নরকের চলচ্চিত্র

নরকের চলচ্চিত্র

রাজশেখর সেন একবার টেবিলের ওপরে রাখা ডিজিটাল ক্লকটার দিকে তাকালেন। বারোটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি রয়েছে, তবু এখনই পাড়াটা নিঝুম হয়ে গিয়েছে।

বাঁশদ্রোণির ভেতরের দিকটায় এখনও একটু মফসসলের ছাপ আছে। এখানে ছোট ছোট একতলা দোতলা বাড়ি আছে, রাস্তার ধারে কয়েকটা পুকুর আছে, কলাগাছের ঝাড় আছে। এমনকী মেন রোড থেকে একটু দূরে হেঁটে গেলে এক—দুটো বাঁশবন অবধি দেখা যায়।

কয়েক বছর আগে অবধি এমন নির্জন রাত্তিরে হঠাৎ হঠাৎ শেয়ালের ডাক শোনা যেত। আজকাল আর শোনা যায় না। শহর এগিয়ে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে পুকুর, বাঁশবন, কলাগাছ আর শেয়ালেরা।

তবু অন্তত রাতের দিকে এই পাড়াটায় এখনও নির্জনতা পাওয়া যায়। আর সেইজন্যেই বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও রাজশেখর সেন বাঁশদ্রোণি ছেড়ে কোনো দামি জায়গায় ফ্ল্যাট কিনে উঠে যাননি। নিস্তব্ধতা না থাকলে মাথায় নতুন চিন্তা আসে না। সমস্তদিন শু্যটিং—ফ্লোরে অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসে তিনি সেই নৈঃশব্দ্য খুঁজে পান।

বাগানের দিকে যে জানলাটা, তার সামনেই তার লেখার টেবিল। ওই টেবিলের সামনে পেতে রাখা চেয়ারটায় বসে তিনি জানলার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। দেখেন হাস্নুহানা গাছে জোনাকির আলো দপদপ করছে। বাতাসের সঙ্গে ফুলের গন্ধ ভেসে আসে। পাঁচিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টটার টিমটিমে বাল্ব থেকে একটু আলো এসে পড়ে গুলঞ্চ গাছের ডালে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে মনে হয়, অন্ধকার জলের ওপরে অনেকগুলো ডুবন্ত মানুষের হাত যেন বাঁচার আশায় ছটফট করছে।

আস্তে আস্তে রাজশেখরের চোখের সামনে থেকে তার চেনা বাগানের দৃশ্য মুছে গিয়ে অন্য কোনো ছবি ভেসে ওঠে। কোনো ভয়ের দৃশ্য। তিনি স্ক্রিপ্ট লেখার খাতার ওপরে ঝুঁকে পড়েন। দ্রুত চলতে থাকে তার হাতের কলম। সৃষ্টি হয় আরও একটা হইচই ফেলে দেওয়া হরর—ফিল্মের গল্প আর চিত্রনাট্য।

হ্যাঁ, পরপর কয়েকটা গায়ে কাঁটা দেওয়া ভয়ের সিনেমা তৈরি করার পরে রাজশেখর সেনের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। শুধু এদেশে নয়, বিদেশেও তার পরিচালিত ভয়ের ছবি প্রশংসিত হয়েছে।

এই মুহূর্তে যে ছবিটা তিনি বানাচ্ছেন, তার ইনডোর আর আউটডোর শ্যুটিং কমপ্লিট। তবু সিনেমাটা তিনি রিলিজ করতে পারছেন না। তার কারণ, সিনেমাটার কয়েকটা জায়গায় কম্পিউটার—গ্রাফিক্স আর অ্যানিমেশনের দরকার ছিল আর সেই কাজটা রাজশেখর সেন যাদের দিয়েছিলেন সেই ”অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরস” কাজটা শেষ করতে অনেক সময় নিয়ে নিল।

এর মধ্যে ফোনে, ই—মেলে, চিঠিতে রাজশেখর সেন অনেকবার তাদের তাগাদা দিয়েছেন, রাগারাগি করেছেন। ওদের দিক থেকে শুধু সংক্ষিপ্ত উত্তর এসেছে— আরেকটু সময় দিন, আরেকটু। তবে শেষ অবধি ওরা কাজটা কমপ্লিট করতে পেরেছে। আজকেই স্টুডিওয় স্পেশাল মেসেঞ্জারের হাত দিয়ে পৌঁছে গেছে সিডি—র প্যাকেট।

শু্যটিং—এর ব্যস্ততার মধ্যে সেই প্যাকেট খুলে দেখবার সময় পাননি রাজশেখর সেন। এবারে কম্পিউটারটা অন করে প্যাকেটটা খুললেন। সিডি—টা চালিয়ে দেখতে হবে কাজটা ওরা কেমন করল।

প্যাকেটটা খুলে রাজশেখর সেন একটু অবাক হলেন। শুধু সিডি—ই নেই, সঙ্গে রয়েছে অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরসের ডিরেক্টর সুধাময় প্রধানের লেখা একটা চিঠি। চিঠিটা বেশ লম্বা।

এত সব কী লিখেছেন মিস্টার প্রধান? কৌতূহল নিয়ে রাজশেখর সেন চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন।

.

ডিয়ার মিস্টার সেন,

অ্যাডভান্সড অ্যনিমেটরসের ডিরেক্টর হিসেবে আপনার সমস্ত অভিযোগ মেনে নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় নেই। সত্যিই আপনার কাজ শেষ করতে অস্বাভাবিক দেরি হয়ে গেল। তার জন্যে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

হয়তো এইটুকু লিখেই এই চিঠি শেষ করে দেওয়া যেত। তাতে ব্যবসায়িক সৌজন্যও রক্ষা হত। কিন্তু আমার বিবেক বলছে আর কয়েকটা ঘটনা আপনাকে জানিয়ে রাখা উচিত। হয়তো আপনি আমাকে পাগল ভাববেন, তবুও।

আপনি যে কাজটা আমাদের দিয়েছিলেন সেটা ছিল চ্যালেঞ্জিং, ভীষণই চ্যালেঞ্জিং। আপনি আমাদের বানিয়ে দিতে বলেছিলেন নরকের চলচ্চিত্র। স্টুডিয়োয় নয়, কম্পিউটারের স্ক্রিনে। আপনি চেয়েছিলেন লেলিহান আগুন। সেই আগুনের রং যেন পৃথিবীর কোনো আগুনের মতন না হয়। আপনি চেয়েছিলেন সেই আগুনের মধ্যে সারি সারি ছায়ামূর্তি। তাদের মুখে যেন লেগে থাকে যন্ত্রণার ছাপ। তবে সব শেষে আপনি পুরো ব্যাপারটাই আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। শুধু বলেছিলেন যাই বানাই না কেন, তার মধ্যে যেন নরকের একটা বিশ্বাসযোগ্য ছবি ফুটে ওঠে।

আমি এই অ্যাসাইনমেন্টাটা দিয়েছিলাম অনির্বাণকে। অনির্বাণ মজুমদার। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জুনিয়র কিন্তু সবথেকে প্রতিভাবান। দু’বছর আগে সিলিকন ভ্যালির একটা কলেজ থেকে অ্যানিমেশনে ডিগ্রি নিয়ে এসে আমাদের সংস্থায় ও যোগ দিয়েছিল।

আমাদের এই অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরসে এমন অনেক কর্মী আছেন যাঁদের এক্সপেরিয়েন্স কিংবা টেকনিকাল নলেজ অনির্বাণের চেয়ে বেশি। কিন্তু গত দু’বছরে অনির্বাণ তাঁদের ওপরে টেক্কা দিয়েছে একটাই কারণে— ওর মতন কল্পনাশক্তি আর কারুর মধ্যে ছিল না।

কোনোকিছু নিখুঁতভাবে কপি করতে বললে অনির্বাণ পারত না, রেগে যেত। কিন্তু নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে বললে ওর ফুর্তি দেখে কে? তখন ও জান লড়িয়ে দিত সেই কাজটার পেছনে। আর এরকম এক—একটা অ্যাসাইনমেন্ট শেষ হওয়ার পরে আমরা একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য হতাম, এমন অরিজিনাল কাজ আগে এদেশে দেখিনি। ওর কাজের দৌলতে অ্যাডভান্সড অ্যানিমেটরসকে আই—টি সেক্টরের রথী—মহারথীরাও সম্মান করতে শুরু করেছিল।

তাই অনির্বাণ মজুমদারকেই আমি নরকের চলচ্চিত্র বানাবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। কারণ, নরক সম্বন্ধে তো আর কারুর চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নেই। ওখানে ওর কল্পনাশক্তিই কাজে লাগত।

.

অনির্বাণ কিন্তু তা বিশ্বাস করত না। সেটা যখন বুঝতে পারলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

আমি শুধু দেখেছিলাম, কাজটা হাতে পাওয়ার পরেই অনির্বাণ বইয়ের মধ্যে ডুবে গেল। নানা রকমের বই। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে আসা চামড়ায় বাঁধানো অ্যান্টিক বই, কলেজস্ট্রিটের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে আনা বৃষ্টির ছিটে লাগা বাদামি পাতার বই, নানান ইউনিভার্সিটির জার্নালস, পিরিয়ডিক্যালস, রিসার্চ পেপার। আর সবার ওপরে ই—বুক তো ছিলই। অফিস ছুটি হয়ে যাওয়ার পরেও বহুক্ষণ ও নিজের কিউবিকলে ঘাড় গুঁজে বই পড়ত। তখন শুনশান অফিসে থাকতাম কেবল আমরা দুজন— আমি আর অনির্বাণ।

অ্যাসাইনমেন্টটা ওকে দেওয়ার মাস—দুয়েক পরে, অমনই এক জনহীন সন্ধ্যাবেলায়, অনির্বাণ হঠাৎ স্যুইং—ডোর ঠেলে আবার চেম্বারে ঢুকল। ওকে দেখে কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগল। চোখদুটো কেমন যেন ঘোরলাগা।

আমি বললাম, বসো অনির্বাণ। কিছু বলবে?

অনির্বাণ বলল, হ্যাঁ, একটাই কথা বলব বলে এলাম। আমার বিশ্বাস নরক ব্যাপারটা কাল্পনিক নয়। রূপক তো নয়ই। সত্যিকারেই নরক রয়েছে, যেমন রয়েছে এই কলকাতা শহর।

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি বেশি পড়াশোনা করলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। ঘোর সন্দেহ হল, অনির্বাণের হয়তো তাই হয়েছে। তবু বহু বছর ধরে অফিস চালাচ্ছি তো। মনের কথা বেমালুম মনে চেপে রেখে বললাম, কেমন করে বুঝলে?

অনির্বাণ উত্তর দিল, সে তো এককথায় আপনাকে বোঝাতে পারব না। তবে পৃথিবীর সমস্ত মহাকাব্য, লোককথা, উপকথায় নরকের যে বর্ণনা রয়েছে তার মধ্যে অদ্ভুত মিল। এটা কখন সম্ভব বলুন তো?

তুমিই বলো।

যখন জিনিসটা বাস্তবে থাকে। কল্পনায় কল্পনায় তফাত থাকতে পারে, কিন্তু বাস্তবে কোনো তফাত থাকে না। আকাশকে সব দেশের লোকই নীল রং দিয়ে আঁকবে। ঘাসকে সব দেশের লোকই সবুজ বলবে। সেইরকমই নরকের ছবিও সব দেশে এক, কারণ মৃত্যুর পরের এক জগৎ সত্যিই রয়েছে।

ওর সঙ্গে তর্ক করতে পারতাম। বলতে পারতাম, পৃথিবীর সব মানুষের মনেই মৃত্যুর পরের অবস্থা নিয়ে একটা ভয় থাকে। সেই ভয়টাই গানে, গল্পে কিংবা লেখায় ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয়। বলতে পারতাম, ভয়টা যেহেতু এক, তাই ছবিগুলোও এক। কিন্তু আমি সেসব না বলে বললাম, বাঃ। তাহলে তো তোমার কাজ সহজ হয়ে গেল। ওইসব গল্পে যা—যা পাচ্ছ, তার ওপরে বেস করে মিস্টার সেনের অ্যানিমেশনের কাজ—টা নামিয়ে দাও না। এতবড় একজন পরিচালকের প্রোজেক্ট আমাদের জন্যে পিছিয়ে যাচ্ছে। এটা তো ভালো কথা নয়।

উঁহু! বেশ জোরেই ঘাড় নাড়ল অনির্বাণ। বলল, ওসব গল্পে বছরের পর বছর এত রং চড়েছে যে, এখন আর আসল ছবিটাকে খুঁজেই পাবেন না। ওইসব লোককথা উপকথাকে মডেল ধরে অ্যানিমেশন বানালে আপনি ভয় পাবেন না। হেসে ফেলবেন।

অনির্বাণের কথা শুনে আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমাদের তো ভয়ের ছবি—ই দরকার। তাই ওকেই আবার জিগ্যেস করলাম, তাহলে কী করবে ভাবছ?

অনির্বাণ প্রায় স্বগতোক্তির মতন করে বলল, একবার যদি মৃত্যুর পরের জগৎটা নিজের চোখে দেখে আসতে পারতাম!

ওর পাগলের মতন কথা শুনে এইবার আমি মেজাজ হারালাম। কড়া গলায় বললাম, শোনো অনির্বান। যাই করো আর তাই করো, মিস্টার সেনের কাজটা কিন্তু আর একমাসের মধ্যে শেষ করে দিতে হবে। তার বেশি সময় দিতে পারব না।

মাত্র একমাস! ওর গলায় হতাশা স্পষ্ট।

আমি বললাম, হ্যাঁ, একমাস। তিরিশ—দিন। তার মধ্যেই তুমি আমাকে তোমার কাজ হ্যান্ড—ওভার করবে।

.

তার ঠিক দুদিন বাদেই অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে অনির্বাণের গাড়িটা এক্সপ্রেসওয়ের একটা উঁচু ব্রিজ থেকে নিচে পড়ে গেল। ও একাই ছিল গাড়িতে। মারা গিয়েছিল অনির্বাণ।

ওর গাড়িটা কোনো অ্যাকসিডেন্টের ফলে ব্রিজ থেকে পড়ে গিয়েছিল? নাকি ও নিজেই নিজেকে ছুড়ে দিয়েছিল শূন্যের বুকে?

আজ আমার সন্দেহ হয় দ্বিতীয়টাই ঠিক। অনির্বাণ নিজের চোখে নরক দেখতে গিয়েছিল।

মিস্টার সেন, বুঝতে পারছি আপনার ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। তবে আমার কাহিনিও শেষ হয়ে এসেছে।

অনির্বাণের মৃত্যুর দু’দিন পরের ঘটনা। মানে আজ থেকে ঠিক পনেরোদিন আগে। তারিখটা ছিল আঠেরো জানুয়ারি। সেই রাতে যেমন শীত পড়েছিল তেমন শীত কলকাতায় অন্তত দেখেছি বলে মনে পড়ে না। পুরো শহরটাই যেন একটা মর্গের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল। সেই রাতেই, রাত বারোটার সময় আমার সেল—ফোনটা বেজে উঠল। ঘুমজড়ানো চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকালাম। দেখলাম ফোন করেছেন মিস্টার আহুজা। নিউ আলিপুরে রাস্তার যেদিকে আমাদের অ্যাডভান্সড অনিমেটরসের অফিস, তার ঠিক উলটোদিকেই মিস্টার আহুজার বাড়ি। কিন্তু এত রাতে ওঁর ফোন কেন!

মোবাইলটা কানে লাগিয়ে বললাম, হ্যালো মিস্টার আহুজা।

ওদিক থেকে জবাব ভেসে এল—মিস্টার প্রধান, শান্তভাবে শুনুন। ডোন্ট গেট প্যানিকড। আপনার অফিসে আগুন লেগেছে। আমি প্রথমেই ফায়ার—ব্রিগেডে ফোন করেছিলাম। ইন ফ্যাক্ট ওরা পৌঁছেও গেছে। বাট ইউ শুড কাম ইমিডিয়েটলি।

মিস্টার আহুজাকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়ি নিয়ে দৌড়লাম অফিসের দিকে। যখন অফিসে পৌঁছলাম ততক্ষণে আগুন নিভে গেছে। চারিদিক জলে থইথই করছে, কিন্তু আর বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়নি।

ফায়ার—ব্রিগেডের লোকজন যতক্ষণে বিদায় নিল, ততক্ষণে ভোরের আলো ফুটে গেছে। ক্লান্ত শরীরে মিস্টার আহুজার ড্রইং—রুমে গিয়েই বসলাম। ওঁর কাজের লোক আমাদের সামনে দু—কাপ গরম কফি রেখে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে মিস্টার আহুজা প্রশ্ন করলেন, আপনার অফিসে কি রাতে কেউ থেকে গিয়েছিল মিস্টার প্রধান? আপনার কোনো এমপ্লয়ি?

চমকে উঠলাম। বললাম, না তো। একথা কেন জিগ্যেস করছেন?

না… মানে আমি তো অনিদ্রারোগী। রোজকার মতন জানলার ধারে বসে বই পড়ছিলাম। তার মধ্যেই একবার চোখ তুলে দেখলাম আপনার অফিসের ভেতর একটা ছায়া চলাফেরা করছে। একটামাত্র কিউবিকলেই আলো জ্বলছিল। লোকটা সেই কিউবিকলে কম্পিউটারের সামনে বসে ঘাড় গুঁজে কাজ করছিল, আবার মাঝেমাঝে উঠে এসে জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, আকাশ থেকে যেন কিছু একটা নেমে আসবে।

আমি ভেবেছিলাম, আপনার—ই কোনো স্টাফ ওভারটাইম করছে। একটু পরেই হঠাৎ কিউবিকলের আলোটা নিভে গেল আর তারপরেই আগুনের প্রথম হলকাটা দেখতে পেলাম।

শুকনো গলায় বললাম, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না মিস্টার আহউজা। তবে আমার কোনো স্টাফ যে কাল রাতে অফিসে ছিল না এ ব্যাপারে আমি সিওর।

কিন্তু ধরুন, অফিস ছুটির পরে কেউ যদি লুকিয়ে বসে থাকে।

অসম্ভব! আমি নিজে অফিসের প্রত্যেকটা কর্নার চেক করে নিজের হাতে তালা দিয়ে বেরোই। তাছাড়া কে আমার সঙ্গে এমন শত্রুতা করবে?

তবে কি আমিই ভুল দেখলাম? হতে পারে। বয়স হচ্ছে। বিমর্ষ গলায় বললেন মিস্টার আহুজা।

.

না, মিস্টার আহুজা ভুল দেখেননি। পরের দিন অফিস পরিষ্কার করে নতুনভাবে কাজ শুরু করলাম। আমার নিজস্ব কম্পিউটারটা আমার নিজস্ব পাস—ওয়ার্ড দিয়ে খুললাম এবং খুলেই দেখলাম ডেস্কটপে একটা নতুন আইকন জ্বলজ্বল করছে। তার নাম ”নরকের চলচ্চিত্র”।

হ্যাঁ, মিস্টার সেন। ওই নামে একটা আধঘণ্টার ভিডিও—ক্লিপিং কেউ আমার কম্পিউটারে আপলোড করে দিয়েছিল।

না, এমন অস্পষ্ট ভাষায় কথা বলার প্রয়োজন নেই। স্পষ্ট করেই বলি। তাতে যদি আপনি আমাকে উন্মাদ ভাবেন তো ভাবুন। মৃত্যুর দেশ থেকে ফিরে এসে অনির্বাণ ওই ছবি আমার কম্পিউটারে আপলোড করে দিয়েছিল। এইভাবেই ও কমপ্লিট করে গিয়েছিল ওর অ্যাসাইনমেন্ট।

আমি, কেবল আমিই আমার কম্পিউটারে দেখেছি সেই ভিডিও। ঠিকই বলছি, অ্যানিমেশন নয়। ভিডিও ফোটোগ্রাফি। যা ঘটছে, ক্যামেরা দিয়ে তারই রেকর্ডিং। বানানো কিছু নয়। কিন্তু সেই চলচ্চিত্র এই জগতের নয়। আগুনের অমন বিভৎস রং আমরা পৃথিবী মানুষেরা কোনোদিন দেখিনি। সেই আগুনের মধ্যে আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে যে জীবগুলো, তারাও এই জগতের কেউ নয়। কোনো মানুষের শরীর ওইভাবে যন্ত্রণায় বেঁকে যেতে পারে না। অত যন্ত্রণায় কোনো মানুষ বেঁচে থাকতেও পারে না। ওরা প্রেত।

এই চিঠির সঙ্গেই ওই ভিডিও ফুটেজের সিডি পাঠিয়ে দিলাম। আমার কাছে কোনো কপি রাখলাম না। কারণটা বুঝতে পারছেন কি? আমি ভয় পেয়েছি।

আপনি ভিডিওটা নিজে দেখুন। তারপর স্থির করুন আপনার সিনেমায় ওটা ব্যবহার করবেন কি না। যদি আমার পরামর্শ শোনেন তাহলে বলব ওটা ব্যবহার করবেন না। ফেলে দিন। নষ্ট করে ফেলুন। মৃত্যুর পরের জগতে উঁকি মারার অধিকার বোধহয় আমাদের, মানে জীবিত মানুষদের নেই।

‘বোধহয়’ বলছি কেন? নিশ্চয়ই নেই। তার প্রমাণ কী জানেন? আমার অফিসের ওই আগুন।

পরলোক থেকে তার কাজ শেষ করে যাওয়ার জন্যে ফিরে এসেছিল অনির্বাণ। জানি না মৃত্যুর পরে কোন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিল সে, কিন্তু সেরকম কোনো ক্ষমতার জোরেই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল নরকের ছবি। রেখে গিয়েছিল আমার কম্পিউটারে। কিন্তু নরকের প্রহরীরা ছাড়বে কেন? তারা ধাওয়া করেছিল অনির্বাণকে। জ্বালিয়ে দিতে চেয়েছিল আমার কম্পিউটার সমেত পুরো অফিসটাকেই। পারেনি শুধু মিস্টার আহুজা জেগে ছিলেন বলে।

কিন্তু ওরা কি চেষ্টা ছাড়বে? মনে হয় না। সেইজন্যেই আবার বলছি, নষ্ট করে ফেলুন সিডিগুলো। নরকের জীবদের ঘাঁটাবেন না।

ভালো থাকুন, সাবধানে থাকুন। ইতি— সুধাময় প্রধান।

.

চিঠিটা পড়া শেষ করে ওটাকে মুঠোর মধ্যে পাকিয়ে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেললেন রাজশেখর সেন। রাগে তার মুখ থমথম করছে। দাঁতে দাঁত শিপে বললেন, ওল্ড শিট। নিজের অপদার্থতা ঢাকবার জন্যে ভূতের গল্প বানাচ্ছে। কাজটাকে জগাখিচুড়ি করে ছেড়েছে নিশ্চয়ই। একবার চালিয়ে দেখে নিই, তারপর প্রধানের মজা দেখাচ্ছি।

সিডির স্লটে সিডিটা ঢুকিয়ে ফাইল ওপন করলেন রাজশেখর সেন। ঠিক তখনই ফুলের গন্ধকে সরিয়ে একটা পচা গন্ধ ঢুকে পড়ল তার জানলা দিয়ে। জোনাকিগুলো ভীষণ ভয়ে হাস্নুহানার ঝোপ ছেড়ে ছিটকে গেল চতুর্দিকে।

.

পরেরদিন শহরের সবকটা বড় কাগজে মোটামুটি এই ভাষায় একটা খবর বেরোল—

”গতকাল রাত বারোটা নাগাদ এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন জনপ্রিয় বাংলা ছবির পরিচালক রাজশেখর সেন। পুলিশ এবং ফরেনসিক—বিশেষজ্ঞদের কথায় জানা যাচ্ছে, তিনি তাঁর বাঁশদ্রোনির বাড়ির একতলার ঘরে বসে কম্পিউটারে কিছু কাজ করছিলেন। এই সময় সম্ভবত শর্ট—সার্কিট থেকে তাঁর কম্পিউটারে আগুন লেগে যায়। সাধারণত এমন আগুনের শিখা বেশিদূর ছড়ায় না। কিন্তু কালকের ঘটনায় আগুনের তীব্রতা এতই বেশি ছিল যে, রাজকুমারবাবু তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠবারই সময় পাননি। মুহূর্তের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে যায় তাঁর শরীর। আগুন যেমন হঠাৎ জ্বলে উঠেছিল তেমনই হঠাৎই নিভে যায় বলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা। কারণ,কম্পিউটারটি ছাড়া ঘরের আর কোনো জিনিসের ক্ষতি হয়নি। রাজকুমারবাবুর মৃত্যুতে অসমাপ্ত রয়ে গেল তাঁর আগামী ছবি, যেটির কাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর সহকারী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *