নবম পর্ব- চারিদিকে মানুষের অস্পষ্ট ব্যস্ততা
১।
চুঁচুড়ার খরুয়াবাজারের দিক থেকে অটো সরাসরি লঞ্চঘাটে এল না। রাত হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে দশটা। বেশি দেরি করলে লাস্ট লঞ্চ মিস করবে ও। তাই অটো থেকে নেমেই লঞ্চঘাটের দিকে তাড়াতাড়ি পা চালাল। ঘাট পেরিয়ে ওপারে নৈহাটি যেতে হবে। সেখান থেকে ট্রেন ধরে কলকাতা। চেতলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় মাঝরাত। কাল রাতে ফিরতে পারেনি। এখানে আটকে গেছিল। আজ না গেলেই নয়। দিনের বেলায় এই জায়গাটা গমগম করে। রিকশাওয়ালারা “কোথায় যাবেন দাদা?” বলে অতিষ্ঠ করে মারে। এখন একটা জনপ্রাণী নেই। মন্দির আর বটতলাটা পার হয়েই আর একটুখানি। ঠিক এই সময় পিছন থেকে চাপা গলায় একটা ডাক শুনতে পেল। কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে “অভয়… অভয়…”
চমকে পিছনে তাকাল অভয়। এত রাতে এখানে কেউ তাকে কেন ডাকবে? পিছন ফিরতেই ছেলেটাকে দেখতে পেল সে। বটগাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। অভয় পিছন ফিরতেই হাতছানি দিয়ে ডাকল। অভয় গেল না।
দাঁড়িয়ে রইল। হাতের সিগারেটটা মাটিতে ফেলে ছেলেটাই এগিয়ে এল এবার, “অভয়হিজড়া তো?”
অভয় উত্তর দিল না। তার নিরুত্তর থাকাকে সম্মতি ধরে নিয়ে ছেলেটা বলল,”আমাকে চিনিস?”
অভয়ের গলা শুকিয়ে এসেছে। তবু মাথা নেড়ে বলে, “চিনতে পারলাম না।”
“চিনিসনি? আচ্ছা। আসলে ইউনুস আমায় তোর কথা বলেছে।”
“কোন ইউনুস?”
“খিদিরপুরের। চিনিস না এমন ভাব করছিস?”
“সে তো জেলে। খুন করেছে।”
“কিছুই খবর রাখিস না। ইউনুস ছাড়া পেয়েছে। আজকে সকালে। তোরখোঁজ করছে।”
“কেন?”
“ও ধান্দাছেড়ে দেবে। খিদিরপুর খোলের কাম তোকেই সামলাতে হবে। পারবি?”
অভয়ের বুকের ধুকপুকানি এত বেড়ে গেছে, যেন বাইরে থেকেও শোনা যাবে। তবু সেটা বুঝতে না দিয়েঅভয় বলল, “সেটা তোমার মুখে শুনব কেন? ইউনুস আমার নিজে বলুক।”
“বলবে। ও আসলে এখানে আসতে চাইছে না। ওদিকটায় আছে। চল আমার সঙ্গে।”
“আমার খোঁজ পেলে কীভাবে?”
“খরুয়াবাজারের হিজড়া অফিসে তুই বুধবার করে আসিস, সেটা অনেকেই জানে। কিন্তু ইউনুস অফিসে যেতে চাইছে না। ওখানে সবাই প্রায় এর চেনা। জেল থেকে ফিরে ও দেশের বাড়ি চলে যাবে বলছে। তুই কি যাবি? না এখানেই থাকবি?”
“চলো। তবে তাড়াতাড়ি। লাস্ট লঞ্চ বেরিয়ে গেলে সারারাত আমায় এখানেই থাকতে হবে।”
ছেলেটা আগে আগে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। ফেরিঘাটের বাঁ পাশ দিয়ে হনুমান মন্দির পেরিয়ে যে সরু রাস্তাটা সোজা চলে গেছে, দিনের বেলাতেই সেটা প্রায় নির্জন থাকে। এত রাতে তো কথাই নেই। খানিক এগিয়ে একটা ভাঙা বাড়ি। এককালে কোনও বড়োলোক মানুষ থাকতেন। এখনও সেইসব খিলানের কিছু অবশিষ্ট আছে। ভাঙা গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল ছেলেটা। অভয় ইতস্তত করতে বলল, “ভয় পাচ্ছিস নাকি? ইউনুস ভিতরেই আছে। আয়।”
অভয় ভিতরে ঢুকে কয়েক পা এগিয়ে একবারে পোড়ো ভাঙা এক চাতালে উপস্থিত হল। কেউ নেই। এতক্ষণে অভয়ের ভয় করতে শুরু করেছে। এভাবে আসাটা ঠিক হয়নি। সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল, “ইউনুস কোথায়?”
ছেলেটা খুব ধীরেসুস্থে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা সিগারেট লাইটার দিয়ে ধরিয়ে বলল, “এত তাড়াকীসের? সব হবে। একে একে। আগে তুই সত্যি কথা বল তো, আমার পিছনে লেগেছিস কেন?”
অভয় ধরা পড়ে গেছে। এই আশঙ্কাটাই সে করছিল। কিন্তু এখন আর পিছনে ফেরার উপায় নেই। সে চুপ রইল।
“অ্যাই শালা গিলিতোর, তোর মতো খজ্জরের বাটুতে ধুরপিট করে আমি খাই রে খানকি। সত্যি কথা বল, আমার পিছনে লেগেছিস কেন?”
অভয় পালাতে চাইল। ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে প্রেতের মতন উদয় হল তিন-চারটেগুন্ডা মতো লোক। ঘিরে ধরে দাঁড়াল অভয়ের দুদিকে। পালাবার পথ নেই।
“পিছনে লাগিনি। ভুল করছ তুমি।”
“শোন, ভুল আমি করি না। ইউনুসের খোলায় সেদিন মরতে মরতে বেঁচেছি। তারপর থেকেই দেখছি তুই শালা ধুরানির মতো আমার পিছে লেগে আছিস। পুলিশের লোক? সত্যি কথা বল।”
কোনওমতে পাশাপাশি মাথা নাড়ল অভয়।
“কে তোকে পাঠিয়েছে? নাম বল। কেন পিছু নিয়েছিলিস?”
অভয় জানে এই কথা জানাজানি হলে তার মোগা তাকে আস্ত রাখবে না। তার মোগা ভয়ানক লোক। প্রয়োজনে তার দেশের বাড়িতে লোক পাঠিয়ে বাবা, মা, বোনেরও ক্ষতি করতে পারে। সে চুপ রইল।
বিরাশি সিক্কার একটা চড় এসে পড়ল অভয়ের গালে। গাল জ্বালা করে। উঠল। তারপরেই একের পর এক চড় লাথি ঘুসি। অভয় ঠিক করে নিয়েছে সে কিছু বলবে না। আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা আছে তার। এত মারেও সে মুখ দিয়ে টু শব্দ করল না। প্রায় মিনিট দশেক জনাচারেক মিলে বেধড়ক পেটাল তাকে। অভয় ব্যথায় কুঁকড়ে ছোটো হয়ে পড়ে আছে। গোটা দেহ কাঁপছে থরথর করে। দাঁত ভেঙে গেছে। চোয়ালও। দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে। বুকের পাঁজরগুলো যেন এক্ষুনি ফেটে বেরিয়ে যাবে। সেই অবস্থাতেই সে বুঝতে পারল তার দুই হাত নিয়ে পিছনে শক্ত করে বেঁধে দিল কেউ। মুখে স্টিকিং প্লাস্টার লাগিয়ে দিল একজন। পা দুটো বেঁধে দিল শক্ত নাইলনের দড়ি দিয়ে। এরা তাকে নিয়ে কী করতে চাইছে? বেশিক্ষণ সাসপেন্সে থাকতে হল না। সেই ছেলেটা নিজের হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগের মধ্যে তার মাথা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। দড়ি এঁটে দিল গলার কাছে। অভয় হাঁ করে শ্বাস নেবার চেষ্টা করতে লাগল। ভুল করল। ব্যাগের মধ্যে আটকে থাকা সামান্য অক্সিজেন ফুরিয়ে যেতে লাগল দ্রুত। বুক ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। কাটা মুরগির মতো প্রাণপণে ছটফট করতে শুরু করল। দুজন জোয়ান লোক তাকে চেপে ধরে রেখেছে। নড়াচড়ার উপায় নেই। ধীরে ধীরে চারদিকের পৃথিবী ঘোলাটে হয়ে গেল অভয়ের চোখের সামনে। এখন তার গোটা দেহ স্থির, শুধু হাঁ করা মুখ শেষ অক্সিজেনটুকুর জন্য হা-হুতাশ করছে।
২।
এই সবই রামানুজ নিজের কানে শুনেছিল। একদিন রাতে বেজায় মদ খেয়ে ঘরে ঢুকেছিল বিশ্বজিৎ। কী হয়েছিল কে জানে! শুধু হাউহাউ করে কাঁদছিল, আর বলছিল তার নরকেও ঠাঁই হবে না। সে মানুষ খুন করেছে। আসলে মনেপ্রাণে রামানুজকে ভালোবেসে ফেলেছিল বিশ্বজিৎ। রামানুজ সেটা বুঝত। আর বুঝত বলেই বিশ্বজিতের সঙ্গে থাকাকালীন অন্য কোনও পারিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সেই রাতেই নেশার ঘোরে বিশ্বজিৎ হড়হড় করে সব উগরে দেয়। খিদিরপুরে হিজড়াখোলে বাক্সটা অদ্ভুত পথে এসেছিল। এই বাক্সের আসল মালিক নাকি ছিল এক ম্যাজিশিয়ান। সে মরার পরে তার ওয়ারিশ ছিল না কেউ। এই বাক্স নানা হাত ঘুরে খিদিরপুরে আসে। খিদিরপুরে নাকি ইউনুসের এক মোগা ছিল। সে এই বাক্স ইউনুসের কাছে রেখে গেছিল। বাক্সে কী আছে কেউ জানত না। খুলতে পারলে তো জানবে! বিশ্বজিৎ একদিন এই বাক্স দেখে ফ্যালে। এটা কী, জানতে চাইলে ইউনুস বলে, এই বাক্সে ভূত আছে। এই বাক্স কেউ খুলতে পারে না। তার মোগা কয়েকদিন এটা তার কাছে লুকিয়ে রাখতে বলেছে। অদ্ভুত এই বাক্সটায় কোনও তালাচাবি নেই। কিন্তু এই বাক্স বিশ্বজিতের চেনা। ছোটোবেলায় ম্যাজিক দেখানোর শখ ছিল। তখন এইরকম বাক্স দেখেছে। কাঠের খাঁজে খাঁজে আটকানো থাকে। কোথাও ছোট্ট একটা গোঁজ থাকবেই। সেটা চাপ দিলে পাশাপাশি খুলে যাবে ড্রয়ারের মত। ইউনূস ঘর থেকে বেরোতেই বাক্সটা খুলে ফেলেছিল। ভিতরে অদ্ভুত পাঁচটা বোতল। চারটে তরল। একটায় প্রায় অর্ধেকের বেশি সাদা বড়িতে ভরা। বোতলের গায়ে মড়ার গুলির চিহ্ন। ছোটো থেকেই বিশ্বজিতের মাথায় অদ্ভুত সব বিকৃত তামাশা ভর করে। একেবারে ছোটোবেলায় বন্ধুর সঙ্গে পাঁচিলে বসে গল্প করতে করতে আচমকাই তাকে ঠেলা মেরে ফেলে দিয়েছিল, শুধু কী হয় দেখার জন্য। বাড়িতে একটা পোষা টিয়াপাখি ছিল। সেটাকে ডানা বেঁধে তিনটে বিড়ালের মুখে ছেড়ে দিয়ে পরম তৃপ্তিতে বিড়ালদের ফিস্ট উপভোগ করেছিল। ঠিক তেমনই, যেন তামাশা করার জন্যেই ইউনুসের মনে একটা সাদা বড়ি ফেলে দিয়ে বাক্স বন্ধ করে রাখল। সেদিন সে বুঝেছিল ভূতে ধরলে কী হয়। এক চুলের জন্যে বেঁচে গেছে সেই দিন। কিন্তু স্বভাব যায় না ম’লে। সবার অলক্ষে বাগটা চুরি করে আনতে ভোলেনি।
সমস্যা শুরু তারপর থেকেই। কারা যেন তার পিছু নিচ্ছে। সবসময় মনে ভয়। এক হিজড়া সব জায়গায় তাকে ফলো করত। তাকে নিকেশ করেছে। কিন্তু শাস্তি নেই। যেখানেই যায়, মনে হয় হাজার জোড়া চোখ তাকে ধাওয়া করছে। সব এই ভূতের বাক্সের জন্য। কিন্তু এই বাক্সের এমন তুক, সে না পারছে গিলতে, না পারছে সেটাকে ফেলে দিতে।
রামানুজ বিশ্বজিৎকে জড়িয়ে ধরে। ঠিক যেমন করে একজন মা বাচ্চাকে প্রবোধ দেয়। বিশ্বজিৎ ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। বলছিল সে ভালো হয়ে যেতে চায়। রামানুজ তাকে বলেছিল তার পরিচিত একজন আছে, যে এই বাক্স নেবে। শুধু নেবে না, মোটা টাকায় কিনে নেবে। পরের দিন প্রথমবার দেবাশিস গুহ বিশ্বজিতের বাড়ি এসেছিল। দুজনে মিলে ঘর বন্ধ করে কীসব কথাও বলেছিল। সেদিন অনেক রাতে দেবাশিস চলে যাবার পর বিশ্বজিতের মুখে রামানুজ একজনের নাম শোনে। এই নাম সে জীবনে ভুলবে না। ‘মাস্টার’।
.
রামানুজ এখন দাঁড়িয়ে আছে বিরাট উঁচু সেই বাড়িটার সামনে। এই বাড়িতেই মাস্টার আছেন। নিজের চোখে মাস্টারকে সে কোনও দিন দেখেনি। একেবারে শুরুর দিকে নাকি দেবাশিস নিজেই বিশ্বজিৎকে মাস্টারের সঙ্গে পরিচয় করায়। বেশ কিছুদিন মাস্টারের কথাই বলত বিশ্বজিৎ। মাস্টার বলেছেন তাকে দলের কাজে লাগাবেন। বলেছেন তাকে স্বাভাবিক জীবন দেবেন। কাপড়ের দোকানের কাজটা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল বিশ্বজিৎ। মাস্টার মানা করেন। এতে নাকি লোকের সন্দেহ বাড়বে। কিন্তু তলে তলে দলের নানা কাজ করত সে। রামানুজ জানে। প্রায়ই রাতে বাড়ি ফিরত না। এভাবে কিছুদিন চলল। সমস্যা শুরু হল তারপর। একদিন বিশ্বজিৎ আবার চরম নেশা করে বাড়ি ফিরল। দেবাশিসকে নাকি দল থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। সঙ্গে তাকেও। সেদিন প্রথম বিশ্বজিৎকে ভয় পেতে দেখেছিল রামানুজ। ও বারবার বলছিল, “এরা ভালোর ভালো, খারাপের খারাপ।” কারা? সঠিক জানে না রামানুজ। তবে সে একজনকে চেনে। মাস্টার। একদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় একটা খবর বেরিয়েছিল। সঙ্গে ছবি। সেই ছবি দেখে চমকে গেছিল বিশ্বজিৎ। মন্ত্রীমশাইয়ের ঠিক পাশেই অমায়িক চেহারার একটা লোক। মুখে মৃদু হাসি। বিশ্বজিতের গলা কাঁপছিল। ধরা গলায় সে রামানুজকে ডেকে জানায়, “এই দেখ। এই যে বাঁদিকে। এই আমাদের মাস্টার। দেখতে এমন হলে কী হবে? খতরনাক লোক। একটু বেচাল করলেই জানে মেরে দেবে।”
“তোমাকেও?”
“আমি তো চুনোপুঁটি এর কাছে। দরকারে দেবাশিস গুহকেও খতম করে দিতে পারে।”
.
রামানুজ জিনসের প্যান্টের পকেট থেকে একটা সিগারেট বার করে ধরাল। এখনও সময় লাগবে। কম করে হলেও ঘন্টাখানেক। কিন্তু তাকে এই কাজ করতেই হবে। গোলাপ বলেছে পারিকের বদলা ছিবড়িকেই নিতে হয়। নইলে মরার পরে দেবী বহুচেরা নরকে পাঠান। বিশ্বজিৎ সবসময় ভয়ে থাকত মাস্টার তাকে মেরে ফেলে দেবে। সেই তো দিল। সেদিন পালিয়ে যাবার আগে বিশ্বজিতের সেই ভয়জড়ানো চোখ রামানুজ ভুলবে না। এতদিনে সুযোগ এসেছে শোধ নেবার। ওই তো, গেট দিয়ে লোকটা বেরোল…
.
৪।
মেইলটা পেয়ে খানিক চুপ করে বসে রইলেন মাস্টার। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! তিনি একবার ভাবলেন ঘুরিয়ে ফোন করেন। কিন্তু লাভ হবে কি? এলাহাবাদ অবধি আর উৎসাহ দেখাচ্ছে না। যে সময় সবচেয়ে বেশি ম্যাসনিক ব্রাদারহুডের সাহায্য লাগবে, সেই সময়ই আচমকা তারা এভাবে হাত গুটিয়ে নেবে, তা স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি মাস্টার। লন্ডন আর এডিনবরা ব্রাদারহুড জানিয়েছে দুটোতেই নতুন গ্র্যান্ডমাস্টার এসেছেন, যাঁদের কেউই আর এই ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহী নন। শেষ চেষ্টা করেছিলেন কাল রাতে। সরাসরি বার্কিংহ্যাম প্যালেসে মেইল করে। এইমাত্র জবাব এল, সাতদিন আগে যে সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল, সেটাই বলবৎ থাকবে। ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক সংকোচনের জন্য রানির ভাতা কমিয়ে দিচ্ছেন। ফলে নীবারের খাতে যে টাকাটা নিয়মিত আসত, সেটা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হল। এর বদলে নীবার যদি কোনও পদক্ষেপ নেয়, তার জন্যেও ব্রিটিশ রাজবংশ তৈরি।
বেশ খানিকক্ষণ মাথা টিপে বসে রইলেন মাস্টার। এই কি তবে শেষ? আসলে ব্রিটেনের রাজবংশ তাদের আগের গৌরব হারিয়েছে। এতরকম স্ক্যান্ডালে জড়াচ্ছে রোজ, আরও একটা নতুন স্ক্যান্ডাল কয়েকদিন সাড়া ফেলবে সোশ্যাল মিডিয়াতে হয়তো। এর বেশি কিছু হবে না। কাউকেই অনন্তকাল ধরে ভয় দেখিয়ে রাখা যায় না। এই দিনটা আসবে মাস্টার জানতেন। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি, সেটা বোঝেননি।
অবশ্য ইঙ্গিত পেয়েছিলেন অনেক দিন থেকেই। দেবাশিসকে তাড়িয়ে দেবার পর থেকেই তাসের ঘরের মতো সবকিছু ভেঙে যেতে লাগল। দেবাশিস বাসুর হাতে মরল। বিশ্বজিৎকে মরতে হল। তুর্বসু এই কেসে জড়িয়ে গেল। নিশীথ ধরা পড়ল। আর সবচেয়ে খারাপ যেটা হল, সেটা অপর্ণার কেসটা। মাস্টার মনেপ্রাণে চাইছিলেন অপর্ণা যাতে এর থেকে দূরে থাকে। ওকেও না জানিয়ে থাকা গেল না। এদিকে এই মেইল। এখন নীবার কীভাবে চলবে, কিংবা আদৌ চলবে কি না, সেটাই বড়ো প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেল। মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরোলেন মাস্টার। হাতে চামড়ার ব্যাগে দরকারি কাগজপত্র। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সামান্য হোঁচট খেলেন। একেবারে অভ্যাসবশেই গলার আই কার্ড সোয়াপ করে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। বেরোতে বেরোতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি সার্ভিসে দিয়েছেন। একটু হেঁটে বাস ধরে বাড়ি যাবেন।
মাস্টারের মন তাঁর বশে নেই। থাকলে বুঝতে পারতেন তিনি বেরোনো মাত্র উলটো দিকের দেওয়ালে পিঠ দিয়ে সিগারেট টানতে থাকা এক ছোকরা সিগারেট ফেলে তাঁর পিছু নিল। একটু এগিয়ে বাঁদিকের গলিটা ধরলেন মাস্টার। এই গলিটা বড্ড সরু। দুইদিকে উঁচু দেওয়াল। একজনই কষ্ট করে যেতে পারে। উলটো দিক থেকে কারা যেন আসছে। শাড়ি পরা। কিন্তু চলাফেরায় পুরুষালি ভাব। হাতে ঘণ্টা আর ঢোল। বাজনা বাজাচ্ছে আর তারস্বরে গান গাইছে “তোর পিরিতে পইড়া আমার জীবন অন্ধকার / লক্ষ্মী আমার সোনা ছাইড়্যা যাইও না কো আর।” এতক্ষণে মাস্টারের সংবিৎ ফিরল। তিনি দ্রুত পিছন ফিরে দৌড়াতে যেতেই দেখেন ফিনফিনে রোগা একটা ছেলে, কালো টিশার্টে অ্যাচিভার লেখা, তাঁর দিকে বন্দুক তাগ করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বোঝার আগেই এগিয়ে আসা হিজড়াদের একজন নাচতে নাচতেই তাঁর হাত দুটো চেপে ধরল। সামনে ছেলেটা পকেটের রুমাল বার করে তাতে বোতল থেকে কী যেন নিয়ে মিশিয়ে চেপে ধরল মাস্টারের নাকে। মাস্টার হাত পা ছোড়ার চেষ্টা করলেন প্ৰাণপণে। সেই হিজড়া শক্ত হাতে তাঁকে চেপে ধরে আছে। মাস্টার জ্ঞান হারালেন। তখনও গান চলছে, “তোর পিরিতে পইড়া আমার…।
ধস্তাধস্তিতে মাস্টারের পকেটে ঝোলানো আইডেন্টিটি কার্ড খসে পড়ল। কেউ খেয়াল করেনি। গলির মুখে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে তাঁকে চাপিয়ে নিয়ে চলে যাবার অনেক পরে এক কলেজ স্টুডেন্ট সেই রাস্তায় আইসক্রিম খেতে খেতে যাচ্ছিল। রাস্তার চুঁইয়ে আসা আলোতে কার্ডটা দেখে সে তুলে নেয়। দ্যাখে তাতে এক প্রৌঢ় মানুষের ছবি। নিচে লেখা- প্রশান্ত মজুমদার। ডিরেক্টর। ডিরেক্টরেট অফ স্টেট আর্কাইভ। ওয়েস্ট বেঙ্গল।