পূর্বখণ্ড— সংলিপ্ত
মধ্যখণ্ড- সংশপ্তক
উত্তরখণ্ড- সংখ্যাপন

নবম পরিচ্ছেদ— গণপতির বাক্স

নবম পরিচ্ছেদ— গণপতির বাক্স

কাকভোরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছিল। সারা সকাল একভাবে বৃষ্টি হয়ে দুপুরের দিকে একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু রাস্তাঘাট জলে জলে একাকার। আকাশে জল ভরা মেঘ মুখ ভার করে রয়েছে। বেলা একটু পড়তেই গণপতি দর্জিপাড়ার দিকে পা বাড়াল। এই পথ তার হাতের তালুর মতোচেনা। কিন্তু আজ তার পা টানছে না। ভেবেছিল কোনও দিন আর এইমুখো হবে না। পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে দারোগা প্রিয়নাথের জন্য পালাতে পারল না। তারিণীর জন্য পালাতে পারল না। কাল হাসপাতালে সাইগারসন সাহেব তাদের যা যা বললেন, তা যদি সত্যি হয়, তবে ঘোর বিপদ। এই বিপদে পালানো চলে না। কিন্তু জেনেশুনে সাপের গর্তে হাত ঢোকানোর ফল কী হতে পারে সেটাও হাড়েহাড়ে জানা আছে তার। একটু সন্দেহ হলেই এরা শত্রুর শেষ রাখে না। সেখানে গণপতিকে ছেড়ে দেবে, ভাবাটাই হাস্যকর।

তবে গোপন বার্তা দিয়ে তাকে যখন ডাকা হয়েছে, তখন নিশ্চিত তাদের কোনও মতলব আছে, যাতে গণপতিকে কাজে লাগতে পারে। সাহেবও সেটাই বললেন। গতকাল সবকিছু খুলে বলার পরে দারোগাবাবু আর সাহেব তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এককালে তারিণী নিজে এই কাজ করত। খোচড়ের কাজ। এই কাজ করেই ড্রিসকল সাহেবের নেকনজরে এসেছিল সে। কিন্তু গণপতি মাতাল-দাতাল মানুষ। সে কি পারবে এই কাজ করতে? এমনই নানা চিন্তা করতে করতে আনমনে পথ হেঁটে কখন চৌরাস্তা পেরিয়ে এসেছে মনে নেই। সেখানে এসে দেখল গোটা পঞ্চাশ খোট্টা বেজায় ভিড় করে এক দোতলা বাড়ির দিকে চেয়ে আছে। তাদের একদল চাতক পাখির মতো ছাদের দিকে, অন্য দল পাশেই নর্দমার দিকে তাকিয়ে। শহরে এ এক নতুন জুয়াখেলার আমদানি হয়েছে। এদের কেউ কেউ বাজি রাখে, তিন ঘণ্টার মধ্যে এমন বৃষ্টি হবে যে বাড়ির নর্দমা দিয়ে হুহু করে জল পড়বে। অন্যরা এর উলটোটা বলে। বাজির দর দুই আনা থেকে পাঁচশো টাকা অবধি ওঠে। এবার দুই দলই ট্যাঁকঘড়ি হাতে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে মহা হল্লা করছে। তাদের কোনওমতে এড়িয়ে সোনাগাজির দরগা পাশে রেখে গণপতি মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের ঠিকানায় পা বাড়াল। মেঘ গুড়গুড় করছে। বৃষ্টির আর খুব দেরি নেই। সময়মতো পৌঁছাতে না পারলে ভিজে একশা হতে হবে। গণপতির হাঁফ ধরে গেল। একে দ্রুত হাঁটা, অন্যদিকে চাপা উত্তেজনা। লখনের দল কি কিছু জানতে পেরেছে? যদি পেরে থাকে, আজ তবে তার আর রেহাই নেই।

একশো বছর আগেও সোনাগাজির দরগায় চারদিকে শ্যাওলাধরা দেওয়ালে কাক-শালিকের বাসা ছিল। এ রাস্তায় সন্ধে হতে না হতে কেবল শিয়াল কুকুর ছাড়া কারও আওয়াজ পাওয়া যেত না। এখন সেই রাস্তাতে এই বৃষ্টির দিনেও আতর, গোলাপ, ফুলেল তেল বিক্রি হচ্ছে। দোকানের সামনে ফুলুরি, চিংড়ি, তোপসে মাছ ভাছা, হাঁসের ডিম সিদ্ধ, পেঁয়াজ দিয়ে ছোলাভাজা সাজানো। দুই একটা মিঠাইয়ের দোকান-ও আছে। মিঠাইওয়ালা হাঁক পাড়ছে “মজাদার নকোলদানা, এই বেলা নে আর পাবি না” কিংবা “ক্ষীরের ছাঁচ, ক্ষীরের আঁচ, ক্ষীরপুলি চা-আ-ই।” খানদানি লম্পটরা আজ বিকেল না হতেই বিভিন্ন বাড়িতে ঢোকা শুরু করে দিয়েছে। মোড় ঘুরতেই রামকৃষ্ণ শুঁড়ির দোকান। দোকানের সামনে এক বেশ্যা মদ দিতে বলছে। আরও দুই-তিনজন ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। শুঁড়িকে দেখেই গা ঢাকা দিয়ে অন্য পথে যাবার ধান্দায় ছিল গণপতি। শুঁড়ি সে সুযোগ দেবে কেন? গণপতিকে দেখেই হাঁক পাড়লে, “ও চক্কোত্তির পো! আজকাল এই পথে দেখি না যে বড়ো?”

“নানা কাজে ব্যস্ত থাকি কিনা…” গণপতি এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল।

“অ। তার মানে কাজকম্মো জুটচে। আয় হচ্চে। ভালো ভালো। কিন্তু ভালোমানুষের পো, এই গরিব শুঁড়ির কাচে মদ খেয়ে যে গোটাগুটি সাড়ে সাত টাকা ধার করেচিলে, সেটা দিতে গেলেই বুজি পরাণে ব্যাতা লাগে? বলি টাকাটা কি পাব?” দোকানের সামনে বেশ্যারা উচ্চস্বরে অশ্লীল হাসি হেসে উঠল। যেন কতই না মজা হয়েছে। একজন আবার ছড়া কাটল-

“কাপ্তেনগিরি কি ঝকমারি।
কেঁদেকেঁদে শেষে চোখে পড়ে বারি”

আবার সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠে। গণপতি দ্রুত পা চালায়। দর্জিপাড়া পেরোতেই রাস্তা সরু হয়ে এল। এদিকে বাড়িগুলো আরও কাছাকাছি ঘেঁষা প্রায় প্রতিটি বাড়ির একতলাতেই নানা অদ্ভূত জড়িবুটি, সারসাপ্যারিলা, আর অদ্ভুত সব পেটেন্ট কেমিক্যালের দোকান। বাইরের বোর্ডে চোখ বুলালে অনায়াসেই “মদনানন্দ মোদক”, “রতিবর্ধক রসায়ন”, “শঙ্কর শক্তি সালসা”-র মতো বিচিত্র সব নাম দেখা যায়। গণপতি যে ঠিকানায় যাবে, বাস্তবে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। ৭ নং মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের পরের বাড়িটিই ৮ নং। ৭/১- এর সন্ধান শুধু বিশেষ কিছু লোক ছাড়া জানে না।

৭ নম্বরের সামনে এসে দাঁড়াতেই গণপতির ভয় করা শুরু হল। এতক্ষণ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। প্রথমেই যা মনে এল, তা হল গঙ্গার ঘাটে পিণ্ডারী বাবার ছিন্নভিন্ন দেহ, আর শৈলর পরিণতি। কে জানে, এই সন্ধেই তার জীবনের শেষ সন্ধে কি না!

ইষ্টনাম জপ করে ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল গণপতি। বাইরে আচমকা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। দূরে প্রবল চিৎকারে বোঝা গেল বাজিতে জেতা খোট্টারা উল্লাসে ফেটে পড়েছে। ঘরের ভিতর এখনই এত অন্ধকার যে তেমন কিছু ঠাহর করা যায় না। দেওয়াল জুড়ে বড়োবড়ো কাঠের ক্যাবিনেট। কাচ ঢাকা। তাতে সারি সারি অদ্ভুত নামের সব বোতল সাজানো। এক বুড়ো মুসলমান ক্যাবিনেটের সামনে বড়ো কাঠের টেবিলে লণ্ঠন জ্বালিয়ে খুব নিচু হয়ে কিছু একটা পড়ছিলেন। গণপতি তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বুড়ো বই থেকে মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে খুব নম্রস্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, “জি জনাব?”

গণপতির বুকের ধুকপুকানি যেন বাইরে থেকে শোনা যাবে। তবু সে অম্লানবদনে বলল, “আজ সন্ধেছটায় আমাকে আসতে বলা হয়েছিল।”

বুড়োর চোখে সন্দেহ ঘনীভূত হয়।

“আজ? কিসনেবুলায়া?”

এবার গণপতি ফ্যাসাদে পড়ল। এর আগে এখানে সে বার দু-এক এসেছে। দুইবারই সঙ্গে শৈল ছিল। তাই ঢুকতে সমস্যা হয়নি। এই বড়োবড়ো ওষুধের আলমারি আসলে পুরোটাই ধোঁকা। পিছনে আর-একটা ঘর আছে। সেটার গোপন নামই ৭/১। গণপতি জানে। খানিক আমতা আমতা করে সোজা সেই আলমারির দিকেই আঙুল দেখিয়ে বলল, “ওই কামরায় আমাকে ডেকেছে।”

বুড়ো মুসলমান এবার উঁচু টুল থেকে নেমে এলেন।

“আপ কেয়া কহ রহে হ্যায়, কুছ সমঝমে নেহি আ রহা।”

গণপতি খেয়াল করে দেখল বুড়ো লম্বায় গণপতির চেয়েও আধা হাতখানেক বড়ো। বইটা সযত্নে মুড়ে রেখে পিছনের টেবিলের ওপাশ থেকে বেরিয়ে এল সে। দাঁড়াল গণপতির ঠিক পাশটাতে। একনজরে বইটার নাম খেয়াল করল গণপতি। বটতলার মুসলমানি বই “মোক্তল হোছেন প্রণীত জঙ্গনামা।” হাজিপাড়া ঝোয়তঝরি প্রেসে ছাপা

এই দেখাই কাল হল গণপতির। হুল ফোটার মতো তীব্র এক যন্ত্রণায় ঘাড়ের কাছটা জ্বলে যেতে লাগল। তার অন্যমনস্কতার সুযোগে ঘাড়ের কাছে সজোরে কিছু একটা ফুটিয়ে দিয়েছে লোকটা। এত দ্রুত, গণপতি নিজে জাদুকর হয়েও আন্দাজ করতে পারেনি। এখন একটা বিচ্ছিরি জ্বালাধরা ভাব ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘাড় থেকে সারা দেহে, সঙ্গে সঙ্গে অবশ হয়ে যাচ্ছে গোটা দেহ। গণপতির চোখে গোটা ঘর যেন দুলে উঠল, বীরুৎজাতীয় উদ্ভিদের মতো সে টলেপড়ে যেতে থাকল মাটিতে। পড়েই যেত, যদি না একেবারে শেষ মুহূর্তে সেই বুড়ো তাকে সযত্নে ধরে মাটিতে শুইয়ে দিত।

এরপর খানিকক্ষণ গণপতির কিচ্ছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরতে শুরু করল, মনে পড়ল ঠিক এমনটাই হয়েছিল তার সঙ্গে। অনেক বছর আগে। যেদিন পিণ্ডারী বাবার খুনের দিন কালঘুমে ধরেছিল। সেদিনের মতো আজকেও কানে আসছে একের পর এক গলার আওয়াজ। সেই ঘোরের মধ্যেও একটা গলা চিনতে পারল সে। নরকে গেলেও সে এই গলা ভুলবে না। লখন। লখন চেঁচিয়ে নির্দেশ দিল। গণপতি বুঝতে পারল তার হাতের শিরায় আবার একটা কিছু ফুঁড়ে দেওয়া হচ্ছে। তার শিরা উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে প্রচণ্ড জ্বলুনি। সারা গা দিয়ে ঘাম হচ্ছে। তারপর আচমকা যেন এক ধাক্কায় সম্পূর্ণ চেতনায় ফিরে এল গণপতি।

একটা খালি ঘর। তাতে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা চেয়ার। ঘরে এক কোনায় টেবিলে একটা লণ্ঠন জ্বলছে। তারই হলুদ আলোতে ঘরের সবাইকে দেখা যাচ্ছে। মাঝের চেয়ারটাতে লখন নিজে বসে। বাকিগুলোতে আরও তিন-চারজন। এদের দুজন স্পষ্টতই সাহেব কিংবা অ্যাংলো। বাকিরা নেটিভ। গণপতি মাথা উঠানোর চেষ্টা করতেই লখন কেটে কেটে বলল, “কোথায় পালিয়েছিলি?”

গণপতির মাথা ঘোরাচ্ছে। তবুও সে একটু অবাক হবার ভান করে বলল,”পালাব কোথায়? পালাইনি তো।”

“পালাসনি? কাল মঞ্চ থেকে ভ্যানিশ হয়ে কোথায় গেছিলি? মল্লিকবাড়ি কাল সারারাত আমার লোক তোকে খুঁজেছে। পায়নি। এমনকি তুই ম্যাজিক শেষে কার্টেন কলেও আসিসনি। কোথায় গেছিলি?”

গণপতি দেখল তার বুদ্ধি একেবারে ঠিকঠাক কাজ করছে।

“পালাব কেন? কাল স্পেশাল শো ছিল। ওই পালিয়ে যাওয়াটাই চমক। কার্টেন কলে সেটা নষ্ট হয়ে যেত।”

“কাল এলি না কেন? এখানে তো কাল আসার কথা ছিল।”

এবার গণপতি যে অভিনয়টা করল, অমৃতলাল উপস্থিত থাকলে তাকে পরের নাটকে নায়কের পার্ট দিতেন। চোখ বড়োবড়ো করে বলল, “গতকাল? আসার কথা তো ছিল আজকে! সেইরকমই তো হ্যান্ডবিলে ছিল।”

“সেইরকম ছিল? কোথায়, দেখি হ্যান্ডবিল?”

“আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। তুমিই তো বলেছিলে প্রমাণ রাখতে নেই।”

লখন একটু দমে গেল।

“তবুও, কী লেখা ছিল মনে আছে?”

“হ্যাঁ। দুই স্তনে তিনবার করিয়া পাঁচদিন মাত্র…”

“হ্যান্ডবিল কবে পেয়েছিলি?”

গণপতি কড় গুণে কীসব যেন হিসেব করে। তারপর জিভ কেটে বলে, “এ হে! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। অঙ্কে আমি বড়ো কাঁচা। একদিন এদিক ওদিক হয়ে গেছে”, হাসার চেষ্টা করল গণপতি। হাসি ফুটল না।

“কাল কোথায় ছিলিস সারারাত?”

“গঙ্গার ঘাটে।”

“কোন ঘাট?”

“আহিরীটোলা।”

“কেন?”

অদ্ভুত বিষন্ন গলায় গণপতি বলল, “কাল মায়ের মৃত্যুদিন ছিল। মাকে পুড়িয়ে অস্থি ওই ঘাটেই ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। তাই মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল……”

লখনের গলা যেন একটু নরম হল, “মা কত বছর হল মারা গেছেন?”

“অনেকদিন। হিসেব নেই।”

“শোন, যে কারণে কালকে তোকে ডাকা হয়েছিল, আগেই বলেছিলাম সংঘের কাজে ডাক পেলেই আসতে হবে। আসবি তো?”

“অবশ্যই। দরকার হলে ম্যাজিক দেখানো ছেড়ে দেব।”

“না না। একেবারেই না। বরং এই ম্যাজিকটাই তোকে দেখিয়ে যেতে হবে। শুনেছি ইদানীং নাকি খুব নামডাক হয়েছে তোর?” গণপতি মৃদুস্বরেজানায়, “সামান্য।”

“তুই নাকি যে-কোনো বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারিস? মঞ্চে আত্মাকে আহ্বান করতে পারিস?”

“তা অল্প পারি বটে।”

বলতে না বলতে লখন চোখ দিয়ে ইশারা করতেই তিন-চারজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল গণপতির উপরে। দুজন পুলিশি হ্যান্ডকাফ দিয়ে তার দুই হাত পিছমোড়া করে বেঁধে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিল মুখ। বাকি দুজন সে কিছু বোঝার আগেই তার পা দুটো মোটা দড়িতে বেঁধে ভরে দিল কাপড়ের বস্তায়। তারপর গোটা দেহ আগাগোড়া বেঁধে ছুড়ে ফেলে দিল ঘরের একদিকে অন্ধকার কোণে। লখন এতক্ষণ কিচ্ছু বলছিল না। শুধু তাকিয়ে দেখছিল। এবার বাকিদের দিকে ফিরে চোস্ত ইংরেজিতে বলল, “এই ঘরটা তালা দিয়ে বাইরে একজন দাঁড়িয়ে থাক। আমি আধঘণ্টা বাদে ফিরব। দেখি,

যতটা শোনা যায়, সেটা সত্যি না মিথ্যে। কে থাকবে পাহারায়?” একজন রাজি হল। লখন তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় গণপতির গলার আওয়াজ ভেসে এল, “কোথায় যাচ্ছ হে লখন? আমাকেও নিয়ে যাও।”

ভূত দেখার মতো চমকে সবাই দেখল কোমরে এক হাত দিয়ে হাসিমুখে গণপতি দাঁড়িয়ে আছে। দড়িদড়া বস্তা সব পায়ের কাছে শীতের ঝরা পাতার মতো পড়ে। অন্য হাতের তর্জনীতে দুলছে তালাখোলা স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসনের আসল পুলিসি হ্যান্ডকাফ। বলা হয় এই হ্যান্ডকাফ থেকে স্বয়ং শয়তানও নাকি মুক্ত হতে পারেন না।

এতক্ষণে লখনের মুখে হাসি ফুটল। “জিও বাচ্চা!” পিণ্ডারী বাবা এই কথাটা প্রায়ই বলত, খুব খুশি হলে।

লখন এবার গণপতির দিকে এগিয়ে দিল একটা চেয়ার। স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “তোকে যে কাজটা দেব, বড়ো কঠিন কাজ। দেবার আগে তাই পরীক্ষা করা দরকার। প্রথম পরীক্ষায় পাশ করেছিস। এবার দ্বিতীয়। তুই নাকি মঞ্চে ভূত নামাতে পারিস? কেমন করে?”

“নামাতে হয় না। আমি নিজেই আসি গণপতির কাছে”, সবাইকে চমকে দিয়ে যেন অশরীরী কেউ কথা বলে ওঠে। ঘরের সবাই তাকায় গণপতির দিকে।

তার ঠোঁটটুকুও কাঁপছে না। শুধু ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সেই অশরীরী কন্ঠ আবার বলল, “বল, কী জানতে চাস?”

হো হো করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল লখন। “ধুসস! এই ভেন্ট্রিলোকুইজম দিয়ে তুই লোক ভোলাস? এসবে চলবে না। সত্যিকারের ভূত নামাতে পারবি?”

“তাও নামিয়েছি। বন্ধ ক্যাবিনেটে।”

“ওসব নেটিভদের সঙ্গে চলে। সাহেবদের কাছে ওইসব জারিজুরি ফাঁস হয়ে যাবে। সত্যিকারের ভূত নামবে মঞ্চে চলে ফিরে বেড়াবে, কিন্তু ধরতে গেলে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। পারবি এমন ভূত নামাতে?”

প্রায় মিনিট পাঁচেক চুপ করে বসে রইল গণপতি। কী যেন ভাবছে, তারপর তার চোখ জ্বলে উঠল, “পারব। তবে খরচা হবে।”

“কীসের খরচা।”

“একটা কাচ লাগবে। বিরাট বড়ো কাচ।” শুনেই লখন নিজেও ভাবতে শুরু করল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান এসে গেল তার মাথায়।

“সাব্বাস”, বলে প্রায় লাফিয়ে উঠল লখন।

“তোর হবে। তোকে দিয়েই হবে। শুধু শেষ পরীক্ষা।”

লখনের আদেশে দ্রুত দুই-তিনজন মিলে গণপতির চোখ আবার বেঁধে দিল। তবে এবার টকটকে লাল একটা কাপড়ে। একজন তার ডান পায়ের কাপড় উঠিয়ে গার্টার দিয়ে বেঁধে দিল হাঁটুর কাছে। অন্যজন তার দুই হাত ডুবিয়ে দিল বরফঠাণ্ডা জলে। গণপতি বুঝতে পারল এবার কী হবে। না চাইলেও নীবারসপ্তক তাকে গ্রাস করতে চলেছে। অন্য সময় হলে সে হয়তো আপত্তি করত। কিন্তু সাইগারসন সাহেব যা বললেন, এর পরে সে মানা করা মানে শেষ সূত্র অবধি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া।

গণপতি কানে শুনতে পেল, লখন বাদে বাকি সবাই মৃদু স্বরে মন্ত্রের মতো কী যেন আওড়াচ্ছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝল একটানা এক লয়ে সবাই বলে চলেছে, “ওরিজেন ওরিজেন ওরিজেন।” জাবুলনদের উপাস্য সাধু। যে-কোনো কাজ শুরুর আগে এই ওরিজেনের নাম নিয়ে কাজ শুরু হয়। যাতে সবাই টের না পায়, তাই সাঁটে Origen-কে উলটে পালটে লেখে ignore। “ইগনোর করিবেন না।” এসব গণপতি জানে। শুধু জানে না এবার ঠিক কী হতে চলেছে।

লখনের গলা ভেসে এল। তবে এবার আর তুই না, তুমি।

“আজ থেকে জাবুলনদের এই ভ্রাতৃসংঘ তোমাকে আপন করে নেবে। আমাদের ঈশ্বর জাবুলনের JAH মানে স্বর্গ, আমাদের অভীষ্ট অক্ষর G। এই G থেকেই সব। Geometry, God, Grand Architect of Universe, Grand Master। হিব্রু বর্ণমালা অনুযায়ী আমাদের স্বর্গীয় সংখ্যা তাই ১০+১+৫, অর্থাৎ ১৬। আর ১ ও ৬ থেকে পাই ৭। বুঝতে পারলে হ্যাঁ বলো।”

“হ্যাঁ”, গণপতি মাথা নাড়ল।

“আজ থেকে আমি তোমার মাস্টার। তুমি সেটাই করবে আমি যা আদেশ করব। রাজি?”

“রাজি।”

“বলো হ্যাঁ, রাজি মাস্টার।”

“হ্যাঁ, রাজি মাস্টার।”

“তোমার পণ কী?”

“আমার জীবন।”

“তুমি কী দেবে?”

“ভক্তি।”

“যদি তাই হয় আমার কথা শোনো। আমার কাছে এসো। প্রতিবার এক পা, এক পা করে।” গণপতি এক পা এগোল।

“এসো।”

পা বাড়াতেই গণপতির দুই চোখে তীব্র চাপ অনুভূত হল। শক্ত লোহার সরু কিছু ঠিক চোখের পাতার উপরেই ধরা। এক পা কেন, আর এক চুল নড়লেই চোখে বিঁধে যাবে সেই শলাকা। এইসবই কি তবে তাকে ফাঁদে ফেলার উপায়? সাহেবের কথা শুনে সে ভুল করেছে। হয়তো এরা সব জানে। শৈলর মতো আগামী কাল তার দেহও পড়ে থাকবে সোনাগাজির কোনও এক আস্তাকুঁড়ে।

“এসো”, লখনের গলার স্বর আরও কঠিন হল। গণপতি জানে ফেরার উপায় নেই। যা থাকে কপালে ভেবে পা এগিয়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের উপরের চাপ উধাও হল। চোখ থেকে কাপড় খুলে ফেলা হল। লখন তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

“ব্রাদারহুডে স্বাগত”, হাসিমুখে বলল লখন।

বাকিরা আবার মৃদুস্বরে ওরিজেনের নাম জপ করছে।

এরপর সবাই একে একে বেরিয়ে গেল। ঘরে লখন আর গণপতি। আর কেউ নেই। লখন বলল, “আমরা ব্রাদারহুডের সবাই মিলে এক চরম পরীক্ষার সামনে এসেছি। এত বছর ধরে মুক্তির যে প্রচেষ্টা আমরা চালাচ্ছিলাম, অবশেষে তার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি সবাই। এখানেই তোমার সাহায্য লাগবে।”

“কিন্তু কীভাবে?”

“সব বুঝিয়ে বলব। একটু অপেক্ষা করো।”

লখন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গণপতি বসে রইল। বুঝতে পারছে, আজ থেকে সে-ও ষড়যন্ত্রের অংশীদার। খানিক বাদেই লখন ঢুকল। তবে একা না। লখনের সঙ্গে যে ঢুকল তাকে গণপতি চেনে। লখন তাকে পরিচয় দিয়েছিল নিজের দিদি বলে। লাল চুল, গোলাপি ত্বকের সেই মেয়েটা আজ ইউরোপীয় গাউন পরায় তাকে একেবারে অন্যরকম লাগছে।

ময়নার হাতে অদ্ভুত একটা বাক্স। সিসের লাইনিং দেওয়া। লখন বাক্সটা ময়নার থেকে নিয়ে গণপতির হাতে দিল।

“কী আছে এতে?”

“নিজেই খুলে দ্যাখো, তুমি তো বড়ো ম্যাজিশিয়ান।”

নানাভাবে চেষ্টা করল গণপতি। বাক্সে কোনও তালাচাবি নেই। এমন বাক্স ম্যাজিকের দুনিয়ায় অনেক আছে। গণপতির কোনোটা খুলতেই এক মিনিটের বেশি লাগে না। এদিকে দশ মিনিট হয়ে গেল। ঘেমেনেয়ে গেল গণপতি। কিন্তু এই অদ্ভুত বাক্সটা কিছুতেই খুলতে পারল না।

“পারছি না। অসম্ভব। এমন বাক্স আগে কোনও দিন দেখিনি।”

“আমাকে দাও”, হেসে হাত বাড়াল লখন, “এই বাক্সে ভূত আছে। তোমায় দেখাচ্ছি কীভাবে এই ভূতকে পুষতে হবে।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *