমিই-বা কেন পারব না নিজ জীবনের এই অনতিগুরু ভার বহন করে কোনো জ্যোতির্ময় দিগন্তের দিকে রক্তাক্ত চরণে এগিয়ে যেতে?
এই কারণেই আমি আঠেরোশো বছর আগেকার তামিল মহাকাব্য ‘শিলপ্পদিকরম’-এর কাছে হাত পাতলাম। গ্রিকদের কাছে ইলিয়াড বা ওডিসি যা, তামিল জনতার কাছে ‘শিলপ্পদিকরম’ ও ‘মণিমেখলাই’-ও তাই-ই। ‘শিলপ্পদিকরম’ জৈন সন্ন্যাসী ইলাঙ্গো আডিগলের দ্বারা রচিত। ‘মণিমেখলাই’ লিখেছিলেন বৌদ্ধ বণিক শিত্তলৈ শাত্তান। দ্বিতীয়টি প্রথমটির সিকুয়েল। শিলপ্পদিকরম-এর নায়ক কোভালন, নায়িকা কন্নকী ও প্রতিনায়িকা মাধবী। মাধবী ও কোভালনের মেয়ে মণিমেখলাই, যাকে নিয়ে সিকুয়েল মহাকাব্যটি লিখিত হয়েছে।
‘শিলম্বু’ শব্দের অর্থ নূপুর ও ‘অদিকরম’ শব্দের অর্থ কথা বা কাহিনি। অতএব, ‘শিলপ্পদিকরম’ শব্দের অর্থ নূপুরের গল্প বা নূপুর-কথা। সমস্ত কাহিনিটি একজোড়া নূপুরের চারিদিকে আবর্তিত হয়েছে, তাই এ কাব্য সার্থকনামা। শিলপ্পদিকরম কবেকার লেখা, তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। পণ্ডিত ভি আর রামচন্দ্র দীক্ষিতর অভ্রান্ত যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করেছেন শিলপ্পদিকরম দ্বিতীয় শতকের শেষার্ধে লেখা। চের, চোল, পাণ্ড্য বংশের রাজাদের কথা শিলপ্পদিকরম-এ বিশদে বর্ণিত হয়েছে, অথচ পল্লব রাজবংশ এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। এর থেকেও প্রমাণ হয়, পল্লবদের উত্থানের আগেই (খ্রিস্টাব্দ ২০০) এ মহাকাব্য লিখিত হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে প্রাচীন তামিল সঙ্গম-সাহিত্য মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে লেখা হয়েছিল।
এই সঙ্গম-সাহিত্যেরও তিনটি যুগবিভাগ আছে। শিলপ্পদিকরম তৃতীয় সঙ্গমের সমকালীন রচনা। তামিল সাহিত্যে যে-পাঁচটি রচনাকে মহাকাব্যের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, তার প্রথম দুটিই শিলপ্পদিকরম ও মণিমেখলাই। শিলপ্পদিকরম-এর রচনাশৈলী চম্পূজাতীয় অর্থাৎ গদ্যে পদ্যে বিমিশ্রিত।
কবি ইলাঙ্গো আডিগল ছিলেন একজন জৈন ক্ষপণক। পূর্বাশ্রমে তিনি ছিলেন চেরবংশের রাজকুমার। তাঁর অগ্রজ রাজা শেঙ্গুত্থুবান। এক বিশেষ ঘটনার অভিঘাতে ইলাঙ্গো রাজ্য পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে যান ও ‘শিলপ্পদিকরম’ রচনা করেন। কী কারণে তাঁকে সন্ন্যাসী হতে হয়েছিল, সেসব ঘটনা আমি উপন্যাসমধ্যে বিবৃত করব।
এ মহাকাব্যের প্রধান তিনটি চরিত্র—কোভালন, কন্নকী ও মাধবী। অপ্রধান চরিত্র অনেক। প্রধান তিনটি চরিত্রের মধ্যে ত্রিভুজ প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান। সেই প্রণয়প্রসঙ্গ ও জীবন-সংগ্রামের অনুষঙ্গের ভিতর দিয়ে সম্পর্কের নানামুখী আলোছায়াপাত, চরিত্রগুলির মানসিক টানাপোড়েন বর্ণিত হয়েছে। আজকের পরিভাষায় প্রথমদিকে কোভালন আইডিয়ালিস্ট ও কন্নকী রিয়ালিস্ট ছিল। কিন্তু কাহিনি যতই এগিয়েছে, ততই ওদের দুজনের স্থান-বিনিময় হতে থাকে। এবং কাহিনির অন্তিমে এক ভয়ংকর বাস্তব সত্যের উন্মোচনের মধ্য দিয়ে এই দ্বন্দ্ব সমাহিত হয়। তাদের ব্যক্তিগত ক্ষোভ, প্রক্ষোভ কাহিনির সমাপ্তিতে রাজকীয় অপশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থানের রূপ ধরে। এই যে ব্যক্তিগত স্তর থেকে ক্রমশ সমষ্টির স্তরে উত্তরণ—এই ব্যাপারটি শিলপ্পদিকরমকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
রামায়ণ বা মহাভারতের মতো শিলপ্পদিকরম-এ কাহিনিভাগ রাজবংশের মানুষদের চারপাশে আবর্তিত হয়নি। তামিল মহাকাব্যের কেন্দ্রে আছেন সাধারণ মানুষ, পরিধিতে রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা। মধ্যবিত্ত কোভালন ও কন্নকী ভাগ্যবিপর্যয়ে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ায় সমাজের নীচু তলার মানুষের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। সমাজে নারীর অবস্থান নিয়ে বারবার প্রশ্ন তোলে শিলল্পদিকরম। এবং এ রচনার সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র কন্নকী—এক নারী, যার নেতৃত্বেই অন্তিমে গণরোষের মুখে পড়তে হয় রাজাকে। এসব কারণেও শিলপ্পদিকরম যথেষ্ট আধুনিক লক্ষণাক্রান্ত রচনা।
এ মহাকাব্যে দক্ষিণ ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা বিশদে বলা আছে। চের, চোল ও পাণ্ড্যবংশ তখন দক্ষিণে রাজত্ব করছে। চেরবংশীয় শেঙ্গুত্থুবান, চোলবংশীয় কারিক্কাল ও পাণ্ড্যবংশীয় নেডুঞ্জেলিয়ণ স্ব স্ব ক্ষেত্রে শাসনরত। সিংহলে তখন রাজা গজবাহুর আমল । তাঁদের শাসনব্যবস্থা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ব্যর্থতা ও যুদ্ধনীতি বিশদে বর্ণিত হয়েছে। উচ্চকোটি থেকে নিম্নকোটি সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস—বৈদিক, বৌদ্ধ, জৈন, বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত এবং বনবাসী মানুষের ধর্মীয় প্রথা এ আখ্যানে সবিস্তারে বর্ণিত। নগরজীবন ও গ্রামজীবনের অনুপুঙ্খ বর্ণনাও উপস্থিত এখানে। সামাজিক প্রথাসমূহের প্রীতিপূর্ণ সহাবস্থান, এমনকি জনমনে প্রসারিত কুসংস্কারের কথাও স্থান পেয়েছে ইলাঙ্গোর রচনায়। কবি ইলাঙ্গো আডিগল সঙ্গীতশাস্ত্রে অতিশয় কলানিপুণ, গীতবাদ্যে তাঁর অপ্রতিম পাণ্ডিত্য এ রচনাকে সমৃদ্ধতর করেছে। এক কথায় এই মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ভারতের তৎকালীন সমাজ-ইতিহাসের অগ্রগণ্য ভাষ্যকার হয়ে উঠেছেন ইলাঙ্গো আডিগল ৷ আমি কিন্তু ইলাঙ্গো আডিগলের রচনার অনুবাদ করতে বসিনি। আমি লিখতে চেয়েছি একটি উপন্যাস—গণমানুষ যার কেন্দ্রে। সেক্ষেত্রে শিলপ্পদিকরম-এর কাহিনির রূপরেখাটুকুই আমি আশ্রয় হিসেবে নিয়েছি। সেই রূপরেখা থেকে আমি নির্মাণ করেছি আমার আবিষ্কৃত তাৎপর্য। তা না হলে শিলপ্পদিকরম নিংড়ে এই সুবৃহৎ উপন্যাস রচনার কোনো অর্থই থাকে না আমার কাছে।
ইলাঙ্গো আডিগল অত্যন্ত ইঙ্গিতকুশল। তিনি তাঁর লেখায় এমন অনেক ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন, যেগুলো তিনি তাঁর সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতার চাপে ব্যাখ্যা করতে পারেননি। ওইখানেই আমাকে ভাবতে হয়েছে। সেই ইঙ্গিতগুলোকেই বিশদ করতে হয়েছে। যেমন, কোভালন-কন্নকীর বিবাহের পরেই তিনি এমন একটি কথা লিখে অধ্যায়ের সমাপ্তিরেখা টেনেছেন, যার মধ্যে ভবিষ্যতে তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক যে সহজ থাকবে না, তার ইশারা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অথচ এসব ইশারা ইশারাই থেকে গেছে। ইলাঙ্গো তা আর ব্যাখ্যা করেননি। কিংবা মাধবীর কবিতায় এমন সব ইমেজারি ইলাঙ্গো ব্যবহার করেছেন, যা ঘটনা কোনদিকে যাবে, তার অস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। আমাকে ওসব ইঙ্গিতের সূত্র ধরেই নতুন উপকাহিনি নির্মাণ করতে হয়েছে।
ইলাঙ্গোর রচনা ক্ষিপ্র, তিনি এক ঘটনা থেকে পরের ঘটনায় অতি দ্রুততার সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে গেছেন। ঘটনা থেকে ঘটনান্তরে যাওয়ার এই দ্রুতগতি প্রক্রিয়া কিন্তু আমার দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হয়নি। যদি ঘটনার গতি স্বাভাবিক হতে হয়, তবে তা ধীর পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই অগ্রসর হওয়া উচিত। ফলত আমাকে ভাবতে হয়েছে, কোন কোন সম্ভাব্য পার্শ্ব ঘটনার অভিঘাতে মূল ঘটনাস্রোতে স্বাভাবিক পরিবর্তন আনতে পারব। এজন্যে আমাকে উপন্যাসের চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্বের ভিতর প্রবেশ করতে হয়েছে, নতুন অনেক ঘটনা সংযোজন করতে হয়েছে।
ইলাঙ্গো স্থানে স্থানে অলৌকিক ঘটনা এনেছেন। সেযুগের মহাকাব্যে অমনটা লিখলে দোষ ছিল না। কিন্তু আমরা সংশয়ী, আধুনিক মানুষ। তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার বাস্তবনির্ভর ব্যাখ্যাই আমরা খুঁজব। সব সময় যে সে-ব্যাখ্যা মিলবে, এমনটা দাবি করছি না। তবে আমাদের মনের অভিমুখ বাস্তবতার দিকেই। তাই মূল আখ্যানের বহু অলৌকিক ঘটনা-সন্নিবেশকে বাস্তবতার আলোকেই আমাকে পরীক্ষা করতে হয়েছে। এই পরীক্ষা করতে গিয়েই আরও অনেক নতুন ঘটনার চোরা স্রোত আমার চোখে পড়েছে এবং যথাস্থানে সন্নিবেশিত করেছি।
ইলাঙ্গো তাঁর কাব্যের অন্তিমে কন্নকী ও কোভালনের স্বর্গগমন, কন্নকীর নামে দেবদেউল নির্মাণ, সেই মন্দিরের স্থাপনা ইত্যাদি বেশ বিশদেই লিখেছেন। আমার চোখে এ সমস্তই কাহিনির ভার, বর্ণনার অতিশয়ী ফেনা। মাদুরাইক্কাণ্ডম-এ গিয়েই আখ্যান শেষ হয়ে গিয়েছে প্রকৃত প্রস্তাবে। তাই শিলপ্পদিকরম-এর অন্ত্যপর্ব বঞ্জিক্কাণ্ডম নিয়ে আমি মাথা ঘামাইনি। একটি আধুনিক উপন্যাসে বঞ্জিক্কাণ্ডম-এর বিষয়বস্তু থেকে কোনো উপাদান সংগ্রহ করার প্রয়োজন থাকে না।
ইলাঙ্গো তাঁর আখ্যানে চরিত্রগুলির নামকরণ খুব কাছাকাছি উচ্চারণের শব্দ দিয়ে করেছেন। যেমন—মাধবী, মালতি, মাদারি, মদালন ইত্যাদি। এই নামগুলো এত কাছাকাছি যে, পাঠক এদের গুলিয়ে ফেলতে পারেন। সেক্ষেত্রে কিছু কিছু চরিত্রের অন্যবিধ নামকরণ জরুরি হয়ে উঠেছে।
ইলাঙ্গো পূর্বাশ্রমে রাজপুরুষ; ফলত পাণ্ড্যরাজার শাসনের অব্যবস্থা তিনি খুব খোলাখুলি বলতে পারেননি। অথচ তাঁর লেখায় দুয়েকটি শব্দে বা বাক্যে ধাঁধা বা প্রহেলিকার মতন করে অব্যবস্থার সংকেত দিয়ে গেছেন। উপর উপর তিনি সব রাজারই প্রশংসা করছেন, অথচ রচনার অন্তরালে রেখে যাচ্ছেন তাঁর যন্ত্রণা, তাঁর ক্ষোভ। একদিন যখন এই সব রাজারা ইতিহাসের বিস্মৃত ধূলিকণা হয়ে যাবেন, তখন আমাদের মতন কেউ তাঁর রচনার অন্তরালে লুকিয়ে রাখা ব্যাসকূটসমূহ ভেঙে অর্থ নিষ্কাশন করবেন, হয়তো এই ছিল তাঁর আস্থা। যদি আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে ইলাঙ্গো আডিগল এই আশাই পোষণ করে থাকেন, তবে এটুকু বিনীতভাবে বলতে পারি যে, আমি তাঁর সেই আশা পূরণের প্রাণপণ প্রয়াস করেছি। সার্থক হয়েছি কি না, বলতে পারব না ।
শেষ পর্যন্ত আমার এ উপন্যাস ‘মূর্ছিত নূপুর’ মূল মহাকাব্য ‘শিলপ্পদিকরম’-এর কাহিনির রূপরেখাটুকুকে অনুসরণ করেও প্রায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আখ্যান হয়ে উঠেছে। অন্তত আমি একে এভাবেই দেখছি। শিলপ্পদিকরম-এর কাহিনির মুকুরে আমি প্রতিবিম্বিত হতে দেখছি আমার আজকের সময়কে, আজকের মানুষের ব্যথাবেদনা আশানিরাশাকে । আমি দেখলাম, আঠেরোশো বছর আগেকার কোভালন-কন্নকী-মাধবী বা অন্যান্যদের সংকট প্রকৃতিগতভাবে আমাদের থেকে খুব আলাদা নয়। সেই একই প্রেম-অপ্ৰেম, বঞ্চনা-প্রতারণা, আস্থা-অনাস্থার আলাপ। তাই জীবনানন্দ দাশ যখন লিখেছেন—
‘যেখানেই যাও চলে, হয় নাকো জীবনের কোনো রূপান্তর;
এক ক্ষুধা এক স্বপ্ন এক ব্যথা বিচ্ছেদের কাহিনী ধূসর
ম্লান চুলে দেখা দেবে যেখানেই বাঁধো গিয়ে আকাঙ্ক্ষার ঘর’
(বলিল অশ্বত্থ সেই; মহাপৃথিবী)
—তখন তিনি নিছক নিখাদ সত্যই উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু এই দ্বন্দ্ব-সমাকুল ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনের দুর্গম বনপথের মধ্য দিয়ে কোভালন, কন্নকী, কাভুন্দি থেকে শুরু করে আজকের আমরাও কোনো এক আশাশীল প্রত্যয়ের মাদুরাই নগরীর দিকে যাত্রা করেছি। সেখানে উপনীত হয়ে আমাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও আবার ফিনিক্স পাখির মতো আমরা জেগে উঠেছি প্রণয়কাবেরীর তটভূমিকায়; এ উপন্যাস আমাকে অন্বেষার এতাদৃশ উত্তরই দিয়ে গেছে।
বহু প্রসঙ্গ, প্রাদেশিক ভাষা ও পরিভাষা উপন্যাসমধ্যে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি, কারণ তা করলে আমার এই রচনার গতি ব্যাহত হত। এই জন্যেই উপন্যাসের শেষে পৃথক টীকা রচনা করে অব্যাখ্যাত বিষয়সমূহ পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছি।
তামিল ভাষার অনেক শব্দেরই যথাযথ প্রতিবর্ণীকরণ বাংলা ভাষায় সম্ভব নয়। বাংলা ভাষার অনেক বর্ণও তামিল বর্ণমালায় নেই। আবার এমন অনেক বর্ণ তামিল বর্ণমালায় আছে, যার যথাযথ উচ্চারণ বাঙালির জিহ্বায় প্রায় সম্ভব নয়। আমরা সেই সব বর্ণের উচ্চারণে অভ্যস্ত নই। তাই অনেক তামিল শব্দের বানান বাংলা ভাষার উচ্চারণের সমীপবর্তী করেই আমাকে লিখতে হয়েছে।
আমাকে প্রথম শিলপ্পদিকরম-এর গল্পটি বলেছিলেন এক তামিল যুবক। নাম তাঁর ব্রহ্মচারী শ্রীনিবাসন। তিনি আমাকে শিলপ্পদিকরম পড়তে উৎসাহিতও করেছিলেন। সে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের কথা। আমরা দুজন বছর চারেক একই আশ্রমের একই কক্ষে অন্তেবাসী ছিলাম। তীব্র অসুস্থতার কারণে চিররুগ্ন শ্রীনিবাসন অকালে নিজের জীবনে ছেদ টেনে দিয়েছিলেন নিজের হাতেই। আমি যে কখনও শিলপ্পদিকরম নিয়ে কিছু লিখব, সেকথা তখন দূরতম স্বপ্নেও ভাবিনি। কে যে কার কাছে কী রেখে চলে যায়!
আবীরলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও সমিধশঙ্কর চক্রবর্তী আমাকে বইপত্র জোগাড় করে দিয়ে ও আমার নানা প্রশ্নের উত্তর বহু পরিশ্রম করে খুঁজে দিয়েছেন। অথচ এখনও অবধি আমি তাঁদের এ উপন্যাস লেখার কথা বিশদে কিছুই জানাইনি।
ফলত অকালপ্রয়াত শ্ৰীনিবাসন এবং চিরজীবেষু আবীর ও সমিধ আমাকে অজ্ঞাতসারেই সাহায্য করেছেন। আমি তাঁদের সকলের কাছেই সবিশেষ কৃতজ্ঞ।
ধানসিড়ি প্রকাশনের কর্ণধার শুভ বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রকাশনা-সংশ্লিষ্ট সকলেই আমার এই উপন্যাসটিকে বই হিসেবে রূপদানের কাজে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তাঁদের সকলকেই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
প্রতিটি উপন্যাসই এক অন্তর্গত অভিযাত্রার কথা বলে। যদি কোনো সহৃদয় পাঠক এ উপন্যাসের আখ্যানভাগের সঙ্গে পথ হেঁটে অনাবিষ্কৃত কোনো চিন্ময় পুষ্পহার অথবা কোনো চিন্ময় মাদুরাই-কে নিজের ভিতরে খুঁজে পান, তাহলে আমার শ্রম কথঞ্চিৎ সার্থক হবে বলে মনে করি ।
কিমধিকমিতি—
সন্মাত্রানন্দ
৩০ নভেম্বর, ২০২৩